সংসার – ইসলামিক উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
নাদিমের বিয়েটা অ্যাকসিডেন্টের মতো হঠাৎ করে হয়ে গেল। এখন তার বিয়ে করার মোটেই ইচ্ছা ছিল না। দাদির কথা রাখতে গিয়ে একরকম বাধ্য হয়ে রাজী হয়েছে। তাই বিয়ে পড়ানোর সময় অসন্তুষ্ট মনে তিনবার কবুল উচ্চারণ করেছে। সেই সময় তার মনে হয়েছে, যে কাজ অনিচ্ছায় ও অসন্তুষ্টির সঙ্গে করা হয়, তার পরিণতি কি ভালো হয়? না সেই কাজ ভালভাবে সমাধা হয়? কথাটা মনে হতে শিহরিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহপাকের কাছে দিলে দিলে ফরিয়াদ করল, তুমি সর্বশক্তিমান ও সব কিছুর মালিক। তুমি সমস্ত জীবের অন্তরের কথা জান। তোমার ঈশারাতেই এই কাজ সম্পন্ন হল। তুমি আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের ও শান্তির করো।আমাদেরকে তোমার ও তোমার হাবিবে পাকের প্রদর্শিত পথে চালিত করে ইহকাল ও পরকালে কামিয়াব করো।
রাজশাহী টাউনের প্রায় বিশ-বাইশ মাইল উত্তরে সারেংপুর গ্রাম। গ্রামটার পশ্চিম দিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মা। এই গ্রামে বেশ কয়েক ঘর ধনী ও মানী লোকের বাস। তাদের মধ্যে চৌধুরী বংশের খুব নাম-ডাক। তবে চৌধুরীদের এখন পড়ন্ত বেলা। নাদিম এই বংশের ছেলে। নাদিমের দাদাজীরা পাঁচ ভাই। বিরাট এলাকা নিয়ে তাদের বসতবাড়ি। সবার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী ও আত্মীয়-স্বজন যে কত, কে তার হিসাব রাখে। একই বাড়িতে পাঁচ ভাইয়ের সংসার। তবে তা ভাগাভাগি হয়ে যে যার প্রয়োজন মতো বাড়ি-ঘর করেছে। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে বিরাট বিরাট উঠোন। সেই উঠোনে চাষের মৌসুমি ধান ঝাড়াই-মাড়াই হয়। মেয়ে ও পুরুষের জন্য সেফটি ট্যাংকের ভিন্ন ভিন্ন পায়খানা আছে। প্রত্যেকের উঠোনের একপাশে একটা করে চাপকলও আছে। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বাড়ি ঘর তৈরি করলেও এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা আছে। বাইরে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকের পাঁচিলের গায়ে সদর দরজা আছে। নাদিমের দাদাজী সবার ছোট। পাঁচ ভাইয়ের কেউ বেঁচে নেই। এক সময় এই চৌধুরী বাড়ির খুব নাম ডাক ছিল। পাঁচ ভাইয়ের পাঁচটা দহলিজ ছিল। যে কোন আত্মীয়-স্বজন এলে দহজিলে থাকতে দেয়া হত। শুধু রাতের বেলা এক সময় কেউ সাথে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে তার আপনজনের সঙ্গে দেখা করিয়ে আনত। কালের পরিবর্তনে সে সব আর নেই। তবে ঐ যে একটা কথা প্রচলিত আছে, তাল পুকুরে ঘটি ডুবে না। সেই রকম অবস্থা এখন চৌধুরী বংশের। যে কোন আত্মীয়-স্বজন এলে এখন বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে মেহমানদারী করান হয়। নাদিমের দাদাজীর নাম ছিল আবদুস সোবহান চৌধুরী। তিনি খুব সৎ ও ধার্মিক ছিলেন। উনার স্ত্রী কবিরন বিবি চৌকস মহিলা। সংসার গুছানোয় যেমন পারদর্শিনী তেমনি স্বামীর সঙ্গে ছিল গভীর সম্পর্ক। ধর্ম কর্মও খুব মেনে চলেন। চার বৌয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া হতে দেখে সংসারের কাজ চার ভাগ করে চার বৌয়ের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন। পনের দিন অন্তর অন্তর বৌদের উপর ন্যস্ত কাজের পরিবর্তন হয়। স্বামী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলে রহিম সংসারের হাল ধরলেও আয়-ব্যয়ের হিসাব কবিরন বিবি রাখতেন। রহিমের বিয়ের ছমাসের মধ্যেই বৌ আফ্রিদার গুণে মুগ্ধ হয়ে সংসারের হিসাবপত্র তাকে বুঝিয়ে সিন্দুকের চাবি তার আচঁলে বেঁধে দিয়ে বললেন, মা, আজ থেকে এই সংসারের ভাল মন্দ সবকিছুর দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিলাম। এই দায়িত্ব যতদিন তোমার উপর থাকবে ততদিন সংসারের কারো সঙ্গে বেঈমানী করো না। কারো প্রতি অবিচার করো না।
আফ্রিদা শাশুড়ীর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলেছিল, আপনি দোয়া করুন আম্মা, আল্লাহ পাক যেন আমাকে আপনার উপদেশ মেনে চলার তওফিক দেন। সেই থেকে আফ্রিদা ও রহিম দুজনে সংসার চালিয়ে আসছে। তিন ভাই ও দুবোনকে মানুষ করে বিয়ে দিয়েছে।
নাদিমরা দুভাই ও পাঁচ বোন। পাঁচ বোনের মধ্যে দুবোন জমজ। তাদের একজন। পাঁচ বছর বয়সে পুকুরে ডুবে মারা গেছে। আর অন্যজন সাত বছর বয়সে ধনুষ্টংকর হয়ে মারা গেছে। বাকি তিন বোনের বাকেরা ও ফৌজিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মমতাজ ক্লাস নাইনে পড়ে। আর ছোট ভাই আবুল খায়ের ক্লাস সেভেনের ছাত্র। নাদিমের মেজ চাচার তিন ছেলে এক মেয়ে। সেজ চাচার দুছেলে দুমেয়ে। আর ছোট চাচার তিন বছরের ও এক বছরের শুধু দুটো ছেলে। আগের থেকে সংসার অনেক বড় হয়েছে। ছেলেদের মধ্যে নাদিম বড়। সেই জন্য এবং চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য সে সকলের প্রিয়পাত্র। তার মা আফ্রিদা এই গ্রামের ধনী হাজী আকবর আলীর কন্যা। যেমন রূপবতী তেমনি গুণবতী। চৌধুরী বাড়ির সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। যে। কোন ঘরে কোন উৎসব বা কাজ-কর্ম হলে আফ্রিদার উপস্থিতি থাকা চাই। তার কথামতো সবকিছু হয়। সব ঘরের ছেলে-মেয়েরা তাকে বড়মা বলে ডাকে।
নাদিম কলেজে পড়ার সময় থেকে আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে তাকে জামাই করার জন্য চেষ্টা করে আসছে। নাদিমের আব্বা রহিমের সাথে চাচাতো ভাই রহমত আলীর গাঢ় সম্পর্ক। রহমত আলী ও তার স্ত্রী হুসনেআরা নাদিমকে জামাই করতে খুব আগ্রহী। নাদিমকে তারা ছোটবেলা থেকে খুব স্নেহ করত। বিয়ের পর অনেক দিন তাদের কোন সন্তানাদি না হওয়ায় তারাই এক রকম নাদিমকে মানুষ করেছে। পরে তাদের মাত্র একটা মেয়ে হয়েছে। তার নাম রশিদা। রশিদা এখন ক্লাস এইটে পড়ছে। নাদিমকে জামাই করবে ভেবে তাকে আগের থেকে অনেক বেশি স্নেহ করে। রহমত আলী সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট। সে যেমন সাংসারিক প্রয়োজনীয় কোন জিনিস কারো কাছ থেকে নেয় না, তেমনি নিজের জিনিসও কাউকে দেয় না। কিন্তু নাদিমের জন্য সাত খুন মাফ। যখন যা প্রয়োজন নাদিম এসে চাইলেই খুশি মনে দিয়ে দেয়। নাদিম হুসনেআরাকে ছোট বৌ বলে ডাকে। রহমত আলী সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র একটা ঘরে চাবি দিয়ে রাখে। নাদিমের যখন কোন কিছুর দরকার হয় হুসনেআরার কাছে এসে বলবে, ছোট বৌ চাবিটা দাও। হুসনেআরা আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে তার হাতে দিয়ে দেয়। যেদিন রহমত আলীর ঘরে মেহমান কুটুম আসে অথবা ভাল কিছু রান্না হয়, সেদিন নাদিমকে দাওয়াত করে খাওয়াবে। নাদিমও ছোটবেলা থেকে তাদেরকে খুব শ্রদ্ধা করে।
রশিদার গায়ের রং কাল হলেও দেখতে-শুনতে ভাল। বাপ-মার একমাত্র সন্তান বলে হয়ত একটু উগ্র ধরনের। তাকে কেউ কিছু বলে পার পায় না। একটা বললে সাতটা শুনিয়ে দেয়। তবে নাদিমকে খুব ভয় পায়। এই রকম স্বভাবের জন্যে সে ছোট বেলা থেকে তার চড়-চাপটা খেয়ে আসছে।
নাদিম বি.এ. পাস করে যখন গোদাগাড়িহাই স্কুলে মাস্টারি করতে লাগল তখন রহমত আলী একদিন নাদিমের আব্বাকে বলল, আমি রশিদাকেনাদিমের হাতে দিতে চাই।
রহিম বলল, আমার মেজ ও ছোট শালী নাদিমকে জামাই করবে বলে অনেক দিন আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া আমার মামাতো ভাই আফসু ও খালাত ভাই কাদের এবং বড় বুবুও প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তোমাকে এখন কিছু বলতে পারছি না, পরে জানাব।
রহমত আলী চিন্তা করল, ওরা হয়ত অনেক কিছু যৌতুক দেয়ার কথা বলেছে, তাই এরকম বলছে। বলল, রশিদা আমাদের একমাত্র মেয়ে। পরে ওরাই তো আমাদের সব কিছু পাবে, তবু আমি এখন নাদিমের নামে পাঁচ বিঘা ধানী জমি লিখে দেব।
রহিম বলল, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। যৌতুকের কথা যা বললে তা আর কোনদিন মুখে উচ্চারণ করো না। জান না, বিয়েতে লেনদেন হারাম? নাদিম এসব কথা শুনলে খুব রেগে যাবে। সে কি ধরনের ছেলে, তা তো জান। আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলে দেখি। তা ছাড়া নাদিমেরও মতামত নিতে হবে, আম্মাকেও জানাতে হবে। সেদিন আর এ ব্যাপারে কোন কথা হল না।
ঐ দিন রাতে রহিম স্ত্রীকে রহমত আলীর কথা জানাল।
আফ্রিদা বলল, রশিদা একটু খরখরি আর রং কাল। নাদিম যদি মত দেয়, তা হলে আমার কোন অমত নেই। তবে তুমিও তো জান, বড় বুবু ও জয়নাব অনেক আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে।
রহিম বলল, শুধু তারা কেন, আমাদের আত্মীয়দের মধ্যেও অনেকে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। ওসব কথা বাদ দিয়ে বল, রহমত আলীকে কি বলব?
আফ্রিদা বলল, আমরা যাই বলি না কেন সবার আগে নাদিমের মতামত নিতে হবে তার উপর আম্মা রয়েছেন। ওনাকে না জানিয়ে, মতামত না নিয়ে আমরা কিছু করতে পারি না।
রহিম বলল, আমি সে কথা রহমত আলীকে বলেছি।
আফ্রিদা বলল, আমার মতে কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে না দেয়াই ভাল। কারণ একজনের মেয়েকে বৌ করলে অন্যজন মনে কষ্ট পাবে।
রহিম বলল, কথাটা তুমি মন্দ বলনি। তবে কি জান, যার যেখানে হুকুম আছে তার সেখানেই হবে।
আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে নাদিমের মা-বাপের কাছে সুবিধে করতে না পেরে তার দাদী কবিরন বিবির কাছে প্রস্তাব দিতে লাগল।
কবিরন বিবি খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। একদিন চার ছেলেকে ডেকে নাদিমের বিয়ের প্রস্তাবের কথা বলে আলোচনা করে ঠিক করলেন, কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে দেবেন না। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় অন্য জায়গায় বিয়ের ব্যবস্থা করতে ছেলেদেরকে বললেন, তাই প্রায় আঠার-বিশ মাইল দূরের এক গ্রামের জানাশোনা বংশের একটা ভাল মেয়ের খোঁজ পেয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে নাদিমের বিয়ে দিয়ে দিলেন।
মেয়ের বাবা শিহাব নাদিমের মেজ দাদাজীর মেজ ছেলে বাতেনের ক্লাসফ্রেণ্ড ছিল। গোদাগাড়িতে তখন হাইস্কুল থাকলেও কলেজ ছিল না। তাই বাতেন রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়েছে। সেই সময় সে প্রেমতলী গ্রামের বাড়িতে লজিং থাকত। সেই বাড়ির ছেলে শিহাবও ইন্টারে পড়ত। ফলে দুজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর দুজনেরই বাবা মারা যান। তাই বাতেন যেমন পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়, তেমনি শিহাবও বন্ধ করে দেয়। সে সব অনেক আগের ব্যাপার হলেও তারা আজও সখ্যতা বজায় রেখেছে। বছরের বিভিন্ন সময় পিঠা, ফল-পাকাড়ি নিয়ে দুজন দুজনের বাড়িতে যাতায়াত করে। শিহাব নাদিমের সম্বন্ধে সব কিছু জেনে তাকে জামাই করার জন্য একদিন বন্ধু বাতেনকে বলল।
বাতেন বলল, ভাইপো বলে বলছি না, ছেলে হিসাবে নাদিম সত্যিই খুব ভাল। উপযুক্ত মেয়ে থাকলে আমি তাকে জামাই করতাম। ছেলের বাপের সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাব।
শিহাব বাড়ি চলে যাওয়ার পর একদিন বাতেন রহিমকে শিহাবের কথা বলে বলল, তোমরা তো জান আমি একসময় তাদের বাড়িতে থেকে কলেজে পড়েছি। ওদের অবস্থা ভালো বংশও ভালো। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা ছোট। ক্লাস থ্রী না ফোরে পড়ে। মেয়েটাই বড়। গত বছর ম্যাট্রিক পাস করেছে। দেখতে-শুনতে খুব ভাল। আর শিহাবকে তো তোমরা সবাই চেন।
চাচাতো ভাইয়ের কথা শুনে রহিমের মায়ের ও স্ত্রীর কথা মনে পড়ল, আত্মীয়দের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে না দেয়াই ভাল। কারণ একজনের মেয়েকে বৌ করলে অন্যরা মনে কষ্ট পাবে। চিন্তা করল, এখানে বিয়ে হলে কোন আত্মীয়ই মনে কষ্ট পাবে না। বলল, আমার কোন অমত নেই। তুমি আম্মার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বল।
বাতেন একসময় ছোট চাচীর কাছে এসে প্রস্তাবটা পাড়ল।
কবিরন বিবি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তিনিও শিহাবকে চেনেন। যতবার শিহাব এসেছে ততবার বাতেনের সাথে এসে কদমবুসি করে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করেছে। ভাবলেন, এখানে নাদিমের বিয়ে দেয়া চলে। হঠাৎ ওনার মনে হল, কোন আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে নাদিমের বিয়ে হলে বোধ হয় ভাল হত। শেষমেষ মনকে শক্ত করে বাতেনকে বললেন, তুমি তো ওদের বাড়িতে থেকে দুবছর লেখাপড়া করেছ। এখনও যাতায়াত কর। মেয়েকে নিশ্চয় দেখেছ? আর ওদের বংশপরিচয়ও জেনেছ?
বাতেন বলল, জি, আমার কাছে সবকিছু ভাল মনে হয়েছে বলেইতো আপনার কাছে প্রস্তাব দিলাম। নাদিম আমাদের ছেলে। যেখানে-সেখানে বা যেমন-তেমন মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে পারি না।
তুমি কি রহিমকে কথাটা বলেছ?
জি, বলেছি। শুনে আপনাকে বলতে বলল।
ঠিক আছে, তুমি এখন যাও। ভেবে চিন্তে পরে তোমাকে জানাব।
বাতেন চলে যাওয়ার পর কবিরন বিবি রহিম ও আফ্রিদাকে ডেকে তার কথা বলে মতামত জিজ্ঞেস করলেন।
রহিম বলল, আম্মা, আপনি ভাল বুঝবেন কাকেন; তাতে আমার কোন দ্বিমত নেই।
বড়মা কিছু বলবে? কবিরন বিবি আফ্রিদাকে বড়মা বলে ডাকেন।
জি না আম্মা, আমার কিছু বলার নেই। তবে নাদিমকে একবার জিজ্ঞেস করলে ভাল হয়।
নাদিম কি তার কোন আত্মীয়ের বা অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ করে?
এ ব্যাপারে সে আমাকে কোন দিন কিছু বলে নি। আমার মনে হয়, সে এসব নিয়ে এখনও মাথা ঘামায়নি।
তোমরা এবার যাও। এসব কথা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করো না। আর নাদিমকেও কিছু বলল না। যা বলার তাকে আমি বলব।
কয়েকদিন পরে কবিরন বিবি সব ছেলেদের সাথে আলাপ করে বাতেনকে ডেকে বললেন, তুমি দুচার দিনের মধ্যে প্রেমতলী যাও। গোপনে গ্রামের পাঁচজনের কাছে শিহাবদের নানিয়েল ও দাদিয়েলদের খোঁজ-খবর নাও। উভয় বংশের লোকজন কোন গর্হিত কাজ করেছে কিনা, কেউ সুধখোর ও মদখোর ছিল কিনা, কোন মেয়ে বংশের মুখে কলঙ্ক দিয়েছে কিনা সব কিছু জানার চেষ্টা করবে। যদি এইসব তাদের মধ্যে কেউ করে না থাকে, তা হলে শিহাবকে শুধু তার মেয়েকে নিয়ে আসতে বলবে। আমি কাজটা গোপনে করতে চাই। পরে তারা ধুমধাম করে যা করতে চায় করবে।
বাতেন বলল, ঠিক আছে চাচি, তাই হবে বলে ওনার কাছ থেকে চলে এল।
একদিন কবিরন বিবি নাদিমকে ডেকে পাঠালেন।
নাদিম এসে বলল, আমাকে ডেকেছেন দাদি?
কবিরন বিবি বললেন, হ্যাঁ ভাই, বস। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
নাদিম দাদির পাশে বসে বলল, কি কথা বলবেন বলুন।
তুমি উপযুক্ত হয়েছ, এবার আমি তোমার বিয়ে দিতে চাই।
বিয়ের কথা শুনে নাদিম লজ্জা পেয়ে মথা নিচু করে বলল, এ ব্যাপারে আমাকে বলছেন কেন? আব্বা-আম্মাকে বলুন। তবে আমার ইচ্ছা-বলে থেমে গেল।
কি হল, থামলে কেন? বল তোমার কি ইচ্চা? আমি কিন্তু একটা ভাল মেয়ের খোঁজ পেয়ে লোক লাগিয়েছি। যদি সবকিছু মনের মতো হয়, তা হলে কয়েকদিনের মধ্যে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করব। তোমার আব্বা, আম্মা ও চাচাদেরকে জানিয়েছি। তারাও তোমাদের বিয়ে দিতে চায়। তাই তোমার মতামত জানার জন্য ডেকেছি।
আপনারা যা করবেন তাতে আমার কোনো অমত নেই। তবে আমার ইচ্ছা, ভালো বংশের কোন গরিব ঘরের মেয়েকে বিয়ে করব।
কেন দাদু? বড়লোকের মেয়েরা কি ভাল না? হয়তো তাদের মধ্যে অনেকে ধর্মীয় শিক্ষা না পেয়ে একটু-আধটু খারাপ হতে পারে। তাই বলে সবাই খারাপ, একথা ভাবছ।
কেন?
না দাদি, বড়লোকের মেয়েরা খারাপ একথা বলছি না। আমার চিন্তাধারাটা একটু অন্যরকম।
বল, কি তোমার চিন্তাধারা?
বড়লোকের মেয়েরা যেমন বেশি আরামপ্রিয় হয় তেমনি খাওয়া-পরার ব্যাপারেও বাছ-বিচার করে। সে মেয়েকে যদি স্বামীর ঘরে এসে পরিশ্রম করতে হয় অথবা খাওয়া-দাওয়া ও পোশাক-পরিচ্ছদ বাপের বাড়ির তুলনায় নিম্নমানের হয়, তা হলে অনেক দুঃখ পায়। উপায়ান্তর না দেখে অনেকে হয়ত নিজের ভাগ্যের কথা মনে করে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে; কিন্তু মনের দুঃখটা তার চিরসাথী হয়ে থাকে। ফলে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ী ও বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গে ঝগড়া করে। কাউকে সে খুশি মনে গ্রহণ করতে পারে না। তখন সংসারে অশান্তি নেমে আসে। অপরপক্ষে যদি কোন ভাল বংশের গরিব মেয়েকে বিয়ে করা যায়, তা হলে মেয়েটা বাপ-মার ঘরে যা খেয়েছে। পরেছে তার চেয়ে স্বামীর বাড়িতে ভাল খাওয়া-পরা পেয়ে খুব শান্তি পায় এবং শ্বশুর বাড়ির সবাইকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। এরা সাধারণত পরিশ্রমী ও খুব স্বামীভক্ত হয়। আমি মনে করি, প্রত্যেক বাপ-মার উচিত মেয়েদেরকে বিলাসিতায় আরামপ্রিয় না করে মানুষ করা।
তোমার চিন্তাধারাটা মন্দ নয়। তবে কি জান ভাই, সুখ-শান্তি তকদিরের ব্যাপার। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরিবদের চালচলন খুব নিম্নমানের হয়। তাদের। মনমানসিকতাও নিম্নমানের। তা ছাড়া প্রত্যেক বংশের মান-সম্মান বলে একটা কথা আছে। সব থেকে উত্তম হল সমপর্যায়ে আত্মীয়তা করা।
এটা অতি সত্য কথা আপনি বলেছেন।
তা তুমি তেমন কোন মেয়ের সন্ধান পেয়েছ নাকি?
না দাদি, আমি ওসব ব্যাপার নিয়ে এখনও কোন চিন্তা করিনি। আপনাকে শুধু আমার মনের ইচ্ছাটা জানালাম।
নাদিম দাদির কাছ থেকে মায়ের কাছে এসে বলল, দাদি আমার বিয়ের ব্যবস্থা। করছেন, এ ব্যাপারে তুমি কি কিছু জান?
আফ্রিদা বলল, তোর মেজ চাচা তার বন্ধুর মেয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। তুই কার কাছে শুনলি?
একটু আগে দাদি আমার মতামত জিজ্ঞেস করলেন।
কি বললি?
বললাম, আপনাদের মতামতই আমার মত।
আফ্রিদা ছেলেকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
কয়েকদিন পর বাতেন ছোট চাচির কথামতো প্রেমতলী গিয়ে শিহাবদের বাড়িতে থেকে গোপনে গ্রামের লোকজনদের কাছে সবকিছু খোঁজ-খবর নিল। কোন দোষ পেল। না। শিহাব তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করেছে। দুতিন দিন থেকে শিহাব ও তার স্ত্রীকে বিয়ের কথা বলে শিহাবকে ও তার মেয়ে সাজেদাকে নিয়ে ফিরে এল।
সাজেদাকে দেখে বাড়ির ছোট বড় সবাই অবাক। এত সুন্দর মেয়ে তারা এর আগে দেখেনি। এক কথায় অপরূপা। শালওয়ার-কামিজের উপর বোরখা পরে এসেছিল। বোরখা খুলতে যারা সেখানে ছিল সবাই চমকে উটল। সাজেদাকে নাশতা খাইয়ে বাতেনের স্ত্রী জোহরা তাকে সাথে করে কবিরন বিবির কাছে নিয়ে এসে সাজেদার পরিচয় দিল। তারপর সাজেদাকে বলল, কদমবুসি কর-ইনি আমার ছোট শাশুড়ী।
সাদেজা কদমবুসি করতে কবিরন বিবি তার হাত ধরে পাশে বসালেন। তারপর দোয়া করে সাজেদার আপাদমস্তক দেখে আলহামদু লিল্লাহ বলে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?
মোসাম্মৎ সাজেদা বেগম।
লেখাপড়া কতদূর করেছ।
গত বছর ম্যাট্রিক পাস করেছি।
শুনে খুশি হলাম। তারপর জোহরাকে বললেন, বড়মার কাছে নিয়ে যাও।
জোহরা আসবার সময় সাজেদাকে বলল, এবার যার কাছে নিয়ে যাচ্ছি তাকেও কদমবুসি করবে।
আফ্রিদা রান্নাঘরে রান্না করছিল। জোহরা সাজেদাকে তার ঘরে নিয়ে এসে একটা মেয়েকে দিয়ে আফ্রিদাকে ডেকে পাঠাল। সে ঘরে এলে জোহরা বলল, তোমার ভাসুরের বন্ধু শিহাব ভাইয়ের মেয়ে সাজেদা।
আফ্রিদা সাজেদাকে দেখে খুব খুশি হল। সে কদমবুসি করতে এলে জড়িয়ে ধরে মাথায় ও মুখে চুমো খেয়ে বলল, থাক মা থাক, বেঁচে থাক সুখী হও। তারপর জোহরাকে বলল, বুবু, তুমি একে নিয়ে একটু বস, আমি কিছু নাশতা নিয়ে আসি।
জোহরা বলল, আমি এখন কিছু খাব না। আর সাজেদাকেও নাশতা খাইয়ে নিয়ে এলাম। তোর পছন্দ হয়েছে কিনা বল।
আফ্রিদা বলল, এমন মেয়ে কার না পছন্দ হবে? আল্লাহ আল্লাহ করে কাজটা মিটে গেলে হয়।
জোহরা সাজেদাকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল।
বাতেনের চার ছেলে দুমেয়ে। বড় মেয়ে আয়েশা ও বড় ছেলে রফিকের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ ছেলে রিয়াজুলের সঙ্গে নাদিমের খুব ভাব, এক সঙ্গেই বি.এ. পাশ করেছে। রিয়াজুল বাজারে কাপড়ের দোকান দিয়েছে। ইন্টারে পড়ার সময় ছোট ফুপুর মেয়ে হালিমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। হালিমা তখন ক্লাস টেনে পড়ত। সেজ ছেলে রেজাউল ক্লাস টেনে আর ছোট ছেলে রশিদুল সেভেনে পড়ে। ছোট বোন আমেনা ক্লাস ফোরের ছাত্রী।
পরের দিন বৃহস্পতিবার। নাদিম স্কুল ছুটির পর ঘরে এসে ভাত খেয়ে বিছানায় কাত হতে তন্দ্রামতো এসেছিল। কারো ডাকে তন্দ্রাভাব কেটে যেতে তাকিয়ে দেখল, রফিক ভাইয়ের স্ত্রী জুলেখা দাঁড়িয়ে। বলল কি ব্যাপার ভাবি, ডাকাডাকি করছ কেন?
জুলেখা বলল, হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমার সঙ্গে কনে দেখতে যাবে।
নাদিম এসব ব্যাপার কিছুই জানে না। জুলেখার চাচাতো বোন সায়লা প্রায় তাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। বেশ কিছুদিন আগে একদিন নাদিম কি-একটা দরকারে রফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে সায়লাকে দেখে। সায়লা দেখতে মোটামুটি সুন্দর। বি.এ. পড়ছে। নাদিমকে দেখে সায়লা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নাদিম জুলেখা ভাবিকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কোথায়?
জুলেখা বলল, কোথায় গেছে বলে যায়নি। কেন, কোন দরকার আছে নাকি?
নাদিম বলল, হ্যাঁ, একটু দরকার ছিল। যাক পরে আসব বলে সে ফিরে আসতে লাগল।
জুলেখা বলল, নাদিম ভাই, শোন। না
দিম দরজার বাইরে চলে এসেছিল, সেখানে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু বলবে?
জুলেখা বলল, হ্যাঁ, ভিতরে এস বলছি। নাদিম ভিতরে এলে বলল, তুমি তো সায়লাকে কয়েকবার দেখেছ, পছন্দ হলে বল, বিয়ের ব্যবস্থা করব।
নাদিম বলল, আমি এখনও বিয়ে করার কথা ভাবি নি। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
জুলেখার মনে হল সায়লাকে নাদিমের পছন্দ হয়নি।
আজ জুলেখা ভাবির মুখে কনে দেখার কথা শুনে নাদিম ভাবল, সায়লা হয়ত এসেছে, তাই ডাকতে এসেছে। বলল, কনে আমার দেখার দরকার নেই। সে কাজ মুরব্বিরা করছেন।
মুরুব্বিদের হুকুমে তাদেরই নিবার্চিত কনেকে দেখাবার জন্য আমার সঙ্গে যেতে বলছি।
নাদিম উঠে বসে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই।
আমি আর কনে দেখে কি করব? মুরব্বিরা যখন দেখে নির্বাচিত করেছেন।
বা-রে, তাই বলে যে তোমার জীবনসঙ্গিনী হবে তাকে দেখে পছন্দ করবে না, এ কেমন কথা?
দেখে আমার যদি পছন্দ না হয়?
আগে দেখ, তারপর পছন্দ-অপছন্দের কথা। সত্যি কথা বলতে কি এত সুন্দরী মেয়ে আর দেখিনি।
অত পাম দিতে হবে না, চল যাচ্ছি।
জুলেখা তাকে সঙ্গে করে নিজের ঘরে নিয়ে এল।
বাতেন শিহাবদের বাড়িতে যাতায়াত করে বলে সাজেদা ছোটবেলায় চাচা বলে ডেকেছে। বড় হয়ে আব্বার বন্ধু জেনে তাকে আব্বার মত সম্মান করে। এবারে বাতেন চাচা গিয়ে যখন আব্বা, আম্মা ও দাদির সঙ্গে তার বিয়ের কথা বলে তখন সে আড়াল থেকে শুনেছে। তারপর এখানে আসবার সময় দাদি তাকে ঘটনাটা বলে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। নাদিমের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য আব্বা যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাও জানে। জুলেখা ভাবির কাছে নাদিমের নাম শুনে তাকে দেখার জন্য মনের মধ্যে তাগিদ অনুভব করেছে। তাই আজ যখন জুলেখা ভাবি বলল, কি ভাই, বিয়ের আগে বরকে একবার দেখতে ইচ্ছা করছে নাকি? তখন হ্যাঁ বলার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লজ্জায় তা বলতে পারে নি, মাথা নিচু করে ছিল। জুলেখা ভাবি তার চিবুক তুলে ধরে বলল, আরে ভাই এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? তোমাদের মতো বয়স আমাদেরও একদিন ছিল। চুপ করে থাকাটাই কিন্তু সম্মতির লক্ষণ বলে চিবুক ছেড়ে দিয়ে ছোট ননদ আমেনাকে পাশে দেখে বলল, তুই এখানে থাক, আমি নাদিম ভাইকে নিয়ে আসি।
জুলেখা চলে যাওয়ার পর সাজেদা এতক্ষণ দুরুদুরু বুকে নাদিমের কথা চিন্তা করতে করতে আমেনার সঙ্গে কথা বলছিল। জুলেখা ঘরে ঢুকলে তার দিকে তাকাতে গিয়ে দরজায় একজন সুদর্শন যুবককে দেখে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ভাবল, নিশ্চয় নাদিম।
নাদিম ভাবীর সঙ্গে এসে সাজেদাকে দেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাজেদা মাথা নিচু করে নিলে তাকে ভাল করে দেখে খুব অবাক হল। সত্যি মেয়েটা অত্যন্ত সুন্দরী।
জুলেখা দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে নাদিমকে বলল, একেই মুরব্বিরা তোমার জন্য নির্বাচিত করেছেন। তারপর একটা হাত ধরে ভিতরে এনে বলল, কি ব্যাপার, দুজনেই যে চুপচাপ? ঠিক আছে, আমরা চলে যাচ্ছি। তোমরা দুজন দুজনকে ভাল করে দেখ, কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস কর। আমি তোমাদের জন্যে নাশতা নিয়ে আসি। তারপর আমেনাকে সাথে করে বেরিয়ে গেল।
সাজেদাকে দেখে নাদিমের একটা হাদিস মনে পড়ল, আল্লাহ পাকের রসুল (দঃ) বলেছেন, যার বেশি ধন সম্পত্তি থাকে, সে ধনের অহঙ্কার করে। যে খুব শক্তিশালী, সে শক্তির অহংকার করে। যার রূপ থাকে, সে রূপের অহংকার করে। এই মেয়ে খুব রূপসী, এরও নিশ্চয় রূপের অহংকার আছে। এই কথা ভেবে সে এতক্ষণ শংকিত মনে চিন্তা করছিল, এর যদি রূপের অহংকার থাকে তা হলে একে বিয়ে করে আমি কি সুখী হতে পারব? না আমি ওকে সুখী করতে পারব?
ভাবি ও আমেনা চলে যাওয়ার পর নাদিম সালাম দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করল।
সাজেদা একবার মাথা তুলে নাদিমের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে নাম বলল।
নামের অর্থ জানেন?
না, আপনি বলে দিন।
ধার্মিক। ধার্মিক কাকে বলে জানেন?
জানব না কেন? যে ধর্মের আইন মেনে চলে তাকে ধার্মিক বলে।
আপনি কি ধর্মের আইন মেনে চলেন?
যতটা সম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করি। আপনার নামের অর্থটা বলুন।
আমার নাম জানেন দেখছি। পুরো নাম জানেন?
না।
আসেফ নাদিম।
এবার অর্থটা বলুন।
যোগ্য সঙ্গী।
দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।
ঠিক আছে, বসা লাগবে না। আরো দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করব। কিছু মনে করবেন না তো?
মনে করার কি আছে। করুন, কি জিজ্ঞেস করবেন।
মাথায় কাপড় দেননি কেন? মেয়েদের মাথার চুল গায়ের মোহররাম লোককে দেখান হারাম এটা কি জানেন?
সাজেদা ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বলল, মেয়েদের মাথায় কাপড় দিতে হয় জানতাম, কিন্তু যা বললেন তা জানতাম না।
নাদিম বলল, মেয়েদের শুধু মাথায় কাপড় দিলেই আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ)-এর হুকুম মানা হয় না। এমনভাবে মাথা ঢাকতে হবে যেন চুল পরপুরুষের নজরে না পড়ে। সেই জন্যেই উত্তম পন্থা হল, আলাদা রুমাল দিয়ে চুলসহ পুরো মাথা বেঁধে রাখা। যাক, নিশ্চয় লেখাপড়া করেছেন?
এস.এস.সি. পাশ করেছি।
বেহেশতী জেওর পড়েছেন?
না।
বেহেশতী জেওর প্রত্যেক সাবালক নর-নারীর পড়া অবশ্য কর্তব্য। পড়ে দেখবেন, আমার কথা কতটা সত্য।
এতক্ষণ কথা বলতে বলতে সাজেদার সাহস বেড়ে গেছে। বলল, এবার আমি দুএকটা প্রশ্ন করতে পারি?
নিশ্চয়।
কুরআন শরীফে প্রত্যেক সূরার আগে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লেখা আছে। কিন্তু একটা সূরার আগে তা নেই, সেই সূরাটার নাম কি? আর সেই সূরাটা কত পারায়? (এটা সে যার কাছে কুরআন পড়া শিখেছে তার কাছে জেনেছিল)।
দশ পারায়, সূরা তওবা।
এমন সময় জুলেখা নাশতা নিয়ে এসে নাদিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আরে তুমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছ? বস বস, নাশতা খাবে?
নাদিম বলল, না ভাবি, আমি এখন কিছু খাব না। তুমি মেহমানকে নাশতা করাও, আমি যাই বলে চলে যেতে উদ্যত হল।
জুলেখা বলল, দাঁড়াও, যাওয়ার আগে বলে যাও কেমন দেখলে?
পরে বলব, বলে নাদিম চলে গেল।
জুলেখা সাজেদাকে নাশতা খাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, নাদিম ভাইকে কেমন মনে হল?
সাজেদা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ভাল।
ঐদিন রাতেই সাজেদার সঙ্গে নাদিমের বিয়ে হয়ে গেল।
<