বাক টার্নার পরদিন সকালে এল না।

হোয়াইটস্টোনে এটাই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ ভাবছে টার্নার ভয় পেয়েছে, নয়তো তস্করদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। অন্য একটা দল ভাবছে ইচ্ছে করেই আসেনি সে, অল্প সময়ের একটা সুযোগ দিয়েছে কেবল।

সূর্য ওঠার দুঘণ্টা পর শহরে এসেছে জেথ। সেলুনে গিয়ে গলা ভেজাল প্রথমে, স্টোর থেকে প্রচুর বুলেট, একটা হেনরী আর একটা পুরানো কোল্ট কিনল এরপর।

ডিলান উডম্যানের সেলুনের সামনে অবস্থান নিয়েছে শহর পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। ছোটখাট একটা ভিড় ঘিরে আছে তাদের। এ মুহূর্তে সবার কি করণীয়, তা ব্যাখ্যা করছে জাজ। লোকগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে, জেথের কাছে মনে হলো হোয়াইটস্টোনের এ সঙ্কটে এদের অনেকেই এগিয়ে আসবে। দুর্ধর্ষ একটা দলের বিরুদ্ধে লড়তে হলে যে ধরনের লোক দরকার এরা কেউই তেমন নয়। বেশিরভাগই নিরীহ গোছের বুড়িয়ে যাওয়া, ব্যবসা করে পেট চালায়। দুএকজন ভবঘুরেও আছে। কাছে যাওয়ার পর দর্শক-শ্রোতার সারিতে উনি। থর্টনকে দেখতে পেল ও, বুকে টিনের তারাটা নেই।

ভিড় ঠেলে জাজের দিকে এগোল জেথ। বক্তৃতার ওই পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক আহ্বান করছিল সে। ওকে এগোতে দেখে, থেমে হাসল। সামনে গিয়ে চিরকুটটা বাড়িয়ে দিল জেথ।

কিছুটা বিস্মিত মনে হলো তাকে, কিছুক্ষণ দেখল ওকে, তারপর চোখ নামাল হাতের কাগজে। পাগল হয়েছ তুমি! সামান্য কাজের জন্যে এত টাকা? এবার পুরোপুরি বিস্মিত দেখাচ্ছে তাকে, খানিকটা বিরক্তও।

সামান্য কাজ? জাজের বা শহর কমিটির কাছে হতে পারে, কিন্তু ওর কাছে মোটেও তা নয়, ভাবছে জেথ-ওয়াইল্ড বিল হিকককে ড্রয়ে হারানোর মত কঠিন। এই যে এখানে এতগুলো লোক আছে, কেউ কেউ হুজুগে কোমরে পিস্তলও ঝুলিয়েছে, এদের কেউ তো এমন প্রস্তাব নিয়ে আসেনি! তাহলে এটা কি করে সামান্য কাজ হলো?

জেথের ভবঘুরে জীবনে ঝুঁকিই একমাত্র বৈচিত্র্য। বাক টার্নারকে ধরতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাবে, যদি শহর কমিটি ওর সাথে চুক্তিতে আসে। সত্যি কথা বলতে গেলে পাঁচ হাজার কেন পাঁচশো ডলারও কখনও একসাথে রোজগার করেনি জেথ। টাকার চেয়ে কঠিন এ-কাজটা সারার জেদই ওর বেশি। টার্নার ওকে রোস্ট বানাতে চেয়েছিল, ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি ওর। তস্করদের ধরতে গেলে যেটুকু ঝুঁকি নিতে হবে টাকাটা তার তুলনায় কোনভাবেই বেশি নয়। মারা পড়তে পারে ও। আর এরা হারাবে টাকা। পাঁচ হাজার বা এক লাখ, যে কোন একটার আশা ত্যাগ করতে হবে। ওরা রাজি না হলেও কিছু আসে-যায় না, বাক টার্নারকে এমনিতেও ধাওয়া করতে হবে-ম্যাকলীনদের নিজেদের স্বার্থেই। শহর কমিটির সাথে চুক্তিটা তাই জেথের কাছে বাড়তি পাওনা।

জাজের ওপর নজর বুলাল জেথ, পাঁচ হাজার ডলার যেন অপাত্রে দান করা হবে এমন মুখভঙ্গি। খানিকটা নিরাশই হলো ও, গতরাতে রোয়ানা বলেছিল রাজি না হয়ে এদের উপায় নেই। শ্রাগ করে ফিরতি পথ ধরল জেথ।

শুধুই বড়াই, আর কিছু নয়! জুলিয়াস হোল্ডেনের শ্লেষপূর্ণ গলা শোনা গেল। বোবা এ বীরপুরুষ টার্নারের সামনে পড়লে নির্ঘাত প্যান্ট খারাপ করে ফেলবে।

হাসির হিড়িক পড়ল সাথে সাথে।

ব্যাংকারের ওপর রাগ হলো জেথের। রোয়ানাকে যেমন, ওকেও তেমনি অপদস্থ করতে চাইছে। ম্যাকলীনরা তার কি ক্ষতি করেছে? ঝটিতি ঘুরে দেখল ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে, একেবারে সহজ নিশানা। জেথের ডানহাতে কোল্ট উঠে এসেছে। মাত্র একটা গুলি করল। হোল্ডেনের সদ্য ধরানো সিগার দ্বিখণ্ডিত হয়ে এক টুকরো পড়ল ফুটপাথে, অন্য টুকরো আটকে থাকল দুঠোঁটের মাঝখানে।

তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছ! আমি…আমি তোমাকে… শেষ করতে পারল না ব্যাংকার। তার চোখে নিখাদ আতঙ্ক, রাগে চেঁচাতে সিগারের টুকরো পড়ে গেল ঠোঁট থেকে।

হোল্ডেনের চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়ল জেথ। সেরকম ইচ্ছে থাকলে বুলেটটা বুকে বেঁধাত। হোল্ডেনও শেষে বোধহয় তা উপলব্ধি করতে পেরে চুপ মেরে গেল। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে কোল্টে টোটা ভরল জেথ, অথচ ব্যাংকারের প্রতিক্রিয়া দেখে ভেতরে ভেতরে মজা পাচ্ছে। দারুণ ভীতু লোক, এবং সময়ে সময়ে বেপরোয়া। আড়চোখে লক্ষ করল জাজকে, কিছু একটা ভাবছে সে।

পারলে ও-ই পারবে, মার্শালের তারাটা ওকেই দাও, জাজ, বলল একজন। দুজন সমর্থন করল তাকে।

ঠিক আছে, ম্যাকলীন, জাজের আপসী গলা। তোমার কথাই থাকল। এখন থেকেই কাজে নেমে পড়ো। আমরা চাই এ শহরের আর একটা লোকও যেন মারা না পড়ে কিংবা কোন দোকান বা বাড়ির যাতে ক্ষতি না হয়। এসব সামলানোর। পরেও টার্নারকে ধরবে তুমি এবং লুটের টাকা উদ্ধার করবে। আর হ্যাঁ, কাজ শেষে পাবে তোমার পাওনা।

ভাল গ্যাড়াকলে পড়েছে, ভাবল জেথ। একটু আগেও মনে হয়েছিল দুএকজনের সাহায্য পাবে, এখন আর সে-সম্ভাবনা রইল না। লোকগুলোর ওপর খানিকটা বিতৃষ্ণা অনুভব করছে, নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকবে এরা। অনেকেই ধরে নিয়েছে অসম্ভব এ কাজটি ওর দ্বারা সম্ভব হবে না, এদের একজন স্বয়ং জাজ।

তঙ্কররা হোয়াইটস্টোনে কয়েকবার এসেছে, ওদের ঘোড়াগুলো দেখে মনে হয়নি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। তারমানে কাছাকাছি কোথাও ওদের হাইড আউট। এটা অবশ্য রোয়ানার ধারণা। হোয়াইটস্টোনের আশেপাশে প্রতিটি পর্বতশ্রেণী, গিরিখাত আর উপত্যকা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে মেয়েটা, এঁকে দেখিয়েছে। ওর মতে লুকানোর উপযুক্ত জায়গা পুমাস ক্যানিয়ন অথবা তার কাছাকাছি কোন জায়গা যেটা ট্যালন ভ্যালি বা ক্যাপেশাস ক্যানিয়নও হতে পারে। টার্নার নিশ্চয়ই উপযুক্ত স্থানটি বেছে নিয়েছে। ডাকাতির পর দুবৃত্তরা ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন দিকে এবং শেষে কোথাও গিয়ে মিলিত হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। জেথ ঠিক করেছে উত্তরের ট্রেইল ধরে পুমাস ক্যানিয়নের কাছে যাবে প্রথমে। নতুন কেনা হেনরীটার পরীক্ষাও নেয়া যাবে কোন এক ফাঁকে। স্যাডলে চেপে উত্তরে এগোল ও। কিছু লোক চিৎকার করে আর টুপি নেড়ে ওকে উৎসাহ দিচ্ছে। একটু আগের বিরক্তি আর রাগ চলে গেল ওর।

শহর ছাড়িয়ে এসে দেখতে পেল বিবর্ণ ট্রেইলটা। ডানে থালার ন্যায় প্রসারিত মাঠে সবুজ ঘাস, তবে র্যাঞ্চিংয়ের জন্যে উপযুক্ত নয়। ঘাসের বৃদ্ধি এত কম যে গরু একবার খেয়ে গেলে দুই সপ্তাহেও ফের খাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠবে না। তেমন ঘন হয়েও জন্মায়নি। এপাশে বিশাল ঢালু জমি অনেক দূরে উঁচু পর্বতের। চূড়ায় গিয়ে মিশেছে, বালি আর কাঁকরপূর্ণ, রয়েছে অসংখ্য খুদে খুদে বোল্ডার, গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা কিছু সাইক্যামোর ঝোপ।

ট্রেইলটা পশ্চিমে নাক বরাবর চলে গিয়ে দিগন্তের ও-মাথায় বাঁয়ে বাক নিয়েছে। সেখানে ঘন সবুজের অ্যাসপেনের বন। পেছনে মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে চোঙাকার জারকান পিস্, এখানকার সবচয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। ট্রেইলে মাত্র একজন ঘোড়সওয়ারের ট্র্যাক, সম্ভবত দুদিন আগের। অস্পষ্ট তবু এগিয়ে যাওয়া যাবে।

নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই ওর। দুর্বত্তদের সাথে শুরুতে একটা লড়াই হোক এবং তাতে ওদের দুএকজন হতাহত হোক, এটাই চাইছে। এরপর টার্নার দলবল নিয়ে শহরে এলে মোকাবিলা করবে। কাজটা কঠিন, ওর ইচ্ছে মাফিক সবকিছু ঘটবে না এটাই স্বাভাবিক। সবকিছু আসলে নির্ভর করছে টার্নারের মর্জির ওপর। এমন হতে পারে তস্করদের হাইড আউট খুঁজে পাবে না জেথ, উল্টো ওকে দেখে একটা সীসা কপালে সেঁধিয়ে দেবে শুধু।

তবু আশাবাদী জেথ, যে সন্দেহ মনে ধুকপুক করছে তা খতিয়ে দেখতে চায়।

ইতোমধ্যে অনেকখানি চলে এসেছে। এদিকটা বেশ খোলামেলা। বাম দিকের ঢালে উঠে এল। লম্বাটে রুক্ষ এক টুকরো জায়গা, অদূরে পর্বতের বিশাল কাঠামো। কাছাকাছি অনেকগুলো ঝোপ। ঘোড়াটাকে তারই একটার আড়ালে রেখে স্যাডল ছাড়ল হেনরীর হাতে। বক্স এলডারের একটা ডালে নিশানা করে অনুশীলন করল কিছুক্ষণ, তারপর অসন্তুষ্ট হয়ে কোল্ট নিয়ে বিভিন্ন অবস্থানে। কসরত করল। জেরেমি মিলার ওর পিস্তল ছিনিয়ে নিয়েছিল, বদলে তার কান কেটে নেবে, ঠিক করল জেথ।

সূর্য ধীরে তেতে উঠছে, ঘামছে ও। ঘোড়ার কাছে এসে পানি পান করল। তারপর স্যাডলে চেপে ইচ্ছেমত এগোতে দিল গ্রে-টাকে।

এই জেথ, দাঁড়াও! পেছন থেকে চেঁচাল কেউ।

থেমে, পেছনে তাকাল জেথ। ছুটে আসছে এক অশ্বারোহী, কে হতে পারে? গলাটা মেয়েলি। রোয়ানাই বোধ হয়। কিন্তু মিলের কাছে থাকার কথা মেয়েটার, গতরাতে তাই বলেছিল। হয়তো শহরে আবারও কিছু ঘটেছে, কিংবা জরুরী কোন তথ্য জানাতে এসেছে।

ওর পরনে রাইডিং পোশাক-লেভাইসের প্যান্ট, তারওপর চ্যাপস, ফ্লানেলের শার্ট, ভেস্ট আর ব্যানডানা। লম্বা চুলগুলোকে ঢাকতে পারেনি কাউবয় হ্যাট। মোটেও পুরুষের মত লাগছে না, ভাবল জেথ, বরং নারীত্বের লক্ষণগুলো ফুটে উঠেছে বিভিন্ন অঞ্চলে।

তোমার সাথে যাব, সহাস্যে ঘোষণা দিল রোয়ানা।

ওর স্যাডল বুটে একটা লী এনফিল্ড। অবাক হলো জেথ, আসলে সপ্রতিভ এ মেয়েটিকে এভাবে কখনও কল্পনা করেনি। এর কারণ রোয়ানা বরাবর এ ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে এবং ও আদ্যোপান্ত পুবের মেয়ে-জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে সেখানেই। মাত্র তিনটে বছরে পশ্চিম ওকে বদলে দিয়েছে।

জেথের অনুসন্ধানী দৃষ্টি আঁচ করতে পারল রোয়ানা। এদিকটা ভাল করে চিনি, অস্বস্তিতে স্যাডলে নড়েচড়ে বসল। ঝামেলা করব না বরং তোমাকে সাহায্য করতে পারব। রাইফেল দেখে অবাক হয়েছ, না? আর সবার মত হুজুগে পড়ে নিইনি, ভালই চালাতে পারি। যদি বলো তোমার সাথে ডুয়েল লড়তে পারি। চোখে চোখ রেখে হাসল ও, কৌতুক ফুটে উঠেছে কালো চোখে। সেটা অবশ্য আমার জন্যে মোটেও ভাল হবে না। তোমার কিছু হলে বুড়ো আমাকে খুন করবে।

শ্রাগ করে ঘোড়া ছোটাল জেথ। রোয়ানা পিছু নিল।

কিছুদূর আসার পর দুপাশে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর চোখে পড়ল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক গরু চরছে। জমিতে বেড়া বা কাটাতার নেই, ট্রেইলের এ-পাশের জমিও সম্ভবত একই মালিকের। খানিক দূরে বিশাল এক জশুয়ার নিচে একটা কেবিন। পেছন হাঁটু অবধি লম্বা ঘাস, আর সামনে কাঠ দিয়ে তৈরি ছোট ছোট কয়েকটা খোপ, গবাদি পশু রাখার জন্যে। পাশে দুটো দৈত্যাকার ওঅটর ট্রাফ।

ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগোল রোয়ানা। এটা ট্রিপল ক্রস, স্যাম জারভিসের বাথান। খুব শিগগির ধনী হতে যাচ্ছে বুড়ো। কদিন আগে ওর জমিতে তেল পাওয়া গেছে। সার্ভেয়াররা ঘোষণা করার পর থেকে ব্যাপারটা নিয়ে সাড়া পড়ে গেছে সবখানে।

ইদানীং সোনার মত তেলও মানুষকে আলোড়িত করছে। এরপর হয়তো আলোড়িত করবে কয়লা, রত্ন বা অন্য কোন খনিজ পদার্থ। প্রকৃতিতে এসব পাওয়া না গেলেই ভাল হত-মানুষে মানুষে অযথা শত্রুতা বা রেষারেষি হত না।

বিশালদেহী এক বুড়ো বেরিয়ে এল কেবিন থেকে, হাতে রিপিটার। লম্বা দাড়ি বুক ছাড়িয়ে পেট অবধি পৌঁছেছে। ভাবলেশহীন মুখ, কিন্তু শীতল চোখে রাজ্যের সন্দেহ। পাকা গাথুনির শরীর, ময়লা কাপড় ভেদ করে সদপে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করছে পেশীগুলো। সত্তর হবে বয়স, কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের বদৌলতে শরীরের ভাঙন আটকে রেখেছে।

সুপ্রভাত, রোয়ানা। এসো কফি আছে। ঘুরে কেবিনে ঢুকে পড়ল বুড়ো।

স্যাডল ছেড়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। গোছানো কেবিন-একপাশে খাটিয়া, মাঝে টেবিল আর দুটো চেয়ার। দেয়ালে কয়েকটা বাফেলো ও কুগারের করোটি ৭ জেথ ধারণা করল অদ্ভুত এ বুড়োর সাথে রোয়ানার সম্পর্ক ভালই, যদিও লোকটাকে সুবিধের মনে হয়নি ওর কাছে। ওদের পরিচয়ের সময়েও ভাবলেশহীন থাকল সে, তবে দৃষ্টি থেকে সন্দেহের ছায়া বিদায় নিয়েছে। যাকে তাকে নিশ্চয়ই শত্রু ভাবছে না?

কোথায় যাচ্ছ? শুকনো খটখটে গলা ট্রিপল ক্রস মালিকের।

পুমাস ক্যানিয়নের ওদিকটায়।

ওদিকে আবার কি দরকার পড়ল? বাথান আর মিল ছেড়ে তুমি তো নড়োই না।

তুমি আসলেই কুঁড়ের বাদশা, স্যাম! শহরের কোন খবরই দেখি রাখছ না। শনিবার বিকেলে ডাকাতি হয়েছে ব্যাংকে। এক লাখ লুট করার পর বাক টার্নার। ওদিকেই সরে পড়েছে, মানে আমার ধারণা আর কি… পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল রোয়ানা।

শুনতে শুনতে চিন্তিত হয়ে পড়ল স্যাম জারভিস। মলিন দেখাচ্ছে মুখ। ওখানে হোল্ডেন আর তোমার টাকাই বেশি ছিল, তাই না? তিক্ত কণ্ঠে বলল বুড়ো। পরোক্ষভাবে আমারও ক্ষতি হয়ে গেল। তোমরা কেউই জমিটা কিনতে পারবে না। নগদ টাকা তো হারিয়েছই, উপরন্তু যার যার সম্পত্তি-যেগুলো মর্টগেজ রেখে সিটি ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে। বাকি রইল উইলি আর ইস্টার্ন পেট্রোল কোম্পানি। অবশ্য মিলারও অংশ নিতে পারে, স্টোর ধ্বংস হওয়ার পর আদৌ যদি কুলিয়ে উঠতে পারে। সাফ কথা, আমি আশানুরূপ দাম পাব না। হোল্ডেন সবচেয়ে বেশি অফার দিয়েছিল, তারপর তুমি, তাই না? উল্টোদিকের দরজা দিয়ে ভেতরের কামরায় চলে গেল জারভিস, ফিরে এল মিনিট খানেক পর। কফি আর ঘরে তৈরি বিস্কুট পরিবেশন করল।

হোল্ডেন জমি কিনতে পারবে, সম্ভাবনা বাতলে দিল রোয়ানা। ব্যাংক মর্টগেজ রেখে ঋণ পাবে সে। তাছাড়া আমার ধারণা সব টাকা লুট হয়নি। সে নিজেই বলেছে এক লাখের কিছু বেশি।

আরেকজন বাড়ল, নিস্পৃহ কণ্ঠে মন্তব্য করল জারভিস।

পুমাস ক্যানিয়ন এখান থেকে মাইল চারের কিছু বেশি, ভাবছে জেথ। তস্করদের একজন টাকা চুরি করেছিল এবং মারা গেছে খুবই ভাগ্যবান একজন অজ্ঞাত লোকের হাতে, যাকে কিনা ধরতে চাইছে বাক টার্নার। সে নোক কি ধারে-কাছেই থাকে? কি করে জানল ওই সময়ে ওখানে উপস্থিত হবে দুবৃত্ত, একেবারে টাকাসহ? লোকটি কি জারভিস? হতে পারে, না-ও হতে পারে। তবে এটা ঠিক বুড়োর আচরণ কেমন অস্বাভাবিক। দেখে যে কেউ বিরূপ ধারণা পোষণ করতে পারে।

জেথ আসলে সন্দেহের ওপর নির্ভর করছে। ওর ধারণা দুর্বত্ত চোরটির কথা আগে থেকে জানত খুনি, ওঁৎ পেতে ছিল। হতে পারে দৈবাৎ যোগাযোগ কিন্তু তাহলে কতগুলো প্রশ্ন থেকে যায় কিভাবে সে জানল টাকাসহ পালাচ্ছে তস্কর কখন? যদি আগে থেকে না-ই জানত তবে স্যাডল ব্যাগ হাতড়ে এতগুলো টাক পেয়ে যাওয়া-নাহ, কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তাছাড়া দুর্বত্তকে কেন খুন। করবে সে, টাকার কথা নিশ্চয়ই নিজ থেকে বলেনি লোকটা। সবচেয়ে বড় কথা বাক টার্নার সত্যি বলছে কি-না। জেথ আশা করছে জায়গাটা খুঁজে পেলে, ওখানে। হয়তো এমন কোন চিহ্ন বা সূত্র পাওয়া যাবে যাতে পুরো ব্যাপারটা কিছুটা হলেও খোলসা হবে।

ট্রিপল ক্রস ছেড়ে ফের রওনা দিল ওরা।

কিছুদূর এগিয়ে দক্ষিণে মোড় নিল ট্রেইল। প্রচুর গরুর খুরের দাগের মধ্যে আসল ট্রাক খুঁজে বের করতে বেশ কষ্ট হলো, মাইল খানেক আসার পর অবশ্য আর অসুবিধা হলো না। জেথ নিশ্চিত যে-ট্রাক ধরে এগোচ্ছে, ওটা ট্রেস করেই শহর থেকে এসেছে। চলার পথে অ্যাম্বুশ করার মত জায়গা দেখতে পেলে এড়িয়ে যাচ্ছে নয়তো সতর্ক থাকছে। ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলছে মাথায়। ডাকাতির পর। ছড়িয়ে পড়েছিল দলটা, তারপর মিলিত হয়েছে কোথাও, এসব ক্ষেত্রে তাই হয়। যদি পুমাস বা ক্যাপেণাস নিয়ন হয়ে থাকে, পৌঁছুতে বিকেল হয়ে যাওয়ার কথা। ক্যাম্প করতে সময় লেগেছে, সন্ধ্যায় ফুর্তি করা খুব স্বাভাবিক। রাতে এমন একজন পাহারায় ছিল বা পাহারায় না থাকলেও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল যে এতগুলো টাকার লোভ সামলাতে পারেনি। যে করে হোক টাকা নিয়ে সটকে পড়ে সে, সম্ভবত মাঝরাতে। হাইড আউট থেকে বেরোনোর সময় কিংবা এর পর আক্রান্ত হয় লোকটা। যোগাযোগটা কোনক্রমেই কাকতালীয় হতে পারে না। খুনী নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছিল, জানত কোন পথে কখন আসবে দুবৃত্ত।

সবকিছুই জেথের অনুমান আর খানিকটা যুক্তির সমন্বয় কেবল। এর পেছনে নির্দিষ্ট কোন সূত্র নেই, তবে ওর স্থির বিশ্বাস ঠিক এটাই ঘটেছে। টার্নারও শহরে গিয়ে ভাওতা মারছে না। এতগুলো টাকা পাওয়ার পরও ঝুঁকি নেয়া অস্বাভাবিক। জেথ তার জায়গায় হলে ভুলেও শহরমুখো হত না। যত ভয়ই দেখাক না কেন সাধারণ মানুষ একবার খেপে গেলে রক্ষা নেই, ভাল করে জানে টার্নার। যার। নামে এক ডজন হুলিয়া আছে, তার পক্ষে আরেকটা ওয়ান্টেড পোস্টার বাড়ানো কোন ব্যাপার না হলেও, সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার ঝুঁকি কেউই নেয় না। পশ্চিমের মানুষ হুজুগে ও বেপরোয়া, একবার খেপে গিয়ে পিছু নিলে গায়ের চামড়া আস্ত থাকবে না। হোয়াইটস্টোনে এখনও তা ঘটেনি এজন্যে যে টার্নার বেছে বেছে প্রতিষ্ঠিত কিছু লোকের ক্ষতি করেছে যাদের প্রতি সাধারণ হোয়াইটস্টোনবাসীর সহানুভূতি খুব কমই আছে।

ঘাতক লোকটা টার্নার নিজে হতে পারে, বা দলের অন্য কেউ। সে নিজে হয়ে থাকলে বাড়তি লাভের আশায় শহরে হামলা করবে না। এতটা বোকা সে নয়। এক ডজন হুলিয়া থাকার পরও যে বেঁচে থাকে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। টার্নার যদি ঘাতক হত, টাকা নিয়ে সটকে পড়ত। অন্য কেউ করেছে কাজটা। রাতের বেলা ট্র্যাক লুকানো কঠিন কাজ, সুতরাং তা থাকবেই। জেথ ঠিক এ কারণে আশাবাদী, দুএকটা সূত্র পেয়েও যেতে পারে। অন্তত সন্দেহটা যদি নিরসন হয় তো মন্দ কি, ভাবল ও।

পুমাস ক্যানিয়নের মুখে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন দেহটা। চারপাশে প্রচুর ট্রাক দেখতে পেল জেথ। খুঁটিয়ে দেখল সব। দুজনের বুটের ছাপ মৃতের কাছে এসে ডানদিকে ফিরে গেছে। এদের একজন সম্ভবত শহুরে মানুষ, ধারণা করল জেথ, যে বলতে গেলে ঘোড়ায় চড়েই না। দুপায়ের পাতার দূরত্ব অপেক্ষাকৃত কম। এ লোকের ট্র্যাকের প্রতি আগ্রহবোধ করল ও।

ত্রিশ গজ এগোতে আধ ঘণ্টার মত লেগে গেল। উঁচু ঢালের ওপর ঝোঁপের আড়ালে ট্রাক চলে এসেছে। একটা নাল লাগানো ঘোড়ার ছাপ পাওয়া গেল সেখানে। লোকটা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল। সিগারের কয়েকটা অর্ধাংশ পড়ে আছে। সব লোক সিগার খায় না এবং কেবল প্রভাবশালীরাই বার বার এভাবে অর্ধাংশের বেশি ফেলে দিতে পারে। তারমানে যে সে তোক নয়, পুলক। অনুভব করছে জেথ, অভিজাত কোন লোক খুন করেছে দুর্বত্তকে-কোন সুযোগ না দিয়েই, কারণ মৃতের হোলস্টার আর সিক্সগান পরখ করেছে ও, গুলি ছোড়া দূরে থাক অস্ত্রটা হোলস্টার থেকে বের করতে পারেনি হতভাগ্য লোকটা।

দুবৃত্তের ট্র্যাক ধরে পুমাস ক্যানিয়নে ঢুকে পড়ল জেথ। ট্র্যাক লুকানোর চেষ্টা করেনি টার্নার, চারদিন আগের ট্রাকগুলোও স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। ক্যাম্প পর্যন্ত অনায়াসে পৌঁছে গেল। মিনিট দশ পর ফিরতি পথ ধরল। ভাবছে, কানা একটা ক্যানিয়নে কেন আশ্রয় নিয়েছিল টার্নার? অবরোধের আশঙ্কা তার মাথায় আসেনি? আরেকটা ব্যাপার, ওই একটা রাতই কাটিয়েছে এখানে। কেউ তাদের তাড়া করেনি বা পিছুও নেয়নি। তাহলে সরে পড়ল কেন? শুধু শনিবার রাতটা এখানে থাকার কি আলাদা কোন গুরুত্ব আছে?

জেথের সন্দেহ, গূঢ় কোন কারণে কানা এই ক্যানিয়নে শনিবার রাতটা কাটিয়েছে বাক টার্নার।

বেরিয়ে এসে ঘাতক লোকটার ট্র্যাক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জেথ। নিজের অনুমানের পক্ষে সূত্র পাওয়ায় দারুণ উৎসাহ বোধ করছে। মৃতদেহের কাছ থেকে ঝোঁপের কাছে ফিরে ঘোড়ায় চেপে পুবে এগিয়েছে লোকটা। জায়গাটা দুৰ্গম, চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে যেতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটা তথ্য জেনেছে ও-ঘোড়াটার রঙ কালো, কাটা গাছে লোম লেগেছিল; ওটা বুনো আর চঞ্চল স্বভাবের, যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমত ঘাস মাড়িয়েছে; ঘোড়াটা লম্বা ও উঁচু, সামনে-পেছনে পায়ের দূরত্ব সাধারণ ঘোড়ার চেয়ে বেশি, লম্বা ঘোড়া উচ্চতায়ও বেশি হয়ে থাকে। কয়েকদিনের পুরানো ট্র্যাক। জায়গাটা রুক্ষ বলে অস্পষ্ট, নরম মাটিতে পড়লে হয়তো বোঝা যেত। ওর ধারণা শেষ পর্যন্ত হয়তো নিরাশ হতে হবে না।

গনগনে তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। প্রচণ্ড তাপে চাদি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। ঘেমে গেছে জেথ, শরীরের সাথে শার্ট লেপ্টে আছে। একটা মেসায় উঠে আসার পর মেসকিট ঝোঁপের আড়ালে ছায়া দেখতে পেয়ে থামল। দারুণ ক্লান্তি লাগছে ওর। ছায়ায় বসে মাথা থেকে হ্যাট সরিয়ে দিতে খানিকটা হালকা লাগল। ব্যানডানার গিট আলগা করে কপাল, ঘাড় আর মুখ মুছল।

ঘোড়া দুটোর লাগাম হাতে অনুসরণ করছিল রোয়ানা। স্যাডল ব্যাগ থেকে খাবার বের করে পাশে বসল। খেয়ে নাও, প্যাকেট খুলে এগিয়ে দিল। ট্র্যাকিংয়ের ছাই-পাঁশ কিছুই বুঝি না আমি। এতক্ষণ ধরে যা জেনেছ, খেয়ে জানাবে আমাকে। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু?

জেথ কথা বলতে পারে না, মেয়েটা বোধহয় তা ভুলে গেছে, ভাবল ও।

মিনিট দশ বিশ্রাম নিয়ে ফের কাজে নামল। মেসার ঢাল বেয়ে নেমে গেছে লোকটা। কাজটা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে গেল এবার। প্রচুর ঘাস এদিকে, তেমন কোন চিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট নেই। কিছু ঘাস দলে গেলেও আড়াই দিনে ফের সোজা হয়ে গেছে। চটকানো মাটি আর ঈষৎ নুয়ে পড়া ঘাস দেখে, তার সাথে অনুমান ও সম্ভাবনা মিলিয়ে এগোনো ছাড়া উপায় নেই।

ঘন্টাখানেক বাদে বেশ কিছু দূরে একটা অ্যাসপেনের নিচে এসে ক্লান্ত দেহে বসে পড়ল জেথ। চারদিক কেমন নীরব, শূন্য মনে হলো। শুভ্র মেঘ থমকে আছে আকাশে, নডছে না গাছের একটা পাতাও। গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে। নাহ, জেরেমি মিলারের স্টোরে মারের ধকলটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনও, ভাবল জেথ।

পানির ক্যান্টিন এগিয়ে ধরল রোয়ানা। জেথ, আমি দুঃখিত, আন্তরিক শোনাল ওর কণ্ঠ। মাঝে মাঝে আমি ভুলে যাই যে তুমি কথা বলতে পারো না। তোমার আর সবকিছু এত স্বাভাবিক যে…

হেসে ওকে আশ্বস্ত করার প্রয়াস পেল জেথ। সহসা সামনে দুটুকরো কাগজ পেয়ে খুশি হয়ে উঠল ও। কিছু ছাই পড়ে আছে ওগুলোর সাথে। পুলকিত হলো জেথ, এত পরিশ্রম বৃথা যায়নি। পেন্সিল সাথে ছিল, বের করে কাগজ দুটোয় লিখে রোয়ানাকে জানাল সবকিছু।

ডাকাতি করার জন্যে শহরেরই এক লোক ভাড়া করেছে বাক টার্নারকে। রাতে এক দুবৃত্ত চুরি করল টাকাগুলো। পুমাস ক্যানিয়নের বাইরে অপেক্ষা করছিল শহরের সেই লোক অথবা তারই নিযুক্ত কেউ, যদিও তার নিজের থাকার সম্ভাবনা বেশি। দুবৃত্তকে খুন করে টাকা হাতিয়ে নেয় সে। পরদিন থেকে শহরে আক্রমণ করল টার্নারের দল, সবই পূর্ব পরিকল্পিত। ক্ষতি হলো রোয়ানা ম্যাকলীন, ডগলাস গ্রীন, জুলিয়াস হোল্ডেন আর জেরেমি মিলারের। পুরো পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কেবল প্রতিদ্বন্দীদের আর্থিকভাবে দুর্বল করা নয় বরং লোকটা পানির দামে ট্রিপল ক্রস কিনতে চাইছে। এখানকার বেশিরভাগ ক্রেতাকে আর্থিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে সে, বন্ধকী রেখে যাতে ব্যাংক ঋণ পেতে না পারে সেজন্যে কয়েকজনের সম্পত্তিও ধ্বংস করেছে।

ওহ গড! বিস্ফারিত হয়ে গেছে রোয়ানার চোখ। পুরোটাই সত্যি মনে হচ্ছে, মিলে যাচ্ছে সব! জেথ, তেমন লোক… ভাবছে ও। ধনী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী…ডাকাতি বা টার্নারের দ্বারা ক্ষতি হয়নি বরং বাড়তি এক লাখ ডলার এখন তার হাতে, এমন একজন যে হোল্ডেনের ব্যাংকে টাকা রাখেনি…পেয়েছি! উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ, অস্ফুট স্বরে বলল, তেমন লোক একজনই….জাজ উইলসন হলেন!

.

০৬.

তুমি যা ধারণা করেছ, হয়তো সত্যি তাই ঘটেছে। কিন্তু প্রমাণ করবে কিভাবে? চিন্তিত দেখাল রোয়ানাকে।

পরিষ্কার কোন পরিকল্পনা জেথের নেই। আপাতত কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। বাক টার্নারকে বাগে পেলে অবশ্য পেছনের লোকটার মুখোশ খুলে দিতে পারবে। কিন্তু ওটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। স্যাম জারভিসের কথা মনে পড়তে কাগজে লিখল: ট্রিপল ক্রসের নিলাম কবে?

আগামীকাল হওয়ার কথা ছিল। এখন নিশ্চয়ই পিছাবে। ক্যান্টিন থেকে পানি পান করল রোয়ানা, মুখে ছিটাল এরপর। হ্যাট খুলে ছেড়ে দিল অবিন্যস্ত চুল। জেথ, তুমিও কিন্তু কম বুদ্ধিমান নও,মুগ্ধতা ওর কণ্ঠে। কয়েকদিন আগের চিহ্ন দেখে এতকিছু আঁচ করা সহজ ব্যাপার নয়। জেথের চোখে স্থির হলো ওর। দৃষ্টি, কি যেন ভাবল। আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত সফল হবে তুমি, সেটা অবশ্য বেশ কঠিন হবে।

কাগজের টুকরো আর পেন্সিল পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল জেথ। দুবৃত্তরা কি ধারেকাছেই আছে, ভাবছে ও, হয়তো দেখেছে ওদের। যদি দেখে থাকে, হামলার আশঙ্কা হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাক টার্নার এতক্ষণে বুঝতে না পারলেও আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টের পেয়ে যাবে তার জন্যে বিপদের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে জেথ। এখানে না হলেও শহরে অন্তত দেখা হবে, অন্তস্তল থেকে টের পাচ্ছে ও।

ফিরতি পথ ধরল ওরা।

শহরে পৌঁছে লুইফ বেক্সটারের সেলুনের দিকে এগোল। চমঙ্কার বিকেল, পরিষ্কার আকাশ। মৃদু বাতাস বইছে। কৌতূহল নিয়ে ওদের দেখছে শহরের লোকেরা। মাঝ রাস্তায় জাজকে দেখে ঘোড়ার রাশ টানল জেথ।

টার্নারের খোঁজ পেলে? জানতে চাইল উইলসন হলেন।

 মাথা নাড়ল-জেথ।

পাঁচ হাজার ডলারের আশা কি এখনও আছে?

তীক্ষ দৃষ্টিতে জাজকে দেখছে জেথ। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তাচ্ছিল্যের সাথে কথাগুলো বলেছে কি-না।

নিজের টাকা তুমি কোথায় রাখো, জাজ? জানতে চাইল রোয়ানা।

হাচিনসনের ব্যাংকে, হাসল সে। এ-তো সবাই জানে।

ডাকাতিতে তোমার কোন ক্ষতি হয়নি। তুমি সত্যি ভাগ্যবান।

একটা সিগার ধরিয়ে রোয়ানার কথাগুলোর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছে সে।

নিলামে দর হাঁকাবে?

ওটা কেনার মত টাকা আমার আছে।

ধন্যবাদ দিয়ে ঘোড়ার রাশ ঢিলে করল রোয়ানা। জাজ সামনে থেকে সরে যেতে এগোল। সেলুনে এসে বসল ওরা। জেথের জন্যে হুইস্কি আর নিজের জন্যে জুসের ফরমাশ দিল। কিছু বুঝতে পারলে? লুইফ পানীয় দিয়ে যেতে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল। ওর সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক।

মাথা নাড়ল জেথ।

চলো, তোমার জন্যে কাপড় কিনব, জুস শেষ করে উঠে দাঁড়াল রোয়ানা। সব তো পুড়ে গেছে।

কাগজ-পেন্সিল বের করে লিখল জে: কোন কিছু জানতে চেয়ো না। কিছুক্ষণ থাকব এখানে। সন্ধ্যার পর কাপড় কিনব। এ সুযোগে মিলের কাছে যাও, সারাদিনে মেরামতের কাজ তদারক করতে পারোনি।

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রোয়ানা, চোখে ভয়। তুমি ওদের আশা করছ, তাই না? জেথ, তুমি একা!

হেসে ওকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল জেথ।

কি যেন ভাবল মেয়েটা, তারপর শ্রাগ করে বেরিয়ে গেল।

টার্নার আসবে, এটা একরকম নিশ্চিতই। জেথ বাক টার্নার হলে একটা কাজই করত এখন-জেথ্রো ম্যাকলীনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিত।

সময় নিয়ে সিগারেট রোল করল ও। ধরিয়েছে, এ সময়ে সামনে এসে দাড়াল লুইফ। তোমাকে আরেকবার দেব নাকি? নিষেধ করতে চলে গেল সে।

নিজের অবস্থানটা দেখল জেথ। সেলুনের এককোণে বসে আছে, দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে। এখানে ঢোকার পর ওকে খুঁজবে টার্নার, ডানে তাকালে দেখতে পাবে…প্রচুর সময়। ঢুকেই গুলি করতে পারে এমন সুযোগ দেয়ার ইচ্ছে ওর নেই।

.

বাক টার্নারের কাজ আপাতত একটাই-বোবা ওই ছোকরাকে খুন করা। ছেলেটা অবশ্য খুব স্মার্ট, পিস্তলেও বোধহয় চালু। কিন্তু তিনজনকে একা সামলাতে পারবে না। কার্লি, মরগান আর পিটকে মনোনীত করেছে এ-কাজে। যোগ্য লোক।

দুপুর পর্যন্ত দিনটা সে কাটিয়েছে হোয়াইটস্টোন থেকে মাইল খানেক দূরে এক উপত্যকায়। ঘুরে-ফিরে নজর রেখেছে শহরের ওপর। জানত জেথ্রো ম্যাকলীন পুমাস ক্যানিয়নের দিকে আসবে, তাই ক্যাপেশাস ক্যানিয়নে রাত, কাটানোর পর সরে এসেছে দলবল নিয়ে। কেবল ডরম্যান ছাড়া। ম্যাকলীনের ওপর নজর রাখার জন্যে রয়ে গেছে সে, এবং সুযোগ পেলে নিকেশ করে। ফেলবে। ডরম্যান তা পারেনি, খুব বেশি সতর্ক বোবা ছেলেটা, ট্র্যাকিংয়ের সময়েও চারপাশে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে।

তিনজনকে মনোনীত করার পরও খুব নিশ্চিন্ত হতে পারছে না টার্নার। ভরসার কথা-জেথ্রো ম্যাকলীন একা। তাকে সাহায্য করার মত হোয়াইটস্টোনে নেই কেউ, অন্তত এখন। এখানকার ঘটনা কাউন্টির বাইরে জানাজানি হলে ইউ। এস মার্শাল বা শেরিফ চলে আসতে পারে, বলা যায় না অবস্থা গুরুতর আঁচ করতে পারলে এক ডজন আমিও চলে আসতে পারে। সেরকম কিছু হওয়ার আগেই কেটে পড়তে চায় টার্নার। এই প্রথম একটু ভিন্ন ধরনের কাজে জড়িত হয়েছে ও-বেশি মুনাফার আশায়। চেহারা দেখানোর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাই।

নিজের মাথায় পাথর ভাঙার ইচ্ছে ওর নেই, তাই সকালে শহরে আসেনি। শহরে ঢোকার পর সহিংসতা এড়ানো তার নিজের পক্ষেও কষ্টকর। কিন্তু উপর্যুপরি হামলায় হিতে বিপরীত হতে পারে। ভয়-আতঙ্কের বদলে তখন নিরীহ লোকগুলোর মধ্যে জন্ম নেবে সাহস, প্রতিহিংসা। উন্মত্ত লোকেরা তখন ওকে খুঁজে বেড়াবে, খুঁজবে ভয়ঙ্কর টেক্সাস রেঞ্জাররা বা বাউন্টি হান্টাররা। তেমন হলে ধরা পড়তে বাধ্য। শহর কমিটি এরমধ্যে ভাড়া করে ফেলেছে বোৰা ছেলেটাকে, আর সে-ই ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোকরার বয়স কম হলে কি হবে যা তেজ! ট্র্যাকিংয়ে যাদু জানে। স্লিম বেকারসহ সবার ট্র্যাক ঠিক ঠিক খুঁজে পেয়েছে। অথচ তার জায়গায় টার্নার নিজে হলে আড়াই দিনের পুরানো ট্র্যাক খুঁজে পেত কি-না ওর নিজেরই সন্দেহ আছে। শুধু ভয়ঙ্কর সেজন্যেই নয়, শহরের পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখার জন্যেও ছেলেটাকে খুন করা দরকার। ভয়-আতঙ্ক-সাহস, এগুলো খুব দ্রুত ছড়ায়। আজকের রাতটা পেরোলে জেথ্রো। ম্যাকলীন যে অন্তত কয়েকজন সঙ্গী পাবে তা হলফ করে বলে দিতে পারে সে। সেরকম হলে পরিকল্পনা তো ভেস্তে যাবেই শেষতক পৈত্রিক প্রাণ নিয়ে পিঠটান দিতে হতে পারে।

পুমাস ক্যানিয়ন থেকে ফিরে এসে ক্লান্ত দেহে সেলুনে ঢোকাই স্বাভাবিক, ভাবছে টার্নার, ধরে নেয়া যায় ব্যাংকের উল্টোদিকের লুইফস কর্নারে আছে ছোকরা। খুব সম্ভব এখন দ্বিতীয় পেগ পান করছে।

টার্নার যা ভেবেছিল, দলটাকে দেখে সিঁটিয়ে গেল শহরের লোকজন। প্রত্যেকটা আস্ত গাধা! আনমনে হাসল ও, সকালে আসেনি বলে ধরে নিয়েছে আর আসবে না। একেকটা মুখ পাংশুর মত, বাচ্চারা চিৎকার করছে। হুড়োহুড়ি পড়ে। গেছে রাস্তায়। কেউ বাড়ির ভেতর ঢুকছে, কেউ আবার বেরিয়ে আসছে। চুটিয়ে তা দেখে মজা লুটছে টার্নার।

রাস্তার এক পাশে, ব্যাংক থেকে চল্লিশ গজ দূরে একটা বাকবোর্ড ফেলে সবচেয়ে কাছের বাড়িটার উদ্দেশে ছুটল এক দম্পতি। সিক্সগান বের করে তাদের দুজনকেই ভূপাতিত করল টার্নার। এতে সহজ হয়ে গেল ওদের কাজ। নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল রাস্তা, একটা কুকুর বা মোরগ পর্যন্ত নেই। বাড়ির জানালাগুলোয় আতঙ্কিত, কৌতূহলী মুখ। বাড়িগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার লোভ বহুকষ্টে সামলে রাখল ও, নাহলে ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ্য হত!

নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে পুরো সজাগ দুবৃত্তেরা। সবার হাতে কক করা রাইফেল। চোখ বাড়ির জানালা বা ছাদ কিংবা গলিতে। খানিক আগে ছাদের। ওপর এক বুড়োকে রাইফেল হাতে দেখে গুলি করে ফেলে দিয়েছে পিটার্স। রাস্তায় পড়ে আছে বুড়োর প্রাণহীন দেহ।

কার্লি, ডরম্যান, পিট, ফাঁকা রাস্তার ওপর নজর বুলিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে নির্দেশ দিল টার্নার। সেলুনে ঢুকে দেখামাত্র গুলি করবে ছোকরাকে, কোন সুযোগ দেবে না।

এগোল নির্দিষ্ট তিনজন। সেলুনের সামনে হিচিং রেইলে বাঁধল ঘোডার লাগাম। তারপর শেষবারের মত ঠিক করে নিল গানবেন্ট আর হোলস্টার। সবার আগে কার্লিই পোর্চে উঠে এল, পেছনে পাশাপাশি অন্য দুজন। মিটিমিটি হাসি খেলা করছে কার্লির ঠোঁটে, বোবা ছেলেটাকে মোকাবিলা করতে সে একাই যথেষ্ট। টস্টোনে একবার তিনজনকে একসাথে মোকাবিলা করেছিল ও, তাদের মধ্যে কেবল একজন গুলি করার সুযোগ পেয়েছিল। ম্যাকলীন কি ওর চেয়েও ফাস্ট হবে? তাছাড়া লড়াই তো হবে একতরফা। দেখামাত্র ড্র করবে ও, অন্যরাও ওর নির্দেশ মত পিস্তল বের করবে। তারপর সহজতম কুপোকাত!

বাইরে থেকে সেলুনের ভেতরকার গুমোট ভাব আঁচ করতে পারল কার্লি। ভেতরে যারা আছে, অবস্থা বেগতিক দেখে সরে গেছে একপাশে। কার্লির আশঙ্কা হলো কেউ হয়তো বোবাটাকে সাহায্য করতে পারে। তাতে অবশ্য অসুবিধে নেই, পিট ও ডরম্যান তাদের সামলাবে।

ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। ডান পাশে বারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেথ্রো ম্যাকলীন, পা ফাঁক করে। সতর্ক। হেলান দিয়ে থাকায় দ্রুত ড্র করতে পারবে না সে, জানে কার্লি। টের পেল পাশে এসে দাড়িয়েছে ডরম্যান আর পিট।

এবার বয়েজ! হুঙ্কার ছেড়ে কোমরে হাত বাড়াল কার্লি রাফ।

<

Super User