১১.
বাতাসে ক্রমাগত রূপ বদল করছে কুয়াশা। অদ্ভুত সব আকৃতি তৈরি হচ্ছে-কোনটা স্তম্ভ, কোনটা গাছ, কোনটা বা আবার একশো ফুট লম্বা মানুষ।
কিশোর, আমার গা ছমছম করছে, মুসা বলল। ওই যে ওই কুয়াশার স্তরটাকে দেখো, মনে হয় যেন একটা হাতি। সাদা হাতি।
আজব জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কুয়াশার মত আচরণ করছে না। কুয়াশা হলে এক আকৃতিও বেশিক্ষণ থাকত না, বাতাসেও সরে যেত। এই জিনিসটা সরছে না। একই জায়গায় একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেন একটা সাদা হাতি, কিংবা সঠিক ভাবে বললে ছাই-সাদা হাতি।
চোখ ডলল কিশোর।
এখনও আছে ওটা।
উত্তেজনায় টগবগিয়ে উঠল, রক্ত।
এ সত্যি হতে পারে না। শ্বেতহস্তী খুব দুর্লভ। একটা সাদা হাতির জন্যে ওদেরকে দুই লক্ষ ডলার দেবে বলেছে টোকিও চিড়িয়াখানা।
কিশোরের মনে হলো স্বপ্ন দেখছে। তবে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন যে ভাবে দ্রুত বদলাতে থাকে, এটা তেমন করে বদলাচ্ছে না। এক রকম রয়ে গেছে।
কাছে এগোনোর চেষ্টা করলে হয়তো কুয়াশা হয়ে মিলিয়ে যেতে পারে হাতিটা। তখন নিশ্চিত হতে পারবে, স্বপ্ন, নাকি চোখের ভুল?
দেখা যাক এটা সত্যি কিনা, বলল সে। এসো। খুব আস্তে, এক পা এক পা করে।
এগোতে লাগল ওরা।
নড়ল না দানবটা। মিলিয়ে গেল না। ভয় পেয়ে পালাল না। রেগেও গেল না। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। হয়তো আর কখনও মানুষ দেখেনি। সুতরাং জীবগুলোকে ভয় পাবে, না ঘৃণা করবে, বুঝতে পারছে না।
আরও কাছে এসে কিশোর দেখল, সাদাটা আসলে কুয়াশার জন্যে মনে হয়েছে। কিন্তু কুয়াশার মধ্যে আরও হাতি তো দেখেছে আগে, ওগুলোকে তো এ রকম মনে হয়নি? এটাকে এখন হালকা ধূসর লাগছে। তাতে নিরাশ হলো না সে। জানা আছে, শ্বেতহস্তী বলতে ধবধবে সাদা হাতি নয়। তুষার শুভ্র হাতির কথা কেবল গল্প-কাহিনীতেই লেখা থাকে। বাস্তবে যেগুলোকে সাদা হাতি বলা হয়, সেগুলোর চামড়া পুরোপুরি কালো নয়, ফ্যাকাসে ধূসর।
একেবারে কাছাকাছি যেতে পারলে বুঝতে পারত, এই হাতিটার ফ্যাকাসে ভাবটা কতখানি বেশি। যত বেশি হবে, তত দাম বাড়বে।
মুসাও কিশোরের মতই সাবধানে এগোচ্ছে। শ্বেতহস্তীর দাম তারও জানা।
ওদের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না হাতিটা।
দশ ফুটের মধ্যে চলে এল দুজনে। তারপর থামল।
এই মুহূর্তটা জীবনে ভুলবে না ওরা। দম বন্ধ হয়ে আসছে উত্তেজনায়।
এটার চামড়ায় ফ্যাকাসে ভাবটা অনেক বেশি, সেজন্যেই দূর থেকে কুয়াশার মধ্যে সাদা লাগছিল। মাঝে মাঝে লালচে ছোপ। পিঠটা সাদা, ময়লা তুষারের মত, যেন তুষার জমা পর্বতের চূড়া। নখ সাদা, চোখের রঙ লালচে-সাদা। কান আর মাথায় সাদার মধ্যে লাল লাল ছোট-বড় ফুটকি।
আর কোন সন্দেহ নেই, শ্বেতহস্তীই এটা! মাদী হাতি।
সাদা হাতি যে, তার আরও একটা বড় প্রমাণ, কালো হাতির মত বদমেজাজী নয়। মারচিসন ন্যাশনাল পার্কে একটা সাদা গণ্ডার ছিল। অনেকেই লিখেছে ওটার। কথা। খুব নাকি দ্র ছিল ওটা, সাধারণ গণ্ডারের মত বদমেজাজী নয়। সাদা খরগোশ, সাদা ইঁদুর, কালো কিংবা ধূসর জাতের পাখি যেগুলো সাদা হয়ে যায়, সবই নাকি শান্ত স্বভাবের হয়। সাদা রঙের তুষার-চিতাকে ভয় পায় না মানুষ। অথচ কালো চিতা আর কালো জাগুয়ার ভয়ানক হিংস্র হয়।
যে চিড়িয়াখানা এই হাতিটাকে পাবে, তারা অতি ভাগ্যবান। দর্শকদের জন্যে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হবে এটা। অনেক চিড়িয়াখানার এই হাতি কেনার সামর্থ্যই নেই। জাপানীদের আছে, দুর্লভ জানোয়ারের জন্যে তারা খরচও করে। ওরা ঘোষণা করেছে দুই লাখ ডলার দেবে, চাপাচাপি করলে আরও অনেক বেশিও। দিতে পারে, বিশেষ করে এই হাতিটার জন্যে।
মাত্র দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে এতগুলো টাকা, অথচ ধরে নিয়ে যাওয়ার কোন উপায় দেখছে না ওরা। এতবড় একটা হাতির বিরুদ্ধে দুটো ছেলে কিছুই করতে পারবে না। ধরতে হলে অনেক লোকবল দরকার। এই সাফারির জন্যে যত লোক ভাড়া করেছে ওরা, সবাইকে নিয়ে এলেও হয়তো কাজ হবে না। একটাই কাজ করার আছে আপাতত, জানোয়ারটাকে বিরক্ত না করে, চমকে না দিয়ে চুপচাপ পিছিয়ে যাওয়া। তারপর লোকজন নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসা।
হাতিটার ওপর চোখ রেখে আস্তে আস্তে পিছাতে শুরু করল দু-জনে। যে ভাবে এগিয়েছিল, তার চেয়ে সাবধানে।
হঠাৎ কানের কাছে কথা বলে উঠল একটা ভারি কণ্ঠ।
চমকে ফিরে তাকাল ওরা।
ছয়জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে আরবদের সাদা পোশাক। হাতে পিস্তল আর তলোয়ার।
দৌড় দেব নাকি? মুসা বলল।
লাভ নেই। গুলি করে মেরে ফেলবে। বরং কথা বলে দেখি। বাংলা বোঝা প্রশ্নই ওঠে না, ইংরেজিও যে বোঝে না সেটা বোঝা গেল জিজ্ঞেস করতেই, নেতার কাছে জানতে চাইল কিশোর, ইংরেজি জানেন?
জবাবে রাগী ভঙ্গিতে মাথা নাড়ানো আর কিছু আরবী শব্দের তুবড়ি। আকামি যা বলেছে, ঠিক সে-রকম ওদের গায়ের রঙ-সাদাও না, কালোও না। মরুভূমিতে জন্ম, সেখানকার রোদ গাঢ় বাদামী করে দিয়েছে ওদের চামড়া। মাথায় পাগড়ি জড়ানো। পা খালি, জুতো-স্যান্ডেল কিছু নেই। তুষার মাড়াচ্ছে, অথচ ভঙ্গি দেখে মনে হয় না কোন অসুবিধে হচ্ছে। কঠিন লোক ওরা।
কথা বলতে বলতে একবার হাতিটার দিকে, একবার ছেলেদের দিকে তাকাঁচ্ছে নেতা।
ওদের উদ্দেশ্য আন্দাজ করতে পারছে কিশোর।
তাবুতে হামলা মনে হয় এরাই চালিয়েছে, বাংলায় বলল সে। কোনভাবে জেনেছে, হাতি ধরতে এসেছি আমরা। ওরাও এসেছে একই উদ্দেশে। আমাদের হাতিগুলো ওরা চুরি করেছে। এটাকে ধরতেও বাধা দেবে।
এমন ভঙ্গি করো, যেন কোনই আগ্রহ নেই আমাদের।
তাই করতে হবে। চুপচাপ সরে পড়ি চলো। অবশ্য যদি যেতে দেয়।
যেতে দিল না ওরা। যেই পা বাড়াল ছেলেরা, পিস্তলের নল ঠেসে ধরা হলো পিঠে। কাপড় ছিঁড়ে চোখ বেঁধে ফেলল। কেড়ে নেয়া হলো ছুরি দুটো। তারপর এগোনোর জন্যে বেশ জোরে, ব্যথা দিয়ে খোঁচা মারল পিঠে।
চলতে চলতে পাথরে পিছলে, হোঁচট খেয়ে, কিংবা উঁচু-নিচুতে তাল, সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে এগোল দুজনে। সেসব ক্ষেত্রেও খোঁচার বিরাম নেই। অকারণেই মারছে। কখনও গালাগাল, কখনও তলোয়ারের খোঁচাও সহ্য করতে হচ্ছে।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মুসার প্রশ্ন।
বোধহয় ওদের ক্যাম্পে। জায়গাটা কোথায় গোপন রাখতে চায়, সেজন্যেই চোখ বেঁধেছে।
নিয়ে গেলে ভালই হয়। আউরোকে দেখতে পাব। মুক্ত করতে পারব।
জবাব দিল না কিশোর। মুসার দুঃসাহস যে কতখানি, ভাল করেই জানে সে। যত সহজে মুক্ত করার কথা বলছে, একদল গলাকাটা ডাকাতের হাত থেকে সেটা যে তত সহজ হবে না, মুসা নিজেও বুঝতে পারছে। তবু আশা ছাড়ছে না।
খুব কষ্ট হচ্ছে এগোতে। শ্যাওলার সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়েই কাহিল হয়ে গেছে। এখন এই দুর্গম পথ। তার ওপর খিদে। পা চলতে চায় না। তবে একটাই স্বস্তি, এই হাঁটাহাঁটির ফলে শরীরটা গরম রয়েছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়ও জমে যায়নি এখনও। অবশ্য পিঠে ধারাল তরবারির ফলা ঠেকে থাকলে, আর কখন খচ করে ঢুকে যায় ভাবলে এমনিতেই গরম হয়ে থাকে শরীর।
সোজাসুজি না গিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরপথে নেয়া হলো ওদের, কোন দিকে যাচ্ছে দ্বিধায় ফেলে দেয়ার জন্যে, যাতে পথ চিনতে না পারে।
তবে একটা ব্যাপারে অসাবধান হলো ডাকাতেরা, বাতাস। এ অঞ্চলে আসার পর থেকে লক্ষ করেছে কিশোর, বাতাস বয় পশ্চিম থেকে পুবে। অনেক ঘোরাঘুরির পর অবশেষে যখন সোজা এগোল ওরা, খেয়াল করল বাতাস লাগছে তার পিঠে। তথ্যটা মনে গেঁথে নিল সে। ডাকাতের আস্তানা থেকে বেরোতে পারলে বাতাসের বিপরীতে এগোতে হবে। তাহলে পৌঁছে যাবে হোয়াইট লেকে, সেখান থেকে ব্ল্যাক লেক আর গ্রীন লেক পেরিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারবে।
কিন্তু যদি মুক্তি পায় ডাকাতদের কবল থেকে, তবে তো; মস্ত একটা যদি রয়ে যাচ্ছে।
প্রায় ঘন্টা দুই একটানা চলার পর সামনে কথার শব্দ শোনা গেল।
হঠাৎ করে পিঠ থেকে বাতাস এবং তলোয়ার দুটোই সরে গেল। বেশ উষ্ণ এখানে আবহাওয়া। রান্নার সুগন্ধ ভুরভুর করছে।
বন্দিদের চোখ থেকে কাপড় খুলে নেয়া হলো।
বিরাট এক গুহায় এসে ঢুকেছে ওরা। সেজন্যেই আর বাতাস লাগছে না। পিঠে। মশালের আলোয় আলোকিত। আগুনের বড় কুণ্ড গরম করে রেখেছে গুহাটা। হাত থেকে ফটিকের ঝাড়বাতির মত ঝুলে আছে স্ট্যালাকটাইট। ঝালর লাগানো দামী কাপড়ে ঢাকা দেয়াল। মেঝেতে চিতাবাঘের চামড়ার কার্পেট। সাদা আলখেল্লা পরা মানুষেরা বসে আছে তাতে। বাঘের মাথাকে তাকিয়া বানিয়ে ঠেস দিয়েছে। হাতে পুদিনার গন্ধ মেশানো চায়ের পেয়ালা।
এ কোথায় ঢুকলামরে বাবা! কিশোর বলল। মনে হচ্ছে হাজার বছর পেরিয়ে এসে ঢুকেছি আরব্য রজনীর জগতে।
কিংবা কাউন্ট মস্টিক্রিস্টোর প্রাসাদে! বিড়বিড় করল মুসা।
.
১২.
তোমাদের পছন্দ হয়েছে জেনে খুশি হলাম! ইংরেজিতে কথা বলল কেউ।
সাংঘাতিক ভারি কণ্ঠস্বরটা এল যেন গুহার দেয়াল ভেদ করে। জবাব যখন দিয়েছে, নিশ্চয় তাদের বাংলা বুঝতে পেরেছে। এই বিদেশ-বিভুইতে বাংলা বোঝে কেউ, এটা জেনে হাঁ হয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।
বিশালদেহী একজন মানুষ। সাত ফুটের কাছাকাছি লম্বা, সেই পরিমাণ চওড়া। অন্যদের মত সাদা পোশাক পরেনি। বরং তার আলখেল্লাতে রামধনুর সাতটা রঙই বিদ্যমান, খুব দামী, চমৎকার সিল্কের কাপড়ে তৈরি, মশালের আলোয় চকচক করছে। সোনা-রূপায় তৈরি, মূল্যবান পাথর বসানো একটা ব্রেস্ট প্লেট পরেছে বুকে। মাথায় পাগড়ির বদলে রয়েছে সিংহের কেশরে বানানো মুকুটের মত একটা জিনিস। কোমরের বেল্টের জন্যে জীবন দিতে হয়েছে একটা তুষার-চিতাকে। একপাশে খাপে ঝোলানো অলঙ্করণ করা একটা বড় পিস্তল, আরেক পাশে তলোয়ার। সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারি করা স্লিপার পায়ে, কিশোরের পায়ের প্রায় দ্বিগুণ হবে একেকটা পা। বিশাল পায়ের ছাপের কথা মনে পড়ল তার।
দাস ব্যবসায়ীদের সর্দার লোকটা, বুঝতে অসুবিধে হলো না ছেলেদের। একেই উয়াটুসিরা বঙ্গমানব বলে জানে।
কিন্তু এক্ষণে বজ্রমানবের মুখে মেঘ বা বজের কোন চিহ্ন নেই, তার জায়গায় রয়েছে উজ্জ্বল রোদ। তামাটে রঙের মুখে ঝকঝক করে উঠল সাদা দাঁত।
মাথা নুইয়ে সালাম জানাল লোকটা। ইংরেজিতে বলল, বাংলা বুঝতে পারি, বলতে পারি না। আমার তেলের কোম্পানিতে অনেক বাংলাদেশী আর ভারতীয় আছে, তারা বাংলায় কথা বলে। নোয়াখালীর একজন ফোরম্যানের কাছে অল্প-স্বল্প বাংলা শিখেছি। যাই হোক, আমার বাড়িতে স্বাগত জানাচ্ছি তোমাদের। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। বিশ্রাম দরকার। এসো আমার সঙ্গে।
লোকটার মোলায়েম ব্যবহারে. পিত্তি জ্বলে গেল কিশোরের। অনেকগুলো বাজে কথা মুখে এসে গিয়েছিল, কিন্তু চেপে গেল। এ সব বলার সময় নয় এখন।
পর্দা সরিয়ে আরেকটা ছোট গুহায় ঢুকল বস্ত্রমানব। এটা আরও জমকালো করে সাজানো। চিতার চামড়ার ওপর রাখা পুরু গদি। নরম বালিশে হেলান দিয়ে তাতে আধশোয়া হলো লোকটা। কিশোর-মুসাকেও গদি দেখিয়ে আরাম করতে বলা হলো।
কঠোর পরিশ্রমের পর গা এলিয়ে দিতে পেরে খুশিই হলো ওরা।
ট্রে হাতে ঢুকল একজন চাকর। ট্রেতে পুদিনার সুগন্ধ দেয়া তিন কাপ গরম চা আর কিছু কেক।
দেখো আমাদের চা খেতে পারো কিনা, বস্ত্রমানব বলল। সরি, কফি দিতে পারলাম না, নেই। ইউরোপ-আমেরিকায় ঘোরার সময় কফিই খাই, তবে বাড়ি ফিরলে চা।
এটা আপনার বাড়ি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না না, হেসে উঠল বমানব। এটা সাধারণ শিবির। পারস্য উপসাগরের তীরের একটা দেশে পঞ্চাশ হাজার মানুষের আমি শেখ। টাকার অভাব নেই আমার। কিন্তু শুধু টাকায় মন ভরে না, অ্যাডভেঞ্চারের প্রবল নেশা, তাই বেরিয়ে পড়ি মাঝে মাঝে। প্রাসাদ ছেড়ে চলে আসি গুহায়। লোক রেখে আসি আমার প্রজাদের প্রতি যাতে কোন অবিচার না হয় সেটা দেখার জন্যে, আর আমি এসে এখানে আইন ভাঙি।
বেআইনী কাজ যে করেন স্বীকার করছেন?
করব না কেন? যেটা তোমরা জেনেই গেছ, সেটা লুকিয়ে লাভ কি? কয়েকবার গেছি তোমাদের ক্যাম্পে। তোমাদের বন্ধু উয়াটুসিদের গ্রাম থেকে বেশ কয়েকজনকে ধরে এনেছি, খুব ভাল চাকরের কাজ করতে পারে ওরা। ওদেরকে এমন লোকের কাছে পাঠাই, যারা ভাল টাকা দেয়।
সর্দারের ছেলেকে ধরে এনেছেন। তাকেও পাঠিয়ে দিয়েছেন?
না, এখনও এখানেই আছে। দেখতে চাও?
জবাবের অপেক্ষায় না থেকে হাততালি দিল শেখ।
একজন চাকর ঢুকল।
আরবিতে তাকে হুকুম দিল শেখ।
খানিক পর পর্দা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকল আউরো। বন্ধুদের দেখে আনন্দে চিৎকার করে ছুটে এসে তাদের হাত চেপে ধরল।
তোমরা এসেছ! জানতাম আমাকে নিতে আসবে!
তোমাকে নিতে আসিনি, শুকনো স্বরে বলল কিশোর। আমরাও তোমার মতই বন্দি। তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না।
দপ করে আলো নিভে গেল ওগাবোর মুখ থেকে।
অ। হাসিমুখে মিঠে মিঠে কথা বলছে আর খাবার দিচ্ছে বলেই এই শেখকে বিশ্বাস কোরো না। ও খুনী।
হা হা করে হেসে উঠল শেখ।
ছেলেটাকে আমার ভীষণ পছন্দ। ওর তেজ আছে। এ ভাবে আমার সামনে কথা বলতে সাহস করে না কেউ। সর্দারের ছেলে তো, সর্দারের মতই কথা।
কালো হয়ে গেল তার মুখ।.ঔনো রাগ ফুটল চোখের তারায়। দূর হয়ে গেল হাসি হাসি ভাবটা।
তবে সর্দারের ছেলেরা বেয়াদব হয়, ওকে আদব শিক্ষা দেব আমি! কিছু শিক্ষা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। এই ছেলে, মোয়রা, দেখাও তোমার বন্ধুদের।
নড়ল না আউরো।
আরবিতে তীক্ষ্ণ আদেশ দিল শেখ। দৌড়ে ঘরে ঢুকল একজন চাকর। আউরোকে চেপে ধরে জোর করে তার পিঠ ঘোরাল কিশোর-মুসার দিকে। চামড়ার চাবুক দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়া হয়েছে পিঠ।
মৃদু হাসল শেখ।
কড়া গলায় বলল মুসা, লাগতে হলে সমানে সমানে লাগা উচিত। একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে সবাই পেটাতে পারে, এতে বীরত্ব জাহির হয় না। কথা না শুনলে কি করবেন? পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবেন?
না না, মারব কেন? টাকা আসে এমন কোন কিছুকেই মেরে ফেলি না আমি। ভাল গোলাম হবে ও। তবে তার আগে ওর তেজটা নষ্ট করতে হবে। ঘোড়াকে যেমন করে বশ মানানো হয়।
এই নিষ্ঠুরতার কি কোন প্রয়োজন আছে? কিশোরের প্রশ্ন।
নিষ্ঠুর? কি বলছ তুমি? আমরা অনেক ভদ্র। কি দিয়ে মেরেছি, দেখাচ্ছি, দাঁড়াও।
দেয়ালে ঝোলানো খুব সাধারণ দেখতে একফালি চামড়া নামাল শেখ।
দেখো হাত দিয়ে, বলল সে। একেবারে নরম। আমাদের ভাষায় একে যা বলে তার বাংলা করলে দাঁড়াবে কোমল শিক্ষা।
মনে করেছেন চিনি না, কিশোর বলল। অত্যাচার করার জন্যে যত খারাপ জিনিস বানিয়েছে মানুষ, তার মধে এটা একটা। দক্ষিণ আফ্রিকায় একে বলে স্যামবক। গণ্ডারের চামড়া কেটে বানিয়ে সিংহের চর্বি ডলে নরম করা হয়। নরম করাই হয় যাতে মারলে বেশি ব্যথা লাগে। চামড়ায়-ছুরির মত কেটে বসে যায়। আপনার মত নিষ্ঠুর মানুষেরা যারা একটা ছেলেকে পেটাতে দ্বিধা করে না, তারাই কেবল একে কোমল বলতে পারে। নিজের পিঠে পড়লে আর এই নাম রাখত না।
জ্বলে উঠল বজ্বমানবের চোখের তারা, তবে মুখে হাসি লেগে রইল।
মনে হচ্ছে তোমাদের এই বন্ধুটির মত একই শিক্ষা দরকার তোমাদেরও। তবে সেটা না করতে হলেই খুশি হব আমি। বেয়াদবি আমি সইতে পারি না। যারা করে, তাদেরকে আদব শিখিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। চাকরের দিকে চাবুকটা ছুঁড়ে দিল শেখ। সেটা লুফে নিয়ে আউয়োকে সহ পর্দার ওপাশে চলে গেল চাকর।
ছেলেদের দিকে তাকাল শেখ। আশা করি ওর পিঠে আরও বিশ ঘা চাবুক লাগবে। সেটা ওকে তো বটেই, তোমাদেরও ভদ্র হতে শেখাবে। পর্দার ঠিক ওপাশেই কাজটা করা হবে, যাতে চিৎকারটা তোমরাওঁ শুনতে পাও।
চাবুকের প্রথম বাড়িটা পড়তেই বাঘের মত লাফিয়ে উঠল মুসা।
টেনে তাকে বসিয়ে দিল কিশোর।
কিছু করলে আউরোর ক্ষতিই করবে শুধু। বসে থাকো। আমাদের সুযোগ আসবে।
বিশটা বাড়ি শেষ হলো। টু শব্দ শোনা গেল না আউরোর। নিরাশ হলো শেখ, তার চেহারাই সেটা বলে দিচ্ছে। প্রতিটি বাড়ি পড়েছে আর দাঁতে দাঁত, চেপেছে কিশোর-মুসা, যেন তাদের নিজের পিঠে পড়েছে।
শেষ হয়ে গেলে শেখ বলল, ওরটা আপাতত শেষ। এবার তোমাদের ব্যবস্থা। হয়তো ভাবছ ধরে নিয়ে আসা হলো কেন?
আমাদেরও গোলাম বানানোর ইচ্ছে নাকি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না। তোমাদের কিনতে রাজি হবে না কেউ। তোমাদের দিয়ে কাজ তো হবেই না, অকারণে ঝামেলা বাড়াবে। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে থেকে থেকে ওদেরই মত হয়ে গেছ তোমরাও। বশ মানানো কঠিন। সব সময় খালি পালানোর চিন্তায় থাকবে। যেহেতু তোমরা আমেরিকার নাগরিক, তোমাদের সরকারও গোলমাল করতে পারে। না, কোটিপতির প্রাসাদের আরামের জীবন তোমাদের জন্যে নয়। ভাগ্য এত ভাল নয় তোমাদের।
তাহলে আটকে রেখেছেন কেন?
কারণ আছে। জানোয়ার ধরার ওস্তাদ তোমরা। আজ একটা সাদা হাতির কাছে তোমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে আমার লোকেরা। এত দামী জানোয়ার সারা দুনিয়ায় আর নেই। তোমরা ওটাকে ধরার চেষ্টা করবেই। তাই তোমাদের ঠেকিয়েছি।
কেন?
কেন, সেটা না বোঝার মত বোকা নও তোমরা। তোমাদের মত আমিও জানি ওটাকে কোথায় বিক্রি করলে বেশি দাম পাওয়া যাবে। একটা হাতির দামে দশটা ক্যাডিলাক গাড়ি কিনতে পারব। হাতিটা ধরে বিক্রি না করা পর্যন্ত তোমাদের আটকে রাখতেই হচ্ছে।
ততক্ষণ কি আমার লোকেরা বসে বসে আঙুল চুষবে মনে করেছেন? ওরা আমাদের খুঁজবে। খুঁজে বের করবে এই গুহা। দলে ওরা অনেক, সেই তুলনায় আপনারা অনেক কম। শুধু শুধু প্রাণ খোয়াবেন। প্রাণের চেয়ে কি বড় হয়ে গেল একটা হাতি?
কুটিল হাসি হাসল বজ্রমানব।
সাধারণ হাতি হলে অন্য কথা ভাবতাম। কিন্তু শ্বেতহস্তী সাধারণ নয়। জানো, অনেক দেশে দেবতা মানা হয় একে? পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি আমি, বাঘায় গেছি, সিয়ামে গেছি-থাইল্যান্ডকে অনেকে বলে সিয়াম, আমারও এই নামটাই ভাল লাগে। শ্বেতহস্তীকে নিয়ে যে কি করে ওরা, না দেখলে বুঝবে না।
পাগল-ছাগল সব দেশেই আছে, মুখ গোমড়া করে বলল মুসা।
তা বলতে পারো। মস্ত এক ধনীর বাড়িতে একবার একটা সাদা হাতি দেখেছিলাম। মার্বেল পাথরে বাঁধানো শানদার বিশাল এক চতুরে ওটাকে রাখা হত। সোনা-রূপার কারুকাজ করা অনেক দামী সিল্কের কাপড়ে সারাক্ষণ ঢেকে রাখা হত ওটার পিঠ। কাপড়ের স্কুলগুলোর কি বাহার, একেবারে গোড়ালির ওপর নামানো। সোনার মালা বানিয়ে পরিয়ে রাখা হত দাতে। মাথার ওপর ধরে রাখা হত রাজকীয় ছাতা, যাতে রোদে কষ্ট না পায় হাতি।
হাতির সেবা করার জন্যে অস্থির হয়ে থাকত অনেক বড় বড় নামী-দামী মানুষেরা। কেউ উটপাখির পালকের পাখা দিয়ে বাতাস করত, কেউ গা থেকে মাছি তাড়াত, কেউ বা সোনার পাত্র থেকে তুলে নিয়ে দুর্লভ ফল খাওয়াত ওটাকে।
নদীতে নিয়ে যাওয়া হত গোসল করানোর জন্যে। তখন সোনার সুতোয় কাজ করা কাপড়ে ঢেকে দেয়া হত ওটার শরীর। আটজন লোক ওই সময় সদাব্যস্ত থাকত ওটার সেবায়, কোন ভাবে যেন কোন কষ্ট না হয়। বাজনা বাজাতে বাজাতে আগে আগে যেত ব্যান্ড পার্টি। নদী থেকে গোসল সেরে এসে চত্বরে উঠলে রূপার গামলায় করে গরম পানি এনে পা ধুয়ে দেয়া হত হাতির, তারপর সুগন্ধী মাখিয়ে দেয়া হত।
গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত ব্যাটাদের, গজগজ করতে লাগল মুসা। নির্বোধের দল! একটা হাতিকে নিয়ে এই কাণ্ড!
হাসল শেখ। ওটা হাতি নয় ওদের কাছে, দেবতা। দেবতার পূজা তো করবেই। ওই অতি মারা গেলে তাকে রাজার সম্মান দেয়া হয়েছে। বিশাল মঞ্চে সাতদিন শুইয়ে রাখা হয়েছে লাশ। তারপর চন্দন কাঠের মত দামী কাঠ দিয়ে পোড়ানো হয়েছে। পোড়া ছাইগুলোও সাংঘাতিক পবিত্র, নেয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু দিনরাত কড়া নজর রেখেছে প্রহরীরা, যাতে কেউ নিতে না পারে। সেই ছাই কুড়িয়ে নিয়ে দামী বাক্সে ভরে কবর দেয়া হয়েছে এমন জায়গায়, যে গোরস্থানে রাজারাজড়াদেরই কেবল ঠাই মেলে।
শেতহস্তীর ব্যাপারে নানা মজার মজার কিচ্ছা-কাহিনীও চালু আছে। এক সময় নাকি গোটা পৃথিবীটা ছিল বিশাল এক সাদা হাতির পিঠে। হাতিটা কোন কারণে নড়লেই পৃথিবীও কাঁপত, ফলে ভূমিকম্প হত। একবার রানী ভিক্টোরিয়াকে কি উপহার দিয়েছিলেন সিয়ামের এক রাজা, জানো? একটা সোনার বার, তার তালা খোলার চাবিটাও সোনার। সবাই ভেবেছিল এত দায় বারে করে নিয়ে দামী দামী পাথর কিংবা অলঙ্কার পাঠানো হয়েছে। কি বা খুলে দেখা গেল তাতে রয়েছে রাজার সাদা হাতির কয়েকটা রোম। রাজার কাছে মনে হয়েছিল, ইংল্যান্ডের রানীকে পাঠানোর জন্যে এর চেয়ে দামী জিনিস আর তাঁর সাম্রাজ্যে নেই। আর সিয়ামের রাজদূত রানীর প্রশংসা করার সময় বলেছেন, রানীর চোখ, ভাবভঙ্গি, এবং আরও অনেক কিছুই একেবারে সাদা হাতির মত। এরপরও বলতে চাও এই হাতি সাধারণ হাতি?
না, মাথা নাড়ল মুসা, দামের দিক থেকে অসাধারণ। মানুষই এর দামটা বাড়িয়েছে। প্রাণী হিসেবে আর দশটা সাধারণ হাতির মতই হাতি এটাও।
মাথা ঝাঁকাল শেখ। বুদ্ধিমান ছেলে। আমার কাছেও দামটাই বড়। যাই হোক, ওই হাতি যতদিন ধরা না পড়ে তোমরা আমার মেহমান। উল্টোপাল্টা কিছু কোরো না, আমিও তোমাদের কিছু করব না। কিন্তু আমার কাজে নাক গলাতে এলে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারবে না, এটা মনে রেখো।
.
১৩.
হাততালি দিল শেখ।
চোখের পলকে উদয় হলো চাকর।
ছেলেদেরকে শেখের গুহা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হলো পেছনের বড় গুহায়। পুরোপুরি অন্ধকার এখন ওটা। খালি।
গুহার চারপাশে অনেক পর্দা ঝোলানো। ওগুলোর অন্যপাশের হোট গুহা থেকে আসছে নাক ডাকানোর শব্দ। কোন কোনটাতে কথা বলছে একাধিক লোক, তাসটাস খেলছে হয়তো, ঘুমায়নি এখনও।
বড় গুহার পেছনের ছোট একটা গুহায় কিশোর-মুসাকে নিয়ে আসা হলো। পুদিনা মেশানো চায়ের কড়া গন্ধ এখানে। অগ্নিকুণ্ডের ওপর বিরাট পাত্রে চা তৈরি হচ্ছে, বাষ্প উঠছে ওটা থেকে, পুদিনার গন্ধ ছড়াচ্ছে। একটি মাত্র মশাল জ্বলছে গুহাটায়, অন্ধকার কাটছে না। এখানে আরামের ব্যবস্থা নেই, চিতার চামড়ার কার্পেট নেই, গদি নেই। নগ্ন দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে আছে খোঁচা খোঁচা পাথর। ঠাণ্ডা পাথুরে মেঝে। এককোণে কুকুরের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে একটা ছেলে, খালি গা। মানুষের সাড়া পেয়ে নড়ে উঠল। উঠে দাঁড়ালে চেনা গেল, সর্দার ওগারোর ছেলে।
আউরো! এগিয়ে গেল মুসা। এই জঘন্য জায়গায় এনে তোমাকে রেখেছে ওরা! উয়াটুসির রাজকুমারের জন্যে যোগ্য জায়গাই বটে!
দূর্বল হাসি হাসল আউরো। এটা গোলামদের ঘর। পাচার করার আগে এখানেই বন্দি করে রাখা হয়। কাল পর্যন্ত অনেকেই ছিল। ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জাহাজে তুলে দেয়ার জন্যে। লোহিত সাগরের কোন বন্দরে নিয়ে যাওয়া হরে। ওরা বলেছে, আমাকেও নিয়ে যাবে আগামীকাল, পারস্য উপসাগরের তীরে।
ঘরটা দেখতে দেখতে বলল মুসা, মাটির নিচের কয়লা রাখার ঘরও এরচেয়ে ভাল। আর কিছু না থাক, ওসব ঘরের একটা খুদে জানালা হলেও থাকে, এটার তা-ও নেই। আগুনে চাপানো পাত্রটার দিকে তাকাল। যাই হোক, এই ঠাণ্ডায় চা যে খেতে দিচ্ছে এটাই বেশি।
চা কি আর আমাকে দেয়? ওটা প্রহরীদের জন্যে। যাতে জেগে থাকতে পারে।
তোমাকে কি খেতে দেয় ওরা?
কিছু না। একেবারেই কিছু না। ওরা বলে, হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে যখন চাইব, তখনই কেবল দেবে। ওরা বলে, সর্দারের ছেলে আমি-এই ভাবনাটি মাথা থেকে, বিদেয় না হলে ভাল গোলাম হতে পারব না। বলেছে, না ভোলা পর্যন্ত খেতে দেবে না। না দিক। না খেতে খেতে মরে যাব, তবু মাথা থেকে বিদেয় করব না।
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গর্বিত কিশোরটির দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে কিশোর। পিঠের জখমগুলোতে নিশ্চয় অকল্পনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু মুখের ভাবে সেটা একবিন্দু প্রকাশ পাচ্ছে না ছেলেটার। এই ছেলে ভাঙবে তবু মচকাবে না। সুযোগ পেলে অনেক বড় নেতা হতে পারবে।
কিন্তু আগামীকাল ওকে দেশ থেকে সরিয়ে নেয়া হলে সেই সুযোগ আর কোনদিনই পাবে না আউরো। গোলামির ঘানি টেনেই কাটবে সারাজীবন। তাকে বাঁচাতে হলে কিছু একটা করা দরকার, এবং সেটা আজ রাতেই।
গুহাটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল কিশোর। দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি, ছাত, মেঝে, কোন জায়গা বাদ দিল না।
কিন্তু কোন রকম ফাঁকফোকর দেখল না। খোলা জায়গা একটাই আছে, যেখান দিয়ে ঢুকেছে ওরা। সেটার পাহারায় রয়েছে ছয়জন প্রহরী। তিনজন বসেছে দরজার বাইরে, তিনজন ভেতরে। আলখেল্লার ঝুল পেতে বসেছে, যাতে ঠাণ্ডা এড়াতে পারে। চা খেতে খেতে নিচু স্বরে আলাপ করছে। বিশালদেহী মানুষ একেকজন। সঙ্গে পিস্তল আর তলোয়ার রয়েছে।
ওরকম অস্ত্র থাকলে একজন লোকই নিরঞ্জ তিন বন্দিকে সামলানোর জন্যে যথেষ্ট। ছয়-ছয়জন সশস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই।
ছয়জনের কাছে যদি অস্ত্র না-ও থাকত, তাহলেও হাতাহাতি লড়াইয়ে কার করতে পারত কিনা সন্দেহ। তার ওপর ওদের চিৎকারে আরও লোক ছুটে আসত।
অলৌকিক কোন উপায়ে যদি কাবু করতে পারে এই ছয়জনকে, তাহলেও ঝামেলা শেষ হবে না। বড় গুহাটা পেরোতে হবে, যার চারপাশে ছড়িয়ে আছে ডাকাতদের ঘর। সবাই ঘুমায়নি। হঠাৎ উঁকি দিয়ে বসতে পারে একআধজন। চোখে পড়ে গেলেই চিৎকার শুরু করবে, আবার ধরে আনা হবে ওদেরকে।
পালানোর কোন উপায় দেখতে পাচ্ছে না কিশোর। আপাতত হাল ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়াই উচিত মনে করল। ঘুমিয়ে আগে ক্লান্তি দূর করা দরকার। কিন্তু যা শীতল মেঝে, ঘুম হবে বলে মনে হয় না।
বুশ জ্যাকেটের পকেটে শক্ত একটা কিছু ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে কোমরের নিচে, অস্বস্তিকর। সামান্য একটু নড়েচড়ে শুলো, যাতে চাপটা না লাগে।
হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বসল সে। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। পকেটের জিনিসটা কাজে লাগানো যেতে পারে।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছুঁয়ে দেখল জিনিসটা। আধ ইঞ্চি ব্যাসের তিন ইঞ্চি লম্বা একটা বিশেষ কার্তুজ।
বড় জানোয়ার ধরার সময় হরদম ব্যবহার করা হয় এগুলো। ভেতরে সেরনিল নামে এক ধরনের তরল ঘুমের ওষুধ ভরা থাকে। মাথায় ইঞ্জেকশনের সুচের মত সুচ লাগিয়ে তীর ছোঁড়ার যন্ত্রে পরিয়ে ছুঁড়ে মারা হয় জানোয়ারকে লক্ষ্য করে।
গায়ে ফোঁটার পনেরো মিনিটের মধ্যে নিথর হয়ে ঘুমিয়ে যায় জানোয়ার। তারপর চার ঘণ্টার জন্যে আর খবর নেই। ট্রাকে তুলে বয়ে নিয়ে গিয়ে খাঁচায় ভরার জন্যে যথেষ্ট সময়।
যে কার্তুজটা আছে তার পকেটে, এটা একটা বড় গণ্ডার, মোষ কিংবা হাতিকে কাবু করে ফেলতে পারে। ছয় থেকে বারোজন মানুষকে গভীর ঘুমে অচেতন করে দিতে পারে।
কিন্তু লোকগুলোর শরীরে ঢোকাবে কি করে এই ওষুধ? তার কাছে ছোঁড়ার যন্ত্র নেই। থাকলেও অবশ্য লাভ হত না। ওদের দিকে যন্ত্র তাক করতে দেখলেই গুলি করত।
চোখ পড়ল চায়ের পাত্রটার ওপর। আগুনে কি ওষুধের গুণ নষ্ট করবে? জানা নেই। পেয়ালার পর পেয়ালা চা খাচ্ছে লোকগুলো। এত চা খায় কি করে আল্লাহই জানে। কয়েক মিনিট পর পরই পেয়ালা ভরছে। পাত্রটাতে যদি কোনমতে গিয়ে ওষুধটা ঢেলে দিয়ে আসতে পারে.••
মোড়ামুড়ি শুরু করল। আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে আগুনের কাছে। যেন শীত লাগছে, উত্তাপ চায়, এমন ভঙ্গি।
সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে ফিরে তাকাল লোকগুলো।
হাত তুলে জ্বলন্ত কয়লা দেখাল সে। বোঝাল, উষ্ণতা দরকার।
সন্দেহ করল না লোকগুলো। এত ঠাণ্ডার মধ্যে আগুনের আরাম সবাই চায়। আর নজর দিল না তার দিকে।
গড়াতে গড়াতে এমন একটা জায়গায় চলে এল সে, লোকগুলো রইল তার একপাশে, আরেক পাশে আগুন। লোকগুলো আলাপে মগ্ন হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রইল সে। সাবধানে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওদের অলক্ষ্যে বের করল কার্তুজটা। শরীরের আড়ালে রেখে প্লগ খুলে চায়ের পাত্রে ঢেলে দিল ভেতরের ওষুধ। খালি কার্তুজটা পকেটে ভরে রাখল। ওষুধ কাজ করলেই হয় এখন।
ঘুমের মধ্যেই যেন সরছে, এমন করে চলে এল আবার মুসা আর আউয়োর কাছে।
কিশোর কি করে এসেছে, বুঝে ফেলেছে মুসা।
আউরো আন্দাজ করেছে কিছু একটা করা হয়েছে, কিন্তু কি, বুঝতে পারেনি। চুপ করে রইল। নড়ল না কেউ। প্রহরীদের সন্দেহ জাগে এমন কিছু করল না।
উঠে গিয়ে আবার পাত্র থেকে চা ভরে এনে খেতে লাগল লোকগুলো।
উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছে কিশোর। কাজ হবে তো? এটাই ওদের শেষ ভরসা। গরমে ওষুধ নষ্ট হয়ে গেলে আর কিছুই করার নেই।
আচ্ছা, ওষুধের গন্ধ পেয়ে যাবে না তো? আশা করল, পাবে না, পুদিনার তীব্র গন্ধ ঢেকে দেবে ওষুধের গন্ধ।
চা খাচ্ছে লোকগুলো।
কিশোরের মনে হচ্ছে, যুগ যুগ ধরে খেয়েই চলেছে ওরা। তবু কিছু ঘটছে না। অনন্তকাল পেরিয়ে যাচ্ছে যেন।
কিন্তু আসলে পেরোল পনেরো মিনিট। কথা কেমন জড়িয়ে এল ওদের। তারপর থেমে গেল। ঢুলতে শুরু করল প্রহরীরা।
আনন্দে দুলে উঠল কিশোরের মন। হচ্ছে, কাজ হচ্ছে!
একজন আরেকজনকে জেগে থাকার জন্যে হুশিয়ার করতে লাগল ওরা। কিন্তু গিলেছে তো সবাই। কে জেগে থাকবে? ওষুধ কাবু করে ফেলল ওদেরকে। কয়েক মিনিটেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল।
পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল তখন তিনজনে।
নড়ছে না প্রহরীরা।
সাবধানে ওদেরকে ডিঙিয়ে এল কিশোর। পর্দা সরাল কয়েক ইঞ্চি। উঁকি দিয়ে দেখল বড় গুহাটায় কেউ আছে কিনা।
প্রায় অন্ধকার গুহা। অল্প কয়েকটা মশাল জ্বলছে এখনও। এই সামান্য আলোয় এতবড় গুহার কিছুই আলোকিত করতে পারেনি।
প্রথমে কিছু চোখে পড়ল না তার। আরও ভাল করে তাকাতে দেখতে পেল কয়েকজন লোক ঘুমিয়ে আছে। চিতার মাথাকে বালিশ বানিয়েছে।
ফিসফিস করে বলল কিলোর, কঠিন ঠাই। কেউ জেগে উঠলেই এখন মরেছি।
অন্ধকার তো, মুসা বলল। দেখতে পাবে?
স্পষ্ট না দেখলেও আমাদের পোশাকই বুঝিয়ে দেবে ওদের দলের লোক নই। হলে আলখেল্লা থাকত।
ঘুমন্ত প্রহরীদের দিকে তাকাল মুসা। তাহলে আলখেল্লাই পরে নেব।
লোকগুলোর ভারি শরীর থেকে আলখেল্লা খোলাটা অত সহজ হলো না, তবে ভোলা গেল শেষ পর্যন্ত। দ্রুত সেগুলো পরে নিল ওরা। চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফলে কেউ এখন বুঝতে পারবে না ওরা কারা।
নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে বড় গুহাটা ধরে এগোল তিনজনে। বুক কাঁপছে। দৌড় দিতে ইচ্ছে করছে। ধরা পড়ার ভয়ে দিল না।
প্রথম লোকটার পাশ কাটাল নিরাপদে।
মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে আরেক দিকে। তবে প্রয়োজন ছিল না-পরনে আলখে, মুখ তো দেখাই যায় না।
দ্বিতীয় লোকটার কাছে আসতেই মাথা তুলল সে। তিনটে সাদা আলখেল্লা পরা মূর্তি নজরে পড়ল। আবার মাথা নামিয়ে চোখ মৃদল সে।
ধীরেসুস্থে তৃতীয় এবং চতুর্থ লোকটার পাশ কাটাল ওরা।
গুহার বাইরে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অলস ভঙ্গিতে তাকাতে লাগল এদিক ওদিক। যেন ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল বলে বাইরের খোলা হাওয়ায় খাস নিতে এসেছে।
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল কেউ পাহারায় আছে কিনা।
কাউকে চোখে পড়ল না।
একদিকে হাঁটা দিল তখন। তারপরেও যখন কেউ ডাকল না, হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে। আলখেল্লার ঝুল তুলে দিল দৌড়।
আগে আগে ছুটছে কিনোর। বাতাস গায়ে লাগতে মোড় ঘুরল। মনে আছে, বাতাসের বিপরীতে যেতে হবে। দিনের মত এত জোরাল না বাতাস, তবু বোঝ যায়।
দুর্গম পথ। চাঁদ আছে আকাশে। কিন্তু থাকলেই কি, কুয়াশার জন্যে ঠিকমত চোখে পড়ে না। এর ওপর নির্ভর করে চলা মুশকিল।
তবু থামল না ওরা। ছুটছে। কাঁটায় লেগে হাত-পায়ের চামড়া ছড়ে গেল, চোখা পাথরে পা কাটল, কিন্তু ছোটার বিরাম নেই।
চোখে পড়ল হোয়াইট লেক। সামনে, মৃদু চিকচিক করছে ঘোলাটে চাঁদের আলোয়।
ওই যে হাতিটা! বলে উঠল মুসা।
আশ্চর্য! দিনের বেলা যেখানে দেখেছিল, ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ওটা।
কিন্তু আমি তো দেখছি দুটো, কিশোর বলল। যতটা সম্ভব তীক্ষ্ণ করে ফেলেছে দৃষ্টি। মনে হচ্ছে আরেকটা কালো হাতিও আছে। নাকি সাদাটারই ছায়া?
গুঁড়ি মেরে মেরে কাছে এগোতে লাগল ওরা।
মুহূর্তের জন্যে সরে গেল কুয়াশা। পরিষ্কার হলো ধোঁয়াটে চাঁদের আলো। না, আসলেই আছে আরেকটা হাতি। মদ্দা। স্পষ্ট দেখা গেল এখন। ওর কালো চামড়া এই আলোতেও বোঝা যাচ্ছে। নিচে নামবে কি করে ভাবল কিশোর। পথ একটাই, শ্যাওলার ভেতরের সুড়ঙ্গ। খুঁজে বের করা কঠিন হলো।
আবার ওটায় ঢুকব? ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না মুসার। এই মাঝরাতে!
ওটার মধ্যে দিনই কি আর রাতই কি? একই রকম অন্ধকার।
কিন্তু রাতের বেলা যদি চিতাবাঘ ঢুকে বসে থাকে?
থাকলে কিছু করার নেই। আর কোন উপায় নেই আমাদের। অসুবিধে একটাই হবে, হাতে-পায়ে পেঁচাবে এই আলখেল্লা।
খুলে ফেলব?
খুলে রেখে যেতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু ভীষণ ঠাণ্ডা। শেষে নিচের ঝুল তুলে কোণগুলো শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে বাঁধল ওরা। ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে।
ভেতরে ছোট ছোট হাজারো শব্দের কোলাহল। অত সব শব্দ। কারা করছে, মোটামুটি জানা আছে ওদের। কিন্তু ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে পরোয়া করল না। করার দরকারও নেই। কারণ ওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর হিংস্রতম যেটা, সেটা সিভেট ক্যাট। একধরনের বনবিড়াল। ওদের সাড়া পেয়ে ভয়ে ছুটে পালাল।
ঢোকার সময় যে অসুবিধে হয়েছিল মুসার, এখন পথ জানা থাকায় সেটা আর হলো না। বাইরে বেরিয়ে এল নিরাপদে।
নামতে নামতে ব্ল্যাক লেক আর গ্রীন লেকের পাশ কাটাল, তারপর বাশে ছাওয়া গরিলা-বনের ভেতর দিয়ে এসে পৌঁছল ক্যাম্পে।
এতটাই ক্লান্ত, কথা বলার শক্তিও আর নেই। সোজা বিছানায় পড়তে ইচ্ছে করছে, পড়েই ঘুম।
কিন্তু এখুনি একটা কাজ না সারলে হবে না, কিশোর বলল। ডাকাতদের আস্তানা কোথায় জেনে গেছি। পুলিশকে খবর দিতে হবে।
আউরোর বাবাকে জাগানো হলো।
রাতদুপুরে ছেলেকে দেখে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইল না। শেষে নেচে উঠল আনন্দে। তক্ষুণি একজন লোক পাঠাল পর্বতের পাদদেশে মটুয়াঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে।
এত রাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলায় মহা বিরক্ত হলো পুলিশেরা। সকালের আগে বেরোতে পারবে না, সাফ বলে দিল।
কি আর করা? অপেক্ষা করতেই হলো।
তবে কথামত সকালবেলা ওগাবোর গাঁয়ে এল ওরা। পথ দেখিয়ে ডাকাতদের গুহায় তাদের নিয়ে চলল কিশোর। সঙ্গে নিয়েছে তার দলবল।
গুহার কাছে পৌঁছল দুপুরের সামান্য আগে। কিন্তু গুহায় ঢুকে দেখা গেল খালি গুহা। কোন মানুষ নেই!
বন্দিরা পালিয়েছে জেনেই সাবধান হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয় ডাকাতেরা। পালিয়েছে। জিনিসপত্র সব নিয়ে গেছে। বাতাসে ভাসছে কেবল পুদিনার গন্ধ।
ভীষণ শয়তান ব্যাটারা! নাকমুখ কুঁচকে বলল কিশোর।
সাংঘাতিক দুর্গম পথ পার হয়ে আসতে পুলিশেরও কষ্ট হয়েছে। শীতে কাবু হয়ে গেছে ওরা। হাত-পায়ের নানা জায়গায় জখম। রাগটা পড়ল কিশোরদের ওপর। কিন্তু যেহেতু ডাকাতরা গুহায় থাকার প্রমাণ আছে, দোষ দিয়ে কিছু বলতে পারল না। কেবল কালো মুখগুলোকে আরও কালো করে রাখল।
.
১৪.
এরপর কি করবে ডাকাতেরা বুঝতে পারছে কিশোর। সাদা হাতিটা দেখেছে। এই এলাকা ছাড়ার আগে ওটা ধরার চেষ্টা করবে বজ্রমানব।
সময় কম, বলল সে। ইতিমধ্যেই ধরে ফেলেছে কিনা কে জানে! তবে বোধহয় পারেনি। কারণ সকালটা গেছে জিনিস গোছগাছ করতে। সুযোগ একটা পেলেও পেতে পারি।
হোয়াইট লেকের দিকে ফিরে চলল ওরা।
অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে মুসা।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ভাবছ মনে হয় কিছু?
মুখ তুলে তাকাল মুসা। হ্যাঁ, ভাবছি। একটা চালাকি করলে কেমন হয়?
কি চালাকি?
বুদ্ধিটা খুলে বলল মুসা।
হাসল কিশোর। এতে কাজ হলেও হতে পারে। এখান থেকে ক্যাম্পে যাওয়ার নিশ্চয় অন্য কোন পথ আছে, শর্ট কাট। নইলে গাঁ থেকে হাতি ধরে আনতে পারত না ডাকাতেরা। একজন পুলিশকে সাথে নিয়ে যাও তুমি, রাস্তাটা খুঁজে বের করো। আমি অন্যদের নিয়ে ঘুরপথে যাই।
বেশ। এক ঘণ্টার মধ্যে খুদে দানবকে নিয়ে হোয়াইট লেকে পৌঁছে যাব।
শর্ট কাট রাস্তাটা খুঁজে বের করতে সময় লাগল না। সেটা ধরে একজন পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পে এসে পৌঁছল মুসা।
সাপ্লাই ট্রাক খুঁজে একটা স্প্রে গান বের করল। সাদা রঙ ভরল সেটাতে। অবাক হয়ে তার কাজ দেখছে গ্রামবাসীরা। কিন্তু ওদের কৌতূহল মেটানোর জন্যে কোন কথা বলল না সে।
ডাক দিল খুদে দানবকে।
আনন্দে শুড় তুলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এল হাতির বাচ্চা।
তোর জন্যে একটা কাজ ঠিক করেছি, খুদে। আয় আমার সঙ্গে।
পুলিশ সঙ্গীকে নিয়ে আবার হোয়াইট লেকে ছুটল মুসা। বাচ্চাটা চলল পেছন পেছন। ..
পাহাড় বেয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়, তার ওপর তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে, হাঁপিয়ে পড়ল দু-জনে। খুদে দানবের অবশ্য অতটা অসুবিধে হলো না। পাহাড়ে চড়ার অভ্যেস আছে তার।
হ্রদের তীরে পৌঁছে দেখল ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে কিশোররা। অধৈর্য হয়ে উঠেছে পুলিশ। বার বার চলে যেতে চাইছে। ওদেরকে বোঝাতে বোঝাতে অস্থির হয়ে গেছে কিশোর।
হাতে স্প্রে গান আর সঙ্গে একটা বাচ্চা হাতিকে নিয়ে মুসাকে দেখে ভুরু কুঁচকে গেল ওদের। হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগল।
তাদের প্রশ্নের জবাব দিল না মুসা। কুয়াশার মধ্যে সাদা হাতিটাকে খুঁজছে তার চোখ।
দেরি করে ফেললাম নাকি? আনমনে বিড়বিড় করল সে। ডাকাতেরা ধরে নিয়ে গেল না তো?
এখনও নেয়নি, কিশোর বলল। তবে খারাপ খবর আছে। একজন লোক পাঠিয়েছিলাম খবর নিতে। গোপনে দেখে এসেছে ডাকাতেরা অনেক লোক, যা আন্দাজ করেছিলাম তারচেয়ে অনেক বেশি। আমাদের ডবল। এদিকেই আসছে। সবার কাছে পিস্তল আছে। সেই তুলনায় আমাদের কাছে তেমন কোন অস্ত্র নেই। পুলিশের আছে বল্লম, কুলিদের কাছে ছুরি।
আগ্নেয়াস্ত্র না থাকারই কথা, শিকার করতে আসেনি ওরা। যদি কোন কারণে বিপদে পড়ে যায়, সে-জন্যে সতর্কতা হিসেবে একটা রাইফেল এনেছে, মুংগার হাতে আছে সেটা।
একসাথে দল বেঁধে এসে যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর, কিশোর বলছে, ওদের সঙ্গে পারব না আমরা। তবে তোমার রঙের বুদ্ধিটা কাজে লাগলে বোকা বনতেও পারে, তাতে ছড়িয়ে পড়বে ওরা। এক এক করে কাবু করব তখন।
তা তো হলো। কিন্তু আমাদের শ্বেতহস্তী কোথায়?
ওদিকে। ওই পাথরগুলোর কাছে।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কুয়াশার মধ্যে খুঁজতে লাগল মুসা। প্রথমে সাদা-কালো কিছু পাথর চোখে পড়ল। তারপর নড়ে উঠল সাদা একটা পাথর। তার পর পরই
জায়গা বদল করল কালো একটা পাথর, ঔড় তুলে চিৎকার করে উঠল।
পা টিপে টিপে কালো হাতিটার কাছে চলে এল কিশোর আর মুসা।
ওদের দেখেই সরে যেতে লাগল হাতিটা।
দৌড়ে ওটার কাছে চলে এল দু-জনে। প্রে গান তুলে সাদা রঙ ছিটাতে শুরু করল ওটার শরীরে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো হাতিটা পরিণত হলো সাদা হাতিতে। পুরো শরীর রঙ করার দরকার পড়েনি। কুয়াশার মধ্যে বোঝারই উপায় রইল না ওটা কালো হাতি।
মানুষের অদ্ভুত আচরণে ভড়কে গেছে হাতিটা। চিৎকার করছে সমানে।
করুক, কিশোর বলল। যত চেঁচাবে, তত তাড়াতাড়ি এটাকে খুঁজে পাবে ডাকাতেরা।
শোনা গেল ডাকাতদের হই-চই। ছুটে আসছে ওরা।
দ্রুত নির্দেশ দিল কিশোর। দশ-পনেরোজন কুলিকে পাঠাল রঙ করা হাতিটার পেছনে। বাকিরা সাদা হাতিটার কাছাকাছি হ্রদের তীরে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল কিশোর-হে কুয়াশা, আরও, আরও বেশি করে পড়ো! ঘন হয়ে পড়ো! যাতে ডাকাতেরা হাতিটাকে চিনতে না পারে।
যেন তার প্রার্থনা সত্যি শুনতে পেল চাঁদের পাহাড়। সাহায্য করল ওদেরকে। হঠাৎ করে সাংঘাতিক ঘন হয়ে গেল কুয়াশা। দশ হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ে না।
কুয়াশার মধ্যে শোনা গেল চিৎকার, আরবিতে চেঁচিয়ে কথা বলছে ডাকাতেরা। কি ঘটছে আন্দাজ করতে পারছে কিশোর। রঙ করা হাতিটাকে তাড়া করেছে ওরা।
পরিকল্পনার একটা অংশ তো ঠিকঠাক মতই হচ্ছে। বাকিটা হবে তো? সাদা হাতিটা এখন ডাক ছাড়লেই হয়। কিশোর দেখেছে, এটা মাদী হাতি। কালোটা পুরুষ। ওটা বিপদে পড়েছে বুঝে ডাকাডাকি করবে তো? করলে কয়েকজন ডাকাত দেখতে আসতে পারে। তখন হামলা চালিয়ে কাবু করে ফেলা যাবে ওদের।
কিন্তু সাদা হাতিটা অতিমাত্রায় ভদ্র। চুপচাপ রইল। এত শোরগোলও যেন ওটার ধৈর্যের বাধ ভাঙাতে পারল না। তবে কি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে মুসার পরিকল্পনা?
আর বসে থাকা যায় না। মরিয়া হয়ে কিশোরই হাতির ডাক ডাকতে আরম্ভ করল। চিৎকারের পর চিৎকার।
সাড়া দিল ডাকাতেরা। হট্টগোল আর ছুটন্ত পায়ের শব্দ শোনা গেল। দৌড়ে এল একজন ডাকাত।
মুহূর্তে তাকে কজা করে ফেলল পুলিশ। পিস্তল ব্যবহারের সুযোগই পেল না লোকটা, কেড়ে নেয়া হলো। ধরেই হাত-পা বাঁধা শেষ।
কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল আরেক ডাকাত। তাকেও আটকে ফেলা হলো।
তারপর বেরোল তিনজন একসঙ্গে। দু-জনকে কাবু করে ফেলা গেল কোন গোলমাল ছাড়া, কিন্তু তৃতীয়জন পিস্তল তুলে গুলি করে বসল।
পড়ে গেল একজন পুলিশ।
গুলির শব্দ শুনে দল বেঁধে ছুটে এল ডাকাতেরা। দশ-বারোজন একসঙ্গে বেরিয়ে এল কুয়াশার আড়াল থেকে। প্রচণ্ড হাতাহাতি লড়াই বেধে গেল পুলিশ আর কুলিদের সঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত পারল না ডাকাতেরা। আটক হলো। হাতে গুলি খেল কিশোরের সবচেয়ে ভাল যোদ্ধাদের একজন, হামবি। কিন্তু তারপরেও লড়াই বন্ধ করল না।
ওষুধ লাগিয়ে তার জখম বেঁধে দিতে চাইল কিশোর।
ওসব পরে, বলে এড়িয়ে গেল হামবি।
রঙ করা হাতিটাকে নিয়ে কি ঘটছে দেখার জন্যে দৌড়ে গেল মুসা। একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল, ওটাকে ঘিরে ফেলেছে ডাকাতেরা। মোটা মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে। দুই দিকে হাতির ডাক শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে কয়েকজন ডাকাত। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কোনদিকে যাবে। যারা হাতির বেশি কাছে রয়েছে, তারা বুঝে ফেলেছে এটা রঙ করা হাতি, বিমূঢ় হয়ে গেছে এরা। ব্যাপারটা কি ঘটেছে মাথায়ই ঢুকছে না তাদের।
হঠাৎ আরেকটা হাতির চিৎকার কানে এল মুসার। এটা কিশোরের কণ্ঠ থেকে বেরোয়নি।
কি হয়েছে দেখার জন্যে দৌড়ে গেল সে। দেখল, সাদা হতিটা সরে গিয়েহল, ওটাকে ঘিরে ফেলেছে কয়েকজন ডাকাত। তলোয়ার দিয়ে খোঁচা। মেরে মেরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ওদের ক্যাম্পের দিকে। রাগে, যন্ত্রণায় চিৎকার করছে জানোয়ারটা।
ওদের নিষ্ঠুরতা দেখে মুসার মনে হলো এই লোকগুলোই হয়তো গায়ে গিয়ে সেদিন কিশোর হাতিটার শুড় কেটেছিল।
কিন্তু সাদা হাতি ভদ্র হলেও সহ্যের একটা সীমা আছে। কত আর কষ্ট সহ্য করবে? আচমকা ঘুরে গিয়ে রুখে দাঁড়াল সে। এ রকম কিছু ঘটতে পারে আশা করোন বোধহয় লোকগুলো। সরে যাওয়ারও সুযোগ পেল না। চোখের পলকে দু-জনকে দাঁত দিয়ে গেঁথে ফেলল হাতি। পা দিয়ে পিষে ভর্তা করে দিল আরেকজনকে। শুড় দিয়ে বাড়ি মেরে শুইয়ে দিতে লাগল নাগালে যাকে পেল।
সাদা হাতিটার চিৎকার শুনে সমস্ত বাধা পায়ে দলে পড়িমরি করে ছুটে এল কালো মন্দা হাতিটা। আক্রমণ করে বসল ডাকাতদের।
দুটো খেপা হাতির আক্রমণ ঠেকানোর সাধ্য হলো না ডাকাতদের। ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক দৌড় মারল। গিয়ে পড়ল পুলিশ আর কুলিদের খপ্পরে।
ওরা জিতে গেছে, বুঝতে পারল কিশোর। কিন্তু বজ্রমানবের কথা ভুলে গিয়েছিল সে।
কুয়াশা সরে এসে ঢেকে ফেলল কিশোরকে। কয়েক সেকেন্ড পর সেটা সরতেই দেখল, ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে শেখ।
কুটিল হাসি হাসল ডাকাত সর্দার। বাহ্, তুমি এখানে! তোমাকেই খুঁজছিলাম!
খাপ থেকে পিস্তল খুলল সে।
দাঁড়ান, হাত তুলল কিশোর, আমার কাছে পিস্তল নেই। আমি শুনেছি, আরব যোদ্ধারা মুখোমুখি লড়াইয়ে নিরস্ত্র শত্রুকে হত্যা করে না। কাপুরুষতা মনে করে। আপনিও আরব। সাহস থাকলে পিস্তলটা ফেলে দিন। তারপর আসুন। দেখা যাক কে হারে, কে জেতে।
পিস্তল ফেলল না শেখ, তবে খাপে ঢুকিয়ে রাখল।
তুমি একজন আরব শেখকে কাপুরুষ বলো! এসো, দেখি, কতটা বাঘের বাচ্চা?
বিশাল বপু নিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে রেলইঞ্জিনের গতিতে কিশোরকে আঘাত করতে ছুটে এল শেখ।
শেষ মহর্তে পথ থেকে সরে গেল কিশোর। জুডোর কায়দা প্রয়োগ করল শেখের ওপর। লোকটার নিজের ওজন আর শক্তিকে কাজে লাগিয়েই কাবু করার চেষ্টা করল তাকে।
বিফল হলো না। দড়াম করে মুখ নিচু করে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ল যেন পাহাড়। মাথা ঠকে গেল ভীষণ ভাবে। অজ্ঞান হয়ে গেল।
যে কোন মুহূর্তে জ্ঞান ফিরে আসতে পারে লোটার। সঙ্গে দড়ি নেই। তাড়াতাড়ি শেখের লম্বা আলখেল্লা ছিঁড়ে ফালি করে দড়ি পাকিয়ে তার হাত-পা বেঁধে ফেলল কিশোর।
চোখ মেলল শেখ। হাত-পা নড়ানোর চেষ্টা করে পারল না। বুঝতে পারল, আর কিছু করার নেই তার। চুপ হয়ে গেল।
কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল পুলিশেরা, সঙ্গে মুংগা। অবাক হয়ে একবার তাকাতে লাগল পড়ে থাকা দানবটার দিকে, একবার কিশোরের দিকে।
ওরা বলছে, মুংগা বলল কিশোরকে, আপনি সাদা মানুষের জাদু ব্যবহার করেছেন। নইলে এই দৈত্যের সঙ্গে পারতেন না। আপনাকে পিষে ফেলত।
জাদুই, মুচকি হাসল কিশোর, তবে সাদা মানুষের নয়। এশিয়ানদের।
কুলিদের সহায়তায় বন্দিদের নিয়ে চলে গেল পুলিশ।
কিশোর-মুসা রয়ে গেল। তাদের অন্য কাজ আছে।
খুদে দানবকে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রেখে একজন লোককে তার পাহারায় রেখে দিয়েছিল মুসা। এখন দেখল, বড় হাতি দুটোর সঙ্গে গিয়ে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে বাচ্চাটা। তার পরিকল্পনার এটাও একটা অংশ ছিল।
হাতির স্বভাব ভাল করে জানা আছে তার। মা-হারা বাচ্চা হাতিকৈ দেখাশোনার ভার পড়ে অন্য বয়স্ক মাদী হাতির ওপর। স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব নিয়ে নেয় হস্তিনী। খালা হয়ে যায় শিশুটার। প্রয়োজন পড়লে তাকে নিজের দুধ খাইয়েও বাঁচিয়ে রাখে।
মুসা দেখল, বাচ্চাটার সঙ্গে ড় জড়াজড়ি করে আদর করছে সাদাটা। গলার ভেতর বিচিত্র ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে দুটোরই। এ যেন আদর করে চুমু খাওয়ার সঙ্গে সোহাগের কথা।
মুসাকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করতে করতে তার দিকে ছুটে এল খুদে দানব।
ক্যাম্পে যাওয়ার জন্যে তাকে নিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল মুসা।
এইবার হবে অগ্নিপরীক্ষা। শিশু হাতির মায়ায় সাদাটা কি আসবে সঙ্গে সঙ্গে লড়াইয়ের আগে হলে এককথা ছিল, কিন্তু এখন মানুষের ওপর ঘৃণা জন্মেছে হাতিটার, নিষ্ঠুর ভাবে তাকে তলোয়ার দিয়ে খুঁচিয়েছে মানুষ। শত্রু আর বন্ধুর পার্থক্য কি বুঝতে পারবে? জোর খাঁটিয়ে তাকে বন্দি করা যায়নি, মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে কি টেনে আনা যাবে?
বাচ্চাটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাতিটা।
বাচ্চাটা একশো গজ সরে গেল…দুশো গজ…তবু নড়ছে না সে।
খালা যে আসছে না এতক্ষণে খেয়াল করল খুদে দানব। ফিরে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল।
হাতির ভাষা না জানলেও আন্দাজ করতে পারল কিশোর-মুসা, কি বলছে বাচ্চাটা। আদুরে গলায় বলছে ওটা-প্লীজ, খালা, এসো না আমাদের সঙ্গে! তোমাকে আমার ভাল লেগেছে!
এই ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই মাদী হাতির। কেঁদে উঠল মায়ের অন্তর। জবাব দিল-ঠিক আছে, খোকা, আসছি! দাঁড়া!
এক পা দু-পা করে এগোতে শুরু করল শ্বেতহস্তী। গতি বাড়ছে। এগিয়ে আসতে লাগল হেলেদুলে। একবার দ্বিধা করে কালো হাতিটা পিছু নিল সাদাটার। সে-ও সঙ্গিনীকে হারাতে রাজি নয়।
তাদেরকে এগিয়ে আনার জন্যে আনন্দে চিৎকার করে ছুটে গেল বাচ্চাটা। দুটোর মাঝখানে থেকে গায়ে গা ঠেকিয়ে জড়াজড়ি করে নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। যেন বাবা-মাকে পেয়ে গেছে। এগোল কিশোরদের ক্যাম্পের দিকে।
স্তব্ধ হয়ে প্রাণী জগতের এক অপার বিস্ময় দেখছে দুই গোয়েন্দা। চোখে জল এসে গেল ওদের। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে, খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে ওরাও এগোল হাতিগুলোর পেছন পেছন।