তিন পিশাচ –- রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর, ১৯৯২

রবিনের চোখে পড়ল প্ল্যাস্টিকের ব্যাগটা। সৈকতের বালিতে দেবে রয়েছে। তুলে নিয়ে দেখে হাসল। স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের গায়ে লাল রঙে আঁকা রয়েছে কয়েকটা বেড়ালছানা। গলায় নীল রুমাল বাঁধা। ভেতরে অনেক জিনিসের মধ্যে রয়েছে একটা খেলনা ভালুক, কালো কুৎকুতে চোখ মেলে যেন তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

বাচ্চা মেয়ের জিনিস, বলল সে। ভুলে ফেলে গেছে।

সৈকতের এদিক ওদিক তাকাল মুসা। কোন বাচ্চা মেয়েকে চোখে পড়ল না। বেলা পড়ে এসেছে। নির্জন হয়ে গেছে সৈকত। কেবল একজন নিঃসঙ্গ সারফারকে দেখা গেল তার বোর্ড নিয়ে চলেছে রাস্তার দিকে। ওয়াচটাওয়ার থেকে নেমে চলে যাচ্ছে লাইফগার্ড।

যেখানে আছে ফেলে রাখো, বলল মুসা। মেয়েটার মনে পড়লে ফিরে এসে তুলে নেবে।

বয়েস বেশি কম হলে আসতে পারবে না, বলল দলের তৃতীয় সদস্য কিশোর পাশা। তাছাড়া অন্য কেউও তুলে নিয়ে যেতে পারে।

বালিতে বসে পড়ে ব্যাগটার জন্যে হাত বাড়াল সে। দেখি, কিছু মেলে কিনা। তাহলে পৌঁছে দিতে পারব।

ব্যাগটা নিয়ে উপুড় করে সমস্ত জিনিস কোলের ওপর ঢেলে দিল কিশোর। হুম! বলে ভুরু কোঁচকাল। মানিব্যাগ নেই। আইডেনটিটি নেই। রোমশ খেলনা ভালুকটা বাদেও রয়েছে একটা বই, নাম সাকসেস থ্রু ইমেজিং আর পিপল ম্যাগাজিনের একটা কপি। নানা রকম কসমেটিকসের বাক্স আর টিউব আছে। গুনল কিশোর। চার ধরনের লিপস্টিক, আই শ্যাডোর দুটো প্ল্যাস্টিক বক্স, একটা আইলাইনার পেনসিল এবং মেকাপ করার আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস। একজোড়া লাল পাথর বসানো কানের টবও পাওয়া গেল।

বাচ্চা মেয়ের নয় ব্যাগটা, বলল সে। বয়স্ক মহিলার। প্রচুর মেকাপ নেয়।

এবং ছোটদের মত খেলনা পছন্দ করে, যোগ করল মুসা।

বইয়ের মলাট উল্টে দেখল কিশোর। লাইব্রেরির বই। পেছনের মলাটের ভেতর দিকে আঠা দিয়ে সাঁটা একটা ম্যানিলা খাম, ফ্রেনসো পাবলিক লাইব্রেরির ছাপ মারা।

সূত্র একটা মিলল, খুশি হয়ে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। বই বন্ধ করে বন্ধুদের দিকে তাকাল। কে বইটা নিয়েছে নিশ্চয় খাতায় লেখা আছে। ঠিকানা নিয়ে ব্যাগটা ফিরিয়ে দিতে আর অসুবিধে হবে না।

ফ্রেনসো, না? ঠোঁট ওল্টাল রবিন। ফোন করতে অনেক পয়সা লাগবে।

 লাগুক, মুসা হাসল। জিনিস ফেরত পেলে খুশি হয়ে কলের দামটা দিয়ে দেবে মহিলা।

হয়ত আমাদেরকে দাওয়াতও করে বসতে পারে, আশা করল কিশোর। ফ্রেনসোর আঙুরের খেত দেখার জন্যে। চলো, তাড়াতাড়ি করতে হবে। নইলে লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবে।

বালির ওপর দিয়ে মেইন রোডের দিকে প্রায় দৌড়ে চলল তিন গোয়েন্দা। সাইকেল তিনটে শুইয়ে রেখে গেছে রাস্তার পাশে। তুলে নিয়ে ছুটল স্যালভিজ ইয়ার্ডে।

ইয়ার্ডে যখন পৌঁছল সূর্য তখন ডুবতে বসেছে। বাড়ির জানালাগুলোয় রোদ পড়ে কাচগুলোকে মনে হচ্ছে চারকোণা সোনার চাদর। সেদিকে নজর দেয়ার সময় নেই ওদের। তাড়াহুড়া করে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে এসে ঢুকল হেডকোয়ার্টারে। ফ্রেনসোর ডিরেকটরি এনকয়ারিতে ফোন করল কিশোর। পাবলিক লাইব্রেরির নম্বর নিয়ে ডায়াল করল লাইব্রেরিতে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, সময় বেশি নেই।

 বেশি সময় লাগলও না। ওপাশ থেকে রিসিভার তুলতেই টেলিফোন লাইনে লাগানো স্পীকারের সুইচ অন করে দিল কিশোর, সবার শোনার জন্যে। ভারিক্কি চালে বলল, হ্যালো, কিশোর পাশা বলছি। তারপর জানাল কেন ফোন করেছে।

কমপিউটারে রেকর্ড করা আছে সব, ওপাশ থেকে জবাব দিল মহিলা কণ্ঠ। দেখি, কি করতে পারি।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবার শোনা গেল কথা। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মহিলা। তোমাদের নম্বরটা দেয়া যাবে? আবার ফোন করতে হতে পারে–

যাবে।

প্লীজ!

নম্বর দিল কিশোর।

ফোনের কাছ থেকে নোড়ো না, মহিলা বলল। কেটে গেল লাইন।

আস্তে করে রিসিভার নামিয়ে রেখে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল কিশোর। ব্যাপারটা কি বলো তো? মহিলাকে বেশ অস্থির মনে হল।

কিছু একটা হয়েছে, মুসা বলল।

কয়েক মিনিট পরেই ফোন বাজল। ওপাশের কণ্ঠটা এবারেও একজন মহিলার, তবে আগের জনের নয়। উত্তেজনায় কাঁপছে, উন্মাদ হয়ে গেছে যেন। ওকে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল মহিলা। আমি আসছি। আমার মেয়েটা …মেয়েটা হারিয়ে গেছে!

ফুঁপিয়ে উঠল লাউডস্পীকার। আরেকটা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল। শান্ত হও নরিয়া, প্লীজ, ওরকম কোরো না! রিসিভারটা মহিলার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছেন তিনি। কিশোর পাশা?

বলছি।

বইটা সৈকতে পেয়েছ?

হ্যাঁ।

ফ্রেনসো পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বইটা ধার নিয়েছিল আমার মেয়ে। তার পর পরই হারিয়ে গেছে।

বলুন।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, হলিউডে গিয়ে সিনেমায় অভিনয় করবে বলে।

পেছন থেকে মহিলা বললেন, ওকে বলো, আমরা আসছি।

বলছি, নরিয়া, বলছি।

লম্বা দম নিলেন ভদ্রলোক, টেলিফোনেই বোঝা গেল। বললেন, আমার নাম পিটার ডিকসন। তোমাদের ফোন পেয়ে আশা হচ্ছে, মনে হচ্ছে ডলি ভালই আছে। তোমাদের সঙ্গে দেখা করা দরকার। কথা বললে কিছু বেরিয়ে পড়তে পারে। ব্যাগে কোন ঠিকানা পেয়েছ?

না।

পুলিশ কিছু করতে পারছে না। তোমাদের ঠিকানাটা দাও। কাল সকাল নাগাদ পৌঁছে যাব।

লিখে নিন।

ঠিকানা লিখে নিয়ে কিশোরকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কেটে দিলেন মিস্টার ডিকসন।

মেয়ে হারিয়েছে। প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা। চমৎকার আরেকটা কেস পেয়ে গেল বোধহয় তিন গোয়েন্দা, কি বলো?

বইটার পাতা ওল্টাতে আরম্ভ করেছে কিশোর। জানি না। কয়েকটা রশিদ বেরোল ভেতর থেকে। দেখে নিয়ে মাথা দোলাল সে, এটা হাই-লো লোন জুয়েলারি কোম্পানির। আর এটা ক্যাশ-ইন-আ-ফ্ল্যাশ, ইক। বন্ধকী কারবার করে। মনে হচ্ছে মেয়েটার টাকার খুব দরকার পড়েছিল।

রশিদগুলো ভেতরে রেখে বইটা বন্ধ করে নামটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। সাকসেস গ্রু ইমেজিং। নাম শুনেছি বইটার। লেখক বলতে চান, শুধু কল্পনা করেই মনের জোরে তুমি যা চাইবে তাই পেয়ে যাবে। মনের মত কাজ চাও? পেয়ে যাবে। বাড়ি চাও..

কিংবা সিনেমার অভিনেত্রী হতে চাইলেও হয়ে যাবে, রবিন বলল।

তাই। আবার বইটা খুলল কিলোর। একটা বিশেষ অধ্যায়ের বিশেষ জায়গা পড়তে শুরু করল, কি ভাবে উন্নতি করা যায়। ইচ্ছে শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যা ইচ্ছে তাই পাওয়া যায়।

 খাইছে! হেসে ফেলল মুসা। এ তো দেখছি আলাউদ্দিনের আশ্চর্য চেরাগ। উইল পাওয়ার খাটাতে খাটাতে বাড়ি যাই। দেখব, একটা আস্ত কেক দিয়ে ফেলে নাকি মা।

.

০২.

পরদিন সকালে ইয়ার্ডের অফিসের সামনে জটলা করছে তিন গোয়েন্দা। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল একটা টয়োটা। ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এসে কিশোর পাশাকে খুঁজলেন এক ভদ্রলোক। লম্বা, মাথায় বাদামী চুল পাতলা হয়ে আসছে, চেহারায়। বুদ্ধির ছাপ। পাশের প্যাসেঞ্জার সিট থেকে নামলেন এক মহিলা। কালো চুল। চোখেমুখে প্রচণ্ড উদ্বেগের ছাপ।

মিস্টার ডিকসন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

 হ্যাঁ। তুমিই ডলির ব্যাগটা পেয়েছিলে তো?

আমি না, রবিন পেয়েছে। দুই সহকারীর পরিচয় করিয়ে দিল, কিশোর। অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন মেরিচাচা। ডিকসনদের মেয়ে হারিয়েছে শুনে তাদেরকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলেন বসে কথা বলার জন্যে।

 টেবিলে ব্যাগটা রেখে দিয়েছে কিশোর। মিসেস ডিকসন দেখে চিনতে পেরে মাথা ঝাঁকালেন। ও রকম ব্যাগ পছন্দ করে ডলি। হালকা। ভেতরের জিনিসগুলো ঢেলে দিলেন টেবিলে। খেলনা ভালুকটার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকালেন। এটা কিছু বলতে পারবে না।

লাইব্রেরির বইটা তুলে নিলেন তিনি। ভেতর থেকে বের করলেন রশিদগুলো। একবার দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন, পিটার, ও না খেয়ে আছে! পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভিখিরি আর চোর-বদমাশদের সঙ্গে! মরবে তো!

রশিদগুলো দেখে ডিকসনও গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, অনেক কারণেই মানুষ জিনিস বন্ধক রেখে টাকা ধার নেয়। না খেয়ে আছে, এটা জোর দিয়ে বলতে পারো না।

 হাতে করে একটা খাম নিয়ে এসেছেন তিনি। টেবিলের ওপর উপুড় করে ঢেলে দিলেন। একগাদা ফটোগ্রাফ। ডলির ছবি। আঠারো বছর বয়েস। সৈকতে বেশি যাওয়ার অভ্যেস থাকলে নিশ্চয় তাকে দেখেছ।

তিন গোয়েন্দার হাতে হাতে ছবিগুলো ঘুরতে থাকল। সুন্দর চেহারার কালো চুল আর সবুজ চোখওয়ালা একটা মেয়ের ছবি। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাজিয়ে দলের ড্রামবাদকের পোশাক পরা। কড়া করে লিপস্টিক লাগিয়েছে। কোনটাতে ব্যালে ড্যান্সার, কোনটাতে তীর্থযাত্রী। দশ বছর বয়েসে তোলা ছবি আছে, আছে তের বছর বয়েসে তোলা মিস টিন ফ্রেনসো প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ হওয়ার ছবি।

ছবিগুলো অবাক করল ছেলেদের।

একেক ছবিতে একেক রকম লাগছে, মুসা বলল। কোনটা যে ওর আসল চেহারা বোঝাই মুশকিল।

চুলের কারণে লাগছে এরকম, বুঝিয়ে দিলেন মিসেস ডিকসন। কখনও লম্বা, কখনও ছোট। কখনও সাদা লিপস্টিক, কখনও গাঢ় লাল, কখনও কমলা। তবে সবুজ আর নীল কখনও লাগাতে দেখিনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে চুলেও রঙ লাগায়নি।

কাঁদতে শুরু করলেন মিসেস ডিকসন।

পুলিশকে জানিয়েছি, ডিকসন বললেন। কিছুই করতে পারছে না। সৈকতে যে জায়গায় ব্যাগটা পেয়েছ, সে জায়গাটা দেখতে চাই। তারপর লাইফগার্ডদের সঙ্গে কথা বলব।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। সার বেঁধে গিয়ে উঠল ডিকসনের গাড়িতে। সারাটা সকাল তিনজনেই বসে বসে দেখল সৈকতময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ডিকসন দম্পতি। লাইফগার্ড আর অল্প বয়েসী রৌদ্র স্নানার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন। বেলা একটা নাগাদ হতাশ এবং ক্লান্ত হয়ে পড়লেন দুজনে।

ছবিটা কেউ চিনতে পারল না, ডিকসন বললেন।

ছবিতে যা দেখাচ্ছে মেয়েটা তার চেয়ে সুন্দর, মিসেস বললেন। গোলমালটা বোধহয় সেখানেই। আবার কাঁদতে শুরু করলেন তিনি।

 খুঁজে ওকে বের করবই, বললেন ডিকসন। ছেলেদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, এ শহরে খুঁজতে কতটা সময় লাগবে, বলতে পার? বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করব। সুপারমার্কেটগুলোতে খোঁজ নেব। হ্যাণ্ডবিল বিলি করব। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব।

এখানকার পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন, পরামর্শ দিল রবিন। খুব ভাল লোক।

সুতরাং থানায় চললেন ডিকসন দম্পতি। ফ্লেচারের সঙ্গে দেখা করে মেয়ে হারানোর কথা জানালেন।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাপ্টেন বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই হলো সমস্যা। একটা ছবিতে টোকা দিয়ে বললেন, এটা রাখতে পারি?

নিশ্চয়ই, মিসেস বললেন।

 শেষ কবে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? জানতে চাইলেন ফ্লেচার।

দুমাস আগে। এর দুদিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। ফোন করে আমাদেরকে চিন্তা করতে মানা করল। আমরা তাকে বোঝাতে যেতেই কেটে দিল লাইন।

মাথা ঝাঁকালেন চীফ। ডিকসনদের ফোন নম্বর আর ঠিকানা লিখে নিয়ে বললেন, আমার লোকদের জানিয়ে দেব। খেয়াল রাখবে। ইয়ে, ছেলেগুলোকে কাজে লাগাচ্ছেন না কেন?

ছেলেগুলো? বুঝতে পারলেন না মিসেস ডিকসন।

হ্যাঁ, ওরা। তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন চীফ। ওরা গোয়েন্দা। ভাল কাজ করে। বহুবার সাহায্য করেছে পুলিশকে।

এই সুযোগটারই যেন অপেক্ষায় ছিল কিশোর। চীফ বলেও সারতে পারলেন না, পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে বাড়িয়ে ধরল সে।

কার্ডটা পড়লেন ডিকসন। বললেন, চীফ যখন সুপারিশ করছেন, কোন প্রশ্ন আর করতে চাই না। বুঝতে পারছি তোমরা ভাল কাজ করো। ঠিক আছে, ভাড়া করলাম। চেক লিখে দেব?

না, মাথা নাড়ল কিশোর। টাকা নিই না আমরা। শখে কাজ করি। তবে ডলিকে আগে পেয়ে নিই, খরচাপাতি যা হবে, বিল পাঠিয়ে দেব, দিয়ে দেবেন। এখন আপনার মেয়ের একটা ছবি দরকার আমাদের।

যা চাও, পুরো খামটাই কিশোরকে দিয়ে দিলেন ডিকসন। যখন যা দরকার হবে, শুধু একটা ফোন করবে আমাকে। পেয়ে যাবে।

তো, আমরা এখন কি করব? চীফকে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস।

বাড়ি ফিরে যান। টেলিফোনের কাছে বসে থাকবেন। আমরা কিছু জানতে পারলে জানাব।

হায়রে, মেয়েটাকে কত মানা করলাম বেরোতে, গলা ধরে এল মিসেস ডিকসনের, শুনল না। আর দেখব কিনা কে জানে!

.

০৩.

কাজটা আসলে আমাদেরকে গছিয়ে দিলেন চীফ, মুসা বলল।

তা তো দিলেন, টেবিলে বিছানো ছবির দিকে তাকিয়ে রবিন বলল, কিন্তু শুরু করব কোত্থেকে?

হাসল কিশোর। বন্ধকীর দোকানগুলো থেকে করতে পারি।

হেডকোয়ার্টারে বসে কথা বলছে ওরা।

সোজা হল রবিন। ঠিক।

ওসব জায়গা থেকে টাকা ধার করতে হলে, কিশোর বলল। কোন মূল্যবান জিনিস জমা রাখতে হয়। নাম-ঠিকানা দিতে হয়।

তাহলে তো পেয়েই গেলাম! নিশ্চিন্ত হলো মুসা।

পাব, সব সময় নিরাশ করার প্রবণতা কিশোরের, খারাপ দিকটা চিন্তা করে, যদি রশিদগুলো ডলির হয়। অন্য কারুরটাও রাখতে পারে। দুই সহকারীর মুখের দিকে তাকাল, গোয়েন্দাপ্রধান। রশিদে হলিউডের ঠিকানা দেখা যাচ্ছে। একটু পরেই পিকআপ নিয়ে হলিউডে যাবে বোরিস। লিফট নিতে পারি আমরা।

একমত হয়ে ট্রেলার থেকে বেরিয়ে এল তিনজনে।

হাতের কাজ শেষ করে গাড়ি বের করল বোরিস। মেয়েটা যে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, একথা শুনেছে। রাশেদ পাশার কিনে রেখে আসা পুরনো মাল আনতে হলিউডে যাচ্ছে সে। তিন গোয়েন্দাকে নিতে অসুবিধে নেই।

 পেছনে উঠে বসল তিন কিশোর। রশিদের ঠিকানা মোতাবেক প্রথম দোকানটার সামনে নামল। ভেতরে আলো খুব সামান্য। কেমন ছাতলা পড়া গন্ধ। কিশোরের বাড়িয়ে দেয়া রশিদটার দিকে গম্ভীর মুখে তাকাল মালিক, তারপর নীরবে খুলল একটা আলমারির তালা। নীল ফিতে লাগানো রূপার একটা মেডেল বের করে আনল। ফেরত নেবে?

হাতে নিয়ে জিনিসটা দেখতে লাগল কিশোর। স্ট্যাচু অভ লিবার্টির মত দেখতে একটা মূর্তি আঁকা রয়েছে মেডেলের একপিঠে। আরেক পিঠে লেখা রয়েছেঃ ফ্রেনসো জেসিজ স্পেলিং বী প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। ডালিয়া ডিকসন।

মেয়েটা ঠিকানা রেখে গেছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। আমরা তার বন্ধু।

বাড়ি থেকে পালিয়েছে নিশ্চয়?

 হ্যাঁ। মাস দুই আগে…

হাত তুলে থামিয়ে দিল কিশোরকে দোকানি। আর বোলো না। ওসব পুরানো কেচ্ছা। শুনতে ভাল লাগে না।

একটা রেজিস্টার বের করে কাউন্টারে বিছিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল সে। কি নাম বললে?

ডালিয়া ডিকসন।

মাথা নাড়ল লোকটা। না। জিনিসটা বন্ধক রেখে গেছে এলিজা পিলচার।

ঠিক বলছেন তো? রবিনের কণ্ঠে সন্দেহ।

চোখ ভালই আছে আমার।

ঠিকানা আছে? জানতে চাইল কিশোর।

আবার খাতার দিকে তাকাল লোকটা। পশ্চিম লস অ্যাঞ্জেলেস। তেরোশো বিরাশি রিভারসাইড ড্রাইভ।

কিন্তু পশ্চিম লস অ্যাঞ্জেলেসে তো কোন রিভারসাইড ড্রাইভ নেই? রবিনের প্রশ্ন।

মিথ্যে ঠিকানা অনেকেই দিয়ে থাকে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিশোরের বাড়িয়ে ধরা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল দোকানি। কিছুটা নরম হয়ে বলল, দেখতে তো ভালই। ও মেডেল নিয়ে আসেনি। যে এসেছিল তার চুল সোনালি, গালে একটা তিল আছে। ট্রায়াফে অভিনয় করে যে মেয়েটা তার মত। প্রতি সোমবার টিভিতে দেখে আমার স্ত্রী।

ওই অভিনেত্রীর নাম এলিজা পিলচার, কিশোর বলল।

মাথা ঝাঁকাল দোকানি। কি জানি, অন্য কেউও এসে তার নামে মেডেলটা দিয়ে টাকা নিতে পারে। ছদ্মবেশ ধরাটা তো কঠিন কিছু না। শোনো, এটা কি নেবে তোমরা? আট ডলার পঁচাত্তর সেন্ট লাগবে।

টাকা দিয়ে মেডেলটা নিয়ে নিল কিশোর।

 বাইরে বেরিয়ে পিকআপে এসে উঠল তিন গোয়েন্দা।

কেসটা বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না আমার, অভিযোগের সুরে বলল মুসা।

খুব তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে যাও তুমি, কিশোর বলল। তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে। কোন দোকানে খোঁজ পেয়েও যেতে পারি।

দ্বিতীয় দোকানের মালিক ততটা নিরস নয়। তবে তেমন তথ্যও দিতে পারল। শুধু বলতে পারল, সোনার একটা আংটি নিয়ে এসেছিল একটা মেয়ে। পরনে টিউনিক, পায়ে হাঁটু সমান উঁচু বুট। মহাকাশের গল্প নিয়ে করা ছবি। সার্চ ফর এরিওয়ান-এর অভিনেত্রীর মত পোশাক।

 কি নাম বলল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

শেলি টেনার।

হু। ছবিটার নায়িকার নাম।

আংটিটা নেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না কিশোর। নিল না। পিকআপে ফিরে এসে দেখল অস্থির হয়ে উঠেছে বোরিস। বার বার ঘড়ি দেখছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে বোধহয়।

তোমাদের হলো? জিজ্ঞেস করল সে।

আর একটা দোকান, জবাব দিল কিশোর। হলিউড বুলভারে যেতে হবে।

দেরি করলে রেগে যাবেন মিসেস পাশা, বলল বটে, তবে গাড়ি নিয়ে চলল বুলভারে। এই রাস্তাটা আমার পছন্দ না।

কেন, সেটা জানা আছে গোয়েন্দাদের। গলিটা নোংরা। দুধারের বাড়িগুলো জীর্ণ, মলিন। মানুষগুলোও তেমনি। হলিউডের চাকচিক্যের ছিটেফোঁটাও নেই এখানে।

যে দোকানটা খুঁজছে কিশোররা, তার এক ব্লক দূরে মোড়ের কাছে গাড়ি রাখার জায়গা আছে। নেমে গেল ছেলেরা। স্যুভনির আর হলিউডের ম্যাপ বিক্রি করে ওরকম একটা দোকান পার হয়ে আরও দুটো দরজার পর বন্ধকী দোকানটা। আগে আগে চলেছে মুসা।

অহেতুক সময় নষ্ট, বিড়বিড় করে বলল সে। দোকানের দরজায় পা দিল।

হঠাৎ চেঁচামেচি শোনা গেল দোকানের ভেতর। ছুটে বেরোল একটা লোক। মুসার গায়ে এসে পড়ল। কনুইয়ের গুঁতো মেরে তাকে ফেলে দিয়েছিল আরেকটু হলেই।

অ্যাই অ্যাই! করে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। তাকিয়ে রয়েছে মুসা। কালো মুখ ঠোঁটের দুই কোণ থেকে বেরিয়ে রয়েছে শ্বদন্ত। নাকের ফুটো বড় বড়। চোখ প্রায় দেখাই যায় না গভীর কোটরের অনেক ভেতরে যেন লুকিয়ে রয়েছে। শয়তানী ভরা চাহনি।

আবার চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলল মুসা। শব্দ বেরোল না। লোকটার হাতের দিকে তাকাল। কালো, রোমশ থাবা। বড় বড় নখ বেরিয়ে আছে আঙুলের মাথা থেকে।

দোকানের ভেতরে চিৎকার শোনা গেল। ছুটতে শুরু করল অদ্ভুত লোকটা।

আবার চিৎকার করে উঠল দোকানের ভেতরের লোকটা, ধর! ধর!

গলির দিক থেকে চেঁচিয়ে উঠল এক মহিলা।

সুভনিরের দোকানের ভেতরে দুঃস্বপ্নের মত হারিয়ে গেল কিম্ভুত মানুষটা। আবার শোনা গেল চেঁচামেচি।

এতক্ষণে হুঁশ ফিরল যেন মুসার। দৌড়ে গেল স্যুভনিরের দোকানে। দেরি করে ফেলেছে। পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে চলে গেছে লোকটা।

বন্ধকীর দোকানে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। দোকানদার কাঁপছে এখনও। কিশোরের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ডাকাতি করতে এসেছিল! পালাল!

 সাইরেন শোনা গেল গলির মাথায়। ভেতরে এসে ঢুকল একটা পুলিশের গাড়ি। ওটা দোকানের সামনে এসে থামতে না থামতেই পেছনে এসে দাঁড়াল, আরেকটা। ভিড় জমল। দোকানের মালিকের সঙ্গে বেরেলি তিন গোয়েন্দা। পাগলের মত হাত নাড়ছে লোকটা।

জনতাকে পিছে হটিয়ে দিল একজন পুলিশ অফিসার। আরেকজন জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেল দোকানদারকে। হাত তুলে মুসাকে দেখিয়ে দিল লোকটা। তৃতীয় আরেকজন অফিসার এসে প্রশ্ন করল মুসাকে, তুমিই লোকটাকে থামানোর চেষ্টা করেছিলে?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

কি হয়েছিল?

দ্বিধা করল মুসা। বলল, বললে তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না। পাগল ভাববেন আমাকে।

বলো।

লোকটা…লোকটাকে মানুষ মনে হল না। দানব!

 ধৈর্য হারাল না অফিসার। গরিলা? না অন্য কোন ধরনের দানব?

গরিলা-টরিলা নয়। কি বলব?…মায়ানেকড়ের মত লাগল। সিনেমাতে যেগুলো দেখায়।

হুম! নোটবুক বের করল অফিসার। তা মায়ানেকড়েটা কতটা লম্বা হবে?

 প্রায় আমার সমান।

 কিশোরের দিকে ফিরল অফিসার। তুমি কি জিনিস দেখেছ?

কিশোর জানাল, সে-ও মায়ানেকড়েই দেখেছে। তারপর বলল, অবাক লাগছে না তো আপনার?

হাসল অফিসার। গত হপ্তায় একটা পেট্রল স্টেশনে এরকম ঘটনা ঘটেছে। গরিলা সেজে এসেছিল একজন।

হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে এতক্ষণে, বলে উঠল বন্ধকী দোকানের মালিক। কাগজে দেখেছি। সবুজ মুখওয়ালা মানুষের কথাও পড়েছি। ঘাড় থেকে নাকি কি একটী বেরিয়ে থাকে। সান্তা মনিকায় কি যেন করেছিল।

অফিসার হাসল। এ শহরে কোন কিছুই স্বাভাবিক নয়।

পুলিশ চলে গেলে তিন গোয়েন্দাকে বলল দোকানদার, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে?

ডলির কথা বলল তাকে কিশোর। দোকানে ঢুকে রেজিস্টার বের করল লোকটা। তারপর ড্রয়ার খুলে ধনুকের মত, দেখতে একটা সোনার পিন বের করল।

এ রকম একটা জিনিস বন্ধক রাখতে আসে কেউ, বল? লোকটা বলল। খারাপ লাগে না? ইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন নেয়ার পর সাধারণত মানুষ এ ধরনের জিনিস উপহার পায়।

যে মেয়েটা বন্ধক রাখতে এসেছিল তার চেহারা মনে আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। দেখুন তো ও নাকি?

কিশোরের বারিয়ে ধরা ডালিয়া ডিকসনের ছবিটা দেখল দোকানি। হতে পারে। কড়া মেকআপ করে এসেছিল। চুলের রঙও আরেকটু হালকা ছিল। তবে এ-ই হতে পারে।

আরেকবার রেজিস্টার দেখল লোকটা। জানাল পিনটা বন্ধক রাখতে এসেছিল এনভি নিউম্যান নামে একটা মেয়ে।

আরেকজন অভিনেত্রীর নাম, গুঙিয়ে উঠল কিশোর। নাহ, কোন পথ দেখতে পাচ্ছি না।

.

০৪.

সেদিন বিকেলে হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিনজনে। হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়েছে মুসা। প্রশ্ন তুলল, এ রকম বহুরূপী একটা মেয়েকে কি করে খুঁজে বের করব আমরা?

একটা মুহূর্ত কেউ কোন জবাব দিতে পারল না। তারপর কিশোর বলল, সিনেমায় ঢোকার চেষ্টা করছে ডলি। কাজেই দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে। ওদের কাছে গিয়ে খোঁজ নিতে পারি আমরা।

হ্যাঁ, চেষ্টা করতে দোষ কি? খুব একটা আশাবাদী মনে হল না মুসাকে।

পরদিন সকালে বাসে করে হলিউডে চলে এল তিনজনে। একটা তালিকা তৈরি করে নিয়ে এসেছে কিশোর। এক নম্বর নামটা থেকে শুরু করল। প্রথমেই রিসিপশনিস্টের সঙ্গে দেখা। রোগাটে এক মহিলা। ওদের কথা শুনতেই চাইল না। অবশেষে জানিয়ে দিল, মক্কেলদের কথা বাইরের লোকের কাছে বলার নিয়ম নেই।

সে আপনাদের মক্কেল না-ও হতে পারে, মরিয়া হয়ে বলল মুসা।

তাহলে আমাদের কাছে এসেছ কেন? আবার টাইপিঙে মন দিল মহিলা।

দ্বিতীয় এজেন্সীটাতে গোমড়ামুখো মহিলা কড়া গলায় বলল, জানলেও বলতাম না। লজ্জা করে না? এই বয়সেই অভিনেত্রীদের পিছে লেগেছ?

লাল হয়ে গেল কিশোরের মুখ। পিছে লাগিনি। তার বাবা-মা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন তাকে খুঁজে বের করতে…

ও, বাড়ি থেকে পালিয়েছে। তাহলে পুলিশের কাছে যায় না কেন? তিনটে ছেলেকে পাঠায়। যত্তসব! ওসব শয়তান ছেলেমেয়ের খোঁজ রাখার দায়িত্ব নিইনি আমরা। যেতে পার।

তৃতীয় এজেন্সীটাতে অতটা খারাপ ব্যবহার করল না রিসিপশনিস্ট। কিশোরকে চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠল, আরে, মোটুরাম না! কি কাণ্ড দেখো

ছেলেবেলায় একটা কমেডি সিরিজে অভিনয় করেছিল কিশোর। সেটাতে তার। নাম ছিল বেবি ফ্যাট সো। নামটাকে ঘৃণা করে সে। এবং যে ওই নামে তাকে ভাকে, তাকেও। 

ডলির ছবির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল মহিলা। ও রকম চেহারার অনেকেই আছে। কে ও? বোন? বন্ধু?

তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড মহিলাকে দিয়ে কিশোর জানাল, ওর নাম ডালিয়া ডিকসন। ওকে খুঁজে বের করে দেয়ার জন্যে আমাদেরকে অনুরোধ করেছে। ওর বাবা-মা। দুমাস আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।

মনে হয় অহেতুক সময় নষ্ট করছ। ওর মত আরও হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আছে। তবে সিনেমায় ঢোকার চেষ্টা করে থাকলে খোঁজ মিলতেও পারে। টেলিভিশনের জন্যে একটা সিরিজ হচ্ছে, রিচ ফর আ স্টার। তার অডিশনে যোগ দিতে পারে। ওখানে অ্যামেচারদেরকে ডাকা হয়েছে।

যে স্টুডিওতে অডিশন হবে তার ঠিকানাটা দিল মহিলা। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ছেলেরা। স্টুডিওতে পৌঁছে দেখল গেটের সামনে লাইন, লম্বা হয়ে চলে গেছে, সেই ব্লক পেরিয়ে তার পরের ব্লকের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে।

সোজা গেটের দিকে এগোল কিশোর। চিৎকার করে উঠল লাইনে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েরা। প্রতিবাদের ঝড় উঠল।

কিশোরের হাত চেপে ধরল মুসা। এভাবে পারবে না। অন্য কোন উপায় বের করতে হবে। এ লাইনে দাঁড়ালে এ জনমে কোনদিন ঢুকতে পারব না।

 বাস স্টপেজের একটা বেঞ্চে বসে পড়ল কিশোর। উপায় তো একটা বের করতেই হবে।

তিনজনেই ভাবছে। উজ্জ্বল হলো রবিনের মুখ। এখানে ঢোকা যাবে না। তার চেয়ে আরেক কাজ করতে পারি আমরা। ট্যালেন্ট এজেন্টদের সাহায্য নিতে পারি। ডলির ছবি দিয়ে হ্যাঁন্ডবিল ছেপে ডাকে পাঠিয়ে দেব ওদের কাছে। এ শহরে যতগুলো স্টুডিও আর এজেন্ট আছে সবার কাছে পাঠাব। অনুরোধ থাকবে, এই মেয়েটিকে কেউ দেখে থাকলে দয়া করে তিন গোয়েন্দাকে একটা ফোন করবেন। ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দিয়ে দেব আমাদের।

সাড়া দিল না কিশোর।

আমার কিন্তু বেশ ভাল মনে হচ্ছে, আবার বলল রবিন।

আমারও, তার সঙ্গে একমত হলো মুসা। সারা হলিউড চষে বেড়াতে হবে না। যে সব লোক আমাদের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না তাদের কাছে গিয়ে ধরনা। দিতে হবে না।

এর চেয়ে ভাল আর কোন উপায় আপাতত কিশোরেরও মাথায় এল না। অগত্যা আবার কি বীচে ফিরে চলল বাসে করে। ইয়ার্ডে ফিরে দেখল, রোভার একা। ভেনচুরাতে মাল কিনতে গেছেন রাশেদ পাশা আর মেরিচাচী। বোরিসকেও নিয়ে গেছেন। কিশোরকে দেখেই রোভার বলল, বাজারে যেতে পারেননি আজ ম্যাম। ফ্রিজে কিছু নেই, বলে গেছেন, খিদে পেলে পয়সা বের করে নিয়ে গিয়ে পিজাটিজা কিছু কিনে খেতে।

খুব ভাল, খুব ভাল, খুশি হয়ে উঠল মুসা। তাই খাব। দেরি করছি কেন?

দাঁড়াও, টাকা নিয়ে আসি, কিশোর বলল। ভালই হল। খেতে খেতে হ্যাঁণ্ডবিলে কি লিখতে হবে সেটার একটা খসড়া করে ফেলতে পারব।

সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তিনজনে। রকি বীচে কোস্ট, হাইওয়ের পাশের পিজা শ্যাকটা বেশ জনপ্রিয়। ওখানে গিয়ে ভিড় করে কিশোর আর তরুণেরা। পিজা খায়, ভিডিও গেম খেলে, মিউজিক শোনে, আর বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ জমায়।

তিন গোয়েন্দা ঢুকে দেখল, ভিডিও গেম খেলছে কয়েকজন। কালো চুলওয়ালা হাসিখুশি একটা মেয়ে খেলছে আর মাথা ঝাঁকিয়ে খিলখিল করে হাসছে।

বড় সাইজের তিনটে পিজার অর্ডার দিয়ে কাউন্টারের সামনে বসে অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। হুল্লোড় করে উঠল ভিডিও গেম প্লেয়াররা।

মেয়েটা মনে হয় ভাল খেলে, রবিন মন্তব্য করল।

খেলা শেষ। ফিরে তাকাল মেয়েটা। তারপর উঠে এল টুল থেকে। দরজার দিকে এগোল। তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। মেয়েটার স্কার্টের ঝুল এত বেশি। প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। পুরানো ছাটের একটা ব্রাউজ পরেছে, সামনের দিকটা দোমড়ানো। খুদে একটা ঘড়ি বসানো রয়েছে বুকের একপাশে। কানে দুল। সব কিছু মিলিয়ে তাকে এ যুগের মেয়ে লাগছে না, মনে হচ্ছে একশো বছর আগের। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। বেরিয়ে গেল।

এ রকম পোশাক পরেছে কেন? অবাক হয়ে বলল রবিন।

কুমড়োর মত মোটা এক মহিলা বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। হাতে ট্রে। খাবারে বোঝাই। তিনটে পিজা ছেলেদের সামনে নামিয়ে রেখে কোকা কোলা। আনতে গেল।

 খাবারের দিকে হাত বাড়িয়েই থমকে গেল কিশোর। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, পেয়েছি! তুড়ি বাজাল। ওই মেয়েটাই!

কোন মেয়েটা? বুঝতে পারল না মুসা।

ডলি। ডালিয়া ডিকসন! কোন সন্দেহ নেই।

লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর। হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে ছুটে বেরোল। পিজা শ্যাকের সামনের পার্কিং স্পেসে এসে দাঁড়িয়ে তাকাল ডানে বাঁয়ে। তারপর মেইন রোডের দিকে। দুদিক থেকেই চলাচল করছে গাড়ি। ওপাশে রাস্তার বাইরে। দাঁড়িয়ে-বসে রয়েছে কয়েকজন ভবঘুরে। কিন্তু পুরানো পোশাক পরা মেয়েটা নেই।

.

০৫.

 এই শুনছ! এই ভাই, খেলাটা একটু থামাবে তোমরা? জরুরী কথা বলতাম। খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে বলল কিশোর। আবার এসে পিজা শপে ঢুকেছে। খেলা থামিয়ে ফিরে তাকাল সবাই। অবাক হয়েছে। রান্নাঘরে যাচ্ছিল মোটা মহিলা, থমকে দাঁড়াল।

যে মেয়েটা এইমাত্র বেরিয়ে গেল, বলল কিশোর। তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা।

 পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল খেলোয়াড়েরা। কারও কারও চোখে সন্দেহ ফুটেছে এখন। অস্বস্তি বোধ করছে। একজন জানতে চাইল, কেন?

 ডলির ছবি বের করে দিল কিশোর। হাতে হাতে ঘুরতে লাগল ওটা। বলল, ওর বাবা দিয়েছেন ছবিটা। খুঁজে বের করতে অনুরোধ করেছেন। ফ্রেনসোতে বাড়ি। দুই মাস আগে বেরিয়েছে, আর ফিরে যায়নি।

কিন্তু ওর বাবার নাম তো ডিকসন নয়, বলল আরেকটা ছেলে। ওর নামও ডলি নয়।

হয়ত বানিয়ে অন্য নাম বলেছে, রবিন বলল।

 অনেক বেশি ডিটেকটিভ ছবি দেখো তোমরা, বলল একটা মেয়ে।

গরম হয়ে বলল মুসা, ছবি দেখলেই ডিটেকটিভ হয়ে যায় নাকি! খালি : এককথা। বোঝে না শোঝে না, একটা বলে দিলেই হলো।

তার ধমকে কাজ হলো। অস্বস্তিতে পড়ে গেল ছেলেমেয়েরা। আরেকটা মেয়ে বলল, ওই মেয়েটা বাড়ি থেকে পালায়নি। এদিকেই থাকে।

চেনো?

চিনি।

দুই মাসের বেশি? কিশোর জানতে চাইল

জবাব দিতে পারল না মেয়েটা।

ঘন ঘন পোশাক পাল্টায়, তাই না? আবার বলল কিশোর। চুলের রঙও বদলায়।

চুপ হয়ে গেছে সবাই। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে খেলোয়াড়েরা। জবাব দিতে চাইছে না। ভাবছে বোধহয়, এই তিনজন কারা?

তামাটে রঙের একটা গাড়ি এসে থামল বাইরে। ধূসর চুলওয়ালা একজন। লোক ঢুকলেন। কি ব্যাপার, সবাই এত চুপচাপ? কিছু হয়েছে নাকি?

না, মিস্টার জেনসেন, এগিয়ে এল ওয়েইট্রেস। এই ছেলেগুলো ওদের একজন বন্ধুকে খুঁজতে এসেছে।

ও, বলে কাউন্টারের ওপাশে চলে গেলেন মিস্টার জেনসেন। ক্যাশ রেজিস্টার খোলা এবং টাকা গোনা দেখেই বোঝা গেল তিনি ম্যানেজার।

অবশেষে কিশোরকে বলল একটা মেয়ে, ওই মেয়েটা কোথায় থাকে আমি জানি। মেইন রোড ধরে গেলে পুরানো একটা হাউজিং কমপ্লেক্স পাবে, চেশায়ার স্কোয়্যার, ওখানে। নাম বেটসি।

ভাল নাম? রবিন জানতে চাইল।

বেটসি অ্যারিয়াগো।

নাক টানল কিশোর। নামটা ঠিক তো?

না হওয়ার তো কোন কারণ দেখি না, জবাব দিল একটা ছেলে। আর বাড়ি থেকে পালালেই কেউ নাম বানিয়ে বলে না। কেন বলবে? বাড়ি থেকে বেরোনো অপরাধ না। বেরিয়েছে যে তারও নিশ্চয় কোন কারণ আছে। হয়ত ওর মা দুর্ব্যবহার করত…

 ও অভিনেত্রী হতে চায়, বাধা দিয়ে বলল মুসা। পালিয়েছে সে জুন্যে। কেউ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেনি। অন্তত আমাদের জানা নেই।

বেশ, ছেলেটা বলল। ওর সঙ্গে আবার দেখা হলে তোমাদের কথা বলব। ঠিক আছে?

দ্বিধা করল কিশোর। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিয়ে বলল, এই নাম্বারে ফোন করতে বোলো, প্লীজ।

কার্ডের দিকে তাকিয়ে হাসল ছেলেটা। বাহু, গোয়েন্দা। জিনসের প্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে বলল, বলব।

ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে দুই সহকারীকে নিয়ে আবার কাউন্টারে ফিরে এল কিশোর।

রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো ওয়েইট্রেস মহিলা। পেছনে চললেন ম্যানেজার। ছেলেমেয়েরা ফিরে গেল তাদের খেলায়।

কিশোরের দিকে কাত হয়ে নিচু স্বরে বলল রবিন, মেয়েটা ফোন করবে বলে মনে হয় তোমার?

না, পিজা চিবাতে চিবাতে জবাব দিল কিশোর। তার ফোনের অপেক্ষায় বসেও থাকব না। চেশায়ার স্কোয়্যার আমরাও চিনি। জলদি খাও।

.

চেহারা পুরানো হলেও এখন আর পুরানো নেই কমপ্লেক্সটা। অনেক সংস্কার করা। হয়েছে। পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে, সাগরের দিকে মুখ। নতুন করে রঙ করা হয়েছে। চকচক করছে পেতলের জিনিসগুলো। নতুন লনে নতুন ফুলের বেড তৈরি হয়েছে।

যে লোক সংস্কার করেছেন, তিনি নিজেকে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করেন। রসিক লোক। সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভবিষ্যতের প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধাঁধায় ফেলার জন্যেই তিনি একাজ করেছেন। মাটি খুঁড়ে বের করবে ওরা আঠারোশো নব্বই সালের বাড়ি, তিনি বলেছেন। দেখবে ভেতরে বোঝাই হয়ে আছে উন্নত কারিগরির যন্ত্রপাতি, যেগুলো তৈরি হয়েছে। আরও একশো বছর পরে। দ্বিধায় পড়ে যাবে ওরা।

ডলি নামের কেউ থাকে না এখানে, পাহারাদার বলল।

তাহলে বেটসি অ্যারিয়াগো? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

 সতর্ক হলো লোকটা। তোমাকে চেনে?

 নিশ্চয়ই।

 তোমার নাম?

 কিশোর পাশা। ও রবিন মিলফোর্ড, আর ও মুসা আমান। ফ্রেনসোর মিস্টার ডিকসন পাঠিয়েছেন, আমাদেরকে। বেটসির সঙ্গে জরুরী কথা আছে আমাদের।

দ্বিধা করল প্রহরী। টেলিফোনে হাত।

বলেই দেখুন না, খুব খুশি হবে। মিস্টার ডিকসন, মনে রাখবেন। কিন্তু কিশোরের কথা শুনছে না লোকটা। নিচের মেন রোডে পুলিশের সাইরেন বাজছে। দ্রুত ছুটে আসছে।

রাস্তার দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। রকি বীচ পুলিশের গাড়িটা চিনতে অসুবিধে হলো না। মোড় নিয়ে চেশায়ার স্কোয়্যারে ওঠার গলিতে পড়ল। উঠে আসতে লাগল ওপরে।

 বাড়ির ভেতরে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল কেউ। রাগ আর ভয় মেশানো চিৎকার।

অ্যাই! অ্যাই! বলে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

দারোয়ানের ছোট ঘর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল প্রহরী। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসা লোকটার পথরোধ করে দাঁড়াল। গাঢ় রঙের শার্ট পরনে। একটা মোজা টেনে দিয়েছে মাথার ওপর, যাতে চেহারাটা চেনা না যায়। তবে মাথায় কালো চুল, এটা গোপন করতে পারল না।

ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল লোকটা। ঝট করে পা বাড়িয়ে দিল প্রহরী। তৈরিই ছিল লোকটা। পা-টা এড়িয়ে গিয়ে এক ঘুসিতে চিৎ করে ফেলল। প্রহরীকে।

 মুসাও আটকাতে গেল ওকে। প্রচণ্ড ঘূসি এসে লাগল মুখে। তার মনে হলো হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে। বোঁ করে উঠল মাথা। রাস্তার ওপরই বসে পড়ল।

রবিন আর কিশোর কিছু করার আগেই ছুটে চলে গেল লোকটা। লাফাতে লাফাতে গিয়ে ঢুকল পাহাড়ের ঢালের ঝোপঝাড়ের ভেতর।

<

Super User