০৪.
মাহবুব সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর বাড়ি গেল। অসুখে খুব রোগা হয়ে গিয়েছিল। এই কয়েক দিনে কিছুটা ইম্প্রভ হয়েছে। তবু মরিয়ম খাতুন ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, অসুখ হয়ে বেশ রোগা হয়ে গেছিস। কিছু দিন থেকে ভালো করে খাওয়া দাওয়া করে স্বাস্থ্য ভালো হলে তারপর যাবি।
সুলতান খাঁন সেখানে ছিলেন। বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ।
মাহবুব বলল, অনেক দিন আসিনি, তাই দুএক দিনের জন্য এসেছি।
মরিয়ম খাতুন বললেন, সে কিরে, এতদিন পর এসে মাত্র দুদিন থাকবি? না বাবা না, অন্তত দশ পনের দিন থেকে শরীরটা ভালো হলে তারপর যাবি।–
মাহবুব বলল, এক সপ্তাহের বেশি থাকতে পারব না। অসুখ করে পড়ার অনেক ক্ষতি হয়েছে। পরীক্ষারও বেশি দেরি নেই। পড়াশোনা করতে হবে। নচেৎ রেজাল্ট ভালো হবে না।
সুলতান খাঁন বললেন, ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বুঝো করো।
মাহবুব ক্লাস করতে না যাওয়া পর্যন্ত মাহবুবা দুতিন দিন অন্তর মেসে এসেছে। তারপর ভার্সিটিতে দেখা করত। তিন চার দিন দেখা না পেয়ে একদিন মেসে গেল।
মাসুম তখনও ফেরেনি। রুমে তালা দেখে ফিরে আসছিল। এমন সময় মাসুমকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মাসুম কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, রুমে তালা দেখে নিশ্চয় ফিরে যাচ্ছিলেন?
মাহবুবা বলল, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনার বন্ধু নিখোঁজ কেন?
সে কথা জানতে হলে আসুন আমার সঙ্গে। তারপর রুমে এসে বসতে বলে বলল, কেমন আছেন আগে বলুন।
ভালো। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভালো, তবে বন্ধু বিহনে, ভালো করে পড়াশোনা করতে পারছি না।
তা কেন? একা একা পড়াশোনা তো ভালো হওয়ার কথা।
আপনার কাছে ভালো হলেও আমি একা একা পড়তে পারি না।
প্রাইমারীতে পড়ার সময় একজন শিক্ষকের কাছে শুনে ছিলাম।
একে গুন গুন, দুয়ে ঠিক।
তিনে গন্ড গোল, চারে হাট।
মাহবুবা হেসে উঠে বলল, আরে ভাই, ওটা তো প্রাইমারী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নয়? থাক আপনার বন্ধুর নিখোঁজের খবর বলুন।
সেতো চার পাঁচ দিন আগে বাড়ি গেছে, কেন আপনাকে জানাইনি?
জানালে কি আর খোঁজ নিতে আসতাম? কদিন থাকবে কিছু বলে গেছে?
বলে তো গেল দুদিন থাকবে। চার পাঁচ দিন হয়ে গেল এল না। মনে হয় আজ কালের মধ্যে চলে আসবে।
ঠিক আছে চলি তা হলে?
সে কি? কিছু না খাইয়ে ছাড়ছি না। বসুন চা করি, ঘরে বিস্কুট চানাচুর আছে।
চা খেয়ে মাহবুবা বিদায় নিয়ে ফিরে এল।
.
মাহবুব বাড়িতে আসার পাঁচ দিন পর সুলতান খাঁনের ভীষণ জ্বর হল। মাহবুব ডাক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। কিন্তু কোনো কাজ হল না। দিনে রাতে চার পাঁচবার জ্বর ১০৪ ডিগ্রী উঠে। মাথায় পানি দিলে, ঔষুধ খাওয়ালে কমে। ওষুধের এ্যাকসান কেটে গেলে আবার উঠে।
তিন চার দিনের মধ্যে কোনো উন্নতি না হতে মাহবুব টাউন থেকে বড় ডক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতে লাগল। আট দশ দিন পর জ্বর ভাল হল। আরো দুদিন পর। মাহবুব মায়ের সামনে আব্বাকে বলল, ডাক্তার বললেন, আপনি কয়েক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। তাই বলছিলাম এবার আমি ঢাকা যেতে চাই, আমার পড়া শোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। এমনি অসুখ হয়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে।
সুলতান খাঁন বললেন, হাঁ বাবা, তুমি কালকেই রওয়ানা দাও। আল্লাহ চাহেতো আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাব।
মাহবুব বলল, আমার হাজার বার টাকা লাগবে।
সুলতান খাঁন খুব অবাক হয়ে বললেন, এত টাকা কি দরকার?
আমার টাইফয়েড হয়েছিল। বন্ধু মাসুম, যে গত বছর বেড়াতে এসেছিল, আমরা তো মেসে একরুমে থাকি। প্রথমে সে ডাক্তার এনে চিকিৎসা করায়। তিন দিনের দিন জ্বরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ডাক্তার মেডিকেলে নিতে বলেন। মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার আগে মাহবুবা নামে আমাদের একটা জানাশোনা মেয়ে তাদের গাড়িতে করে ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করায়। সেখানে প্রায় পনের দিন ছিলাম। দশ হাজার টাকা বিল। হয়েছিল। আমার বা মাসুমের কাছে অত টাকা ছিল না। মাহবুবা দিয়েছে তাকে দিতে হবে।
সুলতান খাঁন বললেন, ঠিক আছে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।
একটা মেয়ে এত টাকা দিয়েছে শুনে মরিয়ম খাতুনের মনে সন্দেহ হল। ছেলেকে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একটা মেয়ে শুধু শুধু তোর জন্য এতকিছু করল কেন?
মাহবুব মায়ের কথার উত্তর এড়াবার জন্য বলল, জান আম্মা, মাসুম আর মাহবুবা না থাকলে হয় তো এবার মারা যেতাম। ওদের দুজনের ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।
মরিয়ম খাতুন বললেন, মাহবুবা বুঝি খুব বড় লোকের মেয়ে?
বড় লোকের মানে, ওর বাবা ভীষণ বড়লোক। বাংলাদেশের যে কয়েকজন বড় লোক আছেন, তাদের মধ্যে উনিও একজন।
মরিয়ম খাতুন অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু সে তোর জন্য অত কিছু করল কেন বলবি তো?
মাহবুব কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
কিরে বলছিস না কেন?
মাহবুব আমতা আমতা করে বলল, মেয়েটাও ভার্সিটিতে পড়ে। চেনা পরিচয় ছিল। আমার অসুখ হয়েছে জেনে করেছে।
মরিয়ম খাতুন বুঝতে পারলেন, মেয়েটা হয়তো মাহবুবকে পছন্দ করে। বললেন, আল্লাহ মেয়েটার ভালো করুক, তাকে সুখী করুক, তার মনের নেক কামনা পূরণ করুক।
মাহবুব মনে মনে বলল, আমিন।
সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে শুধু মাহবুবের লেখাপড়ার খরচের জন্য টাকা নেন। এবারে টাকা আনার আগেই জ্বরে পড়েছেন। এক সময় ছেলেকে ডেকে বললেন, তুমি আলাউদ্দিন মীরের কাছে যাও। তাকে বলবে আব্বা বার হাজার টাকা দিতে বলেছে।
মাহবুব কখনো আব্বার কথার উপর কথা বলেনি। তাই বেশ অবাক হলেও আলাউদ্দিন মীরের কাছে কেন টাকা চাইতে বলছেন, জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সামলে নিল। বলল ঠিক আছে, এক্ষুণী যাচ্ছি।
সুলতান খাঁন বললেন, তাকে বলবে আমি অসুস্থ তাই তোমাকে পাঠিয়েছি।
জ্বি বলব বলে মাহবুব বেরিয়ে গেল।
আলাউদ্দিন মীর প্রথম জীবনে একজন সাধারণ গৃহস্থ ছিলেন। নিজে সামান্য লেখাপড়া জানেন। অর্থাভাবে পাঁচ ছেলেকেও প্রাইমারী পর্যন্ত পড়িয়ে আর পড়াতে পারেন নি। তা ছাড়া ছেলেগুলোর মোটা বুদ্ধি। কিন্তু মেয়ে তাহেরা যেমন চালাক চতুর তেমনি বুদ্ধিমান। তাই সব ভাইয়েরা তাকে যেমন খুব ভালবাসে তেমনি তার আব্দারও পূরণ করে। আলাউদ্দিন মীরও মেয়েকে অত্যন্ত ভালবাসেন। মেয়ের পড়া শোনার ঝোঁক দেখে পড়া বন্ধ করেননি। দূরে কলেজ বলে যাতায়াতের জন্য বাঁধা রিক্সার ব্যবস্থা করেছেন। তাহেরা গত বছর বি.এ. পাস করেছে। এস.এস.সি. করার পর থেকে অনেক জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। আলাউদ্দিন মীরও চেয়েছিলেন বিয়ে দিতে; কিন্তু তাহেরা রাজি হয়নি। বলেছে এম.এ.পাস না করা পর্যন্ত তোমরা আমার বিয়ের কথা চিন্তা করবে না। আলাউদ্দিন মীর আদরের মেয়ের কথার প্রতিবাদ করেনি।
তাহেরা মাহবুবকে আজও ভুলতে পারেনি। তাই সে যতবার বাড়ি এসেছে ততবারই চাকর রহিমকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে। আসেনি বলে মনে আঘাত পেলেও তার প্রতি বিদ্বেষ জন্মায়নি বরং তার জন্যে আরো পাগল হয়ে উঠেছে। এবারে, তার আসার খবর পেয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল। মাহবুব আসেনি।
আলাউদ্দিন মীরের পূর্ব পূরুষদের ও তাদের বর্তমান অবস্থার কথা মাহবুব আব্বার কাছে শুনেছিল। আরো শুনেছিল, তাদের পারিবারিক পরিবেশ খুব নিচু শ্রেণীর। তাই কলেজে পড়ার সময় তাহেরা যেদিন তাকে ডেকে ভালবাসার কথা জানায় সেদিন মনের কথা না জানালেও পরে যখন চাকরের হাতে বার বার ডেকে পাঠিয়েছে তখন আব্বার কথা স্মরণ করে তার সঙ্গে দেখা করেনি। আজ তার বাবার কাছে টাকা চাইতে আসার সময় চিন্তা করতে লাগল, তাহেরা কত দিন ডেকে পাঠিয়েছে, সে একদিনও যাইনি। আজ তার সঙ্গে দেখা হলে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তা হলে কি বলবে। এই সব ভাবতে ভাবতে আলাউদ্দিন মীরের কাঁচারী বাড়ির সামনে এসে চাকর রহিমকে দেখে জিজ্ঞেস করল, মীর চাচা ঘরে আছেন?
রহিম চোদ্দ পনের বছরের এতিম ছেলে। সাত আট বছর বয়সের সময় থেকে এদের বাড়িতে চাকরের কাজ করছে। সে মাহবুবকে চিনে। তাকে দিয়েই তাহেরা মাহবুবকে ডেকে পাঠায়। বলল, দাঁড়ান দেখে আসি। তারপর বাড়ির ভিতর চলে গেল।
তাহেরা নাস্তা খেয়ে বারান্দায় এসে কুলি ফেলল। তারপরে রহিমকে দেখে বলল, কিরে কিছু বলবি নাকি?
রহিম বলল, আপা, আপনি যাকে ডেকে আনার জন্য আমাকে পাঠান, তিনি চাচার খোঁজ করছেন।
তাহেরা চমকে উঠে বলল, কি বললি? মাহবুব ভাই এসেছে?
হ্যাঁ আপা, আমি কাঁচারী ঘরের সামনে গরুর জন্য খড় কাটছিলাম। চাচা ঘরে আছে কিনা জিজ্ঞেস করল। চাচাকে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। সেকথা বললে যদি চলে যান, তাই একটু দাঁড়াতে বলে আপনার কাছে এলাম।
তাহেরা বলল, খুব ভালো করেছিস। যা ওকে কাঁচারী বাড়িতে বস, আমি আসছি। আর শোন, আব্বার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি উনি একটু পরে আসছেন।
জ্বি আচ্ছা বলে রহিম চলে গেল।
তাহেরা তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে সামান্য প্রসাধন করল। তারপর কাঁচারী বাড়িতে এসে মাহবুবকে সালাম দিয়ে বলল, আজ আমার কি সৌভাগ্য, যাকে পাঁচ-ছ-বছর ধরে ডেকেও দেখা পাওয়া যায় নাই হঠাৎ তার আগমন? তা কেমন আছ?
এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে পারে মাহবুব চিন্তা করেছিল। তাই কুণ্ঠিত হলেও সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তুমি কেমন আছ?
ভালো মন্দ জেনে কি হবে? আমার কথা কী তোমার মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন?
তা হলে পাঁচ-ছ-বছর দেখা করনি কেন? ডেকে পাঠালেও আসনি কেন?
মাহবুব উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
আমার কথার উত্তর তুমি যে দিতে পারবে না, তা আমি জানি। তবু কয়েকটা কথা না বলে থাকতে পারছি না। পাঁচ-ছ-বছর আগে একদিন এখানেই তোমাকে যে কথা বলেছিলাম, তার উত্তর শোনার জন্য আজও তোমার প্রত্যাশায় আছি। সেদিন তুমি বলেছিলে প্রেম ভালবাসা মনের ব্যাপার। যেদিন মন থেকে সাড়া পাব সেদিন। জানাব। আজও কী তোমার মনে সেই সাড়া জাগেনি?
এই কথারও উত্তর দিতে না পেরে মাহবুব চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাহেরা বসে পড়ে মাহবুবের পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে ভিজে গলায় বলল, তুমি বলতে না পারলেও আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার মনে আমার জায়গা কখনো হবে না। তোমার কথাই ঠিক প্রেম ভালবাসা কখনো জোর করে আদায় করা যায় না, ওটা মনের ব্যাপার। তবে একটা কথা মনে রেখ, বি. এ. পাশ করার পর থেকে অনেক জায়গা থেকে ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছে; তোমার জন্য তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আর একটা কথাও মনে রেখ, তোমার মনে আমার জায়গা না হলেও আজীবন তুমি আমার মনি কোঠায় বিরাজ করবে। দোয়া করি, আল্লাহ তোমার ভবিষ্যৎ জীবন সুখের ও শান্তির করুক। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল।
তাহেরার মা রোশনী বিবি রহিম তাহেরাকে যা কিছু বলেছে, খাওয়ার ঘর থেকে সব শুনেছেন। তারপর মেয়ের কথা শুনে ও তাকে সাজ-গোজ করে কাঁচারী বাড়িতে যেতে দেখে ভাবলেন, কে এই মাহবুব? তাকে তাহেরা ডেকেই বা পাঠায় কেন? এখন আবার তার কাছে গেলই বা কেন? তা হলে কী একেই তাহেরা পছন্দ করে? আর সেই জন্যই কী নানা ছুতায় বিয়ে করতে রাজি হয়নি? ছেলেটা কে দেখার ইচ্ছা দমন করতে না পেরে কাঁচারী বাড়ির পূর্ব পাশের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তাদের সব কিছু দেখছিলেন ও শুনছিলেন। মেয়েকে চোখ মুছতে মুছতে চলে যেতে দেখে তিনিও চলে গেলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে আলাউদ্দিন মীর বাইরে থেকে এসে কাঁচারী বাড়িতে মাহবুবকে বসে থাকতে দেখে তার কাছে গেলেন।
মাহবুব দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
আলাউদ্দিন মীর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, দাঁড়ালে কেন বস। তারপর নিজেও বসে বললেন, কয়েক দিন আগে তোমার আব্বার অসুখের কথা শুনেছিলাম। যাই যাই করেও কাজের চাপে যেতে পারিনি। এখন কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে এখন ভালোর দিকে। বার হাজার টাকার জন্য আব্বা আমাকে পাঠালেন।
ঠিক আছে, তুমি বস, আমি আসছি। কথা শেষ করে আলাউদ্দিন মীর বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন।
রোশনী বিবি বারান্দায় ছিলেন। স্বামী কাছে এলে বললেন, কে ছেলেটা? চেনা চেনা মনে হলেও চিনতে পারছি না।
আলাউদ্দিন মীর বললেন, চল ঘরে গিয়ে বলছি। ঘরে এসে বললেন, সুলতান খাঁনের ছেলে মাহবুব। তার অসুখ তাই ছেলেকে বার হাজার টাকার জন্য পাঠিয়েছে।
রোশনী বিবি টাকার ব্যাপারটা জানেন, তাই আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বললেন, টাকাটা দিয়ে এস. কথা আছে।
আলাউদ্দিন মীর টাকা নিয়ে মাহবুবের কাছে এসে দেওয়ার সময় বললেন, তোমার আব্বাকে বলো, এই বার হাজারই শেষ। আমার কাছে তার আর কোনো টাকা পাওনা নেই।
মাহবুব যে কথা আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি, সে কথা জানার আগ্রহ চেপে রাখতে পারল না। বলল, আব্বা আপনার কাছে কিসের টাকা পেতেন?
তোমার আব্বা কি তোমাকে কিছুই বলেন নি?
জ্বি না।
আলাউদ্দিন মীর চিন্তা করলেন, ছেলে অমত করবে বলে হয়তো সুলতান খাঁন তাকে জানাইনি। সুযোগ যখন এসেছে তখন আমারই জানিয়ে দেওয়া উচিত। নচেৎ পরে এই ছেলে আমাকে দোষ দিতে পারে। বললেন, তোমাকে লেখাপড়া করাবার জন্য বড় পুকুরটা সাত বছরের জন্য এক লাখ টাকায় সাফকবলা রেখেছেন। এই সময়ের মধ্যে টাকা ফেরৎ দিলে তোমাদের পুকুর তোমাদের থেকে যাবে। আর না দিতে পারলে সাত বছর পর আমাদের হয়ে যাবে।
কথাটা শুনে মাহবুবের মনে হল, তাকে যেন কেউ সূউচ্চ পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। অনেক্ষণ মাথানিচু করে চুপ করে রইল। তখন তার একটা হাদিসের কথা মনে পড়ল, আল্লাহ যখন কোনো লোককে অপমানিত করতে চান, তখন তার ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেন। হাদিসটা মনে পড়তে আব্বার উপর প্রচন্ড অভিমান হল। এক সময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
আলাউদ্দিন মীর তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, এতে তুমি এত চিন্তা করছ কেন? তোমার আব্বা তোমাকে উচ্চ শিক্ষিত করে মানুষ করার জন্য যা করেছেন, তা অত্যন্ত ভালো কাজই করেছেন। তার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। এই বছরই তো তুমি পাশ করে বেরোবে। এখনো দুবছর সময় আছে, এর মধ্যে তুমি রোজগার পাতি করে টাকাটা দিয়ে দিও। তা হলে তো কোনো সমস্যা নেই।
মাহবুব চোখ মুছে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসি চাচা। তারপর মাতালের মতো টলতে টলতে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
আলাউদ্দিন মীরের ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুঠে উঠে মিলিয়ে গেল। তারপর স্ত্রীর কাছে ফিরে এসে বললেন, বলো কি বলবে।
রোশনী বিবি বললেন, তুমি তো সুলতান খাঁনের পুকুর নেওয়ার তালে আছ। আর তোমার মেয়ে যে তার ছেলেকে ভালবাসে, তার কী হবে?
আলাউদ্দিন মীর চমকে উঠে বললেন, কি বাজে কথা বলছ?
বাজে কথা নয় সত্য। তারপর তাহেরা ও মাহবুবের সঙ্গে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে। খুলে বলে বললেন, আমার কি মনে হয় জান, তাহেরা মাহবুবের জন্যই এতদিন বিয়েতে রাজি হয়নি।
স্ত্রীর কথা শুনে আলাউদ্দিন মীর অনেক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর বললেন, ব্যাপারটা অনেক আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল।
তোমার এসব বোঝার সময় কোথায়? সব সময় তো চিন্তা কর, কি করে সম্পত্তি বাড়াবে। এখন আমি একটা কথা বলি শোন, তোমার মুখেই খানেদের অনেক গুণাগুণ শুনেছি। মাহবুবের গুণাগুণও তুমি আমার কাছে অনেক করেছ। এখন তাকে জামাই করার ব্যবস্থা কর।
আলাউদ্দিন মীর হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, তুমি দারুন কথা বলেছ। মাহবুবের মতো সোনার টুকরো ছেলের জন্য এক লাখ কেন, কয়েক লাখ খরচ করলেও পাওয়া যাবে না। আমি দুএক দিনের মধ্যে সুলতান খাঁনের সঙ্গে আলাপ করব। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু সুলতান খাঁন কি আমাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে রাজি হবেন। হাজার হোক আমাদের পূর্ব পুরুষরা এক সময় তাদের প্রজা ছিল।
রোশনী বিবি বললেন, সে সব অনেক আগের কথা। তা ছাড়া তাহেরার কথাটা আমাদের চিন্তা করতে হবে না?
ঠিক আছে তাই হবে। এখন যাই পাশের গ্রামে একটু যেতে হবে। কথা শেষ করে আলাউদ্দিন মীর বেরিয়ে গেলেন।
মাহবুব ফেরার পথে মনকে শক্ত করল। ভাবল, আব্বা আমাকে না জানিয়ে ভুল করলেও আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য করেছেন। এখন কিছু বলে তার মনে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত নিল, আব্বার সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলাপ করবে না। আরো সিদ্ধান্ত নিল, পরীক্ষার পর যেমন করে তোক উপার্জন করে আলাউদ্দিন মীরের এক লক্ষ টাকা পরিশোধ করতেই হবে। তারপর মনে মনে আল্লাহকে জানাল, আল্লাহ পাক, তুমি আমাকে এই টাকা পরিশোধ করার তওফিক দিও।
ঘরে এসে যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে আব্বাকে টাকা নিয়ে আসার কথা ও আলাউদ্দিন মীর যা বলতে বলেছিলেন বলল। তারপর পাঁচশো টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখ, আমার সাড়ে এগার হাজার টাকা হলেই চলবে।
মরিয়ম খাতুন টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আমাদের লাগবে না, তুই নিয়ে যা। তোর অসুবিধা হলে কোথায় পাবি?
মাহবুবের শুধু কান্না পাচ্ছে। মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এল।
মাহবুব চৌদ্দ দিন বাড়িতে থেকে ঢাকা ফিরে এল। আসবার সময় মাকে বলে এল, আমি টাকা চেয়ে না পাঠালে, তোমরা পাঠিও না।
মাসুম মেসেই ছিল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করল, কিরে দুদিনের কথা বলে দুসপ্তাহ পার করে এলি যে?
মাহবুব আব্বার অসুখের কথা বলল।
একটা চিঠিও তো দিতে পারতিস। এদিকে তোর মাহবুবা প্রতিদিন এসে আমার উপর ঝাল ঝাড়ছেন। তুই তাকে না জানিয়ে গেলি, আর সেই রাগটা আমার উপর দেখাচ্ছেন। প্রেম ও স্বপ্ন/৪
সে কথা আমাকে বলছিস কেন? তাকে বললেই পারতিস।
তা আর বলিনি; কিন্তু কে শোনে কার কথা। তার ধারণা, তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তুই না জানিয়ে গেছিস।
কেউ যদি ভুল ধারণা করে, সেজন্যে তুই আমাকে দোষী করছিস কেন? যাক, যা হওয়ার হয়েছে। তারপর টাকার বান্ডিল বের করে তা থেকে দুহাজার নিয়ে বাকি টাকা মাসুমের হাতে দিয়ে বলল, ক্লিনিকের বিলের টাকা। মাহবুবা এলে দিয়ে দিবি।
মাসুম বলল, আমি দেব কেন? তুই দিবি।
আমি দিলে নেবে না।
আর আমি দিলে বুঝি নেবে?
আমি যখন থাকবো না তখন দিবি। না নিতে চাইলে যুক্তি দেখিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবি।
মাসুম চিন্তা করে দেখল, মাহবুবের কথাটা ঠিক। বলল, ঠিক আছে, চেস্টা করব। না নিলে আমাকে দোষী করবি না বলে রাখছি।
মাহবুব আর কিছু বলল না।
পরের দিন ক্লাস করে মাহবুব মেসে ফিরল না। প্রায় ঘন্টা তিনেক লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করল। তারপর কয়েকজন জানা শোনা ছেলের সঙ্গে দেখা করে প্রাইভেট ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করে দিতে বলে সন্ধ্যের সময় ফিরল।
মাসুম জিজ্ঞেস করল, সারাদিন কোথায় ছিলি?
একটা কাজে কয়েক জায়গায় যেতে হয়েছিল।
কাজটা কি শুনি?
পরে শুনিস, এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
তোর কি হয়েছে বলতো?
এবারে বাড়ি থেকে ফিরে তোকে যেন কেমন মনে হচ্ছে। তোর বাবার অবস্থা কী ভালো নয়?
নারে আব্বা ভাল আছেন। মন খারাপ অন্য কারনে।
সেই কারণটা বলছিস না কেন?
বলার মতো হলে তুই জিজ্ঞেস করার আগেই বলতাম। এখন আমার কথা বাদ দিয়ে নিজের চরকায় তেল দে।
তা না হয় দেব; কিন্তু তোর মাহবুবা কাল এলে কি বলব? আজ প্রায় দুঘন্টা তোর জন্য অপেক্ষা করে গেছে। টাকা দিতে গিয়েছিলাম, নিল না। জিজ্ঞেস করল, কিসের টাকা? বললাম, মাহবুবের ক্লিনিকের বিল। বলল, যার টাকা সে দিলে নেব। কাল এই সময় আসব, আপনার বন্ধুকে থাকতে বলবেন। তারপর আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।
তাকে বলিস, কয়েকদিন আমি খুব ব্যস্ত থাকব, সে যেন না আসে। পরে আমিই তার সঙ্গে দেখা করব। তারপর মাসুমের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে ব্রীফকেসে তুলে রাখল।
তুই কি আমাকে অবিশ্বাস করিস?
একথা বলতে পারলি?
তা হলে কি হয়েছে বলছিস না কেন?
বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করবি না। বললাম না, বলার মতো হলে আগেই বলতাম? তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। একটু সামলাতে দে, তারপর বলব। তোকে বলব না তো কাকে বলব। তোর কাছে একান্ত অনুরোধ, আমি না বলা পর্যন্ত কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
মাসুম আহত স্বরে বলল, ঠিক আছে তাই হবে।
পরের দিন বেলা তিনটের সময় মাহবুবা মেসে এসে মাসুমকে একা দেখে সালাম দিয়ে বলল, এখনো মাহবুব ফেরেনি?
মাসুম বলল, না ফেরেনি।
আমি যে প্রতিদিন আসি, সে কথা তাকে বলেন নি?
বলেছি। তারপর মাহবুব যা বলতে বলেছিল, বলল।
ব্যস্ততার কারণ আপনাকে কিছু বলেনি?
না। জিজ্ঞেস করতে বলল, ব্যস্ততা কমলে নিজেই বলবে। তার আগে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করেছে।
ঠিক আছে, কয়েক দিন পরে আসব বলে মাহবুবা ভারাক্রান্ত মনে সেখান থেকে। ফেরার পথে চিন্তা করতে লাগল, বাড়িতে গিয়ে মাহবুবের কী এমন হল, যে কারণে আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করছে না।
আট দশ দিনের মধ্যে মাহবুব এক সহপাঠির মাধ্যমে এলিফেন্ট রোডে নাইন টেনের দুটো ছাত্র-ছাত্রী পেল। সপ্তাহে চারদিন পড়াতে হবে। বেতন দুহাজার টাকা। দুতিন মাসের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনার উন্নতি দেখাতে পারলে আরো এক হাজার বাড়িয়ে দেবে।
মাহবুব সহপাঠিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিয়ে মসজিদে গিয়ে দুরাকাত শোকরানার নামায পড়ল, তারপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর আজিমপুরে এক মেসে থাকার ব্যবস্তা করে রাত আটটায় ফিরে এল।
মাসুম পড়ছিল। পড়া বন্ধ করে বলল, আর কতদিন ব্যস্ত থাকবি?
আল্লাহর রহমতে আজই শেষ বলে মাহবুব বই পত্র গুছিয়ে বাঁধতে শুরু করল।
কিরে এসব কি করছিস?
কি করছি দেখতেই তো পাচ্ছিস।
কিন্তু কেন বলবি তো?
আমি এখানে আর থাকব না, অন্যখানে আজই চলে যাব।
মাসুম খুব অবাক হয়ে বলল, কী পাগলামী করছিস?
আমি যে কখনো পাগলামী করিনি তা নিশ্চয় জানিস?
কিন্তু কেন যাবি বলবিতো? আমি কি এমন দোষ করেছি? যে জন্যে তুই আজ দশ বার দিন আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলিসনি, এখন আবার চলে যেতে চাচ্ছিস?
তুই কোনো দোষ করিসনি। আমার তকদির আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।
তা হলে মাহবুবার কারণে তুই পালাতে চাচ্ছিস? তারপর তার দুটো হাত ধরে ভিজে গলায় বলল, না বললে কিছুতেই যেতে দেব না।
মাহবুব বলল, ঠিক আছে বলছি, তবে তার আগে তোকে ওয়াদা করতে হবে, যা বলব, কোনো দিন কাউকে বলবি না। মাহবুবাকে তো নই-ই।
করলাম।
হাত ছেড়ে বস, বলছি। তারপর আব্বা তাকে না জানিয়ে কি ভাবে লেখাপড়া করাচ্ছে এবং দুবছরের মধ্যে আলাউদ্দিন মীরের এক লাখ টাকা ফেরৎ দিতে না পারলে কি হবে, সব কিছু খুলে বলে বলল, যেমন করে থোক এই সময়ের মধ্যে আমাকে এক লাখ টাকা যোগাড় করতেই হবে।
মাসুম বলল, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু এখান থেকে চলে যাবি কেন?
এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারলি না? আরে বোকা, এখানে থাকলে মাহবুবার সঙ্গে যোগাযোগ হবে। এখন আর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আমার উচিত হবে না।
কেন? সে আবার দোষ কি করল, যে জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উচিত হবে না?
আসলে তুই শুধু বোকা নস, নীরেট বোকা। আরে নীরেট বোকা গাধা, আমার এখন দুটো সাধনা। একটা হল, রেজাল্ট ভালো করা। আর অন্যটা হল, আব্বার ঋন পরিশোধ করা। এর মধ্যে মাহবুবার সঙ্গে যোগাযোগ, রাখার সময় কোথায়? যদি আল্লাহ পাকের দয়ায় এই দুটো সাধনায় সফল হতে পারি, তখন যোগাযোগ করার চেষ্টা করব।
আমি যত বড়ই নিরেট বোকা গাধা হইনা কেন; আমার তো মনে হচ্ছে তুই তার থেকে আরো বেশি। কারণ আমি মাহবুবাকে যতটুকু জেনেছি তাতে হলফ করে বলতে পারি তুই যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখিস, সে আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।
আরে না, আত্মহত্যা কি এতই সোজা। মাহবুবা আমাকে ভীষণ ভালবাসে তা জানি। তাই বলে এরকম কাজ সে কিছুতেই করতে পারবে না। আর আমার জানা যদি সত্য হয়, তবে আজীবন অপেক্ষা করবে।
মাসুম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু সে তো আমাকে খেয়ে ফেলবে। অন্ততঃ ঠিকানাটা দে।
মাহবুব হেসে উঠে বলল, খেয়ে ফেললে তো ভালই। সে আর জ্বালাতন করতে পারবে না। আর ঠিকানাই যদি দেব তা হলে ঠিকানা বদলাচ্ছি কেন?
তোর মতলব যে কি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তোকে কিছু বুঝতে হবে না। তুই রান্নার কাজটা সেরে ফেল, আমি সব কিছু বেঁধে হেঁদে রেডি করি। খেয়ে তারপর যাব।
ঐ রাতেই দশটার সময় মাহবুব একটা রিকশাভ্যানে করে আজিমপুর মেসে চলে গেল। যাওয়ার সময় মাসুমকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, তোকে অনেক জ্বালিয়েছি মাফ করে দে। তারপর বলল, তুই চিন্তা করিস না, মাঝে মাঝে আসব। আর শোন, মাহবুবাকে বলিস, আমি খুব বাজে ছেলে। সামান্য ব্যাপারে তোর সঙ্গে রাগারাগি করে চলে গেছি। তাকে ভুলে যাওয়াই আপনার উচিত।
মাসুম বিশ্বাসই করতে পারল না, মাহবুব সত্যি সত্যি চলে যাবে। তাই কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
মাহবুব চলে যাওয়ার পর দুটো কারণে বেশ কয়েক দিন মাসুম সকালে পান্তা খেয়ে বেরিয়ে যায়। ফিরে মাগরিবের নামাযের পর। প্রথম কারণ হল, চার বছর দুজনে এক সঙ্গে ছিল। একা একা থাকতে মন চাইত না। দ্বিতীয় কারণ হল, মাহবুবা এসে মাহবুবের কথা জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দিবে।
এর মধ্যে মাহবুবা দুদিন এসে রুমে তালা দেখে ফিরে গেছে। তৃতীয় দিন এসেও তাই দেখে গলির মোড়ের ওষুধের দোকানের একজন সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করল, মাহবুব সাহেব ও মাসুম সাহেব কি আর এখানে থাকেন না?
সেলসম্যান বললেন, মাসুম সাহেবকে প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যেতে দেখি। ফেরেন সন্ধ্যের পর। ওঁর মুখেই শুনেছি, মাহবুব সাহেব কিছু দিন আগে এখান থেকে। চলে গেছেন।
ধন্যবাদ জানিয়ে মাহবুবা ফেরার সময় চিন্তা করল মাহবুব কেনই বা তার সঙ্গে দেখা করছে না, কেনই বা এখান থেকে চলে গেল? মাসুম ভাই-ই বা সারাদিন বাইরে থাকেন কেন? কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিল, আজ সন্ধ্যার পর আবার আসবে। বাসায় পৌঁছে ড্রাইভারকে বলল, এখন যেখান থেকে এলাম সন্ধ্যার পর সেখানে আবার যাব।
মসজিদে মাগরিবের নামায পড়ে মাসুম যখন গলির মুখে এল তখন ওষুধের দোকানের সেই সেলসম্যান তাকে ডেকে বললেন, যে মেয়েটি আপনাদের কাছে আসেন, তিনি দু তিন দিন এসে আপনাকে না পেয়ে ফিরে গেছেন। আজও এসেছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় আপনাদের কথা জিজ্ঞেস করে গেলেন।
মাহবুবা যে আসবে তা মাসুম জানে। তাই ঠিক আছে বলে রুমে এসে পড়তে বসল। কিছুক্ষণ পরে মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পেল, মাসুম ভাই আসতে পারি?
মাসুম গলা চিনতে পেরে চমকে উঠে পরমহুর্তে সামলে নিয়ে বলল, আসুন।
মাহবুবা সালাম দিয়ে ভিতরে এল।
মাসুম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, খাটেই বসুন।
বসতে আসিনি মাসুম ভাই, শুধু জানতে এসেছি, আমি কি এমন অপরাধ করেছি, যে জন্য মাহবুব এখান থেকে পালাল। আর আপনিও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এরকম পরিস্থিতিতে একদিন না একদিন পড়তে হবে তা মাসুম জানত। তাই কি বল ব ভেবে রেখেছে। কিন্তু রাত্রে মাহবুবা আসবে এবং এত তাড়াতাড়ি এই পরিস্থিতিতে পড়বে ভাবেনি। বলল, আপনি আগে বসুন তো।
না বসব না। এটা মেস, এমনি দিনে আসি বলে মেসের লোকজন যে সব কমেন্ট করেন, তার কিছু কিছু আমার মনে পড়ে। আজ রাতে এসেছি, সেজন্য হয় তো আরো কিছু বলবেন। আমার প্রশ্নের উত্তর পেলেই চলে যাব।
মাসুম মাহবুবের শেখান কথাগুলো বলে বলল, ও যে এত নীচ তা কল্পনাও করিনি। আর বন্ধুর নীচতার কথা কী করে আপনাকে বলব, সে কথা ভেবে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
– শুধু শুধু মিথ্যে বলে নিজেকে ছোট করবেন না মাসুম ভাই। আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না সরাসরি বললেই পারতেন। যাক, আপনাকে আর বিরক্ত করতে কখনো আসব না। আপনাকে পালিয়েও বেড়াতে হবে না। মাহবুবের ঠিকানা দিলে বাধিত হতাম।
মাসুম মাথা নিচু করে বলল, ঠিকানা চেয়েছিলাম দেয়নি।
মাহবুবা বলল, এই কথাটা অবশ্য সত্যি বলেছেন। তারপর কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, ওর গ্রামের ঠিকানা জানেন?
মাসুম জানে। বলবে কিনা চিন্তা করতে লাগল।
কি হল? চুপ করে আছেন কেন? জানা থাকলে লিখে দিন। ঢাকার ঠিকানা জানাতে নিষেধ করলেও গ্রামেরটা দিতেতো নিষেধ করেনি?
মাসুম একটা কাগজে লিখে তার হাতে দিল।
চলি বলে সালাম দিয়ে মাহবুবা বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।
মাসুম সালামের উত্তর দিতে ভুলে গিয়ে হাঁ করে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।