০৬.

ওদেরকে লিভিং রূমে বসিয়ে রেখে উঠে গেলেন আঙ্কেল জ্যাক। নিজের মনে গুনগুন করতে করতে ঢুকে গেলেন গবেষণাগারের মধ্যে। কয়েক মিনিট পর গুনগুন করতে করতেই গিয়ে ঢুকলেন রান্নাঘরে।

 রান্নাঘরের টেবিলে বসে মুদী দোকানের ফর্দ করছেন চেরি আন্টি। মুখ তুলে তাকালেন। সুন্দরী, মাথায় সোনালি চুল, মোলায়েম বাদামী চোখ, মুখে আন্তরিক হাসি। কি ব্যাপার, জ্যাক? বাচ্চাগুলোর সঙ্গে তোমার টপ সিক্রেট ব্যক্তিগত আলোচনা শেষ হলো? ওদের সঙ্গে কথা বলতে যেতে পারি এখন?

আন্টিকে বসে থাকতে ইশারা করলেন আঙ্কেল জ্যাক। আনমনে বিড়বিড় করলেন, বেচারারা!

আলমারি খুলে শিশি-বোতল আর বয়াম ঘাটতে শুরু করলেন তিনি।

পাশে এসে দাঁড়ালেন চেরি আন্টি। কি হয়েছে? ওদেরকে এত বিমর্ষ দেখলাম কেন? কি বলতে এসেছে তোমাকে?

যা খুঁজছিলেন পেয়ে গিয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে উঠলেন আঙ্কেল জ্যাক। আঙুরের রস ভর্তি একটা ছোট বোতল বের করলেন।

স্ত্রীর দিকে ঘুরলেন তিনি। রবিন আর তার দুই বন্ধুর কি করে যেন মগজে গেঁথে গেছে ওরা বোকা হয়ে গেছে।

আঙুরের রসের বোতল থেকে চোখ সরিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন চেরি আন্টি। বুঝলাম না। বোকা হয়ে গেছে মানে?

বোকা হয়ে গেছে মানে বোকা হয়ে গেছে। বোতলটার দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল জ্যাক। বড় মুষড়ে পড়েছে বেচারারা। ওরা আমার কাছে এসেছে এমন কোন ওষুধ আছে কিনা জানতে যেটা ওদের বুদ্ধিমান বানিয়ে দিতে পারে।

হাঁ হয়ে ঝুলে পড়ল চেরি আন্টির নিচের চোয়াল। ওদেরকে কী বলেছ তুমি? বলেছ তো ওরা ঠিকই আছে, অকারণ দুশ্চিন্তা করে করে…

ঠোঁটে আঙুল রেখে আন্টিকে চুপ থাকতে ইশারা করলেন আঙ্কেল জ্যাক। ফিসফিস করে বললেন, শুকনো কথায় আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে না ওদের। কোন কারণে আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে–এটাই হলো ওদের সমস্যা। নিজেদের ওপরই আর কোন আস্থা নেই ওদের।

কি করবে তাহলে?  জিজ্ঞেস করলেন চেরি আন্টি।

এই যে, ওষুধ দিচ্ছি, জবাব দিলেন আঙ্কেল জ্যাক। ল্যাবরেটরি থেকে কম্পিউটারে একটা লেবেল প্রিন্ট করে এনেছি।

বোতলটা কাউন্টারে রাখলেন আঙ্কেল জ্যাক। লেবেলটা বের করে দেখালেন আন্টিকে। তাতে লেখা: বুদ্ধি বাড়ানোর টনিক।

লেখাটার দিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করলেন চেরি আন্টি, এ রকম কোন ওষুধের কথা তো জন্মেও শুনিনি।

দরাজ হাসি ছড়িয়ে পড়ল আঙ্কেলের মুখে। আমিও শুনিনি। তবে ওদের আমি বলব এটা আমার নিজের আবিষ্কৃত ওষুধ, বুদ্ধি বাড়ায়। ওদের বিশ্বাস জন্মানোটাই হলো আসল কথা। ওষুধে কাজ করছে এটা ভাবতে আরম্ভ করলেই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন চেরি আন্টি। দেখো কাজ হয় কিনা।

তাড়াহুড়া করে লিভিং রূমের দিকে চলে গেলেন তিনি। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে।

বোতলের দিকে মনোযোগ দিলেন তিনি। সুন্দর করে লেবেলটা লাগিয়ে দিলেন বোতলের গায়ে। তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালমত দেখলেন আঙুরের রস লেখা আসল লেবেলটা কোনখান দিয়ে দেখা যায় কিনা।

হয়েছে, সন্তুষ্ট হয়ে নিজেই ঘোষণা দিয়ে জানালেন নিজেকে। চমৎকার। পুরানো লেবেলটা দেখা যায় না। এটাকে মগজ উন্নত করার কিংবা বুদ্ধি বাড়ানোর ওষুধ ভাবতে আর আপত্তি কোথায়?

ভাগ্যিস, বুদ্ধিটা এসেছিল মাথায়। আপনমনে হাসলেন, আঙ্কেল জ্যাক। বোতলটা হাতে নিয়ে রওনা দিলেন লিভিং রূমের দিকে।

এই সময় টেলিফোন রাজল। ফোনটা রয়েছে ল্যাবরেটরিতে। হলের শেষ মাথার ঘরটা ল্যাবরেটরি।

কাউন্টারে বোতলটা রেখে ছুটলেন ফোন ধরার জন্যে। এই সুযোগে লুকানোর জায়গা থেকে বেরিয়ে এল মাজুল আর গাজুল।

ল্যাবরেটরির দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল গাজুল, এটাই আমাদের সুযোগ।

কি করবে? লিভিং রুমের দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করল মাজুল।

দেখোই না কি করি।

বোতলটা তুলে নিয়ে মুখটা খুলে ফেলল গাজুল।

কি করছ?  জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে মাজুল।

আহ, চুপ থাকো না! ওরা শুনতে পেলে দৌড়ে আসবে দেখার জন্যে। আমার প্ল্যানটাই তখন বাতিল। গোলাম বানানোর জন্যে আর ধরে নিয়ে যাওয়া যাবে না ছেলেগুলোকে।

আর কিছু না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইল মাজুল।

বোতলটাকে কাত করে সমস্ত রস সিংকে ফেলে দিল গাজুল। কোমরে ঝোলানো একটা ব্যাগ থেকে আরেকটা বোতল বের করল। সেটা থেকে পানির মত রঙহীন তরল পদার্থ ঢালল প্রথম বোতলটায়। ছোট ছোট নানা রঙের শিশিও আছে ব্যাগটাতে। আঙুরের রসটা যে রঙের ছিল, সে-রকম রঙ মিশিয়ে দিল বোতলের তরল পদার্থে। দেখতে অবিকল আঙ্কেল জ্যাকের রেখে যাওয়া আঙুরের রসের মতই রঙ হয়ে গেল জিনিসটার।

সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল গাজুল। কিছু বুঝলে? আমাদের ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা মগজ উন্নত করার সত্যিকারের ওষুধ মিশিয়ে দিলাম। মগজশক্তি রসায়ন মানুষের ব্রেনের ওপর কতখানি কাজ করবে জানি না। তবে আশা করি বোকা ছেলেগুলোর এবার খানিকটা হলেও বুদ্ধি বাড়বে। আর তা হলেই হয়ে গেল আমাদের কাজ।

লেবেল লাগানো আঙুরের রসের বোতুলটার মুখ লাগিয়ে আবার আগের জায়গায় রেখে দিল গাজুল।

ল্যাবরেটরির দিক থেকে পায়ের শব্দ শোনা গেল।

জলদি। তাড়া দিল গাজুল। আলমারির পেছনে।

বোতলটার দিকে তাকিয়ে আছে মাজুল। কোন মানুষকে কখনও এ ফরমুলা খাওয়ানো হয়নি। কি ঘটবে কে জানে! যদি রিঅ্যাকশন হয়? মগজের ওষুধ, বলা যায় না, পাগলও তো হয়ে যেতে পারে। মরে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।  

সঙ্গীর কাঁধে জোরে এক ঠেলা মেরে আলমারির দিকে ঘুরিয়ে দিল গাজুল। মারা গেলে আর কি করব। গবেষণা করতে গেলে এ রকম দুচারজন মারা যেতেই পারে। দেখা যাক কি হয়…চলো চলো…

.

০৭.

 রান্নাঘরে ফিরে এলেন আঙ্কেল জ্যাক।

বোতলটা তুলে নিয়ে লিভিং রূমের দিকে এগোলেন তিনি। কানে আসছে চেরি আন্টি আর ছেলেদের কথাবার্তা, হাসাহাসির শব্দ।

দরজার কাছে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন তিনি। তারপর মুচকি হেসে ঢুকে পড়লেন ঘরের মধ্যে। বোতলটা তুলে দেখালেন ছেলেদের। এই যে, তোমাদের ওষুধ।

বোতলটা প্রথমে কিশোরের হাতে দিলেন তিনি।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কিশোর। চোখের পাতা সরু হয়ে এল। সন্দেহ ফুটল তাতো বুদ্ধি বাড়ানোর ওষুধ?

মুখভঙ্গি নির্বিকার করে রেখে মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল জ্যাক। হ্যাঁ, আমার নিজের ফরমুলা। বহু বছর ধরে এর ওপর গবেষণা করেছি আমি।

চেরি আন্টির পাশে কাউচে বসে পড়লেন তিনি। জিনিসটা কি ভাবে কাজ করে ব্যাখ্যা করে বোঝানো খুব কঠিন। বুদ্ধিমান মানুষদেরই সহজে মাথায় ঢুকতে চাইবে না, আর তোমরা তো বোকাই হয়ে গেছ। তবু বলি, এটা হলো নিউরন আর প্রোটনের ব্যাপার-স্যাপার। তার যুক্ত হয়েছে মগজে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহের নিয়ম-কানুন…

অত কঠিন কঠিন কথা শুনতে গিয়ে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় হলো মুসার। বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কা-কা-কাজ হবে তো?

ভয়ে ভয়ে বলল রবিন, মগজ বদলে দেবে? কিশোরের হাতের বোতলটার দিকে তাকাল সে।

না, তা বদলাবে না, আশ্বস্ত করলেন আঙ্কেল জ্যাক। আড়চোখে পরস্পরের দিকে তাকালেন তিনি আর চেরি আন্টি। আবার ছেলেদের দিকে ফিরলেন আঙ্কেল জ্যাক। সোজা করে বলতে গেলে তোমাদের মগজের বুদ্ধি, চলাচলের রাস্তার মধ্যে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো সৃষ্টি হয়েছে, যার জন্যে বোকা হয়ে গেছ তোমরা, সেটা দূর করতে সাহায্য করবে এই ওষুধ। তোমাদের মগজের মহাসড়কটা খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি আমি। মগজে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহকে আরও খোলাখুলি ভাবে প্রবাহিত করতেও সাহায্য করবে এই ওষুধ।

এত বড় জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার পরেও সন্দেহ যেতে চাইল না কিশোরের। বোতলটার দিকে তাকাল আবার। তো কি করব আমরা এখন? কতটা করে ওষুধ খেতে হবে?

পুরোটাই, আঙ্কেল জ্যাক বললেন। তিন দাগ ওষুধ আছে এখানে। সমান সমান তিন ভাগ করে খেয়ে ফেলবে আজ রাতে।

তারপর? রবিনের প্রশ্ন।

তারপর, স্রেফ ভুলে যাবে এটার কথা। মনে করারও আর প্রয়োজন নেই। জোর করে চালাক হওয়ার চেষ্টা কোরো না। সব কিছু ভুলে গিয়ে পড়ালেখায় মন দেবে। কোন কাজকেই অবহেলা করবে না। যত বেশি পরিশ্রম করবে, যত বেশি মনোযোগী হবে, তত দ্রুত বুদ্ধি খুলতে থাকবে তোমাদের।

তার গোল লাল টকটকে মুখে কোমল হাসি ছড়িয়ে পড়ল। তারপর দেখো কি ঘটে। আমার বিশ্বাস, তোমাদের মনের কষ্ট দূর হবে।

সত্যিই বুদ্ধিমান হব তো? সন্দেহ যাচ্ছে না কিশোরের।

হবে হবে…

 বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দ হলো। দুবার খাটো, একবার লম্বা।

ওই যে, বোধহয় হ্যারি এল। আমার সহযোগী বিজ্ঞানী। উঠে দাঁড়ালেন আঙ্কেল জ্যাক। জরুত্রী মীটিং আছে তার সঙ্গে।

ঠিক আছে, আমরা তাহলে যাই, বোতলটা হাতে নিয়ে কিশোরও উঠে দাঁড়াল। রবিন, যাবে না?

হ্যাঁ হ্যাঁ, যাব তো বটেই।

কি হয় জানিও, আঙ্কেল জ্যাক বললেন। আরেকটা কথা, এটা আমার অতি গোপন একটা আবিষ্কার। কাউকে বোলো না।

বলবে না কথা দিয়ে, আঙ্কেল আর আন্টি দুজনকেই ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।

বোতলটা কোটের পকেটে ভরে রাখল কিশোর।

 মুসা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?

চলো, আগে আমাদের বাড়িতেই যাই। দেরি না করে ওষুধটা খেয়ে ফেলি। তারপর তোমাদের যেখানে ইচ্ছে যেও।

কিশোরদের বাড়িতে ঢুকে সোজা মুসা আর রবিনকে নিজের ঘরে নিয়ে এল কিশোর। ওদেরকে ওখানে বসিয়ে রেখে নিচতলায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এল মেরিচাচী কোথায়।

তিনি ওখানে নেই। তারমানে তার অফিসে। কাজে ব্যস্ত। ইয়ার্ডের কর্মচারী বোরিস আর রোভার গেছে রাশেদ পাশার সঙ্গে পুরানো মাল কিনতে।

দ্রুত তিনটে গ্লাস তুলে নিয়ে আবার ওপরতলায় উঠে এল সে। টেবিলে রাখল ওগুলো। সমান তিন ভাগে ভাগ করল ওষুধটাকে।

সত্যি সত্যি কাজ হবে তো? হালকা লালচে রঙের তরল পদার্থটার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল মুসা। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।

নিজের গ্লাসটা তুলে নিল রবিন। আঙ্কেল জ্যাকের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো। অসম্ভব বুদ্ধিমান। আমাদের সঙ্গে মিথ্যে বলবেন না।

হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। কাণ্ডটা কি হবে ভাবো তো? বুদ্ধিমান হয়ে যাব আমরা। আর আমাদেরকে বোকা বলার সাহস পাবে না কেউ। কি সাংঘাতিক ব্যাপারই,না হবে।

হ্যাঁ, সাংঘাতিক, রবিন একমত হলো তার সঙ্গে।

একসঙ্গে গ্লাস তুলল ওরা। গ্লাসে গ্লাসে টোকা লাগিয়ে টোস্ট করল বড়দের মত করে।

উজ্জ্বল আলোয় ঝিক করে উঠল রঙিন তরল।

খেতে কেমন লাগবে আল্লাহই জানে, দ্বিধা করছে কিশোর।

যেমনই লাগে খেয়ে ফেলা যাক, রবিন বলল। যত দেরি করব, ততই ভয় বাড়বে।

একসঙ্গে ঠোঁট লাগিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল তিনজনে। ইঞ্চিখানেক ওষুধ থাকতেই গ্লাসটা নামিয়ে রাখল মুসা। বিচ্ছিরি স্বাদ! আর এত ঘন!

খেয়ে ফেলো, মুসা, খেয়ে ফেলো, কিশোর বলল। কাজে লেগেও যেতে পারে।

বোকা থাকা চলবে না আমাদের, যোগ করল রবিন।

আবার গ্লাস ঠোঁটে ঠেকাল ওরা। কোনমতে মুখে ঢেলে গিলে ফেলল। গ্লাসগুলো নামিয়ে রাখল।

 ঠোঁটে লেগে থাকা ওষুধ চেটে মুসা বলল, জঘন্য। এত ভয়াবহ স্বাদের জিনিস জীবনে মুখে দিইনি।

হু। মিকশ্চারও অত খারাপ না, কিশোর বলল দুনিয়ার সবচেয়ে বাজে স্বাদের ওষুধ। কয়েকবার ঢোক গিলে স্বাদটা জিভ থেকে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল সে। ওয়াক ওয়াক করল। মনে হচ্ছে বেরিয়ে চলে আসবে। মুসার দিকে তাকাল। চিউয়িং গাম আছে নাকি?  

পকেটে হাত দিল মুসা।

কি, চালাক চালাক লাগছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

উম।…মনে তো হচ্ছে, জবাব দিল কিশোর।

রাইনসরাস বানান করো তো।

উ?

রাইনসরাস। করো। বানান করো।

 দ্বিধা করতে লাগল কিশোর। ভাবছে। তারপর বলল, আর-আই-এন-ও…

থামো থামো, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল রবিন। কাজ করছে না ওষুধ।

এত দ্রুত নিশ্চয় কাজ করে না এই ওষুধ, মুসা বলল। সময় দিতে হবে। ওই যে আঙ্কেল বললেন, চিন্তার রাস্তার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে..নিশ্চয় অতিরিক্ত ময়লা পড়ে গেছে। সাফ হতে সময় লাগবে।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। তা লাগুক। বুধবারের মধ্যে হয়ে গেলেই বাঁচি।

কেন? বুধবার কেন?

ভুলে গেছ, বুধবারে অংক পরীক্ষা?

 হাই তুলতে শুরু করল কিশোর। হঠাৎ করেই ঘুম পাচ্ছে আমার।

আমারও, রবিন বলল।

আমি তো চোখই টেনে খুলে রাখতে পারছি না, টেবিলের ওপরই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে চাইল মুসা। বাড়ি যাওয়া এখন আমার পক্ষে দুঃসাধ্য!

থাক, যাওয়ার দরকার নেই, কিশোর বলল। রাতে আমাদের এখানেই থেকে যাও। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দাও রাতে ফিরবে না।

ঘুমজড়িত স্বরে মুসা জবাব দিল, আমার ফোন করার ক্ষমতাও নেই।

.

০৮.

পা টিপে টিপে ওপরতলায় উঠল মাজুল আর গাজুল।

না দেখে কিসে যেন পা বেধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল মাজুল।

 চাপা গলায় ধমকে উঠল গাজুল, আহ, আস্তে। দেখে হাঁটো। সারা বাড়ির লোক সব জাগিয়ে দেবে দেখছি।

মাজুল বলল, এখানে কেন এলে, এখনও বলোনি কিন্তু।

মগজশক্তি রসায়ন তোমারও খাওয়া উচিত, বিরক্তকঠে বলল গাজুল। আর গাধা, এখানে এসেছি শিওর হতে, ওষুধটা খেল কিনা ছেলেগুলো, ওষুধে কাজ হলো কিনা দেখতে।

ভারী পায়ে অন্ধকার হল ধরে হেঁটে চলল দুজনে। কিশোরের শোবার ঘরের সামনে এসে থামল। উঁকি দিল ভেতরে।

ওই যে একটা ছেলে, ফিসফিস করে বলল গাজুল।

 বাকি দুটো কোথায়? এ বাড়িতেই তো ঢুকতে দেখলাম। আর বেরোয়নি।

আছে অন্য কোন ঘরে। গেস্টরূমে।

নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল দুজনে। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। তিনটে গ্লাস পড়ে আছে। সব কটাতেই লালচে ওষুধের তলানি।

একটা গ্লাস তুলে নিয়ে তাঁকে দেখল গাজুল। হাসি ফুটল মুখে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, খেয়েছে। তিনটে খালি গ্লাস। তিনজনেই খেয়েছে।

ফিরে তাকিয়ে দেখল বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাজুল।

কিশোরের মুখের কাছে ঝুঁকে দেখতে লাগল। টাইম ট্রাভেল

দেখতে দেখতে কুঁচকে গেল তার ভুরু।

হাত নেড়ে ডাকল, গাজুল, এদিকে এসো তো?  

কি হলো?

দেখো তো মরেটরে গেল নাকি!

শঙ্কিত হয়ে উঠল গাজুল। তাড়াতাড়ি বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। কিশোরের নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখল। ফিরে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, উহ, পিলে চমকে দিয়েছিলো তোমাকে গাধা কি আর সাধে বলি। দিব্যি তো নিঃশ্বাস পড়ছে।

লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাল মাজুল। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখার কথা মনেই হয়নি।

তা তো হবেই না। হয় তোমাকেও ওষুধ খাওয়ানো দরকার, নয়তো বাড়ি ফিরে ওঅর্কশপে গিয়ে মগজটা খুলে দেখা দরকার কোথায় কি গোলমাল হলো। তোমার এ সব বোকামির কথা মনিব শুনলে হয়তো তোমাকে বিকল বানিয়েই ফেলে রাখবে। কিংবা হাওয়া করে দেবে।

ভয় দেখা দিল মাজুলের চোখে। না–না, দোহাই তোমার, বসকে বোলো না, প্লীজ। তুমি না আমার বন্ধু।

হু। এখন থেকে মাথাটা খেলানোর চেষ্টা করবে।

করব। করব।

চলো, বেরিয়ে যাই, গাজুল বলল। দেখা তো হলো।

 বাকি ছেলে দুটোকে দেখবে না?  

না, দরকার নেই। তিনটে গ্লাসে ওষুধ, তারমানে তিনজনেই খেয়েছে। আর এই ছেলেটা যখন ভাল আছে, বাকি তিনটেও থাকবে, সন্দেহ নেই তাতে।

.

কিশোর! এই কিশোর কিশোর।

ডাক শুনে চোখ মেলল কিশোর। দেখল জানালার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছেন মেরিচাচী। রোদ এসে পড়েছে ঘরে।

ওঠ, ওঠ। আর কত ঘুমাবি? স্কুলে যাবি না? হাসলেন চাচী। হাসিটা সকালের সোনালি রোদের মতই উজ্জ্বল।

উঠে বসল কিশোর। মুখের কাছে হাত নিয়ে এসে দীর্ঘ হাই তুলল। ঘুমটা যেতে চাইছে না চোখ থেকে। হিংসে হলো চাচীর ওপর। রোজ সকালে এত হাসিখুশি থাকেন কি করে চাচী। তার মনে হতে লাগল ওরকম মেজাজে থাকতে হলে মগজ ভরা বুদ্ধি থাকা দরকার। যার যে জিনিসটার ঘাটতি থাকে সব সময় সেটা নিয়েই মাথা ঘামায় মানুষ।

.

স্কুল বাসে ওঠার পর অন্য দিনের তুলনায় পরিস্থিতির বিশেষ কোন উন্নতি হলো না ওদের বেলায়। সামনের দিকের একটা সীটে জানালার কাছে বসল কিশোর। জায়গা না পেয়ে মুসা আর রবিন চলে গেল পেছনের দিকে।

ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কিশোর। দিনটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। ধূসর, মেঘে ঢাকা ভারী আকাশ। বৃষ্টির সম্ভাবনা। গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের মাথায় হালকা কুয়াশা।

ফিরে তাকাল সে। পাশের সীটে বসেছে শারিয়া আর রয়। ওদের ক্লাসের দুজন সবচেয়ে ভাল ছাত্র। নিজের অজান্তেই গুঙিয়ে উঠল সে। দা নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ক্রসওয়ার্ড পাজল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে ওরা।

ভাল ছাত্র বলে দুজনের খুব অহঙ্কার। প্রতিটি সূত্র এত জোরে জোরে বলছে, যাতে বাসের সবাই শুনতে পায়। বুঝতে পারে ওরা টাইমসের ক্রসওয়ার্ড পাজলের মত জটিল জিনিসের সমাধান করছে।

ক্লাসের আর কেউ এর সমাধান করতে পারে না, তিক্তকণ্ঠে ভাবল কিশোর। অসম্ভব কঠিন। সেজন্যেই বাসে উঠেই প্রতিদিন এটা নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করে যেন সবাইকে, বিশেষ করে কিশোবদেরকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে যে ওরা কতখানি বোকা।

হাই কিশোর, ডেকে বলল রয়, এ জিনিসটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সাহায্য করবে?

কিশোরের দিকে তাকিয়ে পিত্তি জ্বালানো হাসি হাসল শারিয়া, আমরা বোকা বনে গেছি।

কিশোরের বলতে ইচ্ছে করল, বোকা বনলে বনেই থাকো না। কিন্তু আরেকটা জিনিস মনের কোণে খচখচ করছিল বলেই আগ্রহী চোখে ফিরে তাকাল। ওষুধে কাজ হয়েছে কিনা, ওরা বুদ্ধিমান হয়েছে কিনা বোঝা দরকার।

রয় জিজ্ঞেস করল, এমন একটা বোকা গাধার নাম বলল তো, যেটার বানান সাত অক্ষর দিয়ে হয়।

গাধা তো এক রকমই হয়, জবাব দিল কিশোর। আর সেটার বানান তিন অক্ষরে…।

উঁহু, আঙুল নাড়ল রয়, এই গাধাটার বানান সাত অক্ষর দিয়েই হয়।

হেসে কুটিকুটি হতে লাগল শারিয়া।

এটা আমার মস্ত সুযোগ, কিশোর ভাবছে, মগজটা বুদ্ধিমান হয়েছে কিনা বোঝার। বহু সময় তো পার হয়েছে। এতক্ষণে ওষুধে ক্রিয়া করে ফেলার কথা। ইস, আঙ্কেল জ্যাকের ফরমুলাটা যদি কাজ করত। জবাবটা কি হবে, ভাবতে লাগল সে।

পারছ না? হাসতে হাসতে বলল রয়। দাঁড়াও, সূত্র দিয়ে দিই। দেব?

ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।

ঠিক আছে, দিচ্ছি,রয় বলল। কে-আই-এস-এইচ…

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল শারিয়া, ও-আর-ই।

প্রচণ্ড রসিকতায় মজা পেয়ে হো হো করে হেসে উঠল দুজনে। ওদের সঙ্গে যোগ দিল আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে। শুঁটকি টেরি আর তার বন্ধুরাও রয়েছে সেই দলে।

রাগে, হতাশায়, দুঃখে চোখে পানি চলে এল কিশোরের। সীটের মধ্যে এলিয়ে পড়ল। দৃষ্টি জানালার বাইরে। ভেসে বেড়ানো কুয়াশা আর ধূসর আকাশ মনটা আরও খারাপ করে দিল তার।

এত বোকা কি করে হয়ে গেলাম আমি। ভাবছে সে। এতটাই বোকা! মগজটাতে কি হলো আমার।

পেছনের সীট থেকে শোনা গেল আচমকা রবিনের চিৎকার। হায় হায়, আমার ব্যাগ।

ফিরে তাকাল কিশোর। কি হয়েছে, রবিন?

আমার স্কুল ব্যাগ, জবাব দিল রবিন। আনতে ভুলে গেছি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুসা বলল, আমি ব্যাগ এনেছি, কিন্তু টিফিন আনিনি। ভুলে গেছি। লাঞ্চের সময় খাব কি?

সীটের সারির মাঝখান দিয়ে বাসের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে দুলতে দুলতে এগোল রবিন। চিৎকার করে অনুরোধ করতে লাগল ড্রাইভারকে, আমার ব্যাকপ্যাক, বই খাতা, সব বাড়িতে ফেলে এসেছি। প্লীজ, বাসটা ঘোরান। ফিরিয়ে নিয়ে চলুন। প্লীজ।

সরি, নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিল ড্রাইভার। বিশালদেহী একজন মোটাসোটা মহিলা। ঠোঁট থেকে ঝুলছে একটা দাঁত খোঁচানোর কাঠি। ফিরেও তাকাল না রবিনের দিকে।

কিন্তু আমার জিনিসগুলো তো দরকার, মরিয়া হয়ে বলতে লাগল রবিন। নইলে, নইলে ক্লাস করব কি করে? স্কুলে গিয়ে কি করব?

মুসাও উঠে এসেছে তার পেছন পেছন। ড্রাইভারকে অনুরোধ করতে লাগল সে-ও।

সরি নির্বিকার কণ্ঠে একই জবাব দিল মহিলা।

মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল কিশোরের। আরও দমে গেল। এত বোকা তো ছিল না ওরা। হঠাৎ করে এমন কি ঘটে গেল যে মগজের এই অবস্থা হয়ে গেল?

দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ভাল হওয়ার কোনই লক্ষণ নেই।

তার মনে হতে লাগল, আজকে বাসে ওঠার পর থেকে যা যা ঘটল এরচেয়ে খারাপ কিছু আর ঘটতে পারে না।

কিন্তু তার ধারণা ভুল।

.

০৯.

ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে লিখতে থেমে গেলেন মিস্টার ক্রেগ। চক হাতে ঘুরে দাঁড়ালেন। কি হলো, কিশোর? এত হাসি কিসের?

ক্লাসের সবগুলো চোখ এখন কিশোরের দিকে।

হাসি থামানোর চেষ্টা করছে কিশোর। কিন্তু এমন একটা ছবি ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে টেরির দোস্ত কডি, না হেসে থাকতে পারছে না সে। তাকালেই হাসি। মিস্টার ক্রেগের কিম্ভুত একটা ছবি এঁকেছে কডি। নাক দিয়ে দুটো কালো ক্রিমি বেরিয়ে আসছে।

ছবির নিচে টেরি ক্যাপশন লিখে দিয়েছে: পেট পচা। তাই ক্রিমিও পেটে থাকতে চায় না।

এই লেখাটাই বেশি হাসাচ্ছে কিশোরকে। ছবিটা দেখে তার মনে হচ্ছে: শিল্পী বটে কড়ি! ছবি আঁকায় ওর যে এত ভাল হাত, কই জানা ছিল না তো!

অংক করাচ্ছেন মিস্টার ক্রেগ। সারা ক্লাসের মনোযোগ সেদিকেই ছিল। পিনপতন নীরবতা। কেবল ব্ল্যাকবোর্ডে মিস্টার ক্রেগের চক ঘষার কিচকিচ শব্দ। এর মাঝে কিশোরের হো হো করে হেসে ওঠাটা যে কতটা বেমানান লেগেছে, ভাবতেই এখন সিঁটিয়ে গেল সে।

গাধা! গাধা আর কাকে বলে!

এগিয়ে এলেন মিস্টার ক্রেগ। কিশোরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার হাতের ছবিটার দিকে তাকালেন।

আচমকা হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিলেন ছবিটা দেখার জন্যে চোখের সামনে নিয়ে গেলেন।

ঢোক গিলল কিশোর। মুখ তুলে তাকাল টিচারের দিকে। হাসি নেই তার মুখে। ভীষণ গম্ভীর।

আরও নীরব হয়ে গেছে ঘরটা। নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে।

তুমি এঁকেছ? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার ক্রেগ। ফিসফিসানির মত শোনা গেল তাঁর কণ্ঠ।

না, কোনমতে জবাব দিল কিশোর। কান ঝাঁ-আঁ করছে। ঘাড় গরম হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে লাল হয়ে যাচ্ছে মুখ।

হু। কে কছে তাহলে? মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার ক্রেগ।

আঁ!… কডির কথা বলবে কিনা ঠিক করতে পারছে না কিশোর। জানি না!

আমার ছবি নাকি? মিস্টার ক্রেগের প্রশ্ন।

তা-তাও তো বুঝতে পারছি না, স্যার, বলেই হা-হা করে হেসে উঠল কিশোর। আটকাতে পারল না হাসিটা।

গাধা! মস্ত গাধা! মনে মনে গাল দিল নিজেকে।

 নীরবতা নেই আর ঘরে। সবাই হাসছে এখন। মিস্টার ক্রেগ বাদে।

হাসি থামার অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। তারপর ছবিটা কিশোরের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আঁকাটা ঠিক হয়নি। আমার চুল আরও লম্বা। নাকটা আরও খাটো।

হাঁপ ছেড়ে বাচল কিশোর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আল্লাহু আঁচিয়েছেন আমাকে, ভাবল। মিস্টার ক্রেগ ধমক দেননি। স্কুল ছুটির পর থাকতে বলেননি। শাস্তি দেননি। বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম।

কিন্তু নিঃশ্বাসটা একটু আগেভাগেই ফেলেছে কিশোর। তখনও অনেক কিছু বাকি।

ক্লাসটাকে যখন আজ এতটাই সরগরম করে তুলতে পারলে, কিশোর পাশা, মিস্টার ক্রেগ বললেন, যাও না, ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দাও সমীকরণটা কি ভাবে করতে হবে।

সমীকরণ? আমি?

বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়া শুরু হলো কিশোরের। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখে পায়ে শক্তি পাচ্ছে না। কোনমতে টলতে টলতে এগিয়ে গেল ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে।

সমীকরণটা পড়তে গিয়ে মাথা চুলকানো শুরু করল।

আরও একবার ভাবল মগজ উন্নত করার ওষুধটার কথা। এখনও কি ওষুধের কার্যকারিতা শুরু হওয়ার সময় হয়নি?

ইস্, যদি জেনে যেত কি করে সমাধান করতে হবে সমীকরণটার? কি মজাই না হতো। খসখস করে লিখে যেত মিস্টার ক্রেগ আর সহপাঠীদের বিস্মিত চোখের সামনে। ওকে আর বোকা বলার সাহস পেত না কেউ। বোকা তো সে ছিলও না। কিন্তু কেন যে…

ওষুধে কি কাজ শুরু করেছে?

যদি খালি…যদি খালি…

চকে লিখে রাখা অংকগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন যেন অন্য রকম লাগতে শুরু করল তার।

মনে হলো যেন একটা তীব্র বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল সমস্ত দেহে।

খাড়া হয়ে উঠল হাতের লোম। ভয়ে না মগজের কোন প্রতিক্রিয়ার কারণে, বুঝতে পারল না।

পারবে সে, বুঝে গেল। সমাধান করে ফেলতে পারবে সমীকরণটার।

কি হলো, কিশোর? চুপ করে আছো কেন? পেছন থেকে বললেন মিস্টার ক্রেগ।

অক্ষর আর নম্বরগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সে, কোনটার সমাধান করব, স্যার? কিভাবে?

হেসে উঠল সারা ক্লাস। ব্যঙ্গের হাসি।

ঠিক আছে, প্রথমে এক্স থেকেই শুরু করি, গলা কাঁপছে কিশোরের।

একটুকরো চক তুলে নিয়ে লিখতে আরম্ভ করল সে।

 লিখতে গিয়ে বেশি চাপ দিয়ে চকই ভেঙে ফেলল। অর্ধেকটা চক উড়ে গিয়ে পড়ল মেঝেতে। তাকাল না সে।

বুকের মধ্যে কাঁপছে। হচ্ছে তো অংকটা?

অদ্ভুত এক ভয়ের অনুভূতি। এ রকম অনুভূতি জীবনে হয়নি তার।

অবশেষে লেখা শেষ হলো। ফিরে তাকাল মিস্টার ক্রেগের দিকে। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, হয়েছে, স্যার?

বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মিস্টার ক্রেগের মুখ।

কঠিন হয়ে গেল দৃষ্টি।

অস্থির ভঙ্গিতে চুলে আঙুল চালালেন টিচার। চঞ্চল চোখের মণি দ্রুত ঘুরছে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখাগুলোর ওপর।

আশ্চর্য! বিড়বিড় করলেন তিনি। অবিশ্বাস্য!

হাসিটা চওড়া হলো কিশোরের।

ঢোক গিললেন মিস্টার ক্রেগ। চোখের পাতা সরু করে আনলেন। এগুলো কি করলে? এতক্ষণ ধরে লিখলে, কিছুই তো হয়নি।

তারমানে, স্যার? হাসি মুছে গেল কিশোরের মুখ থেকে, হয়নি?

উঁহু। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন টিচার। যে ভাবে লেখা শুরু করলে, আমি তো ভাবলাম পেরেই ফেলবে…কিন্তু কথাটা শেষ হলো না তার।

তারমানে, স্যার…ভুল? ঢোক গিলল কিশোর। ভাঙা ভাঙা স্বর বেরোল কোলাব্যাঙের মত।

পুরোপুরি ভুল, হতাশ ভঙ্গিতে জানালেন মিস্টার ক্রেগ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

ফুটো বেলুনের মত চুপসে গেল কিশোর। তবে কেউ আর এখন হাসছে না তার দিকে তাকিয়ে। সবারই যেন দুঃখ হচ্ছে তার জন্যে।

কিশোরকে কেউ সাহায্য করতে পারবে? মিস্টার ক্রেগ বললেন। রবিন, মুসা-তোমরা তো কিশোরের বন্ধু। পারবে তার অংকটা করে দিতে?

না, স্যার, জবাব দিল রবিন। আমি আমার বইপত্রই আনতে ভুলে গেছি। তা ছাড়া এই চ্যাপ্টারটা আমি পড়িওনি।

মাথা চুলকে মুসা বলল, আমি, স্যার, আমার লাঞ্চবক্স আনতেই ভুলে গেছি।

.

১০.

জানালার ঠিক বাইরেই ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে ঘরের ভেতরে নজর রেখেছে দুই জোড়া চোখ।

মাজুলের দিকে ঘুরল গাজুল। নাহ্, এই অপদার্থগুলোকে দিয়ে হবে না। তিনটেই গাধা, গাধা, গাধা!

বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল সে। থু থু করে থুতু ফেলল মাটিতে।

তারমানে মগজশক্তি রসায়নেও কোন কাজ করছে না? জানালা দিয়ে আবার ক্লাসরূমের ভেতরে তাকাল মাজুল।

উঁহু, করছে না। মানুষ হলো একেবারে নিচু জাতের প্রাণী। বুদ্ধিশুদ্ধি বলতে কিছু নেই ওদের।

কি আর করা, মাজুল বলল। অকারণে আর এদের পেছনে লেগে না থেকে চলো আর কাউকে খুঁজি। এ স্কুলের কোনটাকে দিয়েই মনিবের কোন কাজ হবে না। বুদ্ধিমান মানুষ দরকার আমাদের। বুদ্ধিমান গোলাম।

.

মগজের ওষুধটা তো কাজ করছে না, আঙ্কেল, টেলিফোনে ককিয়ে উঠল রবিন।

তাকে বলো, মগজ খুলছে না আমাদের পাশে থেকে বলে দিল কিশোর।

বলো, আগের মতই বোকা রয়ে গেছি,মুসা বলল।

কিশোরের ঘরে বসে কথা বলছে ওরা।

তোদেরকে ধৈর্য ধরতে বলেছিলাম, আঙ্কেল বললেন। গবেষণাগারে কোনও ধরনের মেশিন চলছে। সেটার গর্জনকে ছাপিয়ে চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে তাকে।

কিন্তু আমরা তো ঠিকঠাকমতই ওষুধ খেয়েছি, বলো না, কিশোর বলল। কাজ হচ্ছে না কেন? যা ভয়ঙ্কর একটা দিন কাটিয়েছি…আর…আর…

বরং আগের চেয়ে বোকা হয়ে গেছি, ফোনে আঙ্কেলকে জানাল রবিন।

এটা তোর ভুল ধারণা, আঙ্কেল জবাব দিলেন। তা ছাড়া এ ধরনের মগজ উন্নয়নকারী ওষুধগুলো রাতারাতি কাজ করে না। রক্তের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যেতে প্রচুর সময় নেয়। তোদেরকে এখন…

মেশিনের শব্দ থামল।

কিসের শব্দ হচ্ছিল, আঙ্কেল? জিজ্ঞেস করল রবিন।

ব্লেন্ডার মেশিন, আঙ্কেল জানালেন। গাজরের রস মেশাচ্ছি।

কিন্তু…আমরা কখন বুদ্ধিমান হব? রবিন নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। কালকে আমাদের অংক পরীক্ষা। আমরা চাইছি ভাল একটা গ্রেড পেতে।

ভাল, গ্রেড তো পরের কথা, কিশোর বলল। পাস করব কিনা সন্দেহ। আমি শুধু পাস করলেই খুশি।

ঘাড় কাত করে মুসাও কিশোরের সঙ্গে একাত্ম হলো। সেকথা আঙ্কেলকে জানাল রবিন।

পাস করবে না মানে? আঙ্কেল বললেন। অবশ্যই পাস করবে। কি বলেছিলাম তোদের, ভুলে গেছিস? ভাল করে পড়ালেখা করতে হবে। বেশি বেশি করে পরিশ্রম করতে হবে। ওষুধটার কথা মন থেকে উধাও করে দিয়ে একেবারে ভুলে যেতে হবে। তারপর দেখ না, কি ভাবে কাজ করছে। আগামীকালকের। পরীক্ষার জন্যে ভাবনা নেই। পাস করে যাবি।

কিন্তু, মাথা চুলকাল রবিন, এতক্ষণেও কি রক্তে মিশে যায়নি?

বললাম তো ওষুধটার কথা ভুলে যেতে, আঙ্কেল জ্যাক বললেন। কাল আবার ফোন করিস আমাকে। আমি জানি, কালকে তোরা ভাল খবর দিতে পারবি।

তাকে ধন্যবাদ আর গুডবাই জানিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল রবিন।

ভাল খবর, তিক্তকণ্ঠে বিড়বিড় করল কিশোর। মেঝেতে রাখা ব্যাকপ্যাকটাতে ধা করে এক লাথি মারল, যেন সমস্ত দোষ ওটার। ভাল খবরটা কি আকাশ থেকে পড়বে? অংকে তো গোল্লা পাব।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কোন চ্যাপ্টারটা পড়তে হবে তাই তো জানি না।

স্কুলের কাউকে ফোন করে জেনে নেব নাকি? রবিন বলল। রয়, কিংবা শারিয়া, কিংবা অন্য কেউ বলব আমাদের সঙ্গে এসে বসে পড়তে?

মাথা খারাপ নাকি তোমার? কিশোর বলল। ওরা আমাদের সঙ্গে বসে কস্মিনকালেও পড়বে না। আমাদের বোকামিকে ওরা রীতিমত ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। বুঝতে পারো না সেসব? ব্যাকপ্যাকে আবার লাথি মারতে গিয়ে আঙুলে পেল ব্যথা। আঁউ করে উঠল।

এ সব রাগারাগি আর চিন্তা-ভাবনা করার চেয়ে এসো বসে বসে পড়ি, রবিন বলল। আঙ্কেল কি করতে বলেছেন, শুনলে না? মন দিয়ে পড়তে বলেছেন। ওষুধের কথা ভুলে যেতে বলেছেন।

হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। বের করো তো দেখি অংক বইটা। আর রিভিউ শীটটা।

গলাটা শুকিয়ে গেছে, মুসা বলল। কোকটোক কিছু আনো না।

যাচ্ছি,  বলে দরজার দিকে রওনা হলো কিশোর।

বারান্দায় বেরিয়েই উহ করে এক চিৎকার দিয়ে বুক চেপে ধরল।

কি হলো, কি হলো! বলে দৌড়ে এল মুসা ও রবিন।

হাসি শোনা গেল গলির মাথা থেকে। বলে উঠল হাসি হাসি একটা বালককণ্ঠ, ডার্টটা এত জোরে আঘাত করবে বুঝতে পারিনি।

জ্বলন্ত চোখে সেদিকে তাকাল কিশোর। চিৎকার করে উঠল, তুমি কখন এলে?

রবিন আর মুসাও বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে। বারান্দার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল আট বছর বয়েসী ছেলেটাকে। ওর নাম ডন। মেরিচাচীর বোনের ছেলে। ওর বাবা আইব্রাম হেনরি স্টোকার অনেক বড় বিজ্ঞানী। অ্যারিজোনায় থাকে ডনরা। মাঝে মাঝেই বেড়াতে আসে সে। বেশির ভাগ সময়ই একা আসে।

কোথায় পেলে ওই ডার্ট? রাগে আবার চিৎকার করে উঠল কিশোর। ডার্ট কোন খেলনা জিনিস হলো না। আরেকটু..আরেকটু হলেই তো খুন করে ফেলেছিলে আমাকে।

 না, তা করব কেন? এগুলো খেলনা ডার্ট, এগিয়ে আসতে আসতে জবাব দিল ডন।

কিন্তু ব্যথা তো কম লাগল না, রাগ যাচ্ছে না কিশোরের। আর লাগালেও ঠিক হৃৎপিণ্ডের ওপরে।

তাই তো লাগাব, মেঝে থেকে ডার্টটা কুড়িয়ে নিতে নিতে নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল ডন। তাতে পয়েন্ট বেশি। পঞ্চাশ পয়েন্ট। তবে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট মাথায় লাগাতে পারলে। মাথায় একশো। পেটে তিরিশ। হাতে আর পায়ে দশ পয়েন্ট করে।

ভাগো এখান থেকে ধমকে উঠল কিশোর। বুকের আহত জায়গাটা ডলতে ডলতে বলল, আবার কেন মরতে এসেছ এখানে? একা এলে নাকি?  

কিশোরের ধমকে হাসি মুছল না ছেলেটার। বরং মজা পাচ্ছে। তার কাজ সে করে ফেলেছে। হ্যাঁ, একা। থাকব কিছুদিন। বাবা গেছে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে। ফিরতে দেরি হবে।

তারমানে জ্বালিয়ে মারবে! বিড়বিড় করল কিশোর। নিজের জ্বালাতেই বাঁচি না…

তার কথা যেন কানেই ঢুকল না ডনের। মুসার দিকে তাকাল, ডার্ট ছোঁড়াছুঁড়ি খেলবে নাকি, মুসাভাই?

নাহ, শুকনো কণ্ঠে জবাব দিল মুসা। কালকে অংক পরীক্ষা। পড়তে হবে।

পরীক্ষা দিয়ে আর কি করবে। ফেল করবে জানা কথা। তারচেয়ে এসো, ডার্ট খেলা যাক..

ধৈর্য হারাল কিশোর। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, তুমি যাবে এখান থেকে।

চমকাল না ডন। স্নায়ুর জোর সাংঘাতিক। ভুরু কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকাল, কি হয়েছে তোমার, কিশোরভাই? অমন করছ কেন?  

জবাব দিল না কিশোর।

কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বোধহয় বুঝতে পারল ডন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। আর কিছু না বলে চলে গেল সে।

Super User