০৬.

বিষণ্ণ অন্ধকারকে যেন খানখান করে দিল তীব্র, তীক্ষ্ণ চিৎকার। শিরশির করে উঠল মুসার পিঠের কাছটায়। পাঁচ ফুট দূরের যে কালো ছায়াটাকে বনের ছায়া মনে করেছিল সে, আসলে ওটা একটা গরিলা। একজন উয়াটুসি পুরুষের সমান লম্বা, কিন্তু তিন-চারগুণ চওড়া। কুচকুচে কালো শরীর, তার মধ্যে সাদা বলতে কেবল বিকট হ থেকে বেরিয়ে থাকা ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো। গভীর কোটরে বসা চোখের রঙও কালো। কালো নাকটাকে মনে হচ্ছে শক্ত রবারে তৈরি, আর দাড়িকে লাগছে রঙ করার ব্রাশের মত।

লম্বা একটা কালো হাত বাড়িয়ে মুসার হাত থেকে বাঁশের কোড়টা কেড়ে নিল গরিলা। ছুঁড়ে দিল ঝোঁপের ভেতর। কিচমিচ করে উঠল কয়েকটা কণ্ঠ। তারমানে। ওখানে রয়েছে তার বাচ্চাগুলো। দুই হাতে নিজের বুকে দমাদম কিল মেরে যেন ঢাক বাজাতে শুরু করল গরিলাটা। এতেও সন্তুষ্ট হতে না পেরে ঢাকের সঙ্গে সঙ্গত করার জন্যে গলা ছেড়ে চিৎকার করতে লাগল।

এই শিক্ষা জীবনে ভুলবে না মুসা। কোন বড় জানোয়ারকে বিরক্ত করার পর যে অভিজ্ঞতা হয় সেটা বলার জন্যে বেঁচে থাকে না বেশির ভাগ মানুষই। কেন যে কি কারণে বিরক্ত হবে জানোয়ারেরা, সেটাও ঠিক করে বলার উপায় নেই। এই যেমন, এই গরিলাটা হয়েছে মুসা একটা বাঁশের কোড় তুলেছে বলে।

দুপদাপ করে হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে ওর। পিছাতে শুরু করল মুসা। অতবড় এক গরিলার সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে যাওয়ার মত বোকামি আর হয় না। সঙ্গে বন্দুক নেই। আছে শুধু দু-জনের কাছে দুটো ছুরি। এই দানবের বিরুদ্ধে সেগুলো দুটো সাধারণ শলাকা মাত্র।

পিছাতে পিছাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরের গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা।

দাঁড়িয়ে থাকো, ফিসফিস করে বলল কিশোর। একচুল নড়বে না। যেই বুঝবে তুমি ভয় পেয়েছ, মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলবে মুণ্ডটা।

পাশাপাশি দাঁড়াল দু-জনে।

সমানে ঢাক বাজিয়ে চলেছে গরিলাটা। চিৎকারও বন্ধ করছে না। আট ইঞ্চি লম্বা হাতের রোম। থাবাটা যেন একটা ভাত খাওয়ার বাসন।

ওর ভাষাতেই ওকে শাসানো দরকার, কিশোর বলল।

নিজের বুকে চাপড় মারতে শুরু করল সে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এমন ভঙ্গি করে ফেলল, কুৎসিত ভঙ্গি, যেন সে-ও একটা গরিলা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল।

দেখাদেখি মুসাও তা-ই করল।

দু-জন মানুষ আর একটা গরিলার মিলিত বিচিত্র চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল বাশবনে। চতুর্দিকে এখানে ওখানে শুরু হয়ে গেল আরও গরিলার ঢাক বাজানো আর চিৎকার। কলরব শুরু করল পাখি আর বানরের দল।

কি হয়েছে দেখার জন্যে দৌড়ে এল আকামি আর মুংগা। সঙ্গে কুলিরা। কাণ্ড দেখে তো হতবাক। একটা গরিলা চাইছে দুটো ছেলেকে ভয় দেখাতে, আর ছেলেরা চাইছে গরিলাটাকে ভয় দেখাতে।

কি করবে বুঝতে পারছে না আকামি আর মুংগা।

তবে খানিক পরে বোঝা গেল গরিলাটাই পরাজিত হতে চলেছে। কয়েক ইঞ্চি পিছিয়ে গেল ওটা। সঙ্গে সঙ্গে এক পা এগিয়ে গেল ছেলেরা। হাত নেড়ে এমন ভঙ্গি করছে যেন ধরতে পারলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে গরিলাকে।

চিৎকার থামিয়ে দিল গরিলাটা। মুখের ভাব বদলে গেল। চোখে ভয় ফুটছে।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে, লম্বা দুই হাত মাটিতে নামিয়ে দিয়ে, কব্জিতে ভর রেখে, চার হাত-পায়ে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল ঝোঁপের ভেতর।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ভয়টা প্রকাশ করল এতক্ষণে। বলল, আমার পা জমে গেছে।

হাসল কিলোর। তোমার কিছু খাবার দরকার। বাঁশের কোঁড় খেয়ে দেখতে পারো।

আরও! ভয়ে ভয়ে গাছের নিচে ছায়ার দিকে তাকাতে লাগল মুসা, এখন তার মনে হচ্ছে প্রতিটি ছায়াই একটা করে গরিলা। না খেয়ে মরে যাব, তবু বাঁশের কেড়ের লোভ আর করছি না!

আবার চলতে শুরু করল ওরা। বাঁশবন থেকে বেরিয়ে এল খোলা তৃণভূমিতে।

তারপরে একটা হ্রদ। বৃষ্টির মধ্যেও খুব সুন্দর লাগছে দেখতে।

বৃষ্টি-ভেজা আজব এই পার্বত্য অঞ্চলের এটা আরেক অদ্ভুত ব্যাপার। ঢালটা যেন বিচিত্র এক ব্যালকনি, আর প্রতিটি ব্যালকনিতে রয়েছে একটা করে হদ। অভিযাত্রীরা চমৎকার সব নাম দিয়েছে এগুলোর-গ্রীন লেক, ব্ল্যাক লেক, হোয়াইট লেক, গ্নে লেক। ওপর থেকে নেমে আসা বরফগলা পানি আর ক্রমাগত বষ্টির পানিতে সব সময় টুইটম্বুর থাকে হ্রদগুলো। প্রতিটি ব্যালকনি থেকে জলপ্রপাতের মত পানি ঝরে পড়ছে তার নিচের হ্রদটায়।

উদ্বিগ্ন হয়ে আকামি বলল, ওই পানিতে পায়ের ছাপ মুছে যাবে। এগোব কি করে?

হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। বিশাল একটা ফুলের ওপর বসে রয়েছে চন্দ্ৰপাহাড়ের এক ভয়াল চেহারার প্রাণী। একটা ক্যামেলিয়ন। বড় বড় চোখ, মাথা থেকে বেরিয়েছে তিনটে শিং, যেন প্রাগৈতিহাসিক দানবের খুদে সংস্করণ।

খুব খারাপ লক্ষণ, আকামি বলল। কোনখানে যাওয়ার সময় এই প্রাণী সামনে পড়লে আর এগোনো উচিত না। এগোলেই বিপদ।

এ সব কুসংস্কার বিশ্বাস করে না কিশোর, অধৈর্য হয়ে বলল, হলে হবে। এগোও।

সঙ্গে আসা কুলিরাও দাঁড়িয়ে গেছে। কেউ এগোতে রাজি নয়। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে ছোট্ট গিরগিটিটার দিকে। আকামির সঙ্গে ওরাও একমত-ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া উচিত।

দেখো, বোঝনোর চেষ্টা করল কিশোর, তোমরা সবাই সাহসী মানুষ। ভয়ানক বাঘ-সিংহের মুখোমুখি হতে পরোয়া কোরো না। হাতি-গণ্ডারের সঙ্গে লাগতে ভয় পাও না। দাঁত নেই, বিষ নেই এমন একটা খুদে প্রাণীকে ভয় পাচ্ছ তোমাদের মত মানুষ, এ কথা বিশ্বাস করতে বলল আমাকে?

প্রাণীটার মুখের কাছে আঙুল নিয়ে গেল কিশোর।

আতঙ্কিত চোখে নীরবে তাকিয়ে রয়েছে লোকগুলো।

নড়ল না ক্যামেলিয়নটা। কোথা থেকে উড়ে এসে একটা মাছি বসল কিশোরের আঙুলে। ক্যামেলিয়নের মুখ থেকে বিদ্যুতের মত ছিটকে বেরিয়ে এল লিকলিকে জিভ, মাছিটাকে আটকে ধরে নিয়ে চলে গেল আবার মুখের ভেতর।

অনেকটা পিঁপড়েখেকোর মত কাজ করে এর জিভ, মুসাকে বলল কিশোর। কেমন লম্বা দেখলেই তো। চটচটে আঠা, লাগলে আর ছুটতে পারে না।

মাছিটাকে খেয়ে আরেকটা ফুলের ওপর সরে গেল ক্যামেলিয়নটা। এতক্ষণ ছিল নীল ফুলের ওপর, তার শরীরের রঙও ছিল নীল; যেই কমলা রঙের অন্য ফুলটাতে গেল, শরীরটা হয়ে গেল কমলা। মুহূর্তে গায়ের রঙ বদলে ফেলেছে।

দেখলেন! কাঁপা গলায় বলল আকামি, জাদু জানে!

জাদু না ছাই! রেগে গেল কিশোর। নিজেকে বাঁচানোর আর কোন উপায় নেই এটার, তাই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর চেহারা বানিয়েছে, যাতে অন্যেরা খেতে না আসে একে, ভয় পেয়ে সরে যায়। নিজের রঙ বদলাতে পারে, যাতে যে ফুলের ওপর বসবে তার সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। দুটো কাজ হয় এতে-শত্রুর চোখ এড়িয়ে থাকতে পারে, শিকারও তাকে দেখতে পায় না বলে জিভের নাগালে চলে আসে।

কিন্তু কোনভাবেই বোঝানো গেল না কুসংস্কারাচ্ছন্ন কুলিদের।

রেগেমেগে শেষে কিশোর বলল, বেশ, তোমরা না আসতে চাইলে চলে যাও। আমি আর মুসা একাই যেতে পারব।

ক্যামেলিয়নটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সে। পেছনে চলল মুসা।

আধ মাইলও গিয়ে সারেনি, ছুটতে ছুটতে এল আকামি। জিজ্ঞেস করল, সত্যিই তাহলে ফিরে যাবেন না?

না, কিশোর বলল। তোমার আসার দরকার নেই।

আমি যাব আপনাদের সঙ্গে।

কিন্তু অশুভ লক্ষণ যে দেখলে?

 বিপদে পড়লে একসঙ্গেই পড়ব। আপনাদের ফেলে আমি যাব না।

লোকটার বিশ্বস্ততায় গলে গেল কিশোর। কতটা দুঃসাহস দেখাচ্ছে আন্দাজ করতে পারল। রক্তে মিশে যাওয়া শত বছরের কুসংস্কার ভাঙতে চলেছে সে, সোজা কথা নয়।

কিন্তু আকামি একাই নয়, কয়েক মিনিট পর হাঁপাতে হাঁপাতে মুংগাও এসে হাজির।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল কিশোর।

হাতের রাইফেলটা দেখিয়ে কৈফিয়তের সুরে মুংগা বলল, ভাবলাম, এটা ফেলে যাচ্ছেন, বিপদে পড়তে পারেন। তাই নিয়ে এলাম।

নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল কিশোর।

সরে গেল মুংগা। না না, আপনার বয়ে নেয়া লাগবে না। আমিই নিতে পারব।

খানিক পর এক এক করে ফিরে এল সব কজন। একজন লোকও ক্যাম্পে ফিরে যায়নি। ক্যামেলিয়নের ভয় কাউকে ঠেকাতে পারল না শেষ পর্যন্ত।

.

০৭.

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। অঝোরে ঝরছে এখন বড় বড় ফোঁটায়। মাথার ওপর অনেক নেমে এসেছে কালো মেঘ। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায়। অন্ধকারও বেড়েছে। দশ ফুট দূরের জিনিসও আর চোখে পড়ে না ঠিকমত।

কিন্তু দমল না ওরা। হাতির পায়ের ছাপ অনুসরণ করে ঠিকই এগিয়ে চলল।

খুদে দানবের ছাপের পাশে মাঝেসাঝে খালি পায়ের ছোট ছাপ চোখে পড়ছে, বোধহয় সর্দারের ছেলে আউরোরই হবে।

বেচারা আউরো! আনমনে বলল কিশোর, যা শুনলাম, সুন্দর চেহারার ছেলেমেয়েগুলোকেই কেবল নিয়ে যায়। কেন নেয়?

আন্দাজ করতে পারি, আকামি বলল।

কেন?

কিডন্যাপাররা স্ন্যাভার, মানুষের ব্যবসা করে। গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। সুন্দর চেহারাগুলো নেয় বেশি দাম পাবে বলে।

কান খাড়া করে ফেলেছে মুসা। কিন্তু দাস ব্যবসা তো বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে বলে শুনেছি? এর বিরুদ্ধে এখন কড়া আইন করা হয়েছে।

কই আর হলো? আকামির হয়ে জবাব দিল কিশোর। আগের মত খোলাখুলি বাজারে বিক্রি হয় না, এই যা। গোপনে গোপনে এখনও হরদম চলছে এই ব্যবসা। শুধু আফ্রিকাই নয়, ভারত, বাংলাদেশ আর ওরকম দরিদ্র আরও অনেক দেশ থেকে মানুষ পাচার করে দেয়া হয় ধনী দেশগুলোতে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে। নারী আর শিশুরাই প্রধানত এসবের শিকার।

নিশ্চয় জাহাজে করে সাগর পার করে নিয়ে যায়। সেজন্যেই জাহাজীদের গায়ের গন্ধ পেয়েছে আকামি।

মাথা ঝাঁকাল আকামি।

সামনে পেলে গন্ধ শুঁকে চিনতে পারবে লোকটাকে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

নিশ্চয় পারব। আরবদের ওই ডাউ জাহাজগুলোর গন্ধ বড় বদ। একবার নাকে ঢুকলে জীবনে আর ভোলার উপায় নেই।

হ্রদের পাড়ে এসে দাঁড়াল ওরা। সব চিহ্ন আচমকা শেষ হয়ে গেছে এখান থেকে। আকামির মত ওস্তাদ ট্র্যাকারও আর কোন চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছে না।

ব্যাটারা ভীষণ চালাক, বলল সে। এখান থেকে কোথায় গেছে বলার উপায় নেই। পানিতে নেমেছে এটুকু বুঝতে পারছি। কিন্তু তারপর? যে কোনও দিক দিয়ে নেমে অল্প পানিতে হেঁটে গিয়ে আবার পাড়ে উঠতে পারে। সাঁতরে লেক পার হয়েও ওপাড়ে চলে যেতে পারে। কোনটা করেছে?

হাতি কি সাঁতরাতে পারে নাকি? জানতে চাইল মুসা।

খুব ভাল পারে, জবাব দিল তার বন্ধু। তবে পানি বেশি গভীর না হলে সাঁতরানোর চেয়ে তলা দিয়ে হেঁটে চলে যেতেই বেশি পছন্দ করে ওরা।

তাজ্জব ব্যাপার! শ্বাস নেয় কি করে?

 শুড়টা উঁচু করে রাখে, নাকের ফুটো বের করে রাখে পানির ওপর।

তাহলে তো পানির নিচে কাদায় পায়ের ছাপ থাকার কথা।

হ্রদটা বেশি গভীর না। টলটলে পরিষ্কার পানিতে চোখ ডুবিয়ে নিচের কাদা দেখতে লাগল আকামি। কিছুই দেখতে পেল না। একটা পরীক্ষা করল তখন। নেমে গেল পানিতে। পা দেবে গেল কাদায়। নাড়া লেগে ঘোলা হয়ে গেল পানি। ওপরে উঠে এল সে। আবার পানিতে চোখ ডুবিয়ে দেখল। আস্তে আস্তে থিতিয়ে গেল কাদা, আবার পরিষ্কার হলো পানি। তার পায়ের ছাপ নেই।

তারমানে হাতি এদিক দিয়ে গেলেও বোঝার উপায় নেই, চারপাশ থেকে গলিত কাদা সরে এসে নিমেষে ঢেকে দিয়েছে তার পায়ের ছাপ।

কোনওখান দিয়ে তো নিশ্চয় উঠেছে পানি থেকে, মুসা বলল। পাড়ে নিশ্চয় ছাপ পড়েছে। সেটা খুঁজে বের করলেই তো পারি?

কিন্তু বিশেষ আশাবাদী হতে পারল না আকামি। কারণ অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। পায়ের ছাপ পড়লে সেটা মুছে দেবে এই বৃষ্টি। তবু কিশোরের কথার প্রতিবাদ না করে হ্রদের পাড়ে খুঁজতে শুরু করল সে।

সাংঘাতিক বিরক্তিকর এই শীতল বৃষ্টি। বেশিক্ষণ এর মধ্যে থাকলে একধরনের অস্থিরতায় পেয়ে বসে মানুষকে। কুলিদের মধ্যে সেই লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করল।

হ্রদের পশ্চিম পাড়ে এসে আরেক বিপদ, চলাই মুশকিল হয়ে উঠল। থিকথিকে কালো কাদা, পা পড়লে ডেবে যায়-কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত দাবে। কি মনে হতে ম্যাপ বের করল কিশোর। দেখল, এখানেই আছে সেই কুখ্যাত বিগো বগ, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি করেছে অভিযাত্রীরা। পানি আর কাদার আঠাল সূপ তৈরি হয়ে থাকে যেন এখানে। মানুষের পা আঁকড়ে ধরে রাখে। এর মধ্যে হাঁটতে গেলে সাংঘাতিক পরিশ্রম।

শরীর ডেবে গেলেও এটাকে চোরাকাদা বলা যাবে না। কারণ চোরাকাদাকে যেমন অতল বলা হয়, এটা ঠিক সেরকম নয়। তবে চোরাকাদার চেয়ে কম বিপজ্জনকও নয়। যেখানে বেশি গভীর, সেখানে পড়লে অন্যের সাহায্য ছাড়া উঠে আসা কঠিন।

কাদার মধ্যে নেমে এগোনোর চেষ্টা করতে হঠাৎ কোমর পর্যন্ত ডেবে গেল আকামির। সবাই মিলে টেনেটুনে তাকে তুলে আনল বগ থেকে।

হেঁটে যেতে পারবে না বুঝে সাঁতরে যাওয়ার চেষ্টা করল মুসা। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত করে পড়ল তরল কাদার ওপর। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল তার। শরীর।

তাড়াতাড়ি কাদার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তার বাহু ধরে টেনে তুলে আনল কিশোর আর আকামি।

সারা গায়ে কাদা মেখে ভূত সেজে গেছে মুসা। হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, বাপরে বাপ, কি জঘন্য! পানি আর কাদা যে এক জিনিস নয় এতদিনে বুঝলাম! সাঁতার কাটা অসম্ভব!

এই সময় একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল ওদের। দুটো হাতি। একটা বড় মাদী, আরেকটা ছোট মদ্দা-বয়েস খুব অল্প, সবে কৈশোর পেরিয়েছে। কিন্তু বাচ্চা হলেও হাতির বাচ্চা, গায়ে-গতরে অনেক বেড়ে গেছে। বড়টা সম্ভবত ছোটটার মা।

কাদায় পড়েছে বড়টা। পাড়ে দাঁড়িয়ে খুঁড়ে ড় লাগিয়ে তাকে টেনে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাচ্চাটা।

অনেক চেষ্টা করেও মাকে তুলতে পারল না সে। মায়ের তুলনায় অনেক ছোট, গায়ে শক্তিও কম, অতবড় ভারি একটা শরীরকে কি আর তুলে আনতে পারে? আর্তচিৎকার করতে করতে কাদায় পুরোপুরি ডুবে গেল মা। বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করল বাচ্চাটা, কাদার পাড়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। অনেকটা মা হারা মানবশিশুর মতই।

বড় মায়া লাগল মুসার। কিন্তু কি করবে? বিশাল একটা হাতিকে কাদা থেকে তুলে আনার সাধ্য তাদের নেই।

এই করুণ দৃশ্য মন খারাপ করে দিল অভিযাত্রীদের। কাদার ভয়াবহতাও বুঝতে পারল। এই কাদা মাড়িয়ে আর এগোনোর সাহস করল না।

তা ছাড়া পায়ের ছাপ নেই, কোন চিহ্ন নেই, কোন দিকে এগোবে? অহেতুক আর হাঁটাহাঁটি না করে নিরাশ হয়ে গায়ে ফিরে চলল দলটা।

অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল এই সময় হাতির বাচ্চাটা। একাকী এই ভয়ঙ্কর জায়গায় থাকতে যেন সাহস হলো না তার, মানুষের পিছে পিছে চলল।

হাতির বাচ্চারা এ রকম করে, জানা আছে মুসার। নিরালা জায়গায় একলা থাকতে ভয় পায়। কি মনে হতে হাত বাড়িয়ে ডাকল ওটাকে সে। কুকুরের বাচ্চার মতই সাড়া দিল হাতির বাচ্চা। এগিয়ে এসে তার হাতে ঔড় ঘষতে লাগল।

আদর করে তার শুড়ে হাত ঘষে দিল মুসা। সহজেই জন্তু-জানোয়ার নেওটা হয়ে যায় তার। এই বাচ্চাটারও হতে দেরি লাগল না। নামও একটা দিয়ে দেয়া হলো। মায়ের কাদায় ডুবে মরার ঘটনাটা স্মরণীয় করে রাখার জন্যে বাচ্চার নামকরণ হলো কাদার খোকা।

.

০৮.

অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল সর্দার ওগারো, ওদের দেখেই দৌড়ে এল। ভেজা চুপচুপে, কাদামাখা বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে দেখেই অনুমান করে নিল কি ঘটেছে। তবু জিজ্ঞেস করল, আমার ছেলেকে পেয়েছ?

নীরবে মাথা নাড়ল কিশোর।

বিষণ্ণ চোখ তুলে পর্বতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল সর্দার, হে বজ্ৰমানব, তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে মানুষের কিছু করার নেই! বুঝলাম, আর কোনদিন ছেলেকে দেখতে পাব না আমি!

দেখুন, এত সহজে হাল ছাড়বেন না, বোঝাতে চাইল কিশোর, আমরা এখনও চেষ্টা ছাড়িনি। খবরটা পুলিশকে জানিয়েছেন?

লোক পাঠিয়েছি। কিন্তু জানি, লাভ হবে না। এমনিতেই অনেক কাজ পুলিশের, গোলমাল লেগেই আছে দেশে, ছেলে হারানোর মত একটা ছোট্ট ঘটনাকে পাত্তাই দেবে না ওরা। আসবে না।

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে কুঁড়েতে ফিরে গেল সর্দার।

শরীর থেকে আঠাল কাদা ধুয়ে ফেলার জন্যে হ্রদে নামল কিশোর-মুসা আর তাদের সঙ্গীরা।

প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। ক্যাম্পে যারা ছিল, তারা রান্না করেই রেখেছে। তাঁবুতে ঢুকেই খেতে বসে গেল কিশোররা। গপগপ করে গিলতে লাগল সবাই। কাদার খোকারও খাবারের ব্যবস্থা করল কুলিরা।

পেট শান্ত হয়ে এলে মুসা জিজ্ঞেস করল, আজ রাতে কি করব? পাহারা লাগবে? হাতির এই বাচ্চাটাকেও যদি চুরি করতে আসে?

খাঁচায় তালা দিয়ে রাখব, জবাব দিল কিশোর।

খাঁচায় ঢুকতে চাইল না হাতির বাচ্চা। শেষে মুসাকে আগে ঢুকে গিয়ে ডেকে ডেকে তাকে ঢোকাতে হলো। তারপর এক ফাঁকে পিছলে বেরিয়ে চলে এল সে। চট করে তখন দরজা লাগিয়ে তালা আটকে দেয়া হলো। শিকের ফাঁক দিয়ে শুড় বের করে হাতির ভাষায় প্রতিবাদ জানাতে লাগল কাদার খোকা। আদর করে তার ওঁড়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল মুসা, থাক, কোন ভয় নেই। এখানে তুই বেশি নিরাপদ।

বলল বটে, কেন যেন কথাটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না। আগের রাতে খুদে দানবকেও এ রকম অভয় দিয়েছিল। কিন্তু রক্ষা করতে পারল কই?

তবে এদিন আর ভুল করল না। এক তালার ওপর ভারি আরেকটা তালা লাগাল সে। দেখি, এবার কি করে খোলে ব্যাটারা?

ঝুঁকি নিতে চাইল না কিশোর, পাহারার ব্যবস্থা করল। হাতির বাচ্চাটা ছাড়াও আরও অনেক দামী দামী জানোয়ার আছে। নিলে ভাল দামে বেচতে পারবে ডাকাতরা।

আকামি আর মুংগা বেজায় ক্লান্ত। কুলিদের কারও ওপর পাহারার ভার দিতে ভরসা পেল না কিশোর। সর্দার ওগারোর সঙ্গে পরামর্শ করল।

গ্রাম থেকে লোক দিল সর্দার।

হাতে বল্লম নিয়ে খাঁচার সামনে পাহারায় বসল দুজন শক্তিশালী উয়াটুসি যোদ্ধা।

.

আহত হাতির চিৎকারের মত অদ্ভুত শব্দ পৃথিবীতে আর আছে বলে জানা নেই মুসার। চমকে জেগে গেল সে। মেরুদণ্ডে বয়ে গেল শীতল শিহরণ, শিরশির করে উঠল চামড়া, খাড়া হয়ে গেল রোম। মনে হলো বিদ্যুতের তার ছুঁয়ে ফেলেছে।

একটা মুহূর্ত যেন পাথর হয়ে পড়ে রইল সে। তারপর বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় দিল তাবুর বাইরে, কি হয়েছে দেখার জন্যে।

খাঁচার কাছে এসে হোঁচট খেল। কিসে লাগল দেখার জন্যে তাকাল নিচে। অন্ধকার এখনও কাটেনি। আবছা ভাবে দেখল ওগারোর একজন প্রহরী পড়ে আছে। নিথর। তাড়াতাড়ি বসে তার নাড়ি দেখল। মারা গেছে লোকটা।

হাতড়ে হাতড়ে দ্বিতীয় লোকটাকেও বের করল সে। সে-ও মৃত।

পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। তাঁবু থেকে বেরোতে শুরু করেছে কুলিরা। গা থেকে আসছে গ্রামবাসীরা। খাঁচার মধ্যে এখনও চিৎকার করে চলেছে হাতির বাচ্চাটা।

কি হয়েছে ওর? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর।

মনে হয় ডাকাতেরা ভয় দেখিয়েছে।

 তালায় হাত দিয়ে দেখল মুসা। একটা ভোলা। আরেকটা লাগানো রয়েছে।

 দৌড়ে তাবুতে গিয়ে চাবি নিয়ে এল সে। তালা খুলল।

কি করবে?

 ভেতরে গিয়ে ওকে শান্ত করব।

যেয়ো না! এখনওর হুঁশ নেই, খুন করে ফেলবে!

করবে না। আমাকে চেনে।

দরজা খুলে আস্তে ঢুকে পড়ল মুসা।

এই, খোকা, চুপ কর! আমি, চিনতে পারছিস না? আমি…

কিন্তু তার কথা হাতির কানে ঢুকল বলে মনে হলো না। নিজের চিৎকারেই হয়তো কান ঝালাপালা, মুসার কথা আর শুনতে পাচ্ছে না। এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিল।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। খাঁচার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।

চেপে ধরল তাকে বাচ্চাটা। চাপ দিতে শুরু করল। আরেকটু বাড়লেই মড়মড় করে পাঁজর ভেঙে যাবে মুসার। বুঝল, কিশোর ঠিকই বলেছে। ঢোকাটা উচিত হয়নি।

শুড়টা ধরার জন্যে হাতড়াতে শুরু করল সে। ওটাতে হাত বুলিয়ে দিতে পারলে হয়তো শান্ত করা যাবে।

একটা কান ঠেকল হাতে। একটা দাঁত। হাত চলে গেল যেখানে ঔড় থাকার কথা, কিন্তু নেই ওটা। তার বদলে চটচটে আঠাল পদার্থ ভিজিয়ে দিল হাত।

আরেকটু ওপর দিকে হাত তুলতে হাতে ঠেকল কাটা মাংস। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। আরও ওপরে কাটা ওঁড়ের গোড়াটুকু।

ব্যাপারটা বুঝে ফেলল মুসা। চুরি করতে এসে দু-জন প্রহরীকে খুন করেছে ডাকাতেরা। হাতিটাকে চুরি করতে চেয়েছে। কিন্তু তালা খুলতে পারেনি। বাচ্চাটা ভেবেছিল, কোন বন্ধু এসেছে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। শুড় বাড়িয়ে স্বাগত জানাতে গিয়েছিল সে। কেটে ফেলেছে ভয়ানক নিষ্ঠুর লোকটা। নিশ্চয় ভেবেছে-নিতেই যখন পারলাম না, অন্য কাউকেও রাখতে দেব না। শুড় কাটা হাতির কোন দাম নেই।

প্রচণ্ড যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গেছে বাচ্চাটা। শান্ত করার আশা বৃথা। খাঁচায় থাকলে মরতে হবে। তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগোল কিশোর।

এই খেপা অবস্থায় শুড় থাকলে কিছুতেই বেরোতে পারত না মুসা, ধরে ফেলত তাকে হাতি। এখন ধরতে পারল না বটে, মাথা দিয়ে ঢুস মারতে ছাড়ল না।

খাঁচার বাইরে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল মুসা।

তাড়াতাড়ি এসে তাকে তুলে নিল কয়েকজন কুলি।

খাঁচা থেকে ছুটে বেরোল ক্ষিপ্ত হাতি। যাকে সামনে পেল তাকেই ধরার চেষ্টা করতে লাগল। এদিক ওদিক ছুটে পালাতে শুরু করল লোকে।

কাউকে ধরতে না পেরে গায়ের দিকে ছুটল মত্ত হাতি। প্যাপিরাসের তৈরি কুঁড়ের বেড়াগুলো ধসিয়ে দিতে লাগল টুস মেরে। তছনছ করে ফেলতে লাগল সবকিছু।

আচমকা কানফাটা শব্দে গর্জে উঠল ভারি রাইফেল।

 ঢলে পড়ল হাতিটা।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে তখন। সেই আবছা আলোয় কিশোরের হাতে রাইফেলটা দেখতে পেল মুসা।

কেন মারলে? চিৎকার করে উঠল সে।

আর কি করতে পারতাম!

কয়েক মিনিট সময় পেলে শান্ত করতে পারতাম ওকে। মেরে ফেলার দরকার ছিল না।

পারতে না। ওর গুঁড়ের যন্ত্রণা কমত না। ক্রমেই আরও ক্ষিপ্ত হত। রক্তক্ষরণে মরার আগে আরও কি কি ক্ষতি করত কে জানে। মানুষ মারলেও অবাক হতাম না।

কিন্তু ওষুধ আছে আমাদের কাছে। ওর চিকিৎসা করতে পারতাম।

দেখো মুসা, মাঝে মাঝে তুমি খুব বোকা হয়ে যাও! তোমার দুঃখ বুঝতে পারছি। একটা কথা বুঝতে পারছ না, জখমটা সারানো গেলেও কোনদিনই আর শুড় ফিরে পেত না সে। বেঁচে থাকতে সাংঘাতিক অসুবিধে হত। তোমার দুটো হাত কেটে দিলে কি অবস্থা হবে বলো? হাতির ঔড় না থাকলে আমাদের হাত না থাকার চেয়েও বেশি অসুবিধে হয়। পানিও খেতে পারে না। ওকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়ার আর কোন উপায় ছিল না।

ছুরি আর কুড়াল নিয়ে মৃতদেহটার ওপর ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে গ্রামবাসীরা। হাতির মাংস তাদের প্রিয় খাবার। নষ্ট করার মানে হয় না।

কিশোরের কথায় তখনকার মত চুপ হয়ে গেলেও রাগ চাপা আগুনের মত ধিকিধিকি জ্বলতে লাগল মুসার মনে। ডাকাতদের ওপর বিষিয়ে গেছে মন। দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন একটা প্রতিজ্ঞা করল সে। তাকাল বন্ধুর দিকে।

বুঝতে পারল কিশোর। নীরবে মাথা ঝাঁকাল শুধু।

.

০৯.

 নাস্তার পর ঘটনাটা নিয়ে আকামির সঙ্গে আলোচনায় বসল কিশোর।

সামান্য কটা টাকার জন্যে এত নিষ্ঠুর হতে পারে কেউ, ভাবা যায় না! বলল সে। কাল রাতে আবার নিশ্চয় পায়ের ছাপ রেখে গেছে। কি মনে হয় তোমার, পিছু নিয়ে ধরা যাবে?

মাথা নাড়ল আকামি। না, লাভ নেই। কালকের অবস্থাই হবে। পানির কাছে টেনে নিয়ে যাবে আমাদের, তারপর ফুস!

যদি খালি জানতাম কোথায় থাকে ব্যাটারা! এতবড় পার্বত্য এলাকায় কোথায় খুঁজব ওদের?

হাঁটাচলাও সহজ নয় এখানে, মুসা বলল। রাস্তা তো নেইই, দুনিয়ার যত কাদা,হদ, জঙ্গল, খাড়া খাড়া টিলা আর তুষার।

তারপরেও, হাল আমরা ছেড়ে দিতে পারি না, কিশোর বলল। আকামি, সবাইকে বলো তৈরি হতে। একঘণ্টার মধ্যেই বেরোব আমরা।

হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকাল মুসা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল। বন থেকে বেরোতে দেখেছে খুদে দানবকে।

মাথা বের করেই দাঁড়িয়ে গেছে হাতির বাচ্চাটা। সাবধানে তাকাচ্ছে। মুসাকে দেখে চিৎকার করে উঠল আনন্দে। ছুটে এল তার দিকে।

মুসাও ছুটে গেল। কোথায় ছিলি তুই খুদে! জলদি বল! কেমন আছিস?

ম্যাজিকের মত চারপাশে লোক জড় হয়ে গেল। মুসার দুঃখ দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওদেরও, আনন্দ দেখে খুশি হলো।

সবাই খুশি, কেবল সর্দার ওগারো বাদে।

 আমার ছেলে? আমার ছেলে তো এল না ওর সঙ্গে।

সবগুলো চোখ ঘুরে গেল বনের দিকে। আউরোকে দেখা গেল না। ডাকাতদের আখড়া থেকে পালিয়ে এসেছে একলা খুদে দানব। কাদায় মাখামাখি। তাকে হ্রদে গোসল করাতে নিয়ে গেল মুসা।

ভাল করে গোসল করিয়ে তাকে নিয়ে পানি থেকে উঠে এল সে। খেতে দিল।

অনেক অত্যাচার চলেছে বেচারার ওপর। চামড়ায় আঁচড় আর কাটাকুটির দাগ। কাটা বসানো ভারি বুটের লাথি আর চামড়ার চাবুকের বাড়ির স্বাক্ষর ওগুলো।

ভীষণ রাগ লাগছে মুসার। শাস্তি দিতেই হবে শয়তানগুলোকে। আউরোকেও উদ্ধার করে আনতে হবে। কিন্তু ওদের আস্তানাটা খুঁজে পাবে কি করে? পায়ের ছাপ ধরে গিয়ে যে লাভ নেই, সে তো জানাই হয়ে গেছে।

চট করে মাথায় এল বুদ্ধিটা। তাই তো, খুদে দানবের পায়ের ছাপ ধরে ধরে গেলেই হয়! কাছেই আকামিকে দেখে উত্তেজিত হয়ে তাকে কথাটা জানাল মুসা।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল আকামি।

হতে পারে, কাজ হতে পারে!

সুতরাং আবার দল বেঁধে বেরোনোর পালা। আগের রাতে ডাকাতেরা যে ছাপ রেখে গেছে, সেগুলোকে গুরুত্ব দিল না ওরা, বাচ্চা হাতিটার ছাপ অনুসরণ করে এগোল। অনেক জায়গায় ছাপ অত্যন্ত অস্পষ্ট, কিন্তু আকামির অভিজ্ঞ চোখে তা-ও এড়াল না।

গ্রীন লেকের দিকে এগিয়ে গেছে চিহ্ন। তবে এবার আর পানিতে হারিয়ে গেল না। বরং হদের পাড় ধরে এগোল। ডানে ঘুরে পুব দিকে চলে গেছে। পুব প্রান্ত ছাড়িয়ে, জলপ্রপাত পেরিয়ে প্রায় খাড়া পথ বেয়ে উঠে গেছে ব্যালকনিতে, যেখানে ব্ল্যাক লেককে ঢেকে রেখেছে কালো মেঘ। এখানে জন্মে আছে প্রকাণ্ড পাম, প্রকাণ্ড মিমোসা আর আট ফুট উঁচু ঘাস। বিশাল এক গণ্ডার চরছে দানবীয় বিছুটি বনে, তিন ইঞ্চি লম্বা কাঁটাওয়ালা ডালগুলো চিবিয়ে চলেছে-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আইসক্রীম কেক খাচ্ছে। হ্রদের কিনারে জন্মে আছে বড় বড় জলজ উদ্ভিদ।

পুরো দৃশ্যটা এতটাই অস্বাভাবিক, মুসার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে। বিড়বিড় করে বলল, এ তো ফ্যান্টাসি ল্যান্ড! কল্পনার রঙিন জগৎ!

মোটেও কল্পনার জগৎ নয়, বাস্তব, অতিমাত্রায় বাস্তব, কিশোর বলল। তিরিশ লক্ষ বছর আগে পুরো আফ্রিকারই এই চেহারা ছিল। এখান থেকে বেশি দরে নয় সেরেঙ্গেটি প্লেন-বিশাল এক তৃণপ্রান্তর, ওখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে অতিকায় শুয়োর, ভেড়া, উটপাখি, বেবুন আর গণ্ডারের ফসিল। আজকের গণ্ডারের দই গুণ বড় ছিল ওগুলো। আফ্রিকা ছিল দানবের রাজত্ব। দানবেরা সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কেবল এই পার্বত্য এলাকা বাদে। এখানে ওরা টিকে আছে আজও।

কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না আমার, পৃথিবীর সব জায়গা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল দানবেরা, অথচ এখানে টিকে থাকল কি করে?

এর সঠিক জবাব কেউ দিতে পারে না। প্রতিদিন বৃষ্টি হওয়াটা অবশ্য একটা বড় কারণ। তাতে দ্রুত বাড়ে গাছপালা, বড় হয়; আর বেশি খাবার পেলে তৃণভোজীরাও বিশালাকার হয়ে যায়। কিন্তু অনেক কারণের একটা হতে পারে এটা, সব নয়। আরেকটা জবাব হতে পারে এই জায়গাটা কোনভাবে আলাদা হয়ে গিয়েছিল দুনিয়ার সঙ্গে, এখনও আলাদা হয়েই আছে, সাগরের মাঝে দ্বীপগুলো যেমন মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে যায়। মাটিরও কোন ব্যাপার থাকতে পারে। এই অঞ্চলে কখনও আগ্নেয়গিরির উৎপাত হয়নি, ফলে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একই রকম রয়ে গেছে মাটি। যা-ই ঘটে থাকুক, এখানে আমরা তিরিশ লক্ষ বছর আগের পৃথিবীর পরিবেশে রয়েছি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেমন লাগছে ভাবতে?

ভূতুড়ে!

ভারি কুয়াশা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে রূপ নিল। বাড়তে বাড়তে একেবারে মুষলধর শুরু হলো, সেই সঙ্গে বজ্রপাত। দশ মিনিটে মুছে দিল বাচ্চা হাতিটার পায়ের ছাপ।

হঠাৎ করে থেমে গেল বৃষ্টি। পায়ের ছাপের জন্যে ব্যর্থ খোঁজাখুঁজি, চলল। মেঘের নিচে ঢেকে থাকা অদৃশ্য পর্বতের দিক থেকে ভেসে এল বাজ পড়ার প্রচণ্ড শব্দ, ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল যেন ব্যঙ্গের হাসি হেসে।

যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সবাইকে ছড়িয়ে পড়ে একশো ফুট গোল একটা বৃত্ত তৈরি করার নির্দেশ দিল আকামি। তারপর ভাল করে প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা পরীক্ষা করে দেখতে বলল। দেখতে দেখতে কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে আসবে সবাই।

কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। ভেজা মাটিতে বসে পড়ল ওরা।

আবার বজ্রের হাসি শোনা গেল গুপ্ত পর্বত থেকে।

এই শব্দ রাগিয়ে দিল কিশোরকে। এখানে বসে বসে ওই হাসি শুনবে নাকি? তোমরা পুরুষ মানুষ, না কচি খোকা? দুদু খাও? যাদের ভয়ে কাবু হয়ে বসে আছ। এখানে, তারা দেবতা নয়, আমাদেরই মত মানুষ। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আশেপাশেই কোথাও আছে ওরা, হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। ওদের খুঁজে বের আমাদের করতেই হবে। এক কাজ করি এসো, ভাগাভাগি হয়ে খুঁজতে থাকি। একসঙ্গে দু-জন দু-জন করে থাকব। এই জায়গা থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ব আমরা। তন্নতন্ন করে খুঁজব। দুপুর নাগাদ ফিরে আসব আমরা এই জায়গায়, কেউ কিছু পেয়ে থাকলে বলব।

কেউ আনমনে মাথা নাড়ল, কেউ বিড়বিড় করল, কিন্তু নির্দেশ অমান্য করল না কেউ। কে কার সঙ্গে থাকবে, ভাগ করে দিল আকামি। একেক দল একেক দিকে ছড়িয়ে গেল। কিশোর-মুসা রওনা হলো উত্তরে।

খাড়া আরেকটা ঢালের কাছে চলে এল ওরা। দানবীয় গাছপালা এখানেও, রোমশ ডালপালা; বিরাট বিরাট ফুল-যেমন ডেইজির আকারই বাসনের সমান। যে সব শ্যাওলা পায়ের নিচে কার্পেটের মত হয়ে থাকার কথা, সেগুলো কিশোরের মাথা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে কয়েক গজ এগিয়েই থেমে গেল দু-জনে। সামনে অসম্ভব ঘন হয়ে জন্মেছে শ্যাওলা, লতার সঙ্গে জট পাকিয়ে দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে একেবারে নিরেট, কোন ফাঁক-ফোকর নেই এর মধ্যে।

হবে না এ ভাবে, মাথা নেড়ে বলল কিশোর। শ্যাওলা ঠেলে এগোনো যাবে না। এমন কাণ্ড আর দেখিনি!

জন্তু-জানোয়ার চলাফেরা করে কি ভাবে তাহলে?

ভাল প্রশ্ন। নিশ্চয় সুড়ঙ্গ আছে। করে নিয়েছে ওরা। চলো, বেরিয়ে গিয়ে খুঁজে দেখি।

যতটা কষ্ট করে ঢুকেছে, ঠিক ততটাই কষ্ট করে শ্যাওলা যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখানে আবার বেরিয়ে এল ওরা। শ্যাওলার কিনারা ধরে এগোল। খুঁজে বের করল সুড়ঙ্গমুখটা। কিন্তু বড় বেশি সরু ওটা-সাপ কিংবা ইঁদুর-ঘঁচো জাতীয় প্রাণীরা তৈরি করেছে। কিন্তু চন্দ্ৰপাহাড়ের ইঁদুর-ঘঁচোও বেড়ালের চেয়ে বড়।

মুসা বলল, মোড়ামুড়ি করে ঢুকে যাওয়া যায়।

তা যায়। গিয়ে সাপের কামড় খেয়ে মারাও যায়। ইঁদুর চলাচল করলে এখানে সাপ থাকতে বাধ্য। মাম্বা কিংবা গোখরোর মুখোমুখি পড়লে আর বাঁচতে হবে না। অন্য কিছু করা দরকার।

কি করবে ভাবছে ওরা, এই সময় সমস্যার সমাধান করে দিল একটা শুয়োর। ছুটে বেরোল আরেকটা বড় সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে। এতক্ষণ ওই মুখটা চোখে পড়েনি ওদের।

মানুষ দেখে থমকে দাঁড়াল শুয়োরটা। ঘেঁৎ-ঘোৎ শুরু করল। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে গোলমাল না করে ছাড়বে না।

ছুরির মত ধারাল ভয়ঙ্কর দাঁতগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। মুসাকে সাবধান করল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো!

চোখ গরম করে গোঁ-গোঁ করে ধমক দিল শুয়োরটা, কয়েকবার আক্রমণ করার মিথ্যে হুমকি দিল। কিন্তু বোকা মানুষগুলো তার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না দেখে বোধহয় ভাবল, এই কাপুরুষদের সঙ্গে লড়াই করে মজা নেই। শেষবারের মত একবার শাসিয়ে, দাঁত নাচিয়ে, নেমে চলে গেল পর্বতের ঢাল বেয়ে।

.

১০.

সুড়ঙ্গটার ভেতরে উঁকি দিল ওরা। তিন ফুট উঁচু, দুই ফুট মত চওড়া। ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ভেতরটা মোটেও পছন্দ হলো না মুসার। হাত-পায়ে ভর দিয়ে এগোতে হবে। ভেতরে ঢুকে আরেকটা শুয়োরের যদি মুখোমুখি হয়ে যাই? যা অন্ধকারের অন্ধকার, বাপরে বাপ! সাংঘাতিক বিপদে পড়ব!

অন্য ভাবেও ভেবে দেখতে পারো। তোমার যেমন অপছন্দ, শুয়োরেরও তেমনি অপছন্দ হতে পারে এই সুড়ঙ্গ। চিতাবাঘের ভয়ে। সুতরাং সামনে যদি শুয়োর পড়ে, ঘোৎ-ঘোৎ করেই, তুমিও চেঁচানো শুরু করবে। চিতাবাঘের মত গর্জন করতে পারলে তো আরও ভাল। চিতাবাঘ সাজার এই মোক্ষম সুযোগ ছাড়া বোধহয় উচিত হবে না। কি বলো?

পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু গর্জনের ওপর ভরসা করতে পারব না আমি। ছুরিটা হাতে রাখব। চিৎকার শুনে.ভয় না পেলে শেষ ভরসা এই ছুরি।

হাতে নয়, দাতে, শুধরে দিল কিশোর। হামাগুড়ি দেয়ার জন্যে হাত দুটো ব্যবহার করতে হবে তোমাকে। ছুরি ধরতে পারবে না।

চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, দাঁতে ছুরি কামড়ে ধরার পর শুয়োরের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর মনে হলো না দুই গোয়েন্দাকে।

আগে সুড়ঙ্গে ঢুকল কিশোর। সামনে কোনও বিপদ থাকলে প্রথমে সে-ই সেটার মোকাবেলা করতে চায়।

এতে মুসা যে বিপদমুক্ত থাকল তা নয়, কারণ আক্রমণ পেছন থেকেও আসতে পারে।

তাতে বরং বিপদটা বেশিই, পেছন দিকে ছুরি চালাতে পারবে না। এত সরু সুড়ঙ্গে ঘোরার উপায় নেই।

বন্ধুকে সামনে থাকতে দেয়ায় শুরুতে যে অস্বস্তিটা ছিল, এখন আর নেই। বিপদে পড়লে কিশোর তো অন্তত ছুরি চালাতে পারবে, সে তা-ও পারবে না। তার সামনের দিকটায় একটা বাধা অন্তত আছে, পেছনে কিছুই নেই। একেবারে খোলা। শুয়োর এসে যদি দাঁত দিয়ে চিরে দেয়, কিংবা চিতাবাঘে কামড়ে ধরে, কিছুই করার থাকবে না তার।

চলো, এগোই, কিলোর বলল। কোন অসুবিধে আছে?

না, মানা করে দিল মুসা। বিপদটা বুঝতে যখন পারেনি তার বন্ধু, না বুঝুক, না বুঝে স্বস্তিতে থাকুক।

চলতে চলতে নতুন আরেকটা দুশ্চিন্তা এসে ভর করল মাথায়-কত লম্বা এই সুডঙ্গ কয়েক মাইলও হতে পারে। এভাবে হামা দিয়ে কতটা এগোনো সম্ভব? বিপদ আরও আছে। মাটিতে পড়ে থাকা কুটো আর চোখা পাথর ইতিমধ্যেই হাতের তালু আর হাটুতে খোঁচা দিতে আরম্ভ করেছে। এই অত্যাচার কতক্ষণ সইতে পারবে?

সামনে থেকে ডাকল কিশোর, মুসা, আসছ?

অনেকটা এগিয়ে গেছে সে। শ্যাওলার সুড়ঙ্গের ভেতর প্রতিধ্বনি তেমন হলো না, শব্দটাও কেমন চাপা চাপা।

চিৎকার করে জবাব দিল মুসা।

কয়েক মিনিট নীরবে হামাগুড়ি দিল সে। হঠাৎ শ্যাওলায় বাড়ি খেল মাথা। থেমে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করল, ব্যাপারটা কি? দু-ভাগ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ।

এবার কি? কোনটা ধরে যাবে? ডাকল, কিশোর?

মনে হলো, তার মুখ ভর্তি তুলল। বিস্ময়কর ভাবে শব্দ চেপে দিচ্ছে শ্যাওলা। আবার চিৎকার করে ডাকল সে। কোন ফল হলো না। বেশিদূর এগোল না তার ডাক। সাড়াও মিলল না।

আবার চিৎকার করল।

জবাব নেই।

তার জন্যে অপেক্ষা করল না কেন কিশোর? হয়তো দু-ভাগ যে হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ, এটা খেয়ালই করেনি। ভোলা পেয়েছে, ঢুকে পড়েছে। মাথায় বাড়ি না। লাগলে সে নিজেও বুঝতে পারত না। যেটা ভোলা পেত, সেটা দিয়েই ঢুকে যেত।

মাথা গরম হতে দিল না সে। তাতে বিপদ বাড়বে। শান্ত থেকে ভাবার চেষ্টা করল-কি ঘটতে পারে? সুড়ঙ্গটা যে ভাগ হয়েছে কিশোর এটা খেয়াল না করলে যেটা সোজা গেছে সেটা দিয়েই ঢুকবে। মোড় নিয়েছে যেটা সেটা দিয়ে নয়। তাহলে সোজা গেছে কোনটা? কি ভাবে বোঝা যাবে?

গাঢ় অন্ধকারে সেটা বোঝা কঠিন।

দুটো সুড়ঙ্গই সোজা গেছে মনে হচ্ছে।

ভীষণ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। নিজেকে বোঝানোনার চেষ্টা করল-ভয়ে নয়, আসলে পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছি আমি। পরিশ্রম হবেই, রয়েছে খাড়া পর্বতের ঢালে। হাত-পায়ে ভর দিয়ে ঢাল বেয়ে ওপরের দিকে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়।

কিন্তু মন কি আর ফাঁকিতে পড়ে? ঠিকই বুঝতে পারছে, পরিশ্রমে নয়, বুক কাঁপছে প্রচণ্ড ভয়ে। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের চেয়েও খারাপ অবস্থা হয়েছে তার।

অন্ধকার এই গর্তের মধ্যে বোঝারও উপায় নেই কোথায় ঘাপটি মেরে আছে হিংস্র জানোয়ার, কিংবা মারাত্মক বিষাক্ত সাপ। কোনদিকে যাচ্ছে তা-ও বোঝা যায় না। যদি দেখতে পেত, এতটা অনিশ্চয়তায় ভুগত না।

ছুরি দিয়ে ছাতে খোঁচা মেরে দেখল। গায়ে গায়ে জড়িয়ে গিয়ে শক্ত রবারের। মত হয়ে আছে শ্যাওলা। কাটার জন্যে খুঁচিয়েই চলল। হাত ব্যথা হয়ে গেল। কিন্তু থামল না সে। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে ছাত দিয়ে দেখা গেল এক চিলতে আলো।

দ্বিগুণ উদ্যমে খোঁচাতে থাকল সে।

মাথা গলানোর মত একটা ফোকর করে ফেলল।

আলোয় মাথা বের করতে পারাটা একটা বিরাট স্বস্তি। কিন্তু লাভটা কি? চারদিকে যেদিকেই তাকায় কেবল শ্যাওলা, শ্যাওলা আর শ্যাওলা। তা-ও বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। কুয়াশায় গিলে নিয়েছে যেন শ্যাওলার বনকেও।

কোনটা যে কোন দিক, বাইরেটা দেখে আরও অনিশ্চিত হয়ে গেল। কিছু বোঝার উপায় নেই। ভেতরে তো অন্তত দুটো সুড়ঙ্গ আছে, যে কোন একটা বেছে নিতে পারে। এখানে কি আছে? কিছু না।

আবার মাথা নিচু করে ফেলল। হাত-পায়ে ভর দিয়ে এগোল ডানের সুড়ঙ্গ ধরে।

কিশোরের নাম ধরে ডাকল আবার।

সাড়া নেই।

বুঝল, এভাবে ডেকে ডেকে অহেতুক দমই শেষ করবে, লাভ হবে না।

ছড়ে যাওয়া তালু আর হাটুতে ভর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলল। প্রতিবার হাত বাড়াতে গিয়েই মনে হচ্ছে এই বুঝি হাতটা পড়ল মসৃণ, পিচ্ছিল কোন ঠাণ্ডা কিলবিলে শরীরে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠবে সরীসৃপটা, ছোবল মারবে।

কিন্তু তেমন অঘটন ঘটল না।

আরেকটা দুই-সুড়ঙ্গের কাছে পৌঁছাল সে।

 ডানে যাবে না, বায়ে?

 দুটো একই রকম মনে হলো তার, বায়েরটাই ধরল।

একটু পরেই থেমে গেল। কান পেতে আছে। সামনে মৃদু একটা খসখস শব্দ। এগিয়ে আসছে।

কিছু একটা আসছে!

আশা করল, ছোট কিছু হবে, নির্বিষ, ক্ষতি করতে পারবে না, এমন কিছু, শজারু কিংবা খরগোশ। কিন্তু অত ছোট জানোয়ার এমন শব্দ করতে পারবে না। শব্দটা হচ্ছে সুড়ঙ্গের ছাত আর দেয়ালে ঘষা খাওয়ার ফলে।

দ্রুত মনের পর্দায় খেলে গেল ভয়াবহ কতগুলো জর মুখ। প্রাণীটা গরিলা, দানবীয় পিঁপড়ে ভালুক কিংবা জঘন্য হায়েনা হতে পারে। তিনটেই সাংঘাতিক জীব। শুয়োরও কম বিপজ্জনক নয়। ক্ষুরের মত ধারাল দাঁত ওগুলোর। চোখের পলকে চিরে ফালাফালা করে দিতে পারে।

এ রকম বদ্ধ জায়গায় সবচেয়ে মারাত্মক হলো চিতাবাঘ।

ভাবনাটা অবশ করে দিতে চাইল তার শরীর।

পিছিয়ে যাবে?

লাভ নেই। যত তাড়াতাড়িই পিছাক, তারচেয়ে অনেক দ্রুত ছুটে আসতে পারবে চিতাবাঘ। ধরে ফেলতে কয়েক সেকেন্ডও লাগবে না।

ভয় পেয়েছে সে এটা বুঝতে পারলে আরও সাহস হয়ে যাবে বাঘটার। দ্বিধা থাকবে না আর, আক্রমণ করতে ছুটে আসবে।

মনে পড়ল কিশোরের কথা-ঘোৎ-ঘোৎ করবে…

কিন্তু শুয়োর হওয়ার ইচ্ছে নেই তার। জানোয়ারই যখন হতে হবে, চিতাবাঘই হবে, গর্জন করবে।

এমন গর্জন শুরু করল, দুনিয়ার কোন চিতাবাঘই তা পারবে না। একই সঙ্গে সামনের দিকে ছুটে গেল আক্রমণের ভঙ্গিতে। জানোয়ারটা সাহস সঞ্চয় করার আগেই তাকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে হবে।

গর্জনের জবাবে গর্জন। জবাবটাও কম ভয়ঙ্কর নয়।

আরও জোরে গর্জন করতে লাগল মুসা। মনে হচ্ছে ফুসফুস ফেটে যাবে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে জন্তুর মত করে যতটা জোরে সম্ভব ছুটে গেল সামনের দিকে।

ঠাস করে মাথায় মাথায় বাড়ি লাগল।

উফ! করে উঠল চিতাবাঘটা।

 উফ! করে উঠল সে নিজেও।

বসে পড়ল দুই চিতাবাঘ। হাসতে লাগল। ভীতুর হাসি। কারণ দু-জনেই ভয় পেয়েছে সাংঘাতিক।

এখানে তোমার দেখা পাব, কল্পনাই করিনি, কিশোর বলল।

মুখটার কাছে অপেক্ষা করনি কেন? দু-ভাগে ভাগ হয়েছে যেখানটায়।

দু-ভাগ? বুঝতেই পারিনি! এখন বলো দেখি, ভুল পথে এলে কি করে?

 আন্দাজে ঢুকে পড়েছি দুই সুড়ঙ্গের একটাতে।

 ঘুরতে পারবে?

চেষ্টা করল মুসা। শরীর বাঁকিয়ে, মুচড়ে-টুচড়ে, অনেক ভাবে। শেষে বাদ দিল চেষ্টা।

পারব না। বেশি সরু।

তাহলে পিছাতেই হবে তোমাকে, উপায় নেই। বেশি দূর যেতে হবে না, ভেবো না, এই পাঁচ থেকে দশ মাইল! তিক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।

কি যেন ভাবল মুসা। শান্তকণ্ঠে বলল, দাঁড়াও, পাঁচ মিনিটেই ঘুরে যাব।

কি করে?

হাসল মুসা, জাদু জানি আমি। এসো।

পিছাতে লাগল মুসা। চলে এল দ্বিতীয় দুই-সুড়ঙ্গটার মুখে। পাশেরটাতে ঢুকে চুপ করে বসে রইল। তার পাশ কাটিয়ে গেল কিশোর। তখন পিছু নিল সে।

কিশোর ভাবল, এখনও তার সামনেই রয়েছে মুসা। হঠাৎ পেছনে এক ভয়াবহ গর্জন শুনে চমকে উঠল। অপেক্ষা করছে চিতাবাঘের ধারাল নখের আঁচড়ের। তার বদলে খোঁচা লাগল ছুরির মাথার।

তুমি! পেছনে গেলে কি করে!

বললাম না, জাদু।

আরে বাবা অত মশকরা করছ কেন? বলেই ফেলো না।

ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল মুসা।

একটা ঘণ্টা হামাগুড়ি দিল ওরা।

তারপর থেমে গেল কিশোর। আমার হাতও শেষ, হাঁটুও শেষ। আর কোন দিন উঠে দাঁড়াতে পারব না! জানোয়ার হয়ে বাঁচতে হবে।

চিত হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা। না ঘুমিয়ে আর পারব না আমি। যাও, ঘুরে এসো। আমি এখানেই অপেক্ষা করব।

কিন্তু এখানে ঘুমানো অসম্ভব মনে হলো তার। শ্যাওল-বনে বুকে হেঁটে চলা কৎসিত প্রাণীর অভাব নেই, ওগুলো জাগিয়ে রাখল তাকে। চুপ করে থাকলেই শরীরের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

কাঁপুনি উঠে গেল এক সময়।

জমে যাচ্ছি ঠাণ্ডায়, বলল সে। চলো, এগোই। না হলে শরীর গরম থাকবে না।

বাপরে বাপ, এমন ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে মেরু অঞ্চলে আছি! আবার এগোতে শুরু করল কিশোর।

খানিক দূর এগিয়ে থেমে গেল। এই মুসা, দেখো, মনে হয় এসে গেছি। আলো দেখতে পাচ্ছ?

নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলল ওরা।

 আলোটা বাড়ছে ক্রমে।

অবশেষে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। আলো এত উজ্জ্বল লাগল, চোখই মেলতে পারল না ঠিকমত, মিটমিট করতে থাকল। অথচ আলো যে খুব বেশি, তা নয়। রোদের চিহ্নও নেই, মেঘে ঢাকা সূর্য; এমন লাগছে বেশিক্ষণ একটানা অন্ধকারে থেকে দিবালোকে বেরিয়ে আসার কারণে।

আমি মনে করেছিলাম বিষুবরেখার কাছাকাছি আছি, মুসা বলল। কিন্তু এ তো মেরু অঞ্চল।

বিষুবরেখাতেই আছি। তবে সাগরসমতল থেকে অনেক ওপরে তো, তাই এত ঠাণ্ডা। আল্পস পর্বতের চুড়ার চেয়েও ওপরে রয়েছি আমরা।

চোখে অবিশ্বাস নিয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। যাহ্, বেশি বলে ফেলছ! তা কি করে হয়? মন্ট ব্ল্যাঙ্কের উচ্চতা পনেরো হাজার ফুট।

জানি। কিন্তু এটার চূড়া সতেরো হাজারের কাছাকাছি। আমরা আছি প্রায় ষোলো হাজার ফুট উঁচুতে।

মস্ত বড় পর্বতারোহী হয়ে গেলাম তো তাহলে। তাই তো বলি, এত শীত, লাগে কেন! কিন্তু এত ওপরে, এই ঠাণ্ডাতেও যে দাবানল লাগতে পারে, জানতাম না। দেখো, কত ছাই।

ছাই? কুয়াশার জন্যে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না আসলে। ছাই কোথায়?

এই তো।

হাত রেখে দেখো।

হাত রাখল মুসা। হাতে লেগে গেল ভেজা ভেজা সাদা জিনিস।

আরি, তুষার! বিষুব অঞ্চলে তুষার! স্বপ্ন দেখছি নাকি!

আরও দেখো। ওই যে, হ্রদটা, হোয়াইট লেক।

কুয়াশা বড় বেশি সচল এখানে। এই সরছে, এই জমছে। সরে যেতে বেরিয়ে পড়েছে হ্রদটা। আক্ষরিক অর্থেই সাদা। পানির ওপরে পুরোটা বরফ হয়ে আছে। তার ওপর হালকা তুষারের আস্তরণ।

কেমন পাথুরে, মরু প্রকৃতি এখানকার। দানবীয় ফুল আর গাছপালা অনেক পেছনে পড়ে আছে। কুয়াশার চাদরের ওপাশে কোথাও রয়েছে পর্বতের আকাশ কুঁড়ে ওঠা চূড়া। আছে বরফের নদী। যেখান থেকে যখন তখন হিমবাহ নেমে যায় নিচের খাড়ির দিকে।

কুয়াশা কুণ্ডলীর ফাঁকে ফাঁকে নিচের আজব দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, যেন এলিসের মত এক আজব দেশে এসে পড়েছে ওরা। যেখানকার সবই অদ্ভুত। পর্বতের কোলে বিশাল ছড়ানো আঙিনায় যেন বিষণ্ণ হয়ে ঘুমিয়ে আছে কালো ব্ল্যাক লেক। তার নিচে ব্যালকনিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যেন গ্রীন লেক, চারপাশের জঙ্গলের পটভূমিতে একটা রত্নের মত জ্বলছে।

নিচে, অনেক নিচে, পর্বতের পাদদেশে চোখে পড়ছে ছোট হোটেলটার চালাগুলো, যেখানে গেস্ট বুকে দেখেছে সেই সব বিখ্যাত মানুষদের নাম, যারা এই পর্বতের চূড়ায় চড়ার বহু চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অনেক রাজকুমার, কাউন্ট, ডিউক, এবং রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির লোয়েল টমাস জুনিয়র আর অ্যাডলাই স্টিভেনসনের মত অভিযাত্রীরা।

তবে গেস্ট বুকে খুব কম নামই লেখা আছে। আরও হাজার হাজার মানুষ সেই অনাদিকাল থেকে ঘুরে গেছে এই রহস্যময় পর্বতের পাদদেশ থেকে, চেষ্টা চালিয়েছে এর চূড়ায় ওঠার।

আবার এগিয়ে এল কুয়াশার ধূসর চাদর, চোখের সামনে বাধা হয়ে ঢেকে দিল নিচের অপরূপ দৃশ্য-হৃদ, জঙ্গল, বাড়িঘর।

চন্দ্রপৃষ্ঠের চেয়েও বিস্ময়কর এই পর্বতের জন্যে চাঁদের পাহাড় নামটা মোটেও অসঙ্গত নয়!

Super User