১৬.

আধঘণ্টা পর ফিরে এল মুসা। কপালে ঘাম। চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল। হেসে বলল, বাইকটা ফেলে দিয়েছি একটা ডোবায়। চাবি রেখে এসেছি একটা পিলার বক্সে। কিছু সময়ের জন্যে আটকে দিলাম ব্যাটাদের।

রাবাতের দিকে তাকাল সে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, নানা, কি হয়েছিল? এত গালাগাল শোনার শখ হলো কেন হঠাৎ? প্রচুর তো শুনলে-বাদুড়, ভাম! বাড়ি গিয়ে মাকে যদি বলি…কথা শেষ করতে পারল না হাসির জন্যে। মা এবং নানার কি চেহারা হবে কল্পনা করে হা-হা করে। হাসতে শুরু করল।

কিছুটা বিব্রত দেখাল রাবাতকে। আগে জানা থাকলে ধরতে পারত না। হঠাৎ করে এসে চমকে দিয়েছিল। যেটা থেকে তেল নেব বলেছিলাম সেটাতে ভিড় থাকায় মোড়ের পাম্পটায় চলে গেলাম। পেট্রোল নেয়ার পর মনে হলো, ট্যাংকের নিচে আবার যন্ত্র আটকে দেয়নি তো মিলার? রাস্তার ধারে সরে গিয়ে গাড়ির নিচে উঁকি দিয়ে দেখতে গেলাম। এই ফাঁকে আমার অজান্তে পাশে এসে দাঁড়াল শয়তান দুটো। ছুরি বের করে ভয় দেখাল, ওদের কথা না শুনলে হুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেবে। পিকনিক গ্রাউন্ডে গাড়ি নিয়ে যেতে বাধ্য করল আমাকে।

গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে রয়েছেন আপনি। এখনও যে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি, এটাই বেশি।

থাক, অত ভাবতে হবে না, হাত নাড়লেন রাবাত। আমি তখন সতর্ক ছিলাম না বলে বেকায়দায় পেয়ে গিয়েছিল। এরপর এলে আর সহজে ছাড়ব না, খানিকটা শিক্ষা দিয়ে দেব।

কি ভাবে শিক্ষাটা দেবে, বুঝতে পারল না মুসা। তবে নানাকে জিজ্ঞেস করার সাহসও হলো না। পুলিশকে জানালে কেমন হয়?

আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে ওদের আর জড়াতে চাই না। ওই হাদাগুলো এসে করবেই বা কি? শুধু শুধু একগাদা প্রশ্ন করে কেবল সময় নষ্ট করবে। শহর থেকে বেরিয়ে পশ্চিমে রওনা হয়ে যাব, তাহলেই হবে।

পশ্চিমে?

হ্যাঁ। ওদিকে যাব ভাববেই না ওরা। গুণ্ডাগুলোও না, মিলার আর তার দোস্তও না। পশ্চিমের কোন শহরে উঠে পুরানো গাড়ির দোকানে যাব। বুইকটা বেচে দিয়ে অন্য গাড়ি নিয়ে নেব। আবার রওনা হব নিউ ইয়র্কের দিকে। বুইকটা না দেখলে ওরা চিনতে পারবে না, আমরাও জ্বালাতন থেকে বাঁচব।

নানার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল মুসা, হ্যাঁ, এইটা ভাল বুদ্ধি। বুইকটাই হচ্ছে যত নষ্টের মূল। মিলার, তার দোস্ত, মোটর সাইকেলওয়ালারা, সবাই চিনে গেছে এটাকে। ওদের খসাতে হলে গাড়িটাই বিদেয় করতে হবে।

জলদি মালপত্র গুছিয়ে নে। এখুনি বেরোব।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার হাইওয়েতে এসে উঠল ওরা। পশ্চিমে চলল। মধ্যরাতে ওহাইও আর পেনসিলভানিয়ার সীমান্তে একটা শহরে ঢুকল। রাস্তাগুলো সব নির্জন। বেশির ভাগ বাড়িরই আলো নিভে গেছে। তবে হাইওয়ের পাশে হলিডে ইন হোটেলটায় আলো জ্বলছে। ঘর নিতে অসুবিধে হলো না। বাকি রাতটা নিরাপদেই ঘুমিয়ে কাটানো গেল। পরদিন সকালে উঠেই চলে এল একটা গাড়ির দোকানে। তখনও খোলেনি দোকানটা। অপেক্ষা করতে হলো ওদের।

অবশেষে দোকান খুলল। বুইকটার জন্যে যা দাম দিতে বলল সেলসম্যান, দর কষাকষি না করে তাতেই রাজি হয়ে গেলেন রাবাত। দুই বছরের পুরানো একটা ফোর্ড সেডান কিনে নিলেন। বুইকের দাম বাবদ যা কাটা গেল, সেটা বাদ দিয়ে বাকি টাকার চেক লিখে দিলেন। তারপর আবার অপেক্ষার পালা। লং ডিসট্যান্ট কল করল সেলসম্যান। চেকটা ঠিক আছে। কিনা ব্যাংকে ফোন করে জেনে নেয়ার জন্যে।

ফোর্ড গাড়িটা নিয়ে দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে দুপুর পেরিয়ে গেল।

এইবার আশা করি ঝেড়ে ফেলা যাবে ওদের, রাবাত বললেন। কড়া নজর রেখেছেন মিলার আর তার দোস্তকে দেখা যায় কিনা। বড় করে হাই তুললেন, চোখ ডললেন। নাহ, বয়েস বেড়েছে আমার। ধকল আগের মত সহ্য করতে পারব না, ভুলেই গিয়েছিলাম। আর বেরোতে ইচ্ছে করছে না। আজ বরং এখানেই থেকে যাই। বিশ্রাম নিই। মিলারের ভয় আর না করলেও চলবে। ফোর্ডটা চিনতে পারবে না ও, আমাদেরও খোঁজ পাবে না।

আপত্তি তো নেইই, বরং খুশি হয়ে রাজি হলো গোয়েন্দারা। এই একটানা ছোটা ওদেরও ক্লান্ত করে তুলেছে। হলিডে ইনে ফিরে এল ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাবাতের নাক ডাকানোর শব্দ শোনা গেল।

মোটেলের পুলে সাঁতার কাটল তিন গোয়েন্দা। কাছের একটা ছোট গলফ কোর্সে গলফ খেলল। বেশি দূরে গেল না। সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফিরে এল। মুসা আর রবিন টেলিভিশন দেখতে লাগল। জানালার কাছে বসে কিশোর তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। বার বার ভ্রুকুটি করছে আর নিচের ঠোঁট ধরে টানছে। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। আচমকা মাথা ঝাঁকিয়ে আনমনেই বলল, ঠিক, এটাই আসল ব্যাপার!

ফিরে তাকাল অন্য দুজন।

কোনটা আসল ব্যাপার? জানতে চাইল রবিন।

রাবুনানার আবিষ্কারের প্রতি কোন আগ্রহ নেই মিলারের, কিশোর বলল। কোনকালে ছিলও না।

স্তব্ধ হয়ে গেল মুসা। খাইছে! বলো কি! আগ্রহ না থাকলে আমাদের পিছু নিয়েছে কেন? কাস্টারে নেমে আমরা যখন বন দেখতে গেলাম, আমাদের পিছু নিল, তখন পিস্তল বের করেছিল কেন? তুমি কি বলতে চাইছ পিস্তল দিয়ে বাইসন শিকারে এসেছে সে?

সুপারমার্কেটে আমাকেই বা ধরেছিল কেন তার দোস্ত? রবিন বলল।

ওর কথাই ভাবছি আমি, কিশোর বলল। কেশে গলা পরিষ্কার করে সোজা হয়ে বসল। সুপারমার্কেটে ঠিক কি বলেছিল তোমাকে লোকটা, রবিন?

বলেছিল, আমি নাকি ওর ছেলে, নেশা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি, আমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছে। অতি সহজ চালাকি। আমাকে আটকে রেখে রাবুনানার কাছে মুক্তিপণ হিসেবে তাঁর আবিষ্কারটা চাইবে। জিনিসটা কি, বলো তো? কোন ধরনের অস্ত্র? নাকি দেশরক্ষা বাহিনীর কাজে লাগে এমন কিছু?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, ম্যানেজারকে কি বলেছে লোকটা, সেটা শুনতে চাই না। ঢুকেই তোমাকে কি বলেছিল?

তোমার সঙ্গে নেই ওটা। তবে অসুবিধে নেই। আদায় করে নিতে পারব।

তখন তোমার সঙ্গে কি জিনিস ছিল না?

আর কি? ঢোঁক গিলল রবিন। নিশ্চয় রাবুনোর আবিষ্কার।

কেন, আর কিছু হতে পারে না? এমন কিছু, যা সব সময় তোমার সঙ্গে থাকে, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় ছিল না?

ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন। কিসের কথা বলছ?…ও, ক্যামেরাটা? ক্যামেরা এবং ক্যামেরার ব্যাগ। কিন্তু ওই সাধারণ জিনিসের প্রতি আগ্রহী হবে কেন লোকটা?

হাসল কিশোর। ক্যামেরার ব্যাগে তোমার ব্যবহার করা ফিল্মগুলো ছিল। মোটেলে রেখে গিয়েছিল। ওগুলোই চাচ্ছিল সে। কোন সন্দেহ নেই আর আমার।

হেলান দিয়ে বসে দুই হাতের আঙুলের মাথাগুলো এক করল কিশোর, তাতে দেখাল অনেকটা তাবুর চুড়ার মত। হাসিটা লেগে আছে মুখে। পিজমো বীচে তার ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন রাবাত, চেহারাটা কি হয়েছিল মনে আছে? সাংঘাতিক চমকে গিয়েছিল। আতঙ্কিত। আমার বিশ্বাস, আমরা যা ভাবছি সে-কারণে পিজমো বীচে যায়নি সে, গিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে।

ধরা যাক, ঘটনাক্রমেই আমাদের সঙ্গে ওখানে মিলারের দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ওপর নজর রাখার জন্যে আসেনি। রাবুনানার বাড়িতেও আমরা বেরিয়ে আসার পর যে উঁকি মেরে দেখেছিল, সেটাও খুব সাধারণ ব্যাপার। উঁকিঝুঁকি মারা ওর স্বভাব। এক ধরনের কৌতূহল, পড়শীর ব্যাপারে যেমন থাকে কারও কারও। আমার চলে আসার পর মনটিরেতে কারও সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিল সে। আমরা সান্তা বারবারায় থেমে লাঞ্চ খেলাম, কিন্তু সে সোজা চলে গেল পিজমো বীচে। সেখানে গিয়ে হয়তো খাওয়া সেরেছে, বা বিশ্রাম নিয়েছে। তারপর আমরা গেলাম। সৈকতে একই সময়ে বেরিয়েছিলাম। রাবুনো তো দেখেই গেলেন রেগে। মিলারের চোখে বিস্ময় দেখেছি আমি। ওর চেহারা মনে আছে?

সৈকত ধরে হেঁটে শহরের দিকে চলে গিয়েছিল সে। তারপরই বদলে গেল পরিস্থিতি। মনটিরেতে কি কি ঘটেছিল, মনে আছে তোমাদের?

আছে, মুসা বলল। আবার ওর সঙ্গে সৈকতে দেখা হলো আমাদের। অন্য লোকটাকেও ওখানেই দেখলাম–ক্যামেরার দোকানে রবিনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল যে।

হ্যাঁ। বাজি রেখে বলতে পারি ফিশারম্যান ওআর্কে আমাদের পিছু নিয়ে আসেনি মিলার। তাহলে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করত। এমন ভাবে চলাফেরা করত, যাতে আমাদের চোখে না পড়ে। কিন্তু তা সে করেনি। খোলাখুলিই সৈকতে হাঁটছিল সে, আর দশজন সাধারণ টুরিস্টের মত।

চোখের ওপর দুহাত চেপে ধরল কিশোর। পুরো দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করছে। খুঁটিনাটি বাদ না দিয়ে।

মিলারের কাছেও একটা ক্যামেরা ছিল সেদিন, অবিকল রবিনেরটার মত। কিন্তু ছবি তুলছিল না। হাতে রেখে দিয়েছিল। তারপর দ্বিতীয় লোকটা এল। তাকে বলল মিলার–এনেছি ওটা। এর মানে কি? দ্বিতীয় লোকটার জন্যে কিছু নিয়ে এসেছিল মিলার। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে একটা বেঞ্চের সামনে দাঁড়াল, যেটাতে তখন রবিন বসেছিল। আমাদের চিনতে পারল মিলার। কি রকম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল মুখ মনে আছে? স্যুভনিরের দোকান থেকে রেগেমেগে বেরিয়ে এলেন রাবুনো। দেখেই কেটে পড়ল মিলারের সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকটা। মিলারকে চেপে ধরলেন রাবুনো। ধমকাতে শুরু করলেন।

আবারও ভয় পেয়ে গেল মিলার। ওখানে রাবুনানাকে আশা করেনি, তাহলে নিশ্চয় আসত না। মিলারকে ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে তার সঙ্গে যেতে বললেন রাবুনো। বেঞ্চে রাখা ক্যামেরাটা তুলে নিল রবিন। রওনা হলাম আমরা।

ওই সময় থেকেই শুরু হয়েছে যত গণ্ডগোল। আমাদের পিছু নিল মিলার। মনে আছে, আমাদের গাড়ির পেছন পেছন কি ভাবে দৌড়ে এসেছিল? কিছু বলছিল, আমরা বুঝতে পারিনি?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

রবিন তাকিয়ে রইল কিশোরের দিকে। ঠিক! কেন এসেছিল?

কারণ, যে ক্যামেরাটা তুমি তুলে নিয়েছিলে, ওটা তোমার ছিল না, রবিন। ওটা মিলারের। রাবুনানাকে তেড়ে আসতে দেখে আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে তাড়াতাড়ি রেখে দিয়েছিল বেঞ্চে।

তারমানে তুমি বলছ, মুসা বলল, ক্যামেরার পেছনেই লেগেছে সে? কিন্তু এরও তো কোন মাথামুণ্ড নেই। তার ক্যামেরা সে ফেরত চায়। মোটেলে এসে আমাদের দরজা খটখটালেই তো হত। বলত, তার ক্যামেরা ভুল করে আমরা নিয়ে এসেছি। ফেরত দিয়ে দিতাম। সাত রোজাতেই ফেরত নিয়ে যেতে পারত। এত চালাকি, এত পিছু নেয়ার কোন প্রয়োজন। পড়ত না।

 শুধু ক্যামেরা হলে হয়তো তাই করত, কিংবা তা-ও করত না। মনটিরে থেকে সান্তা রোজায় গাড়ি চালিয়ে আসা কম ঝক্তি নয়, সাধারণ একটা ক্যামেরার জন্যে এ-কাজ করবে? তারপরও থামেনি। দীর্ঘ পথ আমাদের পিছে পিছে এসেছে। আমার ধারণা, ক্যামেরা নয়, ভেতরের ফিল্মের জন্যেই এমন করছে। ওটা ওদের কাছে দামী। ওই ফিল্মে কি আছে, সেটা আমাদের জানতে দিতে চায় না ওরা।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল রবিন, এইটা হতে পারে। এতক্ষণে বুঝতে পারছি। মনটিরে থেকে আসার পর এত তাড়াতাড়ি ফিল্ম ফুরিয়ে গেল কেন ক্যামেরার, কেন ক্যামেরা আর তার ব্যাগটা অন্য রকম লাগল। তখনও পুরোপুরি ধরতে পারিনি ব্যাপারটা, দুটোই নতুন ক্যামেরা বলে। তবে পরিবর্তন একটা টের পেয়েছি। ক্যামেরা বদল হতে পারে, ভাবলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলতাম। উঠে গিয়ে ক্যামেরার ব্যাগটা এনে বিছানায় উপুড় করল সে। নয় রোল ফিল্ম পড়ল বিছানায়, তার মধ্যে একটা কেবল নতুন, ব্যবহার করা হয়নি। বাকিগুলো ছবি তুলে শেষ করে ফেলা হয়েছে, ডেভেলপ করতে হবে। চলো, ক্যামেরার দোকানে। দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডেভেলপ করে দেয় এমন দোকান নিশ্চয় আছে।

বেরিয়ে পড়ল ওরা। হোটেল থেকে তিন ব্লক দূরে ছোট একটা মলে পাওয়া গেল ক্যামেরার দোকান। কাউন্টারে বসা মহিলাকে ফিল্মগুলো বের করে দিল রবিন। ডেভেলপ করতে সময় লাগবে। বিভিন্ন দোকানের ডিসপ্লে উইন্ডোতে রাখা জিনিস দেখে সময় কাটাতে লাগল ওরা।

কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এল ক্যামেরার দোকানে। শক্ত হলুদ কাগজের বড় একটা খাম ঠেলে দিল মহিলা। উত্তেজনায় প্রায় কাঁপতে কাঁপতে ওটা নিয়ে পার্কিং লটের দিকে এগোল রবিন। একটা নির্জন জায়গায় এসে খাম থেকে ছবির প্রিন্টগুলো বের করে দেখতে লাগল। দুপাশে দাঁড়িয়ে পাহারা। দিতে লাগল মুসা আর কিশোর। বার বার এদিক ওদিক চেয়ে দেখছে কেউ তাকিয়ে আছে কিনা। মাউন্ট রাশমোরে রাবুনো, কাস্টার পার্কে বাইসনের পাল, ব্যাডল্যান্ডের নানা রকম পাথরের ছবি। তার মধ্যে একটা বিমানের ছবি, রানওয়েতে ছুটতে ছুটতে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এটা আমি তুলিনি, রবিন বলল।

ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল মুসা। চেহারাটা বেশ ছিমছাম বিমানটার। বেশি সরু, অনেক লম্বা ছুঁচাল মাথা, পেটের কাছে ডানাদুটো হাঙরের পিঠের পাখনার মত চোখা হয়ে পেছনে বেঁকে গেছে। যাত্রীবাহী প্লেন নয়, আর্মির জিনিস।

বাকি ছবিগুলো ঘটতে লাগল রবিন। আরও কয়েকটা ছবি পাওয়া গেল, যেগুলো সে তোলেনি। তেল শোধনাগার আর ভারী মাল তোলার এলিভেটরের মাঝামাঝি কিছু যন্ত্র দেখা গেল। খুব কাছে থেকে তোলা ড্রয়িং আর নকশার ছবি রয়েছে। বোর্ডে পিন দিয়ে আটকানো আছে জিনিসগুলো। নোটবুকের কিছু লেখা পাতার ছবি আছে। নানা রকম সমীকরণ, নোট, অর্থহীন শব্দমালা লেখা রয়েছে পাতাগুলোতে, যেগুলো পুরোপুরি দুর্বোধ্য ওদের কাছে।

ছবিগুলো দেখা শেষ করল রবিন। ঘেমে গেছে। হু, মাথা দুলিয়ে বলল সে, এ সব জিনিসই তাহলে দ্বিতীয় লোকটাকে দিতে যাচ্ছিল মিলার! মনে তো হচ্ছে আর্মির গোপন কোন ব্যাপার! মিলার একটা স্পাই, দেশের বাইরের শত্রুর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছিল এ সব তথ্য!

.

১৭.

এফ বি আইকে জানাতে হবে! চিৎকার করে উঠলেন রাবাত। ওরাই শয়তানগুলোর ব্যবস্থা করবে।

টেলিফোন ডিরেক্টরি টেনে নিয়েছে ততক্ষণে মুসা। দেখে বলল, এখানে নেই। এই শহরে এফ বি আইয়ের অফিস নেই।

না থাকারই কথা। নিউ ইয়র্কে গিয়ে ওদের জানাতে হবে। চল চল, এখনই রওনা হব। সুটকেস গোছা।

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। সারারাত গাড়ি চলল একটানা। ভোররাতে আকাশ যখন ধূসর হয়ে আসছে তখন একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকল। সাদা পাথরের দেয়াল। প্রচুর গাড়ি চলাচল করছে। সুড়ঙ্গের অন্য পাশে আসতে চোখে পড়ল আকাশ ছোঁয়া দালান, প্রায় জট বেধে থাকা যানবাহনের ভিড়। প্রকাণ্ড পেনসিলভানিয়া স্টেশনের প্রকাণ্ড বাড়ির সামনে জায়গা দখলের জন্যে গুতোগুতি শুরু করেছে শত শত ভাড়াটে ট্যাক্সি।

স্টেশনের সামনে রাস্তার অন্য পাড়ে গাড়ি রাখলেন রাবাত। কিশোর নেমে গিয়ে একটা বিল্ডিঙে ঢুকল। টেলিফোন বুক দেখে এফ বি আই-র ঠিকানা জানার জন্যে। গাড়িতে বসে রইল অন্য দুই গোয়েন্দা, কিশোর কি খবর নিয়ে আসে শোনার জন্যে উদ্বিগ্ন।

সাড়ে নটার দিকে অফিসটা খুঁজে পেলেন রাবাত। ভেতরে ঢুকে একজন মানুষকে বসে থাকতে দেখা গেল। তার নাম হোগারসন। নিখুঁত একজন মানুষ–সুন্দর করে আঁচড়ানো বালি রঙের চুল, সাদা দাঁত, শান্ত, নরম। ব্যবহার, আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত মেলাল। মিলার আর তার দোস্তের অপকর্মের কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রাবাত, শেষ দিকে তো রীতিমত খেপে গেলেন। কথা আটকে যেতে শুরু করল।

ধৈর্য হারাল না হোগারসন। তাকে শান্ত হওয়ার সুযোগ দিল।

মুসা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল, নানা, প্লীজ, অত রেগে যাওয়ার কিছু নেই। আমরা যা ধারণা করেছি তা না-ও হতে পারে। মিস্টার হোগারসনকে বরং ছবিগুলো দেখাও।

নিশ্চয়! আছাড় দিয়ে ছবির খামটা টেবিলে রাখলেন রাবাত। এগুলো ক্যামেরার মধ্যে ছিল। রবিন ভেবেছিল ওটা ওরই ক্যামেরা। ভুল করে ওরটা নিয়ে চলে গেছে স্পাইটা। মিলার বেঈমানটা এগুলো বিক্রি করে দিতে যাচ্ছিল বিদেশী শত্রুর কাছে।

ছবিগুলো দেখল হোগারসন। চেহারার ভাব একই রকম রইল, বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না।

ব্যাপারটা কেমন যেন লাগল কিশোরের। মনে হলো, রাবাতের কথায় বোধহয় গুরুত্ব দিচ্ছে লোকটা। বলল, মিস্টার হোগারসন, আগে আমাদের পরিচয়টা দিয়ে নেয়া দরকার। পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বাড়িয়ে দিল।

কার্ডটা দেখল হোগারসন। প্রশ্ন করার জন্যে মুখ খুলল। কিন্তু তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কিশোর বলল, আমি কিশোর পাশা, আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। ক্যালিফোর্নিয়ার রকি বীচে আমাদের হেড কোয়ার্টার। যে কোন ধরনের রহস্যের ব্যাপারে আমরা আগ্রহী। অনেক ছোটবেলা থেকে গোয়েন্দাগিরি করে এসেছি, শখানেকের বেশি রহস্যের সমাধান করেছি। কিছু কিছু তো এতটাই জটিল ছিল, পুলিশও হাল ছেড়ে দিয়েছিল। সুতরাং এ সব ব্যাপারে আমরা একেবারেই আনাড়ী, এ কথা বলতে পারবেন না।

এই প্রথম রবিনের মনে হলো হোগারসনের নির্বিকার মুখে অতি সামান্য উজ্জলতা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। কার্ডটা টেবিলে রাখল।

মুসা বলল, মিস্টার হোগারসনকে সব বলো, কিশোর।

মনটিরেতে কি করে ক্যামেরা বদল হয়েছে, খুলে বলল কিশোর। গণ্ডগোল এখান থেকেই শুরু। তারপর নানা ভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে আমাদের। সারাক্ষণ টেনশনে রেখেছে।

এক মুহূর্ত স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি আমাদের! কণ্ঠস্বর দাবিয়ে রাখতে পারলেন না রাবাত।

তাঁকে কথা বলতে দিল না কিশোর। নিজে বলতে লাগল সব। মোটেলের ঘরে আগুন লাগা থেকে শুরু করে, কাস্টার ন্যাশনাল পার্কে পিস্তল হাতে অনুসরণ, মিশিগানে রবিনকে অপহরণের চেষ্টা, কোন কথাই বাদ দিল না।

মিশিগানের স্টারজিসে ঘটেছে ঘটনাটা, কিশোর বলল। কয়েক দিন আগে। সুপারমার্কেটের অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার ডেপুটি শেরিফকে ডেকে এনেছিল। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। শেরিফের অফিসে নিশ্চয় রেকর্ড রাখা হয়েছে।

চুপ করে আছে হোগারসন। আর কিছু বলে কিনা কিশোর, শোনার অপেক্ষা করল। মাথা ঝাঁকাল তারপর। শুধু বলল, হু।

সব কথা উগড়ে দিতে পেরে, সন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারে পিঠ ঠেকাল কিশোর।

রাবাত বললেন, ওই ছুঁচো মিলারটা একজন সাংঘাতিক পাই। আর তার দোস্তটা নিশ্চয় বিদেশী শত্রুদের চর।

হোগারসন হাসল। কোন দেশ?

তাতে কি কিছু এসে যায়?

না, তা হয়তো যায় না।

ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে ছবির খামটা সহ উঠে চলে গেল। হোগারসন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানাল, তার সহকর্মীরা খোঁজখবর শুরু করেছে। গোয়েন্দাদের যোগাযোগ রাখতে বলল।

নিউ ইয়র্কে কোথায় উঠছেন আপনারা? জিজ্ঞেস করল হোগারসন।

ইস্ট সাইডের ঘোট একটা হোটেলের নাম বললেন রাবাত, রিয়ারভিউ প্লাজা। লিখে নিল হোগারসন।

হঠাৎ সন্দেহ জাগল রাবাতের, আচ্ছা, রুম পাওয়া যাবে তো ওখানে? ভর্তি হয়ে যায়নি তো?

কয়েক মিনিট বসলে আমরাই সেটা জেনে দিতে পারি, হোগারসন বলল।

আবার উঠে চলে গেল সে। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে বলল, রিয়ারভিউ প্লাজায় দুটো রুমের কথা বলে এসেছে। খালি আছে।

যদি আর কিছুর দরকার পড়ে, কিংবা মিলারের সঙ্গে দেখা হয়, দয়া করে আমাদের জানাবেন, অনুরোধ করল হোগারসন। তার নাম লেখা কার্ড দিল।

গোয়েন্দারা বুঝল, তাদের কথায় গুরুত্ব দিয়েছে এফ বি আই। তদন্ত শুরু করেছে। সন্তুষ্ট হয়ে বেরিয়ে এল ওরা। সারি দিয়ে লিফটের দিকে এগোল। নেমে এল নিচে। হোটেলে চললেন রাবাত। পুরানো বাড়ি। এক সময় নদীর দিকে মুখ করা ছিল। এখন চারপাশে বড় বড় বিল্ডিং গজিয়ে ঘিরে ফেলেছে বাড়িটাকে। আঙিনায় ঢুকতেই গাড়ির দায়িত্ব নিয়ে নিল হোটেলের একজন অ্যাটেনডেন্ট। চালিয়ে নিয়ে চলে গেল পার্কিং লটে। লটটা কোথায় বোঝা গেল না। আরেকজন অ্যাটেনডেন্ট ওদের সুটকেসগুলো বয়ে নিয়ে চলল ওপরতলায়। ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। জানালায় হালকা ঘোলাটে কাচ। তার ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে অন্য একটা বাড়ির কাঁচে ঘেরা অফিস দেখতে পেল কিশোর। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। কয়েক সারি কম্পিউটারের সামনে বসে কাজে ব্যস্ত নারী-পুরুষ।

একঘেয়ে দৃশ্য। ভাল লাগল না কিশোরের। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় এসে উঠল। চোখ মুদে ভাবতে লাগল, তদন্ত শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে এফ বি আইয়ের? মিলার আর সেই লোকটার ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেবে? আর কিছু ভাবতে পারল না। ঘুমিয়ে পড়ল।

স্বপ্ন দেখল, বাড়িতে রয়েছে। স্যালভিজ ইয়ার্ডে। জঞ্জালের ভেতরে লুকানো ট্রেলারে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে ঢুকছে গোপন সুড়ঙ্গপথে। তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে তাকে, কারণ টেলিফোন বাজছে… বেজেই চলেছে…

উত্তেজিত অবস্থায় ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘেমে গেছে। টেলিফোন আসলেও বাজছে, তবে হোটেলে তাদের ঘরে রাখা ফোনটা। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল রবিন। ঘুম জড়িত চোখে তাকিয়ে আছে কিশোর। রবিনকে বলতে শুনল, হ্যাঁ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়!

রিসিভার রেখে কিশোরকে বলল, লবি থেকে হোগারসন ফোন করেছে। ওপরে আসছে।

হুড়াহুড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। মুসা দৌড় দিল নানাকে জাগানোর জন্যে। আলুথালু পোশাকে খালিপায়েই ছুটে এলেন। রাবাত। ঠিক এই সময় দরজায় টোকা পড়ল।

সঙ্গে করে আরেকজনকে নিয়ে এসেছে হোগারসন। তার চেয়ে লম্বা, বয়েসও কিছু বেশি। পরিচয় করিয়ে দিল, এজেন্ট পিটারম্যান। চেয়ারে বসল দুজনে। হোগারসন চুপ করে রইল, কথা বলতে লাগল পিটারম্যান।

মিলারের সম্পর্কে বেশির ভাগ প্রশ্নেরই জবাব দিলেন রাবাত। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। সকালের মত উত্তেজিত হলেন না, বলতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেললেন না। জানালেন, মিলারের ব্যাপারে কমই জানেন তিনি, অথচ বেশ কয়েক বছর ধরে লোকটা তার পড়শী, এত কাছাকাছি থাকলে আরও অনেক বেশি জানার কথা ছিল। কোন ধরনের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করে লোকটা, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব নেই–অন্তত রাবাত দেখেননি, অর্কিড জন্মানোর হবি। আর যে লোকটা মনটিরেতে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, রবিনকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল, তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বারোটা ছবি দেয়া হয়েছিল হোগারসনকে। সেগুলো বের করল পিটারম্যান। দ্বিতীয় লোকটার ছবি এর মধ্যে আছে কিনা জিজ্ঞেস করল। ছবিটা বের করে দিল রবিন। পুলিশের তোলা সাধারণ ছবি নয়। দামী পোশাক পরা অবস্থায় ভোলা হয়েছে। জায়গাটা দেখে মনে হলো বিমান বন্দর অথবা কোন রেল স্টেশনে রয়েছে। গেট দিয়ে বেরোচ্ছে। যেন এইমাত্র নামল। বিমান কিংবা ট্রেন থেকে।

এর পরিচয় জানা গেছে? জানতে চাইল রবিন। রেকর্ড খারাপ, না ভাল?

ছবিটা খামে ভরে আবার পকেটে রেখে দিল পিটারম্যান। আগেও এর সঙ্গে গণ্ডগোল হয়েছে আমাদের। নাম একটা জানি, তবে সম্ভবত এটাও অনেকগুলো ছদ্মনামের একটা। ব্যালার্ড।

সঙ্গে করে আনা একটা অ্যাটাশে কেস খুলল হোগারসন। কয়েক রোল। ফিল্ম বের করল। দেখে মনে হলো, ব্যবহার করা হয়ে গেছে ওগুলো। ডেভেলপের অপেক্ষায় আছে। রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, রবিন, একটা সাহায্য করবে? তোমার ক্যামেরার কেসে ভরে রাখো এগুলো। অনেক উপকার হবে আমাদের। কেসটা চুরি যাওয়া নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। যায় যাক। নষ্ট ফিল্ম এর ভেতরে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত, প্রবল আপত্তি জানালেন, না না, এটা করা উচিত হবে না! ছেলেটাকে ফাঁদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। বিপদে পড়তে পারে ও। ওকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে ওর। বাবা-মা। আমি ওর ক্ষতি হতে দিতে পারি না।

হাসল হোগারসন। মিস্টার রাবাত, ভুল করছেন, ওকে টোপ আমরা বানাচ্ছি না। টোপ সে হয়েই আছে। তাকে বরং বাঁচানোর চেষ্টা করছি। মিলার আর তার সঙ্গী আপনাদের খুঁজে বের করবেই। ফিল্মটা ওদের চাই। রবিনকে আবার ধরবে ওরা। তখন যদি সে ফিল্ম দিতে না পারে, কি ঘটবে বুঝতে পারছেন?

বজ্রাহত মনে হলো রাবাতকে। বসে পড়লেন আবার। তারমানে কিছু একটা গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে সে। আপনারা তার ওপর নজর রাখবেন। তাকে অনুসরণ করবেন। যেই ওকে ধরবে, আপনারা ওদের আটকাবেন।

স্বীকারও করল না দুই এজেন্ট, অস্বীকারও করল না। কেবল রাবাতকে অনুরোধ করল, তারা নিউ ইয়র্ক কিংবা হোটেল ছেড়ে যাওয়ার আগে যেন ওদেরকে একটা খবর দিয়ে যান। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল দুজনে।

দরজা বন্ধ করেও সারতে পারল না মুসা, চেঁচিয়ে উঠল রবিন, দারুণ হয়েছে। কাউন্টারস্পাই হিসেবে কাজ করার সম্মান দেয়া হলো আমাকে! এতদিন আমরা ছিলাম শিকার, এখন হলাম শিকারী। ডাকাতগুলো লেগে ছিল, আমাদের পেছনে, আমরা লাগব এবার ডাকাতের পিছে!

ডাকাত নয়, স্পাই, মনে করিয়ে দিল মুসা।

ওই হলো। স্পাইরাও আমার মতে একধরনের ডাকাত।

অত খুশি হয়ো না! গম্ভীর হয়ে বললেন রাবাত। তোমাকে ওরা টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে! শান্ত থাকার চেষ্টা করছেন তিনি, পারছেন না। কল্পনাও করতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত এফ বি আইয়ের হয়ে কাজ করতে হবে। পড়শীকে ধরার জন্যে ফাঁদ পাততে হবে সুদূর নিউ ইয়র্কে এসে!

.

১৮.

 আর কত! ভোতা স্বরে বলল রবিন। চার চারটে দিন পেরিয়ে গেল, ওদের ছায়াটির দেখাও নেই!

দোষটা আমাদেরই, মুসা বলল, আমরাই তো খসানোর চেষ্টা করেছি। এখন পাওয়া যাবে কেন?

চুপ করে আছে কিশোর। আমেরিকান মিউজিয়াম অভ-নেচারাল হিস্টরির সামনে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে তাকিয়ে আছে চত্বরে দানা খুঁটে বেড়ানো কবুতরের ঝাকের দিকে। রাবাতের দিকেও লক্ষ রেখেছে।

শব্দ করে পাশের রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। বিরক্ত চোখে ওগুলো দেখছেন বৃদ্ধ। রাগ হচ্ছে ভীষণ। গত চারদিনে একটি বারের জন্যে যেতে পারেননি–আবিষ্কার নিয়ে যেখানে যাওয়ার কথা, এত কাঠখড় পুড়িয়ে যাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তিনি। কারও সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারেননি। সারাক্ষণ কেবল একই চিন্তা, একই কাজ–মিলার আর তার দোস্তকে আড়াল থেকে টেনে বের করে আনা। হোটেল থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল, সতর্ক হয়ে ওঠে তার চোখের তারা। উত্তেজিত হয়ে যান। রবিনের কাছ ঘেঁষে থাকেন, সরেন না মুহূর্তের জন্যেও।

জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পটগুলোতে তাদের খোঁজা হতে পারে অনুমান করে ওসব জায়গাতেই এসে বসে থাকেন। নিউ ইয়র্ক সিটির দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘোরাফেরা করেন। সারাক্ষণ ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখে রবিন। যেখানে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ফিল্মের রোলগুলো বের করে দেখে। কেউ যদি চোখ রাখে, যাতে মনে করে ওগুলো ডেভেলপ করার অপেক্ষায় আছে।

প্রথম দিন জাহাজে করে ম্যানহাটান আইল্যান্ড ঘুরে এসেছে ওরা। সন্ধ্যায় ডিনার খেয়েছে একটা হোটেলের খোলা ছাতের ওপরের রেস্টুরেন্টে। একধারে ওখানে ক্রেতাদের মনোরঞ্জনের জন্যে পিয়ানো বাজায় বাদকদল। নিচে নিউ ইয়র্ক শহরের আলোকমালা, যেন আলোর এক বিশাল সমুদ্রের মত ছড়ানো। যেদিকে তাকানো যায় শুধু আলো আর আলো। শব্দেরও কমতি নেই। প্রাণবন্ত শহরের অবিরাম গুঞ্জন, চলছেই, চলছেই।

পরদিন খুব সকালে উঠল ওরা। ব্রুকলিন থেকে মাটির নিচের পথ দিয়ে গেল কনি আইল্যান্ডে। সেখানে আরও অনেক ট্যুরিস্টের সঙ্গে বিখ্যাত অ্যাকোয়ারিয়াম দেখল। পটেটো নিশ খেলো ওরা ওখানে। ঠোঁট চাটতে চাটতে কিশোর বলল, মেরিচাচীকে গিয়ে বলতে হবে এ কথা। সে তো মনে করে সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে ভাল নিশ সে-ই কেবল বানায়। এখানকারটা খেলে বুঝতে পারত কি জিনিস।

ধীরে ধীরে স্ট্যাচু অভ লিবার্টির দিকে এগিয়ে গেল ওরা। দিন শেষে খাওয়া সারতে গেল ওঅর্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। এত উঁচুতে বসেছে, ছোট আকারের প্লেনগুলো উড়ছে ওদের নিচ দিয়ে। গোগ্রাসে গিলছে মুসা। চারপাশে তাকাচ্ছে। যেন বুঝতে পারছে না কোনদিকে আগে তাকাবে।

তৃতীয় দিনও ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাতে লাগল ওরা। ঐতিহাসিক গ্রীনউইচ ভিলেজ দেখতে চলে গেল। দুপুরের খাওয়া খেলো চায়নাটাউনে।

লাঞ্চের পর তার ফরচুন কুকিতে পাওয়া কাগজের টুকরোটা খুলে পড়লেন রাবাত। তার ভাগ্যলিপিতে বলা হয়েছে:

আজ রাতে প্রেমে সার্থক হবে তুমি।

তিন গোয়েন্দা তো হেসেই বাঁচে না। হাসতে লাগলেন রাবাতও। এমন উদ্ভট কথায় কে না হাসে? তারপর গেল ওরা রকেটির রেডিও সিটি মিউজিক হল দেখতে। ডিনার খেলো লিনডিতে। নিউ ইয়র্কের অসামান্য স্বাদের পনির কেক খেলো। রাতে হোটেলে ফিরে এতটাই ক্লান্ত বোধ করল, বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুম।

চতুর্থ দিন সকালে গেল মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অভ আর্টে, তারপর এসেছে সেন্ট্রাল পার্কে। বেঞ্চে বসেছে রোদের মধ্যে। ঠেলাগাড়িতে করে খাবার বিক্রি করছিল ফেরিওয়ালা। একজনকে ডেকে বিশেষ ধরনের রুটির ভেতরে ভেড়ার মাংস কেটে কেটে দিয়ে তৈরি করা সুভলাকি স্যান্ডউইচ কিনে খেয়েছে।

এখন, ওরা রয়েছে পার্কের আরেক প্রান্তে। মিউজিয়াম অভ ন্যাচারাল হিস্টরির সামনে।

এতসব ঘোরাঘুরির সময়, প্রায়ই বাদামী রঙের সোয়েটার আর ধূসর স্ন্যাকস পরা একজন তরুণকে আশেপাশে দেখেছে। আরও একজনকে দেখেছে নেভি ব্লেজার পরা, খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা, রুক্ষ চেহারার মাঝবয়েসী লোক। কখনও দুজনে একসঙ্গে থাকে, কখনও একজন এদিক থাকলে আরেকজন ওদিক।

এফ বি আইয়ের লোক, রবিন বলল। ওরা কাছাকাছি থাকলে সাহস পাই।

 কিন্তু এরা কতটা কি করতে পারবে বুঝতে পারছি না, মুসার গলায় সন্দেহ। যাদের ধরতে এসেছে, বিশেষ করে মিলারের দোস্তটা একটা ইন্টারন্যাশনাল স্পাই। গোলাগুলি চলতে পারে।

এ সব আলোচনা বাদ দে, নিষেধ করলেন রাবাত। যখন চলে, দেখা যাবে। সামলানোর ক্ষমতা না থাকলে এদের পাঠাত না অফিস।

নানার মেজাজ খারাপ, আন্দাজ করতে পারল মুসা। অতিরিক্ত ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সকালে বিছানা থেকে উঠতেই কষ্ট হয়েছে। মুসা অবশ্য আসতে মানা করেছিল। বলেছে, নানা, শুয়েই থাকো। নাস্তার জন্যে খবর পাঠাচ্ছি। ঘরেই থাকি আজ। মিলারের কথা ভুলে যাই বরং। সে আর আমাদের খুঁজে পাবে না।

পাবে! প্রায় ধমকে উঠেছেন রাবাত। ওকে ধরার এই সুযোগ কোন কিছুর বিনিময়েই ছাড়তে রাজি নই আমি!

মিলারের প্রতি রাবাতের রাগ দেখে মুচকি হেসেছে কিশোর।

 আজ কিছু ঘটবেই, রাবাত বলেছেন। মন বলছে আমার।

সুতরাং সেই মন বলার কারণেই এখন পার্কে বসে আছে ওরা। বিকেল। হয়ে গেছে। কিছুই ঘটেনি এখনও। বাদামী সোয়েটার পরা লোকটা নেই আশেপাশে। নীল ব্লেজার পরা লোকটা আছে। এককোণে দাঁড়িয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রীম কিনে খাচ্ছে। চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি।

আমাদের আসলে চোখে পড়ছে না ওদের, মুসা বলল। এতবড় শহরে কোথায় খুজবে মিলার? এমন কিছু করা উচিত আমাদের, যাতে সবার নজরে পড়ে যাই–এই যেমন এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের দেয়াল বেয়ে ছাতে ওঠার চেষ্টা, কিংবা হাডসন নদীতে সাঁতার কাটা। টেলিভিশনে দেখানো হবে আমাদের। মিলার তখন জানতে পারবে আমরা কোথায় আছি।

ভুরু কুঁচকে মুসার দিকে তাকালেন রাবাত। তোর মায়ের মাথায় গোবর বলেই তোর এই অবস্থা!

ফোড়ন কাটতে ছাড়ল না মুসাও, মগজ থাকার কি খেসারত যে দিতে হচ্ছে, সে-ও দেখতেই পাচ্ছি!

ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল কিশোরের মুখে। টেলিভিশন।

এইবার ভুরু কোঁচকানোর পালা মুসার। ঘাবড়ে গিয়ে বলল, খাইছে! সত্যি সত্যি আবার নদীতে ঝাঁপ দিতে বলবে না তো? আমি রসিকতা। করছিলাম।

টেলিভিশনে যেতে হলে নদীতে ঝাঁপ দেয়া কিংবা বিল্ডিঙে চড়া লাগে না, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। কোনো কুইজ শোতে যেতে পারি। কিংবা নতুন মুখদের অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়া যেতে পারে।

হোটেল উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যোগ দিলে কেমন হয়? রবিন বলল, পত্রিকায় পড়েছি, একটা নতুন হোটেল ভোলা হচ্ছে নিউ ইয়র্কে। নাম রাখা হচ্ছে নিউ উইন্ডসর। লোকের আগ্রহ আছে ওটার ওপর, কারণ, বছর দুই আগে পুড়ে যাওয়া আরেকটা হোটেলের জায়গায় তৈরি হচ্ছে ওটা। অনেক বড় পার্টি দেবে। গভর্নরও আসতে পারেন।

কবে খুলছে?

কাল রাতে। গভর্নর এলে টিভির লোকেরা আসবেই ক্যামেরা নিয়ে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমাদের দাওয়াত পাওয়ারও ব্যবস্থা করে দিতে পারবে এফ বি আই। হোটেলটাতে ঘর নেয়া গেলে আরও সুবিধে। মিলার আর ব্যালার্ড জেনে যাবে কোথায় আছি আমরা।

উঠে দাঁড়াল কিশোর। সোজা রওনা দিল নীল ব্লেজার পরা লোকটার দিকে। কাছে এসে বলল, কাল রাতে নিউ উইন্ডসরের উদ্বোধনী পার্টিতে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া কি এফ বি আইয়ের পক্ষে সম্ভব?

এত চমকে গেল লোকটা, হাত থেকে আইসক্রীম পড়ে গেল। ভাবতেই পারেনি তাকে চিনে ফেলবে একটা ছেলে।

টিভির নিউজ সেকশনের লোক নিশ্চয় আসবে, বুঝিয়ে বলল কিশোর। আইসক্রীম পড়ে যাওয়াটাকে পাত্তাই দিল না। লোকটার জুতোর ওপর পড়ে গলছে ওটা। হোটেলটা খোলার ব্যাপারে বাইরের লোকের মতামতও নিশ্চয় নেয়া হবে। প্রতিবেদক যদি আমাদের একজনকে প্রশ্ন করে, তাহলে বলতে পারি আমরাও ওই হোটেলে উঠেছি। ভাল লাগছে। হ্যারিস মিলার তখন জেনে যাবে আমরা কোথায় আছি। সারা নিউ ইয়র্কে আমাদের পেছনে ঘুরে বেড়ানোর ঝামেলা থেকে বাঁচবেন আপনিও।

সামলে নিয়েছে ততক্ষণে লোকটা। লম্বা দম নিল। বলতে চাইল,–কিশোর কি বলছে সে বুঝতে পারছে না। তারপর ভাবল বোধহয়, অহেতুক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এই ছেলেকে বোকা বানাতে পারবে না। আরেকবার দম নিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়। জানাব।

রাস্তার দিকে চলে গেল সে।

বন্ধুদের কাছে ফিরে এল কিশোর। জানাবে বলে গেল।

 কিন্তু আমাদের যে এখানে একা ফেলে গেল, রাবাত বললেন।

নানা, মরিয়া হয়ে বলল মুসা, অমন অসহায়ের মত ভঙ্গি কোরো না তো! তোমাকে অসহায় বলা, আর ভয়ানক শারম্যান ট্যাংককে খেলনা বলা। একই কথা। তোমার সঙ্গে লাগতে এলে বরং মিলারই অসহায় হয়ে যাবে।

মুসার কথায় হাসি ফুটল রাবাতের মুখে। মেজাজ অনেকটা ঠিক হয়ে এল। ট্যাক্সি নিয়ে রিভারভিউ প্লাজায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন।

সেদিন সন্ধ্যায়ই ফোন বাজল। রাবাত ধরলেন। হোগারসন করেছে। জানাল, নিউ উইন্ডসরে ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আগামী কাল যেন চলে যান।

গাঢ় রঙের স্যুট কিংবা রেজার আছে আপনাদের? জানতে চাইল হোগারসন। টেলিভিশনে চেহারা যদি দেখাতেই হয়, লোকে যাতে বোঝে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যেই বহুদূর থেকে ছুটে এসেছেন আপনারা। তৈরি হয়ে এসেছেন।

কিন্তু নেই তো! কিছুটা নিরাশ মনে হলো রাবাতকে।

থাক, চিন্তা করবেন না। জোগাড় করে দেয়া যাবে।

.

১৯.

পুরোপুরি শেষ হয়নি হোটেল বাড়িটার কাজ। বিশাল গুহার মত দেখতে লবিটার বাতাসে রঙ আর অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের কড়া গন্ধ। লিফটের কাছে একজন রুম সার্ভিস ওয়েইটারের সঙ্গে দেখা। রবিনের অনুরোধে তাকে একটা ছাপানো নকশা দিল সে, তাতে হোটেলের কোন ফ্লোরে কি আছে দেখানো আছে। ওদের ঘরগুলো রয়েছে তেত্রিশ নম্বর ফ্লোরে। রিয়ারভিউর ঘরের চেয়ে ছোট। তবে ওটা যেমন চারদিক থেকে বদ্ধ, এটা তেমন নয়, রাবাতের ঘর থেকে ঈস্ট রিভার চোখে পড়ে।

পাঁচটার সময় হোটেলে এসেছে ওরা। লবিতে যন্ত্রপাতি বসিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে টিভির লোকেরা। ছয়টা পয়তাল্লিশ মিনিটে যখন এফ বি আইয়ের দেয়া গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার পরে নামল আবার, আলোয় ঝলমল করছে তখন লবিটা। মেসেজ ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে আছে হোগারসন। ওদের প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল একজন প্রতিবেদকের সঙ্গে।

লম্বা, সুদর্শন একজন লোক। ঝকঝকে সাদা দাঁত। সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল। রাবাতের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় তাঁর বাঁ কানের পাশ দিয়ে পেছনে তাকাল। তারপর তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল একজন

মহিলাকে স্বাগত জানানোর জন্যে। রিভলভিং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে। মহিলা। গায়ের জ্যাকেটে প্রচুর ঝলমলে পুতি আর আয়নার টুকরো বসানো।

টিভি ক্যামেরার লাল আলো জ্বলে উঠল। একধারে দাঁড়ানো কানে হেডফোন পরা একজন ইঙ্গিত করল একজন ঘোষককে। ক্যামেরার সামনে এসে ঘোষক বলতে লাগল, সে নিউ উইন্ডসরের লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে যিনি রয়েছেন তার নাম মনিকা কনসর, হোটেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। যোগ দিতে সেই রোম থেকে উড়ে এসেছেন।

মিসেস কনসর ভি আই পি, সন্দেহ নেই, কিন্তু তার আর কোন পরিচয় দিল না ঘোষক। তিন গোয়েন্দা ভাবল, এখানে উপস্থিত অতিথিরা নিশ্চয়।

মহিলার পরিচয় জানে, কেবল ওরা তিনজন আর মিস্টার রাবাতই জানেন না। হাসিতে ঠোঁট এত ছড়িয়ে ফেললেন মহিলা, মুসার ভয় হতে লাগল ছিঁড়ে না যায়। অল্প দুচারটা কথা বলেই সরে গেলেন।

আচমকা রাবাত আর তিন গোয়েন্দার দিকে নজর দিল ঘোষক। হাত তুলে স্বাগত জানানোর ভঙ্গি করল। মুহূর্তে ওদের দিকে ঘুরে গেল ক্যামেরার চোখ।

আর ইনি হলেন মিস্টার আরমান রাবাত, চেঁচিয়ে উঠল ঘোষক, যেন হঠাৎ করে তাকে চোখে পড়ে যাওয়ায় অবাক হয়েছে। অত্যন্ত সম্মানিত একজন মেহমান। বহুদূরের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছেন শুধু এই অনুষ্ঠানে, যোগ দেয়ার জন্যে।

ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি হাসলেন রাবাত। ঘোষকের হাত চেপে ধরলেন। সহজে আর ছাড়তে চাইলেন না। ঘোষক বলল–পুরানো ওয়েস্টমোর হোটেলেটা যখন এখানে ছিল, তখন তার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এলে ওটাতে ছাড়া আর কোথাও উঠতেন না। তাঁর স্ত্রী এখন পরপারে; ঈশ্বর তার বিদেহী আত্মার মঙ্গল করুন!!  তাড়াতাড়ি বলতে গেলেন রাবাত, আমি আর আমার স্ত্রী হানিমুন করেছি…

কথা শেষ করতে দিল না ঘোষক, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে দিল, অবশ্যই ওয়েস্টমোর হোটেলে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। পারল না।

গমগমে কণ্ঠে রাবাত বললেন, প্রায়ই আসতাম আমরা। ওয়েস্টচেস্টার পুড়ে যাওয়ার খবর শুনে তো রীতিমত মুষড়ে পড়েছিলাম। তবে আর চিন্তা নেই। ওটার চেয়ে ভাল হোটেল নিউ উইন্ডসর এখানে দাঁড়িয়ে গেছে। এখনও কাঁচা কাঁচা গন্ধ আছে বটে, তবে কেটে যাবে। খুব শীঘি কেটে যাবে, ঠিকমত চালু হলেই। এই ছেলেগুলোকে নিয়ে এসেছি এবার, নিউ ইয়র্ক দেখাতে। এদের একজন আমার নাতি, অন্য দুজন তার বন্ধু ক্যামেরার চোখ ঘুরে গেল কিশোর, মুসা আর রবিনের হাসি হাসি মুখের দিকে। পুরো হপ্তাটাই এখানে কাটিয়ে যেতে চাই আমরা। খুব উপভোগ করছে ওরা। ইতিমধ্যেই রোলার কোস্টারে করে কনি আইল্যান্ড ঘুরিয়ে এনেছি ওদের।

এই সময় হাতের চাপ সামান্য শিথিল হতেই তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিল ঘোষক। তার পেশাদারী হাসিটা বিন্দুমাত্র মলিন না করে দ্রুত পিছিয়ে গেল। রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে ধন্যবাদ দিল। ব্যস, কাজ শেষ।

 ঘোষকের মতই তাড়াহুড়ো করে ওখান থেকে সরে এলেন রাবাত। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ছেলেদের দিকে তাকালেন, কি বলেছি আমি, বলো তো? ঠিকঠাক মত বলেছি তো সব?

 হেসে মুসা বলল, দারুণ বলেছ তুমি, নানা। একটা ভুলই কেবল করেছ, ওয়েস্টমোরের জায়গায় ওয়েস্টচেস্টার বলে ফেলেছ।

তাই নাকি? মোটেও চিন্তিত মনে হলো না রাবাতকে। একই কথা। মিথ্যে যে এতগুলো বলতে পেরেছি, এই বেশি। নিউ উইন্ডসরে যে থাকব, এটা ঠিকমত বলেছি তো?

তা বলেছ।

তবে আর চিন্তা নেই। ওই ছুঁচো মিলারটাকে জানিয়ে দেয়া হলো, কোথায় আমাদের পাওয়া যাবে।

ওখানে থাকার আর কোন দরকার নেই। ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে এলেন রাবাত। সিটিক্রপ বিল্ডিঙের একটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে চললেন ওদের।

রিসিপশনের কাছে দাঁড়িয়ে ওদের বেরোতে দেখল হোগারসন। বাধা দিল না।

ভাবতে ভাবতে চলেছে তিন গোয়েন্দা, কাজ যা করার তো করা হলো। মিলার আসতে কত সময় নেবে?

.

২০.

পরদিন সকালে নাস্তা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তিন গোয়েন্দা, এই সময় হোটেলের কফি শপে ঢুকলেন রাবাত। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন, রাত জেগে টেলিভিশনে নিজের ইন্টারভিউ দেখেছেন। লেট নাইট নিউজ দেখেছেন, লেট-লেট নাইট নিউজ দেখেছেন। মূসার পাশে হাসিমুখে বসতে বসতে জানালেন, সকালের খবরেও তার ইন্টারভিউ দেখানো হয়েছে।

কফি শপে হোটেলের আরও অনেক মেহমান নাস্তা খাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিতে হাসলেন, যেন সাংঘাতিক কেউকেটা কিছু হয়ে গেছেন। এখনই সবাই অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে সই নিতে ছুটে আসবে। খাতা না আনলেও মেনু হাতে এগিয়ে এল ওয়েইটার। তার মুখের দিকে তাকালও। তবে চিনতে পারার কোন লক্ষণ নেই তার চোখে।

রেগে গেলেন মনে হলো রাবাত। জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। আদেশ দিলেন, কফি। প্যানকেক। দুটো ডিম। আর গরুর মাংস ভাজা। এ চমকে গেল মুসা। নানা, তোমার না ডিম আর গরু খাওয়া বারণ। কোলেস্টেরল:..

চুলোয় যাক কোলেস্টেরল! ধমকে উঠলেন রাবাত। ময়লা জমলে, আমার শিরায় জমবে, তোর মাথাব্যথা কেন? আজ সারাদিনে অনেক ঘটনা ঘটবে, এনার্জি দরকার হবে আমার। সুতরাং সেটা এখনই জোগাড় করে নিতে, হবে।

কিন্তু খাওয়ার পর ঘটনা আর ঘটে না। এনার্জি খরচেরও প্রয়োজন পড়ছে রাবাতের। হোটেলের লবিতে বসে থাকার ব্যবস্থা করেছে তিন গোয়েন্দা। বার বার অহেতুক ক্যামেরা আর ক্যামেরার ব্যাগে হাত বোলাচ্ছে রবিন। এফ বি আইয়ের দুজনেই উপস্থিত। নীল ব্লেজার পরা লোকটা ঢুকেছে গিফট শপে, জিনিস দেখার ভান করছে। নিউজ কাউন্টারে ম্যাগাজিন ওল্টাচ্ছে বাদামী সোয়েটার।

আসছ না কেন, মিলার? বিড়বিড় করলেন রাবাত। আমরা তো তোমার অপেক্ষায়ই আছি।

তা কিন্তু তা-ও কিছু ঘটল না। আধঘণ্টা গেল। এক ঘণ্টা। ঘড়ির কাটা চলছে।

বেলা এগারোটায় মেজাজ গরম হতে আরম্ভ করল তার। সাড়ে এগারোটায় ফুটতে শুরু করল।

আশ্চর্য! বললেন তিনি। সেই কখন থেকে বসে আছি, মনে হচ্ছে বছর পেরিয়ে গেছে। গাধাটা সাক্ষাৎকার দেখেনি নাকি? ছাগল কোথাকার! খবরও দেখে না! ধূর্ত হাসি ফুটল ঠোঁটে। আজ বিকেলে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে একটা ডাবল গেম আছে। দেখতে যাবি নাকি, মুসা?

যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না, মুসা বলল। মিলার আর তার দোস্ত সাক্ষাৎকারটা দেখেছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। দেখলে এখানে খুঁজতে আসবেই। তখন আমরা না থাকলে এতদিনের কষ্ট অহেতুক যাবে।

বাইরে থেকে একটু ঘুরে এলেও পারি, রাবাত বললেন। এখানে বসে থেকে ভুল করছি আমরা। হয়তো ঢোকার সাহসই পাচ্ছে না। বাইরে গিয়ে ওদের সুযোগ করে দেয়া উচিত।

আমার মনে হয় না, কিশোর বলল, আমরা বাইরে বেরোলেও ওদের হারাতে হবে। এসে আমাদের না পেলে অপেক্ষা করবে ওরা। কিংবা আবার। আসবে। এতদূর আমাদের পিছু ধাওয়া করে আসতে পেরেছে ওই ফিল্মের জন্যে। এত সহজে হাল ছাড়বে না।

সুতরাং বসে না থেকে বাইরে ঘুরে আসারই সিদ্ধান্ত হলো। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে মেসেজ ডেস্কে এসে দাঁড়ালেন রাবাত। ইয়াংকি স্টেডিয়ামে যেতে হলে কোন্ ট্রেন ধরতে হবে, এবং সেটা মাটির নিচ দিয়ে যায় কিনা, জিজ্ঞেস করলেন।

দুপুর বেলা সদলবলে হোটেল থেকে বেরোলেন রাবাত। হোটেলের দুই ব্লক দূরেই একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন। আধ ব্লক পেছনে লেগে রইল দুই এফ বি আই। প্ল্যাটফর্মে নেমে প্রথম ট্রেনটা ইচ্ছে করে মিস করল গোয়েন্দারা, ওই দুজনকে আসার সময় দিল, ওরা এখনও এসে পৌঁছায়নি। পরের ট্রেনটায় চড়ল সবাই। এফ বি আইরা রইল কামরার এক প্রান্তে, গোয়েন্দারা আরেক প্রান্তে। ব্রংক্স বল পার্কের দিকে চলল ট্রেন। চতুর্দিকে কড়া নজর রাখলেন রাবাত। মিলাররা পিছু নিয়েছে কিনা দেখছেন।

 স্টেডিয়ামে এসে ভান করলেন যেন তারা নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। তাতে খেলা দেখার সুবিধে আছে। খেলা দেখতে বসলে কোনও এক পক্ষকে সমর্থন করতে হয়। সেই পক্ষের দর্শকদের মধ্যে বসা ভাল। এবং সেটাই করলেন। তিনি। ইয়াংকিদের মধ্যে, বসলেন। প্রথম গেমে এক রান এগিয়ে রইল ইয়াংকিরা। সুতরাং প্রচুর চেঁচাতে পারলেন তিনি। আশেপাশে ইয়াংকি সমর্থক থাকায় চেঁচাতে কোন অসুবিধে হলো না।

বিরতির সময় হট ডগ খাওয়া হলো। নাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলেন তিনি। দুজনের কেউই জিততে পারলেন না। রবিন আর কিশোরও প্রচুর খেল, তবে নানা-নাতির ধারেকাছেও যেতে পারল না।

শুরু হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের খেলা। শুরুতেই ইয়াংকিদের হারিয়ে দিল বহিরাগত টীম। নিজের আর বাইরের দল, দুটোকেই গালাগাল শুরু করল ইয়াংকি সমর্থকরা। সিটি বাজিয়ে, নানা রকম কটু কথা বলে উত্তেজিত করে জেতানোর চেষ্টা করতে লাগল। খেলার উত্তেজনায় কখন যে তাদের দলে মিশে গেলেন রাবাত আর তিন গোয়েন্দা, খেয়ালই রইল না। শেষ পর্যন্ত যখন ব্রংক্স বহুবাররা হেরে গেল, শির উঁচু করে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে বেরোনোর জন্যে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। ঘাড় কাত করে মুসার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি, বলেছিলাম না ইয়াংকিরা জিতবে?

প্রচুর দর্শক হয়েছে। বেরোনোর গেটে ভিড়। ঠেলাঠেলি করে বেরোতে হচ্ছে। কনুইয়ের গুতো মেরে ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে এগোলেন। রাবাত। স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে রেল স্টেশনে চলে এলেন। জনতার কোলাহল বিরক্তিকর, তবু বিকেলটা ভাল লাগল তার। সুন্দর বাতাস বইছে।

ম্যানহাটানের ট্রেন এসে দাঁড়াল। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। রাবাত যে কামরাটায় উঠলেন, তাতে বেজবল খেলার বেশ কিছু ভক্তও উঠেছে। দরজা বন্ধ হলো। চলতে শুরু করল ট্রেন। মুসার চোখে পড়ল বাদামী সোয়েটার পরা এফ বি আইকে, প্ল্যাটফর্মে জনতার ভিড়ে আটকা, পড়েছে সে, পাগলের মত তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, ওদেরকে খুঁজছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিল মুসা। দেখতে পেল লোকটা। গতি বেড়ে গেছে। ট্রেনের। বাদামী সোয়েটারকে ফেলে রেখেই প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে চলে। এল।

মুসার দুপাশে চেপে আছে দুজন ভক্ত। একজন হোঁৎকা বিশালদেহী লোক, গায়ে স্পোর্টস কোট; আরেকজন মুসার চেয়ে দু-এক বছরের বড় হবে, কোন কিছু না ধরেই দাঁড়িয়ে আছে, একনাগাড়ে পিনাট খেয়ে চলেছে। শরীর মোড়ামুড়ি করে কোনমতে দুজনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে কিশোরের কাছে চলে এল মুসা। একটা ধাতব হ্যান্ড-স্ট্র্যাপ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।

বডিগার্ডকে খুইয়েছি, তাকে বলল মুসা। বাদামী সোয়েটার পরা লোকটাকে প্ল্যাটফর্মে দেখলাম, উঠতে পারেনি।

বডিগার্ড? হেসে উঠল হাড্ডি সর্বস্ব একটা মেয়ে। বয়েস ষোলো সতেরো হবে। মাথায় বেগুনী রঙের কাপড় অনেকটা পাগড়ির মত করে পেচিয়েছে। সেটে আছে প্রায় কিশোরের গায়ের সঙ্গে। অকারণ কথা বলে বলে তার কান পচিয়ে ফেলার জোগাড় করেছে। গায়ে মাংস না থাকলে কি হবে, গলাটা যেন মাইক। এমন করে ফাটা বাশে বাড়ি মারছে, কিশোরের ভয় হতে লাগল, কামরার সব লোকই শুনে ফেলবে। কিসের বডিগার্ড? ভি আই পি নাকি তোমরা! বাব্বাহ, বডিগার্ডও থাকে সঙ্গে! পরের বার প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে দাঁড়াবে নাকি!

খুব সাংঘাতিক কোন রসিকতা করে ফেলেছে যেন মেয়েটা, এমন ভঙ্গিতে নিজের কথায় নিজেই পুলকিত হলো। তার কথায় মজা পেল আরও কয়েকজন যাত্রী। মুসার দিকে তাকাল।

 দুষ্টবুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল কিশোরের চোখে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেবো না। ওকে আর দরকার হবে না। ইনকিউবেশন পিরিয়ড কালই শেষ হয়ে গেছে তোমার।

শক্ত হয়ে গেল মেয়েটা। সতর্ক হয়ে উঠল। ইনকিউবেশন! কেঁপে উল ফাটা বাঁশ। কিসের ইনকিউবেশন? ছোঁয়াচে রোগে ধরেছিল নাকি?

না না, মাথা নাড়ল মুসা, কিসের রোগ! ও এমনি এমনি বলছে! মিথ্যে বলা ওর স্বভাব!

মুসার বলার ভঙ্গিতে সন্দেহ আরও বাড়ল মেয়েটার। কিশোরের কাছ থেকে সরার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মুসার কাছে থাকাটাও বিপজ্জনক। কোন রোগ, কে জানে! চিকেন পক্সও হতে পারে! তাড়াতাড়ি সরে যেতে লাগল। সে। কামরার একেবারে আরেক ধারে চলে গেল। পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই নেমে গেল। পক্সের ভয়ে তার সঙ্গে নামল আরও কয়েকজন।

ম্যানহাটানে পৌঁছার আগেই আরও অনেকে নেমে গেল। ভিড় আর আগের মত নেই। কামরার মাঝখানে প্রচুর জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়েছে রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে। তাদের কাছাকাছি আসতে ভয় পাচ্ছে লোকে।

রাবাতকে বলল কিশোর, এফ বি আইয়ের লোকটা ট্রেনে উঠতে পারেনি। প্ল্যাটফর্মে তাকে থেকে যেতে দেখেছে মুসা।

তাতে আর অসুবিধে কি? রাবাত বললেন। এখানে মিলারও নেই, তার দোস্তও নেই।

তা ঠিক। যাত্রীদের ওপর আরেকবার চোখ বোলাল তিন গোয়েন্দা। মিলার কিংবা ব্যালার্ডের সঙ্গে কারও সামান্যতম মিলও নেই।

ফোরটি-সেকেন্ড স্ট্রীটে এসে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল ওরা। একটা সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করলেন রাবাত, যেটা ধরে গেলে পথ বাঁচবে। অল্প সময়ে পৌঁছতে পারবেন হোটেলে। অন্ধকার সুড়ঙ্গমুখটা দেখতে ভাল লাগল না মুসার। মনে হলো, ওর মধ্যে ঢোকাটা উচিত হবে না। সমর্থনের আশায় রবিন আর। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কিছু বলল না ওরা। নীরবে এগোল রাবাতের। পিছু পিছু। অগত্যা মুসাকেও যেতে হলো।

সুড়ঙ্গের মাঝামাঝি পৌঁছে একটা ডাক কানে এল, দাঁড়াও, রাবাত!

পুরো সুড়ঙ্গটা নির্জন, নিজেদের বাদে আর কাউকে দেখেনি এত ক্ষণ। এবার দেখল। এগিয়ে আসছে আরেকজন। হাসি হাসি মুখ। বিচিত্র একটা রেনকোট পরা থাকায় আগের চেয়ে খাটোও লাগছে, মোটাও।

মিলার! চিৎকার করে উঠলেন রাবাত।

যাক, দেখা তাহলে হলো, মিলার বলল। অনেক দিন পর, কি বলো।

নীরব সুড়ঙ্গ। এতটাই নীরব, কোথায় যেন টপ টপ করে পানির ফোঁটা পড়ছে, তা-ও কানে আসছে।

পেছনে কথা বলে উঠল আরেকজন, ক্যামেরার ব্যাগটা আমি নিয়ে নিচ্ছি।

 মনটিরেতে এই লোককেই দেখেছে গোয়েন্দারা, মিলারের দোস্ত, ব্যালার্ড। হাতে উদ্যত পিস্তল, রবিনের দিকে ধরে রেখেছে।

প্রতিবাদ না করে ব্যাগটা দিয়ে দিল রবিন।

ফিল্মগুলো আছে কিনা, দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে দেখে নিল লোকটা। মিলারের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল, ঠিকই আছে। রাবাত আর গোয়েন্দাদের আদেশ দিল, ভেতরে যাও। সবাই।

পিস্তল দিয়ে সুড়ঙ্গের একটা দরজার দিকে ইশারা করল সে। খিল খুলে দিল মিলার। তার ওপাশে একটা দেয়াল আলমারি। সেঁতসেতে। ঝাড়ু, মেঝে পরিষ্কার করার স্পঞ্জ আর জীবাণু ও কীট-পতঙ্গনাশক ওষুধের টিনে বোঝাই।

ঢোকো! পিস্তল নেড়ে আবার আদেশ দিল ব্যালার্ড।

ঢুকতে বাধ্য হলো চারজনে। দরজা লাগিয়ে দেয়া হলো বাইরে থেকে। খিলটাকে ভালমত আটকে রাখার জন্যে তার মধ্যে কাঠি জাতীয় কিছু ঢোকানোর শব্দ পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে সরে গেল পদশব্দ।

বাঁচাও! চিৎকার করে উঠল মুসা। কে আছ, আমাদের এখান থেকে বের করো।

Super User