ডীপ ফ্রিজ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: ২০০২
০১.
ভয়ানক ঠাণ্ডা! কিশোর বলল।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল প্যাসেঞ্জার। সীটে বসা রবিন, আর বেশি নেই। এসে গেছি।
এত ঠাণ্ডা নিশ্চয় সাইবেরিয়াতেও নেই! গাড়ি চালাতে চালাতে মুসা বলল। শার্লিরা থাকে। কি করে।
শুধু শার্লিরা না, হেসে বলল রবিন। আরও বহু লোক বাস করে এ অঞ্চলে। তারা থাকে কি করে?
থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে আরকি, মন্তব্য করল পেছনের সীটে বসা কিশোর। আমরা গরম অঞ্চল থেকে এসেছি বলে ঠাণ্ডাটা অনেক বেশি লাগছে।
নিউ ইয়র্কে বেড়াতে এসেছে ওরা। নিউ ইয়র্কের নিউ পোর্টে। রবিনের খালার বাড়িতে। এসে দেখে তিনি নেই। জরুরী কাজে চলে গেছেন। ঘরে একটা নোট রেখে গেছেন। তাতে লেখা: জরুরী কাজে বেরোতেই হলো। দিন সাতেকের মধ্যেই ফিরছি। ঘরে খাবারটাবার সব আছে। আশা করি তোমাদের কোন অসুবিধে হবে না।-আন মারগারেট।
সেটা গত কালকের কথা। আজ চলেছে ওরা পাইনভিউ লেকে। আরেক আন্টির বাড়িতে। বেলী আন্টি। তার মেয়ে শার্লি। আজকে ওর জন্মদিন। নিউ পোর্ট থেকে ফোন করেছিল রবিন। ওদের আসার খবর পেয়ে একটা সেকেন্ডও আর দেরি করেনি শার্লি। নিউ পোর্টে চলে গিয়েছিল রবিনদের সঙ্গে দেখা করতে। দাওয়াতটা তখনই দিয়ে এসেছে।
লোকের দিকে মুখ করা একটা বড়, চমৎকার বাড়িতে থাকে শার্লিরা। আগেও এখানে এসেছে রবিন। তবে কিশোর আর মুসা এই প্রথম।
পাইন বনের ভেতর দিয়ে গেছে রাস্তা। লেক ঘিরে আংটির মত একটা পাক খেয়ে এগিয়ে গেছে। বছরের এ সময়টায় বাইরের কেউই রাস্তাটা ব্যবহার করে না তেমন, কেবল স্থানীয় অধিবাসী আর আইস ফিশারম্যানরা ছাড়া।
জানুয়ারির শেষ দিকেই জমাট বরফ হয়ে যায় লেকের ওপরের পানি। আর এখন মধ্য-ফেব্রুয়ারিতে সেটা এতই পুরু, ট্রাক নিয়ে উঠে পড়ে আইস ফিশারম্যানরা। গাড়ি চালিয়ে চলে যায় নিজেদের ফিশিং শ্যান্টির কাছে। এই জমাট বরফে স্কেইটিংও খুব ভাল জমে।
তুষারে ঢাকা পিচ্ছিল রাস্তায় শেষ মোড়টা নিতেই সামনের বরফে ঢাকা লেকটা চোখে পড়ল ওদের।
উফ, কি দারুণ সুন্দর। চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। মুগ্ধ দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। একেবারে ছবির মত! ডীপ ফ্রিজ
লেকের একধারে অনেকগুলো ফিশিং শ্যান্টি। এক জায়গায় এ রকম শ্যান্টির জটলাকে স্থানীয় মাছ শিকারীরা বলে শ্যান্টি টাউন। আরেক ধারে আইস-হকি খেলতে নেমেছে ছেলের দল।
দেব নাকি বরফের ওপর দিয়েই চালিয়ে? জ্বলজ্বলে চোখে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।
দাও, লেকের ওপর দিয়ে যাওয়ার আনন্দটা কিশোরও মিস করতে রাজি নয়।
.
পার হয়ে এল নিরাপদেই।
শার্লিদের ড্রাইভওয়েতে ঢুকল গাড়ি।
ওই দেখো! কি বানিয়েছে। বলে উঠল কিশোর।
একটা স্লেম্যানের গায়ে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে শার্লি আর তার বাবা-মা। কাউচে বসা লাইফ-সাইজ ভাস্কর্য। টেলিভিশন দেখছে সোম্যান। সব কিছুই বরফ দিয়ে। বানানো হয়েছে।
খাইছে। দারুণ তো। মুসা বলল।
মরগান আঙ্কেল খুব ভাল ভাস্কর, রবিন জানাল।
হুঁ, মাথা ঝাঁকাল মুসা। ভাল যে সেটা তো সৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর।
ড্রাইভওয়ের শেষ মাথায় গাড়ি রাখল মুসা। দরজা খুলে নামল।
দৌড়ে এল শার্লি। এলে। আমি তো তোমাদের দেরি দেখে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কাল রাতে যা তুষার পড়েছে! ভাবছিলাম, রাস্তার এত তুষার মাড়িয়ে হয়তো আর আসতেই পারলে না।
শার্লির গায়ে লাল পার্কা। কান ঢাকা সাদা মাফলারে। শীতের এই সাদা ওয়ান্ডারল্যান্ডে অপূর্ব সুন্দর লাগছে ওকে।
একে একে নামল কিশোর আর রবিন। শার্লিকে হ্যাপি বার্থডে উইশ করল ওরা। হাত-পা ছড়িয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে লাগল। গা গরম করার জন্যে কয়েক রাউন্ড স্নো-বল ছোঁড়াছুড়ি খেলল। তারপর দল বেধে এগিয়ে গেল শালির বাবা-মার সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
এসো, মিসেস মরগান বললেন। শার্লি তো তোমাদের জন্যে অস্থির হয়ে গিয়েছিল।
কি করব। যা বরফ, জবাব দিল কিশোর।
হ্যাঁ, আসতে যে পারলে সেটাই বেশি।
পুরো সকালটাই নিশ্চয় এর পেছনে কাটিয়েছেন, স্লেম্যানের ভাস্কর্যটা দেখিয়ে বলল কিশোর।
হ্যাঁ, জবাব দিলেন বেলী আন্টি।
কাল রাত থেকে বানানো শুরু করেছি, যোগ করলেন মরগান আঙ্কেল।
কিশোর, আমার মা আর বাবা, শার্লি বলল।
হাসল কিশোর। সে তো বুঝেইছি।
মিস্টার জিম মরগান বেশ ভারিক্কি চেহারার মানুষ। ধূসর হয়ে এসেছে খাটো করে ছাঁটা চুলের রঙ। মিসেস বেলীল মরগান হাসিখুশি, আন্তরিক। হাসি লেগেই আছে মুখে।
কিশোরের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন মরগান আঙ্কেল। আমিও তোমাদের অপেক্ষাই করছি। জরুরী কথা আছে।
বাবা, প্লীজ, শার্লি বলল। মাত্র তো এল ওরা। আগে কিছু মুখে দিক। লাঞ্চটা শেষ হোক।
লাঞ্চ তো আর চলে যাচ্ছে না।
আসামাত্র বেচারা ছেলেগুলোকে নিয়ে পড়লে কেন? বাধা দিতে এগিয়ে এলেন বেলী আন্টি। ওরা এখানে আনন্দ করতে এসেছে। তোমার জরুরী কথা শুনতে নয়।
আমি শুধু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, এখানকার চুরি-ডাকাতিগুলোর খবর ওদের কানে গেছে কিনা, মরগান আঙ্কেল বললেন।
সজাগ হয়ে উঠল কিশোর। তাড়াতাড়ি বলল, না না, আন্টি, আমরা বিরক্ত হচ্ছি না। শোনার বরং আগ্রহই হচ্ছে।
কেউ জমায় স্ট্যাম্প, কেউ অন্য কিছু রবিন বলল, আমাদের হবি অপরাধের কিনারা করা।
সাবধানী চোখে ওদের দিকে তাকালেন বেলী আন্টি। সবগুলো পাগল।
মরগান আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কতদিন ধরে হচ্ছে এ সব?
হচ্ছে তো কয়েক বছর ধরেই। শীতকালে। শীতের ভয়ে লোকে পালায়। লেকের চারপাশের ওসব নির্জন বাড়িতে তখন চোর ঢোকে। জিনিসপত্র চুরি করে। নিয়ে যায়, মরগান আঙ্কেল জানালেন। পুলিশ কিছু করতে পারছে না। বড় দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। বাড়ি খালি রেখে আমরাও তো শহরে-টহরে যাই। তোমরা আসাতে ভালই হলো। শার্লি এসে কাল যখন বলল তোমরা এসেছ, ভাবলাম, যাক, এবার বোহয় এ সমস্যাটার একটা সমাধান হবে। শুনেছি তো, এমন এমন অনেক কেসের। কিনারা করেছ তোমরা, পুলিশও যার থই খুঁজে পায়নি। আর সে-বছর রবিনও এসে একটা জটিল কেসের কিনারা করে রেখে গেছে। তারপর থেকেই ভক্তি এসে গেছে। তোমাদের ওপর। একটা বাচ্চাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। দিব্যি খোঁজ-খবর করে কিডন্যাপারদের পাকড়াও করে ফেলল রনি। বাচ্চাটাকে উদ্ধার করল। তাই বলছিলাম, যদি চুরির কেসটারও কিছু করতে পারতে…
জিম, বাধা দিলেন বেলী আন্টি, এখানকার কাজটা তুমি শেষ করো। আমি বারগার বানাতে গেলাম।
ছেলেদের দিকে তাকালেন মরগান। তোমরা আনন্দ ফুর্তি করো। আমি যাই।
আচ্ছা, কিশোর বলল।
স্লোম্যানটার গায়ে ফিনিশিং টাচ দিতে লাগলেন মরগান আঙ্কেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিক দেখল তিন গোয়েন্দা। তার কাজের প্রশংসা না করে পারল না।
শার্লি বলল, লেকে যাবে নাকি? বাবা বলল, বরফের অবস্থা খুব ভাল। স্কেইটিং জমবে।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে বাড়ির পেছন দিক ঘুরে লেকের পাড়ে এসে দাঁড়াল সে।
সত্যি, এত সুন্দর জায়গা! লেকটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুসা বলল। পিকনিকের জন্যে এর তুলনা হয় না।
নির্বিঘ্নে চুরি-ডাকাতির জন্যেও তুলনাহীন, কিশোর বলল।
চোর-ডাকাতের কথা এখানে ভাল লাগছে না। দৃশ্যটার সঙ্গে বেমানান।
স্বর্গেও সাপ থাকে, গম্ভীর স্বরে জবাব দিল কিশোর। বাড়িঘরগুলোর অবস্থান দেখো। দেখলেই বুঝবে জায়গাটা কেন চোর-ডাকাতের স্বর্গ হয়েছে।
বেশির ভাগ বাড়িই বড় বড়। দুতিনতলা উঁচু। প্রতিটি বাড়ির চারপাশে প্রচুর খালি জায়গা। একজন মানুষকেও দেখা গেল না কোনখানে।
ডোবারকে ফোন করব কিনা ভাবছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে রবিন বলল। চুরিগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করা যাবে। ডোবার কগনান নিউ পোর্ট থানার অফিসার। কিডন্যাপ করা বাচ্চাটাকে উদ্ধারের সময় আমাকে অনেক হেল্প করেছিল। খুব ভাল অফিসার।…থাকগে, পরেই করব। চলো, শরীরটাকে গরম করে আসি। স্পীড স্কেইট নিয়ে এলে ভাল হত, লেকের ওপর জমে থাকা শক্ত, সমতল, মসৃণ বরফের দিকে তাকিয়ে আফসোস করল সে।
আনলেও কোন লাভ হত না, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল মুসা। আমার সঙ্গে পারতে না। সাধারণ স্কেইট দিয়েই তোমাকে হারানোর ক্ষমতা রাখি আমি।
তাই নাকি? এসো, সাধারণ স্কেইট দিয়েই হয়ে যাক প্রতিযোগিতাটা।
চলো।
কিশোর এ সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে গেল না। তবে গাড়ি থেকে অন্য দুজনের সঙ্গে সে-ও তার স্কেইট বের করে নিয়ে চলে এল লেকের কিনাবে। পরে নিল দ্রুত।
শার্লি বলল, তোমরা যাও। আমি বরং মাকে সাহায্য করিগে।
ঘুরে বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল সে।
কোনখান থেকে ছোটা শুরু করবে ভাবছে কিশোর, এমন সময় হই-চই কানে এল।
ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা।
লেকের একধারে জটলা করছে হকি খেলোয়াড় ছেলেগুলো। ওদের মুখোমুখি হয়েছে কয়েকজন বয়স্ক লোক। ঝগড়া করছে মনে হলো। তুমুল উত্তেজনা। কিশোর বলল, হকি খেলছে, না চোর ধরা পড়েছে?
চোর না, চোর না! পেছন থেকে বলে উঠল শার্লি। হট্টগোল শুনে কি হয়েছে দেখার জন্যে ফিরে এসেছে। তোমার মাথায় এখন চোর ছাড়া আর কিছু নেই মনে হচ্ছে। বারার মত!
আঙ্কেলকেও নিশ্চয় দোষ দেয়া যায় না, রবিন বলল। বছর বছর চুরি হচ্ছে। পুলিশ কিছু করতে পারছে না। এখানে বাস করছেন। চিন্তায় তো তিনি পড়বেনই।
তা ঠিক, একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
হট্টগোলের দিকে নজর দিল রবিন। ওর চেয়ে দুএক বছরের বড় একটা ছেলেকে দেখিয়ে আনমনেই বলে উঠল, পিটার হিগিনস না?
আচমকা হকি স্টিক তুলে একজন লোককে বাড়ি মারতে গেল ছেলেটা।
ওকে একদম সইতে পারে না বাবা, শার্লি বলল। এক্কেবারে বুনো। মারামারির জন্যে গত বছর আমাদের স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ওকে।
তবে ফুটবলটা ভালই খেলে, দেখে গিয়েছিলাম, রবিন বলল।
তা খেলে, শালি বলল। তবে ফাউল করে করে অনেকের পায়েই ব্যান্ডেজও আঁধায়। বাবার ধারণা, পিটার আর ওর বন্ধুরাই চুরিগুলো করে।
হঠাৎ লোকের কিনার থেকে ভেসে এল গলা ফাটানো চিৎকার। অ্যাই, ভাগো এখান থেকে। কোন কথা নেই। খেলা বন্ধ, ব্যস!
পিটার আর তার সঙ্গী খেলোয়াড়দের দিকে এগিয়ে আসছে আরও কিছু লোক। শার্লি জানাল, ওরা শিকারী। কারও কারও হাতে আইস বার। ইস্পাতের ভারী ওই শিকগুলোর সাহায্যে বরফ খোঁচায় ওরা। বরফে মাছ ধরার গর্তগুলোকে বুজে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। তবে এ মুহূর্তে পিটানোর জন্যেই নিয়ে এসেছে ওই শিক।
চলো! বলে শার্লি বাধা দেবার আগেই বরফের ওপর দিকে স্কেইটিং করে ছুটল কিশোর।
পিছু নিল তার দুই সহকারী।
ওরা যখন কাছে গেল, তুমুল ঝগড়া বেধে গেছে ততক্ষণে দুটো দলের মধ্যে। বুড়ো একজন লোকের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল পিটার, আমরা খেলবই। আপনি বাধা দেয়ার কে?
বুড়োর সব চুল সাদা। গায়ে লম্বা ঝুলওয়ালা উলের কোই।
নিচু স্বরে কিশোর আর মুসাকে জানাল রবিন, বুড়োর নাম জিথার জ্যাকসন। শীতকালে সব সময় ওই একটা কোটই পরে থাকে। টাকা-পয়সার যে অভাব তা নয়। অতিরিক্ত কিপটে। জ্যাকসনস বেইট শপ দোকানটার মালিক। এই লেকের পাড়ের একমাত্র দোকান। লোকে বলে ওর জন্মের পর থেকেই চালাচ্ছে।
দেখো না খেলে আবার। সমান তেজে চেঁচিয়ে পিটারের কথার জবাব দিল। বুড়ো।
খেলবই তো। কি করবেন?
বললাম না, খেলেই দেখো।
কঠোর আরেকটা জবাব দিতে যাচ্ছিল পিটার, চোখ পড়ল রবিনের দিকে। আরি রবিন; কখন এলে?
এই তো। একটু আগে, রবিন বলল। কি হয়েছে?
আরে দেখো না, হকি খেলতে বাধা দিচ্ছে। সব মাছ নাকি তাড়িয়ে দিচ্ছি আমবা। নিজেরা পারে না ধরতে, দোষটা এখন আমাদের।
হাই, রবিন। হাত নেড়ে ডাকতে দেখা গেল আরেকজন লোককে। মাথায় লাল ক্যাগ। লম্বা, ছিপছিপে দেহ। এত উঁচু, সবার মাথার ওপর দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে।
হাই! হাত নাড়ল রবিন।
আজই এলে নাকি?
হুঁ।
হাতের ইশারা করল লোকটা, এসো এদিকে।
মেরিন ডগলাস, লোকটার দিকে এগোনোর সময় দুই বন্ধুকে জানাল রবিন। খুব ভাল মোটর মেকানিক।
রবিন কাছে যেতে দস্তানা পরা একটা হাত বাড়িয়ে দিল ডগলাস। কেমন আছ? কিশোর আর মুসার দিকে চোখ পড়তে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, বন্ধু। নাকি?
হ্যাঁ, হাতটা ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে জবাব দিল রবিন। ও কিশোর।…আর ও মুসা।…ডগলাস, এত গোলমাল কিসের?
শুনলেই তো পিটারের কাছে। কিশোরের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে জবাব দিল ডগলাস। তারপর হাত বাড়াল মুসার দিকে। ওরা তো বলে হকি খেলে। কিন্তু যে কাণ্ডটা করে তাকে হকি খেলা বলে না। বরফের ওপর দিয়ে পাগলের মত ছুটতে থাকে। কোনদিন যে বিপদ ঘটাবে। হয় কারও শ্যান্টি ভাঙবে, নয়তো নিজেরাই বরফ ভেঙে পানিতে পড়ে মরবে।
শয়তানি করলে তো বিপদ হবেই। আপনারা বাধা দিচ্ছেন কেন? মাছ তাড়ায় বলে?
উঁহু। ভয়টা অন্যখানে। কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ কাউকেই নামতে দেবে না আর লেকে। মাছ ধরাটা তখন যাবে আমাদের।
সবচেয়ে বেশি রাগ তো দেখা যাচ্ছে জ্যাকসনের, কিশোর বলল। ফেটে পড়ছে। এ রকম করছে কেন?
করবে না? এখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলে ওর ব্যবসা খতম। দোকানে লাল বাতি জ্বলবে যে। খেপাটা স্বাভাবিক।
পিটার কি করছে দেখার জন্যে ফিরে তাকাল রবিন। জ্যাকসনের সঙ্গে ঝগড়া। তুঙ্গে উঠেছে পিটারের। হকি স্টিক তুলে বাড়ি মারতে গেল বুড়োকে। তাকে সাহায্য করতে এগোল তার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডট আর কারনি। বয়েসে পিটারের দুতিন বছরের বড় হবে ওরা। গণ্ডগোল করার কারণে ওদেরকেও স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
জ্যাকসনও কম যায় না। কোমরের টুল বেল্টে ঝোলানো ছোট একটা কুড়াল একটানে খুলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আমাকে বাড়ি মারবি? আয় তো দেখি কত্তবড় সাহস!
বাধা দিতে এগিয়ে গেল রবিন।
তার কথা কানেও তুলল না কেউ।
চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল কারনি। বেঁকিয়ে উঠল, নিজের চরকায় তেল দাওগে।
তবে খুনখারাবির মধ্যে কাউকেই যেতে দিল না জনতা।
পিটারদেরকে হকি স্টিক নামাতে বাধ্য করল। জ্যাকসনও আবার কুড়ালটা কোমরে ঝোলাল। কিন্তু কথার লড়াই বন্ধ করল না দুপক্ষের কেউই।
তীব্র স্বরে জ্যাকসন বলল পিটারকে, ভেবেছিস, চুরি-ডাকাতি করে এত সহজেই পার পেয়ে যাবি? আমি সব জানি!
কি জানো তুমি, বুড়ো ভাম কোথাকার! ঝাজিয়ে উঠল পিটার। মিথ্যে কথা বললে দেব এক বাড়িতে মাথাটাকে দুফাঁক করে।
আবার হকি স্টিক তুলল সে।
আবার কুড়ালে হাত দিতে গেল জ্যাকসন।
তবে দ্বিতীয়বারের মত আবার সামলে নিল নিজেদের।
পুলিশের সাইরেন কানে এল।
.
০২.
তিনটে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল লেকের কিনারে।
হুড়মুড় করে কয়েকজন পুলিশ অফিসার নেমে দৌড় দিল বরফের ওপর দিয়ে।
বরফে আটকানোর কাঁটা বসানো নেই ওদের বুটের নিচে। কাজেই প্রথম লোকটাই লেকে নেমে আছাড় খেল।
হেসে ফেলল মুসা।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে লোকটা আবার উঠে দাঁড়াতেই রবিন বলল, ডোবার কগনান।
কাছে এসে জনতার দিকে তাকিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল সে, একটা ফোন পেলাম, এখানে নাকি গণ্ডগোল হচ্ছে?
নিজের দলের কাছে ফিরে গেছে পিটার। চিৎকার করে বলল, জ্যাকসন নিজেকে এই লেকের মালিক দাবি করছে।
অ্যাই, পাজি ছোঁড়া, মিথ্যে কথা বলবি না! চেঁচিয়ে উঠল জ্যাকসনও। চোরের মার বড় গলা।
শুরু হলো জনতার গুঞ্জন। সবাই একসঙ্গে কথা শুরু করল। কিছু বোঝার উপায় নেই।
চিৎকার করে উঠল ডোবার, আহ, একজন একজন করে বলুন না!
স্কেইট করে তার পাশে এসে দাঁড়াল রবিন।
অবাক হয়ে গেল ডোবার। আরি, তুমি এলে কখন? এরা কারা?
এই তো, খানিক আগে। কিশোর আর মুসার পরিচয় দিল রবিন।
কিশোরের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল অফিসার। আমি ডোবার কগনান। তোমাদের কথা অনেক শুনেছি রবিনের মুখে।
আপনার কথাও শুনেছি আমরা, হাত মেলাতে মেলাতে বলল কিশোর।
এদিকে এসো। কথা বলি। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ভিড়ের কাছ থেকে সরে গেল ডোবার। তার সঙ্গের অফিসাররা গিয়ে জনতাকে পাহারা দিতে লাগল, যাতে ঝগড়া করতে না পারে।
গত তিন সপ্তাহে এই নিয়ে বারো বার আসতে হয়েছে আমাকে এখানে, ডোবার জানাল। এখন আমি চীফের অপেক্ষা করছি। এগারো বারের বার তিনি। আমাকে বলেছিলেন আবার এ রকম কিছু ঘটলে তিনি নিজে আসবেন তদন্ত করতে।
জ্যাকসনের দোকানের দিক থেকে লেকে নেমে আসতে দেখা গেল দুজন। যুবককে। জনতার ভিড়ের দিকে এগোল ওরা। বয়েস তেইশ-চব্বিশ। একজনের মাথায় সোনালি চুল, ছয় ফুট উঁচু। আরেকজনের কালো চুল, উচ্চতায় প্রথমজনের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি খাটো।
ওই যে, জ্যাকসনের দুই নাতি, ডোবার বলল। বড়টার নাম জ্যাকি। আর ছোটটা রকি। বাবা-মা থাকে ম্যারিল্যান্ডে। ওরাও ওখানেই থাকে। বছরে কয়েকবার করে আসে দাদার দোকানদারিতে সাহায্য করতে। ওদেরকে খারাপ লাগে না আমার।
পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইউরি রিকম্যানও এসে পৌঁছলেন। বরফের ওপর দিয়ে পা পিছলাতে পিছলাতে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল ডোবার। ক্যাপ্টেনও নেমে এগিয়ে আসতে লাগলেন। মাঝপথে মিলিত হলেন দুজনে। কিছু কথা হলো। তারপর একসঙ্গে জনতার দিকে এগোলেন।
অনেকেই আছেন দেখছি, ক্যাপ্টেন বললেন। ভালই হলো। আমি আপনাদের ঝগড়া থামাতে আসিনি। সেটা পার্ক কমিশনারের দায়িত্ব। আমি এসেছি জনসনদের বাড়ির ডাকাতির তদন্ত করতে। কেউ কোন তথ্য দিতে পারবেন আমাকে?
জনতার দিকে তাকিয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। কে কি বলে শুনতে আগ্রহী।
পারব, জবাব দিল জ্যাকসন।
অকারণে এর মধ্যে জড়াচ্ছ কেন, দাদা? চুপ করানোর চেষ্টা করল জ্যাকি।
কি চুপ করতে দিলেন না ক্যাপ্টেন। কি জানেন, বলুন?
বাড়িটার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছি পিটার হিগিনসকে, জ্যাকসন জানাল।.
ফেটে পড়ল পিটার। দেখো বুড়ো, সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে। পস্তাতে হবে এর জন্যে। হকিস্টিক তুলে শাসাতে লাগল সে। মুখ টকটকে লাল।
দেখলেন, দেখলেন, আপনার সামনেই কেমন করছে? জ্যাকসন বলল। ওকে ছেড়ে রাখলে মানুষ খুন করবে একটু আগে আমাকেই খুন করতে চেয়েছিল…
তুমি থামো, পিটার, ক্যাপ্টেন বললেন। আমি দেখছি।
পিটারের কাছে সরে গেল রবিন।
আপনি জানেন না, ক্যাপ্টেন, চেঁচিয়ে উঠল পিটার, বুড়োটা অনেক দিন থেকেই আমাকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করছে। বাবাকে তো শেষই করে দিয়েছে। ওর মিথ্যে কথা আপনি বিশ্বাস করবেন না।
শুনি তো আগে, জ্যাকসনের দিকে ঘুরলেন ক্যাপ্টেন। পিটারকে ওখানে কখন ঘুরঘুর করতে দেখেছেন?
কাল সন্ধ্যায় দেখেছি। আজ সকালে দেখেছি। সারা সপ্তাহ ধরেই দেখছি, জ্যাকসন জানাল। দিনে, রাতে, সব সময়। শুধু ওই বাড়িটাই নয়, আরও অনেক বাড়ির সামনে ওকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি।
তাহলে আমার সঙ্গে থানায় চলুন একবার, প্লীজ। লিখিত বক্তব্য পেলে ভাল হয়।
যাচ্ছি। এগুলো জেলে ভরতে না পারলে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না কেউ।
ঘুম তোমার এমনিতেই হয় না, বুড়ো ভাম! রাগে গজগজ করতে লাগল পিটার। শুধু শুধু চোরের দোষ দিও না।
চোরতাকে এখনও অ্যারেস্ট করছেন না কেন? ঝাঁজিয়ে উঠল জ্যাকসন।
অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন ক্যাপ্টেন। এ ভাবে কাউকে অ্যারেস্ট করা যায় না, মিস্তার জ্যাকসন। থানায় চলুন। আপনার বক্তব্য শুনি। পিটারকেও আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। ওর কি বলার আছে সেটাও শুনি। সে যে চোর, প্রমান পেলে তখন অ্যারেস্ট করা যাবে।
এতগুলো লোক যে ওকে বাড়িগুলোর সামনে ঘুরঘুর করতে দেখল, সেটা প্রমাণ না?
না। আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন, মিস্টার জ্যাকসন। চোর হলে ও বাঁচতে পারবে না। আর মিথ্যে বললে আপনাকেও ভুগতে হবে। সহকারী অফিসারদের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। ওকে নিয়ে চলো।
পিটারের দিকে এগিয়ে গেল কয়েকজন অফিসার।
আচমকা এক কাণ্ড করল পিটার। রবিনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, রবিন, এখনও তুমি চুপ করে আছ! কিছু করছ না! আমি যে চোর নই, তুমি তো জানো?
অ্যারেস্ট তো করেনি তোমাকে, প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রবিন। শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করতে নিয়ে যাচ্ছে থানায়।
পিটারের হাত ধরে টান দিল একজন অফিসার।
রবিন, মরিয়া হয়ে বলল পিটার, রবিন, তোমাকে কি আমি সাহায্য করিনি? কিডন্যাপ হওয়া সেই ছেলেটাকে খুঁজতে গিয়ে তুমি যখন বিপদে পড়লে…
মনে আছে আমার, পিটার, শান্তকঠে বলল রবিন। চুপচাপ চলে যাও এখন ওদের সঙ্গে কোন গোলমাল বাধিয়ো না। সত্যি যদি অপরাধী না হও, তোমাকে বের করে আনার ব্যবস্থা আমরা করব।
পিটারকে গাড়ির দিকে নিয়ে চলল পুলিশ।
জ্যাকসন, আপনিও আসুন, ক্যাপ্টেন বললেন দোকান বন্ধ করে আসতে সময় লাগবে?
না। যাচ্ছি, চলুন। দোকান আমার নাতিরাই সামলাতে পারবে।
ক্যাপ্টেনের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করল জ্যাকসন।
বুডোর দুই নাতির দিকে ঘুরল রবিন। হাত বাড়িয়ে দিল। আমি রবিন মিলফোর্ড। ডোবারের মুখে আপনাদের নাম জেনেছি। জ্যাকি আর রকি।
মুখটা গোমড়া করে রাখল জ্যাকি। রবিনের হাতটা আলতো করে ছুঁয়েই ছেড়ে দিল।
কিন্তু রকি তা করল না। রবিনের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, আমি রকি জ্যাকসন। ও আমার বড় ভাই জাকি জ্যাকসন।
কিশোর আর মুসাকে দেখিয়ে রবিন বলল, এরা আম বন্ধু। কিশোর পাশা। ও মুসা আমান। আপনাদের মতই আমরাও বাইরের লোক। লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বীচ থেকে এসেছি।
অ, তাই নাকি?
কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করছ। ধমকে উঠল জ্যাকি। এসো জলদি!
ভাইয়ের আচরণে বিব্রত বোধ করল রফি। হাসিটা ধরে রাখল কোনমতে। কিছু মনে কোরো না। সবার সঙ্গেই এমন ব্যবহার করে ও। আমি যাই। দোকান সামলাতে হবে। পরে কথা বলব।
ভাইয়ের পিছু পিছু রওনা হয়ে গেল ও।
আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন কারণ নেই। যার যার পথে চলে যেতে লাগল সবাই। নেতাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। খেলাটেলা আর জমবে না বুঝতে পেরে পিটারের দুই দোস্ত ডট আর কারনিও আর দাঁড়াল না। আচমকা স্কেইটিং করে ছুটতে শুরু করল। তাকিয়ে আছে কিশোর। মুহূর্তে জ্যাকসনের নাতিদের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে রকিকে বরফের ওপর ফেলে দিল কারনি। ভান করল, যেন না দেখে করেছে। ডটের হকি স্টিকের মাথাটাও বেশ জোরেই লাগল জ্যাকির পিঠে।
কিশোরের কানে এল ডটের ব্যঙ্গভরা কন্ঠ, বরফের মধ্যে দেখে চলাফেরা কোরো।
হাসতে হাসতে চলে গেল পিটারের দুই দোস্ত।
ছেলে দুটোর আচরণ ভাল লাগল না তিন গোয়েন্দার।
এখানে আর করার কিছু নেই ওদেরও।
শার্লিদের বাড়িতে ফিরে চলল।
.
০৩.
দরজার কাছেই দেখা হয়ে গেল মরগান আঙ্কেলের সঙ্গে।
পুলিশকে আমিই ফোন করেছিলাম, জানালেন তিনি।
ভাল করেছেন, জবাব দিল কিশোর। নইলে খুনোখুনি হয়ে যেত।
আমিও বুঝতে পারছিলাম। যে ভাবে মারমুখো হয়ে উঠেছিল বুড়ো জ্যাকসন দূর থেকে দেখেও বেশ কেঝা যাচ্ছিলযাকগে। কেসটা হাতে নিয়েছ নাবি তোমরা?
তেমন করে হাতে এখনও নিইনি। তবে খেয়েদেয়ে জনসনের বাড়িটা একবার ঘুরে আসব। দেখি কোন সূত্র পাওয়া যায় কিনা। আন্টি, খিদে পেয়েছে। খাবার দিন।
খেতে বসে বার বার পার্টির কথা তুলে কিশোরকে নিরস্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন বেলী আন্টি। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারলেন না। মরগা আঙ্কেল আরও উসকে দিতে লাগলেন কিশোরের কৌতূহলটাকে। অতএব নাকেমুখে খাবারগুলো প্রায় খুঁজে দিয়ে দুই সহকারীকে নিয়ে উঠে পড়ল কিশোর। জনসনদের বাড়ি রওনা হলো।
জনসনদের বাড়িটা অনেক বড়। লেকের দিকে মুখ করা। কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে দেখা গেল সূত্র খুঁজতে। ডোবার কগনানকেও পাওয়া গেল ওখানেই।
কিছু পেলেন? জানতে চাইল কিশোর।
নাহ, মাথা নাড়ল ডোবার। জ্যাকসনের কথার ওপরই কেবল ভরসা। তবে হিগিনসদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল নয় তার। মিথ্যেও বলে থাকতে পারে।
সম্পর্কটা খারাপ হলো কেন? কৌতূহলী হলো কিশোর।
এক সময় পিটারের বাবা মিস্টার হিগিনস আর জ্যাকসন একসাথে ব্যবসা করেছে। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, সম্পর্কটা টেকেনি।
এর বেশি আর কিছু বলতে চাইল না ডোবার। কাজেই অন্য প্রসঙ্গে গেল কিশোর, কটা বাড়িতে চুরি হয়েছে?
গত তিন বছরে প্রায় দুই ডজন।
কি কি জিনিস নিয়েছে?
বেশির ভাগই সোনা-রূপার গহনা। ঘড়ি আর ওরকম সহজে বহনযোগ্য ছোটখাট দামী দামী জিনিস যা পেয়েছে সব নিয়েছে। কোন হদিস করা যায়নি ওগুলোর। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
বিক্রি না করে কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে বলছেন?
হয় লুকিয়ে ফেলেছে, নয়তো অনেক দূরের কোন শহরে নিয়ে গিয়ে চোরাই বাজারে বিক্রি করেছে। রবিনের দিকে তাকাল ডোবার। আচ্ছা, পিটারকে তোমার সন্দেহ হয়?
উঁহু, মাথা নাড়ল রবিন। বদমেজাজী। তবে চোর বোধহয় নয়।
অভাবে স্বভাব নষ্ট অনেক সময় হয়ে যায়, ডোবার বলল। যাকগে, চোর নাহলেই ভাল।
বাড়িটার চারপাশে তিন গোয়েন্দাও খানিকক্ষণ খুঁজে দেখল। কিন্তু বরফে পুলিশের এত বেশি জুতোর ছাপ পড়েছে, চোরেরটা থেকে থাকলেও আলাদা করে চেনা এখন মুশকিল। কিছু পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে বাড়ির সীমানা থেকে বেরিয়ে চলে এল ওরা।
চলো, এখানে আর দেরি না করে শার্লিদের বাড়ি চলে যাই, রবিন বলল। পার্টিটায় যোগ দেয়া দরকার। নইলে শার্লি আর আন্টি, দুজনেই মনে কষ্ট পাবে। মরগান আঙ্কেলের কথা আলাদা। পার্টির চেয়ে চোর ধরার ব্যাপারটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন উনি।
রবিন, মুসা জিজ্ঞেস করল, সত্যিই কি তোমার মনে হয় পিটার নিরপরাধ? তার দোস্ত দুটোকে দেখে কিন্তু জ্যাকসনের ধারণাই সঠিক বলে মনে হচ্ছে আমার। পাজির পা ঝাড়া।
আর যে-ই করে থাকুক, পিটার যে নিজে চুরি করেনি এ ব্যাপারে আমি এখন মোটামুটি শিওর, জবাব দিল কিশোর।
কি করে শিওর হলে? রবিনের প্রশ্ন।
ডোবার কি বলল শোনানি? রহস্যময় এই চুরিগুলো হচ্ছে বছর তিনেক ধরে।
হ্যাঁ। তাতে কি?
তুমিই তো বলেছ গত বছর মিশিগানে চলে গিয়েছিল পিটার। তার মার কাছে এক বছর থেকে এসেছে। ও এখানে যখন ছিল না, তখনও তো চুরি হয়েছে।
হুঁ, এটা একটা শক্ত যুক্তি, মাথা দুলিয়ে বলল মুসা। তা ছাড়া নিজের এলাকায় থেকে এ ভাবে একের পর এক চুরি করার সাহস দেখাবে, এটাও অবিশ্বাস্য।
ঠিক, কিশোর বলল।
কিন্তু কথা হলো, প্রশ্ন তুলল রবিন, পিটার যদি চুরি না করে থাকে, তাহলে চোর কে?
সেটাই এখন খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, জবাব দিল কিশোর।
শার্লিদের বাড়িতে ফিরে এল ওরা। বিশাল লিভিং রূমটায় বসে আছেন মরগান আঙ্কেল, বেলী আন্টি ও শালি। গরম চকোলেট খাচ্ছে সবাই।
কিশোরদের দেখেই জিজ্ঞেস করলেন বেলী আন্টি, আইসক্রীম খাবে?
গুঙিয়ে উঠল মুসা। ওটা তো আর গরম গরম দিতে পারবেন না।
হাসলেন বেলী আন্টি। দেখা যাক, গরম কি দেয়া যায়।
মরগান আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন, কিছু পেলে?
নাহ্, তেমন কিছু না, রবিন জানাল। কিশোর বলল, পুলিশ এখনও সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আহ্, বিরক্ত হয়ে বললেন বেলী আন্টি, ছেলেগুলোকে একটু মুক্তি দাও না। ওরা এসেছে পার্টিতে আনন্দ করতে, আর তুমি ওদের লাগিয়ে দিলে গোয়েন্দাগিরিতে।
আমি জানি, পার্টির চেয়ে গোয়েন্দাগিরিতেই বেশি মজা পায় ওরা, মরগান শ্রাঙ্কেল জবাব দিলেন।
গরম চকোলেটের মগ, প্রচুর মাখন লাগানো কেক আর তিন-চার রকমের ফলের কুঁচি মেশানো আইসক্রীমের ট্রে এনে সোফার পাশের ছোট টেবিলে রাখলেন আটি। যার যারটা তুলে নিতে বললেন তিন গোয়েন্দাকে।
বেলী আন্টি নানা ভাবে চেষ্টা করলেও চুরির আলোচনা বাদে অন্য আলোচনা। জমল না। কোন সময় যে নিজেও তিনি যোগ দিয়ে ফেলে, বলতে পারবেন না।
আচ্ছা, আন্টি, চুরি হওয়ার রাতগুলোতে অস্বাভাবিক কোন কিছু কি চোখে। পড়েছে আপনার? কিংবা কোন শব্দ? প্রশ্ন করল কিশোর।
যতবার ডাকাতি হয়েছে, পৃলিশ এসে একই এশ করেছে আমাদের। আমরাও একই জবাব দিয়েছি না, কিছুই দেখিনি, কিছু শুনিওনি, বেলী আন্টি বললেন।
তবে এটা ঠিক, মরগান আঙ্কেল বললেন, আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে আমাদের অজান্তে কোন গাড়ির যাবার উপায় নেই। শুনতে আমরা পাবই!
কেন? জানতে চাইল মুসা।
কারণ আমাদের বাড়িটা রাস্তার একেবারে ধার ঘেঁষে তৈরি। পাইনভিউ থেকে বেরোনোর সময়ও আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হবে, ঢোকার সময়ও। গাড়ির রাস্তা ওই একটাই, জবাব দিলেন মরগান আঙ্কেল।
তা ছাড়া, বেলী আন্টি বললেন, শীতকালে যানবাহন চলাচলও এখানে নেই বললেই চলে। কালেভদ্রে প্রতিবেশীদের একআধটা গাড়ি যায়-আসে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে। সব শুনতে পাই আমরা। জায়গাটা এত নীরব বলেই শান্তির জন্যে এখানে বাস করতে এসেছি।
এক মুহূর্তের নীরবতার পর আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন, চুরিগুলো কি বন্ধ করতে পারবে তোমরা? কি মনে হয়?
এক মুহূর্ত চিন্তা করে জবাব দিল কিশোর, আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা তো আমরা অবশ্যই করব। দেখি কি করা যায়।
.
০৪.
থানাতেই পাওয়া গেল ক্যাপ্টেন ইউরি রিকম্যানকে। পাইনভিউ লেকের চুরির কেসটা নিয়ে ব্যস্ত। পিটার আর জ্যাকসনের দুটো সই করা লিখিত বক্তব্য রয়েছে তাঁর সামনে, টেবিলে। সেগুলো পড়ছেন।
সাড়া পেয়ে মুখ তুললেন। অ। তোমরা। বসো…কি খবর? ডোবারের তো তোমাদের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা…
পিটার চুরি করেনি, কিশোর বলল।
ভুরু উঁচু করলেন ক্যাপ্টেন! কি করে বুঝলে?
গত বছর সে ছিলই না পাইনভিউতে। মিশিগানে মায়ের কাছে চলে গিয়েছিল। কিন্তু চুরি তো থেমে থাকেনি। তারমানে সে জড়িত নয়।
মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন! জড়িত নয় বলতে পারো না। কারণ তার দোস্তরা তো পাইনভিউতেই ছিল। সে নিজে সামনে ছিল না, এটা বলা যেতে পারে। কিন্তু জড়িত নয়, কিংবা জানে না বলাটা ভুল হবে। একটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনজনেরই মুখের দিকে তাকালেন তিনি। তা ছাড়া, সে নিজেই স্বীকার করেছে চুরি করে ঢুকেছে একটা বাড়িতে।
হতবাক হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।
ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, মানে?
একটু আগে সে নিজের মুখে বলেছে, বন্ধুদের নিয়ে ডেভিড শফারের বাড়িতে ঢুকেছিল। দুই হপ্তা আগে চুরি হয়েছে বাড়িটাতে।
ও চুরি করেছে, এ কথা বলেছে?
না, তা বলেনি। বলেছে, সাহস দেখানোর জন্যে বাজি ধরে খালি বাড়িতে ঢুকেছিল। তবে বিনা অনুমতিতে যে ঢুকেছিল, এ কথা স্বীকার করেছে।
কথা বলা যাবে ওর সঙ্গে?
এসো। উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন!
তাকে অনুসরণ করে বাড়ির পেছন দিকের একটা হাজতের সামনে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
দুহাতে মাথা চেপে ধরে একটা বাংকের ওপর বসে রয়েছে পিটার।
পিটার, দেখো কারা এসেছে, ডাক দিলেন ক্যাপ্টেন।
মুখ তুলল পিটার।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, তোমরা কথা বলো। আমি আসছি।
শিকের ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল পিটার, আমাকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছ?
দেখি কি করতে পারি… জবাব দিল কিশোর। ক্যাপ্টেনকে বললাম, এক বছর তুমি ছিলে না পাইনভিউতে। কাজেই ওসময়কার চুরি-ডাকাতিগুলোতে তোমার সরাসরি জড়িত থাকা সম্ভব নয়।
তারমানে আমি নিরপরাধ, এই তো বলছ?
নিরপরাধ কিনা সে-প্রমাণ যেমন এখনও মেলেনি, চোরের সঙ্গে যোগসাজশ আছে কিনা সে-ব্যাপারেও শিওর নই, জবাব দিল কিশোর।
মানে? এগিয়ে এসে শিক ধরে দাঁড়াল পিটার।
ক্যাপ্টেন বললেন, তুমি নাকি ডেভিড শফারের বাড়িতে ঢুকেছিলে।
ও তো স্রেফ মজা করার জন্যে। ঢুকে, ফ্রিজ থেকে কিছু খাবার বের করে নিয়ে বেরিয়ে চলে এসেছি। মনে হচ্ছিল, বেশ একটা মজা হলো।
মজা!
জানি, জানি। গাধামি করেছি, বুঝতে পারছি এখন।
বড় এক গোছা চাবি নিয়ে হাজির হলেন ক্যাপ্টেন। তালাটা খুলে দিতে দিতে পিটারকে বললেন, আপাতত তোমাকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিন গোয়েন্দার দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল পিটার, অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
ধন্যবাদটা নিতে পারছি না আমরা, কিশোর বলল। তোমাকে ছাড়ানোর ব্যাপারে আমরা কিছুই করিনি।
গুঙিয়ে উঠল পিটার, তারমানে বাবা এসেছে।
উঁহু, জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন। তাকে ফোন করে তোমার কথা জানালাম। ছাড়া তো দূরের কথা, সারা জীবন আটকে রাখতে বলে দিলেন।
দমে গেল পিটার। তাহলে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন?
এইমাত্র খবর পেলাম, আরেকটা বাড়িতে চোর ঢুকেছিল, জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন। তুমি এখানে আটকা রয়েছ। এই একটা চুরি অন্তত তুমি করোনি, এটা বোঝা গেছে।
তারমানে সত্যি আমাকে যেতে দিচ্ছেন?
বললাম তো, আপাতত। পরে তোমাকে আবার দরকার হবে আমাদের। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। এখন বাড়ি যাও। দূরে কোনখানে যাবে না। খোঁজ করলে যেন পাই। রবিনের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। তোমরা যাবে সঙ্গে?
মাথা ঝকাল রবিন, যাব।
পিটারকে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল ওরা। মুসা বসল ড্রাইভিং সীটে। রবিন তার পাশে। পিটারকে নিয়ে কিশোর বসল পেছনে।
পাইনভিউতে ফিরে চলল আবার ওরা।
রাত যতই বাড়ছে, আবহাওয়া আরও ঠাণ্ডা হচ্ছে। রাস্তা খারাপ নয়, কিন্তু বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বরফের কারণে। গাড়ি চালাতে অতিরিক্ত সাবধান থাকতে হচ্ছে মুসাকে। একটু এদিক ওদিক হলেই গিয়ে পড়বে রাস্তার পাশের খাদে।
শহর থেকে বেরিয়ে এসে পাইনভিউর রাস্তায় পড়ল গাড়ি। পিটারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, তারপর? এই চুরির পেছনের আসল ঘটনাটা কি বলো তো?
আমি কি করে জানব? রুক্ষ স্বরে জবাব দিল পিটার।
দেখো, পিটার, ক্যাপ্টেন কিন্তু সহজে তোমাকে ছাড়বেন না। তোমার আর তোমার দুই দোস্তের ওপর দোষটা চাপানোর চেষ্টা করবেন তিনি। তোমাকে আমরা সাহায্য করতে চাইছি। আর কিছু না করো, নিজেকে বাঁচাতে অন্তত আমাদেরকে সহযোগিতা করো।
দোষ কি করে চাপাবে? গত চুরিটার সময় আমি হাজতে আটকা ছিলাম, ক্যাপ্টেন নিজের মুখে বলেছে।
এমনও তো হতে পারে তোমার দোস্তরা গিয়ে কাজটা সেরে এসেছে, তুমি যে নির্দোষ সেটা বোঝানোর জন্যে। তা ছাড়া শফারের বাড়িতে চুরি করে ঢোকার কথাটা বোকার মত স্বীকার করে ফেলে নিজের নামটাকে সন্দেহের তালিকায় লিখিয়ে দিয়ে এসেছ।
কিন্তু আমি চুরি করিনি। এ সব চুরি-ডাকাতিতে যুক্তও নই। আমার তো ধারণা, সব শয়তানির মূলে ওই বুড়ো জ্যাকসন।
সামনের প্যাসেঞ্জার সীট থেকে ঘুরে তাকাল রবিন। জনসনদের বাড়ির কাছে তোমাকেই সন্দেহজনক ভাবে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। জ্যাকসনকে নয়। এর কি জবাব দেবে?
সন্দেহজনক ভাবে নয়, তীব্র প্রতিবাদ জানাল পিটার। দেখতে গিয়েছিলাম। বড় বড় বাড়িগুলো দেখতে আমার ভাল লাগে। দেখি আর ভাবি, আমিও একদিন ওরকম একটা বাড়িতে বাস করব।
ও কি বলতে চায় বুঝতে পারল রবিন। লেকের ধারের বাড়িগুলো এমনিতেই বড় বড়। আর জনসনদের বাড়িটা তো রীতিমত একটা প্রাসাদ। তাকিয়ে থাকার মতই।
ভাল সুন্দর কোন বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকাটা নিশ্চয় অপরাধ নয়? পিটার বলল, হোক না সেটা অন্যের বাড়ি।
চুরি করে বিনা অনুমতিতে কারও বাড়িতে ঢুকলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে, জবাব দিল কিশোর। এটা আবার ভুলে যেয়ো না।
ভুলিনি। দেখো, একটা কথা বিশ্বাস করতে পারো, আমি বা আমার বন্ধুরা চোর নই। এই চুরির সঙ্গে জড়িত থাকা তো দূরের কথা।
তোমার কথা বাদ দিলাম। তোমার দোস্তরা যে জড়িত নয়, কি ভাবে প্রমাণ করবে? তোমাকে দেখতে কি থানায় গিয়েছিল ওরা? চুরিটা যখন হয়, তখন কি তোমার সামনে ছিল?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিল পিটার, কাজে ব্যস্ত থাকলে যাবে কি করে?
এ সব বলে পুলিশকে বোঝাতে পারবে না।
আবার এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে পিটার বলল, দেখো, না বলে শফারদের বাড়িতে ঢুকে অপরাধ করেছি, ঠিক। তবে জিনিসপত্র চুরি করিনি। এই চুরিগুলো বুড়ো জ্যাকসনের কাজ। আমার বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে আমার ওপর দোষটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
তোমার বাবার সঙ্গে জ্যাকসনের শত্রুতাটা কি নিয়ে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ব্যবসায় পার্টনার ছিল। বেইট শপ আর ওটার চারপাশের জমির মালিক ছিল দুজনে, সমান সমান ভাগ, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল পিটারের কণ্ঠ। কিন্তু মার সঙ্গে বাবার ডিভোর্সের সময় বাবা বেশ বড় রকমের একটা সমস্যায় পড়ে গেল। টাকার সমস্যাও ছিল।
তারপর?
পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে রবিন। শুনছে। গাড়ি চালানোর জন্যে পেছনে নজর দিতে পারছে না মুসা। পিচ্ছিল রাস্তায় গাড়ি চালাতে খুব সাবধান থাকতে হচ্ছে তাকে। তবু যতটা সম্ভব শোনার চেষ্টা করছে।
জ্যাকসনের কাছে টাকা ধার চাইল বাবা। কিন্তু বুড়ো একটা পয়সাও দিল না। বাবা তখন খানিকটা জমি বেচতে চাইল। বুড়ো তাতেও রাজি হলো না। টাকার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল বাবা। নামমাত্র মূল্যে পুরোটাই ঠকিয়ে নিল তখন জ্যাকসন। ওর কাছে বিক্রি করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না বাবার। তারপর থেকেই বুড়োকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে বাবা। শত্রুতাটা বুড়োই জন্ম দিয়েছে। বাবা নয়।
এদিকেই যেন কোথায় তোমাদের বাড়িটা? শহরের একপ্রান্তে পৌঁছে জিজ্ঞেস করল রবিন।
হ্যাঁ, ডানে। ওই যে, গাছটার নিচে। হাত তুলে সবচেয়ে বড় গাছটা দেখাল পিটার।
গাছের কাছে গিয়ে গাড়ির গতি ধীর করল মুসা। পথ এত বেশি পিচ্ছিল, বাড়ির দিকে বাঁক নেয়ার সময় প্রায় শামুকের গতিতে গাড়ি চালাতে হলো তাকে।
রাস্তার ধারে কিছু ডালপালা পড়ে আছে। ঝড়ে ভেঙে পড়েছে হয়তো। তার ওপাশে একটা জীর্ণ মলিন পুরানো বাড়ির সামনে তার চেয়েও পুরানো একটা গাড়ি। বাড়ির একটা জানালার কাঁচ ভেঙে গিয়েছিল। সেখানটায় হার্ডবোর্ড লাগিয়ে ফোকর বন্ধ করা হয়েছে। বড়ই করুণ দশা।
কেউ কিছু বলার আগেই বলে উঠল পিটার, হ্যাঁ, এটাকেই বাড়ি বলে এখন আমার বাবা। কিন্তু বুড়ো জ্যাকসন যদি বাবার কথাটা মেনে নিত, তাহলে এত দরিদ্র হালে বাস করা লাগত না আমাদের। লেকের পাড়ের কোন একটা বাড়িতেই থাকতে পারতাম।
বাড়ির সামনে এনে গাড়ি রাখল মুসা। পুরানো ভলভো গাড়িটার পেছন থেকে আচমকা বেরিয়ে এলেন ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট পরা একজন মানুষ। হাতের শটগানটা তুলে কাঁধে ঠেকালেন। নিশানা করলেন মুসার দিকে।
.
০৫.
বাবা, কি করছ? আমরা চেঁচিয়ে উঠল পিটার।
তোমার বাবা? কিশোর জানতে চাইল।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল পিটার। মাথা গরম। পাহারা দিচ্ছিল।
এই, কি করেছিলি তুই? চিৎকার করে জানতে চাইলেন মিস্টার হিগিনস। বন্দুক নামালেন।
কিছুই করিনি।
তাহলে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল কেন?
দরজা খুলে নেমে গেল পিটার। বুড়ো জ্যাকসনের শয়তানি।
আস্তে করে দরজা খুলে নেমে এল কিশোর। রবিন আর মুসাও নামল।
জ্যাকসন! কি করেছে? জানতে চাইলেন মিস্টার হিগিনস।
ঘরে চলো না। ঘরে গিয়ে বলি, পিটার বলল। এখানে ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি কথা।
জ্যাকসনের কথা আর কি বলব, বিড়বিড় করলেন মিস্টার হিগিনস। ওর মত ঠগবাজ আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।
আপনাদের ব্যবসার কথা সব বলেছে আমাকে পিটার, কিশোর জানাল।
পিটার আর তার বাবার পেছন পেছন ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল কিশোর। এতই জীর্ণ, দুএক জায়গায় তক্তাও নেই। সে-সব জায়গা টপকে পেরোল। রবিন আর মুসাও একই ভাবে উঠে গেল।
তোমরা ভাবছ আমিই সম্পর্কটা নষ্টের জন্যে দায়ী? শটগানটা নামিয়ে রেখে নড়বড়ে একা লাউঞ্জ চেয়ারে বসে পড়লেন মিস্টার হিগিনস। ভুলেও তা ভেবো না।
পুরানো লম্বা একটা কাউচ দেখিয়ে কিশোরদের বসতে বলল পিটার। কিন্তু কাউচের মাঝখানে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে একটা মন্তু কুকুর। এটাকে সরানোর চেষ্টা করল পিটার। নড়লও না কুকুরটা। এমনকি চোখের পাতা একবার মেলেই সেই যে বন্ধ করল, খুললও না আর।
দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। ঘরের চারপাশে দ্রুত একবার চোখ বোলাল। চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল মুসা আর রবিন।
মিস্টার হিগিনস, লেকের পাড়ের বাড়িগুলোতে চুরি হওয়ার কথা তো নিশ্চয় শুনেছেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বুড়ো জ্যাকসনের কাজ, সাফ জবাব দিয়ে দিলেন মিস্টার হিগিনস।
কিন্তু তিনি চুরি করবেন কেন? টাকার তো তার অভাব নেই।
ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কি বললেন মিস্টার হিগিনস, বোঝা গেল না। ছেলের দিকে তাকালেন। তোকে থানায় নিয়েছিল কেন?
জনসনের বাড়ির কাছে আমাকে ঘুরতে দেখেছিল। সত্যি বলছি বাবা, বিশ্বাস করো, আমি চুরি করিনি।
আমার জীবনটা তো ধ্বংসই করে ছেড়েছে, এবার তোর পেছনে লেগেছে। ওই শয়তানটাকে আমি শেষ করে ছাড়ব আজ। থাবা মেরে বন্দুকটা তুলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার হিগিনস। আজ আমারই একদিন কি ওর…।
তাড়াতাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। মিস্টার হিগিনস, প্লীজ। পুলিশ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যা করার ওরাই করবে। অকারণে বিপদে পড়তে যাবেন না।
কিন্তু তোমরা কে? এখানে কি করছ? ধমকে উঠলেন মিস্টার হিগিনস।
বাবা, ওরা আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে, পিটার বলল।
আমাদের ধারণা, জবাব দিল কিশোর, চুরিগুলো পিটার করছে না। সেটাই প্রমাণ করতে চাইছি আমরা।
তোমরা এতে নাক না গলালেই ভাল করবে, মিস্টার হিগিনস বললেন। এটা জ্যাকসন আর আমার সমস্যা।
আপনাদের সমস্যা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু পিটার যে চুরিগুলোতে জড়িত নয়, এটা আমাদের প্রমাণ করতেই হবে। নইলে যে কোন সময় আবার ওকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ।
কিছুটা শান্ত হলেন মিস্টার হিগিনস। বেশ। করো প্রমাণ। তবে বুড়োটা যদি আমার ছেলের পেছনে আবার লাগে, ওকে আমি খুন না করে ছাড়ব না।
আর লাগতে পারবে না। আমরা লাগতে দেব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
বসে পড়লেন আবার হিগিনস। বন্দুকটা নামিয়ে রাখলেন।
আমরা এখন যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে আবার আসব।
রবিন আর মুসাকে নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর।
এগিয়ে দিতে এল পিটার। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। আমার জন্যে অনেক কষ্ট করলে।
ও কিছু না, কিশোর বলল। সত্যি যদি ডাকাতগুলোর সঙ্গে তোমার কোন সম্পর্ক না থাকে, বুড়ো জ্যাকসন তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। চলি। আবার দেখা হবে।
গাড়িতে উঠে রবিন জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয় তোমার?
কিশোর প্রশ্ন করল, কোন ব্যাপারে?
চুরি। মিস্টার হিগিনসের ধারণা জ্যাকসনই চোর।
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমিও না। চুরি করার কোন কারণ নেই তার। টাকার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া চুরি করে করে ঘাবড়ে দিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের তাড়ালে আখেরে তারই লোকসান হবে। দোকানের আয় কমে যাবে। বন্ধই করে দিতে হবে হয়তো একদিন।
এঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। গীয়ার দিতে দিতে বলল, কিন্তু, বুড়োর মারমুখো আচরণ দেখেছ? কাস্টোমারের সঙ্গে এই ব্যবহার করলে দ্বিতীয়বার আর তার দোকান মাড়াবে না কেউ। আমার তো ধারণা, নাতি দুটো ওকে না সামলালে এতদিনে মানুষের মার খেয়ে ভূত হয়ে যেতে হত বুড়োকে।
হুঁ, আনমনে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। নিচের ঠোঁট চেপে ধরে জোরে এক টান দিয়ে ছেড়ে দিল।
রবিন বলল, দুটো নয়, একটা। বড় নাতিটা তো বুড়োর মতই বদমেজাজী। দাদা-নাতি তিনজনের মধ্যে একমাত্র শান্ত মগজ কেবল ছোটটার। কিশোর, তুমি কিছু বলছ না?
অ্যাঁ?…হ্যাঁ। কাল সকালে দাদা-নাতি তিনজনের সঙ্গেই দেখা করতে যাব। মুসা, বাড়ি চলো এখন।
বাড়ি ফিরে আন্ট মারগারেটের কোন মেসেজ আছে কিনা দেখার জন্যে দোতলায় উঠে এল রবিন। আনসারিং মেশিনের প্লে বাটন টিপতেই শোনা গেল পুরুষকণ্ঠ: ভাবলাম, তোমাদের জানানো দরকার। জিথার জ্যাকসনের বাড়িতে রহস্যময় ভাবে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সকাল বেলা চলে এসো। আমিও থাকব।-ডোবার কগনান।
.
০৬.
পরদিন রোববার।
সকাল সকালই জ্যাকসনের বাড়িতে পৌঁছে গেল তিন গোয়েন্দা। দেখল, ওদের আগেই পৌঁছে গেছে ডোবার। জ্যাকসন আর তার দুই নাতি রকি-জ্যাকির সঙ্গে কথা বলছে।
মূল বাড়ি, যেটাতে রয়েছে জ্যাকসনের বেইট শপ আর বসবাসের ঘর, সেটা থেকে ডজনখানেক গজ দূরে একটা জিনিসপত্র রাখার ছাউনি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পোড়া কয়লার টুকরো ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। আগুনের তাপে চারপাশের বরফ গলে গেছে। বরফ গলা পানিতে মাটি ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছিল। সেই কাদা জমে এখন কাদার বরফ।
ভ্যান থেকে নেমে গেল কিশোর। নাকে লাগল পোড়া প্লাস্টিকের ঝাঁজাল পন্ধ।
মুসা আর রবিনও নেমে এগিয়ে গেল তার পেছনে।
এই যে, তিন গোয়েন্দা, ডোবার বলল। জ্যাকি জ্যাকসন আর রকি জ্যাকসনের সঙ্গে নিশ্চয় আগেই পরিচয় হয়েছে তোমাদের?
গতকালই, জবাব দিল কিশোর। হাত মেলানো চলল। গতকালকের মত আজ আর শীতল ব্যবহার করব না জ্যাকি। ব্যাপারটা লক্ষ করল কিশোর।
কি হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল সে।
আগুন, ডোবার জবাব দেয়ার আগেই বলে উঠল জ্যাকি।
আমার কাছে কিন্তু দুর্ঘটনার মত লাগছে না, ডোবার বলল। ওই দেখো, হাত তুলে কিশোরকে পোড়া একটা পেট্রল রাখার ক্যান দেখাল সে। ছাউনির বেড়ায় পেট্রল ঢেলে তারপর আগুন দিয়েছে।
ওরকম ক্যান আমরা বিক্রি করি না, জ্যাকি বলল।
কেউ কিছু দেখেছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
দাদার সঙ্গে পেছনের ঘরে বসে কথা বলছিলাম, জ্যাকি জানাল। এ সময় দেখি আগুন।
নিভানোর চেষ্টা করেছি, রকি বলল! হোস পাইপে বরফ জমে গিয়েছিল। পানি বের করতে করতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল ঘরটা।
রাগত দৃষ্টিতে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল জ্যাকি।
কি ছিল ছাউনিতে? কিশোরের প্রশ্ন।
বেশির ভাগই গরমকালে লেকে ব্যবহারের জিনিসপত্র, জবাব দিল জ্যাকি। ভেলা, বালতি, চাকার টিউব-এ ধরনের জিনিস।
কয়েকজন মাছ শিকারী গিয়ে দোকানে ঢুকল এ সময়।
এক মিনিট, বলে গোয়েন্দাদের রেখে জিনিসপত্র বিক্রি করতে চলে গেল দুই ভাই। কিশোর লক্ষ করল, বড় ভাইকে ভীষণ ভয় পায় রকি।
এই দুজনের সম্পর্কে কতটা জানেন? ডোবারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
গতকাল যা যা বললাম। তার বেশি না।
বুড়ো জ্যাকসন এখন কোথায়?
মাছ ধরছে।
সত্যি! এত ঘটনা ঘটে গেল। ঘর, জিনিসপত্র পুড়ে নষ্ট হলো। তার কিছুই এসে গেল না?
দুই সহকারীকে নিয়ে পোড়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। একটা শিক পড়ে থাকতে দেখে সেটা দিয়ে পোড়া ছাই আর কয়লা ঘটতে শুরু করল। সূত্রের আশায়।
শিকটাকে তো পোড়া মনে হচ্ছে না, ডোবারের দিকে তাকাল কিলোর। কেউ ঘাটাঘাটি করে গেছে নাকি?
আমাদের ফরেনসিক বিভাগের লোকজন আর দমকল বাহিনীর কর্মীরা, ডোবার জানাল।
বুড়ো জ্যাকসন আর নাতিরা ঘাঁটেনি?
হয়তো ঘেঁটেছে। তবে জুতোর ছাপটাপ তো কিছু দেখলাম না পোড়া ছাইয়ের মাঝে। এমন পোড়া পুড়েছে, হয়তো কোন জিনিসই আর অবশিষ্ট নেই বুঝতে পেরে অকারণ কষ্ট করতে যায়নি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, অফিসার ডোবার, কিশোর বলল। খবরটা আমাদেরকে জানানোর জন্যে।
সাবধান থেকো, ডোবার বলল। চোরগুলোকে মোটেও সুবিধের মনে হচ্ছে না আমার। আগুন লাগিয়ে যারা বাড়ি পুড়িয়ে দিতে পারে, ওরা সহজ লোক নয়। আরও খারাপ কিছুও করতে পারে। জমাট লেকটার দিকে তাকাল সে। এত শান্ত। দেখে মনেই হয় না এখানে এ ধরনের কোন কিছু ঘটতে পারে!
ডোবার চলে গেল।
কিশোরের দিকে তাকাল রুবিন। এখন, কি করব?
বুড়ো জ্যাকসনের সঙ্গে কথা বলব।
খাড়া পাড় বেয়ে লেকের দিকে নামতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা। আগে আগে চলেছে কিশোর। পানির চিহ্নও নেই। লেকের যেদিকেই তাকানো যায়, জমাট বরফ। কিনারের কাছটাতেও প্রায় ফুটখানেক পুরু। যত বরফ, আইস ফিশারম্যানদের ততই সুবিধে।
প্রচুর পরিশ্রম আর খুব যত্ন করে বানানো হয়েছে মাছ ধরার শ্যান্টিগুলো। খুপরির মত ঘরগুলোর কোন কোনটার মাথায় টেলিভিশনের অ্যান্টেনাও দেখা যাচ্ছে। আয়েশী শিকারী।
আহ্! নাক কুঁচকাল মুসা। খাবারের গন্ধ! রান্না করছে কে?
করছে, যাদের খিদে পেয়েছে, হেসে বলল রবিন।
মাংস ভাজার গন্ধ। গরম খাবার, টেলিভিশন, ঘরের মধ্যে বসে মাছ ধরা-বড় মৌজে আছে শিকারীরা, কিশোর বলল।
দেখো দেখো, কি কাণ্ড করেছে, রবিন বলল। প্রতিটি শ্যান্টির দরজায় রঙ দিয়ে বড় বড় করে নাম-ঠিকানা লেখা রয়েছে। এ সব লিখেছে কেন?
যদি হারিয়ে যায় শ্যান্টিগুলো, রসিকতা করল মুসা, চিনে যাতে বাড়ি ফিরে আসতে পারে।
বেশির ভাগ শ্যান্টির তুলনায় জ্যাকসনেরটা হোট। পুরানোও অনেক। প্রাইউডের দেয়ালের চলটা উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। চালায় নতুন আলকাতরা পড়েনি বহুকাল। কড়া রোদে পুড়ে শুকিয়ে সাদা সাদা হয়ে গেছে আগের আলকাতরা।
মলিন দরজাটায় থাবা দিল কিশোর। মিস্টার জ্যাকসন, আমি কিশোর পাশা।
ঢুকে পড়ো। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল জ্যাকসন। আস্তে কথা বলো। কথা শুনে ভয় পেলে মাছ চলে যাবে।
ঠেলা দিয়ে দরজা খুলল কিশোর। ছোট্ট কেবিনটা জিনিসপত্রে ঠাসা। বেশির ভাগই মাছ ধরার সরঞ্জাম। বালতি থেকে শুরু করে ন্যাকড়া, রীল, নাইলনের সুতো সবই আছে। আর আছে ব্যবহার করে ফেলে দেয়া প্রচুর কফির কাপ। এক কোণে রাখা একটা মোটরচালিত ড্রিল মেশিন। ওটার কর্ক ব্লেডটা এক ফুট চওড়া।
কুঁজো হয়ে চেয়ারে বসে আছে জ্যাকসন। চেয়ারটা এতই পুরানো, হাতলের গদিতে পোর স্পঞ্জ বেরিয়ে পড়েছে। বুড়োর হাতে খাটো একটা ছিপ। সামনে বরফের মধ্যে ফুটখানেক চওড়া গোল একটা গর্ত। সেটা দিয়েছিপের সুতো চলে গেছে নিচে।
আহহা, দরজাটা লাগিয়ে দাও না, রুক্ষ স্বরে বলল বুড়ো। গর্তের নিচের বরফ-শীতল পানিতে ভাসমান একটা লাল-সাদা ফাতনার দিকে চক্ষু স্থির।
ভেতরে জায়গা বলতে নেই। তার মধ্যেই কোনমতে গাদাগাদি করে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
আগুন লাগার ব্যাপারে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম আপনাকে, কিশোর বলল।
ওই শয়তান ছেলেটার কাজ, পিটার হিগিনস, প্রশ্ন করার আগেই জবাব দিয়ে দিল জ্যাকসন। প্রতিশোধ নিল আমার ওপর। চুরি করায় পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছি বলে।
কাল রাতে ওর সঙ্গে দেখা করেছি আমরা, কিশোর বলল। চুরিটুরিগুলো, বোধহয় ও করেনি।
অ, একরাতেই ওর পক্ষে?
আমাদের কোন পক্ষটক্ষ নেই, স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল কিশোর। আমরা শখের গোয়েন্দা। এই অপরাধের তদন্ত করছি।…এমন হতে পারে, চোরেরাই আপনার ঘরে আগুন দিয়েছে।…আগুনটা দেখলেন কখন?
সাড়ে দশটার দিকে। আমরা তাস খেলছিলাম। আমি, জ্যাকি আর রকি।
কার চোখে পড়ল প্রথমে?
জ্যাকির। বাথরূম থেকে পোড়া গন্ধ পেয়ে দেখতে গিয়েছিল। খানিক পরে বাইরে থেকে ওর আগুন আগুন চেঁচানো শুনে আমরাও গেলাম।
পোড়া গন্ধটা আপনারা পাননি?
প্রথমে পাইনি। পরে পেয়েছি।
আগুন আগুন বলে চেঁচানোর আগে না পরে?
ঠিক মনে করতে পারছি না।
কাউকে দেখেছেন? গাড়ি-টাড়ি বা কোন কিছু?
এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল জ্যাকসন। তোমার কি মনে হয়? আগুন লাগিয়ে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে গেল। দেখতে পেলে ছেড়ে দিতাম?
ফাৎনার দিকে চোখ পড়তেই অস্ফুট চিৎকার দিয়ে উঠল বুড়ো। পানির নিচে চলে গেছে ফানা।
খেয়েছে! বলে উঠল মুসা। চোখ চকচক করছে ফাত্রাটার দিকে তাকিয়ে। বোধহয় হাতও নিশপিশ করছে ছিপটাকে ধরে টান মারার জন্যে।
কথা বোলো না! ফিসফিস করে বলল জ্যাকসূন। খানিকটা সুতো ছাড়ল সে। তারপর ছিপ ধরে টান মারল।
উহহু, গেল ছুটে!যেৎ-ঘোৎ করে উঠল বুড়ো। তোমাদের জন্যে।
তার অভিযোগের ধার দিয়েও গেল না কিশোর। আগের প্রসঙ্গে অটল রইল। পিটার বাদে অন্য কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?
না। ভাগ্যিস ভেতরে মূল্যবান কিছু ছিল না। সুতো গুটাতে শুরু করল জ্যাকসন।
দামী কোন জিনিসই নষ্ট হয়নি?
না। ছাউনির চালায় কাল একটা ফুটো দেখতে পায় জ্যাকি। চালা খুলে মেরামত দরকার ছিল। ছাউনির সমস্ত দামী জিনিস দোকানে সরিয়ে ফেলি আমরা।
ছাউনিটা বীমা করানো ছিল?
না।
চুপ হয়ে গেল কিশোর। আর কি জিজ্ঞেস করা যায় ভাবছে।
এই সুযোগে ড্রিল মেশিনটা দেখিয়ে মুসা জিজ্ঞেস করল, মিস্টার জ্যাকসন, ওই জিনিসটা দিয়ে কি করেন?
বরফ ফুটো করি। দুই ফুট পুরু বরফও অনায়াসে ফুটো করে ফেলা যায়।
আরেকটা কথা। শ্যান্টিগুলোর দরজায় নাম-ঠিকানা লেখা কেন?
বোকা নাকি? মানুষের বাড়ির গেটে নাম-ঠিকানা লিখে রাখা হয় কেন? অধৈর্য হয়ে উঠল জ্যাকসন। কোনটা কার বাড়ি চিনে রাখার জন্যে। শ্যান্টির ব্যাপারেও সেই একই কারণ। হাত নেড়ে বলল, এখন তোমরা যাবে? ওসব চুরিদারি আর আগুন লাগানোর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে ভাল লাগছে না আমার। তবে বরফের মধ্যে মাছ ধরা যদি শিখতে চাও, বসতে পারো।
হা হা, শিখব শিখব! মুসার কণ্ঠে প্রচণ্ড উত্তেজনা।
এখন না। এখন সময় নেই, নিতান্ত বেরসিকের মত বলে উঠল কিশোর। আমাদের অন্য কাজ আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস্টার জ্যাকসন।
শ্যান্টি থেকে বেরিয় এল ওরা। খানিকক্ষণ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করল লেকের ওপর।
রাগ করে মুসা বলল কিশোরকে, কাজ তো কিছু দেখছি না। শুধু শুধু আমার মাছ ধরাটা বন্ধ করলে।
রবিন বলল, এক কাজ করা যায়। মেরিন ডগলাসের সঙ্গে কথা বলতে পারি। চুরি-ডাকাতিগুলোর ব্যাপারে তার কি অভিমত, জানা যাক।
কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে ডগলাসকে?
শার্লিদের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করার কথা ভাবল কিশোর। কিন্তু সেটা আর করতে হলো না। বেশ কিছুটা দূরে বরফের ওপর নিঃসঙ্গ বসে থাকতে দেখা গেল একটা লোককে। মাথায় লাল ক্যাপ।
হাত তুলে রবিন বলল, ওই যে!
এগিয়ে গেল ওরা। ভুল করেনি রবিন। মেরিন ডগলাসই। বিলাসবহুল কেবিন নেই তার। বাইরে খোলা বরফের ওপর বসে মাছ ধরছে। স্নেডে করে বয়ে এনেছে তার মাছ ধরার সরঞ্জাম। একটা বালতি উল্টো করে রেখে সেটার ওপর বসেছে। জড়সড় হয়ে আছে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটায়।
সাড়া পেয়ে ফিরে তাকাল ডগলাস। আরে রবিন যে। কেমন আছ তোমরা?
ভাল, জবাব দিল রবিন। খাচ্ছে কেমন?
দূর, বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ডগলাস। একেবারেই না। মাছেরও মনে হয় আজ শীত লাগছে। অকারণ কষ্ট করছি। অনেকক্ষণ থেকেই বাড়ি যাবার কথা ভাবছিলাম।
চলুন তাহলে। আজ আপনার বাড়ি দেখব।
চলো। কফিটা তোমাদের সঙ্গে বসেই খাব।
ছিপ, সুতো এ সব গুছাতে তাকে সাহায্য করল তিন গোয়েন্দা। পেছন পেছন গিয়ে উঠল তার সবুজ পিকআপ ট্রাকটায়। লেক থেকে মাইলখানেক দূরে ডগলাস কার স্যালভিজ ইয়ার্ড-এ পৌঁছতে সময় লাগল না। কাঁটাতারের বেড়া দেয়া ইয়ার্ড। পুরানো, ভাঙাচোরা বাতিল গাড়িতে ভর্তি।
গেট দিয়ে ঢুকতেই বাড়ির ভেতর থেকে ঘেউ ঘেউ করে উঠল একটা কুকুর।
গাড়ি থেকে নেমে ডগলাসের বাড়িতে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। হলঘরের পাশেই শিকলে বাধা কুকুরটাকে দেখতে পেল। মনিবকে দেখে কাছে আসার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল ওটা।
এগিয়ে গিয়ে কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল ডগলাস। এই তো আমি এসে গেছি, পুটি। খুব একা একা লাগছিল? আজ আর বেরোব না, যা, কথা দিলাম।
কুকুরের নাম পুটি। আজব নাম, মনে হলো মুসার। কিছু বলল না।
চুরি আর জ্যাকসনের বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করল তিন গোয়েন্দা। নতুন কিছু জানাতে পারল না ডগলাস। কফি খাওয়া শেষ হলো। যাওয়ার জন্যে উঠল ওরা।
গেট পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দিল ডগলাস আর পুটি।
আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল ডগলাস, কোন প্রয়োজন হলেই যেন নির্দ্বিধায় চলে আসে গোয়েন্দারা।
.
০৭.
এখন কি করব? রবিনের প্রশ্ন। বহুত তো জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিছুই তো এগোল না।
আমি এখনও ভাবছি, নিচের ঠোঁটে ঘনঘন দুবার চিমটি কাটল কিশোর, মিস্টার মরগানের কালকের কথাটা।
কোন্ কথা? ভুরু নাচাল মুসা।
ওই যে, কালকে বললেন, চুরি হওয়ার পর কোন গাড়িটাড়ির শব্দ তাঁর বাড়ির কাছ দিয়ে যেতে শোনেন না।
তাতে কি?
তাতে? গাড়ির শব্দ যদি না শুনে থাকেন তিনি, তাহলে ধরে নিতে হবে চুরির মাল নিয়ে চলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না চোরের। কারণ, সে এখানকারই বাসিন্দা।
তে কি করতে চাও এখন?
পরীক্ষা করে শিওর হব, মরগান আঙ্কেলদের বাড়ি থেকে গাড়ির শব্দ সত্যিই কতখানি শোনা যায়।
নেই কাজ তো খই ভাজ। এরচেয়ে বুড়োর সঙ্গে বসে মাছ ধরলে কাজ হত। আইস ফিশিঙের এতবড় একটা সুযোগ পেয়েও আমি হাতছাড়া করতে রাজি না এবার, মুসা বলল।
অনেক সুযোগ পাবে। আগে কেসটার একটা কিনারা করে ফেলি, কিশোর বলল।,
আর যেতে অরাজি হলো না মুসা, চলো তাহলে।
মুসার পাশে বসে নির্দেশ দিতে লাগল কিশোর। ভ্যান চালাতে বললে পাশের রাস্তা ধরে মরগান আঙ্কেলদের বাড়ির দিকে। সরু রাস্তাটা ধরে এগোনোর সময় তীক্ষ্ণ নজর রাখল কিশোর।
সামনে চুলের কাঁটার মত একটা মোড়।
মোড় পেরোলেই মরগান আঙ্কেলের সীমানা।
খানিকক্ষণ রাস্তাটায় আসা-যাওয়া করল ওরা। বাড়ির সামনে দিয়ে।
মরগান আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন, পেছনের সীট থেকে বলে উঠল রবিন। বাড়ির কাছ দিয়ে চুপি চুপি পালিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই কারও।
তুষারপাতের সময় ইঞ্জিনের শব্দ ঢাকা পড়ে যেতে পারে, মুসা বলল।
গেটের ভেতর গাড়ি ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল শালি। কাছে এসে বলল, অনেকক্ষণ আগেই তোমাদের আসার শব্দ পেয়েছি। বাড়ির পেছনে ঘোরাঘুরি করছিলে কেন?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, তুষারপাতের সময়ও কি বাড়ি থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পাও?
নিশ্চয়ই। কেন?
এবারও শার্লির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মুসার দিকে তাকাল কিশোর, পেলে তো তোমার কথার জবাব?
কিন্তু এর পরও সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর। রবিনকে বাড়ির ভেতরে গিয়ে কান পেতে থাকতে বলে বাড়ির সামনে-পেছনে বার বার ঘোরাঘুরি করতে থাকল ভ্যানটা নিয়ে। ফিরে এসে রবিনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, যতবার বাড়ির কাছে দিয়ে গাড়ি গেছে, ততবার ইঞ্জিনের শব্দ শুনেছে রবিন। এমনকি দুই মাইল গতিতে আস্তে চালিয়েও ফাঁকি দিতে পারেনি রবিনকে। শেষে ভ্যানের শব্দ বেশি বলে শার্লিদের শব্দ কম করা সেডান গাড়িটা চালিয়ে দেখল। ওটার শব্দও স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল বাড়ির ভেতর থেকে।
মরগান আঙ্কেল বাজার থেকে ফিরলে তাকে সব জানাল কিশোর।
তাহলেই বোঝো, তিনি বললেন। পুলিশকে আমি কোনমতেই বিশ্বাস, করাতে পারিনি। তাদের ধারণা, ঘুমিয়ে ছিলাম বলে আমি শুনতে পাইনি।
স্বামীর পক্ষ নিয়ে বেলী আন্টি বললেন, রাতে ও প্রায় ঘুমায়ই না আজকাল। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। টিভি দেখে। বই পড়ে। যতগুলো চুরি হয়েছে, সব হয়েছে সন্ধ্যারাতের সামান্য পরে। অত তাড়াতাড়ি আমিই ঘুমাই না। শার্লির বাপের তো কথাই নেই।
হু, কিশোর বলল। আমরা বুঝতে পেরেছি। দুই সহকারীর দিকে তাকাল, চলল, বাইরেটা গিয়ে আরেকবার দেখে আসি।
এবারও ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা। বাড়িঘরগুলোর কাছ থেকে বেশ খানিকটা সরে এসে লেকের পাশে একটা খোলা জায়গায় গাড়ি রাখল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বাড়ছে ঠাণ্ডা।
দেখছ, কত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যায় এখানে? রবিন বলল।
তদন্তটা গরমকালে করতে পারলে ভাল হত, মুসা বলল।
গাড়ির বুট খুলে গরম কাপড়-চোপড় বের করতে শুরু করল কিশোর। ভারী জ্যাকেট পরল। পায়ে দিল কাটা বসান বুট। যাতে বরফের ওপর হাঁটার সময় পিছলে না পড়ে।
বনে ঢুকল ওরা। ছয় ফুট লম্বা ডাল কেটে নিয়ে ছড়ি বানাল। বরফে বুকে দেখে বোঝার জন্যে, পাতলা না ভারী।
কথাটা ঠিকই বলেছ তুমি, কিশোরকে বলল রবিন। চুরিটা যে-ই করুক, গাড়িতে করে আসে না। এখানেই বাস করে। কিংবা রাতের বেলা বাইরের কোন জায়গা থেকে এসে বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে ঢোকে। কিন্তু তাতে যে পরিমাণ ঝুঁকি আর কষ্ট হবে, কোন চোরই সেটা করতে রাজি হবে কিনা সন্দেহ আছে আমার।
তবে বাইরে থেকে এলে মুশকিল হয়ে যাবে। কাউকে সন্দেহ করতে পারব না, মুসা বলল। ধরব কি করে ওকে?
দুজনের কথায় বিশেষ কান নেই কিশোরের। বেইট শপটার দিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। মগজে গভীর ভাবনা চলেছে ওর। আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, জ্যাকসনের ব্যাপারে কি ধারণা তোমাদের?
মানে! চমকে গেল মুসা আর রবিন দুজনেই।
আগুন লাগার ঘটনাটা?
বড় বেশি ভাগ্যবান মনে হয়েছে ওদেরকে, জবাব দিল রবিন। আগুন লাগার আগে সমস্ত দামী দামী জিনিস সরিয়ে ফেলা। ঘর পুড়ে যাওয়ার পরেও জ্যাকসনের অতিরিক্ত নির্বিকার ভাব। কাকতালীয় মনে হয়।
ঠিক বলেছ, বাতাসে তর্জনী দিয়ে বাড়ি মারার ভঙ্গি করল কিশোর। নির্বিকার থাকার কারণটা বোঝা যায়। পুড়েছে তো কেবল মূল্যহীন ভাঙা একটা ছাউনি। পুড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কাজটা পিটারের। পুলিশ বা আমাদের নজর অন্য দিকে সরানোর জন্যেও এ কাজ করে থাকতে পারে। এক ঢিলে দুই পাখি।…কিন্তু আমি ভাবছি মোটিভটা কি? কেন চুরি করবে বুড়ো জ্যাকসন? তার টাকার অভাব হয়েছে বলে তো মনে হয় না!
তারমানে বুড়োকেই চোর সন্দেহ করছ তুমি? রবিনের প্রশ্ন।
কিংবা তার দুই নাতি। ওদেরকেই বেশি সন্দেহ হচ্ছে আমার। কতগুলো পয়েন্ট দিচ্ছি, ভেবে দেখো। এক, ওরা বিদেশী-অর্থাৎ এখানে সব সময় থাকে না। মাঝে মাঝে আসে দাদাকে সাহায্য করতে। দুই, অনেক দূরের শহরে থাকে ওরা। ম্যারিল্যান্ডে। চোরাই মাল নিয়ে ম্যারিল্যান্ডে গিয়ে আশপাশে কোনখানে যদি মালগুলো বিক্রি করে দেয়, জানার কথা নয় এখানকার পুলিশের, যদি খোঁজ না নেয়। ডোবার কি বলেছিল, মনে আছে? তার সন্দেহ দূরের কোন শহরে গিয়ে মাল বিক্রি করে দিয়ে থাকতে পারে চোরেরা। তারমানে ম্যারিল্যান্ডে খোঁজ নেয়নি। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করে শিওর হতে হবে। যাই হোক, তিন, জ্যাকির সন্দেহজনক আচরণ। লেকে ঝগড়ার সময় আমাদের পাত্তাই দিতে চায়নি, কিন্তু পরদিন যখন আগুন লাগার তদন্ত করতে গেলাম, যেচে এসে খাতির করতে লাগল। এর মানে কি? মানে হলো, আমাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা, যে পিটারই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে আগুনটা লাগিয়েছে। চার, আগুন লাগার পর ধোঁয়ার, গন্ধ। জ্যাকসন আর রকি কাছাকাছি থেকেও গন্ধ পেল না, আর বাথরূম থেকে গন্ধ পেয়ে বেরিয়ে গেল জ্যাকি। কিছুক্ষণ পর আগুন আগুন বলে চিৎকার করল। এর একটাই ব্যাখ্যা, ধোয়ার গন্ধ মোটেও পায়নি সে। বেরিয়ে গিয়ে আগুন লাগিয়েছে ছাউনিতে। আগুন ভালমত লাগার পর চিৎকার করেছে। ধোয়ার গন্ধের কথা মিথ্যে বলেছে।
একটানা অনেক কথা বলে দম নিল কিশোর। তারপর বলল, এখন প্রশ্ন একটাই, চোরাই মাল কি ভাবে সরায় ওরা? পুলিশ যেহেতু ওদের সন্দেহ করে না, গাড়িতে করে নিয়ে সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে পাইনভিউ লেক থেকে। গত কয়েক বছরের রেকর্ড থেকে জানা যায়, কেবল শীতকালে চুরিগুলো হয়। প্রতিটি বাড়িতে চুরি করার পর পরই ম্যারিল্যান্ডে যায় না ওরা যাওয়া সম্ভব নয়, অনেক দূরের পথ। গেলে যেতে-আসতে বেশ সময় লাগবে। যায় একবারই। সেটা শীতের পর। সমস্ত চোরাই মাল জমিয়ে একসাথে নিয়ে যায়।
আরেকটা প্রশ্ন আসে এখন। মালগুলো কি করে? জবাব, লুকিয়ে রাখে। আর রাখে পাইনভিউরই কোনখানে। পুলিশ ওদের সন্দেহ করে না। তাই দোকানের মধ্যে কিংবা তার আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে রাখাটাই ওদের জন্যে সুবিধে। যদিও লুকানোর সবচেয়ে ভাল জায়গা নয় দোকানটা। কোন কারণে যদি পুলিশ সন্দেহ করে বসে, গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে, বেরিয়ে যাবে মালগুলো।
ঝুঁকি নিতে না চাইলে দোকানে রাখবে না ওরা। অন্য কোথাও লুকাবে। তবে সেটা পরের কথা। আগে আমাদেরকে দোকানেই খোঁজ করতে হবে। সেখানে পাওয়া না গেলে ভেবে দেখব, আর কোথায় লুকাতে পারে।
কিন্তু ওরাই যে চুরি করছে, অত শিওর হচ্ছ কি করে? মুসার প্রশ্ন।
এখনও হইনি। তবে হয়ে যাব।
পিটার আর তার দুই দোস্তকে কি সন্দেহের তালিকা থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছ?
না। তবে দোকানে খুঁজতে যেতে তো বাধা নেই। চোরাই মালগুলো ওখানে পেয়ে গেলে আমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে।
তাহলে এখন কি করব?
দিই একটু পাহারা-টাহারা। বলা যায় না, আজকেও চুরি করতে বেরোতে পারে। তাহলে হাতেনাতেই ধরে ফেলতে পারব।
হাসল রবিন। বেশি আশা হয়ে যাচ্ছে না?
পাহারা দিতে দোষ নেই।
ঘণ্টাখানেক ধরে লেকের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াল ওরা। লেকের পাড়ের বাড়িঘরগুলো দেখল। কোনটায় আলো আছে, কোনটাতে নেই। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে থাকতে ভাল না লাগায় গরম এলাকায় বেড়াতে চলে গেছে ওসব বাড়ির লোকরা। আর এই সুযোগে বিনা বাধায় ওসব বাড়িতে ঢুকে পড়ছে চোর।
রাত যত বাড়ছে, শীতও বাড়ছে। সেই সঙ্গে ধেয়ে আসছে কনকনে ঠাণ্ডা ঝোড়ো বাতাস। যত গরম পোশাকই গায়ে থাকুক, ঠেকাতে পারছে না। সুচের মত বিঁধছে। হাড় পর্যন্ত ঠাণ্ডা করে দিতে চাইছে।
আরও আধঘণ্টা ঘুরে বেড়িয়ে পুরো লেকটাকে এক চক্কর দিল ওরা। অস্বাভাবিক কোন কিছুই চোখে পড়ল না। ওদের দেখে নিশ্চয় সাবধান হয়ে গেছে চোর। চুরি করতে বেরোয়নি।
.
০৮.
পরদিন আবার এল ওরা পাইনভিউতে।
পিটারদের বাড়ির সামনের সরু রাস্তাটা পেরোনোর সময় মুসার বাহুতে হাত রাখল কিলোর, রাখো তো।
পিটারের বাবার সঙ্গে দেখা করবে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
থাকলে করব। পিটার কি করছে, সেটাও দেখেই যাই।
গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে এনে পিটারদের ড্রাইভওয়েতে ঢুকল মুসা।
গ্যারেজে পাওয়া গেল ওদের। পিটার আর তার দুই বন্ধু ডট ও কারনিকে। পিটারের পুরানো পিকআপ গাড়িটা চালু করছে তিনজনে মিলে।
জ্যাক দিয়ে পেছনটা উঁচু করে চাকা লাগাচ্ছে পিটার।
কাজকর্ম তো ভালই জানে মনে হচ্ছে, মুসা বলল।
হাসল রবিন। কি করে বুঝলে?
ভঙ্গি দেখে।
রতনে রতন চেনে, হাসিটা বাড়ল, রবিনের। একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি, মুসা। পিটারও তোমার মতই গাড়ি পাগলা।
কথা শুনে ফিরে তাকাল কারনি। দেখতে পেল তিন গোয়েন্দাকে। বলে উঠল, আরি আরি, কে এসেছে দেখো! জুনিয়ার শার্লক হোমসের দল। ন্যাকড়া দিয়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এল সে। হাতটা বাড়িয়ে দিল কিশোরের দিকে, কালি লাগবে কিন্তু।
লাগুক, হেসে হাতটা ধরল কিশোর।
তোমাদের কথা সব আমাদের বলেছে পিটার। যে ভাবে ওকে থানা থেকে বের করে এনেছ…
আমরা আনিনি, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। ক্যাপ্টেন ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিয়েছেন। হয়তো ফাঁদ পেতেছেন, কে জানে! ছেড়ে না দিলে তো ফাঁদে ফেলতে পারবেন না।
কাছে এসে দাঁড়াল ডট আর পিটার।
ডট হাত মেলাল তিন গোয়েন্দার সঙ্গে।
পিটার জিজ্ঞেস করল, কাল আসোনি কেন? শুনলাম, কালও এসেছিলে পাইনভিউতে।
কালকে ব্যস্ত ছিলাম অতিরিক্ত।
চোর ধরা নিয়ে?
মাথা ঝাঁকাল কিলোর।
এগোল কিছু?
হ্যাঁ না দুটোই বলতে হয়। ডট আর কারনির দিকে তাকাল কিশোর। তোমাদের দুজনকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। কিছু মনে কোরো না। আশা করি সত্যি জবাব দেবে।
কুঁচকে গেল কারনির ভুরু। কি করে বুঝবে সত্যি বলছি?
বলোই না। বোঝাবুঝির ব্যাপারটা তো পরে।
বলে ফলো।
পিটারকে থানায় নিয়ে যাবার পর এ এলাকায় আরেকটা চুরি হয়েছে। তোমরা করোনি তো? পিটারকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে?
ভুরুটা আরও কুঁচকে গেল কারনির। তারপর হেসে ফেলল, না। আমরা, খারাপ ছেলে হতে পারি, কিন্তু অপরাধ করে আরেকজনকে নিরপরাধ প্রমাণ করার মত খারাপ নই, বোকাও নই। তা ছাড়া চুরি করার মত ঘৃণিত কাজ আমাদেরকে দিয়ে হবে না।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল জন। তারপর বলল, বিশ্বাস করছ আমাদের কথা?
নির্দ্বিধায় মাথা ঝাঁকাল কিশোর। করছি।
হাসি ফুটল কারনি আর ডটের মুখে।
ঘরে যাবে? পিটার বলল। একটা জিনিস দেখাব তোমাদের।
মাথা কাত করল কিশোর।
দুই বন্ধুর দিকে ফিরল পিটার। তোমরা চাকাটা লাগিয়ে ফেলো। আমি ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল পিটার। নিজের বেডরূমে নিয়ে এল। দেয়ালে ছোট-বড় নানা রকম পোস্টার লাগানো। সবই গাড়ি কিংবা মোটর সাইকেলের ছবি।
এ জিনিসটা আশা করি সাহায্য করবে তোমাদের তদন্তে, বলে ড্রয়ার খুলল পিটার। পোস্টকার্ড সাইজের একটা কার্ড বের করল। তাতে নতুন মডেলের মস্ত
একটা ট্রাকের ছবি।
ছবিটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে, এটা আমার মিশিগানের বন্ধুদের। গত বছর ক্রিসমাসের সময় ওখানে ছিলাম আমি। উল্টে দেখাল কার্ডটা। দেখো, পেছনে নাম সই করা রয়েছে আমার বন্ধুদের। তারিখও দেয়া রয়েছে। বলতে পারো, কার্ড তো ডাকেও পাঠানো যায়। ওদের টেলিফোন নম্বর আছে আমার কাছে। ফোন করে কার্ডটার ব্যাপারে জানতে চাইতে পারো। সন্দেহ দূর হবে।
কার্ডটা হাতে নিল কিশোর। বলল, দেখিয়ে ভালই করলে। গোয়েন্দাগিরিতে কোন কিছুকেই সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না, যতক্ষণ না কেসটার সমাধান হয়ে যায়। আচ্ছা, আরেকটা কথা। রাতের বেলা কি করে কারনি আর ডট? ওরা যে চুরিগুলো হওয়ার সময় বাড়িতেই ছিল, প্রমাণ করার উপায় আছে?
হাসল পিটার। বড়ই খুঁতখুতে মন তোমাদের। তবে সেটাকে দোষ বলছি না। এ রকম না হলে বড় গোয়েন্দা হওয়া যায় না। মাথা ঝকাল সে, হ্যাঁ, প্রমাণ করার ভাল উপায় আছে। ওরা দুজনেই সন্ধ্যার পর একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করে। মাঝরাত পর্যন্ত। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো, এখানকার একটা চুরিও মাঝরাতের পরে হয়নি, সব আগে হয়েছে। আর রেস্টুরেন্টের নাম-ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে দিচ্ছি, মালিকের নামও জেনে যাও, কারনি আর ডটের ব্যাপারে খোঁজ নিতে সুবিধে হবে।
তার আর দরকার হবে না, বলতে গেল মুসা, তোমাদের কথাতেই বিশ্বাস করলাম…
তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বলল পিটারকে, দাও, নাম-ঠিকানাগুলো লিখেই দাও। আর তোমার কার্ডটা আপাতত আমার কাছেই থাক।
<