রেড লায়ন থেকে কিংকে তুলে নিয়ে ইয়ার্ডে চলে এল হ্যারি। উজ্জ্বল রোদ। ভেতরে ঢুকল বিশাল চকচকে ক্যাডিলাকটা। ওদেরকে স্বাগত জানাতে ছুটে গেল না কোনও কিশোর। নীরব চত্বরের চারপাশে চোখ বোলাল ওঁরা।

পিটার! চিৎকার করে ডাকল কিং। কিশোর!

রবিন বলেছে, হ্যারি জানাল। ওদের গোপন হেডকোয়ার্টারে রেখেছে পিটারকে। জঞ্জালের ভেতরে লুকানো। গলা চড়িয়ে ডাকল, কিশোর! কিশোর পাশা!

পিটার! কিশোর! কিংও ডাকল।

এত চেঁচামেচি কিসের! এই সক্কাল বেলা! বাড়ির কোণ ঘুরে বেরিয়ে এলেন মেরিচাচী। ফুলগাছে পানি দিচ্ছিলেন বোধহয়। এখন কটা বাজে? এত সকালে এসে চেঁচামেচি জুড়েছেন!

সরি, ম্যাম, মোলায়েম গলায় বলল কিং। ছেলেগুলোকে খুঁজছি আমরা। কিশোরকে দেখেছেন?

 ও, আপনারা, চিনতে পারলেন মেরিচাচী।

কিশোরকে খুঁজছি আমরা, হ্যারি বলল এমন ভঙ্গিতে, যেন মস্ত অপরাধ করে ফেলেছে। ও কোথায়?

জানি না। রাতে রবিন আর মুসা ছিল এখানেই। ভোর হতেই কোথায় যে গায়েব হয়েছে সৃষ্টিকর্তাও বলতে পারবে কিনা সন্দেহ! আমি তো সাধারণ মানুষ!

কিন্তু আমাদেরকে এখানে দেখা করতে বলেছে ওরা, হ্যারি বলল।

তাহলে আছে কোথাও। ওদের ওয়ার্কশপে দেখুন। বায়ের ওই যে বড় জঞ্জালটা…

থ্যাংক ইউ, বাধা দিয়ে বলল, কিং। যাচ্ছি।

প্রায় দৌড়ে চত্বর পেরিয়ে এসে ওয়ার্কশপে ঢুকল দুজনে। কাউকে দেখল না।

নেই তো! কিং বলল।

ও কি? কান পেতে শুনছে হ্যারি।

কাছাকাছি কোনখান থেকে শব্দটা আসছে। ধাতব শব্দ। সেই সাথে চাপা, গোঙানি।

ওদিকটায়,হ্যারি বলল। ওই বড় পাইপটার কাছে।

পাইপের কাছে এসে খোলা মুখ দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল ওরা। হাত-পা বেঁধে। তার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে রবিন আর মুসাকে। টেনে ওদেরকে বের করা হল। মুখের কাপড় খুলে নিতেই প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা, কিডন্যাপার!

নিয়ে গেছে ওদেরকে! রবিন বলল।

ওদেরকে? কিং বলল, পিটার আর কিশোরকে? কোথায়? কখন?

পাঁচ মিনিটও হয়নি, ককিয়ে উঠল মুসা। হয়ত আরও কম। কে কিশোর আর কে পিটার বুঝতে পারেনি, তাই দুজনকেই ধরে নিয়ে গেছে?

কথা বলতে বলতেই রবিন আর মুসার বাঁধন খুলছে দুজনে। হ্যারি। জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

জানি না!

 কি গাড়ি? লাইসেন্স নম্বর রেখেছ?

গাড়িটা দেখতেই পারিনি! জবাব দিল রবিন।

বেশি দূর যেতে পারেনি, কিং বলল। পুলিশকে…

মুসা! তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি। তোমার বুকে ও কিসের আলো? এত লাল…

ইমারজেন্সি লাইট, মুসা, চেঁচিয়ে উঠল রবিন। নিশ্চয় কিশোর! অন সুইচটা টিপে দিয়ে ডিরেকশনাল ডায়ালটা দেখ!

শার্টের বুক পকেট থেকে খুদে যন্ত্রটা বের করল মুসা। অনিয়মিত ভাবে জ্বলছে নিভছে লাল আলো। সুইচ টিপতেই টিইইপ টিইইপ শুরু করল। ডায়ালের। তীরটা ঘুরে গেল রকি বীচের কেন্দ্রের দিকে।

বেশ জোরাল! মুসা বলল। তার মানে বেশি দূর যেতে পারেনি!

শহরের দিকে চলেছে, বলল রবিন। কিং, জলদি! ওদের পিছু নেয়া যাবে। এখনও সময় আছে।

ওয়ার্কশপ থেকে ছুটে বেরোল চারজনে। ক্যাডিলাকে এসে উঠল। মুসার চোখ সিগন্যাল ডায়ালের দিকে। স্পষ্ট সংকেত দিচ্ছে যন্ত্রটা।

 ওদিকে, হাত তুলে দেখাল মুসা। সোজা শহরের দিকে।

দ্রুত গাড়ি চালাল হ্যারি। কিং তাকিয়ে রয়েছে ডায়ালটার দিকে। কি যন্ত্র? কিভাবে কাজ করে?

একই সঙ্গে দুটো কাজ করে এটা, বুঝিয়ে বলল রবিন। ডিরেকশনাল সিগন্যাল আর ইমারজেন্সি অ্যালার্ম। সংকেত পাঠাতেও পারে গ্রহণও করতে পারে। এখন ওটা কিশোরের পাঠান সংকেত ধরছে। টিপ টিপ করছে সে জন্যেই। যতই কাছাকাছি যাব জোরাল হবে, সংকেত। কোনদিক থেকে সংকেত আসছে। সেটা নির্দেশ করবে তীরটা। ইমারজেন্সি অ্যালার্ম হিসেবেও কাজ করে যন্ত্রটা, কণ্ঠস্বরেই চালু হয়ে যায়, ভয়েস কমাণ্ড। আলোটা জ্বলছে তার কারণ কিশোর এখন বলছে…

না না বলো না! চেঁচিয়ে বাধা দিল মুসা, তাহলে কিশোরের সিগন্যাল অফ হয়ে যাবে!

ঢোক গিলল রবিন। তাই তো! হেল্প শব্দটা বলতে পেরেছে হয়ত কিশোর, যন্ত্রের কাছে।

ডানে, হ্যারি, আচমকা নির্দেশ দিল মুসা। বিড়বিড় করল আনমনে, শব্দ বাড়ছে। মনে হয় থেমে গেছে কিডন্যাপাররা।

ভ্রূকুটি করল কিং। যন্ত্রগুলো একাধারে প্রেরক এবং গ্রাহক, তাই তো বললে? রবিন, কিশোর একটা যন্ত্র ব্যবহার করছে, তাই না? যেন নিজেকেই কথাগুলো বোঝাচ্ছে সে। অ্যাক্সিডেন্টালি ওর সিগন্যাল যদি বন্ধ করে দিই আমরা কি ঘটবে?

অফ হয়ে যাবে ওর বীপারটা, রবিন বলল। কিডন্যাপাররা কিছু শুনতে পাবে না। পকেট ভালমত লুকানো থাকলে আলো জ্বলাও দেখতে পাবে না।

আশা করি ভালমতই লুকানো আছে, কিং বলল ধীরে ধীরে। কারণ। সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছে ও। মারাত্মক। অ্যাক্সিডেন্টালি আমরা একটা গোলমাল করেও দিতে পারি। তাহলে সংকেত দিতে শুরু করবে ওর যন্ত্র। আর সেটা কিডন্যাপারদের চোখে পড়ে গেলে, ওরা বুঝতে পারলে একটা সংকেত পাঠানোর যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, ভয়ানক বিপদ হবে কিশোরের। বুঝে যাবে কোন ছেলেটা কিশোর!

মুখ শুকিয়ে গেল রবিনের। এ কথাটা ভাবেনি। তাগাদা দিল হ্যারিকে, জলদি, আরও জোরে চালান!  

.

কিডন্যাপারদের ভাড়া করে আনা নীল লিংকন গাড়িটা একটা সেলফ-সার্ভিস ফিলিং স্টেশনে ঢুকল। পেছনের সীটে বসে রইল, কিশোর আর পিটার, জনের সঙ্গে। ডেভ নেমে গিয়ে ট্যাঙ্কে পেট্রল ভরতে শুরু করল। কেউ এল না গাড়িটার কাছে।

সত্যি কথাটা বললে তোমাদের দুজনের জন্যেই ভাল হত, জন বলল।

সাহায্য আসছে, কিশোর বলল। আমি জানি, আসছেই। বেশিক্ষণ লাগবে না।

আমিও জানি, একমত হলো পিটার। আমার বন্ধুরা আসবেই।

আসতে দেরি হলেই বুঝবে মজা, খেঁকিয়ে উঠল ডেভ। এখনও সময়। আছে। কিশোর বেরিয়ে যেতে চাইলে তাকে চলে যেতে দেব আমরা। পরে আর সুযোগ দেয়া হবে না। এক সময় না এক সময় জানতে পারবই আমরা কোনজন। কিশোর। তখন তাকে মেরে ফেলা হবে।

কে বিশ্বাস করে আপনার কথা, পিটার বলল।

আমিও না, কিশোর বলল। আমি যে কিশোর, একথা বললেই আপনারা ছেড়ে দেবেন, মোটেও বিশ্বাস করি না আমি। সাপকে বিশ্বাস করা যায়, আপনাদেরকে না। ভয় করি না। সাহায্য আসবেই।

গাধার মত কথা বল না। ধমকে উঠল জন। কোত্থেকে সাহায্য আসবে? আর ভয়টা কিসের পাচ্ছ, শুনি? পিটার কে, সেটা জানলেও আমরা তার ক্ষতি করব না। বাঁচিয়ে রাখব আমাদেরই স্বার্থে। কারণ মেরে ফেললে তাকে দিয়ে আর কোনও কাজ হবে না। বল, কে পিটার?

আগে সাহায্য আসুক তো, কিশোর বলল। তারপর নিজেরাই দেখতে পাবেন।

কপালে দুঃখ আছে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল জন। আমরা আর কি করব!

না, আপনাদের কিছুই করার নেই, পিটার বলল। যা ইচ্ছে করবেন। এত বকবক করছেন কেন?

চড় মারার জন্যে হাত তুলেও থেমে গেল জন। ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল ডেভ। মাথা গরম কর না। সুযোগ দিয়েছি, কথা শোনেনি। পরে আর আমাদেরকে দোষ দিতে পারবে না। ছেলেগুলোকে চালাক ভেবেছিলাম, এখন দেখছি একেবারে বোকা।

.

রকি বীচের রাস্তা ধরে যতটা সম্ভব জোরে গাড়ি ছুটিয়েছে হ্যারি। তার পাশে বসে সিগন্যাল ডায়ালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। পেছনের সীট থেকে তার ঘাড়ের। ওপর দিয়ে ঝুঁকে এসেছে কিং আর রবিন, দেখার জন্যে। হঠাৎ কমে যেতে শুরু করল সিগন্যাল, দুর্বল হয়ে যেতে লাগল।

 ডানে! চিৎকার করে বলল মুসা। তীরটা ঘুরে গেছে সাগরের দিকে।

মোড় নিল হ্যারি। চওড়া একটা রাস্তা, চলে গেছে বন্দরের দিকে। সকালে প্রচণ্ড ভিড় রাস্তায়, দুদিকেই ছুটে চলেছে প্রচুর গাড়ি। আরও কমে আসছে। সংকেতের শব্দ, ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।

 দক্ষিণে ঘুরেছে! মুসা বলল।

মুসা, রবিন বলল।  নিশ্চয় হাইওয়ের দিকে চলেছে ওরা। তীরটা দেখছ? অর্ধেক উত্তরে অর্ধেক দক্ষিণে। তার মানে লস অ্যাঞ্জেলেস।

তুমি…মনে হয় ঠিকই বলেছ, ঘাবড়ে গেছে মুসা।

হাইওয়েটা কদ্দূর? জিজ্ঞেস করল কিং।

মাইলখানেক, জবাব দিল রবিন।

মাথা নাড়ল হ্যারি। যা ভিড়! কিছুতেই জোরে চালাতে পারছি না।

হাইওয়েতে আমাদের চার গুণ জোরে চালাতে পারবে ওবা, কিং বলল। তোমাদের যন্ত্রের রেঞ্জ কতোটা?

তিন মাইল, রবিন জানাল।

 জোরে চালানোর চেষ্টা করেও পারছে না হ্যারি। অসহায় লাগছে তার। পারলে গাড়ির ভিড়ের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। ডায়ালের তীর দেখছে মুসা। থিরথির করে কাঁপছে ওটা, যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কোনদিকে ঘুরবে। অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে সংকেত। দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে আসলে, সে জন্যেই হচ্ছে এরকম। এক সময় জিভারোতে চলে এল তীর, কোনও দিক নির্দেশ করছে না আর। থেমে গেল সংকেতের শব্দ। নিভে গেল লাল আলো। রেঞ্জের বাইরে চলে গেছে প্রেরক যন্ত্রটা।

গেল! মাথায় হাত দিয়ে ফেলল কিং। আর ওদেরকে ধরা যাবে না। কি গাড়ি তা-ও জানি না। কি ভাবে অনুসরণ করব? আর কোনও উপায় নেই। পুলিশের কাছেই যেতে হবে।

.

গা ঘেঁষাঘেষি করে বসেছে পিটার আর কিশোর। সীটের আরেক প্রান্তে পিস্তল হাতে বসে রয়েছে জন। চোখ বন্ধ।

কিশোরের কানে কানে বলল পিটার, মনে হচ্ছে বলে দেয়া উচিত, কিশোর। তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবে।

না, দেবে না। আমি গিয়ে সব ফাঁস করে দেব, এই ভয়ে। বিপদ আরও বাড়বে তখন আমাদের। পিটারের কোনও ক্ষতি ওরা করবে না, কিন্তু কিশোর পাশাকে ওদের কোনও প্রয়োজন নেই। অহেতুক কেন ঝামেলা রাখবে? তাছাড়া। অনেক বেশি জেনে ফেলেছে কিশোর, তাকে চুপ করিয়ে দিতেই চাইবে…

আচমকা চোখ মেলে ধমকে উঠল জন, এই, থামবে! এত কথা কিসের! যত্তোসব! একটাকে খতম করে দিতে পারলেই এখন বাঁচি!

খিকখিক করে হাসল সে। আবার চোখ মুদল। সকালের উজ্জ্বল রোদে তীব্র বেগে ছুটছে লিংকন। কে জানে কোন অজানার উদ্দেশে।  

.

১৭.

 থানার লম্বা বেঞ্চটায় বসে রয়েছে দুই গোয়েন্দা, হ্যারি আর কিং। ওদের সঙ্গে রয়েছেন মেরিচাচী আর রাশেদ পাশা। সব কথা শোনার পর মেরিচাচী ভীষণ খেপে যাবেন ভেবেছিল রবিন আর মুসা। কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে আশ্চর্য রকম শান্ত রয়েছেন তিনি।

ওই যে, কিশোরের মত ছেলেটা, হ্যারিকে বললেন তিনি। পিটার মনটেরো, আপনার দেশের লোকের কাছে খুবই মূল্যবান, তাই না? ভবিষ্যতে দেশটার স্বাধীনতার জন্যে?

হ্যাঁ, মিসেস পাশা, মাথা দোলালো হ্যারি। খুবই দামী। সিভিল ওয়ার ছাড়া একমাত্র ওর বাবাই পারে দেশটাকে স্বাধীন করতে। শান্তি আনতে। কিন্তু ওই কিডন্যাপারগুলো তা চায় না। ওরা চায় ওদের ইচ্ছে মত চালাতে। স্যার মনটেরোর ছেলেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে তাকে ওদের কথা শোনাতে বাধ্য করতে। সে জন্যেই পিটারকে উদ্ধার করা এখন এত জরুরী।

কিশোর আর তার বন্ধুরা আপনাদেরকে সাহায্য করেছিল, বলছেন, আর তখনই পিটারকে সহ কিশোরকে তুলে নিয়ে গেছে ওরা?

হ্যাঁ, তাই, জবাবটা দিল কিং।

তাহলে ঠিক কাজই করেছে ছেলেরা, যেন রায় ঘোষণা করলেন মেরিচাচী। ওরা যে আপনাদেরকে সাহায্য করেছে এ জন্যে আমি খুশি। এখন ছেলেদুটো। নিরাপদে ফিরে এলেই আরও বেশি খুশি হই আমি।

বেরিয়ে এলেন ইয়ান ফ্লেচার। গম্ভীর হয়ে আছেন। লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশকে সতর্ক করে দিয়েছি। কিন্তু ওরাই বা কি করতে পারবে বুঝতে পারছি না। গাড়িটা কি গাড়ি জানি না। লাইসেন্স নম্বর জানি না। শুধু কিডন্যাপারদের চেহারার বর্ণনা জানিয়ে দেয়া হয়েছে…

আবার সেই একই ব্যাপার, নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করলেন মেরিচাচী। কিছুই করার নেই আপনাদের। আগের বারও একই অবস্থা হয়েছিল। আপনাদের নাকের নিচে দিয়ে সব কাণ্ড করে চলেছে লোকগুলো, কিছুই করতে পারছেন না আপনারা।

সাধারণত একই জায়গায় আবার ফিরে আসে না কিডন্যাপাররা, মিসেস পাশা। ওরা যে আসবে কি করে বুঝব?

বোঝা উচিত ছিল, চীফের কথা একটুও পছন্দ হচ্ছে না মেরিচাচীর। কিশোর তো বলেইছিল আপনাদেরকে ও সাধারণ কিডন্যাপার নয়। তার কথা। শোনা উচিত ছিল।

হয়ত ঠিকই বলেছেন আপনি, মিসেস পাশা, তর্ক করলেন না ইয়ান ফ্লেচার। যাই হোক, লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করার কথা দিয়েছে। তবে পেলেও সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিতে পারবে কিনা সন্দেহ।

কেন নয়? প্রশ্ন করলেন রাশেদ পাশা।

কারণ কিশোর আর পিটারকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে। কিডন্যাপাররা। ওদের কাছে অস্ত্র আছে। যা শুনলাম, তাতে মনে হয় ওরা সাধারণ কিডন্যাপার নয়, আরমির লোক। আর ওসব লোক বড় ভয়ংকর হয়। উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে নিজের জীবনের পরোয়া করে না। মুখোমুখি হয়ে ওদেরকে ঠেকানো হয়ত যাবে, কিন্তু ছেলেগুলোর মারাত্মক বিপদ হয়ে যাবে। একটাই উপায় আছে। কোনভাবে ওদেরকে চিহ্নিত করে চুপি চুপি গিয়ে ছেলেগুলোকে উদ্ধার করে আনা।

হুঁ! ছেলেদের বিপদটা বুঝতে পেরে আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন রাশেদ পাশা।

তবে যতক্ষণ খোঁচাখুঁচি করা না হবে, কিং বলল। ক্ষতি হবে না। ছেলেগুলোর। পিটারকে মারবে না ওরা, তাহলে স্যার মনটেরোকে কথা শোনাতে পারবে না। কিশোরেরও ক্ষতি করবে না। করে কোনও লাভ নেই ওদের। শুধু। আটকে রাখবে দুজনকেই যতক্ষণ না ওদের উদ্দেশ্য সফল হয়।

তা ঠিক, চীফ বললেন। এখন একটাই জিনিস দেখতে হবে আমাদের, ছেলেগুলোকে নিয়ে যাতে আমেরিকা থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে ওরা। আচ্ছা, ওদের তো নানায় যাওয়ার কথা। দক্ষিণ লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে গেল কেন? ওখানে কি আছে?

নিশ্চয় বেরিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছে ওরা, হ্যারি বলল।

চারজনকে বেরোতে হবে! কি ভেবে হঠাৎ বলে উঠল রবিন। নিজেরা। দুজন, আর কিশোররা দুজন। ওরা জানে না কোন জুন পিটার। ওদের প্ল্যান ছিল তিনজনের বেরোতে হবে, চারজনের নয়। এতে কি প্ল্যানের পরিবর্তন করতে হবে না? হ্যারি আর কিং-এর দিকে ফিরল সে। লস অ্যাঞ্জেলেসে যাওয়ার অন্য কারণ নেই তো? হয়ত ওখানে গিয়ে কোনভাবে সনাক্ত করতে পারবে পিটারকে।

আমার জানা নেই, রবিন, কিং বলল।

নানদাতে নিয়ে গেলে হতে পারে, হ্যারি বলল। তবে লস অ্যাঞ্জেলেসে নয়। আমার মনে হয় না কোনও উপায় আছে ওদের।

মুসা বলল, নানদান ট্রেড মিশনে এমন কেউ নেই তো যে পিটারকে চিনতে, পারবে? মানে, মনটেরোদের কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু? কিংবা আত্মীয়?

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল হ্যারি আর কিং। অবাক হয়েছে। এই সহজ কথাটা কেন ওদের মনে পড়েনি ভেবে।

র‍্যামন রিভস? যেন কিং-এর কাছে জানতে চাইল হ্যারি।

স্যার মনটেরোর অনেক পুরনো বন্ধু অবশ্য তিনি, আনমনে বিড়বিড় করল। কিং। না, তাকে বোধহয় ফাঁকি দিতে পারবে না ছেলেগুলো। কি করে এখন…।

এই র‍্যামন রিভসটি কে? চীফ জানতে চাইলেন, আমেরিকায় কি করছেন?

লস অ্যাঞ্জেলেসে নানান ট্রেড মিশনের প্রধান তিনি, কিং জানাল। তবে ওই উগ্রপন্থীদের কিছুতেই সাহায্য করবেন না রিভস।

ইচ্ছে হয়ত নেই, চীফ বললেন। তবে রবিনের কথাটাও না ধরে পারছি না।  পালানোর পরিকল্পনা করেছিল ওরা তিনজন, চারজন নয়। এটা ওদের জন্যে বড় সমস্যা। এর জন্যে বেপরোয়া হয়ে উঠবে ওরা। মিস্টার রিভসকে বাধ্য করতে পারে পিটারকে চিনিয়ে দিতে। কিংবা চালাকি করে জেনে নেবে তার কাছ থেকে। এখুনি হুশিয়ার করে দেয়া দরকার।

তাহলে ফোন করি, কিং বলল। শয়তানগুলোকে বিশ্বাস নেই। আরেকটা ব্যাপার, মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ওদের। ভেতরে নিশ্চয় ওদের স্পাই আছে। ওর সাহায্যও নিতে পারে ওরা। মিস্টার রিভসকে সতর্ক করে রাখলে তিনিও হয়ত আমাদের সাহায্য করতে পারেন। ফাঁদে ফেলে দেয়া যেতে পারে কিডন্যাপারগুলোকে।

করুন। এখুনি। আমার ফোনটাই ব্যবহার করুন, চীফ বললেন।

ফোন করতে গেল কিং। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল অন্যেরা। মেরিচাচী আর বসে থাকতে পারলেন না, উঠে পায়চারি শুরু করলেন।

যদি কিছুতেই বুঝতে না পারে কোন ছেলেটা পিটার? হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

তাহলে, আমার বিশ্বাস, দুজনকেই নানদায় নিয়ে যেতে চাইবে।

আফ্রিকায়? প্রায় চিৎকার করে বললেন মেরিচাচী। ওই শয়তানগুলো নিয়ে গেলে আর বাঁচিয়ে রাখবে…

ফিরে এল কিং। মিশন অফিসে নেই রিভস। সম্ভবত হলিউডে গেছেন, জরুরী কাজে। প্রায়ই যান। অফিসের কেউ কিছু বলতে পারল না। মেসেজ রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু আমিও ওদেরকে কিছু বলতে সাহস করলাম না। কোন লোকটা বিশ্বাসঘাতক কে জানে! এখুনি আমাদের লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে যাওয়া উচিত।

হ্যাঁ, তুড়ি বাজাল হ্যারি। লোকগুলো এখনও অফিসে না গিয়ে থাকলে ওদের আগেই আমাদের গিয়ে বসে থাকা উচিত। ঘাপটি মেরে থাকব। ওরা এলেই খপ করে ধরব।

ঠিক আছে, চীফ বললেন। বুদ্ধিটা মন্দ না। আমি লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশকে জানিয়ে দিচ্ছি। মিশন অফিসের ওপর নজর রাখুক ওরা। আপনারা যাওয়ার আগে যদি মিস্টার রিভস ফিরে আসেন তাহলে তাকেও যেন সতর্ক করে দেয়, বলে রাখব।

.

জানালাশূন্য, অন্ধকার, একটা ছোট ঘরে বসে রয়েছে কিশোর আর পিটার! কয়েক ঘণ্টা হলো এখানে এনে ওদেরকে ভরেছে কিডন্যাপাররা। ঘরটা পাহাড়ের ওপর। চারপাশ ঘন গাছপালায় ঘেরা। এই অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ওরা।

কোথায় এনেছে, কিশোর? পিটারের প্রশ্ন।

হলিউড হিলের কোথাও হবে, জবাব দিল কিশোর। কারও বাড়ির স্টোররুম কিংবা সেলার এটা। ঢোকানোর সময় আলো ছিল, ঘরটায় একবার নজর বোলাতে। পেরেছিল সে। শক্ত করে ওদেরকে বেঁধে রেখে গেছে, তাই বেরোনোর পথ। খোঁজার চেষ্টাও করতে পারছে না। যদিও কিশোরের ধারণা, খোলা রেখে গেলেও বিশেষ সুবিধে করতে পারত না। পথ নেই, দেখেছে ঢোকার সময়ই।

মানে আমাদেরকে কি করবে, বল তো? আবার প্রশ্ন করল পিটার।

তোমাকে কি করবে, বলতে পারি। যেভাবেই হোক আমেরিকা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, নানদায়। তবে এখানে যে কেন রেখে গেল বুঝতে পারছ না। যদি না…

কী, কিশোর?

যদি না কারও জন্যে অপেক্ষা করে। এমন কেউ, যে তোমাকে সনাক্ত করতে পারবে।

হুঁ, ঠিকই বলেছ। দুজনকে নেয়ার কোনও ইচ্ছেই ওদের নেই। ভাবছি, তখন তোমাকে কি করবে ওরা?

আমিও তাই ভাবছি, কিশোরের কণ্ঠে অস্বস্তি।

.

দুপুরের কড়া রোদ, রেজায় গরম। উইলশায়ার বুলভারের একটা অফিসের সামনে পাকিং লটে গাড়ি সেকালেন ইয়ান ফ্লেচার। বিশাল ক্যাডিলাকটা পুলিশের গাড়ির পাশে রাখল হ্যারি। চীফ গাড়ি থেকে বেরোতেই তাড়াহুড়া করে এগিয়ে এল লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন পুলিশ।

মিস্টার রিভস ফেরেননি, চীফ, লোকটা জানাল। সন্দেহজনক কোনও লোককেও অফিসে ঢুকতে দেখিনি সারাক্ষণই চোখ রাখা হয়েছে অফিসের ওপর।

ওরা এখানে আসেনি, চীফ, মুসা বলল। ইমারজেন্সি সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কোনও সাড়া নেই যন্ত্রের।

বাড়ির ভেতরে ঢুকলে হয়ত সাড়া দিতে পারে, হ্যারি বলল।

দেখা দরকার, বলল কিং। চীফ, আমার মনে হয় আপনার এখানে থাকাই ভাল। অবশ্যই লুকিয়ে থাকতে হবে। কিডন্যাপাররা যাতে দেখতে না পায়।

দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল হ্যারি আর কিং। এলিভেটরে করে উঠে এল তিনতলায়, যেখানে রয়েছে মিশনের অফিস। বেশ সম্মান দেখিয়ে হ্যারি আর কিংকে স্বাগত জানাল রিসিপশনিস্ট মেয়েটা। রিভসের কথা জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়ল। কোনও খবর জানে না।

তাঁর অ্যাসিসটেন্ট মিস উলি জেসাপকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, মেয়েটা জানাল। নানদার হস্তশিল্পের একটা প্রদর্শনী হচ্ছে, সেখানেও যেতে পারেন। তবে সারাদিন তো থাকার কথা নয়। ওরকম থাকেন না কখনও। মিস জেসাপ ফিরে এলেও জানা যেত মিস্টার রিভস কোথায় আছেন। সকাল থেকেই কয়েকবার করে দুজনের কাছে ফোন এসেছে, কোথায় গেছে জানতে চেয়েছে, জবাব দিতে পারিনি।

প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্যেই যেন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল মেয়েটা, এই সময় ফোন রাজল। রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল। ওখানে আর থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা।

আপনারা বললেন মিশনে স্পাই আছে, মুসা বলল। স্পাইয়ের দরকার নেই। ওই একটা মেয়েই যে হারে কথা বলতে থাকে, সব গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

হয়ত, হাসল কিং। মেয়েটা কথা একটু বেশিই বলে। তবে আসল কথাটাই বলতে পারল না। আমরা যা জানতে চাই। রিভস কোথায়?

তার মানে, হ্যারি বলল। মিস্টার রিভস কোথায় আছেন একথা কিডন্যাপারদেরকেও বলতে পারবে না সে।

তা তো বুঝলাম। এখন কি করা? এলিভেটর দিয়ে নামতে নামতে প্রশ্ন রাখল রবিন।

অপেক্ষা আর আশা করা ছাড়া আর কি করার আছে? কিং বলল। বসে থাকব। দেখব কে আগে আসে। মিস জেসাপ, মিস্টার রিভস, নাকি কিডন্যাপাররা। এছাড়া আর তো কিছু ভাবতে পারছি না।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পার্কিং লটে বসে বসে ঘামতে লাগল দুই গোয়েন্দা, দুজন। নানান আর কয়েকজন পুলিশম্যান। হতাশ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ডায়ালের। দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ব্যথা করে ফেলল মুসা। একবারের জন্যেও জ্বলল না লাল আলো।

আর পারি না! অপেক্ষা অসহ্য হয়ে উঠেছে মুসার কাছে। কিশোর আর পিটারের সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে। কি করে জানব, পিটারকে চেনে এরকম আর কাউকে খুঁজে বের করেনি কিডন্যাপাররা?

জানার উপায় নেই, ভয়ানক গম্ভীর হয়ে আছে হ্যারি। শুধু জানি ট্রেড মিশনই ওদের একমাত্র আশা। সেজন্যেই বসে থাকতে হবে।

অবশেষে, দুপুরের পরে, ওপরতলায় বসে যে শাদা পোশাকের পুলিশম্যানটি নজর রাখছিল, সে ওয়াকি টকিতে কথা বলল ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে। কালো চুলওয়ালা এক মহিলা এই মাত্র ঢুকল। এখানকারই কেউ মনে হচ্ছে। তাকে খুঁজছেন না তো?

মিস জেসাপ! চেঁচিয়ে উঠল কিং। সে-ই হবে! গিয়ে দেখা দরকার।

আবার ওপরতলায় ছুটে এল গোয়েন্দারা। একই রকম হাসি দিয়ে স্বাগত জানাল রিসিপশনিস্ট। হাল্লো, আবার এসেছেন! ভাল। মিস্টার রিভসের কোনও খবর নেই। তবে মিস জেসাপ ফিরেছে। ওর সঙ্গে দেখা করবেন? মিস্টার রিভসের অফিসে আছে।

কোণের দিকে মিস্টার রিভসের অফিস। সেদিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল মুসা। কান পেতে শুনছে।

কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন।

অফিসে কথা শোনা যাচ্ছে। মিস জেসাপই বলছে হয়ত কারও সঙ্গে।

হ্যারিও কান পাতল। কই, আমি তো শুনছি না।

কি জানি, গাল চুলকাল মুসা। আমার ভুলও হতে পারে।

 দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। মিস্টার রিভসের ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র ঘাঁটছে মিস ডলি জেসাপ। গায়ে সবুজ ব্লাউজ। পরনে ধূসর স্ন্যাকস। ওদেরকে দেখে চকচক করে উঠল চোখ, পিটারকে পেয়েছেন?

পেয়েছি, তিক্তকণ্ঠে বলল কিং। তারপর আবার হারিয়েছি।

হারিয়েছেন? ধীরে ধীরে ডেস্কের ওপর থেকে একটা কানের দুল, তুলে নিয়ে পরতে লাগল মিস জেসাপ।

সারাদিন কোথায় ছিলে, ডলি? হ্যারি জিজ্ঞেস করল। মিস্টার রিভসের সঙ্গে?

মাথা ঝাঁকাল ডলি।

পিটারের কথা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করেছে?

না তো। কেন?

কিডন্যাপাররা পিটারকে ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের ধারণা, কিং বলল। মিস্টার রিভসের কাছে যাবে ওরা পিটারকে সনাক্ত করার জন্যে…

সর্বনাশ! আঁতকে উঠল ডলি। মিস্টার রিভস তা পারবেন! ওরা তাঁকে ফাঁকি দিতে পারবে না। জলদি হুশিয়ার করে দেয়া দরকার!

তাকে পাব কোথায়?

ঘড়ি দেখল ডলি। দুটো জায়গার কোনও একটাতে হতে পারে। হ্যাঁণ্ডিক্র্যাফট ইমপোর্টার গিল্ড, কিংবা দি আর্টস অভ, আফ্রিকা। ওই দুটো জায়গায়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। বিকেল পাঁচটার আগেই সারতে হবে।

দেড় ঘণ্টা বাকি, হিসেব করে বলল হ্যারি। একসঙ্গে গেলে সময় পাব না। ভাগাভাগি হয়ে যেতে হবে।

জলদি চলুন, রবিন বলল।

দুটো জায়গার ঠিকানা লিখে দিল ডলি। দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে এলিভেটরের দিকে চলল চারজনে। যে মুহূর্তে এলিভেটরের দরজা বন্ধ হলো, ঘুরে। তাকাল মুসা, মিস্টার কিং! ও মিথ্যে বলেছে! গাধা বানানোর চেষ্টা করেছে। আমাদেরকে।

.

১৮.

 মানে? বুঝতে পারল না রবিন।

কি করে বুঝলে? হ্যারির প্রশ্ন।

ভুল করছ তুমি, মুসা, কিং বলল। ওই মেয়েটাকে বহু বছর ধরে চিনি

না, ভুল আমি করছি না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল মুসা। ডলি বলেছে মিস্টার রিভস তা পারবেন। আরও বলেছে, ওরা তাঁকে ফাঁকি দিতে পারবে না।

বিস্ময় ফুটল কিং-এর চোখে। ঠিকই তো বলেছে। আমরা সবাই সেটা জানি।

জানি। কিন্তু আমরা একবারও বলিনি ডলিকে যে পিটার আর আরেকটা ছেলেকে নিয়ে কোনও গোলমাল হয়েছে। বলিনি কিডন্যাপাররা দুজনকে ধরে নিয়ে গেছে। তাহলে কি করে জানল সে, বোকা বানানো হয়েছে কিডন্যাপারদেরকে? পিটারকে সনাক্ত করা দরকার?

 চুপ হয়ে রইল অন্য তিনজন। এলিভেটর নিচে নামলে বেরিয়ে এল সবাই। অবশেষে হ্যারি বলল, ও ঠিকই বলেছে। ট্রেড মিশনের কেউই জানে না এ খবর। ডলি জানল কিভাবে?

মাথা ঝাঁকাল কিং। রকি বীচের বাইরে একমাত্র পুলিশ জানে। আর তারা নিশ্চয় ঢোল পিটিয়ে বলতে যাবে না ট্রেড মিশনের অফিসে। তার

এর একটাই মানে, মুসা বলল। ডিলির সঙ্গে কির্ডন্যাপারদের যোগাযোগ রয়েছে।

 তা কি করে হয়? প্রশ্ন তুলল কিং। সারাটা দিন সে মিস্টার রিভসের সঙ্গে সঙ্গে ছিল।

সেটা তার মুখের কথা। প্রমাণ তো আর নেই।

মিস্টার রিভসকে জিজ্ঞেস করলেই সব জানা যাবে। ডলি মিছে কথা বলে থাকলে ফাঁস হয়ে যাবে।

এক মিনিট হাত তুলল রবিন। মুসার মনে হয়েছিল সে অফিসে কথা বলতে শুনেছে। আমরা শুনিনি। সে ভুল করেছে ভেবেছি। কারণ ডলি অফিসে একা, কার সঙ্গে কথা বলবে? ডেস্ক থেকে একটা কানের দুল তুলে তাকে পরতে দেখেছি। আমি যতটা জানি, কিশোরও অনেকবার বলেছে, টেলিফোনে কথা বলার সময়ই শুধু ওরকম ভাবে দুল খুলে নেয় মহিলারা। অস্বাভাবিক বড় দুল যারা পরে। কানে থাকলে রিসিভার চেপে ধরতে অসুবিধে হয়। হতে পারে টেলিফোনে কিডনাপারদের সঙ্গে কথা বলেছিল সে। মনে আছে, রিসিপশনিস্ট বলেছিল, সকাল থেকে অনেক ফোন এসেছে মিস জেসাপের কাছে? অনেকে নাকি খুঁজেছে। বাজি রেখে বলতে পারি এখন কিডন্যাপাররাই যোগাযোগ করতে চেয়েছে ডলির সঙ্গে।

কিং, মুসা বলে। আপনি বলছেন, অনেক বছর ধরে চেনেল ডলিকে। তার মানে তার সঙ্গে কাজ করেছেন। ডলি কি স্যার মনটেরোর সঙ্গেও কাজ করেছে? পিটারকে দেখলে চিনবে?

আমি শিওর না, ভ্রূকুটি করল কিং। অনেক বছর ধরে স্যার মনটেরোর অফিসে কাজ করেছে অবশ্য, তবে মিস্টার রিভসের মত তার পারিরারিক বন্ধু নয়! পিটারকে চিনতে পারবে কিনা জানি না। তবে বলাও যায় না। চিনেও ফেলতে পারে। ঈশ্বর, তাই তো, এখন মনে হচ্ছে সে-ই। পিটারের মেসেজটা তার হাত দিকেও বেরিয়ে যেতে পারে!

  পার্কিং লটের দিকে দৌড় দিল চারজলে। ইয়ান ফ্লেচারকে জানাল সন্দেহের কথা।

ওকে ধরা দরকার। ফুঁসে উঠল হ্যারি। চাপ দিলেই…

না, রাজি হলেন না চীফ। লাভ হবে না। উগ্রবাদীদের দলে হলে ভীষণ শক্ত হবে। কিছুতেই মুখ খুলবে না। আপনাদেরকে ভুল জায়গায় পাঠাতে চেয়েছে। তার মানে সময় চেয়েছে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে। দেখা করার জন্যেও হতে পারে। আর তা করলে সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।

 ঠিকই বলেছেন, মুসা বলল। সে ভাববে আমরা মিস্টার রিভসের সঙ্গে দেখা, করতে চলে গেছি। এই সুযোগে সে চলে যাবে কিডন্যাপারদের সঙ্গে কথা বলতে।

হ্যাঁ। আমি পুলিশকে বলে যাচ্ছি এখানে থেকে অফিসের ওপর নজর রাখতে, চীফ বললেন। তারপর আমার গাড়িতে করে তোমাদেরকে নিয়ে সরে যাব এখান থেকে, ডলি ভাববে আমরা চলে গেছি। ঘুরে আবার আরেক দিক দিয়ে চলে আসব। লুকিয়ে উঠে পড়ব ক্যাডিলাকে। ওকে অনুসরণ করব। আমাদেরকে পুলিশ কারে করে চলে যেতে দেখবে সে। কাজেই একটা ক্যাডিলাক পিছু নিলে খেয়াল করবে বলে মনে হয় না।

বুদ্ধিটা ভাল। সবারই মনে ধরল। চীফের কথামতই কাজ করা হলো

পনেরো মিনিট পর বেরিয়ে এল ডলি জেসাপ। একটা লাল পনটিয়াকে উঠল। গাড়িটাকে অনুসরণ করে চলল হ্যারি আর কিং-এর ক্যাডিলাক।

.

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রয়েছে কিশোর আর পিটার। অনেকক্ষণ ধরে রয়েছে একই ভাবে।

আর আমাদের খুঁজে পাবে না তোমার বন্ধুরা, পিটার বলল।

 পাবেই! আমি জানি, ওরা পাবেই! খুঁজে বের করবেই আমাদের!

হঠাৎ জ্বলে উঠল আলো। ক্ষণিকের জন্যে অন্ধ করে দিল যেন ছেলেদের। ভেতরে ঢুকেছে দুই কিডন্যাপার। কিশোরের দিকে এগিয়ে এল জন, পিটারের দিকে ডেভ। টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল দুজনের শার্ট।

পিটারের দিকে তাকিয়ে ডেভ বলল, ভেরি গুড। খেল তাহলে খতম, অ্যাঁ?

কিশোরের দিকে তাকাল পিটার। তার পেটে ছোট একটা কাটা দাগ রয়েছে। কিশোরের তেমন দাগ নেই।

এবার কি বলবে? কিশোরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে জন। ওরকম এক দাগ তোমার করে নেয়া উচিত ছিল।

.

 হলিউড হিলের একটা ছোট বাড়ির ড্রাইভওয়েতে ঢুকল লাল পনটিয়াক। থামল। বেরিয়ে এল ডলি। দৌড়ে এগোল সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ল বারান্দায়। দুটো বাড়ি আগে একটা মোড়ে থেমে গেল ক্যাডিলাক। ইমারজেন্সি সিগন্যালের দিকে তাকাল মুসা।

না, কিছু নেই, হতাশ কণ্ঠে বলল সে। মনে হয় কিশোরের যন্ত্রটা পেয়ে গেছে কিডন্যাপাররা। অফ করে দিয়েছে। কিংবা ওরা এখানে নেইই।

তাহলে কি আমাদের ভুল হলো? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল হ্যারি।  

না, জোর দিয়ে বলল মুসা। ওই মেয়েটা কিডন্যাপারদের দলেরই।

চল, কিং বলল। বাড়িতে ঢুকে পড়ি। তারপর যা হয় হবে।  

গাড়ি রেখে হেঁটে এগোল দলটা। নিঃশব্দে দ্রুত চলে এল বাড়ির আঙিনায়। লম্বা লম্বা গাছ, লতা আর ঝোপঝাড়ের জঙ্গল হয়ে আছে বাড়ির চারপাশে। সামনের দরজার কাছে এসে কান পাতল ওরা। কথা শোনা গেল না। শুধু কাঠের। মেঝেতে ডলির হাই হিলের খটখট শব্দ। কলিং বেল বাজাল কিং! দরজা খুলে হাঁ হয়ে গেল ডলি।

এখানে কি? খেঁকিয়ে উঠল সে। পরক্ষণেই হাসল, অস্বস্তি আর ভয় মেশানো হাসি। সরে জায়গা করে দিল সবাইকে ঢোকার জন্যে। একটা লিভিং রুমে নিয়ে এল। মিস্টার রিভসকে পেয়েছেন? কিডন্যাপাররা তার কাছে গিয়েছিল?

তার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি আমরা, হ্যারি বলল।

কারণ, কিং বলল। তার সঙ্গে দেখা করতে যাবার দরকার নেই কিডন্যাপারদের। পরে মনে হয়েছে আমাদের।

আপনাকে চুপ থাকতে অনুরোধ করব, শান্তকণ্ঠে ডলিকে সাবধান করলেন চীফ। কারণ বেফাঁস যা কিছু বলবেন এখন আদালতে সব যাবে আপনার বিরুদ্ধে।

ওরা কোথায়? ভুরু নাচাল মুসা। পিটার আর কিশোর?

কিডন্যাপারদের সঙ্গে কথা বলেছেন আপনি, রাগ চাপতে পারল না রবিন। জানি আমরা। ওরা কোথায়? কি করেছে কিশোর আর পিটারকে?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ওদের দিকে তাকিয়ে রইল ডলি। নিরাশ ভঙ্গিতে হাত ছড়াল দুপাশে। কি বলছ বুঝতে পারছি না। এই কিশোরটি কে? কোনও কিশোরকে তো চিনি না আমি? আর আমি কি করে জানব পিটার কোথায় আছে?

 খুব ভাল করেই জান এখন তুমি, কড়া গলায় বলল কিং। কিশোর কে। আর পিটারের কি হয়েছে তা-ও জান, কারণ কিডন্যাপারদের দলেরই লোক তুমি।

 আমি! হাঁ হয়ে গেল ডলি। আমি? মানে আমি পিটারের ক্ষতি করব? বহু বছর আমি স্যার মনটেরোর কাজ করেছি। আমি তার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।

কেন মিথ্যে বলছ? শান্ত কণ্ঠে বলল হ্যারি। চীফ, বাড়িটা খুঁজে দেখা দরকার।

তার জন্যে সার্চ ওয়ারেন্ট লাগবে। কঠিন হয়ে উঠল ডলির কণ্ঠ। তারপর কি ভেবে মনস্থির করে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, দেখুন। যত খুশি দেখুন। আমার তো আর কিছু লুকানোর নেই। তবে মনে অনেক কষ্ট দিলেন আমাকে।

আমিও কি দিয়েছি? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

আপনি? পলকের জন্যে রাগে বিকৃত হয়ে গেল ডলির মুখ। তারপর জোর করে হাসল। হ্যাঁ, মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম, আপনিও দিয়েছেন।

কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, চীফ বললেন। খুঁজুন তো।

ছড়িয়ে পড়লেন চীফ, হ্যারি, রবিন, আর মুসা। লিভিং রুমে ডলির সঙ্গে রইল কিং।

এর জন্যে পস্তাতে হবে আপনাকে, কিং, শাসিয়ে বলল ডলি। কিডন্যাপারদের ব্যাপারে কিছু জানি না আমি। কিংবা ওই দুটো ছেলের ব্যাপারে।

ছেলে যে দুটো কি করে জানলে?

একটু আগেই তো বললেন কিশোর নামে আরও একটা ছেলে রয়েছে।

না, কিশোর নামে আরেকটা ছেলে রয়েছে ওভাবে একবারও বলিনি। ছেলে কেন, বয়স্ক মানুষও হতে পারে কিশোর। কিন্তু তুমি একেবারে নিশ্চিত ভাবে বলে দিলে সে ছেলে। তারমানে তুমি জান। এই নিয়ে দুবার মুখ ফসকাল তোমার। একবার অফিসে, একবার এখানে। তা কিডন্যাপারদেরকে চিনিয়ে দিয়েছ নাকি, পিটার কোনজন?

আর একটা কথাও বলতে চাই না আপনার সঙ্গে।

ভেতরের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল রবিন আর হ্যারি। আরেক দিক থেকে এলেন ফ্লেচার আর মুসা। ডলির মুখোমুখি দাঁড়াল রবিন। কিছু কথার জবাব দিতে হবে আপনাকে, মিস জেসাপ।

ছেলেদেরকে দিয়েও আমাকে অপমান করাতে চান নাকি? কিং-এর দিকে। তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল ডলি।

কিং কিছু বলল না। রবিন তার কথা বলে গেল, আমার বন্ধু কিশোর বলে, ছোটখাট ব্যাপারও অবহেলা করতে নেই গোয়েন্দাগিরিতে। যাই হোক, আপনি একজন নানদান। এবং আমার বিশ্বাস, ওখানকার জুয়েলারি আপনার খুব পছন্দ।

কি বকবক করছে এই ছেলেটা? কিং-এর দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল ডলি। দেখুন, আমি আপনাকে হুঁশিয়ার করছি…

পকেট থেকে হাত বের করল রবিন। হাতে হাতির দাঁতের তৈরি ছোট একটা গহনা। কানে পরার জন্যে। বলল, এটা আপনার বেডরুমে পেয়েছি, মিস জেসাপ। কানের দুল, তাই না? নানদার মেয়েরা পরে। মাত্র একটাই আছে। আরও একটা থাকার কথা ছিল, নেই। কারণ ওটা হারিয়ে গেছে। আবার পেয়েছি। সেই বক্স ক্যানিয়নে, যেখানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিশোরকে। কিডন্যাপারদেরকে তুলে নেয়ার জন্যে ওখানে নেমেছিল হেলিকপ্টারটা।

 হাতির দাঁতের তৈরি খুদে হাতির দাঁতটার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ডলির মুখ।

কিশোর বলে, বলতে থাকল রবিন। কোনও মহিলাই তার পছন্দের জিনিস ফেলে না, বিশেষ করে গহনা। একটা দুল হারিয়ে গেলে আরেকটা পরা যায় না, তবু রেখে দেয়। মহিলাদের স্বভাব। আপনিও মহিলা। একটা হারিয়ে এসেও আরেকটা ফেলতে পারেননি। আপনি স্যার মনটেরোর শত্রু, মিন্স জেসাপ। সেদিন ক্যানিয়নে আপনিই হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়েছিলেন। পাইলট ছিলেন আপনিই। তখনই কোনভাবে আপনার কান থেকে দুলটা খুলে পড়ে গিয়েছিল।

.

১৯.

 খাইছে! বলে উঠল মুসা। ফ্লাইং স্যুট আর গগলসের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। একজন মহিলা!  

ও-ই পাইলট ছিল কিনা, চীফ বললেন। সেটা শিওর হতে হবে আমাদের।

তা হওয়া যাবে, কিং বুলল। যাদের কাছ থেকে হেলিকপ্টার ভাড়া নিয়েছিল তাদের কাছে গেলেই হবে। নিশ্চয় কণ্ঠস্বর চিনতে পারবে ওরা।

 আর কানের দুলটা তো আছেই, হ্যারি বলল। প্রমাণ।

জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ডলি। ঘৃণা আর রাগ ছড়িয়ে পড়েছে মুখে। আচমকা হেসে উঠল খিলখিল করে, বেশ, আমিই পাইলট ছিলাম, হেলিকপ্টার চালিয়েছি। স্বীকার করছি। তাতে দোষের কি আছে? আমি একজন নানদান। দুশো বছর ধরে ওখানে বাস করছে আমার বাপ-দাদারা।

আর আমরা বাস করছি দুহাজার বছর ধরে, বলল কালো চামড়ার নানদান, হ্যারি। আমরা তোমাদেরকে দয়া করে জায়গা দিয়েছি আমাদের দেশে, নানদা বলে মেনে নিয়েছি। কিন্তু ওটা আমাদের দেশ।

–কক্ষণো না! হিঁসিয়ে উঠল ডলি।

 চীফ বললেন, আপনাদের দেশ, আপনাদের পলিটিকস, সেটা আপনাদের ব্যাপার। ওসব নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। এটা নানদা নয়; আমেরিকা। এখানে এসে দুটো ছেলেকে কিডন্যাপ করেছেন। ভলির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি এখন কিডন্যাপারদের একজন। সেই বিচার হবে, শাস্তি আপনাকে মেনে নিতেই হবে। সাংঘাতিক কঠোর হয়ে উঠল তার কণ্ঠ, ছেলেদুটো কোথায়? পিটার আর কিশোর?

 ছিল এখানেই, ডলি জবাব দিল। এখন নেই। জন আর ডেভ এসে নিয়ে গেছে।

কোথায়? জানতে চাইল কিং।

 সেটা কোনদিনই তোমাকে বলব না আমি। পিটার এখন আমাদের কব্জায়। স্যার মনটেরোকে যা করতে বলব তাই করতে বাধ্য হবেন তিনি।

না, অত আশা কোরো না। তিনি কোনদিনই তোমাদের কথা শুনবেন না। নিজের ছেলের প্রাণের বিনিময়েও না। যা ভাল বুঝবেন তাই করবেন। তার কাছে সব চেয়ে বড় নানদার ভবিষ্যৎ।

 বানিজি একমাত্র ছেলের জীবনের ঝুঁকি নেবেন?

 নেবেন। আরও বড় ঝুঁকি হলেও নেবেন, হ্যারি বলল।

 চীফ রেগে গেলেন, জাহান্নামে যাক নানদা। আমি এখানকার পুলিশ। আমেরিকার। আমেরিকায় বসে কিডন্যাপিঙের মত মস্ত একটা অপরাধ করেছেন আপনি, মিস জেসাপ। ভাল চান তো ছেলেগুলো কোথায় আছে বলুন।

আমি একজন সৈনিক, দেশপ্রেমিক, জবাব দিল ডলি। কিডন্যাপার নই। কিছুতেই মুখ খোলাতে পারবেন না আমার। ওদেরকে নিয়ে চলে গেছে জন আর ডেভ। ওদেরকে ধরার সাধ্য নেই আর আপনাদের।

 চীফের মুখের ওপর হেসে উঠল সে। পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলেন চীফ হ্যারি, কিং, রবিন আর মুসা। ডলি মুখ না খুললে কি করে জানা যাবে পিটার আর কিশোর কোথায় আছে? সবাই কিছুটা হতাশ, রবিন বাদে। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে ডলির দিকে। এখানে কিডন্যাপাররা না এসে থাকলে কি করে জানবে কে কিশোর আর কে পিটার? ধীরে ধীরে বলল সে। নিশ্চয় মিস জেসপি বলেছেন ওদেরকে টেলিফোনে।

হেসে উঠল ডলি। অবশ্যই বলেছি। সহজ ব্যাপার। পিটারের পেটে ছোট একটা কাটা দাগ আছে। কয়েক বছর আগে, অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করা হয়েছিল তার।

বুঝলাম, মাথা ঝাঁকাল রবিন। তবে সেটা নিয়ে ভাবছি না। আমি ভাবছি জন আর ডেভ যদি মিস জেসাপ আসার আগেই চলে গিয়ে থাকে তাহলে তিনি এত তাড়াহুড়া করে অফিস থেকে চলে এলেন কেন? আসারই বা কি প্রয়োজন ছিল? জবাব একটাই। ফোনে সঙ্গীদের বলে দিয়েছেন, কিভাবে পিটারকে সনাক্ত করতে হবে। ওরা তখন পিটারকে চিনে নিয়ে পালানোর ব্যবস্থা করতে লাগল। মিস জেসাপও চলে এলেন। নিশ্চয় কোনও জরুরী কাজ আছে।

ঠিক, একমত হয়ে মাথা দোলালেন চীফ। রবিন ঠিক বলেছে। নইলে এত তাড়াহুড়া করে অসময়ে বাড়ি আসতে যাবেন কেন মিস জেসাপ?

এটা আমার বাড়ি, কর্কশ কণ্ঠে বলল ডলি। যখন খুশি আমি আসতে পারি এখানে।

তা পারেন, রবিন স্বীকার করল। তবে, এত তাড়াহুড়া কেন? আমার কি মনে হয় জানেন? পিটারকে নিয়ে চলে যাবে আপনার বন্ধুরা। কিশোরকে ফেলে যাবে। তাকে পাহারা দিতেই আপনার এই আসা।

কিশোর? ভরু কোঁচকালেন চীফ।

হ্যাঁ, ঠিক! তুড়ি বাজাল হ্যারি। অহেতুক নানদায় বয়ে নিয়ে যাবে না ওরা কিশোরকে। ওদের দরকার পিটারকে। একলা তাকেই নেবে। দুটো ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি।

তা। তার মানে এখানেই আছে এখনও কিশোর! বলে উঠল মুসা।

খোঁজ, খোঁজ, আবার খোঁজ নির্দেশ দিলেন চীফ।

এবার ডলির পাহারায় রইল হ্যারি। অন্যেরা ছড়িয়ে গেল খোঁজার জন্যে। প্রতিটি ঘর, প্রতিটি আলমারি, মোট কথা একজন মানুষ লুকিয়ে থাকার মত যত জায়গা আছে সব খুঁজে খুঁজে দেখতে লাগল। বেশিক্ষণ লাগল না সব দেখতে। কিশোরের চিহ্নও দেখতে পেল না।

বাইরে দেখা দরকার, কিং বলল। গ্যারেজে। ছাউনি-টাউনিও থাকতে পারে।

ওদেরকে বাইরে বেরোতে দেখে মুচকি হাসল ডলি। গ্যারেজ বাদে ছোট একটা ছাউনি আছে। ছাউনির ভেতরে পাওয়া গেল শুধু বাগান করার যন্ত্রপাতি। গ্যারেজের ভেতরে কিছুই না। বাড়ির আশপাশে পাহাড়ের অনেকখানি জায়গা খুঁজে দেখল মুসা। কিশোরের চিহ্নও পেল না।

আবার ঘরে ফিরে এল দলটা।

টিটকারির সুরে ডলি বলল, বলেছিলাম না, নেই। পাবে না। কিং, হ্যারি স্বীকার করতেই হলো তোমাদেরকে। পরাজয় মেনে নিতে লজ্জা কিসের? দেখো, তোমাদের স্যার মনটেরোকেও কব্জা করে ছাড়ব আমরা।

আবার খোঁজ! কিছুতেই পরাজয় মেনে নিতে রাজি নন ইয়ান ফ্লেচার। রাগে পিত্তি জ্বলছে তাঁর, কিন্তু কিছুই করার নেই। কথা আদায় করা যাচ্ছে না ডলির মুখ থেকে, রাগটা তার এ জন্যেই।

অন্ধকার হয়ে আসছে। বাড়ির চারপাশে গাছপালা ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না শেষ বিকেলের রোদ। বিছানার নিচে আর আলমারিগুলোতে আবার খোঁজার জন্যে আলো জ্বেলে নিতে হল।

চীফ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

মিটমিট করতে শুরু করেছে বাল্বগুলো।

কি ব্যাপার? অবাক হয়েছে হ্যারি। বৈদ্যুতিক গোলমাল?

জ্বলছে নিভছে…জ্বলছে নিভছে…কিছুতেই ঠিক হতে চাইছে না যেন আলো।

আকাশ তো ভালই, জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল রবিন। আবহাওয়ার জন্যে এরকম হচ্ছে না। গরমও তেমন নেই যে সার্কিটে ওভারলোড হয়ে যাবে।

জ্বলছে নিভছে…জ্বলছে নিভছে…নিয়মিত।

যেন ইচ্ছে করে করছে কেউ, কিং অনুমান করল। মাস্টার সুইচ নিয়ে কিছু করছে না তো? কিংবা ফিউজ…

নিশ্চয় কিশোর! আবার চেঁচিয়ে বলল মুসা। সংকেত দেয়ার চেষ্টা করছে! আশপাশেই আছে কোথাও!

কিন্তু কোথায়? ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগলেন চীফ। সমস্ত জায়গায়ই তো খোঁজা হয়েছে।

ওই মহিলা জানে! ডলির দিকে আঙুল তুলে বলল রবিন।

হাসি মুছে গেছে ডলির মুখ থেকে।

চীফ, মুসা বলল। ঢালের ওপর তৈরি হয়েছে বাড়িটা। পেছন দিকের ভিত মাটিতে গড়া হয়েছে, কিন্তু সামনের দিকটা পিলারের ওপর। মেঝের নিচে ফাঁকা জায়গা আছে। গোপন সেলার-টেলার থাকলে অবাক হব না।

 ছুটে বেরিয়ে গেল মুসা। ফিরে এল একটু পরেই। জানাল, কংক্রীটের ভিতের ওপর তৈরি হয়েছে বাড়িটা। বিরাট একটা বাক্সের মত হয়ে আছে নিচেটা। ভেতরে ফাঁকা থাকতেই পারে। তবে ঢোকার পথ দেখলাম না।

বাইরে না থেকে থাকলে, রবিন বলল। ভেতরে আছে।

সরাও! নির্দেশ দিলেন চীফ। সমস্ত কার্পেট সরিয়ে ফেলো। বিছানার নিচে আবার দেখো। ট্র্যাপডোর থাকতে পারে। আলমারির ভেতরেও গোপন দরজা থাকতে পারে।

বেডরুমের সব চেয়ে বড় আলমারিটাতে পথ পেয়ে গেল রবিন। আলমারির নিচে। একটা ট্র্যাপডোর। সরু মই নেমে গেছে নিচের অন্ধকারে।

আলমারির ভেতরেই আলোর সুইচ খুঁজে পেল মুসা। জ্বেলে দিল। নিচের সেলারে জ্বলতে নিভতে আরম্ভ করল একটা বাল্ব। মই বেয়ে দ্রুত নেমে এল ওরা জানালাশূন্য একটা ঘরে। অনেক মদের বোতল আর বাতিল আসবাব পড়ে রয়েছে। আর রয়েছে…

কিশোর! চিৎকার করে বলল রবিন।

কিশোর? মুসাও চেঁচাল।

খুদে সেলারের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান। পিঠের ওপর নিয়ে গিয়ে হাত বেঁধেছে। মুখে কাপড় গোঁজা। পুরনো ধাচের একটা সুইচ বক্সের হাতলে পা ঠেকানো। মাস্টার সুইচের হাতলে লাথি মারলেই নিভে যাচ্ছে আলো, আবার জ্বলে উঠছে।

আমরা বুঝেছি, মুসা বলল, তুমিই সংকেত দিচ্ছ।

তাড়াতাড়ি কিশোরের মুখের কাপড় খুলে নিল রবিন। বাঁধন খুলে দিল।

তোমাদের কথা অনেকক্ষণ থেকেই শুনছি, কিশোর বলল। খোঁজাখুঁজি করছ তা-ও বুঝতে পারছিলাম। শেষে তো ভয়ই হচ্ছিল, পাবে না ভেবে…

 তুমি সংকেত দেয়াতে ভাল হয়েছে, মুসা বলল।

নইলে সত্যিই হয়ত পেতাম না, বলল রবিন। তবে মুসা আন্দাজ করে ফেলেছিল, সেলারে আটকে রাখা হয়েছে তোমাকে।

দুর্বল ভঙ্গিতে হাসল কিশোর। এখন বলে ফেল তো, কি করে এখানে এসে খুঁজে বের করলে আমাকে?

সংক্ষেপে তাকে সব কথা জানাল রবিন আর মুসা।

চমৎকার! প্রশংসা করল কিশোর। ভাল গোয়েন্দা হয়ে উঠেছ তোমরা ইদানীং। ভেরি গুড।

কিশোরের প্রশংসা পাওয়া খুব কঠিন। খুশি হল দুই সহকারী। একনাগাড়ে বসে থেকে থেকে হাত-পা ঝিমঝিম করছে কিশোরের। তাকে মই বেয়ে উঠে বেরোতে সাহায্য করল রবিন আর মুসা। নিয়ে এল লিভিং রুমে। তার পিঠ চাপড়ে দিলেন ইয়ান ফ্লেচার।

তুমি ভাল আছ, কিশোর? কিং বলল, সত্যিই খুব খুশি লাগছে। তোমার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।

রবিন আর মুসার কাছে তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, হেসে বললেন চীফ।

হয়েছি। চারপাশে চোঁখ বোলাচ্ছে কিশোর। পিটার কোথায়? তাকে নিয়ে গেছে নাকি কিডন্যাপাররা?

মাথা ঝাঁকাল হ্যারি।

তোমাদের ছাগল পেয়েছ, রবিন আর মুসার দিকে তাকিয়ে কুৎসিত হাসি হাসল ডলি। এবার কেটে পড়তে পারো। জন আর ডেভকে ধরার চেষ্টা করলে অহেতুক সময় নষ্ট করবে। পিটারকে হাতে পেয়েছে ওরা। হাওয়া হয়ে গেছে এতক্ষণে।

সবাইকে নিরাশ মনে হলো, বিশেষ করে কিং আর হ্যারিকে। কেবল কিশোরের মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। ডলির দিকে তাকিয়ে হাসল। দাঁড়ান, ছাগলই ভেড়া বানাবে আপনাদের। হাওয়া হয়ে গেছে বলছেন তো। পারবে না। আমি কিশোর পাশা থাকতে অন্তত না।

.

২০.

লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশকে খবর দিলেন ইয়ান ফ্লেচার। তারা এসে গ্রেপ্তার করল ডলিকে। তারপর কিশোরের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, স্যান ডিয়েগো পুলিশকে রেডিওতে খবর পাঠাল। নানদানদের ক্যাডিলাকটা ছুটে চলল মেকসিকো সীমান্তের দিকে।

এখন বল তো, কিশোর, চীফ জিজ্ঞেস করলেন। পিটারকে নিয়ে যাওয়া ঠেকাব কি করে?

ঠিক বলতে পারছি না এখনও। তবে সুযোগ আছে। পিটারকে সনাক্ত করার পর তাকে ওপরে তুলে নিয়ে গেল। তারপর ওদেরকে ফোনে কথা বলতে শুনেছি।

কার সঙ্গে?

ওদের সহকর্মীদের সঙ্গে, আমার বিশ্বাস। সহকারীরা রয়েছে মেকসিকোর টিজুয়ানায়। ওরা বলল, এবার পিটারকে ধরেছে, কোনও সন্দেহ নেই। আর প্ল্যান মোতাবেকই বেরিয়ে যাবে।

প্লানটা কি?

জানি না। ও সম্পর্কে কিছু বলেনি ওরা।

তাহলে কি করে…? বলতে গিয়ে বাধা পেল কিং।

কয়েকটা সূত্র আছে আমাদের হাতে, কিশোর বলল। কিডন্যাপাররা মেকসিকো সীমান্তের কাছে টিজুয়ানায় কারও সঙ্গে দেখা করবে। টিজুয়ানা দিয়ে মেকসিকো সীমান্ত পার হবে ওরা।

কিন্তু সেটা কখন? জিজ্ঞেস করলেন চীফ। যে কোনও সময় পেরোতে পারে ওরা।

ওরা বলেছে স্যান ডিয়েগোতে কাজ আছে ওদের। সীমান্ত পেরোনোর আগে কিছুক্ষণ থামবে ওখানে। সীমান্ত পার হবে রাত দশটায়।

আর ঠিক ওই সময় আমরা গিয়ে বসে থাকব ওখানে! কিং বলল। ভালই হবে, খুব ভাল। ভাবছি

ওদের প্ল্যান জানার আমাদের কোনও দরকার নেই, চীফ বললেন। কার সঙ্গে দেখা করবে সেটাও জানা লাগবে না। ওসব ছাড়াই ওদেরকে আটক করতে পারব আমরা।

সে রকমই আশা করছি, কিশোর বলল।

 কিশোর, রবিন জিজ্ঞেস করল। পিটারকে নিয়েই সীমান্ত পেরোবে তো? মানে, এতটা খোলাখুলি যাওয়ার সাহস করবে? ছদ্মবেশ নেবে না তো? কিংবা পিটারকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা?

তাই তো। মুসা কথাটা ধরল। পুলিশ যে ওদের পিছে লাগতে পারে এটা না বোঝার মত বোকা নিশ্চয় নয় ওরা। সীমান্তেও কড়া নজর রাখা হতে পারে, এই সন্দেহও করতে পারে ওরা।  

তা পারে, মাথা দোলাল কিং। তাহলে চিনব কি করে ওদেরকে? পুলিশই বা বুঝবে কিভাবে?

সেটা আমাদের কাজ, আশ্বস্ত করলেন্ত চীফ। ছদ্মবেশী লোককে কি করে চিনতে হয়, সে ব্যাপারে ট্রেনিং আছে আমাদের।

 নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। দক্ষিণে ছুটে চলেছে ক্যাডিলাক। স্যান ডিয়েগোতে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। নটার বেশি বেজেছে। সোজা সীমান্তের দিকে যেতে দেখল স্যান ডিয়েগো পুলিশের দুটো পেট্রল কারকে।

আধ ঘণ্টা সময় আছে আমাদের হাতে, ঘড়ি দেখে বলল কিশোর। তার পরে যে কোনও মুহূর্তে সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করতে পারে কিডন্যাপাররা।

ওরা, কিছুটা হতাশার সুরেই বলল মুসা। এবং আরও হাজারও মানুষ। সব সময়ই পেরোয়।

অনেকগুলো লেন এগিয়ে গেছে সীমান্তের দিকে। অসংখ্য গাড়ি, বাস, আর ট্রাকের সারি যেন স্রোতের মত এগিয়ে চলেছে সেদিকে সবাই সীমান্ত পেরোবে। প্রতিটি গাড়ির প্রায় বাম্পারে বাম্পারে লেগে যাচ্ছে, এতই কাছাকাছি। চেক পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছে। চেক হয়ে যাওয়ার পর ঢুকে পড়ছে মেকসিকোতে।

 এগুলোর মাঝে কি করে চিনবেন ওদেরকে চীফ? কিং-এর প্রশ্ন।

লোকগুলোর চেহারার বর্ণনা বর্ডার গার্ডকে দিয়ে দিয়েছে স্যান ডিয়েগো পুলিশ। ওদের লিংকন গাড়িটার বর্ণনা। এবং অবশ্যই পিটারেরও। মেকসিকান পুলিশ কড়া নজর রাখবে। সন্দেহজনক লোক দেখলেই প্রশ্ন শুরু করবে।

আর আমরা তখন কি করব? হ্যারি জানতে চাইল।

বসে বসে নজর রাখব।

রাস্তার পাশে এমন জায়গায় গাড়ি রাখা হলো, যাতে একযোগে সমস্ত লেনগুলো চোখে পড়ে। স্যান ডিয়েগো পুলিশের একটা গাড়িকে দেখা গেল সেন্টার বর্ডার বুদের কাছে। আরেকটা বেশ কিছুটা দূরে। সময় কাটছে। দশটা বাজতে দশ।

দেখুন। হাত তুলল কিং.। একটা নীল লিংকন!

সীটের একেবারে কিলারে বসে গলা বাড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে ক্যাভিলাকের দর্শকরা। বিরাট নীল গাড়িটা ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চলেছে চেক পয়েন্টের দিকে। ভেতরে উঁকি দিল সীমান্ত প্রহরীরা। ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে সতর্ক নজর রাখল স্যান ডিয়েগো পুলিশ। অনেকক্ষণ কথা বলল প্রহরীরা। তারপর সরে হাত নেড়ে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিল গাড়িটাকে।

ওরা নয়! গুঙিয়ে উঠল মুসা। কি।

হলে এমন ছদ্মবেশ নিয়েছে, হ্যারি বলল পুলিশ চিনতে পারেনি। ধোঁকা খেয়েছে।

ছদ্মবেশে ওদেরকে ফাঁকি দিতে পারবে বলে মনে হয় না আমার, মাথা নাড়লেন চীফ। বর্ডার গার্ডেরা এমনিতেই ভীষণ সতর্ক আর চালাক। তার ওপর হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে। তিনগুণ সতর্ক হয়ে গেছে ওরা। পিটারের বয়েসী কাউকে দেখলে সহজে ছাড়বে না। দরকার হলে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করবে।

কিন্তু কিডন্যাপাররা কি সেটা জানে না? রবিন প্রশ্ন তুলল।

নিশ্চয় জানে, রবিন, জবাবটা দিল কিশোর। সেজন্যেই লুকিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করবে। এমন কোনও গাড়িতে করে যেটা নিয়মিত সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত করে, এবং যেটার দিকে প্রহরীদের নজর কম।

যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ওই বাসগুলোর মত?

দুটো বাস এগিয়ে গিয়ে থামল চেক পয়েন্টের কাছে। ওগুলোতে উঠল স্যান ডিয়েগো পুলিশ। ক্যাডিলাকের দর্শকেরা দেখতে পেল সীটের সারির মাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে পুলিশেরা। প্রতিটি যাত্রীর চেহারা দেখছে। নেমে এল এক সময়। হাত নেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল বাসদুটোকে।

নাহ, হবে বলে মনে হচ্ছে না, হ্যারির কণ্ঠে হতাশা।

আমি.. আমি আশা ছাড়তে পারছি না, কিশোর বলল। তাকিয়ে রয়েছে গাড়ির লম্বা সারিগুলোর দিকে। একে একে এগিয়ে যাচ্ছে ওগুলো চেক পয়েন্টের দিকে। চেক হয়ে গেলে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ছে মেকসিকোতে।

দশটা বাজতে দুই মিনিট।

বেরিয়ে যায়নি তো! আর আত্মবিশ্বাস রাখতে পারলেন না চীফ। মেকসিকো পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার…

জোরাল একটা টিইপ টিইপ যেন ভরে দিল ক্যাডিলাকের ভেতরটা। চমকে উঠল সবাই। সব কটা চোখ ঘুরে গেছে মুসার দিকে। শব্দটা আসছে তার শার্টের পকেট থেকে।

ইমারজেন্সি সিগন্যাল! চিৎকার করে বলল সে।

 অফ কর ওটা, চীফ বললেন। এখন এসব গোলমাল…

না না, কর না! হাসল কিশোর। ওটাই তো আসল। বের করো পকেট থেকে। দেখো, তীরটা কোন দিক নিদের্শ করছে। কিডন্যাপাররা কাছাকাছিই রয়েছে।

যন্ত্রটা বের করে ডায়ালের দিকে তাকাল মুসা। গাড়ির সারির দিকে নির্দেশ করে রয়েছে তীরটা। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে যানবাহনগুলো। ওগুলোর মাঝে একটাও নীল লিংকন নেই। আর কোনও বাসও নেই। শুধুই গাড়ি আর গাড়ি। চার-পাঁচটা ট্রাক আর ভ্যানও রয়েছে।

আসুন! নামুন সবাই! বলতে বলতে নেমে পড়ল কিশোর।

যানবাহনের সারির দিকে এগোল ওরা। মাঝের লেনে একটা পুরনো ট্রাক রয়েছে। মেকসিকোর লাইসেন্স প্লেট। দুপাশে মলিন অক্ষরে স্প্যানিশ ভাষায়, লেখা রয়েছে মেকসিকোর একটা লেটুস ফার্মের নাম। বর্ডার বুদের দিকে এগোচ্ছে। ওটা। মুসার ডায়ালের কাটা সোজা মুখ করে রয়েছে ওটার দিকে।

ওটাই! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। জলদি আসুন!

আগে আগে ছুটছেন এখন চীফ। বুদের সামনে গিয়ে থামল ট্রাকটা। তিনিও পৌঁছে গেলেন এই সময়। ট্রাকের পেছনের ক্যানভাসের  ঢাকনা তুলল গার্ড। ভেতরে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। স্যান ডিয়েগো পুলিশকে ইশারা করল গাড়িটা ছেড়ে দেয়ার জন্যে।

না। চিৎকার করে বলল কিশোর। এই ট্রাকেই আছে ওরা।

মাথা নাড়ল প্রহরী। সরি, ইয়াং ম্যান, ওতে কেউ নেই। পেছন দিকটা খালি। শুধু ড্রাইভিং সীটে ড্রাইভার। মেকসিকোর লোক।

হতেই পারে না, জোর তর্ক শুরু করল কিশোর। শুনছেন, আমাদের সিগন্যাল কত জোরে বাজছে?

যানবাহনের শব্দকে ছাপিয়ে টিপ টিপ করছে যন্ত্রটা। কিং আর ইয়ান ফ্লেচার গিয়ে ক্যানভাস তুলে দেখলেন। পেছনটা পুরো খালি।

 তোমার সিগন্যাল নিশ্চয় কোনও গোলমাল করছে, কিং বলল।

 ট্রাকের শূন্য পেছনটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। একপাশে চলে এল। দেখল ট্রাকের সে পাশটা চকচক করে উঠল চোখ। না, মিস্টার কিং, আমাদের সিগন্যাল ঠিকই কাজ করছে। ট্রাকের ভেতরটা দেখুন। বেখাপ্পা লাগছে না বডিটা? বাইরের দেয়ালের ভেতরে আরেকটা দেয়াল আছে। মাঝখানটায় ফাঁপা।

 স্যান ডিয়েগোর দুজন পুলিশকে নিয়ে লাফিয়ে ট্রাকের পেছনে উঠলেন ইয়ান ফ্লেচার। দেয়ালটা পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন। কিশোর, দরজা-টরজা কিছু নেই।

 থাকার কথাও নয়, জবাব দিল কিশোর। এত বোকা নয় কিডন্যাপাররা। ওরা ভেতরে ঢোকার পরই নিশ্চয় ভেতরের দেয়ালটা লাগান হয়েছে। স্যান, ডিয়েগোতে থেমেইছিল সেজন্যে। এটাই ছিল ওদের জরুরী কাজ। দেয়াল খুলে আনতে হবে।

সাবধান, চীফ, হুঁশিয়ার করল হ্যারি। ওরা ভয়ংকর লোক। অস্ত্র আছে।

ট্রাকের দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়তে ইশারা করলেন চীফ পুলিশ দুজনকে। পিস্তল বের করলেন। দেয়ালে লাথি দিয়ে বললেন, ব্যস, হয়েছে, এবার বেরিয়ে এসো। হাত তুলে। কিছু করার চেষ্টা করলে মরবে।

কোনও সাড়া এল না। শুধু যানবাহনের ইঞ্জিনের গুঞ্জন চলছে একটানা। আর মুসার সিগন্যালের জোরালো শব্দ।

কড়া গলায় আবার আদেশ দিলেন ফ্লেচার।

কয়েক সেকেণ্ড নীরবতা। তারপর মড়মড় করে কাঠ ভাঙার শব্দ হলো। ভেঙে খুলে গেল দেয়াল। হাত তুলে বেরিয়ে এল জন আর ডেভ। ওই যে কিশোর বলেছিল, ভেড়া বানিয়ে ছাড়বে, ভেড়াই বনে গেছে যেন ওরা।

 কিশোরের ওপর চোখ পড়ল ডেভের। জিজ্ঞেস করল, তুমি! এত তাড়াতাড়ি বেরোলে কি করে? ট্রাকটা চিনলে কি করে?

চুপ! ধমক দিয়ে বললেন চীফ। অত কথার দরকার নেই! ওদের পিস্তলগুলো কেড়ে নিলেন তিনি।

 ভেতরে হাত-পা বাঁধা আর মুখে কাপড় গোঁজা অবস্থায় পাওয়া গেল পিটারকে। তাকে বের করা হলো। মুখ থেকে কাপড় খুলতেই হাসল সে। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। বের করলে কিভাবে? তাজ্জব ব্যাপার!

কি করে, কিশোর? হ্যারিও অবাক। সিগন্যালের সাহায্যেই করেছ, বুঝলাম, কিন্তু যন্ত্রটা ওখানে গেল কিভাবে? ট্রাকটা তো আগে কখনও দেখোনি?

ট্রাকে ওই যন্ত্র আমি ঢোকাইনি, হেসে বলল কিশোর। ওরা নিজেরাই ঢুকিয়েছেন।

ওরা? একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল রবিন আর মুসা।  

মনে আছে, ওয়ার্কশপে ডেভকে বলেছিলাম, বুঝিয়ে দিল কিশোর। বাগটা রয়েছে পিটারের পকেটে? বলার কারণ ছিল। আমার যন্ত্রটা ছিল আমার প্যান্টের পকেটে। কাজেই চাইছিলাম পিটারের পকেটেই আগে খুঁজুক ও। পিটারের দিকে ঘুরল সে। আমি তার খুব কাছাকাছি ছিলাম। চট করে এক সুযোগে আমার যন্ত্রটা, ফেলে দিলাম ডেভের কোটের পকেটে।

দাঁত বের করে হাসল কিশোর। সারাক্ষণ তার পকেটেই ছিল যন্ত্রটা। ওটার বীপার অফ করা ছিল, কাজেই শব্দ করেনি। কিন্তু সিগন্যাল ঠিকই পাঠাচ্ছিল।

ডেভের দিকে তাকিয়ে রাগ করে বলল জন, গাধা কোথাকার!

জ্বলন্ত চোখে ডেভও তাকাল জনের দিকে, তোমার গাধামী বুদ্ধির জন্যেই এরকম হলো!

নিয়ে যান এগুলোকে বিরক্ত হয়ে পুলিশম্যানদের নির্দেশ দিলেন ফ্লেচার।

একে অন্যকে বকাবকি আর দোষারোপ করতেই থাকল দুই কিডন্যাপার। হাতকড়া পরিয়ে ওদের ট্রাক থেকে নামাল পুলিশ।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগ করেই চীফ বললেন, সিগন্যালটার কথা আমাদেরকে বলনি, কিশোর!

ওটা যে কাজ করবে, শিওর ছিলাম না, স্যার, কৈফিয়ত দিচ্ছে যেন কিশোর। ডেভ পকেটে হাত ঢোকালেই তো শেষ হয়ে যেত। কাপড়ও বদল করতে পারত সে। করেনি, তার কারণ, অতিরিক্ত ব্যস্ত ছিল ওরা। আর বাঁ পকেটে ঢুকিয়েছিলাম। সাধারণত ওই পকেটে কমই হাত দেয় লোকে কোনও জিনিস বের করার জন্যে না হলে ঢোকায় না। আসল কথা হলো, আমাদের ভাগ্য ভাল, কাজটা হয়ে গেল।

হাসলেন চীফ। হ্যাঁ, তা বলতে পারো। যাই হোক, যন্ত্রটা ঢুকিয়ে দিয়ে কাজই করেছ একটা!

তিন গোয়েন্দা হাসল। পিটার হাসল। এখন সে পুরোপুরি নিরাপদ। বিপদ কেটে গেছে। আর কোনও ভয় নেই।

বাবারও কাজ করতে আর কোনও অসুবিধে হবে না, বলল সে। ইচ্ছেমত করতে পারবে।

পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে সে আর কিশোর। দুই যমজ ভাইয়ের মত। অনেকেই অবাক চোখে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। অনেক অবাক ঘটনাই ঘটে এই পৃথিবীতে, যা বিশ্বাস করা কঠিন। এটাও তেমন একটা ঘটনা।

<

Super User