বৃদ্ধ বয়সের মোড় ঘুরবার পর এখন ওই ঘটনার কথা মনে পড়লে দুজনের কেউই বিশ্বাস করতে পারতেন না যে এক সঙ্গে পঞ্চাশ বছর জীবনযাপন কালে সেটাই ছিল তাদের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা কাটাকাটি এবং একমাত্র ঘটনা যা তাদেরকে তাদের সব দায়-দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করার দোরগোড়ায়। এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এখন বৃদ্ধ ও শান্ত হবার পরও তারা ওই প্রসঙ্গ তোলার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতেন, কারণ পুরনো ক্ষত থেকে হয়তো আবার রক্তক্ষরণ শুরু হবে, যেন মাত্র গতকালই ঘটেছিল ওই আঘাত দানের ঘটনাটি।

ডাক্তার উরবিনো ছিলেন প্রথম পুরুষ মানুষ যাকে ফারমিনা ডাজা প্রস্রাব করতে শোনেন। তিনি সেটা শোনেন তাঁদের বিয়ের রাতে। তারা তখন ফ্রান্সের পথে। জাহাজের সেরা কক্ষে ফারমিনা সাগর-পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে ছিলেন। এই সময় তার স্বামীর অশ্বের মতো জল নিঃসরণের শব্দ এতো বীর্যবান ও কর্তৃত্বব্য প্রক বলে মনে হয় যে তা তাঁর আসন্ন ধ্বংসযজ্ঞের আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। বছর। গড়িয়ে যাবার সঙ্গে ওই জলপ্রবাহ দুর্বল হয়ে যায়, তবু তার স্মৃতি প্রায়ই তার কাছে ফিরে ফিরে আসতো, কারণ প্রতি ব্যবহারের সময় তার স্বামী যে কমোডের কিনারাটা ভিজিয়ে দিতেন সেটা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। ডাক্তার উরবিনো তার স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে প্রতি দিনের এই দুর্ঘটনা তার নিজের কোনো অসতর্কতার জন্য ঘটছে না, এর জৈবিক কারণ রয়েছে, একটু ইচ্ছা থাকলেই এই যুক্তি যে কেউ বুঝতে পারত, কিন্তু স্পষ্টতই ফারমিনার সে ইচ্ছা ছিল না। তরুণ বয়সে তাঁর জলপ্রবাহ এতো সুনির্দিষ্ট এবং এতো দ্ব্যর্থহীন ছিল যে স্কুলে বোতল ভর্তি করার সময় লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতায় তিনি সর্বদা বিজয়ী হতেন। কিন্তু কালের ধ্বংসাত্মক পরিণতিতে ওই জলপ্রবাহ শুধু যে হ্রাস পেয়েছে তা-ই নয়, সেটা এখন বাঁকা রূপ ধারণ করেছে, চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, একটা বিচিত্র ফোয়ারার মতো হয়ে উঠেছে, এখন বহু চেষ্টা করেও তার পক্ষে আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলতেন, যিনি টয়লেট আবিষ্কার করেছেন তিনি পুরুষ মানুষ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ডাক্তার একটা প্রাত্যহিক কাজের মাধ্যমে পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। প্রত্যেকবার ব্যবহারের পর তিনি টয়লেট পেপার দিয়ে কমোডের প্রান্তগুলি মুছে দিতেন। তাঁর স্ত্রী এটা জানতেন, কিন্তু বাথরুমে অ্যামোনিয়ার গন্ধ খুব তীব্র না হয়ে ওঠা পর্যন্ত তিনি এ সম্পর্কে কখনো কিছু বলতেন না, তবে সে রকমটা হলে তিনি যেন একটা অপরাধ আবিষ্কার করে ফেলেছেন সেই ভঙ্গিতে ঘোষণা করতেন, এহ, একেবারে খরগোশের খাঁচার মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়ে এই শারীরিক অসুবিধা ডাক্তার উরবিনোকে একটা চূড়ান্ত সমাধানে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি বসে বসে প্রস্রাব করতে লাগলেন, যেমন করতেন তার স্ত্রী এবং এর ফলে কমোড়টা পরিষ্কার থাকলো, তিনিও তাঁর সমাদরের স্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেন।

এই পর্বে পৌঁছে ডাক্তার নিজে প্রায় কিছুই করতে পারতেন না। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে মারাত্মক বিপদ ঘটানোর আশঙ্কায় তিনি স্নান করার ব্যাপারে বিশেষ সাবধান হলেন। এ বাড়িটি ছিল আধুনিক, তাই পুরনো শহরের বড় বড় বাড়িগুলিতে সিংহের থাবার মতো পা বসানো টিন ও সিসার যে রকম স্নানের টব থাকতো এখানে সে জাতীয় কিছু ছিল না। তিনি তার বাথরুম থেকে আধুনিক স্নানের টবটা স্বাস্থ্যগত কারণে সরিয়ে দিয়েছিলেন : স্নানের টব হল ইউরোপীয়দের আবিষ্কার করা আরেকটা জঘন্য জিনিস। ওরা স্নান করতো শুধু মাসের শেষ শুক্রবারে, তাও যে জলে তারা নিজেদের শরীরের ময়লা পরিষ্কার করার চেষ্টা করতো সেই ময়লা জলের মধ্যেই। তাই তিনি ঘন শক্ত কাঠের একটা বিশাল টব তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন, ফারমিনা ডাজা সেখানে তাঁর স্বামীকে স্নান করিয়ে দিতেন, যেন তিনি এক সদ্যজাত শিশু। গোলাপি-বেগুনি বন্য পাতা আর কমলার খোসা একসঙ্গে মিশিয়ে তাকে জলে ফেলে জল গরম করা হত, তারপর ফারমিনা স্বামীকে সেই জল দিয়ে স্নান করাতেন। স্নান পর্ব এক ঘণ্টার বেশি সময় নিতো। এর প্রভাব ডাক্তারের ওপর এতই স্নায়ুবিক উত্তেজনা প্রশমক ছিল যে তিনি ওই সুগন্ধযুক্ত নির্যাসের মধ্যে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়তেন। স্নান করাবার পর ফারমিনা ডাজা তাকে কাপড় পরতে সাহায্য করতেন। তিনি তার দু’পায়ের মাঝখানে ট্যালকম পাউডার ছিটিয়ে দিতেন, গায়ের ছোট ছোট ফুসকুড়ির ওপর কোকো মাখন মাখিয়ে দিতেন, এমন মমতার সঙ্গে তাঁকে তাঁর জাঙ্গিয়া পরতে সাহায্য করতেন যে মনে হত সেটা যেন একটি শিশুর ডায়াপার। তারপর তিনি একটি একটি করে তাঁকে তাঁর পুরো পোশাক পরিয়ে দিতেন, মোজা থেকে আরম্ভ করে পোখরাজের পিন দিয়ে তার টাই-র গিঁট বেঁধে দেয়া পর্যন্ত। তাদের দাম্পত্য ঊষাগুলি শান্ত হয়ে ওঠে কারণ যে শৈশব তার সন্তানরা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল তিনি আবার তার সেই শৈশবের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। ফারমিনাও, অবশেষে, তার পারিবারিক কর্মসূচি মেনে নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর ক্ষেত্রেও বছরগুলি পার হয়ে যাচ্ছিল। তাঁর ঘুম ক্রমেই কমে যায়, আর সত্তর বছর বয়সে পৌঁছে তিনি দেখলেন যে স্বামীর আগেই তিনি জেগে উঠছেন।

একজন চিকিৎসক ও ধর্মবিশ্বাসী হিসেবে ডাক্তার উরবিনের অভিজ্ঞতা ছিল প্রচুর। কিন্তু ওই পেন্টেকস্টের রবিবারে চাদর উত্তোলন করার পর জেরেমিয়া দ্য সৎ আমুরের শরীরের দিকে তাকিয়ে যা তিনি দেখলেন তা ইতোপূর্বে কখনো দেখেন নি। মৃত্যুর সঙ্গে এতো বছরের ঘনিষ্ঠতার পর, তার সঙ্গে এতো দিনের লড়াইয়ের পর, তাকে এতবার উল্টেপাল্টে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর তিনি যেন এই প্রথমবার সরাসরি মৃত্যুকে দেখলেন আর মৃত্যুও যেন তাকে দেখলো সরাসরি। না, এটা মৃত্যুভীতি নয়। বহু বছর ধরেই ওই ভয় তার মধ্যে ছিল, তার সঙ্গেই বাস করেছে ওই ভয়। এক রাতে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার পর থেকেই তার নিজের ছায়ার ওপর আরেকটা ছায়া তাঁকে সর্বদা অনুসরণ করেছে এবং তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে তার চিরদিনের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যু কোনো স্থায়ী সম্ভাবনা নয়, সেটা একটা আশু বাস্তবতা। তবে একদিন তিনি এমন একটা কিছুর শারীরিক উপস্থিতি দেখলেন যা এতদিন ধরে তার কাছে ছিল শুধু একটা কল্পিত বাস্তবতা। এতদিন তিনি জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরকে একজন সন্ত হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, যে-সন্ত তার নিজের সৌভাগ্যের কথা জানে না, কিন্তু এখন বিধাতা যে এক বিশাল বিহ্বল করা সত্যকে তাঁর সামনে উন্মোচিত করার জন্য জেরেমিয়াকে ব্যবহার করলেন তাতে তিনি আনন্দিতই হলেন। যখন জেরেমিয়ার চিঠি তার প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরলো, তার কুটিল অতীত, তার ধোকা দেবার অচিন্তনীয় ক্ষমতা, তখন তিনি অনুভব করলেন যে তার জীবনে একটা চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় কিছু ঘটে গেছে।

ফারমিনা ডাজা কিন্তু তার বিষণ্ণ মনের অবস্থা দিয়ে নিজেকে সংক্রমিত হতে দিলেন না। তিনি যখন ডাক্তারকে প্যান্ট পরতে আর তার জামার দীর্ঘ এক সারি বোতাম লাগাতে সাহায্য করতেন তখন ডাক্তার অবশ্যই সে চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি সফল হন নি, কারণ ফারমিনা ডাজার মনে দাগ কাটা সহজ ছিল না, বিশেষ করে এমন একজন মানুষের মৃত্যু দ্বারা যার জন্য তাঁর কোনো রকম চিন্তাই ছিল না। তার সম্পর্কে তিনি শুধু জানতেন যে জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর একজন পঙ্গু মানুষ, ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা করে, যাকে তিনি কখনো দেখেন নি, আন্টিলের বহু দ্বীপের মধ্যে একটি দ্বীপে সংঘটিত বহু অভ্যুত্থানের মধ্যে একটি অভ্যুত্থানের সময় যে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, যে পরে প্রয়োজনের তাগিদে একজন শিশুদের আলোকচিত্রশিল্পী হয়ে ওঠে, বস্তুতপক্ষে প্রদেশের সব চাইতে সফল আলোকচিত্রশিল্পী, আর দাবা খেলায় যে একজনকে হারিয়ে দিয়েছিল যার নাম টোরমলিনো বলে তার মনে পড়ে, যদিও আসলে তার নাম ছিল কাঁপাব্লাঙ্কা।

ডাক্তার উরবিনো বললেন, কিন্তু সে তো একটা জঘন্য অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত কেইনের এক পলাতক ব্যক্তির বেশি কিছু ছিল না। কল্পনা কর, সে মানুষের মাংস পর্যন্ত খেয়েছে। তিনি যে চিঠির গোপন তথ্যগুলি নিজের সঙ্গে তাঁর কবরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সেই চিঠিটা স্ত্রীর হাতে দিলেন কিন্তু ফারমিনা ডাজা সেটা না পড়েই ভাঁজ করা পাতাগুলি তাঁর ড্রেসিং টেবিলের একটা দেরাজে রেখে দেরাজটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। তার স্বামীর বিস্মিত হবার অগাধ ক্ষমতা এবং তার অতিরঞ্জিত মতামতসমূহ, যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই অধিকতম দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে থাকে, এ সবের সঙ্গে ফারমিনা সুপরিচিত ছিলেন। তার মনের সঙ্কীর্ণতা যার সঙ্গে তাঁর পাবলিক ইমেজ ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ তা-ও ফারমিনার জানা ছিল। কিন্তু এবার ডাক্তার যেন নিজেকেও ছাড়িয়ে গেলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে তার স্বামী জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরকে শ্রদ্ধা করতেন সে এক সময়ে যা করেছিল তার জন্য নয়, বরং শুধুমাত্র একটা ঝোলা পিঠে নিয়ে নির্বাসিত এক ব্যক্তি এখানে আসার পর যা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তার জন্য এবং এতো দিন পরে তার যথার্থ পরিচয় উদঘাটিত হবার ফলে তার স্বামী কেন এতটা বিপর্যস্ত বোধ করছেন এটা তার বোধগম্য হল না। গোপনে একজন রমণী রাখার ব্যাপারটাকে তার স্বামী কেনো এমন ঘৃণ্য বলে বিবেচনা করছেন তাও ফারমিনা বুঝতে পারলেন না, বিশেষ করে এক ধরনের মানুষ যখন এটাকে পুরুষপরাম্পরা ভাবে প্রাপ্ত একটা প্রথা বলে মনে করতো, তা ছাড়া রমণীটি যে জেরেমিয়ার মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্তে তাকে সাহায্য করেছিল সেটা তার কাছে একটা প্রেমের হৃদয় বিদারক প্রমাণ বলেই মনে হল। তিনি বললেন, তার মতো গুরুতর কারণে তুমিও যদি অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিতে তবে তার বাস্তবায়নে তোমাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য হত। অর্ধ শতাব্দি ধরে অতি সহজ সাধারণ জিনিস বুঝতে তার স্ত্রীর যে অক্ষমতা তাকে ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত করে তুলতে এখন ডাক্তার উরবিনো আরেকবার তার মুখোমুখি হলেন। তিনি বললেন, তুমি কিছু বোঝ না। সে কি ছিল বা কি করেছিল তা আমাকে ক্রুদ্ধ করছে না, সে যে এতো বছর ধরে আমাদের সঙ্গে কী প্রচণ্ড ছলনা করেছে সেটাই আমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে।

তাঁর চোখ জলে ভরে উঠতে শুরু করলো কিন্তু ফারমিনা তা না দেখার ভান করলেন।

স্বামীর কথার উত্তরে তিনি বললেন, ও ঠিক কাজটি করেছে। ও যদি সত্য কথা বলতো তাহলে তুমি অথবা ওই রমণী অথবা এই শহরের কেউই, সবাই ওকে যে রকম ভালবেসেছিল সে রকম ভালবাসতো না।

তিনি তার কোর্টের বোতামঘরের মধ্যে দিয়ে তার ঘড়ির চেইন সযত্নে ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি তার টাই-এর গিঁট আবার ঠিকঠাক করে তার পোখরাজের টাই পিনটা যথাস্থানে আটকে দিলেন। তারপর তাঁর রুমালে ফ্লোরিডা জল ছিটিয়ে ওই রুমাল দিয়ে তার চোখ ও ভেজা দাড়ি মুছিয়ে দিয়ে তিনি রুমালটি তার বুক পকেটে গুঁজে দিলেন, আর তার কোণাগুলি ম্যাগনোলিয়া ফুলের মতো করে ছড়িয়ে দিলেন। এমন সময় বাড়ির গভীর অভ্যন্তর থেকে পেণ্ডুলাম ঘড়িতে এগারটা বাজার ঘণ্টা ধ্বনি ভেসে এলো।

ফারমিনা স্বামীর বাহু জড়িয়ে ধরে বললেন, তাড়াতাড়ি করো, আমাদের দেরি হয়ে যাবে।

ডাক্তার লুসিডাস অলিভেল্লার স্ত্রী আমিস্তা দেশাম্প আর তাদের একই রকম পরিশ্রমী সাত কন্যা রজতজয়ন্তির মধ্যাহ্ন ভোজের যাবতীয় খুঁটিনাটি এমন সুচারু রূপে সম্পন্ন করেছিলেন যাতে ঘটনাটি বছরের সেরা সামাজিক ঘটনা বলে চিহ্নিত হতে পারে। তাদের পারিবারিক ভবন ছিল ঐতিহাসিক জেলার একেবারে কেন্দ্রে, প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এক ভবন, যার আসল প্রকৃতি ফ্লোরেন্সের এক স্থপতি নষ্ট করে দিয়েছিল। ওই স্থপতি একটা কু-বাতাসের মতো এখানে আসে, নবীকরণের ধ্যান ধারণা নিয়ে। সপ্তদশ শতাব্দির অনেক ধ্বংসাবশেষকে সে রূপান্তরিত করে ভেনেশীয় প্রাসাদে। ডাক্তার অলিভেল্লার শহরের ওই বাড়িতে ছিল ছটি শোবার ঘর, সুন্দর হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা রাখা একটি বড় খাবার ঘর ও একটি বড় অভ্যর্থনা কক্ষ, কিন্তু শহর থেকে এবং শহরের বাইরে থেকে আসা অতিথিদের জন্য এ জায়গাও যথেষ্ট হতো না। বাড়ির উঠানটি ছিল কোনো মঠের নির্জন প্রকোষ্ঠের মতো, তার মাঝখানে কুলকুল ধ্বনি ভোলা একটা পাথরের ফোয়ারা, হেলিওট্রোপ ফুলের টব তার চারপাশে সাজানো, গোধূলিলগ্নে সেটা বাড়িটিকে সুরভিত করে তুলতো, কিন্তু তার লতামণ্ডিত পথ ও চত্বরে এত বিপুল সংখ্যক প্রাচীন ও মর্যাদাবান পরিবারের সদস্যদের স্থান সঙ্কুলান হত না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ভোজসভা তাদের গ্রামের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হবে, মোটরে করে মহাসড়ক দিয়ে গেলে মাত্র দশ মিনিটের পথ। সেখানে আছে এক একরের বেশি জায়গা নিয়ে বিশাল উঠান, বড় বড় লরেল গাছ, আর পাশের শান্ত প্রবাহিত নদীতে অজস্র স্থানীয় জলপদ্মের সম্ভার। সিনোরা অলিভেল্লার তত্ত্বাবধানে ডন সাঙ্কোর হোটেল থেকে আসা লোকরা রৌদ্রালোকিত জায়গাগুলিতে রঙিন ক্যানভাসের চাদোয়া টানিয়ে দিয়েছে, লরেল গাছগুলির নিচে একটা বড় পাটাতনের ওপর একশো বিশজন অতিথির জন্য অনেকগুলি টেবিল সাজিয়েছে, প্রত্যেক টেবিলের ওপর লিনেনের টেবিলক্লথ বিছিয়ে দিয়েছে, আর সব চাইতে সম্মানিত টেবিলের উপর স্থাপন করেছে সেদিনের সদ্যতোলা তাজা গোলাপের গুচ্ছ। একটা কাঠের মঞ্চও তারা নির্মাণ করেছে, সেখানে ব্যান্ডের শিল্পীরা শুধু নির্ধারিত গান ও নাচের বাজনা বাজাবে। সিনোরা অলিভেল্লার সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক আজকের ভোজসভায় পৌরহিত্য করবেন। তাকে একটা সানন্দ চমক দেবার উদ্যেশ্যে সিনোরা অলিভেল্লা স্কুল অব ফাইন আর্টস থেকে চার সদস্যের একটি বিশেষ বাদক দলকে নিয়ে এসেছেন। স্বামীর ডিগ্রি লাভের বার্ষিকীর তারিখের সঙ্গে পেন্টেকস্টের রবিবারের তারিখটি না মিললেও উৎসবের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তাঁরা এই তারিখটিই বেছে নেন।

পাছে সময়াভাবে অপরিহার্য কিছু বাদ পড়ে যায় এই ভয়ে তিন মাস আগে থেকে আজকের আয়োজন শুরু করা হয়। তারা সিনেগা দ্যা ওরো থেকে জ্যান্ত মুরগি কিনে আনেন। সমগ্র উপকূল জুড়ে ওই মুরগি ছিল বিখ্যাত, শুধু তাদের আকার ও স্বাদের জন্যই নয়, আরো একটা কারণে। সেই ঔপনিবেশিক যুগ থেকে এই সব মুরগি বন্যার জল জমা মাটিতে খুঁটে খুঁটে খাবার খেয়েছে এবং মাঝে মাঝে তাদের পাকস্থলিতে খাঁটি সোনার ছোট ছোট পিণ্ড পাওয়া গেছে। তার স্বামীর উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য সিনোরা অলিভেল্লা, তার কয়েকটি মেয়ে ও পরিচারক নিয়ে, বিলাসবহুল সামুদ্রিক জাহাজে বেরিয়ে পড়েন এবং সব জায়গা থেকে সর্বোৎকৃষ্ট জিনিসগুলি সংগ্রহ করেন। তিনি পূর্বাহ্নেই সব কিছু অনুমান করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, শুধু একটা বিষয় তিনি খেয়াল করেননি, উৎসব উদযাপিত হবে এ বছর জুন মাসে, এক রবিবারে, যখন দেরিতে বর্ষা নামে। মাত্র আজ সকালে হাই ম্যাস-এ গিয়ে তিনি এই বিপদটি সম্পর্কে সচেতন হন। বাতাসের আর্দ্রতা তাঁকে শঙ্কিত করে তোলে। তিনি দেখেন যে আকাশ ভারি ও নিচু হয়ে এসেছে, সমুদ্রের দিগন্ত রেখা প্রায় দেখা যায় না। এই সব অশুভ লক্ষণ সত্ত্বেও অ্যাস্ট্রনমিক্যাল অবসার্ভেটরির পরিচালক, যার সঙ্গে গির্জাতেই তার দেখা হয়, তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে এই শহরের সমগ্র বিক্ষুব্ধ ইতিহাসে এমনকি নির্মমতম শীতের সময়েও পেন্টেকস্টের সময় কখনো বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু ঘড়িতে যখন বারটার ঘণ্টা বাজলো, অনেক অতিথি যখন বাইরের মাঠে প্রাক-লাঞ্চ হালকা সুরা পান করছিলেন তখন অকস্মাৎ একটা প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দ হল, মাটি কেঁপে উঠল থরথর করে, সমুদ্রের দিক থেকে একটা মত্ত হাওয়া এসে টেবিল-চেয়ার উল্টে দিল, চাদোয়া উড়িয়ে নিল, আর গোটা আকাশ একটা বিধ্বংসী বর্ষণ ধারায় ভেঙে পড়ল।

ঝড়ের তাণ্ডবলীলার মধ্যে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো, দেরিতে আসা আরো কয়েকজন অতিথির সঙ্গে, পথে তিনি যাদের দেখা পান, অনেক কষ্টে নিমন্ত্রণদাতার বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। তিনিও তাঁদের মতো এক পাথর খণ্ড থেকে অন্য পাথর খণ্ডে লাফ দিয়ে কর্দমাক্ত উঠান পার হতে চাইলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা হলুদ ক্যানভাসের চাদোয়ার নিচে ঢেকে ডন সাঙ্কোর লোকেরা তাঁকে বহন করে নিয়ে গেল। ওরা বাড়ির ভেতরে নতুন করে আলাদা আলাদা টেবিল স্থাপন করল, এমনকি শোবার ঘরগুলিতেও, আর অতিথিরা তাঁদের বিরক্ত মেজাজ লুকাবার কোন চেষ্টা করলেন না। ঝড়ো হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপ্টা এড়াবার জন্য বাড়ির জানালাগুলি বন্ধ করে দেয়া হয়, ফলে গোটা বাড়ি হয়ে উঠেছিল একটা জাহাজের বয়লার রুমের মতো উষ্ণ। উঠানের টেবিলগুলিতে প্রত্যেক অতিথির নামাঙ্কিত কার্ড ছিল। তদানীন্তন প্রথা অনুযায়ী একাংশ ছিল পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত, অন্য অংশ মেয়েদের জন্য। কিন্তু বাড়ির ভেতর নামাঙ্কিত কার্ডগুলি সব এলোমেলো হয়ে যায়, অতিথিরা যে যেখানে পারলেন বসে পড়লেন, আর অন্তত এই একবারের মতো আমাদের সামাজিক কুসংস্কারের আগল ভেঙে বাধ্যতামূলক ভাবে মেয়েপুরুষ একসঙ্গে বসে গেলেন। ওই জলপ্লাবনের মধ্যে আমিস্তা অলিভেল্লাকে যেন সর্বত্র একই সময়ে উপস্থিত দেখা গেল। তার চুল ভিজে চুপচুপ, তার অপূর্ব সুন্দর পোশাকটি কাদায় কাদাময়, কিন্তু এই দুর্ভাগ্যের মধ্যেও তিনি তার অপরাজেয় হাসিটি অটুট রেখেছেন, এই শিক্ষা তিনি নিয়েছিলেন তার স্বামীর কাছ থেকে, ওই হাসি দুর্ভাগ্যকে কোন ছাড় দেয় না। তার মেয়েরাও ছিল একই ধাতুতে তৈরি। তাদের সহায়তায় টেবিলের আসনগুলি সুশৃঙ্খল রাখতে তিনি সম্ভাব্য সব কিছু করলেন। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো বসলেন মাঝখানে, তার ডানপাশে বসলেন আর্চবিশপ অবডুলিও রে। ফারমিনা ডাজা বসলেন তার স্বামীর পাশে, যেমন তিনি সব সময় বসতেন, তাঁর ভয় হত পাছে তাঁর স্বামী খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়েন কিংবা জামায় স্যুপ ফেলে দেন। ডাক্তার উরবিনোর উল্টোদিকে বসেছেন ডাক্তার লুসিডাস অলিভেল্লা, প্রায় পঞ্চাশ বছরের সুরক্ষিত এক ব্যক্তি, কিছুটা মেয়েলি ধরনের, যার উৎসবমুখর ভাবভঙ্গির সঙ্গে তাঁর নির্ভুল রোগ নির্ণয় ক্ষমতার কোনো মিল ছিল না। টেবিলের অন্যান্য অংশে বসেছিলেন প্রাদেশিক সরকার ও পৌর কর্পোরেশনের অফিসাররা, আর গত বছরের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিজয়িনী সুন্দরী, যাকে পথ দেখিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসেন গভর্নর এবং নিজের পাশে বসান। যদিও এই সব আমন্ত্রণে বিশেষ পোশাক পরতে অনুরোধ করার কোনো প্রচলিত প্রথা ছিল না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণে, তবু মহিলারা পরে এসেছিলেন নৈশকালীন গাউন ও দামি অলঙ্কার, আর বেশির ভাগ ভদ্রলোক টাইসহ ডিনার জ্যাকেট, কেউ কেউ ফ্ৰককোটও। শুধু বিশেষ পরিশীলিত কয়েকজন, যাদের মধ্যে ডাক্তার উরবিনোও ছিলেন, তারা তাদের সাধারণ পোশাক পরে এসেছিলেন। প্রতিটি টেবিলে ছিল ছোট্ট সোনালি নকশা আঁকা ফরাসি ভাষায় মুদ্রিত পরিবেশিতব্য খাদ্যদ্রব্যের নাম-তালিকা।

সর্বনাশা গরমে আতঙ্কিত ও দিশেহারা সিনোরা অলিভেল্লা বাড়ির সর্বত্র ঘুরে ঘুরে ভদ্রলোকদের লাঞ্চ খাবার সময় তাঁদের কোট খুলে রাখতে বললেন। কিন্তু এ কাজে প্রথম এগিয়ে আসার সাহস কেউ দেখালেন না। আর্চবিশপ ডাক্তার উরবিনোকে বললেন যে এক দিক থেকে এ একটা ঐতিহাসিক লাঞ্চ : এই প্রথম বারের মতো দেশ স্বাধীন হবার পর যে দু’টি পরস্পরবিরোধী দল গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে দেশটিকে রক্তাক্ত করেছে তারা একসঙ্গে এক টেবিলে বসেছে, তাদের ক্ষত নিরাময় ও ক্রোধ প্রশমিত হয়েছে। এই চিন্তা উদারপন্থীদের উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মিলে গেল, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে, যারা পঁয়তাল্লিশ বছরের রক্ষণশীল আধিপত্যের পর তাদের দল থেকে এবার একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে সক্ষম হয়েছে। ডাক্তার উরবিনো অবশ্য একমত হন নি, তবে তিনি আর্চবিশপের মন্তব্যের প্রতিবাদ করতেও চান নি, যদিও আর্চবিশপকে তার বলতে ইচ্ছা হয়েছিল যে যারা এই পার্টিতে এসেছেন তারা তাদের মতবাদের ভিত্তিতে এখানে আসেন নি, তারা এসেছেন তাদের বংশ মর্যাদার ভিত্তিতে, যে ব্যাপারটি সর্বদাই রাজনীতির সঙ্কট ও যুদ্ধের ভয়াবহতার উর্ধ্বে অবস্থান করে এসেছে। তার মতে একজন উদারপন্থী রাষ্ট্রপতি হুবহু একজন রক্ষণশীল রাষ্ট্রপতির মতোই, তবে তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ অত সুন্দর নয়।

যেমন আকস্মিকভাবে বর্ষণধারা শুরু হয়েছিল তেমনি আকস্মিক ভাবেই তা একসময় ক্ষান্ত হল, আবার মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য হেসে উঠলো, কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডবে বেশ কয়েকটি গাছ শিকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়েছে। আর উপচেপড়া জলস্রোত উঠানকে একটা জলাভূমিতে পরিণত করেছে। সব চাইতে বেশি বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। রান্নাঘর। বাড়ির পেছন দিকে ইটের উপর বসিয়ে কাঠের উনুন বানানো হয়েছিল, বাবুর্চিরা কোনো রকমে তাদের হাঁড়িগুলি বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। জলভর্তি রান্নাঘরকে ঠিকঠিক করতে ও পেছনের গ্যালারিতে নতুন উনুন বসাতে তাদের অনেকটা সময় অপচয় হয়। কিন্তু দুপুর একটা নাগাদ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শুধু মিষ্টি এখনো এসে পৌঁছায় নি। সিস্টার্স অব সেইন্ট ক্লেয়ারের ওপর এটার ভার ছিল, তারা কথা দিয়েছিলেন যে বেলা এগারোটার আগেই তা এখানে পৌঁছে যাবে। এখন ভয় হল মহাসড়কের এক জায়গায় যে খাতটি আছে তা হয়তো জলমগ্ন হয়ে গেছে। আজকের চাইতে কম শীতের সময়েও ওই জায়গা ডুবে যেতো, আর সেক্ষেত্রে এখানে মিষ্টি এসে পৌঁছাতে কমপক্ষে আরো দু’ঘণ্টা লেগে যাবে।

আবহাওয়া পরিষ্কার হওয়া মাত্র ওরা ঘরের জানালাগুলি খুলে দেয়। গন্ধযুক্ত ঝড় বাইরের বাতাস পরিশুদ্ধ করে দিয়েছিল, সেই বাতাস বাড়িতে ঢুকে বাড়িটাকে শীতল করল। তখন বারান্দার বেদিতে ব্যান্ড তাদের অনুষ্ঠান শুরু করল। এবার গোলমাল আরো বেড়ে গেল। বাড়ির ভেতরের তামার পাত্রগুলি থেকে খটাং খটাং শব্দ ভেসে এলো, আর ওই শব্দ ছাপিয়ে গান শোনার জন্য প্রত্যেকে হইচই করে উঠল। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে প্রায় কান্নার অবস্থায় পৌঁছেও হাসিমুখ অক্ষুণ্ণ রেখে আমিত্তা অলিভেল্লা খাবার পরিবেশন করার নির্দেশ দিলেন।

স্কুল অব ফাইন আর্টস-এর দলটি মোৎসার্তের লা শেজ দিয়ে তাদের অনুষ্ঠান শুরু করল। প্রথম পঙক্তিগুলির সময় একটা আনুষ্ঠানিক নীরবতা বিরাজ করে। কিন্তু তারপর অনেকের উচ্চ কণ্ঠ শোনা যেতে থাকে। ডন সাঙ্কোর কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারকরা ঘন করে বসানো টেবিলগুলির মধ্যে দিয়ে গরম ভাপ ওঠা খাবার পাত্রগুলি নিয়ে কোনরকমে ঠেলেঠুলে এগিয়ে যায়, কিন্তু এতসব হট্টগোল এবং বিভ্রান্তির মধ্যেও ডাক্তার উরবিনো প্রোগ্রামটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই দিকে তার একটা চ্যানেল ঠিক খোলা রাখতে সক্ষম হন। তার বর্তমান সময়ে মনঃসংযোগের ক্ষমতা এতটাই হ্রাস পেয়েছিল যে দাবা খেলার সময় পরবর্তী কী চাল দেবার পরিকল্পনা তিনি করছেন তা তিনি কাগজে লিখে রাখতেন। তবু এখনো একটা গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ চালিয়ে যাবার পাশাপাশি একই সঙ্গে তিনি একটা কনসার্টও চমৎকার অনুসরণ করতে পারতেন। অবশ্য অস্ট্রিয়ায় বাসকালে তাঁর এক অতি বিশিষ্ট বন্ধু জনৈক জার্মান অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টরকে যে চূড়ান্ত অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী হতে তিনি দেখেছিলেন তা তিনি কখনো অর্জন করতে পারেন নি। ওই শিল্পী টানহাউসার শুনতে শুনতে ডন জিওভানির স্বরলিপি পড়তেন।

অনুষ্ঠান সূচিতে মোৎসার্তের পরে ছিল শুবার্টের মৃত্যু এবং কুমারী মেয়ে। ডাক্তার উরবিনোর মনে হল এটা ওরা বড় বেশি সহজবোধ্য নাটকীয়তার সঙ্গে বাজাচ্ছে। তিনি ঢাকনা দেয়া পাত্রগুলির ঝন ঝন শব্দের মধ্য দিয়ে কান খাড়া করে বাজনাটা শোনার চেষ্টা করলেন, এই সময় লজ্জায় গাল লাল হয়ে যাওয়া একটি তরুণের ওপর তাঁর চোখ পড়ল আর তরুণটি তখনই মাথা নেড়ে তাঁকে সম্ভাষণ জানালো। তিনি যে তাকে কোথাও দেখেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু কোথায় সেটা কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। প্রায়ই এ ব্যাপারটা ঘটছিল, বিশেষ করে মানুষের নামের ক্ষেত্রে, যাদের তিনি খুব ভালো করে চেনেন তাদের ক্ষেত্রেও, কিংবা কোনো একটা গান বা বাজনার সুরের ক্ষেত্রে এবং তখন তিনি এমন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত হতেন যে একদিন রাতে তার মনে হয়েছিল যে সকাল পর্যন্ত ওই যন্ত্রণা ভোগ করার চাইতে তার মরে যাওয়াই শ্রেয়। এই মুহূর্তে তিনি প্রায় সে-অবস্থায় উপনীত হচ্ছিলেন, এমন সময় একটা দয়াবান বিদ্যুৎ-চমক তার স্মৃতিকে আলোকিত করে দিল। গত বছর এই ছেলেটি তার ছাত্র ছিল। ওকে এখানে এই বিশেষ নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন, কিন্তু ডাক্তার অলিভেল্লা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে এ হচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পুত্র এবং এখন সে আইন সম্পর্কিত চিকিৎসাবিদ্যার অঙ্গনে একটি অভিসন্দর্ভ তৈরি করছে। ডাক্তার উরবিনো সানন্দ হাত নাড়ার মাধ্যমে তাকে সম্ভাষণ জানালেন, তরুণ ডাক্তারও উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে তার উত্তর দিলেন। কিন্তু তখনো, আসলে কখনই, তিনি উপলব্ধি করেন নি যে সেদিন সকালে জেরেমিয়া দ্য সৎ আমুরের বাড়িতে তিনি যে তরুণ প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসককে দেখেছিলেন এই তরুণ সেই ব্যক্তিই। বার্ধক্যকে আরেকবার পরাজিত করতে পেরেছেন এই সুখানুভূতি নিয়ে তিনি প্রোগ্রামের শেষ নিবেদনের তরল স্বচ্ছ গীতিময়তার মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করলেন কিন্তু সঙ্গীতটি কী তা তিনি ধরতে পারলেন না। পরে তরুণ চেল্লোবাদক, সবে মাত্র যে ফ্রান্স থেকে ফিরে এসেছে, তাঁকে জানায় যে এটা গেব্রিয়েল ফরে-র সৃষ্টি, যার নামই ডাক্তার উরবিনো শোনেন নি, যদিও ইউরোপের সঙ্গীত জগতের সর্বশেষ খবরাখবর সাধারণত তিনি ভালো ভাবেই রাখতেন। ফারমিনা ডাজা তার ওপর চোখ রাখছিলেন, যেমন সব সময় রাখতেন, কিন্তু বিশেষ করে সেই সব সময় যখন সর্বজনসমক্ষে তার মধ্যে আত্মদর্শনের প্রবণতা জেগে উঠতো। ফারমিনা নিজের খাওয়া থামিয়ে তার পার্থিব হাতটি স্বামীর হাতের ওপর আলতো ভাবে রেখে বললেন, আর ও বিষয়ে ভেবো না। ডাক্তার উরবিনো গভীর আনন্দের সুরের তীর থেকে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাস্য করলেন, আর তখনই তাঁর স্ত্রী যে বিষয় নিয়ে ভয় করছিলেন তিনি আবার সে বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। জেরোমিয়া দ্য স্যাঁৎ-আমুরের কথা তার মনে পড়লো। এই মুহূর্তে সে নানা রকম সম্মানের নিদর্শন সংবলিত তার ভুয়া সামরিক ইউনিফর্ম পরে কফিনে শুয়ে আছে, শিশুরা তাদের প্রতিকৃতি থেকে তাকে দেখছে অভিযোগভরা চোখ নিয়ে। ওর আত্মহত্যার কথা বলার জন্য ডাক্তার উরবিনো আর্চবিশপের দিকে মুখ ফেরালেন, কিন্তু আর্চবিশপ আগেই সে খবর শুনেছেন। হাই ম্যাস-এর সময় এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে, এমনকি জেনারেল জেরোমিয়া আর্গোট ক্যারিবীয় শরণার্থীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছেন, জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরকে যেন পবিত্র মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়। আর্চবিশপ বললেন, ওই অনুরোধের মধ্যেই আমার মনে হয় যথাযথ শ্রদ্ধার অভাব প্রকাশ পেয়েছে। তারপর অধিকতর সদয় কণ্ঠে তিনি জানতে চাইলেন কেউ তার আত্মহত্যার কারণ জানে কিনা। ডাক্তার উরবিনো জবাব দিলেন, বার্ধক্যভীতি। তাই ছিল সঠিক শব্দটি, কিন্তু ডাক্তার উরবিনোর মনে হল। তিনি যেন এইমাত্র তা আবিষ্কার করেছেন। ডাক্তার অলিভেল্লা তার সব চাইতে কাছে বসা অতিথিদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি তার কথা থামিয়ে তাঁর শিক্ষকের কথোপকথনে অংশ নিয়ে বললেন, এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার যে আজকাল আর প্রেমের জন্য কাউকে আত্মহত্যা করতে দেখা যায় না। প্রিয় ছাত্রের মুখে নিজের ভাবনার প্রতিধ্বনি শুনে ডাক্তার উরবিনো বিস্মিত হলেন না।

তিনি বললেন, তার ওপর আবার সোনালি সায়নাইডের সাহায্যে।

যখন তিনি এ কথা বললেন তখনই ওর চিঠি তাঁর মধ্যে যে তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল তাকে ছাপিয়ে উঠল ওর প্রতি তাঁর অনুকম্পার বোধ। এর জন্য তিনি তার স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিলেন না। তিনি ধন্যবাদ দিলেন সঙ্গীতের অলৌকিকত্বকে। এর পর তিনি আর্চবিশপকে বললেন যে সন্ধ্যাবেলায় দীর্ঘকাল, দিনের পর দিন, দাবা খেলার মধ্যে দিয়ে তিনি ওই জাগতিক সন্তকে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি শিশুদের সুখের জন্য তার নিবেদিতচিত্ততা, সকল পার্থিব বিষয়ে তার জ্ঞানের ব্যাপ্তি, তার সর্বপ্রকার বিলাসবর্জিত কঠোর জীবনযাত্রা প্রণালীর কথা আর্চবিশপকে জানালেন। জেরেমিয়া দ্য স্যাঁৎ-আমুর তার আত্মার বিশুদ্ধতা দিয়ে যেভাবে নিজের সমস্ত অতীত থেকে নিজেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে এনেছিল তাতে ডাক্তার উরবিনো নিজেই অবাক হন। তারপর তিনি তার ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলি ক্রয় করার উপকারিতার কথা মেয়রকে বললেন। একটা প্রজন্ম যারা হয়তো তাদের ওই প্রতিকৃতিগুলির বাইরে আর কোথাও কোনো সুখের সন্ধান পাবে না এবং যাদের হাতে ন্যস্ত হবে এই শহরের ভবিষ্যত তাদের ইমেজগুলি সংরক্ষিত করার জন্য এটা করা দরকার। একজন জঙ্গি শিক্ষিত ক্যাথলিককে আত্মহত্যার মতো একটি কাজকে সন্তজনিত বিবেচনা করতে দেখে আর্চবিশপ রীতিমত বিস্মিত ও লজ্জিত হলেন কিন্তু জেরেমিয়ার ছবির নেগেটিভগুলি দিয়ে একটা আর্কাইভ গড়ার প্রস্তাবে রাজি হলেন। মেয়র যখন জানতে চাইলেন কার কাছ থেকে সেগুলি কিনতে হবে তখন ব্যাপারটার গোপনীয়তায় ডাক্তার উরবিনোর জিভ যেন আগুনে পুড়ে গেল। তিনি শুধু বললেন আমি তার ব্যবস্থা করবো। মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে তিনি যে রমণীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এখন তার প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করে তিনি নিজেকে দায়মুক্ত অনুভব করলেন। ফারমিনা ডাজা ব্যাপারটা লক্ষ করলেন, তিনি নিচু গলায় স্বামীর কাছ থেকে কথা আদায় করলেন যে ডাক্তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেবেন। চিন্তামুক্ত হয়ে ডাক্তার বললেন, অবশ্যই তিনি তাতে যোগ দেবেন, না যোগদানের প্রশ্নই ওঠে না। আহারোত্তর বক্তৃতাগুলি ছিল সংক্ষিপ্ত ও সরল। ব্যান্ড একটা জনপ্রিয় সুর বাজাতে শুরু করল, অনুষ্ঠানসূচিতে যার উল্লেখ ছিল না। অতিথিরা হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। ডন সাঙ্কোর লোকেরা উঠানটা জলকাদা মুক্ত করে নাচের উপযোগী করার চেষ্টা করছিল। কয়েকজন অতিথি তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যে সব অতিথি বিশেষ সম্মানীয়দের টেবিলে বসেছিলেন শুধু তারাই বসার ঘরে অবস্থান করছিলেন। পারস্পরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জ্ঞাপনের সময় সর্বশেষ পর্বে ডাক্তার উরবিনো এক চুমুকে আধগ্লাস ব্র্যান্ডি পান করায় সবাই আনন্দ প্রকাশ করছিল। কারো মনে পড়ল না যে ইতিপূর্বে খাবার টেবিলে তিনি একই কাজ করেছিলেন, একটা বিশেষ আইটেম খাবার সময় এক চুমুকে আধগ্লাস এঁ ক্রু পান করেছিলেন। কিন্তু ওই অপরাহে তার হৃদয় তাই দাবি করেছিল তার কাছে, আর এই আত্মপ্রশ্রয়দান তাঁকে চমৎকার ভাবে পুরস্কৃত করে, আবার বহু বছর পরে, তার মধ্যে গান গাইবার ইচ্ছা জাগায়, এবং তিনি গাইতেনও, তরুণ চেল্লোবাদক জানালো যে সে তাঁর সঙ্গে বাজাবে, কিন্তু এই সময় একটা ঘটনা ঘটলো। হঠাৎ সাম্প্রতিক কালের একটা নতুন মোটরগাড়ি উঠানের কাদাভর্তি গর্তের ওপর দিয়ে সঙ্গীতের দলকে কাদাজলে সিক্ত করে, তার হর্নের শব্দে খামার-আঙিনার হাঁসগুলিকে চমকে দিয়ে, একেবারে বারান্দার সামনে এসে থামলো। আর গাড়ি থেকে নামলো ডাক্তার মার্কো অরেলিও উরবিনো ডাজা ও তার স্ত্রী, তাদের দুজনের হাতেই লেসের কাপড়ে আবৃত দুটি ট্রে। ঠিক এই রকম আরো ট্রে দেখা গেল গাড়ির ভেতরে আসনের উপর, এমনকি চালকের পাশে মেঝের উপরেও। ওগুলি ছিল বিলম্বে হাজির হওয়া মিষ্টির পাত্র। সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো, হাসি-ঠাট্টা করলো এবং এ সবের পালা শেষ হলে ডাক্তার অরেলিও উরবিনো ডাজা গম্ভীরভাবে জানলেন যে ঝড় শুরু হবার আগেই সিস্টার্স অব সেইন্ট ক্লেয়ার তাকে অনুরোধ করেছিল তিনি যেন মিষ্টির পাত্রগুলি এখানে পৌঁছে দেন, কিন্তু তাকে যখন একজন খবর দিল যে তার বাবা-মার বাড়িতে আগুন লেগেছে তখন তিনি মহাসড়ক ছেড়ে ও দিকে চলে যান। তার ছেলে কাহিনীটা শেষ করার আগেই এ কথা শুনে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো অস্থির হয়ে ওঠেন, কিন্তু তাঁর স্ত্রী তাকে মনে করিয়ে দিলেন যে তোতাপাখিটা উদ্ধারের জন্য তিনি নিজেই অগ্নিনির্বাপকদের খবর দিয়েছিলেন। যাই হোক, মিষ্টি এসে পড়ায় আমিস্তা অলিভেল্লার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। অতিথিরা ইতিমধ্যে কফি পান করে ফেললেও তিনি বারান্দার চত্বরে তাদের মিষ্টি পরিবেশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তবে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর অলঙ্নীয় দিবান্দ্রিার সময় প্রায় পার হয়ে যাচ্ছিল।

সেদিন তার দিবান্দ্রিা তিনি গ্রহণ করতে সক্ষম হন, যদিও খুব সংক্ষিপ্ত ও অস্থিরতাপূর্ণ হয় সে-নিদ্রা, কারণ বাড়িতে ফিরে তিনি দেখতে পান যে আগুন লাগলে যে ক্ষতি হত অগ্নিনির্বাপক দল তার বাগান ও বাড়িঘরের প্রায় সেই রকম ক্ষতিই সাধন করেছে। তোতাকে ভয় দেখাবার জন্য তারা তাদের শক্তিশালী নলের সাহায্যে নিক্ষিপ্ত প্রচণ্ড জলধারা দিয়ে একটা গাছকে সম্পূর্ণ নিষ্পত্র করে ফেলেছে, অনিয়ন্ত্রিত একটা জোরালো জলধারা শোবার ঘরের জানালা ফুটো করে ভেতরে ঢুকে আসবাবপত্র এবং দেয়ালে ঝোলানো নাম না জানা কতিপয় পূর্বপুরুষের প্রতিকৃতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। ওদের ট্রাকের ঘণ্টাধ্বনি শুনে সত্যিই আগুন লেগেছে ভেবে প্রতিবেশীরা সদলে সেখানে উঠে এসেছিল। রবিবারের জন্য সেদিন স্কুল বন্ধ না থাকলে গোলমালটা আরো বেশি হত। অগ্নিনির্বাপক দল যখন দেখলো যে তাদের সম্প্রসারিত মই দিয়েও পাখিটার নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না তখন তারা তাদের দা দিয়ে গাছটার শাখা-প্রশাখা কাটতে শুরু করে। সৌভাগ্যক্রমে ডাক্তার উরবিনো ওই সময়ে ফিরে না এলে তারা গাছটার শাখা-প্রশাখা একেবারে কাণ্ড পর্যন্ত কেটে ফেলতো। চলে যাবার সময় তারা বলে গেল যে গাছটা সম্পূর্ণ হেঁটে ফেলার অনুমতি পেলে তারা বিকালে পাঁচটার পর আবার আসবে। বেরিয়ে যাবার সময় তারা ভেতরের বারান্দা ও বসার ঘর কর্দমাক্ত করে দিয়ে যায়, ফারমিনা ডাজার প্রিয় তুর্কি গালিচাটাও ছিঁড়ে ফেলে। এই সবই ছিল অপ্রয়োজনীয়, কারণ সবার ধারণা সার্বিক গোলমালের মধ্যে তোতাটা প্রতিবেশীদের উঠানের ভেতর দিয়ে চম্পট দিয়েছে। ডাক্তার উরবিনো ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে তার খোঁজ করলেন, বিভিন্ন ভাষায় তাকে ডাকলেন, শিস দিলেন, গান গাইলেন, কিন্তু কোনো উত্তর মিললো না। তখন তিনি ধরে নিলেন যে ওটা উধাও হয়ে গেছে। এরপর তিনি যখন শুতে গেলেন তখন প্রায় তিনটা বাজতে চলেছে। তবে শোবার আগে ঈষদুষ্ণ অ্যাসপারাগাস দ্বারা বিশুদ্ধিকৃত তার প্রস্রাবের মধ্যে একটা গোপন উদ্যানের ঘ্রাণ গ্রহণ করে তিনি তাৎক্ষণিক আনন্দ উপভোগ করে নিলেন।

তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন একটা দুঃখের অনুভূতি নিয়ে। আজ সকালে বন্ধুর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে তার যে দুঃখ হয়েছিল এটা সে দুঃখ নয়। সম্প্রতি দুপুরের ঘুমের পর একটা অদৃশ্য মেঘ তার আত্মাকে মথিত করতো। তার মনে হতো এটা বিধাতার একটা বিজ্ঞপ্তি। তিনি এখন তাঁর জীবনের সর্বশেষ অপরাহুগুলি যাপন করছেন। তিনি এই মুহূর্তে ওই দুঃখানুভূতিতে আক্রান্ত হলেন। বয়স পঞ্চাশ হবার আগে পর্যন্ত তিনি তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির আকৃতি আর ওজন আর অবস্থা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ধীরে ধীরে তাঁর প্রাত্যহিক দিবানিদ্রার পর জেগে উঠে চোখ বন্ধ করা অবস্থায়, তিনি এক এক করে তার দেহের ভেতরের বস্তুগুলি অনুভব করতে শুরু করেন, তার অন্দ্ৰিাপীড়িত হৃৎপিণ্ড, তার রহস্যময় যকৃত, তার দুর্বোধ্য অগ্নাশয়। তিনি ইতিমধ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন যে সবচাইতে বৃদ্ধ যারা তারাও তাঁর চাইতে অল্পবয়সী এবং তাঁর প্রজন্মের রূপকথার মতো গ্রুপ প্রতিকৃতিগুলির মধ্যে একমাত্র তিনিই এখনো জীবিত আছেন। তিনি যখন প্রথম বিস্মৃতির আক্রমণগুলি অনুভব করেন তখন তিনি তার মেডিক্যাল স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে শোনা একটা কৌশলের দ্বারস্থ হন : যে-মানুষের কোনো স্মৃতি নেই সে কাগজের মধ্য থেকে তা তৈরি করে নেয়। কিন্তু এটা ছিল এক ক্ষণস্থায়ী মোহ, কারণ এক সময় তিনি এমন একটা পর্যায়ে এসে উপনীত হন যেখানে পকেটে রাখা লিখিত স্মারকগুলি কিসের স্মারক তাই তিনি ভুলে যেতেন, যে-চশমা চোখে পরে আছেন তাই খুঁজে বেড়াতেন বাড়ির সর্বত্র, দরজা তালাবন্ধ করার পরও আবার চাবি ঘোরাতেন, যা পড়ছিলেন তার মর্ম বুঝতে ব্যর্থ হতেন। কারণ প্রাথমিক সূত্রগুলি তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন, কিংবা চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক আর তার মনে থাকে নি। কিন্তু যা তাকে সব চাইতে বিচলিত করে তা হল তার নিজের যুক্তির শক্তিতে তার আস্থার অভাব, তাঁর মনে হল, অপ্রতিরোধ্য কোনো জাহাজডুবির মতো, তিনি তাঁর সুবিচারের বোধ ও শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।

নিজের অভিজ্ঞতা ব্যতীত আর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়াই ডাক্তার উরবিনো জানতেন যে অধিকাংশ মারাত্মক ব্যাধিরই আপন আপন বিশেষ গন্ধ আছে, কিন্তু কোনো গন্ধই বার্ধক্যের গন্ধের মতো অত সুনির্দিষ্ট নয়। এটা তিনি পেয়েছেন শব ব্যবচ্ছেদের টেবিলে মৃতদেহকে মাথা থেকে পায়ের বুড়ো আঙুল পর্যন্ত চিরে ফেলার সময়। যে সব রোগী খুব সাফল্যের সঙ্গে তাদের বয়স লুকিয়ে রাখে তাদের মধ্যেও তিনি ওই গন্ধ পেয়েছেন। তিনি তাঁর নিজের কাপড়ের ঘামের গন্ধে এবং অরক্ষিত মুহূর্তে তার ঘুমন্ত স্ত্রীর নিঃশ্বাসেও ওই গন্ধ পেয়েছেন। তিনি ছিলেন মৌলিকভাবেই একজন প্রাচীন ধাঁচের খ্রিস্টান, তা না হলে তিনি হয়তো জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরের সঙ্গে একমত হতেন যে বার্ধক্য একটা অশোভন অবস্থা এবং বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই তার পরিসমাপ্তি টানা উচিত। তিনি শয্যায় ছিলেন একজন ভালো ব্যক্তি, কিন্তু তার মতো একজন মানুষের জন্যও তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা ছিল তার যৌন প্রশান্তির মধ্যে, তার যৌন ক্ষুধার ধীর গতির সহৃদয় অবলুপ্তির মধ্যে। একাশি বছরে পৌঁছে তার এই বোধটুকু খুব স্বচ্ছ ছিল যে এই জগতের সঙ্গে তিনি বাধা রয়েছেন কয়েকটি সরু সুতা দিয়ে এবং ঘুমের মধ্যে অবস্থানের সামান্য একটু পরিবর্তনের ফলেই সেই সুতা ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এবং এখন সেই সুতাগুলি অক্ষত রাখতে তিনি যদি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তার কারণ মৃত্যুর অন্ধকারের মধ্যে ঈশ্বরকে না খুঁজে পাবার ভয়। ফারমিনা ডাজা এ সময় ব্যস্ত ছিলেন অগ্নিনির্বাপক দল কর্তৃক বিধ্বস্ত শোবার ঘরটি ঠিকঠাক করার কাজে। চারটা বাজার একটু আগে তিনি তার স্বামীর প্রাত্যহিক পানীয় বরফকুচি দেয়া এক গ্লাস লেমোনেড নিয়ে আসতে বললেন, তারপর স্বামীকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য পোশাক পরে নিতে বললেন। ওই অপরাহ্নে ডাক্তার উরবিনোর হাতে ছিল দুটি বই; অ্যালেক্সিস কারেল রচিত অজানা মানুষ এবং এক্সেল মুন্থ রচিত সান মিশেলের কাহিনী। দ্বিতীয় বইটির পৃষ্ঠা এখনো কাটা হয় নি, তিনি পাচিকা ডিনা পার্ডোকে শোবার ঘর থেকে তার মার্বেলের কাগজ কাটা ছুরিটা নিয়ে আসতে বললেন, তিনি ওটা ওখানে ফেলে রেখে এসেছেন। ছুরিটা যখন আনা হল। ততক্ষণে তিনি অজানা মানুষ-এর যে জায়গায় একটা খাম দিয়ে চিহ্ন দেয়া ছিল সেখান থেকে পড়তে শুরু করে দিয়েছিলেন, শেষ হবার মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা বাকি আছে। তিনি ধীরে ধীরে পড়ছিলেন, ঈষৎ মাথা ধরেছে, খাবার সময় শেষ পর্বে যে আধগ্লাস ব্র্যান্ডি পান করেছিলেন তাকেই মাথা ধরার কারণ হিসেবে মনে মনে চিহ্নিত করলেন। পড়ার মধ্যে থেমে থেমে লেমোনডের গ্লাসে চুমুক দিলেন, সময় নিয়ে বরফের টুকরা চুষলেন। পায়ে মোজা পরে আছেন, গায়ের জামা মাড় দেয়া কলারবিহীন, সবুজ ডোরাকাটা ইলাসটিক সাসপেন্ডারটা কোমর থেকে ঝুলছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য পোশাক বদলাবার কথা ভাবতেই তার বিরক্তি বোধ হল। একটু পরেই তিনি পড়া বন্ধ করলেন, তারপর তার বেতের দোল-চেয়ারে খুব আস্তে আস্তে দুলতে শুরু করলেন। তিনি ব্যথিত চিত্তে সামনের উঠানের কলা গাছগুলি দেখলেন, পত্রপল্লব মুড়ানো আম গাছটি দেখলেন, বৃষ্টির পর উড়ে বেড়ানো উইপোকার ঝাক দেখলেন, আরেকটি অপরাহের স্বল্পস্থায়ী ঐশ্বর্য দেখলেন যা আর কখনো ফিরে আসবে না। তিনি যে কখনো পারামারিবো থেকে আনা একটি তোতাপাখির মালিক ছিলেন যাকে তিনি একজন মানুষের মতই ভালবাসতেন সে কথা তিনি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন। আর ঠিক তখনই তিনি পাখিটির কণ্ঠস্বর শুনলেন : রাজকীয় তোতা মনে হল খুব কাছে। থেকে কথাটা বলল, তার একেবারে পাশ থেকে, আর তখনই তিনি তাকে আম গাছটার সব চাইতে নিচু ডালটিতে বসে থাকতে দেখলেন।

বদমাশ কোথাকার! ডাক্তার উরবিনো চেঁচিয়ে উঠলেন।

তোতাটাও একেবারে একই গলায় উত্তর দিল, আপনি আমার চাইতেও বড় বদমাশ, ডাক্তার।

তাকে দৃষ্টির আওতায় রেখে তিনি তার সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন, খুব সতর্কতার সঙ্গে তার জুতা পরলেন যেন পাখিটা ভয় না পায়, তার সাসপেন্ডার বাহুর উপরে টেনে তুললেন, তারপর উঠানে নেমে গেলেন। উঠান তখনো কাদাময়। তিনি তাঁর লাঠি দিয়ে মাটি পরীক্ষা করতে করতে এগিয়ে গেলেন, বারান্দার সিঁড়ির তিনটি ধাপে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে না যান সেদিকে খেয়াল রাখলেন। তোতাটা নড়লো না। সে মাটির এতো কাছে বসেছিল যে ডাক্তার উরবিনো তার দিকে নিজের বেড়াবার লাঠিটা বাড়িয়ে দিলেন, সে যেন তার রুপার হাতলের ওপর বসতে পারে, প্রায়ই সে এ রকম বসতো, কিন্তু এবার পাখিটা এক পাশে সরে গিয়ে পার্শ্ববর্তী মাচায় বসলো, আরেকটু উঁচুতে, কিন্তু গাছের পাশে রাখা বাড়ির মইটার সাহায্যে তার কাছে যাওয়া ছিল এখন আগের চাইতে সহজ। আগুন নির্বাপকরা এসে পৌঁছার আগেই মইটা ওখানে এনে রাখা হয়েছিল। ডাক্তার উরবিনো উচ্চতাটা হিসাব করলেন, মইটার দুটি ধাপ উঠলেই তিনি পাখিটাকে ধরতে পারবেন। তিনি একটা মিষ্টি বন্ধুত্বপূর্ণ গান গাইতে গাইতে প্রথম ধাপটা উঠলেন, বদমেজাজি পাখিটার মন অন্য দিকে ফেরাতে চেষ্টা করলেন, আর পাখিটা তখন সুর বাদ দিয়ে গানের কথাগুলি অবিকল পুনরাবৃত্তি করল, কিন্তু ভীত বা লজ্জাকাতর ভঙ্গিতে গাছের ডালটার আরো একটু উপরে সরে গেল। ডাক্তার উরবিনো বিশেষ কোনো অসুবিধা ছাড়াই এবার দ্বিতীয় ধাপে উঠলেন, মইটা তিনি ধরেছিলেন তার দু’হাত দিয়ে, আর পাখিটা যেখানে ছিল সেখানে বসেই আবার গোটা গানটার কথাগুলি বলে যেতে লাগল। ডাক্তার এবার তৃতীয় ধাপে উঠলেন, তারপর চতুর্থ ধাপে, তিনি শাখাটার উচ্চতার হিসাবে একটু ভুল করেছিলেন, এরপর তিনি বাঁ হাতে মইটা ধরে তার ডান হাত দিয়ে পাখিটকে পাকড়াও করতে চেষ্টা করবেন। পুরনো পরিচারিকা ডিনা পার্ডো তাঁকে মনে করিয়ে দিতে আসছিল যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যাবার জন্য তাঁর দেরি হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সে মই-এর ওপর দাঁড়ানো একটা মানুষের পিঠ দেখতে পেলো, সবুজ ডোরাকাটা ইলাসটিক সাসপেন্ডারটা না দেখলে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতো না যে মানুষটা আর কেউ নয় স্বয়ং ডাক্তার উরবিনো।

সে চিৎকার করে উঠলো হা, ভগবান, আপনি তো মারা পড়বেন।

একটা বিজয়ীর নিঃশ্বাস ফেলে ডাক্তার উরবিনো তোতার টুটি চেপে ধরলেন। কিন্তু পর মুহূর্তেই তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। কারণ মইটা তার পায়ের নিচ থেকে পিছলে সরে যায়। এক মুহূর্তের জন্য তিনি শূন্যে হাওয়ায় ভেসে রইলেন। আর তিনি উপলব্ধি করলেন যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন না করে, কোনো কিছুর জন্য অনুতাপ করার আগেই, কারো কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই এই পেন্টেকস্টের রবিবারে চারটা বেজে সাত মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করতে চলেছেন।

ফারমিনা ডাজা এই সময় রাতের খাবারের স্যুপটা ঠিক হয়েছে কিনা চেখে দেখছিলেন। হঠাৎ তার কানে এলো ডনা পার্ডোর আতঙ্কিত চিৎকার, দাস-দাসীদের হট্টগোল, সমস্ত পাড়ার হইচই এর শব্দ। হাতের চামচটা মাটিতে ফেলে দিয়ে বয়সের অপ্রতিরোধ্য ওজন সত্ত্বেও তিনি প্রাণপণে ছুটে যাবার চেষ্টা করলেন, চেঁচাতে লাগলেন উন্মাদিনীর মতো, যদিও আম গাছের নিচে কী ঘটেছে তা তিনি তখনো জানেন না। যখন তিনি দেখলেন যে তার মানুষটা কাদার মধ্যে চিৎ হয়ে পড়ে আছে তখন তার বুকের খাঁচার ভেতর তার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। তিনি দেখলেন যে তাঁর স্বামী এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন, কিন্তু মৃত্যুর শেষ আঘাত তিনি প্রাণপণে প্রতিহত করে চলেছেন যেন ফারমিনা তার কাছে পৌঁছাবার সময় পায়। চারপাশের হট্টগোল সত্ত্বেও, ফারমিনাকে ছাড়া মরতে হচ্ছে এই অপুনরাবৃত্তনীয় বেদনার অশ্রুজলের মধ্য দিয়ে, তিনি তাকে চিনতে পারলেন। তিনি তার দিকে শেষবারের মতো তাকালেন এবং এই শেষ বারে তার দুটি চোখ এমন উজ্জ্বল, এমন বেদনার্ত, এমন সকৃতজ্ঞ দেখলো যা ফারমিনা তাদের অর্ধশতাব্দির মিলিত জীবনে আগে কখনো দেখেন নি। ডাক্তার উরবিনো তাঁর শেষ নিঃশ্বাসটুকু দিয়ে কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন, তোমাকে আমি কতটা ভালবেসেছি একমাত্র ঈশ্বর তা জানেন।

স্মরণীয় মৃত্যু ছিল এটা, এবং অকারণে নয়। ফ্রান্সে উচ্চতর বিশেষ পড়াশোনা শেষ করার পর এই প্রদেশের শেষ কলেরা মহামারীর দুর্যোগ প্রতিরোধে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো যে নতুন চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেন তা তাকে সমগ্র দেশে খ্যাতিমান করে তুলেছিল। এর আগের মহামারীতে তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে শহরের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ প্রাণ হারিয়েছিল। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ছিলেন তাঁর পিতা, যিনি নিজেও একজন শ্রদ্ধাভাজন চিকিৎসক ছিলেন। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো তার তাৎক্ষণিক মর্যাদা এবং উত্তরাধিকর সূত্রে প্রাপ্ত অর্থের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অনুদান দিয়ে মেডিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ক্যারিবীয় প্রদেশগুলিতে এটাই ছিল প্রথম এবং বহু বছরের জন্য একমাত্র মেডিক্যাল সোসাইটি, যার আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। তিনিই এখানে জল সরবরাহের প্রথম কৃত্রিম প্রণালী, প্রথম পয়ঃনিষ্কাশন। ব্যবস্থা এবং আচ্ছাদিত সর্বজনীন বাজারের প্রচলন করেন, যার ফলে লাস অ্যানিমাস উপসাগর দিয়ে ময়লা আবর্জনা বাইরে বেরিয়ে যাবার সুযোগ পায়। তিনি ভাষা একাডেমি ও ইতিহাস একাডেমিরও সভাপতি ছিলেন। চার্চকে প্রদত্ত তাঁর সেবার জন্য জেরুজালেমের ল্যাটিন প্যাট্রিয়ার্ক তাঁকে নাইট অব দি অর্ডার অব দি হোলি সিপালকার সম্মানে ভূষিত করেন এবং ফরাসি সরকার তাঁকে প্রদান করেন লিজিয়ন অব অনারের কমান্ডারের পদমর্যাদা। তিনি শহরের প্রতিটি ধর্মীয় ও নাগরিক সমিতিকে উৎসাহিত করতেন। রাজনীতিতে উৎসাহবর্জিত শহরের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি দেশপ্রেমী সংস্থা নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সংস্থাটি সরকার ও স্থানীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে তৎকালীন পরিবেশের তুলনায় বেশ দুঃসাহসিক প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করত। ডাক্তার উরবিনো ওই সংস্থার কর্মকাণ্ডে বিশেষ উৎসাহ দিতেন। এই সব কাজের মধ্যে সব চাইতে স্মরণীয় ছিল বায়ু নিয়ন্ত্রিত বেলুনের পরীক্ষামূলক উডডয়ন। বিমান-ডাকের কোনো রকম যৌক্তিক সম্ভাবনার কথা কেউ ভাবার বহু আগে এই বেলুনের উদ্বোধনী উড্ডয়নের সময় এর মাধ্যমে সান হুয়ান ডি লা সিনেগাতে একটি পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল। শিল্পকলা কেন্দ্রের ধারণাও তার মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ওই কেন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুল অব ফাইন আটর্স যে ভবনে শুরু হয়েছিল আজও সেখানেই আছে। প্রতি এপ্রিলে যে কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বহু বছর ধরে তিনি তারও একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

যে কাজটি অন্তত বিগত একশ’ বছর ধরে সবাই অসম্ভব ভেবে এসেছিল তাও তিনি সম্ভব করে তুলেছিলেন; তা হল ড্রামাটিক থিয়েটারের পুনর্নির্মাণ। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ওই ভবনটি মুরগি-ঘর ও খেলুড়ে রাতা-মোরগের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তাকে এবার নাট্যশালায় রূপান্তরিত করার জন্য একটা বিরাট জমকালো নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। ওই আন্দোলনে শহরের প্রতিটি সংস্থা যুক্ত হয়, যার সার্থক পরিণতিতে ড্রামাটিক থিয়েটারটি নতুন রূপে পুনর্নির্মিত হয়, যদিও অনেকে মনে করেন যে এত বড় আন্দোলন যোগ্যতর কোনো লক্ষ্য অর্জনে পরিচালিত হলে ভালো হত। যাই হোক, নাট্যশালার উদ্বোধন হল, যদিও তখনো আসন অথবা আলোর সব ব্যবস্থা হয় নি, দর্শক-শ্রোতুকুলকে নিজেদের চেয়ার ও আলো নিয়ে আসতে হত বিরতির সময়ের জন্য। ইউরোপের বড় বড় অনুষ্ঠানে যে প্রথা ছিল এখানেও তা প্রচলিত হল। ক্যারিবীয় গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যেও মহিলারা তাদের দীর্ঘ পোশাক ও পশমের কোট পরলেন। কোনো কোনো অনুষ্ঠানমালা এত দীর্ঘ ছিল যে শেষ হতে হতে সকালের প্রার্থনার সময় হয়ে যেতো। ওই দীর্ঘ সময় টিকে থাকার জন্য ভৃত্যকুলকে তাদের প্রভুদের জন্য চেয়ার, আলো, খাবার দাবার ইত্যাদি নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে হয়। মরশুম শুরু হয়েছিল একটা ফরাসি অপেরা কোম্পানি দিয়ে। তাদের নতুনত্ব ছিল অর্কেস্ট্রা দলে বীণার ব্যবহার, আর তাদের অবিস্মরণীয় বিজয় গৌরব ছিল অপূর্ব কণ্ঠস্বর ও নাটকীয় প্রতিভার অধিকারী এক তুর্কি গায়িকা, যে খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে গান গাইতো আর যার পায়ের আঙুলে ছিল মূল্যবান পাথরখচিত কয়েকটা আংটি। তবে প্রেক্ষাগৃহ তেলের প্রদীপের ধোয়ায় এতই আচ্ছন্ন হয়ে যায় যে প্রথম অঙ্কের পরই মঞ্চ প্রায় দেখা যাচ্ছিল না, আর শিল্পীদের কণ্ঠও প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে, অবশ্য সাংবাদিকরা এসব ছোটখাটো ত্রুটির কথা তাদের প্রতিবেদন থেকে বাদ দিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার গৌরবগাথাই বাড়িয়ে লেখেন। নিঃসন্দেহে ডাক্তার উরবিনোর সাহসী উদ্যোগগুলির মধ্যে এটাই সবচাইতে বেশি সংক্রামক হয়ে ওঠে। শহরের সব চাইতে বিস্ময়কর অঙ্গনও এই সংক্রমণের শিকার হয় এবং ইসোল্ড আর ওটেলো আর আইডা আর সিগফ্রিডের একটা গোটা প্রজন্ম গজিয়ে ওঠে। কিন্তু ব্যাপারটা ডাক্তার উরবিনো-প্রত্যাশিত চরম পর্যায়ে গিয়ে কখনো পৌঁছায় নি। তিনি চেয়েছিলেন যে ইতালিপন্থী আর ওয়াগনারীয়রা বিরতির সময় লাঠি আর ছড়ি নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হবে, কিন্তু তেমনটা ঘটেনি।

ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো, প্রায়ই এবং শর্তহীন ভাবে, নানা সরকারি পদ গ্রহণের জন্য অনুরুদ্ধ হন, কিন্তু যে সব চিকিৎসক তাদের পেশাগত মর্যাদা ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা ললাটে তিনি ছিলেন তাদের নির্মম সমালোচক। তিনি যদিও সর্বদাই একজন উদারপন্থী বলে বিবেচিতে হতেন এবং পার্টি-প্রার্থীকেই ভোট দিতে অভ্যস্ত ছিলেন তবু সেটা ছিল বিশ্বাসের চাইতেও বেশি একটা ঐতিহাসিক প্রশ্ন। সম্ভবত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারগুলির মধ্যে তিনিই ছিলেন শেষ সদস্য যিনি আর্চবিশপের বাড়ি যাবার সময় রাস্তার উপরেই হাঁটু গেড়ে বসতেন। তিনি নিজেকে বর্ণনা করতেন একজন স্বভাবসিদ্ধ শান্তিবাদী বলে, জাতির মঙ্গলের স্বার্থে উদারপন্থী ও রক্ষণশীলদের পুনর্মিলনের পক্ষে এক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি রূপে। কিন্তু জনসমক্ষে তাঁর আচরণ ছিল এতই স্বাধীন ও স্বয়ম্ভর যে কোনো গোষ্ঠীই তাঁকে তাদের সভ্য বলে দাবি করতো না। উদারপন্থীরা তাকে মনে করতো একজন প্রাচীন যুগের গুহাবাসী, রক্ষণশীলরা ভাবতে তিনি প্রায় একজন মেসন সম্প্রদায়ের সদস্য, আর মেসনরা তাঁকে পবিত্র ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানের একজন গোপন স্বার্থরক্ষাকারী বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার কম কঠোর সমালোচকদের মূল্যায়নে তিনি ছিলেন শুধু একজন অভিজাত, জাতি যখন অন্তহীন গৃহযুদ্ধের রক্তক্ষরণে মরতে চলেছে তখন তিনি কবিতা উৎসবের আনন্দে মুগ্ধ ও আত্মহারা।

তাঁর মাত্র দুটি কাজ ছিল এই প্রতিচ্ছবির সঙ্গে সঙ্গতিহীন। একশ’ বছরেরও বেশি কাল ধরে তাদের পারিবারিক বাসভবন ছিল মারকুইস ডি কাসালডুয়েরার ভূতপূর্ব প্রাসাদ। ডাক্তার উরবিনো সেটা ত্যাগ করে নব্য ধনীদের পাড়ায় একটা নতুন বাড়িতে উঠে যান। দ্বিতীয় কাজটি ছিল বংশ গৌরব বা বিরাট ধন ঐশ্বর্য বিহীন নিম্নতর শ্রেণীর একটি সুন্দরী রমণীকে বিয়ে করা। ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক নামের দীর্ঘ পুচ্ছবিশিষ্ট মহিলারা আড়ালে এটা নিয়ে ঠাট্টা করতেন, কিন্তু এক সময় তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে ওই রমণী স্বাতন্ত্র ও চরিত্রের গুণে তাদের সবাইকে নিপ্ৰভ করে দিয়েছে। ডাক্তার উরবিনো এই সব এবং জনসাধারণের মধ্যে তাঁর ইমেজের অন্যান্য ফাঁক-ফাটল সম্পর্কে সুঅবিহিত ছিলেন। তিনি যে একটি প্রাচীন পারিবারিক নামের শেষ সদস্য, তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই যে ওই নামটি অবলুপ্ত হতে যাচ্ছে এ সম্পর্কে তার চাইতে বেশি সচেতন আর কেউ ছিল না। তার ছেলে, মার্কো অরেলিও, পঞ্চাশ বছর বয়স, তার মতোই এক ডাক্তার, সকল প্রজন্মের পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রদের মতই উল্লেখযোগ্য কিছুই সে করে নি, এমনকি একটি সন্তানেরও জন্ম দেয়নি। ডাক্তার উরবিনের একমাত্র কন্যা, ওফেলিয়া, নিউ অর্লিয়ান্সের এক নিরেট ব্যাংক কর্মচারীকে বিয়ে করেছে এবং চরম পরিণতিতে পৌঁছেছে তিনটি কন্যার জন্ম দিয়ে, কিন্তু একটি পুত্র সন্তানেরও নয়। ইতিহাসের জোয়ারে তার রক্তপ্রবাহ আর বইবে না এ চিন্তা তাকে কষ্ট দিলেও নিজের মৃত্যু বিষয়ে তাকে যে ভাবনা সব চাইতে বিচলিত করতো তা হল তাকে ছাড়া ফারমিনা ডাজা নিঃসঙ্গ একা জীবন কিভাবে যাপন করবে সে-ভাবনা।

যাই হোক, এই ট্র্যাজেডি শুধু তার বাড়িতেই আলোড়ন তোলে নি, সাধারণ মানুষকেও তা আলোড়িত করে। একটা কিছু দেখার আশায় তারা রাস্তায় ভিড় জমায়। তিনদিনের শোক পালনের কথা ঘোষিত হয়, সকল সরকারি ভবনে পতাকা রাখা হয় অর্ধনমিত, আর গির্জাগুলিতে বিরতিহীন ভাবে ঘণ্টা বাজতে থাকে এবং ওদের পারিবারিক সমাধিস্থলের ভূগর্ভস্থ কক্ষ সিলমোহর না করে দেয়া পর্যন্ত ওই ঘণ্টাধ্বনি অব্যাহত থাকে। স্কুল অব ফাইন আর্টস-এর একটি দল একটা মৃত্যুমুখোশ বানায়, পরিকল্পনা ছিল যে পরে একটা প্রমাণ সাইজ আবক্ষ মূর্তির জন্য এটা ছাঁচ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই পরিকল্পনা বর্জিত হয়, কারণ শেষ মুহূর্তে যে আতঙ্কের চিহ্ন ডাক্তারের মুখে ফুটে উঠেছিল তার বিশ্বস্ত বাস্তববাদী প্রতিফলন খুব শোভন হবে বলে বিবেচিত হয় নি। জনৈক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এই সময়ে ইউরোপ যাবার পথে এখানে থেমেছিলেন, তিনি করুণ রসসিক্ত বাস্তবধর্মী একটি বিশালাকার ক্যানভাস আঁকেন, সেখানে নিয়তির মারাত্মক মুহূর্তে মই-এর ওপর ডাক্তার উরবিনো চিত্রিত হয়েছেন, তোতা পাখিটিকে বন্দি করার জন্য তিনি তখন সবেমাত্র তার হাত প্রসারিত করেছেন। এই ছবিতে যা কাহিনীটির নির্ভেজাল সূত্রকে অস্বীকার করে তা এই যে ডাক্তারের পরনে তাঁর কলারবিহীন শার্ট ও সবুজ ডোরাকাটা সাসপেন্ডারের পরিবর্তে দেখানো হয় মাথায় বাউলার হ্যাট ও গায়ে কালো ফ্ৰককোট, যা বহু আগের কলেরা মহামারীর সময়ের একটি প্রাচীন পদ্ধতিতে মুদ্রিত ছবি থেকে নকল করা হয়। সবাইকে ছবিটি দেখার সুযোগ দানের উদ্দেশ্যে ট্র্যাজেডিটি সংঘটিত হবার পরবর্তী কয়েক মাস তা দি গোল্ডেন ওয়াইর-এর বিশাল গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়। তখন শহরের সকল মানুষ তার সামনে দিয়ে এক এক করে শ্রদ্ধাভরে হেঁটে যায়। তারপর যে সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কীর্তিমান পৃষ্ঠপোষকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো সঙ্গত বলে মনে করে তাদের দেয়ালেও ছবিটি প্রদর্শিত হয়। এবং সব শেষে একটি দ্বিতীয় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পর সেটা স্কুল অব ফাইন আর্টস-এ টানিয়ে রাখা হয়, বহু বছর পর যা চিত্রকলার ছাত্ররা সেখান থেকে টেনে নামিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা চত্বরে পুড়িয়ে ফেলে, কারণ তারা তাকে দেখে ঘৃণ্য কলাকৈবল্যবাদ ও একটি বিশেষ সময়ের প্রতীক রূপে।

ফারমিনা ডাজার বৈধব্যের প্রথম মুহূর্ত থেকেই একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বামী তার অসহায়ত্ত নিয়ে যে ভয় করেছিলেন তা ছিল অমূলক। কোনো বা কারো স্বার্থসিদ্ধির জন্যই স্বামীর মৃতদেহকে ব্যবহৃত না হতে দেবার সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অটল। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে যখন শ্রদ্ধাজ্ঞাপক তারবার্তা এলো যে তার স্বামীর মরদেহ প্রাদেশিক সরকারের অ্যাসেমব্লি চ্যাম্বারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কিছু সময়ের জন্য রাখা হবে, জনগণের শ্রদ্ধা জানানোর সুবিধার্থে, তখনও তিনি তাতে সম্মতি দেন। নি। আর্চবিশপ নিজে যখন অনুরোধ করলেন যে ডাক্তার উরবিনোর মৃতদেহ এক রাতের জন্য ক্যাথিড্রালে থাকুক, ধর্মীয় মর্যাদায় তা সেখানে প্রহরা দিয়ে রাখা হবে, শান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সে অনুরোধও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি শুধু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রাথর্নার সময় তার স্বামীর মরদেহ ওখানে রাখতে সম্মত হন। তার পুত্র এত জায়গা থেকে এত বিভিন্ন ধরনের অনুরোধ আসতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়। সে যখন আর্চবিশপের অনুরোধ রক্ষার জন্য মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসে তখনও ফারমিনা ডাজা তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন নি। তিনি তার গ্রামীণ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন যে মৃতদেহ একমাত্র পরিবারের ধন, রাত জেগে ধর্মীয় প্রহরা দেয়ার কাজ বাড়িতেই পালিত হবে, পাহাড়ি কফি আর ভাজা পিঠা খেতে খেতে যার ইচ্ছা হবে সে এবং তার যেভাবে খুশি সেভাবে সে ডাক্তারের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতে পারবে। ঐতিহ্যানুসারে নয় রাত ধরে জেগে থেকে বিলাপের যে প্রথা তা পালিত হবে না। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পরে বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্তরঙ্গ বন্ধুবৃন্দ ছাড়া আর কারো জন্য সে দরজা খোলা হল না।

মৃত্যুর শাসনাধীনে বাড়িটি চলতে থাকে। প্রতিটি মূল্যবান সামগ্রী সুরক্ষার জন্য তালাবন্ধ করে রাখা হল। দেয়ালে দেয়ালে দেখা গেল সেখানে ইতিপূর্বে ঝোলানো ছবিগুলির চিহ্নরেখা, ছবিগুলি সব নামিয়ে ফেলা হয়েছে। বাড়ির এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করে আনা চেয়ারগুলি বসার ঘর থেকে শোবার ঘর পর্যন্ত দেয়ালের পাশে সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শূন্য জায়গাগুলি মনে হল বিশাল, আর বড় আসবাবগুলি একপাশে সরিয়ে রাখার ফলে সৃষ্ট শূন্যতার মধ্যে লোকজনের কণ্ঠস্বরে একটা অপার্থিব অনুরণন শোনা গেল। শুধু কনসার্ট পিয়ানোটি ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে রইল, একটা সাদা চাঁদরে আবৃত। পাঠাগারের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। নিজের বাবার বড় টেবিলের ওপর কোনো শবাধার ছাড়া শুইয়ে রাখা হল তাঁকে, যিনি একদা ছিলেন জুভেনাল উরবিনো দ্য লা কাল, শেষ চূড়ান্ত ভীতির রেখা যার মুখাবয়বে এখন প্রস্তরীভূত হয়ে আছে, তার পরনে আস্তিনহীন ঢোলা কালো একটা জামা, পাশে রক্ষিত নাইটস অব দি হোলি সিপালকারের সামরিক তরবারি। তার পাশে, শোকের পূর্ণ পোশাকপরিহিতা, মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা, কিন্তু তা ছাড়া প্রায় সম্পূর্ণ অনড়, ফারমিনা ডাজা-কে দেখা গেল। আবেগের বিশেষ কোনো অবিব্যক্তির প্রকাশ না ঘটিয়ে লোকজনের শোকজ্ঞাপন ও সমবেদনা গ্রহণ করলেন তিনি, পরদিন বেলা ১১টা পর্যন্ত, তারপর তিনি বাড়ির বারান্দায় স্বামীর কাছ থেকে শেষ বিদায় নিলেন, রুমাল নেড়ে তাকে তার শেষ বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। উঠানে ডিনা পার্ডোর চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসে স্বামীকে কাদার মধ্যে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে দেখার পর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা তাঁর পক্ষে সহজ হয় নি। তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আশার, কারণ ডাক্তারের চোখ দুটি ছিল খোলা এবং তার মধ্যে এমন একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলজ্বল করছিল যা ইতিপূর্বে তিনি কখনো দেখেন নি। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন তাঁকে একটি মুহূর্ত দেবার জন্য, তিনি যেন তাঁর স্বামীকে তাদের সকল দ্বিধাসন্দেহ সত্ত্বেও কতো ভালবেসেছিলেন সে কথা বলতে পারেন, এটা জানার আগে যেন তার স্বামীর মৃত্যু না ঘটে। তাকে নিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করার একটা অদৃশ্য আকুলতা তিনি অনুভব করেন, যে সব কথা এতদিন না বলা ছিল তা যেন এবার বলতে পারেন, যেসব কাজ অতীতে বাজে ভাবে করেছেন এবার যেন তা সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করতে পারেন তার জন্য তিনি প্রার্থনা করেন। কিন্তু মৃত্যুর অমোঘ অনমনীয়তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে তিনি বাধ্য হন। তার তীব্র বেদনা সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে এক অন্ধ ক্রোধে বিস্ফোরিত হল। এমনকি তার নিজের বিরুদ্ধেও এবং এটাই তাকে একা তার নিঃসঙ্গতার মুখোমুখি হবার সাহস ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যোগালো। এরপর থেকে তার আর শান্তি ছিল না, কিন্তু তার কোনো বাক্য বা আচরণের মধ্যে যেন শোকের প্রকাশ না ঘটে সে বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সতর্ক থাকলেন। শুধু একবার তার গভীর ব্যথার প্রকাশ ঘটে, তাও অনিচ্ছাকৃত ভাবে, যখন রবিবার রাত এগারোটায় ওরা বিশপের আশীর্বাদধন্য কফিনটা বাড়িতে নিয়ে আসে, তখনো কফিনের মধ্যে জাহাজের মোমের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার তামার হাতল আর ভেতরের নরম সিল্কের লাইনিং। ডাক্তার অরেলিও উরবিনো ডাজা দেরি করে কফিন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন, প্রচণ্ড গরমে অজস্র ফুলের গন্ধে বাড়ির বাতাস ইতিমধ্যে ভারি হয়ে উঠেছিল, তা ছাড়া তার মনে হল তিনি যেন তার বাবার ঘাড়ের কাছে লালচে ছায়ার প্রথম আভাস দেখতে পাচ্ছেন। নীরবতার মধ্যে হঠাৎ একজনের মৃদু গলার মন্তব্য শোনা গেল, এই বয়সে বেঁচে থাকতেই একজন মানুষের অর্ধেক ক্ষয় হয়ে যায়। ওরা কফিনের ডালা বন্ধ করে দেবার আগে ফারমিনা ডাজা তার আঙুল থেকে নিজের বিয়ের আংটিটি খুলে স্বামীর আঙুলে পরিয়ে দিলেন, তারপর জনসভায় কথা বলার সময় তাঁর স্বামী মূল প্রসঙ্গ ছেড়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলে তিনি সর্বদা যা করতেন তাই করলেন, তাঁর হাত তিনি ঢেকে দিলেন নিজের হাত দিয়ে। তাকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, খুব শিগগির আবার আমাদের দেখা হবে।

বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের ভিড়ে ফ্লেরেন্টিনো আরিজা এতক্ষণ কারো চোখে পড়ে নি। ফারমিনা ডাজাকে দেখে তার মনে হল তার বুক বুঝি ভেঙে যাচ্ছে। সমবেদনা জানানোর তাড়াহুড়ার মধ্যে ফারমিনা ডাজা তাঁকে চিনতে পারে নি, যদিও গত রাতের যাবতীয় কাজকর্মে তার চাইতে সাহায্য করতে বেশি প্রস্তুত আর কেউ ছিল না, সকল কাজে তার মতো দক্ষতার পরিচয়ও আর কেউ দেয় নি। রান্নাঘরে তিনিই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, কফির যেন ঘাটতি না পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখেন, যখন প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে আনা চেয়ার যথেষ্ট হল না তখন তিনিই অন্যত্র থেকে আরো চেয়ার আনার ব্যবস্থা করেন, বাড়িতে যখন আর ফুলের মালার স্থান সঙ্কুলান হল না তখন সেগুলি উঠানে রাখার আয়োজনও তিনিই করেন। ডাক্তার লাসিডে অলিভেল্লার ওখানে তাঁর রজত-জয়ন্তির উৎসব যখন তুঙ্গে তখন দুর্ঘটনার সংবাদ শুনে তার অতিথিরা এ বাড়িতে ছুটে আসেন। এখন তাঁরা আম গাছের নিচে গোল হয়ে বসে কথাবার্তা বলছেন। তাদের জন্য যথেষ্ট ব্র্যান্ডির সরবরাহ যেন অব্যাহত থাকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাও সুনিশ্চিত করেন। রাতদুপুরে পলাতক তোতা যখন পাখা ছড়িয়ে মাথা উঁচু করে হঠাৎ খাবার ঘরে উদিত হয় তখন কি করতে হবে তাও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নির্ভুল ভাবে উপলব্ধি করেন। পাখিটিকে দেখে সারা বাড়ির মধ্য দিয়ে একটা বিহ্বল কাঁপুনির স্রোত বয়ে যায়। সবার মনে হল এটা অনুতাপের সুনিশ্চিত নিদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। তোতাটি তার নির্বোধ মুখস্থ করা বুলির একটিও উচ্চারণ করার আগেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার ঘাড় চেপে ধরে তাকে একটা আচ্ছাদিত খাঁচায় পুরে আস্তাবলে নিয়ে যান। তিনি যাবতীয় কাজ এমনই বিচক্ষণতার সঙ্গে করেন যে তাকে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো বলে কারো মনেই হয় নি, বরং সবার মনে হল যে পরিবারের এই দুঃসময়ে তিনি এক অমূল্য সাহায্য দান করছেন।

তাঁকে দেখে যেমন মনে হত তিনি তাই ছিলেন : একজন অচপল কাজের মানুষ। তিনি ছিলেন কৃশকায়, তার দেহ ছিল ঋজু, ত্বকের রঙ শ্যামলা, দাড়ি পরিষ্কার করে কামানো, রুপার ফ্রেমের গোলাকার চশমার পেছনে চোখ দুটি ঔৎসুক্যে ভরা, নাকের নিচে পুরানোকালীন রোমান্টিক গোঁফ, অগ্রভাগ ছিল মোম দিয়ে পাকানো। কপালের কাছে তার অল্প যেটুকু চুল ছিল তা তিনি উপর দিকে টেনে আঁচড়ে, চুলের ঔজ্জ্বল্যবর্ধক বিশেষ প্রসাধনী লাগিয়ে, তার চকচকে চাদির মাঝখানে চেপে বসিয়ে রাখতেন, পুরোপুরি টাকের একটা সমাধান হিসেবে। স্ত্রীলোকের প্রতি তাঁর সহজাত সৌজন্য এবং তার ধীরগতিসম্পন্ন আচরণ সবাইকে তাৎক্ষণিক ভাবে আকৃষ্ট করতো, কিন্তু এগুলি একজন প্রতিষ্ঠিত অকৃতদারের ক্ষেত্রে খানিকটা সন্দেহজনক গুণাবলি বলেও বিবেচিত হত। গত মার্চ মাসে তার ছিয়াত্তর বছর পূর্ণ হয়েছে। এ ঘটনাটি লুকিয়ে রাখার জন্য। তিনি যথেষ্ট অর্থ, কৌশল ও ইচ্ছাশক্তি ব্যয় করেছেন। তাঁর আত্মার একাকিত্বের মধ্যে তিনি সুনিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করতেন যে এই পৃথিবীতে তাঁর মতো এত দীর্ঘকাল ধরে কোন মানুষ আরেকজন মানুষকে নীরবে নিভৃতে এমন ভাবে ভালবাসেনি।

ডাক্তার উরবিনোর মৃত্যুর রাতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা খবরটা শোনার সময় যে পোশাকে ছিলেন তখনও সেই পোশাক পরেই ছিলেন। সব সময় তিনি ওই পোশাকই পরতেন, জুন মাসের প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও : ভেস্ট সমেত গাঢ় রঙের স্যুট, সিল্কের বো-টাই, সেলুলয়েডের কলার, ফেল্টের হ্যাট, হাতে কালো চকচকে ছাতা যা তিনি ছড়ি হিসেবেও ব্যবহার করতেন। কিন্তু যখন রাতের আঁধার কেটে আলো ফুটতে শুরু করে তখন তিনি মৃতদেহের নৈশকালীন প্রহরা থেকে দু’ঘণ্টার জন্য নিজেকে সরিয়ে নেন। দু’ঘণ্টা পর তিনি ফিরে আসেন উদীয়মান সূর্যের মতো তাজা, সযত্নে দাড়ি কামানো, তাঁর ড্রেসিংটেবিলের লোশন দ্বারা শরীর সুরভিত। এখন তার পরনে বিশেষ ধরনের কালো ফ্রক কোট, যা শুধু শেষকৃত্যানুষ্ঠান ও পবিত্র সপ্তাহের ক্রিয়াকাণ্ডের সময় পরা হয়, গলায় উইঙ্গ কলার ও টাই-এর পরিবর্তে শিল্পীর বো, মাথায় একটা বাউলার হ্যাট। হাতে ছাতাও আছে, শুধু অভ্যাসের জন্যই নয়, দুপুরের আগেই যে বৃষ্টি নামবে সে সম্পর্কে তিনি ছিলেন সুনিশ্চিত। তিনি ডাক্তার অরেলিও উরবিনো ডাজাকে সে কথা জানিয়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠানটা একটু এগিয়ে আনার কথা বললেন। ওরা চেষ্টাও করেন, কারণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিলেন জাহাজী পরিবারের সদস্য, তিনি ছিলেন ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির সভাপতি এবং মনে করা হত যে আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো জ্ঞান তার আছে। কিন্তু বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষ, পাব্লিক এবং প্রাইভেট কর্পোরেশনসমূহ, সামরিক ব্যান্ড, স্কুল অব ফাইন আর্টস-এর অর্কেস্ট্রা, বিভিন্ন স্কুল ও ধর্মীয় সংস্থার সঙ্গে আগে থেকে ঠিক করা ছিল যে শেষকৃত্যানুষ্ঠান হবে বেলা এগারোটায়, এখন তা পরিবর্তন করা সম্ভব হল না। ফলে যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হবে বলে আশা করা গিয়েছিল তা বিধ্বংসী বর্ষণের কারণে একটা চরম বিশৃঙ্খল ঘটনায় পরিণত হল। খুব কম লোকই কাদামাটি ভেঙে ঔপনিবেশিক যুগের সিবা গাছ। দ্বারা সুরক্ষিত পারিবারিক সমাধিস্থলে এসে পৌঁছতে পারলেন। গাছটির শাখা-প্রশাখা সমাধিক্ষেত্রের দেয়ালের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। আগের দিন অপরাহ্নে ওই একই শাখা-প্রশাখার নিচে, কিন্তু দেয়ালের অপর পাশে, আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে, ক্যারিবীয় শরণার্থীরা জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরকে সমাহিত করেছিল। তার পাশেই ওরা তার কুকুরকেও কবর দেয়, সে-অনুরোধই তিনি করে গিয়েছিলেন।

যে অল্প কয়েকজন শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্যন্ত থেকে যান ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি ততক্ষণে ভিজে চুপচুপ। তিনি বাড়ি ফিরলেন খুবই ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায়। এত বছরের নিখুঁত যত্ন ও সতর্কতা এবং অত্যন্ত বেশি রকম সাবধানতা অবলম্বনের পর এবার বুঝি তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন। তিনি একটু ব্র্যান্ডি ঢেলে এক গ্লাস লেমোনেড খেলেন, বিছানায় শুয়ে দুটো অ্যাসপিরিনের বড়ির সঙ্গে তা পান করলেন, গায়ে একটা উলের কম্বল জড়ালেন, তারপর যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর শরীরের যথার্থ ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হল ততক্ষণ তার গা থেকে বালতি বালতি ঘাম ঝরালেন। তারপর তিনি যখন আবার ফারমিনা ডাজাদের বাড়িতে ফিরে গেলেন তার মনে হল তার প্রাণশক্তি তিনি পুরোপুরি ফিরে পেয়েছেন। ইতিমধ্যে ফারমিনা ডাজা বাসভবনের সকল শাসনভার আবার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বাড়িঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে, দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য তা প্রস্তুত, পাঠাগারের বেদিতে তিনি প্যাস্টেলে আঁকা তাঁর স্বামীর একটি প্রতিকৃতি সাজিয়ে রেখেছেন, ফ্রেমের চারপাশে কালো রেখা এঁকে দিয়েছেন। আটটা নাগাদ গত রাতের মতই লোকের ভিড় ও গরম দেখা গেল, কিন্তু বিশেষ প্রার্থনাটি শেষ হলে একজন সবার কাছে একটা অনুরোধ প্রচার করলেন, সবাই যদি এখন আর দেরি না করে বিদায় গ্রহণ করেন তাহলে রবিবারের পর এই প্রথম বারের মতো সদ্য বিধবা একটু বিশ্রাম নিতে পারবেন।

বেশির ভাগ মানুষকে ফারমিনা ডাজা পাঠাগারের বেদির সামনে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন, তবে অন্তরঙ্গ বন্ধুদের তিনি রাস্তার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন, যেন তিনি নিজের হাতে সেখানে তালা লাগাতে পারেন, যা তিনি চিরকাল করেছেন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত যা তিনি করবেন। এই সময় তিনি দেখতে পেলেন ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে, শোক পালনের কাপড় পরে জনশূন্য বসার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি খুশি হলেন, কারণ বহু বছর তিনি তাকে নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলে দিয়েছিলেন এবং এই প্রথম তিনি তাকে স্পষ্ট দেখলেন, বিস্মৃতি দ্বারা পরিশোধিত, কিন্তু তাকে ধন্যবাদ দেবার আগেই তিনি বুকের ওপর তার হ্যাট চেপে ধরেন, ঈষৎ কম্পমান কিন্তু মর্যাদাশীল, আর তখন যে ফোঁড়াটি এতকাল তার জীবনকে ধরে রেখেছিল সেটা বিস্ফোরিত হল।

তিনি বললেন, ফারমিনা, আমি অর্ধশতাব্দি ধরে এই সুযোগটির জন্য অপেক্ষা করেছি, যেন আমি আমার চিরন্তন বিশ্বস্ততা ও অন্তহীন ভালবাসার শপথের কথা আবার তোমাকে জানাতে পারি।

ফারমিনা ডাজার মনে হল তিনি যেন একটি উন্মাদ ব্যক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে আসলে হোলি স্পিরিট দ্বারা অনুপ্রাণিত, এ কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ তাঁর ছিল না। তার তাৎক্ষণিক আবেগতাড়িত ইচ্ছা হয়, তার স্বামীর মৃতদেহ যখন কবরের ভেতরে এখনো উষ্ণ, সেই সময়ে এই গৃহকে এভাবে অপবিত্র করার জন্য তিনি তাকে অভিশাপ দেবেন। কিন্তু তার বিশাল ক্রোধের মর্যাদাই তাকে তা করতে দিল না। তিনি শুধু বললেন, এখান থেকে বেরিয়ে যাও। আর যে ক’বছর বেঁচে থাকো তোমার মুখ আর এখানে দ্বিতীয়বার দেখিয়ো না। তিনি রাস্তার দরজাটা বন্ধ করতে শুরু করেছিলেন, সেটা খুলে আবার বললেন, আর আমি আশা করি খুব বেশি বছর তুমি বাঁচবে না।

তিনি তখন নির্জন রাস্তায় তার পদধ্বনি মিলিয়ে যেতে শুনলেন, তখন অতি ধীরে ধীরে দরজাটা বন্ধ করলেন। দরজার আড়াআড়ি পাল্লা দুটি তুলে দিলেন, দরজায় তালা লাগালেন। তারপর একাকী নিজের নিয়তির মুখোমুখি হলেন।

তখনো তার বয়স আঠারো বছর পূর্ণ হয় নি, সেই সময়ের কথা তার মনে পড়লো। তখন তিনি যে নাটকের জন্ম দিয়েছিলেন তার ওজন ও আকার সম্পর্কে তিনি। কখনো সম্পূর্ণ সচেতন হন নি, যে নাটক তাকে অনুসরণ করবে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম বারের মত তিনি অশ্রু বিসর্জন করলেন, কোনো সাক্ষীর উপস্থিতি ছাড়া, তিনি সর্বদা যেভাবে চোখের জল ফেলতেন সেই ভাবে। তিনি চোখের জল ফেললেন তাঁর স্বামীর মৃত্যুর জন্য, নিজের একাকিত্ব ও ক্রোধের জন্য, আর যখন তিনি তাঁর শূন্য শয়ন ঘরে প্রবেশ করলেন তখন তিনি চোখের জল ফেললেন তার নিজের জন্য, কারণ তার কুমারিত্ব বিসর্জন দেবার পর থেকে তিনি কদাচিৎ ওই শয্যায় একাকী রাত্রি যাপন করেছেন। তাঁর স্বামীর প্রতিটি জিনিস আবার তার চোখে জল এনে দিল; শোভা বাড়াবার জন্য সুতার গুচ্ছযুক্ত তাঁর চটি জোড়া, বালিশের নিচে তার পাজামা, ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাঁর প্রতিবিম্বের অনুপস্থিতি, নিজের ত্বকে স্বামীর দেহের গন্ধের অভাব। একটা অস্পষ্ট ভাবনায় তিনি কেঁপে উঠলেন; একটা মানুষ যাদের ভালবাসে তাদের উচিত মৃত্যুর সময় তাদের সব জিনিস নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। শয্যা গ্রহণের জন্য তৈরি হতে তিনি কারো সাহায্য নিতে চাইলেন না, ঘুমাতে যাবার আগে তিনি কিছু খেতে চাইলেন না। শোকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন ঈশ্বর যেন আজ রাতে ঘুমের মধ্যে তাঁর প্রাণ হরণ করেন। তারপর নগ্ন পদে, কিন্তু পুরো পোশাক পরা অবস্থায়, ওই আশা নিয়ে, তিনি যেখানে শুলেন সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি যে ঘুমিয়ে পড়েছেন তা তিনি বুঝতেই পারেন নি, কিন্তু ঘুমের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন যে তিনি তখনো বেঁচে আছেন, তাঁর শয্যার অর্ধেকটা খালি পড়ে আছে, সব সময় তিনি যেভাবে শুতেন আজো সেই ভাবে শুয়ে আছেন, শয্যার বা ধারে, নিজের বাঁ পাশে, কিন্তু শয্যার অন্য পাশে অন্য একটা দেহের ওজন যে ওখানে নেই তাও উপলব্ধি করলেন তিনি। ঘুমাতে ঘুমাতেই তিনি ভাবলেন। যে এই ভাবে তিনি আর কোনো দিন ঘুমাতে পারবেন না, তারপর ঘুমের মধ্যেই তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, শয্যায় তার নিজের জায়গায় শুয়ে, নিজের অবস্থান একটুও পরিবর্তন না করে, তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাতে থাকলেন, রাতা মোরগগুলি ডেকে উঠার পরও অনেকক্ষণ তিনি ঘুমিয়ে থাকলেন, তারপর ঘৃণিত সূর্যের প্রভাত আলো তাকে জাগিয়ে দিলো, তার স্বামীকে ছাড়া। আর শুধু তখনই তিনি হৃদয়ঙ্গম করলেন যে তিনি মরে না গিয়ে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন, ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন, আর কাঁদতে কাঁদতে মৃত স্বামীর কথা যতটা ভেবেছেন তার চাইতে বেশি ভেবেছেন ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা।

অন্যদিকে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, একান্ন বছর নয় মাস চার দিন আগে তাঁর যে দীর্ঘ বিক্ষুব্ধ প্রেম ফারমিনা ডাজা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল তারপর থেকে এক মূহূর্তের জন্যও ওর কথা ভাবা বন্ধ করেন নি। তাকে কোনো দৈনন্দিন হিসেব রাখতে হয় নি, কোনো কুঠুরীর দেয়ালে প্রতিদিনের জন্য দাগ কাটতে হয় নি, কারণ ওকে মনে করিয়ে দেবার জন্য একটা না একটা কিছু তার জীবনে প্রতিদিনই ঘটেছে। ওর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মায়ের সঙ্গে জানালার রাস্তার একটা ভাড়া বাড়ির অর্ধেকটা নিয়ে থাকতো। সেখানে তার মা, তার তরুণী জীবন থেকেই, টুকিটাকি জিনিসের একটা দোকান চালাতেন। পুরনো জামা-কাপড় কেটে আর ন্যাকড়া ইত্যাদি দিয়ে ব্যান্ডেজ তৈরি করে যুদ্ধাহতদের জন্য তিনি সে সব বিক্রি করতেন। ফ্লোরেন্টিনো ছিল তার একমাত্র সন্তান। বিখ্যাত জাহাজ মালিক ডন পায়াস ভি লোয়াইজার সঙ্গে একটা সাময়িক সম্পর্কের ফলে ওর জন্ম হয়। যে তিন ভাই ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তার মাধ্যমে ম্যাগডালেনা নদী বক্ষে বাষ্পচালিত নৌযান চলাচলে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত করেছিলেন ডন পায়াস ছিলেন তাঁদেরই একজন।

তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর পুত্রের বয়স দশ বছর। তিনি গোপনে ওর খরচপত্র যোগালেও কখনো আইনের চোখে তাকে সন্তানের স্বীকৃতি দেন নি, তার ভবিষৎ সংস্থানের জন্যও কোনো ব্যবস্থা করেন নি। বাবার মৃত্যুর পর তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। তখন সে ডাক বিভাগে যোগ দেয়। সেখানে তার ওপর বস্তা খোলার, চিঠি পত্র বাছাই করে আলাদা করার এবং যে দেশ থেকে ডাক এসেছে তার পতাকা দপ্তরের দরজায় উড়িয়ে দিয়ে জনসাধারণকে খবর দেয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয়।

ওর সুবিবেচনা বোধ ও কাণ্ডজ্ঞান টেলিগ্রাফ যন্ত্র পরিচালক জার্মান দেশত্যাগকারী লোটারিও থুগুটের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সময় ক্যাথিড্রালে অর্গান বাজাতেন, তা ছাড়া নিজ গৃহে ছাত্রছাত্রীদের সংগীত শিক্ষাও দিতেন। লোটারিও থুগুট ফ্লোরেন্টিনোকে মোর্স সঙ্কেত ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা কিভাবে পরিচালিত হয় তা শিখিয়ে দেন। আর তাঁর কাছ থেকে বেহালা বাদনে কয়েক দিন শিক্ষা গ্রহণের পরই সে প্রায় পেশাদার বাদকের মতো বাজাতে সক্ষম হয়। ফারমিনা ডাজার সঙ্গে যখন তার প্রথম দেখা হয় তখন নিজের সামাজিক বৃত্তে তার বিপুল চাহিদা। সে সাম্প্রতিকতম নাচগুলি নাচতে পারে, ভাবালু কবিতাবলী মুখস্থ আবৃত্তি করতে পারে। বন্ধুবর্গের প্রেমিকদের উদ্দেশে রাতের বেলা তাদের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বেহালা বাজাতে সে ছিল সর্বদাই রাজি। খুব কৃশকায় ছিল সে, তার কালো চুলে সুবাসিত পোমেড মাখিয়ে সে তার মাথায় বসিয়ে রাখতো। ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য তাকে চশমা পরতে হত, যার ফলে তার অসহায় চেহারা আরো প্রকট হয়ে উঠতো। চোখের অসুবিধা ছাড়াও সে ভুগতো দীর্ঘকালীন কোষ্ঠকাঠিন্যে, যার জন্য তাকে জীবনভর এনিমা নিতে হয়। তার একটা কালো স্যুট ছিল, প্রয়াত পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, কিন্তু তার মা ট্রান্সিটো আরিজা সেটার এতো যত্ন নিতেন যে প্রতি রবিবারই সেটাকে নতুন মনে হত। তার দুর্বল চেহারা, তার সংযম, তার অনুজ্জ্বল পোশাক সত্ত্বেও ফ্লোরেন্টিনোও তাদের সঙ্গে, কালক্ষেপণের জন্য, বাজি ধরতো, যতদিন পর্যন্ত না ফারমিনা ডাজার সঙ্গে তার দেখা হয়, আর তখনই তার নিষ্পাপ সারল্যের সমাপ্তি ঘটে।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রথমবার ফারমিনা ডাজাকে দেখে এক অপরাহ্নে। লোটারিও থুগুট তাকে লোরেঞ্জো ডাজা নামক এক ব্যক্তির কাছে একটা টেলিগ্রাম পৌঁছে দিতে বলে। লোরেঞ্জে ডাজার বাসার হদিস কেউ জানতো না। ফ্লোরেন্টিনো তাকে ইভাঞ্জেল পার্কের একটি প্রাচীন জরাজীর্ণ বাড়িতে খুঁজে বের করে। বাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত, ভেতরের উঠানে ফুলের টবগুলিতে আগাছা জন্মেছে, একটা পাথরের ফোয়ারা দেখা গেল যার মধ্যে কোনো জল নেই, বাড়িটাকে মনে হল পরিত্যক্ত মঠের মতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বারান্দার খিলানে ঢাকা পথ দিয়ে নগ্নপদ দাসীকে অনুসরণ করার সময় কোথাও কোনো মানুষের শব্দ শুনতে পেল না। তার চোখে পড়ল মুখ বন্ধ করা কয়েকটা পিচ বোর্ডের বাক্স আর ইট মিস্ত্রির কিছু হাতিয়ার। সেগুলি অব্যবহৃত চুন ও কয়েকটা সিমেন্টের বস্তার মধ্যে পড়ে আছে, কারণ তখন বাড়ির একটা আমূল সংস্কারের কাজ চলছিল। উঠানের একেবারে শেষ প্রান্তে একজন খুব মোটা লোক একটা অস্থায়ী দপ্তরে বসে আছেন, তাঁর কোঁকড়ানো জুলফি বেড়ে উঠে তার গোঁফের সঙ্গে মিশেছে, তিনি একটা দেরাজের ওপাশে বসে দিবানিদ্রারত। তিনিই লোরেঞ্জে ডাজা, শহরে খুব বেশি পরিচিত নন, কারণ তিনি এখানে এসেছেন এখনো দু’বছর হয় নি, আর তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও বেশি ছিল না।

তিনি যেভাবে তারবার্তাটি গ্রহণ করলেন মনে হল এটা বুঝি তার অশুভ স্বপ্নেরই সম্প্রসারণ। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এক ধরনের সরকারি অনুকম্পার সঙ্গে তার ধূসর নীল চোখের দিকে তাকালো। তিনি অনিশ্চিত আঙুল দিয়ে সিলমোহর ভাঙার চেষ্টা করছিলেন, বেশ ভীত, বহু টেলিগ্রাম-প্রাপকের চোখে মুখে ফ্লোরেন্টিনো এটা লক্ষ করেছে, তারা মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত না করে কোনো টেলিগ্রামের কথা ভাবতেই পারে না। ভদ্রলোক টেলিগ্রামটা পড়ার পর তাঁর স্থৈর্য ফিরে পেলেন। তিনি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, সুখবর। তারপর তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বাধ্যতামূলক পাঁচ রিয়াল দিয়ে স্বস্তির হাসি হেসে তাকে জানিয়ে দিলেন যে খবরটা খারাপ হলে তিনি তাকে পয়সাটা দিতেন না। অতঃপর তিনি করমর্দন করে তাকে বিদায় দিলেন। এটা ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, টেলিগ্রাম বিলিকারীর সঙ্গে সাধারণত এ রকম করা হত না। রাস্তার দরজার দিকে ফিরে যাবার সময় আবার দাসী তার সঙ্গ নিল, তাকে পথ দেখাবার জন্য ততটা নয় যতটা তার ওপর নজর রাখার জন্য, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এবার বুঝলেন যে বাড়িতে আরো মানুষ আছে। উঠানের উজ্জ্বলতা তখন এক মহিলার কণ্ঠস্বরে ভরপুর, তিনি পাঠ্য পুস্তকের একটা পাঠ পুনরাবৃত্তি করছিলেন। সেলাই কক্ষের পাশ দিয়ে যাবার সময় ফ্লোরেন্টিনো জানালা দিয়ে একজন বয়স্ক মহিলা ও একজন অল্প বয়সী মেয়েকে একটা বই পড়তে দেখলেন। ওরা দুজন খুব কাছাকাছি চেয়ারে বসে আছে, মহিলার কোলের উপর একটা খোলা বই। দৃশ্যটা বিচিত্র মনে হল তার কাছে; মেয়ে মাকে পড়তে শেখাচ্ছে। তার ধারণা শুধু অংশত ভুল ছিল, মহিলা বালিকার মা নয়, তার পিসি, যদিও নিজের সন্তানের মতোই তিনি তাকে লালনপালন করেছেন। পড়ালেখায় বাধা পড়ে নি কিন্তু জানালার ওপার দিয়ে কে যাচ্ছে তা দেখার জন্য মেয়েটি চোখ তুলে ওদিকে তাকিয়েছিল, আর ঐ আকস্মিক চাউনিই প্রেমের এমন এক ঘূর্ণি ঝড় তোলে যা অর্ধশতাব্দি পরে আজও থামে নি।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা লোরেঞ্জো ভাজা সম্পর্কে যা জানতে পারে তা এই : তিনি কলেরা মহামারীর পর তার একমাত্র কন্যা ও এক অবিবাহিতা বোনকে নিয়ে সান হুয়ান ডি লা সিনেগা থেকে এখানে চলে আসেন। ওকে যারা জাহাজ থেকে নামতে দেখে তাদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে তিনি স্থায়ী ভাবে বাস করার জন্য এখানে এসেছেন, কারণ একটি সুসজ্জিত ভবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তিনি তার প্রায় সবই। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। মেয়েটির অল্প বয়সে তার মা মারা যায়। ভদ্রলোকের বোনের নাম এসকোলাস্টিক, চল্লিশ বছর বয়স, একটা মানত পালনের জন্য তিনি রাস্তায় বেরুবার সময় সেন্ট ফ্রান্সিস সম্প্রদায়ের পোশাক পরতেন, আর বাড়িতে থাকার সময় তিনি কোমরে জড়িয়ে রাখতেন একজন অনুতাপকারীর রঞ্জু। মেয়েটির বয়স তের বছর, মৃত মায়ের নামেই তার নাম ফারমিনা।

লোরেঞ্জা ডাজাকে একজন সম্পন্ন লোক বলে অনুমান করা হত, কারণ তিনি কোনো কাজ করেন বলে কারো জানা ছিল না, তবু তিনি বেশ ভালো ভাবে থাকতেন এবং ইভানজেল পার্কের বাড়িটির জন্য নগদ টাকা প্রদান করেছিলেন, দু’হাজার স্বর্ণ পেসো। তারপরও বাড়িটির সংস্কারের জন্য তাকে ওই অঙ্কের অন্তত দ্বিগুন ব্যয় করতে হয়। তাঁর মেয়ে প্রেজেন্টেশান অব ব্লেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনা করছে। দুই শতাব্দি ধরে সমাজের সম্ভ্রান্ত তরুণীরা সেখানে পরিশ্রমী হবার কলাকৌশল শিখেছে এবং সুবাধ্য স্ত্রী হবার গুণাবলী অর্জন করেছে। ঔপনিবেশিক যুগে এবং গণতন্ত্রের প্রথম ক’বছর স্কুলটি শুধু ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন পরিবারের মেয়েদেরই ছাত্রী হিসেবে গ্রহণ করতো, কিন্তু স্বাধীনতার ফলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া প্রাচীন পরিবারগুলিকে নতুন যুগের বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার করতে হয় এবং যে সব প্রার্থী বেতন দিতে সক্ষম তাদের সবার জন্য, রক্তের রঙ নির্বিশেষে, অ্যাকাডেমিকে তার দরজা খুলে দিতে হয়। শুধু একটাই অলঙ্ঘনীয় শর্ত ছিল, ছাত্রীকে অবশ্যই ক্যাথলিক বিয়ের বৈধ সন্তান হতে হবে। যাই হোক, স্কুলটি ছিল ব্যয়বহুল এবং ফারমিনা ডাজা যে সেখানে পড়ে এই তথ্যটি তার পরিবারের সামাজিক অবস্থান না হোক, অর্থনৈতিক অবস্থানের সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে এটা উৎসাহিত করলো, কারণ তার মনে হলো কাঠ বাদামের মতো চোখের ওই সুন্দরী কিশোরী তার স্বপ্নের আয়ত্ত্ব বহির্ভূত নয়। কিন্তু মেয়েটির বাবার কঠোর শাসনব্যবস্থা একটা দুর্বার বাধার জন্ম দিল। আর সব মেয়ের মতো ফারমিনা ডাজা অন্য মেয়েদের সঙ্গে দল বেঁধে কিংবা কোনো বৃদ্ধা পরিচারিকার সঙ্গে স্কুলে যায় না, সে সব সময় স্কুলে হেঁটে যায় তার অবিবাহিতা পিসির সঙ্গে এবং তার আচরণ থেকে বোঝা যায় যে তাকে বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা বা অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দিতে দেয়া হয় না।

নিঃসঙ্গ শিকারি হিসেবে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার গোপন জীবন শুরু হয় নিষ্পাপ ও সরল ভাবে। সকাল সাতটা থেকে ছোট্ট পার্কটির সব চাইতে নিভৃত বেঞ্চে সে বসে থাকতো, ভান করতো যেন বাদাম গাছগুলির ছায়ার নিচে বসে কবিতার বই পড়ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত নীল ডোরা কাটা ইউনিফর্ম পরা ওই অসম্ভব মেয়েটিকে তার স্কুলের দিকে হেঁটে যেতে না দেখা যেত ততক্ষণ পর্যন্ত সে বসে থাকতো। মেয়েটির পরনের মোজা ছিল হাঁটু পর্যন্ত, মাথায় মোটা একটা বেণী, যার শেষ প্রান্তে ফুলের মতো করে ফিতা বাঁধা। নিজের সহজাত অহঙ্কারী ভঙ্গিতে সে হেঁটে যেতো, মাথা উঁচু, চোখ দুটি অচঞ্চল, দ্রুতগতি, নাক সোজা সামনের দিকে, বইয়ের ব্যাগ আড়াআড়ি করে দুই বাহুর নিচে বুকের কাছে ধরা, তার হরিণীর মতো চলন দেখে মনে হত সে যেন মধ্যাকর্ষণের প্রভাবমুক্ত। তার সঙ্গে তাল রাখতে ব্যস্ত পাশে পাশে চলা পিসি। ফ্লোরেন্টিনোকে তার কাছে যাবার কোনো সুযোগই দিল না। পিসির পরনে তার চিরাচরিত বাদামি রঙের পোশাক ও সেন্ট ফ্রান্সিসের রজু। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা দিনে চারবার করে তাদের পথপরিক্রমা দেখতো, আর রবিবারে একবার, তারা যখন হাই ম্যাস-এর প্রার্থনার পর গীর্জা থেকে বেরিয়ে আসতো। মেয়েটিকে দেখাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। একটু একটু করে সে তাকে আদর্শায়িত করে তুললো, তার মধ্যে আরোপ করলো অসম্ভব সব গুণাবলী এবং কল্পিত আবেগ-অনুভূতি, আর দু’সপ্তাহ পর সে তাকে ছাড়া আর কিছু বা অন্য কারো কথা ভাবতেই পারলো না। তখন সে ফারমিনা ডাজাকে একটা চিঠি পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিল, একটা সহজ সরল চিঠি, কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় তার চমৎকার নোটারির হাতের লেখায়। বেশ কয়েক দিন সে চিঠিটা তার পকেটে নিয়ে ঘুরলো, কেমন করে ওটা তার হাতে দিবে তা নিয়ে প্রচুর ভাবলো, ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে আরো কয়েক পাতা লিখলো, ফলে মূল চিঠিটা একটা প্রশংসাসূচক অভিধানের রূপ নিলো। পার্কে ওর পথ চেয়ে বসে থাকার সময় প্রায়ই সে যে সব বই পড়তো, যা তার প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, তাই তাকে তার চিঠিতে ওই প্রশংসাসূচক শব্দাবলী যোগ করার প্রেরণা যোগায়।

চিঠিটা ওর কাছে পৌঁছে দেবার একটা উপায় খুঁজে পাবার উদ্দেশ্যে সে প্রেজেন্টেশান অ্যাকাডেমির অন্য ছাত্রীদের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের অবস্থান ছিল তার জগতের চাইতে বড় বেশি দূরে। তাছাড়া, অনেক চিন্তার পর, তার মনে হলো যে তার অভিপ্রায়ের কথাটা অন্য কাউকে জানানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তবু সে একটা খবর যোগাড় করতে সক্ষম হলো। এই শহরে আসার কয়েক দিন পর ফারমিনা ডাজা এক শনিবার একটা নাচের পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়েছিল কিন্তু তার বাবা তাকে সেখানে যাবার অনুমতি দেন নি। তিনি তার চূড়ান্ত মতামত জানিয়ে দিয়েছিলেন, যথা সময়ে সবই হবে। ইতিমধ্যে চিঠিটা ষাট পাতার বেশি হয়ে গিয়েছিল, কাগজের দু’দিকে লেখা। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার গোপন ভালবাসার ভার আর বইতে পারলো না। সে সব কথা তার মাকে খুলে বললো, একমাত্র তার সঙ্গেই সে তার চিন্তাভাবনা ভাগ করে নিতে পারতো। প্রেমের ব্যাপারে পুত্রের অপাপবিদ্ধ সরলতায় মায়ের চোখে জল দেখা দিল। তিনি নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে তাকে পথ দেখাতে চেষ্টা করলেন। তিনি প্রথমে তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝালেন যে মেয়েটির হাতে তার গীতিকাব্যময় কাগজের তাড়া তুলে দেয়া ঠিক হবে না, এর ফলে তার স্বপ্নের গভীরতা দেখে সে শুধু ভীত হয়ে পড়বে, কারণ মায়ের ধারণায় হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপারে মেয়েটিও তাঁর পুত্রের মতোই কাঁচা ও অনভিজ্ঞ। প্রথম কাজ হবে। ফ্লোরেন্টিনো যে তার সম্পর্কে উৎসাহী সে ব্যাপারে তাকে সচেতন করে তোলা, তখন সে তার প্রেম নিবেদনে অত অবাক হবে না এবং বিষয়টা ভেবে দেখার সময় পাবে।

সর্বোপরি তিনি বললেন, যে মানুষটিকে তোমার পক্ষে আনতে হবে তিনি হলেন মেয়ের পিসি।

কোনো সন্দেহ নেই যে দুটি উপদেশই ছিল বিজ্ঞজনোচিত, কিন্তু সেগুলি আসে বড় দেরিতে। আসলে, ফারমিনা ডাজা যে দিন তার পিসিকে পড়াবার সময় জানালার ওপাশ দিয়ে কে যাচ্ছে দেখার জন্য একটু চোখ তুলেছিল তখনই সে ফ্লোরেন্টিনোর অসহায় ভঙ্গি দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে দিন রাতে খাবার সময় তার বাবা যখন টেলিগ্রামটির কথা বলেন তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কেনো এ বাড়িতে এসেছিল এবং জীবিকার জন্য সে কি করে ফারমিনা তা জানতে পারে। এ তথ্যটি তার উৎসাহ ও কৌতূহল বাড়িয়ে তোলে, কারণ আরো অনেকের মতো ওই সময়ে ফারমিনাও টেলিগ্রাম আবিষ্কারকে জাদুবিদ্যার মতো একটা কিছু মনে করতো। এর পর সে যখন ওকে প্রথম বারের মতো ছোট্ট পার্কটিতে গাছের ছায়ায় একটা বই পড়তে দেখে তখনই সে ওকে চিনতে পারে, যদিও সে যে ওখানে কয়েক সপ্তাহ ধরেই বসে থাকছে এটা তার পিসির কাছ থেকে শোনার আগ পর্যন্ত সে ওই ঘটনায় কিছু মাত্র বিচলিত হয় নি। এর পর প্রতি রবিবার প্রার্থনার শেষে গির্জা থেকে বেরিয়ে আসার পর তারা যখন ওকে আবার দেখতে পেল তখন পিসির মনে আর কোনো সন্দেহ রইলো না যে এই সাক্ষাৎগুলি আকস্মিক নয়। তিনি বললেন, ও আমার জন্য এতো কষ্ট করছে না। তার আপাত-বিশুষ্ক আচরণ ও অনুতাপকারীর পোশাক সত্ত্বেও পিসি এসকোলাস্টিকার জীবন সম্পর্কে একটা স্বভাবজ আগ্রহ ছিল এবং দুষ্টুমিতে সহযোগিতা করার জন্য ছিল একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। এগুলিই তার সব চাইতে বড় গুণ এবং তাঁর ভাইঝির প্রতি একটা মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে এই ব্যাপারটাই তাঁর মধ্যে অপ্রতিরোধ্য আবেগের জন্ম দিল। ফারমিনা ডাজা অবশ্য তখন পর্যন্ত প্রেমের বিপদ থেকে পুরোপুরি মুক্ত, সে সম্পর্কে তার মনে কোনো সাধারণ ঔৎসুক্যও জাগ্রত হয় নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সম্পর্কে যে একমাত্র অনুভূতি তার হয় তা হলো এক ধরনের অনুকম্পা, কারণ তার মনে হলো যে মানুষটা অসুস্থ। কিন্তু তার পিসি তাকে বললেন যে একটা মানুষের আসল স্বভাব জানতে অনেক দিন লাগে, আর তার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, যে মানুষটি পার্কে বসে বসে ওদের যাওয়া আসা লক্ষ করে সে যদি অসুস্থ হয়েই থাকে তাহলে সেটা হলো প্রেম রোগ।

প্রেম বর্জিত ভালোবাসার একমাত্র সন্তানটির জন্য এসকোলাস্টিকা পিসি ছিলেন স্নেহ ও সহমর্মিতার এক সুন্দর আধার। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তিনিই তাকে মানুষ করেছেন। ফারমিনা ডাজার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি পিসির চাইতে একজন সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীর মতোই বেশি আচরণ করেছেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার উপস্থিতি লক্ষ করা তাদের দুজনের জন্যই সময় কাটাবার একটা বিনোদনমূলক উপকরণে পরিণত হলো। দিনে চারবার, ছোট্ট ইভানজেলিস পার্কের মধ্যে দিয়ে আসা যাওয়ার সময়, উভয়েই, প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও প্রায় সর্বদাই কালো পোশাক পরা, কৃশকায়, ভীতু, সাধারণ দেখতে, গাছের নিচে বসে বই পড়ার ভান করা তরুণটিকে দ্রুত চোখে দেখতো। আর তরুণটি চোখ তুলে তার জীবনের দুই অনমনীয় উদাসীন রমণীকে একবারও তার দিকে না তাকিয়ে পার্কের মধ্য দিয়ে চলে যাবার দৃশ্যটি দেখবার আগেই, ওদের দুজনের মধ্যে যে আগে তাকে দেখতো সে তার হাসি চাপতে চাপতে বলতো, ওই যে, দেখা যাচ্ছে ওকে।

পিসি বলতেন, বেচারা! আমি সঙ্গে থাকি বলে ও তোমার কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না, কিন্তু তার অভিপ্রায় যদি তুচ্ছ ও হাল্কা না হয় তাহলে একদিন ও আসবেই এবং তোমাকে একটা চিঠি দেবে।

নানা রকম অসুবিধার কথা পূর্বাহ্নে অনুমান করে তিনি ফারমিনাকে নীরব সাংকেতিক ভাষায় কথা বলতে শেখালেন, নিষিদ্ধ প্রেমের ক্ষেত্রে যা ছিল এক অপরিহার্য কৌশল। এই সব ছেলেমিভরা অপ্রত্যাশিত ক্রীড়া কৌতুক ফারমিনা ডাজার চিত্তে এক অচেনা কৌতূহলের জন্ম দিল, কিন্তু ব্যাপারটা যে আরো অনেক দূর যেতে পারে সে কথা পরবর্তী কয়েক মাস ধরে তার মনেই হয় নি। কখন যে খেলাটা একটা সার্বক্ষণিক চিন্তায় পরিণত হল তা সে খেয়াল করতেই পারলো না। ওকে দেখার তাগিদে এখন তার রক্ত টগবগ করে ওঠে, আর একদিন রাতে সে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো, কারণ তার মনে হলো তার বিছানার পায়ের দিকের অন্ধকার থেকে ও যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর সে মনপ্রাণ দিয়ে কামনা করলো তার পিসির ভবিষ্যদ্বাণী যেন সত্য হয়, সে ঈশ্বরের প্রার্থনা জানালো ও যেন তাকে লেখা ওর চিঠিটা তার হাতে দেবার সাহস পায়, ও কি লিখেছে ফারমিনা শুধু সেটা জানতে চায়, আর কিছু না।

কিন্তু তার প্রার্থনা বিফলে গেল। বরং উল্টো ফল হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন তার মায়ের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলে তখনই ব্যাপারটা ঘটে। মা তার সত্তর পৃষ্ঠাব্যাপী প্রশংসায়পূর্ণ চিঠি ফারমিনাকে দেয়া থেকে পুত্রকে নিবৃত্ত করলেন, আর ওদিকে ফারমিনা বছরের বাকি দিনগুলি ব্যর্থ প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দিল। ডিসেম্বরের ছুটি এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক চিন্তা হতাশায় রূপান্তরিত হল, কেমন করে ছুটির ওই তিন মাস সে ফ্লোরেন্টিনোকে দেখতে পাবে, ফ্লোরেন্টিনোইবা কেমন করে তাকে দেখবে, তখন তো সে আর হেঁটে হেঁটে স্কুল যাবে না। বড় দিনের আগের রাতেও তার দুর্ভাবনার অবসান হল না, কিন্তু গির্জায় মধ্য রজনীর প্রার্থনার পর ভিড়ের মধ্যে ওকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে চমকে উঠলো, একটা প্রচণ্ড অস্থিরতায় তার হৃদয় মন মথিত হল। সে মাথা ঘোরাবার সাহস পেল না, বাবা আর পিসির মাঝখানে বসেছিল সে। ওরা যেন তার অস্থিরতা লক্ষ না করে সেজন্য নিজেকে তার নিয়ন্ত্রণ করতে হল। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে গির্জা থেকে বেরুবার সময় সে ওকে এতো কাছে অনুভব করলো, এতো পরিষ্কার ভাবে, যে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তির প্রভাবে তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হল, আর তখনই সে ওকে দেখতে পেল, তার চোখের কাছ থেকে এক হাতেরও কম দূরত্বে। সে দেখতে পেল তার হিমশীতল চোখ, তার বিষণ্ণ মুখ, ভালোবাসার আতঙ্কে তার প্রস্তরীভূত ঠোঁট। নিজের দুঃসাহসে আতঙ্কিত হয়ে সে পিসি এসকোলাস্টিকার হাত আঁকড়ে ধরল যেন সে পড়ে না যায়, আর পিসি তার হাতের লেসের দস্তানার মধ্য দিয়ে ওর বরফশীতল ঘাম দেখতে পেলেন, আর তার হাতে ঈষৎ চাপ দিয়ে তিনি তাকে তার নিঃশর্ত সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আর ওদিকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আতসবাজি আর ঢোলের বাদ্যধ্বনির মধ্যে, দরজায় দরজায় রঙিন আলোর মালার মধ্যে, শান্তির জন্য চিৎকার করা জনতার মধ্যে ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো একজন মানুষের মতো, তার অশ্রু জলের ভেতর দিয়ে আনন্দ উৎসব দেখতে দেখতে, সকাল পর্যন্ত লক্ষ্যহীনভাবে পথে পথে ঘুরলো, চোখ ধাঁধানো বিভ্রান্তির মধ্যে তার মনে হল, ঈশ্বর নয়, সে-ই যেন ওই রাতে পুনর্জন্মগ্রহণ করেছে। এর পরের সপ্তাহে দিবানিদ্রার জন্য নির্ধারিত সময়ে ফারমিনা ডাজাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় ফারমিনা ও তার পিসিকে দোরগোড়ায় বাদাম গাছগুলির নিচে বসে থাকতে দেখল সে এবং তখন থেকে তার চিত্তবিভ্রম আরো বেড়ে গেল। প্রথম দেখার সময় সেলাই ঘরে ওই অপরাহ্নে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে দৃশ্য দেখেছিল বর্তমানে তারই পুনরাবৃত্তি দেখল সে, এবার ঘরের বাইরে : মেয়েটি তার পিসিকে পড়া দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার স্কুলের ইউনিফর্ম ছাড়া ফারমিনাকে অন্য রকম দেখালো। সে এখন পরে আছে বহু ভাঁজ দেয়া একটা আঁটো জ্যাকেট, গ্রিক ধাচের, আর মাথায় জড়িয়ে রেখেছে তাজা গার্ডেনিয়া ফুলের একটা মালা, তাকে দেখাচ্ছিল মুকুট পরিহিতা কোনো দেবীর মতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা পার্কটিতে বসে থাকলো, তাকে যে দেখা যাবে সে সম্পর্কে সে সুনিশ্চিত ছিল। এবং এখন আর সে বই পড়ার ভান করলো না। সে চুপচাপ বসে থাকলে কোলের উপর তার খোলা বইটা রেখে, তার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ থাকলো কুহকিনী মেয়েটির ওপর, যার হৃদয়ের চোখ কিন্তু তার ওপর একবারও পড়লো না।

প্রথমে তার মনে হয়েছিল যে বাদাম গাছের নিচে পড়ালেখার ব্যাপারটা অপরিকল্পিত, বাড়ির ভেতরে সারাক্ষণ মেরামতের কাজ চলছিল, তাই এই ব্যবস্থা, কিন্তু পরবর্তী দিনগুলির অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝলো যে আগামী তিন মাস, প্রতিদিন অপরাহ্নে এই একই সময়ে, ফারমিনা ডাজাকে এখানে দেখা যাবে এবং ওই বিশ্বাস তাকে নতুন। আশায় পূর্ণ করলো। ও যে তাকে দেখেছে এমন কোনো আভাস সে পায় নি, কিন্তু ওর ঔদাসীন্যের মধ্যে এমন একটা দীপ্তি ছিল যা তাকে লেগে থাকতে উৎসাহ যোগালো। তারপর জানুয়ারির শেষ দিকে এক অপরাহে ওর পিসি তার চেয়ারের উপর বই খাতা রেখে, ভাইঝিকে দোরগোড়ায় একা ফেলে ভেতরে চলে গেলেন। আর বাদাম গাছ থেকে হলুদ পাতার রাশি ঝিরঝির করে বৃষ্টির মতো ওর মাথার ওপর পড়তে থাকলো। এটা একটা পূর্ব পরিকল্পিত সুযোগ এই উচ্চ চিন্তায় উদ্দীপিত হয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা রাস্তা অতিক্রম করে ফারমিনা ডাজার সামনে এসে দাঁড়ালো, এতো কাছে যে সে ওর নিঃশ্বাস পতনের শব্দ শুনলো, নাকে ফুলের গন্ধ পেলো, যে গন্ধ সে সারা জীবন ওর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে রাখবে। সে মাথা উঁচু করে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়ালো, মাত্র অর্ধশতাব্দি পরে আবারও সে যে ভাবে দাঁড়াবে, এবং ওই একই কারণে। সে বললো, আমি শুধু তোমাকে আমার একটা চিঠি গ্রহণ করতে বলছি।

ফারমিনা ডাজা তার কণ্ঠস্বর যে রকম শুনলো সে রকম হবে বলে ভাবে নি। তীক্ষ্ণ, পরিষ্কার, সুনিয়ন্ত্রিত, যার সঙ্গে তার বিষণ্ণ উদাসীন ভাবভঙ্গির কোনো মিল নেই। ওর এম্রয়ডারি থেকে চোখ না তুলে ফারমিনা জবাব দিল, আমার বাবার অনুমতি ছাড়া আমি এটা গ্রহণ করতে পারি না। ওর কণ্ঠের উষ্ণতায় ফ্লোরেন্টিনোর গায়ে কাঁটা দিল, ওর চাপা গলার সুরেলা ধ্বনি সে তার বাকি জীবনে ভুলবে না। কিন্তু সে নিজেকে স্থির রেখে দ্বিধাহীন ভাবে বললো, তাহলে সেটা নিয়ে এসো। তারপর তার আদেশের মধ্যে একটা অনুরোধের সুর লাগিয়ে তাকে একটু কোমল করলো, বললো, এটা জীবন মরণের ব্যাপার। ফারমিনা ডাজা তার দিকে মুখ তুলে তাকালো না, তার সেলাই বন্ধ করলো না, কিন্তু তার সিদ্ধান্তের দরজাটা একটু ফাঁক করে দিল, যে ফাঁক দিয়ে গোটা পৃথিবী ঢুকে পড়তে পারতো। ও বললো, প্রতিদিন বিকালে এসো, আর আমি আসন পরিবর্তন না করা পর্যন্ত অপেক্ষা কোরো।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সামনের সোমবারের পূর্ব পর্যন্ত ওর কথার অর্থ বুঝতে পারে নি। সে দিন তার ছোট্ট পার্কের বেঞ্চ থেকে সে একই দৃশ্য দেখলো, তবে একটু পরিবর্তনসহ। এসকোলাস্টিকা পিসি বাড়ির ভেতর যাবার পর ফারমিনা ডাজা উঠে দাঁড়ালো, তার পর অন্য চেয়ারটায় গিয়ে বসলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তখন রাস্তা পেরিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার কোটের কলারের ভাঁজ করা অংশে লাগানো ছিল একটা সাদা ক্যামেলিয়া ফুল। সে বললো, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হল এটা। ফারমিনা ডাজা ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো না, কিন্তু দ্রুত তার চারপাশটা দেখে নিল, গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে জনশূন্য রাস্তাঘাট দেখলো, বাতাসের ঝাঁপটায় মরা পাতাগুলির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য লক্ষ করলো। তারপর বললো, দাও আমাকে।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এক সময় ওকে তার সত্তর পৃষ্ঠার চিঠিটা দিতে চেয়েছিল কিন্তু পরে আধ পৃষ্ঠায় তার ধীর স্থির সুস্পষ্ট বক্তব্যটি তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়। সে প্রতিশ্রুতি দিল তার নিখুঁত বিশ্বস্ততার এবং তার চিরস্থায়ী ভালোবাসার। সে তার কোটের ভেতরের পকেট থেকে চিঠিটা বের করে সেলাইরত মেয়েটির বিচলিত চোখের সামনে তুলে ধরলো, মেয়েটি তখনো তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারে নি। সে আতঙ্কে প্রস্তরীভূত একটা হাতে কম্পমান নীল খামটা দেখল, সে তার এম্ব্রয়ডারির ফ্রেমটা উঁচু করে তুলে ধরলো যেন ও তার ওপর চিঠিটা ফেলে দিতে পারে, সে যে ওর আঙুলির কাঁপুনি দেখেছে সেটা সে স্বীকার করতে চাইলো না। আর তখনই ব্যাপারটা ঘটলো। বাদাম গাছের পাতার মধ্যে একটা পাখি নড়ে উঠলো আর তার পুরীষ ঝরে পড়লো সূচি কাজটির উপরে। ফারমিনা ডাজা দ্রুত ফ্রেমটা সরিয়ে নিয়ে চেয়ারের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল, ও যেন কী ঘটেছে তা দেখতে না পায়, আর তখন সে প্রথম বারের মতো ওর মুখের দিকে তাকালো, তার নিজের মুখ তখন যেন আগুনের তাপে লাল ও তাতানো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মুখে কিন্তু কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না, চিঠিটা হাতে ধরে সে শুধু বললো, এটা সুলক্ষণ। ফারমিনা ডাজা ওকে ধন্যবাদ জানালো, তার প্রথম হাসিটি ওকে উপহার দিল, তারপর ওর কাছ থেকে চিঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে, ভাঁজ করে, বডিসের ভেতর লুকিয়ে ফেললো। এর পর ফ্লেরেন্টিনো আরিজা তার কোটে লাগানো ক্যামেলিয়া ফুলটা খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলো, কিন্তু সে ওটা গ্রহণ করলো না, বললো, এ ফুল প্রতিশ্রুতির ফুল। তারপর ওর খেয়াল হল যে তাদের সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তখন ও আবার তার স্থৈর্যের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে বললো, এখন যাও, আর আমি না বলা পর্যন্ত ফিরে এসো না।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে প্রথম দেখার পরই তার মা সেটা জানতে পারেন, মাকে বলার আগেই, কারণ তিনি দেখলেন যে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ক্ষুধা নাই, সারা রাত বিছানায় শুধু এপাশ ওপাশ করে। কিন্তু ওর চিঠির উত্তরের প্রত্যাশায় থাকার সময় তার অবস্থা জটিলতর হল। সে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হল, সবুজ বমি করলো, তার আচার-আচরণে বৈকল্য দেখা দিল, মাঝে মাঝে তার মূৰ্ছা যাবার মতো হতে লাগলো। এ সব দেখে মা ভয় পেলেন। তার কাছে উপসর্গগুলি প্রেমের বিপর্যয়ের চাইতে কলেরার বিধ্বংসী রূপ বলেই বেশি মনে হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ধর্মপিতা, এক বৃদ্ধ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, মা তাঁকে ডেকে আনলেন। মা যখন গোপন শয্যাসঙ্গিনীর জীবনযাপন করছিলেন তখন থেকেই তিনি তাঁর কাছে নিজের যাবতীয় সুখ-দুঃখ ও সঙ্কটের কথা খুলে বলে এসেছেন। এই চিকিৎসকও রোগীর অবস্থা দেখে শঙ্কিত হলেন। নাড়ি দুর্বল, ঘন ভারি নিঃশ্বাস, মুমূর্ষ মানুষের মতো ফ্যাকাসে ঘাম হচ্ছে। কিন্তু তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন যে গায়ে জ্বর নেই, শরীরের কোথাও কোনো ব্যথা নেই, রোগীর একমাত্র সুনির্দিষ্ট অনুভূতি হল আশু মৃত্যুর জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তিনি কয়েকটি তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিচক্ষণ প্রশ্ন করলেন, প্রথমে রোগীকে, তারপর রোগীর মাকে এবং স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে প্রেমের উপসর্গ আর কলেরার উপসর্গের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। তিনি রোগীর স্নায়ুকে প্রশমিত করার জন্য লিনডেন ফুলের রস খেতে বললেন, তারপর বায়ু পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে অন্য কোথাও ঘুরে আসার পরামর্শ দিলেন, দূরত্বের মধ্যে সে হয়তো সান্ত্বনা খুঁজে পাবে। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা চাইলো শুধু নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দিতে, তাতেই তার আনন্দ।

<

Super User