১১.
ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। সকালের মত নেই আর। তবে আকাশে ভারী মেঘ জমে আছে এখনও। যে কোন সময় আবার শুরু হবে।
কেইনের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাল মুসা। সে আর কিশোর এসেছে। রবিনকে রেখে এসেছে মোটেলে, ইভার সঙ্গে। কেইনের বাড়িতে ঢুকলে বিপদ ঘটার একশো ভাগ সম্ভাবনা। সবাই আটকা পড়লে উদ্ধারের উপায় থাকবে না আর। রবিনকে রেখে এসেছে সে-কারণে। বলে এসেছে, রাত বারোটার মধ্যে ফিরে না গেলে প্রথমে যেন মিয়ামি পুলিশের কাছে যায় রবিন, কারণ ডেপুটি হেরিং গেকোকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। তারপর রকি বীচে ফোন করে ওমর ভাইকে।
কারলু রোডে সারি সারি নানা ধরনের চকচকে গাড়ির পেছনে ভ্যানটা রাখল মুসা। একপাশে কেইনের বাড়ির দেয়াল। ওটা ঘেঁষে রাখা হয়েছে গাড়িগুলো।
বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে হাসি আর বাজনার শব্দ।
সাগরের দিক থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে যেন ঘন কুয়াশা। ফ্লাডলাইট জ্বেলে দিতে হয়েছে কেইনকে। তারপরেও সুবিধে হচ্ছে না। বাড়িটার খুব সামান্য জায়গাই স্পষ্ট হয়েছে তাতে। সত্তিই বোধ করছে কিশোর। কুয়াশার মধ্যে গাছপালার ভেতরে সহজে ওদেরকে চোখে পড়বে না।
পার্টির উপযুক্ত পোশাক পরে এসেছে দুজনে। উল্টোপাল্টা পোশাকে এসে মেহমানদের নজরে পড়ে গেলে ধরা পড়ে যাবে সহজেই। কিশোর পরেছে স্পোর্ট কোট আর স্ন্যাকস। মুসা গায়ে দিয়েছে উজ্জ্বল রঙের প্রিন্টওয়ালা শার্ট। পরনে জিনস।
ভেতরে ঢোকার আগে শেষবারের মত সাবধান, করল কিশোর, দেখো, কারও সন্দেহ হয়, এমন আচরণ কোরো না। সবাই যাতে ভাবে আমরাও দাওয়াত পেয়েই এসেছি।
হাসল মুসা, তা করব না। তবে সামনে খাবার পড়ে গেলে খানিকটা তো চেখে দেখতেই হবে, কি বলল? না খেলেই বরং গেস্টরা সন্দেহ করবে।
কোন রকম ঝুঁকি নেবে না। আমাদের উদ্দেশ্য হবে কাজ সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া।
ড্রাইভওয়ে ধরে আগে আগে হেঁটে চলল কিশোর। পেছনে মুসা।
সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন লোক। কিন্তু তাদের কাউকেই কেইনের দুই সহকারীর মত লাগল না। মেহমানই হবে ওরা।
সামনের হলঘরে ঢুকে লোকজন দেখে ফিসফিস করে কিশোরের কানের কাছে বলল মুসা, দুশো জনের কম হবে না।
এনডি আর কোরির ব্যাপারে সতর্ক থাকো, কিশোর বলল।
কোথায় ওরা? দেখছি না তো।
এখানে দেখা যাচ্ছে না বলে যে বাড়িতে নেই, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। ওখানে দাঁড়িয়েই হলঘর আর লিভিং রূমের সমস্ত জায়গায় চোখ বোলাল কিশোর। নীরা লেভিনের সামনেও পড়া চলবে না আমাদের।
রান্নাঘরের দিকে এগোল দুজনে। চারপাশে নজর রাখতে লাগল মুসা, কিশোর এগিয়ে গেল রেফ্রিজারেটরটার দিকে।
ছবিগুলো ভালমত দেখে এসে বলল, ছবিটা নেই।
সরিয়ে ফেলল নাকি? রেফ্রিজারেটরটার দিকে তাকাল মুসা। সবই ঠিকঠাক আছে, কেবল ছবিটা সরিয়েছে।
তারমানে নজরে পড়ে গেছে ওদের, কিশোর বলল। ঠিক আছে, এক কাজ করা যাক। ভাগাভাগি হয়ে গিয়ে খুঁজতে থাকি আমরা। জিনা এ বাড়িতে আছে কিনা, বোঝা দরকার। থাকলে কোথায় আছে জানতে হবে। তুমি এই তলাতেই খোজো, আমি দোতলায় যাচ্ছি। ফোন বেজেছিল ওখানে, মনে আছে? কেইনের অফিস-টফিস থাকতে পারে।
সিঁড়ির দিকে এগোল সে। কে যেন ডেকে বলল তাকে, আই, কোথায় যাচ্ছ? কেইন এখনই চলে আসবে।
তার একটা মেসেজ আছে, সেটাই দিতে যাচ্ছি, ফিরে তাকাল না কিশোর। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। দ্রুত ভাবনা চলেছে মগজে। একটা সেকেন্ডও আর দেরি না করে একেক লাফে কয়েকটা করে সিঁড়ি টপকে দোতলায় উঠে এল।
শূন্য হলঘর। ডানে ঘুরল সে। শেষ মাথায় চলে এল। তিনটে বেডরূম আর একটা বাথরূম পেরোল। ওগুলোতেও কেউ নেই।
মুসা তখন লিভিং রূমের এক মাথার দিকে এগিয়ে চলেছে। শেষ মাথার হলে এসে পৌঁছল। ওটা ধরে এগোলে মস্ত একটা বাথরূম, গোটা দুই বেডরূম আর। একটা বসার ঘরে যাওয়া যায়।
একটা বেডরূমে ঢুকে বড় একটা দেয়াল আলমারি খুলে দেখল। বাথরূমে খুঁজল। নেই কেউ। ঘরটাও কেউ ব্যবহার করে বলে মনে হলো না।
দ্বিতীয় বেডরূমটাও প্রথমটার মতই। তবে আলমারিটা একেবারে খালি নয়। ছোট একটা বাক্স পাওয়া গেল। তাতে জাপানী ভাষায় কি যেন লেখা। তার ভেতরে কতগুলো ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ দেখা গেল। ডায়োড, ট্রানজিস্টর, কম্পিউটারের চিপস এ সব জিনিস।
শেষ ঘরটায় বড় একটা টেবিলে প্রচুর জিনিসপত্র ছড়ানো। তার মধ্যে লাল একটা সানগ্লাস দেখতে পেল সে। জিনিসটা পরিচিত মনে হলো। অবিকল এ রকম একটা সানগ্লাস আছে জিনার।
তুলে নিয়ে পকেটে ভরতে যাবে ঠিক এই সময় দরজার কাছ থেকে শোনা গেল এনডি টাওয়ারের কণ্ঠ, অ্যাই, কে তুমি?
সানগ্লাসটা প্রথমে পকেটে ভরল মুসা। তারপর আস্তে করে ঘুরে দাঁড়াল। আমি একজন গেস্ট!
তুমি! চিৎকার করে উঠল এনডি। আবার ঢুকেছ এখানে!
খেপা ষাঁড়ের মত মাথা নিচু করে ছুটে গেল মুসা। মাথা দিয়ে প্রচণ্ড গুতো মারল এনডির পেটে। ওর ভয়ানক শক্ত খুলির এ রকম আঘাতে বাঘ কাবু হয়ে যাওয়ার কথা, আর এনডি তো মানুষ হুঁক করে একটা শব্দ বেরোল মুখ থেকে। মেঝেতে পড়ে গেল সে।
কোন দিকে আর না তাকিয়ে হলরূম ধরে দৌড় মারল মুসা।
ওপরতলায় কিশোর তখন এক বেডরূম থেকে আরেক বেডরূমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু জিনার কোন চিহ্নই চোখে পড়ছে না তার।
হল পার হয়ে বাঁয়ে ঘুরল। বাকি আছে দুটো ঘর। ওগুলো দেখা হয়ে গেলেই শেষ হয়ে যাবে। হলের শেষ মাথার দিকে পা বাড়াল সে। কানে এল একটা শীতল কণ্ঠ, …আরে না, এখন না! আমি আগে আসি। পার্টি শেষ হলেই রওনা দেব। কি বললাম, বুঝেছ?
ডগলাস কেইনের গলা চিনতে পারল কিশোর।
পা টিপে টিপে দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল সে। কান পাতল দরজায়।
তোমার কাজ হলো, তীক্ষ্ণ হয়ে যাচ্ছে কেইনের গলা, আমি যা বলি অক্ষরে অক্ষরে শুনবে। কমও না, বেশিও না।
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থাকার পর চেঁচিয়ে উঠল কেইন, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ? ফোনে কথা বলছে সে, বোঝা গেল। আমি বলছি আমি এসে যা করার করব। দেখে যেন দুর্ঘটনা মনে হয়। সেজন্যেই তো ওদের খবর দিতে বললাম তোমাকে। দিয়েছ, না তা-ও দাওনি?
গভীর আগ্রহে দম বন্ধ করে শুনছে কিশোর। তার মনে হচ্ছে, ওদের কেসটার সঙ্গে এ সব কথার কোন সম্পর্ক আছে।
আরে গাধাটাকে তো কোনমতেই বোঝানো যাচ্ছে না! আরও জোরে চিৎকার করে উঠল কেইন। তোমার কি ধারণা দুনিয়াসুদ্ধ লোকের মাথায় তোমার মত গোবর পোরা? তুমি গায়েব করে দেবে, আর সবাই একবাক্যে বলবে-আহা, আহা, গায়েব হয়ে গেল! কেউ কোন খোঁজ নেবে না? এখন বুঝতে পারছি ড্যাগো কেন তোমাকে আমার কাজ করতে পাঠিয়েছে। পাঠিয়ে আসলে জানে বেঁচেছে। তোমার হাঁদাপনা ও আর সহ্য করতে পারছিল না। দেখো, পিকো, তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আমি ড্যাগোর মত তোমাকে আর কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব না। আমাকে খুশি করতে পারলে ভাল, না পারলে কানটা ধরে বের করে দেব। আর আমি যাদের বের করে দিই, পরে তাদের কি হয় জানো তো? হয় অ্যালিগেটরের পেটে যায়, নয়তো হাঙরের খাবার হয়। এইমাত্র তুমি যে পদ্ধতিতে গায়েব করতে চাইলে।
দড়াম করে ফোনটা রেখে দিল কেইন। এত জোরে আছাড় দিয়ে রাখল, দরজার বাইরে দাঁড়িয়েও শুনতে পেল কিশোর।
নিচতলার চেঁচামেচি মনোযোগ সরিয়ে নিল তার। হট্টগোলটা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। কেইনের কানেও যাবে নিশ্চয়। দেখতে বেরোতে পারে। তাড়াতাড়ি দরজার কাছ থেকে সরে যেতে লাগল সে। কিন্তু কোথাও লুকিয়ে পড়ার আগেই ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল কেইন। কিশোরকে দেখে ফেলল।
অ্যাই! কে, কে! চিৎকার করে উঠল কেইন। ও, তুমি! এনডি! কোরি! জলদি এসো! দৌড়ে এসে কিশোরের কোট চেপে ধরল সে।
কিন্তু ধরে রাখতে পারল না। দৌড় মারল কিশোর। হ্যাঁচকা টান লেগে কাপড় ছিঁড়ে গেল। ফিরেও তাকাল না সে। সিঁড়ির দিকে ছুটল। কানে আসছে কেইনের চিৎকার। লোকজন ডাকছে সে।
জমে উঠেছে পার্টি। কিন্তু হট্টগোল যেন চরমে পৌঁছাল হঠাৎ করেই। ব্যাপারটা ভাল লাগল না কিশোরের।
পালাচ্ছে! পালাচ্ছে! কানে এল চিৎকার।
প্রথমে ভাবল, তার কথাই বলা হচ্ছে। চারপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখে বুঝল অন্য কারও কথা বলছে। জানালার বাইরে চোখ পড়তে দেখল লন ধরে সৈকতের দিকে ছুটে যাচ্ছে একটা ছায়ামূর্তি। কুয়াশার জন্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
মুসা!
পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে এনডি। বিপদে পড়ে গেছে মুসা।
বিপদে কিশোর নিজেও পড়েছে।
থামাও! থামাও ওকে! সিঁড়ির মাথায় শোনা গেল কেইনের চিৎকার।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে গেস্টদের ওপর নজর বোলাল একবার কিশোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে সবাই বোঝার চেষ্টা করছে গণ্ডগোলটা কোথায়।
কিন্তু কিশোরকে তাড়া করতে গিয়ে যখন দুজন গেস্টকে ধাক্কা মেরে একটা কাঁচের বাক্সের ওপর ফেলে দিল কেইন, হাসির হুল্লোড় উঠল।
হাসিটা থেমে গেল গুলির শব্দে।
ঝট করে একটা টেবিলের আড়ালে বসে পড়ল কিশোর। পরক্ষণেই বুঝল, শুলিটা তাকে লক্ষ্য করে করা হয়নি। শব্দ এসেছে বাইরে থেকে। মুসার জন্যে দুশ্চিন্তায় বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল তার।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল আবার। কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা দরজা লক্ষ্য করে দিল দৌড়।
মুসা তখন সৈকতে পৌঁছে গেছে। আলগা বালি মাড়িয়ে ছোটা ভীষণ কঠিন। এগোনোও যায় না। তা ছাড়া অল্পেতেই পরিশ্রান্ত হয়ে যেতে হয়।
পেছনে তাড়া করে আসছে এনডি। বালিতে সে-ও দৌড়াতে পারছে না ঠিকমত। কিন্তু তার হাতে পিস্তল আছে। আরেকবার গুলি করল সে।
মুসার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল গুলি।
চিৎকার করে উঠল এনডি, থামো বলছি! পরের বার কিন্তু মাথা সই করে মারব!।
মুসা বুঝল, দুবারই ইচ্ছে করে মিস করেছে এনডি। তাকে থামানোর জন্যে।
লাফ দিয়ে চত্বরে নেমে মুসারা যেদিকে গেছে সেদিকে ছুটল কিশোর। সামনে লনের মধ্যে চেয়ার পাতা। সরানোর সময় নেই। লাফ দিয়ে একটা চেয়ার পেরোল।
কিছুদূর এগোতেই দেখল, খুব বেশি দূরে যেতে পারেনি মুসা। দাঁড়িয়ে গেছে। পেছনে এগিয়ে যাচ্ছে এনডি। নিশ্চয় পিস্তলের ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়েছে মুসাকে।
পেছন থেকে এনডিকে কাবু করতে ছুটল কিশোর। কিন্তু তার পেছনেও লোক লেগে গেছে। কোরি ছুটে আসছে ধরার জন্যে। তার পেছনে চেঁচাতে চেঁচাতে আসছে কেইন।
ছুটতে ছুটতেই ফিরে তাকাল একবার কিশোর। বুঝল, আর ছুটে লাভ নেই। ধরা পড়ে গেছে। কারণ, কেইন আর কোরি-দুজনের হাতেই উদ্যত পিস্তল।
তা ছাড়া, কুকুরগুলোকেও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাঘের মত গর্জন করতে করতে ছুটে আসছে ওগুলো।
.
১২.
কজওয়ে ধরে বেরিয়ে এল গাড়িটা।
তারপর যে রাস্তাটা ধরল, দেখেই বুঝতে পারল কিশোর, ফ্লোরিডার বিখ্যাত অ্যালিগেটর অ্যালির দিকে যাচ্ছে।
মুসাকে জানাল সে-কথা।
বিড়বিড় করে মুসা বলল, এত রাতে অ্যালিগেটরগুলো এখন ঘুমিয়ে থাকলেই বাঁচি।
অ্যাই, চুপ! কোন কথা নয়, সামনের প্যাসেঞ্জার সীট থেকে ধমক দিল কোরি।
গাড়ি চালাচ্ছে এনডি।
পেছনের সীটে হাতকড়া লাগিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে মুসা আর কিশোরকে। হাতকড়ার একটা মাথা হাতের কব্জিতে, অন্য মাথা গাড়ির ফ্রেমে আটকানো। কোনমতেই ছুটানো সম্ভব নয়, একমাত্র চাবি ছাড়া। কাজেই ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা না করে চুপচাপ সুযোগের অপেক্ষায় বসে রইল দুজনে।
সৈকত থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে বাগানের একটা ছাউনিতে আটকে রাখা হয়েছিল ওদের। গেস্টরা যাতে না দেখে। নিশ্চয় ওদের কাছে গিয়ে কৈফিয়ত দিয়েছে কেইন, দুটো চোর ঢুকেছিল চুরি করতে। পালিয়ে গেছে।
পাটির পর গাড়িটাতে তুলে দেয়া হয়েছে ওদের। দ্বীপের বাইরে দূরে কোথাও সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। জিনাকেও বোধহয় এ ভাবেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কেইনের। গাল আইল্যান্ডের বাড়িতে যে নেই জিনা, এ ব্যাপারে শিওর এখন ওরা। তবে নেয়া হয়েছিল ওখানে, তার প্রমাণ যেফ্রিজারেটরে লাগানো ছবিটা, আর টেবিলে রাখা চশমা। হয়তো ওঘরেই প্রথমে আটকে রাখা হয়েছিল ওকে। সেজন্যেই চশমাটা ফেলে আসতে পেরেছে।
চলতে চলতে গাড়ির গতি কমে গেল হঠাৎ। কারণটা জানার জন্যে দুজনেই। বাইরে তাকাল ওরা। অতি সরু একটা রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিল এনডি। দুই পাশেই বিশাল জলাভূমি। অন্ধকারে পানি চেনা যাচ্ছে না। তবে আছে। ওগুলোতে কোন কোন প্রাণীর বাস, কল্পনা করে শিউরে উঠল কিশোর। জোক আছে। নানা ধরনের বিষাক্ত কীটপতঙ্গ আছে। আর আছে ঝাঁকে ঝাঁকে অ্যালিগেটর। কোন মতে যদি চাকা পিছলে ওই জলায় গিয়ে পড়ে গাড়িটা, আর উঠতে পারবে না। ভয়াবহ কাদায় আটকে যাবে। পুরোটা যদি ডুবে যায়, তাহলে জ্যান্ত কবর হবে। আর যদি না যায়, অ্যালিগেটরের খাবার হবে।
এটা কোরি কিংবা এনডির না জানার কথা নয়। তাহলে এ পথ ধরল কেন ওরা? নিশ্চয় পুলিশের ভয়ে। সামনে সম্ভবত চেক পোস্ট জাতীয় কিছু আছে। দুটো ছেলেকে গাড়ির পেছনে হাতকড়া লাগিয়ে কেন আটকে রাখা হয়েছে, অবশ্যই জানতে চাইবে ওরা। সে-সব এড়ানোর জন্যেই এই নির্জন বিপজ্জনক রাস্তা ধরেছে এনডি।
অতিরিক্ত সাবধান থেকেও চাকা সোজা রাখতে পারছে না সে। বৃষ্টিতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে থাকার কারণে। সামনের ডান পাশের চাকাটা মূল রাস্তা থেকে সরে গেল কাঁচা মাটিতে। প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে কাত হয়ে গেল গাড়ির একপাশ।
শক্ত হয়ে বসে থাকো! নড়বে না কেউ! চিৎকার করে উঠল এনডি। স্টিয়ারিং চেপে চাকাটাকে তুলে আনার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করল।
মুক্ত হাতটা দিয়ে সামনের সীটের পেছনটা খামচে ধরল কিশোর। টের পাচ্ছে, উঠে আসার বদলে ক্রমশ রাস্তা থেকে নেমে যাচ্ছে চাকাটা।
আর মাত্র কয়েক ইঞ্চি সরে গেলেই শেষ। কোনমতেই আর তোলা যাবে না। জলাভূমিতে পড়ে যাবে গাড়ি।
শেষ চেষ্টা করল এনডি। লো গীয়ারে দিয়ে গ্যাস পেডাল পুরো চেপে ধরল ফ্লোরবোর্ডের সঙ্গে। একই সঙ্গে গায়ের জোরে যতটা সম্ভব বায়ে ঘুরিয়ে দিতে লাগল স্টিয়ারিং।
সাংঘাতিক ঝাঁকি। আরও কয়েক ইঞ্চি পিছলে গেল চাকা। তবে সামনে না গিয়ে সরে যেতে লাগল বা পাশে। উঠে চলে আসতে শুরু করল। আর গোটা কয়েক ঝাঁকুনি আর চাকা পিছলানোর পর রাস্তায় উঠে এল পড়ে যাওয়া চাকাটা।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলে কপালের ঘাম মুছল এনডি।
গাড়ির আরোহীরা আবার স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে শুরু করল।
আর কোন অঘটন ঘটল না। রাস্তাটা নিরাপদেই পার হয়ে এল গাড়ি। বড় রাস্তায় উঠল। যেন ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়ার জন্যেই দ্বিগুণ গতিতে গাড়ি ছোটাল এনডি।
প্রায় ঘণ্টা তিনেক গাড়ি ছোটানোর পর গন্তব্যে পৌঁছল ওরা। মিয়ামিতে অনেক আগেই ঢুকে পড়েছে। এখন কোথায় এল, সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারল কিশোর। বিসকেইনি বে।
প্রচুর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গাছপালা দেখা যাচ্ছে।
আরও কয়েক মিনিট চলার পর বড় একটা দেয়াল ঘেরা বাড়ির গেটের কাছে। এসে থামল গাড়ি। ভেতরে গাছপালা, ঝোঁপঝাড়ের প্রায় জঙ্গল হয়ে আছে।
কাউকে গেটের কাছে আসতে দেখা গেল না। অথচ খুলে গেল গেটটা।
খাইছে! বিড়বিড় করল মুসা। ভূতের বাড়ি নাকি?
গাড়ি ঢোকাল এনডি। লম্বা ড্রাইভওয়ে চলে গেছে সুদৃশ্য একটা গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত। কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল চত্বরের একপাশে। বেশ খানিকটা দূরে, সীমানার উত্তর প্রান্তে সিমেন্টে বাঁধানো বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা হেলিকপ্টার। চিনতে পারল কিশোর। কেইনের হেলিকপ্টারটা। তারমানে ওদেরকে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে হেলিকপ্টারে করে এসে বসে আছে।
কয়েক গজ এগিয়েই থেমে গেল গাড়িটা। একটা বড় গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। হাতে ছোট রিমোট কন্ট্রোলের মত একটা যন্ত্র। গেটের দিকে তুলে বোতাম টিপতেই আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল গেটের পালা।
মুসার ভূত রহস্যের সমাধান হয়ে গেল। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে খোলে, বন্ধ হয় গেটটা।
গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল লোকটা। নিচু হয়ে তাকাল। গাড়ির ভেতরটা দেখল। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে যেতে ইশারা করল এনডিকে।
গাড়ি-বারান্দার সামনে এনে গাড়ি রাখল এনডি। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে দরজা খুলে নামল। তার আগেই নেমে পড়েছে কোরি। পকেট থেকে চাবি বের করে খুলে দিল কিশোরের হাতকড়া। এনডির হাতে পিস্তল বেরিয়ে এসেছে। মুসার হাতকড়াও খুলে দেয়া হলো। তারপর দুজনকেই বেরিয়ে আসতে বলা হলো।
মুসা আর কিশোর দুজনের পিঠেই পিস্তল ঠেসে ধরে ঘরে ঢোকানো হলো।
বিশাল বড় হলঘর। দুই পাশের দেয়াল ঘেঁষেই দুটো মস্ত মাছের ট্যাংক রাখা। পাঁচশো গ্যালন পানি ধরে একেকটাতে।
আপনার বস্ মনে হয় পুঁটি মাছ খুব পছন্দ করে? একটা ট্যাংক দেখিয়ে এনডির সঙ্গে রসিকতা করল কিশোর।
তা তো করেই, মুখ গোমড়া করে জবাব দিল এনডি। বায়েরটাতে আছে একটা স্টিং রে। আর ডানেরটাতে কয়েক ডজন পিরানহা।
বাপরে, সাংঘাতিক হবি তো। খুনে মাছ পোষে।
খুনে জিনিসই আমার পছন্দ, কথা বলে উঠল একটা কণ্ঠ। ছায়ার মধ্যে থেকে লম্বা লম্বা পায়ে বেরিয়ে এল ডগলাস কেইন। পিতপিতে মাছ পুষে মজা নেই। ঠিকমতই তাহলে আনতে পেরেছ, এনডি। দেরি দেখে আমি তো চিন্তায়ই পড়ে গিয়েছিলাম। যা পিছলা না এগুলো। ভয় পাচ্ছিলাম পালিয়ে না যায়।
নাহ্, যাবে কোত্থেকে, জবাব দিল কোরি। হাতকড়া খোলা কি আর অত সহজ।
কথাবার্তা শুনে পাশের লিভিং রূম থেকে বেরিয়ে এল গাট্টাগোট্টা এক লোক। মাথায় কোঁকড়া চুল। মুখটা কেমন চারকোনা। বড় বড় দাঁত। কাছে এসে দাঁড়াল। মুসা আর কিশোরের আপাদমস্তক দেখে বলল, এই দুটো ছেলেই এত নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছিল তোমাদের?
হাসল কেইন। অত সহজ মনে কোরো না ওদের। খোঁজ-খবর নিয়েছি আমি। কি জেনেছি জানো? শুনলে ভাল লাগবে না তোমার। ওরা কারও পেছনে লাগলে তার সর্বনাশ না করে ছাড়ে না। কেউ রেহাই পায়নি ওদের হাত থেকে।
এতটাই…! কথাটা শেষ করল না লোকটা। এক ভুরু উঁচু করল।
কিশোর, এর নাম রাগবি ড্যাগো, পরিচয় করিয়ে দিল কেইন।
শুরু থেকেই লোকটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিশোর। কিছু মনে করার চেষ্টা করছিল। মনে হচ্ছিল কোথাও দেখেছে একে। নাম শোনার পর বুঝল কোথায় দেখেছে। পত্রিকায়। ছবি।
আপনিই ফ্লোরিডার সেই কুখ্যাত গ্যাং লীডার নন তো? কিশোর বলল। বহুবার পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছেন। সারা আমেরিকার পুলিশ আপনাকে খুঁজছে।
তুমি জানলে কি করে? অবাক হলো ড্যাগো।
জানি বলেই তো গোয়েন্দাগিরি করতে পারি, জবাবটা এড়িয়ে গেল কিশোর।
কি বুঝলে? ড্যাগোর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল কেইন। বলেছিলাম না, ডেঞ্জারাস ছেলে ওরা। নাম শুনেই চিনে ফেলল তোমাকে। খোঁজ-খবর রাখে। তবে যত বিপজ্জনকই হোক, এবার আর ওদের মুক্তি নেই। দুই সহকারীর দিকে তাকাল সে। এনডি, ওদেরকে আমার জলজ প্রাণীগুলো দেখিয়ে আনন। গরমও যা পড়েছে আজ। মিয়ামির পচা গরম। ইচ্ছে করলে গোসল করার জন্যে পুকুরেও নামিয়ে দিতে পারো।
দাঁত বের করে হাসল কোরি। এনডিও হাসল। পিস্তল দেখিয়ে ইশারা করল দুই গোয়েন্দাকে। পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে পেছনের দরজার দিকে এগোতে বাধ্য করা হলো ওদের। তবে তার আগে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে নেয়া হলো দুজনেরই।
ওদিক দিয়েই ঢুকতে দেখা গেল নীরা লেভিনকে। ওকে দেখামাত্র পিস্তল লুকিয়ে ফেলল দুই গুণ্ডা। কিশোর আর মুসার পেছনে এমন করে গা ঘেঁষে দাঁড়াল যাতে ওদের বাধন দেখতে না পায়।
থমকে দাঁড়াল নীরা। ওরা এখানে কি করছে?
দ্বিধা করল এনডি। কি-কিছু না, ম্যাম।…মিস্টার কেইনের অ্যাকোয়ারিয়াম দেখতে চাইল…
ওদের নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এল কেইন। একটু পরেই চলে যাবে ওরা। নীরার হাত ধরে টান দিল সে। এসো।
কিছুই তো বুঝতে পারছি না! চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে নীরা। শত্রু থেকে বন্ধু হয়ে গেল কি করে হঠাৎ? তোমার চাকরি নিয়েছে নাকি?
ওসব নিয়ে পরে কথা বলব তোমার সঙ্গে, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল কেইনের কণ্ঠ। এখন যেতে দাও।
এগোও, কিশোরকে ধাক্কা দিল এনডি।
বাইরে দুটো বিশাল সুইমিং পুলের কাছে ওদেরকে নিয়ে আসা হলো।
সাঁতার কাটতে বলবেন নাকি? সেগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করল মুসা, সুইমিং সুট তো ফেলে এসেছি, ভুলে।
কোন অসুবিধে নেই, হেসে জবাব দিল কোরি। অনেক আছে আমাদের। কটা লাগবে?
কিশোর লক্ষ করল একটা পুলেও ডাইভিং বোর্ড নেই। পাড়ের চারপাশ ঘিরে মোটা শিকলের বেড়া। অনেক নিচে পানি।
বেশ কিছুটা দূরে বোট হাউস আর জেটি। জেটিতে বাঁধা একটা সাদা বোট। চ্যানেলের বাইরে খোলা সাগরে একটা ইয়ট দেখা যাচ্ছে। বেআইনী কাজ কারবার করে রাজার হালেই আছে কেইন আর ড্যাগো। হেলিকপ্টার, ইয়ট কোন কিছুরই অভাব নেই।
কিশোরের গায়ে কনুই দিয়ে তো লাগাল মুসা। কোন দিকে তাকিয়ে আছ?
পুলের দিকে দৃষ্টি ফেরাল আবার কিশোর। বিশাল একটা ত্রিকোণ পাখনা ভেসে উঠেছে একটা পুলের পানিতে। মসৃণ গতিতে ঘুরতে লাগল পুলের কিনার ঘেষে।
হাঙর!
হোয়াইট শার্ক!
মানুষখেকো বলে ভয়ানক বদনাম আছে এগুলোর।
আপনাআপনি দ্বিতীয় পুলটার দিকে নজর চলে গেল কিশোরের। ওটাতেও কি হাঙর আছে?
যেন তার মনের কথা পড়তে পেরেই হেসে বলল কোরি, ওটাতে কি আছে, ভাবছ, তাই না? যাও, নিজের চোখেই দেখো।
দ্বিতীয় পুলটার কাছে নিয়ে আসা হলো ওদের। ছোট একটা বাক্সের ভেতরে রাখা সুইচ টিপে দিল এনডি। পানি নিরোধক আবরণে মোড়া বা জ্বলে উঠল পুলের নিচে। একবার তাকিয়েই শিউরে উঠল কিশোর। মস্ত দুটো অ্যালিগেটর শুয়ে আছে পানির তলায়। আলো দেখে নড়েচড়ে উঠল দানব দুটো। বিকট ভঙ্গিতে হাঁ করে ওপরের দিকে তাকাল একটা। ভঙ্গিটা মোটেও ভাল লাগল না ওর। জানোয়ারগুলো হয়তো ভেবেছে, খাবার নিয়ে আসা হয়েছে।
মনে হয় না মানুষের মাংসে এদেরও অরুচি আছে।
.
১৩.
কোন একটা পুলের পানিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হবে ওদের-ভাবছে কিশোর। যেটাতেই ফেলা হোক, ফলাফল সমান। পাড়ের এত নিচে পানি, কোনমতেই হাত বাড়িয়ে নাগাল পাবে না। ধরে উঠতে পারবে না-যদি ওঠার সময় পায়, যদি তার আগেই ছিন্নভিন্ন করে না ফেলে ওদেরকে ভয়াবহ জানোয়ারগুলো।
ধাক্কা খাওয়ার অপেক্ষাতেই আছে সে আর মুসা। মনে মনে বাঁচার উপায় খুঁজছে।
নড়ে উঠল মুসা।
উঁহু! সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলের খোঁচা মারল তার পাঁজরে এনডি। ওসব করে কোন লাভ হবে না। ফুটো হওয়া রক্তাক্ত লাশটা তখন ফেলে দেব পুলের পানিতে। হজম করে ফেলবে অ্যালিগেটরেরা।
ঘড়ি দেখল কোরি। তারপর বলল, আসলে, এখুনি তোমাদের মারা হবে না। বসের নির্দেশ নেই। একটু ভয় দেখানো হলো কেবল। তবে বাড়াবাড়ি করলে ভয়টা সত্যে পরিণত হবে, মনে রেখো।
মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। বেঁচে থাকলে মুক্তির সুযোগ থাকবে। জিজ্ঞেস করল, কি করতে চান আমাদের নিয়ে?
খিকখিক করে হাসল কোরি। আমাদের বস্ খুব মজার লোক। এসো, দেখাচ্ছি তোমাদের।
সাগরের উল্টো দিকে বনে ঘেরা একটা জায়গায় ওদের নিয়ে আসা হলো। গাছপালার ভেতরে এক টুকরো খোলা জায়গা। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে মস্ত একটা তাঁবু। এত বড়, একটা দোতলা বিল্ডিং অনায়াসে ঢেকে দেয়া যাবে ওই তাবু দিয়ে।
খাইছে! এটা কি জিনিস? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মুসা। সার্কাস দেখাবে নাকি?
তাই মনে হচ্ছে? হেসে বলল কোরি। সার্কাসের তাবু নয়। এটা আমাদের অস্থায়ী গুদাম। বনের মধ্যে বড় বেশি পোকামাকড়ের আড্ডা। খুব জ্বালায়। বেশি বেড়ে গেলে গ্যাস দিয়ে মেরে ফেলা হয় ওগুলোকে। তাতে পোকাও মরে, জিনিসপত্রও নষ্ট হয় না।
এখন পোকামাকড় বেড়ে গেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পোকা মারার গ্যাস ছাড়া হবে তাঁবুটাতে, কোরির কথার খেই ধরল এনডি, দারুণ মজা পাচ্ছে যেন বলতে। ধাতব দুটো সিলিন্ডার দেখাল। তামার একটা টি-এর মত সরু পাইপ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে সিলিন্ডার দুটোর মুখ। টির ছোট দুটো মাথা সিলিন্ডারে লাগানো, লম্বা মাথাটা চলে গেছে তাঁবুর নিচ দিয়ে ভেতরে। তাঁবুর সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলে বাতাস আটকে যাবে। ক্যানভাসের লম্বা লম্বা বেলুনের মত কতগুলো জিনিস দেখাল সে। তখন এগুলো দিয়ে তাঁবুর কানাগুলো মাটির সঙ্গে চেপে রাখা হবে।
হট ডগ তো মনে হচ্ছে না এগুলোকে, মুসা বলল।
বাহ্, এ সময়েও খাবারের চিন্তা, এনডি বলল। সত্যি তোমার স্নায়ু ভীষণ শক্ত। না, হট ডগ নয়। এগুলোকে আমরা বলি স্যান্ড স্নেক। কানাগুলোকে এ জিনিস দিয়ে চেপে দিলে এক বিন্দু গ্যাসও আর বেরোতে পারে না।
আর ভেতরে যারা থাকে, এনডি থামতেই কোরি বলল, দশ মিনিটের মধ্যে খতম। জ্যান্ত কোন প্রাণীই আর এরপর বেঁচে থাকতে পারে না।
কি জিনিস রাখা হয় তাবুটাতে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হাসল এনডি। কি জিনিস? ধরো স্মাগলিঙের মাল। দেখবে নাকি? এসো।
তাবুর দরজা দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসা হলো ওদের। নানা আকারের প্রচুর বাক্স সাজিয়ে রাখা হয়েছে ভেতরে। বেশির ভাগ বাক্সের গায়েই বার্মিজ আর থাই ভাষায় লেখা দেখতে পেল কিশোর। তার মনে পড়ল, ওই দুটো দেশ, বিশেষ করে মিয়ানমার হলো হেরোইন চোরাচালানিদের স্বর্গরাজ্য। তারমানে মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করে কেইন।
তাঁবুর মধ্যে কাঠের তৈরি একটা কেবিন দেখা গেল। ওটাও অস্থায়ী। তবে লোহার ফ্রেম দিয়ে এমন করে নাট-বল্ট লাগিয়ে আটকানো, বেশ মজবুত, বোঝা যায়। দরজার বাইরের দিকে লাগানো লোহার চ্যাপ্টা ডাণ্ডাটা খুলে দিল কোরি। আড়াআড়ি লাগিয়ে দরজা আটকে রাখা হয়েছিল। টান দিয়ে পাল্লা খুলল। তারপর দুজনকে ঠেলে দিল দরজার অন্যপাশে। পরক্ষণে আবার পাল্লা লাগিয়ে ডাণ্ডা তুলে দিল।
ঘুটঘুটে অন্ধকার।
দেখি, ঘোরো তো, মুসা বলল। তোমার হাতের বাঁধনটা খুলতে পারি নাকি। নিজেরটা তো নিজে পারব না।
কে? মুসা নাকি? অন্ধকার থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠ।
জিনা! একসঙ্গে বলে উঠল কিশোর আর মুসা।
ঘরের এক প্রান্ত থেকে দৌড়ে আসার শব্দ হলো।
সত্যি! তোমরা! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! দুজনকেই ছুঁয়ে দেখতে লাগল জিনা।
বিশ্বাস না হওয়ার কিছু নেই, কিশোর বলল। যে হারে সূত্র রেখে এসেছ, খুঁজে বের করতে বরং দেরিই করে ফেলেছি। আরও আগে বের করা উচিত ছিল।
আমাকে যে এখানে আটকে রেখেছে, কার্ডটা দেখে বুঝেছ, না?
বুঝলেও নিজে নিজে আসিনি। ওরাই আমাদের এখানে ধরে নিয়ে এসেছে। নাও, এখন বাধনগুলো খোলো তো আমাদের। সব কথা পরে শুনব। তা তুমি ভাল আছ তো?
এ অবস্থায় কি আর ভাল থাকা যায়, প্রথমে মুসার বাঁধনটা খুলতে শুরু করল জিনা। রোজ এসে একবার করে খাবার দিয়ে যায়। ফাস্ট ফুড। একই বার্গার আর ফ্রাই খেতে খেতে জিভ পচে গেছে আমার।
চাবির রিঙে ছোট্ট একটা টর্চ আছে জিনার। সেটা কিশোরের হাতে তুলে দিল। ব্যাটারি প্রায় শেষ। সারাক্ষণ জ্বালালে কিছুই থাকত না। অন্ধকারেই বসে থেকেছি। দিনের পর দিন এ ভাবে থাকাটা যে কি কষ্টের!
পরে শুনব, কিশোর বলল। এখন বেরোনোর চেষ্টা করা দরকার।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। তোমরা পারো নাকি দেখো।
বন্ধ, জানে, তবু প্রথমে গিয়ে দরজায় ধাক্কা মেরে দেখল কিশোর।
তাড়াতাড়ি করা দরকার, মুসা বলল। গ্যাস ছেড়ে দিলে আর বেরোনো লাগবে না কোনদিন।
গ্যাস! বুঝতে পারল না জিনা।
তাকে বুঝিয়ে দিল মুসা। শুনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না জিনা। আপনাআপনি হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল যেন তার। বসে পড়ল মাটিতেই। বিষাক্ত গ্যাসের সাহায্যে কি করে গুদামে পোকা মারা হয়, জানে সে।
কিশোর কোন কথা বলছে না। কাজে ব্যস্ত। পেনলাইটের সামান্য আলো দিয়ে ছাতের একটা গ্রিল আবিষ্কার করে ফেলল।
ওদিক দিয়ে বাতাস আসে, মুসার দিকে ঘুরে তাকাল সে। মুসা, এসো তো এখানে। তোমার কাঁধে চড়ে দেখি কিছু করতে পারি কিনা।
গ্রিলটার নিচে এসে দাঁড়াল মুসা। তার কাঁধে চড়ল কিশোর। জিনা মুসাকে এমন করে ধরে রাখল, যাতে সে ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, কিশোরের কাজে ব্যাঘাত না হয়।
জিনার কী-রিঙটা আলো ছাড়াও আরও নানা ভাবে সাহায্য করল। একটা চাবি দিয়ে গ্রিলের স্ক্রুগুলো খুলে ফেলল কিশোর। ঠেলা দিয়ে সরাতে গিয়ে বুঝল, কেবিনের ওপরও ভারী জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। গ্রিলের কিনারে চেপে বসেছে ওগুলো।
রাজ্যের যত জিনিস চাপিয়ে দিয়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে। হাত ওপর দিকে তুলে রাখতে রাখতে পেশীতে ব্যথা শুরু হয়েছে।
পারছ না? ওপর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা। কিশোরের ভার বইতে বইতে সে-ও ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।
সরাতেই হবে, কিশোর বলল। বেরোনোর এটাই একমাত্র পথ।
কিসের শব্দ! উদ্বিগ্ন শোনাল জিনার কণ্ঠ।
খবরদার, শ্বাস নেবে না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। গ্যাস ছেড়ে দিয়েছে!
দুই হাতে প্রাণপণে গ্রিলটা ধরে ঠেলতে লাগল সে। তার চাপে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে মুসা। কিন্তু সরল না।
নড়তে শুরু করল অবশেষে গ্রিলটা। শেষ বারের মত জোরে ঠেলা মেরে পাশে সরিয়ে দিল কিশোর। দুড়ম-দাড়ম করে কি সব যেন পড়ল কেবিনের ছাত থেকে গড়িয়ে।
গ্রিলের ফোকরের দুই প্রান্ত চেপে ধরে নিজেকে টেনে তুলতে শুরু করল সে। মাথাটা ঢুকিয়ে দিল ফোকরের ভেতর দিয়ে। ফোকর গলে উঠে এল ওপরে। ছাতে উঠে বসল।
দম বন্ধ করে রেখেছে।
হামাগুড়ি দিয়ে ছাতের কিনারে চলে এল সে। লাফ দিয়ে মাটিতে নামল।
দরজার ডাণ্ডাটায় তালা দেয়া না থাকলেই হয় এখন। তালা থাকলে খুলতে পারবে না। বের করে আনতে পারবে না মুসা আর জিনাকে।
কতক্ষণ আর দম আটকাবে? শ্বাস টানল। ভয়ানক বিষাক্ত, তীব্র ঝাজাল গ্যাস মেশানো, বাতাস ঢুকে গেল নাক দিয়ে। জ্বালা করে উঠল কণ্ঠনালী। ফুসফুসে চাপ অনুভব করল।
দৌড় দিল দরজাটার দিকে।
টর্চের সামান্য আলো ব্যবহার করে দেখল, তালা নেই।
দ্রুতহাতে ডাণ্ডাটা সরিয়ে খুলে ফেলল দরজা।
জিনা! মুসা! ডাক দিল সে।
হাঁসফাঁস করছে ওরা দুজনে। জিনার গোঙানি শোনা গেল। ফাঁসাসে কণ্ঠে মুসা কি বলল, বোঝা গেল না।
শ্বাস নিচ্ছ কেন? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। জলদি বেরিয়ে এসো!
বলল বটে, কিন্তু সে নিজেই আর দম না টেনে থাকতে পারবে না। গলার মধ্যে ঘড়ঘড়ানি শুরু হয়ে গেছে। আগুন ধরে গেছে যেন ফুসফুসে। মাথার ভেতরটা ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। চিন্তার শক্তি হারাচ্ছে। কি করবে?
ইচ্ছে করছে মাটিতে শুয়ে পড়ে গভীর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে।
.
১৪.
গ্যাসের শিকার হওয়া চলবে না এখন কোনমতে!
নিজেকে বোঝাল কিশোর।
কোন একটা অস্ত্রের জন্যে মরিয়া হয়ে তাকাতে লাগল চারপাশে। টর্চের আলো এত কমে গেছে যে, যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে। তার আগেই খুঁজে বের করতে হবে কিছু একটা।
কেবিনের সামান্য দূরে একটা বেঞ্চ দেখতে পেল। ওঅর্কবেঞ্চ। তাতে দুচারটা যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। শাবল, হাতুড়ি, এ সব।
কিন্তু আসল জিনিসটা কই?
যেটা খুঁজছে সে?
দেখতে পেল। দুলে উঠল বুকের মধ্যে। তাড়াতাড়ি ছুটে গেল।
থাবা দিয়ে তুলে নিল মরচে পড়া ছুরিটা।
দরজার কাছে ফিরে এল। বহু কষ্টে অজ্ঞান হওয়া থেকে বিরত রাখছে নিজেকে।
ঘোলাটে লাল একটা গোল রিঙ সৃষ্টি করে জ্বলছে টর্চটা। তবে দরজাটা কোথায় আছে দেখার জন্যে যথেষ্ট।
সেদিকে তাকিয়ে ডাক দিল, মুসা! বেরিয়ে এসো জলদি!
সাড়া পেল না।
মুসা!
এই যে! দরজার কাছ থেকে শোনা গেল তার ফ্যাসফেসে কণ্ঠ।
জিনার শক্তি প্রায় শেষ। তাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে মুসা।
বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে।
তাবুর দরজাটা কোন দিকে আছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মুসাদেরকে আসতে বলে আন্দাজে সেদিকে দৌড় দিল কিশোর।
দরজাটা পাও গেল না। কিন্তু তাবুর দেয়াল ঠেকল হাতে। মরচে পড়া ছুরিটা চালাল পাগলের মত। ধার বলতে নেই। তবু চোখা মাথাটা কাজে লাগল।
যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে ছুরির খোঁচা মারতে মারতে ফেঁড়ে ফেলল ক্যানভাসের খানিকটা জায়গা। পেছনে তাকিয়ে ডাক দিল, মুসা!
এই যে আমি!
ঠিক এই সময় নিভে গেল টর্চ।
কাজ প্রায় শেষ। আর দরকারও নেই এটার। তবে টর্চটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেছে কিশোরের মন। তাই ফেলতে পারল না। ভরে রাখল পকেটে।
বাইরে বেরিয়ে এল সে। তাঁবুর কাছেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে। মুখ হাঁ করে ডাঙায় ভোলা মাছের মত খাবি খেতে খেতে বাতাস টানতে লাগল।
ফুসফুস ভরে গেল সাগর থেকে আসা তাজা হাওয়ায়।
কমে আসতে লাগল জ্বলুনি। বুকের চাপ। মাথাটা পরিষ্কার হয়ে আসছে।
পেছনে গোঙানির মত আওয়াজ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখল মুসা আর জিনাও তার মত মাটিতে পড়ে বাতাস টানছে।
পুরো এক মিনিট পর কথা বলল জিনা, উহ, নরক থেকে বেঁচে এলাম!
তাহলেই বোঝো, পোকামাকড়ের কত কষ্ট! শুকনো হাসি হাসল মুসা। ওদেরকে যে কত ভাবে মারি আমরা!
জ্বালায় বলেই তো মারি, জিনা বলল।
আমাদের কাছে জ্বালানো মনে হয়। আসলে তো ওরা বাঁচতে চায়, খাবার খেতে চায়। আমাদের যন্ত্রণা দেয়ার জন্যে মোটেও করে না।
উঠে বসল কিশোর। কথা বোলো না। কাছাকাছিই থাকতে পারে ওরা। কথা শুনলে আবার এসে ধরবে। এবার এমন ব্যবস্থা করবে, যাতে কোনমতেই আর বাঁচতে না পারি।
হামাগুড়ি দিয়ে বনের দিকে এগোল ওরা। উঠে দাঁড়ালে যদি চোখে পড়ে যায় এই ভয়ে।
গাছপালার ভেতরে এসে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল বন থেকে বেরোনোর জন্যে।
বনের বাইরে বেরোতেই একটা গাড়ি চোখে পড়ল। হলুদ রঙের একটা সিডান। গায়ে বড় একটা পোকার ছবি। নিচে কোম্পানির নাম লেখা।
ভেতরে কেউ নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর কাছে এল ওরা। নামটা পড়ে বুঝে গেল কিশোর, গাড়িটা এখানে কেন। কয়েকটা প্রশ্নেরও জবাব পেয়ে গেল। বলল, পোকা-মারা কোম্পানির গাড়ি। পেশাদার লোককে নিয়ে এসেছে ওরা। নিয়মিত বোধহয় পোকা মেরে রেখে যায় লোকটা। আমাদের তাঁবুর ভেতরে ভরে মারার কারণটা বুঝেছ?
না, মাথা নাড়ল মুসা।
অ্যাক্সিডেন্ট হিসেবে দেখানোর জন্যে। বলবে, ভুলক্রমে দুর্ঘটনায় মারা গেছি আমরা।
এত ঝামেলা না করে হাঙর কিংবা অ্যালিগেটরের পুলে ফেলে দিলেই কি ভাল করত না? চিহ্নও থাকত না আমাদের।
ওরকম কিছু করলেই বরং পুলিশের সন্দেহ বাড়ত। ওরা জানে, আমরা উধাও হয়ে গেলে সেটা নিয়ে তদন্ত হবে। আমাদের বাড়ি থেকে লোক আসবে। ডেপুটি গেকোর কথার দুই পয়সা দাম দেবে না। কারণ ঘুষখোর পুলিশটার সব কথা বলে দেবে রবিন। মিয়ামি পুলিশ যাবে তখন গাল আইল্যান্ডে। সূত্র ধরে ধরে গিয়ে হাজির হবে কেইনের বাড়িতে। সহজে ছাড়া হবে না তাকে। কোনখানে তার কয়টা বাড়ি আছে বের করে ফেলবে পুলিশ। এ বাড়িটাতে আসবে। হাঙর আর অ্যালিগেটরের পুল দেখলে বুঝে যাবে আমাদের কি গতি করেছে কেইন।
গ্যাসের মধ্যে পড়ে মরলেও তো বুঝত।
না, অন্য কথা বোঝাতে পারত তখন কেইন। বলত জিনার খোঁজে আমরা গিয়ে তার তাঁবুতে ঢুকেছি। ঠিক এ সময় পোকা মারার জন্যে গ্যাস ছেড়েছে পোকা-মারা কোম্পানির লোক। আমরা যে ভেতরে আছি, জানার কথা নয় লোকটার। পুলিশকে বিশ্বাস করিয়ে ফেলত কেইন। তিন-তিনটা খুন করেও তখন ধোয়া তুলসি পাতা হয়ে থাকত সে।
কত্তবড় শয়তান! দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। ওকে ধরে একবার হাঙর, একবার অ্যালিগেটরের পুলে যদি চুবাতে পারতাম, রাগটা কমত!
রাগ পরে কমিয়ো, হাসল কিশোর। এখন দেখো, গাড়িটা স্টার্ট দিতে পারো নাকি। হাতের কাছে যখন পেয়েই গেছি, পালানোর জন্যে রেডি থাকি।
দরজায় তালা দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি পোকা-মারা কোম্পানির লোক। চাবিটাও ইগনিশনেই আছে। মোচড় দিতেই গুঞ্জন তুলল ইঞ্জিন। স্টার্ট নেবে।
হয়েছে, থামাও! মুসার পাশে উঠে বসল কিলোর। কার-টেলিফোনটা টেনে নিল। ফোন করল মিয়ামি পুলিশকে।
ফোন ধরল যে ডিউটি অফিসার, তার নাম ডিটেকটিভ ওয়ারেন। কোন ভূমিকার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল কিশোর, রাগবি ডাগোকে ধরতে চান? স্মাগলার এবং গ্যাংলীডার?।
সঙ্গে সঙ্গে জড়তা চলে গেল অফিসারের কণ্ঠ থেকে। কে বলছেন?
আমার নাম কিশোর পাশা। ঠিকানা দিচ্ছি, ভাল করে বুঝে নিন। এখানে এলেই আমাকে দেখতে পাবেন। শুধু রাগবি না, পুরো দলটাকেই ধরতে পারবেন।
ঠিকানা জানা নেই কিশোরের, কিভাবে কিভাবে কোনখানে আসতে হবে বলে দিল ডিটেকটিভ ওয়ারেনকে। পেছনে খুট করে শব্দ হতেই তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিল কিশোর। তার মনে হলো, আরও কিছু যেন বলতে চেয়েছিল ডিটেকটিভ ওয়ারেন। কিন্তু সে-সময় আর নেই।
তাড়াতাড়ি ফোন রেখে গাড়ি থেকে নেমে এল সে।
শব্দটা যেদিক থেকে হয়েছে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কাউকে আসতে দেখা গেল না। তারমানে কোন বুনো প্রাণী হবে। শেয়াল কিংবা ব্যাকুন।
মুসা জিজ্ঞেস করল, নামলে কেন? চলো, বেরিয়ে যাই।
বেরোবে কি করে? গেট তো খোলে রিমোট কন্ট্রোলে।
গুতো মেরে ভেঙে ফেলব।
আমার মনে হয় না ভাঙতে পারবে। কেইন সিনেমা দেখেনি, এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারবে না। গাড়ি নিয়ে যে হরহামেশা গেট ভেঙে বেরিয়ে যায় হিরোরা, এটা তার অজানা নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যাতে না ভাঙা যায় সে ভাবেই তৈরি করা হয়েছে গেটটা।
তাহলে কি করব? বসে থাকলে তো ধরা পড়ে যাব।
দেখি, কয়েক মিনিট অপেক্ষা করি। পুলিশকে কাছে আসার সময় দিই। আমাদের এদিকে শত্রুপক্ষের কাউকে আসতে দেখলে কেটে পড়ব। যদি না আসে, কয়েক মিনিট পর অ্যাকশনে যাব। শুধু পুলিশের আশায় বসে থাকলে হবে না। আমাদেরও প্রচুর কাজ আছে। কেইন আর ড্যাগোকে হাতে যখন পেয়েছি, প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ব না। নেমে এসো। লুকিয়ে থাকি।
গাড়ির কাছেই ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে বসল তিনজনে।
হ্যাঁ, এবার বলো তো, জিনাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ধরল কি করে ওরা তোমাকে?
সামনে দিয়ে এসে গাড়িটার পথরোধ করল, জিনা বলল। তারপর এনডি আর কোরি নেমে এসে পিস্তল দেখিয়ে ধরে নিয়ে গেল আমাকে।
হারম্যান কেগ ছিল না ওদের সঙ্গে?
এই কেগটা আবার কে?
বুঝলাম। তারমানে চেনো না একে। কেন তোমাকে কিডন্যাপ করল সেই কথাটা বলো দেখি আগে।
জেরি আঙ্কেলের ডকটা ভাঙার সময় এনডিকে দেখে ফেলেছিলাম আমি, জিনা বলল। বোটের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সে। বোট চালাচ্ছিল আরেকটা লোক। পরে আর কখনও দেখিনি তাকে। এনডিকে যে দেখেছি, সেটা বুঝে ফেলেছিল সে। পরের দিন যখন সৈকতে গেলাম, আবার তাকে দেখতে পেলাম কেইনের বাড়িতে। কোরির সঙ্গে ধরাধরি করে একটা বোট থেকে মাল নামাচ্ছিল। বাক্সের গায়ে বার্মিজ লেখা। আমাকে এনডির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল এনডি।
কেন তোমাকে কিডন্যাপ করা হলো, সেটা তো বুঝলাম, কিশোর বলল, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আমাদের খোঁজ পেল কি করে ওরা? ফ্লোরিডা থেকেই আমাদের পিছে লেগেছিল। গাড়ির চাকা কেটে দিয়ে ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়াতে চেয়েছে।
সেটা আমারই বোকামির জন্যে, চাপা ক্ষোভের সঙ্গে বলল জিনা। আমাকে যখন ধরে নিয়ে গেল ওরা, কেইনের সামনে হাজির করল, তাকে হুমকি দিয়েছিলাম। তোমাদের নাম করে বলেছিলাম, তোমরা আমাদের বন্ধু। আমার নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনলে অবশ্যই আমাকে উদ্ধার করতে আসবে তোমরা। সে-কারণেই নিশ্চয় সাবধান হয়ে গিয়েছিল ওরা। তোমাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর করে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তোমরা বিপজ্জনক। সেজন্যে গাল আইল্যান্ডে ঢোকার আগেই তোমাদের বিদায় করতে চেয়েছিল।
হু, চুপ হয়ে গেল কিশোর।
কেগকে চেনো না, মুসা বলল, কিন্তু তার বাড়িতে তোমার ঘড়ি পাওয়া গেল কিভাবে?
কেগের বাড়িতে আমার ঘড়ি! আমি তো ভেবেছিলাম ঘড়িটা আমি কেইনের বাড়িতে ফেলে এসেছি। কেগকে আমি চিনিই না…
আমি বুঝে গেছি, কিশোর বলল। তোমার কিডন্যাপিঙের দায় অন্য কারও ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা বেচে যেতে চেয়েছিল। এর জন্যে কেগের চেয়ে উপযুক্ত তোক আর কে আছে? করে বীমার দালালি, অথচ গাল আইল্যান্ডে এসে সময় কাটাচ্ছে পচা পচা ছবি এঁকে। চালচলন রহস্যময়। স্থানীয় লোকও নয় সে। মিয়ামি থেকে পুলিশ এসে তদন্ত চালালে ঘুষখোর গেকোটার সাহায্যে সহজেই তাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারত। সেজন্যে ফাঁদ তৈরিও করে রেখেছিল ওরা। কেগের গাড়িটা চুরি করে সেটার সাহায্যে তোমাকে কিডন্যাপ করে, তোমার ঘড়ি নিয়ে ফেলে রেখে আসে তার বাড়ির টেবিলে। তোমার ছবি থেকে তার গাড়ির নম্বর বের করে আমরাও তো তাকে সন্দেহ করা শুরু করে দিয়েছিলাম।
কেইনটা আসলেই পাজি! মুসা বলল। আমরা যখন প্রথম ঢুকলাম তার বাড়িতে, এমন ভঙ্গি করল, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।
ফ্রিজের দরজায় আটকানো বাবার ছবিটা পেয়েছিলে? জিজ্ঞেস করল জিনা।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল মুসা। রাখলে কখন?
আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে কেইনের সঙ্গে যখন চেঁচামেচি করছি আমি, নীরা লেভিন নামে একটা বেটি এসে ঘরে ঢুকল। এনডিকে আমার পাহারায় রেখে মেয়েলোকটাকে বের করে দিয়ে আসতে গেল কেইন। পানি খাওয়ার ছুতোয় ফ্রিজের কাছে গিয়ে তখন চুম্বকের সাহায্যে আটকে দিয়ে এলাম ছবিটা।
ভালই করেছিলে, মুসা বলল। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না। কার্ডটা পাঠালে কি করে?
এ বাড়ি থেকেই জোগাড় করেছিলাম ওটা, জিনা জানাল। দোতলার একটা অফিস ঘরে সামান্য সময়ের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাকে। টেবিলে রাখা মিয়ামির সমুদ্রপাড়ের ছবিওয়ালা কার্ডটা দেখেই ফন্দি এল মাথায়। বোকা পিকোটাকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করলাম ওটা। একটা কলমও চুরি করলাম। বাথরূমে গিয়ে লিখলাম। দরজা দিয়ে বের করে আমাকে তাবুতে নিয়ে যাওয়ার সময় দরজার পাশের ডাকবাক্সে ফেলে দিলাম, যেটা থেকে পিয়ন এসে চিঠি নিয়ে যায় পোস্ট করার জন্যে। রাতের বেলা ছিল বলেই এত কাজ করতে পেরেছি, দিনে হলে পারতাম না।
তার জন্যে বোকা পিকোটাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া উচিত তোমার, মুসা বলল।
জবাব দিতে যাচ্ছিল জিনা, দূর থেকে আসা সাইরেনের শব্দ শুনে থেমে গেল।
সোজা হয়ে বসল কিশোর। চলো, সময় হয়েছে।
পোকা-মারারা তো এল না, মুসা বলল। এনডি আর কোরিরও দেখা নেই।
ঘড়ি দেখল কিশোর। খুব বেশিক্ষণ তো হয়নি। আমরা মরেছি কিনা, একেবারে শিওর হয়ে তারপর আসবে ওরা।
গেটের দিকে ছুটল তিনজনে।
হেলিকপ্টারটা চোখে পড়তে থেমে গেল কিশোর। দাঁড়াও দাঁড়াও, এক কাজ করা যাক। অকেজো করে দিয়ে আসতে হবে ওটাকে, যাতে স্টাট না নেয়। পালাতে না পারে কেইন।
ঠিক। আমি যাচ্ছি। হেলিকপ্টারের দিকে দৌড় দিল মুসা।
বাকি থাকল বোটটা, ছুটতে ছুটতে জিনাকে বলল কিশোর। গাড়িতে করে পালাতে গেলে পুলিশের সামনে পড়ে যাবে ওরা। বেরোতে পারবে না। আমি বোটটার ব্যবস্থা করে আসি। তুমি কোথাও লুকিয়ে পড়ো। খবরদার, কোনমতেই ওদের হাতে পোড়ো না আর। তাহলে তোমাকে ব্যবহার করে পালানোর ব্যবস্থা। করে নেবে ওরা।
ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। সামনে সমুদ্র। বোটহাউসটা দেখা যাচ্ছে। সাগর থেকে একটা চওড়া চ্যানেল বেরিয়ে এসেছে। সেটার মুখেই বানানো হয়েছে বোটহাউসটা। বোটহাউসের বাইরে নোঙর করে রেখেছে একটা বোট। ইয়টটা রয়েছে ভোলা সমুদ্রে। ওটাতে যেতে চাইলে বোটে করে যেতে হবে। বোটটা নষ্ট করে দিলেই যাওয়ার উপায় থাকবে না আর।
পানির কিনারে এসে জুতো খুলে ফেলল কিশোর। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পানিতে। সঁতরে এগোল বোটের দিকে।
কিশোরের কথা অমান্য করল না জিনা। কোন ঝুঁকি নিতে গেল না। একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। তাকিয়ে রইল বাড়িটার দিকে।
ফর্সা হয়ে আসছে পুবের আকাশ। একটা দুটো করে পাখি ডাকতে আরম্ভ করেছে।
এগিয়ে আসছে সাইরেনের শব্দ।
সামনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরোল হঠাৎ পিকো। দৌড় দিল ড্রাইভওয়ে ধরে। কিছুটা এগিয়ে রিমোট কন্ট্রোল তুলে সুইচ টিপে গেটটা খুলে ফেলল।
অবাক হয়ে গেল জিনা। পুলিশকে ঢোকার সুযোগ করে দিচ্ছে নাকি লোকটা?
বুঝল পরক্ষণেই। খোলা গেট দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল পিকো। পুলিশের আসার সঙ্কেত পেয়েই পালাচ্ছে ভীতু লোকটা।
সামনের দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল আরও তিনজন। ডগলাস কেইন, রাগবি ড্যাগো আর নীরা লেভিন। খোলা গেটের দিকে তাকিয়ে দ্বিধা করল ওরা। কি যেন বলল কেইন। শব্দ শুনলেও এত দূর থেকে কথাগুলো বুঝতে পারল নাজিনা। নিশ্চয় পিকোকে গালাগাল করছে।
উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত তুলে হেলিকপ্টারটার দিকে দেখাতে লাগল কেইন। রাগবি দেখাতে লাগল পানির দিকে। বোঝা গেল সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ওরা, কোন পথে পালাবে। কেইন বলছে হেলিকপ্টারে করে যেতে, ড্যাগো বলছে বোটে করে। শেষমেষ হেলিকপ্টারের দিকেই ছুটল ওরা।
মুচকি হাসল জিনা। মনে মনে বলল, যাও, দেখোগে ওড়াতে পারো কিনা! একবার মুসার হাত পড়লে তোমাদের বাপেরও সাধ্য নেই ওটা আর এত তাড়াতাড়ি ওড়াতে পারো।
পেছনে হট্টগোল শুনে ফিরে তাকাল জিনা। এনডি আর কোরি দৌড়ে আসছে। ভীষণ উত্তেজিত। কেন, সেটাও অনুমান করতে পারল সে। নিশ্চয় কেবিনে ঢুকে ওদেরকে না পেয়ে তাজ্জব হয়ে গেছে ওরা। বসুকে খবরটা দিতে আসছে। কিন্তু সাইরেনের শব্দ শুনে আর বসদেরকে হেলিকপ্টারের দিকে দৌড়াতে দেখে থমকে গেল ওরা। বুঝল, পরিস্থিতি সুবিধের নয়।
যেতে যেতে চিৎকার করে আদেশ দিল কেইন, ওদিকে যাচ্ছ কোথায়, গাধা কোথাকার! জলদি বোট নিয়ে পালাও! ইয়টটা নিয়ে চলে যাও গাল আইল্যান্ডে। আমরা হেলিকপ্টারে করে যাচ্ছি।
পৌঁছে গেছে পুলিশ। গেট দিয়ে ঢুকল প্রথম গাড়িটা। পেছনে একে একে আরও চারটা। পুরো বহর নিয়ে চলে এসেছে ওরা। রাগবি ড্যাগোকে ধরার এমন চমৎকার মওকা কোন ভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
গাড়ি-বারান্দায় এসে ব্রেক করল সামনের গাড়িটা। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দুদিকের দরজা। প্রথমেই যাকে নামতে দেখল জিনা, দেখে অবাক হয়ে গেল।
রবিন!
বুঝতে পারল না, পুলিশের সঙ্গে ও এল কি করে?
রবিনকে দেখে আর লুকিয়ে থাকতে পারল না জিনা। লাফ দিয়ে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটল গাড়ি-বারান্দার দিকে।
দেখল, ইভাও নামছে গাড়ি থেকে। জিনা তো আর জানে না, কিশোর রবিনকে বলে এসেছে মধ্যরাতের পর ওরা মোটেলে ফিরে না গেলে মিয়ামি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ডিটেকটিভ ওয়ারেন রবিনের আসার সংবাদটাই জানাতে চেয়েছিল কিশোরকে। লাইন কেটে না দিলে ওই সময়ই রবিনের সঙ্গে কথা বলতে পারত কিশোর।
.
১৫.
চব্বিশ ঘণ্টা পর নিজেদের ভাড়া করা ভ্যানটায় করে আবার গাল আইল্যান্ডে ফিরে চলল তিন গোয়েন্দা। এবার ওদের সঙ্গে রয়েছে জিনা আর ইভা। মিয়ামি পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘ সিটিঙের পর, পুরো রিপোর্ট লিখে দিয়ে একটা হোটেলে গিয়ে উঠেছিল গোয়েন্দারা। পুলিশের অনুরোধে-অন্তত একটা দিন যেন থেকে যায় ওরা। ওদেরকে দরকার হতে পারে।
হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে শরীরটা ঝরঝরে হয়ে গেছে ওদের। গাড়ি চালানোর সময় মনের আনন্দে শিস দিতে শুরু করল মুসা।
ঘুরপথে না গিয়ে অ্যালিগেটর অ্যালিতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল সে। কিশোর জিজ্ঞেস করলে বলল, দিলের বেলা না দেখে যাচ্ছি না আমি, সে-রাতে কাদের খাবার হতে যাচ্ছিলাম।
দেখো, এখন সত্যি সত্যি না খাবার হয়ে যাও, সাবধান করল বটে কিশোর, কিন্তু আপত্তি করল না। কারণ দিনের আলোয় অ্যালিগেটরে ভরা জলাভূমিটা দেখার লোভ সামলাতে পারল না সে-ও।
রবিন আর জিনারও আগ্রহ আছে। ইভার নেই। বহুবার দেখেছে সে। তবে বাধা দিল না। কিছু বলল না। ওরা দেখতে চাইছে, দেখুক।
নিরাপদেই পেরিয়ে এল বিশাল জলাভূমিটা। কোথায় পড়তে যাচ্ছিল রাতের বেলা, দিনের আলোয় দেখে শিউরে উঠল মুসা। সত্যি ভয়ানক জায়গা! বড় বাঁচা বেচেছে।
.
কজওয়ে ধরে গাল আইল্যান্ডে যখন ঢুকছে ওরা, মাথার ওপর উঠে এসেছে সূর্যটা। তীব্র হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের কড়া রোদ।
গাল আইল্যান্ডে ফিরে মোটেলে ঢোকার পথেই দেখা হয়ে গেল হারম্যান কেগের সঙ্গে। সবুজ গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামাতে বলল কিশোর।
নেমে গেল ওরা দল বেঁধে। গাড়িটা থেকে খানিক দূরে ঝড়ে উপড়ে পড়া একটা পাম গাছের ওপর ছাতার নিচে বসে গভীর মনোযোগে পামের জটলার ছবি আঁকছে সে। রোদ থেকে বাঁচার জন্যে বালিতে খাড়া করে গেঁথে দিয়েছে বড় একটা ছাতা।
ছেলেমেয়েদের সাড়া পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল হাত। থেমে গেল পেন্সিল। তোমরা!
হ্যাঁ, আমরা, হাসিমুখে জবাব দিল কিশোর। আজ আর কোন অভিযোগ নিয়ে আসিনি আপনার কাছে। আসল কিডন্যাপাররা ধরা পড়েছে।…জিনা, হারম্যান কেগ।
মাথা নাড়ল জিনা, জীবনেও দেখিনি একে।
উঠে এল কেগ। ভুরু কুঁচকে জিনাকে দেখতে লাগল।
পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর। সংক্ষেপে জানাল সব।
খোদা বাঁচিয়েছে আমাকে! জোরে নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল। কেগ। ওর ঘড়িটা যে আমার ঘর থেকে নিয়ে গেছ, একটা কাজের কাজ করেছ। চুরি করে আমার ঘরে ঢুকেছিলে বলে এক বিন্দু রাগ নেই আর আমার।
কিন্তু একটা কথা বলুন তো, কিশোর বলল, বীমার দালালি ছেড়ে আপনি এতদিন ধরে এই গাল আইল্যান্ডে এসে বসে আছেন কেন?
অবাক হয়ে গেল কেগ। আমি বীমার দালালি করি কে বলল তোমাকে?
ভুলে যাচ্ছেন কেন, আমরা গোয়েন্দা। কেইন আর ড্যাগোর মত অপরাধীকে ধরিয়ে দিয়ে এলাম, আর আপনি কি কাজ করেন, সেটা বের করতে পারব না?
তা ঠিক, মাথা ঝাঁকাল কেগ। আর মিথ্যে বলব না। সত্যি কথাটাই বলি। বীমার দালালি আমার পেশা নয়। আমি এ লাইনে নতুন। মানুষকে পলিসি গছানো যে কি কঠিন ব্যাপার, যে এ কাজ না করেছে সে বুঝবে না। অনেক চেষ্টা-চরিত্র। করে যা-ও বা একজনকে রাজি করালাম, এমন একটা প্যাঁচে ফেলে দিল আমাকে যে, পারলে কোম্পানির ম্যানেজার আমাকে পুলিশে দেয়। কিছুটা সেই ভয়ে, আর মনের দুঃখে এসে এই স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছি।
পচা পচা ছবি আঁকার জন্যে, হাসল মুসা। গলা লম্বা করে কেগের হাতের ছবিটা দেখল। এগুলো কি পামের জটলা, না মুঠি বাধা ছাগলের শিং? শিঙের মাথায় ওগুলো কি? তুলোর পোঁটলা?
স্তব্ধ হয়ে গেল কেগ। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল গম্ভীর মুখে। তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। ঠিক বলেছ। আমি জানি আমার আঁকা ভাল হয় না। কিন্তু এত সহজে সত্যি কথাটা আমার মুখের ওপর কেউ বলেনি আর। শুধু এ কথাটার জন্যে তোমাদেরকে একটা দাওয়াত দিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
খাওয়ার দাওয়াত তো? সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা লুফে নিল মুসা। বলুন, কবে আসতে হবে?
কেগকে ধন্যবাদ দিয়ে, হাসাহাসি করতে করতে গাড়িতে ফিরে এল ওরা।
মোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গাড়ির শব্দ শুনে অফিস থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন মিস্টার ব্রুক। গাড়ির কাছে এসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলতে লাগলেন, এসেছ তোমরা! বাঁচা গেল। দেরি দেখে আমি তো চিন্তায়ই পড়ে গিয়েছিলাম…
হ্যাঁ, চাচা, গাড়ি থেকে নামতে নামতে জবাব দিল ইভা। অ্যালিগেটর অ্যালিতে থেমেছিলাম। জলাভূমিটা দেখতে চেয়েছিল ওরা।
অ। টেলিফোনে সব শুনেও নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, মিস্টার ব্রুক বললেন। মনে হচ্ছিল, ড্যাগো আর কেইন সহ ধরা তো পড়েছে মাত্র চার পাঁচজন। কিন্তু ওদের দলে আরও লোক আছে নিশ্চয়। যারা তখন ওবাড়িটাতে ছিল না। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে রাস্তায় যদি কিছু করে তোদের?
কিছু যে করেনি, দেখতেই তো পাচ্ছ, হেসে বলল ইভা।
ড্রাইভিং সীট থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল মুসা। কিন্তু কথাটা হলো আঙ্কেল, আপনার দুশ্চিন্তা কমেছে, কিন্তু আমার যে বেড়ে যাচ্ছে।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন মিস্টার ব্রুক। ইভাও অবাক।
কেন, এখন আর দুশ্চিন্তা কিসের? জানতে চাইলেন মিস্টার ব্রুক। সব ঝামেলা তো শেষ।
দুশ্চিন্তাটা হলো, কেউ খাওয়ার কথা বলছে না, মুখ গোমড়া করে বলল মুসা। নাড়িভুড়ি হজম হয়ে গেলে কোন মানুষ বাঁচে বলে আমার জানা নেই।
হা-হা করে হেসে উঠলেন আঙ্কেল ব্রুক।
চমকে গেল ইভা। চাচাকে এ ভাবে হাসতে বহুকাল দেখেনি।
হাসতে হাসতে মিস্টার ব্রুক বললেন, ভাল কথা মনে করেছ তো। তোমাদের অপেক্ষায় থেকে থেকে পেট বলে যে একটা জিনিস আছে, ভুলেই গিয়েছিলাম। চলো চলো, কুপারের ওখানেই গিয়ে খাওয়াটা সেরে আসি। আমরা যে বিজয়ী হয়েছি, লাঞ্চ দিয়ে সেটা সেলিব্রেট করব।
তা-ই চলুন। মিস্টার কুপারকেও জানাতে পারব, তার রেস্টুরেন্টটা বেঁচে গেছে। কেইনের শয়তানি বন্ধ হয়েছে। আবার আসবে ট্যুরিস্ট, জমে উঠবে ব্যবসা।
সেটা জানে না মনে করেছ? সুখবরটা অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছি ওকে।
আরও একবার জানাব আমরা, চলুন।
আবার গাড়িতে উঠল সবাই। দলে এবার যুক্ত হলেন মিস্টার ব্রুক।
কুপারস ডিনারের সামনে এনে গাড়ি রাখল মুসা। গাড়ি থেকে নেমে সারি দিয়ে ভেতরে ঢুকল সবাই। তাড়াহুড়ো করে চেয়ার টানাটানি করে এনে টেবিল গুছিয়ে দিল কুপার আর ম্যাগি। আরাম করে বসল সবাই। পনেরো মিনিটের মধ্যেই বিরাট এক ট্রে বোঝাই করে বার্গার আর স্টেক স্যান্ডউইচ নিয়ে হাজির হলো ম্যাগি।
কেইনের বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছে পুলিশ, খেতে খেতে গোয়েন্দাদের জানালেন মিস্টার ব্রুক। নানা রকম দামী দামী চোরাই মালে ভর্তি ছিল বাড়ির নিচতলার স্টোররূম। বড় বড় মার্কেটের দোকান থেকে চুরি গেছে ওসব। লিস্ট আছে মিয়ামি পুলিশের কাছে। সেই সঙ্গে চোরাই পথে আনা প্রচুর ইলেকট্রনিক সামগ্রী, বিশেষ করে কম্পিউটারের পার্টস, বেআইনী ভাবে আনা। গ্যাংলীডার রাগবি ড্যাগো দক্ষিণ ফ্লোরিডাতেও তার ব্যবসা বিস্তার করতে চেয়েছিল। দলে ঢুকিয়ে নিয়েছিল স্মাগলার কেইনকে।
খালাস পেয়ে যাবে না তো? প্রশ্ন করল জিনা।
না, তা পাবে না, মাথা নাড়লেন মিস্টার ব্রুক। প্রথমেই আমার এ কথাটা মনে হয়েছে। পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওরা বলল, না, ওর বিরুদ্ধে এত বেশি প্রমাণ আছে ওদের হাতে, কোনমতেই ছাড়া পাবে না কেইন। আর ড্যাগো তো আগে থেকেই অভিযুক্ত হয়ে আছে। মুখ তুললেন মিস্টার ব্রুক। আমাদের দ্বীপ থেকে কেন তাড়াতে চেয়েছিল ওরা, বলেছে কিছু?
কেইন আর ড্যাগো অন্তত আমাদের সামনে মুখ খোলেনি, কিশোর বলল। পরে কি করবে জানি না। তবে নীরা বেগম জেরার মুখে ক্যানারি পাখির মত গান গাওয়া শুরু করেছিল। আর পিকোটাকেও ধরে ফেলেছে পুলিশ। সে তো এমন কাণ্ড করল, যেন পেটে যা আছে উগরে দিতে পারলে বাঁচে।
পিকো কে?
কেইনের বিসকেইনি বের বাড়ির পাহারাদার।
ও। তা কি বলল?
পুরো দ্বীপটাই কিনে ফেলতে চেয়েছিল কেইন, ছুরি দিয়ে স্টেক কেটে কাঁটা চামচে গেঁথে মুখে পুরল কিশোর। ওদের হেডকোয়ার্টার বানাতে চেয়েছিল। চোর-ডাকাত স্মাগলারদের স্বর্গদ্বীপ। ফ্লোরিডার পশ্চিম উপকূলে সুন্দর, ছিমছাম, নিরিবিলি একটা দ্বীপের চেয়ে ভাল হেডকোয়ার্টার ওদের মত অপরাধীরা আর কোথায় পাবে? স্থলপথ, জলপথ, আকাশপথ, সব দিক থেকে ঢোকা যায়।
হুঁ, তা ঠিক। আমার গাছগুলো কে চুরি করেছে, বলেছে নাকি? জানতে চাইলেন মিস্টার ব্রুক।
ওই দুই শয়তানই লোক দিয়ে করিয়েছে, কিশোর জানাল। এনডি আর কোরি। আপনি যে ভেবেছেন বিক্রির জন্যে নিয়ে গেছে, তা না; আসলে বিরক্ত করে করে আপনাকে বিয়ে করার জন্যে।
সে তো বোঝাই যাচ্ছে এখন, মাথা দোলালেন মিস্টার ব্রুক। আর টাকা খেয়ে ওদের সহায়তা করে এসেছে শয়তান গেকোটা।
তাই তো, গিরগিটিটার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, খেতে খেতে মুখ তুলল মুসা। ওটার কি গতি করেছে মিয়ামি, পুলিশ? নারকেল গাছে তুলে দিয়ে গেছে, যেখানে ওর আসল বাসা?
হাসলেন মিস্টার ব্রুক। না, নারকেল গাছে তোলেনি। তবে শাসিয়ে দিয়ে গেছে, দ্বীপের কারও ব্যাপারে যেন আর নাক না গলায়। ওর জায়গায় একজন অফিসারকে বসিয়ে গেছে অস্থায়ী ভাবে দ্বীপে পুলিশের দায়িত্ব পালনের জন্যে। বলে গেছে যত শীঘি পারে কাউন্টিতে নালিশ করে ওর ডেপুটিগিরি খতম করে ওকে জেলে ভরার ব্যবস্থা করবে।
মজার ব্যাপারটা কি জানেন? আবার আগের কথায় ফিরে এল কিশোর। নীরা লেভিন কিন্তু ওদের সঙ্গে থেকেও জানত না কেইনের আসল ব্যবসাটা কিসের। তাকে বলা হয়েছিল এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা আছে কেইনের। সে একজন বিরাট বড়লোকের স্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল। সেজন্যেই পুরো দ্বীপটা কিনে নেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করে আসছিল কেইনকে। একটু-আধটু অপরাধ করে ফেলেছিল।
বহু জায়গা এখন খালি পড়ে আছে দ্বীপে, মিস্টার ফ্রক বললেন। সব নীরার কেনা, তার নিজের নামে। অনেকেই তার কাছে জমি বেচে দিয়ে চলে গেছে। অনেকে বাড়িঘরের কাজ শুরু করেছিল মাত্র, তাদের জায়গাও কিনে নিয়েছে নীরা।
তার অত সাধের কেইন তো গেছে চোদ্দ শিকের আড়ালে, মুসা বলল। এখন এসে ওসব জায়গা ভোগ করুক। ইচ্ছে করলে তাবু খাঁটিয়ে বাস করতে পারে।
যদি সে-ও বেরোতে পারে শিকের আড়াল থেকে, ফোড়ন কাটল রবিন।
তা পারতেও পারে, কিশোর বলল। যে রকম খেপেছে কেইনের ওপর, ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতেও দ্বিধা করবে না। তার শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে তখন তাড়াতাড়িই ছেড়ে দেয়া হবে জেল থেকে।
তা তো হলো, জিনা বলল। কিন্তু আমরা এখন কি করব? বাড়ি ফিরে যাব?
উঁহু, অত তাড়াতাড়ি না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল মুসা। কিছুই দেখা হলো না এখানকার সমুদ্র। শুনেছি, পুরানো আমলে আশেপাশে প্রচুর জাহাজডুবী হয়েছে। সমুদ্রে ডুব দিয়ে দিয়ে গুপ্তধন খুঁজব। তা ছাড়া কেগের দাওয়াতটার কথা ভুলে যাচ্ছ কেন? না খেয়ে চলে গেলে নিরাশ হবে না ভদ্রলোক?