১১.

বরফের মত জমে গেল মুসা।

দুই হাত চোখের ওপর এনে রাস্তার দিকে তাকাল। ড্রাইভওয়ে দিয়ে V একটা ভ্যান ঢুকছে। ওটার হেডলাইটের আলো।

বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে মুসার। চকিতে পিছিয়ে গেল। তারপর ঘুরে দিল দৌড়। প্রায় ডাইভ দিয়ে এসে পড়ল পাতাবাহারের বেড়ার ওপর।

কে ও? জিজ্ঞেস করল টাকি।

আমি কি করে জানব? হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল মুসা।

বাতাসে কম্পমান বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে রইল সবাই। ভ্যান থেকে নামতে দেখল দুজন লোককে। কপালের ওপর টেনে দিয়েছে হ্যাট। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না।

পেছনের দরজা খুলল একজন। লম্বা কালো একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ টেনে নামাল।

লাশের ব্যাগ।

নীরবে তাকিয়ে রইল ছেলেরা। ভারী ব্যাগটা ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল লোক দুজনে।

একটু আগে মারা গেছে নিশ্চয়, বিড়বিড় করল টাকি। রাতেও আসা

বন্ধ নেই। কেঁপে উঠল সে।

তুমি না বললে কেউ আসবে না? ফিসফিস করে বলল মুসা।

আসার তো কথা ছিল না। তবে ওরা বাইরের লোক। তুমি ভেতরে থাকতে থাকতে আবার যদি কেউ আসে, লুকিয়ে পোডড়া। লুকানোর জন্যে অনেক কফিন আছে। নিচু স্বরে হাসল সে। তোমার তো বেজায় সাহস। পারবে না?

নিটু আর হ্যারল্ড নীরবে হাসল।

দম আটকে রাখতে রাখতে ফুসফুস ব্যথা শুরু হয়ে গেল মুসার। মনে হলো ফেটে যাবে। ফোঁস করে ছেড়ে দিল বাতাস।

ধরা পড়ার বেশি ভয় যদি করো, কডি বলল, এখনও সময় আছে, হার স্বীকার করে নাও। কষ্ট করার আর দরকারই নেই তোমার। কি বলো?

হার স্বীকারের কথা আসছে কেন? এতক্ষণে কথা বলল কিশোর। লোকগুলো গেলেই গিয়ে ঢুকবে ও। ঢুকতেই তো যাচ্ছিল।

পারকার পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা। হুডের নিচে মুখ লুকানোর চেষ্টা করল। আতঙ্কিত চেহারাটা কাউকে দেখাতে চায় না।

ফিউনরল পারলারের পাশের একটা জানালায় আলো জ্বলল। সবুজ পর্দা টানা জানালায় ভুতুড়ে লাগল আলোটা।

মিনিট দুয়েক পর আবার নিভে গেল। বেরিয়ে এল লোকগুলো। ভ্যানের কাছে এসে পেছনের দরজাটা লাগাল দড়াম করে। সামনে গিয়ে উঠে বসল।

চলে গেল গাড়িটা।

ফিরে তাকাল মুসা। সবগুলো চোখের দৃষ্টি তার দিকে।

আমি যাচ্ছি, নিচু স্বরে বলল সে।

দ্বিতীয়বার বেড়া. ফাঁক করে ঠেলে বেরোল পার্কিং লটে। এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে।

পেছন পেছন চলল বাকি সবাই। ভেজা, পাকা চত্বরে ওদের জুতোর শব্দ হতে লাগল।

বাড়িটার পেছনে পাতাশূন্য গাছগুলো বাতাসে দুলে দুলে যেন হাত নেড়ে তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল ওদের।

বাড়ির পেছনে এক চিলতে ঘাসে ঢাকা জমি আছে। পাকা চতুর থেকে সরে ওখানে পা দিতেই ফচ্ করে ভেজা মাটিতে ডেবে গেল মুসার জুতো। তারপর যতবার পা ফেলল ফচ ফচ করতেই থাকল।

পেছনের জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দপদপ করে লাফাচ্ছে কপালের কাছে শিরাটা। কাঁচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে উঁকি মেরে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। কিছুই দেখতে পেল না। ভেতরে অতিরিক্ত অন্ধকার। কোন রকম আলো নেই। থাকলেও পর্দার জন্যে ভেতরের জিনিস দেখা যেত না।

দাঁড়িয়ে আছো কেন? জানালা খোলো, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল টাকি। কণ্ঠস্বরে মনে হলো ভয় পাচ্ছে।

কাঁচের গায়ে পুটুর পুটুর আওয়াজ তুলছে বৃষ্টির ফোঁটা। দুই হাত বাড়িয়ে কাঠের ফ্রেম চেপে ধরে ঠেলা দিল মুসা। সহজেই ওপর দিকে উঠে গেল পাল্লাটা। দমকা বাতাসে দুলে উঠল জানালার দুদিকের পর্দা। জীবন্ত মনে হচ্ছে ও দুটোকে।

জানালার চৌকাঠের ওপর দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল মুসা। এইমাত্র যে লাশটা আনা হলো, কোথায় রেখে গেল ওটা? কিছুই চোখে পড়ছে না।

তীব্র একটা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারল নাকে।

উঁহ, কি গন্ধ! নাক কুঁচকে ফেলল মুসা।

লাশের গন্ধ, একপাশ থেকে বলল কডি। পচা, ফুলে ওঠা লাশ।

ওর কথায় কান দিয়ো না, কিশোর বলল, ওটা ফরমালডিহাইডের গন্ধ। লাশের গায়ে মাখানো হয়।

পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল মুসার। গন্ধটা সহ্য করতে পারছে না।

হার স্বীকার করবে? মুসার কাঁধে আবার আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত রাখল টাকি। দেখো, টাকা-পয়সা হাতের ময়লা। প্রাণই যদি না বাঁচল টাকা দিয়ে কি করবে? বলো, ভয় পেয়েছ। পেয়েছি  শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই ছেড়ে দেব।

না! তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল কিশোর। মুসা আমান ভয় পায় না! ভয় শব্দটা ওর অভিধানেই নেই। বিশ্বাস না হয় রবিনকে জিজ্ঞেস করে দেখো। কি বলো, রবিন?

নীরবে মাথা ঝাঁকাল রবিন।

 মুসা, উঠতে পারবে? ঠেলা দেব? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না, লাগবে না, দুই হাতে চৌকাঠ চেপে ধরল মুসা। দেয়ালে পা বাধিয়ে বেয়ে উঠে গেল ওপরে। অন্যপাশে পা ঝুলিয়ে দিয়ে চৌকাঠে বসল।

.

১২.

পর্দার কোনাগুলো বাতাসে উড়ে এসে পেঁচিয়ে ধরতে গেল যেন মুসার গলা।

প্রথম কফিনটা, মনে করিয়ে দিল টাকি, অন্য কোন কফিনে ঢুকলে কিন্তু হবে না। যাও, নামো। ডালা খুলে ঢুকে পড়ো।

আমরা কিন্তু তাকিয়ে রইলাম, কড়ি বলল।

ইস, আমার ক্যামেরাটা কেন যে আনলাম না, আফসোস করতে লাগল হ্যারল্ড। আতঙ্কে পাগলের মত চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাচ্ছে মুসা আমান-এমন একটা দৃশ্যের ছবি তোলার সুযোগ আর জীবনে পাব না।

থামো! কঠিন স্বরে ধমকে উঠল কিশোর। একদম চুপ! ফাজলেমি মার্কা আর একটা কথা বললে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি!

ওদেরকে ঝগড়ার সুযোগ দিল না মুসা। লাফিয়ে নামল ভেতরে। ধীরে ধীরে সোজা করল শরীরটা।

বাতাসে পর্দা দোলাচ্ছে। একটা পর্দার নিচের অংশ আলতো বাড়ি মারছে তার পিঠে। আরেকটা পর্দার কোনা এসে আবার পেঁচিয়ে ধরতে গেল গলা।

টান দিয়ে গলা থেকে পর্দাটা সরিয়ে সামনে তাকাল সে। অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করল।

কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আলো জ্বালব? কিছু তো দেখছি না।

না, আলো জ্বালানো চলবে না, টাকি বলল। ঠিক আছে, কফিনটা কোনখানে দেখানোর ব্যবস্থা করছি। একটা টর্চ বের করে জানালার ফ্রেমের ওপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে জ্বালল সে। ম্লান একটা গোল আলো গিয়ে পড়ল মেঝেতে।

কয়েক পা এগিয়ে গেল মুসা। আলোটা স্থির হয়ে আছে এক জায়গায়।

পেছনে আরেকটা টর্চ জ্বলে উঠল। কডি জ্বেলেছে। আলো দুটো খুদে স্পটলাইটের মত ঘুরে বেড়াতে লাগল মেঝেতে।

সেই আলোর আভায় যতটা সম্ভব ঘরটা দেখে নিতে লাগল মুসা। ছাত একেবারেই নিচুতে। ওর মাথার ফুট দুই ওপরে। পাশাপাশি রাখা দুটো ধাতব টেবিল দেখতে পেল। একটা খালি। আরেকটার ওপর লম্বা কোন জিনিস প্ল্যাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢাকা। তলায় কি আছে বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর।

একদিকে একটা ডেস্কের ওপর রাখা কাগজ ফড়ফড় করছে বাতাসে। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একসারি ফাইলিং কেবিনেট। নানা রকম কয়েল আর টিউব। হাসপাতালের ঘরের মত। ওগুলোর পাশে নিচু টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা কালো রং করা কফিনের সারি। টর্চের আলোর আভায় চকচক করছে।

খাইছে! ঝুলে পড়ল মুসার নিচের চোয়াল।

ভয় পাচ্ছো, কালটু মিয়া? কড়ি জিজ্ঞেস করল। হাতের আলোটা ঝটকা দিয়ে উঠে এল মুসার মুখের ওপর।

আলো নামাও, গাধা কোথাকার! দেখব কি করে? ধমকে উঠল মুসা।

কফিনগুলো তো দেখলে, টাকি বলল। ওই যে, প্রথম কফিনটা। যাও। টর্চের আলো ফেলে কোন কফিনটাতে ঢুকতে হবে দেখিয়ে দিল সে।

ভয় পাচ্ছে! নিটু বলল। এই, জানালার কাছ থেকে সরে যাও তোমরা। মু-ম্মুসাকে পালানোর পথ করে দাও।

ও পালাবে না, পালাবে না, পালাবে না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। কতবার বলব? তোমাদের মত মুরগীর কলজে নাকি ওর? …যাও, মুসা, এগোও। শুয়ে পড়োগে কফিনটার মধ্যে। টাকা আয়ের খুব সহজ রাস্তা।

সহজ, তবে তোমার জন্যে-মনে মনে বলল মুসা। ঈশপের গল্পের একটা উপমা মনে পড়ল: তোমাদের জন্যে খেলা বটে, আমার জন্যে মরণ! কফিনগুলোর ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবল, সত্যি কি পারবে ঢুকতে? কেমন লাগবে? ভেতরের গন্ধটা কেমন?

বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। জানালার দিকে ফিরল সে। জিজ্ঞেস করল, কফিনে শুয়ে কি ডালা নামিয়ে দিতে হবে?

ঢোকো, অধৈর্য কণ্ঠে টাকি বলল, শুধু ঢুকলেই হবে। আর কিছু করতে হবে না তোমাকে, মু-ম্মুসা! বাকিটা যার করার সে-ই করবে, রহস্যময় শোনাল তার কথা। জলদি করো। বাইরে যা ঠাণ্ডা।…পারবে? না পারলে চলে এসো।

পারবে না মানে? জোরগলায় বলল কিশোর। অবশ্যই পারবে। এ কোন ব্যাপার হলো!

ধীর পায়ে কফিনগুলোর দিকে এগিয়ে চলল মুসা। টর্চের আলো দুটো স্থির হয়ে আছে পেছনের সবুজ দেয়ালে। কফিনের ডালা নামানো।

যাও, মুসা, যাও! ঢুকে পড়ো! ও কোন ব্যাপারই না তোমার জন্যে! জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে মুসাকে অভয় দিল কিশোর। তাতে আরও পিত্তি জ্বলে গেল মুসার। অন্যকে পরামর্শ দেয়া সোজা!

ও এত দেরি করছে কেন? অস্থির হয়ে উঠেছে কডি। মুসার দুর্গতি দেখার জন্যে তর সইছে না যেন আর।

কফিনের ডালার ওপর হাত নামাল মুসা। কাঠের অনুভূতিটা মসৃণ, শীতল। এত জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

ডালা তোলো, মুসা-নিজেকে বোঝাল সে। তারপর ঢুকে পড়ো ভেতরে। কি আর হবে? খাট আর চৌকির মত কফিনও কাঠেরই তৈরি। সাধারণ বাক্সের মত। নিচে গদি আছে। বাক্সের ভেতরে শুলে বিছানার মতই লাগবে।

সবুজ দেয়ালে নড়ে উঠল দুটো আলোর একটা। আবার স্থির হলো।

ডালার কিনার চেপে ধরে ভারী দম নিল মুসা। টেনে উঁচু করে ঠেলে দিল ওপর দিকে। পুরোটা খুলে ফেলল। তারপর তাকাল ভেতরে।

তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে আসতে শুরু করল গলার গভীর থেকে।

.

১৩.

কাচের চোখের মত নিষ্প্রাণ দুটো চোখ। কালচে ঠোঁটে স্থির হয়ে আছে রক্ত পানি করা অস্বাভাবিক হাসি। নিচের ঠোঁটের ওপর নেমে এসেছে ওপরের পাটির একটা মাত্র দাঁত। ওই একটাই। মুখে আর কোন দাঁতই নেই। কপালে আর গালে গভীর কাটা দাগ। হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা।

চিত হয়ে আছে লাশটা। স্তব্ধ। নিথর।

চিৎকারটা বেরোয়নি মুসার মুখ থেকে। নিজে নিজেই বন্ধ করেছে না অতিরিক্ত ভয়ে আটকে গেছে, বলতে পারবে না।

জানালার কাছ থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, মুসা, কি হয়েছে?

এ-একটা…লা-লা-লাশ, কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল মুসা। কফিনের দিকে আঙুল তুলল।

বললাম না ও ভয় পাবে, হারল্ডের কণ্ঠ কানে এল তার। চেঁচিয়ে গলা ফাটাবে।

তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিকৃত হাসি হাসতে লাগল তার বন্ধুরা।

কডি বলল, আমি শিওর, এইমাত্র যে লাশটা আনল, ওটাই রেখে গেছে ওই কফিনে।

আবার হেসে উঠল ওরা।

অত হাসির কি হলো? ধমকে উঠল মুসা। এখানে একটা মানুষের লাশ রয়েছে। মৃতদেহ। এতে হাসির কি দেখলে? দেখি আলোটা নামাও নিচের দিকে।

পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে তার। গলাটা এমন শক্ত হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস ফেলার সময় চাপা শিসের মত শব্দ বেরোচ্ছে।

টর্চের আলো নিচে নামল। কিন্তু কফিনের গায়ে পড়ছে আলো, ভেতরে ঢুকতে পারছে না। কোনমতেই চেহারাটা স্পষ্ট হচ্ছে না।

ভয় পাচ্ছ নাকি? জিজ্ঞেস করল টাকি।

ও পারবে না, ঘোষণা করে দিল হ্যারল্ড।

তারমানে আমরা জিতে গেলাম, বলল কডি। দুশো ডলার!

গায়ের জোরের জেতা নাকি? কাজই শেষ হলো না এখনও, কর্কশ শোনাল কিশোরের কণ্ঠ। মাথাটা ঠেলে দিল জানালার ভেতরে। মুসা, ঢুকে পড়ো। শুয়ে পড়ো লাশটার ওপর। ও কিছু না। পারবে তুমি।…ও, দেখতে পাচ্ছো না? …এই, আলোগুলো ঠিকমত ফেলো তোমরা। না দেখলে কোথায় ঢুকবে?

লাশের ওপর শোব?

 কি হবে? এক বিছানায় শোয় না দুজন মানুষ? তফাৎ শুধু বিছানার জায়গায় বাক্স, আর গরমের জায়গায় ঠাণ্ডা লাগবে স্পর্শটা। তোমার যে একবিন্দু ভয় লাগছে না, বুঝতে পারছি আমি।

ভয় না-মুনে মনে বলল মুসা, লাগছে আতঙ্ক!

 যাও, ওঠো! কিশোর বলল।

কফিনটার দিকে ঘুরল মুসা। জানালার বাইরে চুপ হয়ে গেল সবাই। অস্পষ্ট আলোতে আরেকবার লাশটার দিকে তাকাল সে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে চেপে ধরল কফিনের কিনার।

ফরমালডিহাইডের তীব্র গন্ধ যেন পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। অসুস্থ বোধ করছে মুসা। বমি ঠেলে আসতে লাগল।

কফিনের ওপর ঝুঁকল সে। পারবে তো?

 নাহ, পারবে না!  

কফিনের কিনার ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসতে গেল।

কানে এল গোঙানির শব্দ।

ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেল তার।

অস্পষ্ট আলোতে একটা নড়াচড়া লক্ষ করল।

পরক্ষণে ঝটকা দিয়ে উঠে এল হাতটা। লাশের হাত। খামচে ধরল তার পারকা।

চিৎকার করার জন্যে আবার মুখ খুলল সে। এবারেও কোন শব্দ বেরোল না।

হাতের মুঠিটা শক্ত হলো।

থাবা মারল অন্য হাতটা।

হ্যাঁচকা টানে মুসাকে কফিনের মধ্যে উপুড় করে ফেলল।

না! বলে চিৎকার দিয়ে টানাটানি করে সরে আসতে চাইল মুসা।

 উঠে বসল লাশটা। পারকা ছাড়ল না। টানছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে কাছে।

 কাঁচের মত চোখজোড়া তাকিয়ে আছে নিষ্পলক।

গাল আর কপালের কাটা দাগটা অনেক গভীর আর স্পষ্ট লাগছে এখন।

ছাড়ো, ছাড়ো! বলে লাশের কব্জি চেপে ধরল মুসা। ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল।

ঝাড়া দিয়ে একটা হাত ছাড়িয়ে নিল লাশটা। গলা পেঁচিয়ে ধরল মুসার। কায়দা মত ধরতে পেরেছে এবার। টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল কফিনের মধ্যে।

মুখটা লাশের বুকে চেপে বসতে দেরি নেই। গায়ের জোরে এক ঝাড়া মারল মুসা। একই সঙ্গে মুক্ত হাতটা দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল বুকে।

ছুটে গেল লাশের হাত। হঠাৎ ছুটে যাওয়ায় তাল সামলাতে না পেরে মেঝের ওপর পড়ে গেল মুসা।

ভারী একটা দেহ লাফ দিয়ে এসে পড়ল তার গায়ের ওপর। হুক করে বাতাস বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। আপনা-আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা, খাইছে! পরক্ষণে চিৎকার করে উঠল, সরো, সরো ওপর থেকে, শয়তান কোথাকার!  

কিন্তু সরল না জ্যান্ত হয়ে ওঠা লাশ। ওটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করল মুসা। গড়িয়ে সরে আসতে চাইল নিচ থেকে। দুই হাত বুকে ঠেকিয়ে ধাক্কা মারতে লাগল।

কিন্তু লাশের গায়ে শক্তি কম না। দুই হাতে মুসার বাহু খামচে ধরে পেটের ওপর বসে রইল ওটা।

চলল ধস্তাধস্তি। টানাটানি। গোঙানো। বুকের পাঁজর ব্যথা করছে মুসার। মাথা ঘুরছে। ভূতের সঙ্গে লড়াই করে আর কতক্ষণ টিকবে, বুঝতে পারছে না।

আচমকা ঝটকা দিয়ে উঠে গেল তার ডান হাতটা। দুর্বল জায়গা মনে করে লাশের চুল চেপে ধরে মারল হ্যাঁচকা টান।

একটানে খুলে নিয়ে এল মাথাটা!

.

১৪.

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত বোকা হয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। ওটা যে মাথা নয় বুঝতে সময় লাগল। কাটা দাগগুলো কুচকে গেছে। বেরিয়ে থাকা একমাত্র দাঁতটা সহ ধসে পড়েছে ঠোঁট দুটো। একটা মুখোশ। রবারের মুখোশ।

বড় করে ঢোক গিলে লাশের মুখের দিকে তাকাল সে। শুঁটকি টেরি!

টেরি? কফিনের মধ্যে ঢুকে শুয়েছিল? আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল তার। যখন দেখেছে, দলের সঙ্গে টেরি নেই। তারপর ও ঢোকার জন্যে এগিয়ে যেতেই ভেতরে ঢুকল ভ্যানটা, যেন আর সময় পেল না। ভ্যানের লোকগুলোকে ঠিক করে রেখেছিল টেরি, সময় মত লাশ ভরার ব্যাগে করে টেরিকে এনে কফিনে রেখে গেছে ওরা। সেজন্যেই বার বার বলে দিয়েছিল টাকি, সামনে যে প্রথম কফিনটা পড়বে, সেটাতে ঢুকতে। তারপরেও আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে টর্চের আলো ফেলে দেখিয়ে দিয়েছে।

ইস, আমি একটা গাধা! মনে মনে নিজেকে গাল দিল মুসা। মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। কিন্তু ওর চুল এতই ছোট করে ছাঁটা, কোকড়া হয়ে তারের জালের মত বসে আছে, ধরাই যায় না। তাই আপাতত ছেঁড়ার হাত থেকে বেঁচে গেল চুলগুলো। ছুঁড়ে ফেলল হাতের মুখোশটা।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। মুখ ফাঁক। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। দম নিতে ব্যস্ত।

মুসা ভাবছে, এখুনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াবে টেরি। হাসতে হাসতে নিজের বিজয় ঘোষণা করবে। কারণ, মুসা ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে। সবাই শুনেছে সেটা।

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়তে লাগল টেরি। কি করে বুঝলে তুমি, ওর মধ্যে আমি আছি?

জ্বলে উঠল ছাতে লাগানো আলো। উজ্জ্বল আলোয় চোখ মিটমিট করতে করতে ফিরে তাকাল মুসা। দেখল, জানালা গলে ঘরে ঢুকেছে টাকি। বাকি সবাইও ঢুকছে।

এগিয়ে এসে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলা মুখোশটা তুলে নিল টাকি। হাতে পেঁচাতে শুরু করল নরম রবারে তৈরি জিনিসটা।

রবিন আর কিশোর এসে দুদিক থেকে ধরে মুসাকে টেনে দাঁড় করাল।

বিমূঢ়তা কাটেনি টেরির। মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করল, আমি, সেটা কি করে জানলে?

জবাব দিল না মুসা। সে নিজেও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। টেরি রয়েছে, কল্পনাই করেনি। সত্যিকারের লাশ ভেবেছে।

ঘটনাটা যে কাকতালীয়ভাবে মুসার পক্ষে চলে এসেছে, কিশোরও অনুমান করে নিয়েছে সেটা। মুসা সত্যি কথাটা ফাস করে দেয়ার আগেই। সুযোগটা কাজে লাগাল, মুসাকে বোকা বানানো তোমার কর্ম নয়, টেরি, সে তো আগেই বলেছি। নইলে কি আর এত টাকা বাজি ধরতাম।

আমার মাথায়ই ঢুকছে না, মেঝেতে পা ছড়িয়ে দিয়ে, দুই হাত পেছনে নিয়ে গিয়ে তাতে ভর দিয়ে শরীরটা উঁচু করে রেখেছে টেরি। আমি ভেবেছি, দেখামাত্র লেজ তুলে দৌড় দেবে তুমি। কিংবা বাবাগো-মাগো চিৎকার দিয়ে ভিরমি খেয়ে পড়বে।

খলখল করে হেসে উঠল কিশোর। তাহলেই বোঝো, শুঁটকি, তোমার ক্ষমতা। হাত বাড়াল, আজ আর মাপ করছি না। টাকাটা দিয়ে দাও। তোমরা হেরেছ।

কিন্তু কথা যেন কানেই ঢুকছে না টেরির। শক পাওয়া মানুষের মত বিড়বিড় করেই চলল, তুমি টেনে আমার মুখোশ খুলে নিলে! জানো বলেই নিয়েছ। কি করে জানলে? কি করে?

মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল কিশোর। মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝাল-বোলো না, খবরদার!

চুপ করে রইল মুসা। সে যে ভয় পেয়েছে, আতঙ্কে আরেকটু হলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল–জানতে পারলেই আবার পেয়ে বসবে টেরির দল।

শুঁটকি না হলে এ রকম ছাগুলে বুদ্ধি কেউ করে? তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিশোর। ছ্যাহ! মুখোশ পরে মরা লাশ সাজে। মুসা আমান তো বিরাট ব্যাপার, একটা দুধের বাচ্চাও ধরে ফেলতে পারত এটা। আসল লাশকেই যে ভয় করে না, সে তোমাকে ভয় পাবে ভাবলে কি করে?

এতক্ষণে যেন সংবিত ফিরল টেরির। উঠে দাঁড়াল। তাই নাকি?

লজ্জা থাকলে আবার তাই নাকি বলছ। তুমি তো জ্যান্ত মানুষ, সত্যিকারের মরা লাশ থাকলেও কফিনে ঢুকতে পারবে মুসা, ঘোষণা করে দিল কিশোর। সামান্যতম বুক কাঁপবে না ওর। একবার মর্গে ঢুকে আমি আর রবিন ভয়ে দিলাম দৌড়, হাসতে হাসতে গিয়ে লাশের গালে গাল ঘষতে লাগল সে।

কিশোর, দোহাই তোমার! চুপ করো! আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল মুসা। মুঠো শক্ত হয়ে গেছে তার। এই জঘন্য খেলা…

দেখলে, কি বিনয়? প্রশংসা পর্যন্ত সইতে পারছে না।

চোখের পাতা সরু হয়ে এল টেরির। মুসার কাঁধ থেকে টোকা দিয়ে লাশ বাধা দড়ির একটা টুকরো ফেলল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আসল লাশকেও তাহলে ভয় পাও না?

ইয়ে… বলতে গেল মুসা।

না, পায় না, মুসাকে কথা বলতে দিল না কিশোর।

ওর দিকে ঘুরল টেরি। বেশ। একটা শেষ বাজি। মুসার সর্বশেষ পরীক্ষা…।

তুমি ওর পরীক্ষা নেয়ার কে? রেগে উঠল রবিন।

বেশ, পরীক্ষা নয়, হাসল টেরি, ফাইন্যাল চ্যালেঞ্জ।

চ্যালেঞ্জ, শব্দটা এমন ভঙ্গিতে বলল টেরি, ভয় পেয়ে গেল মুসা।

পাঁচশো ডলার বাজি, কিশোরকে বলে মুসার দিকে তাকাল টেরি। সহসাই আবার দেখা হবে আমাদের, মু-ম্মুসা। খুব শীঘ্রি। এখানে। এই ঘরে।

হাত বাড়াল কিশোর, টাকাটা! মাপ চাইলে অবশ্য মাপ করে দিতে পারি।

দ্বিধা করল টেরি। তারপর পকেটে হাত ঢোকাল। বের করে আনল শূন্য হাতটা। আনতে ভুলে গেছি। একবারেই নিও।

.

১৫.

পরের রাতে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে মুসা। এর একটা বিহিত Wil করতেই হবে। বন্ধ করতে হবে এই যন্ত্রণা। এ ভাবে সারাক্ষণ মানসিক চাপের মধ্যে থাকার চেয়ে তোতলা মুসা হওয়া বরং অনেক ভাল।

কিশোরকে ফোন করল সে। তৃতীয়বার রিঙ হতে তুলে নিল কিশোর, হালো, কিশোর পাশা বলছি।

আমি। মুসা।

ও, মুসা। কি খবর? থার্ড চ্যাপ্টারের অঙ্কগুলো মিলছে না তো?

জাহান্নামে যাক অঙ্ক! অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমি। এত মানসিক চাপ নিয়ে হোমওঅর্ক করা যায় না।

মানসিক চাপ? অবাক হলো কিশোর। কিসের?

 কিসের, জানো না?

টেরির ফাইন্যাল চ্যালেঞ্জ।

অ, হাসল কিশোর, ওটা কোন চাপ হলো নাকি? যাব আবার। লাশের কফিনে শুয়ে দেখিয়ে দেবে তুমি। ব্যস, হয়ে গেল। পাঁচশোটা কড়কড়ে ডলারও এসে যাবে, তুমিও হিরো হয়ে যাবে স্কুলে। কেউ আর তোমাকে তোতলা মুসা বলে খেপাবে না।

খেপালে খেপাক! মড়ার সঙ্গে শুতে পারব না আমি। মর্গের মিথ্যে কথাটা কেন বললে ওদের?

মুসা, এখন এ সব সাধারণ কথা নিয়ে আলোচনার সময় নেই। অঙ্কগুলো শেষ করতে হবে। রাখি? পরে দেখা হবে।

ফোন রেখে দিল কিশোর।

রাগে জ্বলতে লাগল মুসা। রবিনকে ফোন করল।

সব কথা শুনে রবিন বলল, কিশোরের কাজ-কারবার আমারও কেমন অবাক লাগছে। কিন্তু বিনা কারণে তো কিছু করে না ও। ওর মনে কি আছে ও-ই জানে।

টেরির এই শয়তানিটা বন্ধ করা দরকার।

হ্যাঁ, দরকার।

তাহলে কিছু একটা করো। সাহায্য করো আমাকে। আমি ভাবলাম, রকি বীচে এসে কত না আরামে থাকব। কিন্তু এ যে গ্রীন হিলসের চেয়েও খারাপ অবস্থা।

অস্থির হয়ো না, মুসা। টেরির দল তোমার কিছু করতে পারবে না।

রবিনের কথায় খানিকটা সান্ত্বনা পেল মুসা।

ফোন রেখে দিয়ে বিছানায় বসল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠল আবার। ভাবল রবিন করেছে। কিন্তু কানে ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল একটা ব্যঙ্গভরা কন্ঠ, কি ব্যাপার, মু মুসা? কার সঙ্গে এত বকরবকর করছিলে? তোমার প্রেতাত্মার সঙ্গে?

টা-টা-ট্টাকি!

হ্যাঁ, টা-টা-ট্টাকি! শোনো, টেরি বলেছে, ফাইন্যাল বাজিটা হবে কাল রাতে। ফিউনরল পারলারেই। কাল রাত, মনে রেখো। ভুললে, বাজি হারবে।

*

পরদিন। পাশাপাশি হাঁটছে কিশোর আর মুসা। পরিষ্কার রাত। সেদিনের মত বৃষ্টি নেই। তবে কনকনে ঠাণ্ডা। একফালি ফ্যাকাশে চাঁদ ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়ি-ঘরের ছাতের ওপর নীলচে-ধূসর আকাশে। গাছগুলো আজ শান্ত, নিথর।

টেরিদের বাড়ির বাইরে তাকে আর তার বন্ধুদেরকে পাওয়া গেল। কিশোরদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোররা আসতে সবাই মিলে দল বেঁধে চলল ফিউনরল পারলারে।

নিটু আর হ্যারল্ড একটা টেনিস বল লোফালুফি করতে করতে চলেছে। ধরতে গিয়ে বার বার মিস করছে নিটু। অন্ধকার লন থেকে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে আনছে বলটা।

 টেরি, টাকি, কডি তিনজনেই গম্ভীর। আজ রাতে ওরা ফালতু কিছু করতে চায় না।

আগের দিনের দুশো, আজকের পাঁচশো-মোট সাতশো ডলার, এনেছ? জানতে চাইল কিশোর।

টেরি বলল, জেতো আগে, তারপর দেখা যাবে।

তারমানে টাকাটা তোমার মেরে দেয়ার ইচ্ছে?

মোটেও না। তুমি টাকা এনেছ কিনা, তাই বলো।

টাকার প্রয়োজন হবে না আমাদের, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল কিশোর। কারণ বাজিটা হারছি না আমরা। মুসার পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, মুসা, রবিন আর আমার একটা সমস্যাই হবে।

কি?

এতগুলো টাকা কি করে খরচ করব।

 অ, তাই তো! এতক্ষণ খেয়াল করলাম না, আশ্চর্য! রবিন কোথায়?

শরীর খারাপ। জ্বর। সেদিন রাতে ঠাণ্ডা লেগেছে। শুয়ে আছে কম্বলের তলায়।

আহহা, মিস করল। দেখতে পারল না। আজকের দেখাটাই সবচেয়ে জরুরী ছিল।

দেখো, কিশোর বলল, তোমাকে আগেভাগে বলে দিচ্ছি, কোন রকম ফালতু নাটক করতে যাবে না। দেখতে দেখতে অসহ্য হয়ে গেছি। সত্যিকারের ভয় দেখানোর মত কিছু করতে পারলে করো, নইলে চলো, চলে যাই। ফিরে গেলে সব টাকা এবারেও মাপ করে দিতে রাজি আছি আমি।

তারমানে ঘাবড়ে গেছ! খিকখিক করে হাসল টেরি। মানে মানে কেটে পড়তে চাইছ। তা হবে না। কালটুটাকে মু-ম্মুসা বানিয়েই ছাড়ব আমি।…আজকে আর নকল কিছু নয়। একটা আসল লাশ আছে।

হাঁটার সময় হঠাৎ ফুটপাতের কিনার থেকে মুসাকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় নামিয়ে দিল কুডি। কি, কালটু, লাশের কথা শুনে পানি আছে কলজেতে? সত্যি কথাটা স্বীকার করে ফেলো না ছাই।

এমন জোরে এক ধাক্কা মারল কিশোর, ফুটপাত থেকে রাস্তায় পড়ে একেবারে চিত হয়ে গেল কডি। এবার হাত দিয়ে দেখো তো তোমার কলজেতে পানি আছে নাকি?

উঠে দাঁড়াল কডি। ঘুসি পাকিয়ে ছুটে আসতে গেল কিশোরের দিকে। ততক্ষণে সামলে নিয়েছে মুসা। রুখে দাঁড়াল কডিকে।

ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে ধমক দিয়ে কডিকে থামাল টেরি।

নীরবে পথ চলল এরপর সবাই। আর কোন অঘটন ঘটাল না।

পাতাবাহারের বেড়ার ধারে পার্কিং লটের পেছনে আগের দিনের জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। অন্ধকারের মধ্যে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন ফিউনরল পারলারটা। আজ রাতে বৃষ্টি নেই। বাতাসও নেই। সব কেমন থমথমে। এক ধরনের ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। মৃত্যুর মত নিথর।

টেরির পিছু পিছু পেছনের জানালাটার দিকে এগিয়ে চলল সবাই। পার্কিং লটের পাকা চত্বরে জুতো ঘষার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

বিল্ডিঙের পেছনের ঘন অন্ধকারের মধ্যে এসে ঢুকল ওরা। বন্ধ জানালাটা খুলল টেরি। মুসাকে ইঙ্গিত করল আগে ভেতরে ঢোকার জন্যে।

দ্বিধা করতে লাগল মুসা। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, সত্যি সত্যি লাশ আছে?

মাথা ঝাঁকাল টেরি। আছে। সত্যিকারের মড়া। আজ সকালে রেখে গেছে। সেজন্যেই তো আজকে আসতে বললাম।

মড়াটা এখনও তাজা, রসিকতার ঢঙে বলল হ্যারল্ড।

কেউ তার কথায় হাসল না।

ভ্যান থেকে কালো ব্যাগে ভরে সেদিনকার লাশ নামানোর দৃশ্যটা মনে পড়ল মুসার। সেদিন অবশ্য ভেতরে টেরি ছিল। কিন্তু দৃশ্যটা ভয়ানক। গায়ে কাঁটা দিল তার।

টেরি বলল, যাও, মু-ম্মুসা। আজ দেখব তোমার সাহস কেমন। জলদি করো। কে, কখন লাশ রাখতে চলে আসবে ঠিক নেই। ঠেলা দিয়ে মুসাকে জানালার চৌকাঠে তুলে দিল সে। যাও, যাও, তোমার কাজ শুরু করো।

শেষবারের মত সবার দিকে ফিরে তাকাল মুসা। ভঙ্গি দেখে মনে হলো চিরকালের জন্যে যাচ্ছে, আর কোনদিন দেখা হবে না ওদের সঙ্গে।

তারপর লাফ দিয়ে নামল ভেতরে।

Super User