বাউন্টিতে বিদ্রোহ – জেমস নরম্যান হল ও চার্লস নর্ডহফ
কিশোর ক্লাসিক / রূপান্তর: নিয়াজ মোরশেদ / সেবা প্রকাশনী

ভূমিকা ১৭৮৭ সালের তেইশ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথ বন্দর থেকে রওনা হয় এইচ.এম.এস (হিজ ম্যাজেস্টিজ শিপ) বাউন্টি। গন্তব্য, বিশাল দক্ষিণ সাগরের ছোট্ট দ্বীপ তাহিতি। উদ্দেশ্য, তাহিতি থেকে কয়েক হাজার রুটিফলের চারা সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলোয় পৌঁছে দেয়া। ইংল্যান্ডের তকালীন রাজকীয় সরকার আশা করেছিল, এ গাছের চাষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংরেজ মালিকানাধীন খামারগুলোয় কর্মরত নিগ্রো ক্রীতদাসদের জন্যে সস্তায় যথেষ্ট খাবারের ব্যবস্থা করা যাবে।

বাউন্টির সেই ঘটনাবহুল যাত্রার ঘটনারাশি উন্মোচন করা হয়েছে এ কাহিনীতে। বাউন্টির ইংল্যান্ড থেকে রওনা হয়ে তাহিতিতে পৌঁছানো, রুটিফলের চারা সংগ্রহের জন্যে দীর্ঘদিন সেখানে থাকা, অবশেষে ফিরতি যাত্রা, তারপর বিদ্রোহ, জাহাজ নিয়ে বিদ্রোহীদের তাহিতিতে ফিরে যাওয়া এবং সব শেষে এইচ. এম. এস প্যানডোরা নামের একটি জাহাজ গিয়ে বিদ্রোহীদের কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আসা এবং বিচার করার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ বই-এ।

কাহিনীর কথক হিসেবে লেখকদ্বয় নির্বাচন করেছেন রজার বিয়্যাম নামের এক কাল্পনিক চরিত্রকে। নৌবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর বৃদ্ধ বয়েসে স্মৃতিচারণের ভঙ্গিতে সে গল্প বলছে। বাউন্টির নাবিকদের ভেতর রজার বিয়্যাম বলে কেউ না থাকলেও পিটার হেউড নামের একজন ছিল। এই হেউডের আদলেই লেখকরা গড়ে তুলেছেন বিয়্যামের চরিত্র। সে কারণে স্বাভাবিক ভাবেই বাউন্টির নাবিক তালিকা থেকে হেউডের নাম বাদ দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে বিয়্যামের নাম। মিডশিপম্যান পিটার হেউডের দিনলিপিই (এ মেমোয়ার অভ পিটার হেউড নামে প্রকাশিত) বাউন্টিতে বিদ্রোহ (মূল ইংরেজি নাম মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি)-এর মূল ভিত্তি। এ ছাড়া উইলিয়াম রাই-এর এ ন্যারেটিভ অভ দ্য মিউটিনি অন বোর্ড এইচ.এম.এস বাউন্টি, ও এ ভয়েজ টু দ্য সাউথ সী; স্যার জন ব্যারোর দ্য মিউটিনি অ্যান্ড পাইরেটিক্যাল সিজিওর অভ এইচ.এম.এস, বাউন্টি, জর্জ ম্যাকানেস-এর দ্য লাইফ অভ ভাইস অ্যাডমিরাল উইলিয়াম ব্লাই থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছেন লেখকদ্বয়।

.

বাউন্টিতে বিদ্রোহ
এক

১৭৮৭র বসন্ত-শুরুতে আমার বাবা মারা গেলেন প্লুরিসি রোগে। মা সাধারণ গ্রাম্য মহিলা, ভেবেছিলাম ধাক্কাটা সামলাতে পারবেন না। কিন্তু যখন দেখলাম শুধু যে সামলে নিয়েছেন তা-ই নয়, বরং শক্ত হাতে ধরেছেন সংসারের হাল, তখন আশ্চর্য না হয়ে পারিনি। প্রকৃতি বিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহের কারণে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হওয়ায় দুর্লভ সম্মান লাভ করেছিলেন বাবা। প্রকৃতির প্রতি আগ্রহ ছিল মায়েরও-আগ্রহ না বলে বলা উচিত, ছিল অদ্ভুত এক আকর্ষণ। এই আকর্ষণের কারণে রয়্যাল সোসাইটির ফেলোর স্ত্রী হয়েও মা রয়ে গিয়েছিলেন পুরোপুরি গাইয়া। শহরের কৃত্রিম পরিবেশের চেয়ে উইদিকম্বির শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনই বেশি প্রিয় ছিল তার কাছে।

সত্যি কথা বলতে কি, বাবার মৃত্যুর পরই মা-কে আমি বুঝতে শুরু করি; মা হিসেবে নয় চমৎকার এক সাথী হিসেবে। জীবন, পৃথিবী, প্রকৃতি সম্পর্কে মা যে কতখানি জ্ঞান রাখেন, কতখানি বোঝেন তা বুঝতে পারি সেই সময়। বাবার অভাব এক দিনের জন্যেও অনুভব করতে দেননি আমাকে। আগে ছিলেন শুধু মা, সে সময়টায় হয়ে উঠেছিলেন মা বাবা দুইই। আমি কখন কি চাই মা যেন তা বুঝে নিতেন কোন অলৌকিক উপায়ে। আমার মন বুঝে যখন। যেমন প্রয়োজন তখন তেমন হালকা বা গম্ভীর চালে কথা বলতেন। যখন কথার চেয়ে নীরবতাই বেশি ভাল লাগত আমার তখন চুপ করে থাকতেন।

সেদিন সকালে যখন স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস-এর চিঠি এল, বাগানে হাঁটছিলাম আমরা। সময়টা শেষ জুলাই। আকাশ মেঘশূন্য, নীল। বাতাসে গোলাপের সুবাস। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, কালো পোশাকে কী অসাধারণ লাগে আমার মা-কে!-এই সময় আমাদের নতুন কাজের মেয়ে থাকার এসে চিঠিটা দিল মায়ের হাতে। খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠিটা বের করে একটা পাথরের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন মা।

স্যার জোসেফ লিখেছেন, পড়া শেষ করে তিনি বললেন। লেফটেন্যান্ট রাই-এর নাম শুনেছিস না, ক্যাপ্টেন কুকের সাথে দক্ষিণ সাগর অভিযানে ছিলেন? স্যার জোসেফ লিখেছেন, ব্লাই এখন ছুটিতে, টউনটনে এক বন্ধুর বাড়িতে আছেন। আমাদের বাড়িতে নাকি আসতে চান। তোর বাবার খুব উঁচু ধারণা ছিল তাঁর সম্পর্কে।

সতেরো বছরের তরতাজা তরুণ, আমি তখন। ক্যাপ্টেম কুক, দক্ষিণ সাগর-শব্দগুলোর মর্ম ভাল করেই জানি,, ক্যাপ্টেন কুকের সঙ্গে ছিলেন! রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলাম আমি। মা, আসতে লেখো ওকে! যেমন করেই হোক, একদিন যেন ঘুরে যান আমাদের এখান থেকে।

আমি জানতাম, তুই খুশি হবি, মৃদু হেসে মা বললেন।

আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় টউনটন। তখনই মা আমাদের গাড়িটা পাঠিয়ে দিলেন। কোচোয়ানের হাতে দিলেন একটা চিঠি, ব্লাই-এর জন্যে। লিখলেন, আজ সন্ধ্যাটা যদি আমাদের এখানে কাটান আমি এবং আমার ছেলে সত্যিই খুব খুশি হব।

সারাটা দিন টগবগে উত্তেজনায় কাটালাম আমি। ক্যাপ্টেন কুকের একজন সহযাত্রী আমাদের বাড়িতে আসছেন। দক্ষিণ সাগর, তার দ্বীপরাশি, সেসব দ্বীপের সুখী মানুষগুলো সম্পর্কে এতদিন কেবল বইয়েই পড়েছি। আজ একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনতে পাব। উত্তেজিত হওয়ার মত ব্যাপারই বটে।

সন্ধ্যার সামান্য আগে গাড়ি এসে দাঁড়াল আমাদের বাড়ির সামনে। কোচোয়ান লাফিয়ে নেমে দরজা মেলে ধরল। মিস্টার ব্লাই নেমে এলেন। দুরু দুরু বুকে আমি অপেক্ষা করছিলাম তাকে স্বাগত জানানোর জন্যে। এগিয়ে যেতেই তিনি মৃদু হেসে উষ্ণ করমর্দন করলেন আমার সাথে। বললেন, একেবারে বাপের চেহারা পেয়েছ! ওঁর মারা যাওয়া-সত্যিই বিরাট ক্ষতি, অন্তত যারা নৌবিদ্যার চর্চা করে তাদের কাছে।

লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লাই মাঝারি গড়নের মানুষ। ঋজু শক্তপোক্ত শরীর। একটু মোটা। পোড় খাওয়া চেহারা। দৃঢ় চোয়াল। কপালের নিচে সুন্দর কালো একজোড়া চোখ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, বেশির ভাগই ঢাকা পড়ে গেছে নাবিকদের তিন কোনাওয়ালা টুপির নিচে। পরনে নাবিকদের উর্দি, সাদা কিনারাওয়ালা উজ্জ্বল নীল কোট, সাদা ওয়েস্টকোট, ব্রিচেস আর মোজা।

বসার ঘরে নিয়ে বসালাম মিস্টার ব্লাইকে। একটু পরেই মা নেমে এলেন ওপর থেকে। খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম আমরা। খেতে খেতে আলাপ চলল। দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের ব্যাপারে আমার বাবা যে পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ব্লাই। নাবিকদের যে কতটা সুবিধা হয়েছে তা বললেন। তারপর একসময় উঠল দক্ষিণ সাগর প্রসঙ্গ।

ক্যাপ্টেন কুকু যেমন বলেছেন, তাহিতির ইন্ডিয়ানরা সত্যিই সেরকম সুখী নাকি? মা জিজ্ঞেস করলেন।

তাহিতির ইন্ডিয়ানদের বেঁচে থাকার জন্যে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয়, বললেন আমাদের অতিথি, এটাকে যদি সুখ বলেন তাহলে ওরা সুখী।

রজার আর আমি সেদিন জাঁ জ্যাক রুশোর লেখা পড়ছিলাম, মা বললেন। ওঁর মতের সাথে আমরা একমত, প্রকৃতির সান্নিধ্যেই মানুষ সত্যিকারের সুখী হতে পারে।

মাথা ঝাঁকালেন ব্লাই। হ্যাঁ, রুশোর অভিমত সম্পর্কে শুনেছি আমি, যদিও পড়ার সৌভাগ্য হয়নি-আমি ফ্রেঞ্চ জানি না। আমি কিন্তু একমত নই ভদ্রলোকের সাথে। আমার বিশ্বাস সুখল, শিক্ষার আলো পাওয়া মানবগোষ্ঠিই কেবল প্রকৃত সুখের সন্ধান পেতে পারে। তাহিতির ইন্ডিয়ানদের কথা ধরুন, খাওয়া পরার কোন চিন্তা ওদের নেই, তা সত্ত্বেও ওদের সমাজে এমন সব অদ্ভুত বিধিনিষেধ আছে, তা-ও আবার একটা দুটো নয় হাজার হাজার, অত বিধিনিষেধ মেনে কোন সভ্য মানুষের পক্ষেই জীবনধারণ সম্ভব নয়। মঁসিয়ে রুশো ওদের ভেতর কিছুদিন থেকে এলে নিশ্চয়ই মত বদলাতেন। থেমে হঠাৎ করেই আমার দিকে ফিরলেন মিস্টার ব্লাই। তুমি তাহলে ফ্রেঞ্চ জানো?

হ্যাঁ, স্যার।

শুধু ফ্রেঞ্চ না, মিস্টার ব্লাই, মা বলে উঠলেন, ইটালিয়ানও জানে। এখন শিখছে জার্মান। গত বছর ল্যাটিনে কৃতিত্ব দেখিয়ে পুরস্কার পেয়েছে। আমার কি মনে হয় জানেন?-ভাষা শেখার ব্যাপারে প্রকৃতিদত্ত কিছু গুণ আছে ওর।

এই গুণটা আমি পেলে-উহ! হাসলেন ব্লাই। কি এক ঝামেলার কাজ যে আমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন স্যার জোসেফ, যদি জানতেন!

কেন? কি হয়েছে? এক সাথে প্রশ্ন করলাম আমি আর মা।

খুব শিগগিরই আবার দক্ষিণ সাগরের দিকে যাত্রা করছি আমি। বাউন্টি নামের ছোট্ট একটা জাহাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে। তাহিতি থেকে কয়েক হাজার রুটিফলের চারা সগ্রহ করে পৌঁছে দিতে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলোয়।

আগ্রহেচকচক করে উঠল মায়ের চোখ। উহ, আমি যদি পুরুষ মানুষ হলাম আমাকে সাথে নেয়ার অনুরোধ করতাম. আপনাকে! চারাগুলোর যত্ন নিতে পারতাম আমি।

মৃদু হাসলেন ব্লাই। খুশি হয়েই আমি সঙ্গে নিতাম আপনাকে। যদিও » আমার সাথে একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী যাচ্ছেন, তবু আপনাকে পেলে আপনাকেই আমি নিতাম। ডেভিড নেলসন অবশ্য মোগ্য লোক, চারাগুলোর অযত্ন হবে না এ বিশ্বাস আমার আছে। আমার যেটা দুশ্চিন্তা সে হলো স্যার জোসেফের চাপানো কাজটা।

কি কাজ সেটা? আবার প্রশ্ন করলাম আমি আর মা।

ইন্ডিয়ানদের রীতিনীতি এবং ভাষা সম্পর্কে যতখানি, সম্ভব জ্ঞান অর্জন করে আসতে বলেছেন আমাকে। শুধু এ-ই না, ওদের ভাষায় যত শব্দ আছে তার একটা তালিকা তৈরি করতে হবে, সম্ভব হলে ওদের ভাষার ব্যাকরণও তৈরি করতে হবে। বলুন তো, আমার মত মানুষ নিজের ভাষার বাইরে আর কোন ভাষাই ভাল করে বুঝি না, কি করে এমন গুরুদায়িত্ব পালন করব?

কোন পথে আপনারা যাবেন, স্যার? আমি প্রশ্ন করলাম। হর্ন অন্তরীপ ঘুরে?

সে চেষ্টাই করব, যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে। ফেরার সময় অবশ্য পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ হয়ে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে আসব।

খাওয়া হয়ে গেছে। টেবিল ছেড়ে উঠে বসার ঘরে গিয়ে বসলাম আমি আর ব্লাই। মা চলে গেলেন রান্নাঘরে টুকিটাকি কাজকর্ম সারতে.। মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ব্লাই আমার ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমাকে যদি আমি সাথে নিতে চাই, যাবে?

আমার অবস্থা তখন রীতিমত লাফিয়ে ওঠার মত। রুদ্ধশ্বাসে বললাম, সত্যি বলছেন! আমাকে নিয়ে যাবেন?

তুমি যদি রাজি হও আর তোমার মা যদি অনুমতি দেন, আমার দিক থেকে কোন অসুবিধা নেই। আমি বরং খুশিই হব। ইন্ডিয়ানদের ব্যাকরণ তৈরির কাজটা তোমার ঘাড়ে চাপানো যাবে।

মা বসার ঘরে আসতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, মা, লেফটেন্যান্ট ব্লাই বলছেন, আমি ইচ্ছে করলেই আগামী যাত্রায় ওঁর সঙ্গী হতে পারি, তুমি আপত্তি না করলেই হয়।

তাই নাকি? মিস্টার ব্লাই-এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন মা।

হ্যাঁ, ম্যাডাম।

কিন্তু, ও জাহাজের কি বোঝে?।

বোঝে না, বুঝে নেবে। আপনি চিন্তা করবেন না, ম্যাডাম, আমার বিশ্বাস খুব শিগগিরই আপনার ছেলে ভাল নাবিক হয়ে উঠবে। ওর ভাষাজ্ঞানটাকে আমি কাজে লাগাতে চাই।

কতদিন আপনারা বাইরে থাকবেন?

এই ধরুন দুবছর।

দুবছর। এক মুহূর্ত ভাবলেন মা। তারপর একটু ইতস্তত করে বলে ফেললেন, ঠিক আছে, আপনি যদি মনে করেন ওকে কাজে লাগাতে পারবেন, নিয়ে যান।

কথাবার্তা সব পাকাপাকি হয়ে গেল। ঠিক হলো শিটহেড এ গিয়ে আমি যোগ দেব বাউন্টিতে।

.

অক্টোবরের শেষ দিকে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লন্ডন গেলাম আমি।

প্রথমেই ভাল এক দর্জির দোকানে গিয়ে এক প্রস্থ নাবিকের পোশাকের মাপ দিলাম। আমাদের উকিল মিস্টার একাইনের সাথে দেখা করে কিছু আইনগত বিষয় পাকাপাকি করলাম। তারপর গেলাম বাবার বন্ধু স্যার, জোসেফের সঙ্গে দেখা করতে।

অত্যন্ত সুপুরুষ স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস। ক্যাপ্টেন কুকের বন্ধু, দীর্ঘদিনের সাথী এবং সহযাত্রী। বছর পঁয়তাল্লিশ হবে বয়েস। এ বয়েসেই রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এ থেকেই অনুমান করা যায় কি গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী তিনি। খাওয়া দাওয়ার পর তার পড়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন আমাকে। টেবিলের ওপর থেকে একতাড়া কাগজ তুলে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।

তাহিতিয়ান ভাষার শব্দ-কোষ, বললেন তিনি। তোমাকে দেব বলে নকলটা তৈরি করে রেখেছি। খুবই সংক্ষিপ্ত আর অসম্পূর্ণ। আশা করছি যদ্র সম্ভব এটা সম্পূর্ণ করবে তুমি। উচ্চারণগুলো আরও ভাল করে শুনে ঠিক বানানে লিখবে। আমার ধারণা-ব্লাইও আমার সাথে একমত, ইটালিয়ানদের বানান পদ্ধতি অনুসরণ করে লিখলে কাজটা সহজ হবে! ইটালিয়ান তো জানো তুমি, তাই না?

হ্যাঁ, স্যার।

বেশ, বলে চললেন স্যার জোসেফ, কয়েক মাস লাগবে ওদের ৮ রুটিফলের চারা সংগ্রহ করতে। সেই সময়টা তুমি ব্যয় করবে অভিধানের কাজে। তোমাকে যেন অন্য বিষয়ে মাথা ঘামাতে না হয় তা দেখবে ব্লাই। তুমি ফিরলেই আশা করি আমি এটা প্রকাশ করতে পারব। তাহিতিয়ানেরই বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলে বিস্তীর্ণ দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপরাশির মানুষ। অভিধানটা তৈরি করা গেলে নাবিকদের কত উপকার হবে বুঝতে পারছ? সহজেই ওরা আলাপ করতে পারবে স্থানীয়দের সাথে।

তাছাড়া আমার বিশ্বাস, একটু থেমে বলে চললেন স্যার জোসেফ, খুব শিগগিরই ওই দ্বীপগুলোর ওপর চোখ পড়বে আমাদের খামার মালিকদের। আমেরিকার উপনিবেশগুলো হাতছাড়া হওয়ার পথে, সুতরাং আজ হোক কাল হোক, ওদিকে ওদের নজর দিতে হবেই। স্থানীয় ভাষার অভিধান, ব্যাকরণ হাতের কাছে থাকলে কত সুবিধা হবে ওদের ভাবতে পারো?

একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবে, কাজ যেটুকু করবে নিখুঁত ভাবে করবে। আর নিখুঁত কাজ করতে হলে একজন ভাল তাইও–মানে বন্ধু বেছে নিতে হবে তোমাকে। মাতাভাই উপসাগরে যখন কোন জাহাজ নোঙ্গর ফেলে, হাজার হাজার ইন্ডিয়ান ক্যানো নিয়ে হাজির হয় সেখানে। সাদা মানুষদের বন্ধু হওয়ার জন্যে উদগ্রীব থাকে সবাই। ওই সময় তোমাকে সাবধান হতে হবে। বন্ধুত্ব করতে হবে সুতরাং একজনের সাথে করলেই হলো, এ মনোভার ভুলেও আমল দেবে না। তীরে নেমে আগে ভাবচাল বুঝবে, লোকজনের সাথে আলাপ করবে, তারপর যাকে মনে হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, উঁচু শ্রেণীর, তাকেই তুমি তাইও হিসেবে নেবে। সাধারণ দুএকটা জিনিস-যেমন, ছুরি, কাঁচি, কুঠার এসবের বিনিময়ে পাবে তাজা খাবার, আতিথেয়তা, উপহারমোট কথা ওদের পক্ষে যা দেয়া সম্ভব সবই তোমাকে দেবে। নিচু শ্রেণীর কাউকে তাইও হিসেবে নিলে পুরো পরিশ্রমটাই পণ্ড হবে। দেখবে, বুদ্ধিশুদ্ধি নেই লোকটার, যেটা তোমার সবচেয়ে বেশি দরকার, হয়তো দেখবে সেটাই সে ঠিক মত জানে নামানে ভাষা, উচ্চারণ ঠিক নেই, এমনি সব ব্যাপার। আমার ধারণা এই লোকগুলো শুধু যে অন্য শ্রেণীর তা-ই না, অন্য গোত্রেরও বটে। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, লম্বা চওড়া সুন্দর চেহারার তাহিতিয়ানরাই বুদ্ধিমান হয় বেশি?

মানে আপনি বলতে চাইছেন, আমাদের ভেতর যেটুকু সামাজিক সাম্য আছে ওদের ভেতর তারচেয়ে বেশি কিছু নেই।

হাসলেন স্যার জোসেফ। আমি বলব কম। ওপরে ওপরে মনে হয় ওরা সবাই সমান, সব শ্রেণীর মানুষ একই কাজ করে, হয়তো দেখবে মাছ ধরা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজা, বা রানী নিজের ক্যানো নিজেই বেয়ে চলেছে বা অন্য মেয়েদের সাথে বসে বাকল-এর কাপড় তৈরি করছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় ওরা সমান। যতই যোগ্যতা বা বুদ্ধির পরিচয় দিক না কেন, ওদের সমাজে যে যে স্তরে জন্মেছে তা থেকে ওপরে উঠতে পারে না। ওদের বিশ্বাস কেবল গোত্রপ্রধানদেরই আত্মা আছে কারণ তারা সাক্ষাৎ দেবদেবীর বংশধর। থেমে কয়েক মুহূর্ত চেয়ারের হাতলে তবলা বাজালেন স্যার জোসেফ। তারপর প্রশ্ন করলেন, তোমার যা যা দরকার সব জোগাড় হয়ে গেছে? কাপড় চোপড়, লেখার সরঞ্জাম, টাকা?

জি, স্যার।

সেক্সট্যান্ট আছে তোমার কাছে

হ্যাঁ। বাবার একটা ছিল, সেটা নিয়ে এসেছি।

ভাল করেছ। ব্লাই যোগ্য নাবিক। সত্যি কথা বলতে কি ওর চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই এখন। ও তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারবে। ওর নির্দেশ মেনে চললে আমার মনে হয় না, তোমার কোন অসুবিধা হবে। মনে রাখবে-এ ধরনের কাজে শৃঙ্খলার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

স্যার জোসেফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। কানের ভেতর গমগম করছে ওঁর শেষ কথাগুলো-শৃখলার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি! কতটা যে বেশি তা আমি ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা হওয়ার আগে হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছিলাম।

.

দুই

নভেম্বরের শেষ দিকে আমি বাউন্টিতে যোগ দিলাম।

আগেই বলেছি জাহাজটা ছোট। মাত্র নব্বই ফুট লম্বা, চওড়া চল্লিশ ফুট। মাল-বহন ক্ষমতা দুশো টন। তিন বছর আগে হাল-এ তৈরি করা হয়েছে বাণিজ্যিক নৌ-বহরের জন্যে। তখন নাম রাখা হয়েছিল বেথিয়া। সম্প্রতি অ্যাডমিরালটি ওটা কিনে নিয়েছে দুহাজার পাউন্ডের বিনিময়ে। স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস-এর পরামর্শ অনুযায়ী নতুন নামকরণ করা হয়েছে বাউন্টি। বেশ কয়েক মাস ডেন্টফোর্ডের ডকে ছিল। রুটিফুলের চারা বহনের উপযোগী করে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে প্রায় চার হাজার পাউন্ড ব্যয়ে। পেছনের বিরাট কেবিনটা ফাঁকা করে চারা গাছ রাখার জন্যে অসংখ্য মাটির পাত্র সাজানো হয়েছে তাকের ওপর। প্রতিটা পাত্রে যাতে পানি দেয়া যায় তার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে দীর্ঘ নল লাগিয়ে। ফলে ওপরে ওঠবার মইয়ের দুপাশে দুটো ছোট্ট কুঠুরিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে লেফটেন্যান্ট ব্লাই এবং মাস্টার মিস্টার ফ্রায়ারকে।

জাহাজটার পুরো কাঠামো তামার পাত দিয়ে মোড়া, সে যুগের বিচারে নতুন একটা ব্যাপার। তার ওপর পেট মোটা খোল, বেটে মাস্তুল আর মোটাসোটা দড়িদড়া-সব মিলিয়ে বাউন্টিকে দেখতে যতখানি না নৌ বাহিনীর সশস্ত্র জাহাজের মত লাগে তার চেয়ে বেশি লাগে তিমি, শিকারী জাহাজের মত। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্যবহার করা যায় এমন একজোড়া কামান বসানো আছে। সামনের দিকে। একই রকম আরও ছটা কামান আছে পেছন দিকে। তা ছাড়াও আছে চারটে চার পাউন্ডার কামান।

জাহাজে পা দিয়েই সব কিছু কেমন অদ্ভুত আর নতুন মনে হলো আমার কাছে। পুরোটা জাহাজ মেয়েমানুষে গিজ গিজ করছে। নাবিকদের স্ত্রীরা বিদায় জানাতে এসেছে স্বামীদের। রাম-এর বন্যা বইছে যেন ডেকের ওপর দিয়ে। নারী-পুরুষের হৈ চৈ, চিঙ্কারে কান পাতা দায়। জেটিতেও অনেক মানুষের জটলা। ওরা দর্শক। হৈ হল্লা করছে ওরাও।

ডেকের নারী পুরুষদের মাঝ দিয়ে পথ করে কোন রকমে জাহাজের পেছন দিকে গেলাম আমি। কোয়ার্টার ডেকে দেখলাম মিস্টার ব্লাইকে। দীর্ঘ, পেটা শরীরের এক লোক তার সামনে।

আমি, স্যার, পোর্টসমাউথ মানমন্দিরে গিয়েছিলাম, লোকটাকে বলতে শুনলাম, আমাদের সময়-রক্ষক এক মিনিট বাহান্ন সেকেন্ড এগিয়ে আছে ঠিক সময় থেকে, এবং দিনে আরও এক সেকেন্ড করে এগিয়ে যাচ্ছে। মিস্টার বেইলি এ ব্যাপারে একটা চিঠি দিয়েছেন আপনাকে।

ধন্যবাদ, ক্রিশ্চিয়ান, ব্যাপারটা দেখছি আমি, বলে ব্লাই ঘাড় ফেরাতেই দেখলেন আমাকে। আহ, মিস্টার বিয়্যাম, তুমি এসে গেছ! বললেন তিনি। এসো পরিচয় করিয়ে দেই, এ হচ্ছে মিস্টার ক্রিশ্চিয়ান, আমাদের মাস্টারের মেট। আর, ক্রিশ্চিয়ান, এ হলো রজার বিয়্যাম, আমাদের নতুন মিডশিপম্যান। রজার, তুমি ক্রিশ্চিয়ানের সঙ্গে যাও, ও তোমার বার্থ দেখিয়ে দেবে, তোমার কাজ সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণাও পাবে ওর কাছে।

মাথা নুইয়ে ক্রিশ্চিয়ানের পেছন পেছন এগোলাম আমি।

পরের দিনগুলোতে একটু একটু করে বাউন্টির অন্যান্য নাবিকদের সাথে পরিচয় হলো আমার। মাস্টার ফ্রায়ার, সার্জন ওল্ড ব্যাকাস, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডেভিড নেলসন, মাস্টার অ্যাট আর্মস চার্লস চার্চিল, সহকারী সার্জন টমাস লেডওয়ার্ড, মাস্টার অ্যাট আর্মস-এর মেট উইলিয়াম এলফিনস্টোন, গোলন্দাজ উইলিয়াম পেকওভার, গোলন্দাজের মেট জন মিলস, সারেং উইলিয়াম কোল, সহকারী সারেং জেমস মরিসন, ছুতোর মিস্ত্রী উইলিয়াম পার্সেল, ছুতোর মিস্ত্রীর দুই সহকারী চার্লস নরম্যান আর টমাস ম্যাকইন্টশ, আর্মারার জোসেফ কোলম্যান, আমার সহযোগী মিডশিপম্যান পাঁচজন-টমাস হেওয়ার্ড, জন হ্যালেট, রবার্ট টিঙ্কলার, এডওয়ার্ড ইয়ং, জর্জ স্টুয়ার্ট; দুই কোয়ার্টার মাস্টার-জন নর্টন আর পিটার লেংকলেটার, সহকারী কোয়ার্টার মাস্টার জর্জ সিম্পসন, পাল নির্মাতা লরেন্স লেবোগ, ক্যাপ্টেনের কেরানী মিস্টার স্যামুয়েল, কসাই রবার্ট ল্যাম্ব, মালী উইলিয়াম ব্রাউন, বাবুর্চি জন স্মিথ আর টমাস হল; দক্ষ খালাসী টমাস বারকিট, ম্যাথ কুইনটাল, জন সামনার, জন মিলওয়ার্ড, উইলিয়াম ম্যাককয়, হেনরি হিব্রান্ডট, আলেকজান্ডার স্মিথ, জন উইলিয়ামস, টমাস এলিসন, আইজাক মার্টিন, রিচার্ড স্কিনার, ম্যাথু থম্পসন, উইলিয়াম মুসাট আর মাইকেল বায়ার্ন-প্রত্যেকে যার যার ক্ষেত্রে দক্ষ। আমি একাই কেবল আনকোরা নতুন।

আটাশ নভেম্বর ভোরে আমরা পাল তুলে দিলাম। তরতর করে এগোল বাউন্টি। কিন্তু কপাল মন্দ, সেন্ট হেলেনস দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছুতেই বাতাস প্রতিকূল হয়ে উঠল। আকাশ হয়ে উঠল মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টি পড়তে লাগল। নোঙ্গর ফেলা ছাড়া গত্যন্তর রইল না আমাদের।

বাউন্টির মত ছোট জাহাজে চল্লিশজন সঙ্গীসহ মাঝ সাগরে নোঙ্গর ফেলা অবস্থায় দিনের পর দিন চুপচাপ কাটিয়ে দেয়া সোজা কথা নয়। দুদিন যেতে না যেতেই বিরক্ত হয়ে উঠল সবাই। আমার ব্যাপারটা অবশ্য অন্যরকম। জাহাজ চালানোর কায়দা কানুন শিখতে শিখতে কোন দিক দিয়ে যে দিন কেটে যায়। আমি টের পাই না। লেফটেন্যান্ট ব্লাই নিজে শেখাচ্ছেন ত্রিকোণমিতি আর নৌ জ্যোতির্বিদ্যা। পাল খাটানো, দড়িদড়ার ব্যবহার, নোঙ্গর ওঠানো নামানো শিখছি মাস্টার ফ্রায়ার এবং মাস্টারের মেট ক্রিশ্চিয়ানের কাছে। সারেং উইলিয়াম কোল আর তার সহকারী জেমস মরিসনের কাছে শিখছি জাহাজ চালানোর কৌশল।

একটানা চব্বিশ দিন আবহাওয়া খারাপ থাকার পর বাইশ ডিসেম্বর বিকেলে আকাশ পরিষ্কার হলো। দিক বদলে বাতাস বইতে লাগল পুব মুখে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল নাবিকরা। অলস দিনের অবসান হলো বোধহয়।

পরদিন ভোরে সারেং-এর শিঙার আওয়াজ আর মরিসনের চিৎকার শুনে যখন ঘুম ভাঙল তখনও রাতের আঁধার কাটেনি। ঝটিতি ডেকে এসে দেখি, বেশির ভাগ নাবিক পৌঁছে গেছে যার যার জায়গায়। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বেশ জোরে বইছে ফরাশি উপকূলের দিক থেকে। মাস্টার ফ্রায়ার ও সহকারী মাস্টার ক্রিশ্চিয়ানকে নিয়ে কোয়ার্টার ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন লেফটেন্যান্ট ব্লাই। নোঙ্গর তোলার কাজে ব্যস্ত কয়েকজন খালাসী।

উপরের পালগুলো ঢিলে করে দাও! ফ্রায়ারের নির্দেশ শুনতে পেলাম।

আমার কাজের জায়গা নিদিষ্ট হয়েছে পেছনের মাস্তুলের ওপরে। মাস্টারের নির্দেশ শুনে তাড়াতাড়ি উঠতে শুরু করলাম আমি। ওপরে উঠে দেখি কয়েকজন নাবিক আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। চামড়ার যে লম্বা খাপের ভেতর পাল মুড়ে রাখা হয় সেটার মুখ খোলার জন্যে টানা হ্যাঁচড়া করছে ওরা। চামড়ার বাধনীগুলো হিমে জমে গেছে। সহজে খুলতে চাইছে না। সেজন্যেই এই টানা হ্যাঁচড়া। এদিকে দেরি দেখে নিচ থেকে ব্লাই চিৎকার করে উঠেছেন:

করছ কি তোমরা, আঁ? ঘুমিয়ে গেছ নাকি? এতক্ষণ লাগে ওইটুকু একটা পাল খুলতে।

অবশেষে খুলল ছোট পালটা। বাতাস লেগে ফুলে উঠল। মৃদু একটু ঝাঁকুনি খেলো বাউন্টি। ইতোমধ্যে নোঙ্গর তোলা হয়ে গেছে। চলতে শুরু করল জাহাজ।

ক্যাপ্টেনের নির্দেশে একে একে অন্য পালগুলোও মেলে দেয়া হলো।

বড় পালটা একটু ঘুরিয়ে দাও! রাই-এর নির্দেশ শোনা গেল। বাতাসের দিকে। হ্যাঁ, হয়েছে! সামনের মাস্তুলের ছোট পালটা সোজা করে দাও।

এমনি ধরনের আদেশ নির্দেশ চলতে লাগল। সেই সাথে খালাসীদের, নাবিকদের দড়িদড়া টানাটানির সময়, হেইও হো! হেইও হো! চিৎকার।

ধীরে ধীরে স্বচ্ছন্দ হয়ে এল বাউন্টির গতি। চিৎকার চেঁচামেচি কমতে কমতে থেমে গেল একসময়। জাহাজ এগিয়ে চলল খোলা সাগরের দিকে।

নির্মেঘ আকাশে সূর্য উঠল। চমৎকার শীতের সকাল। স্বচ্ছ, ঠাণ্ডা, ঝলমলে। মাস্তুলের মাথা থেকে নেমে এসেছি কিছুক্ষণ আগে। এখন দাঁড়িয়ে আছি রেলিং-এ হেলান দিয়ে। ঝুঁকে পড়ে দেখছি সাগরের লোনা জল কেটে বাউন্টির এগিয়ে যাওয়া।

.

সেদিনই সন্ধ্যায় বাতাস বাড়তে বাড়তে ঝড়ের রূপ নিল। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল সাগর। কিন্তু পরদিন ভোর হতে না হতেই আবার আগের মত শান্ত। যেন আমাদের ক্রিস্টমাস উদযাপনের সুযোগ দেয়ার জন্যে ঝড় এসেও এল না। চব্বিশ তারিখ মধ্যরাত থেকেই উৎসবের আমেজ লাগল বাউন্টিতে। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে অতিরিক্ত মদ সরবরাহ করা হলো। পরদিন দুপুরে বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা হলো।

জাহাজী বন্ধুদের সাথে আমার জানা-শোনার পর্ব চলছে এখনও। একটু একটু করে অপরিচিত লোকগুলো সব আপন হয়ে উঠছে। নিচের ডেকে একটা বার্থে থাকতে দেয়া হয়েছে আমাকে। হেওয়ার্ড, স্টুয়ার্ট আর ইয়ংও থাকে একই বার্থে। আমার খাওয়ার ব্যবস্থাও ওই তিনজনের সাথে মেস করে। চারজন রাতে শোয়ার জন্যে ব্যবহার করি চারটে হ্যামক। দিনে বড় একটা সিন্দুককে বানাই খাওয়ার টেবিল; ছোট ছোট কয়েকটা বাক্স কাজ করে চেয়ারের। এক জায়গায় ঘুমাই এবং খাই বলে স্বাভাবিক ভাবেই এই তিনজনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি হয়েছে।

খালাসী মাইকেল বায়ার্ন চমৎকার বাঁশি বাজায়। লোকটা প্রায় অন্ধ। কি করে যেন ও ওর এই অন্ধতু সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। বাউন্টি গভীর সমুদ্রে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কেউ টের পায়নি। যখন পেল তখন আর ওকে তীরে রেখে আসার উপায় নেই। ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর ভীষণ রেগে গেলেন মিস্টার ব্লাই। পারলে তখনই ছুঁড়ে ফেলে দেন সাগরে। অন্য নাবিকরাও খেপে গেল। কিন্তু লাভ কি খেপলে? জ্যান্ত একজন মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় কি সাগরে ফেলে দেয়া সম্ভব? প্রথমদিন রাতে ডেকের ওপর যখন খালাসীরা হল্লা করতে করতে মদ খাচ্ছে তখন আপন মনে কঁশিটা বের করে জনপ্রিয় এক লোকগীতির সুর তুলল বায়ার্ন। মুহূর্তে থেমে গেল সব হৈ চৈ। মগে চুমুক দিতেও যেন ভুলে গেল সবাই। যতক্ষণ বায়ার্ন বাঁশি বাজাল একটা শব্দ করল না লোকগুলো। বাঁশি শেষ হতে সব এক সাথে এসে ঘিরে ধরল ওকে। ওর ওপর আর বিদ্বেষ রইল না কারও। ওর যে অন্ধত্ব ছিল ক্রোধের কারণ তা হয়ে উঠল সহানুভূতির ব্যাপার।

ক্রিসমাসের পর দিন আবার ঝড় এল। এবার আরও তীব্রতা নিয়ে। ঝড়ের শুরুতেই বিরাট এক ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের। বিয়ারের বড় বড় কয়েকটা পিপে ভেসে গেল পানিতে। পিপেগুলো ডেকের এক পাশে রাখা ছিল। বিশাল এক ঢেউ যখন বাউন্টির ওপর ভেঙে পড়ে তখন ওগুলোর কয়েকটা ভেসে যায় সাগরে। জাহাজের তিনটে নৌকাও আরেকটু হলে দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে ভেসে যাচ্ছিল। কয়েকজন খালাসীর চেষ্টায় বেঁচে যায় ওগুলো। বাউন্টির সম্বল বলতে ওই সিটে নৌকা। ভেসে গেলে কি যে হত বলা মুশকিল। হয়তো ওই দিনই ফিরতি পথে রওনা হতে হত আমাদের। নৌকা ছাড়া দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলোয় অবতরণ এক কথায় অসম্ভব।

ঢেউটা যখন ভেঙে পড়ে আমি তখন নিচে, আমাদের সার্জন ওল্ড ব্যাকাস এর সাথে আলাপ করছি তার কেবিনে বসে। অদ্ভুত লোক এই ওল্ড ব্যাকাস। একটা পা কাঠের। তুষারশুভ্র চুল, নীল চোখ। মুখ দেখলে মনে হয় সব সময় রেগে আছেন, অথচ আশ্চর্য নরম তার মন। ডাক্তারী সি করেই ভদ্রলোক যোগ দিয়েছিলেন জাহাজের চাকরিতে। তার গুর থেকে জাহাজেই আছেন। হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, বুঝলে হে, বিয়্যাম, ডাঙার জীবন যে কেমন ভুলেই গেছি জাহাজে থাকতে থাকতে।

ওল্ড ব্যাকাস-এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু উদ্ভিদবিজ্ঞানী মিস্টার নেলসন আর গোলন্দাজ পেকওভার। যুদ্ধ জাহাজের গোলন্দাজদের কাজের অন্ত নেই। কিন্তু বাউন্টি নামে যুদ্ধ জাহাজ হলেও কাজে বাণিজ্য জাহাজের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তাই উইলিয়াম পেকওভারের সময় কাটে অলসভাবে। নিয়ম মাফিক সাধারণ কিছু তদারকি ছাড়া আর কিছু করতে হয় না তাকে। উদ্ভিদবিজ্ঞানী নেলসনও আপাতত কর্মহীন। রুটিফলের চারা জাহাজে ওঠানোর পর শুরু হবে তার কাজ। মিস্টার নেলসন বয়স্ক লোক। একটু চুপচাপ ধরনের। মাথা ভর্তি ধূসর চুল। সার্জনের সঙ্গে গল্প করে খুব মজা পান তিনি।

একটা বাক্সকে টুল বানিয়ে বসেছেপেকওভার। আমি আরেকটা বাক্সে।। সার্জন আর উদ্ভিদবিজ্ঞানী বসেছেন বিছানায়। ঢেউয়ের দোলায় দুলছে জাহাজ। বাতাসের ঝাঁপটায় কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। এর ভেতরেই আলাপ করছি আমরা। নাবিক হিসেবে নতুন আমি। জাহাজের দুলুনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছে যদিও, তবুশান্তই রেখেছি মুখটাকে। নানা বিষয়ে কথা হতে হতে এক সময় সার্জনের

কাঠের পায়ের প্রসঙ্গ উঠল। আমার কৌতূহল মেটানোর জন্যে বহুবার বলা গল্পটা আবার বললেন ওন্ড ব্যাকাস-কবে, কোথায়, কেমন করে আসল পা-টা তিনি খুইয়েছিলেন। সব শেষে নেলসনের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, আমাদের এই পার্সেল, বুঝলেন, ছুতোর মিস্ত্রী হিসেবে জুড়ি নেই ওর।

কি করে বুঝলেন? কাজ দেখানোর কোন সুযোগই তো ও এখনও পায়নি।

পেয়েছে, পেয়েছে! রহস্যময় একটু হাসি হাসলেন সার্জন। আমার এই পা-টা ও-ই তৈরি করে দিয়েছে। একেবারে নিখুঁত কাজ। আমি বুঝতেই পারি এটা আমার আসল পা না নকল। উহ আগেরটা যা ভুগিয়েছে…!

আচমকা কেঁপে উঠল বাউন্টি। ওপর থেকে ভেসে এল খালাসীদের আর্তনাদ: গেল। গেল! গেল! তারপর অস্পষ্ট একটা চিৎকার: সবাই ডেকের ওপর! লাফ দিয়ে ছুটলাম ওপরে। ডেকে উঠতেই বাতাসের তীব্র ঝাঁপটা লাগল চোখে মুখে।

ব্লাইকে দেখলাম, পেছনের মাস্তুলের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে ফ্রায়ার। চিৎকার করে সহকারীদের নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছে সে। টালমাটাল অবস্থা জাহাজের। একবার এদিকে হেলে পড়ছে, একবার ওদিকে। তীর বাতাস ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে চাইছে পাল, মাল, দড়িদড়া। খালাসীরা প্রাণপণে পালের দড়ি কষে বাঁধার চেষ্টা করছে। এই সময় আমি দেখতে পেলাম বিশাল ঢেউটা। প্রায় উঠে পড়েছে জাহাজের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে হুইলে দাঁড়ানো লোকটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করলেন ব্লাই। ত্রিশ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দাও হাল! ডান দিকে! তারপর মাস্তুলের মাথার দিকে তাকিয়ে: এই, তোমরা, উপরে! পালগুলো অর্ধেক করে গুটিয়ে ফেল! জলদি, ঢেউটা এসে পড়ার আগেই।

ব্লাইয়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম আমি। ঢেউয়ের মাথায় উঠিয়ে ফেলতে চাইছেন বাউন্টিকে। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পেলেন না। ঢেউটা আছড়ে পড়ল জাহাজের ওপর। আচমকা নিজেকে আমি আবিষ্কার করলাম পানির নিচে। তীব্র টান অনুভব করলাম শরীরে। ভাগ্য ভাল ঢেউটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা দড়ি ধরে বসেছিলাম। না হলে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যেতাম নিশ্চয়ই। কতক্ষণ যে পানির তলে রইলাম জানি না। বাতাসের অভাবে যখন ফুসফুস ফেটে যেতে চাইছে তখন হঠাৎই সরে গেল পানি। প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচলাম। একটু সুস্থির হয়ে তাকিয়ে দেখি ডেকের কোণে জড় করে রাখা বিয়ারের পিপেগুলো নেই। নৌকা তিনটেও যেখানে ছিল সেখানে আর নেই, উল্টে পড়ে আছে রেলিংয়ের পাশে। কয়েক জন খালাসী প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে আছে ওগুলোর রশি। আরও কি ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে হিসেব নিতে গিয়ে দেখা গেল, বাউন্টির পেছন দিকটায় ফাটল দেখা দিয়েছে কয়েকটা। সেইসব ফাটল দিয়ে নোনা পানি চুকছে ভঁড়ার ঘরে। আমাদের খাবার দাবারের বড় একটা অংশ নষ্ট হয়ে গেছে।

.

উনচল্লিশ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশে পৌঁছার পর ঝড় থেমে গেল। পরিষ্কার আকাশে ঝলমল করে উঠল সূর্য। সব কটা পাল তুলে দিয়ে টেনেরিফের দিকে চলল আমাদের জাহাজ।

জানুয়ারির চার তারিখে মরিশাসগামী এক ফরাশি বাণিজ্য জাহাজের সাথে দেখা হলো আমাদের। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় একদম ওপরের পালগুলো নামিয়ে ওটার নাবিকরা সম্মান জানাল বাউন্টিকে। পরদিন ভোরে, আমাদের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রায় বারো লিগ দুরে দেখতে পেলাম টেনেরিফ দ্বীপকে। টেনেরিফের ছোট্ট বন্দর সান্তাক্রুজের দিকে জাহাজ চালানোর নির্দেশ দিলেন ব্লাই। সান্তাক্রুজ উপকূলে পৌঁছুতে সময় লাগল পুরো একদিন এক রাত। অবশেষে নোঙ্গর ফেললাম আমরা একটা স্প্যানিশ আর একটা আমেরিকান জাহাজের কাছে।

পাঁচ দিন এখানে নোঙ্গর ফেলে রইলাম আমরা। এবং এখানেই রোপিত, হলো অসন্তোষের বীজ, যে অসন্তোষের কারণে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় বাউন্টির এই যাত্রা।

ঝড় থেমে গেলেও প্রাকৃতিক নিয়মেই সান্তাক্রুজের উপকূল তখন অশান্ত। বিরাট বিরাট ঢেউ ভেঙে পড়ছে বালুকাবেলায়। দর দাম করে বেশ কয়েকটা উপকূলীয় নৌকা ভাড়া করলেন লেফটেন্যান্ট ব্লাই। এবং নৌকার মাঝিদেরকে দায়িত্ব দিলেন আমাদের পানি এবং খাবার দাবার সরবরাহের। নিজের লোকদের উদয়াস্ত ব্যস্ত রাখলেন ঝড়ে জাহাজের যে ক্ষতি হয়েছে তা মেরামতের কাজে। এখানেই শুরু অসন্তোষের। আমাদের কিছু নাবিক আশা করেছিল নৌকাগুলো মেরামত করে একদিনের জন্যে হলেও তীরে যাবে। নিজেরা পছন্দ করে কিনে আনবে খাবার দাবার, মদ; সবচেয়ে বড় যেটা প্রায় দেড়মাস পর অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও পা রাখতে পারবে ডাঙার। মাটিতে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত যখন ওদের এই আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিল তখন ক্ষুব্ধ না হয়ে পারল না ওরা।

নোঙ্গর ফেলার পর প্রথম যেদিন ভাঙা থেকে খাবার এল, সেদিন থেকেই নোনা মাংসের বদলে তাজা মাংস পরিবেশন শুরু হলো খাবার সময়। এই ঘটনায় অসন্তোষ একটু বাড়ল নাবিকদের ভেতর। বউন্টির নুন দেয়া মাংস খুব একটা সুস্বাদু কিছু নয়। আমার ধারণা দুনিয়ার সবচেয়ে বাজে নোনা মাংস ওগুলো কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, টেনেরিফ থেকে এনে যে তাজা মাংস আমাদের খাওয়ানো হলো তার মান আরও খারাপ। কয়েকজন নাবিক তো ঘোষণাই করে বসল, এ মাংস মরা ঘোড়া বা খচ্চরের না হয়েই যায় না। মাস্টারের কাছে অভিযোগ করল তারা, এ মাংস খাওয়ার অনুপযুক্ত।

অভিযোগগুলো যথাসময়ে ক্যাপ্টেনের কানে তুলল ফ্রায়ার। শুনে ভয়ানক রেগে গেলেন ব্লাই। সবাইকে ডেকের ওপর জড় করে বলে দিলেন, হয় তারা তাজা মাংস খাবে, নয় তো না খেয়ে থাকবে। ফল হলো রান্না করা তাজা মাংসের বেশির ভাগই নাবিকরা ছুঁড়ে ফেলে দিল সাগরে। অনেকে ক্যাপ্টেনের সামনেই করল কাজটা। রাগে ভেতরে ভেতরে টগবগ করে ফুটলেও ওপরে কোন ভাবান্তর দেখালেন না ব্রাই।

টেনেরিফ থেকে রওনা হবার পর পরই জাহাজের নাবিকদের তিনটে চৌকিতে (Watch) বিভক্ত করলেন ব্লাই। এতদিন নাবিকরা বারো ঘন্টা করে কাজ কর এখন থেকে করবে আট ঘণ্টা করে। মাস্টারের মেট ক্রিশ্চিয়ানকে পদোন্নতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট করলেন, এবং তৃতীয় চৌকির দায়িত্ব দিলেন তাকে (সুষ্ঠুভাবে জাহাজ পরিচালনার স্বার্থে এ ধরনের পদোন্নতি দেয়ার ক্ষমতা ব্লাইকে দিয়েছে অ্যাডমিরালটি)। জাহাজের সবাই ক্রিশ্চিয়ানকে ব্লাইয়ের বন্ধু বলেই জানে। যদিও সেই বন্ধুত্বের স্বরূপ বড় অদ্ভুত। একদিন যদি ব্লাই ক্রিশ্চিয়ানকে ডেকে নিজের সঙ্গে খাওয়ান তো পর দিনই সবার সামনে তাকে রুক্ষ ভাষায় গালিগালাজ করেন; কখনও কখনও বিনা কারণে। ব্লাই খ্যাপাটে স্বভাবের মনে করে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে ক্রিশ্চিয়ান। তবে পদোন্নতি দিয়ে সত্যি সত্যিই ক্রিশ্চিয়ানের মস্তবড় একটা উপকার করেছেন ব্লাই। সব কিছু যদি ঠিকঠাক মত থাকে, ক্রিশ্চিয়ান যদি শেষ পর্যন্ত ক্লাইয়ের মন জুগিয়ে চলতে পারে তাহলে দেশে ফেরার পর অ্যাডমিরালটি ওর পদোন্নতিটা পাকাপাকি ভাবে বহাল করবে। সাধারণত এমনই ঘটে থাকে।

অর্থাৎ ক্রিশ্চিয়ান এখন থেকে অফিসার। শুধু অফিসারই নয়, ফ্রায়ারের সমমর্যাদার অফিসার। কাল যে অধীনস্থ ছিল আজ তাকে সহযোগী হিসেবে দেখতে কারই বা ভাল লাগে? ফ্রায়ারেরও লাগল না। বাইরে কিছু প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ানক ক্ষুব্ধ হলো সে-পদোন্নতি পেয়েছে বলে ক্রিশ্চিয়ানের ওপর, আর পদোন্নতি দিয়েছেন বলে ব্লাইয়ের ওপর। অসন্তোষের আরেকটা বীজ রোপিত হলো এভাবে।

জাহাজের প্রতিটা লোককে ডেকের ওপর ডেকে ক্রিশ্চিয়ানের পদোন্নতির খবর শোনালেন ব্লাই, এবং জানিয়ে দিলেন, এখন থেকে ওকে অফিসার হিসেবে মেনে চলতে হবে। এরপর কিছু কথা তিনি বললেন নাবিকদের উদ্দেশ্যে:

প্রথমেই আমরা একমাস পিছিয়ে গেছি প্রতিকূল বাতাসের কারণে, শুরু করলেন ব্লাই। তারপর ঝড়েও বেশ কিছু দিন সময় নষ্ট হয়েছে। ঝড় আমাদের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা করেছে, আমাদের ভাণ্ডারের প্রায় অর্ধেক খাবার নষ্ট করে দিয়েছে, মদেরও একটা বড় অংশ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কত দিন আমাদের সাগরে থাকতে হবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সামনে আবার ঝড়ে পড়ে আরও সময় নষ্ট হতে পারে, আরও খাবার নষ্ট হতে পারে। তাহিতি থেকে রুটিফলের চারা সংগ্রহের জন্যে আমরা যে সময় হিসেবে ধরেছি বাস্তবে লেগে যেতে পারে তার চেয়ে বেশি। দেড় বছরের মত খাবার আমরা সঙ্গে এনেছিলাম, কিন্তু দেড় মাসেই তা কমে এক বছরের পরিমাণে নেমে এসেছে। সুতরাং, এখন থেকেই যদি মিতব্যয়ী না হই, শেষ পর্যন্ত হয়তো বিপদে পড়ে যাব আমরা। তাই আমি আজ থেকে আমাদের মাথাপিছু রুটির বরাদ্দ এই ততীয়াংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি।

মিতব্যয়িতার প্রয়োজন উপলব্ধি করে সবাই সানন্দে মেনে নিল এ নির্দেশ। কিন্তু নোনা মাংস আর শুয়োরের মাংস সম্পর্কে ওদের অভিযোগ রয়েই গেল।

আমাদের জাহাজে কোন ভাণ্ডার রক্ষক নেই। কেরানী স্যামুয়েলের সহযোগিতায় ব্লাই নিজেই চালিয়ে নেন কাজটা। ছোট খাটো মানুষ স্যামুয়েল। চেহারায় ইহুদি ইহুদি ভাব। সবার বিশ্বাস লোকটা ক্যাপ্টেনের টিকটিকি। জাহাজের কোথায় কি হচ্ছে-সব কিছুর ওপর সে চোখ রাখে এবং সময় মত জানায় ক্যাপ্টেনকে। এ কারণে জাহাজের সবাই তাকে অপছন্দ করে। অনেকে মনে করে এই স্যামুয়েলের সহযোগিতায় লেফটেন্যান্ট ব্লাই জাহাজের জিনিসপত্র চুরি করেন। যদি তা না হয় তাহলে বলতে হবে ব্লাইয়ের প্রশ্রয়ে স্যামুয়েলই চুরি করে। বাবুর্চিদের কাছে খাবার দাবার সরবরাহের দায়িত্ব স্যামুয়েলের। প্রত্যেক বার যখন সে নুন দেয়া-মাংস বের করে, সবচেয়ে ভাল অংশটা রেখে দেয় কেবিনের জন্যে (কেবিনের জন্যে মানে ক্যাপ্টেন ও তার সহভোজীদের জন্যে)। বাকিটুকু, মানের দিক থেকে তা যেমনই হোক, না মেপে দিয়ে দেয় বাবুর্চিদের কাছে। দেয়ার সময় না মাপলেও মুখে একটা ওজনের কথা ঘোষণা করে স্যামুয়েল, এবং খাতায় লিখে রাখে ওজনটা। হয়তো দেখা গেল চার পাউন্ড ঘোষণা করে যে মাংস সে দিল তার ওজন কিছুতেই তিন পাউন্ডের বেশি হবে না। কিন্তু খাতায় লিখে রাখল চার পাউন্ড মাংস বেরিয়ে গেল ভাড়ার থেকে। এ সম্পর্কে কেউ কোন প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করতে গেলে নির্ঘাত দুর্ভোগ পোহাতে হবে তাকে। শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা ব্লাই নেবেনই প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে।

কয়েকদিন পরেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে আমরা যারা ব্লাইয়ের সমর্থকও নই আবার বিরোধীও নই-অর্থাৎ নিরপেক্ষ তারা বিরাট এক প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম।-সত্যিই কি এতখানি নীচ স্বভাবের মানুষ ব্লাই

সেদিন সকালে আবহাওয়া খুব ভাল। বাউন্টির প্রধান হ্যাঁচ তুলে রোদে দেয়ার জন্যে বের করে আনা হয়েছে আমাদের পনিরের মওজুদ। ঢাকনা খুলে দেয়া হয়েছে সবগুলো পিপের। ব্লাই নিজে তদারক করছেন কাজটা। হঠাৎ তার চোখ গেল একটা পিপের দিকে। পাউন্ড পঞ্চাশেক ওজনের দুটো পনির উধাও হয়ে গেছে তার ভেতর থেকে। দ্রুত পিপেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ব্লাই। ঝুঁকে ভাল করে দেখলেন। তারপর আর্তনাদের মত তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল: ওহু, ঈশ্বর! চুরি গেছে।

কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল খালাসী হিব্রান্ড। সে বলল, না, স্যার, চুরি যাবে কেন?-আমরা যখন ডেপটফোর্ডে তখন এই পিপেটা খোলা হয়েছিল। আপনিই তো বলেছিলেন খুলতে। পনির দুটো, স্যার, তখন তীরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

চুপ! বদমাশ!

ক্রিশ্চিয়ান আর ফ্রায়ার ছিল কাছেই। তাদের দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টি হেনে ব্লাই বলে চললেন, সব চোর। একেবারে দল ধরে। তোমরা সবাই ষড়যন্ত্র করছ আমার বিরুদ্ধে-অফিসার,নাবিক-সব। কিন্তু আমিও বলছি, সব কটাকে পোষ মানিয়ে তবে ছাড়ব, খোদার কসম বলছি। হিভ্রান্ডট-এর দিকে তাকালেন তিনি। আর একটা কথাও যদি শুনি তোর মুখে, চাবকে পিঠের চামড়া তুলে নেব, কথাটা মনে রাখিস। ঘুরে নিচে নামার সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন ব্লাই। তারপর আবার চিৎকার, মিস্টার স্যামুয়েল! এক্ষুণি ডেকে এসো!

দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে ডেকের ওপর উঠে এল স্যামুয়েল। বিগলিত ভঙ্গিতে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে।

পঞ্চাশ পাউন্ডের দুটো পনির চুরি গেছে, বললেন ব্লাই। একশো পাউন্ড পনির খেতে যতদিন লাগে ততদিন পনির দেয়া বন্ধ রাখবে-সাধারণ নাবিক, অফিসার সবাইকে!

স্পষ্ট দেখতে পেলাম অসন্তোষের ছাপ পড়ল ক্রিশ্চিয়ান এবং ফ্রায়ারের মুখে। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। দুজনই বুঝতে পারছে এখন প্রতিবাদ করলে কি ফল হবে।

সেদিন থেকেই খাওয়ার সময় পনির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হলো। তবে মাখন সরবরাহ চালু রাখা হলো। ফুল হলো মাখন নিতে অস্বীকার করল নাবিকরা। তাদের বক্তব্য পনির ছাড়া মাখন নেয়ার অর্থ চুরির অভিযোগ স্বীকার করে নেয়া। জন উইলিয়ামস নামের এক খালাসী তো ফোকাসল-এ সবার সামনে ঘোষণাই করে বসল, সে নিজে ছোট এক পিপে ভিনেগার এবং আরও কিছু টুকটাক জিনিস সহ পনির দুটো পৌঁছে দিয়ে এসেছিল মিস্টার ব্লাইয়ের বাড়িতে।

এরপর আমার মত নতুন যারা, যারা স্রেফ ক্যাপ্টেন কুকের সঙ্গী ছিল বলে দেবতার আসনে তুলে বসে আছে ব্লাইকে তাদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে পাঠকরাই অনুমান করে নিন।

.

তিন

কয়েক দিন পর এক বিকেলে ব্লাই তার ভৃত্যকে পাঠিয়ে আমাকে খবর দিলেন যেন রাতে তার সাথে খাই।

সন্ধ্যার পর একটু বিশেষ সাজ সজ্জা করে গেলাম ক্যাপ্টেনের কেবিনে। দেখলাম ক্রিশ্চিয়ানকেও সঙ্গে খেতে বলেছেন ব্লাই। সাধারণত সাভন ওল্ড ব্যাকাস আর মাস্টার ফ্রায়ার ব্লাইয়ের সাথে এক মেসে খাওয়া দাওয়া করেন। আজ সার্জনকে অনুপস্থিত দেখলাম।, ক্যাপ্টেনের টেবিলে চমৎকার চমৎকার বাসন পেয়ালার প্রদর্শনী বসেছে যেন। কিন্তু ঢাকনাগুলো ওলটাতেই খেয়াল করলাম সাধারণ নাবিকদের চেয়ে মোটেই উন্নত নয় খাবারগুলো। নুন দেয়া গরুর মাংস-এটাই পরিমাণে সবচেয়ে বেশি, জঘন্য মাখন, আরও জঘন্য পনির-আমি নিজের চোখে ওগুলোর ভেতর থেকে লাল লাল পোকা বের করতে দেখেছি; খানিকটা নোনা বাঁধাকপি-স্কার্ভি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এটাই একমাত্র উপাদান আমাদের খাদ্য তালিকায়; আর বড় একটা বাসনে ঢিবি করা সেদ্ধ মটর কলাই ভর্তা, বাউন্টির নাবিকরা যার নাম দিয়েছে কুকুরের শরীর।

মদের গেলাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ব্লাই, যেন এমন সুস্বাদু খাবার জীবনে আর কখনও দেখেননি-খাওয়া দূরে থাক। এমন ভঙ্গিতে তিনি খেতে লাগলেন, দেখলে যে কারও মনে তাঁর ভদ্রতাবোধ সম্পর্কে প্রশ্ন জাগবে। ফ্রায়ার লোকটা একটু রুক্ষ প্রকৃতির, সভ্যতা ভব্যতার ধার বড় একটা ধারে না, ক্রিশ্চিয়ানও অনেকটা তেমনি। তবু আমার মনে হলো ওরাও যেন লজ্জা পেল ক্যাপ্টেমকে অমন জঘন্য খাবার বুভুক্ষুর মত খেতে দেখে। ভাষ্টেনের ডান দিকে বসেছে ক্রিশ্চিয়ান, বাঁ দিকে ফ্রায়ার, আর আমি সামনে। কিছুক্ষণ সাধারণ টুকটাক আলাপের পর কথার মোড় ঘুরে গেল বাউন্টির নাবিকদের দিকে।

জাহান্নামে যাক সব! বললেন ব্লাই; মাংস আর কলাই ভর্তায় ভর্তি তার মুখ, দ্রুত চিবোতে চিবোতে জড়িত কণ্ঠে কথা বললেন তিনি। সব কটা বদমাশ, কুঁড়ের বাদশা! কি দেখে যে কর্তৃপক্ষ এদের বাছাই করল, বুঝতে পারি না… চিবোনো খাবারটুকু গিলে ফেলে আরেক গ্রাস মুখে পুরলেন ব্লাই। ওই যে বদমাশটা-কাল যাকে চাবুক মারলাম, কি যেন নাম, মিস্টার ফ্রায়ার?

প্রশ্নটা শুনে একটু লাল হলো মাস্টারের মুখ। বলল, বারকিট।

হ্যাঁ বারকিট, বেয়াদব কুকুর! বাকিগুলোও ওর মতই খারাপ। জাহাজের কাজ যদি এক বিন্দু বোঝে!

আমি কিন্তু, স্যার, আপনার সাথে একমত হতে পারছি না, ফ্রায়ার সবিনয়ে বলল। স্মিথ, কুইনটাল, ম্যাককয় সবাই প্রথম শ্রেণীর নাবিক, এমন কি ওই বারর্কিটও, যদিও ছোকরা ভুল

বেটা বেয়াদব কুকুর! মাস্টারকে থামিয়ে দিয়ে গর্জে উঠলেন ব্লাই। সামান্য কোন অভিযোগও যদি পাই, আবার.আমি ধরব বদমাশটাকে। পরের বার দুই নয়, চার ডজন লাগাব।

ক্যাপ্টেন থামতেই ক্রিশ্চিয়ান বলল, আমার মত যদি চান, তাহলে বলব, দুর্ব্যবহারের চেয়ে সদয় ব্যবহার করেই বারকিটের মত মানুষদের পোষ মানানো সহজ…।

ওকে শেষ করতে না দিয়ে ব্লাই হেসে উঠলেন হা-হা করে। মিস্টার ক্রিশ্চিয়ান, মেয়েদের স্কুলে মাস্টারি নিলেই ভাল করতে তুমি! হা-হা, সদয় ব্যবহার, তাই না? গ্লাস তুলে চুমুক দিলেন তিনি। এসব উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে নামাও, ভাল ক্যাপ্টেন হতে পারবে তুমি। সদয় ব্যবহার, হা! আমাদের নাবিকরা গ্রীক যতটুকু বোঝে সদয় ব্যবহারের মর্যাদা ঠিক ততটুকু বোঝে। ওরা যা ভাল বোঝে, তা হলো শাসন, কড়া শাসন! না হলে বিদ্রোহ আর দস্যুতা সাগরের নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াত।

তা অবশ্য ঠিক, স্বীকার করল ফ্রায়ার। কিন্তু মাথা নাড়ল ক্রিশ্চিয়ান। আমি মানতে পারছি না কথাটা, বিনয়ের সাথে সে বলল। আর দশজন ইংরেজের সাথে কোন পার্থক্য নেই আমাদের . নাবিকদের। কিছু কিছু লোক আছে সত্যিই যাদের কড়া শাসনে রাখতে হয়, তবে ভাল লোকও আছে যারা দয়ামায়াওয়ালা যোগ্য নেতার নেতৃত্বে নির্ভয়ে মৃত্যুর মুখে পর্যন্ত যেতে দ্বিধা করবে না।

 তেমন কোন লোক আছে আমাদের জাহাজে? নাক সিটকানো ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন ব্লাই।

আমার মনে হয় আছে, স্যার, আগের মতই বিনীত কণ্ঠে বলল ক্রিশ্চিয়ান, এবং সংখ্যায় তারা খুব কম নয়।

সত্যিই! একজনের নাম করো তো!

ছুতোর মিস্ত্রী মিস্টার পার্সেল। লোকটা…

এবার আগের চেয়ে অনেক উচ্চস্বরে, এবং বেশিক্ষণ ধরে হাসলেন ব্লাই। সত্যিই মানবচরিত্র বিচারে তোমার জুড়ি মেলা ভার, ক্রিশ্চিয়ান! ওই মাথামোটা বুড়ো বদমাশটা! হা-হা, সদয় ব্যবহার খুব ভাল বলেছ!

মুহূর্তে রক্ত উঠে এল ক্রিশ্চিয়ানের মুখে। অনেক কষ্টে রাগ সামলে সে বলল, বুঝলাম পার্সেলকে আপনার পছন্দ নয়। তাহলে মরিসন।

মরিসন! মানে সারেঙের মেট নেকড়ের চামড়া গায়ে ভেড়া? বলছ এদের সাথে সদয় ব্যবহার করতে হবে?

নেকড়ের চামড়া গায়ে ভেড়া কি না জানি না, স্যার, বলল ফ্রায়ার, এটুকু জানি, ভাল নাবিক মরিসন। মিডশিপম্যান ছিল, তাছাড়া ওর নুও দ্র ঘরে।

জানা আছে আমার! ব্যঙ্গের সুরে বললেন ব্লাই। তোমরা যে যা-ই বলল আমার মত বদলাবে না। মরিসনকে সাবধান থাকতে বোলো! ওর দিকে নজর। রাখছি আমি। একটু বেচাল দেখলেই এমন শিক্ষা দেব..। কি বলছিলে?-দ্র ঘরের ছেলে? মানে চামড়াটা বারকিটের মত পুরু নয়? তাহলে তো আরও বেশি সাবধান থাকতে বলবে। ওর সারেঙও ওকে বাঁচাতে পারবে না।

খেতে খেতে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করলাম ক্যাপ্টেন এবং মাস্টারকে। কিছুক্ষণের ভেতর কোন সন্দেহ রইল না ক্যাপ্টেনকে অপছন্দ করে ফ্রায়ার, পনির নিয়ে সেই ব্যাপারটা সে ভুলতে পারেনি। ব্লাইও অপছন্দ করেন তাঁর মাস্টারকে; সবচেয়ে বড় কথা, সেটা তিনি গোপন করার চেষ্টা করছেন না মোটেই। ক্রিশ্চিয়ানকেও তিনি পছন্দ করেন না, সেটাও লুকানোর চেষ্টা করছেন না। ভাবখানা তোমাদের আমি অপছন্দ করি এর ভেতর লুকোচুরির কি আছে?

কয়েকদিন পরে ওল্ড ব্যাকাস-এর কাছে শুনলাম, ক্যাপ্টেনের সাথে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে মাস্টার। অবাক হলাম না শুনে এমন কিছু ঘটবে, আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম।

.

বিষুবরেখা পার হয়ে এসেছে বাউন্টি।

টেনেরিফ থেকে প্রচুর কুমড়ো নিয়েছিলাম আমরা খাওয়ার জন্যে। বিষুবীয় অঞ্চলের উত্তাপে এবার সেগুলোয় পচন ধরল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেগুলো শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ব্লাই। রুটির বদলে নাবিকদের কুমড়ো সরবরাহের হুকুম দিলেন স্যামুয়েলকে; তাও দুপাউন্ড রুটির বদলে এক পাউন্ড কুমড়ো। স্বভাবতই ব্যাপারটা পছন্দ হলো না কারও। কুমড়ো নিতে অস্বীকার করল সবাই। যথারীতি স্যামুয়েল গিয়ে খবরটা জানাল ক্যাপ্টেনকে। সবাইকে ডেকে জড় হওয়ার নির্দেশ দিলেন ব্লাই।

আমি দেখতে চাই, কার এত বড় সাহস যে কুমড়ো নিতে অস্বীকার করে! ক্রুদ্ধ বাঘের মত গর্জে উঠলেন তিনি। কুমড়ো তো ভাল জিনিস, আমি যা দেব তা-ই খেতে হবে, বদমাশের দল! যদি ঘাস দেই, তা-ও খেতে হবে।– কি করে তোমাদের শায়েস্তা করতে হয় আমি জানি!

এবার আর কেউ অস্বীকার করল না কুমড়ো নিতে। তবে নিল ঠিকই কিন্তু বেশিরভাগই ফেলে দিল পানিতে।

দুএক দিনের ভেতরই আরেকটা গুঞ্জন উঠল, বিশেষ করে অফিসারদের ভেতর, মাংসের পিপেগুলোয় যে পরিমাণ মাংস থাকা উচিত আছে তার চেয়ে কম এবং এই কমটুকু পুষিয়ে নেয়ার জন্যে নাবিকদের সরবরাহ করার সময় কম দেয়া হয় ওজনে। অনেক দিন ধরেই ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা চলছিল, এবার সরব হয়ে উঠল সবাই। তদন্ত করে ব্যাপাটার সুরাহা করার আবেদন জানাল, ওরা মাস্টারের কাছে। আবার সবাইকে ডেকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলেন ব্লাই।

মিস্টার ফ্রায়ারের কাছে অভিযোগ করেছ, হ্যাঁ? চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন তিনি। খাওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট নও তোমরা! শোনো শেষ বারের মত আমি বলছি, খোদার কসম বলছি, সন্তুষ্ট হওয়ার চেষ্টা করো। মিস্টার স্যামুয়েল যা করে আমার নির্দেশে করে; বুঝতে পেরেছ? হ্যাঁ, আমার নির্দেশে করে। অভিযোগ করে লাভ হবে না। কোন প্রতিকারই কেউ করতে পারবে না। কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক আমি জানি। তোমাদের অভিযোগ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। আর না। এর পর আর কোন অভিযোগ যে করবে; কোন কথা। নেই, চাবকানো হবে তাকে। এ-ই আমার শেষ কথা। আশা করি মনে থাকবে সবার।

প্রতিকারের আশা বৃথা বুঝতে পেরে সবাই চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করল। খাবার সম্পর্কে আর কোন অভিযোগ এর পর কেউ করেনি। তাই বলে নিজেদের ভেতর গুঞ্জন ওরা বন্ধ করেনি। স্যামুয়েলের সহযোগিতায় ভাল ভাল খাবার সব চুরি করে ওদেরকে ব্লাই খারাপ খাবার খাওয়াচ্ছে-এ ধরনের আলাপ, ওদের ভেতর চলতেই থাকল।

.

ব্রাজিল উপকূল ছাড়িয়ে প্রায় একশো লিগ আসার পর বাতাস দিক বদলে বইতে লাগল উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিক থেকে। এর পর হঠাৎ বাতাস পড়ে গেল। তারপর হঠাৎই আবার বইতে শুরু করল। বুঝতে পারলাম, দক্ষিণ-পূর্ব বাণিজ্য বায়ুর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি আমরা। বাতাসের এই নিত্য পরিবর্তনশীল এলাকায় দিন দুই পাল গুটিয়ে স্থির ভেসে রইল বাউন্টি। নাবিকরা সব মেতে উঠল মাছ ধরায়। বরাদ্দ সামান্য নোনা মাংসের খানিকটা বড়শিতে গেঁথে ছিপ ফেলল অনেকে; দুএকটা হাঙর বা বড়সড় মাছ যদি পাওয়া যায় এই আশায়।

হাঙর খাওয়ার কথা শুনে ডাঙার মানুষরা হয়তো নাক সিটকাবেন; কিন্তু যারা নাবিক, যারা একটু তাৰ্জা মাংস খেতে পাওয়ার আশায় দীর্ঘদিন হা পিত্যেস করে বসে থাকে তাদের কাছে হাঙরের মাংসও রীতিমত শখ করে খাওয়ার জিনিস।

অনেকের সঙ্গে বড়শি ফেলেছে গোলন্দাজের মেট, জন মিলস। বছর। চল্লিশেক বয়েস লোকটার। লম্বা, পেটা শরীর। জাহাজের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে বড়শি ফেলেছে সে। পাশে দাঁড়িয়ে ছুতোর মিস্ত্রীর সহকারী নরম্যান

আর উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সহকারী ব্রাউন। মোটা রশির মাথায় বড়সড় বড়শি। টোপ হিসেবে দিয়েছে সারাদিনে খাওয়ার জন্যে যেটুকু নোনা মাংস পেয়েছে ওর মেস তার প্রায় পুরোটাই। বেশ কিছুক্ষণ রশি ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভাগ্য প্রসন্ন হলো মিলস-এর। ফুট দশেক লম্বা একটা হাঙর পিঠ উঁচিয়ে চলে গেল বাউন্টির গলুইয়ের নিচ দিয়ে। রেলিংয়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়লাম আমি দেখার জন্যে।

কয়েক মুহূর্ত পরেই ছোট একটা ডোরাকাটা মাছ দেখতে অনেকটা ম্যাকরেলের মত-লাফিয়ে উঠল জলের ওপর।

পাইলট মাছ! চিৎকার করে উঠল নরম্যান। সাবধান এবার আসবে হাঙরটা!

চুপ, গাধা! ধমক দিল মিলস। বানরের মত লাফিও না অত-ভয় পাইয়ে দেবে তো ওকে!

দেখা গেল হাঙরটাকে। ঝকঝকে নীল জলের বুকে নোংরা মনে হচ্ছে ওটার হলদেটে শরীর। টোপ লক্ষ্য করে ছুটে এল। প্রতিটা মুখ কুঁকে পড়েছে রেলিংয়ের ওপর। চোয়াল দুটো হাঁ হলো হাঙরের। একবারে গিলে ফেলল বড়শিসুদ্ধ টোপটা।

 খেয়েছে! খুশিতে চিৎকার করে উঠল মিলস। টানতে শুরু করল দড়ি। নরম্যান, ব্রাউন, ধরো, টানো! একটানে ডেকের ওপর উঠিয়ে ফেলতে হবে।

রশিটা যথেষ্ট শক্ত। মিলস আর তার দুই সহকারী টানছেও প্রাণ দিয়ে। কিছুক্ষণের ভেতর রেলিংয়ের পাশ ঘুরে ধপাস করে ডেকের ওপর আছড়ে পড়ল বেচারা হাঙর। তড়পাতে লাগল। এই ফাঁকে ছুটে গিয়ে একটা ছোট কুঠার নিয়ে এল মিলস। সর্বশক্তিতে হাঙরটার মাথায় ঘা মারল কয়েকটা। তড়পানো থেমে গেল জলদানবের। শরীর আর লেজটা কেবল কাঁপছে থির থির করে। ছসাতজন নাবিক এক সাথে হামলে পড়ল ওটার ওপর। দেখতে দেখতে মাথাটা আলাদা করে ফেলল বড় ছুরি দিয়ে, শরীরটা কেটে ফেলল টুকরো টুকরো করে। তারপর সাগর থেকে বালতি ভরে পানি তুলে ধুয়ে ফেলা হলো ডেক। পরিতৃপ্তির হাসি মিলস-এর মুখে। নাবিকদের ভেতর হাঙরের টুকরো বিলি করতে বসল সে এবার। এই সময় ক্যাপ্টেনের কেরানী গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল তার দিকে।

চমৎকার জিনিস, তোষামুদে স্বরে সে বলল। ধরেছও দারুণ বুদ্ধি খাঁটিয়ে। আমাকে এক টুকরো দেবে তো, না?

বাউন্টির আর সব নাবিকের মত মিলসও অন্তর থেকে ঘৃণা করে স্যামুয়েলকে। লোকটা পানি ছাড়া আর কিছু পান করে না। সবার সন্দেহ, নিজের ভাগের মদ ও জমাচ্ছে দেশে ফিরে বিক্রি করবে বলে।

একটা টুকরো তাহলে চাই তোমার, হ্যাঁ? গরগরিয়ে উঠল গোলন্দাজের মেট। ঠিক আছে দেব, কিন্তু বদলে আমাকে এক বোতল মদ দেবে তুমি, যে সে জিনিস হলে চলবে না, ভাল জিনিস দিতে হবে, তা না হলে আজ হাঙর খাওয়ার আশা তোমাকে ছাড়তে হবে।

কেন ভাই এমন কৃপণের মত ব্যবহার করছ, আগের মতই মধুর স্বরে বলল স্যামুয়েল। তোমার একার ভাগে যা রেখেছ তা দিয়েই তো ডজন খানেক লোককে খাওয়াতে পারবে।

আর তোমার ভাগের মদ বা এতদিন জমিয়েছ তা দিয়ে তো হাজার খানেক লোককে খাওয়াতে পারবে।

শোনো, ভাই মিলস, আমি নিজের জন্যে চাইছি না, চাইছি ক্যাপ্টেনের জন্যে।

এতই যদি দরদ, নিজে একখানা ধরে খাওয়াও না ক্যাপ্টেনকে। এটা আমার, আমি ধরৈছি, আমার যাকে ইচ্ছা দেব, যাকে ইচ্ছা নয় দেব না। ক্যাপ্টেন তো সব খাবারের ভাল ভালগুলো খাচ্ছে, আমাদের খাওয়াচ্ছে রদ্দিগুলো, কেন ওকে আমার ভাগের জিনিস দিতে যাব?

কার সম্পর্কে কি বলছ, বুঝে বলছ তো, মিলস। চাবুকের মত হিস করে উঠল স্যামুয়েলের গলা। কথা না বাড়িয়ে একটা টুকরো আমাকে দিয়ে দাও। ক্যাপ্টেনকে আমি কিছু বলব না।

কিছু বলবে না! এই যে-নাও তাহলে তোমার টুকরো! বলতে বলতে দশ বারো পাউন্ড ওজনের এক টুকরো কাঁচা মাছ গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে ছুঁড়ে দিল মিলস সোজা স্যামুয়েলের মুখ বরাবর। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল নিচে নামার সিঁড়ির দিকে।

অত বড় একটা টুকরোর ধাক্কা সামলাতে পারেনি স্যামুয়েল। চিৎ হয়ে পড়ে গেছে ডেকের ওপর। মিলস চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। নির্বিকার মুখে চলে গেল পেছন দিকে। হাঙরের টুকরোটা নিতে ভুলল না।

দ্রুত জাহাজময় ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। এবং এই প্রথমবারের মত মিলস লক্ষ করল, সে প্রিয় হয়ে উঠেছে বাউন্টির নাবিকদের কাছে। অবশ্য এটাও বুঝতে পারছে, শাস্তি সে এড়াতে পারবে না।

 ওল্ড ব্যাকাস বললেন, স্যামুয়েল খারাপ লোক সন্দেহ নেই-খুব খারাপ লোক, তবু শৃঙ্খলা লাই। যে কোন মূল্যে তা রক্ষা করবে ক্যাপ্টেন।

যা ভাবা গিয়েছিল তা-ই ঘটল। সন্ধ্যার পর পরই মিলসকে ধরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো। সারা রাত থাকল ওরকম। ভোরে শুরু হলো বিচার।

ছটার ঘণ্টা পড়তেই ডেকে হাজির হলেন মিস্টার ব্লাই। ক্রিশ্চিয়ানকে বললেন সবাইকে ডাকতে, অবাধ্যতার শাস্তি কেমন দেখুক। জাহাজের সামনের দিকে চলে গেল ক্রিশ্চিয়ান। চিৎকার করে জানিয়ে দিল ক্যাপ্টেনের নির্দেশ। একটু পরেই ডেকে হাজির হলো নাবিকরা। রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল সবাই নিঃশব্দে।

ঝাঁঝরি খাড়া করো! স্বভাবসুলভ কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন ব্লাই।

ছুতোর মিস্ত্রী আর তার সহকারীরা ধরাধরি করে দুই হ্যাঁচের মুখ থেকে তুলে আনল দুটো লম্বাটে চেহারার কাঠের ঝাঁঝরি। একটা ডেকের ওপর পেতে অন্যটা খাড়া করে দিল বাঁদিকের গ্যাংওয়ের সাথে ঠেকিয়ে।

হয়েছে, স্যার, জানাল ছুতোর মিস্ত্রী পার্সেল।

জন মিলস! হাঁক ছাড়লেন ব্লাই, সামনে এসো!

দৃঢ় পায়ে, মাথা উঁচু করে এগিয়ে এ মিলস। যে শাস্তিই দাও আমি গ্রাহ্য করি না, এমন একটা ভঙ্গি মুখে। ভুরু কুঁচকে তাকালেন ব্লাই ওর দিকে। বললেন, কিছু বলার আছে তোমার?

না, স্যার, মাথাটা সোজা রেখেই দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল মিলস। তাহলে কাপড় খোলো, আদেশ করলেন ক্যাপ্টেন।

খুলল না, গায়ের জামাটা ছিঁড়ে এক সঙ্গীর দিকে ছুঁড়ে দিল মিলস।

খালি গায়ে এগিয়ে গেল খাড়া ঝাঁঝরির দিকে। 

বাঁধো, চিৎকার করলেন ব্লাই।

দুই কোয়ার্টার মাস্টার নর্টন আর লেঙ্কলেটার এবার এগিয়ে এল। দুজনেরই হাতে লম্বা রশি। উঁচু করে ঝাঁঝরির ফাঁকের সাথে বেঁধে ফেলল ওরা মিলস-এর দুহাত।

বাঁধা হয়েছে, স্যার, জানাল নর্টন।

মাথা থেকে হ্যাট খুলে নিলেন ব্লাই। দেখাদেখি জাহাজের অন্যরাও। এবার পকেট থেকে এক কপি যুদ্ধকালীন আচরণ বিধি বের করে তার বিদ্রোহী বা বিদ্রোহাত্মক আচরণের শাস্তি সম্পর্কিত ধারাটি পড়ে শোনালেন গম্ভীর কণ্ঠে। তারপর বললেন, মিস্টার মরিসন, তিন ডজন। শুরু করো।

মরিসন লোকটা ভাল, মনে দয়া মায়া আছে। নীতিগত ভাবে সে শাস্তি হিসেবে চাবুক মারার বিরোধী। তবু ক্যাপ্টেন যখন নির্দেশ দিল চাবুক তুলে নিতে বাধ্য হলো সে। এগিয়ে গেল ঝাঁঝরির কাছে। তারপর সবার দিকে একবার তাকিয়ে মারতে লাগল সপাং সপাং করে।

প্রথমবার যখন চাবুক পিঠে পড়ল আহ! করে একবার আর্তনাদ করল মিলস। প্রথম ডজনটা পুরো হওয়ার আগে আর একটাও শব্দ করল না ও। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেল আঘাতগুলো।

দুহাত বুকের ওপর ভাঁজ কুঁরে দেখছেন ব্লাই। একবার শুনলাম পরিতৃপ্তির সাথে ক্রিশ্চিয়ানকে বলছেন, কে এই জাহাজের ক্যাপ্টেন দেখিয়ে তবে ছাড়ব!

তেরো বারের আঘাতটা পিঠে লাগতেই ভেঙে পড়ল মিলস-এর সহ্যক্ষমতা। এতক্ষণ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ও ব্যথা সামলাচ্ছিল। নিচের ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। এবার ও চিৎকার করে উঠল, ওহ! ওই ঈশ্বর! ওহ!

দ্বিতীয় ডজন যখন শেষ হলো তখন আর শব্দ করার ক্ষমতা নেই মিলস এর। অস্পষ্ট গোঙানির মত আওয়াজ কেবল বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। তৃতীয় ডজন শেষ হওয়ার আগেই জ্ঞান হারাল ও। কিন্তু থামল না মরিসন। ক্যাপ্টেন থামতে বলেনি সুতরাং থামতে পারে না। পুরো তিন ডজন মারার পর থামল সে। কয়েকজন নাবিক ছুটে গিয়ে বাঁধন খুলে দিল মিলস-এর! ডেকের ওপর লুটিয়ে পড়ল অচেতন দেহটা। ওল্ড ব্যাকাস এগিয়ে এসে বসলেন পাশে। প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করে ঘিরে থাকা নাবিকদের দিকে ফিরে শঙ্কিত কষ্টে বললেন, সিক বে-তে নিয়ে চলো!

নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেলেন ক্যাপ্টেন।

মার্চের শুরুতে ব্লাই উষ্ণ মণ্ডলীয় আবহাওয়ার উপযোগী হালকা পোশাক আশাক তুলে রেখে ভারী এবং গরম কাপড় চোপড় বের করার নির্দেশ দিলেন। আগে থাকতেই ঠিক ছিল বাউন্টি কেপ, হন ঘুরে পশ্চিম দিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় পড়বে, সে কারণে গরম কাপড় চোপড় আমরা সঙ্গে এনেছি। কেপ হর্ন দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। কনকনে ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস বিরামহীন ভাবে বয়ে চলেছে এখান দিয়ে। সুতরাং এ এলাকায় এসে নাবিকদের যে গরম কাপড় পরতে হবে তাতে আর সংশয় কী! শুধু পোশাক বদল না, আরও নানা দিক থেকে কেপ হর্নের শীতল ঝড়ো আবহাওয়ার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম আমরা। পুরানো হালকা পালগুলো নামিয়ে নতুন পাল বাঁধা হলো মাস্তুলে।

ইতোমধ্যে জাহাজের মেস ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সার্জন ওল্ড ব্যাকাস এখন আমাদের মেসের সদস্য। উনি ছাড়া স্টুয়ার্ট, হেওয়ার্ড, মরিসন এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানী নেলসনও এই মেসে খাওয়া দাওয়া করেন-আমার সহযোগী মিডশিপম্যানরা তো আছেই। কয়েক দিনের ভেতর আমরা কজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম।

বাউন্টি যত দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছে ঠাণ্ডার প্রকোপ ততই বাড়ছে। ডেক এখন রীতিমত নরক হয়ে উঠেছে-আগুনের নয়, শীতের। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বয়ে আসা তুষার-শীতল বাতাস আমাদের হাড় পর্যন্ত জমিয়ে দিতে চায়। ভারী ভারী পশমী কাপড় পরেও পরিত্রাণ নেই। কাজের সময়টুকু কোন মতে ওপরে কাটিয়ে নিচে নামতে পারলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে সবাই। শুধু ঠাণ্ডার কষ্ট সইতে হলে কথা ছিল না, মাঝে মাঝে ওই শীতল বাতাস বেগ বাড়তে বাড়তে হারিকেনের রূপ নেয়। তখন জীবনটাকে সত্যিই অসহনীয় মনে হয়। জাহাজ বাঁচানোর জন্যে বেশির ভাগ সময় তখন ডেকে কাটাতে হয় নাবিকদের, পাল দড়ি-দড়া ঠিক করার জন্যে মাস্তুলের মাথায় উঠতে হয় নামতে হয়। জীবনে যারা একাজ করেনি তারা বুঝতে পারবে না এতে কি কষ্ট!

প্রথম ঝড়ের দাপটটা কোন মতে সামলাল বাউন্টি, তারপর আর পারল। বাউন্টি প্রায় নতুন জাহাজ। তবু প্রবল ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরের সাথে যুঝতে গিয়ে পর্যদস্ত হয়ে পড়ল বেচারা। খোলের জোডগুলোর অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিল। অবিরাম পানি সেঁচার কাজে ব্যস্ত থাকতে হলো বেশ কিছু নাবিককে। শেষ পর্যন্ত যখন সামনের ডেকেও ফাটল দেখা দিল এবং সেখান দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ফোকাসূলে পানি পড়তে লাগল তখন প্রত্যেককে যার যার হ্যামক পেছনের বড় কেবিন অর্থাৎ রুটিফল গাছের চারা নেয়ার জন্যে সাজানো হয়েছে যেটা সেটায় নিয়ে গিয়ে ঝোলানোর নির্দেশ দিলেন ব্লাই দিলেন না বলে দিতে বাধ্য হলেন বলাই বোধহয় সঙ্গত। কারণ ফোকাসূলের প্রতিটা কুঠরিরই ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ছে। একে ঠাণ্ডা তার ওপর পানির ধারা, এই অবস্থায় ফোকাসূলে থাকা সম্ভব নয় কারও পক্ষে। অবশেষে ব্লাইয়ের নিজের কেবিনের ছাদ দিয়েও যখন পানি পড়তে লাগল তখন তার ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত ভেঙে চুর চুর হয়ে গেল। হর্ন অন্তরীপ ঘুরে যাওয়ার আশা বাদ দিলেন তিনি। বাউন্টির মুখ ঘুরিয়ে দেয়া হলো পুবদিকে। অর্থাৎ এখন আমাদের লক্ষ্য উক্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারত মহাসাগর পেরিয়ে দক্ষিণ সাগরে পৌঁছানো। জাহাজের প্রতিটা মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল ক্যাপ্টেনের এই সিদ্ধান্তে। কয়েক দিনের মধ্যে উষ্ণ আবহাওয়ায় পৌঁছে যাবে বাউন্টি।

সত্যিই আবহাওয়ার উন্নতি হলো কয়েক দিনের মধ্যেই। ঝড় বাদল থেমে গেল, তবে ঠাণ্ডা তেমনিই আছে। তা থাক, ঠাণ্ডা তেমন কোন সমস্যা নয়, ঝড় আর বৃষ্টি না হলেই হলো। নাবিকদের মনে স্বস্তি ফিরে এল। যদিও পানি সেঁচার কাজ পুরোদমেই চালাতে হচ্ছে। হর্ন অন্তরীপ থৈকে প্রচুর সামুদ্রিক পাখি ধরেছিলাম আমরা, তখন জাহাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে ওগুলো খাওয়ার সুযোগ পাইনি, এবার পেলাম। বহুদিন পর তাজা মাংসের স্বাদ পেয়ে মুখ ফিরল সবার। পেছনের বড় কেবিন থেকে আবার যে যার কুঠুরিতে ফিরে গেল।

এর ভেতর একদিন-মার্চের দশ তারিখে-খাবার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করায় খালাসী ম্যাথু কুইনটালকে চব্বিশ ঘা চাবুক মারার নির্দেশ দিলেন ব্লাই। আবার থমথমে হয়ে উঠল নাবিকদের মন।

.

মে-র তেইশ তারিখে আমরা নোঙ্গর ফেললাম আফ্রিকার উপকূলে, কেপ টাউনের কাছে এক জায়গায়। আটত্রিশ দিন এখানে রইল বাউন্টি। ডেক এবং খোলের ফাটলগুলো মেরামত করা হলো। পাল, দড়ি-দড়াও মেরামত করে নেয়া হলো। কারণ এর প্র আমরা যে পথে এগোব সে পথে ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড-এর আগে আর কোন নোঙ্গর করার মত জায়গা বা দ্বীপ পাওয়া যাবে না। ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে প্রায় দুমাসের পথ।

মেরামত ইত্যাদি শেষ হওয়ার পর আমরা আবার পাল তুলে দিলাম। ইতোমধ্যে জুন, মাস প্রায় শেষ। তেরো বার কামান দেগে কেপ টাউনের ওলন্দাজ দুৰ্গটাকে সাহায্য এবং সহযোগিতার জন্যে ধন্যবাদ এবং সম্মান জানাল বাউন্টি। তারপর সোজা ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড (এখনকার টাসমানিয়া)।

উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড পর্যন্ত সেই দীর্ঘ, শীতল কান্তিকর যাত্রার খুব সামান্যই আমার মনে আছে। আসলে মনে রাখবার মত তেমন কিছু ঘটেনি। দিনের পর দিন পশ্চিম এবং দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে বয়ে আসা তীব্র বাতাসের ধাক্কায় ভেসে যাওয়া আর ভেসে যাওয়া। চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সাগরের নীল পানি আর পানি। ব্লাইয়ের কঠোর আচরণে ফল হয়েছে; নাবিকদের ভেতরে কোন রকম অবাধ্যতা নেই। ফলে দিনগুলো সব এক, একঘেয়ে আর নিরুত্তাপ। নিয়ম মত কাজ করে যাওয়া, আর অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, গল্প-গুজব করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

অগাস্টের বিশ তারিখে আমরা মিউস্টোন পাহাড় দেখতে পেলাম। ভ্যান ডিয়েমেনস ল্যান্ড-এর দক্ষিণ পশ্চিম অন্তরীপের কাছে, ডাঙা থেকে ছলিগ মত দক্ষিণ-পুবে সাগর কুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ওটা। দুদিন পর অ্যাডভেঞ্চার বে-তে নোঙ্গর ফেলল বাউন্টি। এখানে আমরা কাটালাম প্রায় দুসপ্তাহ। কাঠ এবং পানি সংগ্রহের কাজেই প্রধানত ব্যয় হলো সময়টা। রোজ দুতোর মিস্ত্রীর তত্ত্বাবধানে গাছ কাটে একদল নাবিক, আরেক দল সেগুলো চেরাই করে তক্তা তৈরি করে অন্য এক দল চলে যায় দ্বীপের গভীরে পানি আনার জন্যে।

দ্বীপের যে অংশে আমরা নেমেছি কেমন যেন মরা মরা সে জায়গাটা। গাছ পালা আছে তবু মনে হয় নিষ্প্রাণ। বেশির ভাগ গাছই ইউক্যালিপটাস জাতীয়। সোজা উঠে গেছে। লম্বায় একশো দেড়শো ফুট, সত্তর থেকে আশি ফুট পর্যন্ত ডাল পালা শূন্য। পাতা যা তা আগার দিকে ত্রিশ চল্লিশ ফুটের ভেতর। পাখির সংখ্যা খুব কম। সারা দিনে একবার কি দুবার তাদের গান শোনা যায়। যে পনেরো দিন এখানে আমরা ছিলাম তার ভেতর বুনো জন্তু দেখেছি মাত্র একটা-অপোসাম জাতীয় খুদে এক প্রাণী, মোটা এক গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল আমাদের সাড়া পেয়ে। মানুষও দেখেছি এ জায়গায়,-সেই অপোসামটার মতই ভীতু। কালো তাদের গায়ের রঙ, শরীর সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গলার স্বর হাঁসের মত। বেশ কয়েকবার দেখেছি ওদের। প্রত্যেকবারই চার পাঁচজনের ছোট দল। আমাদের দেখেই দৌড়ে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়।

আমার ওপর পানি সংগ্রহকারী দলের দায়িত্ব দিয়েছেন ব্লাই। সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে একটা ঝর্না আছে। সেখান থেকে পানির পাত্রগুলো ভরে আমাদের বড় কাটার-এ (এক মাস্তুলওয়ালা দ্রুতগামী নৌকা) করে জাহাজে নিয়ে তুলতে হবে। দিনে দুতিনবার আমরা যাওয়া আসা করতে লাগলাম বাউন্টি আর ঝর্নাটার ভেতর।

ছুতোর মিস্ত্রী পার্সেলের ওপর দায়িত্ব কাঠ সগ্রহের। তাকে সাহায্য করছে দুই সহকারী ছুতোর নরম্যান আর ম্যাকইন্টশ আর দুজন খালাসী। ব্লাই নিজে বনের ভেতর ঘুরে দেখিয়ে দিয়েছেন কোন কোন গাছ কাটতে হবে। প্রথম দুতিন দিনে পার্সেলের সহকারীরা দুতিনটে বড় বড় ইউক্যালিপটাস গাছ কাটল। আগার দিকের ডাল পালা হেঁটে চেরাই শুরু করার আগে কি মনে করে গাছগুলো ভাল মত একবার পরীক্ষা করল পার্সেল। এবং বুঝতে পারল বৃথা গেছে তিন দিনের পরিশ্রম। এ-গাছ দিয়ে ভাল তা হবে না। তখন সে অন্য এক জাতের কতকগুলো ছোট ছোট গাছ কাটার নির্দেশ দিল। এই গাছগুলোর বাকল একটু রুক্ষ ধরনের, তবে কাঠ খুব শক্ত, লালচে রঙের।

সেদিন সকালে আমি আমার লোকদের পানি ভরা তদারক করছি। একটু দূরে পার্সেলের তত্ত্বাবধানে গাছ কাটছে তার লোকেরা। হঠাৎই ব্লাই উপস্থিত হলেন সেখানে। কাঁধে বন্দুক, সঙ্গে উদ্ভিদবিজ্ঞানী মিস্টার নেলসন। ভুরু কুঁচকে একবার গাছগুলোর দিকে তাকালেন ব্লাই। তারপরই কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার:

মিস্টার পার্সেল।

জি, স্যার?

এসব কি গাছ কাটছ? গর্জে উঠলেন ক্যাপ্টেন। এ দিয়ে যে তক্তা হবে তা আমাদের কী কাজে আসবে শুনি? আমার মনে হয় কোন ধরনের গাছ কাটতে হবে, তোমাকে আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম!

খুবই ভাল মিস্ত্রী পার্সেল। নিজের কাজ সে বোঝে; ব্লাই জাহাজ চালানোর কৌশল যতখানি বোঝেন ততখানিই বোঝে। এ নিয়ে তার একটু অহঙ্কারও আছে। তাছাড়া সার্জন ও ব্যাকাসকে বাদ দিলে বাউন্টির সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ সে [ মেজাজটাও তার ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের মতই, কখন উঠবে কখন পড়বে আগে থাকতে আন্দাজ করা শক্ত। ক্যাপ্টেনের কথা শুনে এক মুহূর্ত চুপ করে রইল সে। তারপর বলল:

হ্যাঁ, স্যার, দেখিয়েছিলেন।

তাহলে অকাজে সময় নষ্ট করছ কেন?

লাল হয়ে উঠল ছুতোর মিস্ত্রীর মুখ। আমি সময় নষ্ট করছি না, স্যার, শীতল কণ্ঠে সে বলল। আপনি যেগুলো দেখিয়ে দিয়েছিলেন তার কয়েকটা কেটে দেখেছি, ওগুলো দিয়ে কাজ হবে না।

কাজ হবে না? খালি ফাঁকি দেয়ার বুদ্ধি…ঠিক বলেছি কি না, মিস্টার নেলসন?

ক্যাপ্টেন আর ছুতোর মিস্ত্রীর এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার কোন ইচ্ছা নেলসনের নেই। তাই তিনি বললেন, আমি, স্যার, গাছ গাছড়া চিনি, কিন্তু কোনটায় কেমন কাঠ হবে তা বলা আমার ক্ষমতার বাইরে।

হ্যাঁ, ছুতোর মিস্ত্রী সেটা জানে, বলল বুড়ো পার্সেল। আমি বলছি, ওই সব বড় বড় গাছ দিয়ে তক্তা বানালে কোন কাজেই আসবে না তক্তাগুলো।

ক্রোধের চরম সীমায় পৌঁছে গেছেন ব্লাই। কঠোর কণ্ঠে তিনি বললেন, বেশি কথা না বলে যেমন বলেছি সেইমত করো, পার্সেল। তোমার সাথে তর্ক করার প্রবৃত্তি নেই আমার।

ঠিক আছে, স্যার, একগুঁয়ে স্বরে বলল পার্সেল, বড় গাছই কাটছি। কিন্তু আবার আমি বলছি, তক্তাগুলো কোন কাজে আসবে না। যার যেটা কাজ, সে-ই সেটা ভাল বোঝে…

চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ব্লাই। পাঁই করে ঘুরে আবার ছুতোর, মিস্ত্রীর মুখোমুখি হলেন তিনি।

বেটা বেজন্মা বুড়ো-আমার মুখে মুখে কথা! নরম্যান, তুমি এখন থেকে নেতা এখানকার। আর, পার্সেল, এক্ষুণি তুমি লেফটেন্যান্ট ক্রিশ্চিয়ানের কাছে হাজির হবে। পনেরো দিন শিকল বাঁধা অবস্থায় থাকবে।

পার্সেলকে জাহাজে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব চাপল আমার কাঁধে।

বুড়ো মিস্ত্রী রাগে কাঁপছে থর থর করে। দুহাত মুঠো পাকিয়ে বসে আছে নৌকার মাঝখানে। হঠাৎ তাকে বিড় বিড় করে বলতে শুনলাম, বেজন্মা বলল। ঠিক মত কর্তব্য পালনের পুরস্কার শিকল বাঁধা অবস্থায় থাকা! বড় বাড় বেড়েছে তোমার, ব্লাই! দাঁড়াও, ইংল্যান্ডে ফিরে নেই!

*

অ্যাডভেঞ্চার বে-তে বাকি যে কটা দিন বাউন্টি নোঙ্গর করে রইল, সাধারণ নাবিকদের দিন কাটল চরম অসন্তোষের ভেতর, আমার কাটল অস্বস্তিতে। এই অসন্তোষের পেছনে কোন কারণ যে নেই তা না। এখন মাথা পিছু যে পরিমাণ খাবার দৈনিক সরবরাহ করা হচ্ছে, পোর্টসমাউথ থেকে রওনা হয়ে আসার পর আর কখনও এত কম সরবরাহ করা হয়নি। ভ্যান ডিয়েমেনসল্যান্ড-এর যে জায়গায় আমরা নোঙ্গর ফেলেছি সেখানে খাবার মত এমন কিছু নেই যা দিয়ে। আমাদের খাদ্যাভাব কিছুটা পূরণ হতে পারে। অ্যাডভেঞ্চার বে-তে মাছ নেই। বললেই চলে। যা আছে তা এমন নিকৃষ্ট মানের যে দুএকদিন খাওয়ার পরই আর কেউ সেগুলো খেতে চাইল না। ডাঙায় পাখির সংখ্যাও খুব কম। ফলে ধরা কঠিন। বন্দুক থাকলে মারা যেত হতো, কিন্তু সাধারণ নাবিকরা ইচ্ছে করলেই পাখি শিকারের জন্যে বন্দুক তুলে নিতে পারে না। কিন্তু ব্লাই নিজে প্রতিদিনই বন্দুক কাঁধে চলে যান বনের ভেতর। ফিরে আসেন একটা বা দুটো বুনো হাঁস শিকার করে। নিজে খান সেগুলো। এটাই নাবিকদের অসন্তুষ্ট করল। সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে যোগ হলো ছুতোর মিস্ত্রীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যাপারটা। তার ওপর আছে ফ্রায়ার এবং ব্লাইয়ের ঠাণ্ডা লড়াই। একান্ত প্রয়োজন না হলে দুজন কেউ কারও সাথে কথা বলেন না। মাস্টারের সন্দেহ জাহাজের লোকদের কম খাবার দিয়ে ক্যাপ্টেন নিজের পকেট ভারী করছে। এত সব ব্যাপারের পর আমরা রওনা হওয়ার দুদিন আগে নেড় ইয়ং নামের এক মিডশিপম্যানকে কামানের সঙ্গে বেঁধে বারো ঘা চাবুক মারার নির্দেশ দিলেন ব্লাই।

ইয়ং-এর নেতৃত্বে দুজন খালাসী আর বাউন্টির নাবিক ডিক স্কিনারকে আমাদের ছোট কাটারটা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল শেলফিশ আর কাঁকড়া সগ্রহ করে আনার জন্যে।

নৌকা ভাসিয়ে ফ্রেডারিক হেনরি অন্তরীপের দিকে চলে যায় ওরা। বিকেলের ভেতর ফিরে আসার কথা কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরও ওরা ফিরল না। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল জাহাজের সবাই। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। অবশেষে এল ওরা। কিন্তু চারজন নয়-তিনজন। নাপিত স্কিনার নেই নৌকায়। কোথায় সে, জিজ্ঞেস করতে ইয়ং যা জানাল তার মর্মার্থ-হাঁটতে হাঁটতে বনে ঢুকেছিল কিনার, তারপর আর ফিরে আসেনি।

কাণ্ডের ভেতরটা ফাঁপা একটা গাছ দেখতে পায় ও, মিস্টার ব্লাইকে বলল ইয়ং। আশপাশে মৌমাছি উড়তে দেখে ওর ধারণা হয় গাছটার ভেতর চাক আছে। মধু পাওয়া যেতে পারে ভেবৈ ও আগুন জ্বেলে মৌমাছিগুলোকে গাছের ভেতর থেকে বের করে আনার অনুমতি চাইল আমার কাছে। বলল, কি করে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয় ও জানে, ছেলে বেলায় নাকি অনেকবার করেছে এ কাজ। মধু পেলে আপনি খুশি হবেন ভেবে আমি অনুমতি দেই। ওকে রেখে আমরা তিনজন চলে গেলাম শেলফিশ যোগাড় করতে। ঘণ্টা দুয়েক পর ফিরে দেখি গাছটার গোড়ায় আগুন জ্বলছে, কিন্তু স্কিনার নেই। ওর নাম ধরে ডাকাডাকি করলাম, সাড়া না পেয়ে শেষে কাটার থেকে নেমে বনের ভেতর ঢুকলাম। তিনজন সমানে চিৎকার করতে করতে খুঁজলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত, কিন্তু, স্যার, ওর কোন চিহ্নই দেখতে পেলাম না।

 আমি জানতাম সেদিন বিকেলে নাপিতের কাছে দাড়ি কামানোর কথা ব্লাইয়ের। সময় মত কাজটা হয়নি বলে এমনিতেই বিরক্ত হয়ে ছিলেন তিনি। এখন যে-ই শুনলেন নাপিত ব্যাটা উধাও হয়ে গেছে, জ্বলে উঠলেন তেলে বেগুনে।

জাহান্নামে যা শয়তানের বাচ্চা, গর্জে উঠলেন ক্যাপ্টেন। তোর মত যত মিডশিপম্যান আছে সেগুলোও আস্ত একেকটা শয়তান! মধু পেলে ওই জায়গায় বসেই তোরা খেয়ে আসতি, আমি তা ভাল করেই জানি! স্কিনার কোথায় বল? জানিস না? তাহলে যা, এক্ষুণি যা, জেনে আয়! তোর সঙ্গে যে দুটো বদমাশ ছিল ওদেরও নিয়ে যা। ফিনারকে ছাড়া ফিরবি না জাহাজে!

পূর্ণবয়স্ক মানুষ ইয়ং। ক্যাপ্টেনের কথা শুনে লাল হয়ে উঠল ওর চোখ মুখ। তক্ষুণি সে দুই খালাসীকে ডেকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল। ফিরল পরদিন দুপুরের সামান্য আগে। এবার স্কিনার আছে ওদের সঙ্গে। জানা গেল আরও মৌচাক যদি পাওয়া যায় এই আশায় ও বনের ভেতর ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলেছিল।

চব্বিশ ঘণ্টার ওপর না খেয়ে আছে চারটে মানুষ, কথাটা যেন মনেই পড়ল না ব্লাই-এর। ইয়ং ডেকে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিৎকার করে উঠলেন:

এসো, মিস্টার ইয়ং, কিভাবে কর্তব্য পালন করতে হয় সে সম্পর্কে সামান্য শিক্ষা তোমাকে দেব। মরিসন!

জি, স্যার!

তুমিও এসো, পেছনের ওই কামানটার সাথে বাঁধো মিস্টার ইয়ংকে। বারো ঘা লাগাবে। আর এই বদমাশ নাপিতটাকে বাঁধো গ্যাংওয়ের সাথে। ওকে লাগাবে চব্বিশ ঘা।

ইয়ং এবং ফিনারকে চাবকানোর খুঁটিনাটি বর্ণনা আমি দেব না, শুধু এটুকু বলব, সেই বারো ঘা চাবুক খাওয়ার পর আমূল বদলে গেল ইয়ং। ওর ভেতর থৈকে কে যেন উপড়ে নিয়েছে প্রাণ নামক জিনিসটা। মুখ বুজে কাজ করে যায়, নেহায়েত প্রয়োজন না পড়লে কারও সাথে কথা বলে না, এমন কি বার্থের অন্য মিডশিপম্যানদের সাথেও না। বহুদিন পর, সমস্ত কিছু যখন ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল, ও আমাকে বলেছিল, বাউন্টি ইংল্যান্ডে পৌঁছুলেই সে চাকরি ছেড়ে দেবে বলে ঠিক করেছিল।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন?

ইয়ং জবাব দিয়েছিল, প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে। ওর অধীনে চাকরি করে ওর কিছু করা যেত না, তাই চেয়েছিলাম সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে ওর মুখোমুখি হব।

*

সেপ্টেম্বরের চার তারিখে আবার আমরা নোঙ্গর তুললাম। অ্যাডভেঞ্চার পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম ওতাহিতের (এখনকার তাহিতি) দিকে। সাত সপ্তাহ পর দেখলাম আমার জীবনের প্রথম দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপ। আমাদের অবস্থা তখন শোচনীয়। ক্যাপ্টেনের দুর্ব্যবহার আর অর্ধাহার অনাহারে পাগল হওয়ার দশা সবার। তার ওপর নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে স্কার্ভি। বাউন্টির অর্ধেকের বেশি নাবিক আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে।

সেদিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বিকেল বেলায় কোন কাজ নেই। তাহিতি আর বেশি দূরে নয় ভেবে বসলাম স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস-এর পরামর্শে স্থানীয়দের সাথে বিনিময় করার জন্যে যে সব জিনিস এনেছি সেগুলো ভাল করে একবার দেখার জন্যে। স্যার ব্যাঙ্কস বলেছিলেন পেরেক, রেতি, মাছ ধরা বড়শি ইত্যাদির প্রচুর চাহিদা তাহিতীয়দের ভেতর। সস্তা গহনা পত্রেরও চাহিদা আছে-বিশেষ করে মেয়েদের ভেতর। মায়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ পাউন্ড নিয়েছিলাম এসব কেনার জন্যে। স্যার ব্যাঙ্কস দিয়েছিলেন আরও পঞ্চাশ পাউন্ড। পুরো টাকারই জিনিসপত্র কিনেছিলাম আমি। আমার জাহাজী সিন্দুকটার অর্ধেক ভরে আছে নানা আকারের বড়শি, পিতলের তারের কুণ্ডলী; সস্তা আংটি, কানের দুল, চুড়ি, হার; রেতি, কাঁচি, ক্ষুর, ছোট ছোট আয়না ইত্যাদিতে। রাজা জর্জের ছবিও এনেছি এক ডজন, স্যার জোসেফ এগুলো যোগাড় করে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আছে-সিন্দুকের একেবারে নিচে এক কোনায় লুকিয়ে রেখেছি-একটা বাক্স। মখমলে মোড়া। একজোড়া বালা আর একটা হার রয়েছে ওতে। অন্যসব জিনিসের মত সস্তা নয় এগুলো, খুব বেশি, দামীও অবশ্য নয়। বেশ রোমান্টিক স্বভাবের ছেলে ছিলাম আমি তখন। মনে হয়েছিল কোন সুন্দরী তাহিতীয় যদি আমাকে ভালবাসে বিনিময়ে আমি কি দেব?-তাই নিয়েছিলাম বালা আর হারটা। আজ এত বছর পরে হাসি পায় আমার। ভাবি, কি সরল সোজা ছিলাম তখন।

জিনিসগুলো সব বের করে ঝেড়ে ঝড়ে আবার ওঠাতে শুরু করেছি এমন সময় শুনতে পেলাম ব্লাইয়ের রুক্ষ, কর্কশ কণ্ঠস্বর। যেখানে আমি বসে আছি সেখান থেকে খুব বেশি হলে পনেরো ফুট দূরে ব্লাইয়ের কেবিন।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছ কেন, মিস্টার ফ্রায়ার? চিৎকার করলেন ক্যাপ্টেন। ভেতরে ঢোকো।

মাস্টারের গলা শুনতে পেলাম; জি, স্যার।

কাল অথবা পরশু, ব্লাই বললেন, মাতাভাই উপসাগরে নোঙ্গর করব আমরা। এ পর্যন্ত খাবার এবং অন্যান্য জিনিস যা খরচ হয়েছে তার একটা তালিকা তৈরি করিয়েছি স্যামুয়েলকে দিয়ে। এই যে দেখ-এতে একটা সই লাগবে তোমার।

দীর্ঘ নীরবতা এরপর। অবশেষে আবার শুনতে পেলাম ফ্রায়ারের গলা:

না, স্যার, এতে আমি সই করতে পারব না।

সই করতে পারবে না! কি বলতে চাইছ তুমি?

স্যামুয়েল ভুল করেছে। এত মাংস কখনোই দেয়া হয়নি নাবিকদের।

ভুল করছ তুমি, ফ্রায়ার, আমি জানি কোন জিনিস কতটুকু তোলা হয়েছিল। স্যামুয়েল ঠিকই লিখেছে।

আমি সই করতে পারব না, স্যার।

কেন? স্যামুয়েল যা করেছে আমার হুকুমে করেছে।…এক্ষুণি সই করবে! না হলে

আমি সই করতে পারব না, আবার বলল মাস্টার, অন্তত স্বেচ্ছায় নয়।

করবে: কার করে উঠলেন ব্লাই! করে আরও ভাল করবে! ধুপ ধাপ পায়ের আওয়াজ শুনলাম, সম্ভবত দরজার কাছে গেলেন ব্লাই। তারপর আবার চিৎকার; মিস্টার ক্রিশ্চিয়ান! সবাইকে ডেকে ডাকো এক্ষুণি!

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্রিশ্চিয়ানের চিৎকার শুনতে পেলাম। জাহাজের সামনে পৌঁছে দেয়া হলো ক্যাপ্টেনের আদেশ। কিছুক্ষণের ভেতর সবাই জড়ো হলো ডেকে। ঝপ পট আর জিনিসগুলো সিন্দুকে ভরে আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম। স্লাই এলেন। যুদ্ধকালীন আচরণবিধির বিদ্রোহ বা বিদ্রোহাত্মক আচরণের শাস্তি সম্পর্কিত ধারাটি পড়ে শোনালেন। এরপর এগিয়ে এল স্যামুয়েল। হাতে সেই তালিকা লেখা খাতা, কলম কার কালির দোয়াত!

এবার, মিস্টার ফ্রায়ার, ব্লাই বললেন, সই করো এই খাতায়।

মৃত্যুর মত নিস্তব্ধ বাউন্টির ডেক। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ফ্রায়ায়। তারপর এগিয়ে গিয়ে কলমটা নিল স্যামুয়েলের কাছ থেকে।

মিস্টার ব্লাই, অতি কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করে সে বলল, জাহাজের সবাই সাক্ষী থাকল, আপনার নির্দেশ পালন করার জন্যেই কেবল আমি সই করছি। কিন্তু, স্যার, ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে গেল ভাবলে ভুল করবেন আপনি।

ঠিক সেই সময় মাস্তুলের মাথা থেকে ভেসে এল একটা চিৎকার:

ডাঙা দেখা যায়!

.

চার

ছোট্ট পাহাড়ী দ্বীপটার নাম মেহেতিয়া। অবস্থান তাহিতির চল্লিশ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে। দুচোখ ভর্তি বিশ্বাস নিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম দিগন্তরেখার কাছে বিন্দুর মত স্থির অবয়বটির দিকে। সত্যিই তাহলে দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপ মালায় এসে গেলাম আমরা। সন্দেহ নেই; বাউন্টি এখন সেদিকেই এগোচ্ছে।

সারারাত ঘুমাতে পারলাম না উত্তেজনায়। দ্বীপটাকে কাছ থেকে দেখতে কেমন লাগবে কল্পনা করতে লাগলাম কেবল।

পরদিন ভোরে, ঠিক সূর্যোদয়ের আগে উপকূলের খুব কাছ দিয়ে মতিয়া দ্বীপকে পেরিয়ে গেল বাউন্টি। জীবনে প্রথমবারের মত দেখলাম নারকেল গাছের সবুজ ঝাঁকড়া টুপি পরা দীঘল শরীর, ঝোঁপ ঝাড়ের ভেতর দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপবাসীদের তৃণ ছাওয়া ছোট্ট কুটির। দেখলাম ঝকঝকে রূপালি সৈকতে হেঁটে বেড়াচ্ছে ওদের কয়েকজন। বাউন্টিকে দেখা মাত্র ছুটে দ্বীপের ভেতর দিকে চলে গেল তারা। একটু পরেই দলে দলে নারী পুরুষ শিশু এসে ভীড় করল সাগরতীরে। চিৎকার, সেইসাথে বড় বড় সাদা কাপড় নেড়ে ওরা আমাদের আমন্ত্রণ জানাতে লাগল দ্বীপে।

জাহাজ থামিয়ে নৌকা নামানোর নির্দেশ দিলেন ব্লাই। কিন্তু খেয়াল করলাম, মাথায় ফেনার মুকুট পরে বিশাল বিশাল ঢেউ এগিয়ে যাচ্ছে সৈকতের দিকে। এই ঢেউ এড়িয়ে নৌকা তীরে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও

মেহেতিয়ায় নামতে পারলাম না আমরা। হাত নেড়ে বিদায় জানালাম, দ্বীপবাসীদের। ভরা পালে এগিয়ে চলল বাউন্টি।

সবে মাত্র দ্বীপটার উত্তর প্রান্ত পার হয়েছি আমরা, এই সময় মাস্তুলের ওপর থেকে স্মিথ চিৎকার করে উঠল:

দেখুন, মিস্টার বিয়্যাম!

ওপর দিকে তাকালাম, হাত তুলে সামনের দিকে ইশারা করে আছে স্মিথ। ওর ইশারা অনুসরণ করে চোখ ফেরাতেই দেখি, অনেক অনেক লিগ দূরে বিশাল এক পাহাড়ের অবয়ব উঠে এসেছে সাগর ফুড়ে। সকালের আলোয় হালকা নীল, একটু যেন ভৌতিক দেখাচ্ছে। চূড়া থেকে সমান ভাবে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে পাহাড়টার দুই পাশ।

তরতরিয়ে এগোচ্ছে আমাদের জাহাজ। আমি তাকিয়ে আছি। ঘোর লেগেছে যেন চোখে। কতক্ষণ অমন সম্মোহিতের মত দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, সংবিৎ ফিরতেই ছুটে গেলাম ডেকে। মিস্টার ব্লাইও তাকিয়ে আছেন অবয়বটার দিকে। অদ্ভুত প্রসন্ন দৃষ্টি চোখে। মেজাজটাও সেরকম। আমার পিঠ চাপড়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন তিনি।

ওই যে দেখ, আঙুল তুলে ইশারা করলেন ব্লাই ভৌতিক অবয়বটার দিকে, ওটাই তাহিতি! অবশেষে আসতে পেরেছি আমরা, কি বলো?

মনে হচ্ছে খুব সুন্দর দ্বীপটা, আমি মন্তব্য করলাম।

সত্যিই সুন্দর-এত সুন্দর আর হয় না। ক্যাপ্টেন কুক ইংল্যান্ডের পর যদি কোন দেশকে ভালবেসে থাকেন তো সে এই তাহিতি। আমিও, বুড়ো বয়েসে যখন হাতে কোন কাজ থাকবে না, জীবনের শেষ দিনগুলো এখানকার নারকেল কুঞ্জের ছায়ায় কাটাতে পারলে আর কিছু চাইব না। এই দেশের মত এর মানুষগুলোও সুন্দর। লম্বা পথ পাড়ি দিতে হলো ওদের কাছে আসতে। কাল রাতে লগ দেখে হিসেব করছিলাম। এ পর্যন্ত কত মাইল জাহাজ চালিয়েছি আমরা জানো? সাতাশ হাজার মাইলেরও বেশি!

.

বিকেল নাগাদ দ্বীপটায় কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম আমরা।

তাহিতির সবচেয়ে সুন্দর সবচেয়ে ঐশ্বর্যময় অংশ তাইয়ারাপু। তার পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে বাউন্টি। আমি দাঁড়িয়ে আছি রেলিংয়ের ওপর ভর দিয়ে। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছি না দ্বীপটার দিক থেকে। উপকূলের প্রায় মাইল খানেক এপাশে দীর্ঘ এক প্রবাল প্রাচীর দ্বীপটাকে বেষ্টন করে আছে। সাগরের ঢেউ তাতে বাধা পেয়ে ভেঙে পড়ছে শতধা হয়ে। প্রাচীরের ওপাশে শান্ত লেগুন। সেখানে ক্যানোয় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্থানীয় ইন্ডিয়ানরা। লেগুনের ওপাশে দীর্ঘ বালুকাবেলা। তার ওপাশে সরু একফালি জমি। তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছবির মত তৃণ ছাওয়া কুটির; আভা, রুটিফল; নারকেলের বাগান। আরও ওপাশে ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে গেছে সবুজ পাহাড়ের ঢাল। একেবারে চূড়া পর্যন্ত গাছপালায় ছাওয়া বিশাল পাহাড়। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পাচ্ছি অসংখ্য রুপালি রেখা। ঝরনা ওগুলো। জলপ্রপাতের মত নেমে এসেছে পাহাড়ের বুক ফুড়ে। সত্যিই অদ্ভুত। আমার ইউরোপীয় চোখ বিশ্বাসই করতে চাইছে না, এসব বাস্তব। মনে হচ্ছে, সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখছি যেন।

সারাটা বিকেল আমরা প্রবাল প্রাচীরের পাশে পাশে জাহাজ চালিয়ে গেলাম। তাইয়ারাপু এলাকার পর ফাওন, তারপর হিতিআঃ অবশেষে সন্ধ্যা যখন, হয় হয় তখন পৌঁছলাম তাইয়ারেই-এর পাহাড়ী উপকূলে। এখানে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল প্রবাল প্রাচীর। সাগর ভয়ঙ্কর গর্জনে গিয়ে ভেঙে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে।

বিশাল উপত্যকা প্যাপেনুর সামনাসামনি এসে পাল গোটানোর নির্দেশ দিলেন ব্লাই। সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই। আজ আর এগোনো যাবে না। বাতাস পড়ে গেছে। লেগুনের ভেতর জল যেমন স্থির তেমন স্থির প্রকৃতি। বাতাসের প্রবাহ নেই বললেই চলে। নোঙ্গর ফেলল না বাউন্টি। এমনিই ভেসে রইল শান্ত সাগরে।

রাতে খুব একটা ঘুমাতে পারল না নাবিকরা। বহুদিন পর কাল আবার ডাঙার মাটিতে পা রাখতে পারবে ভেবে উত্তেজিত সবাই। যারা স্কার্ভিতে আক্রান্ত তারা ভাবছে ডাঙায় নেমে খেতে পারবে তাজা ফল-মূল, শাক-সজি; শিগগিরই আবার সুস্থ সতেজ হয়ে উঠবে তারা।

পরদিন ভোরে, দিনের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম সবাই। রাতের বেলা বেশ খানিকটা পশ্চিমে সরে এসেছে বাউন্টি। এখন আমাদের সোজাসুজি সাগরের পাশে শুয়ে আছে ভাইপুপু উপত্যকা। সেখান থেকে ছোট্ট একটা নদী নেমে এসেছে। নদীটা যেখানে সাগরে মিশেছে সে জায়গার নাম পয়েন্ট ভেনাস। এই পয়েন্টে ক্যাপ্টেন কুক তাঁর অস্থায়ী মানমন্দির স্থাপন করেছিলেন শুক্র গ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্যে। সে কারণেই জায়গাটার নাম দিয়েছিলেন তিনি পয়েন্ট ভেনাস (শুক্র গ্রহ)। দ্বীপের আরও ভেতর দিকে ভাইপুপু উপত্যকার প্রান্ত থেকে উঁচু হয়ে উঠে গেছে সেই বিশাল পাহাড়টার চূড়া, স্থানীয়রা যার নাম দিয়েছে ওয়োহেনা। অন্তত সাত হাজার ফুট হবে ওটার উচ্চতা। সূর্যের প্রথম আলোয় কমলা,দেখাচ্ছে পাহাড়টা।

ছোট ছোট দুটো পাল মেলে দিলাম আমরা। ধীর গতিতে এগিয়ে চলল বাউন্টি এক লিগ মত দূরে উপকূলের দিকে। একটু পরে লক্ষ করলাম সৈকতের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার দ্বীপবাসী। অসংখ্য ক্যানো জলে ভাসানোর আয়োজন করছে তারা। আমরা আধ লিগ এগোনোর আগেই দেখলাম ক্যানোয় ক্যানোয় গিজ গিজ করছে মাতাই উপসাগর। প্রতিটা ক্যানোরই লক্ষ্য আমাদের জাহাজু। দ্রুত এগিয়ে আসছে সগুলো।

দেখতে দেখতে একেবারে সামনের ক্যানোগুলো পৌঁছে গেল বাউন্টির কাছে। ইন্ডিয়ানদের চিৎকার শুনতে পেলাম:

তাইও? পিরিতেন? রিমা? অর্থাৎ বন্ধু? ব্রিটেন? লিমা শেষ প্রশ্নটা ওরা করল বাউন্টি পেরুর লিমা থেকে আসা কোনো স্প্যানিশ জাহাজ কিনা জানাবার জন্যে।

তাইও! জবাব দিলেন ব্লাই। তাইও! পিরিতেন!

কথাটা শেষও করতে পারেননি ব্লাই, একটা ক্যানো ভিড়েছিল বাউন্টির গায়ে-সেটার আরোহীরা রেলিং টপকে এসে নামল ডেকের ওপর।

দেখতে দেখতে তাহিতীয় মানুষে ভরে গেল বাউন্টির ডেক। বেশির ভাগই পুরুষ-দীর্ঘদেহী, সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান সবাই। গায়ের রঙ সামান্য তামাটে। রঙচঙে ছবি আঁকা এক টুকরো কাপড় জড়ানো তাদের কোমরের কাছে, ঊর্ধ্বাঙ্গে কারও কারও কাপড় আছে, কারও নেই। মাথায় নারকেল পাতায় তৈরি মুকুটের মত এক ধরনের জিনিস। স্থানীয়রা একে বলে টাউমাতা। যে দুচারজন মহিলা এখন এসেছে তাদের সবাই সমাজের নিচু স্তরের মানুষ। তাদের পরনে হাঁটুর নিচে পর্যন্ত ঝুলে পড়া সাদা কাপড়ের কুঁচিওয়ালা, স্কার্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে অদ্ভুত দেখতে একটু আঁটো ধরনের আঙরাখা, এমন ভাবে তৈরি যাতে ডান হাতটা মুক্ত থাকে, অনেকটা রোমানদের টোগার মত।

মিস্টার ব্লাই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, দ্বীপবাসীদের সাথে কোন অবস্থাতেই যেন আমরা কোন রকম দুর্ব্যবহার না করি। খালি দৃষ্টি রাখতে হবে কোন জিনিস ওরা যেন চুরি বা নষ্ট করার সুযোগ না পায়। সুতরাং ওদের সঙ্গে সাধ্যমত ভাল ব্যবহার করতে লাগলাম আমরা। আমি আমার সিন্দুক থেকে কিছু টুকটাক উপহার এনে দিলাম কয়েকজনকে ভীষণ খুশি হলো তারা। এমনিতেই হাসিখুশি মানুষগুলো, উপহার পেয়ে এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত বিস্তৃত হলো তাদের হাসি।

অবশেষে উপকূলের কয়েকশো গজের মধ্যে পৌঁছুল বাউন্টি। আর এগোনো নিরাপদ নয় মনে করে পাল গুটিয়ে নোঙ্গর ফেলার নির্দেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। এবার, মিছরির ওপর পিঁপড়ে যেমন হামলে পড়ে আমাদের জাহাজটাকে তেমনি করে হেঁকে ধরল তাহিতীয়রা। শত শত ক্যানো ঘিরে। ধরল চারদিক থেকে। প্রত্যেকটার আরোহীরা অন্যগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, কাছাকাছি হতে চাইছে আমাদের। ডেকের ওপর একদল মেয়ের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছি আমি, এই সময় আমার ডাক পড়ল ক্যাপ্টেনের কেবিনে।

ঢুকে দেখি কেবিনে একাই আছেন মিস্টার ব্লাই। টেবিলের ওপর বিছানো মাতাতাই উপসাগরের একটা মানচিত্রের ওপর ঝুঁকে আছেন তিনি। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে সোজা হয়ে একটা সিন্দুক দেখিয়ে বসতে ইশারা করলেন।

তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই, মিস্টার বিয়্যাম, শুরু করলেন তিনি। এই মাতাভাই উপসাগরে বেশ কয়েক মাস থাকতে হবে আমাদের যত দিন না মিস্টার বিলসন রুটিফলের চারা সংগ্রহের কাজ শেষ করছেন অন্তত তত দিন। আমি জাহাজের আর সব কাজ থেকে তোমাকে ছুটি দিচ্ছি। এখন থেকে, যতদিন আমরা এখানে আছি, আমার বন্ধু স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস-এর ইচ্ছানুযায়ী তুমি কাজ করবে। স্যার জোসেফের ইচ্ছা কি তা নিশ্চয়ই তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে আসবার আগে?

জি, স্যার।

তাহলে আর কি?-তীরে চলে যাও। যোগ্য একজন তাইও খুঁজে বের করো। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই, সময় নিয়ে ভাল একজন তাহিতীয়কে বেছে নাও। একদিন, দুদিন, প্রয়োজন হলে এক সপ্তা সময় নাও। একজন ভাল–তাইও বেছে নেয়ার ওপরই নির্ভর করছে তোমার কাজের সাফল্য।

বুঝতে পেরেছি, স্যার।

বেশ তাহলে যাও। সপ্তায় সপ্তায় এলে আমাকে জানিয়ে যাবে তোমার কাজ কেমন এগোচ্ছে।

ডেকে উঠে আসতেই মুখোমুখি হয়ে গেলাম মিস্টার ফ্রায়ারের।

ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করে এলে? জিজ্ঞেস করল সে।

হ্যাঁ।

কাল রাতে আমাকে ডেকে নিয়ে উনি বলেছেন, যতদিন এখানে থাকব জাহাজের কোন কাজে যেন তোমাকে না লাগাই। কেন?–তীরে যাবে?

হ্যাঁ।

ইন্ডিয়ান ভাষার অভিধান তৈরি করবে, তাই না?

হ্যাঁ, আমাকে আসলে সেজন্যেই সঙ্গে এনেছেন মিস্টার ব্লাই।

বেশ বেশ। একটা কথা, দ্বীপবাসীদের সাথে কোন রকম বিনিময় বা ব্যবসা করতে যেও না, সব ধরনের ব্যবসার দায়িত্ব মিস্টার পেকওভারকে দেয়া হয়েছে। ইচ্ছে হলে উপহার দিতে পারো, বিনিময়ে কিছু নেবে না।

মনে থাকবে, স্যার।

ইন্ডিয়ানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যখন খুশি তুমি তীরে যেতে পারো।

ধন্যবাদ, স্যার, বলে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি একটা জোড়া ক্যানো চলে যাচ্ছে জাহাজের কাছ থেকে। কিছুক্ষণ আগে ডাঙার কোন এক গোত্রপ্রধানের কাছ থেকে উপহার হিসেবে কয়েকটা শুকর নিয়ে এসেছিল ওটা। এখন ফিরে; যাচ্ছে। তীরে যাওয়ার জন্যে ভেতরে ভেতরে উদগ্রীব হয়ে উঠেছি আমি। মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের সঙ্গে যেতে পারি না?

নিশ্চয়ই। ডাকো না চিৎকার করে।

রেলিংয়ের কাছে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম জোড়া ক্যানোর আরোহীদের। ইশারায় জানালাম আমি ওদের সাথে তীরে যেতে চাই। মনে হলো আমার ইশারা বুঝতে পারল ওরা। ক্যানোর পেছন দিকে বসা দলনেতা গোছের এক লোক কি একটা নির্দেশ দিল দাড়ীদের। অমনি ক্যানোর, মুখ ঘুরে গেল আমাদের দিকে। কয়েক মিনিটের ভেতর, আবার বাউন্টির গায়ে এসে ভিড়ল ওটা। রেলিং টপকে আমি নেমে গেলাম। একটু পরেই আবার তীরের দিকে চলতে লাগল ক্যানোটা।

ডাঙায় পা রাখা মাত্র দলে দলে নারী পুরুষ ঘিরে ফেলল আমাকে। সংখ্যায় তারা এত বেশি, আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় ভাঙতে বেশিক্ষণ লাগল মা অবশ্য। মানুষগুলো খুবই অদ্র, রীতিমত সুসভ্য বলা যায়। ওদের চোখে মুখে অপার বিস্ময় আর আমাকে স্বাগত জানানোর আকুতি ছাড়া অন্য কোন অনুভব নেই। বাচ্চারা মায়েদের স্কার্টের প্রান্ত আঁকড়ে ধরে আছে, ওরাও অবাক বিস্ময়ে দেখছে আমাকে। আর ওদের মা বাবারা ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে আসতে চাইছে আমার সাথে করমর্দন করার জন্যে। হ্যাঁ, পরে জেনেছিলাম, প্রিয় বা শ্রদ্ধেয় কাউকে স্বাগত জানানোর জন্যে করমর্দনের রেওয়াজ চালু আছে–তাহিতীয়দের ভেতর।

হঠাৎ গম্ভীর একটা গলা ভেসে এল ওপাশ থেকে। জনতা দুপাশে সরে মাঝ বয়েসী দীর্ঘদেহী এক লোককে এগিয়ে আসার পথ করে দিল। সেই সাথে মৃদু একটা গুঞ্জন শোনা গেল:

ও হিটিহিটি!

মসূণ-কামানো গাল লোকটার, বেশির ভাগ ইন্ডিয়ান পুরুদের ভেতর যেটা দেখা যায় না। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, জায়গায় জায়গায় ধূসরের ছোপ লেগেছে। অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজ করা আলখাল্লা তার পরনে। লম্বায় ছফুটের ওপরে। দারুণ স্বাস্থ্য। সাধারণ তাহিতীয়দের চেয়ে ফর্সা গায়ের রঙ। মুখে সরল, প্রাণখোলা-একটু যেন কৌতুকপূর্ণ অভিব্যক্তি। প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারলাম এ লোক সাধারণ কেউ নয়। নিশ্চয়ই কোন গোত্রপতি বা গোত্রপতির পরিবারের সদস্য।

এগিয়ে এল সে। দুহাতে আমার দুকাঁধ ধরে আমার গালে নাক ঠেকিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল কয়েকবার। ব্যাপারটার আকস্মিকতায় প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও একটু পরেই বুঝতে পারলাম, এ এক ধরনের অভিবাদন জানানোর রীতি। ক্যাপ্টেন কুক যার নাম দিয়েছিলেন নাক-ঘষা।

আমাকে ছেড়ে দিয়ে লোকটা তার প্রশস্ত বুকের ওপর আঙুল ঠেকিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল আমি হিটিহিটি। তুমি মিডশিপম্যন! কি নাম?

আরও একবার বিস্মিত হওয়ার পালা আমার। ইংল্যান্ড থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে প্রায় অসভ্য এই ইন্ডিয়ানদের দেশে ইংরেজি কথা শুনব স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। কয়েক মুহূর্ত কোন কথা যোগাল না আমার মুখে। হিটিহিটি আবার করল প্রশ্নটা:

এক নাম?

বিয়্যাম, জবাব দিলাম আমি।

বিয়্যাম! বিয়্যাম। সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উচ্চারণ করল হিটিহিটি। এদিকে জনতার মুখে মুখেও প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছে, বিয়্যাম! বিয়্যাম! বিয়্যাম!

দীর্ঘদিন ধরে যে জিনিসের জন্যে আমার প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছে সে জিনিস চাইলাম এবার। বললাম, একটু খাওয়ার পানি দিতে পারো আমাকে?

হিটিহিটি চমকে উঠে আমার হাত ধরল। চিৎকার করে চারপাশের লোকদের দিকে তাকিয়ে কি একটা নির্দেশ দিল। অমনি ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে কয়েকজন ছুটল দ্বীপের ভেতর দিকে। হিটিহিটি আমার হাত ধরে সৈকতের ঠিক পেছনে একটা ভোলা একচালার কাছে নিয়ে গেল। কয়েকজন তরুণী দ্রুত একটা মাদুর পেতে দিল। বসলাম আমরা। পাশাপাশি। একটু পরেই, যারা ছুটে চলে গিয়েছিল তারা ফিরে এল। এক জনের হাতে বড়সড় একটা শুকনো লাউয়ের খোল। টলটলে পানি তাতে। আমার দিকে এগিয়ে দিল। এক নিশ্বাসে আমি খোলটার অর্ধেক খালি করে ফেললাম।

এর পর একজন একটা ভাব কেটে এনে দিল-প্রথমবারের মত আমি স্বাদ নিলাম দক্ষিণ সাগরীয় এলাকার এই শীতল, মিষ্টি মদের। বড় একটা পাতা বিছিয়ে দেয়া হলো পাশে। কয়েকজন তরুণী পাকা কলা এবং আরও কয়েক রকমের ফল এনে রাখল তার ওপর। হিটিহিটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খাও!

লোভীর মত ফলগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাব, এমন সময় উল্লসিত একটা চিৎকার ভেসে এল সৈকতের দিক থেকে। ঘাড় ফেরাতেই দেখলাম বাউন্টির বড় নৌকাটা এগিয়ে আসছে ফেনাময় ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে। ব্লাই বসে আছেন তার পেছন দিকে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল হিটিহিটি।

ও পারাই! সবিস্ময়ে চিৎকার করল সে। ব্লাই শব্দটা তার অনভ্যস্ত উচ্চারণযন্ত্রের হাতে পড়ে পারাই হয়ে গেছে দেখে বেশ মজা পেলাম আমি। একটু পরেই আবার সে বসল আমার পাশে। বলল, তুমি, আমি, তাইও, হ্যাঁ?

আমি কিছু বলার আগেই আবার সে উঠে দাঁড়াল। ছুটল সৈকতের দিকে। নৌকাটা পৌঁছে গেছে তীরে। আমিও উঠে এগোলাম তার পেছন পেছন।

সবার আগে হিটিহিটিই অভ্যর্থনা জানাল ব্লাইকে, যেন কত দিনের পরিচিত দুজন। ব্লাইয়ের মুখেও দেখলাম পরিচিতের হাসি।

হিটিহিটি, প্রৌঢ় তাহিতীয় লোকটার করমর্দন করতে করতে তিনি বললেন, একদম আগের মতই আছ। পাকা চুলগুলো না থাকলে বুঝতেই পারতাম না তোমার বয়েস বেড়েছে।

হাসল হিটিহিটি। দশ বছর, হ্যাঁ? অনেক সময়! তুমি মোটা হয়েছ, পারাই!

এবার হাসার পালা ক্যাপ্টেনের।

আসো, আসো, হিটিহিটি বলে চলল। অনেক শুয়োর খাও! ক্যাপ্টেন টুট (কুক) কই? শিগগির আসবে তাহিতিতে?

বাবার কথা জিজ্ঞেস করছ?

অবাক চোখে ব্লাইয়ের দিকে তাকাল হিটিহিটি। ক্যাপ্টেন টুট তোমার বাবা!?

হ্যাঁ-তুমি জানতে না?

 কয়েক মুহূর্ত বিস্মিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল ইন্ডিয়ান গোত্রপতি। তারপর অদ্ভুত এক খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ। হাত উঁচু করে জনতাকে চুপ করতে বলে উদাত্ত স্বরে ভাষণ দিতে লাগল সে। ব্লাই পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, এই ফাঁকে আমার কানে কানে বললেন:

সবাইকে বলে দিয়েছি, ক্যাপ্টেন কুকের মারা যাওয়ার খবরটা যেন ইন্ডিয়ানদের না জানায়। তুমিও খেয়াল রেখো, মুখ ফস্কে কখনও যেন বলে বোসো না কুক নই। আমি কুকের ছেলে কথাটা ওদের বিশ্বাস করাতে পারলে সহজে আমাদের কাজ উদ্ধার হবে।

ব্লাইয়ের কথা যে কতখানি সত্যি বুঝতে পারলাম একটু পরেই হিটিহিটির ভাষণ শেষ হতেই গুঞ্জন উঠল সমবেত তাহিতীয়দের ভেতর। উত্তেজিত ভঙ্গিত কথা বলছে সবাই। অদ্ভুত কৌতূহল এবং বিস্ময়ের সঙ্গে তাকাচ্ছে:ব্লাইয়ের দিকে। বুঝলাম ওদের চোখে ক্যাপ্টেন কুকের ছেলে মানে ছোটখাট দেবতা বিশেষ। ক্যাপ্টেন কুক নিজে তাহলে কি ছিলেন সহজেই অনুমান করতে পারলাম।

এখানে সুযোগ পেয়ে আমি মিস্টার ব্লাইকে জানালাম, হিটিহিটি আমার তাইও হতে চেয়েছে।

চমৎকার! মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ব্লাই। ও এখানকার বড়সড় একজন গোত্রপতি। ওকে তাইও হিসেবে পেলে অনেক সহজ হয়ে যাবে তোমার কাজ। ইন্ডিয়ান লোকটার দিকে ফিরে ডাকলেন তিনি, হিটিহিটি!

হ্যাঁ, পারাই।

মিস্টার বিয়্যাম বলল, তুমি আর ও নাকি বন্ধু হয়েছ?

মাথা ঝাঁকাল হিটিহিটি। আমি, বিয়্যাম তাইও!

বেশ বেশ! বললেন ব্লাই। মিস্টার বিয়্যাম আমাদের দেশের এক গোত্রপতির ছেলে। তোমাদের জন্যে নানা রকম উপহার নিয়ে এসেছে ও; বিনিময়ে, আমি চাই, তোমার বাড়িতে রাখবে ওকে। যে কদিন আমরা এখানে আছি ও তোমাদের ভাষা শিখবে, লিখে নেবে। তাহলে ভবিষ্যতে যে সব বৃটিশ নাবিক এখানে আসবে তারা তোমাদের সাথে তোমাদের ভাষায়ই কথা বলতে পারবে। বুঝেছ আমার কথা?

কোন জবাব না দিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল হিটিহিটি। বিশাল একটা থাবা বাড়িয়ে ধরে মৃদু হেসে বলল, তাইও, হ্যাঁ?

আমরা হাত মেলালাম।

তক্ষুণি একটা ক্যানো জলে ভাসানো হলো আমার সব মালপত্র:বাউন্টি থেকে নিয়ে আসার জন্যে। সে রাত থেকেই আমি ঘুমাতে লাগলাম আমার নতুন বন্ধু মাহিনা ও আহেনু গোত্রের প্রধান এবং ফারেরোই মন্দিরের বংশানুক্রমিক প্রধান পুরোহিত হিটিহিটিতে-আতুয়াই-ইরি-হাউ-এর বাড়িতে।

.

পাঁচ

তীরে কিছু সময় কাটিয়ে জাহাজে ফিরে গেলেন ব্লাই। আমার হাত ধরে নিজের বাড়ির পথে এগোল আমার তাইও।

পয়েন্ট ভেনাস হয়ে দ্বিতীয় একটা লম্বা অর্ধচন্দ্রাকার সৈকত ঘুরে পুব দিকে কিছুদূর যাওয়ার পর সাগর তীরে সবুজ ঘাসে ছাওয়া এক টুকরো জমির ওপর হিটিহিটির বাড়ি। তীর থেকে কয়েকশো গজ মাত্র দূরে ছোট্ট একটা প্রবাল প্রাচীর খোলা সাগর থেকে আড়াল করে রেখেছে জায়গাটাকে। প্রবাল প্রাচীর আর সবুজ জমিটুকুর মাঝখানে একটা লেগুন। উষ্ণ নীল জল সেখানে। বাতাসের মত পরিচুর। গভীরতা দুই কি তিন ফ্যাদম হবে খুব বেশি হলে।

হিটিহিটির বাড়িটা চমৎকার-অবশ্যই আর দশটা তাহিতীয় বাড়ির তুলনায়। লম্বায় ষাট ফুট মত, চওড়ায় বিশ ফুট। বিরাট দোচালা। ঘাসের ছাউনি। প্রান্ত দুটো অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে যাওয়ায় ডিম্বাকৃতি চেহারা নিয়েছে ঘরটা। সামনে পরিষ্কার নিকানো উঠান। আমরা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই এক দঙ্গল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঘিরে ধরল আমার তাইওকে। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে হিটিহিটি বলল:

আমার নাতি-নাতনী।

হিটিহিটির বয়েস খুব বেশি হলে পঞ্চাশ। এই বয়েসে এতগুলো নাতি নাতনীর দাদা বা নানা হতে পারা কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পা বেয়ে উঠে গেল ওর কাঁধে। বাকিরা কৌতূহলী চোখে নিরীক্ষণ করছে আমার অদ্ভুত পোশাক আশাক।

বাচ্চাদের হৈ-চৈ শুনে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের সুন্দরী এক মেয়ে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, অপূর্ব দেহবল্লরী। সবচেয়ে আশ্চর্য যেটা, মেয়েটার চোখ দুটো নীল! কোন অইউরোপীয় মেয়ের চোখ এমন নীল হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। পরে জেনেছিলাম মেয়েটা বিবাহিতা এবং দুসন্তানের জননী। হিটিহিটি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে মেয়ের দিকে ফিরল।

ও হিনা, পরিচয় করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে শুরু করল সে। তারপর একটানা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে গেল। তাইও শব্দটা উচ্চারণ করতে শুনলাম কয়েকবার এছাড়া আর একটা কথাও আমি বুঝলাম না। বাবার কথা শেষ হতেই হিনা এগিয়ে এসে আমার সাথে করমর্দন করল, আমার গালে নাক ঠেকিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল, হিটিহিটি যেমন করেছিল। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে, খাবার আয়োজনের কতদূর তার খোঁজ খবর করতে।

এই সময় ঘর থেকে বেরিয়ে এল আরেকটা মেয়ে। হিনার চেয়ে সুন্দরী। বছর সতেরো হবে বয়েস। চেহারায় আচরণে গর্বিত ভঙ্গি। নাম মাইমিতি। হিটিহিটি আমার পরিচয় দিতেই হিনার মত মাইমিতিও করমর্দন করে, গালে নাক ঘষে অভিবাদন জানাল আমাকে। ইতোমধ্যে হিনা ফিরে এসেছে। মাইমিতির সাথে আমার পরিচয় পর্ব শেষ হতেই সে জানাল, খাবার তৈরি, এখন খেতে বসলেই হয়। মাথা ঝাঁকিয়ে আমার হাত ধরে খাওয়ার ঘরের দিকে এগোল হিটিহিটি।

প্রায় একশো গজ দূরে ঝোঁপ ঝোঁপ মত হয়ে থাকা কতগুলো লোহা গাছের নিচে একটা ভোলা একচালায় হিটিহিটির খাওয়ার ঘর। পাশেই রান্না ঘর। কোন মহিলা নেই সেখানে। হিটিহিটির বঁধুনিরা সবাই পুরুষ। খাবার ঘরের আঙিনা পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল হিনা আর মাইমিতি। পুরুষদের খাওয়ার ঘরে প্রবেশাধিকার নেই ওদের, এমনকি উপস্থিত থাকা পর্যন্ত নিষিদ্ধ।

তাহিতির পুরুষরা মেয়েদের সঙ্গ খুবই পছন্দ করে। সমাজে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা আছে মেয়েদের, স্বাধীনতাও পুরুষের প্রায় সমান, তবু ইন্ডিয়ানরা বিশ্বাস করে পুরুষরা আকাশ অর্থাৎ স্বর্গ থেকে এসেছে আর নারীর জন্ম পৃথিবীতে। পুরুষরা, অর্থাৎ পবিত্র আর নারী নোয়া, অর্থাৎ সাধারণ। গুরুত্বপূর্ণ দেব-দেবীদের মন্দিরে ঢোকা দূরের কথা, পা রাখাও নারীদের জন্যে নিষিদ্ধ। এই একই কারণে পুরুষের সঙ্গে এক সাথে বসে খাওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারীর জন্যে। পুরুষের রান্নাটা পর্যন্ত করার অধিকার দেয়া হয়নি নারীকে। এই একটা ব্যাপার ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রে নারী পুরুষে কোন ভেদ নেই তাহিতীয় সমাজে।

মুখোমুখি খেতে বললাম আমি আর হিটিহিটি। পরিবেশনের দায়িত্বে আছে একাধিক ভৃত্য। শুরুতেই পানিভর্তি দুটো নারকেলের মালা নিয়ে এল একজন। হাত এবং মুখ ধুয়ে নিল আমার তাইও! দেখাদেখি আমিও ধুলাম। এর পর শুরু হলো খাবার দেয়া। প্রথম পরিবেশিত হলো ঝলসানো মাছ, সঙ্গে রান্না করা কলা। এর পর একে একে এল শুয়োরের মাংস, নিরামিষ তরকারি, পুডিং-এর মত এক ধরনের খাবার। এ ছাড়াও দেয়া হলো চালের তৈরি এক ধরনের চাইনি আর ডাবের মিষ্টি সর।

সত্যিই চমৎকার রান্না হিটিহিটির রাধুনিদের। তাছাড়া গত কয়েকটা মাস বাউন্টিতে, সত্যিকথা বলতে কি, অর্ধাহারে কাটিয়েছি। আমার ইংল্যান্ডের সম্মান বাঁচানোর জন্যে কম করে খাব ভেবেও তিন জনের সমান খেলাম আমি। কিন্তু আমার তাই ও লজ্জায় ফেলে দিল আমাকে। প্রাণপণ চেষ্টায় আমি যখন খাওয়া শেষ করলাম তখনও দেখি সে খেয়ে চলেছে। বিশাল একেক টুকরো মাছ, মাংস মুখে পুরছে আর চিবোচ্ছে। আমি যদি তিন জনের সমান খেয়ে থাকি ও খেলে কমপক্ষে সাতজনের সমান। অবশেষে খাওয়া শেষ হলো তার। লম্বা করে একটা নিশ্বাস ফেলে হাত ধোয়ার পানি চাইল সে।

খাওয়া শেষ- এবার ঘুম, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল হিটিহিটি।

কাছেই সৈকত। চওড়া একটা মাদুর পেতে দেয়া হলে সেখানকার একটা পুরাউ গাছের নিচে। পাশাপাশি শুয়ে পড়লাম দুজন দিবানিদ্রা দেয়ার জন্যে। তাহিতীয়দের রীতিই এই, দুপুরে ভরপেট খাওয়ার পর দিবানিদ্রা না দিলে চলে না তাদের।

.

আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা এইভাবে। আজ এত বছর পরেও যখন সেদিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়ে অপূর্ব এক আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠি আমি। পৃথিবীর কোন চিন্তা কোন ভাবনা সে সময় আমার ছিল না, সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলাম অভিধানের কাজে।

হিটিহিটির বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সেই ছোট্ট নদী, পয়েন্ট ভেনাসে যেটা সাগরে পড়েছে। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে ওই নদীতে স্নান করে এসে ফল-মূল দিয়ে হালকা নাশতার পর কাজ শুরু করি। কাজ মানে হিটিহিটির সঙ্গে কথা বলা। বিভিন্ন শব্দ শুনে নিখুঁতভাবে লিখে নেয়ার চেষ্টা করি উচ্চারণগুলো। কোন শব্দ বুঝতে অসুবিধা হলে একাধিকবার উচ্চারণ করতে বলি। তারপর বোঝার চেষ্টা করি অর্থ। হিটিহিটি ছাড়াও এ কাজে আমাকে সাহায্য করছে ওর মেয়ে হিনা আর ভাইঝি মাইমিতি।

যতক্ষণ না মাছ ধরা ক্যানোগুলৈ সাগর থেকে ফিরে আসে ততক্ষণ অর্থাৎ এগারোটা বারোটা পর্যন্ত চলে আমার এই কাজ। এরপর রাঁধুনিরা রান্না চড়ায়। আরেকবার স্নান করে আসি আমি। এবার সাগর থেকে। এরপর হিটিহিটির। সঙ্গে দুপুরের খাওয়া এবং দিবানিদ্রা। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে হিটিহিটি বা তার পরিবারের অন্য কোন সদস্যের সাথে বেড়াতে বেরোই। কখনও সাগর পাড়ে, কখনও পাহাড়ে, কখনও বা ওদের কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাসায় যাই। সন্ধ্যার পর একে একে জ্বলে ওঠে ক্যান্ডল নাটের প্রদীপ। বিরাট মাদুরে বসে গল্প করি হিটিহিটির পরিবারের সদস্যদের সাথে। যতক্ষণ না একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে ততক্ষণ চলে গল্প।

ওদের বাড়িতে প্রথম যেদিন পৌঁছুলাম সেদিন বিকেলে, দিবানিদ্রার পর ঘরে ফিরে আমার জাহাজী সিন্দুকটা খুললাম। পরিবারের প্রতিটি সদস্য ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমাকে। অপার কৌতূহল আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সিন্দুকটা যেন যাদুর বাক্স। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ওরা ভেতর থেকে কি বের হয় দেখার জন্যে। একে একে বের করলাম আমি কেতি, বড়শি, কাঁচি, ছোট ছুরি; মেয়েদের চুড়ি, হার, কানের দুল ইত্যাদি ইত্যাদি। হিটিহিটির পরিবারের প্রত্যেককে-যার জন্যে যেটা উপযোগী বুঝে দিলাম কিছু না কিছু। কি খুশি যে ওরা হলো-একেবারে বাচ্চা থেকে নিয়ে হিনা, মাইমিতি এমন কি হিটিহিটি পর্যন্ত-ভাষায় প্রকাশ করতুে পারব না। কিছুদিন যেতে না যেতে অবশ্য বুঝেছিলাম হিটিহিটির মত ইন্ডিয়ানের বন্ধুত্ব অর্জন করার জিনিস। এ জিনিস কেনা যায় না, সে যত মূল্যই দিতে চাই না কেন। ও, ওর মেয়ে আর ভাস্তি আন্তরিক ভাবে পছন্দ করে আমাকে। নানাভাবে তার প্রমাণ পেয়েছি। আমি নিশ্চয়ই আমার কলম, কালি, কাগজ আর অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে এটা আপদ বিশেষ ওদের কাছে; কিন্তু কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি একজনকেও। অসীম ধৈর্যের সাথে ওরা শোনে আমার প্রশ্ন, সাধ্যমত উত্তর দিয়ে যায়। কখনও কখনও মাইমিতি বা হিনা কপট হতাশার ভঙ্গিতে দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে, হয়েছে, হয়েছে, এবার শেষ করো, বিয়্যাম, আমার মাথায় আর কিছু আসছে না! বা হিটিহিটি ঘন্টা খানেক একটানা আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার পর বলে, এবার চলো ঘুমাই, বিয়্যাম! এক দিনে এত চিন্তা ভাবনা করলে নিশ্চয়ই তোমার-সেই সাথে আমারও মাথা বিগড়ে যাবে! কিন্তু পরদিন সকালে দেখি আবার ওরা তৈরি আমাকে সাহায্য করার জন্যে।

প্রতি রোববার আমি আমার অভিধানের পাণ্ডুলিপি বগলদাবা করে বাউন্টিতে গিয়ে উঠি। মিস্টার ব্লাইকে জানাই আমার কাজের অগ্রগতি। গভীর আগ্রহ নিয়ে আমার কথা শোনেন ব্লাই। পাণ্ডুলিপিটা উল্টে পাল্টে দেখেন। তারপর নিজের কাজ কদ্দূর এগিয়েছে সে সম্পর্কে বলেন দুচার কথা। হিটিহিটির বাড়ি থেকে প্রথম যে রবিবার বাউন্টিতে গেলাম সেদিন জানতে পারলাম, তীরে মিষ্টার ব্লাই-এর নির্দেশে বিরাট এক তাঁবু খাটানো হয়েছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী নেলসন আর তার সহকারী ব্রাউন এখন সেখানেই থাকেন। রুটিফলের চারা সংগ্রহ এবং পরিচর্যার জন্যে সাতজন লোক দেয়া হয়েছে ওদের অধীনে। আমার মত নেলসনও দুতিন দিন পর পর জাহাজে গিয়ে ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে আসেন অগ্রগতির খবর।

রুটিফলের চারার খোঁজে রোজ দ্বীপের এখানে ওখানে ঘুরতে হয় নেলসনকে। দ্বীপের সব গোত্রপতি তাদের প্রজাদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, নেলসন যখন যা চাইবেন যেন দেয়া হয় তাকে। অদ্ভুত এক কৌশল খাঁটিয়ে ব্যাপারটা সম্ভব করেছেন ব্লাই। মাতাভাই এ নোঙ্গর ফেলার দুতিন দিন পর এক সকালে তাহিতির সব গোত্রপতিকে বাউন্টিতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। সবাইকে প্রচুর পরিমাণে উপহার-বেশির ভাগই আমি যে সব জিনিস হিটিহিটির পরিবারের সদস্যদের দিয়েছি সে ধরনের-দিয়ে ব্লাই বলেছিলেন, এসব উপহার তাদের জন্যে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পাঠিয়েছেন ইংল্যান্ডের রাজা জর্জ। তারপর তিনি সবিনয়ে জানিয়েছিলেন তার আসার কারণ। শুনে এক সাথে লাফিয়ে উঠছিল সব কজন গোত্রপতি। এত সহজে রাজা জর্জকে খুশি করা যাবে যেন ভাবতেই পারেনি তারা। বলেছিল, যে মূল্যবান উপহার আমাদের জন্যে পাঠিয়েছেন রাজা জর্জ তার বিনিময়ে যা চেয়েছেন সে অতি সামান্য। যত খুশি রুটিফলের চারা তুমি নিতে পারো, পারাই। 

সমাধান হয়ে গেল সমস্যার। নেলসন দ্বীপে ঘুরে ঘুরে চারা সংগ্রহ করে সাগরতীরের তাঁবুতে নিয়ে আসেন। সেখানে সেগুলোর পরিচর‍্যা চলে, ঘোট ঘোট মাটির পাত্রে লাগানো হয়। এখন কেবল সহ চলছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চারা যোগাড় হয়ে গেলে এক সাথে সব নিয়ে যাওয়া হবে জাহাজে।

আমাদের নাবিক যারা জাহাজে আছে তাদের সাথে আলাপ করে মনে হলো ক্যাপ্টেনের দুর্ব্যবহারের কথা ভুলে গেছে তারা। নিয়ম শৃঙ্খলার কড়াকড়ি অনেক শিথিল করা হয়েছে। অবসর সময়ে যে কেউ ইচ্ছে হলেই দ্বীপে যেতে পারে। একমাত্র সার্জন ও ব্যাকাস ছাড়া আর সবাই স্থানীয়দের ভেতর থেকে একজন করে তাইও বেছে নিয়েছে। ব্যাকাস তাইও নেননি কারণ তার ধারণা ইন্ডিয়ানদের সাথে বন্ধুত্ব করার চেয়ে কেবিনে বসে মদ খাওয়া ভাল। প্রায় প্রতিদিনই তাইওদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতে যায় নাবিকরা। তাইওর খাওয়ায় প্রাণ খুলে। ছোটখাট তুচ্ছ কিছু উপহারের বিনিময়ে এই সেবা সত্যিই দুর্লভ।

.

দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল হিটিহিটির বাড়িতে। তারপর এক সকালে অবাক হয়ে দেখলাম আমার জাহাজী বন্ধুদের কয়েকজন এসেছে, আমার সাথে দেখা করতে।

হিনা, মাইমিতি, হিনার স্বামী টুয়াটাই আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সৈকতে। দূরে নোঙ্গর করে আছে বাউন্টি। একটু আগে একটা জোড়া ক্যানোয় চেপে বাউন্টিতে গেছে আমার তাইও। দুপুরে ব্লাই-এর সাথে খাওয়ার দাওয়াত তার। আমরা এসেছিলাম হিটিহিটিকে ক্যানোয় তুলে দিতে। বেশ কিছুক্ষণ আগে। বাউন্টির গায়ে ভিড়েছে ক্যানো। খাওয়া দাওয়ার পর ফিরে আসবে হিটিহিটিকে নিয়ে।

কিছুক্ষণ সাগর পাড়ে কাটিয়ে বাড়ির পথ ধরব, এমন সময় হিনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, বিয়্যাম, দেখ!

হিনার ইশারা অনুসরণ করে তাকালাম আমি। একটু যেন চমকালাম। তীর দিকে এগিয়ে আসছে জোড়া ক্যানোটা! কি ব্যাপার?–ব্লাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলো নাকি হিটিহিটির? তাছাড়া আর কোন কারণ তো দেখছি না ওর ফিরে আসার।

একটু পরেই অবশ্য উদ্বেগ দূর হলো। ক্যানোটা আধাআধি পথ আসতে খেয়াল করলাম, দাড়ীরা ছাড়াও সাদা চামড়ার তিনজন মানুষ বসে আছে ওটার পেছন দিকে। আরেকটু এগিয়ে আসার পর চিনতে পারলাম শ্বেতাঙ্গ তিনজনকে-ক্রিশ্চিয়ান, গোলন্দাজ পেকওভার আরআর, কি আশ্চর্য, আমাদের ওল্ড ব্যাকাস! ইন্ডিয়ানদের সাথে সময় কাটানোর চেয়ে কেবিনে বসে মদ খাওয়া ভাল মনে হয় যার কাছে সেই ওল্ড ব্যাকাস!

অবশেষে তীরে ভিড়ল ক্যানো। সবার আগে লাফ দিয়ে নামলেন সার্জন। কাঠের পা টেনে টেনে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।

আহ, বিয়্যাম, বললেন তিনি, প্রথমে তো চিনতেই পারিনি তোমাকে। ইন্ডিয়ানদের পোশাক পরে একেবারে ইন্ডিয়ান হয়ে গেছ কদিনেই! তারপর, দিনকাল চলছে কেমন?

এই তো, মৃদু হেসে আমি বললাম। তা হঠাৎ আপনি এত কষ্ট করে ডাঙায়?

হ্যাঁ, ক্রিশ্চিয়ান আর পেকওভারকে আসতে দেখে ভাবলাম আমিও এক চক্কর ঘুরে যাই। অনেকদিন তোমাকে দেখি না। দেখে যাই, সেই সাথে টেনেরিফের মদ দুএক বোতল খাইয়েও যাই। কই, পেকওভার, বোতলগুলো নামাও।

ক্রিশ্চিয়ান এগিয়ে এসে করমর্দন করল .আমার সাথে। আমি হিনা, মাইমিতি, ও হিনার স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওর। ওল্ড ব্যাকাস এবং পেকওভারের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলাম। এরপর হিনার নেতৃত্বে হিটিহিটির বাড়ির দিকে এগোলাম আমরা। ভত শ্রেণীর এক লোক মদের বোতলগুলো নিয়ে আসতে লাগল পেছন পেছন। হাঁটতে হাঁটতে একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, মাইমিতি, একটু পরপরই আড়চোখে দেখছে ক্রিশ্চিয়ানকে। ক্রিশ্চিয়ানও একই ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে মাইমিতির দিকে।

অবশেষে হিটিহিটির শীতল বারান্দায় গিয়ে বসলাম আমরা। হিনা গিয়ে রাঁধুনিদের রান্না চড়ানোর নির্দেশ দিয়ে এল। পথে আসতে আসতেই ও জানিয়ে দিয়েছে নতুন অতিথিরা কেউ না খেয়ে ফিরতে পারবেনা।

বসতে না বসতেই ভূতের কাছ থেকে একটা বোতল নিয়ে খুলে ফেললেন ব্যাকাস। বলেছিলেন বটে বোতলগুলো এনেছেন আমাকে খাওয়াবেন বলে, কিন্তু সময় মত দেখা গেল আমার কথা মনেই নেই বৃদ্ধ সার্জনের। দীর্ঘ এক চুমুক দিয়ে বোতলটা তিনি এগিয়ে দিলেন পেকওভারের দিকে। হিনার স্বামী তৃষিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে পকওভার একটা চুমুক দিয়ে ওটা এগিয়ে দিল তার দিকে। একটু পরেই দ্বিতীয়, তারপর তৃতীয় বোতল খোলা হলো। রান্না হতে কিছু সময় লাগবে তাই ওদের ইচ্ছেমত মদ খাওয়ার সুযোগ দিয়ে আমি, ক্রিশ্চিয়ান, মাইমিতি আর হিনা বেরোলাম নদীর পাড় থেকে হেঁটে আসার জন্যে।

অবার শুরু হলো ক্রিশ্চিয়ান আর মাইমিতির চোরা দৃষ্টি বিনিময়।

পাশাপাশি হাঁটছি চারজন। হঠাৎ খেয়াল করলাম, চারজন নয়, দুজন আছি পাশাপশি-আমি আর হিনা। কোথায় গেল আর দুজন? ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, আমাদের খানিকটা পেছনে হাত ধরাধরি করে আসছে ক্রিশ্চিয়ান আর মাইমিতি। এখন আর চোরা চোখে নয়, সরাসরিই তাকাচ্ছে একজন আরেক জনের দিকে।

আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হাসল ক্রিশ্চিয়ান। বলল:

প্রত্যেক নাবিকের একজন মনের মানুষ থাকা দরকার। আমার এতদিন ছিল না, এবার পেয়েছি।

———-

* দুটো বড় আকারের ক্যানো পাশাপাশি জুড়ে তৈরি হয় জোড়া ক্যানো। সাধারণ ক্যানোর চার-পাঁচ ক্ষেত্র বিশেষে দশগুণ পর্যন্ত হয় এগুলোর মাল ও মানুষ বহনের ক্ষমতা।

<

Super User