মুহূর্তের জন্যে আবারও বিভ্রান্ত, বিহ্বল হয়ে পড়ল শেভার্ন। আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি, শেষে প্রতিবাদ করল। বুঝতে পারছ না এসব দলিল আসলে একটা সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে, ইচ্ছে করলে পরিচালনার ফি হিসেবে পুরো বাথানই দখল করে নিতে পারব আমি?
অজানা কোন কারণে এবার কিছুটা সন্তুষ্ট দেখাল শেরিফ জেসনকে। মাথায় হ্যাট চাপিয়ে দরজা মেলে ধরল সে। গুড লাক, বলে বেরিয়ে গেল।
আইনজ্ঞের দিকে তাকাল শেভার্ন, বিহ্বল দৃষ্টিতে ওকেই দেখছে সে। ফের যুবতীকে দেখল ও, তারপর জুডাস ম্যাকলেন্ডনের ওপর চকিত দৃষ্টি হেনে আইনজ্ঞের দিকে ফিরল। মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওদের! বিড়বিড় করে বলল ও। কাগজ তৈরি করে রেখো, সবার মাথা ঠাণ্ডা হলে এ ব্যাপারে আবারও আলাপ করব আমরা।
সবার মাথা ঠাণ্ডাই আছে, মি. শেভার্ন, বলল লাল-চুলো।
আমারটা নেই! বাউ করে বেরিয়ে এল শেভার্ন।
বাইরে তখন দারুণ গরম পড়ছে, দিনের সবচেয়ে উষ্ণ সময়। পুরো রাস্তাই ফাঁকা। বোর্ডওঅক ধরে শহরের মূল অংশের দিকে এগোল ও, বাড়ির কারণে কিছুটা ছায়া পাচ্ছে। ভাবছে ও, বোঝার চেষ্টা করছে কি থেকে কি ঘটেছে। ছোটবেলায় বহু নভেল পড়েছে যেখানে রেলরোড ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার পর এভাবেই পুরস্কৃত হয়েছে, তুচ্ছ ছেলেরা। কিন্তু বালক বয়স। থেকেই ও বুঝতে শিখেছে গল্প আর বাস্তব সম্পূর্ণ ভিন্ন-এবং সেলুনের হালকা খাবার যতই সুস্বাদু হোক, বিনে পয়সায় পাওয়া যায় না।
বুড়ো নীল ম্যাকলেন্ডনকে অসহায় ভাবে খুন করেছে কেউ, এবং আরও ঝামেলা আশঙ্কা করছে মিসেস ব্রুকস। মুখে না বললেও আচরণে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেছে, অন্তত শেভার্নের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তিনজন টা লোককে খুন করেছে ও, সেটা পরিস্থিতির কারণেই হোক, কিন্তু ফলশ্রুতিতে সোডা স্প্রিং-এ কঠিন, আপসহীন এক লোকের ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে গেছে ওর। অতএব, ও একজন বিশেষজ্ঞ। এক দার্শনিকের মন্তব্য মনে পড়তে ক্ষীণ হাসল শেভার্ন: শহরের বাইরে একজন বিশেষজ্ঞ স্রেফ একজন জারজ।
মি. শেভার্ন?
ঘুরে দাঁড়াল ও। জুডাস ম্যাকলেন্ডন। কি ব্যাপার?
প্লীজ, কাজটা নাও তুমি!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। নিজেও জানো আসলে কি বলছ? ছেলেটা উত্তর দেয়ায় খেই ধরল, আমাকে দায়িত্ব নিতে বলছ তুমি, কিন্তু সেদিন বোনকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছ কেন?
মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল ছেলেটা। বাবা তখন বেঁচে ছিল।
এভাবে ভেবে দেখেনি শেভার্ন। এটা একটা কারণ বটে, স্মিত হেসে বলল। ভাবছে অস্বাভাবিক হলেও সত্যি যে বুড়ো ম্যাকলেন্ডনের মৃত্যুতে তার পরিবারের কাউকে খুব একটা হতাশাগ্রস্ত বা শোকাতুর মনে হচ্ছে না। নিজের বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার ঘটনা মনে পড়ল ওর, এই এতদিন পরও ঘটনাটা স্মরণ করতে পছন্দ করে না সে।
নেবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাকলেন্ডনের কথা মনে করল শেভার্ন, মৃত্যুশয্যায় ওকে দারুণ এক উপদেশ দিয়ে গেছে লোকটা: কেবল দুটো ব্যাপারে শঙ্কিত আমি-কখনও যদি পায়ে হাঁটতে বাধ্য হই এবং এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে। সোডা স্প্রিং-এ এসে নিজের ঘোড়া হারিয়েছে ও, এবং এক মহিলার ভূত ঘাড়ে প্রায় চেপে বসেছে!
জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে এড়িয়ে গেল শেভার্ন। বোম্যানস হাউসে এসে ভিন্ন, পথ ধরল, ছেলেটাকে জানাল ভদ্রলোকেরা দিনের এসময়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে কাটায়। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল ও, ভাবছে।
বাল্যকালের উচ্ছ্বাস খুব অল্প বয়সেই বিদায় নিয়েছে ওর জীবনে, বদলে জোড়া কোন্টের ওপর আস্থা অর্জন করেছে। আস্থাটা হয়তো খুব বেশিই। এবার বোধহয় স্থির হওয়ার সময় হয়েছে। সোডা স্প্রিং থেকে অনেক দূরে, তুষারশুভ্র ওই পর্বতশ্রেণীর কাছাকাছি থাকতে কেমন লাগবে?
মনে পড়ল স্রেফ একটা বাথান দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওকে। এমন নয় যে কাঠখোট্টা মিসেস ব্রুকস ব্যক্তিগত ভাবে কিছু চাইবে ওর কাছে, এমনকি মহিলা চপলা এক তরুণীতে রূপান্তরিত হলেও অবস্থার হেরফের হবে না কারণ ও ওই মেয়ের চেয়েও তৎপর-দ্র, বনেদী এবং সুন্দরী কোন মহিলার বাড়ানো দুহাত এড়ানোর ক্ষমতা ওর আছে।
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে দেখা গেল মিসেস ব্রুকসকে। আগের মত আড়ষ্ট দেখাচ্ছে না, প্রায় নিরুত্তাপ স্বরে উইশ করল সবাইকে। জুডের মধ্যে প্রবল আগ্রহ লক্ষ করল শেভার্ন। পরে নাস্তা শেষ করে যখন পোর্চে বেরিয়ে এল পেছনে তাকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তি বোধ করল, ধারণা করল বোন বোধহয় টাইট দিয়েছে জুডকে।
হার্নেস জুড়ছিল হসলার। দুটো বাকবোর্ড আর একটা ফ্রেইট ওয়াগন রয়েছে করালের পাশে, ওয়্যাগনের জ্যাক ঠিক করতে কসরৎ করছে এক লোক। গ্রীজ আর ময়লা লেগে আছে শার্টে। সোডা স্প্রিং-এর পানিতে ধুয়ে কখনও ওই দাগ উঠবে কি-না কে জানে, ভাবল শেভার্ন।
ঘুরতে যাচ্ছে কেউ? হালকা সুরে জানতে চাইল ও।
বাকবোর্ড বা ওয়্যাগনগুলো চেনো না তুমি? শিকলের সাথে একটা চামড়ার টিউব সেলাই করার ফাঁকে মুখ তুলে তাকাল হসলার। শেভার্ন মাথা নাড়তে হাসল সে। এগুলো তো তোমাদের ওয়্যাগন।
গতকাল ওকে ভয় পাচ্ছিল বেটা, কিন্তু আজ যেন পরম বন্ধু মনে করছে! বিরক্তি চেপে রেখে স্টেবল থেকে সরে এল ও। কিছুক্ষণ ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করল। গোল্ডেন ঈগলে গিয়ে এক পেগ বীয়ার গিলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সেটা বোধহয় ঠিক হবে না। ঝামেলাবাজ কারও মুখোমুখি পড়ে যেতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘ যাত্রার শুরুতে সামান্য একটা ঠাণ্ডা বীয়ার এমন কোন কাজ দেবে না। বোম্যানস হাউসে ফিরে এল ও।
রিসেপশনে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল মিসেস ব্রুকস, চামড়ায় মোড়া একটা চেয়ারে বসে আছে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। একটা লেজার দেখছিল নিবিষ্ট মনে, চোখ তুলে ওকে দেখতে পেয়ে মৃদু নড করল।
পাশের রকারে বসল শেভার্ন, স্যাভিলানো দিয়ে বাতাস করল নিজেকে। লিভারি স্টেবলের ওয়্যাগনগুলো সাজানোর নির্দেশ দিয়েছ, ম্যাম?
হ্যাঁ, মি. শেভার্ন। লেজারটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল যুবতী।
এখনও মনস্থির করিনি, বলতে চেয়েছিল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে লেজারের পৃষ্ঠায় চোখ বুলাল ও। এই কলামে ডি.বি বলতে কি বোঝানো হয়েছে, যেসব দেনা শোধ করতে হবে?
ডি.বি কিন্তু দেনার সংক্ষিপ্ত রূপ নয়। ডেথ বেনিফিট।
তাই? আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। নিছক ছন্নছাড়া বা মারকুটে স্বভাবের জন্যে একটা এস্টেটের এক-তৃতীয়াংশ অফার করা হয়নি ওকে। কলাম ধরে হিসাবের ওপর চোখ বুলাল ও, ভাবছে অন্য শব্দ সংক্ষেপগুলোর মানে কি হতে পারে-ডিপ., কাটু কিংবা পি. অ্যান্ড এল-এর মানে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু টি.আর.এন.কিউ মানে কি?
শ্রাগ করল ও। পরেও অর্থোদ্ধার করা যাবে এসবের। একেবারে শেষের লাইনটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। কেউ আশা করে না আকাক্ষিত জিনিসটা তার মুখে পুরে দেবে অন্যরা, মিসেস ব্রুকসের দিকে ফিরে জানতে চাইল শেভার্ন। কিন্তু নিজের সম্পত্তি ধরে রাখার চেষ্টা তো অন্তত থাকতে হবে। এখানে যেসব হিসাব আছে, তাতে মনে হচ্ছে আসলে তেমন কিছুই করোনি তোমরা।
ঠিকই ধরেছ। বাবার বয়স হচ্ছিল, ঠিকমত দেখাশোনা করতে পারছিল না। সাহসী, দৃঢ়চেতা কাউকে দরকার ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একেবারে শেষ মুহূর্তে তোমাকে পেয়েছি আমরা। এর আগে অনেকেই এসেছে, আবার চলেও গেছে, শেভার্নের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে গ্রাহ্য করল না মিসেস ব্রুকস। যদি যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে পারো, হয়তো তোমার পুরস্কারের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারবে।
প্রশংসনীয় সততা দেখাচ্ছ তুমি, ম্যাম! কে, এবং কতজন?
বুঝতে পারলাম না।
জানতে চেয়েছি কাকে এবং কতজনকে খুন করতে হবে?
বিদ্রূপ আর কটুক্তির জন্যে তৈরি ছিল শেভার্ন, কিন্তু অপরূপা লাল-চুলোর নিস্পলক দৃষ্টিই বরং শেষে অস্বস্তিতে ফেলে দিল ওকে। আমার কাজ তো সেটাই, তাই না? তোমার বাবা এ-ই চেয়েছে, এবং তোমরাও তাই আশা করছ।
হ্যাঁ।
কি করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছ যে তোমার পক্ষে যোগ দেব আমি?
কারণ সবকিছুরই পক্ষ-বিপক্ষ আছে। পুরো এলাকাই ভাগ হয়ে যাবে।
কিন্তু ভুল পক্ষ বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে আমার, বলল শেভার্ন, ভুলতে পারছে না জীবনে দুবার একই কাজ করেছে।
আমার ধারণা এরইমধ্যে একটা পক্ষ বেছে নিয়েছ তুমি, মি. শেভার্ন।
কারণ আমি একজন আগন্তুকের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছি?
খানিকটা। কিন্তু তারও আগে, আমাদের দুই শত্রুকে খুন করেছ।
ব্যাপারটা আগেই মাথায় আসা উচিত ছিল। আর কজন আছে কে জানে! এ পর্যন্ত যা শুনেছি তাতে কোন বিচক্ষণ বা সতর্ক মানুষ তোমাদের সবুজ তৃণভূমিতে অবস্থান নিতে অনুপ্রাণিত হবে না।
তুমি কি সত্যিই সতর্ক মানুষ, মি, শেভার্ন? সতর্ক যদি হতেই, সোডা স্প্রিং এর সবচেয়ে কুখ্যাত সেলুনে পোকার খেলতে যেতে না! থেমে ওকে জরিপ করল মহিলা, তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে দৃষ্টি। আচ্ছা, তুমি কি ক্যান্সাসে গেছ কখনও? এখানে আসার আগে ক্যান্সাসে থাকতাম আমরা। গৃহযুদ্ধের সময় ওখানে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর হামলার কথা শুনেছ তো?
শীতল একটা শিহরণ বয়ে গেল শেভার্নের মেরুদণ্ডে। চোখের কোণ দিয়ে দেখল মেয়েটিকে, নিজেকে বোঝাল অযথাই কল্পনা করছে। খুব বেশি হলে তেরো বা চোদ্দ ছিল তখন লাল-চুলোর বয়স। মেয়েটি ঠিক কতটা জানে? ওর নিশ্চয়ই জানা নেই সদ্য জেল ফেরত এক তরুণ কাজ নিয়েছিল কনফেডারেট পন্থী উইলিয়াম রেনারের, কিন্তু ক্যাম্পাসে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর জঘন্য হামলার সময় রুখে দাড়িয়েছিল মালিকের বিরুদ্ধে? মন্দ অতীত আর বিশ্বাসঘাতকতার সস্তা গল্পের কারণে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর কুখ্যাত এক সদস্যের অপবাদ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এতগুলো বছর? এমনকি মেক্সিকো গিয়েও স্বস্তি বা অপবাদ থেকে মুক্তি পায়নি তরুণ। স্বার্থান্বেষী মহলের রোষের শিকার হতে হয়েছে তাকে, পরিস্থিতির ফিকিরে পড়ে আরেকটু হলেই প্রাণ হারাতে বসেছিল!
একটা পোস্টার, সেটা মিথ্যে আর সতিত যাই হোক যথেষ্ট শক্তিশালী। নিজের ক্ষেত্রে তিক্ততার সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে জিম শেভার্ন। উইলিয়াম রেনারের খুনের মিথ্যে অপবাদ, কিংবা কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক-সবকিছুর জের টানতে হচ্ছে ওকে। মরার আগে ওর চরম সর্বনাশ করে গেছে রেনার, সত্য-মিথ্যে মিশিয়ে একটা ওয়ান্টেড পোস্টার ছাড়ার ব্যবস্থা ঠিকই করে গেছে। লোকটা খুন হয়ে যাওয়ায় মিথ্যেটা আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফেরারী হয়ে কাটাতে হচ্ছে ওকে প্রায় দশটা বছর।
দশ বছর আগের একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে সত্যটি কি আদৌ বের করা সম্ভব? পরিস্থিতি অন্যরকম হলে হয়তো সম্ভব হত, কিন্তু ক্যাম্পাসের বেশিরভাগ লোকজন যুদ্ধের সময় উইল রেনারের ভূমিকা যেমন দেখেছে, তেমনি এও দেখেছে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর হামলার আগে রেনারের হয়ে কাজ করত শেভার্ন। দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে কারও সমস্যা হয়নি। দুএকজন যারা আসল সত্যটি জানে, অল্প বয়সে বখে যাওয়া জিম শেভার্নের কি হলো বা না-হলে তাতে কি যায়-আসে তাদের? তাছাড়া কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর মলার পরপরই আহত হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছে শেভার্ন, আর ও-মুখো হয়নি; গুটিকয়েক লোক জানে রেনার খুন হওয়ার দুদিন আগেই মেক্সিকোর পথে রওনা দিয়েছে ও।
মহিলা ওকে চিনতে পেরেছে, অন্য সবার মত ভাবছে সত্যিই কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ ছিল শেভার্নের? ওর অপর্যাপ্ত সতর্কতা বোধের প্রতি কটাক্ষ করতে দশ বছর আগের তিক্ত অতীত তুলে এনেছে আলোচনায়! সত্যিই তো, সতর্ক থাকলে কি উইল রেনারের হয়ে কাজ করত ও? কিংবা সোডা স্প্রিং এ এসে ঝামেলায় জড়ায় নিজেকে খুব বেশিদিন হয়েছে বিধবা হয়েছ তুমি? নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চাইল ও, সযত্নে এড়িয়ে গেল তিক্ত প্রসঙ্গটা।
মুহূর্তের জন্যে প্রশ্নটা নিজের মনে নাড়াচাড়া করল মহিলা, তারপর আঙুলের কর গুনতে শুরু করল।
তিন বছর?
না, তিন দিন।
প্রচণ্ড ধাক্কার মত লাগল বিস্ময়টা। সত্যি? সোডা স্প্রিং-এর পরিবেশ সত্যিই বেদনার, অনেকেই এখান থেকে সরে পড়তে চাইছে…
বিড়বিড় করে কি যেন বলল মহিলা, স্পষ্ট বোঝা গেল না। নীরবতা নেমে এল।
ম্যাকলেন্ডন এস্টেটের পরিবেশ কেমন?
পরিবেশটা সুন্দর, কিন্তু পরিস্থিতি সুখকর কিছু নয়। কেউ যদি সত্যিই জীবনকে উপভোগ করতে চায়, তাহলে থাকতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তুমি কি ফিরে যাবে?
তুমি কি সারা জীবন এখানে কাটাবে?
স্থানীয় লোকজনের বিরোধিতার মুখে…, বলতে শুরু করল ও, তারপর যুবতীকে হাসতে দেখে থেমে গেল। এই প্রথম কোন ম্যাকলেন্ডনের মুখে হাসি দেখতে পেয়েছে।
বয়স্ক এক বোর্ডার বেরিয়ে এল ভেতর থেকে, নাইস ডে, বলে পাশের রকারে এসে বসল বুড়ো।
খুশি হয়ে একমত হলো শেভার্ন, জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল মিসেস ব্রুকসের মুখ থেকে। রৌদ্রদগ্ধ রাস্তায় চোখ বুলাল ও, অন্যমনস্ক ভাবে শুনে গেল বুড়োর গল্প-যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছে লোকটা। আসল প্রসঙ্গ ধরতে কিছুক্ষণ সময় লাগল ওর, গৃহযুদ্ধ নয় বরং বহু পুরানো মেক্সিকান যুদ্ধের কথা বলছে সে।
নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ম্যাকলেনদের রক্তে প্রাণশক্তি আছে, তবে বেশিরভাগ সময় সেটা চাপা থাকে। এত সুন্দর মুখশ্রী নিয়ে কিভাবে নির্লিপ্ত থাকতে পারে মিসেস ব্রুকস, ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না ওর। যে কোন মহিলার চেয়ে সম্রান্ত, গর্বিত আচরণ মিসেস ব্রুকসের। হয়তো বেদনা আর তিক্ততাই। গাম্ভীর্যের কারণ।
সমানে বকবক করে যাচ্ছে বুড়ো। শিগগিরই সোডা স্প্রিং ত্যাগ করবে কি, মিসেস ব্রুকসকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে শেভার্ন, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ধূমপানের উসিলায় সরে এল ও। পোর্চে বেরিয়ে আসা মাত্র একটা পরিবর্তন উপলব্ধি করল-ক্ষণিকের জন্যে হলেও, একঘেয়েমি ভরা সোডা স্প্রিং এর নাগরিক জীবনে এখন আর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু নয় ও!
নতুন এক আগন্তক এসেছে। দীর্ঘদেহী, রোদপোড়া রঙ তার। চুলছে লোকটার ঘোড়া, সরাসরি স্টেবলের দিকে এগোচ্ছে। সেলুনের সামনে দাড়িয়ে আছে বারটেন্ডার, জীর্ণ সাদা অ্যাপ্রন সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আগন্তুককে দেখছে মার্কেন্টাইল স্টোরের মালিক। দুরে হার্নেসের ঝুনঝুন শব্দ শুনতে পেল শেভার্ন। কিছুক্ষণের মধ্যে চারটে ফ্রেইট ওয়্যাগন ঢুকল শহরে।
সমস্যা হয়নি তো? জানতে চাইল হসলার।
হাতের চাবুক গুটিয়ে রাখার সময় মাথা নাড়ল প্রথম টীমস্টার। আসন ছেড়ে নামার পর গোল্ডেন ঈগলের দিকে এগোল, আচমকা চোখাচোখি হলো শেভার্নের সঙ্গে; মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল, চাহনিতে ক্ষীণ সংশয়-প্রায় বোঝা যায় না, তারপর নিজের পথে এগোল। তাপদগ্ধ স্তার চেয়ে সেলুনের আরামদায়ক পরিবেশই বেশি কাক্ষিত মনে হচ্ছে তার কাছে।
স্মৃতি হাতড়ে বেড়াল শেভার্ন, কিন্তু লোকটাকে চিনতে পারল না। দেখা হওয়া সব লোককে মনে রাখা সম্ভবও নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোর্চের আরও ভেতরের দিকে সরে এল, দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ফ্রেইটারদের কাজ দেখতে থাকল।
কয়েকজন মিলে মালপত্র সরাচ্ছে ওয়্যাগন থেকে। ছোট ছোট কিছু বাক্স ভোলা হচ্ছে ক্যানভাসের হুড দিয়ে ঘেরা বাকবোর্ডে, দেখেই আচমকা ওর মনে পড়ল কেন সোডা স্প্রিং-এ অপেক্ষা করছে মিসেস ব্রুকস…
ঘুরে বোর্ডিং হাউসে ঢুকে পড়ল শেভার্ন। কয়েক গজ এগোতে সামনে মিসেস ব্রুকসকে দেখতে পেল। মাথার ওপর একটা ছোট্ট প্যারাসল [ছাতা বিশেষ] ধরে রেখেছে, হাঁটছে ধীর এবং আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। লিভারি স্টেবলই বোধহয় গন্তব্য, একই সঙ্গে যেটা স্থানীয় ফ্রেইট টার্মিনাল, হার্নেস ও স্যাডলের দোকান হিসেবে সেবা উপহার দিচ্ছে।
এখনই? জানতে চাইল শেভার্ন।
হ্যাঁ।
সহজ কথায় কিভাবে বলা যায়, উপায় খুঁজতে শব্দের ভাণ্ডার হাতড়াতে শুরু করল শেভার্ন। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল, শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে দীর্ঘ। বাকবোর্ড যাত্রায় যাওয়া উচিত হবে না-সেই পরামর্শ ওর কাছ থেকে পাওয়ার আশা নিশ্চয়ই করে না মহিলা। আর কিছু করতে হবে? শেষে জানতে চাইল ও।
মিসেস বোম্যানের লেনদেন চুকিয়ে ফেলল। সময়মত রওনা দিতে পারলে হয়তো সন্ধের আগেই মোটামুটি একটা দূরত্বে পৌঁছে যেতে পারব আমরা।
নড করে হ্যাটের কিনারা স্পর্শ করল ও। ঘুরে বোর্ডিং হাউসের দিকে এগোতে শুরু করতে চোখের কোণ দিয়ে প্রথম টীমস্টারকে দেখতে পেল। শেরিফের অফিসের দিকে যাচেছ লোকটা।
ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করল শেভার্ন। কারও পক্ষেই সবকিছু মনে রাখা সম্ভব নয়। শূন্য ল-অফিস থেকে বেরিয়ে আসছে বিশালদেহী টীমস্টার। শেরিফ গেছে কোথায়? শহরে আসা ফ্রেইটারদের কেবল সে-ই দেখছে না?
মিসেস বোম্যানের পাওনা মিটিয়ে নিজের কামরায় এল শেভার্ন। সময় নিয়ে পরিষ্কার করল বহু পুরানো কোল্টজোড়া, তারপর মালপত্র গুছিয়ে নিচে নেমে এল। পোর্চে জুডাস ম্যাকলেন্ডনের দেখা পেল ও, বাকবোর্ড চালিয়ে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা। তোমার মালপত্র তুলে নিচ্ছি, সোৎসাহে বলল সে। আমাদেরগুলোও তুলে নেব। তোমাকে লিভারি স্টেবলে যেতে বলেছে জুলিয়া, ওয়্যাগন বের করতে হবে।
ছয়টা মাসট্যাঙ জোড়া হয়েছে ওয়্যাগনে। ঘোড়াগুলোর আকার আর ষাট মাইল দীর্ঘ চড়াইয়ের ট্রেইল বিবেচনা করল ও, কিছু বোঝাও থাকবে। কিন্তু এবারই প্রথম নয়। এখানকার যে কেউ ট্রেইল সম্পর্কে ওর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে।
লিভারি স্টেবলের শেডের নিচে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস ফ্রক, ভঙ্গিটা একটা পতাকার খুঁটির মতই ঋজু। ওয়্যাগনের চেয়ে কিন্তু বাকবোর্ডের গতি কম, মনে করিয়ে দিল লাল-চুলো। এখনই রওনা দিতে চাইলে ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে তোমার।
সব তৈরি?
হ্যাঁ, মি. শেভার্ন। দয়া করে জলদি করো।
এত তাড়াহুড়ো করছে কেন মহিলা? শোেন আশা করল ওয়্যাগনের মত ও নিজেও তৈরি আছে। মনে করার চেষ্টা করল শেষ কবে ছয় ঘোড়ার বিশাল ওয়্যাগন রাইড করেছে। আসনে চড়ে লাগাম তুলে নিল ও, বুড়ো আঙুল আর অনামিকার ফাঁকে রাখল লীড হর্সের লাগাম, আর শেষ দুই আঙুলের ফাঁকে রাখল হুইলার টীমের লাগাম। ভাগ্য সহায়তা করলে হয়তো ঠিকমত ওয়্যাগন নিয়ে শহর ছাড়তে পারবে। লাগাম নেড়ে যাত্রা শুরু করল ও।
তন্দ্রালু বিড়ালের মত নড়ে উঠল ঘোড়াগুলো, দুপুরের তপ্ত রোদ থাকার পরও মাসট্যাঙের সহজাত প্রবৃত্তির কারণে-কিংবা শেভার্নের নীরস হাতের কারণেই-যাত্রা শুরু করল। অর্ধেক মোড় ঘোরার সময় ছুটতে শুরু করল।
দাঁতে দাঁত চেপে দৃঢ় হাতে লাগাম চেপে ধরল ও। একপাশের দুই চাকা মাটি থেকে উঠে গেছে কিছুটা, তারপর সোজা হয়ে গেল। রাস্তা ধরে এগোল এবার। লাগাম টেনে ধরার সাথে সাথে খিস্তি করা উচিত ছিল, ভাবল ও, তবে সুখের কথা মাইল খানেক পর্যন্ত রাস্তাটা সোজাসুজি চলে গেছে, এবং ওপরের দিকে উঠছে ক্রমশ। ঘোড়াগুলোর ছুটে পালানোর সময় এটাই। চোখের কোণ দিয়ে সেলুনের সামনে শেরিফ আর বিশালদেহী টীমস্টারকৈ দেখতে পেল মুহূর্তের জন্যে, ওর দিকেই তাকিয়ে আছে দুজন।
আচমকা ঝাঁকি খেতে শুরু করল ওয়্যাগন। মাথা থেকে উড়ে গেল ওর হ্যাট, পেছনের ক্যানভাস ঢাকা মালপত্রের ওপর গিয়ে পড়ল। উরুতে বাড়ি খাচ্ছে। হোলস্টার জোড়া, শেভার্ন নিজেও স্থির থাকতে পারছে না সীটের সঙ্গে।
শেষ বাড়িটাও পেছনে ফেলে এসেছে ওয়্যাগন, মূল ট্রেইলে চলছে এখন। ধূলিময় ট্রেইল, পরিশ্রম হলেও তুমুল গতিতে ছুটছে ঘোড়াগুলো। সামলাতে পারবে না ভেবে প্রায় হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল শেভার্ন, কিন্তু ঠিক সেই সময় রণে ভঙ্গ দিল বজ্জাতগুলো। ততক্ষণে প্রায় মাইল খানেক চলে এসেছে ওরা, ট্রেইলের পুরু বালির স্তর আর চড়াইয়ের কারণে ঘোড়াগুলোর উৎসাহে ভাটা পড়েছে। আরও কয়েকশো গজ পর দুলকি চালে এগোতে থাকল। প্রায় হাঁটছে ছয়টা মাসট্যাঙ, থামতে চাইছে।
চাবুক চালিয়ে ওগুলোকে এগোতে বাধ্য করল ও, আরও আধ মাইলের মত এগিয়ে পশুগুলোর ইচ্ছে পূরণ হতে দিল। মনে হয় শিক্ষা পেয়েছিস তোরা! ক্রুদ্ধ। স্বরে গর্জে উঠল ও, কিন্তু ঠিকই জানে মোটেও শিক্ষা নেয়নি তাঁদোড় মাসট্যাঙগুলো, একেবারে শেষ মুহূর্তে ছাড়া কিছুই শিখবে না এরা।
আপাতত ঝামেলা হবে না নিশ্চিন্ত হয়ে ব্রেকের খুঁটির সঙ্গে লাগাম বেঁধে পেছনে পাটাতনের ওপর চলে এল শেভার্ন, মালপত্রের ফাঁকে খুঁজে পেল স্যাভিলানোটা। ক্যানভাসের চেরা দিয়ে পেছনে সোডা স্প্রিং-এর দিকে তাকাল ও। কেউই অনুসরণ করছে না। না কোন বাকবোর্ড, না শেরিফ।
চোখ কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকাল ও। ধারণা করল মাঝ দুপুর এখন। এ পর্যন্ত কবার এই ট্রেইলে যাওয়া-আসা করেছে? ঘোড়াগুলো গতি কমিয়ে হাঁটার গতিতে নেমে আসতে লাগাম নেড়ে তাড়া দিল ও।
একবার বেরিয়ে একটা অ্যাম্বুশে পড়েছে।
ফিরে এসেছে দুটো লাশ নিয়ে।
পানির সাপ্লাই নিয়ে বেরিয়েছে আবার।
নীল ম্যাকলেন্ডনের জন্যে সাহায্য চাইতে ফিরে এসেছে এরপর।
শেরিফ আর ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছে আবার
ফিরে এসেছে ম্যাকলেন্ডনের মৃতদেহ নিয়ে।
শান্তিপূর্ণ এই ট্রেইলে সপ্তমবারের মত যাত্রা করেছে। আর কয়েকবার যাওয়া-আসা করতে হলে এই জায়গাটা ঘৃণা করতে শুরু কববে যে কেউ! ক্রোধের সাথে স্বগতোক্তি করল শেভার্ন। চাবুক চালাল আবার, কিন্তু অনীহায় পেয়ে বসেছে ঘোড়াগুলোকে, গতি বাড়ল না। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, কিন্তু বাগে আনা যাচ্ছে না ঘোড়াগুলোকে। অবশ্য লীড হসগুলো নিজেদের কাজের প্রতি মনোযোগী। সূর্যের উত্তাপ থেকে রক্ষা পেতে হ্যাটের ব্রিম নিচু করে দিল শেভার্ন, নড়েচড়ে বসল আনে। মনে আশঙ্কা এভাবে বসে থেকে হয়তো একসময় আড়ষ্ট হয়ে যাবে পাছার পেশীগুলো-ওয়্যাগনের রকিং বেঞ্চটা ক্রমশ অত্যাচারের একটা যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে।
পেছনে সোডা স্প্রিং চোখে পড়ছে এখনও, শহর থেকে বের হওয়া ট্রেইলে সাদা দুটো বিন্দু দেখা যাচ্ছে। বাকবোর্ড, ধারণা করল শেভার্ন। ওকে ধরতে আরও ঘণ্টা খানেক লাগবে।
যদি এখনও অনীহা থাকে, দেখা যাক এবার কি করিস তোরা! চাবুক চালানোর সময় বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল শেভার্ন। বিস্মিত হয়ে খেয়াল। করল গতি বেড়ে গেছে ওয়্যাগনের। ঘোড়াগুলোর অস্বস্তির কারণ ধরতে অসুবিধে হলো না ওর। ট্রেইলের পাশে একটা স্যাটলকে দেখে ভয় পেয়েছে। ওয়্যাগন বেঞ্চের সাথে নিজের পশ্চাদ্বেশের সংঘর্ষ কিভাবে এড়ানো যায় ভাবতে শুরু করল। ও। মিসেস ব্রুকস কিভাবে ব্যাপারটা সামাল দিচ্ছে?
চাঁদির ক্ষতে হাত বুলাল শেভার্ন, প্রায়-বুজে এসেছে জায়গাটা। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়, ভাবল ও। এখনও এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে নীল ম্যাকলেন্ডনের খুনী। লিভারি স্টেবলের সমস্ত ওয়্যাগন আর বাকবোর্ডের ব্র্যান্ড দেখেছে ও। কোনটারই ছিল না। মিসেস ব্রুকসকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। কোন ব্র্যান্ডের হয়ে কাজ করছে স্বাভাবিক ভাবেই জানা উচিত ওর। আশপাশে কটা ব্র্যান্ড আছে, লাল-চুলোকে জিজ্ঞেস করতে পারত।
আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, এবং এবারও ঘোড়াগুলোই সতর্ক করল ওকে। বুড়িয়ে যাচ্ছে, নাকি গরমে ত্যক্ত হয়ে গেছে? কিন্তু এরচেয়েও উষ্ণ অঞ্চলে বহু দিন কেটেছে ওর, সবকিছু ঠিকমতই চলছিল। চোখ-কান খোলা রাখতে না পারলে…
পাশাপাশি দুজন করে এগিয়ে আসছে চারজন লোক, ঢাল বেয়ে নামছে তারা, ফলে গতি ওয়্যাগনের চেয়ে অনেক বেশি। রাইফেলের রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্র ছড়িয়ে পড়ল লোকগুলো, নিজেদের মধ্যে একটা লাইন তৈরি করেছে। ওয়্যাগন থামিয়ে ব্রেক পোলের সাথে লাগাম বেঁধে রাখল শেভার্ন। পিছিয়ে যাও। চিৎকার করল ও, একটা কোল্ট বেরিয়ে এসেছে হাতে। বিশাল অস্ত্রটা দুই মুঠিতে চেপে ধরেছে, নিশানা ঠিক মাঝখানের লোকটির বুক বরাবর।
তৎক্ষণাৎ হাত তুলল লোকটা। আরে, এ তো নেহায়েত অন্যায়! কোন কথাবার্তা নেই ..।
তোমার প্রশ্নের জবাবে বলছি, এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যে কোন অঞ্চলেই শত্রুতা বা হামলার পূর্ব লক্ষণ-কাউকে ব্যাখ্যা করতে অসুবিধে হবে। আমার। তোমার লোকদের ফিরে আসতে বলো, কারও হাত যেন চোখের আড়ালে না থাকে। তারপর তোমাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আলাপ করা যাবে।
ধাপ্পাটা কাজে লেগে যেতে স্বস্তি বোধ করল শেভার্ন। ধীর গতিতে নিশানা করা লোকটার কাছাকাছি হলে অন্যরা, যদিও এগিয়ে আসছে এখনও। একসময় পিস্তলের নিশানার মধ্যে পৌঁছে গেল।
কোন নরক থেকে এসেছ তুমি? জানতে চাইল লোকটা। বিশালদেহী মান্য সে, মুখটা লালচে। গোল্ডেন ঈগলে পোকারের প্রতিদ্বন্দ্বী মোটর কথা মনে পড়ল শেভার্নের।
পিস্তল নামাল না ও। এদিকে নতুন এসেছি, কিন্তু বদ মতলব নেই। যে কোন ট্রেইলে পাড়ি দেয়ার অধিকার আছে আমার, তাই না? কয়েকবার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে আমাকে।
উত্তরটা সন্তোষজনক নয়, স্ট্রেঞ্জার, ক্ষীণ হেসে বলল বিশালদেহী, ট্রেইল ধরে কেবল অল্প কয়েকটা জায়গায় যাওয়া সম্ভব।
সানফ্রান্সিসকো যাওয়া যায় নিশ্চয়ই?
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে, তারপর হেসে উঠল। এখন আর যায় না। রেলরোড এখান থেকে কয়েকশো মাইল উত্তরে। তাছাড়া, এই মাল নিয়ে পাহাড় ডিঙাতে পারবে না।
সত্যিই নিজের অবস্থান ভুলে গিয়েছিল শেভার্ন, মনে পড়ল উদ্যমী এখন আর সঙ্গে নেই। ওয়্যাগনের ব্যাপারে সচেতন হতে ভাবল ব্রেক পোয় সাথে লাগাম বেঁধে রাখা ঠিক হয়নি বোধহয়, নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত, ঘোড়াগুলো ছুটতে শুরু করলে বিপদ হতে পারে।
ঘোড়া সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে দলের ডানদিকের লোকটার। কে ওপর লাগাম ফেলে রেখেছে সে, হাত দুটো মাথার ওপর তোলা। ঘোড়াটা ফিরতে ব্র্যাভটা দেখতে পেল শেভার্ন। অদ্ভুত ব্র্যান্ড। পাশাপাশি দুটো চ সাইকেলের মত দেখাচ্ছে। একটা চাকা অন্যটার চেয়ে ছোট।
দয়া করে এক আগন্তকের সামান্য কৌতূহল মেটাবে? জানতে চাইল তোমাদের ব্র্যান্ডের নাম কি? মালিক কে?
সত্যিই মজার লোক তুমি, স্ট্রেঞ্জার, সক্ষোভে বলল বিশালদেহী। এ কোন্টের মাজলের দিকে তাকিয়ে থাকা বোধহয় মেজাজ ধরে রাখার জন্যে য নয়। ম্যাকলেন্ডনদের হয়ে ফ্রেইটিং করছ অথচ এটেনভেন্টের ডাবল-ও ব্র্যা কথা শোনোনি ভাবতেই অবাক লাগছে!
চেনা উচিত?
য়ে ঘোড়াগুলো রাইড করছ ওগুলো কি তোমার? একটায় ডাবল-ও ব্র্যা কোত্থেকে পেয়েছ ওটা?
ভুল করে আমার ঘোড়াটাকে মেরে ফেলেছিল এক লোক, ব্যাখ্যা ব শেভার্ন। বেচারা এত অনুতপ্ত হয়েছিল যে শেষে নিজেরটা আমাকে কি দিয়েছে।
ডানদিকের লোকটা অন্যদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে।
আগে কি তুমিই মরতে চাও, নাকি মোটকুকে গুলি করব প্রথমে? শীতল রে জানতে চাইল শেভার্ন।
আগে থেকে সঙ্কেত দেয়া ছিল যেন, একই সঙ্গে পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল ওপরজন। ডানদিকের লোকটা স্যাডল চ্যুত হলো প্রথমে, বিশালদেহীর উদ্দেশে পরের গুলি করল শেভার্ন, কিন্তু লোকটার ঘোড়া লাফিয়ে ওঠায় মিস্ হলো। গড়ান দিয়ে ওয়্যাগনের পাটাতনে চলে এল ও, গুলির তুবড়ি ছোটাতে শুরু করেছে।
গড়িয়ে মাটিতে পড়ল ও, ওয়্যাগনের সামনের চাকার কাছে। চিৎকার করে আগে বাড়ল মাসট্যাঙগুলো, ব্রেক লেভার থাকার পরও সামনে এগোল ওয়্যাগন। কয়েক ফুট উঁচু চাকার সামনে থেকে সময়মত সরে যেতে সক্ষম হলো শেভার্ন।
সে সমানে নিশানা ছাড়াই গুলি করছে তিনজন। ওয়্যাগনের নিচেও বাদ দিচ্ছে না। মুহুর্তের জন্যে নিজের ইতিকর্তব্য সম্পর্কে ভাবল শেভার্ন, ভাবছে ওয়্যাগনে যাবে কি না, তারপর ট্রেইলের পাশের একটা জুনিপারের আড়ালে সরে এল, ততক্ষণে সামনে থেকে সরে গেছে ওয়্যাগনটা।
একজন ধরে নিয়েছে এখনও ওয়্যাগনের নিচে আছে ও। নির্দ্বিধায় লোকটার দেহ ফুটো করল শেভার্ন। আরও দুটো গুলি করল, নিশ্চিত জানে অন্তত একটা বিশালদেহীর শরীরে গেঁথেছে। আচমকা রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছে ঘোড়া দুজন, অপ্রত্যাশিত দিক থেকে আক্রমণ আসায় আত্মবিশ্বাস হারিয়ে চলছে।
হাঁপাচ্ছে শেভার্ন, ওয়্যাগন থেকে লাফিয়ে পড়ায় কিছুটা হলেও আঘাত পেয়েছে কনুই আর বাহুতে। তেমন কিছু নয় অবশ্য। পিস্তল রিলোড করে হ্যাট তুলে নিল। শখানেক গজ এগিয়ে গেছে ওয়্যাগন, থেমে গেলেও মরিয়া হয়ে লাগাম ছেঁড়ার চেষ্টা করছে মাসট্যাঙগুলো। ছুটতে শুরু করল ও, ভাবছে সময়মত পৌঁছার আগেই উন্মত্ত পশুগুলো হার্নেস ছিঁড়ে ফেলে কি-না।
মিনিট কয়েক পরে ওয়্যাগনের পেছনে পৌঁছে গেল ও। হাত বাড়িয়ে লগেট চেপে ধরল, তারপর শরীর তুলে দিল পাটাতনে। দ্রুত সামনে এসে লাগাম তুলে নিল হাতে, ব্রেক রিলিজ করে দিল-বিড়বিড় করে শান্ত করার চেষ্টা করল পশুগুলোকে। পেছনে টান মুক্ত হতে যেন স্বস্তি বোধ করল ঘোড়াগুলো, দৌড়াতে শুরু করেছে আবার।
ওয়্যাগন থামালেই বোধহয় ভাল হত, ভাবল শেভার্ন। পেছনে হয়তো বেঁচে যেত দুজনের কেউ, পরখ করা দরকার। তবে ঝামেলার হবে কাজটা, ওয়্যাগন থামাতে থামাতে অন্তত কয়েকশো গজ পেরিয়ে যাবে। ট্রেইলের পাশে দুটো মরদেহ দেখে কি ভাববে মিসেস ব্রুকস?
ঘেমে গেছে ঘোড়াগুলো, থামতে চাইছে। কিন্তু থামল না শেভার্ন। তিক্ত মনে চাবুক চালিয়ে গেল। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের মুখ খুলে গেছে বোধহয়, টের পেল ভেজা ভেজা লাগছে। এক কনুইয়ের কাছে চামড়া ছড়ে গেছে, সারাক্ষণ জ্বালা করছে। বিড়বিড় করে কঠিন পাথুরে মাটিকে গাল দিল ও। ছুটতে থাক বেটারা, আগে শরীরে কিছু ক্ষত তৈরি কর, তারপর থামতে দেব। বহু পথ পড়ে আছে। সামনে। আরও মাইল খানেক ছুট, তাহলে হয়তো শিক্ষা হবে তোদের?
কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরই ইস্তফা দিতে হলো। সত্যিই হাঁপিয়ে গেছে ঘোড়াগুলো। বেচারা পশু! কখনও শিখবে না এরা। শেভার্ন নিজে কি শিখবে কখনও?
আর কিভাবে ব্যাপারটা সামাল দেওয়া যেত বিড়বিড় করল ও।
আন্তরিক একটা উত্তরে অযথা প্রাণনাশ এড়ানো যেত, বলল ওর বিবেক।
বুলেটও এড়ানো যেত?
বুলেটের ওপর নির্ভর করে যারা বেঁচে থাকে, বুলেটের কারণেই মারা পড়ে একদিন, পাল্টা যুক্তি দেখাল ওর সত্তা।
কিন্তু আমার দোষ ছিল না এতে।
অন্তত ফিরে যেতে পারতে তুমি, ওদের মৃত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতে। একজনও যদি বেঁচে থাকে, মিসেস ব্রুকস বা ছেলেটার ওপর চড়াও হতে পারে, তাই না?
আকাশের দিকে তাকাল শেভার্ন। হয়তো তোমারই সাহায্য করা উচিত ছিল-সঙ্কীর্ণ ট্রেইলে বেজন্মা এই ওয়্যাগনটা ঘোরাতে আরেকজনের সাহায্য দরকার ছিল আমার! উপলব্ধি করল অন্তত এবার বিবেককে যুক্তিতে হারাতে পেরেছে।
সোজাসুজি চলে গেছে ট্রেইল, অন্য দিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ হলো এবার। সীটের ওপর দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাল ও। যুদ্ধক্ষেত্রটা দেখা যাচ্ছে না, কিংবা জায়গাটা শনাক্ত করতে পারছে না, যদিও একেবারে সোডা স্প্রিং পর্যন্ত পুরো ট্রেইলই চোখে পড়ছে। চোখ কুঁচকে তাকাল ও, কয়েক মাইল দূরে সাদা ক্যানভাসের চলন্ত একটা আকৃতি দেখা যাচ্ছে।
ঘুরে ট্রেইলের দিকে মনোযোগ দিল শেভার্ন। কমে এসেছে সূর্যের তেজ, ঘন্টা খানেকের মধ্যে ডুব দেবে দিগন্তের ওপারে। ক্যাম্প করার মত যুৎসই একটা জায়গার খোঁজে চারপাশে উৎসুক দৃষ্টি চালাল ও।
.
০৬.
ট্রেইল থেকে কিছুটা পাশে ক্যাম্প করেছে শেভার্ন। সূর্য তখন ডুবে গেছে, গোধূলির লালিমায় রঙিন হয়ে আছে পশ্চিম দিগন্ত। পাহাড়শ্রেণী থেকে ভেসে আসছে পাইনের গন্ধ মাখা সুবাসিত বাতাস। ওয়্যাগন থামিয়ে হার্নেস থেকে ঘোড়াশুলোকে ছাড়িয়ে নিল ও, ক্লান্ত পশুগুলোকে খাবার দিয়ে কুঠার হাতে এগোল পাশের ঝোপের দিকে। সূর্যের আলো থাকতে থাকতে কিছু শুকনো কাঠ সংগ্রহ করার ইচ্ছে।
সারা দিনে মোটামুটি মাইল ত্রিশের মত পাড়ি দিয়েছে। সন্তোষজনক কয়েক মিনিট পর ওয়্যাগন দুটো পৌঁছে গেল। এখনও পিঠ সোজা করে লীড ওয়্যাগনের আসনে বসে আছে মিসেস ব্রুকস, লাল চুল পরিপাটি। কিছুটা সমীহ আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন, তারপর আচমকা মহিলার ফ্যাকাসে মুখ নজরে পড়ল। কুঠার ফেলে দ্রুত এগোল ও। কৃতজ্ঞ চিত্তে ওর বাড়ানো হাত চেপে ধরল মহিলা, এতটাই ক্লান্ত যে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল শেভার্নের শরীরের ওপর।
পেছনের বাকবোর্ড থেকে ছুটে এল জুডাস ম্যাকলেন্ডন। দুজনে মিলে ঘাসের ওপর বিছানো বেডরোলে শুইয়ে দিল মিসেস ব্রুকসকে। হুইস্কির বোতলের খোঁজে নিজের ব্যাগ হাতড়াতে শুরু করল শেভার্ন।
সত্যিই বুঝতে পারছি না কি হয়েছে আমার! ক্লান্ত স্বরে স্বগতোক্তি করল লাল-চুলো।
সান-স্ট্রোক বলে একে। গরম আর আর্দ্রতার কারণেই এমন হয়েছে। তাপমাত্রা কমে গেলে ভাল লাগবে। পূর্ব প্রস্তুতি দূরে থাক, মনে হচ্ছে শুধু সান স্ট্রোকই নয়, ট্রেইলের দুর্ভোগ বা দুর্ভাগ্যের ব্যাপারেও কোন ধারণা নেই তোমার…ট্রেইলে যতক্ষণ আছ এত পুরু আর কয়েক প্রস্থ কাপড় না পরলেও চলে, তাই না?
অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল জুলিয়া ব্রুকস, চোখ বুজে আছে।
শেভার্ন ধারণা করল এখানে মিসেস ব্রুকসের জীবন ওর মতই কিছুটা হলেও রোমাঞ্চকর। পুরো একটা দিন বাকবোর্ডের সীটে কাটিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে গেছে জুড। ছেলেটাকে ঘোড়াগুলো মুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে সাপ্লাইয়ের খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও, আগুন জ্বেলে মাংস আর কন সহযোগে খাবার তৈরি করল। শেষে নিজের ব্যাগপত্রের কাছে ফিরে এল। গ্রীন রীভারের বোতলটা খুঁজে পেল এবার। একটা কাপে সামান্য হুইস্কি ঢেলে একই পরিমাণ পানি মেশাল। পানীয়ের গুণগত মান আর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে ভাবছে। মিসেস ব্রুকসের কাছে ফিরে এল ও।
কি এটা?
অষুধ। স্বাদটা উপাদেয় নয়, সুতরাং এক চুমুকে খেয়ে ফেলল।
বিনা বাক্য ব্যয়ে নির্দেশ মানল মহিলা, চুমুক দেয়ার পরপরই মুখ বিকৃত হয়ে গেল, কিন্তু একটু পরে ফ্যাকাসে মুখে খানিকটা রঙ ফিরে এল। জঘন্য স্বাদ তোমার এই অষুধের! শুয়ে পড়ার সময় স্মিত হেসে মন্তব্য করল জুলিয়া ধ্রুকস। পানির সঙ্গে মিশিয়ে জিনিসটা নষ্ট করার দরকার ছিল না!
বাউ করল শেভার্ন। পরেরবার শুধরে নেব, পাল্টা হেসে বলল ও, আগুনের কাছে গিয়ে তিনটে থালায় খাবার তুলে নিয়ে এল। ফিরে এসে দেখল কিছুটা হলেও সামলে নিয়েছে মিসেস ব্রুকস।
সত্যিই অদ্ভুত, বিড়বিড় করল জুলিয়া ব্রুকস।
কি অদ্ভুত?
আমি তো জানতাম তোমার দেশের লোকেরা গমের তৈরি রুটি পছন্দ করে, অথচ তুমি কন পোন পছন্দ করো।
কিছু দিন দক্ষিণে ছিলাম আমি।
কনফেডারেটদের সঙ্গে? অননুমোদনের ক্ষীণ আভাস মহিলার কণ্ঠে।
আরও দক্ষিণে, মেক্সিকোয়।
তাতে বরং লাভই হবে।
কিভাবে?
আমাদের বেশিরভাগ লোকই ইংরেজি বলতে পারে না। ওদের সঙ্গে কথা বলতে হলে স্প্যানিশ জানা ছাড়া উপায় নেই।
নীরবে খাওয়া শেষ করল ওরা। ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল শেভার্ন, ভাবছে কিভাবে ট্রেইলের ঘটনাটা সম্পর্কে জানতে চাইবে। আসার পথে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে তোমার? কফিতে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল ও।
অস্বাভাবিক?
ট্রেইলে নতুন কিছু চোখে পড়েনি? দৃষ্টি সরিয়ে জুডের দিকে তাকাল ও, ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা।
মনে পড়ছে না কিছু। বোধহয় আরও মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল আমার।
তারমানে মিসেস ব্রুকস বা জুড, কারও চোখে পড়েনি মৃতদেহ দুটো। কেউ বোধহয় ফিরে এসে লাশগুলো সরিয়ে নিয়ে গেছে, ধারণা করল শেভার্ন। অন্তত একজন যে মারা গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অন্যজনের ভাগ্যে কি ঘটেছে কে জানে। পেনি-ফার্দিং ব্র্যান্ডটা কি তোমার পরিচিত?
কি ব্র্যান্ড?
বাই-সাইকেলের মত দুটো চাকা, একটা আবার ছোট।
তুমি বোধহয় ওস্টেনভেল্টের কথা বলছ?
তোমার শত্রু?
বলা যায়।
আমিও তাই ভেবেছি। এদের চারজন প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল আমাকে।
তাই!? ঝামেলা হয়নি তো?
দুজন পালিয়ে গেছে।
ওহ! চিন্তিত দেখাল মিসেস ব্রুকসকে।
ভোরের আগে বোধহয় চাঁদ উঠবে না, ভাবল শেভার্ন। মিসেস ব্রুকস বা জুড দুজনেই দারুণ ক্লান্ত। এদিকে গত দুই রাত মিসেস বোম্যানের বোর্ডিং হাউসে ভালই ঘুমিয়েছে ও। সুতরাং রাতের প্রথম দিকটা ওরই পাহারা দেয়া উচিত।
জুডের আগে আমাকে ডেকো, বিড়বিড় করে বলল মিসেস ব্রুকস, বোঝা যাচ্ছে হুইস্কির প্রভাব শুরু হয়েছে।
নিভু নিভু, আগুনের কাছ থেকে দূরে সরে গেল শেভার্ন, একটা জুনিপার ঝোপের কাছে বসল। নিবিষ্ট মনে রাতের শব্দ শুনছে। ঠাণ্ডা পড়ছে বেশ। গায়ে একটা কম্বল জড়াল ও, ধূমপান করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ইচ্ছেটাকে গলা টিপে মারল। আনমনে ভাবছে কিভাবে এত নির্লিপ্ত থাকছে মিসেস ব্রুকস। মাত্র তিন দিন আগে বিধবা হয়েছে-এখন বোধহয় চার দিনে পড়ল? সুখকর কিছু নয়। পশ্চিমে জন্ম কিংবা বড় হলেও মিসেস ব্রুকস মনেপ্রাণে একজন স্কট। আশাহতের যন্ত্রণা স্কটদের একটু বেশিই আহত করে, কারণ হৃদয়টা তাদের বরাবরই ভঙ্গুর। নইলে কেন এভাবে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বেদনা ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে মহিলা?
স্কটরা বরাবরই শেভার্নের কাছে ধাঁধার মত। বোঝা কঠিন মনে হয়েছে এদের। কিন্তু জানে এরা প্রায় প্রত্যেকেই উদার মনের মানুষ। হয়তো গরীব হতে পারে, কিন্তু ওদের আন্তরিকতা আর আতিথেয়তার গল্প এমনকি সুদূর পশ্চিমেও চালু আছে।
কোথাও করুণ স্বরে ডেকে উঠল একটা কথোট। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুর মেলাল অন্যগুলো। গাঢ় কিছু ছায়া দেখা যাচ্ছে আকাশে, ওড়ার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। বাদুড়, ধারণা করল শেভার্ন।
তুমিও তো বিশ্রাম নিতে পারো, মি. শেভার্ন, ঘণ্টা তিনেক পর মিসেস ব্রুকসের কণ্ঠ শুনতে পেল ও।
আর তুমি?
আমার তো মনে হচ্ছে কেউ না জাগালে দুপুর পর্যন্ত ঘুমাতে পারব।
ওয়্যাগন থেকে নামার মুহূর্তটি মনে পড়ল শেভার্নের, সত্যিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল মহিলা। ব্যথা আছে এখনও?
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নয়, ক্ষণিকের জন্যে থামল জুলিয়া ব্রুকস। হয়তো খেয়াল করেছ আমার চলাফেরা খানিকটা আড়ষ্ট। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, সেরে উঠতে বেশি দিন লাগবে না।
অস্ত্র আছে তোমার কাছে, ম্যাম?
একটা রাইফেল। কিন্তু যতবারই ওটা দিয়ে গুলি করেছি, কাঁধে চোট পেতে হয়েছে।
রাইফেলগুলো আসলে মেয়েদের শরীরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়নি, ব্যাখ্যা দিল শেভার্ন। দেখল উঠে বসেছে লাল-চুলো, গায়ে কম্বল জড়ানো। নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ল ও, ঘুম নেমে এল চোখে। কিন্তু একটু পরই টের পেল কাধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে কেউ।
মি. শেভার্ন? ফিসফিস করে ডাকছে মিসেস ব্রুকস। কেউ বোধহয় আসছে এদিকে!
নিচের ট্রেইলে? পাল্টা ফিসফিস করল শেভার্ন, চোখ খুলে চারপাশে তাকাল, তবে উঠল না। কান খাড়া করতে ব্রিডলের ঝনঝন আর চামড়ার খসখসে শব্দ শুনতে পেল পরিষ্কার। দ্রুত উঠে বসে বুট জোড়া পায়ে গলাল ও, হোলস্টারে কোল্ট জোড়া পরখ করে নিল। গুটি গুটি পায়ে নিজের বেডরোলের দিকে চলে গেল মিসেস ব্রুকস, জুডের মুখ চেপে ধরল এক হাতে, তারপর জাগাল ছেলেটাকে।
চাঁদ নেই আকাশে, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ক্যাম্পের আগুন অনেক আগেই নিভে গেছে। তন্দ্রা চোখ জোড়া সচকিত করল শেভার্ন, ধারণা করল ভোর হতে এখনও অন্তত ঘণ্টা খানেক বাকি। ধীরে ধীরে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে একটা ঘোড়া।
চোখ কুঁচকে ক্যানভাসে ঢাকা বাকবোর্ড আর বিশাল ফ্রেইট ওয়্যাগনের দিকে তাকাল শেভার্ন, ভাবছে তারার আলোয় কত দূর থেকে চোখে পড়বে ওগুলো। পকেট হাতড়ে বাড়তি গুলি বের করল, আনমনে ভাবছে আবারও সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কি-না। এখনও একই ভাবে এগিয়ে আসছে নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী। তারপর, আচমকা থমকে দাঁড়াল ঘোড়াটা।
চোখ কুঁচকে নিচের ট্রেইলের দিকে তাকাল ও, আবছা আলোয় আগুয়ান ঘোড়া আর আরোহীকে স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করছে। যে-ই এসে থাকুক, সাদা ক্যানভাস অন্তত চোখে পড়েছে তার। কোল্ট জোড়া বের করে অপেক্ষায় থাকল শেভার্ন। ক্যানভাস ঢাকা ওয়্যাগন বা বাকবোর্ড থেকে নিরাপদ দূরত্বে ক্যাম্প করেনি কেন ও? চরতে চরতে ঘোড়াগুলো কত দূরে সরে গেছে কে জানে!
মিসেস ব্রুকস? পরিচিত একটা কণ্ঠ শোনা গেল, কিন্তু শনাক্ত করতে পারল শেভার্ন।
কে তুমি? পাল্টা প্রশ্ন করল মহিলা।
শেরিফ জেসন বেলহ্যাম।
সাবধানে এসো, হাতগুলো যেন দেখতে পাই, বলল ম্যাকলেন্ডন-কন্যা, যুবতীর বুদ্ধিমত্তায় সন্তোষ বোধ করল শেভার্ন।
ঘোড়াটা আবার এগোতে শুরু করেছে, একটু পর উপত্যকার শুরুতে তারার আলোর বিপরীতে শেরিফ বেলহামের ঋজু অবয়ব ফুটে উঠল। কিছুটা পিছিয়ে জুনিপারের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিল শেভার্ন, শেরিফের স্যাডল ত্যাগ করার অপেক্ষায় থাকল।
ইংরেজ লোকটা আছে তোমাদের সঙ্গে? প্রশ্নটা করার পর শেভার্নকে দেখতে পেল শেরিফ, মৃদু নড করল সে। এসবের জন্যে সত্যিই দুঃখিত আমি।
আমার স্বামীর নাকি আমার বাবার মৃত্যুর জন্যে? অদ্ভুত নির্লিপ্ত স্বরে জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
এবার আরও ব্যথিত দেখাল শেরিফকে।
মাঝবয়সী লোকটার জন্যে করুণা বোধ করল শেভার্ন, কিন্তু নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। সত্যিই অদ্ভুত লাগছে, শেরিফ, মৃদু বিদ্রুপের স্বরে মুখ খুলল ও। এতটা পথ একা এসেছ তুমি!
হয়তো আজকের উসিলায় সারা বছরের কামাই নিশ্চিত হয়ে যাবে আমার! খেপা সুরে পাল্টা জবাব দিল ল-ম্যান।
আগে বা পরে ব্যাপারটা ঘটবেই, জানে শেভার্ন-ল-অফিসের দিকে টীমস্টারকে যেতে দেখার পর থেকেই ধরে নিয়েছে। আচমকা ওর উপলব্ধি হলো কেন তাড়াহুড়ো করে সোডা স্প্রিং ছাড়তে চেয়েছিল মিসেস ব্রুকস। শেরিফকে নিরীখ করল ও-যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক, কোমরের সাথে লেপ্টে থাকা একমাত্র পীসমেকারের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে হাত।
সোডা স্প্রিং-এ ঢোকার বা বেরোনোর রাস্তা একটাই, উদ্দেশ্যপূর্ণ স্বরে মন্তব্য করল শেরিফ।
শেভার্নের মনে হলো সত্যিই বোধহয় নিষ্কর্মা লোক ও, অবাঞ্ছিত ভাবে ঘোরাফেরা করছে সোডা স্প্রিং-এর আশপাশে, এ পর্যন্ত কয়েকবার শহরে প্রবেশ করেছে বা বের হয়েছে; অথচ সাফ্রান্সিসকোয় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ওর।
সোডা স্প্রিং থেকে বহু দুরে থাকি আমরা, নিরুত্তাপ স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস। স্রেফ সৌজন্য সাক্ষাতের জন্যে এত পথ পাড়ি দেবে না কেউ। এর আগে কখনও আমাদের দেখতে আসোনি তুমি। হঠাৎ দরদী হয়ে উঠলে যে? ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেল না, শেরিফ, শহরের নিরাপদ বেষ্টনী ছেড়ে আসতে হলো তোমাকে? সোডা স্প্রিং-এ দেখা করলেই পারতে, তাহলেই এত কষ্ট করতে হত না!
কথাগুলো সত্যিই কঠিন, জুলিয়া, তোমার মনের অবস্থা চিন্তা করলে তাই বলতে হচ্ছে। তুমি কি জানো কেন এখানে এসেছি আমি?
না, এবং জানতেও চাই না। অতীত ভুলতে চাইছে শান্তিপ্রিয় এমন যে কোন লোককে খুঁচিয়ে ত্যক্ত করতে সিদ্ধহস্ত তুমি, না চাইলেও হয়তো তোমার সঙ্গে ঝামেলায় জড়াবে কেউ কেউ। স্বামী আর বাবার মৃত্যুর পর এই প্রথম নির্লিপ্ততার মুখোশ খসে পড়ল জুলিয়া ক্লকসের, স্মিত হাসি দেখা যাচ্ছে রহস্যময় ঠোঁটের কোণে, তবে কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর স্পষ্ট। সময়মত নিজের দায়িত্ব যদি না-ই সারতে পারো, সরে গিয়ে অন্য কাউকে কাজটা করতে দাও বরং।
চালু মহিলা, আনমনে ভাবল শেভার্ন, আইন সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। তারপরই ওর মনে পড়ল পুবের স্কুলে পড়াশোনা করেছে মিসেস ব্রুকস, ক্যাম্পাসে থাকত একসময়…গৃহযুদ্ধের শুরুতে…
এক মিনিট, বাধা দিল ও। ব্যাপারটা তুলতে চায়নি, অন্তত এখনই। জানতে পারি কি অভিযোগ নিয়ে সোডা স্প্রিং থেকে এত দূর ছুটে এসেছ?
তোমাকে প্রথম দেখার পরপরই বুঝেছি ঝামেলা তোমার আগে আগে চলে, ওর দিকে ফিরে সরাষে বলল শেরিফ।
অভিযোগটা কি?।
কিন্তু মিসেস ব্রুকসের কথা শেষ হয়নি এখনও, স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ পেল লাল-চুলোর কষ্টে। আইন সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে মি. শেভার্ন, ও হয়তো বলতে পারবে বেআইনী কাজ আর বৈধ কোন কাজ অবৈধ ভাবে করার মধ্যে ঠিক কতটা পার্থক্য।
জুলিয়া ব্রুকসের দিকে ফিরল শেরিফ, অতিমাত্রায় সহিষ্ণু দেখাচ্ছে তাকে। আইনের কোন লোক যদি অসৎ উদ্দেশে ল-অফিস ব্যবহার করে, সেটা বেআইনী। কিন্তু বিপজ্জনক লোকের কাছে মার খাওয়ার চেয়ে ডেপুটিহীন কোন শেরিফ যদি নিজের বিবেকে কিছুটা সেলাই দেয়, তাহলে বেআইনী কাজটাই বদলে গিয়ে অবৈধ ভাবে করা কোন বৈধ কাজে পরিণত হয়।
আশা করি তোমরা দুজনেই বুঝেছ কি বলতে চাইছি, থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাঝবয়েসী লোকটি। ক্ষণিকের জন্যে মিসেস ঐকসকে নিরীখ করল, তারপর আনমনে মাথা নাড়ল। কেবল একটা ব্যাপার অবাক লাগছে আমার, তোমার মত স্মার্ট মহিলা কি করে বারবার একই ভুল করছে। আবারও সামান্য একজন টিনহনকে রক্ষা করার জন্যে জেদ ধরেছ। তোমার জন্যে সত্যিই লজ্জিত আমি, জুলিয়া। লাল চুল কোন উসিলা হতে পারে না-তুমি আর তোমার মা যখন ক্যাম্পাসে ছিলে, তখনও হয়নি।
মি, শেভার্ন কিন্তু ক্যাম্পাস থেকে আসেনি, দৃঢ়, প্রায় অধৈর্য স্বরে বলল মিসেস ব্রুকস। যে কোন টিনহনই ব্রিটিশ বাচনভঙ্গি নকল করতে পারে। নিজের জন্ম বা অতীত সম্পর্কে ইতোমধ্যে যথেষ্ট ও সন্তোষজনক প্রমাণ দিয়েছে মি. শেভার্ন। আরও কিছু চাইলে আমি দিতে পারি।
ব্যাপারটা বিস্মিত করল শেভার্নকে। জানত মেয়েলি মেজাজের কারণে প্রায়ই নিজেদের বিপদে ফেলে দেয় মহিলারা, যুক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না অজান্তে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়। বহুবার শুনলেও এই প্রথম ঘটতে দেখছে অদ্ভুত ঘটনাটা। কিন্তু ওর প্রতি মিসেস ব্রুকসের কোন অনুরাগ থাকলেও, তার বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটায়নি মহিলা। তারপরই ওর মনে পড়ল পিস্তলে হাত চালু এমন লোককে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের চেয়েও জরুরী কাজে ব্যবহার করার দরকার হবে বিধবা লাল-চুলোর।
হয়তো, শুকনো, চিন্তিত স্বরে বলল শেরিফ। এভাবে হয়তো ওই ফ্রেইটারকেও সন্তুষ্ট করা সম্ভব।
জুড, একটা মোম জ্বেলে কাগজ-কলম নিয়ে এসো তো। আমি নিশ্চিত একটা সাক্ষ্য লিখে দিতে আপত্তি করবে না মি. শেভার্ন, ঘুরে শেভার্নের দিকে ফিরল মিসেস ব্রুকস। যাকগে, মি. শেভার্ন, তেষট্টিতে কোথায় ছিলে তুমি?
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন। অন্ধকারে কারও চোখের দৃষ্টি পড়া কঠিন হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছি না, শেষে বলল ও।
ভাল করেই জানো কি জানতে চেয়েছে ও, সীমাহীন বিরক্তি ঝরে পড়ল শেরিফের কণ্ঠে। আঠারোশো তেষট্টি সালে কোথায় ছিলে তুমি?
ভেবে দেখতে হবে।
ভাবার জন্যে দশটা বছর পেয়েছ তুমি।
উঁহু। আমার ধারণা ছিল গত কয়েকদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে এসেছ তুমি। ভাবিনি আমি লক্ষ্ণৌতে ছিলাম নাকি কানপুরে গিয়ে রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছি তা নিয়ে কোন মাথা-ব্যথা আছে তোমার।
শুনতে ভুল হলো নাকি, কোয়ান্ট্রিল বলেছ তুমি?
কোথায়?
কোথায় নয়, কার সঙ্গে।
লক্ষ্ণৌ বা কানপুর কোথায় জানো তুমি? জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
শুনেছি, বিরস মুখে বলল শেরিফ, অসন্তোষ চেপে রাখছে না। নিশ্চই আশা করো না পৃথিবীর অন্য প্রান্তে যে যুদ্ধ হচ্ছে তার কথা জানবে সবাই? মিসৌরিতে উইলিয়াম সি. কোয়ান্ট্রিলের ভূমিকার খবর না রেখে ভারতবর্ষে কিছু ইংরেজের সাফল্যের খবর রাখব, কিভাবে আশা করো তুমি? লরেন্স বা ক্যান্সাসের কেউ কেউ হয়তো আগ্রহী হতে পারে। কিন্তু এখানে তেমন কিছু ঘটবে না। যুদ্ধের সময় তুমি অনেক ছোট ছিলে, জুলিয়া, হয়তো মায়ের কথাই ঠিকমত মনে নেই তোমার।
সারাক্ষণ একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি জুডাস ম্যাকলেন্ডন। বিশ্বাস করা কঠিন কয়েকদিন আগে এই ছেলেটিই বিদ্রোহের বশে শেভার্নের সঙ্গী হতে চেয়েছিল। বাতি জ্বালিয়ে কাগজ আর কলম নিয়ে এল জুড। ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাক্ষ্য লিখল শেভার্ন: তেষট্টির মাঝামাঝি থেকে পঁয়ষট্টি পর্যন্ত মেক্সিকোয় ছিল, যুদ্ধের ঠিক শুরুতে ক্যান্সাসে ছিল কিছুদিনের জন্যে, উইল রেনারের হয়ে কাজ করেছে মাস তিনেক।
উইল রেনার? সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল শেরিফ, কুঁচকে উঠেছে ভুরু। তার মানে কনফেডারেট তুমি?
আমি যাই ছিলাম, তাতে আর কিছু যায়-আসে না এখন।
যুদ্ধের সময় রেনার বা ওর সাঙ্গ-পাঙ্গের ভূমিকা কিন্তু ভুলে যায়নি মানুষ, ওর বেশিরভাগ লোকই কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তোমার নামে একটা পোস্টারও আছে। তাছাড়া অভিযোগ আছে রেনারকে খুন করেছ তুমি।
স্মিত হাসল শেভার্ন, কিন্তু কঠোর হয়ে গেছে মুখ। কিন্তু কোন প্রমাণ নেই।
আছে। অন্তত একজনকে সাক্ষী হিসেবে পেয়েছি আমরা।
নীরবে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন, শেরিফের উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে। ভাবছে ঠিক কতটা আগ্রাসী হতে পারে জেসন বেলহ্যাম।
বিবাদীর পক্ষে সাক্ষী আছে কি-না জানতে চাইলে না? আচমকা সহাস্যে জানতে চাইল মিসেস ব্রুকস।
বিব্ৰত দেখাল ল-ম্যানকে, ঘাড় ফিরিয়ে লাল-চুলোকে দৈখল শূন্য দৃষ্টিতে। এমন কারও কথা শুনিনি…।
যে কেউ এসে অভিযোগ করবে আর তা শুনে ছুটে আসতে পারবে তুমি, কিন্তু অন্য পক্ষেরও যে কিছু বলার থাকতে পারে, তা মানছ তো? মি. শেভার্নের হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি আমি। ক্যাম্পাসে রেনারের দুটো বাড়ি পরেই ছিল আমাদের বাড়ি। তখনকার মি. শেভার্নকে দেখেছি আমি, স্বচক্ষে কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর মুখোমুখি হতে দেখেছি ওকে। সারা শহরে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, ওরা। মি: শেভার্নের মত গুটি কয়েক দুঃসাহসী নোক রুখে দাঁড়িয়েছিল, তা যথেষ্ট ছিল না। বলেই হয়তো আজকে এই সন্দেহ, নইলে নতুন করে ক্যাম্পাসের ইতিহাস লিখতে হত।
কি মূল্য আছে তোমার কথার? উম্মার সঙ্গে জানতে চাইল জেসন বেলহ্যাম, সন্দিহান এখনও। তোমার হয়ে কাজ করছে ও, তুমি যে ওকে রক্ষা করতে চাইবে এ আর নতুন কি!
আরও দুটো পরিবারের কথা বলতে পারি তোমাকে, শেরিফ। ওদের ঠিকানা দেব তোমাকে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করতে পারো কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর হামলার সময় জিম শেভার্নের কি ভূমিকা ছিল। এরা অন্তত মিথ্যে বলবে না, কারণ এই পরিবারগুলোকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজে আহত হয়েছিল সে।
তাদের মধ্যে তুমিও একজন? বাঁকা সুরে জানতে চাইল শেরিফ।
হ্যাঁ। মি, শেভার্নের হয়তো মনে নেই, বলার মধ্যেই শেভার্নের দিকে তাকাল লাল-চুলো, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। আমার সামনেই খুন হয়ে যায় মা। দুর্ভোগ
মা সহ স্কুল থেকে ফিরছিলাম। পথে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যাই। মি. শেভার্নই বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল আমাকে, সদর দরজায় নামিয়ে দিয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে যায় ও। কোয়ান্ট্রিল বাহিনী তখন পিছু নিয়েছে ওর। তাড়া খেয়ে জনমের তরে ক্যাম্পাস ছাড়ল সে, স্মিত হাসল মহিলা। আমাদের কাউকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগও দেয়নি।
আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল শেরিফ, বুঝতে পেরেছে সুবিধে করতে পারবে না। শেভার্নের লেখা জবানবন্দিটা রোল করে পকেটে ভরল। তারপর পুরো ক্যাম্পের ওপর চোখ বুলিয়ে ত্যাগ করল। এত অল্পে সন্তুষ্ট নই আমি, জুলিয়া, অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে আরও নিরেট প্রমাণ দরকার হবে শেভার্নের। এখানে তোমার স্বার্থ দেখছে ও, সুতরাং তোমার সাক্ষ্যে কজন জুরি সন্তুষ্ট হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।
শহরে গিয়ে কাগজপত্র খুঁজতে থাকো, দেখো আমার নামেও একটা পোস্টার পাও কি-না! নিখাদ বিদ্রুপের স্বরে বলল জুলিয়া ব্রুকস, শেরিফের ওপর চরম অসন্তুষ্ট হয়েছে তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে না।
কিন্তু উইল রেনারের খুনের অভিযোগ থেকে মুক্তি মিলবে না ওর, প্রায় ঘোষণার সুরে বলল সে, পরিস্থিতি যা গড়িয়েছে তাতে মোটামুটি সন্তুষ্ট। মেজাজ নিতান্ত খারাপ না হলে গ্রেফতার এড়ানোর যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে এমন কাউকে গ্রেফতার করতে হচ্ছে না, হয়তো এজন্যেও কিছুটা প্রসন্ন বোধ করছে। উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাটের কিনারা ছুঁল শেরিফ। পরেরবার শহরে এলে দেখা হবে, প্রতিশ্রুতি দিল সে, এ নিয়ে আরও আলাপ করব আমরা, জুলিয়া। তারপর নিচু ট্রেইল ধরে এগোল ভোরের আলো ফুটতে থাকা দিগন্তের দিকে।
সামান্য একটা কম্বলের উষ্ণতা বোধহয় মিসেস ব্রুকসের আড়ষ্টতা কাটাতে যথেষ্ট হয়নি। শেভার্ন যখন ছড়িয়ে থাকা ঘোড়াগুলোকে একত্রিত করে যত্ন নিচ্ছে, ভাইয়ের সাহায্যে তখন আগুন জ্বালাল মহিলা।
একটু পর আগুনের কাছে এসে বসল শেভার্ন, নতুন একটা পরিবর্তন খেয়াল করল-শারীরিক আড়ষ্টতা সত্ত্বেও সহজ, স্বতঃস্ফুর্ত দেখাচ্ছে জুলিয়া ব্রুকসকে। সবুজ চোখে গভীর চাহনি, দশ বছর আগের সামান্য একটা ঘটনা যে শেভার্নের জন্যে এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কল্পনাও করেনি বোধহয়। শেরিফ অভিযোগ নিয়ে না এলে বোধহয় ব্যাপারটা কখনোই প্রকাশ পেত না।
সত্যিই কি তোমার নামে পোস্টার ছাড়া হয়েছে? মৃদু স্বরে নীরবতা ভাঙল মহিলা।
কফির মগে চুমুক দেয়ার সময় মাথা ঝাঁকাল ও।
মিথ্যে অভিযোগটা করেছে কে?
উইল রেনার।
বুঝেছি। তোমাকে বিপক্ষে যোগ দিতে দেখে খেপে গিয়েছিল বোধহয়। কিন্তু এতদিন পরও সামান্য এই অভিযোগটা…
সামান্য নয়, ম্যাম, বাধা দিল শেভার্ন। রেনার খুন হয়ে যাওয়ার পর কেউই সামান্য হিসেবে দেখেনি। তাছাড়া আমার অতীতও লোকজনকে সন্দিহান করার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
অতীত?
তরুণ বয়সের পাগলামি বলতে পারো। স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে একটা স্টেজ লুঠ করতে গিয়েছিলাম দুই বন্ধু। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি সত্যিই স্টেজে টাকা থাকতে পারে। পিঙ্কারটনের দুজন স্টেজ গার্ড ছিল সঙ্গে। বলে থেমে গেল। শেভার্ন, কফির মগ নামিয়ে রেখে সিগারেট রোল করতে শুরু করল।
তারপর?
একেবারে হাতে-নাতে ধরা পড়লাম। বিচারে ছয় বছরের জেল হলো।
ওহ! কত ছিল তোমার বয়েস?
ষোলো। বাড়ি ফিরে এসে টের পেলাম ছয় বছরেও পাপমোচন হয়নি, নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হলো। জেল খাটা আসামীকে সন্দেহের চোখে দেখে সবাই, অবজ্ঞা, শীতল আচরণ… বাধ্য হয়ে বেরিয়ে পড়লাম, বাউণ্ডুলের মত ঘুরছি সেই থেকে।
আনমনে মাথা নাড়ল জুলিয়া ব্রুকস। ইংল্যান্ডে গেলে কখন? মেক্সিকো থেকে পালিয়ে চলে গেলাম।
কখনও তোমাকে ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগ পাইনি আমরা, কিছুটা দ্বিধা প্রকাশ পেল জুলিয়া ব্রুকসের কণ্ঠে। এই এতদিন পর..কি হবে তাতে? বরং তোমাকে ছোট করা হবে, অথচ ক্যাম্পাসের জন্যেই তোমার জীবনে এত দুর্ভোগ নেমে এসেছে। আমি সত্যিই দুঃখিত, মি. শেভার্ন!
আজ যা করেছ সেটাই যথেষ্ট, ম্যাম, সম্ভষ্টির সঙ্গে ঘোষণা করল শেভার্ন, সিগারেট ধরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভাবছে সকাল পর্যন্ত চারপাশে খানিকটা চক্কর দিয়ে সময়টা কাটিয়ে দেবে। ক্যাম্প থেকে কিছুটা দূরে সরে এল ও, ঘোড়ার যত্ন নিল।
দিনের আলো বেড়ে গেলেও শেভার্ন খেয়াল করল মিসেস ব্রুকসের মুখের ঔজ্জ্বল্য বাড়েনি। এখনও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে যুবতীকে, যেন দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ভাবছে জুলিয়া ব্রুকস শেষ পর্যন্ত প্রায়শই রোগাক্রান্ত মহিলায় পরিণত হয়ে যায়। কি-না, কিংবা কে জানে হয়তো সময়ের আগেই সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু যতক্ষণ না নিজে মুখ খুলছে কৌতূহল নিবৃত্ত করার ইচ্ছে নেই ওর। বাকবোর্ডে উঠতে মহিলাকে সাহায্য করল ও।
রওনা দিল ওরা। মাসট্যাঙগুলো আজ ভিন্ন মেজাজে আছে, সূর্যের তেজ বেড়ে যাওয়ার আগেই যতটা সম্ভব পথ পাড়ি দিতে চাইছে যেন।
শেভার্ন জানে মোটেই সন্তুষ্ট হয়নি শেরিফ, আগে বা পরে সোডা স্প্রিং-এর ওই ফ্রেইটারের সাথে ব্যবসা চুকিয়ে ফেলতে হবে ওকে। ব্যাপারটার শ্রেয়তর দিক বিবেচনা করল। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে অন্তত একবারের জন্যে হলেও বিজয়ীর পক্ষ নিতে হবে, নইলে ম্যাকলেন্ডনদের সঙ্গেই ডুবতে হবে ওকে, এবং আরও কজন যে দাবি করবে কুখ্যাত কোয়ান্ট্রিল বাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিল। ও…
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেভার্ন। গতরাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। কিছুটা হলেও আচ্ছন্ন বোধ করছে-ঠিক তন্দ্রালু নয়, ছয় ঘোড়র ওয়্যাগন চালানোর কাজটা মনের এক অংশ ঠিকই চালিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু অন্য অংশটা নিরবিচ্ছিন্ন সুখী ভবিষ্যৎ নিয়ে কল্পনার ফানুস ওড়াচ্ছে, যেখানে প্রতি দশ বছর পর পর নতুন ভাবে জীবন শুরু করে লোকেরা: নতুন নাম, নতুন পেশা কিন্তু পুরানো দিনের কোন স্মৃতি নেই। সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিস বোধহয় এটাই: তিক্ত অতীতের অনুপস্থিতি।
নিজেকে সচকিত করল শেভার্ন। সূর্য এখন পিঠ তাতাচ্ছে, ক্লিফের দেয়ালে ঠিকরে যাচ্ছে সোনালি রোদ। ঢালের আকারে লাগাতার উঠে গেছে ট্রেইল, একেবারে দুর্গম না হলেও আয়াসসাধ্য। মেস্কিট, জুনিপার আর ক্রিয়োসোট রয়েছে প্রচুর, এবং পাহাড়ী এলাকা বলে ওগুলোর বৃদ্ধি একটু বেশিই। মাইল খানেক দূরে ফর্ক আকৃতির পাইনের চূড়া দেখা যাচ্ছে। আকার বা আকৃতিতে প্রায় একইরকম-দেখতে দারুণ লাগছে। আর কিছু না হোক, খানিকটা ছায়া পাওয়া যাবে ওখানে।
হঠাৎ করেই গতি বেড়ে গেছে ঘোড়াগুলোর, সামনে কোথাও ছায়া পাওয়া যাবে ব্যাপারটা এরাও টের পেয়েছে। যথেষ্ট গরম পড়ছে, এবং দুপুর নাগাদ আরও পড়বে; প্রায় অসহ্য বোধ হচ্ছে শেভার্নের। সোডা স্প্রিং-এ মাঝ দুপুরেও এত গরম পড়ে না, হয়তো উচ্চতার কারণেই পাহাড়ে গরম বেশি। বুক ভরে শ্বাস টানল ও, ক্ষীণ কিন্তু সজীব পাইনের সুবাস টেনে নিল সানন্দে।
ওর ভারী ওয়্যাগনের চেয়ে যথেষ্ট দূরে আছে বাকবোর্ডগুলো, ধুলো থিতিয়ে। আসার মত দূরত্বে। পাইনের ঝাড়ের কাছে যখন পৌঁছল শেভার্ন, ততক্ষণে রান্নার আয়োজন করেছে জুলিয়া ব্রুকস। ঘন পাইনের মাঝখানে ছোট্ট একটা ওঅটর হোল রয়েছে, এর আগে কেউ খুঁড়েছিল বোধহয়। চুইয়ে পানি জমা হচ্ছে সেখানে, তবে ওদের জন্যে যথেষ্ট। ঘোড়ার তেষ্টা মিটিয়ে সব ক্যান্টিন খালি করে ফেলল জুড, তারপর ভরে নিল ওঅটর হোল থেকে। চোখে প্রশ্ন নিয়ে পানির দিকে ইঙ্গিত করল শেভার্ন।
সোডা স্প্রিং-এর পানির চেয়ে ভাল, ওকে আশ্বস্ত করল ছেলেটা। আর কত দূর যেতে হবে? পনেরো মাইল।
ঘোড়ার যত্ন শেষে হার্নেস জুড়ল শেভার্ন, ব্রিড়ল ঠিকমত লেগেছে কি-না পরখ করল, তারপর সব ঘোড়ার খুর আর মুখ নিরীখ করল। লাগাতার চড়াই বেয়ে উঠতে হলেও মোটামুটি ভাল অবস্থায় আছে ঘোড়াগুলো। ঘাড় ফিরিয়ে রান্নায় ব্যস্ত মিসেস ব্রুকসের দিকে তাকাল, মহিলার ক্ষেত্রে একই কথা বলতে পারলে বোধহয় খুশি হত-কারণ আগুনের পাশে ঢুলতে শুরু করেছে লাল-চুলো। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে। শুয়ে পড়ছ না কেন তুমি? প্রস্তাব করল শেভার্ন। কর্ন পোন তৈরি হয়ে গেলে জানতে পারব আমি।
নিশ্চই পারবে, মি. শেভার্ন।
খানিকটা এগিয়ে ফ্যাকাসে, ক্লান্ত মুখটা জরিপ করল ও। আমাকে ঠিকমত চেনোও না, অথচ জেদী বাচ্চার মত আমার পক্ষে সাফাই গেয়েছ?
আগেরটা আগে সারতে দাও, মি, শেভার্ন।
স্টুয়ের পাত্র আর ডাচ আর্ডেনের দিকে তাকাল শেভার্ন, জুলিয়া ব্রুকসের নির্লিপ্ততার কারণ বোঝার চেষ্টা করছে। সব ঝামেলা বিদায় করে দেয়ার পর?
এখনই আলোচনা করা কি জরুরী?
যদি ইচ্ছে হয় তোমার। …আঘাতটা কি খুব ভোগাচ্ছে তোমাকে?
মনে হচ্ছে তুলনা করার মত অবস্থায় নেই আমি।
আগুনের দিকে তাকাল ও। আশা করছে এস্টেটে পৌঁছার পর মিসেস ব্রুকসের স্বাস্থ্য এবং মেজাজ, দুটোরই উন্নতি হবে। তবে এটা ঠিক গতকাল সকালে যাত্রা করার পর থেকে লাগাতার ধকল যাচ্ছে, তারপরও আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে মহিলাকে।
তুমি তো সৈনিক ছিলে একসময়, খেই ধরল মহিলা। কখনও গুলি লেগেছে তোমার?
কয়েকটা আঁচড় ছাড়া তেমন ভুগতে হয়নি আমাকে।
গুলি বিঁধেনি?
এক হাতে চাঁদির ক্ষতটা স্পর্শ করল শেভার্ন, নতুন চামড়া গজাচ্ছে। ইতোমধ্যে একবার ওটাকে তুলে ফেলেছে ও।
কাঁধের ক্ষত সারতে কদিন লাগে বলতে পারো?
ঝটিতি ফিরে তাকাল শেভার্ন। গুলি লেগেছে তোমার? কখন?
আমার স্বামী মারা যাওয়ার পরপরই।
ডান বগলের কাছে জায়গাটা ইঙ্গিত করল মহিলা। গুরুতর কিছু নয়, তবে আঁচড়ের চেয়ে বেশিই হবে। কিন্তু নড়াচড়া করলেই মনে হচ্ছে ক্ষতের মুখ খুলে যাবে।
ট্রেইলে বেরোনো উচিত হয়নি তোমার, অন্যমনস্ক সুরে বলল শেভার্ন। সপ্তাহ খানেক বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে। বিশদ জানার জন্যে উপযুক্ত এবং শালীন কিছু শব্দের খোঁজে শব্দের ভাণ্ডার হাতড়ে বেড়াল ও। গোল্লায় যাক দ্ৰতা!
চাইলেও তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে জড়াতে হচ্ছে আমাকে, ম্যাম। হয়তো তোমার সঙ্গে তোমার বাবার বা স্বামীর সম্পর্কটা আরও ভাল করে জানা উচিত আমার।
স্রেফ বখে যাওয়া একজন মানুষ! শীতল স্বরে বলল মহিলা। নিজের কানেই তো শুনলে, শেরিফ ওকে টিনহর্ন বলছিল।
ক্ষোভ নাকি হতাশা প্রকাশ পেল বুঝতে পারল না শেভার্ন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। পঞ্চাশ বছরে বাবা যে জ্ঞান অর্জন করেছে আমি যদি আঠারোতে তা করতাম… শ্রাগ করে থেমে গেল মিসেস ব্রুকস, ভুরু কুঁচকে উঠেছে। সন্দেহ নেই ঠিকই বলেছে শেরিফ। আমার স্বামী আর তোমার মধ্যে বলতে গেলে কোন পার্থক্য নেই।
অস্ফুট একটা শব্দ করল শেভার্ন। সত্যি, মিসেস ব্রুকস! কিন্তু আমি তো তোমাকে বড়জোর অস্ত্রের ধরন সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারব?
ওহ, ওভাবে বোঝাতে চাইনি আমি! শেরিফ তোমাকে কুখ্যাত লোক হিসেবে দেখলেও, আমার মনে হচ্ছে তোমার বর্তমান আচরণ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। স্রেফ আমার মা-র কথা মনে করছিলাম।
দুঃখিত, প্রসঙ্গটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
ক্যাম্পাসের ঘটনা তো তুমি জানোই। আমার চোখের সামনেই খুন হয়ে যায়। মা। শহরের প্রায় সবাই যেহেতু ক্রীতদাস প্রথা বিলোপ করার পক্ষে ছিল তাই নির্বিচারে সবাইকে খুন করেছে কোয়ান্ট্রিল গেরিলারা। মানুষগুলো ছিল পুরোপুরি নিরীহ, কেউ কেউ হয়তো যুদ্ধেও যোগ দিয়েছে, কিন্তু যে কোন একটা পক্ষ বেছে নেওয়ার অধিকার যেমন ছিল, নিজেকে বাঁচানোর অধিকারও ছিল তাদের, তাই না? উইল রেনারের লোক বা গেরিলারা সেই সুযোগ দেয়নি কাউকে, নির মানুষগুলোর ওপর স্রেফ টার্গেট প্র্যাকটিস করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রেও তো অলিখিত কিছু নিয়ম থাকে, নিরস্ত্র শত্রুকে খুন করে না বিবেকবান কোন মানুষ। সামান্য এই দয়াটুকুও পায়নি ওরা।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শেভার্ন।
শুনেছি যুদ্ধ যুদ্ধই, মা তাই বলত আমাকে। সাম্প্রদায়িক যে কোন আচরণই বন্ধ হওয়া উচিত, কিন্তু এটাই ছিল যুদ্ধের মূলমন্ত্র। হিংস্রতা কেবল হিংস্রতারই জন্ম দেয় যদ্দিন না একেবারে শেষে মানুষের মনে অন্যের জন্যে দয়া এবং সহানুভূতি জন্মায়।
মহিলার স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে এসবের সম্পর্ক আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলো শেভার্ন। ভাবছে স্বচক্ষে স্বামীকে মরতে দেখেছে কি-না মিসেস ব্রুকস। নিশ্চই তাই ঘটেছে, কারণ সে নিজেও একটা গুলিতে আহত হয়েছে। ট্রেইলের কোথাও ঘটেছে ঘটনাটা?
কি বললে?
কোথায় মারা গেছে তোমার স্বামী?
সোডা স্প্রিং-এ,স্টুয়ের পাত্রের দিকে মনোযোগ দিল জুলিয়া ব্রুকস।
ঘোড়ার যত্ন শেষ করে একটা কফি পটে পানি নিয়ে এসেছে জুড, আগুনে বসিয়ে দিল কেতলিটা।
আমার স্বামী মানুষটা ঠিক সুবিধের ছিল না। শেষদিকে পরস্পরের প্রতি আবেগ বা সহানুভূতি কোনটাই ছিল না আমাদের। ঝামেলা এড়াতে বাবা প্রায়ই টাকাপয়সা দিত ওকে… থেমে গেল মহিলা, দ্বিধা ফুটে উঠেছে চোখে। বাবার শক্রদের সঙ্গে প্রকাশ্যে মেলামেশা করত ও। ব্যাপারটা সত্যিই হতাশ করে আমাকে, প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে কয়েকবার খবর পাঠিয়েছিলাম ওকে, কিন্তু দেখা করা দূরে থাক, উত্তর দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি। শেষে বাধ্য হয়ে শহরে গেলাম, দেখতে চাইছিলাম বাবার দেয়া টাকা কিভাবে জুয়া খেলে নষ্ট করছে সে।
গল্পের শেষ দিকটা আঁচ করতে পারছে শেভার্ন। অনুভূতিটা সুখকর কিছু নয় ওর জন্যে। সোডা স্প্রিং-এ মাত্র একটাই জুয়ার হল আছে, বিরস মুখে বলল।
গোল্ডেন ঈগল। জোচ্চোর আর বুলি হিসেবে তখন কুখ্যাতি অর্জন করেছে আমার স্বামী। সেলুনের পেছনের দরজায় যখন পৌঁছলাম আমি, টের পেলাম কারও সঙ্গে তর্ক করছে ও। …বাধ্য হয়েই ড্র করেছ তুমি, তাই না?
স্থির দৃষ্টিতে মহিলাকে দেখছে শেভার্ন। জানতে আমার গুলিতেই আহত হয়েছ তুমি?
হ্যাঁ, মি. শেভার্ন।
এও জানতে তোমার স্বামীকে খুন করেছি আমি?
মাথা ঝাঁকাল মিসেস ব্রুকস, মুখ নির্বিকার।
কিন্তু আমার ওপর বিদ্বেষ অনুভব করছ না!
অস্ত্র নিয়ে তুমি যদি নিজের জীবন বাঁচাতে পারো, তাহলে নিশ্চই ম্যাকলেন্ডনদের পক্ষেও দাঁড়াতে পারবে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি মি. ব্রুকসের মধ্যে যা দেখতে পায়নি, তেমন কিছুই তোমার মধ্যে চোখে পড়েছে আমার বাবার।
কিন্তু সে জানত না তোমার স্বামী আমারই হাতে…
জানতে পারলে খুশিই হত।
দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল এবার। ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ করা ধাতে নেই শেভার্নের, তাছাড়া সেসব প্রকাশ করে হবেটা কি? ঘোড়া নিয়ে ব্যস্ত জুডাস ম্যাকলেন্ডনের দিকে তাকাল। আমার সঙ্গে যেতে চেয়েছে কেন ও? শেষে নীরবতা ভাঙল, ও কি জানে না আমার কারণেই বিধবা হয়েছ তুমি এবং শরীরে একটা ক্ষত নিয়ে দীর্ঘ যাত্রার ধকল পোহাচ্ছ?
সবই জানে ও, মি. শেভার্ন। ওকে সাথে না নিয়ে বেচারার পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছ তুমি।
তাহলে আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল ও!
আমার স্বামীকে পছন্দ করত জুড, একই রকম শান্ত স্বরে যোগ করল মিসেস ব্রুকস। মাঝে মধ্যেই ভাবি এই বয়সের ছেলেরা কেন যে ছন্নছাড়া বেপরোয়া লোককে পছন্দ করে!
এবং এভাবেই, সিদ্ধান্তে পৌঁছল শেভার্ন, বিজ্ঞতার খ্যাতি পেয়ে যাই আমরা। জুডাস ম্যাকলেন্ডনকে অন্ধভক্ত এক তরুণ বলে ধরে নিয়েছিল ও! স্রেফ সহজাত প্রবৃত্তির কারণে এড়াতে পেরেছিল ছেলেটাকে, নিজের অজান্তে তরুণ আর শেরিফ দুজনকেই বোকা বানিয়েছে। ছেলেটার পরিকল্পনা ও কিভাবে আঁচ করে ফেলেছে তা ভেবে নিশ্চই কূল পায়নি ওরা।
এখন?
এখন কি, মি. শেভার্ন?
জুড নিজের ইচ্ছে পূরণ করার আগেই নিজের চামড়া বাঁচাতে চলে যাওয়া উচিত নয় আমার?
তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই আর। ওকে বুঝিয়েছি আমি। তাই?
অদ্ভুত হলেও সত্যি, এক বাউণ্ডুলের ভূত মাথা থেকে সরতে না সরতেই আরেকজনের ভূত চেপে বসেছে ওর ঘাড়ে।
বলতে থাকো, ম্যাম। আমার আচরণ কি একেবারে অভব্য?
পুরোপুরি ভদ্র এবং খাঁটি ইংরেজদের মত!
জুডাস ক্যাম্পের কাছে আসতে আলাপে ছেদ পড়ল। সাপার তৈরি হয়ে গেছে। নিজের জন্যে এক বাটি স্টু আর কর্ন পোনের একটা চাক নিয়ে পাইনের সারির কাছাকাছি সরে এল শেভার্ন। খেয়াল করেছি রুটি খাও না তুমি, মি. শেভার্ন, হঠাৎ বলল লাল-চুলো। ইংল্যান্ডের সব লোকই কি কর্ন পোন খেতে পছন্দ করে?
<