এগারো

আজকাল বেশির ভাগ সময়ই মনটা ভার হয়ে থাকে নানা চিন্তায়। মায়ের কথাই বেশি মনে পড়ে। আমার তাইও হিটিহিটির বাড়িতে খুব যে কষ্টে আছি তা নয়, বরং উল্টোটাই। তবু মনে শান্তি নেই। বার বার ঘুরে ফিরে মনে হানা দেয় কথাটা-কি থেকে কি হয়ে গেল! মাঝে মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সন্দিহান হয়ে উঠি। মনে হয়, এমন কোন পাপ তো জীবনে করিনি যার জন্যে এত কঠিন শাস্তি আমাদের প্রাপ্য হবে।

এই সব মন ভার করা ভাবনা ভুলবার জন্যে একদিন বাক্স থেকে বের করলাম আমার পাণ্ডুলিপিটা। প্রথমে মন বসাতে কষ্ট হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই আবার ডুবে গেলাম কাজে।

.

বাউন্টি চলে যাওয়ার দিন দশেক পর এক শেষ রাতে হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই জেগে গেলাম আমি। আর ঘুম এল না। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর পয়েন্ট ভেনাস থেকে ঘুরে আসি, ভেবে বিছানা থেকে নেমে এলাম। সকাল হতে ঘন্টাখানেক বাকি আকাশে তখনও তারার মেলা। মৃদু উষ্ণ উত্তরে হাওয়া ভেসে আসছে বিষুবীয় অঞ্চল থেকে। দীর্ঘ ধনুকের মত বাঁকানো সৈকতের ওপর দিয়ে এগিয়ে চললাম আমি।

তাহিতির যে কটা জায়গা আমার প্রিয় তার ভেতর প্রিয়তম এই পয়েন্ট ভেনাস। এমনিতেই রোজ ভোরে আমি চলে আসি এখানে। সূর্যোদয় দেখি। আজ একটু আগে এসেছি এই যা। সরু নদীটা, যার নাম ভাইপুপু, যেখানে সাগরে মিশেছে সেখানে ছোট্ট এক টুকরো সৈকত। জায়গাটা এখন জনশূন্য দেখে ভাল লাগল আমার। উঁচু একটা বালিয়াড়ির ওপর উঠে বসলাম পুবমুখী হয়ে।

একটু পরেই ভোরের প্রথম আলোর রেখা দেখা দিল দিগন্তে। তারপর আস্তে আস্তে রাঙা হয়ে উঠতে লাগল পুবের আকাশ, সেই সাথে সাগর। দুচোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম আমি। সূর্য যখন পুরোপুরি উঠে এল দিগন্ত রেখার ওপরে তখন নেমে এলাম বালিয়াড়ি থেকে। ভাইপপুর পাড় ধরে এগিয়ে চললাম পয়েন্টের পশ্চিম দিকে যেখানে সাগরে মিশেছে নদীটা। মোহনার কাছেই নদীর একটা জায়গা অদ্ভুত শান্ত। স্রোত আছে কি নেই বোঝাই যায় না। অন্তত বিশ গজ চওড়া জায়গাটা। গভীরতা প্রায় দেড় মানুষ সমান। সাঁতার কাটার আদর্শ স্থান। লোকালয় থেকে দূরে এমন একটা নির্জন জায়গা পেয়ে আমি রীতিমত ভৗগ্যবান মনে করি নিজেকে। রোজ সকালে সূর্যোদয় দেখার পর এখানে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে, স্নান করে বাড়ি ফিরি।

গায়ের ইন্ডিয়ান আলখাল্লাটা খুলে রেখে আস্তে আস্তে নেমে পড়লাম নদীতে। দুহাতে নিঃশব্দে জল কেটে এগোলাম ভাটির দিকে। হঠাৎ অদ্ভুত অপরূপ এক দৃশ্য দেখে জমে গেলাম যেন আমি। প্রাচীন একটা গাছের নদীর দিকে বেরিয়ে আসা একটা মোটা শিকড়ের ওপর বসে আছে এক তরুণী। প্রথম দর্শনে মনে হলো জলদেবী বুঝি। নিশ্চয়ই কোন শব্দ করে ফেলেছিলাম, কারণ মুহূর্ত পরেই দেখি চমকে সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছে আমার দিকে। চমকে উঠলাম আমিও। এ সেই তেনি-চার্চিলদের ধরতে গিয়ে যার নাচ দেখেছিলাম টেতিয়ারোয়ায়। সংকোচ বা লজ্জার কোন চিহ্ন নেই চেহারায়। থাকার কথাও নয়। এখানকার সমাজে ওর মত মেয়েরা যে সম্মান বা মর্যাদা ভোগ করে তার তুলনা হয় না। বিরক্ত বা অপমান করেছে বলে কারও বিরুদ্ধে ও যদি অভিযোগ করে মৃত্যু ছাড়া আর কোন শাস্তি তাকে দেয়া হবে না। নিরাপত্তার এই নিশ্চয়তা আছে বলেই তেহানির মত মেয়েরা যখন যেখানে খুশি যাওয়া আসা করে নিঃসংকোচে।

চমক ভাঙতেই ইন্ডিয়ান রীতিতে আমি বললাম, বেঁচে থাকো অনেক দিন।

তুমিও! মৃদু হেসে জবাব দিল তেহানি। মি কে আমি জানি তুমি বিয়্যাম, হিটিহিটির তাইও, না?

হ্যাঁ। তুমি কে বলিতুমি তেহানি, পইনোর আত্মীয়। টেতিয়াবোয়ায় তোমার নাচ দেখেছিলাম।

এবার শব্দ করে হেসে উঠল মেয়েটা। সত্যিই আমাকে দেখেছিলে? কেমন লেগেছিল আমার নাচ।

এত সুন্দর!-জীবনে ভুলব না সে রাতের কথা!

আরেরো মোনা! হাসতে হাসতেই সে বলল। অর্থাৎ, গল্পবাজ।

এমন সুন্দর তুমি নেচেছিলে যে, আমি বলে চললাম, যেন ওর কথা আমার কানেই যায়নি, আমি হিটিহিটিকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হয়েছিলাম, ওই সুন্দরী মেয়েটা কে? ও আসলে মেয়ে না কি নাচের দেবী সশরীরে মর্ত্যে নেমে এসেছেন?

আরেরো মোনা! আবার বলল ও। বলল বটে কিন্তু গালের রক্তিমাভাটা লুকাতে পারল না। এসো-দেখি ডুব সাঁতারে কে বেশি দূর যেতে পারে, তুমি না আমি!

বলে আস্তে করে শিকড় থেকে ও পানিতে নেমে এল। আমার সোজাসুজি এসে বলল, ওই দিকে যাব। হ্যাঁ, এবার এক-দুইতিন।

ডুব দিলাম আমি। পানির এক ফ্যাদম মত নিচে দিয়ে সঁতরে চললাম তেহানির দেখানো দিকে। স্রোতের পক্ষে থাকায় বেশ দ্রুত এগোতে পারলাম। শেষে বাতাসের অভাবে ফুসফুস যখন ফেটে যেতে চাইছে, ভেসে উঠে ভুস করে দম নিলাম। পেছন ফিরে খোঁজ করছি তেহারি-কল্পনাও করতে পারিনি সাঁতারে আমার চেয়ে দক্ষ হতে পারে কোন মেয়ে। এই সময় সামনে থেকে ভেসে এল মধুর ঘন্টাধ্বরি মত রিনরিনে একটা হাসি। চমকে মুখ ঘোরাতেই দেখলাম আমার কমপক্ষে দশগজ সামনে জলের ভেতর নেমে আসা লম্বা একটা শিকড়ের ওপর বসে আছে সে।

তুমি এসে গেছ? হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

দেখতেই পাচ্ছ। ভেবো না আমি পানির ওপর দিয়ে এসেছি।

না, অতটা নীচ আমি নই যে তেহানিকে প্রবঞ্চক ভাবব। বললাম, ঠিক আছে, একটু জিরিয়ে নেই, তারপর আবার দেখব।

ওর পাশে শিকড়ের ফাঁকা অংশটার দিকে ইশারা করল তেহানি। এসো, এখানে বসে জিরও।

মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে চোখের ওপর থেকে ভেজা চুল সরাতে সরাতে আমি উঠে বসলাম ওর পাশে। চুপ করে আছি। তেহানিও চুপ। তারপর অনেকক্ষণ পর-কতক্ষণ কাতে পারব না-আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম ওর দিকে। কি আশ্চর্য! ঠিক একই মুহূর্তে ও-ও তাকিয়েছে আমার দিকে। ওর বাদামী চোখ দুটোয় হাসির ঝিলিক। হঠাৎ করেই মুখ ঘুরিয়ে নিল তেহানি। বুঝতে পারছি আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠছে। আমার পাশেই শিকড় আঁকড়ে আছে ওর হাত। আস্তে হাতটা তুলে নিলাম আমি।মুখ নিচু করে পানির দিকে তাকাল তেহানি।

তেহানি! আমি ডাকলাম। দুহাতে ধরলাম ওর হাতটা।

জবাব দিল না তেহানি। ধীরে ধীরে মুখ উঁচু করে ঘোরাল আমার দিকে। তারপর আমি বা ও কিছু টের পাওয়ার আগেই আমার বান্দ্র বাঁধনে ধরা পড়ল

ও।

বিয়্যাম, আমার কপাল থেকে ভেজা চুল সরিয়ে দিতে দিতে তেহানি বলল, ভোমার স্ত্রী নেই

না।

আমারও স্বামী নেই।

এই সময় ডাঙার ওদিক থেকে ভেসে এল নারীকন্ঠের চিৎকার: তেহানি! তেহানি ও!

তেহানিও চিৎকার করে জবাব দিল: আসি!

ও আমার দাসী। আমার সাথে এসেছে তাহিতিতে। নদীর মুখে ওকে দাঁড়াতে বলে আমি এসেছিলাম গোসল করতে।

টেতিয়ারোযা থেকে এসেছ তুমি?

না। আমি টাউতিরায় থাকি, চাচার সাথে। দুদিন দুরাত সাগর পাড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ আগে পৌঁছেছি এখানে।

তোমার চাচা কে?

অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল মেয়েটা। তুমি জানো না?

না।

আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারো, তারপরও! আশ্চর্য মানুষ তোমরা ইংরেজরা! আমার চাচা ভেহিয়াটুয়া, টাইয়ারাপুর মহা-গোত্রপতি।

হ্যাঁ নাম শুনেছি ওঁর।

তুমি কি তোমার দেশের কোন গোত্রপতি?

তা বলতে পারো, যদি ও খুব ছোট দরের।

যা ভেবেছি। তোমাকে প্রথমবার দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। সাধারণ কাউকে তাইও করবে না হিটিহিটি!

আবার আমরা চুপ। দুজনেই বুঝতে পারছি দুজনের মনের কথা।

তেহানি, কিছুক্ষণ পর আমি ডাকলাম।

হ্যাঁ।

মুখ তুলল ও। আমি ঠোঁট ছোঁয়ালাম ওর ঠোঁটে।

.

সাগর সঙ্গমে পৌঁছে দেখলাম, বৃদ্ধ ভেহিয়াটুয়া নাশতা করতে বসেছে। রুটিফল, ঝলসানো মাছ আর কল। ভাইঝির সাথে আমাকে দেখে একটুও অবাক হলো না সে।

তেহানি, সস্নেহে বলল বৃদ্ধ গোত্রপতি, কে রে তোরসঙ্গের লোকটা?

হিটিহিটির তাইও-ওর নাম বিয়্যাম।

আহ, বিয়্যাম! ওর কথা তো শুনেছি আমি। বলে আমার দিকে তাকাল ভেহিয়াটুয়া। বসো, খাও আমার সাথে। তেহানি, বড় ক্যানোয় তোর নাশতা তৈরি। যা খেয়ে নে।

ছোট একটা ক্যানো ভিড়ে ছিল সৈকতে। তাতে উঠে তীর থেকে কিছু দূরে ভেসে থাকা একটা বড় জোড়া ক্যানোয় চলে গেল তেহানি। আমি বসলাম ভেহিয়াটুয়ার পাশে। হিটিহিটি, বাউন্টি এবং আমার সঙ্গী, যারা তাহিতিতে থেকে গেছে তাদের সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করল সে। যথাসাধ্য আমি সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলাম বৃদ্ধকে।

তাহলে বন্ধুদের সাথে তাহিতিতেই থেকে যাচ্ছ তুমি? অবশেষে জিজ্ঞেস করল ভেহিয়াটুয়া।

আঁ…অন্তত কিছু দিনের জন্যে। রাজা জর্জ যদি জাহাজ পাঠিয়ে আমাদের দেশে ফেরার আদেশ দেন তাহলে না ফিরে পারব না।

তা ঠিক, বলল বৃদ্ধ গোত্রপতি, রাজার আদেশ তো মানতেই হবে।

একটু পরেই তেহনি ফিরে এল তীরে। শুধু নাশতা নয়, সামান্য প্রসাধনও করে এসেছে। তাতেই এতখানি বদলে গেছে ওর চেহারা যে চোখ ফেরানো যায় না। আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম। এই কি কিছুক্ষণ আগের সেই গেছো মেয়ে, যে আমাকে হারিয়ে দিয়েছে ডুব সাঁতারে? চমৎকার চুলগুলো রোদে শুকিয়ে আঁচড়ে নিয়েছে, সামান্য সুগন্ধিও বোধহয় লাগিয়েছে। গ্রীসীয় ঢংয়ে ছাঁটা তুষার শুভ্র একটা কুঁচিওয়ালা বুল পোশাক পরেছে। ছোট একদল মহিলার সামনে থেকে ও যখন মাথা উঁচু করে এগিয়ে এল, আমার মনে হলো সত্যিই রাজকন্যা আসছে। আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল বৃদ্ধ গোত্রপতি।

চলো এবার, আমার কুটুম্বের বাড়িতে যাই, বলল সে।

বিশালদেহী এক লোক হাঁটু গেড়ে পেছন ফিরে বসল ভেহিয়াটুয়ার সামনে। অনায়াস ভঙ্গিতে তার কাঁধে চড়ে বসল গোত্রপতি। বিশালদেহী লোকটা এবার উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল। ভেহিয়াটুয়া, টেইনা এবং আরও দুতিন জন মহা-গোত্ৰপতি এভাবেই চলাফেরা করে। কারণ তাদের অধিকার এত ব্যাপক যে যেখানে তাদের পা পড়ে সে জায়গা, তাদের নিজের সম্পত্তি হয়ে যায়। তাই সাধারণ প্রজাদের জমিজমা রক্ষা করার জন্যে এই ব্যবস্থা।

তেহানিকে পাশে নিয়ে তার চাচার পেছন পেছন এগোলাম আমি।

ভেহিয়াটুয়ার কুটুম্ব আর কেউ নয়, আমার তাইও হিটিহিটি। ব্যস্ত সমস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে সে অভ্যর্থনা জানাল কুটুম্বকে। রাজসিক খাওয়া দাওয়ার আয়োজন শুরু হলো সঙ্গে সঙ্গে। আগে থাকতেই জানাশোনা আছে তেহানি আর হিনার। কলকণ্ঠে গল্প শুরু করল দুজন। ওদের আলাপ না শুনতে পেলেও হিনা বার বার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে দেখে ধারণা করলাম, সকালে নদীতে আমাদের সাক্ষাতের কথা বলছে তেহানি।

দুপুরের পর সবাই কোন গাছ বা চালার ছায়ার আশ্রয় নিল ঘুমাবে বলে। আমার অবস্থা ঘুমানোর মত নয়। তেহানির কথা ভাবতে ভাবতে সকতের দিকে চললাম। সৈকতের কাছেই একটা হিবিসকাস গাছে গয়ায় দেখলাম

আমার তাইওকে। জেগেই আছে। পাশে গিয়ে বসলাম আমি।

ঘুমাওনি, বিয়্যাম? একটু যেন অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করা হিটিহিটি।

ঘুম আসছে না।

কেন?

তেহানির সাথে আমার সাক্ষাতের কথা বললাম হিটিহিটিকে। তাতে কি হয়েছে? প্রশ্ন করল হিটিহিটি।

আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আমি বললাম। আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি, হিটিহিটি।

ভাল, এখন যদি ও রাজি হয় বিয়ে করে ফেল।

আমার মনে হয় ও রাজি হবে, কিন্তু ওর বাপ মা…

বাপ মা নেই ওর। দুজনই মরে গেছে।

তাহলে ভেহিয়াটুয়া?

ও তোমাকে পছন্দ করে। আমার মনে হয় না ও অমত করবে।

ভাল। ধরো আমাদের বিয়ে হলো, তারপর আমার দেশ থেকে একটা জাহাজ এসে জানাল, আমাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন রাজা জর্জ!

হতাশ ভঙ্গিতে প্রশস্ত কাঁধ দুটোয় একটু ঝাঁকুনি দিল হিটিহিটি। তোমরা ইংরেজরা সব এক রকম। যা হয়তো কখনোই ঘটবে না তা নিয়ে ভেবে জীবন দুর্বিসহ করে তোল। আজই কি যথেষ্ট নয় যে কাল বা পরশু নিয়ে মাথা ঘামাও? একটা জাহাজ হয়তো কোন দিন আসবে, এই ভেবে তুমি তোমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে না। সে জাহাজ আসতে আসতে হয়তো দশ বা বিশ বছর পেরিয়ে যাবে! যত্তসব শোনো, বিয়্যাম, গতকাল গত হয়ে গেছে, আজ আছে হাতে, আগামী কাল হয়তো কোনদিনই আসবে না তোমার জীবনে।

বৃদ্ধ বন্ধুর দার্শনিক কথা শুনে হাসলাম, যদিও, তবে একটু ভাবতেই বুঝলাম, ও ঠিকই বলেছে।

তুমি আমার তাইও, অবশেষে আমি বললাম, এদেশে তো আমার আপন কেউ নেই, আমার হয়ে ভেহিয়াটুয়ার সাথে কথা বলবে তুমি? বলবে ওর ভাস্তিকে আমি ভালবাসি, বিয়ে করতে চাই।

বলব মানে! একশো বার বলব। উৎফুল্ল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল হিটিহিটি। অনেক দিন হলো স্ত্রী ছাড়া আছ তুমি! এবার ভাগো, আমাকে ঘুমাতে দাও।

.

কারও ঘুম ভাঙার আগেই হোনি উঠে হাঁটতে হাঁটতে সৈকতে এল। আমাকে দেখেই চঞ্চলা হরিণী হয়ে উঠল যেন। ছুটে এল কাছে।

আমার তাইওর সাথে আলাপ করলাম, তেহানি, আমি বললাম। আমার বিদ্রোহ পক্ষ থেকে ও তোমার চাচার কাছে প্রস্তাব রাখবে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। ভুল হচ্ছে না তো আমার?

আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তেহানি বলল, ঘুমাতে যাওয়ার আগে চাচাকে আমি বলেছি, আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে চাই। চাচা জিজ্ঞেস করছিল, তুমি আমাকে চাও কি না। আমি বলেছি, তুমি চাও না চাও তোমাকে আমার পেতেই হবে। চাচা তখন বলল, তুই কি চাস বিয়্যামকে অপহরণ করে ওর তাই ওর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি আমি? আমি বলেছি, হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে করতে হবে যুদ্ধ! চাচা তখন সস্নেহে আমাকে বলেছে, তোর মা মারা যাওয়ার পর থেকে কোন চাওয়া তোর আমি অপূর্ণ রেখেছি রে, ছোট্ট পায়রা? তোর এই বিয়্যাম বিদেশী, তবু সে তো পুরুষ। কোন পুরুষই তোর ইচ্ছার কাছে মাথা না নুইয়ে পারবে না! বলো, চাচা কি ঠিক বলেছে?

হ্যাঁ আমার মনে হয় ঠিকই বলেছে, ওর হা দুটো আমার হাতে তুলে নিয়ে বললাম।

হাত ধরাধরি করে আমরা যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ভেহিয়াটুয়া বলল, এই যে বা এসে গেছে।

দুজনকেই একটু বা খুশি খুশি লাগছে, মৃদু হেসে মন্তব্য করল আমার তাইও তারপর আমাকে বলল, তেহিয়াটুয়া রাজ, তবে একটা শর্তে, বিয়ের পর তোমাকে ওর সঙ্গে টাউতিরায় থাকতে হবে। ভাস্তিকে কিছুতেই ও চোখের আড়াল করতে পারবে না। আমার মনে হয় না তাতে খুব একটা অসুবিধা হবে তোমার, মাঝে মাঝে এসে বেড়িয়ে যাবে আমাদের…

আর শোনার জন্যে দাঁড়ালাম না আমি ছুটে ঘরের ভেতর গিয়ে আমার বাক্স খুলে বের করে অনলাম সেই হারটা–ইন্ডিয়ানদের ভেতর যদি মনের মানুষ পেয়ে যাই দেব বলে যেটা এনেছিলাম। ভেহিয়াটুয়ার হাতে ওটা তুলে দিয়ে বললাম, তেহানির জন্যে আমার উপহার।

হুঁ, খুশি হবে ও, বলল ভেহিয়াটুয়া। এ অঞ্চলে আর কোন মেয়ের এমন জিনিস নেই। সত্যিই রাজসিক উপহার। এবার বলো তো, বিয়্যাম, তোমাকে আমরা কি দেই?

এটা? তেহানির কাঁধ ধরে আমি বললাম!

ভাল বলেছ, হেসে বলল মহা-গোত্রপতি। সত্যিই রাজসিক উপহার। ভাল করে দেখ তো, এখানকার কোন দ্বীপে ওর জুড়ি খুঁজে পাবে?

.

পরদিনই আমি ভেহিয়াটুয়ার সাথে তল্পিতল্পাসমেত চলে এলাম টেতিয়ারোয়ায়। হিটিহিটি ও তার মেয়ে এল পরদিন। তার পরদিন শুরু হলো তেহানির সাথে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানাদি।

প্রথমেই সাগর তীরে মক্কার একটা নতুন বাড়ি আমাকে উপহার দিল ভেহিয়াটুয়া। ওর নিজের বাড়ি থেকে সেটার দূরত্ব খুব বেশি হলে এক কেবল (১ কেবল=১০০ ফ্যাদম বা ৬০০ ফুট বা ১/১০ নটিক্যাল মাইল)। সেই দিনই আমি আমার নতুন বাড়িতে উঠে গেলাম হিটিহিটি, হিনা, হিনার স্বামী আর ওদের সাথে তাহিতি থেকে যারা এসেছে তাদের সবাইকে নিয়ে। পরদিন ভোরে সদলবলে ভেহিয়াটুয়ার বাড়ির পথে রওনা হলাম আমরা, সঙ্গে বিপুল পরিমাণ উপহার সামগ্রী। আনুষ্ঠানিক ভাবে ওগুলো গ্রহণ করল ভেহিয়াটুয়ার পরিবার। এরপর দুই পরিবারের সদস্যরা যৌথভাবে মিছিল করে এল আমার বাড়িতে। মিছিলের পেছনে এল ভূত্যের দল, কনের বাপের বাড়ি থেকে দেয়া উপহার সামগ্রী নিয়ে। সেসব উপহারের ভেতর আছে গৃহপালিত জন্তু থেকে শুরু করে কাপড়, মাদুর, আসবাবপত্র-মোট কথা নতুন একটা সংসার শুরু করতে যা যা লাগে সর।

ঘরে ফিরে হিনা-যে এখন আমার পরিবারের কর্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছে-বিরাট একটা নতুন মাদুর বিছিয়ে দিল। তার ওপর পাতা হলো নতুন একটা সাদা চাদর। ভেহিয়াটুয়ার স্ত্রী নেই। তার বড় বোন টেতুয়ানুই পালন করছে তার পরিবারের কর্ত্রীর দায়িত্ব। টেতুয়ানুই হিনার চাদরটার ওপর বিছিয়ে দিল আর একটা চাদর।

এবার আমাকে আর তেহানিকে পাশাপাশি বসতে বলা হলো চাদরগুলোর ওপর। বসলাম আমরা। আমাদের ডানে বয়ে এনে রাখা হতে লাগল উপহার। দেখতে দেখতে পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে উঠল গৃহস্থালি জিনিসপত্রের স্তূপ। আনুষ্ঠানিক ভাবে উপহারগুলো গ্রহণ করলাম আমি আর তেহানি।

এরপর হিনা আর টেয়ানুই একটা করে পাওনিহো চাইল। পাওনিহো এক ধরনের ছড়ি। লোহাকাঠের তৈরি। মসৃণ, খাটো, মাথায় তীক্ষ্ণধার হাঙ্গরের দাঁত লাগানো। প্রতিটা ইন্ডিয়ান রমণীর এ ধরনের পাওনিহো আছে। শোক করার সময় ওগুলো দিয়ে মাথায় আঘাত করে রক্ত ঝরায় ওরা।

বিয়ে শোকের অনুষ্ঠান না হলেও হিা আর টেতুয়ানুই পাওনিহোর আঘাতে কেটে ফেলল কপাল। এমন আচমকা কাজটা করে বসল ওরা, বাধা দেয়ার কোন সুযোগই আমি পেলাম না। পুরোহিত তাওমি এবার দুহাতে ওদের দুজনকে ধরে ধীর পায়ে ঘুরতে লাগল আমাদের চারপাশে। দুই পরিবারের দুই কর্ত্রীর মাথা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ে ভিজে উঠতে লাগল টেয়ানুই এর বিছানো কাপড়। কিছুক্ষণ পর শেষ হলো অনুষ্ঠানের এ পর্যায়। আমাকে আর তেহানিকে উঠতে বলা হলো। দুই পরিবারের রক্তে রাঙা কাপড়টা উঠিয়ে ভাঁজ করে রেখে দেয়া হলো সযত্নে।

এরপর আবার মিছিল করে কনের বাড়িতে যাওয়া। একই অনুষ্ঠান-এমন কি চাদর রক্তে রাঙানো এবং ভাজ করে উঠিয়ে রাখা পর্যন্ত আবার অনুষ্ঠিত হলো। তারপর শুরু হলো ভোজ। মেয়েরা এক দিকে ছেলেরা অন্যদিকে। বিকেল পর্যন্ত চলল খাওয়া দাওয়া।

বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি শেষ। এখন বাকি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ভেহিয়াটুয়ার পারিবারিক মারাএ অর্থাৎ মন্দিরে হবে এ অনুষ্ঠান। বৃদ্ধ তাওমির, নেতৃত্বে ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে মিছিল করে মন্দিরে পৌঁছুলাম আমরা।

বিশাল এক অশ্বথ গাছের নিচে দেয়াল ঘেরা এক জায়গায় মন্দিরটা। মেঝে বাধানো পাথর দিয়ে। এক পাশে একটা পিরামিড; ত্রিশ গজ মত লম্বা, চওড়া বিশ গজ, চার ধাপে উঠে গেছে প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচুতে। ওটার চূড়ায় কাঠ খোদাই করে বানানো অদ্ভুত এক পাখির প্রতিমা।

হিটিহিটি আর হিনার সঙ্গে আমাকে নিয়ে অনিয়া হলো ঘেরা জায়গার এক কোনায়। তেহানি, ভেহিয়াটুয়া আর ওদের অন্য আত্মীয় স্বজন রইল আমাদের সামনে, ঘেরা জায়গার অন্যপাশে। বৃদ্ধ পুরোহিত এবার আমার কাছে এসে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল:

এই নারীকে তুমি স্ত্রী হিসেবে চেয়েছ; ওর জন্যে তোমার যে ভালবাসা কোন দিন তা শীতল হবে না তো?

না, আমি জবাব দিলাম।

ধীরপায়ে হেঁটে এরপর তেহানির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তাওমি। একই প্রশ্ন করল ওকে। জবাবও পেল এক। এবার সে ইশারা করল অন্যদের উদ্দেশ্যে। মারাএর দুপ্রান্ত থেকে তারা এগিয়ে এল দুই পরিবারের রক্ত মাখা চাদর দুটো নিয়ে। বিছিয়ে দিল। এরপর এগিয়ে এল নিচু পদমর্যাদার কয়েকজন পুরোহিত। প্রত্যেকের হাতে একটা করে মড়ার খুলি। বিয়ের নীরব সাক্ষী। ভেহিয়াটুয়ার পরিবারের পূর্বপুরুষদের খুলি ওগুলো। পাহাড় চুড়ার পবিত্র গুহায় সংরক্ষিত থাকে খুলিগুলো। বিয়ে বা খুলি প্রয়োজন হয় এমন কোন অনুষ্ঠানের আগে পাহাড় থেকে আনিয়ে নেয়া হয়। অনুষ্ঠান শেষে আবার রেখে আসা হয়। যেখানকার জিনিস সেখানে।

রক্তমাখা কাপড়গুলোর ওপর আমাকে আর তেহানিকে বসতে বলা হলো। হাত ধরাধরি করে। আমাদের দুই পরিবারের অন্য সদসারা বসল দুপাশে। এরপর প্রধান পুরোহিত একে একে অতীতের নামকরা সব গোত্রপতি এবং বীরদের পূর্ণ নাম, পদবী আউড়ে আহ্বান করতে লাগল বিয়েতে সাক্ষী থেকে আশীর্বাদ করার জন্যে। অনেকক্ষণ পর ক্লান্তিকর ব্যাপারটা শেষ করে আমার দিকে ফিরল তাওমি।

এই নারী কিছুক্ষণের ভেতর তোমার স্ত্রী হবে, গম্ভীরকণ্ঠে সে বলল। মনে রেখো, ও নারী, দুর্বল। সাধারণ মানুষ ক্রোধের বশে স্ত্রীকে আঘাত করতে পারে, গোত্রপতিদের তা সাজে না। ওর সাথে সদয় ব্যবহার করবে, মানিয়ে চলবে। থামল তাওমি। তারপর তেহানির দিকে ফিরে বলে চলল, এই পুরুষ কিছুক্ষণের ভেতর তোমার স্বামী হবে। মনে রাখবে, ক্রোধের সময় জিহ্বাকে সংযত করা, ধৈর্য ধরা তোমার কর্তব্য হবে। ওর মঙ্গলের দিকে নজর রাখবে, অসুস্থ হলে সেবা করবে, যুদ্ধে আহত হলে ক্ষত সারিয়ে তুলবে। প্রেমই বিবাহের খাদ্য। তোমাদের বিবাহকে অভুক্ত রেখো না। একটু থেমে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার সে বলল, এ মাইতাই ইয়া মাই তে মেআ রা এ এ না রেইবা ওরুআ অর্থাৎ, এভাবে যদি তোমরা চলো, তোমাদের মঙ্গল হবে।

কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম, আমার হাতের ভেতর কেঁপে উঠল তেহানির হাত। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, ওর চোখে জল। গভীর নিস্তব্ধতা মন্দিরে। ভেহিয়াটুয়ার গৃহদেবতা তাওরার উদ্দেশ্যে আমাদের মঙ্গল কামনা করে দীর্ঘ প্রার্থনা করল পুরোহিত। তারপর বলল, তাপোইটা নিয়ে এসো!

তাপোই হচ্ছে পুরুষদের তৈরি বাদামী রঙের এক ধরনের কাপড়। এই কাপড়কে পবিত্র বলে গণ্য করা হয় ইন্ডিয়ান সমাজে।

মন্দিরের পেছন থেকে বিরাট কাপড়টা নিয়ে এল এক মন্দির রক্ষক। পুরোহিত সেটা দুহাতে ধরে মেলে নিল প্রথমে। তারপর আচমক ছুঁড়ে দিল আমাদের ওপর। আমি আর তেহানি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেলাম ওটার নিচে। এক মুহূর্ত পরেই সরিয়ে নেয়া হলো তাপোই। উঠে দাঁড়াতে বলা হলো আমাদের। বিয়ে শেষ। আমি আর তেহানি এখন বর ও বধূ। দুই পরিবারের সদস্যরা একে একে এগিয়ে এসে ইন্ডিয়ান রীতিতে আলিঙ্গন করতে লাগল আমাদের।

.

বারো

বিয়ের এক মাস পর তেহানি আর আমি বেড়াতে এলাম আমার তাইওর বাড়িতে। বুড়ো হিটিহিটিকে, সেই সাথে স্টুয়ার্ট, মরিসন এবং বাউন্টির অন্য নাবিক বন্ধুদের দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম মনেমনে।

মরিসন আর মিলওয়ার্ড সেই নামকরা যোদ্ধা পইনোর বাড়িতে থাকে এখন। স্টুয়ার্ট পেগিকে বিয়ে করেছে। পেগির বাবা টিপাউ-এর বাড়িতেই আছে ওরা। অন্যরাও যার যার সুবিধা ও সুযোগ মত থাকার জায়গা ঠিক করে নিয়েছে।

দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছুলাম হিটিহিটির বাড়িতে।

তোমার বন্ধুরা জাহাজ তৈরি করছে, খাওয়ার সময় হিটিহিটি জানাল। মরিসন আর মিলওয়ার্ড তদারক করছে কাজ। তলী বসানো হয়ে গেছে, এখন ওরা খোল জুড়ছে।

আমি খুব একটা অবাক হলাম না, মরিসন আগেই জানিয়েছিল ছুতোর মিস্ত্রীর দুই সহকারীকে নিয়ে জাহাজ অর্থাৎ বড়সড়, সাগরপাড়ি দেয়ার উপযোগী নৌকা বানানোর চেষ্টা সে করবে! আমার যা হলো, তা কৌতূহল। দিবানিদ্রা শেষ করে হাঁটতে হাঁটুতে আমরা গেলাম সেখানে, যেখানে জাহাজ তৈরি হচ্ছে–হিনা, ওর বাবা, তেহানি আর আমি।

সৈকত থেকে শখানেক গজ দূরে এক টুকরো ঘাসে ছাওয়া জমি পছন্দ করেছে মরিসন একাজের জন্যে। জমিটার মালিক মহা-গোত্রপতি টেইনা। একদল ইন্ডিয়ান বসে বসে দেখছে সাদা মানুষদের কাজ। গভীর কৌতূহল ওদের চোখে মুখে। আমরা যখন পৌঁছুলাম তখন, টেইনা স্বয়ং তার স্ত্রী ইটিয়াকে নিয়ে উপস্থিত সেখানে। সহৃদয়তার সাথে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল ওরা। আমার ওপর চোখ পড়তেই হাতের কাজ ফেলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এল মরিসন।

তোমার বিয়ের খবর শুনেছি, আমার সাথে করমর্দন করতে করতে সে বলল। কামনা করি, তোমরা সুখী হও।

তেহানির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওর। এই সময় লাফাতে লাফাতে এল ছোকরা টম এলিসন। কেমন দেখলেন আমাদের জাহাজ, মিস্টার বিয়্যাম? জিজ্ঞেস করল সে। মাত্র ত্রিশ ফুট লম্বা যদিও, তবু মিস্টার মরিসন আশা করছেন ওতে চড়ে আমরা বাতাভিয়ায় পৌঁছুতে পারব।

আমিও তাই আশা করি, একটু হেসে আমি বললাম।

জাহাজ বানানোর কাজে অন্য যারা অংশ নিচ্ছে তাদের সাথে কুশল বিনিময় হলো এরপর। বাউন্টির আর্মারার কোলম্যান, ছুতোর মিস্ত্রীর দুই সহকারী নরম্যান আর ম্যাকইন্টশ, খালাসী হিল্যান্ডট, ডিক স্কিনার-সবার সাথেই কিছু না কিছু আলাপ করলাম। একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম, এরা সবাই কাজ করছে প্রাণের তাগিদে। কেউ কেউ সত্যি সত্যি ইংল্যান্ডে ফিরতে চায় বলে, বাকিরা ইংল্যান্ড থেকে আরেকটা জাহাজ এসে পড়ার আগেই এই ছোট্ট জাহাজে উঠে পাল তুলে দিতে না পারলে কি পরিণতি হবে তা ভেবে।

আন্তরিক ভাবে ওদের কাজের সাফল্য কামনা করে বিদায় নিলাম আমরা। তারপর গেলাম স্টুয়ার্টের বাড়িতে। আমরা যখন পৌঁছুলাম ও তখন শ্বশুরের বাগানে কাজ করছে। আমাদের দেখেই কাজ ফেলে উঠে এল স্টুয়ার্ট, চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে লাগল পেগিকে। তেহানির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম ওদের।

রাতে আমাদের এখানে খাচ্ছ তোমরা, ঘোষণা করল স্টুয়ার্ট। খুশি মনেই আমরা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। মরিসন আর এলিসন এসেছে আমাদের সাথে। ওদেরও খেয়ে যেতে বলল স্টুয়ার্ট।

কতদিন লাগবে তোমাদের জাহাজ তৈরি শেষ হতে? খেতে খেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম মরিসনকে।

আরও ছমাস তো লাগবেই, বেশিও লাগতে পারে। যন্ত্রপাতি এত কম, দ্রুত কাজ করতে পারছি না।

ওতে চড়ে বাতাভিয়ায় পৌঁছানোর আশা করো তুমি?

হ্যাঁ। বাতাভিয়ায় একবার পৌঁছুতে পারলে হয়, কোন ডাচ জাহাজে জায়গা পেয়ে যাব নিশ্চয়ই। আমরা পাঁচজন যাব-নরম্যান, ম্যাকইশ, মুস্যাট, বায়ার্ন আর আমি। স্টুয়ার্ট আর কোলম্যান এখানেই থাকতে চায় যতদিন না ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ আসে।

আমারও তাই ইচ্ছা, আমি বললাম। টাউতিরায় ভালই আছি। মন দিয়ে অভিধানের কাজ করতে পারছি।

আমার কথা যদি জিজ্ঞেস করো, স্টুয়ার্ট বলল, বাস করার জায়গা হিসেবে মন্দ নয় তাহিতি। এ জায়গা ছেড়ে জবে মরার কোন ইচ্ছা আমার নেই।

ডুবে মরা না আরও কিছু! মরিসন বলল। আমাদের এই ছোট্ট স্কুনার সারা দুনিয়া ঘুরে আসতে পারবে, দেখো!

আমাদের কথা তো বললেন না মিস্টার বিয়্যামকে, বলে উঠল এলিসন। ছোট একটা রাজ্য গড়ে তুলতে যাচ্ছি আমরা। মিস্টার মরিসন, কথা দিয়েছেন এখানকার পশ্চিমে কোন দ্বীপে আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাবেন।

হ্যাঁ, মরিসন বলল, সেটাই সবচেয়ে ভাল হবে ওদের জন্যে। শান্ত, নিরীহ লোকজন বাস করে এরকম একটা দ্বীপ ওদের খুঁজে দেয়ার চেষ্টা করব।

ওদের মানে, বিদ্রোহীদের? সবাই নাকি? জিজ্ঞেস করলাম।

সবাই না। টম ছাড়া, মিলওয়ার্ড, বারকিট, হিব্রান্ডট আর সামনার যাবে। চার্চিল স্কিনার এখানেই থেকে যাবে ঠিক করেছে।

আর থম্পসন?

ওর কথা বোলো না, একটা জানোয়ার। যা ইচ্ছা হয় করবে, আমার জাহাজে ওর জায়গা হবে না।

মানে?

মানে এখানে যদি কদিন থাকে নিজেই টের পাবে।

পরদিনই টের পেলাম।

.

ভোরবেলা সৈকতে গেছি সাগরে স্নান করব বলে। ডাঙায় তোলা একটা ক্যানোর পাশে দেখলাম ওকে। সঙ্গে আছে চার্চিল। বাচ্চা একটা শুয়োর আগুনে ঝলসাচ্ছে, নাশতা করবে বলে। আমাকে দেখেই খুশি হয়ে উঠল চার্চিল। আন্তরিক গলায় বলল, এসো, বিয়্যাম, নাশতা করো আমাদের সাথে।

তুমি একটা উজবুক, চার্চিল! গর্জে উঠল থম্পসন। নিজেদেরই হয় না, এর ভেতর আবার ডাকছ বদমাশটাকে!

মুহূর্তে আগুন হয়ে উঠল চার্চিল। তুমি-তুমি একটা নরকের কীট! বলল সে। মিস্টার বিয়্যাম আমার বন্ধু। যাও ওই আধা সভ্য ইন্ডিয়ানগুলোর কাছে শিখে এসো, বন্ধুর সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়!

আর একটা কথাও না বলে থম্পসন উঠে একটা বালিয়াড়ির ওপর গিয়ে বসল। দুহটুর মাঝখানে খাড়া করে রাখল মাস্কেট।

এমনিতে আমার নাশতা করার সময় এখনও হয়নি তার ওপর যে ঘটনা ঘটে গেল তাতে ওদের খাবারে ভাগ বসাবার প্রশ্নই ওঠে না। চার্চিলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি দশ বারো জন লোক বড়সড় একটা পালতোলা ক্যানো ডাঙায় টেনে তুলছে। ক্যানোর মালিক ও তার স্ত্রী এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে। লোকটার কোলে তিন চার বছরের একটা বাচ্চা। চার্চিল আর থম্পসনের ক্যানোটার কাছে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। মহিলা কৌতূহলী হয়ে একটু কুঁকল সাদা মানুষদের ক্যানোয় কি আছে দেখার জন্যে। অমনি শোনা হেলি থম্পসনের কর্কশ চিৎকার;

সরো! সরো ওখান থেকে!

বিনীত ভঙ্গিতে মুখ তুলল ইন্ডিয়ান দম্পতি। থম্পসনের ইংরেজি কথার কিছুই বুঝতে পারেনি ওরা।

সরে যা ওখান থেকে, গর্দভের দল! আবার চেঁচাল থম্পসন, এবং এবারও ইংরেজিতে।

অসহায়, একটু বিস্মিত চেহারা হলো ইন্ডিয়ান দম্পতির। কি করবে বুঝতে পারছে না। চার্চিল মাত্র মুখ খুলেছে ওদের বুঝিয়ে বলার জন্যে, এই সময় আচমকা মাস্কেট তুলে গুলি করে বসল থম্পসন। বাচ্চা এবং তার বাবার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল শুলি। দুজনই লুটিয়ে পড়ল বালুকাবেলায়। লাল হয়ে উঠল মাটি। বাচ্চার মা আর্তনাদ করে উঠল প্রাণ কাঁপানো স্বরে। চারপাশ থেকে মানুষজন ছুটে আসতে লাগল আমাদের দিকে।

লাফ দিয়ে উঠে থম্পসনের কাছে ছুটল চার্চিল। এক ঘুষিতে খুনীটাকে শুইয়ে ফেলল মাটিতে। মাস্কেট কেড়ে নিল। তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে সেটার নল দিয়ে। এরপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে থম্পসনের জ্ঞানহীন দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটে গেল নিজেদের ক্যানোর দিকে! খোলের ভেতর থম্পসনকে নামিয়ে রেখে ক্যানোটাকে টেনে নামিয়ে ফেলল সাগরে। কেউ কি ঘুটছে ভাল করে বোঝার আগেই সে পাল তুলে দিল। কিছুক্ষণের ভেতর পশ্চিম দিকে হারিয়ে গেল ক্যানোটা।

মৃত্যু পথযাত্রী বাবা ও বাচ্চার কাছে ছুটে গেলাম আমি। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তখন। মৃত্যুর কোলে আশ্রয় পেয়েছে দুজনই। ততক্ষণে দলে দলে ইন্ডিয়ান জড়ো হতে শুরু করেছে সাগর অরে। মৃতদেহ দুটো দেখে ভয়ানক হয়ে উঠেছে তাদের চেহারা। কয়েকজন হাতে তুলে নিয়েছে পাথরের টুকরো, কারও কারও হাতে লাঠি। দুতিন জন ছুটে এসে ধরে ফেলল আমাকে। এই সময় যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হলো হিটিহিটি।

ও আমার তাইও! গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল, ছেড়ে দাও ওকে! ও কোন অপরাধ করেনি। তোমরা মেয়ে মানুষের মত জটলা করছ কেন এখানে? হাতে অস্ত্র আছে, ক্যানো ভাসিয়ে ধাওয়া করে ধরো না খুনীদের! যে খুন করেছে, তাকে আমি চিনি, কোন ইংরেজ ওকে বাঁচানোর জন্যে হাত তুলবে না!

এতক্ষণে যেন লোকগুলো বুঝতে পারল কি করতে হবে। ক্যানো ভাসিয়ে ছুটল ওর চার্চিল ও থম্পসনের পেছন পেছন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে চার্চিলের ক্যানো। প্রাণপণ চেষ্টা করেও ধরতে পারল না ওরা।

পনেরো দিন পর এই ঘটনার সমাপ্তি টানল নিয়তি।

আমি আর তেহানি টাউতিরায় ফিরে দেখি চার্চিল আর থম্পসন হাজির সেখানে। তাহিতিতে ফিরে যাওয়ার সাহস পায়নি ওরা। তাইয়ারাপুতে কয়েকদিন কাটিয়ে তাই চলে এসেছে টাউতিরিয়ায়। ভেহিয়াটুয়া আমার বন্ধু ভেবে মোটামুটি সাদরেই গ্রহণ করেছে ওদের। ইতোমধ্যে থম্পসনের ওপর চরম বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেছে চার্চিলের মন। এককালে লোকটা ওর সাথী, ছিল, ভেবে ও ওকে না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে।

আমরা যেদিন পৌঁছুলাম সেদিনই চার্চিল এল আমাদের বাড়িতে। হাতে মাঙ্কেট। অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর থম্পসনের প্রসঙ্গ উঠতেই ও বলল, বদমাশটাকে খুন করার কথা ভেবেছি বহুবার। প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছি। ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে খুন করি কি করে, তুমিই বলো! এখন আফসোস হয়, কেন যে সেদিন ওকে বাঁচাতে গেলাম ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে!

হুঁ। না হলে সেদিনই ওর দফা রফা হয়ে গিয়েছিল, আমি বললাম।

খুবই ভাল কাজ হত একটা! একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি আমি। আজ ওকে বলে দিয়েছি, ক্যানোটা নিয়ে যেখানে খুশি চলে যাক, আর যেন এখানে না ফেরে।

শোনো, তুমি আর ওকে নিয়ে মাথা ঘামিও না, ইন্ডিয়ানরাই যা করার করবে। তুমি সঙ্গে না থাকলে এতদিন কবে ওকে সাবড়ে দিত!

জানি। তুমি একটু সাবধানে থেকো, বিয়্যাম। আমার ধারণা ও উন্মাদ হয়ে গেছে; কখন কি করে বসে ঠিক নেই। তোমার কাছে তো একটা মাস্কেট আছে, তাই না? সব সময় ওতে গুলি ভরে রেখো। যতদিন না বদমাশটা এখন থেকে যাচ্ছে ততদিন একটু সতর্ক থাকাই ভাল।

সেদিনই রাতে। আমার বন্ধুদের সম্মানে এক হেইভার আয়োজন করেছে আমার চাচাশ্বশুর। হেইভা মানে অনেকদিন আগে টেতিয়ারোয়ায় যে অনুষ্ঠানে তেহানিকে-নাচতে দেখেছিলাম সে ধরনের অনুষ্ঠান। এক পাশে তেহানি অন্য পাশে চার্চিলকে নিয়ে সবুজ ঘাসের গালিচায় বসেছি আমি। ঢাকের আওয়াজ সবে শুরু হয়েছে কি হয়নি অমনি ইন্ডিয়ান ভাষায় পেছন থেকে কয়েকজনের চিৎকার শুনতে পেলাম, দেখো! দেখো! সাবধান! তারপরই গুলির শব্দ। চার্চিল লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল। কিন্তু তার আগেই গলা দিয়ে কাশির মত একটা আওয়াজ করে লুটিয়ে পড়ল আমার পাশে। মাস্কেটটা খসে পড়ল ওর হাত থেকে।

নারী কন্ঠে তীক্ষ্ণ চিৎকার, আর পুরুষদের হাঁকডাকে ভরে গেল জায়গাটা। সব শব্দ ছাপিয়ে ভেহিয়াটুয়ার গলা শুনতে পেলাম: এই! মারো ওকে! মারো ওকে! মশালের আলোয় দেখলাম মাস্কেট হাতে ছুটে সৈকতের দিকে পালাচ্ছে থম্পসন। দর্শকদের ভেতর ছিল আতুয়ানুই নামের এক দুর্ধর্ষ বীর। বিরাট একটা পাথর দুহাতে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল সে আততায়ীকে লক্ষ্য করে। থম্পসনের দুকাঁধের মাঝখানে লাগল সেটা। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল থম্পসন। পর মুহূর্তে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আতয়ানুই। সেই পাথরটাই আবার তুলে নিয়ে আঘাত করে চলল একের পর এক। খুলি ফেটে ঘিলু বেরিয়ে এল থম্পসনের।

তেহানির হাত ধরে আমি যখন বাড়ি ফিরছি, তখন চার্চিলও আর বেঁচে নেই।

.

সতেরোশো নব্বই সালের ১৫ আগস্ট আমাদের মেয়ে হেলেন-এর জন্ম হলো। দীর্ঘ পদবীসহ তেহানির নামে নাম রাখা হলো তার। আমি আমার মত করেও একটা নাম রাখলাম-আমার মায়ের নামে। নিজের মেয়ে বলে বলছি না, সত্যিই অদ্ভুত সুন্দর হয়েছে বাচ্চাটা। মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান। চোখ দুটো অপূর্ব, গাঢ় নীল, সাগরের মত। আমাদের প্রথম বাচ্চা অর্থাৎ মাতাহিয়াপো বলে ওর জন্ম তাইয়ারাপুর জন্যে এক বিশেষ ঘটনা। শুধু ধর্মীয় বা সামাজিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও।

ভেহিয়াটুয়ার পারিবারিক মন্দিরের পেছনে বড় একটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। তিনটে ছোট ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে তার ভেতর। প্রথমটার নাম মিষ্টি ফানৈর ঘর এই ঘরে প্রসূতি সন্তান প্রসব করে। দ্বিতীয়টাকে বলা হয় আঁতুড় ঘর। প্রসবের পর পনেরোদিন মা ও শিশু এখানে থাকে। তৃতীয় ঘরের নাম সাধারণ ঘর। এখানে থাকে প্রসূতির সেবিকারা।

ছোট্ট হেলেন জন্ম নেয়ার পর ছদিন পর্যন্ত আমাকে যেতে দেয়া হলো না ওর কাছে। এরকমই নাকি রীতি এখানকার। সপ্তম দিন সকালে আমাকে নিয়ে রওনা হলো ভেহিয়াটুয়া। গণ্ডী পেরিয়ে ঢুকলাম দুজন আঁতুড়, ঘরে। প্রথমবারের মত আমি আমার মেয়ের মুখ দেখলাম। ছোট্ট হাতের মুঠো দুটো নাড়ছে আমার দিকে তাকিয়ে।

.

দেখতে দেখতে চলে গেল বছরটা। আমার মেয়ের বয়স এখন সাত মাস। তেহানি আর হেলেনকে নিয়ে সুখেই কাটছে আমার জীবন টাউতিরায়। দেশের কথা ভুলতে বসেছি। মাঝে মাঝে যেটুকু মনে পড়ে তার পুরোটা জুড়ে থাকে মা। মাস তিনেক আগে স্টুয়ার্ট আর পেগি এসেছিল আমাদের এখানে বেড়াতে। ওদেরও একটা মেয়ে হয়েছে। আমাদের হেলেনের মতই ফুটফুটে সুন্দর। দুতিন দিন থেকে ফিরে গিয়েছিল ওরা। আমার অভিধানের কাজ চলছে। এ এমন এক কাজ যার শেষ বোধহয় কখনোই হবার নয়-অন্তত একজনের জীবনকালে যে নয় তাতে আমি নিঃসন্দেহ। প্রতিদিনই নতুন নতুন শব্দের সন্ধান পাচ্ছি, লিপিবদ্ধ করছি; কখনও কোন বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোন পুরানো শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা খুঁজে পাচ্ছি। এছাড়া ঘরে। কাজ তো আছেই। মেয়ের পরিচর্যায় তেহানিকে সুযোগ পেলেই সাহায্য করি। সব মিলিয়ে সময় এখন কোন দিক দিয়ে যে পেরিয়ে যায় টেরই পাই না।

সতেরোশো একানব্বই এল। শুরুটা, গেল বছরের মত সুখেরই হলো। জানুয়ারি চলে গেল, ফেব্রুয়ারিও। মার্চের মাঝামাঝি সময় কয়েক দিনের জন্যে ভেহিয়াটুয়ার সঙ্গে দ্বীপের অন্য পাশে গেল তেহানি, কি এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে। হেলেনকে নিয়ে গেল ও। আমি আর আমার শ্যালক তুয়াহু রইলাম বাড়িতে।

তেহানি যাওয়ার সপ্তাহ খানেক পর এল জাহাজটা।

আগের রাতে হেইভা দেখে এসে ঘুমাতে ঘুমাতে মেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে সেদিন অনেক বেলা হয়ে যাওয়ার পরও ঘুম ভাঙেনি আমার। কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে জেগে দেখি তুয়াহু। চেহারা দেখে মনে হলো কোন কারণে উত্তেজিত ও।

বিয়্যাম! রুদ্ধশ্বাসে বলল তুয়াহু, ওঠো! জাহাজ! জাহাজ!

আর শোনার জন্যে অপেক্ষা করলাম না। বিছানা থেকে নেমে ওর পেছন পেছন ছুটলাম সৈকতের দিকে।

এরই মধ্যে অনেক লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। সবার দৃষ্টি পুর সাগরের দিকে। সূর্যের জন্যে, ভাল করে তাকাতে পারছে না, ভুরু কুঁচকে আছে। তুয়াহুর মত উত্তেজনায় টগবগ করছে তারাও।

স্পেনের জাহাজ হলে, একজনকে বলতে শুনলাম, এখানে আসবে।

ফ্রান্সের হলে হিটিয়ায় যাবে।

ব্রিটিশ হলে যাবে, মাতাভাই-এ, আমার দিকে তাকিয়ে যোগ কর তুয়াহু।

তোমার কি মনে হয়, ওটা ব্রিটিশ? জিজ্ঞেস করল আমার ফুফুশাশুড়ি টেতুয়াই।

কাধ ঝাঁকালাম আমি। এক ইন্ডিয়ান মন্তব্য করল, আর যা-ই হোক, স্পেনের না। দেখছ না দূর দিয়ে চলে যাচ্ছে।

নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম আমি। হা লোকটা ঠিকই বলেছে। এ দ্বীপে ভেড়ার কোন লক্ষণ নেই জাহাজটার গতিতে।

কিছুক্ষণ পর একটু যখন কুলের কাছাকাছি হলো, উপরের পালগুলোর আকৃতি দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না, ওটা ব্রিটিশ জাহাজই। বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠল কলজেটা।

তুয়াহু! চিৎকার করলাম আমি, মনে হচ্ছে ওটা ব্রিটিশ.জাহাজ! তোমার ছোট ক্যানোটা নিয়ে তৈরি হও, এক্ষুণি আমরা মাতাভাই-এ যাব!

.

তেরো

মাতাভাই-এ পৌঁছেই আম্বি স্টুয়ার্টের সাথে দেখা করলাম।

আমি জানতাম তুমি আসবে, বলল ও। জাহাজটা কোথাকার বুঝতে পেরেছ?

হ্যাঁ, জবাব দিলাম। ইংল্যান্ডের যুদ্ধ জাহাজ।

আমারও তাই মনে হয়েছে, দুঃখ মেশানো স্বরে বলল স্টুয়ার্ট। খুশি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু খুশি আসছে না। তোমার?

আমার অবস্থাও স্টুয়ার্টের মতই। জাহাজটাকে প্রথম দেখে সত্যিই খুশি হয়ে উঠেছিলাম, এবার দেশে ফিরতে পারব ভেবে। কিন্তু এর ভেতরে যে তাহিতিও আমার দেশ হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারলাম একটু পরেই, যখন মনে পড়ল তেহানির কুথা, আমার হেলেনের কথা। ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমার বন্ধন যতটুকু তাহিতির সঙ্গে তার চেয়ে কম নয় মোটেই।

না, স্টুয়ার্ট, আমারও আসছে না, একটু চুপ করে থেকে আমি বললাম।

আমাদের বউ বাচ্চাদের কি হবে? করুণ, শোনাল স্টুয়াক্টের গলা। তোমার কাছে আশ্চর্য লাগতে পারে, বিয়্যাম, কিন্তু সত্যি বলছি, বাউন্টি চলে যাওয়ার পর একবারও আমার মনে হয়নি তাহিতি ছেড়ে যেতে হতে পারে আমাদের।

আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। কিন্তু…

থাক, এ নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই। জাহাজটা ইংল্যান্ডের, তুমি ঠিক বুঝতে পেরেছ?

একদম ঠিক?

বেচারা মরিসন!

মানে?

মাত্র চারদিন আগে ও রওনা হয়ে গেছে ওর সেই ছোট্ট স্কুনার নিয়ে।

তাই নাকি! আর অন্যরা?

ওরাও গেছে। নরম্যান, ম্যাকইন্টশ, বায়ার্ন আর মুস্যাটকে নিয়ে ও বাতাডিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করবে। এলিসন, হিব্রান্ডট, বারকিট, মিলওয়ার্ড আর সামনারকে নামিয়ে দিয়ে যাবে কোন স্বপে।

মানে আগের পরিকল্পনা থেকে এক চুল নড়েনি ওরা।

হ্যাঁ।

বেচারাদের কপাল খারাপ বলতে হবে। আর মাত্র চারটে দিন যদি থেকে যেত…

এই সময় জোর এক হৈ-চৈ উঠল সৈকতে ভীড় করে থাকা ইন্ডিয়ানদের ভেতর। দেখতে পেয়েছে ওরা জাহাজটাকে। ছোট্ট একটা অন্তরীপের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসছে মাতাভাইয়ের দিকে। এখনও ওটা উপকূলের তিন চার। মাইল দূরে রয়েছে। এদিকে সন্ধ্যা হয় হয়। বাতাসের বেগ কমে গেছে। আজ আর ওটা বেশিদূর এগোতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

হ্যাঁ, ঠিক তাই। একটু পরেই দেখলাম একে একে পালগুলো গুটিয়ে ফেলা হলো জাহাজটার। এতদূর থেকে আমরা দেখতে না পেলেও বুঝলাম নোঙ্গরও ফেলা হয়েছে। একে একে লোকজন ফিরে যেতে লাগল যার যার বাড়িতে। যারা একটু বেশি উৎসাহী তারা রয়ে গেল সৈকতে।

রাতটা আমি স্টুয়ার্টের বাড়িতে কাটালাম।

পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগেই ফিরে এলাম সৈকতে তুয়াহু আর টাউতিরা থেকে অন্য যারা এসেছে তাদের কাছে। ওরা সৈকতেই রাত কাটিয়েছে। তুয়াহু ক্যানো নিয়ে জাহাজের কাছে যাওয়ার প্রস্তাবদল। ও বলল, জাহাজটা যদি অপরিচিত হয়, আমরা পথ দেখিয়ে নিয়ে আসলে ক্যাপ্টেন খুশি হবে। আর যদি ওটা পারাই-এর জাহাজ হয় আমরাই প্রথম এর সাথে দেখা করব।

আপত্তি করার কিছু দেখলাম না। একটু পরেই ক্যানোয় চেপে রওনা হয়ে গেলাম আমরা-আমি, তুয়াহু, আর তুয়াহুর বৃদ্ধ ভৃত্য পাওটো।

ঘন্টা খানেক লাগল জাহাজটার কাছে পৌঁছুতে। ইতোমধ্যে সূর্যোদয় হয়েছে। দূর থেকে দেখলাম জাহাজটার গায়ে বড় বড় হরফে লেখা প্যানডোরা। কিছুক্ষণ আগে নোঙ্গর তুলে রওনা হয়েছে ওটা। আমরা যখন মাত্র কয়েকশো গজ দূরে তখন প্যানডোরার নাবিকরা লক্ষ করল আমাদের। জাহাজের মুখ সামান্য ঘুরিয়ে আমাদের ক্যানোর দিকে আসতে লাগল ওরা।

বেশির ভাগ নাবিকই ডেকের ওপর, রেলিংয়ে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে উপকূলের দিকে। কিছু লোক কৌতূহলী হয়ে দেখছে আমাদের। ক্যাপ্টেনকে দেখলাম কোয়ার্টার ডেকে, তার চোখের দূরবীন আমাদের দিকে তাক করা। জাহাজ আর আমাদের ক্যানো যখন পাশাপাশি হলো আমরা দাঁড় বেয়ে চললাম ওটার সঙ্গে সঙ্গে। গ্যাঙওয়ে থেকে একটা রশি ছুঁড়ে দেয়া হলো আমাদের দিকে। পাওটো রশিটা ধরে জাহাজের গায়ে নিয়ে লাগাল ক্যানো। আমি আর তুয়াহু উঠে পড়লাম জাহাজে। পাওটো ক্যানোতেই রইল।

রোদে পুড়ে আমার গায়ের রঙও এখন ইন্ডিয়ানদের মত বাদামী হয়ে গেছে, তার ওপর আমার গায়ে রয়েছে ইন্ডিয়ানদের পোশক, বাহুতে উল্কি। জাহাজের সবাই আমাকে তাহিতীয় বলে ভুল করল। গ্যাঙওয়েতে এক লেফটেন্যান্ট দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এসে তুয়াহুর কাঁধ চাপড়ে দিয়ে সে বলল, মাইতাই! মাইতাই! অর্থাৎ, শাবাশ, শাবাশ! সন্দেহ নেই এই একটা ইন্ডিয়ান শব্দই জানে লেফটেন্যান্ট।

ওর সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, মৃদু হেসে আমি বললাম। ইংরেজি ও ভালই বোঝে। আমার নাম বিয়্যাম, রজার বিয়্যাম; হিজ ম্যাজেস্টিজ শিপ বাউন্টির সাবেক মিডশিপম্যান আমি।

মুহূর্তে মুখের ভঙ্গি বদলে গেল লেফটেন্যান্টের। কোন জবাব না দিয়ে আপাদমস্তক দেখল আমাকে। তারপর চিৎকার করে ডাকল, কর্পোরাল!

এগিয়ে এসে সামরিক কায়দায় সালাম কল কর্পোরাল।

কয়েক জন রক্ষী নিয়ে এসে এই লোকটাকে পেছনে নিয়ে যাও!

চিৎকার করে একটা নির্দেশ দিল কর্পোরাল। অমনি চারজন মাস্কেটধারী নৌ-সেনা ছুটে এসে ঘিরে ফেলল আমাকে। অবাক হওয়ারও অবসর পেলাম না, কর্পোরালের নির্দেশ শুনতে পেলাম: এগোও! পিঠে অনুভব করলাম, মাস্কেটের খোঁচা।

এগোতে হলো আমাকে। সামনে সেই লেফটেন্যান্ট।

কোয়ার্টার ডেকে ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে সে বলল, স্যার, গুণ্ডাওলোর একটাকে ধরেছি।

না, স্যার, প্রতিবাদ করলাম আমি। আমি গুণ্ডা নই। আপনারা…

থামো! গর্জে উঠল ক্যাপ্টেন। লেফটেন্যান্টের মতই আপাদমস্তক দেখল আমাকে নীরবে।

আমার কথা শুনুন, স্যার, আবার বললাম আমি। আমি বিদ্রোহী নই। আমার নাম…।

কথা কানে ঢোকেনি, বদমাশ? আমি তোমাকে চুপ করতে বলেছি!

রাগে লজ্জায় আমার কান ঝা ঝা করতে লাগল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়র মত দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ। ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখলাম, তুয়াহু দুচোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওকে কিছু বলার জন্যে মুখ খুললাম। আবার ধমক মেরে থামিয়ে দেয়া হলো আমাকে।

আর্মারারকে ডাকা হলো। আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল সে। তারপর কর্পোরালের তত্ত্বাবধানে রক্ষীরা ক্যাপ্টেনের কেবিনে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখল আমাকে।

দুঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। এর ভেতর রক্ষীদের ছাড়া আর কারও মুখ আমি দেখতে পাইনি। রক্ষীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি কয়েকবার, আগের মতই ওরা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে আমাকে। অবশেষে, প্যানডোরা মাতাভাইয়ে নিরাপদে নোঙ্গর করার পর, এল ক্যাপ্টেন। পেছনে সেই লেফটেন্যান্ট। আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ক্যাপ্টেন। তারপর একটা চেয়ারে বসে ছুঁড়ে মারল প্রশ্নটা :

নাম কি তোমার?

রজার বিয়্যাম।

রাজার সশস্ত্র জাহাজ বাউন্টিতে মিডশিপম্যান ছিলে তুমি?

হ্যাঁ, স্যার।

বাউন্টির নাবিকদের কজন এখন তাহিতিতে আছে?

তিন জন, আমি যতদূর জানি, আমাকে ছাড়া।

নাম কি সেই তিন জনের?

জর্জ স্টুয়ার্ট, জোসেফ কোলম্যান আর রিচার্ড ফিনার।

ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান কোথায়? বাউন্টিই বা কোথায়?

আটজন বিদ্রোহীসহ বাউন্টিতে করে ক্রিশ্চিয়ানের অজানার পথে চলে যাওয়ার কথা বললাম। তারপর থেকে এ পর্যন্ত তাহিতিতে যা যা ঘটেছে তা-ও বললাম। মরিসনের ছোট্ট একটা জাহাজ বানানো এবং তাতে করে মাত্র চারদিন আগে বাতাভিয়ার পথে রওনা হয়ে যাওয়ার কথাও বাদ দিলাম না।

হুঁ, গল্প হিসেবে মন্দ নয় যাহোক, গম্ভীর মুখে বলল ক্যাপ্টেন। তা তুমি কেন গেলে না ওদের সাথে?

ওইটুকুন জাহাজে ওরা অত দূরের পথ পাড়ি দিতে পারবে, আমার বিশ্বাস হয়নি।

হুঁ। কিন্তু শুনলে আশ্চর্য হবেনা কি দুঃখ পাবে?-ওর চেয়ে ছোট নৌকায় করে ক্যাপ্টেন ব্লাই তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে কুপ্যাঙ-এ পৌঁছেছিলেন; সেখান থেকে জাহাজে ইংল্যান্ডে।

সত্যিই, স্যার! ব্লাই, ইংল্যান্ডে পৌঁছুতে পেরেছেন?-ওহ, কি খুশি যে লাগছে শুনে!

হুঁ, কিন্তু তারপর উনি যা করেছেন শুনলে আর লাগবে না। দেশে পৌঁছেই বিদ্রোহের কথা জানিয়েছেন অ্যাডমিরালটিকে। তোমার জন্য ভূমিকার কথাসুদ্ধ।

আমার ভূমিকা! আমার কোন ভূমিকা ওতে ছিল না, স্যার। আমি আপনার এই জাহাজের নাবিকদের মতই নিরপরাধ!

মানে, ক্রিশ্চিয়ানের সঙ্গে জোট পাকিয়ে বাউন্টি দখলের ষড়যন্ত্র করেছিলে, একথা তুমি অস্বীকার করছ?

অবশ্যই, স্যার। এত কথা যখন জানেন তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানেন, ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সাথে যাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই লঞ্চে জায়গা ছিল না বলে যেতে পারেনি। আমরা মোট নজন ছিলাম, যারা বিদ্রোহে অংশ নেইনি তবু কপাল দোষে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম জাহাজে। ব্লাই চিৎকার করে বলেছিলেন, আমাদের যেন সুবিচার হয় উনি দেখবেন। তাহলে কেন আমার সাথে…

যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে থামিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। যথাসময়েই ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে তোমার। তখন তাকেই জিজ্ঞেস কোরো, কেন। এখন বলো, কোথায় গেলে পাব বাউন্টিকে?

আমি যা জানি বলেছি, স্যার।

মানে বাউন্টি এখন কোথায় তুমি বলবে না? ঠিক আছে, আমার কথাটা তাহলে শুনে রাখো, আমি ওটা খুঁজে বের করব। এবং যে বদমাশরা ওটা নিয়ে গেছে তাদের হাজি করব বিচারকের সামনে হা, শুনে রাখো, সে জন্যেই পাঠানো হয়েছে আমাকে।

দ্রুত চিন্তা চলছে আমার মাথায়। কি করে এ সম্ভব? ব্লাই নিজের চোখে দেখেছেন আমি বিদ্রোহে অংশ নেইনি, আমি তার সাথে যেতে চেয়েছি লঞ্চে-শুধু ব্লাই কেন, নেলসন, পার্সেল এবং আরও অনেকে দেখেছে। তার পরেও কি করে তিনি অ্যাডমিরালটিকে জানান বিদ্রোহে আমার ভূমিকা ছিল? ব্যাপারটা মস্ত এক ধাঁধার মত মনে হলো আমার কাছে জানতে ইচ্ছে হলো, ব্লাইয়ের সঙ্গে যারা গিয়েছিল তাদের কজন কি অবস্থায় দেশে পৌঁছেছে। কিন্তু আমাকে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ দিল না ক্যাপ্টেন। বলল, উঁহু, তুমি নয়, প্রশ্ন করব আমি। এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, তাহলে ক্রিশ্চিয়ান কোথায় আছে বলবে না?

আমি যা জানি বলেছি, স্যার!

লেফটেন্যান্ট এর দিকে ফিরল ক্যাপ্টেন।

মিস্টার পার্কিন, লোকটাকে নিচে পাঠিয়ে দাও। আর খেয়াল রাখবে কারও সাথে যেন যোগাযোগ করতে না পারে…একটু দাঁড়াও। হেওয়ার্ডকে আসতে বলো একবার তার আগে।

হেওয়ার্ড নামটা শুনে একটু যেন চমকালাম আমি। কিছুক্ষণ পর সে যখন কেবিনে ঢুকল, খুশিতে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল! হ্যাঁ। আমাদের সেই টমাস হেওয়ার্ড, বাউন্টিতে যে আমার মেসমেট ছিল! হাত বাড়িয়ে আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। বিনিময়ে, ওর চোখে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্য। হাত দুটো পেছনে নিয়ে দুপা পিছিয়ে গেল হেওয়ার্ড।

এই লোককে চেনো তুমি, মিস্টার হেওয়ার্ড?

হ্যাঁ, স্যার। ও রজার বিয়্যাম। বাউন্টিতে মিডশিপম্যান ছিল।

ব্যস, এতেই চলবে, বলল ক্যাপ্টেন।

তাচ্ছিল্যের চোখে আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল হৈওয়ার্ড। এরপর রক্ষীরা আমাকে জাহাজের একেবারে নিচের ডেকে নিয়ে গেল। ভাড়ার ঘরের পাশে ছোট্ট একটা কুঠুরিতে আটকে রাখল শিকল দিয়ে বেঁধে। ঘন্টাখানেক পর স্টুয়ার্ট, কোলম্যান আর স্কিনারকে আনা হলো। একই ভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো ওদেরও।

.

চোদ্দ

পরের চারটে দিন ওই ছোট্ট অন্ধকার কুঠুরিতে আটকা রইলাম আমরা। একে বিষুবীয় আবহাওয়া, তার ওপর বদ্ধ কুঠুরি। অসহ্য গরমে প্রাণ দুর্বিষহ হয়ে উঠল। খাবার যা দেয়া হলো তা এক কথায় জঘন্য। ইংল্যান্ড থেকে প্যানডোরা যে,শুকনো রুটি আর বিচ্ছিরি নোনা মাংস নিয়ে এসেছে তাই, ডাঙার তাজা খাবারের এক কণাও আমাদের দেয়া হলো না। ছোট্ট কুঠরিটায় চার চারজন মানুষ আমরা হাত পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায়, দরজার কাছে সশস্ত্র রক্ষী। একটা কথা বলার উপায় নেই নিজেদের ভেতর। কথা বলতে গেলেই ধমকে থামিয়ে দেয় রক্ষীরা।

এইভাবে কাটল চার দিন। পঞ্চম দিন সকালে অতিরিক্ত একজন রক্ষী নিয়ে হাজির হলো কর্পোরাল। পায়ের শিকল খুলে আমাকে নিয়ে এল গান ডেকের একটা কেবিনে। কেবিনটা প্যানডোরার সার্জন ডা. হ্যামিলটনের। আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন তিনি।

আমি কেবিনে ঢুকতেই রক্ষীদের বিদায় করে দিলেন ডাক্তার। তারপরই তার চোখ পড়ল আমার হাতের হাত কড়ার ওপর। কর্পোরালকে ডাকলেন আবার। হাতকড়া খুলে দিতে বললেন।

লেফটেন্যান্ট পার্কিনের নির্দেশ…নিরাসক্ত কণ্ঠে শুরু করল কর্পোরাল।

হয়েছে, আর বলতে হবে না, বাধা দিলেন ডাক্তার হ্যামিলটন। খুলে নাও ওগুলো। আমি জামিন থাকছি এর।

আর কিছু না বলে হাতকড়া দুটো খুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল কর্পোরাল। দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন সার্জন।

সাবধান হলাম, মৃদু হেসে তিনি বললেন। না, মিস্টার বিয়্যাম, তুমি পালানোর চেষ্টা করবে ভেবে নয়। আমি চাই না আমাদের আলাপে কেউ বাধা সৃষ্টি করা। বসো।  বছর চল্লিশেক বয়েস ভদ্রলোকের স্বাস্থ্যবান। সৌম্য, সুদর্শন। গলার স্বরে অদ্ভুত এক কোমল ভাব। ওঁর কাপড় চোপড়ের বাক্সটার ওপর আমি বসলাম।

প্রথমেই যেটা জানতে চাইব, শুরু করলেন তিনি, তোমার অভিধানের কাজ কতদূর? শেষ হয়েছে?।

স্যার, এ ধরনের কাজ কি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়। তবে অনেক দূর এগিয়েছি। তাহিতীয় ভাষার একটা ব্যাকরণও আমার সাধ্যমত তৈরি করেছি।…কিন্তু-আপনি এসব কথা জানলেন কি করে?

স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস বলেছেন।

মানে-মানে আপনি স্যার জোসেফকে চেনেন!

আঁ-হ্যাঁ, খুব ঘনিষ্ঠভাবে নয় অবশ্য। নাম শুনেছি অনেক আগেই, পরিচয় হয়েছে আমরা রওনা হওয়ার কদিন আগে। তোমার সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা ওঁর।

তাহলে, স্যার, আপনি-আপনি নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, এই বিদ্রোহের ব্যাপারটায় উনি আমাকে দোষী মনে করেন কিনা? আপনি, স্যার আপনি নিজেও কি মনে করেন এমন একটা কাজে জড়ানোর মত পাগলামি আমি করব?

না, অন্তত তোমার চেহারা দেখে আমার তা মনে হয় না।আর স্যার জোসেফের কথা যদি বলো, তোমার বিরুদ্ধে যা যা বলা হয়েছে সব সত্ত্বেও উনি মনে করেন তুমি নির্দোষ।

অথচ দেখুন, আপনাদের ক্যাপ্টেন এমন ব্যবহার করছেন, যেন আমি পালের গোদাদেরই একজন।

গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সার্জন আমার দিকে।

এডওয়ার্ডসকে অবশ্য খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না সেজন্যে, বললেন তিনি।

এডওয়ার্ডস।

প্যানডোরার ক্যাপ্টেন। বিদ্রোহীদের খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওকে।

কিন্তু আমি তো বিদ্রোহ…

হ্যাঁ, তোমার ধারণা তুমি বিদ্রোহ করোনি, বাধা দিয়ে বললেন ডা. হ্যামিলটন, কিন্তু ব্লাইয়ের ধারণা-ধারণা নয় বিশ্বাস, তুমি শুধু বিদ্রোহই করোনি, বিদ্রোহ সংগঠনে গভীর ভাবে জড়িত ছিলে। বাউন্টি যে সকালে দখল করা হয় তার আগের রাতে ক্যাপ্টেন ব্লই নিজে ডেকে এসেছিলেন জানো?

হ্যাঁ।

তুমি আর ক্রিশ্চিয়ান এক মনে কি যেন আলাপ করছিলে।

হ্যাঁ।

তোমাদের আলাপের শেষ অংশটা ব্লাই শুনতে পেয়েছিলেন। তুমি তখন ক্রিশ্চিয়ানকে বলছিলে, আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন, স্যার। জবাবে ক্রিশ্চিয়ান বলেছিল, বেশ, তাহলে, এই কথা থাকল,-তাই না?

নির্বাক হয়ে রইলাম আমি কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললাম, ঠিক এই কথাগুলো না হলেও এরকমই কিছু আমরা বলাবলি করছিলাম। কিন্তু-কিন্তু তার সাথে বিদ্রোরে তো কোন সম্পর্ক ছিল না।

ছিল না! তুমি নিজেই ভেবে দেখ, বিয়্যাম, বিদ্রোহের নেতার সঙ্গে এ ধরনের আলাপ, তা-ও বিদ্রোহের ঠিক আগের রাতে-যে-ই শুনবে তোমরা বিদ্রোহের ব্যাপারটা পাকাপাকি করেছিলে এছাড়া কিছু ভাববে?

আমি এবার বিদ্রোহের ব্যাপারটা পুরোপুরি খুলে বললাম সার্জনকে। কিছুই বাদ দিলাম না। সে রাতে ক্রিশ্চিয়ানের সাথে আমার আলাপ থেকে শুরু করে আমাদের তাহিতিতে নামিয়ে দিয়ে আটজন সঙ্গী সহ ক্রিশ্চিয়ানের নিরুদ্দেশ যাত্রা পর্যন্ত সব মন দিয়ে শুনলেন ডা. হ্যামিলটন। তারপর বললেন, আমি বিশ্বাস করেছি তোমার কথা। তার প্রমাণ-, হাত এগিয়ে দিলেন তিনি। আমি হাতটা ধরে গভীর আবেগে একটু ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু, বিয়্যাম, আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে তো কিছু আসবে যাবে না, বিশ্বাস করাতে হবে বিচারককে। বিচারকরা প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করেন না।

প্রমাণ তো আছে, স্যার। বললাম না, রবার্ট টিঙ্কলার শুনেছিল ক্রিশ্চিয়ানের সাথে আমার আলাপ। ও যদি সাক্ষী দেয়…

হ্যাঁ টিঙ্কলার, আমার মনে হয় ও সাক্ষী দেবে। ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের দলের সাথে ও-ও নিরাপদে পৌঁছেছে ইংল্যান্ডে। কিন্তু তারপরও কিছু সন্দেহ থেকে যাবে। ক্রিশ্চিয়ান যে ছোট্ট একটা ভেলায় চড়ে পালাতে চেয়েছিল তার প্রমাণ কি?

ক্রিশ্চিয়ান পালাতে চেয়েছিল কি না চেয়েছিল তার প্রমাণ কি আমার বিচারের জন্যে খুব জরুরী?

নিশ্চয়ই। তোমার সঙ্গে ওই আলাপের ব্যাপারটা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে হলে ক্রিশ্চিয়ান যে পালাতে চেয়েছিল তা-ও নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে হবে। ও যে পালাতে চেযেছিল এ কথা তুমি ছাড়া আর কেউ জানে?

হ্যাঁ, জন নর্টন জানে। সে-ই ভেলা তৈরি করেছিল ক্রিশ্চিয়ানের জন্যে।

টেবিলের দেরাজ খুলে একটা কাগজ বের করলেন সার্জন।

ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সঙ্গে যারা লঞ্চে উঠেছিল তাদের তালিকা এটা। ওদের মোট বারোজন ইংল্যান্ডে পৌঁছুতে পেরছে। একটু থেমে কাগজটার ওপর চোখ বুলালেন ডা. হ্যামিলটন। তারপর বললেন, নর্টন?…না নর্টন নেই ওদের ভেতর। এখানে বলা হয়েছে, তোফোর দ্বীপে জংলীদের হাতে মারা পড়েছে ও।

নর্টন নেই শুনে দুঃখ পেলাম। কিন্তু যতটা দুঃখ পেলাম তার চেয়ে বেশি হলাম হতাশ। মিস্টার নেলসনও মারা গেছেন। কুপ্যাঙ-এ পৌঁছে কি এক অজানা রোগে পড়েছিলেন। উনি যদি থাকতেন, বিচারকদের সামনে বলতে পারতেন, সত্যিই আমি জাহাজ ছেড়ে লঞ্চে উঠতে চেয়েছিলাম। অর্থাৎ আমার পক্ষে সাক্ষী থাকল মোটে একজন-ওই টিঙ্কলার। ভীষণ হতাশ লাগতে লাগল আমার। কিন্তু ডা. হ্যামিলটন অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন:

ভেঙে পোড়ো না, বিয়্যাম। এখন যেটা তোমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো মন শক্ত রাখা। দেখাই যাক না টিলারের সাক্ষীতে কতটুকু কাজ হয়। এর ভেতর নিশ্চয়ই আরও কোন প্রমাণের কথা মনে পড়ে যাবে আমাদের! স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস তোমার সপক্ষে সামান্যতম প্রমাণও যদি পাওয়া যায় হাজির করতে ছাড়বেন না আদালতের সামনে।

শুনে সামান্য হলেও স্বস্তি পেলাম। এরপর ব্লাই ও তার সঙ্গীরা কি করে কুপ্যাঙ হয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছেন সংক্ষেপে সে গল্প শোনালেন হ্যামিলটন। প্রথমে ওঁরা তোফোয়া দ্বীপে গিয়েছিলেন পানি এবং খাবার দাবার সংগ্রহ করার জন্যে। সেখানে জংলীদের খপ্পরে পড়েন। পুরো দলটাই ধ্বংস হতে হতে বেঁচে যায় অল্পের জন্যে। নর্টন একাই কেবল মারা পড়ে। এরপর কঠোর পরিশ্রম আর কষ্ট ভোগ করে বিদ্রোহের সাতচল্লিশ দিন পর ওঁরা পৌঁছান ওলন্দাজ উপনিবেশ টিমোর-এর কুপ্যাঙ-এ। তারিখটা জুনের চোদ্দ। কুপ্যাঙ এ পৌঁছানোর জন্যে কমপক্ষে বারোশো লিগ সাগর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ওদের। দুমাস এখানে থেকে একটু সুস্থ হওয়ার পর হোট একটা স্কুনারে করে বাতাভিয়ায় চলে আসেন তারা। কুপ্যাঙ-এ মারা গিয়েছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডেভিড নেলসন, বাতাভিয়ায় মারা যায় আরও তিন জন-এলফিনস্টোন, লেকলেটার আর টমাস হল। সহকারী সার্জন লেডওয়ার্ড স্বাস্থ্যগত কারণে বাতাভিয়ায় থেকে যায়, বাকিরা ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটা জাহাজে চড়ে দেশে ফেরে। পথে মারা যায় কসাই ল্যাম্ব। অর্থাৎ উনিশ জনের ভেতর ইংল্যান্ডে পৌঁছায় মাত্র বারোজন।

রাতারাতি বীর হয়ে উঠলেন ব্লাই, বলে চললেন ডা. হ্যামিলটন। হবেন-ই বা কেন?-আমাদের নৌযাত্রার ইতিহাসে এমন খোলা নৌকায় সাগর পাড়ি দেয়ার কথা কেউ কোনদিন শোনেনি। সারাদেশ ব্লাইয়ের প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। সেটাই স্বাভাবিক, তাই না?-আর যারা বাউন্টিতে থেকে গিয়েছিল তাদের চিহ্নিত করা হলো জঘন্য অপরাধী হিসেবে।

কিন্তু, স্যার, বাউন্টিতে যারা থেকে গিয়েছিল তাদের অনেকে যে বাধ্য হয়েছিল থাকতে, তা মিস্টার ব্লাই বলেননি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডসকে যে নির্দেশপত্র অ্যাডমিরালটি দিয়েছে আমি সেটা পড়েছি। বাউন্টিতে যারা থেকে গিয়েছিল তাদের নামের একটা তালিকা আছে ওতে। বলা হয়েছে, তোমাদের সবাইকে বিদ্রোহী হিসেবে গণ্য করতে হবে।

তার মানে কি ইংল্যান্ডে না পৌঁছা পর্যন্ত যেখানে আছি সেখানেই থাকতে হবে আমাদের?

ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে এডওয়ার্ডস-এর ইচ্ছার ওপর। তবে আমি চেষ্টা করব তোমাদের যেন একটু ভাল কোন জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়।

একটা কথা, স্যার, যদি সম্ভব হয় ওকে একটু বলবেন যেন আমাদের কথা বলতে দেন নিজেদের ভেতর।

মানে! তোমাদের কথা বলতে দেয় না নাকি?

না, স্যার।

ঠিক আছে, চিন্তা কোরো না, আমি বলব। এবার আসল কথায় আসি আবার তোমার পাণ্ডুলিপিটা নিশ্চয়ই তোমার বাড়িতে?

হ্যাঁ। আমার বন্ধু এবং শ্যালক তুয়াহুকে আমার নাম করে বললে আমার সিন্দুকটা ও জাহাজে পৌঁছে দিয়ে যাবে।

এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন ডা. হ্যামিলটন। নামটা লিখে দাও। আমি ওকে ঠিক খুঁজে বের করে ফেলব। স্যার জোসেফ বার বার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তোমার পাণ্ডুলিপিটা যেন কোন ভাবেই নষ্ট না হয়।

ঘড়ির দিকে তাকালেন সার্জন।

এবার তোমাকে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে, বলে তিনি উঠে গিয়ে দরজা খুলে কেবিনের বাইরে এপাশ ওপাশ দেখলেন একবার। তারপর আবার দরজা বন্ধ করে বললেন, স্যার জোসেফ আরেকটা দায়িত্ব দিয়েছেন আমাকে। বলেছেন, তোমাকে যদি খুঁজে পাই, এই চিঠিটা যেন দেই তোমাকে।

হাত বাড়িয়ে নিলাম চিঠিটা। খাম খুলে হাতের লেখা দেখেই কেঁপে উঠল শরীর। মা লিখেছেন। মোটামুটি দীর্ঘ চিঠি, কিন্তু বক্তব্য মূলত একটাই; আমি যে নিরপরাধ তাতে কোন সন্দেহ নেই তার মনে। এখন তার একমাত্র চিন্তা, ধরা পড়ার পর বন্দী অবস্থায় দেশে ফেরার যে কষ্ট তা সইতে পারব তো? সব শেষে ধৈর্য ধরে মন প্রাণ দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকার পরামর্শ দিয়ে শেষ করেছেন মা।

.

ঠিকই অনুমান করেছিলেন মা। এর পরের কয়েকটা মাসের কাহিনী অমানুষিক কষ্ট আর দুঃখ ভোগের কাহিনী। আমাদের যতভাবে সম্ভব কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করল প্যানডোরার ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস আর তার দুই সহকারী লেফটেন্যান্ট পার্কিন এবং সেই কর্পোরাল। কি করে যে সে কষ্ট সহ্য করে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছি, ভেবে এখন অবাক হই।

ডা. হ্যামিলটনের অনুরোধে অবশ্য আমাদের একে অন্যের সাথে আলাপ করার অনুমতি দিয়েছে ক্যাপ্টেন, তবে কথা বলতে হবে শুধু ইংরেজিতে। ইন্ডিয়ান ভাষায় যদি একটা শব্দও উচ্চারণ করি সুবিধাটুকু কেড়ে নেয়ার ভয় দেখিয়েছে সে।

কয়েকদিন পর নিজ চোখে আমাদের অবস্থা দেখতে এসে এডওয়ার্ডস এর মনে হলো আমাদের হাত পায়ের বেড়িগুলো যথেষ্ট মজবুত নয়। সেদিনই বেড়িগুলো বদলে দেয়া হলো। আগের বেড়িগুলো একটু ঢিলে ঢালা ছিল; এবারেরগুলো হলো অনেক আঁটো। হাতের মাংস কেটে বসল প্রায়। আরও কয়েকদিন পর এক সকালে ডেকের ওপর শুরু হলো ঠাস ঠাস শব্দ। আমাদের খাবার দিতে আসে যে নাবিকটা তার নাম জেমস গুড। ডা. হ্যামিলটন ছাড়া প্যানডোরার এই একটা লোকের কাছে আমরা একটু সদয় ব্যবহার পাই। কেন যে লোকটার মনে আমাদের সম্পর্কে সহানুভূতি জেগেছে। জানি না। সে সেদিন দুপুরের খাবার দিতে এসে জানাল, ডেকের ওপর আমাদের থাকার জন্যে নতুন ঘর তৈরি হচ্ছে। ডা. হ্যামিলটনের পীড়াপীড়িতেই নাকি এটা করা হচ্ছে।

পরদিন রিকেল নাগাদ শেষ হলো ঘর তৈরির কাজ। সন্ধ্যার সময় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে। এর পর আর যে কদিন প্যানডোরায় রইলাম এই নতুন কারাকক্ষে কাটলো। নিচের কুঠুরির চেয়ে কোনু, অংশে উন্নত নয় এটা, একটু বড় এই যা। বড় কেন, বুঝলাম দুদিন পরেই যখন মরিসন, নরম্যান আর এলিসনকে এনে বেঁধে রাখা হলো আমাদের পাশে। আরও একটা ব্যাপার বুঝলাম, আমরা ধরা পড়ার পর এত দিনেও প্যানডোরা রওনা হয়নি কেন। কারণ একটাই, বাউন্টির বাকি নাবিকদের ধরার জন্যে অপেক্ষা করছে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস।

মরিসনের কাছে শুনলাম ওদের কাহিনী। তাহিতিরই অন্য এক অংশে থাকত ম্যাকইন্টশ, হিলব্রান্ডট আর মিলওয়ার্ড। জায়গাটার নাম পাপারা। মরিসন ওদের স্কুনার-যার নাম দিয়েছে ওরা. রিজোল্যুশন-নিয়ে গিয়েছিল। পাপারায় ওই তিনজনকে তুলে নেয়ার জন্যে। ওখানে পৌঁছে আবহাওয়া ভাল দেখে অতিরিক্ত কিছু শুয়োরের মাংস নুন দিয়ে নেয়ার কথা ভাবে ওরা। এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে। বেশ কয়েকটা দিন লেগে যায় একাজে। অবশেষে ওরা যখন আবার রওনা হওয়ার জন্যে মোটামুটি তৈরি এই সময় জানতে পারে মাতাতাইয়ে প্যানডোরার আসার খবর। ভেবে চিন্তে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগেই নৌ-সেনা বোঝাই একটা লঞ্চ এসে দখল করে নেয় রিজৌলুশন।

নরম্যান আর আমি খুশিতে প্রায় নেচে উঠেছিলাম ইংরেজ উর্দী দেখে, বলে চলল মরিসন। কিন্তু, অন্যদের কথা ভাবতেই সে খুশি আমাদের মিইয়ে গেল। ওদের সাবধান করার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু সম্ভব হয়নি, তার আগেই ধরা পড়ে গেলাম।

সেদিনই সন্ধ্যায় অন্যদেরও নিয়ে আসা হলো পাপারা থেকে। সাতজন ওা-ম্যাকইন্টশ, হিব্রান্ডট, বারকিট, মিলওয়ার্ড, সামনার, মুসভ্যাট আর প্রায়ান্ধ বায়ার্ন। কাল যে কারাকক্ষ মনে হয়েছিল বড়, সেটা আর বড় রইল না।

.

মের প্রথম দিকে এক সকালে আমাকে আর স্টুয়ার্টকে পায়ের বাঁধন খুলে বের করে আনা হলো কারা প্রকোষ্ঠ থেকে। নিচের ডেকের যে কেবিনটাকে সিক বে হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। দরজার সামনে দেখলাম ড়া, হ্যামিলটন অপেক্ষা করছেন। কোন কথা না বলে ভেতরে ঢোকার ইশারা করলেন আমাদের। ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর কি আশ্চর্য!-তেহানি আর পেগি বসে আছে। তেহানির কোলে আমাদের হেলেন, পেগির কোলে ওদের মেয়ে।।

সোজা আমার কাছে এসে দাঁড়াল তেহানি। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল:

শোনো, বিয়্যাম, কান্নাকাটি করার মত সময় আমার নেই। যা বলার তাড়াতাড়ি বলতে হবে। আতুয়ানুই এখন মাতাভাইয়ে। টাউতিরা থেকে তিনশো বাছাই করা যোদ্ধা সাথে নিয়ে এসেছে। ওরা দুভাগে ভাগ হয়ে উপকূলের দুদিকে অপেক্ষা করছে। অনেক দিন ধরে তোমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করছি, কিন্তু সম্ভব হয়নি। অবশেষে ডাক্তারের চেষ্টায় সুযোগ পেয়েছি। আতুয়ানুই বাতের বেলা জাহাজ আক্রমণ করতে চায়। অন্ধকারে কামান দেগে আমাদের কোন ক্ষতি ওরা করতে পারবে না। আমাদের যেটা ভয়, জাহাজ দখল করার আগেই না তোমাদের মেরে ফেলে সৈন্যরা। ডেকের ওপর যে ঘরটা তৈরি করেছে ওতে তোমাদের রেখেছে, তাই না? শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে? কি ভাবে তোমাদের পাহারা দেয় ওরা জানতে চায় আতুয়ানুই।

তেহানি আর ছোট্ট হেলেনকে দেখে খুশিতে এমন আত্মহারা হয়ে উঠেছি যে কিছুক্ষণ আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। হেলেনকে দুহাতে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম বুকের সঙ্গে।

বলো, বিয়্যাম, তাড়াতাড়ি, তাড়া দিল তেহানি। বেশি কথা বলার সময় আমরা পাব না।

কবে তুমি মাতাভাই-এ এসেছ, তেহানি?

তুমি টাউতিরা থেকে আসার তিন দিন পর। ভেবেছিলে তোমাকে আমি ভুলে যাব? আতুয়ানুই আর আমি-দুজনে মিলে এই পরিকল্পনা করেছি। তোমার সব বন্ধু আমাদের সঙ্গে আছে। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আক্রমণ করার জন্যে।

আমাদের উদ্ধার করার কোন উপায় নেই, তেহানি, আমি বললাম, আতুয়ানুইকে বুঝিয়ে বোলো কথাটা। ও আর ওর লোকরা সব মারা পড়বে খামোকা।

না, না, বিয়্যাম! ওরা গুলি চালানোর আগেই আমরা ওদের লাঠিপেটা করে মেরে ফেলব। আতুয়ানুই কাল রাতেই আক্রমণ করতে চায়। কাল চাঁদ থাকবে না।

কেন আমাদের আটকে রাখা হয়েছে তেহানির কাছে তা ব্যাখ্যা করা অর্থহীন। ও কিছু বুঝবে না। যা-ও বা বোঝার সম্ভাবনা ছিল আমরাই তার গোড়া কেটে রেখেছি বিদ্রোহের ব্যাপারটা ওদের কাছে গোপন রেখে। ক্রিশ্চিয়ানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছু জানাব না ইন্ডিয়ানদের। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি আমরা। কিন্তু এখন কি করে তেহানিকে বোঝাই ও আর আতুয়ানুই যে পরিকল্পনা করেছে তা পাগলামি?

ক্যাপ্টেন এটুয়াটি (এডওয়ার্ডস) হিটিহিটিকে বলেছে, বলে চলল তেহানি, তোমরা নাকি খারাপ লোক। তোমাদের ধরেছে ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেবে বলে। হিটিহিটি বিশ্বাস করে না এসব আজেবাজে কথা। কেউই বিশ্বাস করে না।

তেহানি আমাকে যা যা বলেছে ইতিমধ্যে পেগিও স্টুয়ার্টকে সে সব বলেছে। দেখে বুঝলাম আমার মত কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা স্টুয়ার্টেরও। দুজনই চুপ করে আছি।

কই, বিয়্যাম, বলো! তাড়া লাগাল তেহানি।

হ্যাঁ বলো! ওকে সমর্থন করল পেগি।

দেখ, তেহানি, তোমরা যা ভাবছ, তা অসম্ভব, এক কথায় পাগলামি, অবশেষে আমি বললাম। জাহাজ যদি দখল করতেও পারো আমাদের বাঁচাতে পারবে না। আমাদের হাত-পা সব সময় শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। বন্দুক হাতে পাহারাদার দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে দিন রাত। তোমরা জাহাজে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আমাদের খুন করবে।

নিঃশব্দে আসব আমরা–শুরু করল তেহানি।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, তাতে লাভ হবে না। তোমরা যে হামলা চালাতে পারো আগে থাকতেই আন্দাজ করেছে ক্যাপ্টেন এটুয়াটি, (কথাটা সত্যি) তাই দিনরাত তীরের দিকে চোখ রাখার জন্যে কয়েক জনকে ডেকের ওপর রেখেছে সে।

এতক্ষণ কোন মতে স্থির ছিল তেহানি আর পেগি। এর পর আর পারল না। কিছুই করার নেই বুঝতে পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল পেগি। স্টুয়ার্ট বৃথাই চেষ্টা করল ওকে শান্ত করার। তেহানি কাঁদল না। একটা শব্দও করল না। ধীরে ধীরে শুধু বসে পড়ল মেঝেতে আমার পায়ের কাছে। মুখটা দুহাতে ঢাকা। পেগির মত ও-ও যদি কাঁদত আমার জন্যে অনেক সহজ হত কষ্ট সহ্য করা। আমার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ওর পাশে ঘটু গেড়ে বসলাম। কিন্তু, সান্ত্বনা দেয়ার মত কোন কথা খুঁজে পেলাম না।

একটু পরেই দরজা খুলে গেল। ডা. হামিলটন ঢুকলেন, পেছনে রক্ষীরা। পেগি এবার হু-হুঁ করে কেঁদে ফেলল স্টুয়ার্টকে জড়িয়ে ধরে! রীতিমত টানা হ্যাঁচড়া করতে হলো ওকে ছাড়ানোর জন্যে। বাচ্চাকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে তেহানিকে ওঠালাম আমি। এক মুহূর্ত আমাকে জড়িয়ে ধরে বুইল ও। তারপর পেগির হাত ধরে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে। বাচ্চা কোলে ওদের পেছন পেছন এগোলাম আমি আর স্টুয়ার্ট। গ্যাংওয়ের কাছে গিয়ে ভত্যদের হাতে তুলে দিলাম বাচ্চা দুটোকে। ওরা নেমে গেল ক্যানোয়। স্টুয়ার্ট তক্ষুণি ওকে কারাকক্ষে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করল। ওর অনুরোধ রাখল রক্ষীরা। আর আমাকে নিজের কেবিনে নিয়ে গেলেন ডা. হ্যামিলটন। জানালা দিয়ে দেখলাম, ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ক্যানোটা। দাঁড় বাইছে তুয়াহু, টিপাউ, আর পেগির বাবা। তেহানি আর পেগি বসে আছে ক্যানোর সামনের দিকে। এক দাসীর কোলে ওর বাচ্চা। আমার হেলেন তার মায়ের কোলে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম, ক্যানোটা ছোট হতে হতে অস্পষ্ট হয়ে গেল। তারপর এক সময় হারিয়ে গেল তীরের কাছে জটলা করে থাকা অনেক ক্যানোর ভীড়ে।

.

পনেরো

পরের পুরো দিনটা জাহাজের নৌকাগুলো ব্যস্ত থাকল ডাঙা থেকে তাজা খাবার আনার কাজে। পরদিন ভোরে নোঙ্গর তুলে পাল উড়িয়ে দিল হিজ ম্যাজেস্টিজ শিপ প্যানোরা।

বেশ কয়েক দিন কেটে যাওয়ার পর আমরা জানতে পারলাম, প্যানডোরা একা চলছে না, মরিসনের ছোট্ট স্কুনার রিজোল্যুশনকে সাথে নিয়ে চলেছে সে। প্যানডোরার মাস্টারের মেট মিস্টার অলিভারকে ওটার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে এডওয়ার্ডস। সঙ্গে দিয়েছে একজন মিডশিপম্যান, একজন কোয়ার্টার মাস্টার আর ছজন খালাসী। প্যানডোরার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, এগিয়ে চলেছে ছোট্ট জাহাজটা!

পরের তিনটে মাসে তাহিতির চারপাশের কয়েকশো মাইল সমুদ্র চষে ফেলল.ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস। কিন্তু পাওয়া গেল না বাউন্টিকে। ক্রিশ্চিয়ান বা তার সঙ্গীদেরও কোন খোঁজ পাওয়া গেল না আশপাশের দ্বীপগুলোয় খবর নিয়ে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন লোকগুলো।

এই খোঁজাখুঁজির ভেতর এক দুর্যোগময় রাতে হারিয়ে গেল রিজোল্যুশন। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল সে রাতে। সামান্য ঝড়ও ছিল। এর ভেতর কখন যে কোনদিকে চলে গেল ওটা কেউ টের পায়নি। তিন চার দিন একটানা খুঁজেও আর তাকে পাওয়া গেল না। অবশেষে অগাস্টের দুতারিখে ইংল্যান্ডের পথে রওনা হলো প্যানোরা।

জেমস গুডের কাছে খবর পেলাম অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনির মাঝের এডেভার প্রণালীর দিকে এগোচ্ছি আমরা।

সপ্তাহ তিনেকের ভেতর গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ-এর উত্তর অংশে পৌঁছে গেল প্যানডোরা। এখানে সাগর ভীষণ বিপজ্জনক। চারদিকে ডুবো আধা ডুবো পাহাড়ের ছড়াছড়ি। সেগুলোয় বাধা পেয়ে ভয়ঙ্কর গর্জনে ভেঙে পড়ছে ঢেউ। এমন সাগরে জাহাজ যদি ঝড়ের কবলে পড়ে তাইলে আর রক্ষা নেই। নির্ঘাত ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেতে হবে। তারপর কি হবে একমাত্র ভবিতব্যই জানে।

আমাদের কপাল খারাপ বলতে হবে, অগাস্টের আটাশ তারিখ ভোর থেকেই জঘন্য আচরণ শুরু করল আবহাওয়া। এই শান্ত এই অশান্ত; এই রোদ, কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মেঘ; তারপর হয় বৃষ্টি নয় ঝড়, তারপর আবার রোদ। সারাদিন চলল এরকম। জাহাজ বাঁচাতে কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হলো নাবিকদের বদ্ধ ঘরে বসে তা না দেখতে পেলেও অনুভব করলাম ঠিকই।

দিনটা তো কোন মতে গেল, সন্ধ্যার পরেই ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে নেমে এল দুর্ভোগ। ঝড় উঠল আচমকা। তারপরই ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেলো প্যানডোরার তলা। আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে। শিকল বাঁধা হাত আর পায়ে টান পড়ল ভয়ানক। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলাম সবাই। কোন মতে সামলে উঠে বসতে না বসতেই আবার। এবার আগের চেয়ে জোরে। আটকে গেছে জাহাজ।

যেমন এসেছিল তেমনি আচমকা থেমে গেল ঝড়। একটু পরে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস-এর চিৎকার শুনতে পেলাম: কি অবস্থা, মিস্টার রবার্টস?

ভাল না, স্যার! নিচ থেকে ভেসে এল রবার্টস-এর গলা। ভীষণ জোরে পানি উঠছে। এর মধ্যেই তিন ফুট জমে গেছে খোলে!

তক্ষুণি অনবরত পানি সেঁচার নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন। আধ ঘণ্টা যেতে না যেতেই আবার দমকা হাওয়া। এবার আরও জোরে। মড় মড় করে উঠল প্যানডোরার কাঠামো। মৃদু একটা ধাক্কার মত অনুভব করলাম। ডেকের ওপর থেকে কেউ একজন চিৎকার করল: ছুটে গেছে, স্যার!

হ্যাঁ; দুলুনি টের পাচ্ছি। ডুবো পাহাড় থেকে মুক্ত হয়েছে জাহাজ। ভোর পর্যন্ত আর কোন দুর্ঘটনা ঘটল না। কিন্তু দিনের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবার ধাক্কা খেলো প্যানডোরা। একটু পরেই সমবেত কণ্ঠের আতঙ্কিত চিৎকার উঠল জাহাজ জুড়ে। বুঝলাম, ডুবছে প্যানডোরা। আতঙ্ক ভর করল আমাদের:মধ্যেও। এখনই যদি মুক্ত না করে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ইঁদুরের মত ডুবে মরব। মুসভ্যাট, বারকিট, হিব্রান্ডট কেঁদে উঠল হাউমাউ করে। একটু পরেই প্যানডোরার মাস্টার অ্যাট আর্মসকে চাবি হাতে কারা-কুঠুরিতে ঢুকতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমরা।

বাইরে রেরিয়ে দেখি সবগুলো নৌকা নামানো হয়ে গেছে পানিতে। নাবিকদের অনেকে উঠে পড়েছে তাতে জাহাজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে গেছে তারা নৌকাগুলোকে, যেন জাহাজের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ডুবে না যায়, বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সাগর এখনও অশান্ত, ঝড় চলছে। প্যানডোরার ডুবতে আর কয়েক মিনিটও লাগবে কিনা সন্দেহ। পানি পৌঁছে গেছে ওপরের। ডেক পর্যন্ত। আমরাও ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে পড়লাম সাগরে। শিকল খুলে নেয়া হলেও হাতকড়াগুলো খুলে দেয়া হয়নি। সেজন্যে সাঁতার কাটতে খুব কষ্ট হলো যদিও তবু শেষ পর্যন্ত একটা নৌকায় পৌঁছুতে পারলাম আমি। পেছনে ফিরে তাকানোর অবসর যখন পেলাম তখন আর প্যানডোরা নেই জলের ওপর। মাস্তুলের মাথাগুলো কেরল জেগে আছে তখনও। সেগুলো তলিয়ে গেল একটু পরেই।

তারপর আকাশ আবার পরিষ্কার, সাগর শান্ত। সূর্য বেরিয়ে এল মেঘের আড়াল থেকে। ছোট একটা বেলে চরার কাছে জড়ো হলো সবগুলো নৌকা। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস-এর নির্দেশে বেঁচে যাওয়া, লোকদের হিসেব নিতে গিয়ে দেখা গেল প্যানডোরার তিন জন নাবিক আর চারজন বন্দী মারা গেছে পানিতে ডুবে। বন্দী চারজন হলো: স্টুয়ার্ট, সামনার, হিব্রান্ডট আর স্কিনার।

মরিসন আমাকে বলল, স্টুয়ার্টকে ও দেখেছে ডুবে যেতে। জাহাজটা যখন তলিয়ে যায় তখনও সে লাফ দিতে পারেনি। লাফ দেওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে, এই সময় ভারী একটা কাঠের টুকরো পানির নিচে থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে আঘাত করে ওর থুতনিতে। এক মুহূর্ত পরেই ও তলিয়ে যায় সাগরে। শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল আমার। তেহানি আর হেলেনকে ছেড়ে আসার সময় যেমন হয়েছিল অনেকটা তৈমন।

বেলে চরাটায় নামলাম আমরা। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস নৌকার পাল এবং দাঁড় দিয়ে তাবু খাটানোর নির্দেশ দিল। এখানে দুদিন রইলাম আমরা। এর ভেতর নৌকাগুলোকে দীর্ঘ যাত্রার জন্যে তৈরি করে ফেলল ছুতোর মিস্ত্রীরা। আমরা যারা বন্দী তাদের সঙ্গে বন্দীর মত আচরণ করা হচ্ছে আগের মতই। চরায় নামার পর পরই চার জন মাস্কেটধারীকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের। পাহারা দেয়ার জন্যে। জাহাজ থেকে নামানোর সময় তাড়াহুড়োর ভেতর যতখানি সম্ভব খাবার এবং পানীয় ওঠানো হয়েছিল নৌকাগুলোয়। এই দুদিনে তা থেকে এক কণাও খরচ করতে দিল না ক্যাপ্টেন। ক্ষুধা তৃষ্ণা যখন অসহ্য হয়ে উঠল শামুক ঝিনুক যা পেলাম সৈকতে কুড়িয়ে খেয়ে নিলাম। যারা সহ্য করতে পারল, না খেয়ে রইল। ডা. হ্যামিলটন তার ওষুধপত্রের বাক্সটা বাঁচাতে পেরেছেন। এজন্যে খুব খুশি তিনি। এক ফাঁকে আমাকে জানালেন, আমার পাণ্ডুলিপিগুলোও বাঁচাতে পেরেছেন।

অগাস্টের একত্রিশ তারিখ সকালে নৌকাগুলো পানিতে ভাসানো হলো আবার। ডাচ উপনিবেশ টিমোর-এর পথে রওনা হলাম আমরা।

অবর্ণনীয় দুঃখ আর কষ্ট ভোগ করে পনেরো সেপ্টেম্বর মাঝরাতে যখন আমরা টিমোর দ্বীপের কুপ্যাঙ-এ পৌঁছুলাম তখন আমাদের শরীরে হাড় আর চামড়া ছাড়া কিছু নেই। শরীর জুড়ে তৃষ্ণা। ক্ষুধার অনুভূতি লোপ পেয়েছে অনেক আগে।

পুরো উপনিবেশ তখন ঘুমিয়ে। রাতটা শান্ত। নক্ষত্র খচিত স্বচ্ছ আকাশ। কূলের যেখানে আমাদের নৌকা ঠেকেছে তার কাছেই নোঙ্গর করে আছে একটা জাহাজ আর দুতিনটে ছোট ছোট জলযান। তীরের সামান্য ওপাশে একটা দুর্গ। তার উঁচু প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে করুণ সুরে আর্তনাদ করছে একটা কুকুর। আর কোন শব্দ নেই চরাচরে। নৌকার যেখানে যে যেমন ভাবে ছিলাম ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সূর্য অনেকখানি উঠে আসার আগে সে ঘুম কারও ভাঙল না।

.

ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস আর তার সঙ্গীরা নিঃসন্দেহে উপভোগ করেছে কুপ্যাঙ এর দিনগুলো। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অতিথি হয়ে থেকেছে। বন্দীরাও আতিথেয়তা পেয়েছে, তবে একটু অন্য ধরনের। অবিলম্বে আমাদের দুর্গের মাটির নিচের একটা কুঠুরিতে নিয়ে আটকানো হলো।

কুপ্যাঙ-এ যতদিন ছিলাম তার ভেতর একরারের জন্যেও এডওয়ার্ডস আমাদের দেখতে আসেনি। তবে ডা, হ্যামিলটন আমাদের ভোলেননি। প্রথম সপ্তাহটা তিনি প্যানডোরার অসুস্থদের সেবায় ব্যয় করলেন-াদের বেশ কয়েকজন পৌঁছানোর কয়েক দিনের মধ্যেই মারা গেল। এরপর একটু অবসর পেতেই স্থানীয় ডাচ সার্জনকে সঙ্গে নিয়ে এলেন আমাদের দেখতে।

অক্টোবরের ছয় তারিখে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ রেমব্যাঙ-এ চাপলাম আমরা জাভা দ্বীপের বাতাভিয়ায় যাওয়ার জন্যে।

রেমব্যাঙ খুব পুরানো জাহাজ। খোলে অসংখ্য ফুটো। কাঠামোটাও নড়বড়ে। প্রথম দিন থেকেই অনবরত পানি সেঁচতে হলো তাকে ভাসিয়ে রাখার জন্যে। বলা বাহুল্য বন্দীদের দিয়েই করানো হলো কাজটা।

অক্টোবরের একত্রিশ তারিখে আমরা পৌঁছুলাম সামারাঙ-এ। এখানে থামার কথা না থাকলেও জাহাজ মেরামত করিয়ে নেয়ার জন্যে থামতে বাধ্য হলেন রেমব্যাঙ-এর ক্যাপ্টেন। কারণ শেষ দিকে পানি ওঠার পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে জাহাজের বেশির ভাগ নাবিককেই আমাদের সঙ্গে হাত লাগাতে হয়েছিল পানি সেঁচার কাজে।

সামারাঙ-এ পৌঁছে সবিস্ময়ে আমরা দেখলাম, মরিসনের স্কুনার রিজোল্যুশন অনেক আগেই সেখানে এসে বসে আছে। হারিয়ে যাওয়ার পর ওরাও খোঁজাখুঁজি করেছিল প্যানডোরাকে। না পেয়ে শেষে এখানে চলে এসেছে। অলিভার অর্থাৎ এডওয়ার্ডস যাকে রিজোল্যশন-এর দায়িত্ব দিয়েছিল সে জানত দেশে ফেরার পথে প্যানডোরা সামারাঙ-এ থামবে, তাই অন্য কোথাও না গিয়ে এখানেই এসেছে।

সামারাঙ-এ রিজোলশন বিক্রি করে দিল এডওয়ার্ডস। যে টাকা পুের তা ভাগ করে দিল প্যানডোরার নাবিকদের ভেতর পোশাক-আশাক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্যে। জাহাজটা যারা বানিয়েছিল তাদের এক শিলিংও দেয়া হলো না। টাকা না পেলেও অন্তত এই ভেবে ওরা সান্ত্বনা পেল যে, যে দক্ষতায় ওরা ছোট্ট স্কুনারটা তৈরি করেছিল তা ইংল্যান্ডের পেশাদার জাহাজ নির্মাতাদের চেয়ে কম নয় কোন অংশে।

রেমব্যাঙ-এর মেরামত শেষ হওয়ার পর আবার আমরা রওনা হলাম। নিরাপদেই পৌঁছুলাম বাতাভিয়ায়। এখানে চার ভাগে ভাগ হয়ে হল্যান্ড পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার জন্যে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চারটে জাহাজে উঠল প্যানডোরার নাবিকরা। লেফটেন্যান্ট পারকিন, মাস্টার, ভাণ্ডাররক্ষক, গোলন্দাজ, কেরানী, দুজন মিডশিপম্যান আর বাউন্টির দশ বন্দীকে নিয়ে ভিডেনবার্গ নামক জাহাজে উঠল ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস। বাকিরা অন্য তিন জাহাজে। সতেরোশো বিরানব্বই-এর পনেরো জানুয়ারি উত্তমাশা অন্তরীপে পৌঁছুল ভিডেনবার্গ। এইচ.এম.এস গরগন তখন অপেক্ষা করছে সেখানে, শিগগিরই ইংল্যান্ডের পথে রওনা হবে। সদলে এডওয়ার্ডস ভিডেনবার্গ থেকে নেমে গরগনে উঠল।

প্রায় তিন মাস আমরা অন্তরীপে রইলাম। পুরো সময়টা অন্তরীণ থাকতে হলো গরগনে। জাহাজটার ক্যাপ্টেন মিস্টার গার্ডনার অভাবনীয় সদয় ব্যবহার করলেন,আমাদের সাথে। চার হাত-পায়ের বদলে শুধু এক পায়ে বেড়ি পরিয়ে বেঁধে রাখলেন। পুরানো একটী পাল ভাজ করে দিলেন রাতে শোয়ার জন্যে। একটানা বারো মাস যারা খালি মেঝেতে কাটিয়েছে তাদের কাছে রীতিমত্ব বিলাস মনে হলো ব্যাপারটা। জাহাজ যখন সাগরে ভাসল প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা করে ডেকের খোলা হাওয়ায় কাটানোরও অনুমতি দিলেন আমাদের ক্যাপ্টেন গার্ডনার। এসব দেখে মনে মনে জ্বললেও কিছু বলতে পারল না এডওয়ার্ডস, কারণ জাহাজটা তার নয়।

জুনের উনিশ তারিখে আমরা স্পিটহেড-এর অদূরে পৌঁছুলাম। সেদিনই সন্ধ্যার আগে পোর্টসমাউথ বন্দরে, নোঙ্গর ফেলল গরগন। বাউন্টিতে চেপে যেদিন পোর্টসমাউথ থেকে রওনা হয়েছিলাম তারপর চারবছর ছমাস কেটে গেছে, এর ভেতর প্রায় পনেরো মাস আমরা কাটিয়েছি শিকল বাঁধা অবস্থায়।

<

Super User