১১.
পরদিন স্কুলে অংক পরীক্ষার পর কিশোর আর রবিনের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। পরীক্ষাটা কিন্তু খারাপ হয়নি, যাই বলো।
কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। সবগুলো প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছি আমি। এটাকে শুভলক্ষণই বলতে পারো।
আমার অবশ্য কিছু কিছু জায়গায় ভাবতে হয়েছে, রবিন বলল। তিন নম্বর সমীকরণটা তো রীতিমত ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল। তবে সমাধান করে ফেলেছি। ঠিক হলো কিনা বোঝা যাবে মিস্টার ক্রেগের দেখার পর।
তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, কিশোর বলল, এবার পাস করে ফেলব। যদিও শিওর হতে পারছি না।
ওদের পেছনে রয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুনল শারিয়াকে। একেবারেই সহজ।
পানির মত, রয় জবাব দিল।
অকারণেই জোরে জোরে হাসতে লাগল দুজনে।
তিন গোয়েন্দাকে ব্যঙ্গ করল কিনা ওরা বোঝা গেল না। কিন্তু রাগ হতে থাকল মুসার। শুঁটকির চেয়ে কোন অংশেই ভাল না এই ছেলেমেয়ে দুটোও। এখন ওদের সময় খারাপ, তাই কিছু বলল না।
আরও কঠিন অংক দিতে পারেন না, স্যার? ডেকে বলল রয়।
দেখা যাক, পরের বার, জবাব দিলেন মিস্টার ক্রেগ।
কিশোর, হেসে জিজ্ঞেস করল রয়, তোমাদের কেমন হলো?
আশা করি তোমাদের চেয়ে ভাল হবে, গম্ভীর স্বরে জবাব দিল কিশোর।
বিশ্বাস করল না রয় কিংবা শারিয়া। হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল দুজনে।
.
পরীক্ষার ফল জানাব এখন, পরদিন বিকেলে ঘোষণা করলেন মিস্টার ক্রেগ।
ডেস্কের সারির মাঝখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে খাতাগুলো বিতরণ করতে লাগলেন তিনি।
সব মিলিয়ে খুশিই হয়েছি আমি, মিস্টার ক্রেগ বললেন। কঠিন প্রশ্ন করেছিলাম। মোটামুটি সবাই ভাল করেছ তোমরা।
রয়ের টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন তিনি। ভাল করেছ, রয়।
কিশোর ভাবছে, আমি কেমন করলাম? ডেস্কের ওপর দুই হাত রাখা। খুলছে আর মুঠোবদ্ধ হচ্ছে আঙুলগুলো। পাস করেছি তো? শুধু পাস করলেই আমি খুশি।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মুসা আর রবিনের দিকে। পেছনের সারিতে পাশাপাশি বসেছে ওরা। মুসার কোন ভাবান্তর নেই। লেখাপড়ায় খুব ভাল সে কোনকালেই ছিল না। এখন আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু কিশোর আর রবিনের জন্যে ব্যাপারটা ভীষণ দুঃখজনক। বুদ্ধিমান বলে যারা চিরকাল সবার ঈর্ষার কারণ হতো, আজ তারাই অন্যের করুণার পাত্র। কেন এমন হয়ে গেল, সেটা একটা বিরাট রহস্য কিশোরের কাছে। কিন্তু এতই বোকা হয়ে পড়েছে সে, রহস্যটা উদঘাটনের কথাও ভাবছে না। আর ভেবেও লাভ হবে না। ক্ষমতাই নেই।
অস্বস্তি ভরা চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। কথা বলল না।
খোদা, মনে মনে প্রার্থনা করল কিশোর, কোনমতে যেন পাস করে যাই। ফেল করার লজ্জা আর সহ্য করতে পারছি না। খোদা! খোদা! প্লীজ।
খাতা দেয়া শেষ করলেন মিস্টার ক্রেগ। ডেস্কে ফিরে গেলেন।
স্যার, আমার খাতাটা? কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ফিরে তাকালেন মিস্টার ক্রেগ। হাসলেন। হ্যাঁ, তোমাদেরটা বাকি আছে। মুসা আর রবিনেরটাও দেব না। ছুটির পরে আমার সঙ্গে দেখা করবে তোমরা তিনজনে।
সর্বনাশ! একেবারে দমে গেল কিশোর।
নিশ্চয় খারাপ সংবাদ! খুব খারাপ।
ছুটির পর ছেলেমেয়েদের বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলেন মিস্টার ক্রেগ।
সবাই বেরিয়ে গেল। কিশোর, মুসা আর রবিন বাদে।
ওদের খাতা তিনটে বের করলেন মিস্টার ক্রেগ। শক্ত করে ধরে রেখে তাকালেন ওদের দিকে। তীক্ষ্ণ কুটি করলেন। ভাজ পড়ল কপালে।
তোমাদের জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার, সত্যি, মোলায়েম কণ্ঠে বললেন তিনি। বড় বেশি হতাশ করলে তোমরা আমাকে।
.
১২.
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর।
চোখ নামাল রবিন। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারমানে…তারমানে আবার ফেল করলাম। বিড়বিড় করল মুসা।
জবাব দিলেন না মিস্টার ক্রেগ। লম্বা লম্বা পায়ে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন তিনি। তাকিয়ে রইলেন মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশের দিকে।
দোষটা বোধহয় আমারই ছিল, ওদের দিকে পেছন দিয়ে রেখেছেন তিনি। ভাল করার জন্যে অনবরত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলাম তোমাদের ওপর। মরিয়া হয়ে তাই এ কাজটা করে বসলে।
আচমকা ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ওদের দিকে। কিন্তু কল্পনাই করতে পারিনি এ ভাবে আমাকে ঠকাবে তোমরা। নকল করে লিখবে।
নকল। বুঝতে পারল না কিশোর।
হাঁ হয়ে গেছে রবিন।
মুসা তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে।
তিনজনেই ভাল করেছ তোমরা, মিস্টার ক্রেগ বললেন। খুব ভাল। প্রতিটি অংকের সমাধান করেছ। একটা অংকও ভুল হয়নি। কি প্রমাণ হয় এতে? দেখে দেখে লিখেছ। তিনটে খাতা তুলে নিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিলেন তিনি। কেন করলে এ কাজ? আমাকে খুশি করার জন্যে নকল ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না?
কিন্তু…আমরা তো নকল করিনি। কিশোর বলল।
খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেছি আমরা, রবিন বলল। আর কিছুই করিনি।
তাই তো, মুসা বলল। কোন রকম চালাকি করিনি আমরা।
আসলে তো মগজ উন্নত করার ওষুধ খেয়ে বুদ্ধি বেড়ে গেছে আমাদের, ভাবল কিশোর। কিন্তু টিচারকে বলল না সেকথা।
খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নম্বর দেখে বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসতে থাকল রবিনের মুখ থেকে। বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে কি সত্যি কাজ করেছে মগজ উন্নত করার ওষুধ? বুদ্ধিমান হয়ে গেছে ওরা?
তোমাদেরকে আমি পছন্দ করি, মিস্টার ক্রেগের কথা শুনে মুখ তুলে তাকাল রবিন। তাই এবার আর প্রিন্সপ্যালের কাছে পাঠালাম না। তবে এরপর আর এ ধরনের অন্যায় করলে কিন্তু আর মাপ করব না।
কিন্তু…স্যার…আমরা…কথা বের করতে পারছে না মুসা।
সত্যি বলছি, নকলটকল কিছু আমরা করিনি, কিশোর বলল।
অধৈর্য ভঙ্গিতে চোখ ওল্টালেন মিস্টার ক্রেগ। আঙুল তুলে নাড়লেন। বললাম তো, এবারকার মত মাপ করে দিলাম। এ কাজ কেন করেছ, তা-ও বুঝতে পারছি। দাও, দেখি, টেস্ট পেপারগুলো ছিঁড়ে ফেলি। কাল আবার নতুন খাতা দেব। নতুন প্রশ্নপত্র।
কিন্তু, স্যার, আমরা… বলতে গেল কিশোর।
বললাম তো, নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে তোমাদের, কোন কথা শুনতে চাইলেন না মিস্টার ক্রেগ মনোযোগ দিয়ে পড়বে আজ রাতে। যাতে পাস করতে পারো। আজকের কথা তাহলে আর মনে রাখব না আমি।
.
টিচারের ধমক আর রাগারাগি নিয়ে মাথাই ঘামাল না ওরা। আনন্দে নাচতে নাচতে রাড়ি ফিরল।
বুদ্ধিমান হয়ে গেছি আমরা, কিশোর বলল। মগজের স্থবিরতা কেটে গেছে। বোকামি শেষ।
সব আঙ্কেল জ্যাকের কৃতিত, রবিন বলল। তিনিই আমাদেরকে বুদ্ধিমান বানিয়ে দিয়েছেন। ভেবে দেখো, কিশোর, দুনিয়ায় কি একটা সাংঘাতিক অবস্থার সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন তিনি। সমস্ত বোকাদেরকে তো বুদ্ধিমান বানাবেনই, মগজ উন্নত করার ওষুধ বেচে বেচে নিজেও কি পরিমাণ বড়লোক হয়ে যাবেন, কল্পনা করতে পারো?
সব বোকাদের নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই, জবাবটা দিল মুসা। আমি শুধু আমাদের কথা ভাবছি। তুমি কল্পনা করতে পারো, স্কুলে সব বিষয়েই এ প্লাস পেয়ে গেলে কি একটা সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাবে?
এখনই অত আশা করে ফেলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না, গম্ভীর সুরে কিশোর বলল। সব বিষয়ে এ প্লাস পাওয়ার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত। নইলে পরে দুঃখ পেতে হবে। নিশ্চয় আমাদের ভাগ্য ভাল, সব। প্রশ্ন কমন পড়েছিল, তাই ওই পরীক্ষাটায় আমরা ভাল করে ফেলেছি। সবগুলোতেই যে এমন করব, তা না-ও হতে পারে। দেখা যাক, আগামী কাল কি
ওটাতেও এ পেয়ে যাব, জোর দিয়ে বলল রবিন, এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নেই আমার। এমনকি সেটা পাওয়ার জন্যে পড়তেও হবে না আমাদের। মহা উল্লাসে ব্যাকপ্যাকটাকে ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল সে।
বাকি পথটা যেন উড়ে পেরোল তিনজনে।
রবিনদের বাড়িতে ঢুকল ওরা। লিভিং রূমে ঢুকে রিনিতাকে দেখতে পেল। কতগুলো প্লাস্টিকের টুকরো জোড়া দিয়ে ম্যাপ বানানোর চেষ্টা করছে সে।
এখনও এই নিয়েই পড়ে আছো, রবিন বলল। এক খেলা খেলতে বিরক্ত লাগে না তোমার?
না লাগে না, রিনিতা জবাব দিল।
মুসা হেসে জিজ্ঞেস করল, দেব জোড়া লাগিয়ে?
দিলে তো ভালই হতো। কিন্তু তোমরা হাঁদারা কি পারবে? মাথায় গোবর ছাড়া কিছু নেই।
দাও তো দেখি, হাত বাড়াল কিশোর।
থাক থাক, যেটুকু করেছি, সেটাও নষ্ট করার দরকার নেই, কিশোরের হাতটা সরিয়ে দিল রিনিতা।
আরে দিয়েই দেখোনা, রবিন বসে পড়ল রিনিতার পাশে। কিশোর আর মুসাও বসল।
প্রথমেই ইনস্ট্রাকশন শীট–যেটা দেখে দেখে সাজাতে হয়, সেটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করল রবিন।
চিৎকার করে উঠল রিনিতা, হায় হায়, এ কি করলে! সাজাব কি করে এখন? কাঁদতে শুরু করল সে।
হেসে উঠল রবিন। ওই শীটের আর প্রয়োজন পড়বে না।
দ্রুতহাতে জোড়া দিতে শুরু করল সে। তাকে সাহায্য করল কিশোর আর মুসা।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্লাস্টিকের মস্ত একটা ওয়ার্ল্ড ম্যাপ তৈরি হয়ে গেল।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল রিনিতা। বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর বিস্ময়টা যেন বিস্ফোরিত হলো তার। চিৎকার করে উঠল, কি ভাবে করলে।
পানির মত সহজ, হাসতে হাসতে বলল রবিন।
তুমি কি ভেবেছিলে চিরকালই আমরা হাঁদা থেকে যাব, হেসে বলল রবিন।
কিশোর কিছু বলল না। নীরবে উপভোগ করতে লাগল ব্যাপারটা।
.
জানালা দিয়ে চুরি করে পুরো ব্যাপারটাই লক্ষ করল গাজুল আর মাজুল।
মাজুল অবাক, তারমানে সত্যি সত্যি ওষুধে কাজ হয়ে গেল।
হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল গাজুল।কেন, নিজের চোখেই দেখলে। যাক, বাঁচা গে, বারা। নতুন করে আর কারও খোঁজ করা লাগল না। আমাদের গোলাম আমরা। পেয়ে গেছি।
.
১৩.
আঙ্কেল জ্যাক, টেলিফোনে বলল রবিন, শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না।
রিসিভারে ভেসে এল আঙ্কেল জ্যাকের বিমল হাসি। কি বিশ্বাস করব না?
অংক পরীক্ষায় আমরা সাংঘাতিক ভাল করে ফেলেছি, উত্তেজিত কণ্ঠে জানাল রবিন। যে ওষুধটা তুমি আমাদের দিয়েছিলে, কাজ করেছে ওটা।
জোরে জোরে হাসলেন আঙ্কেল। আমার কি মনে হচ্ছে জানিস? ওষুধে আসলে কিছু হয়নি। হয়েছে তোদের মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখার কারণে।
রবিনের দুই পাশে দাঁড়ানো মুসা আর কিশোর। টেলিফোনে কি বলছেন আঙ্কেল শোনার জন্যে রিসিভারের কাছে ঝুঁকে এল দুজনে।
রবিনের কাছ থেকে রিসিভারটা কেড়ে নিয়ে কিশোর বলল, উঁহু, পড়ালেখার জন্যে কিছু হয়নি। আপনার ওষুধই আমাদেরকে বুদ্ধিমান বানিয়ে ছেড়েছে। নিশ্চিন্তে আপনি এটাকে বোতলজাত করে বাজারে ছাড়তে পারেন। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধনী হয়ে যাবেন।
হু, সে-রকম ওষুধ ছাড়তে পারলে সত্যিই হব।…তরে তোমাদের উপকার হয়েছে শুনে খুশি হলাম, আঙ্কেল জ্যাক জবাব দিলেন। কিন্তু তাই বলে পড়ালেখা যেন আবার বন্ধ করে দিও না। পরীক্ষায় ভাল করার জন্যে ওটাই হলো সবচেয়ে জরুরী।
আরও কিছুক্ষণ উত্তেজিত তিন কিশোরের সঙ্গে কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন আঙ্কেল জ্যাক। স্ত্রীর দিকে ফিরলেন।
অংক পরীক্ষায় অসাধারণ ভাল করে ফেলেছে ওরা, হাসতে হাসতে বললেন তিনি। আত্মবিশ্বাস মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় এই ঘটনাটাই তার প্রমাণ। আমি দিলাম ওদেরকে আঙুরের রস, আর ওরা ভাবছে…! হাহ হাহ হা!
.
পরদিন স্কুল বাসে চড়ার আগে দুই সহকারীকে বলল কিশোর, সাবধান, আমরা যে বদলে গেছি এটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে। বুঝতে দেয়া ঠিক হবে না।
কিন্তু রবিন সামলে নিলেও মুসা সামলাতে পারল না। বুদ্ধিমান হয়ে গিয়ে তার আচার-আচরণই পাল্টে গেছে।
গাড়িতে সীটে বসে নিত্যদিনকার মতই নিউ ইয়র্ক টাইমস ক্রসওয়ার্ড পাজলের সমাধান করছে ওরা। আজ ওদের পাশের সীটে বসেছে মুসা। ইচ্ছে করেই। জানে, সে, রবিন কিংবা কিশোর যে-ই ওদের পাশে বসুক না কেন, সমস্যায় ফেলে মজা করতে চাইবে। রোজই তাই করে। ওরা যে ভাল ছাত্র, সেটা যে কোন ভাবেই হোক জাহিরের চেষ্টা করে।
অপেক্ষা করতে লাগল মুসা।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ফিরে তাকাল রয়। জিজ্ঞেস করল, এই, বলো তো চার অক্ষরের একটা গাধার নাম, যেটার প্রথম অক্ষর এম দিয়ে শুরু।
হেসে উঠল পাশে বসা শারিয়া। টেরিয়ার ডয়েল সহ আরও অনেক ছেলেমেয়েই হেসে উঠল।
আজ রয়কেই গাধা মনে হচ্ছে মুসার। রোজ একই রকম প্রশ্ন করে। নতুনত্ব নেই। কোন রকম জড়তা কিংবা আড়ষ্টতা না রেখে শান্তকুণ্ঠে জবাব দিল মুসা, চার অক্ষরের পারব না, তবে তিন অক্ষরের গাধার নাম বলতে পারব। যেটার প্রথম অক্ষর আর দিয়ে শুরু।
মুহূর্তে হাসি মুছে গেল রয়ের। কালো হয়ে গেল মুখ। বাহ, কালটুসটার তো মুখ খুলে গেছে আজ। সেই সঙ্গে একটু যদি বুদ্ধি খুলত।
টান দিয়ে রয়ের হাত থেকে ভাজ করা খবরের কাগজটা কেড়ে নিল মুসা।
আরে আরে কি করছ। চিৎকার করে উঠল শারিয়া! দাও, দাও।
দিল না মুসা। তোমরা যে জিনিসটার সমাধান করতে পারো না, দেখাও আমাকে। বলে দিচ্ছি। নাকি সবই বলে দেব?
বলপেন বের করে কাগজের ওপর লিখতে শুরু করল মুসা। এত দ্রুত, চোখ কপালে উঠে গেল শারিয়া আর রয়ের।
খসখস করে লিখে কাগজটা ফিরিয়ে দিল মুসা। নাও, দেখো এবার।
কাগজের দিকে তাকানোর জন্যে ঝুঁকে এল রয় ও শারিয়া। মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি হয়ে গেল। অস্ফুট একটা চিৎকার বেরিয়ে এল শারিয়ার মুখ থেকে। চোখ বড় বড় করে তাকাল রয়। চোখে অবিশ্বাস। কি করে করলে?
হাসিমুখে কাঁধ ঝাঁকাল মুসা। সহজ। একেবারেই সহজ। অক্ষরজ্ঞান যদি ভাল থাকে তোমার, ক্রসওয়ার্ড পাজল মেলানো কোন ব্যাপারই না।
.
স্কুলে সেদিন ক্লাসে তিন গোয়েন্দাকে অংক পরীক্ষায় বসালেন মিস্টার ক্রেগ। বাকি সবার জন্যে অন্য পড়া।
তিন গোয়েন্দাকে অভয় দিয়ে বললেন, তাড়াহুড়া নেই। ভাবনা-চিন্তা করে সুন্দরমতই জবাব দাও। কোনটা যদি না পারো, ফেলে রাখো, পরে আমার কাছ থেকে জেনে নিও। ঠিক আছে?
প্রশ্নপত্র আর খাতা নিয়ে যার যার ডেস্কে ফিরে এল কিশোর, মুসা ও রবিন।
ডেকে বললেন মিস্টার ক্রেগ, আন্দাজে করলে কিন্তু হবে না। পরে ধরব। কি ভাবে করলে বুঝিয়ে বলতে হবে আমাকে। এগুলো যদি পেরে যাও, আরও কঠিন প্রশ্ন দেয়া হবে। কি, বুঝলে?
মাথা ঝাঁকাল তিনজনেই।
দশ মিনিট পরই মিস্টার ক্রেগের কাছে টেস্ট পেপার নিয়ে হাজির হলো কিশোর। কিছু কিছু সমীকরণ তিন ভাবে করে দেখিয়েছে সে।
সব প্রশ্নের জবাব দিতে রবিনের লাগল বারো মিনিট, মুসার চোদ্দ। ওরাও কিশোরের মত একই কাজ করেছে। মোট কথা যতভাবে করা যায় এই অংকগুলো, সব ভাবেই করেছে।
অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালেন মিস্টার ক্রেগ। খাতার দিকে তাকালেন। কি ব্যাপার? পারছ না? খুব কঠিন মনে হচ্ছে?
করেছি তো, স্যার? শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর।
খাতার দিকে তাকালেন মিস্টার ক্রেগ। প্রথমে দ্রুত দেখলেন ফলগুলো। তারপর ধীরে ধীরে।
আ-আবার তো সেই একই কাণ্ড করেছ। কথা আটকে যেতে শুরু করল মিস্টার ক্রেগের। সবগুলোই তো কারেক্ট। ভাল, ভাল। তারমানে সারারাত বসে পড়াশোনা করেছ তোমরা?
পড়িইনি, স্যার, কোন কিছু না ভেবেই বলে ফেলল মুসা। বইয়ের দিকেই তাকাইনি একবারও। অংক একটা অতি সহজ সাবজেক্ট।
.
স্কুল ছুটির পর রবিনদের বাড়ির পেছনের খোলা জায়গায় বল খেলছে তিনজনে। খেলছে মানে এ ওর কাছে ছুঁড়ে দিয়ে লোফালুফি করছে।
বেশ কয়েক দিন মেঘে ঢাকা থাকার পর মেঘ কেটে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে সূর্য। আকাশের ধূসর রঙ আর নেই। বাতাস চমৎকার। বসন্তকালের মত।
স্কুল ছুটি হওয়ার আগেই সমস্ত হোমওঅর্ক করে ফেলেছি আমি, মুসা বলল। রবারের বলটাকে রবিনের দিকে ছুঁড়ে মারল সে।
মিস করল রবিন। ধরতে পারল না। বলটা চলে গেল পাতাবাহারের বেড়ার দিকে। পেছন পেছন দৌড়ে গেল সে।
কিন্তু তোমাকে তো বলেছিলাম সাবধানে থাকতে, কিশোর বলল। আমরা যে বুদ্ধিমান হয়ে গেছি অত তাড়াহুড়া করে জানান দেয়ার কি প্রয়োজন ছিল? আর মিস্টার ক্রেগের অত ভুল ধরারই বা কি দরকার ছিল?
তাই তো, বল নিয়ে ফিরে এসেছে রবিন। যতবার তিনি ভুল করছিলেন, হাত তুলছিল সে।
কিন্তু এত ভুল করতে থাকলে না তুলে কি করব? মুসা বলল। বোর্ডে লিখতে গিয়ে ম্যাসাচুসেটস বানানও তিনি ভুল লিখলেন। বলব না? কাউকে না কাউকে তো ভুলটা ধরিয়ে দিতেই হবে। টিচার বলে কি মাপ?
কিন্তু, মুসা… বলতে গেল কিশোর।
শুনল না মুসা। তার কথা বলে গেল, সিভিল ওঅর কবে শুরু হয়েছে, সালটা পর্যন্ত তিনি ভুল বললেন। শুধরে দেব না?
কিন্তু তোমার বার বার হাত তোলা দেখে কি রকম ভঙ্গি করছিল সবাই খেয়াল করেছ? রবিন বলল। ভাবখানা যেন টিচারের ভুল ধরিয়ে দিয়ে তুমি মস্ত অপরাধ করে ফেলছ। আসলেই তোমার চুপ করে থাকা উচিত ছিল। তোমার ভয়ে শেষে। পড়ানোই বাদ দিয়েছেন তিনি। এ রকম পর্যদস্ত করাটা অবশ্য ঠিক হয়নি তোমার।
কিশোর আর মুসার মুখে ঠিক হয়নি শুনতে শুনতে রাগ হয়ে গেল মুসার। এত জোরে ছুঁড়ে মারল বলটা, আবারও ধরতে পারল না রবিন। দৌড় দিল ঝোঁপের দিকে। বল খুঁজতে ঢুকে পড়ল ঝোঁপের মধ্যে। খানিক পরেই শোনা গেল তার চিৎকার, কিশোর, জলদি এসো।
কি হলো? বলে দৌড় দিল কিশোর। পেছনে ছুটল মুসা।
ওরা দুজনও ঝোপে ঢুকল।
মাটির দিকে দেখাল রবিন, দেখেছ? জুতোর ছাপ।
ঝুঁকে বসে ভালমত দেখে গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর, হু। তাজা ছাপ। অনেক বড় পা। ঘটনাটা কি? আমাদের ওপর নজর রাখছিল নাকি?
ওই দেখো, মুসা বলল, ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে ছাপগুলো।
ছাপ অনুসরণ করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল ওরা।
পেছনের উঠান পার হয়ে রবিনদের লিভিং রূমের জানালার কাছে এসে শেষ হয়েছে। মাটিতে গম্ভীর হয়ে বসা ছাপগুলো প্রমাণ করে ওখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছে ছাপের মালিকেরা। উঁকিঝুঁকি মেরেছে ঘরের ভেতর।
আর কোন রকম সূত্র পাওয়া গেল না।
এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, কিন্তু আমাদের ওপর নজর রাখতে এল কে? এবং কেন?
.
১৪.
সাতদিন পর।
স্কুলে তার লকারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। ব্যাকপ্যাকে জিনিসপত্র ভরছে। স্কুল ছুটি হয়েছে। বাড়ি যাবে।
উল্টোদিকের লকারের সামনে দাঁড়ানো রয়। হাসিমুখে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, হাই রয়, দিনকাল কেমন যাচ্ছে?
মাথা ঝাঁকিয়ে দায়সারা জবাব দিল রয়, ভাল।
আমাদের বাড়ি যাবে? কম্পিউটার গেম খেলব।
মুখ বাঁকাল রয়। নাহ।
কেন? এসো না, কি হয়েছে, অনুরোধ করল কিশোর।
কাঁধ ঝাঁকাল রয়। উঁহু। তোমার সঙ্গে পারব না। একটা গেমও জিততে পারব। মগজ অতিরিক্ত খুলে গেছে তোমার, বুদ্ধি বেড়ে গেছে।
কিন্তু…
দড়াম করে লকারের দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাড়াহুড়া করে ওখান থেকে সরে গেল রয়।
তাকে ধরতে যাবে কিনা ভাবছে কিশোর, কথা কানে এল। ঘুরে তাকিয়ে দেখে টেরি আর তার দুই দোস্ত টাকি ও কডি। ওপথ দিয়েই যাচ্ছে।
ওদের পথরোধ করল কিশোর। অনুরোধের সুরে বলল, টেরি, কেমন আছো? চলো না আমাদের বাড়িতে। খেলবে।
আঁতকে উঠল টেরি। ওরিব্বাপরে! তোমার সঙ্গে? না বাবা, দৈত্যের সঙ্গে খেলতে আমরা রাজি না। এই টাকি, চল চল!
প্রায় দৌড়ে চলে গেল টেরি আর তার দোস্তরা।
মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। এতটাই বুদ্ধিমান হয়ে গেছে ওরা, অস্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়েছে, সবাই এখন ওদের ভয় পায়।
মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। এ সময় সেখানে এসে হাজির মুসা আর রবিন। ওদেরও মন খারাপ। মুসার মুখ দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কেউ আমাদের সঙ্গে খেলতে রাজি হয় না, করুণ সুরে মুসা বলল।
যাকে বলি, সেই পালায়, রবিন বলল। সবাই আমাদেরকে বলে ফ্রীক।
কেউ কেউ বলে জিন-ভূতের আসর হয়েছে, কেউ বলে কবরস্থানে গিয়ে প্রেতাত্মা ঢুকিয়েছি মগজে…শুনতে শুনতে আর ভাল লাগে না, মুসা বলল।
অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হয়ে যাওয়াটাও যে এতটা বিপজ্জনক, সেটা তো জানতাম না, রবিন বলল।
বিপজ্জনক তো বটেই, প্রচণ্ড দুঃখেরও, মুসা বলল। এরচেয়ে তো বোকা থাকাটাই ভাল ছিল।
না, তা ছিল না, মাথা নাড়ল কিশোর। অস্বাভাবিক থাকাটাই বিপজ্জনক, সেটা বোকাই হোক আর বুদ্ধিমানই হোক। তিনজনেরই বুদ্ধি এখন এক রকম হয়ে গেছে আমাদের। কারও চেয়ে কেউ কম নই, তাই নিজেরাও আর আগের মত খেলতে পারছি না। কি যে করব বুঝতে পারছি না।
বুদ্ধি দিল রবিন, চলো, আবার আঙ্কেল জ্যাকের কাছে যাই। তাকে গিয়ে বলি, আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিটা ফিরিয়ে দেয়ার কোন ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা।
পারলে তো ভালই হতো… চিন্তিত ভঙ্গিতে ব্যাকপ্যাক পিঠে ফেলল কিশোর।
হলরূম ধরে এক সারিতে এগিয়ে চলল ওরা।
আগে আগে চলছে রবিন।
সামনে দুটো ছায়া পড়েছে হলরুমের মেঝেতে।
ধাক্কা লাগবে ভেবে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল রবিন।
তার পিঠের ওপর এসে পড়ল মুসা। কি হলো?
নীরবে হাত তুলে দেখাল রবিন।
একপাশ থেকে বেরিয়ে এল ছায়া দুটো।
বাবা! মা! তোমরা? অবাক হলো রবিন।
ওদের দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন মিস্টার ও মিসেস মিলফোর্ড। গম্ভীর থমথমে চেহারা।
পেটের মধ্যে খামচি দিয়ে ধরার মত অনুভূতি হলো রবিনের। কিছু ঘটেনি তো? জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে, মা?
জবাবটা তোমরাই ভাল দিতে পারবে, এক এক করে রবিন, মুসা, ও কিশোরের ওপর দৃষ্টি ঘুরে. এল মিস্টার মিলফোর্ডের। রবিনের ওপর এসে স্থির হলো আবার। মিস্টার ক্রেগ আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। মুসার মা-বাবা আর কিশোরের চাচা-চাচীকেও ডেকেছেন।
কি করেছ তোমরা? মিসেস মিলফোর্ড জিজ্ঞেস করলেন।
কই, কিছু তো করিনি, জবাব দিল কিশোর।
কিছু করিনি আমরা। রবিন বলল।
এসো আমাদের সঙ্গে। প্রিন্সপ্যাল মিসেস অ্যান্ডারসনের ঘরে যেতে বলা হয়েছে আমাদের।
মিসেস অ্যান্ডারসন? ভুরু কুঁচকাল মুসা। তার ওখানে যাব কেন? কোন অপরাধ তো করিনি আমরা। হচ্ছেটা কি?
ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হলো। দশ সেকেন্ড পর পিন্সপ্যালের অফিসের সামনের ঘরে ঢুকল ওরা। সামনের ঘরটা খালি। চারটে প্রায় বাজে। কর্মচারীদের সবার ছুটি হয়ে গেছে। বাড়ি চলে গেছে সেক্রেটারিরা।
পেছনের ঘর, অর্থাৎ মিসেস অ্যান্ডারসনের অফিসের দরজার দিকে এগোল সবাই। ঢোকার আগেই দরজায় বেরিয়ে এলেন তিনি। স্বাগত জানালেন ওদের। ডেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে ঘরের মাঝখানে একটা লম্বা টেবিলের সামনে বসা দেখা গেল কিশোরের চাচা-চাচী আর মুসার বাবা-মাকে। টেবিলের একধারে বসা মিস্টার ক্রেগ।:আরও একজন লোক আছেন সেখানে, মিস্টার বেলসন। স্কুল। পরিচালকদের সভাপতি। সবাই গম্ভীর।
মিসেস অ্যান্ডারসন এমনিতে হাসিখুশি, আন্তরিক, সবার সঙ্গেই উষ্ণ ব্যবহার করেন। কিন্তু এখন তিনিও গম্ভীর। রবিনের বাবা-মাকেও বসতে অনুরোধ করলেন তিনি।
শীতল দৃষ্টিতে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন মিস্টার বেলসন। ফ্যাকাসে চামড়া, চকচকে টাক, কঠোর চেহারা। ধূসর সুট আর সরু নীল টাই পরেছেন। যতবার দেখেছে তাকে গোয়েন্দারা, এই একই পোশাকে। এগুলো ছাড়া যেন আর কোন কাপড় নেই তার।
বাইরের ঘর আর অফিসের মাঝের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। ঘুরে গিয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। নিজের দুই হাতের দিকে তাকালেন। মুখ তুললেন। আসার জন্যে ধন্যবাদ দিলেন সবাইকে। ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছে কিশোর, অস্বস্তিতে ভুগছেন মিসেস অ্যান্ডারসন।
কি ভাবে কথাটা শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না, অবশেষে শুরু করলেন তিনি। অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা।
.
১৫.
সমস্যা! মিসেস মিলফোর্ড বললেন। কুটি করলেন ছেলেদের দিকে তাকিয়ে।
গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে কোন রকম অঘটন ঘটিয়েছে নাকি ওরা? জানতে চাইলেন মেরিচাচী।
আবার নিজের দুই হাতের দিকে তাকালেন মিসেস অ্যান্ডারসুন। হাত দুটো টেবিলের ওপর ফেলে রেখে মুখ তুললেন। না, কোন ধরনের অঘটন ওরা ঘটায়নি। কোন অপরাধ কিংবা অন্যায়ও করেনি। সমস্যাটা অন্য রকম।
কিশোর, মুসা, রবিনের মুখের ওপর থেকে ঘুরে এল মিসেস অ্যান্ডারসনের দৃষ্টি। আবারও বলছি, কি ভাবে কথাটা শুরু করব আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু না। বললেও চলছে না।
সোয়েটারের আস্তিনে বেরিয়ে থাকা একটা সুতো টেনে ঘেঁড়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার ক্রেগ।
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন মিস্টার বেলসন। নড়েচড়ে বসলেন চেয়ারে।
স্কুলের সবাইকে ঘাবড়ে দিচ্ছে কিশোর, মুসা ও রবিন, অবশেষে কথাটা যেন ছুঁড়ে দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। শুধু তাই না, টিচারদেরকেও ওরা ভয় পাইয়ে দিয়েছে।
কিন্তু, আমরা… বলতে গেল কিশোর।
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। তিন গোয়েন্দার অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বললেন, মহাবুদ্ধিমান হয়ে গেছে আপনাদের ছেলেগুলো। আগে কেন বুঝতে পারিনি সেটাও এক রহস্য। তবে গত হপ্তা দুয়েক ধরে যা ঘটছে, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই আমাদের।
মহাবুদ্ধিমান? চোয়াল ডললেন রাশেদ পাশা। চোখ তুলে তাকালেন তিন গোয়েন্দার দিকে। মহা না হোক, তবে ওরা যে আর দশটা সাধারণ ছেলের চেয়ে বুদ্ধিমান সেটা আমরা অনেক আগে থেকেই জানি।
সেটা তো আমরাও জানতাম, মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে অদ্ভুত কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে ওরা। কিছুদিন এতটাই বোকা হয়ে রইল, যে ক্লাস পরীক্ষার সমস্ত টেস্টে ফেল করতে থাকল। আচার-আচরণে বোকামির চূড়ান্ত। কিন্তু গত দিন পনেরো ধরে হয়েছে উল্টোটা বুদ্ধিমত্তার চূড়ান্ত।
কিন্তু বুদ্ধিমত্তার মধ্যে খারাপটা কি দেখলেন, তা তো বুঝতে পারছি না, না বলে আর পারলেন না মুসার আম্মা মিসেস আমান।
তা ঠিক, মাথা ঝাঁকালেন মিসেস অ্যান্ডারসন। খারাপ কিছু নেই। প্রতিটি পরীক্ষায় একশোতে একশো নাম্বার পায় ওরা। ক্লাসের যত বই আছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া মুখস্থ। বইয়ের পর বই, বইয়ের পর বই পড়ে শেষ করে ফেলে ওরা, একটা অক্ষরও ভোলে না সেগুলোর। যে কোন বিষয়ের ওপর রচনা লিখতে দিলেও, যত কঠিন সাবজেক্টই হোক, বিশ-তিরিশ পৃষ্ঠার রচনা লিখে ফেলে অনায়াসে।
এটা তো দারুণ খবর! হাসলেন মেরিচাচী। সাংঘাতিক। তারমানে গোয়েন্দাগিরির ভূত গেছে মাথা থেকে। আজকাল পড়াশোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়েছে।
ঠিকই বলেছেন, এটা দারুণ খবরই, মোলায়েম স্বরে মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। সাংঘাতিক। কিন্তু মোটেও ভাল অর্থে নয়। বুদ্ধি এত বেশি বেড়ে গেছে, ক্লাসে সারাক্ষণ টিচারদের ভুল শুধরে দিতে থাকে। পাঠ্যবইতে ভুল খুঁজে পায়। ওদের কাণ্ড-কারখানায় ওদেরকে রীতিমত ভয় পায় এখন সহপাঠীরা। তারা জানে, কোন প্রতিযোগিতাতেই আপনাদের ছেলেদের সঙ্গে পারবে না ওরা। ওদের ধারণা, অস্বাভাবিক…মানে, অলৌকিক কোন ব্যাপার ঘটছে কিশোর, মুসা আর রবিনকে ঘিরে।
না না, খারাপ কিছু ঘটাচ্ছে না ওরা, মেরিচাচীকে কথা বলার জন্যে মুখ খুলতে দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন মিস্টার ক্রেগ। ঝুঁকে এসেছেন সামনের দিকে। খুবই ভাল ছেলে ওরা। আসলে, যা করছে তার ওপর ওদের কোন হাত নেই। অনেক বেশি জানে ওরা। অনেক, অনেক বেশি। এই বয়েসের ছেলেদের তুলনায় সীমাহীন জ্ঞান ওদের, অস্বাভাবিক জ্ঞান। যেটা সত্যিই বিপজ্জনক, বুঝতেই পারছেন। স্কুলের পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে ওরা।
আমি লক্ষ করেছি, মিস্টার বেলসন বললেন, ছেলেমেয়েরা এখন আর ওদের সঙ্গে খেলতে চায় না, কথা বলতে চায় না, দূরে দূরে থাকে, সব সময় এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। স্কুলের পরিবেশের জন্যে মোটেও সেটা ভাল কিছু নয়, বুঝতেই পারছেন।
ঘরের সবগুলো চোখ এখন ওদের দিকে, দেখতে পাচ্ছে কিশোর। দুরুদুরু করছে বুকের মধ্যে। তার মনে হচ্ছে ঘটনাটা বাস্তবে ঘটছে না। যেন স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে ওরা। অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হয়ে যাওয়াটা যে এতখানি বিপজ্জনক কল্পনাই করতে পারেনি কোনদিন।
তারমানে আর সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে ওরা। আলাদা করে ফেলা হচ্ছে ওদেরকে। ভবিষ্যতে আরও কি ঘটতে পারে কল্পনা করে মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল শীতল শিহরণ।
তারমানে কোন ধরনের ফ্রিকে পরিণত হয়েছি আমি? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল সে।
আমার কোন বন্ধু থাকবে না। সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।
টিচাররাও আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে, কারণ আমি ওদের ভুল ধরে দিই।
তাহলে কি ঘটবে আমার?
দুই সহকারীর দিকে তাকাল সে। মুসা আর রবিন-ওরাও আর তার সহকারী থাকতে চাইবে না। কারণ ওদের মগজও তার মত একই রকম বুদ্ধিমান হয়ে গেছে।
মাথা নিচু করে আছে মুসা।
নিজের নখ খুঁটছে রবিন।
দুজনেই ভয় পেয়েছে। প্রচণ্ড ভয়।
চুপ করে আছো কেন? মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। কিছু বলো তোমরা।
আচমকা বলে উঠল রবিন, কি বলব? এর কোন ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারব না।
একটা জিনিস হতে পারে… বলতে গেল মুসা।
খপ করে তার হাত চেপে ধরল কিশোর, না না, মুসা, বোলো না। আঙ্কেল জ্যাককে আমরা কথা দিয়েছি কারও কাছে ফাস করব না।
কিন্তু না বললে দেখছ না কি রকম বিপদে পড়ে যাচ্ছি? রবিন বলল। না বলে পারা যাবে না।
কি না বলে পারা যাবে না? ধমকের সুরে বললেন রবিনের মা। আমার ভাই কি করেছে? বলো, জলদি! না বললে আমিই ওকে জিজ্ঞেস করছি। ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন তিনি।
মগজ উন্নত করার ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে আমাদেরকে, বলে ফেলল রবিন।
রবিন, থামো! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
কিন্তু যা বলার বলে ফেলেছে রবিন। আর গোপন রাখা যাবে না। সুতরাং বাকিটাও বলে ফেলল রবিন, আমাদেরকে এক বোতল মগজ উন্নত করার ওষুধ দিয়েছিল আঙ্কেল জ্যাকবুদ্ধি বাড়ানোর জন্যে। হঠাৎ করে কেন জানি বোকা হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। তার কাছে গিয়ে সব বুলোম। বুদ্ধি বাড়ানোর ওষুধ নিয়ে গবেষণা করছে আঙ্কেল জ্যাক, আমাদের কাকুতি-মিনতি শুনে একটা বোতল দিয়ে দিয়েছিল, তিনজনে ভাগ করে খাওয়ার জন্যে। এবং তাতে কাজ হয়ে গেছে। ওষুধ আমাদের বুদ্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এত বোকাই বা হয়ে গিয়েছিলে কেন, হঠাৎ করে? মেরিচাচী প্রশ্ন করলেন। টিচারদের দিকে তাকালেন। বোকা যে হয়ে গিয়েছিল, সেটা আমিও লক্ষ করেছি।
মিস্টার আমান বললেন, আমিও।
তাহলেই তো বোঝা যাচ্ছে, মিস্টার ক্রেগ বললেন, একটা পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল ওদের।
একটা নয়, দুটো, দুই আঙুল তুললেন মিস্টার মিলফোর্ড। একবার অতিরিক্ত বোকা হয়ে যাওয়া, একবার অতিরিক্ত বুদ্ধিমান। কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি। চালাকটা কি করে হলে, তা তো বুঝলাম। কিন্তু বোকা হলে কি করে?
মাথা নাড়ল কিশোর, জানি না!
চুপ হয়ে গেল সবাই।
ঘরে পিনপতন নীরবতা।
দীর্ঘক্ষণ পর জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নীরবতা ভাঙলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। কোন ধরনের জাদু-করা-ফরমুলা এ রকম বুদ্ধিমান বানিয়েছে তোমাদেরকে আমি জানি না, তিন গোয়েন্দাকে বললেন তিনি। তবে একটা কথা জানি। এ স্কুল তোমাদেরকে ছাড়তে হবে। আর তোমাদেরকে এখানে রাখা সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।