ষোলো
পৌঁছানোর এক দিন পর অর্থাৎ একুশ জুন, সতেরোশো বিরানব্বই আমাদের সরিয়ে নেয়া হলো এইচ, এম, এস হেকটর নামক এক যুদ্ধ জাহাজের গান রুমে। সামরিক আদালতে বিচার শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই থাকবে বন্দীরা।
হেকটরে ওঠার পর এক ঘণ্টাও পেরোয়নি। আমাকে ডেকে পাঠালেন জাহাজটার ক্যাপ্টেন মিস্টার মাগু। রক্ষীকে বিদায় করে দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। নানা বিষয়ে আলাপ করলেন কিছুক্ষণ। বিদ্রোহের প্রসঙ্গ একবারও তুললেন না। নিশ্চয়ই খোশ গল্প করার জন্যে আমাকে ডেকে পাঠাননি ভদ্রলোক। কিছু একটা কারণ আছে। কিন্তু কী, সেটা আন্দাজ করতে পারছি না। অবশেষে প্রায় আধঘণ্টা পর টেবিলের একটা দেরাজ খুলে একটা খাম বের করলেন ক্যাপ্টেন মন্টাগুও। এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
তোমার চিঠি, বললেন তিনি। এখানে বসে পড়ো। আমি চলে যাচ্ছি। কেউ বিরক্ত করবে না তোমাকে। বার্থে ফেরার সময় হলে শুধু দরজা খুলে রক্ষীকে বলবে, পৌঁছে দেবে।
বেরিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন মন্টাগু। কম্পিত হাতে আমি খুললাম চিঠিটা। স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস লিখেছেন। তারিখ দেখলাম গরগন পোর্টসমাউথে পৌঁছানোর কদিন আগের। চিঠিটা পড়তে পড়তে সারা শরীর অবশ হয়ে এল আমার। ছোট্ট একটা খবর দিয়েছেন স্যার জোসেফ: দুসপ্তা আগে আমার মা মারা গেছেন। খবরটা তাকে জানিয়েছে আমাদের পুরানো কাজের মেয়ে থ্যাকার। এরপর সান্ত্বনাসূচক কিছু কথা। খুব শিগগিরই আমার সাথে দেখা করতে আসবেন জানিয়ে চিঠি শেষ করেছেন তিনি।
চিঠিটা পড়ে একটা কথাই শুধু আমার মনে হলো, নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। জীবনে মাত্র দুজন নারীর ভালবাসা পেয়েছি, কিন্তু তাদের প্রয়োজন আমার জীবনে যখন সবচেয়ে বেশি তখনই দুজনের একজনও নেই আমার পাশে। মা চিরতরে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে, স্ত্রী পড়ে আছে অর্ধেক পৃথিবী ওপাশে, জীবনে আর কোন দিন দেখা হবে কিনা, এই নিয়তিই বলতে পারে। মা নেই, বোধহয় সে কারণেই, তেহানির কথা আরও বেশি করে মনে পড়তে লাগল আমার। আমার বাচ্চা-আমার হেলেন, আর কখনও কি ওকে দেখব।
কয়েক দিন পর এলেন স্যার জোসেফ। আগের মতই আছেন ভদ্রলোক। হাসিখুশি, সদালাপী। জানালেন, মারা যাওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মা-কে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। কেমন দেখেছেন, কি কি কথা হয়েছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বললেন। ইচ্ছে মত প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন আমাকে। একই প্রশ্ন বার বার করলাম (বেশ কয়েক বার এমন হলো) প্রত্যেক বারই ধৈর্যের সঙ্গে জবাব দিলেন তিনি। তারপর সম্ভবত আমার মনকে ভারমুক্ত করার জন্যেই কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তাহিতীয় ভাষায় অভিধান ও ব্যাকরণের প্রসঙ্গ তুললেন। প্যানডোরা বিধ্বস্ত হলেও আমার পাণ্ডুলিপি খোয়া যায়নি শুনে তিনি একেবারে বাচ্চা ছেলের মত খুশি হয়ে উঠলেন।
চমৎকার, বিয়্যাম! চমৎকার! প্রায় চিৎকার করে বললেন স্যার জোসেফ। অন্তত একটা লাভ তাহলে হয়েছে বাউন্টিকে ওখানে পাঠিয়ে! কোথায় এখন ওগুলো?..
প্যানডোরার সার্জন ডা. স্যামিলটনের কাছে।
আচ্ছা! ভদ্রলোক ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তমি ওঁর সাথে দেখা করব। যাক এসব কথা। এবার তোমার বিদ্রোহের কাহিনী শোনাও-একেবারে গোড়া তো-খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দেবে না।
ক্যাপ্টেম ব্রাইয়ের ভাষ্য আপনি শুনেছেন? আমাকে কি জঘন্য ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে ওতে জানেন?
হ্যাঁ, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি। ব্লাই আমার বন্ধু। ওর চরিত্রের ভাল দিকগুলোর কথা যেমন জানি খারাপ দিকগুলোর কথাও তেমন জানি। ও একেবারে মন থেকে তোমাকে অপরাধী বলেছে। তা সত্ত্বেও আমি বলছি, আমি তোমাকে লিখ বলেই ভাবি।
উনি কি এখন ইংল্যান্ডে আছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না আবার ওকে তাহিতিতে পাঠানো হয়েছে। এই একই কাজে।
খবরটা শুনে দমে গেলাম আমি। কেন জানি না কিছুদিন ধরে আমার মনে হচ্ছিল, ওঁর সঙ্গে কথা বললে উনি আমার সম্পর্কে মত পাল্টাবেন; ক্রিশ্চিয়ানের সাথে সে রাতের আলাপটা যে সত্যি সত্যি বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র ছিল না তা উনি বুঝতে পারবেন। স্যার জোসেফকে বললাম সেকথা।
উনি বললেন, দেখ, ও নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। যতই ভাবো না কেন, তোমার বিচার শুরু হওয়ার আগে দেশে ফিরছে না ব্লাই। তোমার কাহিনী শোনাও, বুঝে দেখি কি ভাবে তোমাকে সাহায্য করা যায়।
ডা. হ্যামিলটনকে যেমন শুনিয়েছিলাম স্যার জোসেফকেও শোনালাম। আমাদের রওনা হওয়ার পর থেকে ধরা পড়া পর্যন্ত সব। শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস।
বিয়্যাম, বাস্তব বাস্তবই, অবশেষে তিনি বললেন, যত কঠোরই হোক না কেন বুকে সাহস নিয়ে তার মুখোমুখি হওয়া ভাল। মহাবিপদে পড়ে গেছ তুমি। ব্লাইয়ের সাথে তুমি লঞ্চে যেতে চেয়েছিলে কথাটা যে জানত সেই মিস্টার লেনসন মারা গেছে; বিদ্রোহের আগের রাতে ক্রিশ্চিয়ান পালাতে চেয়েছিল, তুমি ছাড়া আর যে জানত সেই নর্টনও মারা গেছে।
জানি, স্যার। ডা. হ্যামিলটনের কাছে শুনেছি।
এখন এক জনের সাক্ষ্যের ওপরই তোমার ভাগ্য নির্ভর করছে, সে হলো রবার্ট টিঙ্কলার। কিন্তু কোথায় সে?
যতদূর শুনেছি ও নিরাপদে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছে।
হ্যাঁ। কিন্তু কোথায় আছে? এক্ষুণি তাকে খুঁজে বের করা দরকার। বলছিলে, বাউন্টির মাস্টার ফ্রায়ারের শ্যালক ও
হ্যাঁ, স্যার।
তাহলে বোধহয় ওর খবর আমি বের করতে পারব। অ্যাডমিরালটিতে খোঁজ নিলেই জানা যাবে ফ্রায়ার এখন কোন জাহাজে কাজ করছে। ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি কদ্দূর কি করা যায়।
কদিন লাগবে, স্যার, বিচার শুরু হতে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ঠিক নেই। ব্যাপারটা অ্যাডমিরালটির ওপর নির্ভর করছে। তবে আমার মনে হয় প্যানডোরার বাকি নাবিকরা পৌঁছে গেলেই শুরু করবে অ্যাডমিরালটি।
চলে গেলেন স্যার জোসেফ। রাতের গাড়িতে লন্ডন ফিরে যাবেন তিনি।
পরদিনই, স্যার জোসেফের সুপারিশে কিনা জানি না, নতুন পোশাক দেয়া হলো আমাদের, যেন দ্র বেশে আদালতের সামনে উপস্থিত হতে পারি। হঠাৎ করে এই অপ্রত্যাশিত সদয় ব্যবহারটুকু পেয়ে আমাদের মনোবল অনেকখানি বেড়ে গেল।
.
দশ দিন পর একটা চিঠি এল স্যার জোসেফের কাছ থেকে। উনি লিখেছেন,
প্রিয় বিয়্যাম,
শুভেচ্ছা নিও। লন্ডনে ফিরে আমি অ্যাডমিরালটি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, ফ্রায়ার এখন ওর লন্ডনের বাড়িতে আছে। সামরিক আদালতের সমনের অপেক্ষা করছে। ওর সঙ্গে দেখা করে জানতে পারলাম, টিঙ্কলার ইংল্যান্ডে ফেরার কিছুদিনের ভেতরই ক্যারিব মেইড নামক একটা পশ্চিম ভারতীয় জাহাজে মাস্টারের মেট হিসেবে কাজ পায়।
বছর খানেক আগে প্রথম যাত্রা শেষে দেশে ফিরেছিল টিঙ্কলার। কদিন পরেই রওনা হয়ে গিয়েছিল আবার। মাস তিনেক আগে ফ্রায়ার খবর পেয়েছে, কিউবা দ্বীপের কাছে এক হারিকেনের কবলে পড়ে সবনাবিক সমেত ডুবে গেছে ক্যারিব মেইড।
অস্বীকার করে লাভ নেই, ঘটনাটা তোমার জন্যে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তবু, তোমার অবস্থা আমার মনে হয় একেবারে হতাশাব্যঞ্জক নয়। ফ্রায়ারের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে আমার। তোমার সম্পর্কে কোন রকম বিদ্বেষ দেখলাম না ওর মনে। ওর বিশ্বাস বিদ্রোহের ব্যাপারটায় তোমার কোন হাত ছিল না। আদালতের সামনে ও এই সাক্ষ্য দেবে; তাতে তোমার যথেষ্ট উপকার হবে বলে আমার ধারণা।
কোল, পার্সেল এবং পেকওভারের সাথেও আমি দেখা করেছি। ওদের সবারই দেখলাম খুব উঁচু ধারণা তোমার সম্পর্কে। পার্সেল বলল, তুমি নিজে নাকি ওকে বলেছিলে ব্লাইয়ের সঙ্গে তুমি লঞ্চে যেতে চাও। বাকি দুজনও বলল, তুমি যে নির্দোষ এ ব্যাপারে তাদের মনে কোন সংশয় নেই।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিস্টার গ্রাহামের সঙ্গে আমি দেখা করেছি। ভদ্রলোক নিউফাউন্ডল্যান্ড স্টেশনে বিভিন্ন অ্যাডমিরালের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন গত বারো বছর। সেই সঙ্গে ওই সময়ের ভেতর যতগুলো সামরিক আদালত বসেছে প্রতিটিতে জাজ অ্যাডভোকেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত ভাল। উনি সানন্দে তোমার পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে রাজি হয়েছেন।
সুতরাং আমার মনে হয় না ঘাবড়ানোর তেমন কিছু আছে তোমার। শেষ করার আগে একটা কথাই বলব, ভেঙে পোড় না। মনোবল অটুট রাখো। শিগগিরই আবার দেখা করব তোমার সাথে।
ইতি
জোসেফ ব্যাঙ্কস।
.
এই চিঠি পেয়ে আমার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে সহজেই অনুমেয়। স্যার জোসেফ যতই বলুন ঘাবড়ানোর তেমন কিছু নেই, আমি কিন্তু না ঘাবড়ে পারলাম না। ফ্রায়ার, কোল বা পার্সেলের ধারণা বা বিশ্বাসে যে বিচারকদের মন গলবে না তা আমি জানি। যাহোক, তবু, মিস্টার গ্রাহামের মত মানুষ আমার উকিল হতে চেয়েছেন জেনে একটু স্বস্তি পেলাম মনে। মরিসন ঠিক করেছে নিজেই লড়বে নিজের হয়ে। কোলম্যান, নরম্যান, ম্যাকইন্টশ আর বায়ার্ন আশা করে ওরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে, তাই নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক অফিসার ক্যাপ্টেন ম্যানলিকে যৌথভাবে উকিল নিয়োগ করেছে ওদের আত্মীয় স্বজনরা। বাকিদের স্বার্থ দেখার জন্যে সরকারের তরফ থেকেই নিযুক্ত করা হয়েছে অ্যাডমিরালটির এক অফিসার ক্যাপ্টেন বেনথামকে।
পরের সপ্তায় এদের প্রত্যেকেই একবার করে এলেন আমাদের কাছে।
উনি বললেন, দেখ, ও নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। যতই ভাবো না কেন, তোমার বিচার শুরু হওয়ার আগে দেশে ফিরছে না ব্লাই। তোমার কাহিনী শোনাও, বুঝে দেখি কি ভাবে তোমাকে সাহায্য করা যায়।
ডা. হ্যামিলটনকে যেমন শুনিয়েছিলাম স্যার জোসেফকেও শোনালাম। আমাদের রওনা হওয়ার পর থেকে ধরা পড়া পর্যন্ত সব। শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস।
বিয়্যাম, বাস্তব বাস্তবই, অবশেষে তিনি বললেন, যত কঠোরই হোক না কেন বুকে সাহস নিয়ে তার মুখোমুখি হওয়া ভাল। মহাবিপদে পড়ে গেছ তুমি। ব্লাইয়ের সাথে তুমি লঞ্চে যেতে চেয়েছিলে কথাটা যে জানত সেই মিস্টার লেনসন মারা গেছে; বিদ্রোহের আগের রাতে ক্রিশ্চিয়ান পালাতে চেয়েছিল, তুমি ছাড়া আর যে জানত সেই নটনও মারা গেছে।
জানি, স্যার। ডা. হ্যামিলটনের কাছে শুনেছি।
এখন এক জনের সাক্ষ্যের ওপরই তোমার ভাগ্য নির্ভর করছে, সে হলো রবার্ট টিঙ্কলার। কিন্তু কোথায় সে?
যতদূর শুনেছি ও নিরাপদে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছে।
হ্যাঁ। কিন্তু কোথায় আছে? এক্ষুণি তাকে খুঁজে বের করা দরকার। বলছিলে, বাউন্টির মাস্টার ফ্রায়ারের শ্যালক ও?
হ্যাঁ, স্যার।
তাহলে বোধহয় ওর খবর আমি বের করতে পারব। অ্যাডমিরালটিতে খোঁজ নিলেই জানা যাবে ফ্রায়ার এখন কোন জাহাজে কাজ করছে। ঠিক আছে,
তুমি চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি কদ্দূর কি করা যায়।
কদিন লাগবে, স্যার, বিচার শুরু হতে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ঠিক নেই। ব্যাপারটা অ্যাডমিরালটির ওপর নির্ভর করছে। তবে আমার মনে হয় প্যানডোরার বাকি নাবিকরা পৌঁছে গেলেই শুরু করবে অ্যাডমিরালটি।
চলে গেলেন স্যার জোসেফ। রাতের গাড়িতে লন্ডন ফিরে যাবেন তিনি।
পরদিনই, স্যার জোসেফের সুপারিশে কিনা জানি না, নতুন পোশাক দেয়া হলো আমাদের, যেন দ্র বেশে আদালতের সামনে উপস্থিত হতে পারি। হঠাৎ করে এই অপ্রত্যাশিত সদয় ব্যবহারটুকু পেয়ে আমাদের মনোবল অনেকখানি বেড়ে গেল।
.
দশ দিন পর একটা চিঠি এল স্যার জোসেফের কাছ থেকে। উনি লিখেছেন,
প্রিয় বিয়্যাম,
শুভেচ্ছা নিও। লন্ডনে ফিরে আমি অ্যাডমিরালটি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, ফ্রায়ার এখন ওর লন্ডনের বাড়িতে আছে। সামরিক আদালতের সমনের অপেক্ষা করছে। ওর সঙ্গে দেখা করে জানতে পারলাম, টিঙ্কলার ইংল্যান্ডে ফেরার কিছুদিনের ভেতরই ক্যারিব মেইড নামক একটা পশ্চিম ভারতীয় জাহাজে মাস্টারের মেট হিসেবে কাজ পায়।
বছর খানেক আগে প্রথম যাত্রা শেষে দেশে ফিরেছিল টিঙ্কলার। কদিন পরেই রওনা হয়ে গিয়েছিল আবার। মাস তিনেক আগে ফ্রায়ার খবর পেয়েছে, কিউবা দ্বীপের কাছে এক হারিকেনের কবলে পড়ে সবনাবিক সমেত ডুবে গেছে ক্যারিব মেইড।
অস্বীকার করে লাভ নেই, ঘটনাটা তোমার জন্যে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তবু, তোমার অবস্থা আমার মনে হয় একেবারে হতাশাব্যঞ্জক নয়। ফ্রায়ারের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে আমার। তোমার সম্পর্কে কোন রকম বিদ্বেষ দেখলাম না ওর মনে। ওর বিশ্বাস বিদ্রোহের ব্যাপারটায় তোমার কোন হাত ছিল না। আদালতের সামনে ও এই সাক্ষ্য দেবে; তাতে তোমার যথেষ্ট
উপকার হবে বুলে আমার ধারণা।
কোল, পার্সেল এবং পেকওভারের সাথেও আমি দেখা করেছি। ওদের সবারই দেখলাম খুব উঁচু ধারণা তোমার সম্পর্কে। পার্সেল বলল, তুমি নিজে নাকি ওকে বলেছিলে ব্লাইয়ের সঙ্গে তুমি লঞ্চে যেতে চাও। বাকি দুজনও বলল, তুমি যে নির্দোষ এ ব্যাপারে তাদের মনে কোন সংশয় নেই।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিস্টার গ্রাহামের সঙ্গে আমি দেখা করেছি। ভদ্রলোক নিউফাউন্ডল্যান্ড স্টেশনে বিভিন্ন অ্যাডমিরালের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। গত বারো বছর। সেই সঙ্গে ওই সময়ের ভেতর যতগুলো সামরিক আদালত বসেছে প্রতিটিতে জাজ অ্যাডভোকেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত ভাল উনি সানন্দে তোমার পক্ষে মামলা পরিচালনা, করতে রাজি হয়েছেন।
সুতরাং আমার মনে হয় না ঘাবড়ানোর তেমন কিছু আছে তোমার। শেষ করার আগে একটা কথাই বলব, ভেঙে পোড়ে না। মনোবল অটুট রাখো। শিগগিরই আবার দেখা করব তোমার সাথে।
ইতি
জোসেফ ব্যাঙ্কস।
এই চিঠি পেয়ে আমার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে সহজেই অনুমেয়। স্যার জোসেফ যতই বলুন ঘাবড়ানোর তেমন কিছু নেই, আমি কিন্তু না ঘাবড়ে পারলাম না। ফ্রায়ার, কোল বা পার্সেলের ধারণা বা বিশ্বামে যে রিচারকদের মন গলবে না তা আমি জানি। যাহোক, তবু, মিস্টার গ্রাহামের মত মানুষ আমার উকিল হতে চেয়েছেন জেনে একটু স্বস্তি পেলাম মনে। মরিসন ঠিক করেছে নিজেই লড়বে নিজের হয়ে। কোলম্যান, নরম্যান, ম্যাকইন্টশ আর বায়ার্ন আশা করে ওরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে, তাই নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক অফিসার ক্যাপ্টেন ম্যানলিকে যৌথভাবে উকিল নিয়োগ করেছে ওদের আত্মীয় স্বজনরা। বাকিদের স্বার্থ দেখার জন্যে সরকারের তরফ থেকেই নিযুক্ত করা হয়েছে অ্যাডমিরালটির এক অফিসার ক্যাপ্টেন বেনথামকে।
পরের সপ্তায় এঁদের প্রত্যেকেই একবার করে এলেন আমাদের কাছে। প্রথমে এলেন মিস্টার গ্রাহাম। দীর্ঘ ঋজু শরীর ভদ্রলোকের। বছর পঞ্চাশেক বয়েস। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। শান্ত, ভরাট কণ্ঠস্বর। গলা শুনেই লোকটার অলর পর্যন্ত যেন টের পাওয়া যায়। প্রথম দর্শনেই আমার মনে হলো যোগ্য লোকের হাতে পড়েছে আমার ভাগ্য। আমরা যারা বিচারাধীন তাদের কেউই সামরিক আদালতের কার্যবিধি সম্পর্কে কিছু জানি না। আমার অনুরোধে সবাইকে ইচ্ছে মত প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন তিনি।
আমি, স্যার, নিজেই আমার মামলা পরিচালনা করব ঠিক করেছি, মরিসন বলল। আইনের যে ধারায় আমাদের বিচার হবে সে ধারায় ঠিক কি বলা হয়েছে আমি জানতে চাই।
তোমাদের বিচার হবে নৌযুদ্ধ আচরণ বিধির ১৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, বললেন মিস্টার গ্রাহাম। এই ধারায় বলা হয়েছে; নৌবহরের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোন ব্যক্তি-সে অফিসার বা নাবিক যা-ই হোক না কেন, যদি কোন কারণে বিদ্রোহ বা বিদ্রোহাত্মক আচরণ করে, সামরিক আদালতে তার বিচার হবে। এবং আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।
অন্য কোন শাস্তির ব্যবস্থা নেই। আমি প্রশ্ন করলাম।
না। হয় বেকসুর খালাস অথবা দোষী প্রমাণিত হওয়া এবং মৃত্যুদণ্ড ভোগ করা।
কিন্তু, স্যার, ধরুন এমন অবস্থা হলো, মরিসন বলল, একটা জাহাজে বিদ্রোহ হয়েছে, কিন্তু নাবিকদের একাংশ তাতে জড়িত তো নয়ই, সে সম্পর্কে জানতও নাকিছু তাদের কি হবে?
ওরা যদি বিদ্রোহীদের সাথে জাহাজেই থেকে যায়, আইন ওদের বিদ্রোহীদের সমান অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য করবে। আমাদের সামরিক আইন এ ব্যাপারে সত্যিই খুব কড়া। নিরপেক্ষতার কোন অবকাশ এখানে নেই।
কিন্তু স্যার, যোগ করল কোলম্যান, আমরা যারা ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সঙ্গে লঞ্চে নেমে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু লঞ্চে জায়গা হয়নি বলে, বা বিদ্রোহীরা আটকে রেখেছিল বলে যেতে পারিনি, তাদের কি হবে?
এরকম পরিস্থিতি অবশ্যই বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে, জবাব দিলেন মিস্টার গ্রাহাম। সত্যিই যদি তোমরা তেমন কোন কারণে বিদ্রোহীদের সাথে থেকে গিয়ে থাকো আর আদালতের সামনে তা প্রমাণ করতে পারো তাহলে তো আমি তোমাদের খালাস না পাওয়ার কোন কারণ দেখি না।
আমি একটা প্রশ্ন করব, স্যার? এলিসন জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই।
আমি, স্যার, বিদ্রোহীদের একজন, যদিও যারা এর মূল উদ্যোক্তা তাদের সঙ্গে আমি ছিলাম না। অন্য সবার মত আমিও ক্যাপ্টেন ব্লাইকে পছন্দ করতাম না তাই বিদ্রোহীরা ওদের দলে যোগ দিতে বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি যোগ দিয়েছি। পরিণাম নিয়ে ভাবিনি। আসলে পরিণাম সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না আমার। আমার কোন আশা আছে?
গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস্টার গ্রাহাম। তারপর বললেন, এ সম্পর্কে কোন মতামত দেয়া এমুহূর্তে উচিত হবে না। প্রশ্নটার মীমাংসার ভার আদালতের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভাল।
এর পর আমার সাথে বিস্তারিত আলাপ করলেন মিস্টার গ্রাহাম। ডা. হ্যামিলটন আর স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কসকে যে কাহিনী শুনিয়েছি আর একবার তা শোনালাম। খুঁটিনাটি কিছু প্রশ্ন করলেন মিস্টার গ্রাহাম। তারপর বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, যেন না ঘাবড়াই, আমাকে বাঁচানোর জন্যে সাধ্যমত উনি করবেন।
তারপর জুলাই চলে গেছে, গেছে অগাস্ট। এখনও আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি।
.
সতেরো
সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ সকালে হেকটর থেকে এইচ.এম.এস. ডিউক-এ নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। সামরিক আদালত বসবে এই ডিউক-এর বড় কেবিনে।
বিশাল জাহাজ ডিউক। এর বড় কেবিনটাও তেমনি বিশাল। লম্বায় জাহাজের এমাথা ওমাথা, চওড়ায়ও এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত। আমরা যখন পৌঁছুলাম তখন মানুষে গিজগিজ করছে ডিউক-এর ডেক, কোয়ার্টার ডেক। বেশির ভাগই এ মুহূর্তে বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা যুদ্ধ জাহাজের অফিসার। পুরোদস্তুর ধরাচূড়া পরে আছে সবাই। অসামরিক লোকও আছে কিছু। তাদের ভেতর দেখলাম স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কসকে ডা, তামিলটনের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল উত্তমাশা অন্তরীপে। এতদিন পর আজ আরার তাঁকে দেখলাম, প্যানডোরার অন্যান্য অফিসারদের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন এক ধারে। এডওয়ার্ডসকেও দেখলাম। শীতল নিরাসক্ত দৃষ্টিতে দেখছে আমাদের।
ডেকের অন্য পাশে জড় হয়েছে বাউন্টির অফিসার নাবিকরা-যারা ব্লাইয়ের সঙ্গে ফিরে এসেছিল দেশে। মাস্টার মিস্টার ফ্রায়ার, সারেং কোল, ছুতোর মিস্ত্রী পার্সেল, গোলন্দাজ পেকওভগম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে সব, কজন। যখন শেষবার দেখেছিলাম ওদের তখনকার চেহারাটা ভেসে উঠল মনের পর্দায়। সেদিন আমরা কেউ কি ভেবেছিলাম, আবার আমাদের দেখা হবে, তা-ও আবার এমনি করে?
বিশাল কেবিনটার দরজা খুলে যেতেই সব গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে গেল। দর্শকরা ঢুকে একে একে বসে পড়ল তাদের জন্যে নির্দিষ্ট আসনে। তারপর রক্ষীদের পেছন পেছন ঢুকলাম আমরা-আসামীরা। রক্ষীদের ইশারায় দাঁড়িয়ে গেলাম দরজার পাশে দেয়াল বরাবর। প্রথম দিনটা দাঁড়িয়েই কাটাতে হলে আমাদের। পরে অবশ্য শুনানী ও জেরার দৈর্ঘ্য বিবেচনা করে একটা বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ঠিক নটার সময় আবার খুলে গেল দরজা। বিচারকমণ্ডলীর আগমন সংবাদ ঘোষণা করল মাস্টার-অ্যাট-আর্মস। উঠে দাঁড়াল দর্শকরা। বিচারকমণ্ডলী আসন গ্রহণ করার পর আবার বসল তারা। বিচারকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন পোর্টসমাউথ বন্দরে মোতায়েন রাজকীয় নৌ-বহরের সর্বাধিনায়ক ভাইস অ্যাডমিরাল অভ দ্য বু মাননীয় লর্ড হুড। সদস্য হিসেবে আছেন ক্যাপ্টেন স্যার অ্যান্ড মেপ হ্যামন্ড, ক্যাপ্টেন জন কলপয়জ, ক্যাপ্টেন সরি জর্জ মন্টা (হেকটরের ক্যাপ্টেন), ক্যাপ্টেন স্যার রজার কার্টিস, ক্যাপ্টেন জন ব্যাযেলে, ক্যাপ্টেন স্যার অ্যান্ড স্নেপ ডগলাস, ক্যাপ্টেন জন টমাস ডাকওয়ার্থ, ক্যাপ্টেন জন নিকলসন ইলফিল্ড, ক্যাপ্টেন জন নাইট, ক্যাপ্টেন আলবেরিলে বার্টি, ও ক্যাপ্টেন রিচার্ড গুডউইন কিটস।
এতগুলো দুদে লোককে এক সঙ্গে দেখে রীতিমত ভড়কে যাওয়ার অবস্থা আমার। ডা. হ্যামিলটনের কথাগুলো মনে পড়ে গেল: আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে তো কিছু আসবে যাবে না। বিশ্বাস করাতে হবে বিচারককে। বিচারক প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করেন না।
শুরু হলো আদালতের কাজ।
একে একে আমাদের নাম ডেকে আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ পড়ে শোনান হলো। তারপর পড়া হলো ব্লাইয়ের লিখিত জবানবন্দী, যেটা তিনি দিয়েছিলেন দেশে ফেরার পর পরই। আমার সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানের সন্দেহজনক আলাপের কথা বর্ণনা করেছেন জবানবন্দীর একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে।
ব্লাইয়ের জবানবন্দী পড়া শেষ হতেই আমি অনুভব করলাম, দর্শকদের-এবং বিচারকদেরও-বেশিরভাগের চোখ স্থির হয়ে আছে আমার ওপর। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। বিদ্রোহের হোতা ক্রিশ্চিয়ানের ডান হাত মনে করছে সবাই আমাকে।
একটা ব্যাপার আমাকে ভীষণ অবাক করল; কোলম্যান, নরম্যান আর ম্যাকইশ সম্পর্কে একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি ব্লাই তাঁর জবানবন্দীতে। অথচ আমার বা আর সবার মত ব্লাইও জানতেন এই তিনজন তার সাথে যেতে চেয়েছিল লঞ্চে, বিদ্রোহীদের বাধার কারণে পারেনি। ওরা নির্দোষ-অন্তত ওরা তার সাথে আসতে চেয়েছিল এই কথাটা উল্লেখ করতে পারতেন তিনি জবানবন্দীতে। কেন যে এই নিরপরাধ লোকগুলোর ব্যাপারে ব্লাই মাথা ঘামাননি আজ পর্যন্ত আমি তার কারণ খুঁজে পাইনি।
যাহোক, এর পর ডাকা হলো বাউন্টির মাস্টার জন ফ্রায়ারকে। বিদ্রোহের দিন সকালে যেমন দেখেছিলাম এখনও তেমন আছে ফ্রায়ার। একটুও বদলয়ানি আদালতের নির্দেশে বাউন্টিতে বিদ্রোহ এবং তার পরের ঘটনাবলী সম্পর্কে জবানবন্দী দিল সে। আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে, সম্ভবত কিছু তার জানা ছিল না বলেই, কিছু না বললেও কোলম্যান, নরম্যান আর ম্যাকইন্টশ যে ব্লাইয়ের সঙ্গে আসতে চেয়েছিল তা সে বলতে ভুলল না।
জবানবন্দী শেষে আদালত জেরা করল ফ্রায়ারকে। জেরার এক পর্যায়ে তাকে প্রশ্ন করা হলো:
লঞ্চটা জলে নামাতে কত জন লোক দরকার হত?
জনা দশেক, ফ্রায়ারের জবাব।
আদালত আবার প্রশ্ন করল, বিদ্রোহের দিন ওটা নামানোর সময় আসামীদের কেউ হাত লাগিয়েছিল।
হ্যাঁ। মিস্টার বিয়্যাম, মিস্টার মরিসন, মিস্টার কোলম্যান, নরম্যান, ম্যাকইন্টশ সবাই হাত লাগিয়েছিল।
তুমি কি মনে করো, ওরা বিদ্রোহীদের সাহায্য করার জন্যে একাজ করেছিল, না ক্যাপ্টেন ব্লাইকে সাহায্য কার জন্যে?
আমার মনে হয় ওরা ক্যাপ্টেন ব্লাইকে সাহায্য করার জন্যেই একাজ করেছিল। প্রাণ বাঁচানোর একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিল তাকে।
আমি জড়িত এমন কোন বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন করল না আদালত ফ্রায়ারকে।
জেরা শেষ হওয়ার পর আসামীদের সুযোগ দেয়া হলো সাক্ষীকে প্রশ্ন করার। তিনটে প্রশ্ন করলাম আমি।
আপনি যখন প্রথমবার ডেকে আসেন এবং ক্রিশ্চিয়ানের সাথে আমাকে আলাপ করতে দেখেন তখন কী বিষয়ে আমরা আলাপ করছিলাম, আপনি শুনেছিলেন?
ফ্রায়ারের জবাব, না, মিস্টার বিয়্যাম। সে সময়…
আদালতকে সম্বোধন করে দেবে সব প্রশ্নের জবাব, বাধা দিয়ে বললেন লর্ড হুড।
জি, বলে সভাপতির দিকে ফিরল ফ্রায়ার। না, কিছু শুনেছিলাম বলে আমার মনে পড়ছে না, মাননীয় আদালত।
আমি ক্রিশ্চিয়ানের দলে, আপনার মনে এমন বিশ্বাস জন্মানোর কোন কারণ কি ঘটেছিল? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন।
না, সোজা সাপ্টা জবাব ফ্রায়ারের।
আমার শেষ প্রশ্ন, আপনাকে যদি জাহাজে থাকতে দেয়া হত, এবং কখনও জাহাজ পুনর্দখলের পরিকল্পনা করতেন, আমাকে কি দলে নেয়ার কথা ভাবতেন?
অবশ্যাই ভাবতাম। আমার পরিকল্পনার কথা প্রথম যাদের কাছে প্রকাশ করতাম, মিস্টার বিয়্যাম হত তাদের অন্যতম।
এখানে এসে আবার প্রশ্ন করল আদালত, তুমি বলছ, মিস্টার বিয়্যাম ক্রিশ্চিয়ানের দলে তোমার মনে এমন বিশ্বাস জন্মানোর কোন কারণ ঘটেনি। কিন্তু তুমি যখন ডেকে এসে দেখলে ওর সাথে ক্রিশ্চিয়ান আলাপ করছে, তোমার মনে সন্দেহ জাগেনি?
না, কারণ সে সময় তার দলের নয় এমন অনেক লোকের সাথেই তাকে কথা বলতে দেখেছি।
বিদ্রোহের আগের রাতে তুমি যখন ডেকে চৌকিতে ছিলে, ক্রিশ্চিয়ান আর আসামী বিয়্যামকে এক সাথে দেখনি।
না, যতদূর আমার মনে পড়ে। আমার চৌকিতেই দায়িত্ব পালন করছিল মিস্টার বিয়াম। আমি যতক্ষণ ডেকে ছিলাম ও-ও ছিল। কিন্তু ওই সময়ের ভেতর ক্রিশ্চিয়ানকে একবারও ডেকে আসতে দেখিনি।
মিস্টার বিয়ামের সঙ্গে সে সময় কথা বলেছিলে তুমি?
হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার।
ওকে কি চিন্তিত বা অস্থির লাগছিল।
একদম না।
ফ্রায়ারের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম আমি। কোন সন্দেহ নেই আদালতের সবাই বুঝতে পেরেছে ও আমাকে নিরপরাধ মনে করে।
মরিসন, এবং অন্য আসামীরা প্রশ্ন করল মাস্টারকে। তারপর জবানবন্দী দিতে ডাকা হলো সারেঙ মিস্টার কোলকে। ওর জবানবন্দী থেকে জানতে পারলাম, বিদ্রোহের দিন ভোরে ও আমাকে আর স্টুয়ার্টকে চার্চিলের পাহারায় বার্থে কাপড় পরতে দেখেছিল।
জবানবন্দীর পর আদালত এবং আসামীরা জেরা করল কোলকে। অবশেষে সেদিনের মত আদালত মুলতবী ঘোষণা করলেন সভাপতি। আবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হেকটর-এর গান রুমে।
মিস্টার গ্রাহাম এলেন। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলাপ করলেন আমার সাথে। আজকের জবানবন্দী ও সাক্ষ্য সমূহের বিচার বিশ্লেষণ করে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন পরের সাক্ষীদের কি কি প্রশ্ন করতে হবে। সব শেষে আমাকে হতাশ হতে বারণ করে বিদায় চাইলেন তিনি।
আর একটা প্রশ্ন করতে চাই, স্যার, আমি বললাম।
নিশ্চয়ই। একটা কেন যত খুশি করো।
স্যার, মন থেকে আপনি আমাকে কি মনে করেন?–দোষী না নির্দোষ
কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিতে পারি প্রশ্নটার। আমি তোমাকে নির্দোষ মনে করি।
.
পরদিন সকাল নটায় আবার শুরু হলো শুনানি।
বাউন্টির গোলন্দাজ পেকওভারকে ডাকা হলো প্রথমে। আগে জবানবন্দী দিল সে। তারপর শুরু হলো জেরা। আমার ব্যাপারে মাত্র দুটো প্রশ্ন করা হলো তাকে। বিদ্রোহের সকালে আমাকে দেখেছিল কিনা, আর আমি সে সময় কি করছিলাম। ঠিক ঠিক জবাব দিল পেকওভার। আদালতের জেরা শেষে আসামীদের সুযোগ দেয়া হলো প্রশ্ন করার। মরিসন প্রথমে করল। ও যে বিদ্রোহীদের সঙ্গে ছিল না, বরং লঞ্চে খাবার দাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র তুলে দেয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা বেশ ভাল ভাবে বের করে আনল পের্কওভারের মুখ দিয়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার প্রশ্নগুলো বিশেষ কাজে গল না। আমার প্রশ্নের জবাবে পেকওভার জানাল, বিদ্রোহের আগের রাতে আমাকে আর ক্রিশ্চিয়ানকে ডেকের ওপর দেখেছে, কিন্তু আমাদের আলাপ সে শোনেনি। পরদিন বিদ্রোহের সময় মিস্টার নেলসনের সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হয়েছিল তা-ও সে শোনেনি।
এর পর ডাকা হলো ছুতোর মিস্ত্রী পার্সেলকে। জবানবন্দী শেষে আদালত তাকে প্রশ্ন করল:
জবানবন্দীর এক পর্যায়ে তুমি বলেছ, মিস্টার রিয়্যামকে তুমি বলেছিলে যেন কাটারের বদলে লঞ্চটা দেয়ার অনুরোধ করে ক্রিশ্চিয়ানকে। কেন? কেন বিয়্যামকে বলেছিলে? ওকে বিদ্রোহীদের একজন ভেবেছিলে তাই
না। আমি ওকে ক্রিশ্চিয়ানের বন্ধু বলে জানতাম, তাছাড়া ক্রিশ্চিয়ান আমাকে অপছন্দ করত, তাই আমার কথা শুনবে না মনে করে আমি বিয়্যামকে বলেছিলাম অনুরোধ করতে।
তোমার কি মনে হয় বিয়্যামের অনুরোধেই ক্রিশ্চিয়ান কাটারের বদলে লঞ্চ নামানোর নির্দেশ দিয়েছিল?
হ্যাঁ। সেদিন যদি লঞ্চটা না দেয়া হত; আমরা কেউই বোধহয় আর ইংল্যান্ডের মুখ দেখতে পেতাম না।
বিয়্যাম ছাড়া আর কারও নাম বলতে পারো, যার সাথে ক্রিশ্চিয়ানের বন্ধুত্ব ছিল?
হ্যাঁ। মিস্টার স্টুয়ার্ট। আর কারও নাম এ মুহূর্তে আমার মনে আসছে না।
তোমার কি মনে হয়, ঘনিষ্ঠতম বন্ধু বিয়ামের কাছেও বিদ্রোহের পরিকল্পনার কথা গোপন রেখেছিল ক্রিশ্চিয়ান, এটা সম্ভব?
একটু যেন ফাঁপরে পড়ল পার্সেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলল, সম্ভব। ক্রিশ্চিয়ানকে যতদূর জানি বন্ধুকে বিপদে ফেলার লোক ও নয়। ও নিশ্চয়ই জানত, যে কোন পরিস্থিতিতেই মিস্টার বিয়াম ক্যাপ্টেনের অনুগত থাকবে।
আদালত এর পর প্রশ্ন করল, লঞ্চটাকে যখন জাহাজের পেছন দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় তখন বিয়্যাম কোথায় ছিল?
আমি জানি না। এর মাত্র কয়েক মিনিট আগে আমি ওকে ডেকে, দেখেছিলাম, তখন ও আমাকে বলেছিল, ও ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সাথে যাবে। আমার মনে হয় ও সে সময় কাপড় চোপড় আনার জন্যে নিচে মিডশিপম্যানদের বার্ধে গিয়েছিল।
ওই সময় তুমি মরিসনকে দেখেছিলে?
না।
তোমার কি মনে হয়, ওরা লঞ্চে যেতে হবে এই ভয়ে নিচে পালিয়েছিল?
্না, আমার তা মনে হয় না। নিশ্চয়ই ওদের বাধা দেয়া হয়েছিল ওপরে আসতে, আর সে জন্যে সময় মত এসে লঞ্চে উঠতে পারেনি দুজনের একজনও।
এরপর আসামীদের প্রশ্নের পালা।
শেষ জন যখন লঞ্চে ওঠে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তখন লঞ্চটা কতখানি পানির ওপরে ছিল?।
খুব বেশি হলে সাড়ে সাত ইঞ্চি।
আপনার কি মনে হয় সবার জীবন বিপন্ন না করে আর কারও পক্ষে ওতে ওঠা সম্ভব ছিল?
না, আর একজনকেও নেয়ার ক্ষমতা ছিল না লঞ্চটার। ক্যাপ্টেন ব্লাই নিজে মিনতি করে বলেছিলেন, আর কাউকে যেন না পাঠায় ক্রিশ্চিয়ান।
এরপর সেদিনকার মত মুলতবী হয়ে গেল আদালত।
পরদিন চোদ্দ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, আবার শুরু হলো শুনানি। প্রথমেই জবাবন্দী দিল টমাস হেওয়ার্ড। ওর কাছ থেকে আমার উপকারে আসতে পারে এমন কোন তথ্য বেরোল না। হেওয়ার্ড-এর পর ডাকা হলো হ্যালেটকে। ওর কাছ থেকে আমার সম্পর্কে একটা তথ্যই আদালত জানতে পারল, বিদ্রোহের সময় আমার হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। আমার লঞ্চে ওঠার ইচ্ছা, বা এ ব্যাপারে আমি কাউকে বা কেউ আমাকে কিছু বলেছিল কি না সে সম্পর্কে ও কিছু বলতে পারল না। তবে একটা মিথ্যে কথা বলে ও আমার প্রায় বারোটা বাজিয়ে দিল। বিদ্রোহের সময় আমার সঙ্গে নাকি কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন ক্যাপ্টেন ব্লই, আমি তার কথা না শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে গিয়েছিলাম। এই মিথ্যা কথাটা হ্যালেট কেন যে বলল তা আজও আমি ভেবে পাই না।
এরপর সেদিনকার মত মুলতবী হয়ে গেল আদালত। পরদিন থেকে শুরু হবে আসামীদের আত্মপক্ষ সমর্থন।
.
আঠারো
আসামীদের ভেতর আমি একমাত্র মিডশিপম্যান। তাই আমারই ডাক পড়ার কথা প্রথম। কিন্তু পরদিন অর্থাৎ শনিবার সকালে মিন্টার গ্রাহামের পরামর্শে আমি আদালতের কাছে সময় চাইলাম সোমবার পর্যন্ত। আদালত আমার আবেদন মঞ্জুর করল।
প্রায় পুরো রোববার দিনটা আমি কাটালাম আমার কৌঁসুলি মিস্টার গ্রাহামের সাথে। অন্য আসামীদের পরামর্শদাতা ক্যাপ্টেন ম্যানলি আর ক্যাপ্টেন বেনথামও এলেন তার সাথে। তিনটে দলে ভাগ হয়ে আমরা ছড়িয়ে পড়লাম হেকটর-এর গানরুমের বিভিন্ন কোণে।
আমার বক্তব্যের একটা খসড়া ইতোমধ্যে আমি তৈরি করে ফেলেছি। মিস্টার গ্রাহামের সহায়তায় এবার সেটা সংশোধন করতে লাগলাম। কিছুকথা বাদ দিয়ে, কিছু কথা জুড়ে নতুন করে তৈরি করা হলো জবানবন্দীটা। এরপর মিস্টার গ্রাহাম বলে দিলেন সাক্ষীদের কাকে কাকে আমি ডাকব এবং কি কি প্রশ্ন করব। হেওয়ার্ড তার জবানীতে বলেছে, বিদ্রোহের আগের রাতে সে জেগে ছিল এবং রাত দেড়টার সময় আমার বার্থে ফেরার আওয়াজ পেয়েছিল।
এই কথাটা খুবই জরুরী তোমার জন্যে, বললেন মিস্টার গ্রাহাম। তুমি বলছ, ওই সময় টিঙ্কলারও তোমার সাথে নিচে গিয়েছিল। তোমরা বিদায় নিয়েছিলে একে অপরের কাছ থেকে
হ্যাঁ, স্যার।
তাহলে হেওয়ার্ড নিশ্চয়ই শুনেছিল তোমাদের কথা। ও যেন কথাটা স্বীকার করে, আমাদের দেখতে হবে। আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি টিঙ্কলার তোমার সাথে ছিল তাহলে স্বাভাবিকভাবে এটাও প্রমাণ হয়ে যাবে ও তোমার আর ক্রিশ্চিয়ানের আলাপ শুনেছিল। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তুমি ব্লাইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে-কথাটা কোথায় পেল হ্যালেট। আর কেউ তো এ কথা বলেনি।
কি করে বলবে? কথাটা যে ডাহা মিথ্যা।
আমারও তা-ই মনে হয়েছে, কিন্তু এই মিথ্যে কথাটা বলল কেন হ্যালেট? আচ্ছা, বিদ্রোহের সময় হ্যালেট আর হেওয়ার্ড কেমন আচরণ করছিল? শান্ত ছিল দুজনই?
ঠিক, উল্টোটা, স্যার। দুজনই ভয়ে কাঁপছিল। বার বার ক্রিশ্চিয়ানের কাছে মিনতি করছিল যেন লঞ্চে না পাঠানো হয় তাদের। শেষ পর্যন্ত যখন জোর করে লঞ্চে তুলে দেয়া হলো, দুজনই কেঁদে উঠেছিল হাউমাউ করে।
ভালো। এই কথাটা তোমার বের করে আনতে হবে। হ্যালেট বা হেওয়ার্ড যদি স্বীকার না-ও করে, অন্যদের মুখ থেকে বের করে আনবে। সেজন্যে এই প্রশ্নগুলো করবে- মিস্টার গ্রাহাম বলে গেলেন প্রশ্নগুলো। আমি লিখে নিলাম।
সন্ধ্যার সামান্য আগে উঠলেন মিস্টার গ্রাহাম। চলে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বক্তব্য তুমি নিজেই পড়ে শোনাতে চাও, না আমি পড়ে দেব তোমার হয়ে?
আপনিই বলুন কোনটা করলে ভাল হবে।
যদি মনে করো ঘাবড়ে যাবে না, তাহলে নিজেই পড়ো। তোমার কাহিনী তোমার মুখে শুনলে বিচারকদের মনে যেমন প্রতিক্রিয়া হবে অন্যের মুখে শুনলে তেমন না-ও হতে পারে।
.
সোমবার। সেপ্টেম্বর সতেরো।
ঠিক নটার সময় বসল আদালত এইচ.এম.এস ডিউক-এর বড় কেবিনে। বিচারক এবং দর্শকদের আসন গ্রহণের পর এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর মাস্টার অ্যাট-আর্মস ডাকল, রজার বিয়্যাম, হাজির?
উঠে লর্ড হুডের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম আমি।
বিদ্রোহ ও দস্যুতার মাধ্যমে মহানুভব রাজার সশস্ত্র জাহাজ বাউন্টি দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে তোমার বিরুদ্ধে। রাজসাক্ষীদের জবানবন্দী ও প্রশ্নোত্তর তুমি শুনেছ। এখন তোমার কোন বক্তব্য থাকলে শুনবে আদালত। তুমি তৈরি?
জি, স্যার।।
তাহলে ডান হাত উঁচু করো।
শপথ নিলাম আমি। তারপর তাকালাম স্যার জোসেফের দিকে। ভাবলাম তার দৃষ্টি হয়তো একটু সাহস যোগাবে আমাকে। কিন্তু তিনি তখন দুহাতে হাঁটু আঁকড়ে ধরে বসে আছেন, দৃষ্টি সোজা তার সামনে। আমার দিকে তাকাতে যেন ভয় পাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ কেমন এক আতঙ্ক ভর করল আমার মনে। ঘরের প্রতিটা চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভাবতেই অদ্ভুত এক কাপুনি অনুভব করলাম শরীরে। মুখগুলো ঝাপসা হয়ে এল আমার সামনে। তারপর, দূর থেকে ভেসে আসা অন্য মানুষের কণ্ঠস্বরের মত শুনতে পেলাম আমার গলা:
মহামান্য আদালতের মাননীয় সভাপতি ও বিচারক মণ্ডলী, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা অতি গুরুতর। আমি জানি এই অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে মানুষের মনে আতঙ্ক আর ঘৃণা ছাড়া অন্য কোন অনুভূতি জাগতে পারে না। তবু ভাগ্যের এমনই নির্মম লিখন, আমার বিরুদ্ধে উঠেছে এই অভিযোগ। আমি জানি আদালতে যে সব সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করা হয়েছে, সব আমার বিরুদ্ধে। আমাকে নিঃসংশয়ে নির্দোষ প্রমাণ করে এমন একটা কথাও বলা হয়নি। তবু মহান ঈশ্বর এবং মাননীয় বিচারক মণ্ডলীর সামনে আমি ঘোষণা করছি, আমি নির্দোষ। যে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তা সর্বৈব ভিত্তিহীন।
এ পর্যন্ত বলার পর একটু যেন সাহস ফিরে পেলাম আমি। দর্শকদের দিকে তাকালাম। তারপর মিস্টার গ্রাহামের পরামর্শ মত পড়ে গেলাম আমার লিখিত বক্তব্য শেষ করলাম এই কথাগুলো দিয়ে
মাননীয় সভাপতি ও বিচারক মণ্ডলী, যে তিনজন মানুষের সাক্ষ্য নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে পারত, আমি সত্যি কথা বলছি তারা সবাই আজ মৃত। আমার জন্যে অত্যন্ত দুঃখজনক যদিও, তবু কথাটা সত্যি। তাই আমি শুধু এটুকুই বলব, অনুনয় করে বলব, বিশ্বাস করুন আমার কথা! আমার সুনাম আমার কাছে আমার প্রাণের সমান। মাননীয় সভাপতি ও দ্রমহোদয়গণ, আমার পরিস্থিতিটা বিবেচনা করুন দয়া করে। আমি আপনাদের দয়ার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি আমাকে?
আমার কথাগুলো বিচারকদের মনে কি প্রভাব ফেলল তার কিছুই আন্দাজ করতে পারলাম না তাদের মুখ দেখে। ডা, হ্যামিলটনের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল আবার: বিচারকরা প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করেন না!
আমি কি কোন প্রমাণ হাজির করতে পেরেছি আমার বক্তব্যের সপক্ষে? ভীষণ হতাশ আর ক্লান্ত বোধ করতে লাগলাম আমি।
স্যার জোসেফের দিকে তাকালাম। এখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি দিয়েই যেন বুঝিয়ে দিতে চাইছেন: শাবাশ বেটা! মৃত্যুর কথা মনেও ঠাঁই দিও না! ওঁর দৃষ্টি নতুন করে শক্তি যোগাল যেন আমার শরীরে।
মহামান্য আদালত, আমি বললাম, এবার কি আমি সাক্ষীদের আবার প্রশ্ন করার সুযোগ পাব?
মাথা ঝাঁকালেন লর্ড হুড। মাস্টার-অ্যাট-আর্মস দরজার কাছে গিয়ে হাঁক ছাড়ল:
জন ফ্রায়ার! এই দিকে!
এল ফ্রায়ার। কাঠগড়ায় উঠে শপথ নিল। প্রশ্নের পালা শুরু করলাম আমি।
কোন কারণে আপনি যদি জাহাজে থেকে যেতেন এবং জাহাজ দখলের পরিকল্পনা করতেন, আমাকে কি জানাতেন সেই পরিকল্পনার কথা? (মিস্টার গ্রাহামের পরামর্শে আজ আবার করলাম প্রশ্নটা)।
হ্যাঁ, জবাব দিল ফ্রায়ার, জানাতাম। এবং প্রথম যাদের জানাতাম তাদের ভেতর থাকত ও।
লঞ্চ পানিতে নামানোর ব্যাপারে যারা সাহায্য করেছিল তাদের আপনি কি মনে করেন?-বিদ্রোহীদের সাহায্যকারী না ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সাহায্যকারী?
যাদের হাতে অস্ত্র ছিল না, আমি মনে করি, তারা ব্লাইকে সাহায্য করছিল।
ক্যাপ্টেন ব্লাইসহ মোট কতজন উঠেছিল লঞ্চে?
উনিশ জন।
লঞ্চের কিনারা পানির কতখানি উপরে ছিল।
খুব বেশি হলে আট ইঞ্চি।
লঞ্চে কি আরও লোক উঠতে পারত।
না। উঠলে, আমার মনে হয় যার আগেই উঠে পড়েছিল তাদের প্রাণ বিপন্ন হত।
বিদ্রোহের সময়টাতে একবারও আমার হাতে অস্ত্র দেখেছেন?
না।
বিদ্রোহের সময় ক্যাপ্টেন ব্লাই একবারও আমার সাথে কথা বলেছিলেন?
আমার জানা মতে না।
বিদ্রোহের সময় মিস্টার হেওয়ার্ডকে একবারও ডেকের ওপর দেখেছিলেন?
হ্যাঁ, বেশ কবার।
কি অবস্থায় ছিল ও স্বাভাবিক, আতঙ্কিত নাকি দ্বিধাগ্রস্ত?
দ্বিধাগ্রস্ত তো বটেই, খানিকটা আতঙ্কিতও ছিল ও। জোর করে যখন লঞ্চে নামিয়ে দেয়া হয় তখন তো কেঁদেই ফেলেছিল।
সেই সকালে মিস্টার হ্যালেটকে দেখেছিলেন একবারও
হ্যাঁ, বেশ কয়েক বার।
কি অবস্থায় ছিল ও?
হেওয়ার্ডের মত ভয়ে তটস্থ হয়ে ছিল। ও-ও কেঁদে ফেলেছিল লঞ্চে নামিয়ে দেয়ার সময়।
সাধারণ ভাবে বাউন্টিতে থাকাকালীন আমার আচরণ কেমন ছিল?
চমৎকার! সবাই ওকে খুব পছন্দ করত।
এর পর আদালত প্রশ্ন করল, লঞ্চে টিমোরে যাওয়ার পথে বিদ্রোহের কথা কি প্রায়ই আলাপ করতে তোমরা?
না। সে সময় প্রাণ বাঁচাতেই এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হত যে এসব কথা আলাপ করার সময়ই আমরা পেতাম না।
বিদ্রোহের আগের রাতে আসামী বিয়্যামের সাথে একটা বিশেষ ব্যাপারে আলাপ করেছিল ক্রিশ্চিয়ান। সেই আলাপের শেষটা শুনতে পেয়েছিল ব্লাই। এ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন ব্লাই কখনও কিছু বলেনি তোমাদের?
বলেছে বলে মনে পড়ছে না।
আসামী বিয়্যাম সম্পর্কেকখনও কিছু বলতে শুনেছ ওকে।
হ্যাঁ, একাধিকবার।
কি বলেছিল মনে করতে পারো?
বিদ্রোহের দিনই, জাহাজ থেকে লঞ্চটা যখন দূরে সরে এসেছে, তখন তাঁকে মিস্টার বিয়্যাম সম্পর্কে এই কথাগুলো বলতে শুনেছিলাম: ও একটা অকৃতজ্ঞ বদমাশ। ক্রিশ্চিয়ানের চেয়ে কোন অংশে কম না। পরেও বেশ কয়েকবার একথা বলতে শুনেছি ওকে।
লঞ্চের কেউ বিয়্যামের সপক্ষে কিছু বলেনি?
স্যা, অন্যরা তো বলেছে, আমি নিজেও বলেছি। কিন্তু প্রতিবারই ক্যাপ্টেন ব্লাই ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন আমাদের।
ক্রিশ্চিয়ান আর বিয়্যামের ভেতর একটা বিশেষ আলাপ সম্পর্কে টিঙ্কলারকে কখনও কিছু বলতে শুনেছ?
না, তেমন কিছু আমার মনে পড়ছে না।
রবার্ট টিঙ্কলার কখনও বিয়্যামের সপক্ষে কিছু বলেছে ব্লাইকে?
হ্যাঁ। আমার মত ও-ও বিশ্বাস করত না, বিয়্যাম বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ছিল।
রবার্ট টিঙ্কলার তোমার শ্যালক।
হ্যাঁ।
ও সাগরে নিখোঁজ হয়েছে?
হ্যাঁ, সেরকম খবরই আমি পেয়েছি।
তোমার সঙ্গে ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সম্পর্ক কেমন ছিল?–ঘনিষ্ঠ?
না। বরং উল্টোটাই বলা যেতে পারে।
এর পর ডাকা হলো কোলকে। ফ্রায়ারকে আমি যে প্রশ্নগুলো করেছিলাম ওকেও সেগুলোই করলাম। ফ্রায়ারের মত একই জবাব দিল সে-ও। আদালতের প্রশ্নগুলোও প্রায় একই হলো, জবাবও এল এক।
এর পর কাঠগড়ায় উঠল পেকওভার। আমি প্রশ্ন করে নতুন কিছু বের করতে পারলাম না ওর কাছ থেকে। আদালত জেরা শুরু করল এর পর।
বিদ্রোহের আগের রাতে ডেকের ওপর দায়িত্ব পালন করছিলে তুমি?
হ্যাঁ।
সে সময় কোয়ার্টার মাস্টারদের একজন জন নর্টনের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল একবারও?
প্রশ্নটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম আমি। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটার কথা একবারও মনে পড়েনি-না আমার না মিস্টার গ্রাহামের। নর্টনকে যদি কেউ সেরাতে ভেলা বানাতে দেখে থাকে আমার বক্তব্যের সপক্ষে, খুব জোরাল না হলেও, একটা প্রমাণ অন্তত পাওয়া যায়।
হ্যাঁ, হয়েছিল, জবাব দিল পেকওভার। রাত তখন প্রায় দুটো।
কেন দেখা হলো? ওর তো তখন ঘুমিয়ে থাকার কথা।
চরকিকলের কাছে হাতুড়ির শব্দ শুনে আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম ব্যাপার কি দেখতে। অন্ধকারে ভাল দেখতে পাইনি, কিন্তু বুঝতে পারি, কিছু একটা বানাচ্ছে নর্টন। কি, জিজ্ঞেস করায় ও জবাব দিয়েছিল, মুরগির খাঁচা মেরামত করছে।
সত্যিই মুরগির খাঁচা মেরামত করছিল কিনা তুমি জানো।
না। প্রথমত অন্ধকার ছিল, বিশেষ কিছু দেখতে পারিলাম না। তাছাড়া আমার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি, সত্যিই ও মুরগির বাঁচা মেরামত করছে না অন্য কিছু করছে।
কেন সন্দেহ জাগল না? এ ধরনের কাজ ছুতোর মিস্ত্রী বা তার সহকারীদের করার কথা না?
হ্যাঁ, তবে আমাদের বাউন্টিতে সূতোর মিস্ত্রীদের কাজের চাপ বাড়লে নর্টন প্রায়ই তাদের সাহায্য করত। সে কারণে আমার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি।
তোমার কি মনে হয় ছোটখাট কোন ভেলা তৈরি করছিল কোয়ার্টার মাষ্টার?
হতে পারে। আমি ঠিক জানি না।
এর পর হেওয়ার্ডকে ডাকা হলো সাক্ষীর কাঠগড়ায়। কিন্তু আমার কোন প্রশ্নের জবাবেই ও স্বীকার করল না, বিদ্রোহের আগের রাতে টিঙ্কলার আর আমি এক সাথে নিচে নেমে বার্থে ঢুকেছিলাম।
হ্যালেটও ওর বক্তব্যে অটল রইল: বিদ্রোহের সময় একবার নাকি ব্লাইয়ের কথার উত্তরে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম।
আমার মামলার সওয়াল জবাব শেষ হলো। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে এর পর ডাকা হলো মরিসনকে।
.
উনিশ
সেপ্টেম্বর আঠারো। মঙ্গলবার।
আজ রায় হবে বিচারের।
যথারীতি কাঁটায় কাঁটায় নটায় আদালত বসল। মাস্টার অ্যাট-আর্মস ডাকল, রজার বিয়্যাম!
কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়ালাম আমি।
বিচারক মণ্ডলীর সভাপতি লর্ড হুড জিজ্ঞেস করলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনে আর কিছু বলার আছে তোমার?
না, মাই লর্ড।
একই প্রশ্ন করা হলো আমাদের প্রত্যেককে। প্রত্যেকেই এক জবাব দিলাম। এর পর কিছুক্ষণের জন্যে দর্শকদের বেরিয়ে যেতে বলা হলো কক্ষ থেকে। আমরা-আসামীরাও বেরিয়ে এলাম। ডিউক-এর ডেকের ওপর অপেক্ষা করতে লাগলাম সশস্ত্র রক্ষীদের পাহারায়।
সময় গড়িয়ে চলেছে। থম থম করছে আমাদের মুখ। নিচে কেবিনে বসে বারো জন মানুষ নির্ধারণ করছেন আমাদের ভাগ্য। দুরু দুরু করছে বুকের ভেতর। কি রায় দেবেন বিচারকরা
অবশেষে বিশাল কেবিনটার দরজা খুলে গেল আবার। দর্শকরা ঢুকল প্রথমে। তারপর শুনতে পেলাম, আমার নাম ডাকা হচ্ছে। কেমন অদ্ভুত অপরিচিত মনে হলো নামটা, যেন জীবনে আর কখনও শুনিনি।
খোলা তলোয়ার হাতে এক লেফটেন্যান্ট আর বেওনেট লাগানো মাস্কেটধারী চার রক্ষীর সঙ্গে ঢুকলাম আমি। বিচারকদের দীর্ঘ টেবিলটার প্রান্তে নিয়ে গিয়ে ওরা দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে। সভাপতি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
উঠে দাঁড়াল পুরো আদালত। নীরবে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন আমাকে লর্ড হুড।
রজার বিয়্যাম, তোমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সপক্ষে আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রদত্ত তোমার বক্তব্য শ্রবণ এবং বিচার বিশ্লেষণ করে আদালত এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, তোমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিঃসংশয় প্রমাণিত হয়েছে। অতএক আদালত এই মর্মে রায় প্রদান করছে যে, কৃত অপরাধের শাস্তি স্বরূপ তুমি গ্রেট বৃটেনের আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। গলায় ফাঁস পরিয়ে মহানুভব রাজার কোন যুদ্ধজাহাজে তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। কোন জাহাজে এবং কবে কখন দণ্ড কার্যকর করা হবে তা নির্ধারণ করবে গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের মাননীয় লর্ড হাই অ্যাডমিরালের দপ্তরের দণ্ড কার্যকর-করণ বিষয়ক কমিশনার পরিষদ।
জানি আদালতের বক্তব্য শেষ, তবু আরও কিছু শোনার আশায় যেন দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। তারপর একটা কণ্ঠস্বর-কার আমি জানি না-বলল, আসামী এখন যেতে পারে। রক্ষীদের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম আমি বিশাল কেবিনটা ছেড়ে। আমার সঙ্গীদের কাছে এসে দাঁড়ালাম।
মরিসন জিজ্ঞেস করল, কি, বিয়্যাম?
ফাঁসি হবে আমার! শোনা মাত্র মরিসনের মুখের ভঙ্গি যে কেমন হলো, সে আমি জীবনে ভুলব না। অবশ্য বেশিক্ষণ আতঙ্কিত থাকার সুযোগ ও পেল না, ডাক পড়ল আদালতের সামনে।
একটু পরেই বেরিয়ে এল মরিসন। মুখটা ফ্যাকামে, তবে এখন অনেক সুস্থ সে। আমার পাশে এসে মৃদু হেসে বলল, সুযোগ থাকতে থাকতেই জীবনটাকে উপভোগ করে নেয়া উচিত, বিয়্যাম। একমুহূর্ত পরে যোগ করল, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমার মা যেন এতদিনে মরে গিয়ে থাকে।
এর পর গেল কোলম্যান। বেরিয়ে এল মুক্ত মানুষ হিসেবে। কোয়ার্টার ডেকের এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল ও। তারপর একে একে নরম্যান, ম্যাকইন্টশ, আর বায়ার্ন। ওরাও বেরিয়ে এল রক্ষী ছাড়া। তিন জনের মুখই উদ্ভাসিত হাসিতে।
বারকিট, এলিসন, মিলওয়ার্ড আর মুসভ্যাট দ্রুত গেল আর এল। চারজনকেই দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে।
এরপর আবার ডাকা হলো মরিসন আর মুস্যাটকে। জানানো হলো, ওদের বিষয়টা মহানুভব রাজার বিবেচনার জন্যে পাঠানো হবে। রাজা যদি ক্ষমা করেন তাহলে মুক্তি পাবে ওরা।
আর বেশিক্ষণ আমাদের ডিউক-এর ডেকে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো না। ফিরিয়ে আনা হলো হেকটর-এর গান রুমে। এখান থেকেই সকালে বেরিয়েছিলাম দশজন, এখন ঢুকলাম ছজন।
.
স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস দেখা করতে এলেন পরদিন বিকেলে। তাঁকে দেখেই অত এক স্বস্তি অনুভব করলাম আমি। দুহাতে আমার হাত ধরে একটু চাপ দিলেন তিনি। তারপর পেছন ফিরে সঙ্গে আসা নাবিকের কাছ থেকে মোটাসোটা একটা প্যাকেট নিয়ে খুলতে খুলতে বললেন:
বোসো, বিয়্যাম, তোমার এক পুরানো সঙ্গী এবং বন্ধুকে নিয়ে এসেছি। প্যাকেটটার দিকে ইশারা করলেন স্যার জোসেফ। বলো তো কি?
বিস্মিত হয়ে আমি দেখলাম, প্যাকেটটা থেকে বেরোল আমার তাহিতীয় ভাষার অভিধান ও ব্যাকরণের পাঞ্জলিপি।
তোমার পাণ্ডুলিপি পুরোটা আমি পড়েছি, বলে চললেন স্যার সোজেফ। সত্যি কথা বলতে কি কাজটা এত ভাল করে করতে পারবে আমি ভাবতেও পারিনি। আমি যা চেয়েছিলাম ঠিক তা-ই তুমি করেছ। এখন বলল, এটাকে ছাপাখানায় দেওয়ার উপযোগী করে তুলতে আর কতটা সময় নেবে তুমি?
মানে, স্যার, আপনি বলতে চাইছেন আমি আরও কাজ করব এটার ওপর?
তুমি করতে চাও?
চাই মানে! ফাঁসির দিন ক্ষণ ঠিক হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যস্ত থাকার জন্যে কিছু একটা কাজ ভীষণ দরকার আমার সারা দিন শুয়ে বসে থেকে মৃত্যুর কথা ভাবার ভেতর আর যা-ইখাক স্বস্তি বা শান্তি নেই মোটেই। বললাম, খুব খুশি হব, স্যার, কাজটা শেষ করার সুযোগ পেলে। এটার গুরুত্ব নিয়ে আমি ভাবছি না, আমি ভাবছি…
তুমি না ভাবলেও কাজটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, বাধা দিয়ে বললেন তিনি। অবশ্যই এটা শেষ করতে হবে। রয়্যাল সোসাইটি চায়, ছাপা বইটার শুরুতে একটা ভূমিকা থাকবে। সেই ভূমিকায় সাধারণ ভাবে আলোচিত হবে তাহিতীয় ভাষার মূল সূত্রগুলো; এবং ইউরোপীয় ভাষাগুলোর সঙ্গে তার সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য। রয়্যাল সোসাইটি ভূমিকাটা লেখার দায়িত্ব দিতে চাইছে আমাকে। কিন্তু, কি করে আমি লিখব? তাহিতীয় ভাষা সম্পর্কে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত, ভাসা ভাসা। এই জ্ঞান নিয়ে এমন একটা প্রবন্ধ রচনা করা এক কথায় অসম্ভব। কেউ যদি এটা লিখতে পারে, সে তুমি।
আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি, বললাম, অবশ্য যদি যথেষ্ট সময় হাতে…।
এক মাসের ভেতর পারবে।
আশা করি।
বেশ, পাবে তুমি এক মাস। অ্যাডমিরালটিতে আমার সামান্য প্রভাব আছে, সেটুকু খাঁটিয়ে আমি আদায় করে নেব সময়।
এর পর আমার ফাঁসির আদেশ সম্পর্কে সসংকোচে সামান্য আলাপ করলেন স্যার জোসেফ। মূলত দুঃখ প্রকাশ করলেন। অরপর বিদায় নিলেন।
আমি কাজে ডুবে গেলাম আবার।
.
অক্টোবরের পঁচিশ তারিখ। এই নিয়ে চতুর্থ কি পঞ্চমবারের মত পড়ছি সদ্য সমাপ্ত ভূমিকাটা। করাঘাত হলো দরজায়। ধক করে উঠল বুকের ভেতর। কপালে শীতল ঘাম জমে উঠতে শুরু করেছে। প্রবটা শেষ করার পর থেকে দরজায় কোন শব্দ হলেই এমন হচ্ছে আমার।
ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই, কি প্রশান্তি! ডা. হ্যামিলটন দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়! বিচারের রায় হলো যেদিন তার পর এই প্রথম দেখা আমাদের। শিগগিরই নিউফাউন্ডল্যান্ড-এ চলে যাচ্ছেন ডাক্তার। তাই শেষ বারের মত এসেছেন আমাকে বিদায় জানাতে।
অনেকক্ষণ কথা বললাম আমরা। প্যানডোরা, গ্রেট ব্যারিয়ার রীফে তার বিধ্বস্ত হওয়া, সেখান থেকে ভোলা নৌকায় টিমোর-এ পৌঁছানো-সব প্রসঙ্গ এল, চলে গেল। অবশেষে ওঠার সময় হলো ডা:হ্যামিলটনের। আমার হাত ধরে সান্ত্বনাসূচক কিছু একটা বলার জন্যে সবে মুখ খুলেছেন, দড়াম করে খুলে গেল দরজা। হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে ঢুকলেন স্যার জোসেফ।
বিয়্যাম! বিয়্যাম! কোন রকমে উচ্চারণ করলেন, তারপরই প্রবল আবেগে করুদ্ধ হয়ে এল ভার।
আমি অনুভব করছি, বরফশীতল কিছু একটা যেন উঠে আসছে আমার বুকের ভেতর থেকে গলার কাছে। ডা. হ্যামিলটন তাকাতে লাগলেন একবার স্যার জোসেফের দিকে, একবার আমার দিকে।
না…দাঁড়াও! চিৎকার করে উঠলেন স্যার জোসেফ। তুমি যা ভাবছ তা না…একটু একটু… এক পা এগিয়ে দুহাতে আমার কাঁধ ধরলেন তিনি। বিয়্যাম…বিয়্যাম…টিঙ্কলার বেঁচে আছে…ওকে পাওয়া গেছে…এ-মুহূর্তে ও লন্ডনেই আছে!
বোসো, বিয়্যাম, ডা. হ্যামিলটন বললেন। কিন্তু তার কোন প্রয়োজন আসলে ছিল না। নিজের অজান্তেই আমি বসে পড়েছি মেঝেতে। আমার পা দুটো আর বইতে পারছিল না আমার ভার। ডা. হ্যামিলটন আমাকে উঠিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। পকেট থেকে ব্র্যান্ডির ছোট একটা শিশি বের করে মুখ খুলে ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। বললেন, খাও।
স্যার জোসেফ টেবিলের সামনে চেয়ারটায় বসে রুমাল দিয়ে কপাল মুছছেন।
আমাকে এক চুমুক খাওয়ার অনুমতি দেবেন না, ডাক্তার? বললেন তিনি।
দুঃখিত, স্যার, একদম খেয়াল ছিল না, বলে শিশিটা আমি এগিয়ে দিলাম তার দিকে।
স্যার জোসেফ শিশিতে মুখ লাগিয়ে এক চুমুক খেয়ে বললেন, খাসা জিনিস, ডাক্তার। যে কাজের জন্যে তৈরি ঠিক সে কাজেই লাগল আজ। আমার দিকে ফিরে যোগ করলেন, লন্ডন থেকে সোজা এখানে আসছি। কাল সকালে নাশতা করতে করতে টাইমস-এ চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল খবরটা। ছোট্ট খবর: স্যাফায়ার নামক একটা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান জাহাজ বন্দরে নোঙ্গর ফেলেছে। হাভানার কাছে বিধ্বস্ত ক্যারিব মেইড-এর কয়েক জন বেঁচে যাওযা নাবিককে উদ্ধার করে এনেছে ওটা। নাশতা করা মাথায় উঠল আমার। ছুটলাম বন্দরে। গিয়ে দেখি মাল নামাচ্ছে স্যাফায়ার। ক্যারিব মেইড এর নাবিকদের খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, ওরা আগের দিন সন্ধ্যায়ই তীরে চলে এসেছে। খোঁজাখুজি করে বন্দরের কাছেই এক সরাইখানায় পেলাম ওদের। টিঙ্কলার নামের কেউ ওদের ভেতর আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই সরাই মালিক দেখিয়ে দিল এক লোককে। সে তখন দুলাভাই মানে ফ্রায়ারে বাসায় যাওয়ার জন্যে বেরোচ্ছে। কোন ওজর আপত্তিতে কান না দিয়ে ওকে আমার গাড়িতে তুলে সোজা নিয়ে গেলাম লর্ড হুডের কাছে। কপাল ভাল অ্যাডমিরাল শহরেই ছিলেন। সাড়ে দশটার সময় লর্ড হুড আর আমি টিঙ্কলারকে নিয়ে পৌঁছলাম অ্যাডমিরালটিতে। ওখানে টিস্কলারের জবানবন্দী নেয়ার সব আইনগত ব্যবস্থা পাকা করে সোজা চলে এসেছি এখানে। যতদিন
টিঙ্কলারের জবানবন্দী নেয়া হচ্ছে ততদিন ও অ্যাডমিরালটির হেফাজতে থাকবে।
আমি শুনলাম শুধু, জবাব দেয়ার মত কোন কথা খুঁজে পেলাম না।
এখন কি নতুন করে বসবে সামরিক আদালত? ডা. হ্যামিলটন জিজ্ঞেস করলেন।
না, সেটা সম্ভব নয়। অ্যাডমিরালটির কমিশনাররাই শুনবে টিঙ্কলারের বক্তব্য। তারপর যুক্তিযুক্ত মনে হলে তারা সামরিক আদালতের রায় অদলবদল করতে পারবেন। কমিশনারদের সে ক্ষমতা দিয়েছে আমাদের দেশের আইন।
.
বিশ
অক্টোবরের ছাব্বিশ তারিখ সকালে টমাস বারকিট, জন মিলওয়ার্ড আর টমাস এলিসনকে নিয়ে যাওয়া হলো এইচ.এম.এস, ব্রানসউইক-এ ফাঁসি দেয়ার জন্যে। বাকিরা অর্থাৎ মরিসন, মুসভ্যাট আর আমি, সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম আমাদের নেয়া হলো না। খুশি হব না দুঃখ পাব বুঝতে পারলাম না। একবার ভাবলাম টিলারের বক্তব্য শুনে আমাদের ব্যাপারটা বোধ হয় পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। আবার মনে হলো, না, এক সঙ্গে ছজনকে ফাঁসি দেয়া অসুবিধাজনক বলে আমাদের রেখে গেছে। আজই আরও পরে অথবা কাল আমাদের দণ্ড কার্যকর করা হবে। তার মানে কমপক্ষে আরও কয়েক ঘন্টা কাটাতে হবে। মৃত্যুর সময় গুনে। মরিসন আর আমি পায়চারি শুরু করলাম। মনটাকে ব্যস্ত রাখার-প্রাণান্ত চেষ্টায় ইন্ডিয়ান ভাষায় আমাদের তাহিতীয় বন্ধুদের সম্বন্ধে আলাপ করতে লাগলাম।
এগারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি, এই সময় ক্যাপ্টেন মন্টাগু এলেন। সঙ্গে এক লেফটেন্যান্ট। মৃদু হাসি দুজনেরই মুখে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে চাইল কলজেটা। তাহলে কি…?
জেমস মরিসন, উইলিয়াম মুস্যাট, ডাকলেন ক্যাপ্টেন মন্টাগু।
এগিয়ে গেল দুজন। লেফটেন্যান্টের হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ক্যাপ্টেন পড়লেন:
অ্যাডমিরাল অভ দ্য ব্লু এবং মহানুভব রাজার সশস্ত্র জাহাজ বাউন্টিতে বিদ্রোহের ব্যাপারে তোমাদের দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড প্রদানকারী সামরিক আদালতের সভাপতি লর্ড হুড আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তোমাদের দোষী সাব্যস্ত করলেও বিদ্রোহকালীন কিছু বিশেষ পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তোমাদের মুক্তি দেওয়ার আন্তরিক আবেদন জানিয়েছিলেন মহানুভব রাজার কাছে। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে মহানুভব রাজা তোমাদের বেকসুর খালাস প্রদান করছেন।
রজার বিয়্যাম!
দুই সাথীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।
গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের মহানুভব লর্ড হাই অ্যাডমিরালের দপ্তরের কমিশনার-পরিষদ মহানুভ রাজার সশস্ত্র জাহাজ বাউন্টির সাবেক মিডশিপম্যান রবার্ট টিলারের জবানবন্দী ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে নিঃসংশয় হয়েছেন যে, যে অপরাধের দায়ে তোমার বিচার, দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে সে অপরাধে তুমি অপরাধী নও। অতএব মাননীয় সর্ডের কমিশনার
পরিষদ সামরিক আদালতের রায় বাতিল করে তোমাকে নির্দোষ ও বেকসুর খালাস ঘোষণা করছেন।
এগিয়ে এসে আন্তরিকভাবে আমাদের প্রত্যেকের করমর্দন করলেন ক্যাপ্টেন মন্টাগু।
আমার মনে যে কত কথা এসে ভীড় করছে! কিন্তু বলার সময়, ধন্যবাদ, স্যার, ছাড়া আর কিছু বলতে পারলাম না।
মরিসন বলল, আমার রাজার করুণা আমাকে মুক্তি দিয়েছে। মহানুভবের সেবায় আমি আমার আগামী দিনগুলো উৎসর্গ করব। লর্ড হুডের প্রতিও কৃতজ্ঞ থাকব আজীবন।
মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন মন্টাগু। এরপর আমি প্রশ্ন করলাম, আমরা এখন মুক্ত, স্যার? মানে যেখানে খুশি যেতে পারব? সন্দেহের সুর আমার গলায়।
হ্যাঁ। সেফটেন্যান্টের দিকে ফিরলেন ক্যাপ্টেন। কানিংহ্যাম, দেখ তো, এই ভদ্রলোকদের জন্যে একটা নৌকার ব্যবস্থা করা যায় কি না এক্ষুণি।
হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন মন্টার সঙ্গে আমরা ওপরে উঠে এলাম। কয়েক মিনিটের ভেতর লেফটেন্যান্ট কানিংহ্যাম এসে জানাল নৌকা তৈরি। বিদায় নেয়ার মুহূর্তে ক্যাপ্টেন মন্টাগু আমাকে বললেন, আশা করি শিগগিরই আমাদের আবার দেখা হবে, মিস্টার বিয়্যাম।
নেমে এলাম নৌকায়! দাঁড় টানতে শুরু করল নাবিকরা।
কতদিন পর আমরা মুক্ত মানুষ হিসেবে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি! কিন্তু আমাদের মনের অবস্থা তখন মুক্তির আনন্দ উপভোগ করার মত নয়। মাত্র দুশো পূজেরও কম দূরে নোঙ্গর করে আছে এইচ.এম.এস ব্রানসউইক। ওটার ওপরের ডেকে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে পৌঁছানো তিন জন মানুষ, আমাদেরই তিন সাথী। আর কয়েক মিনিটের ভেতর ফাঁসির দড়ি এ পৃথিবীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাবে মিলওয়ার্ড; বারকিট আর এলিসনকে।
.
হেকটর থেকে নেমে আসার আগে ক্যাপ্টেন মন্টাও একটা চিঠি দিয়েছিলেন আমাকে। স্যার জোসেফের লেখা। কমিশনার-পরিষদের সিদ্ধান্ত জানার পরপরই অ্যাডমিরালটি দপ্তরে বসে তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন। এতক্ষণে পড়ার সুযোগ পেলাম চিঠিটা। স্যার জোসেফ লিখেছেন, লন্ডনগামী রাতের কোচে তিৰুটে আসন তিনি ভাড়া করে রেখেছেন আমাদের তিনজনের জন্যে। পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন: মিস্টার একাইন আশা করে আছেন, তুমি তার বাড়িতে উঠবে। আমার মনে হয় না বুড়ো মানুষটাকে আশাহত করা উচিত হবে তোমার। বিক্ষিপ্ত মনটা একটু শান্ত হলেই আমাকে খবর দিও। জরুরী একটা ব্যাপারে আমি তোমার সাথে আলাপ করতে চাই।
.
পরদিন সকালে লন্ডন কোচ স্টেশনে নেমেই একে অপরের কাছ থেকে বিদায় মিলাম আমরা। মরিসন আর মুস্যাট রওনা হয়ে গেল যার যার বাড়ির পথে। আমি রওনা হলাম ফিগ টি কোর্টে মিটার একাইন-এর বাড়ির দিকে।
মিস্টার এসকাইন আমার প্রয়াত বাবার বন্ধু এবং আমাদের পারিবারিক আইন উপদেষ্টা। একটা সপ্তাহ কাটিয়ে দিলাম তার বাড়িতে। তার পর খবর পাঠালাম স্যার জোসেফের কাছে। জবাব এল কয়েক ঘণ্টার ভেতর। রাতে তাঁর সাথে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আমাকে স্যার জোসেফ।
সন্ধ্যার পর পৌঁছুলাম তাঁর বাড়িতে। দেখলাম আমি একা নই, হেকটরের ক্যাপ্টেন স্যার মন্টাও নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি, রাজনৈতিক ঘটনাবলী কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বা নিতে যাচ্ছে এসব ব্যাপারে কিছুক্ষণ আলাপ করলাম আমরা। করলাম না বলে বলা উচিত স্যার জোসেফ আর স্যার মন্টাই করলেন, আমি শুনলাম। ওঁদের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হলো, খুব শিগগিরই যুদ্ধ বাধতে যাচ্ছে ইউরোপে। অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না আমার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ফিরে যাব তাহিতিতে-আমার হেলেনের কাছে, আমার তেহানির কাছে। সুতরাং ইউরোপ এখন রসাতলে গেলেও আমার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি নেই।
ইউরোপ প্রসঙ্গ শেষ হতেই স্যার জোসেফ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি করবে তুমি, কিছু ভেবেছ, বিয়্যাম নৌবাহিনীতে ফিরে আসবে না অক্সফোর্ডে যাবে আবার
কোনটাই না, স্যার, আমি জবাব দিলাম। ঠিক করেছি আমি তাহিতিতেই ফিরে যাব।
আমার কথা শুনে ভয়ানক অবাক হলেন দুজন। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারলেন না।
ইংল্যান্ডের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ আর নেই, আবার বললাম আমি।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন স্যার জোসেফ। তুমি যে তাহিতিতে ফিরে যাওয়ার কথা ভাববে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো জাহাজের কাজ ছেড়ে আবার লেখাপড়ায় লেগে যাবে। কিন্তু তাহিতি…না!
কেন নয়, স্যার? দেশে কোন বাঁধন, কোন দায় দায়িত্ব আমার নেই। এক মা ছিল, সে-ও মরে গেছে। তাহলে আর কেন?
উহুঁ, কথাটা তুমি ঠিক বললে না, বিয়্যাম, মদের গেলাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে ক্যাপ্টেন মন্টাগু বললেন। দেশে কোন আপনজন নেই বলে কোন দায় দায়িত্বও নেই এটা কিন্তু ভুল। যে ঘটনাটা ঘটে গেল, এর ফলে বিশেষ একটা দায়িত্ব চেপেছে তোমার কাঁধে।
মানে! কিসের দায়িত্ব
তোমার মৃত বাবা মায়ের সম্মানের দায়িত্ব, স্মৃতির দায়িত্ব। বিদ্রোহের মত জঘন্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলে তুমি। যদিও বেকসুর খালাস পেয়েছ তর, আগামী দিনগুলোয় তোমার নামের সাথে সামান্য হলেও-কি বলে ওকে?-কালিমা লেগে থাকবে। তোমার আগামী দিনের কাজের ওপর নির্ভর করবে এই কালিমা চিরদিন থেকেই যাবে না ধীরে ধীরে হালকা হতে হতে মিলিয়ে যাবে। যদি ডাঙার কোন কাজ বেছে নাও বা তাহিতিতে ফিরে যাও, মানুষ বলবে, রজার বিয়্যাম? হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনি, বাউন্টির বিদ্রোহী গুণ্ডাদের একজন তো-সামরিক আদালতে বিচার হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে কেমন করে যেন ছাড়া পেয়ে গেল। জনমতের একটা আলাদা শক্তি আছে, বিয়্যাম। ইচ্ছে করলেই সে শক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
জাহান্নামে যাক জনমত, একটু উষ্ণ কণ্ঠেই আমি বললাম। আমি নির্দোষ এবং আমার রাবা-মা-মৃত্যুর ওপারে যদি জীবন থেকে থাকে তো এতদিনে নিশ্চয়ই জেনে গেছে একথা। সুতরাং অন্যরা যা খুশি ভাবুক, আমি, গ্রাহ্য করি না।
তুমি আসলে পরিস্থিতির শিকার হয়েছ, সহানুভূতির সুরে বললেন ক্যাপ্টেন মন্টা। তার ওপর পেয়েছ চরম দুর্ব্যবহার আর অপমান। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তবে এটাও ঠিক, তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি যা ভাবছ তা ঠিক নয়। আমার-এবং স্যার জোসেফেরও ধারণা, জাহাজের চাকরিই তোমার জন্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে উপযোগী হবে। তোমার মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা সারিয়ে তুলতে হলে এর চেয়ে ভাল আর কোন পথ নেই। বাতাসে যুদ্ধের গন্ধ। তাতে অংশ নেয়াই যথেষ্ট হবে, দুদিনেই তোমার সম্পর্কে সব কানাকানি বন্ধ হয়ে যাবে। আর যদি যোগ্যতা দেখাতে পারো তো কথাই নেই।
এক মুহূর্তের জন্যে থামলেন ক্যাপ্টেন অন্টা। তারপর বলে চললেন, শোনো, বিয়্যাম, সোজাসুজিই বলছি, আমি তোমাকে হেকটর-এ চাই। লোকৈর দরকার আছে আমার, সেই লোকটা যদি তুমি হও সত্যিই খুশি হব আমি।
এরকম একটা প্রস্তাব এমন আচমকা হাজির হবে ভাবতে পারিনি। ইতস্তত করতে লাগলাম আমি।
হ্যাঁ, বিয়্যাম এটাই সবচেয়ে ভাল হবে তোমার জন্যে, বললেন স্যার জোসেফ।
ভাল তো হবে। কিন্তু, স্যার, বিড় বিড় করলাম আমি। স্যার, আপনার প্রস্তাবটা লোভনীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু-
এক্ষুণি তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না, বাধা দিয়ে বললেন স্যার মন্টাগু। ব্যাপারটা নিয়ে ভাল মত চিন্তা ভাবনা করো। এক মাসের ভেতর জানালেই চলবে, ততদিন আমি লোক নেব না।
হ্যাঁ, ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও, স্যার জোসেফ বললেন। আজ আর এ নিয়ে কোন কথা আমরা বলব না।
.
পর দিনই আমি রওনা হলাম কাম্বারল্যান্ডের পথে, ক্রিশ্চিয়ানকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যে। সেখান থেকে উইদিকম্বিতে আমার বাড়িতে।
মাসের শেষ নাগাদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ক্যাপ্টেন মন্টাগুর প্রস্তাব গ্রহণ করব আমি। হেকটরে যোগ দেব নাবিক হিসেবে।
.
উপসংহার
১৭৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমি যোগ দিলাম ক্যাপ্টেন মন্টাগুর জাহাজে। পরের মাসেই ইউরোপ জুড়ে জ্বলে উঠল যুদ্ধের আগুন। বারো বছরের ভেতর সে আগুন আর নিভল না। এই বারো বছরে অসংখ্য নৌযুদ্ধে অংশ নিলাম আমি। বেশির ভাগই স্পেন উপকূলের অদূরে স্প্যানিশ আর্মাতার সাথে। এ ছাড়াও ক্যাম্পারডাউনে ডাচদের সাথে, ডেনদের সাথে কোপেনহ্যাগেন-এ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চদের সাথে ট্রাফালগার-এ যুদ্ধ করতে হলো। এই সময়ের ভেতর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে আমি ক্যাপ্টেন হলাম।
যুদ্ধের পুরো সময়টায় আমি স্বপ্ন দেখেছি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় কোন শান্তিপূর্ণ উপনিবেশে বদলি হওয়ার। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে, বাস্তব আর হয়নি। বাস্তব হলো যুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক পর ১৮০৯ সালের গ্রীষ্মে, যখন ফরাশিদের কাছ থেকে দখল করা কুরিওজ নামের একটা ফ্রিগেটের দায়িত্ব দিয়ে নিউ সাউথ ওয়েলস-এর পোর্ট জ্যাকসনের পথে রওনা হতে বলা হলো আমাকে। সেখান থেকে ভ্যালপারাইজো যেতে হবে। পথে দিন কয়েকের জন্যে থামতে হবে তাহিতিতে।
.
এপ্রিলের গোড়ার দিকে এক বিকেলে মাতাভাই উপসাগরে প্রবেশ করল আমার জাহাজ। দূরে তাহিতির তটরেখা দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির বন্যা উদ্বেল করে তুলল আমাকে। ওই তো ওখানে পয়েন্ট ভেনাস। তার ওপাশে ছোট্ট সেই দ্বীপটা-মোটু আউ। উল্টোদিকে হিটিহিটির বাড়ি। সামান্য দূরে স্টুয়ার্টের নিজ হাতে গড়া বাগান। পেগি এখন কেমন আছে ওদের মেয়ে? বীর পইনোর বাড়ি দেখতে পেলাম, মরিসন আর মিলওয়ার্ড থাকত ওখানে। কাছেই ভাইপুপু উপত্যকা থেকে নেমে আসা ছোট্ট নদী ভাইপুপুর মোহনা, যেখানে তেহানির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল আমার। কতদিন আগের কথা? তখন আমি কৈশোের ছাড়িয়ে যৌবনের দুয়ারে পা দিয়েছি সবে। আর এখন, প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তসীমায়। আমার মেয়ে হেলেন এখন কতবড় হয়েছে?
আশ্চর্য ব্যাপার, আমরা যখন নোঙ্গর ফেললাম একটা ক্যানোও এল না আমাদের-জাহাজের কাছে। সৈকতের ওপর অল্প কয়েক জন মানুষকে কেবল দেখলাম। উত্তেজনা বা আনন্দ নয়, কেমন যেন বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তাহলে কথাটা ঠিক! কদিন আগে পোর্ট জ্যাকসন-এ এক মিশনারির কাছে শুনছিলাম, যুদ্ধ এবং ইউরোপীয় নাবিকদের সাথে আসা রোগ ব্যাধিতে তাহিতির চার পঞ্চমাংশ জনসংখ্যাই নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কথাটার তাৎপর্য তখন হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি। আজ নিজের চোখে দেখে পারলাম। মনে পড়ল বাউন্টি যেদিন প্রথম নোঙ্গর ফেলেছিল এখানে সেদিনকার দৃশ্য। হাজার হাজার ক্যানন ঘেঁকে ধরেছিল আমাদের। চারদিকে-সাগরে, ডাঙায় সেদিন ছিল প্রাণের ছড়াছড়ি। আর আজ! তাহিতির সেই চির সবুজ প্রকৃতিও যেন আর তেমন নেই। কেমন হলদেটে নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে।
অবশেষে অনেকক্ষণ পর একটা হোট জোড়া তালি দেয়া ক্যানো এসে ভিড়ল কুরিওজের গায়ে। দুজন লোক তাতে। ছেঁড়াছোঁড়া ইউরোপীয় পোশাক তাদের পরনে। এক পলক দেখেই বুঝলাম লোকদুটো ভিক্ষুক ছাড়া কিছু নয়। আমাদের দেয়া উপহরের বিনিময়ে কিছুই দিতে পারল না ওরা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা শুরু করল। আমি জবাব দিলাম ওদের ভাষাতেই। টিপাউ, পইনো এবং হিইিহিটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে কাঁধ ঝাঁকুনি আর বিস্মিত দৃষ্টি ছাড়া কিছু পেলাম না।
সূর্যাস্তের ঘন্টা খানেক আগে আমার লোকেরা হিটিহিটির পয়েন্টে নামিয়ে দিল আমাকে। ওদের অপেক্ষা করতে বলে আমি এগিয়ে গেলাম দ্বীপের ভেতর দিকে। একটা মানুষ দেখতে পেলাম না। আমার তাইওর বাড়ির কোন চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। যেখানে হিটিহিটির উঠান ছিল সে জায়গাটা এখন আগাছায় পূর্ণ। ফারেরোই-এর মন্দিরে যাওয়ার পথটারও এক দশা। এখানে যে কোন কালে পথ ছিল অনেক কষ্টে তা কল্পনা করে নিতে হয়।
সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রওনা হলাম তেহানির সাথে যেখানে দেখা হয়েছিল সেই নদীমুখের দিকে।
যেখানে বসে আমি সূর্যোদয় দেখতাম ঠিক সেখানে বসে আছে এক বৃদ্ধা। দূর সাগরের দিকে দৃষ্টি। ধীর পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। চমকে মুখ তুলে তাকাল বৃদ্ধা। আমি হিতীয় ভাষায় কথা বলতেই মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। হিটহিটি? হ্যাঁ, লোকটার নাম সে শুনেছে, অনেক বছর আগে মারা গেছে এই গোত্রপতি। হিনা মাথা নাড়ল বৃদ্ধা। টিপাউ-এর নামও কখনও শোনেনি। তবে পইনোর কথা ভালই মনে আছে তার। ডাকসাইটে যোদ্ধা ছিল। মারা গেছে সে-ও। সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে বৃদ্ধা বলল, তাহিতি এক কালে মানুষের দেশ ছিল, এখন ছায়া ছাড়া কিছু নেই।
.
পরদিন সকালে জনা বারো লোক নিয়ে পানসিতে করে টউিতিরার পথে রওনা হলাম আমি। দ্বীপটার পূর্ব উপকূল মাতাভাইয়ের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থায় আছে মনে হলো। যুদ্ধ ভেহিয়াটুয়ার রাজ্যের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে মড়ক তার কাজ ভাল মতই সম্পন্ন করেছে। আগে, আমি যখন ছিলাম তখন যেখানে পঞ্চাশ জন লোক দেখা যেত এখন সেখানে দশ জনেরও দেখা পাওয়া ভার।
ভেহিয়াটুয়ার রাজ্য অক্ষত আছে কিন্তু বাড়ি নেই। সাগরতীরে যেখানে ছিল উঁচু বাড়িটা সেখানে এখন হিটিহিটির বাড়ির মতই আগাছার জঙ্গল। তবে আশ্চর্য ব্যাপার, আমার বাড়িটা আছে। কি করে এটা সম্ভব হয়েছে আমি জানি না।
পানসি ডাঙার মাটি স্পর্শ করল। জনা বিশেক নারী পুরুষ এগিয়ে এল আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। এক এক করে প্রত্যেকটা লোকের মুখ নিরীক্ষণ করলাম আমি। এক জনকেও পরিচিত মনে হলো না। তেহানির কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না আমার। পোর্ট জ্যাকসনের সেই মিশনারীটির মুখে শুনেছিলাম তেহিয়াটুয়া মারা গেছে। তার পরিবারের অন্যদের খবর জিজ্ঞেস করার সাহস তধন হয়নি, এখনও হলো না। আমার লোকদের কিছু নারকেল কেনার জন্যে দরদাম করার নির্দেশ দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম আমাকে চেনে এমন কারও খোঁজে।
বহুদিন আগের পরিচিত পথেই এগোলাম। হ্যাঁ, আমার বাড়ির দিকে। অর্ধেক পথও যাইনি, এমন সময় হোমরা চোমরা চেহারার মাঝ বয়েসী এক লোকের সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে। দুজনের চোখ এক হলো! মুহূর্তের জন্যে কোন কথা বলতে পারলাম না দুজনের কেউ।
তুয়াহু। আমি প্রশ্ন করলাম।
বিয়্যাম! ছুটে এসে ইন্ডিয়ান রীতিতে আলিঙ্গন করল আমাকে তুয়াহু। আবার যখন মুখ তুলল, দেখলাম ওর চোখে জল। আমার হাত ধরে বলল, এসো, বাড়িতে এলো।
বাড়িতেই যাচ্ছিলাম, আমি বললাম। কিন্তু তার আগে চলো, এমন কোথাও যাই যেখানে আমরা একটু একা থাকতে পারব।
আমার মনের কথা স্পষ্ট বুঝতে পারল তুয়াহ। বলল, এখানেই বলতে পারো যা বলতে চাও। এপথে এখন আর বেশি লোক চলাচল করে না।
অনেকক্ষণ ধরে সাহস সঞ্চয় করলাম আমি। অবশেষে করলাম প্রশ্নটা:
তেহানি কই?
উয়া মাতে–মারা গেছে, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল তুয়াহু। তুমি চলে যাওয়ার তিন চাঁদ পর মারা গেছে ও।
আমাদের বাচ্চা? দীর্ঘ নীরবতার পর আবার আমি প্রশ্ন করলাম।
ও বেঁচে আছে। এখন পরিপূর্ণ নারী। ওর নিজেরও একটা বাচ্চা হয়েছে। আতুয়াই-এর ছেলেকে ও বিয়ে করেছে। একটু দাঁড়াও দেখতে পাবে তোমার মেয়েকে।
বন্ধু, তুমি জানো ও কতখানি প্রিয় আমার। এই এতগুলো বছর আমি স্বপ্ন দেখেছি ফিরে আসব, ফিরে আসব। পারিনি। আমার দে একটানা জড়িয়ে থেকেছে যুদ্ধে। এই জায়গা এখন আমার কাছে স্মৃতির কবরখানা। মেয়েকে আমি দেখতে চাই, তবে-তবে আমার পরিচয় না দিয়ে। আজ এত বছর পর পিতৃত্বের দাবি নিয়ে ওর সামনে দাঁড়াতে, ওকে বুকে জড়িয়ে নিতে, ওকে ওর মায়ের গল্প শোনাতে আমি পারব না, তুয়াহু। বুঝতে পারছ আমার কথা?
করুণ একটু হাসি ফুটল তুয়ার মুখে। বুঝেছি, সে বলল।
ঠিক সেই সময় নারী কণ্ঠের কথাবার্তা ভেসে এল কানে। তুয়াহু আমার হাত স্পর্শ করে বলল, ওই যে, ও আসছে, বিয়্যাম।
দীর্ঘাঙ্গিনী এক তরুণীকে দেখলাম। পেছনে ভূত্যস্থানীয় এক মহিলা। ছোট্ট একটা বাচ্চার হাত ধরে এগিয়ে আসছে তরুণী। কাঁধ থেকে নেমে এসেছে তুষার শুভ্র কুঁচি দেয়া ইন্ডিয়ান ধাচের ঝুল পোশাক। গলায় সোনার হার-তেহানিকে আমি যেটা দিয়েছিলাম।
তেহানি, আমার পাশ থেকে ডাকল তুয়াহু। মেয়েটা মুখ তুলল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল আমার। সাগরের মত গাঢ় নীল চোখ! মৃত মায়ের রূপ পুরোটাই সে পেয়েছে। সেই সাথে পেয়েছে আমার মায়ের সৌন্দর্যের খানিকটা। মাতাভাই-এর সেই ইংরেজ ক্যাপ্টেন, বলল তুয়াহু।
করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। আমার নাতনী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে এল আমার। তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম অন্য দিকে। আমার চোখের জল ওদের দেখতে দিতে চাই না।
এবার যাই আমরা, মামাকে বলল তেহানি। মেয়েকে কথা দিয়েছিলাম, নানার দেশের নৌকা দেখাব।
আচ্ছা, যা, জবাব দিল তুয়াহু।
জাহাজে ফেরার জন্যে যখন পানসিতে উঠলাম তখন রাত হয়ে গেছে। উজ্জ্বল চাঁদ উঠে এসেছে মাথার ওপর। উপত্যকার গভীর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে অনেক মানুষের ফিসফিসানির মত শব্দ তুলে। হঠাৎ আমার মনে হলো, প্রেতাত্মার দল ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-জীবিত এবং মৃত মানুষের ছায়ার মত-আমার নিজের ছায়াও আছে তাদের ভেতর।
***
<