রোধ – গোলাম মাওলা নঈম
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৯

০১.

হোয়াইটস্টোন শহরটা ছোট, সব মিলিয়ে শখানেক লোকের বাস। মূল রাস্তার দুপাশে ফুটপাথ ছাড়িয়ে যথেষ্ট দূরে সারি সারি বাড়ি আর দোকান-ঘর। রাস্তাটা দক্ষিণে গির্জাতক আর উত্তরে রঙজ্বলা একটা সাইনবোর্ড পর্যন্ত দীর্ঘ। পশ্চিমে ঢালু জমি মাইলখানেক তফাতে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে মিশেছে। আর পুবে ফ্রগস রীভারের ওপারে দিগন্তজোড়া তৃণভূমি।

জেথ্রো ম্যাকলীন যখন হোয়াইটস্টোনে প্রবেশ করল তখন দুপুর। গ্রীষ্মের সূর্য সর্বত্র উত্তপ্ত হলকা ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রায় ফাঁকা মূল রাস্তা ধরে এগোল সে। বছর চার আগে একবার এসেছিল এখানে, একটা রাত কাটিয়ে সনোরার ট্রেইল ধরেছিল। শুরুতে এ শহরে একটা সেলুন কাম স্টোর, দুটো হোটেল আর একটা আস্তাবল ছিল কেবল। পশ্চিমে পাহাড়ের কোলে ছিল মাইনারদের আস্তানা। প্রকৃতির ভাণ্ডার ফুরিয়ে যেতে কেটে পড়েছে ভাগ্যান্বেষী লোকগুলো, আর ছোট্ট হোয়াইটস্টোন পরিণত হয়েছে ক্যাটল টাউনে। এর আশেপাশে এখন বেশ কটা বড়সড় বাথান।

কয়েক সারি দোকান পেরিয়ে বামে একটা আস্তাবল চোখে পড়ল। দূর থেকে পরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। সামনে এসে স্যাডল ছাড়ল জেথ। জোয়ান একটা ছেলে বেরিয়ে এসে ভেতরে নিয়ে গেল ঘোড়াটাকে। পোর্চে একটা বেঞ্চি, তাতে বসে সিগারেট রোল করল ও। ধরিয়েছে এ-সময় ফিরে এল তরুণ হসল্যার। চোখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে দেখল ওকে, তারপর সহজ কণ্ঠে জানতে চাইল, দূর থেকে আসছ?

নড করল জেথ। অনর্থক প্রশ্ন, ওর ঘোড়াটার ক্লান্ত শরীর দেখে বুঝে নিয়েছে ছেলেটা। কিন্তু এটাকে আলাপ শুরুর উপায় ভেবেছে।

তোমার ঘোড়াটা দারুণ! বুনো ছিল একসময়, তাই না?

বোঝা যাচ্ছে সুযোগ পেলে ছেলেটা কথা বলতেই থাকবে। উত্তর না দিয়ে রাস্তার ওপাশের বাড়িগুলোর দিকে নজর দিল জেথ। গলা ভেজানো দরকার। দুশো মাইল পাড়ি দিয়েছে, শরীর জুড়ে কেবল ক্লান্তি।

ওর ঊরুতে বাধা হোলস্টার আর পিস্তলের দিকে তাকাল ছেলেটা, চোখে মুখে নগ্ন আগ্রহ। তুমি কি মিলারের আউটফিটে যোগ দিতে এসেছ?

মাথা নাড়ল সে।

তাহলে নিশ্চয়ই ম্যাকলীনরা তোমাকে ভাড়া করেছে?

এবারও না-সূচক জবাব জানাতে হলো।

তাহলে… হতাশ দেখাল ছেলেটাকে, চিন্তিত। একটা শো-ডাউন তো হবেই। জেরেমি মিলার এত সহজে ছেড়ে দেবে না। এজন্যে একগাদা লোকও আনিয়েছে সে, অথচ ম্যাকলীনদের লোকগুলো ঠিকমত পিস্তলও চালাতে পারে না।

ছেলেটার হাতে দুটো রুপোর ঈগল ধরিয়ে দিল জেথ। বুটের তলায় পিষে ফেলল সিগারেটের বাকি অংশ, তারপর হেঁটে চলে এল ফুটপাথে। একটা বাকবোর্ড পেরিয়ে যেতে ধুলোয় ঢেকে গেল চারপাশ। উৎকট গন্ধ এসে নাকে লাগছে, সেই সাথে চোখে-মুখে এসে পড়ছে ধুলো। ব্যানডানা টেনে নাকের গোড়া পর্যন্ত তুলে দিল ও। তারপর সাইডওঅক ধরে হেঁটে সরে এল জায়গাটা থেকে। ধুলো সরে যেতে দক্ষিণে এগোল। হাতের বামে একটা বড়সড় দালান চোখে পড়ল-দুপাশের বাড়িগুলোর চেয়ে আলাদা, শহরের গুটি কয়েক দালানের একটা। হোল্ডেন ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড এর উল্টোদিকে হোয়াইটস্টোনের সবচেয়ে পুরানো সেলুন-লুইফস কর্নার। আগের মতই আছে-বাইরে থেকে অগোছাল ও অপরিচ্ছন্ন। কিন্তু লুইফ বেক্সটারের আন্তরিক হাসি আর হুইস্কিই সেলুনটার বড় আকর্ষণ।

শূন্য রাস্তা পেরিয়ে সেলুনে ঢুকল জেথ। দুপুরের অলস সময় পার করছে জনা বারো লোক। বেশিরভাগই নিরীহ গোছের, কেবল কোণের তিনজন ছাড়া। এক নজর দেখেই বলে দেয়া যায় ঝামেলাবাজ।

বারের সামনে টুলের সারির একটায় বসে পড়ল ও। তিন পাঞ্চারকে পরিবেশন করে ফিরছিল লুইফ বেক্সটার, নতুন খদ্দেরের ওপর চোখ পড়তে থমকে গেল মুহূর্তের জন্যে। খুঁটিয়ে দেখল খানিক, তারপর হাসল। হাউডি, জেথ! ভেবেছিলাম মরে ভূত হয়ে গেছ! নিখাদ কৌতুক তার চোখে। বারের ওপাশে গিয়ে তাক থেকে বোতল আর পরিষ্কার গ্লাস নামাল, গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে সেটা ঠেলে দিল। পাক্কা চারটে বছর! অথচ কথা ছিল বছর ঘোরার আগেই এদিকে আরেকবার ঢুঁ মারবে…অন্তত নিজের বাড়িতে তো ফিরবে!

হুইস্কিতে চুমুক দিল ও। জানে সেরা জিনিসটাই দিয়েছে লুইফ। আড়চোখে তাকাল কোণের তিনজনের দিকে।

সেলুন-মালিক হাসল। ওরা আসার পর আমার বিক্রি বেড়েছে। খানিকটা ঝামেলা অবশ্য করেছে। একটু-আধটু সইতেই হয়, নইলে এটা সেলুন নাকি?

লুইফের স্বভাবের সাথে মিলছে না, আপসের সুরে কথা বলছে সে। এমনটা ও কখনোই ছিল না, ভাবছে জেথ। অনেক আগে থেকে চেনে ওকে, সনোরায় পরস্পরের প্রতিবেশী ছিল ওরা। এখানে এ শহরের শুরুতে জেথ তাকে দেখেছে আপসহীন এক মাইনার হিসেবে, সঙ্গীরা কেটে পড়ার পর সেলুনের ব্যবসা শুরু করে সে। তখনও, কেবল ভাল লোকের জন্যেই উন্মুক্ত ছিল এ সেলুনটি। সারা তল্লাটে বেপরোয়া লোক হিসেবে ওকে জানত সবাই, পারতপক্ষে কেউ ঘাটাত না। তবু ঝামেলা যে হত না তা নয়, কিন্তু লুইফ অনায়াসে সামাল দিত সেগুলো। বয়সের ভারে দুর্বল? ভাবল ও, উঁহু, চল্লিশ পেরোয়নি এখনও, ত্রিশ বছরের যুবকের মতই সুঠাম শরীর…মারিয়া? হবে হয়তো।

অভ্যস্ত হাতে কয়েকটা গ্লাস মুছছিল লুইফ। সবল হাতজোড়া দেখে বোঝা যায় অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে-ওর হাতের বুড়ো আঙুলে হ্যামার টানার দাগ নেই।

ধরে ফেলেছ না? তিক্ত হাসল সেলুন-মালিক, বয়স বেঈমানি করছিল, আর ওদিকে মারিয়ার চাপ…মারিয়াকে তো চেনোই, যা জেদী! তাই সব ছেড়ে…

পানীয় শেষ করল জেথ। নির্জলা হুইস্কি ক্লান্তি অনেকটাই তাড়িয়ে দিয়েছে। অস্বস্তিকর ভাবটা অবশ্য যায়নি, গোসল সেরে একটা লম্বা ঘুম দিলে কেটে যাবে।

রোয়ানা তোমাকে খবর দিয়েছে নাকি? চাপা স্বরে জানতে চাইল লুইফ, আড়চোখে একবার দেখল তিন ঝামেলাবাজকে। উঁহু, এমনিতে আসার লোক তুমি নও। তোমার পরিবার বসতি করল এখানে, তারপরও এলে না-অদ্ভুত মানুষ তুমি, জেথ!

চুপ করে থাকল জেথ।

কয়েকদিন থাকবে নাকি?

শ্রাগ করল ও।

একটুও বদলাওনি তুমি! স্পষ্ট হতাশা লইফের কণ্ঠে, যাকগে, রাতে এসো, একসাথে সাপার করব। জেথকে মানিবেল্টে হাত দিতে দেখে খেপে গেল এবার। খোদার কসম, ওকাজটা করলে তোমার মাথায় আস্ত একটা বোতল ভাঙব আমি!

ইঙ্গিতে শুভেচ্ছা জানিয়ে বারের ওপর থেকে টুপি তুলে মাথায় চাপাল জেথ। বেরোবার আগে খেয়াল করল ঝামেলাবাজদের একজন উধাও হয়েছে।

সেলুন থেকে বেরিয়ে পোর্চে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল জেথ্রো ম্যাকলীন। একটা সিগারেট রোল করল। দুপাশে যদূর চোখ যায় নিরীখ করল শহরটা ঝিম মেরে আছে যেন। অথচ আজ পে-ডে, পাঞ্চারদের ভিড়ে সরগরম থাকার কথা।

দক্ষিণে, শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে গির্জার দেয়ালের কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে কেউ, কোন ভবঘুরে বোধহয়। লোকটার সামনে একটা কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। সারি সারি দোকান আর বাড়ির ওপর চোখ বুলাল সে, ম্যাকলীনদের ফ্লাওয়ার মিলের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল না। মিলটা হয়তো রাস্তার পশ্চিমে কিংবা গির্জা ছাড়িয়ে শহরের বাইরে।

দক্ষিণে মিনিট কয়েক হাঁটার পর ডানদিকে চোখে পড়ল দালানটা। একপাশে এক কামরার অফিস-ঘর, দরজার ওপর ছাদে সাইনবোর্ড ঝুলছে। নিশ্চিত হয়ে এগোল সেদিকে। কাঁচের দরজার ওপাশে আবছা আঁধার, বাইরে থেকে ভেতরের কিছু চোখে পড়ছে না। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল জেথ, চোখ সয়ে আসার পর টের পেল সাজানো একটা কামরায় উপস্থিত হয়েছে। পরিচ্ছন্ন দেয়ালে কয়েকটা পেইন্টিং। দরজার উল্টোদিকের জানালায় দিগন্ত আর পর্বতশ্রেণীর ধূসর অবয়ব। তবে সবচেয়ে চমৎকৃত করার মত ব্যাপার হচ্ছে বিশাল আয়তাকার টেবিলের ওপাশে আরামদায়ক চেয়ারে আসীন, এক মেম্বার উপস্থিতি।

রোয়ানাকে চিনতে একটু কষ্টই হলো।

অনেক কিছুই বদলেছে ওর, ভাবছে জেথ। পাঁচ বছর আগের নিখুঁত মুখটা আর নেই, রং ঝলসে গেলেও এখনও কমনীয়। বুদ্ধিদীপ্ত কালো চোখে কৈশোরের চপলতা নেই, আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পুরুষালি পোশাক, তবু যতটুকু দেখতে পাচ্ছে। মেয়েলি দেহের পুরোটাই আকর্ষণীয়।

রোয়ানার দৃষ্টি আটকে রইল আগন্তুকের মুখে যদিও সে অনাহুত নয়। সেকেন্ড কয়েক, তারপর উজ্জ্বল হলো সুন্দর মুখটা। চেয়ার ছেড়ে সহাস্যে এগিয়ে এল। জেথ খেয়াল করল হাটার ধরনটাও পাল্টে গেছে, প্রত্যয় মেশানো।

কেমন আছ, জেথ?

নড করে ভাল বোঝাতে চাইল জেথ, চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল।

ভাল না। যেটা আমার কাজ নয় তাই করতে হচ্ছে।

অস্বস্তি বোধ করল সে, একটা চেয়ারে বসে হ্যাটটা কোলের ওপর নামিয়ে রাখল।

জেথের অস্বস্তিটুকু আঁচ করতে পারল রোয়ানা, কারণটাও জানে। ফিরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল। কিছু মনে কোরো না। অভিযোগ করিনি, এমনিতেই বলেছি। ড্রয়ার খুলে কাগজ-কলম বের করে এগিয়ে দিল। সহজ হয়ে বসো, আমি তোমার অপরিচিত কেউ নই।

কাগজ নিয়ে লিখল জেথ: বাবা কেমন আছে?

ভাল, যতটুকু থাকা সম্ভব, পড়ার ফাঁকে জানাল রোয়ানা, লাঞ্চ করেছ?

মাথা ঝাঁকাল ও।

কফি?

সায় পেতে কামরার কোণে চলে গেল রোয়ানা, স্টোভে আগুন জ্বেলে কেতলি চড়াল। ড্রয়ার খুলে বের করল দুটো কাঁচের মগ। পানি ফোঁটার পর, কেতলিতে কফির গুড়ো ঢালার সময় ফিরে তাকাল। জেথ তখন দেখছিল ওকে। কিছুটা অস্বস্তি হলো রোয়ানার, মাথা নেড়ে মনোযোগ দিল মগে চিনি ঢালায়। তুমি আমাকে নতুন দেখছ না, পরিবেশনের সময় স্পষ্টভাবে অনুযোগ করল।

না, লিখল জেথ, কিন্তু অনেক বদলেছ।

কেমন কাটছে তোমার?

শ্রাগ করল সে।

তোমাকে আমার হিংসে হয়, জেথ!

প্রশ্ন ফুটে উঠল ওর চোখে।

তুমি খুব স্বাধীনচেতা, যেখানে ইচ্ছে চলে যাচ্ছে…কোন পিছুটান নেই। বাথান, মিল-এসব মানেই তো টাকা। অথচ এগুলো তোমাকে টানে না। তোমার সাহস…

হাত তুলে রোয়ানাকে থামিয়ে দিল জেথ। কাগজে লিখল: এখানকার, তোমাদের কথা বলো।

তুমি চলে যাওয়ার পর, শেষবার যখন এসেছিলে, চাচা ঠিক করল সনোরা ছেড়ে এখানেই বসতি করবে। লুইফ তো আগেই এসেছে, ওর পরামর্শে র‍্যাঞ্চটা কেনা হলো। একে তো পঙ্গু, তাছাড়া নতুন হিসেবে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না সে, তাই আমি এলাম। তার আগে অবশ্য তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কয়েকবার, তুমি ওকে নিরাশ করেছ। এবার আমি ডেকেছি, তবে পরামর্শটা ওর। এবং তোমাকে আর যেতে দিচ্ছি না। হাসছে রোয়ানা, দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ।

সমস্যার কথা বলোকাগজে লিখল জেথ। ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠছে, বরাবর এ চ্যালেঞ্জটাকে ভয় পেয়েছে সে এবং এজন্যেই এড়িয়ে চলা।

খানিকটা নিরাশ মনে হলো রোয়ানাকে, উঠে নিজের মগ কফিতে ভরে নিল। মৃদু চুমুক দিয়ে শুরু করল ফের, এ মিলের আয়ের অর্ধেকটাই আসে সেনাবাহিনীতে পাঠানো সাপ্লাই থেকে। প্রতি মাসে হাচিনসনে সাপ্লাই পাঠানো হয়, ওখান থেকে ট্রেনে করে একাডেমিতে। চুক্তির ব্যবসা, সময়মত না পাঠালে তা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা।…এর আগে যা হয়নি, হাচিনসন যাওয়ার পথে লুট হয়েছে শেষ দুটো সাপ্লাই। জানার পর অবশ্য আবার পাঠানো হয়েছে-তারমানে দ্বিগুণ খরচ। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে দ্বিতীয়বারে আর লুট হয়নি। প্রথমবার পাহারা দেয়ার জন্যে তোক না থাকলেও গতমাসে তিনজনকে নিয়োগ করেছিলাম। লুট করার সময় কারও গায়ে একটা আঁচড়ও লাগায়নি ওরা।

দুবারের জায়গায় চারবার সাপ্লাই পাঠানোয় প্রায় বিশ হাজার ডলার লোকসান হয়েছে আমাদের। এ ক্ষতিটুকু জেনে-শুনে স্বীকার করে নেয়া কেবল চুক্তিটা টিকিয়ে রাখার জন্যে। একাডেমি শেষ একটা সুযোগ দিয়েছে-এবারের সাপ্লাইটা সময়মত না পৌঁছালে চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হবে ওরা। থেমে কফিতে চুমুক দিল রোয়ানা, চোখ জেথের ওপর। বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কি ভাবছে সে।

তাহলে আমার কাজ হচ্ছে, ভাবছে জেথ, সাপ্লাইটা যাতে ঠিকমত পৌঁছায় তা নিশ্চিত করা-প্রয়োজনে বন্দুকবাজি করে হলেও।

এক অর্থে ব্যাপারটা ওরকমই, রোয়ানা আঁচ করতে পারল জেথের ভাবনা কোন পথে এগোচ্ছে। আমি কেবল একটা সমস্যার কথা বলেছি, আরও আছে-সেগুলোও জানাব। তোমাকেই সব সামাল দিতে হবে, কারণ দুদিন বাদে বাথান আর মিল তুমিই চালাবে। সব বুঝিয়ে দিতে পারলে আমার ছুটি।

ওকে দোষ দেয়া যায় না, ভাবছে জেথ, এসব কাজ একটা মেয়ের জন্যে কষ্টকর বটে। সনোরার আরামদায়ক জীবন ছেড়ে এসেছে মেয়েটা, এতে ওর। নিজের স্বার্থ খুব কমই। ফ্রেডারিক ম্যাকলীনের কাছে নিজের ছেলের চেয়ে। অনাথা ভাইঝিই বেশি কাছের, কারণ বড় হওয়ার পর থেকে বাউণ্ডুলের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। বাপের কাছে থাকার চেষ্টা করেনি, রোয়ানাই ওর অভাবটা পূরণ করেছে।

রোয়ানার চোখে-মুখে চাপা হাসি দেখতে পাচ্ছে জেথ, ওর নাজুক অবস্থাটা। উপভোগ করছে। বিরক্তি লাগল ওর, এরকম ফাপরে পড়বে জানলে আসতই না। ভুল হয়েছে, তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করার সময় ভাবল, এ মেয়েটির চিঠিতে বিপদের আভাস ছিল, গুরুত্ব দেয়া ঠিক হয়নি। দশ দিন আগে প্রেসকটে চিঠিটা পেয়েই হোয়াইটস্টোনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল।

তোমাদের আশা পূরণ হচ্ছে না, লিখল জেথ, আমি থাকব না।

আর কত দিন এভাবে সরে থাকবে, জেথ? এক সময় এসবের দায়িত্ব তোমাকে নিতেই হবে, সহানুভূতি রোয়ানার কণ্ঠে। দেরি করলে কেবল ক্ষতিই। বাথান বা মিল চালানো পুরুষদেরই কাজ। সবচেয়ে বড় কথা আমি কুলিয়ে উঠতে পারছি না। শুরুতে সবকিছু গুছিয়ে নিতে চাচা খুব পরিশ্রম করেছে, সামলে উঠতে পারেনি আর। আগে ওর কাছ থেকে পরামর্শ পেতাম, এখন তাও পাচ্ছি না। নিজের কামরা ছেড়ে খুব একটা বেলোয়ই না। তুমি ফিরে এসেছ এটা ওর জন্যে দারুণ খুশির খবর।

জেথ দ্বিধান্বিত, আনমনে অগোছাল চুলে আঙুল চালাল। বিস্বাদ লাগায় বুটের তলায় পিষে ফেলল সিগারেটটা।

তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চলো, বাথানে গিয়ে গোসল সেরে বিশ্রাম নেবে।

উঠল না জেথ, ভাবছে।

কফি দেব?

সায় দিতে মগটা ভরে দিল রোয়ানা।

খানিক পর কাগজে লিখল জেথ: সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে তুমি কেটে পড়তে পারবে না। যা আছ তা-ই থাকবে, আমি কেবল সাহায্য করব তোমাকে।

কত দিন?

হাসল জেথ, ভবিষ্যতের কথা বোঝাতে চেয়েছে মেয়েটা। যদ্দিন না তোমার। অধিকার পাচ্ছে কেউ, ফের লিখল জেথ, তার আগে যদি সরে পড়তে চাও তো আমিও কেটে পড়ব।

সহাস্যে এগিয়ে এল রোয়ানা। তুমি কিন্তু ফেঁসে গেলে…আমি আগে থেকে জানতাম। কেবল চেয়েছি-একবার তোমাকে পেলেই হলো…রাজি করাতে কষ্ট হবে না।

.

বাক টার্নার সর্বাগ্রে, তার পেছনে সাত জন।

কলোরাড ক্যানিয়নে কাটানো গত দুটো মাস মোটেও সুখকর ছিল না টার্নারের জন্যে। ঘঁাচোড় এক বাউন্টি হান্টার পিছু নিয়ে ঢুকে পড়েছিল ক্যানিয়নের গভীর পর্যন্ত, হাইড-আউটের একেবারে কাছাকাছি। বাধ্য হয়ে আঙুল বাকাতে হয়েছে তাকে। আর যাই হোক ওর চেয়ে বেশি তো আর কেউ কলোরাডো ক্যানিয়ন চেনে না।

বজ্জাত বাউন্টি হান্টার মারা যাওয়ার পর হাজির হয়েছিল তার বন্ধুরা। অবস্থা বেগতিক দেখে সবার চোখে ধুলো দিয়ে সটকে পড়েছে সে। এরপর রেডরকে মিলিত হয়েছে অন্যদের সাথে। ওখানেই স্থির করে হোয়াইটস্টোনে আসবে। শেষ দাও মারার পর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, পকেটে রয়েছে কয়েকটা রুপোর ঈগল। রোজগারের পথ তো একটাই, সুতরাং…

বাক টার্নার লোভী তবে নিজেকে সংযত রাখতে জানে, সতর্কও। তাই এমন একটা সময় বেছে নিয়েছে যাতে কাজ হাসিল করতে কোন অসুবিধা না হয়।

দলের লোকগুলো ওকে যমের মত ভয় পায়, টার্নারের হিংস্রতা কারও অজানা নয়। একটা নীতিই পাঁচটি বছর ধরে রেখেছে সবাইকে-টার্নার সমবণ্টনে বিশ্বাসী। অপরাধ জগতে একমাত্র সে-ই দলের লোকদের সমান বখরা দেয়। আর এ কারণে সবাই ওর অনুগত এবং বিশ্বাসী। পাঁচ বছরে দলের সদস্য-সংখ্যার হের ফের হয়নি, একেবারে শুরুতে যারা ছিল তারাই রয়ে গেছে। আইনের হাতে ধরা পড়েনি কেউ, এর কারণ টার্নারের পরিকল্পনাগুলো নিখুঁত। নেতা হিসেবে নিজের কাজে সে সেরা।

বাক টার্নারের চওড়া মেক্সিকান হ্যাট তোবড়ানো। নোংরা ফ্লানেলের শার্ট, তার ওপর ভেস্ট চাপিয়েছে। ঝলসে গেছে ডেনিম প্যান্টের রং। কলোরাডো ক্যানিয়ন ত্যাগ করার পর আর ক্ষৌরি করা হয়নি মুখ। চাকচিক্য কেবল একটি জিনিসে-পিস্তলের বাটে। হলুদ ব্যানডানা গিঁট দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। বুটজোড়া দুর্গম যাত্রার জন্যে যুৎসই। দলের সেরা ঘোড়াটা তার।

আটজনের দলটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রবেশ করল হোয়াইটস্টোনে। কোথায় মিলিত হতে হবে জানা আছে সবার। তস্কর-নেতা আশ্বাস দিয়েছে সহজে কাজটা সারা যাবে। খুঁতখুঁতে স্বভাবের লেইভ পিটার্স নিয়ম মাফিক গোঁ ধরেছিল ঠিকই, কিন্তু নেতার চড়া গলা তাকে নিরস্ত করেছে শেষতক। সবার আগে এখন সে-ই হোল্ডেন ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড-এর সামনে পৌঁছাল, শহরে ঢোকার পর অবস্থা দর্শনে তার মধ্যেই উৎসাহ বেশি।

ব্যাংকের সামনে ওরা এমনভাবে অবস্থান নিয়েছে যে ওদের আসল উদ্দেশ্য কেউই বুঝতে পারবে না। টার্নারের ঘোড়ার খুরের দাপটে ফুটপাথ থেকে সরে গেল একটা নেড়ি কুকুর। স্যাডল ছেড়ে ধূলিময় রাস্তায় নামল সে, হ্যাট খুলে অবিন্যস্ত চুলে আঙুল চালাল। দুই তস্কর ইতোমধ্যে হাঁটতে শুরু করেছে লুইফস কর্নারের পানে, ঠিক তিন মিনিট পর বেরিয়ে আসবে। পুরো দলের আচরণে মনে হচ্ছে সপ্তাহান্তের ফুর্তি করতে শহরে এসেছে কোন আউটফিট, আর তাদের মালিক ব্যাংকে ঢুকছে টাকা তুলতে, বেরিয়ে এসে পাপ্পারদের পাওনা মেটাবে। সবচেয়ে বড় সুবিধে আজ পে-ডে।

স্লিম, পিট, বাইরে নজর রাখবে তোমরা। কার্লি, আমার সাথে এসো, চাপা স্বরে নির্দেশ দিল বাক টার্নার।

অলস ভঙ্গিতে স্যাডল ছাড়ল ওরা। পরিকল্পনা মাফিক টার্নার ছাড়া অন্যরা আপাতত নিরস্ত্র, স্যাডল বুটে একটা রাইফেলও নেই, তবে লুকানো অস্ত্র রয়েছে। তস্কর-নেতা চেয়েছে তার পরিকল্পনা নিখুঁত হোক-এ অবস্থায় দেখলে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না কেউ। অস্ত্র ছাড়া কি ডাকাতি হয়?

স্লিম ও পিটার্স ব্যাংকের সিঁড়িতে বসে গল্প শুরু করল। টার্নারের পিছু নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল কালি রাফ।

চারজন কর্মচারী যার যার ডেস্কে কাজ করছে। একপাশে কাচ-ঘেরা কামরাটা জুলিয়াস হোল্ডেনের। টার্নার সামনে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত কিছুই টের পেল না ব্যাংকার। তস্কর-নেতার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকাতে সিক্সগানের। ভয়ঙ্কর নল চোখে পড়ল। অস্ত্রের পেছনের লোকটাকেও কম ভয়ঙ্কর মনে হলো না। ধাক্কাটা সামলাতে সময় লাগল, তারপর রাগে ফেটে পড়ল। কিন্তু মুখ ভোলার। আগেই হুমকি দিল টার্নার, বোকামি কোরো না, আমি তামাশা করছি না। বেচাল দেখলেই গুলি করব।

কি চাও?

এত সহজ ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না? টার্নারের কণ্ঠে বিদ্রূপ। ব্যাংকের মত জটিল ব্যবসা চালাও কি করে! শীতল চাহনি তার চোখে, একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল। স্রেফ খুলে সব টাকা ঢোকাও এটায়-শুধু নোট।

মনে হলো প্রতিবাদ করবে জুলিয়াস হোল্ডেন, কিন্তু টার্নার হ্যামার টানতে ব্যর্থতায় ঝুলে পড়ল তার কাঁধ। কাঁপা হাতে পকেট থেকে চাবি বের করে সেফ খুলল, ভেতরে ভঁজ করা নোটের বান্ডিল থলেয় ভরতে শুরু করল।

ঠিক এ-সময়ে বাইরে, সিগারেট ধরিয়ে সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করছে পিটার্স, এখান থেকে কত পাব ধারণা করতে পারছ, স্লিম?।

কঠিন চোখে তাকাল স্লিম বেকার। এত উতলা হচ্ছ কেন? সব কিছু আগে ভালয় ভালয় শেষ হোক।

চুপসে গেল তরুণ, বিচিত্র শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করল। এক্কেবারে মরা শহর! বাড়ি আর দোকানগুলোর ওপর ওর চোখ।

সেলুনে গিয়ে একবার শুধু বলে এসো ব্যাংকে ডাকাতি হচ্ছে, সহাস্যে বলল বেকার, তারপর দেখবে কেমন যাদু দেখায় এখানকার লোকেরা।

সব, একটা নোটও যেন পড়ে না থাকে, ব্যাংকের ভেতরে, হোল্ডেনকে তাগাদা দিচ্ছে টার্নার, তার চুপসানো মুখ দেখে হাসল। তুমি একটা আস্ত গাধা! আমাকে দেরি করিয়ে দিতে গিয়ে মরতে চাও নাকি? তোমাকে গুলি করতে একটুও কাঁপবে না আমার হাত, বরং একটা সীসা অযথা খরচ হবে বলে দুঃখ পাব।

এর জন্যে পস্তাতে হবে! জেদের সুরে ঘোষণা দিল ব্যাংকার। সব কটাকে গারদে ঢুকিয়ে ডাকাতি করার মজা টের পাওয়াব।

 তামাশা করছ? শীতল দৃষ্টি হানল বাক টার্নার, এ জিনিসটা আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা কোরো না! সব নোট ইতোমধ্যে থলেয় ঢোকানো হয়ে গেছে, তস্কর-নেতা সেটা কেড়ে নিল। বাক টার্নারকে ধরা এত সহজ নয়। চেহারা তো দেখিয়ে গেলাম, তোমাদের বুড়ো মার্শালকে জানিয়ো। দেখব ধরতে পারে কি-না।…কারও যদি মরার খায়েশ হয়ে থাকে, তো বাধা দাও আমাকে! বেরিয়ে যাওয়ার সময় পিস্তল নাচিয়ে ঘোষণা দিল সে।

টার্নার বেরিয়ে যাওয়ার পর ভেতরে রয়ে গেল কার্লি রাফ। কাঁচের দরজা গলে তাকাল সে, সবাই স্যাডলে চাপার পরও অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। যখন মনে হলো অন্যদের যথেষ্ট সময় দেয়া গেছে, শেষবারের মত নজর বুলাল ব্যাংকার আর স্টাফদের ওপর। সিক্সগান হাতে এরপর বেরিয়ে এল ফাঁকা রাস্তায়। দলটা সটকে পড়েছে।

ঘোড়াটা তৈরিই ছিল, ছুটে গিয়ে স্যাডলে চাপল কার্লি। ঊধ্বশ্বাসে ঘোড়া দাবড়াল উত্তর দিকে।

পেছনে, পোর্চে এসে দাঁড়িয়েছে জুলিয়াস হোল্ডেন, ক্রমাগত গাল বকছে। স্টাফদের একজন একটা রাইফেল এনে গুলি করল ছুটন্ত কার্লি রাফকে, লাগাতে পারল না।

হোয়াইটস্টোন থেকে মাইল পাঁচ দক্ষিণে নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হলো দলটা। এবার কোন দিকে, বাক? জানতে চাইল স্লিম।

পুমাস ক্যানিয়নে রাত কাটাব আমরা।

কিন্তু ওটা তো কানা! ঢোকার মুখে যদি একজন লোকও বসে থাকে তো আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়ব, হয় ধরা দিতে হবে নয়তো না খেয়ে মরতে হবে।

এ শহরের লোকগুলো সব ভীতুর ডিম! ওরা পাসি নিয়ে তাড়া করবে আমাদের!? মার্শাল বেটা নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় সারাদিন। এই যে কাজটা সেরে এলাম, গিয়ে দেখো টেরই পায়নি সে।

গোলমেলে ঠেকছে ব্যাপারটা, সন্তুষ্ট হতে পারছে না শ্লিম বেকার, কিন্তু তর্কও করল না সে।

.

০২.

 ম্যাকলীনরা ডাকাতির খবরটা পেল বিকেলে শহরে ফিরে।

অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এসে উত্তরে এগোল বোয়ানা। ব্যাঙ্কের সামনে ভিড় করেছে শহরের তাবৎ লোকজন। ক্ষণিকের জন্যে থেমে সেদিকে একবার তাকাল ও, তারপর এগোল আবার। কয়েকটা বাড়ি পরেই মার্শালের অফিস। রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল রোয়ানা। জেথ অনুসরণ করল ওকে।

কামরাটার অবস্থা যাচ্ছেতাই। দরজার ঠিক উল্টোদিকে, দেয়ালের কাছে একটা টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার। পাশে স্টোভ আর একটা ঢাকনাবিহীন কেতলি। এককোণে গানরাকে পুরানো আমলের দুটো শটগান এবং কয়েকটা রিপিটার। সারা ঘরের দেয়ালে সাঁটা ওয়ান্টেড পোস্টারগুলো ধূলিমলিন। পেছনে সেল ও লিভিং রুম।

সবার আগে অবশ্য টেবিলের ওপাশে চেয়ারে বসা বুড়োর ওপর জেথের চোখ পড়ল। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে লোকটার বয়স। অবিন্যস্ত সাদা চুল। বিশাল গোঁফজোড়া অবহেলায় ঝুলে আছে ঠোঁটের পাশে। চর্বিবহুল গাল আর চিবুকে ছোট কাঁচা-পাকা দাড়ি। চাহনিতে স্পষ্ট জীবনযুদ্ধে পরাজিত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। বয়সের ভারে একাধারে দুর্বল ও অসহায়। একসময় হয়তো শৌর্য-বীর্য ছিল, এখন নেই। লোকটি ডীন থর্টন, হোয়াইটস্টোনের আইনের মানুষ।

কেমন আছ, রোয়ানা? ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চাইল বুড়ো।

প্রত্যুত্তরে মাথা ঝাঁকাল রোয়ানা, একটা চেয়ার টেনে বসল।

উঠে স্টোভে পানি চড়াল মার্শাল। ফিরে এসে আয়েশ করে বসল, তারপর দুমড়ানো একটা সিগার ধরাল। ভুসভুস করে ধোয়া ছেড়ে ফিরল জেথের দিকে।

ও জেথ, জানাল রোয়ানা।

ফেরারী ছেলেটা? কৌতুক বুড়োর চোখে, নড করল জেথের উদ্দেশে। তোমার কথা শুনেছি। আমার ধারণা কি জানো, তুমি আমার চেয়েও বিটকেলে।

মৃদু হাসল জেথ, মার্শালকে ভাল লেগেছে।

ওরা আসছে, না? রোয়ানার উদ্দেশে জানতে চাইল বুড়ো।

নিশ্চিত থাকতে পারো।

এই লোকগুলো আর শহরটাই আমাকে শেষ করে দিয়েছে। বিরক্তি প্রকাশ করল থর্টন, এমন মরা শহর আর দেখিনি! চেয়ারে বসে থেকে থেকে সবকিছু হারিয়েছি আমি।

পর পর তিনজন কামরায় প্রবেশ করল এ-সময়। প্রথম লোকটি থর্টনের মতই মোটাসোটা, সদ্য ক্ষৌরি করা মুখে ঘাম চিকচিক করছে। লোকটা ডগলাস গ্রীন, পরে জেনেছে জেথ, হোয়াইটস্টোনের বড় হোটেলটার মালিক।

আরেকজন বেশ লম্বা, ছফুটের বেশিই হবে। গম্ভীর মুখে অভিজ্ঞতা আর প্রত্যয়ের ছাপ। গাঢ় নীল চোখে বুদ্ধিদীপ্তি। পরনে দামী কাপড়। সবল ডানহাতে একটা পাইপ। বোঝা কষ্টকর নয় যে আভিজাত্য তার হাতের মুঠোয় নিজের গড়া। অপরিপাটি পোশাক আর তোবড়ানো হ্যাটে তাকে অবশ্য সাধারণ কোন বাথান-মালিক বা ব্যবসায়ীর মত মনে হতে পারে। সে উইলসন হলেন-জাজ।

অন্য লোকটি ব্যাঙ্কার জুলিয়াস হোল্ডেন। এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী। সুঠামদেহী লোকটির সারা মুখে ঘন কালো দাড়ি। ক্লিষ্ট মুখ, ভাবটা এমন যেন এখানে, এ শহরে কিংবা খোদ দেশটাতে আগ্রহী হয়ে দেখার কিছু নেই। বাক টার্নার তাকে ভালই চোট দিয়েছে, ভাবল জেথ্রো ম্যাকলীন।

একে একে আসন দখল করল হোয়াইটস্টোনের তিন শীর্ষপুরুষ।

নিশ্চয়ই শুনেছ হোল্ডেনের ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয়েছে? জাজই শুরু করল, মার্শাল মাথা ঝাঁকাতে খেই ধরল। বেজন্মাগুলোকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। একটা পাসি নিয়ে বেরিয়ে পড়ো, উীন।

আমার সাথে কে যাবে?

 ওরকম লোকের অভাব আছে, না হয় কখনও?

যে কেউ চাইলেই পাসির সদস্য হতে পারে না। এজন্যে ধৈর্য, সহনশীলতা লাগে। এমন মানসিকতা থাকতে হয় যেন নরক পর্যন্ত ছুটতে পারে। ঝুঁকির কাজ, কারণ আউটলরা কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। সত্যিকারে লড়াই করতে জানে এরকম লোকের সংখ্যা এ শহরে হাতে গোণা কয়েকজন। অন্যরা, আমার ধারণা…

তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ, অভিযোগ করল হোটেল-মালিক।

মোটেও না, সিগারে টান দিল মার্শাল। আমি কেবল ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝাতে চাইছি। আনাড়ী লোক দিয়ে কাজ তো হবেই না পদে পদে ঝামেলা হবে কেবল। তারচেয়ে…আমাকে গোটা চারেক শক্ত-সমর্থ লোক দাও, আমি যাব।

লোক জোগাড় করা কি আমাদের কাজ, ডীন? পাসির জন্যে একজন লোকও যদি পাওয়া না যায়, তোমাকে একাই যেতে হবে। কারণ তুমিই শহরের মার্শাল, এবং এখানে বসে বসে মদ গেলার জন্যে আমরা তোমাকে বেতন দেই না।

থর্টনকে খানিকটা বিচলিত দেখাল, উত্তর দেয়ার সময় গলায় দৃঢ়তা থাকল। এতগুলো বেপরোয়া লোকের মোকাবিলা করা একা কারও পক্ষে সম্ভব নয়, আমিও পারব না। তারচেয়ে, আমার কাছে যথেষ্ট অস্ত্র আছে, তোমরা এলে…

আমরা তোমার ডেপুটি নাকি?

না, তা নও, মেঝেয় সিগার ফেলে বুটের তলায় পিষল মার্শাল। আমার ডেপুটিরা কোথায়, জাজ? অনেকদিন থেকেই তোমাদের বলে আসছি দুজন ডেপুটির জন্যে। কিন্তু তোমরা রাজি হওনি এ কারণে যে হোয়াইটস্টোনে এরকম কিছু ঘটেনি, ঘটবেও না এবং এটা কেবল বাড়তি খরচ।

এখন তো হলো। এবার তোমার দায়িত্ব পালন করো।

ড্রয়ার থেকে ছোট একটা বোতল বের করে, ছিপি খুলে গলায় রঙিন পানীয় ঢালল থর্টন। বিরক্তিতে কুঁচকে গেছে তার কপাল। গোল্লায় যাও কৃপণের দল! আমাকে কয়েকজন ডেপুটি দাও, নয়তো আমি উঠছি। হতচ্ছাড়া এ শহরটায় কাজ করে…

আমরা এখান থেকে না ওঠা পর্যন্ত কোথাও যাচ্ছ না তুমি, ডীন, বাধা দিল জাজ, নির্দেশের মত শোনাল তার কথাগুলো। উঠতে যাচ্ছিল মার্শাল, জাজের তীক্ষ্ণ স্বরে নিরস্ত হলো।

সন্তুষ্টচিত্তে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল জাজ, তারপর স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখল থর্টনকে। তোমার মনে রাখা উচিত কোথায় কে উপরওয়ালা। আমরাই তোমাকে বেতন দেই, ডীন, আর তুমি তা বোতল কিনে কিনে শেষ করছ।

বিড়বিড় করে কি যেন বলল মার্শাল, বোঝা গেল না।

শিগগির একটা পাসি গঠন করতে হবে, খানিক বাদে বলল জাজ। নইলে অনেক দূরে চলে যাবে শয়তানগুলো। শত চেষ্টা করেও তখন আর ধরা যাবে না। একটা পাসি যদি আমরা তৈরি করিও, সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ পাসির লোক যেমন দরকার, এরা মোটেও সেরকম হবে না। এরা না জানে ট্র্যাকিং, না পারে ঠিকমত অস্ত্র চালাতে। খুব বেশি হলে কয়েক মাইল এগোতে পারবে, তারপর ফিরে আসবে।…একটু অন্যভাবে চেষ্টা করলে কিন্তু সবকিছু এভাবে ভেস্তে যাবে না-যদি আমরা মিলারের সাহায্য নিই। ওর লোকেরা ট্র্যাকিং বা অস্ত্রে যথেষ্ট পারদর্শী।

এতক্ষণ চুপ করে ছিল রোয়ানা, জাজের দিকে ফিরল। হোয়াইটস্টোনের কোন ব্যাপারে জেরেমি মিলারের আসা উচিত নয়-অন্তত এভাবে, চাপা ক্ষোভ আর জেদ প্রকাশ পেল ওর কণ্ঠে। সে এখন আর শহর কমিটির কেউ নয়, সবাই একমত হয়ে তাকে বাদ দিয়েছি আমরা এবং সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে তাকে কখনোই কোন ব্যাপারে আর ডাকা হবে না।

শীতল দৃষ্টিতে ওকে দেখছে জাজ উইলসন হলেন। আমাদের সামনে একটা সমস্যা। সেটার সমাধান করাই আসল কথা, কিভাবে হলো তা দেখা কেবল। বোকামিই। তাছাড়া, রোয়ানা, মিলারের আউটফিটের সাথে বিতোমার নিজের সমস্যা, শহর কমিটি কেন তাতে পিছিয়ে যাবে?

বিমূঢ় দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। জাজকে বোঝার চেষ্টা করছে, আনমনে মাথা নাড়ল, হয়তো হতাশায়। তারপর ফিরল জেথের পানে।

দেয়ালে শরীর ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেথ, আগ্রহ নিয়ে দেখছে এবং শুনছে। রোয়ানার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতে ওর মনে হলো মেয়েটা হয়তো পরামর্শ চাইছে। কিন্তু জেরেমি মিলারের ব্যাপারে কিছুই জানা নেই ওর, এমনকি এর আগে নামও শোনেনি। রোয়ানাই এখানে ম্যাকলীনদের প্রতিনিধিত্ব করছে, ভাবছে জেথ, কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার হলে সে-ই নেবে। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার-জেরেমি মিলারের সহযোগিতা চাওয়ার সিদ্ধান্তটা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে জাজ এবং আর কেউ না হোক, রোয়ানা তা পছন্দ করতে পারছে না।

এতগুলো টাকা! ব্যাঙ্কারের কণ্ঠে আক্ষেপ। অন্তত এক লাখ। কারও ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণে টাকাগুলো খোয়া যেতে দেয়া যায় না।

মি. হোল্ডেন, শুধু তোমার নয়, খানিকটা রুক্ষ শোনাল রোয়ানার গলা। মি. গ্রীন এবং আমারও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। লুট হওয়া টাকার বেশির ভাগই আমাদের দুজনের। এছাড়া ছোট ছোট র‍্যাঞ্চার, ব্যবসায়ী আর হোমস্টিডারদের টাকাও। আছে এতে।

এ টাকা তো আমাকেই ফিরিয়ে দিতে হবে।

সেজন্যে তোমরা একটা অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে পারো না।

কি করে এটা অন্যায় হলল, তোমার পছন্দ হয়নি বলে? সরোষে রোয়ানাকে আক্রমণ করল ডগলাস গ্রীন। তোমার পছন্দের যথার্থতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমাদের। কয়েকটা বুড়ো ভামের সাথে ঘুরে বেড়াও-ঘরকুনো স্যাম জারভিস আর মদপোর এই থটনটা হলো তোমার বন্ধু! অথচ মিলারের মত সুদর্শন যুবকের সঙ্গ তোমার ভাল লাগে না, ওকে প্রতিবেশী হিসেবেও পছন্দ হয় না। এ কেমন পছন্দ?

হোটেল-মালিকের মন্তব্যে আহত বোধ করল রোয়ানা, গম্ভীর মুখে দেখল তাকে। তারপর কঠোর হয়ে গেল মুখ-জেদ আর প্রত্যয় সেখানে। ঠিক আছে, জেরেমি মিলারকে ডাকো। আমার আপত্তি নেই। আমি পদত্যাগ করলাম। শহরের কোন ব্যাপারে ম্যাকলীনদের আর কোন অধিকার থাকল না।

বসো, রোয়ানা! মেয়েটা ওঠার উপক্রম করতে জাজ প্রায় ধমকে উঠল, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো, এছাড়া আমাদের কি-ই বা করার আছে। মিলারের লোকগুলো ছাড়া এ শহরে এমন কে আছে যে আউটলদের সামনে দাঁড়াতে পারবে?

ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে রোয়ানা। তোমরা যা ইচ্ছে করো, আমি আর নেই এরমধ্যে। ম্যাকলীনদের ছাড়াও তোমাদের চলবে। জেরেমি মিলার তো আছেই!…একটা ব্যাপার না বলে পারছি না-আমার পিছু লেগেছে লোকটা, তাকে কোনমতেই ছাড়ব না আমি। ম্যাকলীনরা মরা এ শহরটাকে জ্যান্ত করেছে একসময়, তাদেরকে এখান থেকে হটানোর অধিকার নেই কারও। ওরা এখানেই থাকবে, কেউ যদি তাতে বাধা দিতে চায় তো সে বোকা আর দুর্ভাগা।

আমাদেরকে এসব বলছ কেন? বিরক্তি প্রকাশ পেল জাজের কণ্ঠে। তোমার দুশ্চিন্তার কারণটাও অহেতুক। হোয়াইটস্টোন থেকে কে তোমাদের সরাবে শুনি? মিলারের সাথে তোমার এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে দেশছাড়া করতে চাইবে সে। পাশাপাশি দুটো বাথানে এরকম হয়েই থাকে।

কথাগুলো ওই কপট লোকটার জানা দরকার, এজন্যেই তোমাদের বললাম। ঝটিতি ঘুরেই হাঁটতে শুরু করল রোয়ানা। পেছনে চারটে হতভম্ব মুখ, কেউ কিছু বলার আগেই বেরিয়ে গেল মেয়েটা।

জেথ খেয়াল করল জাজের প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে অপমানিত বোধ করছে। আমি বুঝতে পারছি না মেয়েটা এভাবে… হতাশায় কয়েকবার মাথা নাড়ল সে, কিন্তু শেষ করল না।

বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল রোয়ানা, জেথ বেরিয়ে আসতে হাঁটতে শুরু করল। মিল পর্যন্ত একটা কথাও বলল না।

ফেরার পথে দুটো ব্যাপার খেয়াল করেছে জেথ। কয়েকজনের উৎসাহী একটা দল লঅফিসের বাইরে অপেক্ষা করছিল, পাসির সদস্য হয়ে ডাকাতদের তাড়া করতে চাইছে। সব কজন নিরীহ গোছের, এদেরকে সঙ্গে নিয়ে থটনের সাফল্যের সম্ভাবনা কম। বড়সড় আরেকটা দল ব্যাঙ্কের প্রবেশমুখে জটলা করেছে, জুলিয়াস হোল্ডেনের পাওনাদার এরা। ব্যাঙ্কারকে খুজছে লোকগুলো।

অফিসে ফিরে নিজের চেয়ারে অনেকক্ষণ ঠায় বসে থাকল রোয়ানা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল জেথ, তেষ্টা পাওয়ায় স্টোভে পানি চড়িয়ে দিল। সময় নিয়ে কফি তৈরি করল। তীজা কফির ঘ্রাণে সংবিৎ ফিরল রোয়ানার, লাজুকভাবে হাসল। ধন্যবাদ, জেথ। দয়া করে এবার মনোযোগ দিয়ে শোনো, হালকাভাবে নিয়ো না। কফিতে চুমুক দিয়ে শুরু করল ও, চাচা এখানে বসতি করেছিল শান্তিপূর্ণ জীবনের আশায়, ওর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। প্রথম দুবছর চলে গেল বাথানটাকে দাঁড় করাতেই, এরপর মিলটা হলো। জেরেমি মিলার শুরু থেকে লেগে ছিল ওর পেছনে, মিল তৈরি হওয়ার সময় সরাসরি বাধা দেয় সে-চায়নি শহর বা তার কাছে মিলটা তৈরি হোক। এরপর থেকে হোয়াইটস্টোনে নতুন কিছু ঘটতে গেলে দুজনকে দুদিকে দেখা গেছে। আমি আসার পর সম্পর্কটা আরও খারাপ হয়েছে।

মিল আর বাথান চালাতে এমনিতে হিমশিম খাচ্ছিলাম, তারওপর উটকো ঝামেলা হিসেবে মিলার-দিশেহারা বোধ করলাম। গত গ্রীষ্মে রাউন্ড আপের সময় বাধল সত্যিকার গণ্ডগোল। আমাদের কয়েকটা গরুর গায়ে নিজের মার্কা বসাল সে। চাক্ষুষ প্রমাণ নেই, কাজটা শেষ হওয়ার পর আমার ফোরম্যান ওখানে, উপস্থিত হয় এবং চ্যালেঞ্জ করে ওর তিনজন কাউহ্যান্ডকে। বন্দুকযুদ্ধে ওদের একজন মারা পড়ল, আরেকজন আহত হলো। এর দুদিন পরেই নিখোঁজ হয়ে গেল ফোরম্যান লোকটা। কোন প্রমাণ নেই তবু আমি নিশ্চিত যে এটা মিলারের নোংরা হাতের কাজ।

এবার, সামনের রাউন্ড আপে ঝামেলা হবেই। শুরু থেকেই গরু হারাচ্ছিলাম আমরা-ঠিক রাউন্ড আপের সময়। আগে গোপনে হত কাজটা, কিন্তু এবার আর পরোয়া করবে না মিলার। কয়েকজন বন্দুকবাজ আনিয়েছে সে, সৎ উদ্দেশ্যে যে নয় তা পরিষ্কার। সাপ্লাই দুট হওয়ার পেছনে যদি ওর হাত থাকে একটুও অবাক হব না আমি।

এত ঝামেলা আর সমস্যার পর উপরি হিসেবে ব্যাঙ্কে ডাকাতির ব্যাপারটা যোগ হলো। ওখানে প্রচুর টাকা ছিল আমাদের। ক্ষতিটা কোনক্রমেই আর পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, কারণ জুলিয়াস হোল্ডেন এক বছরের মধ্যেও টাকা শোধ দিতে পারবে না। এতটা সামর্থ্য ওর আর নেই। উল্টো সিটি ব্যাঙ্ক থেকে বিরাট অঙ্কের দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ পাবে ও। একসময় যদি পরিশোধ করার সুযোগ হয়ও, ততদিনে ভরাডুবি হয়ে যাবে। এখন যে-টাকা আমাদের হাতে আছে তাতে বাথান ও মিল চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। সবচেয়ে বড় কথা এখানে টিকে থাকতে হলে দুর্বল হওয়া চলবে না।

লুট হওয়া টাকাগুলো কেবল একটা উপায়ে পাওয়া সম্ভব-যদি আউটলদের ধরা যায়। একটা পাসি হয়তো ডাকাতগুলোর পিছু নেবে, কিন্তু শহরের আশেপাশের এলাকার যে অবস্থা তাতে বিফল হয়েই ফিরতে হবে। জাজ মনে করে মিলারের সাহায্য নিয়ে আউটলদের শায়েস্তা করা সম্ভব। কিন্তু সে এরমধ্যে আসবে কেন? এ ব্যাঙ্কে তার টাকা নেই, লাভ ছাড়া কে ঝুঁকি নেয়? হয়তো সাহায্য করবে ও, করলেও তাতে গৃঢ় কোন উদ্দেশ্য থাকবেই। নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করার লোক জেরেমি মিলার নয়। থামল রোয়ানা, অনবরত কথা বলায় হাঁপিয়ে উঠেছে। খেই ধরার আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে কফি শেষ করল।

আমি নিজের তাগিদে ডাকাতগুলোকে ধরতে চাই। পাসি বা মিলারের আশায় বসে না থেকে নিজে মাঠে নামতে চাইছি। অন্যের চেয়ে নিজের ওপর নির্ভর করা কি ভাল নয়? জেথ, বাথানের পাঞ্চারেরা শহরের লোকের মতই শান্তি প্রিয়, তাছাড়া র্যাঞ্চিং ছাড়া অন্য কোথাও ওদেরকে ব্যবহার করার অধিকার আমার নেই। ওরা যা পারবে না, তাই করতে পারবে তুমি। টাকাটা উদ্ধার করা কঠিন হবে, কিন্তু দেখে-শুনে এগোতে পারলে আমরা সফল হব।

আমি দুঃখিত, জেথ। একটার পর একটা সমস্যার কথা বলে একদিনেই তোমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছি। এই মুহূর্তে আমার পাশে একজন নির্ভরযোগ্য লোকের থাকা প্রয়োজন। জোর করব না, তবে এ-ও ঠিক যে এগুলো তোমার নিজেরই সমস্যা। বাথান ও মিলের মালিক তুমিই, আমি নই।

রোয়ানা তাকিয়ে আছে, চোখজোড়ায় বিপুল প্রত্যাশা। জেথ টের পেল বাইরে থেকে যত শক্ত মনে হোক না কেন আসলে মেয়েটা তা নয়। দুবছর ধরে বাথান ও মিল চালিয়ে এসেছে, একটা সমর্থ পুরুষের কাজ সামলেছে, শুধু এ কারণে ওকে আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী মনে হয়েছিল। এখন আর তা মনে হচ্ছে না, ক্লান্ত-অসহায় দেখাচ্ছে। অবশ্য একেবারে ভেঙেও পড়েনি, এ মেয়ে সহজে হাল ছাড়বে না, ওর ধাতটা ভালই জানা আছে জেথের।

শক্ত কাজ, তায় একা, ভাবল জেথ্রো ম্যাকলীন। তাতে কি? পিছিয়ে যাওয়া ওর অপছন্দ।

ওহ্, জেথ! সম্মতি পেতে আনন্দে উজ্জ্বল হলো রোয়ানার চোখ-মুখ, দৃষ্টিতে খুশি উপচে পড়ছে। কি করে তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাব…

জেথ অনুভব করল সমস্যাগুলোকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে, নিজের করে ভাবছে রোয়ানা। একটা মেয়ে হয়ে এতদিন আমার দায়িত্ব সামলেছে, ভাবল জেথ, অথচ আমি দূরে থেকে কেবল এড়িয়ে গেছি। বোকামি হয়েছে এবং অনিন্দ্যসুন্দর এ মেয়েটাকে এত ঝামেলায়, কষ্টে ফেলা মোটেও উচিত হয়নি। এবার থেকে ঝামেলাবিহীন কাটবে ওর দিনগুলো, সিদ্ধান্ত নিল ও। দায়িত্ব নিতে ভয় পায় এমন লোকের ওপর যার এত আস্থা, এরকম সুবিধে পাওয়ার অধিকার সে রাখে। বৈকি।

***

পুমাস ক্যানিয়ন হোয়াইটস্টোন থেকে আড়াআড়ি ছয় মাইল দূরে, যেতে হলে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। অসংখ্য খাড়া পাহাড় আর গভীর সঙ্কীর্ণ উপত্যকার সহাবস্থান এমন যে পেরোনো দুঃসাধ্য। বেশিরভাগই শক্ত পাথরে গড়া, চোখা চাই আর খাড়াইয়ে পূর্ণ। প্রাণের চিহ্ন নেই বলতে গেলে, কদাচিৎ দুএকটা ক্যাকটাস। দেখা যায় শুধু।

সমতল একটা মেসায় উঠে আসার পর রাশ টানল বাক টার্নার। ধুলো উড়িয়ে তার পাশে থামল অন্যরা। স্যাডল বুটে দুহাতের ভর রেখে ফেলে আসা পথের ওপর নজর বুলাল টার্নার, খানিক বাদে প্রসারিত হলো তার ঠোঁটের কোণ। যা ভেবেছে-ধাওয়া করে আসছে না কেউ।

ওরা কি আসবে, বাক? ক্লিমের জিজ্ঞাসা।

আজ আর নয়, ঢালু প্রান্তর দিয়ে ঘোড়া ছোটাল তস্কর-নেতা। মেসা থেকে উৎপন্ন বিশাল রুক্ষ ঢাল মাইলখানেক তফাতে ক্যাপেশাস ক্যানিয়নের পাশে গিয়ে শেষ হয়েছে। এখান থেকে ওটার লালচে-বাদামী দেয়াল চোখে পড়ছে। ডানে পুমাস ক্যানিয়ন। যে ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে ওরা সেটা ঘুরপথের। দুটো কারণে এটা বেছে নিয়েছে টার্নার-ট্র্যাক পড়ার সম্ভাবনা কম এবং কোন পাসি যদি পিছু নেয়ও, দুর্গম প্রান্তর পাড়ি দিয়ে শেষাবধি পৌঁছার ধৈর্য রাখতে পারবে না।

পুরো প্রান্তরে লাগাতার সবুজের চিহ্ন কেবল ট্যালন ভ্যালিতে। তার পাশে অনুর্বর ক্রীক, শুকনো খটখটে। তলার শক্ত মাটি রোদ্দুরে ফেটে চৌচির। এরপর ওভম্যান মাউন্টেন। ওটার চুড়া তুষারাবৃত, দুধ-সাদা। এর উত্তরের ট্রেইল ধরে মাইল খানেক এগোলে পুমাস ক্যানিয়নের পার্শ্ব-মুখ-প্রবেশ পথ চোখে পড়বে। টার্নার যে কেন এখানে আশ্রয় নিতে চাইছে বুঝতে পারছে না স্লিম বেকার। তবে এ নিয়ে সে খুব একটা চিন্তিতও নয়।

গিরিখাতের সম্মুখ প্রান্তরটি মোটামুটি সমতল হলেও ভেতরটা তারচেয়ে দুর্গম। সর্বত্র বিশাল বোন্ডার ও পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ত্রিশ গজের মত আসার পর ঢালু হতে শুরু করল ট্রেইলটা, তাতে বালি আর ঘোট ঘোট নুড়ি পাথর। পাশে নিচু একটা জায়গায় বৃষ্টির পানি জমেছে।

ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠল চলার পথ। দশ মিনিটের মাথায় খাড়াইয়ে উঠে এল দলটা। কোনরকমে টিকে আছে কয়েকটা জওয়া, বিবর্ণ হয়ে গেছে ওগুলোর পাতা। এমন পরিবেশে টিকতে পারে কেবল ক্যাকটাস।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়, ঘোড়া থামিয়ে ঘোষণা করল টার্নার, রাতে এখানেই থাকছি। স্যাডল ছেড়ে কাপড়ে লেগে থাকা ধুলো ঝাড়ল প্রথমে, তারপর স্যাডল ব্যাগ হাতে গিয়ে বসল একটা পাথরের ওপর।

একটু পর রান্নার আয়োজনে বসল লেইভ পিটার্স। ক্যাকটি ঝোঁপের পাশে আগুনের কুণ্ডটাকে ঘিরে বসেছে তিনজন। কার্লি গেছে পেছনের শৈলশ্রেণীতে, এ বেলা নজর রাখার দায়িত্ব তার। ডরম্যান ও পিট ঘোড়াগুলোর যত্ন সেরে এসে যোগ দিল অন্যদের সাথে। নিজেদের শেষ সম্বল নিয়ে পোকার খেলতে বসেছে ওরা। হাতে হুইস্কির বোতল নয়তো কফির মগ। লেইভ পিটার্স সবার জন্যে পাইকারি হারে সিগারেট রোল করে চলেছে, প্রতিটির জন্যে সে পাচ্ছে পঁচিশ সেন্ট। আজকের দিনটা চিন্তা করলে তা মোটেও বেশি নয়।

এখন পর্যন্ত খেলায় জিতছে টার্নার ও ডরম্যান। সাপারের পর অবশ্য পরিস্থিতি বদলে গেল। বাক টার্নার যখন টের পেল তার নিজের পকেট থেকে দুই ডলার গচ্ছা গেছে, খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। বোর্ডে পাঁচ ডলার ফেলে দানবটা জিতে নিলেও খুশি হতে পারল না। বিরক্তি চেপে উঠে পড়ল ও, দিনের শেষ সিগারেট ধরিয়ে বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। শিয়রের পাশে রাখল টাকার থলেটা, নিশ্চন্ত বোধ করছে।

টাকাগুলো ভাগ করবে কখন? জানতে চাইল পিটার্স।

 সকালে। নাখোশ হলেও তা চেপে রাখল টার্নার।

কত আছে?

 লাখের কিছু বেশি হবে।

মুখের ওপর হ্যাট চাপানোর আগে স্লিমকে ডাকল টার্নার।

ঘুরে তাকাল দুর্বৃত্ত, খেলায় মন নেই।

মাঝ রাত পর্যন্ত তোমার পালা, স্লিম, ঘুম জড়ানো কণ্ঠে নির্দেশ দিল টার্নার। কোন গাফিলতি চাই না। তোমার পর পিটকে জাগিয়ে দেবে, ভোর থেকে ডরম্যানের পালা।

ঠিক আছে, বাক, হাসল স্লিম। সঙ্গীদের পানে তাকাল, আড়চোখে একবার দেখে নিল টাকার থলেটা। এক লাখ ডলারের চেয়ে ঝুঁকিটা মোটেই বেশি নয়, ভাবছে ও, বাক টার্নার যত ভয়ঙ্কর লোকই হোক-হারবে এবার।

মিনিট দশ পর আসর ভাঙল। অন্যরা যখন শোয়ার আয়োজন করছে রিপিটার হাতে শৈলশ্রেণীর দিকে এগোল স্লিম বেকার। কার্লি ছিল সেখানে, তাকে, পাঠিয়ে দিয়ে বোল্ডারের পাশে বসে পড়ল। চারপাশে নজর বুলাল কিছুক্ষণ, মনোযোগ রাখতে পারছে না। নিজের অতীত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বেকার। টার্নারের দলে যোগ দেয়ার আগে খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছে ওর জীবন। তারও আগে তরুণ বয়সে, একেকটা দিন কি করে কাটবে এ নিয়ে ভাবতে হত। এখন, সবার মত যে বখরা পায় অপচয় না করলে এতদিনে তা লাখের কাছে গিয়ে ঠেকত। কিন্তু নিজেকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে সঞ্চয়ে বিশ্বাস নেই ওর। ওটা বোকা আর কৃপণদের কাজ।

অন্তত এক লাখ ডলার! ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না। নিউ ইয়র্কে গিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারে কিংবা অন্য কেথাও যেখানে বাক টার্নারের শকুনে দৃষ্টি প্রসারিত হবে না। হ্যাঁ, ভাবছে স্লিম বেকার, কেবল একটা কাজই করতে হবে। বিধ্বস্ত পশ্চিমে থাকার প্রয়োজন তাহলে ফুরিয়ে যাবে, নোংরা কাপড়ের বদলে পরবে দামী কাপড়, বড় বড় অনুষ্ঠানে থাকবে তার অবাধ চলাফেরা। আশেপাশে ঘুরঘুর করবে সুন্দরীরা। প্রাসাদোপম বাড়িতে রাজার হালে দিন কাটবে। সত্যি রোমাঞ্চকর!

কঠোর হস্তে ভাবাবেগ দমন করল বেকার। বাক টার্নার বড্ড ভয়ঙ্কর মাষ! ধরা পড়লে পৈত্রিক প্রাণটা খোয়াতে হবে। ভয়ে শুকিয়ে এল ওর গলা। তার পর মনে হলো-তাকে ধরতে পারলে তো? সকালে টার্নার যখন টের পাবে ততক্ষণে অনেক দূরে চলে যাবে সে, আয়ত্তের বাইরে। বাক টার্নার কেন, তখন স্বয়ং শয়তানও ওর টিকিটি ছুঁতে পারবে না।

একঘণ্টা বাদে নিশ্চিন্ত হয়ে ক্যাম্পে ফিরে এল বেকার। ঘুমন্ত টার্নারের পানে এগোল। এরই মধ্যে ঘেমে গোসল করে ফেলেছে। থলেটা যখন হাতে নিল আতঙ্কে পা ফেলতে পারল না। মনে হচ্ছে এখুনি জেগে উঠে গলা চেপে ধরবে তস্কর-নেতা, দৈত্যাকার হাতে ভবলীলা সাঙ্গ করার আগে ভসনার সুরে বলবে: গাধা, কখন কিভাবে চুরি করতে হয় তাও জানো না!

থলেটা নিয়ে সরে এসেও নিশ্চিন্ত হতে পারল না স্লিম। মনে হচ্ছে আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ করছে কেউ। একে একে সবার ঘুমন্ত মুখগুলো খুঁটিয়ে দেখল। ও। তারপর পিছিয়ে ঘোড়াগুলোর কাছে এসে সবচেয়ে তেজীটায় স্যাডল চাপাল। এটা তাকে একটানা অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যাবে।

অনেকটা পথ ঘোড়াকে হটিয়ে নিয়ে এল স্লিম, তারপর স্যাডলে চাপল। পুমাস ক্যানিয়ন কানা বলে বেরোবার পথ একটাই। গিরিখাত থেকে বেরিয়ে আসার পর কিছুটা সুস্থির বোধ করলেও টার্নারের ভূত মাথা থেকে নামেনি এখনতক। থেমে ক্যান্টিন থেকে পানি পান করল দুবৃত্ত। কত সহজে শেষ হলো কাজটা, ভাবল সে, অযথাই ভয় পাচ্ছিল।

প্রথম গুলিটা সরাসরি তার কপালে ঢুকল, পরেরটা বুকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা গেল তস্কর। থমকে দাঁড়িয়েছে ঘোড়াটা। ত্রিশ গজ দূরের ঝোপ। থেকে বেরিয়ে এল স্লিমের আততায়ী। দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে চলে এল মৃতদেহের পাশে। স্যাডল ব্যাগ থেকে থলেটা বের করে নিশ্চিন্ত হলো সে। তৃতীয় গুলি ছুঁড়ে এবার ঘোড়াটার প্রাণ হরণ করল লোকটা। তারপর ঝোঁপের দিকে ফিরে চলল। লুকিয়ে রাখা ঘোড়ায় চেপে পরিতৃপ্তির সাথে একটা সিগার ধরাল। ঠিক যা যা ভেবেছে, তা-ই হয়েছে।

.

হোয়াইটস্টোনের লোকেরা বেশিরভাগই রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে, নয়তো সেলুনে বসে আড্ডা মারছে। পাসির ফেরার অপেক্ষায় আছে সবাই। বিকেলে লঅফিসের সামনের রাস্তায় ছোটখাট একটা সভা হয়ে গেছে, পাসিতে যোগ দেয়ার জন্যে সাহসীদের আহ্বান করেছিল জাজ উইলসন হলেন। হাতে গোণা কয়েকজন এগিয়ে এসেছিল। ডীন থর্টন আনাড়ী লোকগুলোর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার পরপরই শহর ছাড়ে দলটা।

সন্ধ্যার একটু আগে বাথানে ফিরে গেছে রোয়ানা। চেয়েছিল জেথও সাথে যাক, কিন্তু রাজি হয়নি জেথ। থটন কতটুকু করতে পারে জেনে যাওয়াই ওর শহরে থাকার কারণ।

দুঘণ্টা পর ব্যর্থ হয়ে ফিরল লোকগুলো। লঅফিসের উল্টোদিকে ছোট্ট ক্যাফেতে বসে তখন সবে সাপার শেষ করেছে জেথ, সামনে ধূমায়িত কফির মগ। উৎসাহী লোকজন হেঁকে ধরল পাসির ক্লান্ত মানুষগুলোকে, বিশেষ করে থর্টনকে। কিছু না বলে অফিসে ঢুকে দরজা আটকে দিল মার্শাল, তীব্র গাল বল কেউ। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল জাজ, থর্টন দরজা খুলতে ডগলাস গ্রীনকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

সিগারেট রোল করল জেথ। এখানকার কয়েকটা ব্যাপার অস্পষ্ট লেগেছে ওর কাছে। রুক্ষ পশ্চিমের যে কোন শহর ঝামেলামুক্ত রাখতে হলে আইনের হাতকে শক্ত হতে হয়, অথচ এখানে আইনের অস্তিত্ব বলতে গেলে নেইই। ডেপুটি ছাড়া বুড়ো একজন মার্শালের পক্ষে আর কতটুকু করা সম্ভব?

যতটুকু বোঝা যাচ্ছে রোয়ানার সাথে শহর কমিটির অন্যান্যদের সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে। ওদের কাউকে সুস্থভাবে চিন্তা করতে দেখেনি জেথ, নিজেদের দ্বন্দু নিয়েই বেশি ব্যস্ত। জেরেমি মিলারের প্রসঙ্গ আসায় রোয়ানা হঠাৎ এভাবে খেপে গেল কেন? ওর কথায় মনে হয়েছে মিলারের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এদের কারও, কিংবা সবারই। শহরে লোকটার কর্তৃত্ব ছিল একসময়, এখন না থাকলেও কমিটির সদস্যদের ওপর তার প্রভাব থাকতে পারে। হয়তো সে কারণে এদের কাউকেই পছন্দ করে না মেয়েটা। তেমন হলে অবশ্য ওকে দোষ দেয়া যায় না। শত্রুর বন্ধু শত্রুর মতই।

কফি শেষ করে লঅফিসের ওপর আরেকবার নজর বুলাল জেথ। ভিড় লেগে আছে এখনও। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল ও। হিচ রেইলে বাঁধা ছিল গ্রে-টা, স্যাডলে চেপে দক্ষিণে এগোল। শহরে থেকে আর লাভ নেই। বিশ্রাম দরকার। টানা কদিন ধরে ছোটার মধ্যে আছে। মিল পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই বাথানে। যাওয়ার ট্রেইল পড়বে।

অন্ধকার রাস্তা। বেশিরভাগ বাড়িতে আলো নিভে গেছে। গির্জার কাছে চলে এসেছে ও, হঠাৎ করে ঘাড়ের পেছনে শিরশিরে অনুভূতি হলো। বিপদ!

কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্ধকার কুঁড়ে বেরিয়ে এল চারজন। এদের তিনজনকে দুপুরে লুইফের সেলুনে দেখেছে। আমাদের সাথে এসো, অচেনা লোটা, বিশালদেহী বলল, জেথের কানে সেটা আদেশের মত শোনাল। বেচাল দেখলেই গুলি করব। মনে রেখো আমরা চারজন।

একটা সুযোগ এখনও নেয়া যায়, ভাবল জেথ, কিছু বোঝার আগে দুজনকে পেড়ে ফেলা যাবে…অন্যরা? নাহ, বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে যায়। তারচেয়ে এদের সাথে যাওয়াই ভাল, সিদ্ধান্ত নিল ও, পরে কোন সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।

জেরেমি মিলারের সাথে কি এদের কোন সম্পর্ক আছে?

গির্জার পাশে খোলা জায়গা। পেছনে কয়েকশো গজ দূরে পাহাড়ের আবছা অবয়ব। খোলা জায়গাটায় ঢুকে পড়ল ওরা। চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে জেথকে। ভবিষ্যৎ বা গন্তব্য নিয়ে ভাবছে না জেথ। চারজনে মিলে যখন গার্ড অভ অনার দিচ্ছে তা ব্যাপারটা গুরুতর।

মিনিট দশ পর থামল ওরা। জেথ ধারণা করল একটা স্টোরের পেছনে উপস্থিত হয়েছে। সামনের দরজা গলে মৃদু আলো এসে পড়েছে বাইরে।

এবার সিংহাসন থেকে নামো, মি, ডাষ! ব্যঙ্গ করল বিশালদেহী।

অন্যরা হেসে উঠতে রাগে পিত্তি জ্বলে গেল জেথের। নিজেকে সামলে নিয়ে স্যাডল ছাড়ল। গ্রেটার কেশরে হাত বুলাল, ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবে ঘোড়াটা।

কোল্টের নল দিয়ে ওর পিঠে গুতো মারল একজন। ভেতরে ঢুকল জেথ। একটা স্টোর রূমে উপস্থিত হয়েছে। বিশাল কামরার অর্ধেকটা জুড়ে অনেকগুলো বাক্স সাজিয়ে রাখা। শেষ মাথায় কাঠের সিঁড়ি। ফের কোল্টের খোঁচা মেরে ওকে উপরে ওঠার ইঙ্গিত করল লোকটা।

দোতলায়, বারান্দায় উঠে এল জেথ। দরজার কাছে দেখতে পেল আরেকজনকে, হাতে শটগান। কামরাটার দরজায় স্বচ্ছ কাপড়ের পর্দা ভেদ করে ভেতরের আলো মেঝেতে এসে পড়েছে। ইতস্তত করার সুযোগ পেল না জেথ, বিশালদেহীর ধাক্কায় ভেতরে ঢুকতে হলো।

গোছানো কামরা। মাঝখানে বিশাল গোলাকার টেবিল, গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি করা হয়েছে। চারপাশে কয়েকটা চেয়ার। এক কোণে ছোট শেলফের ওপর কাগজপত্র। উল্টোদিকে, তাকে হুইস্কির ঝকঝকে বোতল আর সুদৃশ্য গ্লাস। জানালার পর্দাগুলো নামানো। ছাতের সাথে ঝোলানো লণ্ঠন সারা ঘরে মিষ্টি আলো বিলাচ্ছে। এছাড়াও কোণের ঘোট একটা টেবিলে কয়েকটা মোম জ্বলছে।

এ ঘরের মালিক, অভিজাত সন্দেহ নেই, ভাবল জেথ। সে, দরজার উল্টোদিকে জানালায় অন্ধকার বা পাহাড়শ্রেণী দেখছে। আসলে কি তাই? ওর মনে হলো নিজের ভাবমূর্তি গড়তে চাইছে। অনুমতির তোয়াক্কা না করে হাতলহীন একটা চেয়ারে বসে পড়ল, এমনভাবে যাতে প্রয়োজনে অনায়াসে ড্র করা যায়।

ধীরে ঘুরল লোকটা। তাকে আর্ল বা সিনেটরের মত মনে হলো, চেহারা ও পরিচ্ছদে। কিন্তু জেথের কাছে একটা ধেড়ে শয়তান ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে অফার করল সে, মাথা নেড়ে প্রত্যাখ্যান করল জেথ।

তুমি নাকি শুনতে পাও? সন্দেহ নেই এটা একটা দারুণ ব্যাপার। মুখ খুলল সে। সিগার ধরাল এবার, মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল সারা ঘর।

তাকিয়ে আছে জেথ, জানে খোশ-গল্প করার জন্যে ওকে ধরে আনা হয়নি।

জেথ্রো ম্যাকলীন, বুড়ো ম্যাকলীনের একমাত্র বোবা ছেলে এবং সম্ভবত দুঃখী, জিভ আর টাকরা সহযোগে চুক চুক শব্দ করল লোকটা, করুণ দেখাচ্ছে মুখ। নিজের অক্ষমতার দুঃখে যে ঘরছাড়া হয়েছে। সনোরার লোকেরা তোমাকে নিয়ে মজা করত, কাজটা অমানবিক কিন্তু তারা তো আর কোমাঞ্চিদের মত তোমার অঙ্গহানি করেনি কিংবা তোমার মা-কে রক্ষিতা বানায়নি।

মেজর ম্যাকলীন, তোমার বাবা, বড় একগুঁয়ে লোক, আলাপী ঢঙে বলে চলেছে সে, সত্যিই যেন খোশ-গল্প করছে। ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশনে যখন দায়িত্ব পালন করছিল, বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি কোমাঞ্চিদের। পাল্টা আক্রমণ করল ওরা, তোমার মা আর তোমাকে তুলে নিয়ে গেল। আহা, ছয়টা বছর কি নির্যাতনই না চালানো হয়েছে তোমার ওপর। মিসেস ম্যাকলীনের দুর্ভাগ্য কোমাঞ্চিদের সোহাগ। সে বেশিদিন পায়নি, বছর পেরোনোর আগেই পটল তুলেছে। আর তুমি, অসীম ধৈর্য ধরে সইলে ওদের আদর। তারপর বেরিয়ে এলে কোমাঞ্চিদের গ্রাম ছেড়ে, পেছনে নিজের জিভটা ফেলে-মর্মান্তিক!

কি বলা যায় লোকটাকে, ভাবছে জেথ-পিশাচ? না হলে কেউ এভাবে তামাশা করে?

কোমাঞ্চিদের বদান্যতায় একটা পা হারিয়েছে তোমার বাবা, আর তুমি হারিয়েছ জিভ, থেমে গ্লাসে চুমুক দিয়ে ফের শুরু করল সে। সবাই মিলে ভর করেছ অবলা ঘুড়িটার ওপর। কি করতে পারবে ও? পশ্চিমে দুর্বলের জায়গা নেই, আমার সাথে টক্কর দেয়ার দুঃসাহস তোমাদের মোটেও মানায় না।

শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বলছে, অনুভব করল জেথ। লোকটার টুটি চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে। এ-ও জানে সেটা ঠিক হবে না, অযথা বিপদ ডেকে এনে কি লাভ। তার হাতের কাছে নিশ্চয়ই অস্ত্র আছে, আর বাইরে দুএকজন তো আছেই। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও। প্রতিজ্ঞা করল প্রথম সুযোগেই মনের আয়েশ মিটিয়ে পেটাবে লোকটাকে। এমনও বে মারবে যাতে অন্তত কয়েকটা দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয়।

সম্ভবত এ লোকই জেরেমি মিলার, ধারণা করল জেথ। ধূর্ত, কুশলী এবং কপট। শত্রু হিসেবে এরা শক্তপাল্লা।

ছুঁড়িটা আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে! কদিন আগেও বেড়ালের মত সরে থাকত, এত সাহস পেল কি করে? হাসল সে, জেথের চোখে চোখ রাখল। তুমি, তাই না? কিন্তু এতটা ভরসা করা কি ঠিক হয়েছে যেখানে আমি প্রতিদ্বন্দীকে দুর্বল দেখতে পছন্দ করি? মি. ম্যাকলীন, ফিরে আসা কি তোমার ঠিক হয়েছে? দুদিন পর ট্রেইলে পড়ে থাকবে তোমার লাশ, শকুন খুবলে খাবে ম্যাকলীনদের ভরসাকে। বুড়ো কি এ আঘাত সইতে পারবে?

পকেট থেকে তামাক ও কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল জেথ, সময় নিয়ে ধীরে আয়েশ করে ধরাল। মুখের চেহারার অভিব্যক্তি শান্ত, বিকারহীন, মিলারের হুমকিতে যেন ওর কিছু আসে যায় না।

প্রস্তুত থেকো, ম্যাকলীন, তোমার এ সাহস ধুলোয় মিশিয়ে দেব আমি! রাগে শক্ত হয়ে গেছে লোকটার মুখ, চোখে ঘৃণা। খানিক আগের আয়েশী ভাবটা উধাও হয়েছে। গ্লাসে চুমুক দিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল যেন এখুনি ঝাপিয়ে পড়রে ওর ওপর। আবার যখন দেখা হবে, তুমি বেঁচে থাকবে না, ম্যাকূলীন!

টেবিলের ওপর কাঠের একটা ছাইদানি ছিল, ওটা টেনে নিয়ে ছাই ঝাড়ল। জেথ। ক্ষীণ হাসি লেগে আছে ওর ঠোঁটে, সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মৃদু মাথা ঝাঁকাল। তারপর তাকাল মিলারের দিকে, দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা। ভঙ্গিটা এমন যেন জানতে চাইছে লোকটার আর কিছু বলার আছে কিনা।

মনে কোরো না তোমাদের খুব পরোয়া করি আমি, শীতল শোনাল জেরেমি মিলারের গলা। ইচ্ছে করলেই দুদিনের মধ্যে তাড়াতে পারি। কি আছে তোমাদের, ওই জমিটা ছাড়া? ওটাই চাই আমার! শেষ সুযোগ দিচ্ছি, সময় থাকতে কেটে পড়ো, নইলে প্রাণসহ সব হারাবে। থেমে নিভে যাওয়া সিগার ধরাল, কিছুটা শান্ত দেখাচ্ছে এখন তাকে। পঁচিশ হাজার পর্যন্ত দিতে রাজি আছি, এর এক পয়সাও বেশি না।

টেবিলে কাগজ-কলম ছিল, টেনে নিয়ে লিখল জেথ: কোন গরু চোরের কাছে। ম্যাকলীনরা জমি বিক্রি করবে না।

জেরেমি মিলার যেন ফেটে পড়বে, রাগে লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখ। ঝটিতি হাত বাড়াল ড্রয়ারের দিকে। তৈরিই ছিল জেথ, জানত এরকম কিছু হতে পারে। মিলার ড্রয়ার থেকে হাত বের করার আগেই সিক্সগানের নলে তাকে নিশানা করল। চুপসে গেছে সে, কিছুটা বিস্মিতও। ধীরে খালি হাত বের করে আনল।

এর জবাব তুমি পাবে, ম্যাকলীন। তোমাদের কেউই পার পাবে না।

মাথা ঝাঁকাল জেথ। সহসা টের পেল পেছনে দরজার পর্দা সরে গেছে। প্রায় সাথে সাথে শটগান কক করার শব্দ হলো। ইত্যবসরে সহজেই গুলি করতে পারত মিলারকে, কিন্তু নিরস্ত্র সে। মুহূর্তের ব্যবধানে, ওর মনোযোগ সরে গিয়েছিল, পেছন থেকে গুলি করল কেউ। বদ্ধ ঘরে বোমা ফাটল যেন, ছাতের লণ্ঠন নিভে গিয়ে আছড়ে পড়ল টেবিলের ওপর। মোমের ম্লান আলোয় দেখা গেল না মিলারকে, টেবিলের ওপাশে বসে পড়েছে।

পরিস্থিতি বিচার করল জেথ-লণ্ঠনটা পড়েছে পিস্তলের গুলিতে, তারমানে শটগানঅলা ছাড়াও আরেকজন আছে। নাহ্, কোন সুযোগ নেই। ধীরে সিক্সগানটা হাত থেকে ছেড়ে দিল ও, গাল দিল নিজেকে। প্রথম সুযোগেই মিলারকে গুলি করা উচিত ছিল।

উঠে দাঁড়িয়েছে জেরেমি মিলার, মুখটা হাসিতে উদ্ভাসিত। হাতে একটা কোল্ট শোভা পাচ্ছে। দুঃখিত, মি. ডাম্ব! দেখতেই পাচ্ছ পরিস্থিতি তোমার অনুকূলে নেই। কোন ঝামেলী চাই না আমি। বোকামি কোরো না, তোমাকে গুলি করতে আমার হাত একটুও কাপবে না।

হাসল জেথ, মিলার ঠিকই বলেছে-তার পক্ষে সবই সম্ভব।

ওরা তোমাকে পৌঁছে দেবে, ম্যাকলীন। আর, শেষবারের মত বলছি, আমার সাথে লাগতে আসবে না। ওই জমিটা বেচে দিয়ে কেটে পড়াই ভাল হবে তোমাদের জন্যে। এক টুকরো জমি আর কয়েকটা গরুর দাম কি প্রাণের চেয়ে বেশি? আমি আরও দুটো দিন দেখব, তারপর খেলা শুরু হবে। হাসল মিলার, চোখ দুটো দেখে জেথের মনে হলো লোকটা উন্মাদ বা তার কাছাকাছি।

বেরিয়ে এল জেথ। পেছনে শটগানঅলা মাজল চেপে ধরেছে ওর শিরদাঁড়ার ওপর। অন্য লোকটা ভেতরে রয়ে গেছে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসতে দেখতে পেল ওদের। নিমেষে ওকে ঘিরে ফেলল লোকগুলো।

প্রথম আঘাতটা এল পেছন থেকে, কিছু টের পাওয়ার আগেই। প্রচণ্ড ঘুসিতে মনে হলো মেরুদণ্ড বোধহয় খুঁড়িয়ে গেছে, টলে উঠল শরীর। আঘাতের চোটে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে জেথ। ঝাঁপসা দৃষ্টিতে দেখল নাক বরাবর ছুটে আসছে একটা মুঠি, সরতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। ঘুসিটা ওর নাক থেঁতলে দিল, যন্ত্রণায় দিশেহারা বোধ করছে। টের পেল নাক থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। সামলে নেয়ার সুযোগ পেল না জেথ, পেটে মোম একটা ঘুসি পড়ায় চাপা আর্তনাদ করে উঠল। মনে হলো ফুসফুস খালি হয়ে গেছে, বাতাসের জন্যে হাঁস-ফাস শুরু করলেও পরের ঘুসিটা কোন রকমে এড়াতে পারল। ঝাঁপসা দৃষ্টিতে দেখল লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে বুকে পড়েছে সামনের লোকটা। সুযোগটা ছাড়ল না জেথ, আঘাত করল। তেমন যুৎসই না হলেও নাক ফেটে গেল লোকটার, নাক চেপে ধরে বসে পড়ল সে। সময় ব্যয় না করে এবার পা চালাল জেথ। ছিটকে গিয়ে মেঝের ওপর পড়ল লোকটা।

আরেকটা আঘাত করার তীব্র ইচ্ছে ছিল, পারল না পেছনের লোকটার জন্যে। শটগানের মাজল দিয়ে ওর কাঁধে আঘাত করল সে, জেথের কাছে মনে হলো অবশ হয়ে গেছে শরীরের ডান পাশ। চারপাশ থেকে এবার একের পর এক ঘুসি আসতে লাগল, কোন বাধাই দিতে পারল না জেথ।

আঁধার হয়ে আসছে সব। মেঝেয় লুটিয়ে পড়ার পরও মারতে থাকল ওরা, কিন্তু মাথায় আঘাত করছে না। জেথ অনুভব করল খুব বেশি হলে আর কয়েকটা মিনিট টিকতে পারবে। অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে সারা শরীর, মাংসপেশীগুলো বোধহয় সব থেঁতলে গেছে।

একসময় টের পেল আর মারছে না। টেনে হিচড়ে ওকে বাইরে এনে ফেলল দুজন। শেষ আঘাতটা করল কানের পাশে, জ্ঞান হারাল জেথ।

মুখে খসখসে একটা অনুভূতি চেতনা ফিরিয়ে আনল জেথ্রো ম্যাকলীনের। চোখ খুলে দেখতে পেল ওর জ্ঞান ফেরাতে এভাবেই চেষ্টা করছে গ্রে-টা। উদ্দেশ্য সিদ্ধি হওয়ায় সরে গেল ঘোড়াটা। পড়ে থেকে শক্তি সঞ্চয় করল ও।

মাথার ওপর মেঘে ঢাকা আকাশ, খণ্ড খণ্ড মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। জেথ ধারণা করল মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। ফুরফুরে বাতাস প্রশান্তি এনে দিল শরীরে। বিন্দুমাত্র সাড়া নেই কোথাও। নডতে যেতে সব কিছু মনে পড়ে গেল ওর। জীবনে এরচেয়ে বেশি মার খেয়েছে কিনা মনে করতে পারল না। কৈশোরে, কোমাঞ্চি গ্রামে আটকে থাকার সময়, ওর জিভ কেটে নিয়েছিল কোমাঞ্চি। তাদের হাতে মার খাওয়ার সময়ও এতটা অসহায় বোধ করেনি, যতটা আজ অনুভব করেছে।

বেশ কসরত করার পর স্যাডলে চাপল জেথ। শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। জনশূন্য রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ার ইচ্ছে বহু কষ্টে সামলে রেখেছে, নরম একটা বিছানার জন্যে মন হাহাকার করছে। নিজ থেকে ফিরতি পথে এগোচ্ছে গ্রে-টা, ঘোড়ার ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই ওর। আসলে স্যাডলে বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। এক সময় খেয়াল করল মূল রাস্তায় চলে এসেছে।

শরীরে শক্তি পাচ্ছে না জেথ, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ওর মনে হলো পাজরের একটা হাড়ও বোধহয় আস্ত নেই। হুড়মুড় করে স্যাডল থেকে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। একরাশ ধুলো এসে লাগল মুখে। ফের স্যাডলে চাপতে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মত জ্ঞান হারাল জেথ।

<

Super User