১৬.
সঙ্গে সঙ্গে নাকে এসে ধাক্কা মারল ফরমালডিহাইডের বিশ্রী, তীব্র বা গন্ধ। আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি। নাক টিপে ধরল সে। মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে লাগল।
পেছনে খসখস শব্দ। তারপর জুতো পায়ে ধপ করে নামিয়ে নামল কেউ। বাইরে যারা ছিল সবাই জানালা গলে এক এক করে ঢুকতে শুরু করেছে।
আলো জ্বেলে দিল টেরি। ছাত থেকে ভূতের জ্বলন্ত কানা চোখের মত তাকিয়ে রইল ম্লান আলোটা। রহস্যময় করে তুলল ঘরের পরিবেশ। আলো আঁধারির খেলা। লম্বা লম্বা, উদ্ভট ছায়া সৃষ্টি করেছে টেবিল আর কফিনগুলোর আনাচে-কানাচে।
মুসার মনে হলো ওই ছায়ার মধ্যে ঢুকলে আর জ্যান্ত বেরোনোর আশা নেই। দ্বিধা করতে লাগল সে। কিশোরের দিকে তাকাতে মাথা ঝাঁকাল সে।
সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে কফিনের সারির দিকে এগোল মুসা। সবগুলোর ডালা নামানো। মলিন আলোতেও চকচক করছে কালো পালিশ করা বাক্সগুলোর গা।
কাঁধে হাতের চাপ পড়ল। ফিরে তাকাল মুসা। পিত্তি জ্বালানো কুৎসিত হাসিতে ভরে গেছে টেরির মুখ। সমস্যাটা কি তোমার? এত দ্বিধা কেন? ভয় লাগছে?
জবাব দিল না মুসা। কফিনের সারির ওপর দৃষ্টি স্থির। কাঁধে হাতের চাপ বাড়ল। চাইলে সুযোগ একটা দিতে পারি তোমাকে। ফিরে তাকাল মুসা। সুযোগ? মাথা ঝাঁকাল টেরি। বুঝতে পারছি, প্যান্ট ভেজানোর সময় হয়েছে তোমার। মেঝেতেও পড়বে। পরিষ্কার করবে কে? তারচেয়ে তোমাকে বেরিয়ে যেতে দেয়া উচিত।
হেসে উঠল তার সঙ্গীরা।
কার প্যান্ট খারাপ হয় আজ, দেখা যাবে, রহস্যময় কণ্ঠে বলল মুসা। ফালতু কথা বাদ দিয়ে কোটাতে ঢুকতে হবে তা-ই বলো! ।
চোখের পাতা সরু সরু হয়ে এল টেরির। গলাবাজিটা থাকবে না হে, কা-কা-কালটু মিয়া! বুড়োটা মরেছে বড় সাংঘাতিক মরা। ক্যান্সারে ভুগে ভুগে জ্যান্ত থাকতেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল শরীরটা। তোমাকে অবশ্য বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে হবে না ওকে। হাত মেলাবে। তারপর কফিনে ঢুকে দুই গালে চুমু খাবে। ব্যস।…এসো আমার সঙ্গে।
মুসা ভয় পেয়েছে কিনা বুঝতে পারল না টেরি। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ল, ভয় তো পেয়েছ বোঝাই যাচ্ছে। টাকাটা দিয়ে দাও আমাদের, চলে যাও। এখন দিলে আর পাঁচশো দিতে হবে না; আগের বার যেটা ছিল, দুশো-সেটা দিলেই চলবে।
মুসা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুঁটকিটার বকবক শুনছ কেন? ফরমালডিহাইডের চেয়ে বেশি দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ওর গা থেকে, বমি আসছে আমার, শীতল কণ্ঠে কিশোর বলল। যাও, সেরে ফেলো কাজটা।
ফ্যাকফ্যাক করে হাসল টেরি। একটু পরেই বোঝা যাবে কার গা দিয়ে বেশি গন্ধ বেরোয়। ধোপাও ধুতে চাইবে না তোমাদের কাপড়।
কোন কফিনটাতে ঢুকতে হবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
একটা কফিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল টেরি। সাহায্য করতে ডাকল টাকিকে। দুজনে মিলে চেপে ধরে তুলতে শুরু করল ভালাটা।
লাশটার ওপর চোখ পড়ল মুসার। ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে।
চিত হয়ে শুয়ে আছে লাশটা। কালো স্যুট, সাদা শার্ট, কালো টাই। দুই পাশে লম্বা হয়ে পড়ে আছে হাত দুটো। আঙুলগুলো মোমের মত ফ্যাকাশে।
মাথার চুল উঠে গেছে রোগের কারণে। পাতলা ফুরফুরে চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ে দেয়া হয়েছে পেছন দিকে। ঠেলে বেরিয়ে আছে বড় বড় লাল তিলে ভরা কপাল। চোয়াল বসা। মুখে মাংস বলতে নেই। চোখ বোজা। ঠোঁটের রঙ দেখে মনে হয় ড্রাকুলার মত রক্ত খেয়েছিল, শুকিয়ে কালচে– বাদামী হয়ে আছে। মারা যাওয়ার আগে মুখের মধ্যে রক্ত চলে এসেছিল। বোধহয়, সেখান থেকেই দুএক ফোঁটা বেরিয়ে ঠোঁটে লেগে গেছে। মুখের চামড়ার রঙটাও স্বাভাবিক নয়, ফ্যাকাশে কমলা।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল মুসা। তারপর কফিনের ওপর ঝুঁকল।
যাও, কিশোর বলল, কোন অসুবিধে নেই। সব ঠিক আছে।
ফিরে তাকাল মুসা, কি-কি-কিন্তু লা-লা-লাশটা যদি সত্যি সত্যি খামচে ধরে?
হেসে উঠল কডি। মুসার দিকে আঙুল তুলে বলল, কা-কা-ক্কালটু মুসার চেহারা দেখো। আজকে সত্যি সত্যি পেসাব করে দেবে।
হেসে উঠল নিটু আর হ্যারল্ড।
লাশের পায়ের দিকটাতে রয়েছে টাকি। ডালা থেকে হাত সরায়নি। সে হাসল না। লাশটার চকচকে কালো জুতো আলোয় চমকাচ্ছে। অস্বস্তিভরে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
মুসাকে ডাকল টেরি, নাও, হাত মেলাও বুড়োর সঙ্গে। যদি সাহস থাকে।
ঢোক গিলল মুসা। লাশটার দিকে তাকিয়ে আছে চিন্তিত ভঙ্গিতে। মুখ তুলে দেখল বাকি কফিনগুলো।
ওগুলোর দিকে তাকাচ্ছ কেন? এটাতে ঢুকতে বলা হচ্ছে তোমাকে। পারবে? জিজ্ঞেস করল টেরি। নাকি হার স্বীকার করে নেবে? এটা কিন্তু সত্যি সত্যি লাশ। আজ আর কোন ফাঁকিবাজি নেই।
কফিনগুলো দেখাল মুসা, ওগুলোতে লাশ নেই?
আছে হয়তো, জানি না থাকলেও বহুদিনের। পচা-গলা। মুচকি হাসি ফুটল ঠোঁটে, কেন, তাজাটা পছন্দ হচ্ছে না? পচাগুলোর গালে চুমু খাবে?
তাড়াতাড়ি মুখ ফেরাল মুসা। আ-আমি…ঠিক আছে, ঢুকছি!
প্রথমে হাত মেলাও, তারপর ভেতরে ঢোকো। কোলাকুলি করো, দুই গালে চুমু খাও, এবং বেরিয়ে এসো।
ভারী দম নিল মুসা। বাতাসটা আটকে ফেলল ফুসফুসে, ছাড়ল না। তারপর আস্তে বাড়িয়ে দিল ডান হাতটা। চোখ বুজল।
ভাবছে, সত্যি সত্যি মরা মানুষের সূঙ্গেই হাত মেলাতে যাচ্ছে?
ধরল হাতটা। বাপরে! কি ভয়ানক ঠাণ্ডা! তারমানে আসল লাশই!
চোখ মেলল।
ঝাঁকি দাও, টেরি বলল।
ঝাঁকি দিল মুসা। একবার। দুবার। শক্ত হয়ে গেছে হাতটা। নড়তে চাইল না।
কি বুঝলে, পচা শুঁটকি? ভুরু নাচাল কিশোর। তোমরা হেরে যাচ্ছ, লিখে রাখতে পারো।
দেখাই যাক না, টেরি বলল, মাত্র তো শুরু করেছে। এবার ভেতরে ঢোকো। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো লাশটার ওপর।
দ্বিধা করতে লাগল মুসা।
কডি বলল, ভয় পাচ্ছে কা-কা-কালটুটা…
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। ডান হাতটায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঠাস করে শব্দ হলো। মাগ্লোহ্! বলে মুখ চেপে ধরল কডি। ভয়ানক স্বরে মুসা বলল, সাবধান করে দিলাম। কোনদিন যদি আর ওভাবে ব্যঙ্গ করো, একটা দাঁতও রাখব না, মনে রেখো।
আহত নেকড়ের মত জ্বলে উঠল কডির চোখ। পাল্টা আঘাত হানার জন্যে হাত তুলতে গিয়েও থমকে গেল। মরফিকে কিভাবে পিটিয়েছে মুসা, শুনেছে টাকির মুখে।
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেছে টেরি-বাহিনী। মুসার এই রূপ দেখেনি আর। নতুন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে।
কডিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। কফিনের মধ্যে ঝুঁকল। প্রচণ্ড রাগ মনে। পাথর হয়ে গেছে যেন মনটা। দুনিয়ার কোন কিছুকেই আর পরোয়া করে না এ মুহূর্তে। কমলা রঙের ভয়ঙ্কর মুখটাকেও আর ভয়ানক লাগছে না দেখতে। সহজেই চুমু খেতে পারবে ওই গালে।
সব কটা চোখের দৃষ্টি এখন মুসার ওপর।
কফিনের কিনার খামচে ধরে উঠতে যাবে, ঠিক এই সময় মচমচ করে উঠল কি যেন।
থমকে গেল সে। সোজা হয়ে দাঁড়াল।
আবার মচমচ।
ফিরে তাকাল মুসা। টেরির চোখে ভয় দেখতে পেল। তার দোস্তদের চোখেও।
কিসের শব্দ? ফিসফিস করে বলল টাকি। জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে।
নিশ্চিত হলো মুসা, আজ আর কোন চালাকির মধ্যে যায়নি টেরির দল। তাহলে ঘাবড়াত না। সত্যিকার লাশের সঙ্গেই মুসাকে কোলাকুলি করতে নিয়ে এসেছে ওরা।
আবার শব্দ।
অন্য কফিনগুলোর দিকে তাকাল মুসা।
একটা কফিনের ডালা নড়ে উঠতে দেখল। আরেকটা। তারপর আরেকটা।
ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে কফিনগুলোর ডালা।
.
১৭.
রক্ত পানি করা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে সরে এল মুসা। টলতে টলতে ও সরে গেল দেয়ালের দিকে।
কফিনের সারির দিকে তাকাল। ডালা ঠেলে তোলা হাতগুলো দেখতে পাচ্ছে। পচে ফুলে ওঠা সবজে-লাল হাত। দুর্ঘটনায় ডলা লেগে বিকৃত হয়ে যাওয়া বেগুনি হাত। মোমের মত সাদা ফ্যাকাশে হাত।
আ-আ-আমরা বি-বি-ব্বিরক্ত করেছি ওদের, ভালমত তোতলাতে শুরু করল মুসা। মি-মি-মৃত মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। প-প প্রতিশোধ নিতে আ-আ-আসছে।
একটা কফিনের ডালা পুরোপুরি উঠে গেছে। কুৎসিত, খসখসে গোঙানি শোনা গেল ওটার ভেতর থেকে। একটা মড়া উঠে বসল। পুরানো হতে হতে সবুজ হয়ে গেছে চামড়া। পচা-গলা মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাল টেরির দিকে। চোখ খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেলাই করে পাতা দুটো লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে খুলতে পারছে না।
গোঙানি, উহ্-আহ্, জোরাল গভীর দীর্ঘশ্বাস-নানা রকম ভয়ঙ্কর শব্দে ভরে গেল ঘরের বাতাস।
অন্য একটা কফিন থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল আরেকটা মড়া। পচে, ফুলে বীভৎস হয়ে গেছে মুখটা। রক্তশূন্য চামড়ার রঙ মোমের মত। লাশ তো, তাই স্বাভাবিক মানুষের মত ক্ষিপ্রতা নেই বোধহয় গায়ে, ধীরে সুস্থে, বেশ ভারী পায়ে নামছে।
তৃতীয় লাশটাও উঠে বসেছে এখন। বেগুনী লাশ। নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসা সাদা সাদা কৃমিগুলোকে ঝুলতে দেখে পেট গুলিয়ে উঠল মুসার।
বিকট চিৎকার বেরিয়ে এল টেরির মুখ থেকে।
অ-অ-অসম্ভব! কডি বলল। এ হতেই পারে না!
মড়াদের বিরক্ত করেছি আমরা! আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল কিশোর। ওদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। ওরা আমাদের ছাড়বে না …
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা কাঠের আলমারির দরজা। দড়াম করে গিয়ে পাল্লাটা বাড়ি খেল শক্ত দেয়ালে।
পা টেনে টেনে বেরিয়ে এল একটা ভয়ঙ্কর-দর্শন লাশ। নিশিতে পাওয়া মানুষের মত ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। ওটার চোখের পাতাও সেলাই করে লাগানো। খুলতে পারছে না। মাথার চামড়া অর্ধেক ছিলে এসে ঝুলে রয়েছে কপালে। সামনে দুই হাত বাড়িয়ে থপ থপ করে পা ফেলে এগোতে লাগল ধরার জন্যে।
চিৎকার করে উঠল মুসা।
চিৎকার করে উঠল কিশোর।
টেরি আর টাকি সরে চলে এল মুসার কাছে।
আরেকটা রক্ত জমানো গোঙানি শোনা গেল। ফিরে তাকাল সবাই। আরও একটা লাশ বেরিয়ে এসেছে। মাথায় চওড়া কানাওয়ালা হ্যাট। গায়ে ঢলঢলে একটা ট্রেঞ্চ কোট, নিজের আকারের চেয়ে অনেক বড়। টলতে টলতে এগিয়ে আসতে লাগল মুসাদের দিকে।
কুঁজো হয়ে এগোচ্ছে। লাশের চেহারা ঢেকে দিয়েছে হ্যাঁটের কানা। সামান্য মুখ তুলতেই যেটুকু অংশ চোখে পড়ল, তাতেই বুকের রক্ত পানি হয়ে যাওয়ার কথা অতি বড় সাহসীরও।
মুখের অর্ধেকটা আছে, বাকি অর্ধেকের মাংস গায়েব। খসে পড়ে গেছে। হাড়গুলো শুধু দেখা যাচ্ছে। শূন্য কোটর থেকে ঝুলছে একটা মরা ইঁদুর।
আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল কিশোর।
কুৎসিত গোঙানি। ঘড়ঘড়ানি। আর চাপা দীর্ঘশ্বাস। চলছে একটানা।
দুর্ঘটনায় মৃত লম্বা, বেগুনি রঙের থেঁতলানো, বিকৃত লাশটা নেতৃত্ব দিচ্ছে মড়াদের। মাথা নিচু করা, চোখ বোজা। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাঁটছে। এক পা বাড়িয়ে দিচ্ছে সামনে, থমকাচ্ছে, তারপর আরেকটা পা ফেলছে।
থমকে দাঁড়াল হঠাৎ।
ঝুঁকি লেগে কাঁধ থেকে খসে পড়ে গেল একটা হাত। বিশ্রী শব্দ করে মেঝেতে পড়ল। লাফ দিয়ে চলে গেল একটা টেবিলের নিচে।
হাত খসে পড়াতে যেন কিছুই হয়নি লাশটার। পরোয়াই করল না। একটা সেকেন্ড বিরতি দিয়েই আবার আগের মত এগিয়ে আসতে শুরু করল।
জলদি পালাও! চিৎকার করে উঠল হ্যারল্ড। আতঙ্কে কুঁচকে গেছে চোখ-মুখ।
কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
জানালার দিকটাকে আড়াল করে অর্ধচন্দ্রাকারে সারি দিয়ে ওদের কোণঠাসা করে ফেলেছে লাশের দল।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সবার।
কফিনের লাশটার দিকে তাকাল মুসা। একমাত্র মড়া, যেটা একইভাবে পড়ে রয়েছে। কফিন থেকে উঠে আসেনি। আসার কোন লক্ষণও দেখাচ্ছে না।
ওটার দিকে নজর নেই কারও। তাকিয়ে আছে এগিয়ে আসতে থাকা লাশগুলোর দিকে। টেনে টেনে হাঁটার কারণে জুতো ঘষার খসখস শব্দ হচ্ছে মেঝেতে।
চিৎকার করে উঠল আবার কিশোর, মুসা, কিছু একটা করো!
আমাকে বলছ! কেঁপে উঠল মুসার গলা। আমি করব?
থামাও ওদের! চেঁচিয়ে উঠে মুসাকে সামনে ঠেলে দিল টেরি। মুসা …তুমিই পারবে! আমাদের মধ্যে একমাত্র তোমারই সাহস আছে!
আমার! বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মুসা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার! বাজিটা জিতে গেছ তুমি! সাইরেনের মত কাঁপা কাঁপা শব্দে নিঃশ্বাস বেরোচ্ছে টেরির নাক দিয়ে। এমন ভয় পাওয়াই পেয়েছে, এতটাই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মুখের চামড়া, তিলগুলোও এখন অদৃশ্য। তুমি জিতে গেছ! তুমি জিতে গেছ! তুমি জিতে গেছ! তিনবার বললাম। তারমানে তোমার জেতা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই আর। দোহাই তো-তো-তোমার, মুসা, ক-ক-করো কিছু… আতঙ্কে তোতলানোর সঙ্গে চন্দ্রবিন্দুও যোগ হয়ে গেছে টেরির উচ্চারণে।
মুরগির মত কঁক-কঁক করতে বলছ? মড়াগুলো ভয় পাবে তাতে?
আরে না না! কঁক-কঁক না! ওগুলোকে…
ও, জবাই করব! মুরগির মত?
পা-পা-প্পারলে তাই করো!
কিন্তু ছুরি কোথায়? অসহায় ভঙ্গিতে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।
শু-শু-শুঁটকির কাছে… কথাটা আটকে গেল কিশোরের। বের আর করতে পারল না।
দুই হাত নাড়তে লাগল টেরি, ছু-ছু-ছুরি-টুরি কিছু নেই আ-আ-আ …
গেছে আজ! হতাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল কিশোর। স-স-সব কটাকে তোতলা বানিয়ে দিয়েছে ভূ-ভূ-ভূ-ভূ… কোনমতেই বের করতে পারছে না শব্দটা। বের করার জন্যেই যেন জোরে এক ধাক্কা মারল মুসার পিঠে এবং হড়হড় করে স্পষ্ট কথা বেরিয়ে এল, দৈত্যগুলোকে ঠেকাও! বাঁচাও আমাদের!
ধাক্কা খেয়ে সামনে গিয়ে পড়ল মুসা।
একটা লাশ ওকে ধরে না ফেললে হুমড়ি খেয়ে পড়ত মেঝেতে। পচা, মাংস খসা বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে লাশটা।
.
১৮.
ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে! গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল মুসা, ভয় নয়, হুমকি। কেঁচোর মত শরীর মোচড়াচ্ছে, ছটফট করছে, আ য লাশের বাহু থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। নইলে ভূতগিরি। ঘুচিয়ে দেব আজ জন্মের মত!
কিন্তু চোখ বোজা, সবুজ দানবটা ছাড়ল না ওকে। ঝাড়া লাগতে জট পাকানো চুলের বোঝা থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগল মাছির সাদা সাদা শুয়াপোকা। পচা মুখটা নিয়ে এল চোখের সামনে। বাহুর চাপ আরও বেড়েছে। চাপ দিয়ে ভর্তা করে দেবে যেন হাড়-পাজরা।
হুটোপুটি শোনা গেল পেছনে।
কোনমতে ঘাড় ঘুরিয়ে মুসা দেখল, সামান্য সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করেছে টেরিরা, পড়িমড়ি করে জানালার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। মজা দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকার কথা কল্পনায়ও আনছে না আর ওরা।
সবার আগে জানালার কাছে পৌঁছল কডি। মুহূর্তে উড়ে চলে গেল যেন বাইরে।
মুসার কোমর জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে লাগল সবুজ মড়াটা।
সেসব দেখার সময় নেই নিটু আর হারল্ডের। কার আগে কে জানালা টপকাবে এই নিয়ে হুড়াহুড়ি শুরু করল। ধাক্কা দিয়ে দুজনকে দুই পাশে ফেলে বেরোনোর চেষ্টা করল কিশোর। তাতে গেল সব জট পাকিয়ে, তিনজনের কেউ বেরোতে পারল না। মাথার ওপর দিয়ে ডাইভ দিল টাকি। কপাল ঠুকে গেল চৌকাঠে। ব্যথাটাকে পাত্তাই দিল না সে। ডিগবাজি খেয়ে গিয়ে পড়ল, জানালার বাইরে। ফাঁক পেয়ে তার পর পরই বেরিয়ে গেল টেরি। ওর ঠ্যাং ধরে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল কিশোর। পারল না। পড়ে গেল মেঝেতে। টেরির পর একে একে বেরোল নিটু আর হ্যারল্ড।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জানালায় উঠে বসল। চিৎকার করে ডাকতে লাগল, টেরি! টাকি! কডি! তোমাদের ঈশ্বরের দোহাই লাগে! আমাকে নিয়ে যাও। ফেলে পালিও না…
কিন্তু কেউ তার কথার জবাব দিল না। কাদা-পানিতে জুতো ফেলার ছপছপ শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল।
লাফিয়ে অন্যপাশে নেমে গেল কিশোর। তার জুতোর শব্দও মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
চুপ হয়ে গেছে মুসা। তাকে নড়তে-চড়তে না দেখে সবুজ মড়াটাও শান্ত হয়ে গেছে। চাপ দিচ্ছে না আর। ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পিছিয়ে এল মুসা।
দৌড়ে এল জানালার কাছে। মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল জানালার বাইরে।
আবছা অন্ধকারে অনেকগুলো ছায়ামূর্তিকে ছুটে যেতে দেখল পাতাবাহারের বেড়ার দিকে।
মড়াগুলোর দিকে ফিরল আবার মুসা। মুচকি হাসি ফুটেছে মুখে। সবুজ মড়াটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পালিয়েছে সব। চলো, এই সুযোগে কেটে পড়া যাক।
টান দিয়ে মুখ থেকে মুখোশটা খুলে নিল সবুজ মড়া। বেরিয়ে পড়ল রবিনের হাসিমুখ। কিশোর কোথায়?
ভঙ্গি দেখে যে কেউ ভাববে ভূতের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে, হাসতে হাসতে বলল মুসা। ওর কাণ্ড দেখেই আরও ভড়কে গেছে শুঁটকি-বাহিনী।
কাণ্ড তুমিও কম করনি। উহ্, দুজনে মিলে যা শুরু করলে, হাসি চেপে রাখাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার জন্যে!
তোমাদের অভিনয় আরও ভাল হয়েছে, মেঝেতে চোখ পড়ল মুসার। মাছির পোকাগুলোর দিকে। অনড় পড়ে আছে। আজকাল প্ল্যাস্টিক দিয়ে কত রকমের জিনিস যে তৈরি করছে খেলনাওলারা। মুখ তুলল। দারুণ হয়েছে। ছদ্মবেশ। কারও বাপেরও চেনার সাধ্য ছিল না। …সত্যি সত্যি ভূত ভেবে আরেকটু হলে আমিও পালাচ্ছিলাম!
*
আধঘন্টা পর।
স্যালভিজ ইয়ার্ডে তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওঅর্কশপে গাদাগাদি করে বসেছে ওরা সাতজন। কিশোর, মুসা, রবিন, তাদের দুই বন্ধু টম ও বিড, এবং ওদের দুজনের বন্ধু বারটি আর ডিউক।
হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেছে ওদের। তা-ও থামছে না হাসি। হসির দমকে কয়েকবার করে পানি এসেছে চোখের কোণে। মুছেছে, আবার হেসেছে।
ও, হাসতে হাসতেই কাহিল হয়ে গেছি! মুসা বলল। কিশোর, আর সহ্য করতে পারছি না। ফ্রিজে কিছু নেই তোমাদের?
বসো। নিয়ে আসছি।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোট চারেক পিৎসা আর বড় এক জগ। কমলার রস নিয়ে হাজির হলো কিশোর।
খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। খিদে পেয়েছে সবারই।
খেতে খেতে মুসা বলল, কিশোরের প্ল্যানটা যে এ ভাবে কাজে দেবে, ভাবতে পারিনি। সত্যি বলতে কি, শুরুতে তো রাগই হচ্ছিল আমার ওর ওপর, টেরির দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শত্রুতা করছে ভেবে।
আর এখন? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন।
সেটা কি বুঝিয়ে বলতে হবে?
না, তা হবে না। তোমার রাগ হয়েছে, তাতে আর দোষ কি, ওর আচরণে আমিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি, তোমার ভয়ের রোগটা সারানোর জন্যেই এই চালাকি করেছিল সে…
প্রশংসাটা বেশি হয়ে যাচ্ছে, বাদ দাও এবার, হাত তুলল কিশোর। মুসা, তোমার ভয়টা গেছে তো?
এক্কেবারে মাথা কাত করল মুসা।
আর কিছুকে ভয় পাবে না কখনও?
জীবনেও না।
তা তো হলো, বিড বলল। কিন্তু শুঁটকির গোষ্ঠী বাজির টাকা মিটিয়েছে?
দেবে আর কখন? হাসতে হাসতে বলল কিশোর। প্রাণ নিয়ে পালানোর পথ পাচ্ছিল না, আবার টাকা। জানালার কাছে যা হুড়াহুড়িটা করল… দৃশ্যটা মনে করে হো-হো করে হেসে উঠল আবার সে।
হাসিটা সংক্রমিত হলো সবার মাঝে।
আরেক দফা হাসাহাসি আর চোখ মোছামুছির পর কিশোর বলল, চিন্তা নেই, আশা করি কাল স্কুলেই আদায় করে ফেলতে পারব টাকাটা।
যদি দিতে না চায়?
তোমরা তো আছই। আবার এমন এক প্যাঁচে ফেলব, সেধে এসে পায়ে ধরে দিয়ে যাবে।
*
খেয়েদেয়ে কিশোরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এল মুসা, রবিন, টম, বিড ও তাদের বন্ধুরা। গেট পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে গেল কিশোর।
সবাই এক জায়গায় থাকে না। একসঙ্গে যতদূর যাওয়া যায়, গেল, তারপর আলাদা হয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা হতে লাগল একে একে।
সবার শেষে আলাদা হলো মুসা আর রবিন।
নির্জন রাস্তা ধরে হনহন করে হেঁটে চলল মুসা। একটা জায়গায় দুধারে গাছের সারি। ঘন ঝোঁপঝাড়। তার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পথ।
সেখানটায় এসে থমকে দাঁড়াল মুসা। ভয়ে ভয়ে তাকাল অন্ধকারের দিকে। বুঝতে পারছে, মুখে যতই বলুক ভয় পাবে না, ভূতের ভয় সে মন থেকে তাড়াতে পারবে না কোনদিন।
চারপাশে তাকাল অন্য কোন পথচারী আছে কিনা সেই আশায়। কিন্তু এত রাতে কে আর বেরোবে অকারণে। কাউকে দেখল না।
অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। দোয়া-দরূদ পড়ে ফুঁ দিয়ে নিল বুকে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে দিল ভো দৌড়। টেরির কপাল খারাপ, দৌড়টা দেখতে পেল না। এ মুহূর্তটার জন্যে। পঞ্চাশ হাজার ডলার বাজি ধরতেও দ্বিধা করত না তাহলে সে।