০৫.

আলাউদ্দিন মীর একদিন সুলতান খাঁনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

সুলতান খাঁন এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হননি। কাঁচারীতে বসে একজন কামলাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আলাউদ্দিন মীরকে আসতে দেখে তাকে কাজ করতে যেতে বললেন।

আলাউদ্দিন মীর কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বললেন, আপনার অসুখের কথা শুনেছিলাম, কাজের ব্যস্ততায় আসতে পারিনি। এখন কেমন আছেন?

সুলতান খাঁন তাকে বসতে বলে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভাল। আপনি কেমন আছেন?

সংসারের ঝামেলায় ভালো আর থাকতে পারছি কই। নানান ঝামেলায় একরকম কেটে যাচ্ছে। তা মাহবুব কোথায়?

 সে তো কয়েকদিন আগে ঢাকা চলে গেছে। টাকার ব্যাপারে মাহবুব কী আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল?

প্রথমে করেনি। আমি যখন টাকা দিয়ে বললাম, তোমার আব্বাকে বলো এটাই শেষ। আমার কাছে তার আর কোনো টাকা পাওনা নেই। তখন জিজ্ঞেস করল, আপনার কাছে আব্বার কিসের টাকা পাওনা ছিল? আমি আপনার পুকুর সাফকবলা রাখার কথা বললাম। আমার কথা শুনে মাহবুবকে খুব অবাক হতে দেখলাম। সে কী ব্যাপারটা জানত না?

সুলতান খাঁন চিন্তিত মুখে বললেন, জানালে লেখাপড়া করত না ভেবে জানাইনি। তারপর বললেন, জানানটা ঠিক হয়নি আপনার। কয়েক মাস পরে পরীক্ষা। আমার তো ভয় হচ্ছে লেখাপড়া বন্ধ করে না দেয়।

আপনার কথাই ঠিক, এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে। তবে আপনি যা ভাবছেন তা নাও করতে পারে। কয়েক মাস পরে যখন পরীক্ষা বললেন, তখন পরীক্ষা সে দেবেই। তারপর হয়তো বন্ধ করে দিতে পারে। মাহবুব হিরের টুকরো ছেলে। দেখবেন, এবারেও ভালো রেজাল্ট করবে।

আপনি টাকা দিয়ে সাহায্য না করলে ওকে এতদূর লেখাপড়া করাতে পারতাম না।

কি যে বলেন, টাকা পয়সা থাকলেই যদি লেখা পড়া হত, তা হলে আমার ছেলেদের কেন হল না? আসলে মাথা ভালো হতে হবে। এই দেখুন না, আমার মেয়ে। তাহেরা, তার মাথা ভালো, তাই এক চান্সে বি. এ. পাস করে ফেলল। এবার বিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।

তা দিচ্ছেন না কেন? ওর মতো মেয়ের পাত্রের অভাব আছে নাকি? ভালো ছেলে দেখে এবার ব্যবস্থা করুন।

পাত্রের তো অভাব নেই। রোজ একটা না একটা সম্বন্ধ আসছেই। কিন্তু মা আমার রাজি হচ্ছে না।

সে কি? রাজি হচ্ছে না কেন জিজ্ঞেস করেন নি?

বাবা হয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করি কি করে? ওর মা জিজ্ঞেস করতে বলেছে, সে মাহবুবকে পছন্দ করে। কথাটা কয়েকদিন আগে ওর মা আমাকে বলল। এখন আপনাদের উপর সব কিছু নির্ভর করছে। আগে জানতে পারলে মাহবুবের লেখাপড়ার সব খরচ আমিই দিতাম। আপনাকে দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে হত না। যা হওয়ার হয়েছে। আপনাদের মতামত পেলে দুএক দিনের মধ্যে দলিল ফিরিয়ে দেব। আর মাহবুবের লেখাপড়া শেষ করতে যা লাগবে সব দেব। জানেন তো, তাহেরা পাঁচ ভাইয়ের এক বোন। মাহবুব শিক্ষিত বলে তারা তাকে খুব সম্মান করে। ছোট বোনের স্বামী হলে মাথায় করে রাখবে। বিয়ের সময় যৌতুক যা দেওয়ার তা তো দেবই, তা ছাড়াও দশ বিঘে জমি মাহবুবের নামে লিখে দেব।

সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের সাহস দেখে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে অনেক্ষণ চুপ করে রইলেন।

আলাউদ্দিন মীর তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, আমার কথায় আপনি মনে কিছু নেবেন না। আমার মনে হয় প্রস্তাবটা মেনে নিলে আমাদের উভয়েরই মঙ্গল হবে। তবু যখন সুলতান খাঁন কিছু বললেন না তখন আবার বললেন, এখন কিছু বলার দরকার নেই, মাহবুবের মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এক সময় জানাবেন। এখন আমি তা হলে আসি বলে সালাম দিয়ে চলে গেলেন।

সুলতান খাঁন সালামের উত্তর দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর বাড়ির ভিতরে এসে স্ত্রীকে আলাউদ্দিন মীরের কথাগুলো বললেন।

মরিয়ম খাতুন খুব বুদ্ধিমতী মহিলা। স্বামী রেগে আছেন বুঝতে পেরে বললেন, ছেলে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে পাঁচ জায়গা থেকে তো সম্বন্ধ আসবেই। এতে কিছু মনে করার কি আছে। আর আলাউদ্দিন মীরের মেয়েকে দোষ দেওয়া যায় না। বরং মাহবুবকে পছন্দ করে সে বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলে জানা যাবে, এই গ্রামে আরো কত মেয়ে বা তাদের মা-বাবা মাহবুবকে পছন্দ করে। তারা হয়তো সাহস করে প্রস্তাব দিতে পারছেন না। আর একটা কথা, আজকাল শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করে। তাহেরা শিক্ষিত মেয়ে। সে হয়তো মাহবুবকে এ ব্যাপারে কিছু জানাতে পারে। অথবা আগের থেকে তাদের দুজনের মধ্যে মন দেওয়া নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। নচেৎ তাহেরা তার মাকে পছন্দের কথা বলতে পারত না।

সুলতান খাঁন ভারি গলায় বললেন, তোমার কথা যুক্তি সঙ্গত। কিন্তু মন দেওয়া নেওয়ার কথা যে বললে, তা বিশ্বাস হয় না। মাহবুব এরকম কাজ করতেই পারে না। এসব আলাউদ্দিন মীরের চালাকি। ওযে কত ঘুঘু তা আমার বুঝতে বাকি নেই। আমাকে সম্পত্তি ও টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে সমাজে বড় হতে চায়।

আমিও তোমার সঙ্গে একমত। আমি শুধু সম্ভাবনার কথা বলেছি। যাক, এখন এ ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। মাহবুব এবারে এলে আমি তার সঙ্গে আলাপ করব। আলাউদ্দিন মীরকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। জিজ্ঞেস করলে বলো, আগে মাহবুব লেখা পড়া শেষ করুক তারপর তার সঙ্গে পরামর্শ করে জানাবে।

মরিয়ম যে খুব বুদ্ধিমতী তা সুলতান খাঁন জানেন। তাই তার কথার কোনো প্রতি উত্তর না করে চুপ করে রইলেন।

.

মাহবুবা মাসুমের কাছ থেকে ফিরে বাসায় ঢুকে দেখল, মা-বাবা কোথায় যেন বেরোচ্ছেন।

আনিস সাহেব মেয়েকে দেখে একটু রাগের সঙ্গে বললেন, সারাদিন কি ক্লাস হয়?

মাহবুবের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় কিছুদিন থেকে মাহবুবার মন খুব খারাপ। আজ আবার মাসুমের কথা শুনে আরো মুষড়ে পড়েছে। এখন বাবা রাগের সঙ্গে কথা বলছে দেখে নিজেকে সামলাতে পারল না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, তুমি। আমাকে বকছ কেন বাবা? আমি কি এমন অন্যায় করেছি? বরং ইদানিং তুমিই তো আমার খোঁজ কর না।

আনিস সাহেব কয়েক দিন ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত ছিলেন। মেয়ের খোঁজ নিতে পারেননি। আজ এক বন্ধুর পার্টিতে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন বলে কয়েকবার খোঁজ করে পাননি। তাই যাওয়ার সময় তাকে বাইরে থেকে আসতে দেখে রাগের সঙ্গে কথাটা বলে ফেলেছেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই কোনো দোষ করিস নি। আমিই ভুল করেছি। তোকে নিয়ে একটা পার্টিতে যাব ভেবেছিলাম। না পেয়ে একটু রেগে গেছি। তারপর তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বললেন, তৈরি হয়ে আয় আমরা গাড়িতে অপেক্ষা করছি।

আনিস সাহেব সচরাচর মেয়েকে কোনো পার্টিতে নিয়ে যান না। আজ নিয়ে যাওয়ার পিছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। সে কথা স্ত্রীকে বলেছেন। উদ্দেশ্যটা হল, বন্ধু নাজিমের ছেলে প্রিন্সের সঙ্গে মাহবুবার পরিচয় করিয়ে দেওয়া। প্রিন্স সম্প্রতি ফরেন। থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের উপর উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে এসে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা ফরছে। সে মা-বাবার একমাত্র সন্তান। সুন্দর স্বাস্থ্যবান যুবক। পার্টিতে গিয়ে আনিস সাহেব সবার সঙ্গে মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় প্রিন্সের সঙ্গেও করালেন।

প্রিন্স মাহবুবাকে দেখে মুগ্ধ হল। একসময়ে বলল, ফরেনের মেয়েদের রঙই শুধু ফর্সা। আপনার সঙ্গে তাদের কোনো তুলনাই হয় না। সত্যি বলতে কি আপনার মতো বিউটিফুল মেয়ে আর কখনো দেখিনি। আপনি অদ্বিতীয়া।

মাহবুবা তোষামোদী মোটেই পছন্দ করে না। প্রিন্সের কথা শুনে বিরক্ত হলেও সৌজন্য রক্ষা করার জন্য মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা, ছেলেরা এত হ্যাংলা কেন বলতে পারেন? সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তার গুণ গাইতে শুরু করে দেয়।

বিদ্রূপটা প্রিন্স গায়ে মাখল না। হেসে উঠে বলল, ছেলেদের কাছ থেকে প্রশংসা শোনার জন্য মেয়েরা উদগ্রীব হয়ে থাকে। রূপের প্রশংসা না করলে, মেয়েরা ছেলেদেরকে আন-কালচার্ড-আন সোশ্যাল বলে গালাগালি করে। চলুন না নিরিবিলিতে বসে একটু আলাপ করি। তারপর একজন বেয়ারাকে দুগ্লাস ব্র্যান্ডি নিয়ে আসতে বলল।

মাহবুবা বুঝতে পারল, প্রিন্স ফরেন থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসার সাথে সাথে মদ ও মেয়ে মানুষের নেশা রপ্ত করে এসেছে। বলল, ধন্যবাদ আমি ড্রিঙ্ক করি না। আর আলাপ তো হলই। নিরিবিলিতে আবার কি আলাপ করবেন? কথা শেষ করে তার কাছ। থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে প্রিন্স বলল, দাঁড়ান, যাবেন না। তারপর বলল, আপনার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আশা করিনি।

মাহবুবা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, আমি কী আপনার সঙ্গে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার কিছু করেছি? শুধু শুধু দোষ দিচ্ছেন কেন? তারপর আর সেখানে। দাঁড়াল না।

পার্টি থেকে বাসায় ফিরে আনিস সাহেব মেয়েকে বললেন, জানিস মা, আমার বন্ধু কয়েকটা ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক। গ্রামের বাড়িতেও অনেক জমি জায়গা। প্রিন্সই তার একমাত্র ছেলে। ফরেন থেকে বিজনেস ম্যানেজম্যান্টে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসে বাবার বিজনেস চালাচ্ছে। খুব হ্যান্ডসাম ও স্মার্ট ছেলে। ওর বাবা-মা তো ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বললেন, প্রিন্স ছয় মাস হল ফরেন থেকে ফিরে এসে ব্যবসাতে লেগেছে। এরই মধ্যে অনেক উন্নতি করেছে। প্রিন্সকে আমার দারুন পছন্দ।

স্বামী থেমে যেতে শামীমা বেগম বললেন, আমারও। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কিছু বলছিস না যে?

পার্টিতে নিয়ে যাওয়ার মতবল মাহবুবা গিয়েই বুঝতে পেরেছিল। বলল, আমার কাছেও সবকিছু ভালো মনে হল। তবে প্রিন্সকে খুব একটা ভালো মনে হয়নি।

শামীমা বেগম বললেন, কেন রে-মা? অমন সুন্দর ছেলেকে তোর ভালো লাগল না কেন?

আমি তো বলিনি সে অসুন্দর। তার সঙ্গে আলাপ করে আমার ভালো লাগেনি, তাই বললাম।

আনিস সাহেব বললেন, একবার আলাপ করে কি আর ভালোমন্দ বুঝবি? ভাবছি, প্রিন্সকে বাসায় আসতে বলব। ভালো করে আলাপ কর। দেখবি আমার কথা সত্য কি না।

না বাবা আসতে বলো না। একবার আলাপ করে তার চরিত্র জানা হয়ে গেছে। আর আলাপ করার দরকার নেই। মাহবুবের কথা তোমাদেরকে বলেছি, তারপরও তোমরা কেন এসব কথা বলছ?

কিন্তু মা, তুই ছেলে মানুষ। এখনো সবকিছু বুঝতে শিখিসনি। তোর ছেলেমানুষি কথা শুনে আমরা তো চুপ করে বসে থাকতে পারি না। একটা কথা জানিস না, সমানে সমানে না হলে যেমন আত্মীয়তা মানায় না, তেমনি সাংসারিক জীবনও সুখের হয় না। প্রিন্সকে তোর পছন্দ হয়নি তো কি হয়েছে আমরা অন্য ছেলের সন্ধান করব।

শোন বাবা, তোমাদেরকে বলেছি মাহবুবকে আমি ভালবাসি। তাকে আমাদের সমাজের মতো করে বিয়ে করব। তারপরও কেন যে তোমরা ওসব কথা বলছ বুঝতে পারছি না। শেষের দিকের কথাগুলো কান্নার মতো শোনাল।

আনিস সাহেব স্ত্রীকে কিছু না বলার জন্য ইশারা করে বললেন, কিন্তু মা, এই কাজ খুব কঠিন। যেমন সময়ের দরকার তেমনি ধৈর্য্যেরও দরকার। তুই কী পারবি?

আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর পারব। তোমরা এত শিঘ্রী আমার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছ কেন? মাস্টার্স না করে আমি বিয়েই করব না। ততদিনে মাহবুবকে তৈরি করে নেব।

ঠিক আছে, আমরাতো বলেছি তোর অমতে কিছু করব না।

মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, কথাটা মনে রাখলে খুশি হব। তারপর চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমে এসে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, মাহবুব দুদিনের জন্য দেশে। গিয়ে দুই সপ্তাহ ছিল, ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে ঘা ঢাকা দিল। তা হলে কী মা-বাবার কথা রাখতে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে? তাই বোধ হয় মাসুম। ভাইকে কোনো কথা জানাতে নিষেধ করে পালিয়েছে। আবার ভাবল, মাহবুবের মতো ছেলে এরম কাজ কিছুতেই করতে পারে না। যদি দৈব ঘটনায় বিয়ে করেই থাকে সে। কথা জানাবার সৎ সাহস তার আছে। তবু কেন দেখা না করে পালাল? তা হলে কি অন্য কোনো সমস্যায় পড়েছে? সিদ্ধান্ত নিল যেমন করে হোক তাকে খুঁজে বের করবেই। প্রয়োজনে তার গ্রামের বাড়িতে যাবে।

.

মাহবুব আজিমপুর আসার পর দাড়ি রেখেছে। বাইরে বেরোবার সময় সানগ্লাস ব্যবহার করে, যাতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলেও যেন মাহবুবা চিনতে না পারে। প্রায় মাসখানেক পর একদিন বিকেল চারটার দিকে মাসুমের সঙ্গে দেখা করতে গেল। রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কিরে কেমন আছিস? চিনতে পারছিস তো?

মাসুম সালামের উত্তর দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, কেমন আছি বলব না। তবে চিনতে, পারার কথা যে বললি, তার উত্তরে বলব, তুই যতই ভেশ বদল করিস না কেন, আমার

চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না। তারপর বলল, তুই একদিন আমাকে নীরেট বোকা গাধা বলেছিলি। তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেদিন আমিও তোকে তাই বলেছিলাম। কিন্তু আজ তোকে দেখে সত্যি সত্যি তাই মনে হচ্ছে। আরে নীরেট বোকা গাধা, মাহবুবাকে তুই ভালবাসলেও তাকে সম্পূর্ণ চিনতে পারিসনি। পারলে তার কাছ থেকে পালাতিস না। আমি তাকে যতটুকু জেনেছি তাতেই বুঝেছি তুই তার সারা মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছিস। আজীবন সে তোর প্রত্যাশায় থাকবে। তার সঙ্গে দেখা করা তোর একান্ত উচিত। তুই চলে যাওয়ার পর কিভাবে যে আমার দিন কেটেছে তা আল্লাহ পাক জানেন। এক সপ্তাহ দিনে রুমে থাকতাম না। সকালে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে রাতে ফিরে আসতাম। আর এদিকে মাহবুবা প্রায় প্রতিদিন এসে রুমে তালা দেখে ফিরে গেছে। একদিন সন্ধ্যার পর এসে হাজির। তারপর যেসব কথাবার্তা হয়েছিল বলে বলল, সেদিন মাহবুবার মুখের অবস্থা দেখে তোর প্রতি আমার যতটা রাগ হয়েছিল। এখন তোকে দেখে সেই রাগ আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। তুই এক্ষুণী আমার সামনে থেকে চলে যা নচেৎ কিছু একটা করে ফেলব।

মাহবুব খুব অবাক হয়ে বলল, মাসুম, এ তুই কী বলছিস?

মাসুম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কানে নিশ্চয় কম শুনিস না। যা বললাম তাই কর। তোর মতো কাপুরুষের মুখ আমি দেখতে চাই না। এই মুহূর্তে চলে যা, আর কখনো আসবি না।

মাহবুব আহত স্বরে বলল, ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, তবে একটা কথা মনে রাখিস, আমি যা কিছু করছি মাহবুবার ভালোর জন্য। তুই আমাকে ভুল বুঝবি তা কোনোদিন ভাবিনি।

তোর কোনো কথাই শুনতে চাই না, তুই চলে যা।

মাহবুবের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। বড় রাস্তায় এসে একটা খালি স্কুটার দেখতে পেয়ে আজিমপুর যেতে বলে উঠে বসল।

মাহবুবা এই একমাস মাহবুবকে ভার্সিটিতে, লাইব্রেরীতে, স্টেডিয়ামে ও বিভিন্ন। জায়গায় খুঁজে বেড়িয়েছে। আজ হঠাৎ তার মনে হল, মাসুমের কাছে হয়ত মাঝে মাঝে যায়। সেখানে একবার খোঁজ নিলে কেমন হয়। ভাগ্য ভালো হলে দেখাও হয়ে যেতে পারে। এই কথা চিন্তা করে আজ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে স্বামীবাগ রওয়ানা দিল।

মাহবুবার গাড়ি যখন হাটখোলা পার হয়ে টিপুসুলতান ও নারিন্দা রোডের মোড়ে এল তখন মাহবুবের স্কুটার নারিন্দা রোড থেকে টিপুসুলতান রোডে মোড় নিচ্ছে। সে সামনে বসেছিল। মাহবুবের মুখে দাড়ি ও চোখে সানগ্লাস থাকা সত্বেও চিনতে পেরে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে মাহবুবের স্কুটারের দিকে নির্দেশ করে ড্রাইভারকে বলল, ঐ মুখে দাড়ি ও চোখে সানগ্লাস পরা ছেলেটার স্কুটারকে ফলো করুন।

ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে স্কুটারকে ফলো করে চলল।

মেসের কাছে পৌঁছে মাহবুব স্কুটার থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে হাঁটতে লাগল।

মাহবুবার ড্রাইভার অল্প দূরে গাড়ি থামিয়েছে। মাহবুবা ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি থেকে নেমে মাহবুবকে ফলো করে তার রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল।

মাহবুব মাসুমের কাছে এমন দুর্ব্যবহার পাবে কল্পনাও করেনি। সারা পথ উদভ্রান্তের মতো এসেছে। রুমে ঢুকে চুপ করে বসে চিন্তা করতে লাগল, মাহবুবা নিশ্চয় তাকে এমন কিছু বলেছে যে জন্য মাসুম তার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করল।

মাহবুবের চিন্তাক্লিস্ট মলিন মুখ দেখে মাহবুবার মন বিচলিত হলেও কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।

এমন সময় আসরের আযান শুনে মাহবুব দাঁড়িয়ে দরজার দিকে নজর পড়তে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, তুমি?

মাহবুবা চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ আমি। তা চমকে উঠলে কেন? ভয়ে, না অবিশ্বাস্য কিছু দেখে?

মাহবুব কিছু না বলে মুখ নিচু করে নিল।

মাহবুবা আবার বলল, ভেবেছ ভেশ বদলে আমাকে ফাঁকি দেবে। তা কখনোই পারবে না। যার নাম আমার শরীরের রক্ত কণিকার সঙ্গে চব্বিশ ঘন্টা প্রবাহিত হচ্ছে, সে আমাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য যা কিছু করুক না কেন, পারবে না। একটু বসতেও বলবে না?

মাহবুব তার কথার উত্তর না দিয়ে ব্রীফকেস খুলে টাকার বান্ডিল এনে তার দিকে বাড়িয়ে বলল, অসুখের সময় যা কিছু করেছ সে জন্য চির কৃতজ্ঞ থাকব। ক্লিনিকের বিলটা নিয়ে চলে গেলে খুশি হব।

মাহবুবা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, মাহবুব তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারলে? তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি যে নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

মাহবুবার অবস্থা দেখে মাহবুবের মন বিচলিত হয়ে উঠল। নিজেকে কঠোরভাবে। সামলে নিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল, টাকাটা নিয়ে চলে যাও, আর কখনো এস না।

মাহবুবা শরাহত হংসের মতো ককিয়ে উঠল, কিন্তু কেন মাহবুব কেন? আমি কি এমন অন্যায় তোমার কাছে করেছি?

অন্যায় করেছ সে কথা তো বলিনি। বলেছি চলে যেতে, কারণ যাওয়াটাই তোমার জন্য মঙ্গল।

আর যদি বলি অমঙ্গল?

মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, বেশ চলে গেলে যদি খুশি হও, তা হলে শুধু এখান থেকে নয়, এই পৃথিবী থেকে একেবারে চিরজীবনের জন্য চলে যাব।

মাহবুব আবার চমকে আতঙ্কিত স্বরে বলল, ছিঃ মাহবুবা, এমন কথা মুখে উচ্চারণ করাও পাপ। আমি একটা কাপুরুষ! একটা কাপুরুষের জন্য তুমি নিজের সর্বনাশ করবে কেন?

নিজেকে কাপুরুষ বলতে বিবেকে বাধল না?

বিবেক নেই বলেই যে বললাম এই কথাটা বুঝতে পারছ না কেন? প্লীজ চলে যাও। এটা মেস এখানে কত রকমের লোক আছে। এতক্ষণে হয় তো উঁকি ঝুঁকি মারছে? নানা রকম মন্তব্য করছে।

তুমি কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছ বললেই চলে যাব।

সেকথা বলতে পারব না বলেই তো পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

ঠিক আছে, আজ চলে যাচ্ছি কিন্তু যতদিন কারণটা না বলবে ততদিন বারবার আসব। তারপর চোখ মুখ মুছে বেরিয়ে এসে দেখতে পেল, বেশ কয়েকজন দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রূক্ষেপ না করে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বাসায় যেতে বলল।

যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা এবার রুমে ঢুকে মাহবুবকে ঘিরে ধরে বলল, কি ব্যাপার ব্রাদার? ঘটনা দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়?

মাহবুব বুঝতে পারল এতক্ষণ এরা আড়াল থেকে তাদের কথাবার্তা শুনেছে। তাই বিরক্ত না হয়ে বলল, বড় লোকের মেয়ের খামখেয়ালী আরকি। দেখুন না, শহরের এত কোটিপতির ছেলে থাকতে কিনা অজ পাড়াগাঁয়ের এই হতভাগার পিছু লেগেছে।

তাদের মধ্যে নজুমিয়া নামে এক বয়স্ক লোক ছিলেন। তাকে সবাই দাদু বলে ডাকে। খুব রসিক মানুষ। তিনি বললেন, আরে ভাই পিছু লেগেছে যখন ঝুলে পড়ুন। কোটিপতির মেয়েকে বিয়ে করে আপনিও কোটিপতি হয়ে যান। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা যাই বলুন, নাত বৌ কিন্তু খুব সুন্দরী। মাহবুব দাদুর সঙ্গে মানাবে ভালো।

মাহবুবের মনের অবস্থা খুব খারাপ। হাতজোড় করে বলল, আপনারা দয়া করে এখন যান, আমি নামায পড়তে যাব।

মাহবুবের কথা শুনে সবাই চলে গেল। নজুমিয়া সবার শেষে যাওয়ার সময়। বললেন, এভাবে মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেওয়া আপনার উচিত হয়নি।

মাহবুব কোনো কথা না বলে রুমে তালা দিয়ে মসজিদে গেল।

রাতে ঘুমাবার সময় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল, দুএক দিনের মধ্যে অন্য কোনো মেসে চলে যাবে।

পরের দিন সকালে প্রাইভেট পড়াতে এলিফেন্ট রোডে গেল। ছাত্রটির নাম রাসেল, সে নাইনে পড়ে। ছাত্রীটির নাম রুনা। সে টেনে পড়ে। আজ পড়ানো হয়ে যেতে রুনা বলল, স্যার একটু বসুন। তারপর বইপত্র গুছিয়ে রেখে চলে গেল। একটু পরে রুনার সঙ্গে তার মা এসে বেতনের টাকা দেওয়ার সময় বললেন, আপনার টিচিং খুব ভালো। মাত্র এক মাসের মধ্যে ওদের পড়ার খুব উন্নতি হয়েছে তাই আমরা খুশি হয়ে এই মাস। থেকেই তিন হাজার টাকা দিলাম। তারপর বললেন, রুনার আব্বার কাছে শুনলাম। আপনি ইংলিশে মাস্টার্স করছেন। আরো শুনলাম মেসে থাকেন। মেসে বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকে। সেখানে নিশ্চয় ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারেন না। তাই বলছিলাম কি আপনার অসুবিধা না থাকলে এখানে থাকুন। ছেলেমেয়ে দুটো আপনার খুব ভক্ত। হয়ে পড়েছে। আপনাকে কথাটা বলার জন্য প্রতিদিন তাগিদ দেয়। ফাস্ট ফ্লোরে। দুতিনটে গেস্ট রুম আছে। পছন্দ মতো যে কোনো একটায় থাকতে পারেন। আমাদের সঙ্গেই খাবেন।

এত তাড়াতাড়ি এমন সূবর্ণ সুযোগ আল্লাহ পাইয়ে দেবেন মাহবুব কল্পনা করতে পারেনি। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করার সময় চোখে পানি আসার উপক্রম হল। মুখ নিচু করে সামলে নিয়ে বলল, আমার আপত্তি নেই, তবে আমি পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকব।

সে ব্যাপারে রুনার আব্বার সঙ্গে কথা বলবেন। আপনি দুএক দিনের মধ্যে চলে আসুন।

ঠিক আছে, এখন আসি বলে মাহবুব সালাম বিনিময় করে চলে এল।

মাহবুব যে মেসে থাকে সে মেসের পুরো দায়িত্ব নজু মিয়ার উপর। ঐদিনই মাহবুব নজুমিয়াকে ডেকে চলতি মাসের ভাড়া দিয়ে বলল, আমি কাল এখান থেকে চলে যাব। নজুমিয়া অবাক হয়ে বললেন, আপনি কী আমাদের উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন?

না দাদু রাগ করব কেন? আমি এক বাড়িতে দুটো ছাত্রকে প্রাইভেট পড়াই। সেখানে লজিং পেয়ে গেছি।

নজুমিয়া ম্লান মুখে বললেন, তা হলে তো বাধা দিতে পারি না। এই একমাস এসে আপনি আমাদেরকে কোরআন হাদিস শুনিয়ে নামায ধরিয়েছেন। অনেককে কোরআন পড়তে শিখিয়েছেন। আপনাকে পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছি। চলে যাবেন শুনে খুব খারাপ লাগছে।

মাহবুব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কি করব দাদু মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। ভাগ্যই আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। মনে রাখবেন দাদু, দুনিয়াটা মুসাফির খানা। দুদিন আগে পরে সবাইকে চলে যেতে হবে।

হ্যাঁ ভাই, আপনি খুব দামি কথা বলেছেন। মাঝে মাঝে এলে সবাই খুশি হব।

ইনশাল্লাহ আসব।

 দুদিন পর মাহবুব মেস ছেড়ে দিয়ে রুনাদের বাসায় চলে এল।

.

মাহবুবা তিন চার দিন পর মাহবুবের সঙ্গে দেখা করার জন্য আজিমপুর মেসে গেল।

নজুমিয়ার শরীর খারাপ থাকায় আজ অফিসে যাননি। আসরের নামায পড়ার জন্য অজু করছিলেন। মাহবুবাকে দেখে বললেন, দুদিন আগে এলে দেখা পেতেন। পাখী পরশু উড়াল দিয়েছে।

মাহবুবা চমকে উঠে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ঠিকানা জানেন?

উড়াল দেওয়া পাখির ঠিকানা জানব কি করে?

ধন্যবাদ জানিয়ে মাহবুবা ফিরে এল। তারপর কয়েক দিন চিন্তা করে ঠিক করল, মাহবুবের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আসল ঘটনা জানবে।

একদিন খাওয়ার টেবিলে আনিস সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে মা, তোর কি কোনো অসুখ বিসুখ করেছে? বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি সব সময় মন খারাপ করে থাকিস। খাওয়া দাওয়াও ভালোভাবে করিস না।

মাহবুবা বল, অসুখ বিসুখ করেনি, তবে একটা প্রবলেমে পড়েছি। সলভ করতে পারছিলাম না। এতদিন চেষ্টা করে ফরমুলাটা মাথায় এসেছে।

তা হলে দেরি করছিস কেন?

সবে মাত্র কাল এসেছে। বাবা, আমি মাহবুবের গ্রামের বাড়িতে একবার যেতে চাই।

আনিস সাহেব বেশ অবাক হয়ে বললেন কেন?

প্রবলেম সল্ভ করার জন্য।

আমার মনে হয় তোর ফরমুলাটা রং প্রবলেমটা বল, অন্য ফরমুলায় সলভ করার ব্যবস্থা করব।

মাহবুব সুস্থ হয়ে মাস দুয়েক আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় আমাকে বলে যাই নি। পনের দিন পরে ফিরে আসে। তারপর থেকে আমার সাথে দেখা করেনি। আমি তার মেসে গিয়েও দেখা পাইনি। সপ্তাহ খানেক পরে ঐ মেস ছেড়ে চলে যায়। অনেক চেষ্টা করেও তার ঠিকানা পাইনি। কয়েক দিন আগে দৈবক্রমে তার ঠিকানা পেয়ে দেখা করি। কিন্তু কেন সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি। দুতিন দিন আগে আবার তার কাছে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারলাম ওখান থেকেও পালিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে বাড়িতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যে জন্য আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

আনিস সাহেবের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, আমার মতে তোর সেখানে না যাওয়াই ভালো। গিয়ে হয়তো নতুন বৌ দেখতে পাবি। গ্রামের ছেলেরা শহরের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করলেও গ্রামের মেয়েকেই বিয়ে করে। এ রকম ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।

তোমার কথা হয়তো ঠিক। তবু একবার গিয়ে আমি আসল ঘটনা জানতে চাই।

কিন্তু মা, দূরের পথ, একা একা যাওয়া কি ঠিক হবে? তা ছাড়া তুই কখনো গ্রামে যাসনি। কতরকমের অসুবিধা হবে। কোথায় উঠবি, কোথায় থাকবি, চিন্তা করবি না? গ্রামে তো আর আবাসিক হোটেল নেই যে থাকবি। গ্রামের রাস্তায় গাড়ি যাবে কি না তারও ঠিক নেই। অনেক অসুবিধায় পড়বি।

সেখানে শামীমা বেগম ছিলেন। স্বামী থেমে যেতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, পাগলামী করিস না মা। তোর বাবা ঠিক কথাই বলেছেন, কোনো বিপদ হলে কে। তোকে সাহায্য করবে?

তোমরা ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। মাহবুব যখন ক্লিনিকে ছিল তখন তার কাছে। শুনেছি গ্রামের লোকজন খুব সরল-সোজা। একে অন্যের বিপদে সাহায্য করে। ওর মা-বাবা খুব ভালো। ওদের কাঁচারী বাড়ির সামনে দিয়ে বড় রাস্তা। গাড়ি সরাসরি ওদের বাড়ি পর্যন্ত যাবে। তোমরা দেখ আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া ড্রাইভার চাচাতো থাকবেন। তিনিও তো গ্রামের মানুষ।

আনিস সাহেব বললেন, নিষেধ যখন শুনবি না তখন আর বাধা দেব না। তবে কথা দে, আমাদের অনুমান যদি সত্য হয় তা হলে আমাদের কথা মেনে নিবি?

আমি কি কোনো দিন তোমাদের কথার অবাধ্য হয়েছি?

তা হস্নি, শুধু এই ব্যাপারটা ছাড়া। তারপর হেসে উঠে বললেন, আই উইশ ইউর। গুড লাক। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি মাহবুবদের বাড়িতেই উঠবি?

হ্যাঁ বাবা।

কবে যেতে চাস?

দুএক দিনের মধ্যে।

আমি ড্রাইভারকে কে যা বলার বলে দেব।

.

০৬.

মাহবুবা যখন মাহবুবদের কাঁচারী বাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছাল তখন সুলতান খাঁন আসরের নামায পড়ে মসজিদ থেকে ফিরছেন। দুর থেকে কাঁচারী বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামতে দেখে বেশ অবাক হলেন। আজ দুপুরে মাহবুবের চিঠি পেয়েছেন। লিখেছে সে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ জোগাড় করছে তাকে আর টাকা পাঠাতে হবে না।

সুলতান খাঁন গাড়ির কাছে আসার আগে মাহবুবা ও ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমেছে। মাহবুবা জীবনে এই প্রথম কোনো গ্রামে এল। মাহবুবের কাছে গ্রামের বাড়ি ও বাড়ির চারপাশের বর্ণনা শুনেছিল। আসার সময় গাড়ি থেকে মাঠ-ঘাট, বাড়ি-ঘর ও গাছপালা দেখে তার মন আনন্দে ভরে গেছে। এখন গাড়ি থেকে নেমে চারপাশের গাছ-গাছালি ও গ্রাম্য পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হল। তন্ময় হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল। লুংগী-পাঞ্জাবী ও মাথায় টুপি পরা সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান একজন প্রৌঢ় লোককে তাদের দিকে আসতে দেখে ফটো তোলার লোভ সামলাতে পারল না। গ্রামের সিনারী তোলার জন্য ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। সেটা কাঁধে ঝুলিয়েই গাড়ি থেকে নেমেছে। তাড়াতাড়ি ক্যামেরা ফিট করে একটা সর্ট নিল।

সুলতান খাঁন কাছে এসে ড্রাইভারের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বললেন, কে আপনারা? যাবেন কোথায়?

মাহবুবা মাহবুবের মুখে তার মা ও বাবা দেখতে কেমন তাও শুনেছিল। সট নেওয়ার পর ভালোভাবে দেখে বুঝতে পারল, ইনিই মাহবুবের বাবা। তাই ড্রাইভার বলার আগে সালাম দিয়ে বলল, আমরা ঢাকা থেকে মাহবুবদের বাড়ি বেড়াতে এসেছি।

সুলতান খাঁন খুব অবাক হয়ে সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মাহবুবকে চেনেন?

জ্বি চিনি। আপনি নিশ্চয় মাহবুবের বাবা?

 হা মা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনাদেরকে তো চিনতে পারছি না?

আমাদেরকে তো কখনো দেখেননি, চিনবেন কি করে? আমার বাবার নাম আনিসুর রহমান। উনি একজন ব্যবসায়ী। ঢাকাতেই আমাদের বাড়ি। তারপর ড্রাইভারকে দেখিয়ে বলল, উনি অনেক বছর ধরে আমাদের গাড়ি চালান। আমি ভার্সিটিতে পড়ি। মাহবুবের সঙ্গে ভালোভাবে জানা শোনা আছে।

সুলতান খাঁন ভাবলেন, তা হলে কি এই মেয়েটাই মাহবুবের অসুখের সময় টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল? তারপর ড্রাইভারকে বললেন, আপনি কাঁচারী ঘরের ভিতরে গিয়ে বসুন, আমি আসছি। তারপর মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আসুন।

মাহবুবা যেতে যেতে বলল, আমি তা আপনার মেয়ের বয়সি, আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমার নাম মাহবুবা। নাম ধরে তুমি করে বলবেন।

ততক্ষণে তারা বাড়ির উঠোনে এসে পড়েছেন। সুলতান খাঁন একটু জোরে বললেন, জমিরন কোথায়রে মা, তোর চাচিকে ডাক।

জমিরন চাচির সঙ্গে নামায পড়ছিল। মোনাজাতের পর চাচার গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে সঙ্গে একটা আপটুডেট মেয়ে দেখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, কিরে মা, কি দেখছিস? ঢাকার খুব বড় লোকের মেয়ে। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তোর চাচি কোথায়?

ততক্ষণে মরিয়ম খাতুন নামায শেষ করে বেরিয়ে এসেছেন। স্ত্রীকে দেখে বললেন, মা আমার ঢাকা থেকে এসেছে। কিছু খেতে দাও। তারপর জমিরনকে বললেন, তুই মুখ হাত ধোয়ার পানি দে। আমি কাঁচারী বাড়িতে ড্রাইভারের কাছে যাচ্ছি।

নাস্তা খেতে দিয়ে মরিয়ম খাতুন মাহবুবার সঙ্গে আলাপ করার সময় তার নাম শুনে বুঝতে পারলেন, এই মেয়েই মাহবুবকে চিকিৎসা করিয়ে ভালো করেছে। মনে মনে খুব খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাহবুবের সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?

তা প্রায় আট নয় মাস হবে।

তুমি আসবে মাহবুব জানে?

জ্বি না।

 তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে না কেন?

মাহবুবা বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, আমি একটা বিশেষ কাজে পাশের গ্রামে এসেছিলাম। মাহবুবের কাছে আপনাদের কথা শুনেছি। তাই ভাবলাম, দেখা করে একদিন বেড়িয়ে যাই।

খুব ভালো করেছ মা। আমরা খুব খুশি হয়েছি। আমাদের মাহবুব ও মাহফুজা ছাড়া কেউ নেই। এতবড় বাড়িটা খা খা করে। কারো সঙ্গে দুটো কথা বলতেও পাই না। জমিরনটা আছে বলে তবু রক্ষে।

মাহফুজা কে চাচি আম্মা?

আমার বড় মেয়ে। মাহবুবের চেয়ে ছয় বছরের বড়। অনেক দূরের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। বছরে একবার এসে যে কয়েক দিন থাকে, সেই কয়েক দিন বেশ ভালই কাটে। তারপর খুব খারাপ লাগে।

ছেলের বিয়ে দিয়ে বৌ আনুন। তাহলে তো আর খারাপ লাগবে না।

সময় হলে তাতো আনবই। এখন ওকে বিয়ের কথা বলাই যাবে না।

 কেন? আপনার কষ্ট হচ্ছে, সেকথা জানিয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা বললে কিছু শুনবে না?

ও আমাদের কথার কখনো অবাধ্যতা করেনি। বললে বরং মাথা হেঁট করে মেনে নেবে। তাই বলে পড়াশোনা বন্ধ করে কী বিয়ে দেওয়া উচিত? তা ছাড়া পড়াশোনা শেষ করে রুজী রোজগার করুক, তারপর আর দেরি করব না।

কথা বলতে বলতে মাগরীবের আযান হতে মরিয়ম খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি। কী নামাজ পড়বে?

মাহবুবা লজ্জা পেয়ে বলল, আমি নামায পড়তে জানি না।

ঠিক আছে তুমি বস, আমরা নামায পড়ে নিই।

মাহবুবের বিয়ে হয়নি শুনে মাহবুবার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। বসে বসে চিন্তা করতে লাগল, তা হলে কেন সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? ভেবে রাখল বুদ্ধি করে তার মায়ের কাছ থেকে জেনে নেবে।

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর মরিয়ম খাতুন মাহবুবাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি অন্য। রুমে একা ঘুমাবে, না আমার রুমে ঘুমাবে?

গ্রামের রাতের নিস্তব্ধতা মাহবুবা কখনো অনুভব করেনি। সন্ধ্যার পর আশ পাশের। বাড়ির কিছু কোলাহল শোনা গেলেও রাত যত বাড়ছে, নিস্তব্ধতাও তত বাড়ছে। দুবছর আগে বিদ্যুৎ এলেও বাড়ির বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বারান্দায় একটা ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলোয় উঠোনের অর্ধেক দেখা যায়। মাহবুবা আলো ঝলমলে শহরে মানুষ। সন্ধ্যার পর থেকে তার গা ছমছম করছে। এতবড় বাড়িতে তাদের দুজনকে নিয়ে মাত্র পাঁচ জন মানুষ। মরিয়ম খাতুনের কথা শুনে বলল, আমি আপনার রুমে ঘুমাব। আপনার কাছে গ্রামের গল্প শুনব।

সুলতান খাঁনের এক তলা ছয় কামরা পাকা বাড়ি। আর সদরের দিকের টিন সেড একটা কাঁচারী বাড়ি। এ বাড়িটা তার দাদা বাদশা খান করেছিলেন। সুলতান খাঁনের বাবা রুস্তম খান একবার সংস্কার করেছিলেন। অর্থাভাবে সুলতান খাঁন করাতে পারেন। নি। তাই বাইরের দিকে দেওয়ালে অনেক জায়গায় প্লাস্টার উঠে ইট বেরিয়ে পড়েছে। ভিতর সাইড ভালো থাকলেও অনেক জায়গায় চুন উঠে গেছে। তবে যে তিনটে রুম ব্যবহার হয়, সেগুলোর ভিতরসাইড চুনকাম করেন। এই তিনটে রুমের একটায় সুলতান খাঁন ও তার স্ত্রী থাকেন। বাকি দুটোর একটাতে মাহবুব আর অন্যটা মেয়ে জামায় এলে থাকে। অন্য সময় তালামারা থাকে। অন্য তিনটে রুমের একটায় জমিরণ থাকে। বাকি দুটো খালি পড়ে থাকে।

মাহবুবার পরিচয় জেনে মরিয়ম খাতুন নিশ্চিত হয়েছেন, এই মেয়েই মাহবুবকে পছন্দ করে এবং সেই জন্য তার অসুখের সময় সাহায্য করেছে। তাই হয়তো আমাদের সব কিছু দেখার জন্য এসেছে। তবু রাত্রে ঘুমাবার আগে গল্প করতে করতে এক সময় মরিয়ম খাতুন বললেন, তুমিই তো মাহবুবকে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ভালো করেছ, তাই না মা?

মাহবুবা বলল, আপনার ছেলে বুঝি তাই বলেছে?

শুধু তাই বলেনি, তুমি যে দিন রাত সেবা যত্ন করেছ, ক্লিনিকের টাকা দিয়েছ সব বলেছে। শুনে আমি তোমার জন্য অনেক দোয়া করেছি।

চাচি আম্মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দেবেন তো?

 ওমা, মেয়ের কথা শোন, উত্তর দেব না কেন? কি জানতে চাও বল।

এবারে মাহবুব বাড়িতে আসার পর কি এমন ঘটনা ঘটেছে, যে জন্য তার মন খুব খারাপ। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কিছু বলেনি।

মরিয়ম খাতুন স্বামীর কাছে জেনেছেন, পুকুর রেখে টাকা নেওয়ার কথা আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে মাহবুব শুনেছে। মাহবুবার কথা শুনে ভাবলেন, তাই হয়তো মন খারাপ। বললেন, না কোনো কিছুই ঘটেনি।

তা হলে মাহবুব সব সময় মন খারাপ করে থাকে কেন? আমার মনে হয় আপনি আমার কাছে গোপন করছেন।

মরিয়ম খাতুনের হঠাৎ মনে পড়ল, আলাউদ্দিন মীরের মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা। ভাবলেন তা হলে কি আলাউদ্দিন মীর তাহেরাকে বিয়ে করার জন্য। মাহবুবকেও কিছু বলেছেন? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাহেরার কথা চাপা দিয়ে বললেন, তোমার অনুমান ঠিক। ব্যাপারটা আমাদের পারিবারিক, তোমার না শোনাই ভালো। ঘরের কথা বাইরে কারো কাছে বলা নিষেধ। এটা হাদিসের কথা।

মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে নিজের মেয়ে মনে করে বলুন।

মরিয়ম খাতুন বলাটা ঠিক হবে কি না চিন্তা করতে লাগলেন।

মাহবুবা কাঁদ-কাঁদ স্বরে বলল, আমি যদি আপনাদের মেয়ে হতে চাই, তবু বলবেন না?

মরিয়ম খাতুন আবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অতবড় ভাগ্য আমাদের কী হবে মা? মাহবুবের মুখে শুনেছি তুমি কোটিপতির একমাত্র মেয়ে। তুমি বললেও তোমার মা-বাবা রাজি হবেন কেন?

আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি তাদের মতামত নিয়েই এসেছি। আর তখন পাশের গ্রামে কাজের কথা যে বলেছি, তা সত্য নয়। মাহবুবের মন কেন খারাপ। তা জানার জন্যই এসেছি।

প্রথম থেকেই মাহবুবার কথাবার্তা ও আচার আচরনে মরিয়ম খাতুন অবাক হয়েছিলেন। এখন তার কথা শুনে যেমন আরো বেশি অবাক হলেন, তেমনি আনন্দিতও হলেন। তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় ও দুগালে চুমো খেয়ে বললেন, আল্লাহ গো, এই ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ের মনের বাসনা পুরণ করো। তারপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, এখন আর তোমাকে বলতে বাধা নেই। তারপর আলাউদ্দিন মীরের পরিচয় ও পুকুর সাফকবলা রেখে তার কাছ থেকে একলাখ টাকা নেওয়ার কথা বলে বললেন, আল্লাহর রহমতে আমাদের সংসার বেশ ভাল ভাবেই চলে যায়। মাহবুবকে উচ্চ শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার চাচা টাকাটা নেন। তাকে জানালে রাজি হত না। তাই তখন জানান হয়নি। এবারে তোমার চাচা অসুখের জন্য টাকা আনতে যেতে পারেন নি। মাহবুবকে পাঠিয়ে ছিলেন। আলাউদ্দিন মীর তাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছে। ঐ পুকুরের ও পুকর পাড়ের বাগানের আয়ে আমাদের সংসার চলে। পুকুর ফেরৎ নেওয়ার আর মাত্র দুবছর সময় আছে। এর মধ্যে টাকা না দিতে পারলে পুকুর আলাউদ্দিন মীরের হয়ে যাবে। এই কথা চিন্তা করে মাহবুব হয়তো মন খারাপ করে থাকে।

এতক্ষণে মাহবুবার কাছে সব কিছু ক্লিয়ার হল। বলল, আমাকে যখন মেয়ে বলে গ্রহণ করে পরিবারের গোপন কথা জানালেন তখন মেয়ে হিসেবে আমিও আমার কর্তব্য করব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। চাচাকেও চিন্তা করতে নিষেধ করবেন। আমি কালই ঢাকা ফিরে যাব।

সেকি হয় মা? মেয়ে হয়ে যখন এসেছ তখন মায়ের বাড়িতে এসেই কি যাওয়া যায়? তা ছাড়া যখন তোমার মা-বাবাকে বলেই এসেছ তখন আর দুচার দিন থাকতে অসুবিধা কোথায়?

ঠিক আছে, দুদিন থেকে তারপরের দিন যাব।

পরের দিন সকালে এক ফাঁকে মরিয়ম খাতুন স্বামীকে সব কথা জানালেন।

সুলতান খাঁন বললেন, আমি এরকমই অনুমান করেছিলাম। এই নিয়ে আর চিন্তা করে কি হবে? আল্লাহ যা তকদিরে রেখেছে হবে।

নাস্তা খাওয়ার সময় মাহবুবা সুলতান খাঁনকে বলল, চাচা, মাহবুবের কাছে শুনেছি আপনাদের একটা খুব বড় পুকুর আছে। আরো শুনেছি আপনি খুব ভালো সাঁতারু। এখনো অনেক্ষণ সাঁতার কাটেন। আমি আপনার সাঁতার কাটা দেখব।

সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, হ্যাঁ মা প্রতিদিন সাঁতার না কাটলে মনে শান্তি পাই না। জান মা, আমার আব্বা ও দাদা দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। শুধু তাই নয় খুব ভালো লাঠিয়ালও ছিলেন। মাহবুবকে আমিই সাঁতার ও লাঠিখেলা শিখিয়েছি। ওকে সাঁতারে ও লাঠি খেলাতে কেউ হারাতে পারে না।

মাহবুবা বলল, একথা আমিও জানি। ঢাকায় সাঁতার প্রতিযোগীতায় প্রতি বছর ফার্স্ট হয়। এবছরও তিনটে স্বর্ণ পদক পেয়েছে। তবে লাঠিখেলা জানে জানতাম না।

সুলতান খাঁন আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করলেন। তারপর বললেন, তুমি ড্রাইভারের সঙ্গে গ্রামটা ঘুরে দেখ। দুপুরে গোসল করার সময় তোমাকে নিয়ে যাব। তারপর স্ত্রীকে বললেন, বাজারের ব্যাগ দাও। কিছু মাংস নিয়ে আসি। গোসল করার সময় পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করব। মেয়ের ভাগ্যে থাকলে দুএকটা পড়ে যেতে পারে। শহরের বড়লোকের মেয়েকে তো আর ডাল ভাত খাওয়াতে পারি না।

সুলতান খাঁন বাজারে চলে যাওয়ার পর মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে বলল, চাচা ড্রাইভারের সঙ্গে গ্রাম দেখতে যাওয়ার কথা বললেন, যাব চাচি আম্মা?

মরিয়ম খাতুন বললেন, বিকেলে যেও। এখন তোমার সঙ্গে কিছু আলাপ করব।

ঠিক আছে, তাই যাব।

মরিয়ম খাতুন জমিরনকে ডেকে বললেন, চাল বেছে চুলো জ্বালা। তোর চাচা বাজার থেকে ফিরলে আমি তরকারী রান্না করব।

জমিরন চলে যাওয়ার পর মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি যখন আমাদের মেয়ে হতে চাও তখন তোমাকে কয়েকটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো মা?

মাহবুবা বলল, চাচি আম্মা কি যে বলেন, আপনার কথায় কিছু মনে করব কেন? আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।

মরিয়ম খাতুন বললেন, আমাদের বংশের একটা আলাদা সুনাম আছে। এই বংশের মেয়েরা বেপর্দায় বাইরে চলাফেরা করে না। আর বেপর্দায় চলতে আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) নিষেধ করেছেন। তিনি তাঁর পেয়ারা হাবীবকে উদ্দেশ্য করে কোরআনে বলিয়াছেন, হে নবী (দঃ) আপনার স্ত্রীগণকে ও আপনার কন্যাগণকে এবং অন্যান্য মুমেনদের নারীদিগকেও বলিয়া দিন যে, তাহারা যেন স্ব-স্ব চাদরগুলি নিজেদের (মুখমণ্ডলের) উপর (মাথা হইতে) নিম্নদিকে একটু ঝুলাইয়া লয়; ইহাতে শীঘ্রই তাহারা পরিচিত হইবে, ফলতঃ তাহারা নির্যাতিত হইবে না; এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।

মেয়েরা যদি আল্লাহর হুকুম মতো পর্দার সঙ্গে চলাফেরা করত, তা হলে রাস্তা-ঘাটে এত নির্যাতীত হত না। তুমি শহরের মেয়ে সেখানকার পোশাক-আশাক, চাল-চলন আলাদা। তুমি গ্রাম দেখবে তাতে কোনো বাধা নেই। তবে যাওযার সময় তোমাকে। বোরখা পরে অথবা বড় চাদর গায়ে দিয়ে যেতে হবে। শোন মা, আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে অন্যায় ও অশালীন ছাড়া সবকিছু করার হুকুম দিয়েছেন। তিনি কোরআনে বলিয়াছেন, হে বনী আদম, প্রত্যেকবার মসজিদে উপস্থিত হওয়ার কালে নিজেদের পোশাক পরিদান করিয়া লইও এবং খুব খাও ও পান কর। আর সীমার বাইরে যাইও না। নিশ্চয় আল্লাহতালা সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না।

হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসূল (দঃ) বলিয়াছেন, আহার কর, পান কর, দান কর এবং পরিধান কর, যে পর্যন্ত অমিতব্যয়িতা এবং অহঙ্কার উহাতে মিশ্রিত না হয়। হাদিসে আরো আছে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, যাহা ইচ্ছা ভক্ষণ কর এবং যাহা ইচ্ছা পরিধান কর; কিন্তু অমিতব্যয়িতা এবং অহঙ্কার যেন তোমাকে পথভ্রষ্ট না করে।

আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। সেই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাতির উচিত সৃষ্টিকর্তার বিধান মেনে চলা। সেই বিধান তিনি তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। তুমিই বলো না মা, মানুষের কি উচিত নয়, বিশ্ব প্রভু আল্লাহর বিধান মেনে চলা?

মাহবুবা তন্ময় হয়ে মরিয়ম খাতুনের কথা শুনছিল। এ রকম কথা আগে কখনো শোনেনি। বলল, হ্যাঁ চাচি আম্মা মেনে চলাই তো উচিত।

মরিয়ম খাতুন বললেন, তোমাকে আমি হেজবুন-নেশওয়ান, তাহারাতুন-নেশওয়ান ও একটা নামায শিক্ষার বই দেব। সেগুলো পড়ে সেইসব মেনে চলার চেষ্টা করবে। আর কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও ইসলামের উপর বিভিন্ন বই পড়বে। তা হলে ইসলামকে যেমন জানতে পারবে তেমনি সেইসব মেনে চলারও প্রেরণা পাবে। আর সাংসারিক জীবনে যেমন সুখ-শান্তি পাবে তেমনি আখেরাতেও পাবে। আমি অল্প শিক্ষিত মেয়ে। যখন এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসি তখন ধর্মীয় বিধি-বিধান যেমন জানতাম না তেমনি মেনেও চলতাম না। তোমার চাচা আমাকে সবকিছু শিখিয়েছেন। ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়বার অভ্যাস করিয়েছেন। সেই সব পড়ে জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে মেনে চলারও প্রেরণা পেয়েছি। আর এটাও জেনেছি, যার মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান নেই, তাকে সেই জ্ঞান দান করা কর্তব্য। তুমি শিক্ষিত মেয়ে হলেও তোমার ধর্মীয় জ্ঞান নেই। তাই আমি আমার কর্তব্য পালন করলাম। শিক্ষিত মেয়ে হিসাবে তুমি আমার কথাগুলো নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?

মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে কদমবুসি করে বলল, আপনি দোয়া করুন, আমি যেন আপনার কথা মতো কাজ করতে পারি।

মরিয়ম খাতুন তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন, আল্লাহ তোমাকে দ্বীনকে বোঝার ও সেইমতো চলার তওফিক দেন। তারপর বললেন, মাহবুবকে তুমি কতটা জেনেছ জানি না, ও কিন্তু ধর্মীয় বিধানের বাইরে কোনো কিছু। করে না।

মাহবুবা বলল, তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরপরই তা আমি বুঝতে পেরেছি।

এমন সময় স্বামীকে বাজার থেকে ফিরতে দেখে মরিয়ম খাতুন বললেন, তুমি বস। আমি দেখি তোমার চাচা কী বাজার করে এনেছেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে স্বামীর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বললেন, আপনি বারান্দায় গিয়ে বসুন, আমি আসছি। কথা শেষ করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।

সুলতান খাঁন সালামের উত্তর দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বরান্দায় এসে মাহবুবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, গ্রাম দেখতে যাওনি?

মাহবুবা বলল, চাচি আম্মার সঙ্গে ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম, বিকেলে যাব।

সুলতান খাঁন বললেন, জান মা, তোমার চাচি অল্প শিক্ষিত মেয়ে। ধর্ম সম্বন্ধে একরকম কিছুই জানত না। কিন্তু এ বাড়িতে আশার পর বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়ে আমার থেকে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করেছে। মাঝে মাঝে আমার ভুল-ত্রুটি হলে সংশোধন করে দেয়।

মাহবুবা বলল, চাচি আম্মা সে কথা বলেছেন। ওঁনার মতো মহিলা কখনো দেখা তো দূরের কথা, কোনো বই-পুস্তকেও পড়িনি।

সুলতান খাঁন বললেন, মুসলিম মনিষাদের জীবনী পড়ো, তা হলে তোমার চাচির থেকে আরো ভালো মহিলাদের কথা জানতে পারবে।

আচ্ছা চাচা, মাহবুব কি কলেজে পড়ার আগে মাদ্রাসায় পড়েছে?

ছোটবেলায় মক্তবে কোরআন ও নামায পড়া শিখেছে। তারপর মাদ্রাসায় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়ে হাই স্কুলে ভর্তি করে দিই। তবে ঘরে প্রচুর ধর্মীয় বই পড়েছে। আর এর পিছনে তোমার চাচির অবদান শতকরা নব্বই ভাগ। জেনে রেখ মা, একমাত্র মা-ই পারে ছেলেমেয়েকে সব বিষয়ে আদর্শবান করে গড়তে। তাই তো মাকে সব। বিষয়ে আদর্শবর্তী হতে হয়।

আপনি অতি মূল্যবান কথা বলেছেন। এখানে না এলে আমি এসব জানতে পারতাম না।

এমন সময় মরিয়ম খাতুন এসে হাত পাখা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করতে করতে বললেন, মেয়ের সঙ্গে কী এত কথা হচ্ছে?

সুলতান খাঁন বললেন, মাহবুবাকে আমরা মেয়ে হিসাবে পাব, এত বড় সৌভাগ্য। কী আমাদের কপালে আল্লাহ রেখেছেন?

মরিয়ম খাতুন বললেন, সে কথা আল্লাহপাক জানেন। কপালে রাখলে নিশ্চয় পাব। তারপর বললেন, আমি চারের মসলা ভেজে রেখেছি। বেলা হয়েছে, মাছ ধরার কথা বলেছিলেন না?

সুলতান খাঁন ঘড়ি দেখে বললেন, ঘন্টাখানেক পরে যাব। কামলাদের কাছ থেকে একটু ঘুরে আসি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন।

ঘন্টাখানেক পর ফিরে এসে গোসল করতে যাওয়ার সময় সুলতান খাঁন ড্রাইভার ও মাহবুবাকে পুকুর দেখাতে নিয়ে এলেন। মাছ ধরার জন্য কাঁধে করে খেয়া জালও নিয়ে এলেন।

পুকুর দেখে মাহবুবা বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। একবার নবাব বাড়ি দেখতে গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী দেখেছিল। বেড়াতে গিয়ে রমনা পার্কের লেকও কলাবাগানের লেক দেখেছে; কিন্তু এতবড় পুকুর কখনো দেখেনি। চারদিকের পাড়ে নানা রকম ফলের গাছ পালা দেখে মুগ্ধ হল। চারটে ঘাটেই মেয়ে পুরুষ গোসল করছে, অনেকে কাপড় কাঁচছে।

সুলতান খাঁন বাজার থেকে কয়েক পদের সুগন্ধি মসলা কিনে এনেছিলেন। সেগুলো কুড়া ও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে পুকুরে তিন জায়গায় ফেলে মাহবুবাকে বললেন, চল মা, তোমাকে বাগানের গাছপালা দেখাই। তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিও চলুন।

যেতে যেতে মাহবুবা বলল, আপনি পুকুরে দুতিন জায়গায় কি যেন ফেললেন।

সুলতান খাঁন বললেন, এতবড় পুকুরে খেয়াজালে মাছধরা খুব শক্ত। তাই সুগন্ধী মসলা দিয়ে মাছের খাবার তৈরি করে ফেললাম। সুগন্ধ পেয়ে মাছ যখন খেতে আসবে তখন জাল ফেলব। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কবে ফিরে যেতে চাও?

মাহবুবা বলল, পরশু দিন।

তা হলে কাল ছিপ ফেলব। আল্লাহ রাজি থাকলে যদি বড় মাছ ধরতে পারি, তা হলে তোমার মা-বাবার জন্য নিয়ে যাবে।

না চাচা, এত দূর থেকে মাছ নিয়ে যাওয়ার কী দরকার? ঢাকাতেই কত বড় মাছ পাওয়া যায়।

তা যাবে না কেন? কিন্তু সে সব নদীর মাছ। পুকুরের মাছের স্বাদই আলাদা। তারপর বললেন, তোমরা ঘুরে দেখ আমি যাই। বেশি দেরি করলে মাছ খাবার খেয়ে চলে যাবে।

মাহবুবা জাল ফেলে মাছ ধরা কখনো দেখেনি। বলল, অন্য সময় বাগানের গাছ। পালা দেখতে আসব, এখন আপনার মাছ ধরা দেখব।

সুলতান খাঁন প্রথমে যে জায়গায় মাছের খাবার ফেলেছিলেন, সেখানে জাল ফেললেন। কিন্তু মাছ পড়ল না। তারপর দ্বিতীয় জায়গায় ফেলতে একটা চার পাঁচ কেজি কাতলা মাছ পড়ল।

মাছ দেখে মাহবুবা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বলল, এর থেকেও বড় মাছ আছে?

সুলতান খাঁন হাসিমুখে বললেন হ্যাঁ মা আছে। প্রতি বছর একবার বেড়াজাল দিয়ে মাছ ধরে বিক্রি করা হয়। সে সময় ধরা পড়ে। তার মধ্যে দশ থেকে বিশ ত্রিশ কেজি ওজনেরও মাছ থাকে।

মাহবুবা অবাক হয়ে বলল, এতবড় মাছও আছে?

হা-মা, ওর থেকেও বড় মাছ আছে। গতবারে পঞ্চাশ কেজি ওজনের একটা ভেটকী মাছ পড়েছিল।

মাহবুবা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ওমা, তাই নাকি? অতবড় মাছ আমি। কখনো দেখিনি।

সুলতান খাঁন বললেন, তুমি চৈত্র মাসে মাহবুবের সঙ্গে এস, ঐ সময় মাছ ধরে বিক্রি করা হয়। বড় বড় মাছ দেখতে পাবে। তারপর বললেন, তুমি ঘাটে গাছের ছায়ায় বস, আমি গোসল করে নিই। মাছসহ জালটা ঘাটের উপর রেখে সুলতান খাঁন পুকুরে নেমে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে গোসল করে উঠে এসে বললেন, চল মা, এবার ফেরা যাক। ততক্ষণে ড্রাইভার সেখানে এসেছে।

পুকুরের বিশালতা ও পানি দেখে মাহবুবা প্রথমে ভয় পেয়েছিল। সুলতান খাঁন সাঁতার কাটতে কাটতে যখন পুকুরের মাঝখানে গেলেন তখন আরো বেশি ভয় পেয়েছিল। ফেরার সময় জিজ্ঞেস করল, সাঁতার কাটার সময় আপনার ভয় লাগেনি?

সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, ভয় লাগবে কেন? তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাঁতার জান?

জ্বি জানি। স্টেডিয়ামের সুইমং পুলে সাঁতার কাটি।

তা হলে ভয়ের কথা বলছ কেন?

সুইমং পুল তো এত বড় না। তা ছাড়া তাতে কোনো বড় মাছ নেই। আচ্ছা চাচা, এই পুকুরে কুমীরওতো থাকতে পারে?

নদীতে বা সাগরে যে সব বড় বড় কুমীর থাকে সে সব নেই। তবে ছোট খাট মেছোকুমীর থাকতে পারে?

মেছো কুমীর কী চাচা? তারা কী মানুষকে মেরে ফেলে?

না মা, তারা শুধু মাছ খায়। তাই তাদেরকে মেছো কুমির বলে।

পরের দিন সুলতান খাঁন দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর সুগন্ধিযুক্ত মাছের আদার (টোপ) ও হুইল ছিপ নিয়ে পুকুর ঘাটে এলেন।

ছিপে মাছ ধরা দেখার জন্য জমিরনের সঙ্গে মাহবুবাও এসেছে। জমিরন দুটো জলচৌকি ও দুটো ছাতা এনেছে।

মাহবুবাকে ঘাটের উপর ছাতা খাটিয়ে একটা জলকৌচিতে বসতে দিল। তারপর সুলতান খাঁনের কাছে গেল।

সুলতান খাঁন ততক্ষণে বঁড়শীতে টোপ গেঁথে পানিতে ফেলেছেন। জমিরনের কাছ থেকে জলচৌকি নিয়ে ছাতা খাটিয়ে বসলেন।

ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্রায় দেড় কেজী ওজনের দুটো মিরগেল মাছ ধরে ছেড়ে দিলেন। তারপর একটা বড় মাছ বঁড়শীর টোপ গিলল। অনেকক্ষণ মাছটা খেলিয়ে সুলতান খাঁন ঘাটের কিনারে নিয়ে এলেন। মাছটাকে যখন খেলাচ্ছিলেন তখন জমিরনকে ছাকনিজাল নিয়ে আসতে বলেছিলেন। মাছ কিনারে আনার পর তাকে বললেন, এবার ছাঁকনিজালে করে তুলে নে।

জমিরন মাছটা ছাঁকনি জালে তুলে ঘাটের উপরে নিয়ে এল। প্রায় ছয় সাত কেজি ওজনের রুইমাছ।

মাছটা যখন খেলছিল তখন কয়েকবার লাফ দিয়েছে। মাহবুবা দেখে যেমন আনন্দ পেয়েছে তেমনি ভয়ও পেয়েছে। জমিরন উপরে নিয়ে এসে পাকার উপর রাখতে মাছটা চটাং চটাং শব্দ করে লাফাতে লাগল। মাহবুবা জীবন্ত মাছ কখনো দেখেণি। এখন দেখে খুব আনন্দ পেল।

ঘরে এসে সুলতান খাঁন স্ত্রীকে বললেন, মাছটা ভালো করে জ্বাল দিয়ে রাখ। কাল মাহবুবার সঙ্গে তার মা-বাবার জন্য পাঠাব।

পরের দিন রওয়ানা হওয়ার সময় মাহবুবা জিজ্ঞেস করল, দুচার দিনের মধ্যে কি মাহবুবের চিঠি পেয়েছেন?

সুলতান খাঁন বললেন, তোমরা যেদিন এসেছ, সেদিনই পেয়েছি।

তার ঠিকানা দিন তো।

 ঠিকানা দেয়নি তো মা।

মাহবুবা একটা কাগজে নিজের ঠিকানা লিখে তার হাতে দিয়ে বলল পরের চিঠিতে যদি ঠিকানা দেয়, আমাকে জানাবেন। চার পাঁচ দিন আগে আমাকে না জানিয়ে বাসা পাল্টেছে।

তাই নাকি? ঠিক আছে মা জানাব। তুমি মাহবুবের সঙ্গে আবার এস।

জ্বি আসব বলে মাহবুবা-মরিয়ম খাতুন ও সুলতান খাঁনকে কদমবুসি করে গাড়িতে উঠল।

———–

প্রেম ও স্বপ্নের সমাপ্তি অংশ
“তোমার প্রত্যাশায়”

Super User