ঘ্যাঁচ করে এসে গেটের কাছে ব্রেক কষল পুলিশের গাড়ি। লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামল দুজন অফিসার, ছুটল লোকটাকে ধরার জন্যে। আরেকটা গাড়ি উঠে এল। ওপরে। আরও দুজন অফিসার নামল। দারোয়ানকে উঠতে সাহায্য করল একজন। আরেকজন ঝুঁকল মুসার ওপর। বেশি লেগেছে?

দাঁত বোধহয় বারো-চোদ্দটা খসে গেছে।

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল মুসা। দারোয়ানের ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। এই সময়ে চোখে পড়ল মেয়েটাকে। সেই লম্বা ঝুলওয়ালা স্কার্ট আর দোমড়ানো ব্লাউজ পরা। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পুলিশকে বলতে লাগল, জোর করে ঢুকল!…আমি সবে বাড়িতে এসেছি।… দোতলায় উঠে হলের দিকে যাচ্ছি, এই। সময় টের পেলাম কেউ আছে!

সাদা হয়ে গেছে মেয়েটার মুখ। গলা কাঁপছে। পায়ে ব্যথা পেয়েছে দারোয়ান। খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে বসল তার ঘরের সামনে রাখা চেয়ারে।

কোন বাড়িটায়? জিজ্ঞেস করল অফিসার। কোথায় থাকো তুমি?

 ছোট পার্কটার দিকে দেখাল মেয়েটা। তারপর হঠাৎ করেই কাঁদতে শুরু করল।

লেসিঙের বাড়ি, হাত তুলে দেখিয়ে বলল দারোয়ান। ওইটা। এগারো নম্বর। পার্কের ওধারের ওই যে বাড়িটা।

মাথা ঝাঁকাল অফিসার। সঙ্গীকে নিয়ে গিয়ে উঠল আবার গাড়িতে। মেয়েটা দাঁড়িয়েই আছে। ডিকসনদের দেয়া ছবির মেয়েটার চেয়ে এই মেয়েটা রোগী, তবে চোখের রঙ মিলে যাচ্ছে। ডালিয়া ডিকসনই? নাকি প্রায় একই রকম দেখতে অন্য কোন মেয়ে?

খানিক বাদেই ফিরে এল পুলিশের গাড়িটা। লোকটার পিছু নিয়েছিল যে, দুজন অফিসার, তারাও ফিরে এল। হাঁপাচ্ছে। কপালে ঘাম। যে অফিসার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেছিল, সে নেমে আবার বলল, এখন একটু ভাল লাগছে, না? আমাদের সাহায্য করতে পারবে? কিছু চুরিটুরি গেল কিনা দেখা দরকার।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে বসে পড়ল মেয়েটা।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, হাত নেড়ে বলল অফিসার। অত তাড়াহুড়া নেই। জিরিয়ে নাও। পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে পারবে?

হলের দিকে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা বলল। এই সময় মনে হলো পেছনে কেউ আছে। ফিরে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। তখন মনে হলো, শোবার ঘরে শব্দ হয়েছে। তারপর…

হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো।

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল মেয়েটা। ভয় পেয়ে গেলাম। যদি চোরটোর হয়? মিসেস লেসিঙের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আমার গলা ও শুনে ফেলতে পারে, এ জন্যে রেডিওটা জোরে চালিয়ে দিয়ে পুলিশকে ফোন করলাম।

 বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। ওসব সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। তারপর?

তারপর আর কিছু না। পুলিশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সাইরেনের শব্দ শুনে পালানোর চেষ্টা করল লোকটা। ওর পায়ের আওয়াজ শুনে মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার, পালাতে দিতে চাইলাম না। সিঁড়িতে গিয়ে জাপটে ধরলাম। ওকে।

এটা বোকামি হয়ে গেছে। লোকটা কি করল?

ঝাড়া দিয়ে আমাকে ফেলে দিয়ে দৌড় দিল।

ভাগ্যিস ছুরিটুরি মারেনি। ওরকম বোকামি আর করবে না।

উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। চলুন। এখন যেতে পারব।

 দারোয়ান বলল, তোমার সঙ্গে কারও থাকা উচিত। বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই? খবর দাও না।

মাথা নাড়ল মেয়েটা। আমার বন্ধুরা সব শহরের বাইরে।

এগিয়ে গেল কিশোর। ডলি, আপনার মাকে খবর দিতে পারি আমরা।

থমকে গেল মেয়েটা। তারপর আস্তে করে ঘুরে তাকাল কিশোরের দিকে। ডলি? আমার নাম ডলি নয়। বেটসি। বড় জোর বেটি বলতে পারো।

ওকে বিরক্ত কোরো না! কড়া গলায় বলল দারোয়ান। এমনিতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেয়েটা। ভয়ে কাবু।

পুলিশের গাড়িতে করে চলে গেল বেটি। একজন অফিসার তিন গোয়েন্দার কাছ থেকে ঘটনাটার বিবরণ লিখে নিতে লাগল।

মুসার চোয়ালের বেগুনী হয়ে যাওয়া জায়গাটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে লাগল দারোয়ান। ব্যাটার গায়ে জোর আছে। তোমারই যখন এ অবস্থা করে দিয়েছে…নাহ, আজকাল আর শান্তি নেই। এত বড় বাড়িতে মেয়েটার একা থাকা একেবারেই উচিত না।

 বাড়িটার মালিক কে? জিজ্ঞেস করল রবিন। কোথায় থাকে?

মিসেস আরনি লেসিং। কয়েকদিন আগে ইউরোপ গেছে। কয়েক হপ্তা হল এসেছে বেটি, মিসেস লেসিঙের সঙ্গে আছে। তিনি খুব ভাল। ছেলেমেয়েদের কষ্ট সইতে পারেন না। কেউ অসুবিধেয় আছে দেখলেই তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। বেটি বোধহয় কোথাও একটা পার্টটাইম কাজটাজ করে। এখানে মিসেস লেসিঙের বাড়িঘর দেখাশোনা করে যে মহিলা, তাকে সাহায্য করে। বাড়িতে কি একটা জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় কাল থেকে আসছে না মহিলা। ফলে বেটি একা হয়ে গেছে।

 তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকাল দারোয়ান। সত্যিই তাকে তোমরা চেন?

ডালিয়া ডিকসনের ছবিটা বের করে দেখাল কিশোর। ডলির বাবা-মা এটা দিয়েছে আমাদেরকে। কি মনে হয়?

সময় নিয়ে ছবিটা দেখল দারোয়ান। ভাবের পরিবর্তন হল না। এই বয়েসের একটা মেয়ে আমারও আছে।

আপনি নিশ্চয় চান, আপনার মেয়ে ভাল থাকুক?

মাথা ঝাঁকাল লোকটা। বেটির সঙ্গে আমি কথা বলব। ও-ই ডলি কিনা জানার চেষ্টা করব। এখন হবে না। মুখ খুলবে না ও। একে তো চোরের ভয়; তার ওপর পুলিশের ঝামেলা। টেনশনে আছে।

কাল সকালে আসি একবার, কি বলেন?

এসো। আমি বেটির সঙ্গে কথা বলে রাখব। কাল সকালে বাড়িতে যাতে থাকে, তারও চেষ্টা করব। অন্তত তোমরা যতক্ষণ না আসো, কাজে বেরোতে দেব না। আশা করি, আমার কথা রাখবে ও।

.

পরদিন সকালে চেশায়ার স্কোয়্যারে একা এল কিশোর। মুসা আর রবিনের সঙ্গে স্ত্র আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একা আসাই ভাল। বেশি মানুষ দেখলে হয়ত অস্বস্তিতে পড়ে যাবে মেয়েটা, তখন আর মুখ খুলতে চাইবে না।

কিশোরকে দেখেই বলতে শুরু করল দারোয়ান, ওর বাবা-মা যে তোমাদেরকে পাঠিয়েছে একথা বলিনি ওকে। নিজে নিজেই হয়ত আন্দাজ কবে নিয়েছে। আমি শুধু বলেছি, তোমরা তার ভাল চাও। দেখা করতে রাজি হয়েছে।

 মিসেস লেসিঙের বাড়িটা দেখিয়ে বলল সে, ওই যে, পার্কের ওপাশের বড় বাড়িটা।

দারোয়ানকে ধন্যবাদ দিয়ে চত্বরে ঢুকল কিশোর। এসে দাঁড়াল ১১ নম্বর বাড়ির সামনে। দোতলা বাড়ি। ভিক্টোরিয়ান আমলের চেহারা। সে আবার পা বাড়াতেই একটা দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এল বেটি। এসেছ। আমি তোমার জন্যেই বসে আছি।

 কিশোর পাশা, হাত বাড়িয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান।

হেসে হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল বেটি। তারপর ঘরে ঢুকে গেল ভেতরে। তাকে অনুসরণ করল কিশোর। ঢুকেই একটা ধাক্কা খেল। একলাফে যেন চলে। এসেছে অন্য এক যুগে। ঘরের চেহারাটা বানিয়ে রাখা হয়েছে একশো বছর আগের। চওড়া সিঁড়ি, দোতলার কাঠের গ্যালারি, দেয়ালের প্যানেলিং, আসবাবপত্র সব পুরানো আমলের। পুরু লাল কার্পেটে গোড়ালি দেবে যায়। দেয়ালে ঝুলছে ভারি ফ্রেমে বাঁধানো পেইনটিং।

কেমন জানি লাগে, তাই না? কিশোরকে বলল বেটি। এসো, রান্নাঘরে। এখানকার চেয়ে ভাল।

 মেয়েটার পিছু পিছু সিঁড়ির পাশ কাটিয়ে এল কিশোর। রান্নাঘরটা ভালই। বোদ আসছে। পুরানো আমলের একটা স্টোভে পানি ফুটছে। চেহারাটাই প্রাচীন, জিনিসটা আধুনিক, ইলেকট্রিক হীটার।

দুটো জানালার মাঝের দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে টেবিল। ওখানে চেয়ারে বসতে বলল কিশোরকে বেটি। কিশোরকে কোক বের করে দিল সে। নিজের জন্যে চা ঢেলে নিল।

 বেটি কাজ করছে, আর চুপ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কিশোর। মেঝে ছুঁয়ে যাওয়া গাউনই পরেছে। কালে ফিতে দিয়ে চুল বাঁধা। তার মনে হলো, বাড়িটার সঙ্গে মানানোর জন্যেই বুঝি এ রকম করে কাপড় পরেছে মেয়েটা।

সত্যি, শুরু করল কিশোর। মিসেস লেসিং খুব ভাল। আপনাকে থাকতে দিয়েছেন।

হ্যাঁ। আসলেই ভাল।

তার সঙ্গে পরিচয় হল কি করে?

একটা বিউটি পারলারে।

 পারলারটার নাম?

গোল্ডেন ড্রীম।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। চেনে। রকি বীচেই ওটা।

কাজকর্ম এখনও তেমন শিখতে পারিনি, মেয়েটা বলতে থাকল। কাটতে গিয়ে মিসেস লেসিঙের চুল নষ্ট করে ফেলেছিলাম। অনেকেই এ রকম করে অবশ্য। শিক্ষানবিস অনেক আছে ওখানে। অভিনেত্রী হতে চায় ওরা। যাই হোক, মিসেস লেসিং কিছু বলেননি আমাকে। অভিজ্ঞ একজন বিউটিশিয়ান এসে তখন তার চুল ঠিক করে দিয়েছিল। নিয়মিতই তিনি ওখানে যেতেন। কথা হত আমার। সঙ্গে। হপ্তা দুই আগে আমাকে বললেন, তিনি কিছুদিনের জন্যে ইউরোপে। যাচ্ছেন। হাউসকীপার একা থাকতে ভয় পায়। আমি চাইলে তার বাড়িতে থাকতে পারি। রাজি হয়ে গেলাম।

ভাল করেছেন। থাকাখাওয়ার জায়গা হয়ে গেলে সুবিধে। আপনি নিশ্চয় অভিনয় প্র্যাকটিস করার অনেক সুযোগ পাচ্ছেন।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। তার মনের কথাটা কি করে বুঝে ফেলল ভেবে অবাক হয়েছে। লুই গনজাগা বলল তোমরা নাকি বেশ চিন্তায় আছ।

দারোয়ান?

হ্যাঁ। সতর্ক হয়ে কথা বলছে বেটি। কিশোর কে, কতটা জানে তার সম্পর্কে, না জেনে সব কথা ফাঁস করতে চায় না।

ডলির ছবিটা বের করল কিশোর। টেবিলে রেখে ঠেলে দিল বেটির দিকে।

 একবার ছবিটা দেখল মেয়েটা। কিছু বলল না। ঘুরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

ডলি, কিশোর বলল। তাহলে ধরে নিতে পারি…

বার বার আমাকে ওই নামে ডাকছ কেন? রাগ করে বলল মেয়েটা। আমি বেটি। বেটসি অ্যারিয়াগো।

অভিনেত্রীরা ওরকম গালভরা নামই বেছে নেয়।

তাতে তোমার কি? কে তুমি?

আমাকে আর আমার দুই বন্ধুকে অনুরোধ করেছেন আপনার বাবা-মা, আপনাকে খুঁজে বের করে দিতে। সাগর সৈকতে পাওয়া ব্যাগটার কথা জানাল। কিশোর। সারা রাত গাড়ি চালিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁরা। আপনার মা খুব কাঁদছিলেন।

ওদেরকে তো আমি বলেছি আমি ভাল আছি। চিৎকার করে উঠল ডলি।

 স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। যাক, স্বীকার করল এতক্ষণে! আসলে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার ছিল আপনার। তাহলেই আর দুশ্চিন্তা করতেন না।

যোগাযোগ! জোর করে ধরে নিয়ে যাবে তাহলে!

কিন্তু কি যে কষ্ট পাচ্ছেন। তারা কল্পনা করতে পারবেন না। একবার ফোন করেও তো বলে দিতে পারেন…

ঠিক আছে, বাবা, দেব!

ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খানিকটা চা কাপড়ে ফেলে দিল ডলি। সিঙ্কের কাছে একটা দেয়াল টেলিফোন রয়েছে। সেটার বোতাম টিপতে লাগল দ্রুত।

চেয়ে রয়েছে কিশোর। তার কাজ শেষ।

হাল্লো!..হাল্লো! আম্মা?…আরে, হা হা, আমি! ডলি! যে ছেলেটাকে আমাকে খুঁজতে পাঠিয়েছ, এখানেই বসে আছে। …হ্যা…

থেমে ওপাশের কথা শুনতে লাগল ডলি। আবার বলল, না, আমি আসতে পারব না। খুব ভাল আছি। ছেলেটা বলল, তাই…

আবার কথা শুনতে লাগল ডলি। রেগে গেল হঠাৎ। যা বলার বলেছি! আমি আসব না! এখানে একটা চাকরি করছি আমি। থাকার চমৎকার জায়গা পেয়েছি। কিছুদিন ক্লাস করতে হবে আমাকে…

কিছুক্ষণ চুপ করে শুনুল আবার। কিসের ক্লাস জানো না? কতবার বলব! অ্যাকটিং ক্লাস, অভিনয় শেখায় যেখানে। ওসব অ্যালজেব্রা-ফ্যালজেব্রার মধ্যে কোনদিনই যাব না আমি আর।

ওপাশের কথা শুনে খেঁকিয়ে উঠল, আব্বার শরীর খারাপটা কি আমি করেছি। নাকি? তোমাকে ফোন করাটাই একটা গাধামি হয়ে গেছে। খটাস করে ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিল ডলি। গজগজ করতে লাগল, যত্তসব! কারও কথা শোনাই উচিত না! কিশোরের দিকে চোখ পড়তে বলল, বাড়ি ফিরে যেতে বলে! গেলে কি হবে জান? আবার ধরে ইস্কুলে পাঠাবে। গলা টিপে মেরে ফেলার অবস্থা করবে। তারপর যখন কতগুলো ছাইপাশ হজম করে ইস্কুল থেকে বেরোব, ওদের পছন্দ করা কোন হাঁদার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে! ব্যস, গেল আমার লাইফ!

কি বলবে? জবাব খুঁজে পেল না কিশোর।

.

০৭.

সেদিন সন্ধেবেলা রকি বীচে পৌঁছলেন ডিকসনরা। মেরিচাচীর সঙ্গে ইয়ার্ডে কাজ করছিল তিন গোয়েন্দা, গাড়ির শব্দে ফিরে তাকাল। বাড়ি ফিরেই আগে নেসোতে ফোন করেছিল কিশোর। ডলির ঠিকানা দিয়েছিল, কি কি কথা হয়েছে বলেছিনা। তাহলে এখানে কেন ওরা?

খাইসে! মুসা বলল। কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে!

বেরিয়ে এলেন মিসেস ডিকসন। ডলিকে পেয়েছ! হাসছেন, কিন্তু চোখ লাল। অনেক কেঁদেছেন বোঝা যায়।

হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। ফোনেই তো সব বললাম।

মুসার দিকে তাকালেন মিসেস ডিকান। চোয়াল এখনও নীল হয়ে আছে, যেখানে ঘুসি খেয়েছিল? আজেবাজে লোকের সঙ্গে মিশছে না তো ডলি?

না, মাথা নেড়ে বলল মুসা।

মিস্টার ডিকসনও বেরিয়ে এলেন। মেয়েটা এখন বাড়ি গেলেই হয়।

আপনাদের তো চেশায়ার স্কোয়্যারে যাওয়ার কথা, কিশোর বলল। কোন গোলমাল?

আসলে, হাসলেন মিসেস ডিকসন। তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়েই যাব ভাবলাম। আমরা গেলে হয়ত ভাগিয়ে দেবে। তোমরা যদি একটু বলেকয়ে…

মেয়েকে ভয় পায় ডিকসনরা, বুঝে ফেলল কিশোর। তেতো হয়ে গেল মন। এদের সঙ্গে দেখা না হলেই ভাল হত, ভাবতে লাগল সে।

সরে গেল মুসা। জঞ্জালের কাছে গিয়ে অযথাই কি যেন খুঁজতে লাগল। রবিন একটা চেয়ার পরিষ্কারে মন দিল।

কিন্তু এমন অনুরোধ শুরু করল ডিকসনরা, গাড়িতে উঠতে বাধ্য হল তিন গোয়েন্দা। আবার চেশায়ার স্কোয়্যারে চলল।

লুই গনজাগা নেই গেটে। আরেকজন দারোয়ানের ডিউটি তখন। লেসিং হাউসের মেয়েটার মা-বাবা তাকে দেখতে এসেছেন শুনে খুশি হল সে।

দেখুন, বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিয়ে যেতে পারেন কিনা। গেট খুলে দিল দারোয়ান।

ওরকম করে কথা বলল কেন লোকটা! ফিরে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে আছেন মিসেস।

 কি বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেলেন, ডিকসন। সামনের ছোট পার্কটার দিকে নজর। আরও ডজনখানেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ভিক্টোরিয়ান চেহারার বাড়িটার পাশে ছেলেমেয়েরা ভিড় করছে ওখানে। ষোলো থেকে উনিশের মধ্যে বয়েস।

সবখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেলেমেয়েরা। একটা ছেলে গিয়ে উঠেছে লেসিং হাউসের ছাতে। চিমনিতে পিঠ দিয়ে বসে পায়রাকে দানা খাওয়াচ্ছে। সামার হাউসের ওপরেও উঠেছে কয়েকটা ছেলে। ড্রাইভওয়েতে ব্রেকড্যান্স করছে একটা ছেলে, ওর দিকে তাকিয়ে চেঁচাচ্ছে ওরা। উৎসাহ দিচ্ছে।

সমস্ত কোলাহলকে ছাড়িয়ে গেছে মিউজিকের আওয়াজ। ড্রাম, বাঁশি, আর আরও নানারকম বাদ্যযন্ত্রের মিশ্র শব্দে কান ঝালাপালা।

পার্টি দিচ্ছে মেয়েটা, মিসেস ডিকসন অনুমান করলেন।

একে পার্টি বলো? মুখ বাঁকালেন ডিকসন। এ তো রায়ট লেগেছে!

লেসিং হাউসের কাছ থেকে চারটে বাড়ি দূরে গাড়ি রাখলেন তিনি। হেঁটে এগোলেন। বাগানে গিজগিজ করছে ছেলেমেয়ের দল। চত্বরে আর বাড়ির পাশেও একই অবস্থা। কয়েকজনকে চিনতে পারল তিন গোয়েন্দা, পিজা শ্যাকে দেখেছিল।

বিকট বাজনার তালে তালে নাচছে কয়েকজন। চিৎকার করছে। কাগজের মোড়ক খুলে পিজা খাচ্ছে। পোশাক-আশাকও উদ্ভট। কেউ কেউ গহনা পরেছে। পরেছে বলেই গহনা বলে মনে হচ্ছে ওগুলোকে, নইলে কি জিনিস চেনাই যেত না। একটা ছেলে শার্ট-প্যান্ট কিছু পরেনি। কতগুলো কাপড়ের টুকরো শরীরে জড়িয়ে নিয়ে একগাদা সেফটিপিন দিয়ে আটকে রেখেছে। গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে একটা জীবন্ত সাপ। আরেকটা ছেলে এসব নাচানাচিতে নেই। সে গিয়ে চত্বরের পাশের সুইমিং পুলে ঢেলে, একটা মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম খালি করছে।

সামনের সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে বেলের বোতাম টিপলেন মিসেস ডিকসন। এই সময় আরও জোরালো হয়ে গেল মিউজিক। ছাগলের ডাকের মত মাআঁ মাআঁ করে উঠল কি একটা যন্ত্র।

বাড়ির পাশ ঘুরে বেরিয়ে এল একটা ছেলে। হাতে ডিটারজেন্ট-পাউডারের বাক্স। ডিকসনদের ওপর চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, বেবি, লোক এসেছে।

সামনের চত্বরে ছোট ফোয়ারাটায় গিয়ে পুরো বাক্স ঢেলে দিল সে।

বেজে চলেছে বাজনা।

ফোয়ারায় সাবানের ফেনা তৈরি হচ্ছে। ফুলে উঠল। বাইরে উপচে পড়তে লাগল ফেনা, ঘাসের ওপর দিয়ে পানির সঙ্গে বইতে শুরু করল। বাতাস এসে ঝাপটা দিয়ে কিছু ফেনা উড়িয়ে নিল। দেখতে দেখতে সাদা ফেনায় ভরে গেল। কাছের পাতাবাহারের পাতা আর গাছের ডাল।

দারুণ! চিৎকার করে নিজের শিল্পকর্মের প্রশংসা করল ছেলেটা।

তিন গোয়েন্দার মনে হল, সব কটা বদ্ধ উন্মাদ।

দরজায় কিল মারতে শুরু করলেন ডিকসন। মারতেই থাকলেন, মারতেই থাকলেন।

অবশেষে খুলে গেল দরজা। মানুষের আকৃতির আজব একটা প্রাণী যেন বেরিয়ে এল। মেকাপ করে করে ফ্যাকাসে সাদা করে ফেলা হয়েছে চামড়া। কালো লিপস্টিক।

ডলি! চিৎকার করে বললেন মিসেস ডিকসন।

এটা কিসের সাজ? তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ডিকসন। পেত্নীর?

দরজা বন্ধ করে দিতে গেল ডলি। ঝট করে একটা পা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আটকালেন তার বাবা।

ডলি! মা আমার! ককিয়ে উঠলেন মিসেস ডিকসন। মেয়েকে ধরার জন্যে হাত বাড়ালেন তিনি।

থমকে গেছে ডলি। কেঁপে উঠল ঠোঁট। চোখের কোণে পানি টলমল করল। ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ল মায়ের বুকে। জাপটে ধরল। মেয়ের ভুরুতে লাগানো কালো মাসকারা দাগ করে দিল মায়ের সাদা ব্লাউজ, কিন্তু পাত্তাই দিলেন না তিনি।

দরজায় হেলান দিলেন ডিকসন। চুপ করে আছেন। মা মেয়ের মিলন নাটক চলছে, তা-ই দেখছেন নীরবে। মা কাঁদছে, মেয়েও কাঁদছে। মিনিটখানেক পরে ওদের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন।.স্টেরিও সেটটা দেখতে পেলেন, যেটা থেকে বেরোচ্ছে বিকট শব্দ। বন্ধ করে দিলেন।

 আচমকা এই নীরবতা যেন বড় বেশি কানে বাজল।

হৈ চৈ কমে গেল অতিথিদের। ওরা বুঝতে পেরেছে, বয়স্ক মানুষ ঢুকেছে। পিছলে সরে যেতে শুরু করল যেন সকলে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই মা-বাবার সঙ্গে একা হয়ে গেল ডলি। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে পিজার মোড়ক, আর খাবারের ভুক্তাবশেষ। নোংরা করে রেখেছে। তিন গোয়েন্দার মনে হল, এই নরকে ঢোকার চেয়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসে থাকা অনেক ভাল।

পার্টির লোকজনকে ভোজবাজির মত মিলিয়ে যেতে দেখে কান্না থামাল ডলি। ক্ষোভ জমতে লাগল মনে। শেষে সেটা প্রকাশই করে ফেলল, দিলে তো সব নষ্ট করে। আমার সব কিছুই এরকম করে নষ্ট কর তোমরা! চিৎকার করে উঠল, আমার পাটি নষ্ট করেছ! তা-ও যদি আমার টাকায় হত, এক কথা ছিল। সব করছে রোজার, আমার সম্মানে। কত কষ্ট করে কন্ট্রাক্টটা…

কন্ট্রাক্ট? মা-ও চেঁচিয়ে উঠলেন। কিসের কন্ট্রাক্ট?

কিসের আর! ড্রাকুলার! কি যে একখান ছবি হবে!..আম্মা, দেখলে তো আমি ভাল আছি। খামোকাই আমার জন্যে চিন্তা কর। অনেক শিখছি আমি। কিছু পয়সাও জমিয়েছি। ছবিতেও কাজ পেয়েছি। সব চেয়ে ভাল চরিত্রটা। ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস সাজতে হবে আমাকে।

 চোখের পানি মুছে গেছে। ঝকঝক করে জ্বলছে এখন। তাহলে বুঝতেই পারছ, অবশেষে কাজ একটা জোগাড় করেছি আমি।…ওই তো, রোজার। ইয়ান। রোজার। হাত নেড়ে ডেকে বলল, মিস্টার রোজার আসুন, এই যে আমার আব্বা আর আম্মা।…আম্মা, তুমি ভাবতেও পারবে না আমাকে কিভাবে নিয়েছেন মিস্টার রোজার। দেখেই বুঝে গেলেন, ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেসের চরিত্রটা আমাকেই দেয়া উচিত। আমিই পারব।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল লোকটা। এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল ঠোঁটে। তাড়াতাড়ি বলল, গুড ইভনিং।

তাকিয়ে রয়েছেন মিসেস ডিকসন। গোঁ জাতীয় বিচিত্র একটা শব্দ বেরোল ডিকসনের কণ্ঠ থেকে।

রোজারের বয়েস তিরিশ হবে। মসৃণ চেহারা। তেমনি মসৃণ বালিরঙা চুল। কান ঢেকে আছে। পোশাক-আশাকও মসৃণ, একটা ভঁজ নেই কোথাও।

ডলির আম্মা! মিসেস ডিকসনের দিকে তাকিয়ে বলল রোজার। কণ্ঠস্বরও মসৃণ, পোশাক আর চেহারার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। মা-মেয়ের চেহারা একেবারে এক। না বললেও চিনতাম।

কতোটা সত্যি বলেছে লোকটা, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তবু খুশি হলেন। মিসেস ডিকসন। আরও খুশি হলেন যখন তার একটা হাত হাতে তুলে নিল রোজার, যেন সাত রাজার ধন পেয়ে গেছে, এমনি ভঙ্গিতে। আপনারা এসেছেন, কি যে খুশি হয়েছি আমি। মনে হচ্ছে, এতদিন কেন দেখা হয়নি। আমিও ভুল করেছি। বেটসির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট সই করার আগে আপনাদের অনুমতি নেয়া উচিত ছিল। তাতে দেরি হত অবশ্য। হলে হত।

বিড়বিড় করে কি যেন বললেন মিসেস।

এমন মুখভঙ্গি করলেন ডিকসন, যেন পচা ইঁদুরের গন্ধ পেয়েছেন। ড্রাকুলা, না? ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা?

ওটারই সীকল। পরের ঘটনা নিয়ে কাহিনী। একজন অভিনেত্রী চাইছিলাম। আমরা, অপরিচিত নতুন একজন, যে মিনার চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। ব্রাম। স্টোকারের কাহিনী পড়ে আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, ড্রাকুলার চেহারা দেখার পর আর তার ভোঁতা স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হবে না। হতে পারে না। জোনাথন হারকারটা কোন কাজেরই না তো, তাই ভ্যাম্পায়ারই হয়ে যেতে চাইবে মিনা। ড্রাকুলার সঙ্গে প্রেম করতে চাইবে। আর তা-ই করাব আমরা আমাদের ছবিতে। উপায় একটা বের করে ফেলেছি মিনাকে ড্রাকুলার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়ার।

কি করে? ডিকসনের কণ্ঠে সন্দেহ। যতদূর মনে পড়ে, ধুলো হয়ে গিয়েছিল। ড্রাকুলা।

তাতে কি? আমাদের মত জ্যান্ত মানুষের নিয়ম মানে না ভ্যাম্পায়াররা। ওদের জগতে অন্য রীতি। এমন ভাবভঙ্গি করছে রোজার, যেন গিয়ে বেড়িয়ে এসেছে জীবন্ত ভূতদের ওই জগৎ থেকে। আমাদের ছবিতে ধুলো থেকে ভ্যাম্পায়ারকে ফিরিয়ে আনার কৌশল জেনে যাবে মিনা। তারপর দুজনে মিলে একটা নতুন গল্প তৈরি করবে।

গলা টিপে ধরা হয়েছে যেন, এরকম শব্দ করলেন ডিকসন। ওই মুহূর্তে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল কে যেন।

ও, পরিচয় করিয়ে দিই, মসৃণ কণ্ঠে বলল রোজার। আমার সহকারী হ্যারিসন রিভস। নাটক না করে আসরে আসতে পারে না ও। ঢোকার সময় কিছু একটা করা চাই-ই। তার যুক্তি, এতে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সুবিধে। হ্যারি, এস। ওঁরা বেটসির আব্বা-আম্মা।

 গোলগাল চেহারা রিভসের। রোজারেরই বয়েসী। তবে বেশভূষায় একেবারে বিপরীত। রোজার যেমন, মসৃণ, সে তেমনি খসখসে। তার কালো, কোকড়া চুলগুলো খাটো, কান বেরিয়ে আছে। গোল গোল চোখ। নাকটা মুখের তুলনায়। ছোট। সিঁড়ির গোড়া থেকে ওঠার সময় একটা হাসি দিল। বোকা বোকা লাগল। হাসিটা।

ও তাই নাকি, তাই নাকি…, বলতে বলতে এগিয়ে এল রিভস। জুতোর গোড়ালিটা বেধে গিয়েছিল…

এই কিছুদিন আগেও টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের সঙ্গে যুক্ত ছিল রিভস, রোজার জানাল। কয়েক হপ্তা আগে অনেক জোরজার করে রাজি করিয়েছি ওকে ইয়ান ফিল্মসে কাজ করার জন্যে। হরর ছবি তৈরিতে তার জুড়ি কমই আছে। লোককে ভয় দেখাতে, চমকে দিতে ওস্তাদ। মানুষের মনের সমস্ত অলিগলি তার চেনা। পারেও সে জন্যেই। আমাদের ছবির দর্শকরা টের পাবে আতঙ্ক কাকে বলে। ছবি দেখে বেরিয়েই যে ভুলে যাবে, তা পারবে না। ভয়টা অনেক দিন চেপে থাকবে মনের ওপর।

সাংঘাতিক! শুকনো গলায় বললেন ডিকসন।

ডলি, মিসেস ডিকসন বললেন। আয়, একটু বসা যাক। কথা বলি।

আবার কি কথা? মনে হলো আবার রেগে যাবে ডলি। যা বলার তো বলাই হল। আর কি??

অবাক মনে হলো রোজারকে। ডলি? আমি তো ভেবেছিলাম তোমার নাম বেটসিই। কিন্তু ভাবি-অভিনেত্রীর চোখে আগুনের ঝিলিক দেখেই তাড়াতাড়ি সামলে নিল, ও, বুঝেছি বুঝেছি। আমি একটা গাধা। ভুলেই গিয়েছিলাম। আসা নামে অনেকেই পরিচিত হতে চায় না সিনেমায়। বেটসি তোমার স্টেজ নেম। তোমার আব্বা-আম্মার সঙ্গে একলা থাকতে চাও তো? থাক। এতদিন পরে দেখা, ইচ্ছে তো করবেই। আমি দুএক দিনের মধ্যেই যোগাযোগ করব। ডিকসনের দিকে তাকাল রোজার। আমাকে আপনাদের দরকার হলে, কিংবা কোন প্রশ্ন করার থাকলে দয়া করে এই নাম্বারে একটা রিঙ করবেন।

মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দিল সে।

আপাতত মেষপালকের জীবন যাপন করতে হচ্ছে আমাকে আর রিভসকে, যেন দুঃখে মসৃণ কণ্ঠটা আরও মসৃণ হয়ে গেল রোজারের। পাহাড়ের ওপরে একটা বাড়িতে থাকি আমরা। বাড়িটা ক্রুগার মনটাগোর। বিশ্বাস করবেন, সকালে বাড়ির পেছনের পাহাড়ে ভেড়ার ডাকে ঘুম ভাঙে আমাদের? নাহ, আর পারা যায় না। বাড়িতে একটা ফোন পর্যন্ত নেই। তবে আপনাদের অসুবিধে হবে না। আমার সেক্রেটারি আপনাদের ফোন ধরবে, খবরটা ঠিকই পৌঁছে দেবে আমাকে।

কার্ডটার দিকে না তাকিয়েই পকেটে রেখে দিলেন ডিকসন। কঠিন কণ্ঠে বললেন, আমার মেয়ের যেন কোন ক্ষতি না হয়, এই বলে দিলাম। তাহলে জেল খাঁটিয়ে ছেড়ে দেব।

আব্বা! চিৎকার করে উঠল ডলি।

আপনার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি, ডিক্সনের কথা গায়েই মাখল না। রোজার। বাপ তার মেয়ের জন্যে অস্থির হবেই। মসৃণ ভঙ্গিতে বাউ করে সহকারীর হাত ধরে টেনে নিয়ে দরজার দিকে এগোল সে।

সামান্যতম নরম হলেন না ডিকসন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, অনেক হয়েছে। কয়েকটা কথা খোলাসা করে নেয়া দরকার!

.

০৮.

 ডলি, মা আমার, মিসেস ডিকসন বললেন। তুই জানিস তোকে আমরা ভালবাসি। বিশ্বাস করি।

কই করি? স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন ডিকসন।

এড়িয়ে গেলেন মিসেস। মস্ত একটা সুযোগ তুই পেয়েছিস। তোকে আমরা সাহায্যই করব, কিন্তু…।

নরিয়া, কি বলছ তুমি? চিৎকার করে উঠলেন ডিকসন।

স্বামীর দিকে তাকালেন মিসেস ডিকসন। ও আমাদের মেয়ে বটে। কিন্তু আজ হোক কাল হোক বাড়ি তো ছাড়তেই হবে। চিরকাল তো আর বাপের ঘরে থাকবে না। তাছাড়া:তাছাড়া এখন ও বড় হয়েছে। বেশ, তোমার আপত্তি থাকলে আমিই নাহয় এখানে থেকে যাই ওর সঙ্গে।

কোন দরকার নেই! কচি খুকি নই আমি! চেঁচিয়ে উঠল ডলি। তাছাড়া থাকবে কি করে? এটা তোমার বাড়ি না। আমারও না। মিসেস লেসিঙের। আমাকেই থাকতে দেয়া হয়েছে দয়া করে। আরেকটা কথা তোমাদের জানা থাকা দরকার, একটা বিউটি পারলারে চাকরি করি আমি।

 ওসব কিছুই করার দরকার নেই, গম্ভীর হয়ে বললেন বাবা। আমরা যা করতে বলব, তাই করতে হবে। বাড়িতে থাকতে হবে তোমাকে।

আহ, থাম না পিটার। আমাকে কথা বলতে দাও। তোমার সঙ্গে ও কখনোই সহজ হতে পারে না।

না পারলে না, পারুক। পারার দরকারও নেই। আমি তার বাবা, ব্যস, যথেষ্ট।

ঘোঁৎ ঘোঁৎ করলেন। কয়েকবার হুমকি দিলেন। তবে আস্তে আস্তে গলার জোর কমে আসতে লাগল তার। সুযোগ বুঝে দরজার দিকে তাকে টেনে নিয়ে চললেন মিসেস ডিকসন। বেরোনোর আগে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। মানিব্যাগ বের করলেন। এগিয়ে এসে কয়েকটা নোট মেয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, সাবধানে থেক। বেরিয়ে গেলেন গাড়িতে ওঠার জন্যে।

মুসা আর রবিনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না কেউ। এই পারিবারিক ঝগড়ার মাঝে পড়ে অস্বস্তি বোধ করছে তিন গোয়েন্দা। হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল। ডলিকে তো পাওয়াই গেছে, আর থেকে কি হবে?

ডিকসন দম্পতিকে অনুসরণ করে ওরাও বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল। হঠাৎ বলে উঠলেন মিস্টার ডিকসন, ছবি না কচু! ওই ব্যাটা ছবির প্রযোজক হয়ে থাকলে আমি আমার কান কেটে ফেলব।

চলতে আরম্ভ করল গাড়ি। চেশায়ার স্কোয়্যার থেকে বেরিয়ে পাহাড়ী পথ ধরে নেমে চলল মেন রোডের দিকে।

হয়ত তোমার কথাই ঠিক, মিসেস বললেন শান্ত কণ্ঠে।

হয়ত মানে?

মিস্টার রোজারকে চমৎকার লোক মনে হলো আমার। তবে আরেকটু খোঁজখবর নেয়া দরকার তার সম্পর্কে। না নিলেও অবশ্য ক্ষতি নেই।

 কি ভেবে ছেলেদের দিকে ঘুরলেন তিনি। একটা কাজ করতে পারবে? ওর কার্ড আছে আমাদের কাছে। কাজটা করতে পারবে? তোমরা চালাক ছেলে, ডলিকে যে ভাবে বের করে ফেললে, তাতেই বুঝেছি। জানতে পারবে মিস্টার রোজার সত্যিই ছবির প্রযোজক কিনা?

গুঙিয়ে উঠল মুসা।

তা বোধহয় পারা যাবে, কিশোর জবাব দিল। ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে খোঁজ নিলেই জানা যাবে। তবে প্রযোজক হওয়ার জন্যে কোন সমিতি কিংবা সংগঠনে যোগ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। টাকা থাকলেই হলো। আর ছবির ব্যাপারে সামান্য ধারণা। আসল কাজটা পরিচালকই করে দেয়।

ওই লোকটা একটা ধোঁকাবাজ! গোঁ গোঁ করে উঠলেন মিস্টার ডিকসন। ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস! কি একখান আইডিয়া! গল্পের ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই তার। আর ওর সহকারী, ওটা তো আরেক হাঁদা। ইচ্ছে করে সিঁড়ি থেকে পড়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ..হাহ! ধরে পাগলা গারদে পাঠানো উচিত।

মেন রোড ধরে চলতে চলতে মোড় নিলেন তিনি। স্যালভিজ ইয়ার্ডের দিকে। চললেন। নরিয়া, এভাবে মেয়েটাকে একলা ছেড়ে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। এক কাজ করা যেতে পারে। তুমি থাকো, চোখ রাখো। আমি বাড়ি চলে যাই।

মাথা নাড়লেন মিসেস। না, তা করব না। ডলি এখন বড় হয়েছে। তাকে তার পছন্দমত চলতে দেয়া উচিত। আমরা বেশি নাক গলাতে গেলে অকর্মণ্য বানিয়ে ফেলব শেষে।

 আবার কিছুক্ষণ ঘোঁৎ ঘোঁৎ করলেন ডিকসন। নানা রকম ভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলেন স্ত্রীকে, মেয়ের ক্ষতি হতে পারে, বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিছুতেই যখন বুঝলেন না মিসেস, তখন হুমকি দিতে লাগলেন। তাতেও কাজ হল না। অবশেষে ইয়ার্ডটা দেখা গেল। গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে পকেট থেকে ইয়ান রোজারের কার্ডটা বের করে কিশোরের হাতে দিয়ে বললেন, কিছু জানতে পারলে ফ্রেনসোতে ফোন কোরো আমাদের। সত্যি কথাটা জানা দরকার। মাথা খারাপ না হলে ডলিকে কেউ কোটি কোটি টাকার একটা ছবিতে স্টার বানাবে না। ও ছবির কি বোঝে?

বোঝে, বোঝে, মিসেস বললেন। বুঝবে না কেন? বড় হয়নি?

.

পরদিন খুব সকালে হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা।

আমাদের কাজ এখন, কিশোর বলল। ইয়ান রোজার সত্যিই প্রযোজক কিনা এটা জানার চেষ্টা করা।

গোলমালের দিকেই যত ঝোঁক মেয়েটার, রবিন মন্তব্য করল। কিশোর, লেসিং হাউসে যে চোর ঢুকেছিল, তার সঙ্গে এই ছবিটবি বানানোর কোন যোগাযোগ নেই তো?

নাহ্, মাথা নাড়ল মুসা। তা বোধহয় নেই। চোর যখন-তখন যার-তার বাড়িতে ঢুকতে পারে। এর মধ্যে কোন রহস্য নেই।

তা ঠিক, মুসার সঙ্গে একমত হল কিশোর। এ সময়ে মিস্টার ক্রিস্টোফার হলিউডে থাকলে কাজ হত। তাকে একটা ফোন করলেই রোজারের খবর জেনে যেতে পারতাম।

নেই তো কি আর করা, হাত ওল্টাল মুসা। অন্য ভাবেই কাজ করতে হবে। আমাদের।

মিস্টার সাইমনের সাহায্য নেয়া যায় না? পরামর্শ দিল রবিন।

বোধহয় যায়। হুম! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। বিড়বিড় করল আনমনেই। ভিকটর সাইমন! তিনিও যেহেতু গোয়েন্দা…দাঁড়াও, ফোন করি।

 আরও একটা কথা ভুলে গেছ, মনে করিয়ে দিল রবিন। সিনেমার সঙ্গে তারও যোগাযোগ আছে। চিত্রনাট্য লেখেন। ইয়ান রোজারের কথা তিনিও শুনে থাকতে পারেন।

ভাল কথা মনে করেছ তো! ডায়াল করতে শুরু করল কিশোর।

ফোন ধরল ভিকটর সাইমনের ভিয়েতনামী কাজের লোক, নিসান জাং কিম। জানাল, তিনি নেই। ইডাহোতে একটা ছবির শুটিঙে দলের সাথে গেছেন। কয়েক দিন লাগতে পারে ফিরতে। কয়েক হপ্তাও হতে পারে। ঠিক করে বলে যাননি। ফিরলে তোমাদের কথা বলব।

কিমকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কেটে দিল কিশোর। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, নেই। ওভাবে সাহায্য পাওয়া যাবে না। রোজারের কার্ডটা আছে। চলো, তার অফিসে চলে যাই।

ওর সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে? রবিন বলল। কিন্তু ওদেরকে বেতনই দেয়া হয় বাইরের লোক ঠেকানোর জন্যে। কথা গোপন রাখার জন্যে।

না বললে না বলবে। অফিসে গেলেই অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব।

রেন্ট-আ-রাইড অটো রেন্টাল কোম্পানিতে ফোন করল কিশোর। হ্যানসনকে চাইল। আছে। আর রোলস রয়েসটাও আছে। গাড়িটা পাঠাতে অনুরোধ করল সে।

চকচকে রোলস রয়েস নিয়ে হাজির হয়ে গেল হ্যানসন। মেরিচাচীর চোখে, পড়ল প্রথমে। গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। তারমানে সারাদিনের জন্যে লাপাত্তা হবি। কিশোর, তোকে যে কাজটার কথা বলেছিলাম তার কি হবে?

কাল করে দেব, চাচী। মিস্টার ডিকসনের একটা জরুরী কাজ করতে যাচ্ছি আমরা।

সব সময় কথা তৈরিই থাকে মুখে, নাক কুঁচকালেন চাচী। এমন কিছুই বলিস, যাতে মানা করা না যায়।

গাড়িতে উঠল তিন গোয়েন্দা। রোজারের কার্ডটায় সানসেট ট্রিপের ঠিকানা। দেয়া আছে। যেতে বলল হ্যানসনকে। যেতে প্রায় আধঘন্টা লেগে গেল। স্ট্রিপে পৌঁছে গতি কমিয়ে দিল হ্যানসন, যাতে অফিটা খুঁজে পাওয়া যায়।

মোড়ের কাছে ওই যে পার্কিঙের জায়গা, বলল সে। রাখব ওখানে? লোকের চোখ পড়ে যায় গাড়িটার ওপর। গোয়েন্দাগিরিতে খুব অসুবিধে। নাকি লোকে দেখুক এখন, এটাই চাও?

অদৃশ্য হয়ে যেতে চাই, রবি বলল। ডলি যদি জানতে পারে, ওর প্রিয় প্রযোজকের পেছনে লেগেছি আমরা, হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলবে।

তাহলে আর কি, হাসল হ্যানসন। যা বললাম কৃরি। মোড়ের কাছে গেল। আরেকটু নিরাপদ হওয়ার জন্যে পাশের একটা গলিতে ঢুকে গাড়ি রাখার জায়গা বের করে নিল।

একসঙ্গে যাব সবাই? মুসার প্রশ্ন।

এক মুহূর্ত ভাবল কিশোর। না, বেশি লোক গিয়ে কাজ নেই। আমি একা যাব।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে রওনা হল সে।

 দোতলা একটা বাড়িতে রোজারের অফিস। নিচতলায় একটা কফি শপ আছে। তেমন চোখে পড়ার মত আহামরি কোন বিল্ডিং নয়। সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে আবিষ্কার করল কিশোর, একটা অ্যাকাউন্টিং ফার্মের সঙ্গে শেয়ারে অফিস ভাড়া করেছে ইয়ান ফিল্মস।

দরজার নবে হাত রেখেই চিৎকার শুনল কিশোর। যত্তোসব!

একটা মহিলা কণ্ঠ বলল, একজন স্টান্ট ম্যান না পেলে হবে না। প্রোডাকশন। বন্ধ রাখতে হবে। ডেভিস সাহেব তো আর রাজি হবেন না লাফটা দেয়ার জন্যে।

তাহলে তাই করা হচ্ছে না কেন? তোক জোগাড় করে নিয়ে এলেই হয়, বলল প্রথম কণ্ঠটা। রোজার নয়। অন্য কেউ, যার কণ্ঠটা মসৃণ নয় রোজারের মত। এখানে শুটিং করলে এসব গোলমালে আর পড়তে হত না। গ্রিফিথ পার্কের। পাহাড়ের সঙ্গে মেকসিকান পাহাড়ের কি এমন তফাৎ?

নবে মোচড় দিয়ে ঠেলে পাল্লা খুলে ফেলল কিশোর।

প্রথমেই চোখে পড়ল একজন মহিলাকে। ধূসর, কোকড়া চুল। চোখে রিমলেস চশমা। ডেস্কের সামনে বসে রয়েছে। হাতে টেলিফোন রিসিভার।

টাকমাথা, নীল চোখওয়ালা, একজন পুরুষ কটমট করে তাকালেন কিশোরের দিকে। তারপর গিয়ে ভেতরের আরেকটা ঘরে ঢুকে প্রাম করে লাগিয়ে দিলেন দরজা।

কি চাই? জিজ্ঞেস করল মহিলা। রিসিভার রাখল না।

 মিস্টার রোজার আছেন?

এখন অসময়। মিস্টার রোজারকে এসময়ে খুঁজতে এসেছ কেন?

ইয়ে… কাল তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। এক বন্ধুর বাড়িতে। কথা বলে মনে হল ছবিতে বোধহয় আমাকে ব্যবহার করতে পারবেন।

তোমাকে?

আমার অভিজ্ঞতা আছে। টেলিভিশনে অভিনয় করেছি। আপনাদের ড্রাকুলা ছবিতে কোন হাসির পার্ট থাকলে…

মিস্টার রোজার! চিৎকার করে ডাকল মহিলা।

মিস্টার. রোজার, এই ছেলেটার সঙ্গে নাকি কাল আপনার দেখা হয়েছিল? ড্রাকুলা ছবির কথা বলছে। ব্যাপারটা কি?

 এঘরে এসে দাঁড়ালেন মিস্টার রোজার। ড্রাকুলা? এনসিনাডার শুটিং নিয়েই তো মহা ঝামেলায় আছি, আবার কি? ড্রাকুলা নিয়ে ছবি তৈরি হবে কে বলল?

দুটো সেকেণ্ড লোকটার দিকে স্থির তাকিয়ে রইল কিশোর। পকেট থেকে কার্ডটা বের করল। নীরবে সেটা তুলে দিল লোকটার হাতে।

কার্ডের দিকে তাকিয়ে নাক দিয়ে খোঁতখোঁত করলেন ভদ্রলোক।

যে লোক এই কার্ড দিয়েছেন, তিনি বলেছেন আজ এখানে এলে দেখা হবে, কিশোর বলল। তিনি তাঁর নাম বলেছেন ইয়ান রোজার। এখন মনে হচ্ছে সত্যি কথা বলেননি তিনি।

তা তো বলেইনি। ছবিতে তোমাকে কোন কাজ দিয়েছে নাকি?

আসলে, আমাকে নয়। একটা মেয়েকে দিয়েছে। সংক্ষেপে জানাল কিশোর, ডলিকে কাজ দেয়ার কথাটা।

আমার কার্ড দিয়েছে, টাকমাথায় হাত বোলালেন রোজার। ড্রাকুলা নিয়ে ছবি বানাচ্ছি না আমি। ওসব আমি বানাইও না। আমি তৈরি করি ডকুমেন্টারি আর বিজ্ঞাপন। তোমার মত কাউকে আপাতত দরকার নেই আমার। আর মেয়েটাকে গিয়ে বলবে ড্রাকুলা ছবিতে অভিনয় করতে তাকে যে-ই বলে থাকুক, ঠিক বলেনি। মিথ্যে বলেছে। কাজটাজ কিচ্ছু দেবে না, নিশ্চয় ধোকাবজি। কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে কাজ করতে বলগে। টাকার কি খুব দরকার?

বলতে পারেন।

তোমার বন্ধু?

ঠিক তা নয়। চিনি আরকি। সবে পরিচয় হয়েছে।

তাকে একটা কথা বলবে, প্রযোজকের ব্যাপারে যেন হুশিয়ার থাকে। অনেকেই ওরকম মিথ্যে পরিচয় দিয়ে থাকে এখানে। লোক ঠকানোর জন্যে। আর যে লোক অন্যের কার্ড নিজের নামে চালিয়ে দিতে পারে, তার ব্যাপারে তো খুবই সাবধান থাকা দরকার।

 বলব। লোকটা কে কিছু আন্দাজ করতে পারেন? আপনার কার্ড নিয়ে এরকম ব্যাপার কি আরও ঘটেছে?

শ্রাগ করলেন মিস্টার রোজার। না। তবে একগাদা কার্ড তোমাকে দিয়ে দিতে পারি আমি। দেয়ার জন্যেই বানানো হয়েছে ওগুলো। যে কেউ এসে নিয়ে যেতে পারে। লোকটা দেখতে কেমন?

এই তিরিশ মত বয়েস। হালকা বাদামি চুল। সব কিছুই মসৃণ। চলন-বলন, পোশাক-আশাক, সব। বলল পাহাড়ের ওপরের একটা বাড়িতে থাকে। বাড়ির মালিকের নাম ক্রগার মনটাগো।

আরামেই আছে দেখা যায়। নিরাপদে। মনটাগো মারা গেছেন। চিন্তিত দেখাল রোজারকে। মেয়েটাকে গিয়ে বলবে, এক্ষুণি যাতে কেটে পড়ে। ওই লোকের ধারেকাছেও আর না যায়। শয়তানগুলো মানুষ ঠকানোর তালে থাকে। নাম্বার ওয়ান ঠগবাজ একেকটা। মাঝে মাঝে ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে ওরা।

.

০৯.

 চেশায়ার স্কোয়্যারের গেটে এসে থামল রোলস রয়েস। ডিউটিতে রয়েছে লুই গনজাগা। তার ছোট্ট ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল বিশাল গাড়িটার দিকে।

ছেলেদের ওপর চোখ পড়তেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, আরিব্বাপরে, কি গাড়ি নিয়ে এসেছ! সত্যি বলছি, অবাক করেছ আমাকে! বেটসি জানে এটার কথা? নাকি সারপ্রাইজ দিতে এসেছ?

সারপ্রাইজ তো বটেই, মুসা বলল। আমরা যা বলতে এসেছি, শুনলে রীতিমত ভরকে যাবে। কারেন্টের শক খেলেও অতটা চমকাবে না।

ঘরে আছে? জানতে চাইল কিশোর।

আছে। লম্বা চুলওয়ালা লোকটা আর তার উজবুক সহকারীটা এসেছিল খানিক আগে। চলে গেছে। দাঁড়াও, ডাকছি।

ছোট ঘরে ফিরে গেল দারোয়ান। জানালা দিয়ে দেখা গেল, টেলিফোন করছে। কানে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। আছে তো আছেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অবশেষে নামিয়ে রাখল।

ধরছে না কেউ, জানাল দারোয়ান।

বাইরে-টাইরে যায়নি তো? রবিনের প্রশ্ন।

মাথা নাড়ল গনজাগা। গেলে দেখতাম।

সতর্ক হয়ে উঠল কিশোর। মিস্টার রোজারের সঙ্গে বেরোয়নি তো? ঠিক দেখেছেন?

না, বেরোয়নি। রোজারের সঙ্গে গেছে হাঁদাটা। মোটকা, কোকড়াচুলো। বেটি যায়নি।

উদ্বিগ্ন হলো দারোয়ান। তার ওপর আদেশ রয়েছে, ভালমত না জেনে, না চিনে যাতে স্কোয়্যারে কাউকে ঢুকতে না দেয়। দেখি, আবার চেষ্টা করি।

আবার গিয়ে ঘরে ঢুকল সে। রিসিভার তুলে বোতাম টিপল। কানে ঠেকিয়ে অপেক্ষা করল। এবারেও সেই একই ব্যাপার। ধরল না কেউ। হাত নেড়ে রোলস রয়েসটাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিল সে। কিশোররা নিজেই গিয়ে যাতে দেখতে পারে।

দরজায় ধাক্কা দেবে, বলে দিল সে। না খুললে গিয়ে দেখবে সুইমিং পুলে। কোথাও না পেলে সোজা চলে আসবে আমার কাছে। তারপর দেখব কি করা যায়।

ছোট পার্কটার কাছে এনে গাড়ি রাখল হ্যানসন। নীরব হয়ে আছে লেসিং হাউস। আগের সন্ধ্যার মত সরব নয়। তবে পাটি যে একটা হয়েছিল, তার চিহ্ন এখনও রয়েছে। কাগজের কাপ, প্লেট, মোড়ক আর নানারকম জঞ্জাল পড়ে রয়েছে। এখানে ওখানে, ঝোপঝাড়ের নিচে। হাঁটার সময় পায়ের নিচে পড়ছে।

প্রথমে কলিংবেলের বোতাম টিপল কিশোর। কয়েকবার টিপেও কারও সাড়া পেল না। দরজা খুলতে এল না কেউ।

ডলি নেই, রবিন বলল।

কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, বলল কিশোর। আমি শিওর।

আমি গেটে যাচ্ছি, মুসা বলল। দারোয়ানের কাছে নিশ্চয় মাস্টার কী আছে।

দৌড় দিল সে। রোলস রয়েসটার পাশ কাটাল। ভেতরে অপেক্ষা করছে হ্যানসন।

কিশোর আর রবিন বাড়ির পাশ ঘুরে এগোল। দেখল, বাইরে কোথাও আছে কিনা ডলি। পেল না।

আবার সামনের চত্বরে ফিরে এসে দেখল দারোয়ানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। হ্যানসনও নেমে এসেছে গাড়ি থেকে। সবাই উৎকণ্ঠিত। মাস্টার কী আছে দারোয়ানের কাছে। দরজার তালা খুলল। হলে ঢুকল সবাই। আগের সন্ধ্যার পার্টির চিহ্ন এখানেও রয়েছে।

ডলি! চিৎকার করে ডাকল কিশোর।

জবাব দিল না কেউ।

খুঁজতে আরম্ভ করল ছেলেরা। নিচতলাটা দেখতে বেশি সময় লাগল না। তারপর ওপরতলায় চলল ওরা। তাদের সঙ্গে চলল লুই গনজাগা। হ্যানসন। নিচতলায় পাহারায় রইল।

ওপরতলার দরজাগুলো বন্ধ। একের পর এক খুলতে লাগল দারোয়ান। ভেতরে উঁকি দিল ছেলেরা। আবছা অন্ধকার, অব্যবহৃত বেডরুমগুলোর পর্দা টানা। হলের শেষ মাথায় একটা ঘর দেখা গেল, যেটা হরদম ব্যবহৃত হয় বলে। মনে হল। বেশ বড় একটা বিছানা। লাল রঙের চাঁদরের একটা ধার ওল্টানো। একজোড়া চপ্পল যেন ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে চেয়ারের নিচে। বিছানার পায়ের কাছটায়। পড়ে রয়েছে একটা মখমলের আলখেল্লা।

একটা জানালার পর্দা টেনে দিল গজাগা। রোদ এসে পড়ল ভেতরে। আলোকিত হয়ে গেল ঘরটা।

 মনে হচ্ছে এটাই মিসেস লেসিঙের ঘর, দারোয়ান অনুমান করল। এই বেডরুমটাই ব্যবহার করেন। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাল। ছোট একটা ট্রেতে সাজানো রয়েছে নানারকম পারফিউমের শিশি। বেটি মেয়েটা ভাল। এঘরে নিশ্চয় ঢোকে না সে। জিনিসপত্র ব্যবহার করে না। করে থাকলে ঠিক করেনি।

ঘুরতে শুরু করল মুসা। টান দিয়ে একটা দেয়াল আলমারির পাল্লা খুলল। ভেতরে এত জায়গা, ছোটখাট একটা বেডরুমই বলা চলে। কাপড় বোঝাই

মিসেস লেসিং না ইউরোপে চলে গেছেন? ভুরু কুঁচকে বলল মুসা। কি নিয়ে। গেলেন তাহলে? সবই তো ফেলে গেছেন মনে হচ্ছে?

তার কথার জবাব দিল না কেউ। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে কার্পেটের দিকে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল দারোয়ানকে, আর কোন গেট আছে? স্কোয়্যার থেকে বেরোনোর?

আছে। আবর্জনার গাড়ি আর ডেলিভারি ভ্যানগুলো ঢোকে ও পথে। সব সময় তালা দেয়া থাকে। প্রয়োজনের সময় খুলে দেয়া হয়।

চাবি কার কাছে?

চাবি নেই। ঢোকার দরকার হলে আমাকে খবর পাঠায়। গার্ডহাউসে বসে সুইচ টিপে খুলে দিই।

পাশের বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা করতে গেছে হয়ত ডলি, রবিন বলল।

মনে হয় না। এখানে কারও সঙ্গে মেলামেশা নেই ওর।

আরেকটা দরজা খুলল মুসা। আশা করেছিল আরেকটা আলমারি দেখবে। তা। নয়। ওটা বাথরুম। মার্বেল পাথরে তৈরি বাথটাবে উপচে পড়ছে সাবানের ফেনা। সাবানের গন্ধে বাতাস ভারি। মার্বেল পাথরে তৈরি একটা কাউন্টারের ওপর বসানো হয়েছে দুটো সিংক, ওগুলোতে নানারকম শিশিবোতল আর জার। উল্টে রয়েছে একটা বোতল। মার্বেলের কাউন্টারে পড়েছে হলদেটে তরল, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে মেঝেতে।

নোংরা স্বভাবের মেয়ে, মন্তব্য করল রবিন।

জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। চোখ বোলাল পুরো বাথরুমে। ও বাথরুমে থাকতে ফোন বেজেছে। উঠে গিয়ে ধরেছে। জানল, গেটে দাঁড়িয়ে আছে রোজার। তাকে ছাড়তে বলল দারোয়ানকে। গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিচে নামল দরজা খোলার জন্যে। তারপরই কিছু ঘটেছে। বিপজ্জনক কিছু। ফিরে এসে আর বাথরুমটা পরিষ্কার করতে পারেনি।

না, আমার মনে হয় ফিরে এসেছিল। লোকটার তাড়া খেয়ে এখানে এসে ঢুকেছিল। ধস্তাধস্তি হয়েছিল হয়ত। হাত লেগে উল্টে পড়েছে বোতলটা।

অতি কল্পনা করছ তোমরা, দারোয়ান বলল। অস্বস্তি বাড়ছে তার। আসলে অন্য কিছু ঘটেছে। স্বাভাবিক কিছু। মেয়েটা নোংরা। ফলে গোসল করার পর বাথরুম পরিষ্কার করেনি। পারফিউম ব্যবহার করে বোতলটা রেখেছে। উল্টে যে গিয়েছে খেয়ালই করেনি। বাথরুম এভাবে রেখেই মিস্টার রোজারকে দরজা খুলে দেয়ার জন্যে নিচে নেমে গিয়েছিল তারপর..তারপর…

তারপর কি? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। তারপর কোথায় গেল? রোজারের সঙ্গেও যায়নি, পাশের বাড়িতেও যায়নি, তাহলে গেলটা কোথায়? কি হয়েছে তার?

 ছোট তোয়ালেটা নজরে পড়ল রবিনের। ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে। দাঁড়িয়েছে। পায়ের কাছে রয়েছে ওয়েস্টবাস্কেটটা। তাকিয়ে রয়েছে ওটার দিকে।

এই, দেখে যাও! নিচু হয়ে তোয়ালেটা বের করে আনল সে। সাদা রঙের। এককোণে এমব্রয়ডারি করা একটা প্রজাপতি। মরচে-লাল দাগ লেগে রয়েছে।

এটার কি কোন গুরুত্ব আছে? প্রশ্ন করল রবিন যেন নিজেকেই।

একবার তাকিয়েই চোখ বড় বড় হয়ে গেল গনজাগার। রক্ত! দুই লাফে এগিয়ে এসে হাত বাড়াল তোয়ালেটার জন্যে। এখনও ভেজা। কিছু একটা ঘটেছে আজ সকালে এখানে। পুলিশে খবর দেয়া দরকার।

.

১০.

খবর পেয়ে চীফ ইয়ান ফ্লেচার নিজে এসে হাজির হলেন। অগোছালো নোংরা হয়ে থাকা বাথরুমে একবার চোখ বুলিয়েই গম্ভীর হয়ে গেলেন।

ভুরু কুঁচকে তাকালেন দারোয়ানের দিকে। সকালে একজন লোক দেখা করতে এসেছিল বলছ। গাড়ির নম্বর রেখেছ?

রেখেছি। গাডহাউসের লগবুকে লেখা আছে। কসম খেয়ে বলতে পারি, মেয়েটা ওই গাড়িতে করে বেরোয়নি।

কিন্তু কোন ভাবে তো নিশ্চয় বেরিয়েছে। নাহলে নেই কেন? নিচতলায় চললেন চীফ।

পড়শীদের সঙ্গে কথা বলব, আবার বললেন চীফ। কেউ না কেউ কিছু দেখে থাকবেই। এই, তিন গোয়েন্দাকে বললেন, তোমরা বাড়ি চলে যাও।

স্যার…বলতে গেল কিশোর।

চলে যাও। এখন আর কিছু করার নেই তোমাদের। যা করার পুলিশ করবে।

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরতে হলো তিন গোয়েন্দাকে, বিশেষ করে গোয়েন্দাপ্রধানকে। তাদেরকে ইয়ার্ডে ফিরিয়ে নিয়ে চলল হ্যানসন। কিছুক্ষণ থমথমে নীরবতা বিরাজ করল গাড়ির ভেতরে।

অবশেষে আর থাকতে না পেরে মুখ খুলল মুসা, রহস্যটা ঘোরালো হয়ে উঠছে।

কি বলতে চাও? রবিনের প্রশ্ন।

প্রথমে সৈকতে একটা ব্যাগ কুড়িয়ে পেলাম। মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। সহজেই হয়ে গেল কাজটা, লাইব্রেরিতে ফোন করে। কি জানলাম? ব্যাগের মালিকই হারিয়ে গেছে। তখন আবার তাকে খুঁজে বের করতে হল। করে। দিলাম। সন্তুষ্ট হতে পারলেন না বাবা-মা। আমাদেরকে তদন্ত চালিয়েই যেতে বললেন। যে লোকটা ওদের মেয়েকে কাজ দিয়েছে, তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। নিতে গিয়ে দেখলাম ভুয়া। গেলাম তখন মেয়েটাকে সতর্ক করতে। পারলাম না। কারণ, এখন মেয়েটাই গায়েব।

এবং এই প্রথম, যোগ করল কিশোর। রহস্যটা জমতে আরম্ভ করেছে। আরও মজা হল, পুলিশ, আমাদের বের করে দিয়েছে। নাক গলাতে নিষেধ করেছে।

করে তো ভালই করেছে। এই রহস্যের সমাধান করতে গেলে মাথাই খারাপ হয়ে যাবে।

এর চেয়ে জটিল রহস্যের সমাধান আমরা করেছি। বলে চুপ হয়ে গেল কিশোর।

আবার নীরবতা।

ছেলেদেরকে ইয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল হ্যানসন। ইয়ার্ডের গেটের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। বন্ধ করে রাখা হয়েছে পাল্লা। দিনের এই সময়ে, দুপুরবেলা ইয়ার্ডের গেট কখনও বন্ধ থাকে না।

চাচা-চাচী নেই নাকি? নিজেকেই প্রশ্নটা করল কিশোর।

আমি বলি কি হয়েছে, আগ বাড়িয়ে জবাব দিল রবিন। নোমে কতগুলো পুরানো বাড়ি ভেঙে ফেলার খবর পেয়েছেন রাশেদ আংকেল। ছুটে গেছেন দেখার জন্যে পুরানো পাইপ আর সিংক পাওয়া যায় কিনা।

রবিনের অনুমান ঠিক হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এরকমই করেন রাশেদ পাশা। তবে জায়গার ব্যাপারে ভুল করেছে সে। নোম যাননি তিনি। ডাক শুনে জঞ্জালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুই বেভারিয়ান ভাইয়ের একজন, রোভার। জানাল, লস অ্যাঞ্জেলেসে গেছেন একটা ভাঙা বাড়ির পুরানো মাল কিনে আনতে।

ম্যাম গেছেন রান্নাঘরে, হাত তুলে দেখাল রোভার। ঢুকেছেন অনেকক্ষণ। আমি একা। চোরের তো অভাব নেই। কখন ঢুকে কি হাতে তুলে নিয়ে যায়। কাজ। করছি। দেখতেও পারব না। তাই লাগিয়ে রেখেছি।

গেট খুলে দিল সে। জিজ্ঞেস করল, তোমরা থাকবে তো? না, আবার। বেরোবে?

থাকবে, জানাল কিশোর।

গেট আর বন্ধ করার প্রয়োজন বোধ করল না রোভার। চলে গেল নিজের। কাজে।

রবিন আর মুসা বাড়ি চলে গেল। কিশোর রইল একা। অফিসের বারান্দায়। ওঠার সিঁড়িতে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল ডালিয়া ডিকসনের কথা। কল্পনায় ভাসছে অগোছালো বাথরুম। কি ঘটেছিল? চেশায়ার স্কোয়্যার থেকে মেয়েটাকে বেরিয়ে যেতে দেখেনি দারোয়ান। রোজারের গাড়ির বুটে লুকিয়ে থাকেনি তো? নাকি একাই কোনভাবে বেরিয়ে পালিয়েছে আবার? ভোয়ালেতে রক্তের দাগের কি অর্থ?

 খচখচ করছে মন। চাচী এতক্ষণ কি করছেন? এই সময়ে তো তিনি অফিস ফেলে সাধারণত রান্না করতে যান না। আর গেলেও বড় জোর দুই কি তিন মিনিট। তাড়াহুড়া করে ফিরে আসেন। চুলায় চাপিয়ে দিয়েই। তারপর মাঝে মাঝে উঠে যান কতটা কি হল দেখার জন্যে। সাংঘাতিক একটা ব্যস্ত আর উত্তেজনাময় সময় কাটে তখন তার। নাহ, দেখতে হচ্ছে।

রোভার?

জঞ্জালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রোভার। ঘামছে।

আমি বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি, কিশোর বলল। কাজ আছে। গেট দেখবেন।

আচ্ছা।

রান্নাঘরের খোলা দরজায় এসে দাঁড়াল কিলোর।

ভেতরে কেউ নেই। চুলায়ও কিছু চাপানো নেই। মেঝেতে পড়ে আছে একটা খাবারের টিন, কেউ ফেলেছে। ঢাকনাটা খুলে গড়িয়ে গিয়ে পড়ে আছে এককোণে।

হঠাৎ শীত করতে লাগল কিশোরের।  

কান পেতে আছে। নীরব হয়ে আছে বাড়িটা। ডাকবে? মেরিচাচী কি আছে বাড়ির ভেতরে কোথাও? নাকি অন্য কেউ ঢুকে বসে আছে, যে চমকে দিয়েছে চাচীকে, হাত থেকে তখন টিনটা পড়ে গিয়েছিল তাঁর। কে চমকে দিয়েছিল? চাচীই বা এখন কোথায়?

ডাইনিং রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সে। উঁকি দিল ভেতরে। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা বাসন। সেগুলো মোছার কাপড়টাও মেঝেতে। আলমারির তাকের ড্রয়ারগুলো খোলা। নিচে পড়ে আছে আরও বাসন-পেয়ালা আর চামচ।

মুখ শুকিয়ে গেল কিশোরের। জোরে চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করল, তবে চাপা দিল ইচ্ছেটা। উচিত হবে না। যে ঢুকেছে সে এখনও বাড়িতেই থাকতে পারে। মেরিচাচীকে ভয় দেখিয়ে আটকে রেখেছে হয়ত। কিশোর উল্টোপাল্টা কিছু করলে এখন চাচীর বিপদ হতে পারে।

ডাইনিং রুমের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে এগোল কিশোর। লিভিং রুমেও একই অবস্থা। তাকের বই আর অন্যান্য জিনিস মেঝেতে ছড়ানো। টেবিলের ড্রয়ার খুলে মেঝেতে ফেলে রেখেছে। লিভিং রুমের পরে হলঘরেরও একটা অংশ চোখে পড়ছে। একটা ওয়ারড্রোব খোলা। কাপড়-চোপড় আর জুতো বের করে ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

কিন্তু মেরিচাচী নেই। দেখা গেল না কোথাও।

রাশেদ পাশার ব্যক্তিগত ঘরটাকেও রেহাই দেয়া হয়নি। তার ডেকসেট আর টার্নটেবলটা নেই। আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে স্পীকারগুলো। বেশি বড় বলেই বোধহয় অসুবিধে হবে মনে করে নেয়নি চোর। নাকি নেয়ার সময় পায়নি? কেউ এসে হাজির হয়েছিল?

হাজির! হ্যাঁ, এটাই হবে! মেরিচাচী এসেছিলেন কোন কারণে। চোরটা বাধা পেয়েছিল।

কেন এসেছিলেন চাচী, সেটাও বুঝতে পারল কিশোর। ক্যাশবাক্সটা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। মনে পড়ল, রান্নাঘর দিয়ে আসার সময় ছোট টেলিভিশন সেটটার পাশের কাউন্টারে সেটা দেখে এসেছে। নিশ্চয় চাচীই রেখেছেন ওখানে।

দ্রুত আবার রান্নাঘরে ফিরে এল কিশোর। এখনও রয়েছে বাক্সটা। ডালা খুলে দেখল, ভেতরে টাকাপয়সা ঠিকই আছে। অনেক টাকা। একশো ডলারের বেশি। সেগুলো নেয়নি চোর।

কেন? মেরিচাচীই বা কোথায়?

চাচী! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। গলা কাঁপছে।

  জবাবে বিচিত্র একটা মিশ্র শব্দ কানে এল। চাপা চিৎকার। সেই সাথে কিল মারার আওয়াজ।

প্রায় উড়ে গেল যেন কিশোর। রান্নাঘরের লাগোয়া আরেকটা ছোট ঘর আছে! অনেকটা স্টোররুমের মত ব্যবহার করা হয় ওটাকে। ওয়াশিং মেশিন আর ড্রাইয়ার মেশিনাগুলো ওখানেই থাকে। এককোণ রয়েছে একটা আলমারি, তাতে ঝাড়, ব্রাশ আর ঘর পরিষ্কারের অন্যান্য জিনিস রাখা হয়। ওটার ভেতর থেকেই এসেছে শব্দটা।

বাইরে থেকে আটকে দেয়া হয়েছে আলমারির পাল্লা, ঝুল ঝাড়নের লম্বা ভাণ্ডা দিয়ে। একটা মাথা দরজার হাতলে ঠেকিয়ে আরেক মাথা আটকে দেয়া হয়েছে ওয়াশিং মেশিনের সঙ্গে। ফলে ভেতর থেকে যত ঠেলাঠেলিই করা হোক,

চাচী, চিৎকার করে বলল কিশোর। ভেতরে আছ তুমি? আমি কিশোর!

আলমারির ভেতর থেকে চাপা কথা শোনা গেল আবার।

হ্যাঁচকা টানে ডাণ্ডাটা সরিয়ে আনল কিশোর। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আলমারির দরজা।

সফট ড্রিংকসের বোতল খুললে যেমন ফস করে আচমকা বেরিয়ে আসে গ্যাস আর তরল পদার্থ, অনেকটা তেমনি ভাবে বিশাল শরীর নিয়ে ছিটকে বেরোলেন মেরিচাচী। তার সঙ্গে বেরোল প্রচুর ধুলো, ব্রাশ আর নানারকম টিন।

কিশোর! এলি শেষতক!

টকটকে লাল হয়ে গেছে তার মুখ। ঘাড়ের কাছে চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। মেঝেতে বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন তিনি। চোখ জ্বলছে।

দাঁড়া, আগে ধরে নিই শয়তানটাকে! তারপর দেখাব মজা!

মনে মনে হাসল, কিশোর। এই মুহূর্তে লোকটা যদি মেরিচাচীর সামনে পড়ে তাহলে ওর জন্যে করুণাই হবে তার।

<

Super User