১৪.
দুপুর নাগাদ মুভি স্টুডিওর পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে পড়ল ব্রাউন অলিংগারের চকচকে কালো পোরশি ক্যাব্রিওলে গাড়িটা। দ্রুত চলছে। হাত নাড়ল গার্ড, জবাব। দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করলেন না প্রযোজক। বড় বেশি তাড়াহুড়া আছে মনে হয়। রাস্তায় বেরিয়ে বেপরোয়া ছুটতে শুরু করলেন। মোড়ের কাছে গতি কমালেন না। টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ তুলে নাক ঘোরালেন গাড়ির। আতঙ্কিত হয়ে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে লাগল অন্যান্য গাড়ি।
ভেগার স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে বসে আছে মুসা। রাস্তার অন্য পাশে গাড়ি রেখেছে। অলিংগারের গাড়িটাকে ওরকম করে ছুটে যেতে দেখে বলল, নিশ্চয় আমাদের মেসেজ পেয়েছে।
এবং বিশ্বাস করে বসেছে, হাসতে হাসতে বলল কিশোর।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে মুসাও রওনা হলো। বেশ খানিকটা দূরে থেকে অনুসরণ করে চলল পোরশিকে। রাস্তায় যানবাহনের ভিড় বেশি। ফলে চেষ্টা করেও গতি তুলতে পারছেন না অলিংগার। লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের সীমা ছাড়িয়ে আসার আগে। আর পারলেনও না।
পেছনে পড়ল শহরের ভিড়। তীব্র গতিতে ছুটছেন এখন অলিংগার। মুসাও পাল্লা দিয়ে চলেছে। পথের দুপাশে এখন সমতল অঞ্চল, বেশির ভাগই চষা খেত। কিছুদূর চলার পর মোড় নিয়ে মহাসড়ক থেকে একটা কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়ল পোরশি। ধুলো উড়িয়ে ছুটল আঁকাবাকা রুক্ষ পাহাড়ী পথ ধরে। ঢুকে যেতে লাগল পর্বতের ভেতরে। সামনে ছড়িয়ে রয়েছে পাইন আর রেডউডের জঙ্গল।
এই পথে পিছু নিলেই চোখে পড়ে যেতে হবে। গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো মুসা। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে তিন ঘন্টার পথ চলে এসেছে। এতদূর এসে শেষে বিফল হয়ে ফিরে যেতে হবে? অসম্ভব। প্রয়োজন হলে গাড়ি রেখে হেঁটে যাবে, তা-ও ফেরত যাবে না।
তা-ই করল ওরা। পাঁচ মিনিট চুপ করে বসে রইল গাড়িতে, পোরশিটাকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিল। তারপর নেমে পড়ল। জোর কদমে ছুটল। হাঁটাও নয়, দৌড়ানও নয়, এমনি একটা গতি। ডবল মার্চ বলা যেতে পারে।
পথের প্রথম বাকটার কাছে একটা কাঠের কেবিন চোখে পড়ল। চিমনি থেকে কালো ধোয়ার সরু একটা রেখা উঠে যাচ্ছে পরিষ্কার আকাশে। ওখানেই ঢুকেছে নিশ্চয়? কি করছে ওটার ভেতরে দুজনে, ভাবল মুসা। ডিলন কি বলে ফেলেছে সে অলিংগারকে ফোন করেনি?
ভেতরে আগুন জ্বলছে, ভালই, মুসা বলল। যা শীত। আগুন পোয়াতে ইচ্ছে করছে আমার। দুই হাত ডলতে শুরু করল সে। পর্বতের ভেতরে ঠাণ্ডা খুব বেশি। আর শুধু টি-শার্ট পরে এসেছে ওরা। শীত লাগবেই।
পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকব? রবিন জিজ্ঞেস করল।
না, কিশোর বলল, সামনে দিয়ে ঢুকেই চমকে দেব।
সামনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে গেল তিনজনে। তারপর রেডি-ওয়ান-টু-থ্রী করে একসঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে পড়ল পাল্লায়। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলে ভেতরে ঢুকল। প্রথমেই ডিলনকে দেখার আশা করেছে।
কিন্তু ডিলনকে দেখল না।
বড় একটা ঘর। আসবাবপত্রে সাজানো। কেবিনটা যে কাঠে তৈরি সেই একই কাঠে তৈরি হয়েছে ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, কাউচ, বুককেস। জগিং করে শীত তাড়ানর চেষ্টা করতে দেখা গেল অলিংগারকে। উদ্বিগ্ন, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত চেহারা, পরাজিত দৃষ্টি সব দূর হয়ে গিয়ে অন্য রকম লাগছে এখন তাকে। তিন গোয়েন্দাকে দেখে খুশিই হলেন।
আরি, তোমরা? এখানে কি? ঘড়ি অ্যালার্ম দিতেই জগিং থামিয়ে দিলেন। তিনি। কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন একটা তোয়ালে দিয়ে। ঘাড়েও ঘাম। কপাল মোছা শেষ করে ঘাড়ে চেপে ধরলেন তোয়ালে।
জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না তিন গোয়েন্দা। তিনজন তিন দিকে ছড়িয়ে গিয়ে ডিলনকে খুঁজতে শুরু করল। ডিলন যে নেই সেটা জানতে বেশিক্ষণ লাগল না।
এখানে কি? প্রশ্নটা আবার করলেন অলিংগার। তিন গোয়েন্দাকে দেখে চমকাননি, যেন জানতেন ওরা আসবে। আমাকেই ফলো করছ, সন্দেহ হয়েছিল। এখন দেখি ঠিকই।
পাহাড়ে বেড়াতে এসেছি আমরা, ভোঁতা গলায় মুসা বলল।
সাপ খুঁজতে! শীতল কঠিন দৃষ্টিতে অলিংগারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
ডোনাট খাবে? হাসি হাসি গলায় জিজ্ঞেস করলেন অলিংগার।
ডোনাট? অবাক হয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা, কিশোর, হচ্ছেটা কি?
শ্রাগ করল কিশোর। বিমল হাসি হাসলেন অলিংগার। আগের চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিক হয়ে উঠেছে আচরণ। খেলে খেতে পার। অতিরিক্ত ফ্যাট। সে জন্যে আমার খেতে ভয় লাগে। তবু মাঝে মাঝে লোভ সামলাতে পারি না। মেহমান আসবে বুঝতে পেরেছি। তাই বেশি করেই নিয়ে এসেছি। কমিশারি থেকে। আর ঠিক এসে গেলে তোমরা। চমৎকার কোইনসিডেন্স, তাই না?
কেবিনটা কার? জানতে চাইল কিশোর।
সঙ্কেত দিতে লাগল অলিংগারের ঘড়ি। আবার জগিং শুরু করলেন তিনি। আমার। এখানে এসেই শরীরের ব্যাটারি রিচার্জ করি আমি।
একা?
মোটেও না।
দম বন্ধ করে ফেলল মুসা। দ্রুত তাকাল এদিক ওদিক।
প্রকৃতির কোলে এসে কখনও একা হবে না তুমি, বললেন অলিংগার। তাজা। বাতাস। সুন্দর সুন্দর গাছ। বুনো জানোয়ার। সব সময় ঘিরে থাকবে তোমাকে। এত বেশি, ছত্রিশ ঘন্টার বেশি সহ্যই করতে পারি না আমি। আবার পালাই শহরে।
ঘড়ির সঙ্কেতের সঙ্গে সঙ্গে আরেকবার জগিং থামালেন তিনি। মুখের ঘাম মুছে ভোয়ালেটা সরিয়ে আনার পর মনে হল তোয়ালে দিয়ে ঘষেই মুখের চওড়া হাসিটা ফুটিয়েছেন। তোমাদেরকে কিন্তু খুব একটা খুশি মনে হচ্ছে না। ব্যাপারটা কি?
আজ আপনার অ্যানসারিং মেশিনে একটা মেসেজ পেয়েছেন, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। আপনি ভেবেছেন, বেন ডিলন আপনার সাহায্য চেয়ে ডেকে পাঠিয়েছে। সে জন্যেই এখানে এসেছেন আপনি। আপনি জানেন, ডিলন এখানেই লুকিয়ে আছে।
ডিলন এখানে? হা হা করে হাসলেন অলিংগার। চমৎকার। দারুণ। দেখো। তাহলে। বের করতে পার কিনা। যাও, দেখো।
এত আত্মবিশ্বাস কেন? মনে মনে অবাক হলেও চেহারায় সেটা ফুটতে দিল কিশোর। মেঝে, আসবাব, সব কিছুতে পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে। মাথা চুলকাতে লাগল সে।
ধুলো ছড়ানোটা কোন ব্যাপার না, মুসা বলল। ডজনখানেক স্প্রে ক্যান। আছে আমাদের বাড়ির বেসমেন্টে, বাবার জিনিস। এই স্পেশাল ইফেক্ট দেখিয়ে আমাকে বোকা বানাতে পারবেন না।
কল্পনার জোর আছে তোমাদের মানতেই হবে, মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন অলিংগার। তবে ভুল করছ। আমি কোন মেসেজ পাইনি আজ। চাইলে গিয়ে আমার অ্যানসারিং মেশিন চালিয়ে দেখতে পারো তোমরা। কোন মেসেজ নেই। এখানে সেলিব্রেট করতে এসেছি আমি।
কিসের সেলিব্রেট? মুসার প্রশ্ন।
অবশ্যই ডিলনের মুক্তির। অবাক হলে মনে হচ্ছে? খবরটা শোননি? টাকা। মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। ওকে ছেড়ে দিয়েছে কিডন্যাপাররা। এটাই আশা করেছিলাম আমি।
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে অলিংগারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, কখন ছাড়ল?
কয়েক ঘন্টা আগে। প্যানট্রিতে গিয়ে ডোনাটের বাক্স খুললেন অলিংগার। গ্লাস বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, দুধ খাবে নিশ্চয়? দুধ তোমাদের দরকার। বেড়ে উঠতে, বুদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে দুধ। তোমাদের এখন খুব দরকার।
তার মানে এখন সাফোকেশন টু শেষ করতে পারবেন?
হাসলেন অলিংগার। তবে এই প্রথম তার চোখে বিস্ময়ের আলো ঝিলিক দিয়ে যেতে দেখল কিশোর। নাহ্, আর পারলাম না। অনেক দেরি হয়ে গেছে, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এখন আর সাফোকেশন টুর শুটিং শেষ করা সম্ভব না। তাছাড়া এত বড় একটা বিপদ থেকে এসে ডিলনেরও মনমেজাজ শরীর কোনটাই ভাল না। এই অবস্থায় অভিনয় করতে পারবে না। শ্রমিক কর্মচারী আর অন্য অভিনেতাদেরও মন খারাপ হয়ে গেছে। ছবি এইটা খতম। কেউ যদি না যায়। কাকে পরিচালনা করবে জ্যাক রিডার?
তাই। ছবিটা তাহলে আর করতে চান না। আপনি বুঝে ফেলেছেন, এই অখাদ্য গিলবে না দর্শকেরা। তাই যা খরচ হয়েছে সেটা তুলেই সন্তুষ্ট থাকতে চান। খরচ হয়ে যাওয়া দুই কোটি ডলার।
দুই কোটি? দুধ ঢালতে ঢালতে বললেন অলিংগার, আরও অনেক বেশি খরচ হয়েছে।
হয়তো। এবং সেটাই আপনি ফেরত চান। ছবি শেষ না করলে ইনসিওরেন্স কোম্পানি টাকা দেবে না…
অলিংগারের হাত থেকে গ্লাসটা মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল।
ভাঙা কাচ…ভাঙা কাচ…ভাঙা কাচ…মুসার মগজে যেন তোলপাড় তুলল। ভাঙা কাচের শব্দ।
ছবির ব্যাপারে অনেক বেশি জানো তোমরা, প্রযোজক বললেন। এতটা, ভাবতে পারিনি। ঠিকই আন্দাজ করেছ। ছবিতে লোকসান হলে সেটা দিতে বাধ্য বীমা কোম্পানি, বীমা সে জন্যেই করান হয়। টাকাটা আদায় করার মধ্যে কোন অন্যায় দেখি না আমি।
কিন্তু কিডন্যাপিঙের খেলা খেলে, কর্কশ গলায় বলল কিশোর। টাকা আদায় করাটা কেবল অন্যায় নয়, পুলিশের চোখে ঠগবাজি।
হাসি হাসি ভাবটা চলে গেল অলিংগারের চেহারা থেকে। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দৃষ্টি। অস্বীকার করছি না। তবে পুলিশকে সেটা প্রমাণ করতে হবে। তোমরা এখন যেতে পার। আলোচনা শেষ।
শহরে ফেরার পথে গাড়ির হিটার চালু করে দিল মুসা। তবু ঠাণ্ডা যাচ্ছে না। তার, শরীর গরম হচ্ছে না। বার বার ঘড়ি দেখছে কিশোর, পাঁচটার খবরটা শোনার জন্যে অস্থির। পাঁচটা বাজার দশ মিনিট আগে, রকি বীচ থেকে তখনও অনেক দূরে রয়েছে ওরা, পথের ধারে পুরানো একটা খাবারের দোকান চোখে পড়ল কিশোরের। বাড়িটার সব কিছুই জীর্ণ মলিন, কেবল একটা স্যাটেলাইট ডিশ অ্যান্টেনা ছাড়া।
অ্যাই, রাখো তো। গাড়িটা পুরোপুরি থামার আগেই লাফ দিয়ে নেমে পড়ল।
দোকানে একজন খদ্দেরও নেই। বাবুর্চি দাঁড়িয়ে আছে একহাতে প্লেট আর আরেক হাতে কাটাচামচ নিয়ে। প্লেটে ডিম ভাজা।
খবর দেখবেন না? জিজ্ঞেস করল কিশোর, অনেকটা অনুরোধের সুরেই।
এক চামচ ডিমভাজা মুখে পুরে দিয়ে টেলিভিশনের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল লোকটা। প্রায় ছুটে গিয়ে টিভি অন করে দিল কিশোর। পর্দায় ফুটল ফাইভ-অ্যালার্ম নিউজ।
কিছু কিছু অভিনেতা হিরোর অভিনয় করে, কিন্তু আজ একজন অভিনেতা প্রমাণ করে দিয়েছেন বাস্তবেও তিনি হিরো, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলছে টিভি অ্যাংকারপারসন। আজ সকালে জনপ্রিয় অভিনেতা বেন ডিলনকে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে পুলিশ। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন তিনি। পুলিশকে বলেন, এগারো দিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন। একটু আগে সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর এই বন্দি থাকার কাহিনী তিনি শোনান সাংবাদিকদেরকে। একজন ফাইভ-অ্যালার্ম নিউজ রিপোর্টারও ছিল সেখানে… ই চলতে আরম্ভ করল ভিডিওটেপ। পর্দায় দেখা গেল বেন ডিলনকে। উত্তেজিত হয়ে আছে, থানায় বসে আছে মাইক্রোফোনের সামনে। সানগ্লাসের আড়ালে ঢাকা। পড়েছে তার বিখ্যাত নীল চোখ। সাংবাদিকদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার না করার দুর্নাম আছে এমনিতেই ডিলনের, আর এখন তো সে মানসিক চাপেই রয়েছে।
কিডন্যাপারের চেহারা কেমন জানিয়েছেন পুলিশকে? জিজ্ঞেস করল একজন রিপোর্টার।
নিশ্চয়ই। এক্কেবারে আপনার মত, অভদ্রের মত বলল ডিলন। আন্দাজেই তো বলে ফেললেন। কি করে জানাব? আমি কি ওদের চেহারা দেখেছি নাকি? দিনের বেলা সব সময় চোখ বেঁধে রাখত আমার। রাতে খুলে দিলেই বা কি? আলো জ্বালত না। ঘর থাকত অন্ধকার। কাউকে দেখতে পেতাম না।
ডিলন, অ্যাঞ্জেলা ডোভারের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কি আবার ভাল হবে মনে হয়?
এটাকে এখানে ঢুকতে দিয়েছে কে? আরে মিয়া, আমি কি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি নাকি এখন? এগারো দিন আটকে থেকে আসার পর মেয়েমানুষের কথা কে ভাবে?
কজন কিডন্যাপার ছিল?
বললাম না, আমি ওদের দেখিইনি।
গলা শুনেই লোক গুনে ফেলা যায়, আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর, এটা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। ব্যাটা মিথ্যে বলছে। অভিনয় করে ধোকা দিচ্ছে।
লোকগুলোও তো ধোকায় পড়ছে, তিক্তকণ্ঠে বলল রবিন।
ওরা আপনাকে মারধর করেছে? জিজ্ঞেস করল আরেকজন রিপোর্টার।
না, করবে না। পিকনিকে নিয়ে গিয়েছিল তো! মুখ বাঁকিয়ে হাসল ডিলন। যত্তসব! সব কথা শোনা চাই। আমাকে বেঁধে রেখেছে, পিটিয়েছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি ব্যথায়। তা-ও ছাড়েনি। এখন তো মনে হচ্ছে, আপনাদেরকে ধরে পিটাল না কেন, তাহলে কিছুটা শিক্ষা হত। আপনারা যেমন খবরের জন্যে খেপে গেছেন, ওরাও তেমনি টাকার জন্যে খেপে গিয়েছিল।
আরও কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেন বিরক্ত হয়েই মাইক্রোফোনের কাছ থেকে উঠে চলে গেল ডিলন। পুলিশ বিশ্বাস করেছে তার কথা, রিপোর্টাররাও করেছে। তাদের ভাবভঙ্গিতেই বোঝা গেল সেটা। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে তিন গোয়েন্দা, মিথ্যে বলেছে লোকটা, ঠকিয়েছে, ফাঁকি দিয়েছে। কিন্তু সেটা প্রমাণ। করার কোন উপায় নেই।
ফেরার পথে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল মুসা। আচমকা ফেটে পড়ল, ব্যাটা বদমাশ! রাগে টেবিলে চাপড় মারার মত চাপড় মারল স্টিয়ারিঙে, চাপ লেগে হর্ন বেজে উঠল। পুলিশ বিশ্বাস করেছে যখন, পারই পেয়ে গেল ওরা! এত্তবড় একটা শয়তানী করে। ভুলটা হল কোথায় আমাদের?
কিশোর জবাব দিল, ভুল আমাদের হয়নি। ওরা আসলে আমাদের ফাঁদে পা দেয়নি। কোন ভাবে সতর্ক হয়ে গেছে।
তার মানে আমরা কিছু করতে পারলাম না ওদের? পরাজয়টা রবিনও মেনে নিতে পারছে না। কিশোর আর রবিনকে যার যার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরল কিছুক্ষণ মুসা। শেষে রওনা হলো ফারিহাদের বাড়িতে। কিছুতেই কেসের ভাবনাটা মন থেকে সরাতে পারছে না। মনে হচ্ছে। পরাজয়ের আসল কারণ সে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে যদি কিশোরকে জানাত, তাহলে এরকমটা ঘটত না। কিন্তু আসলেই কি তাই? এখন আর জানার কোনই উপায় নেই।
ভাবতে ভাবতেই ফারিহাদের বাড়িতে পৌঁছে গেল। হেডলাইট জ্বেলে রেখেই গাড়ি থেকে নেমে এল সে। বাড়িতে ঢুকে সোজা চলে এল ফারিহার ঘরের সামনে। দরজায় টোকা দিল। বারান্দার আলোটা জ্বলল। খুলে গেল দরজা। ফারিহা দাঁড়িয়ে আছে।
হাই, মুসা বলল।
হাল্লো, কাকে চাই? তোমাকে চিনি বলে তো মনে হয় না? পথ হারালে নাকি? এটা আমাদের বাড়ি। তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারও নয়, গাড়ির গ্যারেজও নয়।
বাইরে চল। কথা আছে।
বলো না এখানেই। আমি শুনছি। রেগে আছে ফারিহা। তবে বেরোল মুসার
দেখো ফারিহা, ঝগড়াঝাটি করার মত মানসিক অবস্থা নেই আমার এখন। ফারিহার হাত ধরল মুসা, মাঝে মাঝে কি যে হয়ে যায় আমার, কি পাগলামি যে করে বসি…
সরাসরি ওর দিকে তাকাল ফারিহা। মুসা, কি হয়েছে তোমার? এরকম ভেঙে পড়তে তো তোমাকে দেখিনি কখনও?
পকেট থেকে স্ফটিকটা বের করল মুসা, পটার বোনহেড যেটা দিয়েছিল। তাকে। ফারিহার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, এটা রাখ।
কি এটা?
এমন একটা জিনিস, যা আর রাখতে চাই না আমি।
কেন?
কারণ এটা থাকলেই বার বার মনে হবে, একটা রহস্য আমি একা একা সমাধান করতে চেয়েছিলাম। শেষে পুরোটা ভজঘট করে দিয়েছি।
.
১৫.
চব্বিশ ঘণ্টা পরেও পরাজয়ের কথাটা ভুলতে পারল না মুসা। পারল না কিশোরও। চিকেন লারসেনের স্পেশাল মুরগীর কাবাব দিয়ে সেটা ভোলার চেষ্টা করছে।
চুপচাপ তাকিয়ে ওর খাওয়া দেখছে মুসা। ঘন ঘন ওঠানামা করছে কিশোরের হাতের চামচ। দেয়াল কাঁপিয়ে বাজছে হাই ফাঁই স্টেরিও, পঞ্চাশের দশকের রক মিউজিক।
কিশোর, তিন নম্বরটা খাচ্ছ, মুসা বলল।
কিশোরের চোখ ক্ষণিকের জন্যে উঠল। কিন্তু চামচের ওঠানামা বন্ধ হল না। চিবান বন্ধ হলো না। মাথা নাড়ল না।
হঠাৎ সামনের দরজার বেল বাজল। ঘরে ঢুকল রবিন। একটা চেয়ার টেনে। বসল সে। শোনো, খবর আছে একটা। ভোর বেলায় মিস্টার বার্টলেটের কাছে। ফোন এসেছে। জরুরী তলব। জানো কে?
শ্রাগ করল কিশোর। আজকাল মাথা আর খেলে না আমার। রহস্যের সমাধান করতে পারি না।
শোনই আগে কে ফোন করেছিল। দেখো, এটার সমাধান করতে পার কিনা। জ্যাক রিডার ফোন করেছিলেন। ডিলানের সম্মানে কাল রাতে তার বাড়িতে একটা পার্টি দিচ্ছেন। মরগানস ব্যাণ্ড দরকার।
তাহলে মরগানের খুশি, আমাদের কি? মুখ গোমড়া করেই রেখেছে মুসা।
রবিন বলল, কিছুই বুঝতে পারছ না তোমরা। ডিলনের মুখ থেকে সত্যি কথা আদায়ের এটা একটা মস্ত সুযোগ।
কেন? আরেকটু মাংস মুখে পুরল কিশোর, আমাদেরও দাওয়াত করেছে। নাকি?
করলেই কি না করলেই কি, হাসল রবিন। শোনো, আমার বুদ্ধি শোনো। সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, কালো বো টাই আর সানগ্লাস পরে চলে যাব আমরা। যে ক্যাটারিং সার্ভিসকে ভাড়া করেছেন রিডার, ওরা এই পোশাক পরেই যাবে। পার্টি চলাকালে ঢুকে পড়ব, কেউ আমাদের আলাদা করে চিনতে পারবে না।
এতক্ষণে হাসি ফুটল মুসার মুখে। কিশোরও চিবান বন্ধ করল।
পরদিন রাত নটায়, পুরোদমে পার্টি চলছে, এই সময় রিডারের বেল এয়ারের বাড়িতে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল রান্নাঘরে। তিনজনে তিনটে খাবারের ট্রে তুলে নিয়ে চলে এল মেহমানরা যেখানে ভিড় করে আছে সেখানে। ক্যাটারিং সার্ভিসের ওয়েইটারেরা খুব ব্যস্ত, ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক, বাড়তি তিনজন যে ঢুকে পড়েছে ওদের মধ্যে খেয়ালই করল না।
ডিলন কোথায়? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
হরর অথবা ভূতের ছবি তৈরি করার মত করেই যেন সাজানো হয়েছে রিডারের বাড়িটা। মধ্যযুগীয় কায়দায় ভারি ভারি করে তৈরি হয়েছে আসবাব, খোদাই করে অলঙ্করণ করা হয়েছে। রক্তলাল মখমলে মোড়া গদি। দেয়ালে ঝাড়বাতি। লোহার বড় বড় মোমদানীতে জ্বলছে বড় বড় মোম। কালো কাপড়ে লাল রঙে লেখা, ইংরেজিতে লেখা হয়েছে ব্যানার, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়ঃ মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছ বলে স্বাগতম, ডিলন। আঁকাবাঁকা করে আঁকা হয়েছে অক্ষরগুলো, দেখে মনে হয় নিচ থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। লিভিংরুমের মাঝখানে, ঝোলানো হয়েছে ব্যানার। তার নিচে বিশাল কাচের ফুলদানীতে রাখা হয়েছে লাল গোলাপ।
সুইমিং পুলের দিকে মুখ করা বারান্দায় বাজনা বাজাচ্ছে মরগানের দল। হলিউডের সিনেমা জগতের বড় বড় চাঁইয়েরা অতিথি হয়ে এসেছে। খাচ্ছে, নাচছে, আনন্দ করছে।
ওই যে অলিংগার, দেখাল রবিন। বাজনার শব্দকে ছাপিয়ে জোরে জোরে কথা বলতে হচ্ছে, নইলে বোঝা যায় না। আমাদের দিকে তাকালেই সরে যেতে হবে।
ডিলন কোথায়? একজন ওয়েইটারকে এগিয়ে আসতে দেখে আরেক দিকে মুখ করে দাঁড়াল কিশোর।
পেছন থেকে এগিয়ে এসে প্রায় ছোঁ মেরে মুসার চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে নিলেন রিডার। ঘটনাটা কি?
ইয়ে…ইয়ে…মানে…ইয়ে… থেমে গেল মুসা। কথা আটকে গেছে। কি বলবে জানে না।
তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেল রবিন। হেসে বলল, গোয়েন্দাগিরির ব্যবসায় আর পোষাচ্ছে না। তাই ক্যাটারিং ধরেছি।
খুব ভাল করেছ, হরর ছবির সংলাপ বলছেন যেন পরিচালক। তবে মুভি বিজনেস থেকে দূরে থাকবে। যদি হৃৎপিণ্ডে কাঁচির খোঁচা খেতে না চাও। হিরোকে নিয়েই বড় বিপদে আছি এমনিতেই। আর ঝামেলা বাড়িও না।
বুঝলাম না, মিস্টার রিডার? কিশোর বলল।
ডিলনের জন্যে এই পার্টি দিয়েছি। যাতে সে আসে। মন ভাল হয়। আবার অভিনয় করে সাফোকেশন টু-তে। কি জবাব দিয়েছে জান? সিয়াও। আউ রিভোয়া। হ্যাসটা লুয়েগো। শ্যালম। নানা ভাষায় এই কথাগুলোর একটাই মানে, বিদায়।
ডিলন কোথায় জানেন?
পুলের পানির তলায় থাকতে পারে। কিংবা আমার টরচার চেম্বারে। অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে ওদিকটাতেই যেতে দেখেছি।
গোল একটা ঘোরান সিঁড়ি দেখালেন রিডার। নিচে একটা ঘর রয়েছে। সেখানে অত্যাচার করার প্রাচীন সব অ্যানটিক যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বসে কথা বলতে দেখা গেল অ্যাঞ্জেলা আর ডিলনকে।
বেন, তিন গোয়েন্দাকে চিনতে পেরে হেসে বলল অ্যাঞ্জেলা, ওরা গোয়েন্দা। তোমাকে অনেক খুঁজেছে।
তাই নাকি? হাসি মুখে বলল বটে ডিলন, কিন্তু কণ্ঠস্বর তেমন আন্তরিক মনে হল না।
ওই কিডন্যাপিংটা নিশ্চয় খুব বাজে ব্যাপার হয়েছে, রবিন বলল আলাপ জমানর ভঙ্গিতে।
কথাটার জবাব না দিয়ে কর্কশ গলায় ডিলন বলল, তোমরাই পটারকে অপমান করতে গিয়েছিলে?
অপমান? আকাশ থেকে পড়ল যেন মুসা, বলেন কি? আমি তার রেসলিঙের মস্ত বড় ভক্ত। অপমান করতে পারি?
টেলিভিশনে আপনার সাক্ষাৎকার দেখার পর থেকেই কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্যে মরে যাচ্ছি, মিস্টার ডিলন, কিশোর বলল নিরীহ কণ্ঠে। আপনি বলেছেন, অন্ধকারে আপনি বুঝতে পারেননি কিডন্যাপাররা কজন ছিল। তাদের কথা শুনেছেন নিশ্চয়। গলা শুনেও মানুষ গণনা করা যায় অনেক সময়।
মাথা নাড়ল ডিলন। ওই ব্যাটারা অনেক চালাক। কেবলই কণ্ঠস্বর বদল করেছে। আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। অনেক বড় অভিনেতা ওরা, আমার ওস্তাদ। চোখের পাতা সামান্যতম কাপল না ওর। শান্ত, স্বাভাবিক রয়েছে।
একটা স্বর নকল করে শোনাতে পারেন?
দেখ, বেশি চালাকি… লাফ দিয়ে একটা পুরানো উঁচু চেয়ার থেকে নেমে পড়ল ডিলন, ওটাতে বসিয়ে অত্যাচার করা হত মানুষকে।
তার হাত চেপে ধরল অ্যাঞ্জেলা। আরে থামো থামো, ওরা তোমার উপকারই করতে চেয়েছে।
আপনার জন্যে খুবই সহজ কাজ, ডিলনের ওই আচরণ যেন দেখেও দেখেনি। কিশোর, এমনি ভঙ্গিতে বলল, কারণ আপনি বড় অভিনেতা। যে কোন লোকের স্বর নকল করে ফেলতে পারবেন। এভাবেই বলুন না, হাল্লো, পটার? কেমন আছ, পটার? তারপর এই কথাগুলো আবার আপনার স্বাভাবিক স্বরে বলুন। শুনতে খুব। ইচ্ছে করছে।
বলো না, বেন, অ্যাঞ্জেলা বলল। ছেলেগুলো এত করে যখন বলছে।
বলল ডিলন। একবার অন্য স্বরে, একবার নিজের আসল স্বরে। গায়ে কাঁটা দিল মুসার। এই কণ্ঠ তার চেনা। অলিংগারের অফিসে রেডিয়াল বাটন টিপে ফোন। করার সময় ওপাশ থেকে এই স্বরই শুনতে পেয়েছিল। কিশোরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল সে। জবাবে কিশোরও ঝাঁকাল।
আপনার ছবি দেখেছি। সিনেমা, কিশোর বলল। তাতে বেঁধে রাখতে দেখেছি। কিডন্যাপাররাও কি বেঁধে রেখেছিল সারাক্ষণ?
ঢিলেঢালা একটা হাফ-হাতা টারকুইজ শার্ট পরেছে ডিলন। চট করে একবার কব্জির দিকে তাকাল। দাগটাগ কিছু নেই। আড়চোখে তাকাল কিশোরের দিকে। মাথা নেড়ে বলল, না, ঘরে তালা দিয়ে রেখেছিল কেবল।
সাংঘাতিক চালাক তো ব্যাটা, ভাবল মুসা। কাচের ব্যাপারটা কি বলুন তো? এত কাচ?
কিসের কাচ? জিজ্ঞেস করল ডিলন।
আপনার সৈকতের ধারের বাড়িতে। সারা ঘরে কাচ ছড়িয়ে ছিল।
হঠাৎ ঘরের সমস্ত আলো মিটমিট করতে শুরু করল, জ্বলে আর নেভে, জ্বলে আর নেভে।
এই, সবাই স্ক্রিনিং রুমে চলে আসুন, মাইক্রোফোনে বললেন রিডার। সব ঘরেই স্পিকার লাগান রয়েছে, তাতে শোনা গেল তার কথা। আপনাদের জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।
চলো, অ্যাঞ্জেলাকে বলল ডিলন। ছেলেগুলো বিরক্ত করে ফেলেছে। আমাকে।
কাচের ব্যাপারটা বললেন না তো মিস্টার ডিলন? মুসা নাছোড়বান্দা।
আমি কি করে বলব? খেঁকিয়ে উঠল ডিলন। আমি কি দেখেছি নাকি? ধরেই আমার মাথায় একটা বস্তা টেনে দিয়ে ঢেকে ফেলল। ঠেলে মুসাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে অ্যাঞ্জেলার হাত ধরে টানল সে। কাচ নিয়ে কে মাথা ঘামায়? আমি তো ভেবেছি আর কোনদিনই ফিরতে পারব না। একটা কথা শোনো, কাজে লাগবে। বড় বেশি ছোঁক ছোঁক কর তোমরা। ভাল নয় এটা। অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে ঘোরান সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে। বেরিয়ে গেল টরচার চেম্বার থেকে।
এটাই চেয়েছিলাম, কিশোর বলল। ওকে নার্ভাস করে দিতে পেরেছি।
অত্যাচার করার ভয়াবহ যন্ত্রগুলোর দিকে তাকাল মুসা। এ ঘরে এসে কে নার্ভাস হবে না!
নার্ভাস হলে লাভটা কি? কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন, আমরা চেয়েছি ও ভুল করুক। বেস কিছু বলুক। যাতে কাঁক করে টুটি টিপে ধরতে পারি। তা তো করল না। পুরোপুরি ঠাণ্ডা রইল। ওর কিছু করতে পারব না।
ওরা তিনজনও উঠে এল ওপরতলায়। স্ক্রিনিং রুমে বড় একটা সিনেমার পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জ্যাক রিডার।
বক্তৃতা দেয়ার ঢঙে বলছেন, …আমরা সবাই একটা উদ্দেশ্যেই এখানে জমায়েত হয়েছি। ডিলন যে নিরাপদে মুক্তি পেয়ে ফিরে এসেছে এটা জানানোর জন্যে। দুনিয়া কোন দিনই জানতে পারবে না, মৃত্যুর কতটা কাছে চলে গিয়েছিল এতবড় একজন অভিনেতা। তার সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি সত্যি আনন্দিত। আরও খুশি হব যদি ছবিটা শেষ করতে পারি।
কেউ হাসল, কেউ কাশল, কেউ কেউ দৃষ্টি বিনিময় করল পরস্পরের দিকে।
এসব তো আমরা জানি, চিৎকার করে বলল একজন। সারপ্রাইজটা কি?
সারপ্রাইজ? হাসছেন রিডার। হাত কচলাচ্ছেন। সেটা একটা গোপন ব্যাপার। আমাদের সবারই কিছু না কিছু গোপনীয়তা আছে। ডিলনেরও আছে। সেটা গোপন রাখাই ভাল।
কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে মুসা, ভাল করে তাকাল ডিলনের মুখের দিকে। ভাবের কোন পরিবর্তন দেখতে পেল না। লোকটা সত্যিই বড় অভিনেতা, মনে মনে স্বীকার না করে পারল না সে।
ডিলন এই প্রথম আমার ছবিতে কাজ করছে না, রিডার বলছেন, আরও করেছে। তার প্রথম ছবিটাই পরিচালনা করেছি আমি।
আর বলবেন না! দুহাতে মুখ ঢেকে হতাশ হওয়ার অভিনয় করল ডিলন। ভ্যাম্পায়ার ইন মাই ক্লোজেটের কথা বলছেন তো? ছবিটা মুক্তিই দিতে দিল না স্টুডিও। ওই ভয়ঙ্কর বোমা ফাটানোর দৃশ্যটাই এর জন্যে দায়ী। ওফ বিচ্ছিরি!
হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালেন রিডার। আমারও একই অবস্থা হয়েছিল ওই ছবি করতে গিয়ে। লোকে আমার দিকে ফিরেও তাকাত না তখন। বড় পরিচালক বলা তো দূরের কথা, এখন যেমন বলে। থামলেন তিনি। তাকালেন। শ্রোতাদের দিকে। হাততালি আর প্রশংসা আশা করলেন যেন। লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলম্যান, ডিলন জানে না কথাটা, ওই ছবির একটা প্রিন্ট আমার কাছে আছে। সেটাই দেখান হবে এখন।
এইবার হাততালি আর চিল্কারে ফেটে পড়ল শ্রোতারা।
লাইটস! ক্যামেরা! অ্যাকশন! শুটিঙের সময় যেভাবে চেঁচানো সে রকম করে চেঁচিয়ে উঠলেন রিডার।
আলো নিভে গেল। রোম খাড়া করে দেয়া বাজনা বেজে উঠল। পর্দায় ফুটল ছবি।
এক ভয়াবহ ছবি। বোর্ডিং স্কুলে ছাত্ররা বার বার ভ্যাম্পায়ারের শিকার হতে লাগল। পিশাচটাকে জ্যান্ত করে তুলেছিল কয়েকটা ছেলে। বহুদিন বন্ধ করে রাখা পাতাল ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল, পেয়ে গিয়েছিল একটা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আর একটা কঙ্কাল, ওই পাণ্ডুলিপিতে লেখা ছিল কি করে জ্যান্ত করে তুলতে হয় ভ্যাম্পায়ারকে। খেলার ছলে ওরা করে ফেলেছিল কাজটা, সত্যিই যে জেগে উঠবে। পিশাচ কল্পনাই করতে পারেনি।
প্রথমেই ভ্যাম্পায়ারের কামড় খেল ডিলন। হয়ে গেল ভ্যাম্পায়ার। ফ্যাকাসে চেহারা, তাতে সবুজ আভা, চোখের চারপাশে কালো দাগ, চোয়াল বসা, কালো আলখেল্লা পরা ভয়ঙ্কর ভ্যাম্পায়ার আতঙ্কের ঝড় তুলল যেন পর্দায়।
হঠাৎ আঙুল দিয়ে রবিন আর কিশোরের পিঠে খোঁচা মারল মুসা। কিশোরেরটা এতই জোরে হয়ে গেল, উফ করে উঠল সে।
আমি যা দেখেছি তুমিও দেখেছ? ওর কানে কানে বলল মুসা, মনে করতে পার?
অন্ধকারেই উজ্জ্বল হলো কিশোরের হাসি। ভাল মত। এই পোশাকই পরেছিল সে, হ্যালোউইনের রাতে আমাদের হেডকোয়ার্টারে ঢোকার সময়।
.
১৬.
একটা মুহূর্ত; দীর্ঘ, স্তব্ধ হয়ে যাওয়া একটা নীরব মুহূর্ত অনড় হয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। নড়তে পারল না। চোখ আটকে রইল পর্দায়, যেখানে ভ্যাম্পায়ারের সাজে সাজা বেন ডিলন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। রক্ত শোষণ করছে একের পর এক মানুষের।
আমি চেয়েছিলাম, রবিন বলল। একটা ভুল করুক ডিলন। মাত্র একটা। তাহলেই ধরতে পারতাম।
করে ফেলেছে, উত্তেজিত কণ্ঠে মুসা বলল। হ্যালোউইনের দিনে আমাদের হেডকোয়ার্টারে ঢুকে। সেরাতে কোথায় ছিল প্রমাণ করতে পারব আমরা। কিডন্যাপারটা আটকে রাখেনি, এটা তো শিওর।
উত্তেজিত কিশোরও হয়েছে, তবে অনেক বেশি সতর্ক রয়েছে সে। ভিডিও টেপে রেকর্ড করা রয়েছে, চুরি করে আমাদের হেডকোয়ার্টারে ঢুকেছিল একজন। লোক। সেই লোকই যে ডিলন, প্রমাণ করতে পারছি না আমরা। তবে তাড়াহুড়া করলে হয়তো বিশেষ একজনকে ভড়কে দিতে পারব।
কেসটা আবার ভাল লাগতে আরম্ভ করেছে আমার, মুসা বলল।
লাগবেই। কারণ একটা মেজর রোল প্লে করতে হবে তোমাকে।
মুসার মেজর রোলটা হল হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে ভিডিও টেপটা নিয়ে আবার বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে পার্টিতে ফিরে আসা। ছবিটা শেষ হওয়ার আগে।
রকি বীচের দিকে তীব্র গতিতে গাড়ি ছুটিয়েছে মুসা। বুকের মধ্যে কাপন শুরু হয়ে গেছে তার। ব্রেকটা গোলমাল করতে আরম্ভ করেছে, অ্যাকসিলেরেটর পুরোটা না নেমে মাঝপথেই আটকে যাচ্ছে। বিরক্ত লাগে মুসার। এত সময় ব্যয় করে গাড়িটার পেছনে, সব কিছু ঠিকঠাক রাখতে চায়, তারপরেও প্রয়োজনের সময় গোলমাল করতে থাকে। সন্দেহ হতে লাগল তার, পৌঁছতে পারবে তো সময়মত?
ইয়ার্ডে পৌঁছে একলাফে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে ঢুকল হেডকোয়ার্টারে। ক্যাসেটটা বের করে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিল। যেন প্রার্থনা করল সৌভাগ্য বয়ে আনার জন্যে।
তারপর বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে ছুটল আবার বেল এয়ারের দিকে।
ভূতুড়ে চেহারার ছমছমে পরিবেশের সেই বাড়িটাতে যখন পৌঁছল, দেখল তখনও ছবি চলছে। নিঃশব্দে স্ক্রিনিং রুমের পেছনে প্রোজেকশন বুদে ঢুকে পড়ল মুসা। ঘরটা খালি। প্লেয়ারে ক্যাসেটটা ভরল সে। কয়েকটা বোতাম টিপতেই বন্ধ হয়ে গেল প্রোজেকটরের ফিল্ম। ছবি চলে গেল পর্দা থেকে। কয়েক সেকেণ্ড পরেই। সেই জায়গা দখল করল ভিডিও প্লেয়ার, কয়েকটা বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে আবার ছবি ফোঁটাল পর্দায়।
ক্যাসেটটা চালু করে দিয়েই দৌড়ে স্ক্রিনিং রুমে চলে এল মুসা, রবিন আর কিশোরের পাশে।
হাসাহাসি শুরু করেছে দর্শকরা।
একজন বলল, দারুণ এডিটিং করেছ তো হে জ্যাক। কোত্থেকে তুললে এটা?
ঘুমিয়ে ছিলে নাকি তখন? বিরক্ত হয়ে বলল আরেকজন। মনে হচ্ছে ক্যামেরাকে ছেড়ে দিয়ে আরেক জায়গায় চলে গিয়েছিলে? ফোকাসিঙের এই অবস্থা কেন?
ট্রেলারের দরজায় লাথি মারতে দেখা গেল ডিলনকে।
কি ব্যাপার, ডিলন? বলে উঠল এক মহিলা। এরকম করলে কেন? ঢুকতে বাধা দিয়েছিল নাকি কেউ? দেখা তো যাচ্ছে না।
খুশি হয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা। ডিলনের নাম বলেছে মহিলা। তার মানে ওরা। সফল হতে চলেছে।
কার কথা বলছেন? গলায় জোর নেই ডিলনের, ওটা আমি নই…
জ্বলে উঠল ঘরের সব আলো। ডিলনের দিকে ঘুরে তাকালেন রিডার। চোখে খুনীর দৃষ্টি। এগুলো কখন তুললে?
নীল একটা স্ফটিক হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে মরিয়া হয়ে বলল ডিলন, আমি নই! ওই লোকটা আমি নই, বলছি না!
তুমি নও মানে? নিশ্চয় তুমি! কানা হয়ে গেছি নাকি আমরা!
আমি নই, দুর্বল কণ্ঠে আবার বলল ডিলন।
তাহলে কে? কোমল গলায় জানতে চাইল অ্যাঞ্জেলা ডোভার। ছবিটা শেষ করার পরেও ওই পোশাক তোমার কাছে রেখে দিয়েছিলে। কেন অস্বীকার করছ?
পার্টিতে পটার বোনহেডকেও দাওয়াত করা হয়েছে। উঠে দাঁড়াল সে। দুহাত দুপাশে ডানার মত ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে শান্ত হতে বলল দর্শকদের। বলল, অনেক সময় আমাদেরকে আমাদের মত লাগলেও আসলে আমরা নই।
চমৎকার, বোনহেড, তীব্র ব্যঙ্গ ঝরল মুসার কণ্ঠে। ঠিকই বলেছেন। এই যেমন, এখনও গা থেকে টু-টন টিটানের গন্ধ ধুয়ে ফেলতে পারেননি আপনি।
তাড়াহুড়ো করে আবার চেয়ারে বসে পড়ল বোনহেড।
অস্বস্তিতে কেবলই চেয়ারে উসখুস করছে ডিলন।
হচ্ছেটা কি কিছুই তো বুঝতে পারছি না! রিডার বললেন।
দ্রুত ঘরের সামনের দিকে চলে এল কিশোর, রবিন আর মুসা, যেখানে ওদেরকে সবাই দেখতে পাবে। পর্দাটার কাছে।
মিস্টার রিডার, বলতে লাগল কিশোর, যে টেপটা দেখলেন ওটা আমাদের। নয় দিন আগে হ্যালোউইনের রাতে ভোলা। রকি বীচে আমাদের ট্রেলারে ঢুকেছিল ডিলন, চুরি করে।
মৃদু গুঞ্জন উঠল দর্শকদের মাঝে। অবিশ্বাসের হাসি হাসল কেউ কেউ।
অসম্ভব, প্রতিবাদ জানাল অ্যাঞ্জেলা। হ্যালোউইনের তিন দিন আগে কিডন্যাপ করা হয়েছে বেনকে।
কোন কিডন্যাপিংই হয়নি, জোর গলায় বলল কিশোর। পুরোটাই ধাপ্পাবাজি।
হঠাৎ ব্রাউন অলিংগারের ঘড়ি অ্যালার্ম দিতে শুরু করল, উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এসব ফালতু কথা শোনার কোন মানে হয় না। নিশ্চয় নেশা করে এসেছে ছেলেগুলো। কিডন্যাপ অবশ্যই হয়েছিল। জ্যাক, দেখছ কি? বের করে দাও ওগুলোকে। দরজার দিকে এগোনোর চেষ্টা করলেন তিনি। পথ আটকাল মুসা।
একটু দাঁড়ান, মিস্টার অলিংগার, কিশোর বলল, আপনিও জড়িত আছেন
মানে? ভুরু কুঁচকে গেছে রিডারের।
বেন ডিলনকেই জিজ্ঞেস করুন না, মুসা বলল।
উঠে দাঁড়াল ডিলন, যেন বেরিয়ে যাওয়ার জন্যেই। কিন্তু সবগুলো চোখ তার দিকে ঘুরে যাওয়ায় বেরোতে আর পারল না। অলিংগারের দিকে তাকাল। তারপর একে একে কিশোর, মুসা আর রবিনের দিকে। ভঙ্গি আর দৃষ্টি দেখে মনে হলো। কোণঠাসা হয়ে পড়েছে খেপা জানোয়ার।
এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষে বসে পড়তে বাধ্য হলো আবার, তবে চেয়ারে না বসে বসল চেয়ারের হাতলের ওপর। বেশ, স্বীকার করছি, ওটা কিডন্যাপ ছিল না। কিডন্যাপ করা হয়নি আমাকে। জোক। রসিকতা।
জোক! রাগে চিৎকার করে উঠলেন রিডার, আমার ছবিটাকে স্যাবোটাজ করে দিয়ে রসিকতা! এরকম একটা কাজ কি করে করতে পারলে!
বসে পড়লেন অলিংগার। চোখে আগুন। পরিচালকের দিকে তাকিয়ে বললেন, এসব ঝামেলা না করে আসলে তোমাকে খুন করা উচিত ছিল, জ্যাক। যাতে আর কোন দিন কোন ছবি বানানোর পাগলামি করতে না পারো!
বোঝার চেষ্টা করুন, রিডার, ডিলন বলল, ছবির সব চেয়ে ভাল অংশগুলোও কিছু হচ্ছিল না। এ জিনিস পুরোপুরি ফ্লপ হতে বাধ্য। সাফোকেশন টু মুক্তি পেলে হাসাহাসি করত লোকে। বেশি বাজেটের ছবি করার ক্ষমতাই আপনার নেই, এটা মেনে নেয়া উচিত।
কে বলে? আরও রেগে গেলেন রিডার।
ডিলন বলে, আমি বলছি, দুজন তো হয়ে গেল, অলিংগার বললেন। খুঁজলে আরও অনেককে পেয়ে যাবে।
কঠিন হাসি হাসল ডিলন। তাকাল ওর নীল স্ফটিকের দিকে। কি কি গোলমাল হয়েছে, খুলেই বলি, তাহলেই বুঝতে পারবেন। হপ্তা দুই আগে আমি আর ব্রাউন কয়েকটা ডেইলি দেখছিলাম। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল সে। শেষে ঠিকই, করে ফেলল, এ ছবি করা যাবে না। আফসোস করে বলতে লাগল, অনেক টাকা। ইতিমধ্যেই বেরিয়ে গেছে। ছবি শেষ করতে গেলে আরও অনেক বেশি যাবে। তখন আর মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া গতি থাকবে না। আগেভাগেই বন্ধ করে দেয়া উচিত, নইলে ভ্যাম্পায়ার ইন মাই ক্লোজেটের মতই আলমারিতে পড়ে থাকবে। আমিও বুঝলাম, ওই ছবি মুক্তি পেলে আমারও ক্যারিয়ার শেষ। কাজেই ব্রাউন যখন প্ল্যানটা করল, আমিও তাতে যোগ দিতে রাজি হয়ে গেলাম। মন খারাপ করবেন না, রিডার, আর কোন উপায় ছিল না।
করব না, শীতল কণ্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন রিডার, যখন তুমি আর অলিংগার জেলে যাবে।
জেল? চেয়ার থেকে উঠে পর্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ডিলন। কোন সম্ভাবনা। নেই। কাজটা ভাল করিনি, ঠিক, কিন্তু অপরাধ করেছি বলে মনে হয় না। আমিই ভিকটিম, আমিই কিডন্যাপার। আমার বাড়ি আমিই তছনছ করেছি। পুলিশ কাকে ধরবে?
কাচ, বলে উঠল মুসা। মনে হচ্ছে, আবার দম আটকে আসছে। কাচগুলো ভাঙল কে? এল কোত্থেকে?
ওটা ভাঙতেই হলো। স্ফটিকগুলো ছাড়া নড়ি না আমি। সাথে করে নিতে হল। ওগুলো একটা কাচের বাক্সে রাখতাম। কিডন্যাপের খবর জানাজানি হলে পুলিশ আসবে, বাক্সটা দেখে সন্দেহ করবে কি ছিল ওটাতে। জেনে যাবে স্ফটিক রাখা হত। আরও সন্দেহ হবে। স্কটিকগুলো গেল কোথায়? আমাকে নিশ্চয় নিয়ে যেতে দেবে না কিডন্যাপাররা?
কাজেই সন্দেহের অবকাশই রাখলেন না আপনি, কিশোর বলল, বাক্সটা ভেঙে রেখে গেলেন। পুরো দৃশ্যটা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে, ওদিকে সন্দেহ থেকে মুক্তি পাবেন আপনি। বুদ্ধিটা মন্দ না।
এই কিডন্যাপিঙের বুদ্ধিটা ভাল হয়নি, যাই বল, মুখ বাঁকাল ডিলন। র্যানসমের টাকা আনতে প্লে গ্রাউণ্ডে যেতে হল। সত্যিই ওটা কিডন্যাপিং এটা বোঝানর জন্যে করতে হয়েছিল এসব। ঠিকঠাক মতই সব করে বেরিয়ে আসতে পারতাম, বাগড়া দিয়ে বসলে তোমরা। পিছু নিলে। ঠেকানোর জন্যে মারামারিটা করতেই হলো। বাড়ি মেরে বসলাম সুটকেস দিয়ে কাকে যেন।
হ্যাঁ, আমাকেই মেরেছেন, মুসা বলল।
তা নাহয় হলো, কিশোর বলল। কিন্তু হ্যালোউইনের রাতে আমাদের হেডকোয়ার্টারে কেন ঢুকেছিলেন? কেসটা হাতে নিয়েছি তখনও কয়েক ঘণ্টাও হয়নি।
ব্রাউন বলেছে তোমাদের কথা। ঘাবড়ে গেলাম। কারণ তোমাদের নাম শুনেছি আমি। শুনেছি, তিন গোয়েন্দা কারও পিছু নিলে শেষ না দেখে ছাড়ে না। কাজেই শুরুতেই তোমাদের ভয় দেখিয়ে থামানোর চেষ্টা করেছিলাম।
তখনই মানা করেছি! রাগে খেঁকিয়ে উঠলেন অলিংগার। এটা করতে গিয়েই ধরাটা পড়লে! সব সময়ই বাড়াবাড়ি করে বসো তুমি!
করেছি, ভুল করেছি, কি আর করব। তবে অপরাধ করিনি। একটা ছবি মুক্তি না পেলে হলিউডের ক্ষতি হবে না, দর্শকরা পাগল হয়ে যাবে না। বরং ছবিটা বন্ধ করে দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার আর কয়েক কোটি টাকা বাঁচালাম।
র্যানসমের টাকাগুলো কোথায়? মুসার প্রশ্ন।
আমার কাছে। ইনসিওরেন্স কোম্পানি ব্রাউনকে যত টাকা পে করেছে ওটা তার অর্ধেক। ফিরিয়ে দিলেই হবে এখন।
মাথা নাড়ল মুসা, না, হবে না। অপরাধ যা করার করে ফেলেছেন। শাস্তি ভোগ করতেই হবে। টেলিভিশনেও লক্ষ লক্ষ দর্শকের সামনে, রিপোর্টার আর পুলিশের সামনে মিথ্যে কথা বলেছেন। পুলিশ আপনাকে ছাড়বে ভেবেছেন? ইনসিওরেন্সকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টার অপরাধে অলিংগারও পার পাবেন না।
অলিংগারের দিকে ঘুরে গেল রিডারের চোখ। প্রযোজকদের বিশ্বাস নেই যে বলে লোকে, এমনি এমনি বলে না। সব সময় ঠকানর চেষ্টা করে, দরকারের সময় টাকা দিতে চায় না, অথচ ছবি কেন শেষ হয় না সেটা নিয়ে চাপাচাপির সীমা নেই। অ্যাকটরগুলোও সব ফাঁকিবাজ। কিছুতেই কথা রাখবে না।
আর পরিচালকগুলো সব পাগল, তিক্তকণ্ঠে বলল ডিলন।
নীরব হয়ে ছিল ঘরটা। হঠাৎ একজন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।
অ্যাঞ্জেলা, কোথায় যাও? ডেকে জিজ্ঞেস করল ডিলন।
প্রায় দরজার কাছে চলে গেছে অ্যাঞ্জেলা। ফিরে তাকিয়ে বলল, এখানে আর একটা সেকেণ্ড থাকতে চাই না। এরপর কি হবে জানি। পুলিশ আসবে, অপরাধীদের হাতকড়া দিয়ে নিয়ে চলে যাবে। সব ভজঘট করে দিয়েছ, বেন। সিনেমার লোক তুমি, সিনেমাতে থাকলেই ভাল করতে।
অ্যাঞ্জেলা বেরিয়ে যেতে অন্যেরাও উঠে পড়তে লাগল। বেরিয়ে যেতে লাগল দ্রুত। পার্টি ভেঙে গেল। চিৎকার করে সবাইকে থামানোর চেষ্টা করলেন অলিংগার, তার কথা শুনে যেতে বললেন। কেউ থাকল না। তার কৈফিয়ত শোনার আগ্রহ নেই কারও।
আর কেউ না শুনলেও আপনার কথা পুলিশ শুনবে, মিস্টার অলিংগার, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। ঘড়ি দেখল। ফোন করে দিয়েছি। চলে আসবে।
সব কথা বলতে অনেক সময় লেগে গেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করল পুলিশ, জবাব লিখে নিল। ভূতুড়ে চেহারার বাড়িটা থেকে যখন বেরোল তিন গোয়েন্দা, পুবের আকাশে তখন সূর্য উঁকি দিয়েছে। রকি বীচে ফিরে চলল ওরা। কয়েক ঘণ্টা বাদেই স্কুল শুরু হবে। স্কুলের শেষে জরুরী কাজ আছে মুসা আর রবিনের।
.
কয়েকদিন পর ব্রাউন অলিংগারের একটা চিঠি নিয়ে হেড-কোয়ার্টারে ঢুকল মুসা। ডেস্কের ওপর বিছিয়ে দিল, যাতে রবিন আর কিশোর পড়তে পারে। লেখা রয়েছেঃ
মুসা,
প্রথমেই স্বীকার করে নিই, তোমাদের অবহেলা করে ভুল করেছিলাম। অন্যায় যে করেছি সেটাও স্বীকার করছি। তোমরা শুনলে হয়ত খুশিই হবে, উকিলকে দিয়ে বীমা কোম্পানির সঙ্গে একটা মিটমাটে আসতে পেরেছি আমি। রিডারের সঙ্গেও রফা করে নিয়েছি। আগামী তিন-চার মাস আর কোন কাজ করতে পারব না, তবে আশার কথা, ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে কেলেঙ্কারির কথা বেশিদিন মনে রাখে না লোকে। আগামী বসন্ত থেকেই আবার কাজ শুরু করতে পারব। চিঠিটা সে কারণেই লেখা। অবশ্যই ছবি তৈরি করতে হবে আমাকে, এটাই যখন ব্যবসা। ঠিক করেছি, পরের ছবিটা করব তিন গোয়েন্দার গল্প নিয়ে। রহস্য গল্প। কিডন্যাপিঙের গল্প। সত্যি ঘটনা যেটা এবার আমরা ঘটালাম। ছবিটার কি নাম দেয়া যায়, বল তো? টেরর ইন দা গ্রেভইয়ার্ড? ভালই হয়, কি বলো? হ্যাঁ, একটা দাওয়াত দিচ্ছি। আগামী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এসপেটোতে চলে এস, লাঞ্চ খাওয়াব। বিশ্বাস কর, এবার আর ওষুধ মেশান মিল্ক শেক খাওয়াব না।
—ব্রাউন অলিংগার।
চিঠি পড়া শেষ করে বলল রবিন, ওই লোককে আমি আর বিশ্বাস করি না।
আমিও না, চিঠিটা তুলে নিয়ে ছিঁড়ে ঝুড়িতে ফেলে দিল মুসা।
কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না সে। আবার শুরু হয়েছে দম আটকে আসার ব্যাপারটা। ওফ, শ্বাস নিতে পারছি না! যতবারই এই কেসটা নিয়ে। বেভাবতে যাই, এরকম হয়। দম আটকে আসতে চায়।
শান্ত হও, শরীর চিল করে দেয়ার চেষ্টা করো, কিশোর বলল। কেন এরকম হয়, বুঝতে পারবে এখনই।
কি, কিশোর? জলদি বলো! হিপনোটিক সাজেশন? স্ফটিকের কারসাজি?, বোনহেড জিন চালান দিতে জানে? কেন হয়?
ডেস্কের ভেতর থেকে একটা খবরের কাগজের কাটিং বের করল কিশোর। তুলে দিল মুসার হাতে। এটা পড়েই রহস্যটার সমাধান করে ফেলেছি। তুমিও পারবে। পড়ো।
হেডলাইন পড়ল, নিচের লেখাটাও পড়ল মুসা। ঝুলে পড়ল চোয়াল। বিড়বিড় করল, বাতাসে পোলেন বেশি! অনেককেই ধরেছে!
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর, বলছে তো পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এত বেশি আক্রান্ত আর হয়নি লোকে।
তার মানে জিনটিন কিছু না! হে-ফিভারে ধরেছে! আমাদের ভয় দেখিয়ে ঠেকানোর জন্যেই বোনহেড পাথর দিয়েছে, হুমকি দিয়েছে, গোরস্থানে মাটি চাপা দেয়ার ভান করেছে?
আবার মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
তাহলে যখনই কেসটার কথা ভাবি তখনই দম আটকানো ভাবটা হয় কেন?
সব সময় হয় না। আবার যখন না ভেবেছ তখনও হয়েছে এই অসুবিধে। ভালমত খেয়াল রাখলেই মনে থাকত।
স্ফটিকটা ধরলে তাহলে হাতে গরম লাগত কেন?
ওটাও বেশির ভাগই কল্পনা। আরেকটা ব্যাপার অবশ্য আছে। ওরকম পাথর। পকেটে রেখে দিলে গায়ের গরমে গরম হয়ে থাকে। হাত দিয়ে চেপে ধরলে আরও গরম হয়ে যায়। মনে হয়, অলৌকিক ক্ষমতাই আছে ওটার। আর যদি কেউ মাথায়। ঢুকিয়ে দেয়, আছে, তাহলে তো কথাই নেই।
হু! বলতে বলতেই গলা চেপে ধরল মুসা, হাঁসফাঁস করতে লাগল।
কি, আবার আটকাচ্ছে?
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল মুসা।
তাহলেই বোঝো।