১০.

গেল কোথায়? পেছনের বন থেকে বলল একটা কর্কশ কণ্ঠ।

দাঁড়িয়ে পড়লে কেন আবার? এস…অ্যাই ডক, বলল আরেকটা কণ্ঠ, খুঁজে বের করতে হবে ওদের। ঘন গাছপালার ভেতরে কথা বললে শব্দটা ঠিক কোনখান থেকে আছে বোঝা মুশকিল।

আমাদের গুলি করল কেন? মাটিতে গাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল রবিন।

জানি না, ফিসফিস করেই জবাব দিল কিশোর। সেটা জানার চেষ্টা করতে যাওয়াটাও এখন গাধামি। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, এখানে পড়ে থাকাটা ঠিক না। খুঁজে বের করে ফেলবে।

অন্য দুজনও একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল। নিঃশব্দে উঠে পড়ল তিনজনে।

 জলদি করো! পাইনের ভেতর দিয়ে চলার জন্যে তাগাদা দিল মুসা।

শব্দ না করে যতটা জোরে চলা সম্ভব তার পেছনে পেছনে চলল রবিন আর কিশোর। একপাশে রয়েছে এখন পাহাড়টা। তৃণভূমিটা পড়বে সামনে। সেদিকেই চলেছে ওরা।

আবার হলো গুলির শব্দ। ঝরঝর করে ওদের মাথায় ঝরে পড়ল পাইন নীড়ল।

ঝট করে বসে পড়ল আবার গোয়েন্দারা। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সরে এল বিরাট এক পাথরের চাঙরের আড়ালে।

গেল কই? ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠল আবার ডকের কণ্ঠ। পেছনের ঘন জঙ্গলে রয়েছে।

বিচ্ছু! একেবারে বি্চছু একেকটা! বলল দ্বিতীয় কণ্ঠটা।

ভারি পায়ে হাঁটছে লোক দুজন। সাবধান হওয়ার প্রয়োজনই বোধ করছে না। পায়ের চাপে মট করে ভাঙল শুকনো ডাল।

এদিকেই আসছে দেখে আবার উঠে পড়ল মুসা। পাইনের ভেতর দিয়ে প্রায় ছুটে চলল।

ওই, ওই যে! চেঁচিয়ে উঠল ডক। মার, মার!

গুলির শব্দ হলো। ছুটে এসে গোয়েন্দাদের আশপাশের মাটিতে বিধতে লাগল। বুলেট। ছিটকে উঠল মাটি।

দৌড় দাও! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

ছায়ায় ছায়ায় ছুটছে সে। পেছনে লেগে রয়েছে কিশোর আর রবিন। যাতে পথ না হারায় সেজন্যে পাহাড়টাকে নিশানা করে রেখেছে। সব সময়ই এক পাশে রেখেছে ওটাকে। হাঁপাতে আরম্ভ করেছে কিশোর। মনে মনে গাল দিচ্ছে নিজেকে। কয়েক দিন ব্যায়াম করেনি, অবহেলা করে, তার ফল পাচ্ছে এখন।

ঘন একটা ম্যানজানিটা ঝোপ দেখে তার আড়ালে এসে লুকাল ওরা।

 ওদের দেখেছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না, মাথা নাড়ল রবিন। মাথা থেকে বাবার ক্যাপটা খুলে একহাতে নিল, আরেক হাতে মুখের ঘাম মুছল। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না কিশোর? টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে মুখ।

আক্কেল হচ্ছে! ব্যায়াম বাদ দিয়েছি, আনফিট হয়ে গেছে শরীর। যাবেই।

 চলো, আবার তাড়া দিল মুসা। এখানে থাকলে ধরা পড়ে যাব।

ছায়ায় ছায়ায় আবার ছুটতে লাগল তিনজনে।

খসাতে পেরেছি? আরও কিছু দূর আসার পর রবিন বলল।

হয়তো, জবাব দিল কিশোর, ঠিক বলা যাচ্ছে না!

ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় ওরা, মুসা বলল, কথা শুনে তো তাই মনে হলো।

পশ্চিমে এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা। পাহাড়টাকে আগের মতই এক পাশে। রেখেছে। যতটা সম্ভব গাছপালার ভেতরে থাকার চেষ্টা করছে। খোলা জায়গায় একদম বেরোচ্ছে না।

আরও মাইল দুই একটানা হাঁটল ওরা। পেরিয়ে এল প্রচুর বুনো ফুল, ঘন পাইনের জটলা, পাথরের চাঙড়, আর সেই টলটলে পানির ঝর্নাটা, যেটা থেকে পানি ভরেছিল রবিন।

আর কদ্দূর? মুসা জানতে চাইল।

ঠিক পথেই এগোচ্ছি মনে হচ্ছে, কিশোর বলল। আর বেশিক্ষণ লাগবে না।

মিনিটখানেক জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে লাগল ওরা।

ওই যে! হাত তুলে দেখাল মুসা।

 বিশাল তৃণভূমিটার দক্ষিণ পাশ দিয়ে বন থেকে বেরোল ওরা।

 প্লেনটা কোথায়? বলে উঠল কিশোর।

তাকিয়ে রয়েছে তিনজনেই। চমকে গেছে। সেসনাটা নেই। ভাঙা ডানাটাও গায়েব! এ কি করে হয়?

দাঁড়াও, হাত তুলে অন্য দুজনকে এগোতে বারণ করল মুসা। সাবধানে গলা লম্বা করে তাকাল সামনের দিকে। আছে। লুকিয়ে রাখা হয়েছে ওটাকে!

তাই তো! বলল রবিন, ডালপাতা দিয়ে ঢেকে ফেলেছে! দেখো, আমাদের এস ও এসটাও নেই!

ওপর থেকে যাতে কেউ না দেখতে পায়, মুসা বলল।

বুঝলে, ধীরে ধীরে বলল কিশোর, কেউ আছে এখানে, যে আমাদেরকে পছন্দ করতে পারছে না।

তা তো বুঝতেই পারছি, রবিন বলল। কিন্তু কে? কেন?

পথ হারিয়েছ নাকি তোমরা? বলে উঠল ভারি একটা কণ্ঠ।

 চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল তিনজনে।

বিশালদেহী একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। সোনালি চুল, চোখে বড় বড় কাঁচওয়ালা একটা সানগ্লাস। দক্ষিণ-পুবের বন থেকে বেরিয়ে ওদের দিকেই আসছেন।

সাহায্য লাগবে? আন্তরিক হাসি হাসলেন তিনি। পরনে খাকি পোশাক, পিঠে বাধা ব্যাকপ্যাক, ডান কাঁধে ঝোলানো চামড়ার খাপে পোরা রাইফেল। খাপের ঢাকনাটা খোলা, হাঁটার তালে তালে গায়ের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে।

কোত্থেকে এলেন আপনি? জানতে চাইল মুসা। বেশ অবাক হয়েছে।

শিকারে বেরিয়েছি, জবাব দিলেন লোকটা। কপালটা আজ খারাপ, কিছুই পাইনি। এদিকটায় আগে আর. আসিনি। সিয়েরার এই এলাকা আমার কাছে। নতুন। মোটা, মাংসল একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মুসার মনে হলো ভালুকের থাবা। আমার নাম ফ্রাঙ্কলিন জোনস। আবার হাসলেন তিনি। হাত মেলালেন তিন গোয়েন্দার সঙ্গে। ওরা পরিচয় দিল নিজেদের।

পরিচয়ের পর প্রথম কথাটাই জিজ্ঞেস করল রবিন, আপনার গাড়ি আছে, মিস্টার জোনস?

আছে, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন জোনস। উঁচু পাহাড়টা দেখালেন হাতের ইশারায়, ওদিকটায়। অনেক দূরে। কাঠ নেয়ার একটা কাঁচা রাস্তা আছে উত্তরে। ডায়মণ্ড লেকে যাওয়ার হাইওয়েতে গিয়ে পড়েছে।

হোক দূর, হেঁটে যেতে কোন আপত্তি নেই আমাদের। চলুন।

এক মিনিট, জোনস বললেন, তোমাদেরকে লিফট দিতে আমারও আপত্তি নেই। কিন্তু জানতে হবে, দেয়াটা কতখানি জরুরী।

বিমান দুর্ঘটনা আর তার বাবার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা জানাল রবিন। শেষে বলল, তাড়াতাড়ি চলুন। বাবা কি অবস্থায় আছে কে জানে!

আর কিছু ঘটেনি তো? একটু আগে বুনের ভেতর গুলির শব্দ শুনেছি।

চট করে দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে নিল কিশোর। ওদের পেছনেই লেগেছিল লোকগুলো, গুলি করে মারতে চেয়েছিল, জোনসকে একথা বললে হয়তো তিনি ভয় পেয়ে যাবেন, ওদের আর লিফট দিতে রাজি হবেন না। তাই মিথ্যে কথা বলুল কিশোর, হবে হয়তো কোন শিকারি-টিকারি।

তাড়াতাড়ি করা দরকার, তাগাদা দিল রবিন।

দ্বিধা করলেন জোনস। মনে হচ্ছে, আরও ব্যাপার আছে, তোমরা লুকাচ্ছ আমার কাছে। ঠিক আছে, বলতে না চাইলে নেই। সাহায্য আমি করব তোমাদের।

তৃণভূমির মাঝখান দিয়ে আগে আগে রওনা হলেন জোনস। সোজা এগিয়ে। চলেছেন পাহাড়ের দিকে। ডানে রয়েছে রবিন, বায়ে কিশোর, আর মুসা রয়েছে পেছনে।

আপনার নামটা পরিচিত লাগছে, কিশোর বলল, বিখ্যাত লোক মনে হয় আপনি?

নাহ, তেমন কিছু না, হাসলেন জোনস। বেকারসফিল্ডে গোটা দুই ছোট রেস্টুরেন্ট আছে আমার। এখানে তোমার বাবা কেন এসেছিল, রবিন?

মিস্টার মিলফোর্ড একজন সাংবাদিক, সেকথা জোনসকে জানাল রবিন। ডায়মণ্ড লেকে খবর সংগ্রহ করতে যাচ্ছিল, সেকথাও বলল।

সিগারেট বের করলেন জোনস। আঁতকে উঠল মুসা, এরকম অঞ্চলে সিগারেট ধরানো ভয়ানক বিপজ্জনক, দাবানল লেগে যেতে পারে। বলতে যাচ্ছিল সেকথা। কিন্তু ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল কিশোর। যে সিগারেটটা বের করেছেন। জোনস, সেটাতে লম্বা ফিল্টার লাগানো, সাদা কাগজ, আর জোড়ার কাছে সবুজ বন্ধনী। যে দুটো গোড়া কুড়িয়ে পেয়েছে কিশোর, ঠিক একই রকম সিগারেটের। জোনস নামটাও চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু মনে করতে পারছে না কোথায় শুনেছে।

যে লোকটার কাছে যাচ্ছিল বাবা, বলছে রবিন, সম্ভবত তার নাম হ্যারিস হেরিং। পকেট থেকে বাবার নোটবুক বের করে দেখে নিল নামটা। হ্যাঁ, এই নামই। শুনেছেন নাকি নামটা কখনও?

আশ্চর্য! জোনস বললেন, সত্যিই অবাক লাগছে। ওকে চিনি না। কিন্তু আজ সকালে রেডিওতে শুনলাম, গতকাল ডায়মণ্ড লেকে যাওয়ার পথে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছে হ্যারিস হেরিং নামে এক লোক। ছুটি কাটাতে এসেছিল সে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে পাশের খাদে পড়ে গিয়ে আগুন ধরে যায়। গাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে বেচারা!

 তাই নাকি! নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেছে রবিনের।

চুপ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। ভাবছে হেরিঙের মৃত্যুর কথা। জোনসের কাঁধে ঝোলানো রাইফেলের খাপের দিকে চোখ পড়ল কিশোরের। ঢাকনাটা বাড়ি খাচ্ছে বার বার। ঢাকনা ওপরে উঠলেই দেখা যাচ্ছে ভেতরের কালো ধাতব জিনিসটার শরীর। ফায়ার আর্মস সম্পর্কে আগ্রহ আছে তার। পড়াশোনা করেছে। রাইফেলটার আকারটা আর দশটা রাইফেলের মত নয়, পেটের কাছটায় ফোলা। শক্তিশালী অস্ত্র।

বুঝতে পারছি তোমরা আর মিস্টার মিলফোর্ড ইমপরট্যান্ট লোক, জোনস বললেন। তোমরা যে এখানে আছ কে কে জানে?

রবিন আর কেউ না বলে দেয়ার আগেই তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে দিল কিশোর, অল্প কয়েকজন। তাদের মধ্যে খবরের কাগজের লোকও রয়েছে।

তাই নাকি, রবিন? রবিনের দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন জোনস।

তার মাথাটা যখন আরেক দিকে ঘুরে গেছে, খাপের ডালা তুলে ভেতরের জিনিসটা ভালমত দেখার চেষ্টা করল কিশোর।

খচখচ করছে তার মন। সিগারেটের ব্যাপারটা কাকতালীয়, একথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মনে পড়েছে, ইনডিয়ানদের গায়ে লাঞ্চ খাবার সময় যে বাক্সগুলোকে ডিনার টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, ওগুলোতে জোনস। ট্রাকিং কোম্পানির নাম লেখা ছিল দেখেছে। একটা কুঁড়ের সামনে ফেলে রাখা সমস্ত বাক্সতে দেখেছে একই নাম ছাপ মারা। ওই কুঁড়েতে দেখা গেছে হালকাপাতলা লোকটাকে, যার সঙ্গে কথা বলেছিলেন মোড়ল, যে ইশারায় মালটিকে জানিয়েছে গাড়ি তৈরি। তার মানে মিথ্যে কথা বলেছেন জোনস, এর আগেও তিনি এসেছেন এই অঞ্চলে। ঘন ঘন এসেছেন।

 আড়চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। রাইফেল কেসের ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে কিশোর, এটা দেখে অবাক হলো সে। দ্রুত একবার চোখ মিটমিট করেই সামলে নিল। কিশোরকে সাহায্য করা দরকার এখন। মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে তুলে জোনসের দিকে তাকাল সে। কিশোরের কথাই সমর্থন করে জবাব দিল তার প্রশ্নের, হ্যাঁ, জানে। আমাদের যাওয়ার কথা সিটি এডিটরকে জানিয়েছে। বাবা। ম্যানেজিং এডিটরকেও জানিয়ে রেখেছে, কারণ হোটেলের বিলগুলো ওই মহিলাকেই শোধ করতে হবে।

পাশে কাত হয়ে ঝুঁকে এসেছে, খাপের ভেতর উঁকি দেবে এই সময় আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন জোনস।

ঝট করে খাপ থেকে হাত সরিয়ে আনল কিশোর। ঝুঁকে জুতোর ফিতে বাঁধার ভান করল, যেন খুলে গেছে ওটা।

শেষবারের মত লম্বা একটা টান দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটটা মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে মারলেন জোনস। এরকম জায়গায় সিগারেটের গোড়া ফেলাটা যেন সইতে পারল না মুসা, অনেক সময় জুতো দিয়ে থেঁতলানো সিগারেটেও আগুন থেকে যায়, পুরোপুরি নেভে না, আর সেটা থেকে সৃষ্টি হয় আগুন, বিড়বিড় করে এসব কথা বলে নিচু হয়ে গোড়াটা তুলে নিয়ে পকেটে রেখে দিল, নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে বলে।

তোমরা কখন যাচ্ছ বলা হয়েছে? আবার হাঁটতে আরম্ভ করেছেন জোনস। উঁচু, ধূসর দেয়ালটার কাছে প্রায় পৌঁছে গেছেন তারা।

গতকালই যাওয়ার কথা ছিল, রবিন বলল। বুঝে ফেলেছে, জোনসকে বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর, কাজেই সেই মতই কথা বলতে লাগল গোয়েন্দা সহকারী।

 রবিনের দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছেন জোনস, এই সুযোগে আরেকবার ডালা তুলে ভেতরে দেখার চেষ্টা চালাল কিশোর। হেসে ঠাট্টা করে মাঝে মাঝেই মুসা বলে ওকে, পকেটমার হলেও তুমি উন্নতি করতে পারতে। বাপরে বাপ, কি হাত সাফাই! আসলেই, কাজটা খুব ভাল পারে গোয়েন্দাপ্রধান। অনেক সময় বাজি ধরে মুসা আর রবিনের পকেট মেরে দিয়েছে, টেরই পায়নি। ওরা।

তাহলে তো তোমাদেরকে খুঁজতে কাউকে পাঠাবেই ওরা, জোনস বললেন।

 খাপের ভেতরে দেখার জন্যে সাবধানে পাশে ঝুঁকে এল কিশোর।

যে-কোন মুহূর্তে সার্চ পাটি চলে আসতে পারে, রবিন বলল।

আরও তাড়াতাড়ি করা দরকার, মুসা বলল। ওরা এসে পড়ার আগেই আমরা চলে যেতে পারলে ঝামেলা বাঁচত। বলতে বলতে জোনসের একেবারে পাশে চলে এল সে, কিশোরের কাছে, সে-ও দেখার চেষ্টা করল খাপের ভেতরে কি আছে।

রাইফেলের ওপরের ক্যারিইং হ্যাঁণ্ডেল দেখতে পেল কিশোর। অস্ত্রটার অস্বাভাবিক আকৃতির মানে বুঝে ফেলল।

হঠাৎ আরেকবার দাঁড়িয়ে গেলেন জোনস।

এই কি করছ! রাগত গলায় বললেন তিনি। বলেই কিশোরের হাতটা চেপে ধরে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলেন। পিছিয়ে গেলেন এক পা। সরু হয়ে এল চোখের পাতা। খাপ থেকে টান দিয়ে বের করে নিলেন রাইফেল।

 হু, যা ভেবেছি, বিড়বিড় করল কিশোর, এম সিক্সটিন! খাপটা তৈরিই হয়েছে এভাবে, যাতে এম-১৬ রাইফেলের বিশেষ হ্যাঁণ্ডেল, পিস্তল গ্রিপ আর ফোলা ম্যাগাজিন জায়গা হয়ে যায়।

কি বলো? কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল রবিন।

এম সিক্সটিন প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধে, বলতে থাকল। কিশোর, দুরুদুরু করছে বুক। এখন পৃথিবীতে বেশ জনপ্রিয় অস্ত্র এটা। তবে এগুলো ব্যবহার হয় মানুষ শিকারের জন্যে, জানোয়ার নয়। কে আপনি, মিস্টার, জোনস? আমাদেরকে নিয়ে কি করার ইচ্ছে?

চেয়েছিলাম ভাল কিছুই করতে, জবাব দিলেন জোনস, তোমরা তা হতে দিলে না। বেশি ছোঁক ছোঁক করলে তার ফল ভাল হয় না কোনদিনই। আর কোন উপায় রাখলে না আমার জন্যে। যাও, পাহাড়ে চড়। আমার সঙ্গেই যেতে হচ্ছে। তোমাদের।

.

১১.

এই, এসো তোমরা, মিনমিন করে বলল কিশোর, মিস্টার জোনসের মাথা গরম করে দিয়ে লাভ নেই। পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল সে।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে তার এই আচমকা পরিবর্তনে অবাক হয়ে গেল রবিন আর মুসা। কি করতে চাইছে? ভাল অভিনেতা কিশোর পাশা। ছোট বেলায় মোটোরামের অভিনয় করে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। অভিনয় যে করছে বোঝাই মুশকিল, মনে হয় এক্কেবারে স্বাভাবিক। তবু, যেহেতু চেনে ওকে, দুই সহকারীর মনে হলো, এই মুহূর্তে অভিনয়ই করছে সে।

হাঁট! শীতল কঠিন গলায় আদেশ দিল সোনালিচুল লোকটা।

হাঁটতে লাগল রবিন আর মুসা। পেছনে রাইফেল তাক করে ধরে এগোল জোনস।

মিস্টার মিলফোর্ডের কাছেই নিয়ে যাচ্ছেন তো আমাদের? ফিরে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল কিশোর।

চুপ! ধমক দিয়ে বলল জোনস, কোথায় নিয়ে যাব সেটা আমার ব্যাপার। একদম চুপ!।

আপনিই তাহলে আমার বাবাকে কিডন্যাপ করেছেন? বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন। কেন করলেন?

তোমাদের মতই ছোঁক ছোঁক করছিল, বিশেষ করে তোমার ওই বন্ধুটির মত, কিশোরকে দেখিয়ে বলল জোনস। সেজন্যেই আটকাতে হল। লাভ হয়নি কিছুই। একটা কথাও বের করতে পারিনি মুখ থেকে।

নীরবে পশ্চিমমুখো হেঁটে চলল ওরা। পাহাড়ে চড়ার জন্যে একটা সুবিধেমত জায়গা খুঁজছে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর, জিভ বের করে ফেলবে, যেন কুকুরের মত। এত জোরে হাঁটাবেন না আমাদেরকে, প্লীজ! অনুনয় করে বলল।

হাঁট! আবার ধমক লাগাল জোনস। আস্তে যাওয়া চলবে না!

হাউফ! করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল কিশোর। শেওলায় ঢাকা একটা পাথরে পা ফেলল ইচ্ছে করেই, সড়াৎ করে পিছলে গেল পা, চিত হয়ে পড়ে গেল রবিনের গায়ে।

টলে উঠল রবিন। তাল সামলাল কোনমতে।

চোখ মিটমিট করল মুসা। পরক্ষণেই বুঝে ফেলল কি চালাকি করেছে কিশোর আর রবিন।

ভ্রূকুটি করল জোনস। দ্বিধায় পড়ে গেছে।

একটা মুহূর্তের দ্বিধা। সেটাই কাজে লাগাল মুসা। পাই করে ঘুরল। কারাতের প্রচুর প্র্যাকটিস চিতার মত ক্ষিপ্র করে তুলেছে ওকে। চোখের পলকে সোজা হয়ে গেল ভাজ করা কনুই, থাবা লাগল রাইফেলে। কারাতের হাইশু-ইউঁকি। জোর। থাবা খেয়ে একপাশে সরে গেল ভারি রাইফেলের নল।

ভাগ! ভাগ! চিৎকার করে বলল রবিন আর কিশোরকে।

পলকে যেন পায়ে হরিণের গতি চলে এল দুই গোয়েন্দার। তৃণভূমির ওপর দিয়ে ছুটল পশ্চিমের বনের দিকে।

এক লাফে সামনে চলে এল মুসা। শক্ত ঘুসি লাগাল জোনসের পুরু বুকে, কারাতের ওই-জুকি।

 টলে উঠল যেন পাহাড়। পিছিয়ে গেল জোনস। ভারসাম্য হারাল। হাত থেকে রাইফেল ছাড়ল না।

বনের দিকে দৌড় দিল মুসা।

শট শট করে গাছে বিধল একঝাঁক বুলেট। বাতাসে উড়তে লাগল পাইনের নীড়ল, বাকল আর ধুলো। ভয়ে চিৎকার করে, আকাশে উড়ল পাখি। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বুকে হিঁচড়ে চলে এল ঝোপের ভেতর।

ডক! হিলারি! চেঁচিয়ে ডাকল জোনস। কোথায় গেলে? আলসের দল! জুলদি বেরোও! ধর ব্যাটাদের! পালানর চেষ্টা করছে!

মাথা তুলল মুসা। তৃণভূমিতে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা জোনসকে দেখতে পাচ্ছে। লোকটার হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা ওয়াকি-টকি। সেটাতেই কথা বলে আদেশ দিচ্ছে।

ডক সেই দুজনের একজন, রবিন বলল ফিসফিসিয়ে, যারা বনের ভেতর তাড়া করেছিল আমাদের। গলা খুবই কর্কশ।

তাহলে হিলারি নিশ্চয় অন্য লোকটা, কিশার অনুমান করল। ওরা আমাদের খেদিয়ে নিয়ে গিয়ে জোনসের মুখে ফেলেছিল। তখনই বোঝা উচিত ছিল আমার, এত সহজে পিছ ছেড়ে দিল দেখেই। জোনসের সিগারেট আর প্যাকিং বাক্সের গায়ে লেখা নাম বিশ্লেষণ করে কি বের করেছে, দুই সহকারীকে জানাল সে।

অসম্ভব, মানতে পারল না রবিন। পিকআপটাকে স্যাবোটাজ সে করেনি। ছিলই না গাঁয়ে, কি করে করবে?

আমার বিশ্বাস, মুসা বলল, শয়তানীটা মোড়লের।

আপাতত ওসব চিন্তা বাদ, কিশোর বলল, পরে ভাবা যাবে। চলো, চলো।

 বাবার কি হবে? রবিন জিজ্ঞেস করল।

একটা ব্যাপারে আমরা এখন শিওর, কিশোর বলল, জোনসের কথা থেকে। আঙ্কেল জীবিতই আছেন। আগে আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে হবে। তারপর খুঁজে বের করব তাকে।

তুণভূমির দিকে তাকাল তিনজনেই। বনের দিকে তাকিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জোনস।

গুলি বাঁচাচ্ছে ব্যাটা, কিশোর বলল। আমাদের না দেখে শিওর না হয়ে গুলি করবে না।

আস্তে করে উঠে দাঁড়াল তিনজনে। মাথা নিচু করে পা টিপে টিপে এগোল বনের দিকে।

ওই যে! ওই তো! ডকের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল।

 ছয় কদম দৌড়ে গিয়ে যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল গোয়েন্দারা।

তাকিয়ে রয়েছে আরেকটা এম-১৬ রাইফেলের দিকে।

এবার রাইফেল তাক করেছে কালো চুল, রোদে পোড়া চামড়া, নীল চোখওয়ালা একটা লোক। নলের মুখ ঘোরাচ্ছে একজনের ওপর থেকে আরেকজনের ওপর। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল ঠোঁটে, ঠোঁটেই রইল, মুখে ছড়াল না হাসিটা।

ধরেছি, বলল লোকটা। ওর কণ্ঠস্বরেই বুঝতে পারল গোয়েন্দারা, হিলারি।

বাঁ দিক থেকে বেরিয়ে এল আরেকজন। তার হাতেও একটা এম-১৬।

পালিয়ে বাঁচতে আর পারলে না, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল ডক। ছোটখাট শরীর, খাটো করে ছাঁটা বাদামী চুল, ঘন ভুরু। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি তেমন নেই ছেলেগুলোর। বেপরোয়া, এই যা।

পেছন থেকে শোনা গেল জোনসের কথা, যাও, নিয়ে চল ওদের। অনেক পথ যেতে হবে।

কি বলল শুনলে তো? গোয়েন্দাদেরকে বলল ডক। হট।

শ্রাগ করল মুসা। চুপ করে রইল রবিন আর কিশোর। আদেশ পালন না করে আর উপায় নেই।

কি হলো! ধমকে উঠল ডক, দাঁড়িয়ে আছ কেন?

বলেই ভুলটা করল। মুসার পিঠে চেপে ধরল রাইফেলের নল।

গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে গেল মুসা। একপাশ থেকে থাবা দিয়ে ধরে ফেলল নল। ওভাবে ধরেই জোরে এক ঠেলা দিয়ে বাঁটের গুতো মারল ডকের। পেটে। হুক করে উঠল লোকটা। হা হয়ে গেছে মুখ। হাসফাস করছে বাতাসের জন্যে।

দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। পড়তে আরম্ভ করল।

রবিনও চুপ করে রইল না। ঝট করে পা সোজা করে অনেক উঁচুতে তুলে হফেলল। লাথি চালাল, কারাতের ইওকো-গেরিকিয়াজ হিলারির চোয়ালে লাগল লাথিটা। টলে উঠে পিছিয়ে গেল হিলারি। এক লাফে আগে বেড়েই আবার একই কায়দায় লাথি মারল রবিন। কাটা কলাগাছের মত ঢলে পড়ে গেল হিলারি।

 এক দৌড়ে পাইনের জটলায় ঢুকে পড়ল কিশোর। বনের প্রান্তে থাকা জোনসের ওপর তার জুডোর প্র্যাকটিসটা করার ইচ্ছে। তবে শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বাতিল করে দিল সে। জুডো কারাত কোনটারই দরকার পড়ল না। গাছের আড়াল থেকে শুধু একটা পা হঠাৎ বাড়িয়ে দিল সামনে। কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি জোনস, সতর্ক ছিল না, কিশোরের পায়ে হোঁচট খেল।

ততক্ষণে মুসাও পৌঁছে গেছে সেখানে। কনুই দিয়ে অতোশি হিজি-আতি মারল জোনসের ঘাড়ে। হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে বিশালদেহী। লোকটা।

মুহূর্ত দেরি করল না তিন গোয়েন্দা। এক ছুটে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে।

পেছনে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল জোনস, ধর, ধর ওদেরকে! পালিয়ে গেল তো!

থামল না ছেলেরা। গাছের পাশ কাটিয়ে, পাথর ডিঙিয়ে ছুটে চলেছে দক্ষিণে। পেছনে শোনা যাচ্ছে ভারি জুতো পায়ে ছুটে আসার শব্দ।

ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ওরা। হতাশা বাড়ছে, যখন দেখছে জুতোর শব্দ থামছে না, কাছেই আসছে আরও।

পশ্চিমে ঘুরে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটল মুসা। রাস্তাটা চিনতে পারল রবিন। ঝর্না থেকে পানি ভরতে এসেছিল সেদিন এই পথেই।

একটা বুদ্ধি বের করতে হবে,হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। এভাবে চলে পারব না!

বাবাকেও বাঁচাতে হবে! বলল রবিন।

পেছনে উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল।

 রাস্তাটা পেয়ে গেছে ব্যাটারা, মুসা বলল।

 রাস্তা ধরে ছুটলে ঠিক এসে আমাদেরকে ধরে ফেলবে, বলল রবিন।

পিকাপের কথা ভুলে যেতে হবে আমাদের, ছুটতে ছুটতেই বলল কিশোর। মুসা, জোনস যে রাস্তাটার কথা বলেছে সেটা খুঁজে বের করতে পারবে?

কাঠ নেয়ার রাস্তা, বিড়বিড় করল মুসা, হাইওয়েতে গিয়ে যেটা পড়েছে। মালটি বলেছিল অবশ্য ওটার কথা। ইনডিয়ানদের রাস্তাটা বোধহয় ওটাতেই পড়েছে।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল কিশোর। বনের ভেতর কিভাবে বাঁচতে হয়, জানা আছে তোমার। ইস, কেন যে তোমার মত ট্রেনিংটা নিলাম না, কাজে লাগত! বাঁচলে ফিরে গিয়ে নিশ্চয় নেব এবার…

কি করতে হবে সেকথা বলো? বাধা দিয়ে বলল মুসা।

 তুমি বেশি দৌড়াতে পার। তোমার গায়ে শক্তি বেশি। বনে বেঁচে থাকার। ট্রেনিং আছে। ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে কেউ যদি পৌঁছতে পারে, সেটা তুমি।

হয়তো পারব। কি বলতে চাও?

আমি বুঝেছি, রবিন বলল, জোনস আমাদের পিছে লেগে থাকুক, এই তো চাও?

হ্যাঁ,সায় জানাল কিশোর।

দ্রুত একবার হাত মিলিয়ে নিয়ে, গুড বাই আর সি ইউ এগেন বলে পথ থেকে সরে গেল মুসা। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে। জোনসের লোকেরা কিশোর আর রবিনকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়ার পর আবার এসে পথে উঠবে সে, চলতে থাকবে ডায়মণ্ড লেকের উদ্দেশে।

ছুটে চলেছে কিশোর আর রবিন।

লুকিয়ে পড়ার জায়গা খোঁজা দরকার, কিশোর বলল।

উপত্যকায় চলে গেলে কেমন হয়? বিপদে পড়েছি আমরা, ইচ্ছে করে তো যাচ্ছি না। আশা করি ইনডিয়ানদের মরা দাদারা কিছু মনে করবে না।

ভাল বলেছ! ভীষণ হাঁপাচ্ছে কিশোর।

পথের একটা চওড়া জায়গায় এসে থামল রবিন। এবার আর জোনসও আসছে কিনা না দেখে যাচ্ছি না। আর গিয়ে ওর মুখে পড়তে রাজি নই।

হাসল কিশোর। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, রবিন, আমি আর পারছি না! বসতে আমাকে হবেই!

তোমার তো সব সময়ই খালি বসা লাগে! চিৎকার করেই জবাব দিল রবিন। তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না! এরকম সময়েও…।

একটা ভুরু উঁচু হয়ে গেল কিশোরের। ভাবল, আসলেই বলছে না তো? অভিনয় বলে মনেই হলো না। বলল, পার আর না-ই পার, আমি বসছি!

চুপ হয়ে গেল দুজনে। কান পেতে রইল। তিনজনই আসছে, সন্দেহ নেই। দুপদাপ দুপদাপ শোনা যাচ্ছে ওদের পায়ের শব্দ।

সর্বনাশ হয়ে গেছে! বলে উঠল রবিন।

কী?

বোতলটা উঁচু করে ধরল রবিন।

ও, দেয়া হয়নি!

না, মাথা নাড়ল রবিন। পানির অভাবেই শেষে মরে কিনা কে জানে!

.

১২.

লুকিয়ে থেকে কিশোর আর রবিনের কথা সবই শুনতে পেল মুসা। একটু পরেই ভারি পায়ের শব্দ ছুটে চলে গেল তার পাশ দিয়ে।

মুসার কল্পনায় ভেসে উঠল, ভয়ঙ্কর এম-১৬ রাইফেলের চেহারা, যেগুলো বহন করছে জোনস আর তার সহকারীরা। দুই বন্ধুর জন্যে ভাবনা হতে লাগল। তার। জোর করে ঠেলে সরাল মন থেকে দুশ্চিন্তা। ভাবলে কাজ কিছু হবে না। এখন তাকে যা করতে হবে, তা হলো ডায়মণ্ড লেকে পৌঁছানো। নিজেদের কাঁধে। বিপদ নিয়ে তাকে মুক্ত করে দিয়েছে কিশোর আর রবিন, মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে, এখন সে যদি কিছু করতে না পারে, সবই বিফলে যাবে।

সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করেছে। বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সময় নেই। আর এই মুহূর্তে আলস্যকে প্রশ্রয় দিলে পস্তাতে হবে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। পায়ের শব্দ আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার সময় দিল। তারপর চলতে শুরু করল একটা বিশেষ ভঙ্গিতে, লাফ দিয়ে দিয়ে, এভাবে চললে গতিও বাড়বে, ক্লান্তও হবে কম। দুর্গম অঞ্চলে টিকে থাকার জন্যে ট্রেনিং নেয়ার সময় এটা শেখানো হয়েছে ওকে।

ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আবহাওয়া। বাতাস বাড়ছে। শরশর কাঁপন তুলছে গাছের পাতায়।

 জন্তুজানোয়ার চলার সরু একটা পথ ধরে এগোল সে। তৃণভূমিতে বেরিয়ে ওটার ধার দিয়ে এগোল পাহাড়ের দিকে। সাবধান থাকল। দেখেছে, ডক আর হিলারি ছাড়া জোনসের সঙ্গে আর কোন সহকারী নেই, তবু বলা যায় না। খোলা জায়গায় বেরোল না কিছুতেই, গাছের আড়ালে আড়ালে থাকল।

পাহাড়ের কাছে পৌঁছেই ওপরে উঠতে শুরু করল। নিচে থাকার চেয়ে এখন ওপরে থাকা নিরাপদ। নির্জন মালভূমিটার ওপরে উঠে হাঁপ ছাড়ল। দম নিতে নিতে তাকিয়ে দেখল নিচে কোথাও কিছু দেখা যায় কিনা। এখানেই কোথাও রবিনের বাবার ক্যাপটা পড়ে ছিল। সম্ভবত এখান থেকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু কেন? জবাব খুঁজে পেল না।

বনে ছাওয়া পর্বতের ঢালের দিকে তাকাল সে। বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে। এত ওপরে এমনিতেই বেশি থাকে। পাতলা টি-শার্ট ভেদ করে যেন। ছুরির ফলার মত বিধতে লাগল। জ্যাকেট কোমরে জড়ানো রয়েছে, স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটটা পকেটে। দুটোই লাগবে, তবে পরে। রবিনের কাছ থেকে বোতলটা না এনে ভুল করেছে। মনে পড়েছে অনেক দেরিতে। ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। তখন আর। খাবার বলতে সাথে রয়েছে কিছু ক্যাণ্ডি, তবে এটুকু আছে যে এর জন্যেই ধন্যবাদ দিল ভাগ্যকে।

উত্তরে ঘুরল সে। কাঁধে আর পিঠে পড়ছে রোদ। লক্ষ্য রাখতে হবে এটা। এখন সূর্যই তার একমাত্র কম্পাস।

ঘন হয়ে জন্মে থাকা কতগুলো গাছের কাছে উঠে গেছে পাহাড়ের একটা চূড়া। সেখানে উঠে এল সে। পথ খুঁজতে লাগল। কিছুই নেই, কোন পথই চোখে পড়ল না। শেষে গাছের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে চলল উত্তরে।

খাড়া হয়ে আসছে ঢাল। চলার গতি আপনাআপনিই কমে গেল ওর। দিগন্তের দিকে দ্রুত নেমে চলেছে সূর্য। খাড়াই বেয়ে ওঠার পরিশ্রমে ঘামে ভিজে গেছে ওর শরীর।

একটা জায়গায় এসে সমান হয়ে এগিয়ে গেল কিছুদূর পথ, তারপর আবার। উঠে গেল। _ একটা শৈলশিরায় এসে পড়ল মুসা। দাঁড়িয়ে গেল। তাকিয়ে রয়েছে নিচের দিকে।

অবাক কাণ্ড! অলৌকিক ব্যাপার মনে হচ্ছে ওর কাছে।

পুবে-পশ্চিমে চলে গেছে একটা কাঁচা রাস্তা, ইনডিয়ানদের পথটার দ্বিগুণ চওড়া। মনে হয় এটাই সেই রাস্তা, কাঠ চালান করার জন্যে তৈরি করা হয়েছে, মালটি যেটার কথা বলেছিল।

শৈলশিরা থেকে নেমে এসে পথের ওপর দাঁড়াল মুসা। একটা কাজের কাজ হয়েছে পথটা পেয়ে গিয়ে। দারুণ খুশি লাগছে ওর। অন্ধের মত আর বনের ভেতরে পথ হাতড়ে মরতে হবে না। এখন একটা গাড়ি যদি পেত, ইস্…

হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। যেতে হবে আরও অনেক দূর। পঁচিশ তিরিশ মাইলের কম না। হাইওয়েতে পৌঁছে একটা গাড়ি পেলে বেঁচে যেত।

পশ্চিমে চলতে লাগল সে। ডুবন্ত সূর্যের শেষ আলোর উজ্জ্বল বর্শাগুলো এসে লাগছে চোখেমুখে। হাঁটতে হাঁটতেই কোমর থেকে খুলে নিল জ্যাকেটটা। দ্রুত নেমে যাচ্ছে তাপমাত্রা।

ডুবে গেল সূর্য। দেখা দিল ভরা চাঁদ। একটা পুলের কাছে পৌঁছল সে। দুটো সরু নদী পরস্পরকে ক্রসের মত কেটেছে যেখানে, ঠিক তার ওপরে তৈরি হয়েছে পুল। ঠাণ্ডা বাতাসে কুয়াশার মত এক ধরনের বাষ্প উড়ছে। পাইনের গন্ধে বাতাস, ভারি। পানি দেখে পিপাসা টের পেল, কিন্তু খাওয়াব সাহস করতে পারল না।

পুলের অন্য পাশে এসে থামল সে। চাঁদের আলোয় মনে হলো, মূল রাস্তাটা থেকে আরেকটা রাস্তা নেমে চলে গেছে। ভাল করে তাকাতে বুঝল, রাস্তাই। হবে। হয়তো ফরেস্ট সার্ভিসের ফায়ার রোড। নিচের দিকে নেমে গিয়ে এগিয়ে গেছে নদীর ধার ধরে। ঘুরতে আসা মানুষকে ঠেকানোর জন্যেই বোধহয় একটা গেট তৈরি করা হয়েছে এক জায়গায়, নতুন খিল লাগানো, চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওটার রূপালি রঙ। সরু রাস্তা আর নদীটা পাশাপাশি এগিয়ে গিয়ে ঢুকেছে। পাহাড়ের মাঝের একটা গিরিপথের মত ফাঁকের ভেতরে।

রাস্তাটা উত্তেজিত করে তুলল মুসাকে। আশা হলো। তবে সেটা মিলিয়ে গেল অচিরেই, যখন মনে পড়ল, এসব জায়গায় ফরেস্ট সার্ভিসের লোক সব সময় থাকে না। ক্বচিত কদাচিৎ দেখতে আসে, সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। এসব রাস্তা তৈরি করে রাখা হয়েছে দাবানল লাগলে নিভাতে যাওয়ার জন্যে। জরুরী অবস্থা না দেখলে ফরেস্ট সার্ভিসের কর্মীদের এখানে আসার কোন কারণ নেই।

যা করছিল তা-ই করতে লাগল মুসা। আবার এগিয়ে চলা। চলতে চলতেই ক্যাণ্ডি খেয়ে নিল সে। ক্লান্তি বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ঠাণ্ডা। পর্বতের দিক থেকে ভেসে আসছে কয়োটের ডাক, মন ভারি করে দেয় ওই শব্দ। ভীষণ নিঃসঙ্গতা বোধ চেপে ধরে যেন।

.

মুসা যখন বনের ভেতরে ঢুকে ঘাপটি মেরে ছিল, রবিন আর কিশোর তখন ছুটছে। পেছনে ধাওয়া করছে ভারি পায়ের শব্দ। ওরা যত জোরে ছুটছে, পেছনের লোকগুলো আরও জোরে ছুটছে। না ধরে আর ছাড়বে না।

ওই শব্দ শোনার ভাল দিকও আছে, মন্দ দিকও আছে। ভাল দিকটা হল, লোকগুলো মুসাকে দেখতে পায়নি। আর মন্দ দিকটা হলো ধরা পড়তে যাচ্ছে দুজনে, যদি ওদের চোখে ধুলো দেয়ার কোন ব্যবস্থা এখনই করতে না পারে।

নদীর কাছে পৌঁছে গেল ওরা, ইনডিয়ানদের টুয়ক। নদীর ধার ধরে উজানের দিকে ছুটল। শেষ বিকেলের জোরাল বাতাস নদীর পানি ছুঁয়ে এসে ঝাঁপটা মারছে ওদের মুখে। সালফারের গন্ধ জ্বালা ধরাচ্ছে চোখে।

আগে আগে ছুটছে রবিন। আগের দিন যে পাথুরে পথটা ধরে গিয়েছিল, যতটা সম্ভব সেটাকে এড়িয়ে থাকতে চাইছে। দম ফুরিয়ে গেছে ওদের। ক্লান্তিতে পা আর চলতে চাইছে না। সগর্জনে ঝরে পড়ছে জলপ্রপাত, অনেকগুলো নালা দিয়ে গড়িয়ে চলেছে পানি, রোদ পড়ে চিকচিক করছে।

বাআহ, চমৎকার! প্রপাতের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, এখানেই ধসের কবলে পড়ে মরতে বসেছিলে নাকি?

হ্যাঁ, ভাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। ওই যে, আসছে!

কিশোরও তাকাল সেদিকে। প্রায় আধ মাইল দূরে বড় একটা পাথরের চাঙড়– ঘুরে আসছে তিনজন লোক। সবার আগে রয়েছে জোনস। কাঁধে ঝোলানো এম ১৬ রাইফেল। ওপরের দিকে তাকিয়েই দেখে ফেলল গোয়েন্দাদের। ডক বোধহয় বলল কিছু, এতদূর থেকে তার কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল না, কেবল মুঠি পাকিয়ে নাড়াচ্ছে যে সেটা দেখা গেল।

আর এখানে থাকা চলবে না! কিশোর বলল।

দ্রুত আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়ল রবিন। পেছনে রইল কিশোর। কিছুদূর এগিয়ে থামল রবিন। পাহাড়ের খাড়া দেয়ালের দিকে মুখ। হাত বাড়িয়ে একটা খাজ চেপে ধরল। আরেকটা খাজে পা রাখল। বেয়ে উঠতে লাগল সে।

কিশোরও রবিনের মত একই ভাবে এক খাজে আঙুল বাধিয়ে আরেক খাঁজে পা রেখে উঠতে শুরু করল। ককিয়ে উঠল। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির পর এখনকার এই পরিশ্রমটা অসহনীয় লাগছে। কপালের ঘাম চোখের পাতায় পড়ে অস্বস্তি লাগছে, মুখেও ঘাম। হাতের তালু ঘামছে। আঙুল পিছলে না গেলেই হয় এখন।

রবিনের অতটা কষ্ট হচ্ছে না। পাহাড় বেশ ভালই বাইতে পারে সে। ছোট বেলা থেকে এই অভ্যেস। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে পা-ও ভেঙেছে। তার। পরেও লোভটা ছাড়তে পারে না সে। তবে এই মুহূর্তে ভাল না লেগে বরং বিরক্তিই লাগছে। কোন ব্যাপারে বাধ্য করা হলে যা হয় আর কি মানুষের।

নিশ্চিত ভঙ্গিতে উঠে চলেছে রবিন। একটি বারের জন্যে আঙুল ছুটছে না, পা ফসকাচ্ছে না।

কিশোর অতটা সহজ ভাবে পারছে না। অনেক নিচে রয়ে গেছে সে।

খাড়া দেয়াল বেয়ে প্রপাতের ওপরে উঠে গেছে রবিন। এর ওপাশেই রয়েছে। ইনডিয়ানদের প্রাচীন সমাধি উপত্যকা।

হাত-পা ভীষণ ভারি লাগছে কিশোরের। টনটন করছে। থরথর করে কাঁপছে হাত। মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাবে। এখন হাত অবাধ্য হয়ে গেলে…আর ভাবতে পারছে না সে। গালাগাল করছে নিজেকে, এই পাহাড়ে চড়া আরম্ভ করেছিল বলে। বাঁচতে চাইলে উঠতেই হবে এখন, হাল ছেড়ে দেয়ার আর কোন উপায় নেই।

ঠিক এই সময় ডান পা পিছলাল তার। এতই আচমকা, বুঝতেই পারেনি এরকমটা ঘটবে। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে রয়েছে, প্রপাতের পানির কণা উড়ে এসে আশপাশের পাথরকে ভিজিয়ে বরফের মত পিচ্ছিল করে রেখেছে। ডান পা-টাকে তুলে আনার চেষ্টা করতেই পিছলে যেতে শুরু করল ডান হাত।

মরিয়া হয়ে আঙুলগুলোকে আটকে রাখতে চাইল সে। বুকের খাঁচায় পাগল হয়ে গেছে যেন হৃৎপিণ্ডটা, ধড়াস ধড়াস করে লাফ মারছে, বেরিয়ে আসার ষড়যন্ত্র! অনেক চেষ্টা করছে কিশোর, কিছুতেই আটকে থাকছে না আঙুলগুলো। হাতের দিকে তাকাল একবার। ছুটে গেল আঙুল।

সময় যেন স্থির হয়ে গেছে।

 জায়গামত রয়েছে কেবল এখন ওর বাঁ হাত আর বাঁ পা।

নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে শরীর। ভয়ে দেয়ালের উঁচুতে একপাশের কজা খুলে যাওয়া দরজার পাল্লার মত ঝুলছে সে। এইবার আর আমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারল না, ভাবল। নিচের পাথরে পড়ে ছেচে ভর্তা হয়ে যাব!

কিশোর! ওর অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে রবিন।

 সাদা হয়ে গেছে কিশোরের মুখ।

জলদি মুখ চেপে ধর দেয়ালে! চিৎকার করে বলল রবিন। নিচের দিকে তাকাবে না! ভয় যেন অক্টোপাসের বাহু দিয়ে জড়িয়ে চাপ দিচ্ছে ওর বুকে। কিশোরকে বাঁচাতেই হবে। ডান কাঁধটা নাড়াও! ডান পা সরিয়ে নিয়ে যাও দেয়ালের দিকে। খুব আস্তে।

কিন্তু নড়লও না কিশোর।

কি ব্যাপার? শুনতে পায়নি নাকি? আরও জোরে চিৎকার করে ডাকল রবিন, কিশোর! সাড়া পেল না এবারেও। সাহায্য করতে হলে ওর কাছে যেতে হবে। নামতে শুরু করল সে।

রবিন যে আসছে বুঝতে পারল কিশোর। তবে দেখতে পাচ্ছে না। মৃদু খসখস কানে আসছে। নিজে তো বিপদে পড়েছেই, আরেকজনকেও বিপদে ফেলতে যাচ্ছে মনে হতেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল মন। ধমক দিল নিজেকে, এই গর্দভ! ভয় দূর কর। এভাবে মরার কোন অর্থ হয় না!

পৌঁছে গেল রবিন। কিশোরের ফ্যাকাসে মুখে বেপরোয়া ভাব দেখতে পেল সে। তাকিয়ে রইল রবিন। বুঝতে পারল, আবার চালু হয়ে গেছে কিশোরের খুলির ভেতরে সাংঘাতিক সজাগ ক্ষুরধার মগজটা। এইবার ঠিকমত শ্বাস নিতে পারল রবিন। আশা হল, বেঁচে যাবে এযাত্রা ওর বন্ধু।

হঠাৎ ঝটকা দিয়ে আগে বাড়ল কিশোরের মুখ। কেঁপে উঠল ডান, কাঁধটা, আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে শুরু করল দেয়ালের দিকে। তারপর এগোতে শুরু করল ডান পা।

ডান হাতটা নড়ে উঠল। পাথরের গা হাতড়ে হাতড়ে আঁকড়ে ধরার জায়গা। খুঁজছে। পেলও। পা-টা ঢুকিয়ে দিল আরেকটা খাজে। দেয়ালে বুক ঠেকিয়ে বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করল, যদিও এই অবস্থায় বিশ্রাম হয় না।

হয়ে গেছে, কিশোর, পেরেছ! আনন্দে চোখ দিয়ে পানি এসে যাওয়ার জোগাড় হলো রবিনের। আর ভয় নেই। এসো, ওঠো আমার পিছে পিছে। ওপরে চ্যাপ্টা একটা জায়গা আছে, ঝোপ আছে, লুকিয়ে থাকতে পারব। আমাদেরকে দেখতে পাবে না ওরা। এসো, কিশোর, আর বেশি ওপরে নেই।

শক্ত হয়ে গেছে যেন বাঁ হাত। নড়াতে পারবে না আর কোনদিনই, পাথরের সঙ্গে থেকে থেকে পাথরই হয়ে গেছে। দুত্তোর বলে জোর করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে এল কিশোর। ওপরে বাড়াল। ধরল আরেকটা খাঁজ। আত্মবিশ্বাস বাড়ল। আবার উঠতে লাগল।

ওপরে ওপরে উঠছে রবিন। অবশেষে উঠে গেল সরু একটা শৈলশিরায়। শিরার কিনারে গজিয়ে আছে কাঁটাঝোপ। মাথা কাত হয়ে আছে নিচের দিকে। ওই ঝোপের ওপাশে কোনমতে চলে যেতে পারলেই হল, লুকিয়ে বসতে পারবে, নিচে থেকে দেখা যাবে না ওদেরকে।

এসে গেছে ওরা! বলল রবিন, আরেকটু তাড়াতাড়ি করো!

পারল না কিশোর। সেই একই রকম শামুকের গতি। হাত-পা যে আর ফসকাচ্ছে না, এতেই খুশি সে। তাড়াহুড়া করার ক্ষমতাই নেই। দীর্ঘ অনেকগুলো যুগ পার হয়ে যেন অবশেষে রবিনের কাছে উঠে আসতে পারল সে। ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে নিচের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল রবিন। কিশোরের একটা হাত চেপে ধরে তাকে শৈলশিরায় উঠতে সাহায্য করল।

যাক, পারলে শেষ পর্যন্ত! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন।

কিছু বলল না কিশোর। গড়িয়ে গড়িয়ে কোনমতে ঢুকল ঝোপের ভেতর। চুপ করে বসে চোখ মুদল।

কতটা কাছে এল? খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করল সে।

অনেক কাছে, রবিন জানাল। দেখো না।

প্রপাত থেকে ওঠা শীতল বাষ্প উড়ছে বাতাসে। উপত্যকার দিক থেকে আসা বাতাসের ঝাঁপটায় উড়ে চলে যাচ্ছে, সেই জায়গায় ঠাই নিচ্ছে নতুন বাষ্প। চোখ মেললেই জ্বালা করে। তবু জোর করে তাকিয়ে রয়েছে জোনস আর তার সঙ্গীদের। দিকে। প্রপাতের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে ওরা।

শয়তানগুলো গেল কোথায়? ফোঁস করে উঠল জোনস। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকাতে লাগল পাহাড় আর বনের দিকে।

প্রপাতের গর্জনকে ছাপিয়েও তার কথা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে বলল, তোমাদের দোষ! গাধা কোথাকার! আটকাতে পারলে না!

এখানেই কোথাও আছে ওরা, বসো! হিলারি বলল।

বের করে ফেলব! বলল ডক।

তাহলে করছ না কেন? খেঁকিয়ে উঠল জোনস। কিছুতেই পালাতে দেয়া চলবে না। ওই খুঁতখুঁতে সাংবাদিকটাকে আটকেই ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে। যাবে। ছেলেগুলো যে এতটা বিচ্ছু কল্পনাই করতে পারিনি!

সাংবাদিক কথাটা শুনে পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা।

মনে হচ্ছে, ফিসফিস করে বলল কিশোর, কোন কিছুর তদন্ত করে রিপোর্ট লিখতে এসেছিলেন আংকেল, সে জন্যেই তাকে আটকানো হয়েছে। ডায়মণ্ড লেকের গল্পের সঙ্গে এসবের কোন সম্পর্ক আছে।

ভাবছি, হেরিং লোকটা কে? কি জানে?

এমন ভাবে সারতে হবে, জোনস বলছে, যাতে মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট।

তা করা যাবে। হেরিংকে যা করেছি তা-ই করব। পাথরে মাথা ঠুকে আগে বেহুশ করে নেব। তারপর ফেলে দিলেই হবে, ডক বলল।

আবার একে অন্যের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। খুব চমকে গেছে। জোনসের লোকেরা খুন করেছে হেরিংকে!

না, একই কাজ করতে গেলে সন্দেহ করবে পুলিশ, জোনস বলল। ধরে নিয়ে গিয়ে প্লেনের ভেতরে ভরতে হবে সব কটাকে। ধাড়িটাকে সহ। তারপর দেবে আগুন লাগিয়ে। যাতে মনে হয় ল্যাণ্ড করার সময় পুড়ে মরেছে। আরেকটা অ্যাক্সিডেন্ট। কেউ ধরতে পারবে না।

তা পারবে না, প্রতিধ্বনি করল যেন ডক।

আগে ধর ওদের, জোনস বলল। ডক, তুমি চলে যাও। বিচ্ছুগুলোকে ধরতে সময় লাগবে মনে হচ্ছে। আজ রাতে আরেকটা চালান আসবে। ওটা তুমি সামলাও গিয়ে।

আমি! হতাশ হয়েছে মনে হল ডক।

হ্যাঁ, তুমি। ছেলেগুলোকে ধরে আনব আমরা। তারপর ইচ্ছে হলে আগুন লাগানোর কাজটা তুমিই করো।

উজ্জ্বল হলো ডকের মুখ। ঠিক আছে। ঘুরে জোর কদমে নদীর দিকে রওনা হয়ে গেল সে।

কিসের চালান? রবিনের প্রশ্ন।

হবে কোন কিছু, কিছু ভাবছে কিশোর, রবিনের কথায় মন নেই।

চলো, হিলারি, সঙ্গীকে বলল জোনস, এই প্রপাতের ওপাশে একটা উপত্যকা আছে। ওখানে লুকানোর কথা ভাবতে পারে ছেলেগুলো।

দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল সে।

হাসল হিলারি, বেরিয়ে পড়ল বেকাতেড়া কুৎসিত দাঁত। কাঁধে ঝোলানো এম-১৬টা একবার টেনেটুনে দেখে বসের পিছু নিল সে-ও। উঠতে আসতে লাগল রবিন আর কিশোর যেখানে লুকিয়েছে।

পাথর হয়ে গেল যেন দুই গোয়েন্দা। লোকগুলো উঠে এলেই দেখে ফেলবে ওদেরকে।

Super User