০৬.
পরদিন সকাল আটটায় ড্রইং রুমে এসে বসলো তিন গোয়েন্দা। আরিফ সাহেব আগে থেকেই আছেন। কচিও এলো। তাকে আসতে বলে দিয়েছিলো কিশোর।
মামা, একটা কাজ করে দেবে? ভূমিকা না করে সরাসরিই বললো কিশোর।
কি কাজ? খবরের কাগজ থেকে মুখ তুললেন আরিফ সাহেব।
থানায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কাঁচ ভাঙার রাতে রাস্তায় ডিউটি ছিলো যাদের, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে।
এক মুহূর্ত ভাবলেন আরিফ সাহেব। তারপর মাথা কঁকালেন, হু, তা অবশ্য করা যায়। গুলশান থানার ওসিকে ফোন করে বলতে পারি। ব্যবস্থা করে দেবে। কখন যেতে চাস?
পারলে এখনই।
আচ্ছা দেখি।
পনেরো মিনিট পর রিসিভার রেখে দিয়ে ফিরে তাকালেন আরিফ সাহেব। মৃদু হেসে বললেন, হয়ে গেছে। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। ওসি কথা দিয়েছে, আমার চিঠি দেখালেই সহযোগিতা করবে পুলিশ।
আরও আধঘণ্টা পর বেরিয়ে পড়লো ওরা। বাসে করে উত্তরা থেকে বনানীতে এসে নামলো।
ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিশোর বললো, যেসব রাস্তায় কাঁচ ভেঙেছে, ওসব জায়গায় সোমবার কিংবা বুধবারে যাদের ডিউটি ছিলো তাদেরকে জিজ্ঞেস করবো। গত হপ্তার খবর নিলেই হবে।
কিন্তু জিজ্ঞেসটা করবো কি? মুসার প্রশ্ন।
অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে কিনা। কাকে কাকে দেখেছে, কি রকম লোক, এসব।
মনে আছে কিনা ওদের কে জানে! রবিন বললো। প্রশ্নগুলো সব তুমিই ১ করো। আমরা তো বাংলা ভালো বলতে পারি না।
থানায় ঢুকে পরিচয় দিয়ে ওসি কথা জিজ্ঞেস করতেই তার ঘরে ওদেরকে নিয়ে। এলেন একজন ডিউটিরত পুলিশ। আরিফ সাহেবের চিঠি তাঁকে দেখালো কিশোর। ব্যবস্থা মোটামুটি তিনি আগেই করে রেখেছেন।
একজন তরুণ পুলিশ কনস্টেবলের সাক্ষাৎকার নেয়া হলো প্রথম।
ওই কাঁচ ভাঙা? মাথা নাড়লেন কনস্টেবল। নাহ্ কিচ্ছু দেখিনি। দেখলে তো ধরেই ফেলতাম। সন্দেহজনক মনে হয়নি কাউকে। অযথা সময় নষ্ট করেছি, বুঝলে। আসল চোর-ডাকাত ধরা বাদ দিয়ে কতগুলো দুষ্টু ছেলের পেছনে লেগেছি।
দুষ্টু ছেলেই, আপনি শিওর? কিশোরের প্রশ্ন।
তাছাড়া আর কি? দেখো, চাকরিতে ঢুকেছি সাত বছর হয়ে গেছে। শয়তান লোক তো আর কম দেখলাম না…।
আচ্ছা, কাকে কাকে দেখেছেন, মনে আছে? অনেক লোক?
রাস্তা যখন, লোক তো দেখবোই। আসছে যাচ্ছে, আসছে যাচ্ছে, কেউ দাঁড়ায়নি। কোনো গাড়ির দিকে ইট-পাথর ছুঁড়ে মারেনি কেউ, হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে কাঁচ ভাঙেনি…
যাদেরকে দেখেছেন, তাদের কারও চেহারা মনে আছে?
নিশ্চয়ই আছে। অনেকেরই। সাত বছর কাটিয়ে ফেলেছি, এখন একটা। প্রমোশন দরকার আমার। কাজেই ডিউটিতে ফাঁকি দিই না। আর আমার স্মরণশক্তি খুব ভালো, কাউকে একবার দেখলে সহজে ভুলি না…
দাঁড়ান দাঁড়ান, লিখে নিই। পকেট থেকে তাড়াতাড়ি নোটবুক বের করলো কিশোর।
নোটবুকের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন হঠাৎ কনস্টেবল, অযথাই কেশে গলা পরিষ্কার করলেন, ফালতু কথা আর বলা চলবে না বুঝে গেছেন। কারণ বক্তব্য লেখা হয়ে যাচ্ছে খাতায়। আর সেটা যদি ওসি সাহেব। দেখেন…সর্তক হয়ে কথা বললেন এবার তিনি, দাঁড়াও মনে করি। সে রাতে যে রাস্তায় পাহারা দিয়েছি, সেটাতে বিদেশীদের বাড়ি-ঘর বেশি। বেশির ভাগই এমব্যাসিতে চাকরি করে। একজন আমেরিকান মহিলাকে দেখলাম দামী একটা গাড়ি নিয়ে এসে এক বাড়ির সামনে রাখলো। বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আরেক মহিলা। গাড়িতে উঠলো। চলে গেল ওরা। এরপর…এরপর, হ্যাঁ এরপর এলো আরেক বিদেশী মহিলা। হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলো বোধহয়। সাথে একটা কুকুর। এমন পাজি জানোয়ার, আমার হলে পিটিয়ে পাছার চামড়া তুলে ফেলতাম। যেটা দেখে সেটাই শোকে, এখানে লাফ দিয়ে ওঠে, ওখানে লাফ দিয়ে ওঠে… চলে গেল ওরা। তারপর এলো একটা রামছাগল..
রামছাগল?
আরে মানুষই। ছাগলের মতো স্বভাব আরকি। ওই যে দেখেছো না রাস্তায়, কতগুলো ছেলেছোকরা আছে, চুলের ঠিক নেই, কাপড়ের ঠিক নেই, কি যে পরে আর কি যে করে:-ছাগল না ওগুলো? তেমনি একটা আরকি। তোমার তো আরো ভালো জানার কথা। একটা বিদেশী সাইকেলে চড়ে এলো। মাথায় কাপ, চোখে কালো চশমা। আরো দেখো কাণ্ড! পিঠে বস্তার মতো একটা ব্যাগ, সেটার ভেতরে বোধহয় ওয়াকম্যান-টোয়াকম্যান ছিলো, কানে হেডফোন। অনেক দেশেই গাড়ি কিংবা কিছু চালানোর সময় ওসব ব্যবহার করা নিষেধ, অ্যাকসিডেন্ট করে বলে, আমাদের দেশেও মানা করে দেয়া উচিত…এই যে দেখো না, লাজারি কোচগুলো, সারারাত ধরে চলে। দিনেও চলে। কানের পোকা বের করে দিয়ে। সারাক্ষণ ওগুলোর মধ্যে হিন্দি ছবির গান বাজে। ভিসিআর চলে। মাঝে মাঝে ড্রাইভারও গুনগুন করে গলা মেলায়, মাথা দোলায়, অসতর্ক হয়ে যায়। আর অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে..।
তা ঠিক, এক মত হলো মুসা। সব যাত্রী তো ওসব পছন্দও করে না। নিশ্চয়। অসুবিধা হয়। তো, আর কাকে দেখেছেন?
দেখেছি তো অনেককেই। তবে মনে রাখার মতো কাউকে নয়।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, নোটবুক বন্ধ করতে করতে বললো কিশোর।
তোমাকেও ধন্যবাদ। অযথা কষ্ট করছে, বুঝলে। সব দুষ্টু ছেলেদের কাজ।
দেখা যাক, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কি বেরোয়? হেসে বললো গোয়েন্দাপ্রধান।
এরপর কথা হলো সেই সার্জেন্ট আবদুল আজিজের সঙ্গে, সে রাতে যার। সাথে দেখা হয়েছিলো তিন গোয়েন্দার। হেসে স্বাগত জানালেন ছেলেদেরকে। আমার ওপরই তাহলে গোয়েন্দাগিরি চালাতে এসেছো। ভালো। তো কি জানতে চাও?
গত হপ্তায় তো সাত নম্বর রোডের কাছে ডিউটি ছিলো আপনার। কাউকে কাঁচ ভাঙতে দেখেননি। একটা কথা বলুন তো, ওই রোডে এমন কাউকে চোখে। পড়েছে, যার আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছে?
তাহলে তো ধরতামই। অন্তত জিজ্ঞেস তো করতাম, ওখানে কি করছে? না, সে রকম কাউকে চোখে পড়েনি।
লোকজন, গাড়ি, নিশ্চয় অনেক গেছে। এমন কাউকে চোখে পড়েছে, যার। কথা মনে আছে এখনও আপনার?
উ! গাল চুলকালেন সার্জেন্ট, মনে করার চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু আছে। লাল একটা টয়োটা করোলাতে করে গেছেন দুজন বিদেশী ভদ্রলোক। একটা ধূসর ফোক্স ওয়াগেন চালিয়ে গেছে দাড়িওয়ালা এক লোক। সম্বত ড্রাইভার। খবরের। কাগজের এক হকার ঢুকেছিলো এক বাড়িতে, বোধহয় বিলটিল নিতে। দুজন বয়স্কা মহিলা হেঁটে গেছেন, সাথে একটা ছেলে। ছেলেটার হাতে গুলতি ছিলো। একজন মহিলা গেছেন, সাথে একটা কুকুর নিয়ে…
মহিলার হাতে একটা লাঠি ছিলো, না?
মাথা নাড়লেন আবদুল আজিজ, না, কিছুই ছিলো না। শেকল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন কুকুরটাকে।
বিদেশী?
হা, বিদেশী।
কুকুরটার রঙ সাদা, তার মধ্যে কালো ছোপ, তাই না?
না। সারা শরীর ধূসর।
নিরাশ মনে হলো কিশোরকে। না, তাহলে যার কথা বলছি সে না। আচ্ছা, আর কাকে দেখেছেন?
বয় স্কাউটের পোশাক পরা দুটো ছেলে। লম্বা চুলওয়ালা হিপ্পি মার্কা এক তরুণ। টেন-স্পীড সাইকেলে করে গেছে আরেক তরুণ, মাথায় ক্যাপ, চোখে চশমা। পিঠে ব্যাকপ্যাক, তাতে ওয়াকম্যান ছিলো, কানে লাগানো হেডফোন দেখেই বুঝেছি। মোটর সাইকেলে চড়ে গেছে তিনজন, তাদের কোন কিছুই চোখে। পড়ার মতো নয়। চারজন বয়স্ক লোক গেছেন জগিং করতে করতে, সবার গায়েই গেজ্ঞী, তিনজনের পরনে ফুল প্যান্ট, একজনের হাফফকির-টকির আর সাধারণ কিছু লোক পায়ে হেঁটে গেছে, তাদের কথা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি…
একজন হাবিলদারের সাক্ষাৎকার নিতে গেল তারপর ওরা।
কিছুই ঘটেনি, জবাব দিলেন হাবিলদার। চোখে পড়ার মতো কিছু না। যা জিজ্ঞেস করার তাড়াতাড়ি করো। আমার ডিউটি আছে।
জানি, কাঁচ ভাঙতে কাউকে দেখেননি। সন্দেহজনক কাউকে দেখেছেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
না। ঘড়ি দেখলেন হাবিলদার।
আচ্ছা, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। কাকে কাকে দেখেছেন সে রাতে? মানে, চোখে পড়ার মতো?
অনেককেই।
খুলে বলবেন?
আরেকবার ঘড়ি দেখলেন হাবিলদার। পুরানো একটা টয়োটা পিকআপ ট্রাক। ঢুকতে দেখেছি। পেছনে কতগুলো ছেলে হই-হট্টগোল করে গান গাইছিলো। পিকনিক-টিকনিকে গিয়েছিলো বোধহয়। গলির প্রায় শেষ মাথায় গিয়ে একটা বাড়ির সামনে থামলো গাড়িটা। কয়েকটা ছেলে নেমে যাওয়ার পর বেরিয়ে গেল। আরও অনেককেই দেখেছি। টেবিল থেকে ক্যাপ তুলে নিলেন তিনি।
আরও দু-চারজনের কথা বলুন, প্লীজ!
মোটর সাইকেল নিয়ে তিনটে ছেলেকে যেতে দেখেছি। পাশাপাশি চলেছিলো। নিশ্চয় বন্ধু। গাড়ি গেছে কয়েকটা। তবে মনে রাখার মতো একজনই গেছে।
সে কে? আগ্রহে সামনে ঝুঁকে এলো কিশোর।
দেখে তো মনে হলো পাগলা গারদ থেকে বেরিয়েছে। একটা সাইকেলে করে। এলো। মাথায় টুপি, চোখে কালো চশমা, পিঠে ব্যাগ, কানে হেডফোন…শাই শাই করে চলে গেল। একবার ভেবেছি, থামাবো। তারপর ভাবলাম মরুকগে। আমার। কি? তৃতীয়বার ঘড়ি দেখলেন হাবিলদার। চলি, আর থাকতে পারছি না। আর কিছু জানার থাকলে অন্য সময় এসো, যখন আমার বাইরে ডিউটি থাকবে না।
ফাইলে মুখ গুঁজে ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ আলি। ছেলেরা অফিসে। ঢুকতে সাড়া পেয়ে মুখ তুললেন। হেসে বললেন, আরে, তিন গোয়েন্দা যে। এসো এসো।
টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো কিশোর। স্যার, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিলো…
বসো, চেয়ার দেখিয়ে দিলেন সাব-ইন্সপেক্টর। জানি। ওসি সাহেব। বলেছেন। খুব বেশি সময় দিতে পারবো না কিন্তু…
বেশি সময় লাগবে না।
বলো, কি জানতে চাও?
.
০৭.
নিশ্চয় সাইকেলওয়ালা! টেবিলে চাপড় মারলো মুসা।
ঠিক! তার সঙ্গে সুর মেলালো কচি। টুপি, গগলস, ব্যাকপ্যাক, হেডফোন!
চারজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছি আমরা, একমত হলো রবিনও। চারজনেই ওকে দেখেছে। আমরা দুবার পাহারা দিয়েছি। দুবারই দেখেছি।
আলোচনা হচ্ছে বসার ঘরে। পুলিশদের কাছ থেকে নতুন কিছুই জানতে পারেনি ওরা।
তবে, কিশোর বললো, কেউই তাকে কিছু করতে দেখেনি। আমরাও না।
না, তা দেখেনি, সায় দিলে অন্য তিন জনেই।
একটা ব্যাপার কিন্তু সন্দেহজনক, আবার বললো কিশোর। তাকে বিভিন্ন রাস্তায় দেখা গেছে। রাতের বেলা। মোটামুটি একটা বিশেষ সময়ে। ওটা লোকের বাড়ি ফেরার সময়, বেরোনোর নয়। হতে পারে তার বাড়ি ওই এলাকায়। একেক দিন একেক রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরে। কতো লোকেরই তো কতো স্বভাব থাকে।
তারমানে বলতে চাইছে, নিরাশ মনে হলো মুসাকে, ব্যাপারটা কাকতালীয়?
একবার দুবার কাকতালীয় হতে পারে। কিন্তু এবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তাকে জানালা ভাঙতে দেখা যায়নি, তারমানে এই নয় যে সে ভাঙেনি। সন্দেহ থেকে বাদ দেয়া যায় না।
তোমার ধারণা, রবিন বললো, পুলিশ দেখেই সতর্ক হয়ে যায় সে? ওই রাস্তায় আর না ভেঙে অন্য যেখানে পাহারা নেই সেখানে গিয়ে ভাঙে?
অসম্ভব কি?
আমরা পাহারা দেয়ার সময়ও ভাঙেনি, মুসা বললো। তাহলে কি আমাদেরও দেখেছে?
দেখে থাকতে পারে। ভাঙতে এলে তা সাবধান হয়েই আসে। দেখেশুনে নেয় সব। আমরা যে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়েছি, সেটা তেমন ঘন নয়। ভালো মতো তাকালে যে কারোই চোখে পড়তে পারে। এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো। কিশোর। তারপর বললো, এখন আমাদের বড় সন্দেহ ওই সাইকেলওয়ালা। তাকে অপরাধী প্রমাণ করতে পারলেই হয়।
কি করে করবো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
ভাবছো কিছু? রবিনের প্রশ্ন।
কিশোর জবাব দেয়ার আগেই কচি বললো, কিন্তু ও-ই যদি ভেঙে থাকে, তাহলে আমি দেখলাম না কেন? মানে, আমি তো চোখ রেখেছিলাম। কাঁচ ভাঙতে হলে কোনো কিছু দিয়ে বাড়ি মারতে হবে। গাড়ির কাছে থামতে হবে। কোনোটাই করেনি সে। এমন কি যে রাতে কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনেছি, সে রাতেও তাকে দেখিনি।
কিশোরের দিকে তাকালো রবিন। সাইকেল না থামিয়ে কি করে কাঁচ ভাঙা যায় কিশোর?
কিংবা নাহয় থামলোই, মুসা বললো। কিন্তু কারো চোখে না পড়ে কি ভাবে ভাঙে? কি দিয়ে? অদৃশ্য মানব হয়ে যায় নাকি?
অবাস্তব কোনো কিছু ঘটে না নিশ্চয়ই, কিশোর বললো। সেটা সম্ভবও নয়। কচির দিকে তাকালো সে। সে রাতে কাঁচ ভাঙতে শুনেছো তুমি, গাড়ির কাছে কাউকে দেখোনি। হতে পারে তুমি বেরোতে বেরোতে তোমার চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিলো সে। এমন কিছু কি চোখে পড়েছে তোমার যা মনে করতে পারছে না?
চোখ আধবোজা করে ভাবার চেষ্টা করলো কচি। পিকআপের কাছে কাউকে দেখিনি..রাস্তায়ও না… হঠাৎ সোজা হয়ে বসলো সে। দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা নড়াচড়া বোধহয় দেখেছি! গাড়ির সামনে! দূরে! রাস্তায়!
কি ধরনের নড়াচড়া?
বলতে পারবে না। মনে করতে পারছি না। মনে হলো যেন পলকের জন্যে। দেখেছি।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। হয় এরকম। অনেক কিছুই দেখি আমরা যা মনে রাখার চেষ্টা করি না। ফলে ভুলে যাই। নড়াচড়াটা হয়তো কোনো সাইকেলেরই দেখেছো। কিন্তু যেহেতু কাঁচ ভাঙার সাথে সাইকেলের কোনো সম্পর্ক নেই, অন্তত তখন আমার মনে হয়নি, ওটার কথা মনে রাখার চেষ্টা করোনি তুমি। অথচ দেখেছো ঠিকই। একে বলে সাইকোলজিক্যাল ইনভিজিবিলিটি।
এতো দ্রুত যদি চলেই গিয়ে থাকে, রবিন প্রশ্ন তুললো, তার মানে কাঁচি ভাঙার জন্যে থামেনি সে। চলন্ত সাইকেল থেকে কি করে ভাঙলো?
ঠিক বলতে পারবো না। তবে একটা আইডিয়া আসছে মাথায়। দেখি, পুলিশের সঙ্গে আবার কথা বলতে হবে। কচি, তোমাদের পিকআপটাও পরীক্ষা। করতে চাই।
করবে। যখন খুশি।
কিন্তু কিশোর, রবিন বললো, সাইকেলওয়ালা যে কাঁচ ভাঙে, এটা প্রমাণ করবে কি করে? অবশ্য যদি ও-ই ভেঙে থাকে।
হাতেনাতে ধরবো। আবার ভূত-থেকে-ভূতে ব্যবহার করে।
মানে, শহরের সমস্ত ছেলেমেয়েকে হুঁশিয়ার করে দেবে চোখ রাখার জন্যে? মুসা বললো।
হ্যাঁ, তাই করবো। কিছু তথ্য এখন আমাদের হাতে আছে। ওদেরকে পরিষ্কার করে বলতে পারবো, কার ওপর চোখ রাখতে হবে। এতোগুলো চোখের কড়া নজর এড়িয়ে নিরাপদে কিছুতেই কাজ সারতে পারবে না সে।
যদি সে আগেই জেনে না যায় যে চোখ রাখা হচ্ছে, মুসা বললো। যে ভাবে জেনে যায় পুলিশ নজর রাখছে। এক্সরে ভিশন না তো তার? কিংবা ইনফ্রা রেড চোখ, যে অন্ধকারেও দেখবে! কে জানে হয়তো অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে। শুনেছি এদেশে নাকি ওরকম ক্ষমতাশালী লোকের অভাব নেই, অনেক পীর– ফকির আছে
ওসব কিছু না। অন্য কোনো ভাবে জানে। বাস্তব, সহজ কোনো উপায়ে। রাতেও চোখে কালো চশমা পরে, উদ্ভট চেহারার জিনিস। আমার এখন সন্দেহ। হচ্ছে, ওটা ফীল্ড গ্লাস। ওকে হাতেনাতে ধরতে পারলেই জেনে যাবো সেটা। কিন্তু মুশকিল হলো সেটা জানার জন্যে আগামী সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদেরকে। তার আগে আঘাত হানবে না সে।
ভালোই হয়েছে, মুসা বলল। ঘোরার সময় পেলাম। করিমদের বাড়িতে দাওয়াত খাবো, রাত কাটাবো। ও বললো এদেশে গাঁয়ের বাড়িতে রাতে থাকার মজাই নাকি আলাদা, বিশেষ করে শীতকালে। দেখে আসবো সেটা।
আমার পক্ষে যাওয়া বোধহয় সম্ভব হবে না, কচি বললো। অনেক কাজ। আমি ফার্মে না থাকলে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। বাবা একা কদিক সামলাবে?
হ্যাঁ, তা ঠিক, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তোমাকে আটকাবো না। তবে আমাদের সঙ্গে যেতে পারলে ভালো হতো। থাক, অসুবিধে হবে না। করিম পথঘাট চেনে। তো, এখন কি তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে? পিকআপটা দেখতাম।
চলো।
উঠতে যাবে ওরা, এই সময় বাজলো টেলিফোন। মামা-মামীর কারো হবে মনে করে রিসিভার তুললো কিশোর, হ্যালো।
ইয়ে, পরিচিত একটা কণ্ঠ, অস্বস্তি বোধ করছে বোঝা যায়, আরিফ সাহেরে বাসা?
হ্যাঁ।
কিশোর পাশা আছে?
অবাক হলো কিশোর। বলছি।
ও, কিশোর। আমি সানি। আকবর সাহেবের ভাতিজা। কাল রাতে আমাদের বাসার সামনে দেখা হয়েছিলো।
হ্যাঁ, মনে আছে। কি ব্যাপার?
ডলির মুখে তোমাদের সুখ্যাতি শুনে শুনে চাচার ধারণা হয়েছে, চেষ্টা করলে তোমরা হয়তো তার ঈগলটা খুঁজে বের করে দিতে পারবে। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে বললেন আমাদের। তা ফিস কতো তোমাদের?
ফিস-টিস নিই না আমরা। মানুষকে সাহায্য করতে পারলে, রহস্য আর সমস্যার সমাধান করে দিতে পারলেই খুশি।
তাই নাকি? ভালো কথা। চাচাকে বলবো। এখন কি একবার আসতে পারবে? ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যেতো। টেলিফোনে তো সব কথা বলা। যায় না…
এখুনি? এক মুহূর্ত ভাবলো কিশোর। বেশ আসছি।
বাসা চিনবে তো?
নিশ্চয়। রাখলাম।
.
০৮.
বাড়িটা বিশাল। সেদিন রাতের বেলা ঢুকেছিলো গোয়েন্দারা, ভালোমতো দেখতে পারেনি, এখন দেখলো। ভেতরে প্রচুর গাছপালা। গাড়ি বারান্দায় নতুন মডেলের একটা হোণ্ডা সিভিক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো ওরা। গ্যারেজে আরেকটা গাড়ি আছে। অনেক পুরানো। গায়ে ধুলো জমে আছে পুরু হয়ে। কোন আদ্যিকাল থেকে। ওটা ওখানে পড়ে আছে কে জানে। হুড আর উইশীল্ড ক্যানভাসে ঢাকা।
গাছপালার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে খোয়া বিছানো পথ। গাছের কারণে। সামনের দরজাটা প্রায় চোখেই পড়ে না।
কাছে এসে কলিং বেলের সুইচ টিপলো কিশোর। দরজা খুললো না।
এখুনি আসতে বলেছিলো? দরজা খুলছে না দেখে সন্দেহ হলো মূসার। ঠিক শুনেছো?
হা, জবাব দিলো কিশোর।
হঠাৎ বাড়ির অনেক ভেতর থেকে শোনা গেল রেগে যাওয়া কণ্ঠস্বর। দ্রুত। আরও কয়েকবার সুইচ টিপলো কিশোর। দরজা এবারও খুললো না, তবে কথা থেমে গেল।
বেলটাই বোধহয় কাজ করে না, রবিন বললো।
পাশে ঢোকার অন্য দরজা থাকতে পারে, মুসার অনুমান।
আবার রাস্তায় ফিরে এসে আশেপাশে উঁকি দিতে লাগলো ওরা। গ্যারেজটা যে পাশে সে পাশে আর কোনো দরজা দেখা গেল না।
ওটা কি? অদ্ভুত একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। পাশের খোলা চত্বরে চিত হয়ে আছে চার ফুট চওড়া একটা ধাতব জিনিস। দেখতে পিরিচের মতো। নিচে তিনটে পা। আকাশের দিকে পেট।
স্যাটেলাইট ডিশ, কিশোর বললো।
মহাকাশের স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো সঙ্কেত ধরে, জানালো রবিন। টেলিভিশন আর রেডিওর সঙ্কেত গিয়ে স্যাটেলাইটে ধাক্কা খেয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। আর আসে বলেই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনেক দূর থেকে পাঠানো টেলিভিশনের ছবি দেখি, রেডিও শুনতে পাই আমার। এখানকার আইন জানিনে, তবে আমেরিকায় এই ডিশের মাধ্যমে সঙ্কেত ধরে টিভি দেখলে কিংবা রেডিও শুনলে কেবল কোম্পানিকে পয়সা দিতে হয় না। খরচ বাঁচে।
কিশোর বললো, এখানে ওরকম কোন কোম্পানি নেই। রেডিও, টিভি দুটোই সরকারী। লাইসেন্সের খরচ দিতেই হবে।
তাহলে এটা রেখেছে কেন? মুসার প্রশ্ন।
হয়তো এমনি। কিংবা ওটাকে অ্যান্টেনা হিসেবে কাজে লাগায়। কোনো সময় আমেরিকায় ছিলেন হয়তো ভদ্রলোক, তখন কিনেছিলেন, আসার সময় নিয়ে এসেছেন সাথে করে।
মনে হয়, একমত হলো রবিন।
আবার কথা শোনা গেল। মুসা বলে উঠলো, খান সাহেবের গলা না?
ঘরের ভেতর থেকেই এসেছে বোধহয় কথা, মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না।
এই যে, এসে গেছে, এসো! বাড়ির সামনের দিক থেকে শোনা গেল আরেকটা কণ্ঠ। তাড়াতাড়ি আবার সামনের দরজার কাছে চলে এলো ছেলেরা। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সানি। কেমন যেন দ্বিধান্বিত। এসো, আবার বললো সে।
কয়েকবার বেল বাজালাম, বাড়ির পাশে চলে যাওয়ার কৈফিয়ত দিলো। কিশোর, কেউ খুললো না। ওদিকে আর কোনো দরজা-টরজা আছে কিনা দেখতে গিয়েছিলাম।
সরি, সানি বললো। পেছন দিকে ছিলাম আমরা। চাচার সঙ্গে কথা। বলছিলাম। বেল শুনিনি।
ওদের নিয়ে ঘরে ঢুকলো সে। বাড়িটা পুরানো, কিন্তু ঝকঝকে তকতকে। গুলশান-বনানীর আর দশটা আধুনিক বাড়ি থেকে আলাদা, অনেকটা পুরানো ঢাকার বাড়ির মতো। এ
চাচার শরীরটা ভালো নেই আজ, সানি বললো। শুয়ে আছেন। আমাকেই তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। ওই ঈগলটা খুঁজে দেয়ার ব্যাপারে আর
আসলে, রবিন বললো, এই কেসে ইতিমধ্যেই জড়িয়ে গেছি আমরা। কে কাঁচ ভাঙে রার জন্যে কচিকে সাহায্য করছি।
তাই তো। ভুলেই গিয়েছিলাম।
নতুন একটা আঙ্গিক যখন পাওয়া গেল, কিশোর বললো, এদিক থেকেও তদন্ত চালাতে পারি আমরা। হয়তো ঈগল খুঁজতে গিয়েই কাঁচ যে ভাঙে তাকে ধরে। ফেলতে পারবো। চুরি যখন করেছে; নিয়ে গিয়ে নিশ্চয় বিক্রিরও চেষ্টা করবে।
কি করে? মুসা বললো। এতে দামী জিনিস বেচবে কার কাছে? সাধারণ লোকে কিনবে না। টাকা এবং শখ দুটোই যার আছে সে ছাড়া। আর এখন কেনার ঝুঁকিও নিতে চাইবে না কেউ সহজে। চুরির খবর জেনে ফেলেছে অনেকে। এতে টাকা দিয়ে কিনে পুলিশের ঝামেলায় কেউ পড়তে চাইবে না।
এসব জিনিস যারা সংগ্রহ করে তাদেরকে চেনো না তুমি, মুসা, কিশোর বললো। কিছু লোক আছে, যারা রীতিমতো পাগল হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান। থাকে না। যে-কোনো ঝুঁকি নিয়ে বসে। জোগাড় করে লুকিয়ে রেখে দেয়। শুধু নিজে দেখে, কাউকে দেখতেও দেয় না।
মাথা ঝাঁকালো সানি। ও ঠিকই বলেছে। আর এদের টাকাও থাকে প্রচুর। নইলে একটা মুদ্রার জন্যে এতো টাকা কি করে খরচ করবে বলো।
তবে, মুসার কথার খেই ধরলো কিশোর, এটা আমেরিকা নয়। এখানে ওরকম সংগ্রহকারী দু-চারজনও আছে কিনা সন্দেহ। মুদ্রাটা বিক্রি করতে পারবে বলে মনে হয় না।
খুব কঠিন হবে।
আচ্ছা, মুদ্রা, স্ট্যাম্প ঢাকায় যারা সাপ্লাই দেয়, তাদের নিশ্চয় চেনেন আপনারা। নাম-ঠিকানা বলুন, ওদের ওপর চোখ রাখবো আমরা।
আমি? অস্বস্তি ফুটলো সানির চোখে। চুলে হাত চালাতে চালাতে মাথা নাড়লো। নাহ্, আমি চিনি না। ওসব চাচার ব্যাপার। খুব কমই নাক গলাই আমি।
তাহলে তাকেই জিজ্ঞেস করা দরকার।
চোখ মিটমিট করলো সানি। চাচাকে?…ঠিক আছে, করতে পারবে। আগে তোমাদেরকে কাজে নিয়োগ করুক… হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো সে। আরিব্বাবা…
তার দিকে একটা মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে রইলো কিশোর। তারপর ঘরে চোখ বোলালো। আপনার চাচার নিশ্চয় আরও মুদ্রা আছে। দেখা যাবে? এখানে তো। একটাও দেখছি না।
এখানে রাখে না। পড়ার ঘরে। আবার ঘড়ি দেখলো সে।
দেখা যাবে?
দেখবে? ঠিক আছে, এসো।
লিভিং রুম, তারপর আরেকটা বড় হলঘর পার করিয়ে ওদেরকে পেছনের একটা দরজার কাছে নিয়ে এলো সানি। চাবির গোছা থেকে একটা বেছে নিয়ে তালা। খুললো। ঘরটা ছোট। লাল রঙের পুরু কার্পেট বিছানো। মেহগনি কাঠের ভারি ভারি আসবাব। শেলফগুলো বইয়ে ঠাসা। একধারে সুন্দর করে সাজানো পায়। লাগানো অনেকগুলো সুদৃশ্য কাঁচের বাক্স। ভেতরে গাঢ় নীল মখমলের বিছানায় যেন ঘুমিয়ে রয়েছে নানারকম মুদ্র।
একটা বাক্স দেখিয়ে সানি বললো, ওটাতে আমেরিকান মুদ্রা। ডাবল ঈগল আরেকটা আছে ওতে, দেখো। যেটা চুরি গেছে সেটারই মতো। তবে এটার দাম। চুরি যাওয়াটার তুলনায় কিছুই না।
গা ঘেঁষাঘেষি করে মাথা নিচু করে এসে বাক্স ঘিরে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা। নীল মখমলে শুয়ে আছে সোনার মুদ্রাটা। চকচক করছে। একটা রূপার টাকার প্রায় সমান মুদ্রাটার এক পিঠে একটা উড়ন্ত ঈগল ছাপ মারা। ভোরের আকাশে ডানা মেলে দিয়েছে। সূর্য উঠছে সবে, ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যরশ্মি।
কতো পুরানো এটা? জিজ্ঞেস করলো রবিন। উনিশশো নয় সালের, সানি জানালো। তারিখটা অন্য পিঠে। একই রকম সুন্দর, অথচ দাম মাত্র আট হাজার আমেরিকান ডলার।
শিস দিয়ে উঠলো মুসা। মাত্র! আট হাজার ডলার মাত্র হলো!
মাত্র বলেছি যেটা চুরি গেছে তার তুলনায়। দেখতে যেমনই হোক, সেটা আসল কথা নয়, দাম কম-বেশি অন্য কারণে। যেটা যতো বেশি দুর্লভ সেটার দাম ততো বেশি।
চুরি যাওয়ার সময় কিসের মধ্যে ছিলো জিনিসটা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
কালো চামড়ার একটা গহনার বাক্সে। ওই যে সৌখিন বাক্স আছে না কিছু, মহিলারা আঙটি-টাঙটি রাখে, ওরকম। সিগারেটের প্যাকেটের সমান। ডালার একপাশে দুটো কজা লাগানো, আরেক পাশে হুড়কো। বোতাম টিপলেই লাফ দিয়ে উঠে যায় ডালা। ভেতরে এরকমই নীল কাপড়। চাকচিক্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে প্ল্যাস্টিকে মুড়ে রাখা হয়েছিলো।
সোনার চমৎকার মুদ্রাটার দিকে তাকিয়ে সানির কথা শুনছে তিন গোয়েন্দা। তারপর মুখ তুলে সারা ঘরে চোখ বোলালো কিশোর। নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করলো, এ ঘরে তো কোনো টিভি দেখছি না?
টেলিভিশন দুচোখে দেখতে পারে না চাচা, হেসে বললো সানি।
আঙিনায় তাহলে স্যাটেলাইট ডিশ বসানো হয়েছে কেন?
ডিশ? আবার চোখ মিটমিট করলো সে। টিভি একটা আছে। গেম রুমে। আমি আর ডলি দেখি। চাচা এখন শুয়ে আছে ওঘরে, নইলে ডিশটা দিয়ে কি কাজ হয় দেখাতাম।
ও, বলে কি বোঝালো কিশোর বোঝা গেল না। ঠিক আছে, পরে এসে এক সময় নাহয় দেখবো। তা আপনার চাচাকে জিজ্ঞেস করবেন কি, আমাদেরকে…
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হাতে বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আকবর আলি। কঠিন দৃষ্টিতে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, এখানে কি? লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এলেন তিনি। এরপর কোনটা চুরি করবে সেটা দেখতে এসেছো?
আপনার ভাতিজাই এঘরে নিয়ে এসেছে আমাদের, শান্ত কণ্ঠে বললো কিশোর। চুরি করে ঢুকিনি। ঈগলটা খুঁজতে গেলে আমাদের জানতে হবে দেখতে ওটা কি রকম। এখন…
আমার ঈগল খুঁজবে! ভুরু কুঁচকে গেল খান সাহেবের। ওটার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেবো ভেবেছো? বেরোও!
কিন্তু, স্যার, আপনার ভাতিজা… সানিকে দেখালো কিশোর, আমাদেরকে ফোন করে ডেকে এনেছে তদন্ত করার জন্যে! আপনিই নাকি আসতে বলেছেন।
সানি! লাল হয়ে গেছে আকবর আলির মুখ। ও ডেকে এনেছে! আমি আসতে বলেছি! সানি, তুই যে এতো মিথ্যে কথা বলিস জানতাম না তো! ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন খান সাহেব। আমি কিছু বলিনি! বেত তুলে আরেক পা এগোলেন তিনি। ভাতিজাকে বাড়িই মারবেন যেন।
তবে বেতটা যথাস্থানে আঘাত হানার আগেই ঢুকলো ডলি। একটানে বাবার হাত থেকে কেড়ে নিলো ওটা। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, আব্বা!
মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধ। বললেন, তোরা ভাইবোনে মিলে যে কি করছিস বুঝতে পারছি না। থাকগে, বোঝার দরকারও নেই আমার। এই ছেলেগুলোকে বের করে দে এখান থেকে।
বেতটা মেয়ের হাত থেকে আবার ফেরত নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে গেলেন আকবর আলি। বিরক্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো ভাইবোন।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিন গোয়েন্দাকে বললো সানি, সরি, কিছু মনে করো না। চাচার মন-মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেছে ইদানীং। খিটখিটে হয়ে গেছেন। কথায় কথায় রেগে যান।
হ্যাঁ, ভাইয়ের সঙ্গে সুর মেলালো ডলি, আব্বার কথায় কিছু মনে করো না। তোমাদের ডাকতে বলে নিজেই এখন ভুলে বসে আছে। এরপর আবার ডাকতে বললে লিখে দিতে বলবো।
মাথা ঝাঁকালো সানি। হ্যাঁ, তাই করবো। লিখে না দিলে আর ডাকছি না। তোমাদেরকে। গজগজ করে বললো, অযথা মানুষকে ডেকে এনে অপমান…
বাইরে বেরিয়ে খোয়া বিছানো পথ ধরে গেটের দিকে এগোলো তিন গোয়েন্দা।
আশ্চর্য! আনমনে বললো কিশোর। ডাকতে বলেছেন, সেটাও ভুলে। গেলেন? এতো তাড়াতাড়ি?
আমার কাছেও অবাক লাগছে ব্যাপারটা, রবিন মাথা দোলালো।
পাগল আরকি, সাফ মন্তব্য করে দিলো মুসা। এতো টাকা দিয়ে নইলে একটা সোনার টাকা কেনে?
গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে এখন আরেকটা গাড়ি, লাল ছোট একটা সুজুকি। চিন্তিত ভঙ্গিতে ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে কিশোর বললো, যাকগে, ওসব নিয়ে পরে ভাববো। এখন তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। সন্ধ্যার আগেই কচিদের বাড়ি গিয়ে ওদের পিকআপটা দেখতে চাই।
.
চারজনে মিলে পিকআপটা পরীক্ষা করলো ওরা। সীটের ওপরে, তলায়, সীটের সামনের মেঝেতে, পিকআপের ঘোট কেবিনের ভেতর যতো জায়গা আছে, সবখানে।
কাগজ আটকানোর ক্লিপ দিয়ে নিশ্চয় কাঁচ ভাঙা যায় না।
সীটের নিচ থেকে একটা ক্লিপ বের করে দেখালো মুসা।
না, শুকনো গলায় বললো কিশোর।
কিংবা কয়েকটা খালি দুধের টিন দিয়ে? পিকআপের পেছন থেকে টিনগুলো রে করলে রবিন।
আমি রেখেছি ওগুলো, হেসে বললো কচি। মাঝে মাঝে কাজে লাগে।
এটা কি? জুতোর তলায় চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া মটর দানার চেয়ে ছোট একটুকরো ধাতব জিনিস বের করে দেখালো মুসা।
হাতে নিয়ে দেখলো রবিন। চিনতে পারলো না।
কচিও পারলো না।
যাই হোক, মুসা বললো। বেশি ছোট। এটা দিয়ে ঢিল মেরে কাঁচের কিচ্ছ। করা যাবে না। তবে জিনিসটা চেনা চেনা লাগছে।
লাগবেই, বললো রবিন। সীসা। কোনো জিনিস ঝালাই-টালাই করতে গিয়ে পড়ে থাকতে পারে।
হাতের তালুতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো কিশোর। চিনলো না। ফিরিয়ে দিলো আবার মুসাকে। নিজের অজান্তেই জিনিসটা পকেটে ভরলো মুসা। আবার খোঁজাখুজি চললো। কাঁচ ভাঙা যেতে পারে, ওরকম কিছুই পাওয়া গেল না।
কচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে চললো তিন গোয়েন্দা।
বাগানে ছিলেন মামী। ওদেরকে দেখে এগিয়ে এলেন বাগানের কিনারে। এসেছিস। যা, হাতমুখ ধুয়ে নে গে। চা দিচ্ছি।…ও, হ্যাঁ, কিশোর, সানি নামে একজন ফোন করেছিলো। আসতে না আসতেই কতোজনের সঙ্গে পরিচয় করে ফেললি। ফোনও করে।
হাসলো কিশোর। কিছু বললো?
বললো তার চাচা নাকি মত পরিবর্তন করেছেন। যা ঘটে গেছে তার জন্যে অনুতপ্ত।
আবার যাবো! মুসা বললো। কিশোর, এবার পয়সা দিতে রাজি না হলে আর যাচ্ছি না আমি। যেমন লোক, তেমনি তার ব্যবস্থা। বিনে পয়সায় কাজটা করে। দিতে চেয়েছিলাম, ভাল্লাগেনি।
হ্যাঁ, ঠিক, তুড়ি বাজালো রবিন। অন্তত মোটা একটা পুরস্কার ঘোষণা না। করা পর্যন্ত ওঁর মোহর আর খুঁজতে যাচ্ছি না।
কিন্তু ওদের কথায় তেমন কান নেই কিশোরের। জিজ্ঞেস করলো, মামী, আজ বাইরে কাউকে অদ্ভুত আচরণ করতে দেখেছো?
অদ্ভুত আচরণ? অবাক হলেন মামী। না তো!
বেশ, অদ্ভুত আচরণ না হয় না-ই করলো, থামের মাথায় উঠেছিল কেউ? যে ধাতব থামটা থেকে টেলিফোনের তার এসে ঢুকেছে এই বাড়িতে সেটার দিকে হাত তুললো কিশোর।
না, মাথা নাড়লেন মামী। দাঁড়া দাঁড়া, দেখেছি। মেকানিক। ফোনের তার। চেক করতে আসে যে, ওদেরই একজন। লোকটা নতুন। চিনি না।
কখন সেটা? আগ্রহ দেখাল কিশোর।
এই তো, তোরা বেরোনোর একটু আগে। বাগানেই ছিলাম আমি তখন, দেখলি না? যা, হাত-মুখ ধো গিয়ে।
কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলো না মুসা। ওরা ওখান থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপারটা কি, কিশোর?
লোকটা কি ছদ্মবেশী? রবিনের প্রশ্ন। আসল মেকানিক নয়? এ বাড়ির ওপর চোখ রাখছিলো?
রাখতেও পারে, দায়সারা জবাব দিলো কিশোর। এ নিয়ে পরে চিন্তা-ভাবনা করবো। সোমবারের আগে অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপাতত হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে চলো চা খাইগে।
.
০৯.
পরদিন করিমদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেল তিন গোয়েন্দা। দাওয়াত রাতে, অথচ নেয়ার জন্যে দুপুরবেলাই এসে বসে রইলো ছেলেটা।
করিমের মায়ের আদর-যত্নে অভিভূত হয়ে গেল ওরা। সম্পন্ন গৃহস্থ করিমের বাবা, বাড়ি-ঘরের অবস্থা দেখেই সেটা আন্দাজ করা গেল।
বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই শুরু হলো খাবার আসা। খানিক পর পরই এটা নিয়ে আসেন করিমের মা, ওটা নিয়ে আসেন। নানা রকম পিঠা, খেজুরের রসে। তৈরি পায়েস, চিড়া-মুড়ির মোয়া। থালায় করে নিয়ে আসেন, আর বলেন, খাও, বাবারা, খাও। আমরা গরীব মানুষ। ভালা জিনিস ত আর খাওয়াইতে পারুম না। এগুলানই খাও।
বৈঠকখানায় ভিড়। প্রায় সবাই করিমের সমবয়েসী গায়ের ছেলে। বিদেশী বন্ধুদের দাওয়াত করে আনছে একথাটা প্রায় ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো। সে। ওদের আঞ্চলিক সব কথা বুঝতে পারে না মুসা, তা-ও ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে।
শীতের রাত। আটটা বাজতে না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে গাঁয়ের লোক, নিঝুম। হয়ে যায় পাড়া। কচিত কারও ঘরে কুপির কাঁপা আলো চোখে পড়ে। তিন গোয়েন্দাকে দেখতে আসা ছেলেরা চলে গেল আটটা বাজার আগেই। সঙ্গে করে নিয়ে আসা কিছু কিছু জিনিস ওদেরকে উপহার দিয়েছে গোয়েন্দারা। খুব খুশি হয়েছে ছেলেগুলো। ঢাকায় তিন গোয়েন্দা–
রসুই ঘরে ভাত বেড়ে দিয়ে খেতে ডাকলেন করিমের মা।
হ্যারিকেনের মিটমিটে আলো। মাটির মেঝেতে মাদুরের ওপর খেতে বসলো। তিন গোয়েন্দা। এ রকম ভাবে খায়নি আর কখনও। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওদের। আবছা অন্ধকার, খাবারও ঠিকমতো দেখা যায় না। ঘরের ভেতরে কেমন এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ। ওরা জানে না, শুকনো পাট, কাঁচা সরষে, আর অনেক পুরানো তেল চিটচিটে কাঁথা-বালিশের মিশ্র গন্ধ ওটা।
কড়া ঝাল দেয়া মুরগীর মাংস, লাল চালের ভাত, মসুরের ডাল, আর নানা রকম সজী। সেই সাথে প্রচুর কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ।
সাধারণ খাবার। কিন্তু খেতে খেতে মুসার মনে হলো খাবারের এই স্বাদ আগে কমই পেয়েছে। পরিবেশের জন্যেই বোধ হয় ভালো লাগছে এতোটা। মানুষগুলোর অকৃত্রিম ভালোবাসা আর আন্তরিকতাও যোগ হয়েছে এর সঙ্গে। রুটি খেতে অভ্যস্ত যে রবিন, তারও খারাপ লাগছে না খেতে। শুধু ঝালটা একটু বেশি লাগছে। খানিক পর পরই পানি গিলতে হচ্ছে। নাক-চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে ঝালের চোটে।
খাওয়া সেরে বাইরে দাওয়ায় এসে বসলো ছেলেরা। রাতে থাকবে। কাজেই কম্বল-টম্বল নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছে।
পরিষ্কার আকাশ। তবু কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। কুয়াশার জন্যে। অনেক গাছপালা এখানে। বাড়ির সামনে একটা পুকুর। তিন পাড়ে বাঁশঝাড়। ঘন কালো। দেখাচ্ছে এখন। পুকুরে শব্দ করে ঘাই মারছে কাতলা মাছ। বাঁশ বনে কর্কশ গলায় ডেকে উঠলো একটা পেঁচা। তার পর পরই শোনা গেল ঝাড়ের ওপাশের খেত। থেকে আসা শেয়ালের হুক্কা-হুয়া।
উঠানে নেমে নাড়ার আগুন জ্বাললো করিম। অগ্নিকুণ্ডের পাশে পিড়ি পেতে দিয়ে তিন গোয়েন্দাকে ডাকলো ওখানে গিয়ে বসতে।
গোল হয়ে বসলো সবাই।
বাঁশের ছোট টুকরিতে করে খেত থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে অনেক মটরশুটি। আগুনে সেগুলো পোড়াতে দিয়ে করিম বলল, বিকালে তুইল্লা আইন্না রাখছে আমার ভাই। পোড়াইয়া খাইতে খুব মজা লাগে।
মাথার ওপরে খোলা আকাশ। নিচে অন্ধকার নীরবতার মাঝে আগুনের পাশে গল্প চললো ওদের। কথায় কথায় করিম জানালো, চাঁদ উঠলে নাকি মুন্সী বাড়ির দীঘির পাড়ে শেয়ালের আসর বসে। শেয়ালদের রাজা থাকে, মন্ত্রী থাকে, বিচার আচার চলে অনেক রাত পর্যন্ত। জলসা হয়।
বিশ্বাস করলো না মুসা। মুচকি হাসলো।
রেগে গেল করিম। জেদ ধরে বললো, বিশ্বাস করলা না? দ্যাখতে চাও?
মাথা ঝাঁকালো মুসা।
ঠিক আছে। চান উঠুক। তারপর যামু।
অনেক রাতে বাঁশ বনের মাথা ছাড়িয়ে উঠে এলো হলদে চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো করিম। পুরানো চাদরটা ভালোমতো গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো, চল, সময় অইছে।
বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে গেছে পায়ে চলা পথ। সঙ্গে টর্চ এনেছে তিন গোয়েন্দা। করিমের সঙ্গে চলতে অসুবিধে হলো না। এ যেন এক রহস্যময় জগতে এসে পড়েছে ওরা। বাঁশ গাছের নিচে ঘন অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে রয়েছে। জ্যোৎস্না ঢুকতে পারে না।
এমন কি টর্চের আলোয়ও কাটতে চায় না সে অন্ধকার। সামান্য বাতাস। লাগলেই সড়সড় করে বাঁশের পাতা, গাছের ফাঁক দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে যায়। বাতাস, যেন অশরীরী কোনো প্রেতাত্মার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। ধক করে ওঠে বুকের ভেতরটা। ছমছম করতে থাকে গা।
বাঁশবন থেকে বেরোতেই দেখা গেল ধবধবে সাদা মাঠ। ফসল কাটা শেষ। একটা ঘাস নেই কোথাও। সমস্ত খেত জুড়ে পড়ে রয়েছে মাটির ঢেলা। ঘোলাটে চাঁদের আলোয় দূর থেকে দেখলে মনে হয় দিগন্তজোড়া বিশাল এক সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে যেন কেউ। খেতের ওপর দিয়েই কোণাকুণি চলে গেছে পায়েচলা। পথ। সেই পথে নামলো ওরা। কয়েক পা এগোতে এগোতেই জুতোর ওপর মিহি ধুলোর আস্তরণ পড়লো।
বেশ কয়েকটা খেতের পর মুন্সী বাত্রি সীমানা। অনেক বড় এলাকা নিয়ে বাড়ি। বিরাট দীঘির পাড়ে ঘন বাঁশবন। উঁচু হয়ে আছে দীঘির পাড়। কাছে আসতে দেখা গেল কালো কালো অনেক গর্ত।
এই গুলান শিয়ালের গর্ত, জানালো করিম। আমরা বসমু গিয়া দীঘির ঘাটলায়। চুপচাপ।
শান বাঁধানো ঘাট। সিঁড়ির ওপরে বেশ চওড়া একটা প্ল্যাটফর্ম মতে, তাতে বেশ সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে ইট-সিমেন্টের চেয়ার। পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা। সিঁড়ি যতদিন থাকবে এগুলোও থাকবে, নষ্ট হবে না।
সেই চেয়ারে এসে বসলো ওরা।
এইবার খালি বইয়া থাকো চুপ কইরা, করিম বললো।
কখন আসবে? মুসা জিজ্ঞেস করলা।
আইবো, সময় অইলেই।
সময় যায়। চুপ করে বসে আছে ওরা। ফিসফাস পর্যন্ত করছে না। কানের কাছে মশা পিনপিন করছে। চাপড় মারতে গিয়েও মারছে না। যদি আওয়াজ শুনে শেয়ালেরা আসা বন্ধ করে দেয়।
রাত বাড়ছে। মাথার ওপরে উঠে এসেছে চাঁদ। মস্ত বড়। ঘোলাটে ভাব দূর হয়ে গেছে অনেকখানি, হলদেটে রঙ কেটে গিয়ে সাদা হয়ে উঠেছে। পুকুরের পানির ওপর ধোয়ার মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে উড়ছে কুয়াশা।
দূর, আসবে না, আর ধৈর্য রাখতে পারছে না মুসা।
আইবো, আইবো। দ্যাখো না খালি।
রবিন চুপ হয়ে আছে। কিশোরও। করিমের কথা বিশ্বাস করেছে। এতো জোর দিয়ে যখন বলছে, নিশ্চয় আসবে।
আরও কয়েক মিনিট কাটলো। হঠাৎ মুসার বাহু খামচে ধরলো করিম। হাত তুলে দেখালো ঢেলা-খেতের দিকে।
প্রথমে কিছু চোখে পড়লো না। তারপর তিনজনেই দেখলো, দীঘির পাড়ের দিক থেকে খেতের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে একটা জানোয়ার। কুকুরের মতো দেখতে। বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে হেলেদুলে ধীরেসুস্থে চলেছে। গিয়ে বসলো ওটা খেতের একটা আলের ওপর।
পাড়ের কাছ থেকে আরেকটা শেয়াল বেরোলো। বসলো গিয়ে প্রথমটার সামনে, মুখোমুখি, যেন আলাপ করতে বসেছে। তারপর যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হতে লাগলো একের পর এক শেয়াল। কোনোটা একা, কোনোটা জোড়া বেঁধে, আবার কেউ কেউ বাচ্চা-কাচ্চা, পরিবার-পরিজন নিয়ে। দল বেঁধে এগোলো সবাই প্রথম। শেয়াল দুটোর দিকে।
আলে বসা প্রথম শেয়ালটার সামনে গোল হয়ে বসলো ওগুলো। যেন বিচারে বসেছে গাঁয়ের মোড়ল। তার সামনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে জড়ো হয়েছে গ্রামবাসী।
দীঘির পাড়ের গর্তে বোধহয় আর একটা শেয়ালও রইলো না। সব গিয়ে। সামিল হয়েছে সভায়। চাঁদের দিকে মুখ তুলে লম্বা হাঁক ছাড়ল প্রথম শেয়ালটা। ওটাই নেতা, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওটার ডাক মিলাতে না মিলাতেই হা-উ উ-উ-উ-উ করে ডেকে উঠলো আরেকটা। সুর মেলালো আরেকটা। তারপর আরও একটা। সমস্বরে চেঁচাতে শুরু করলো সবগুলো। মহা আনন্দে কেউ কেউ করে লাফালাফি শুরু করলো বাচ্চাগুলো।
সে এক বিচিত্র জারি গান। কেউ বলছে হাউ, কেউ বলছে হোউ, কেউ কা-হুঁয়া, কেউ বা আবার হুক্কা-হুঁয়া। দু-একটা আবার তার জের টানছে হুয়া হুয়া হুয়া হুয়া। বলে। থ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। বাস্তবে এ রকম কিছু ঘটতে পারে, তা-ও আবার নিজের চোখে দেখবে, কোনো দিন কল্পনাই করেনি ওরা।
আড়চোখে করিমের দিকে তাকালো মুসা।
মিটিমিটি হাসছে করিম।
শেয়ালের জারি গান একবিন্দু পছন্দ করতে পারেনি গায়ের কুকুরের দল। পাগল হয়ে গেল যেন ওগুলো। চারদিক থেকে ভেসে আসছে এখন ওগুলোর হাঁকডাক।
পাত্তাই দিলো না শেয়ালের দল। আরও কয়েকবার ডেকে খেলা জুড়ে দিলো। তবে সবাই নয়, ছোটগুলো। বড়রা স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো ওদের খেলা। সেই সঙ্গে চললো গুরু-গম্ভীর আলোচনা।
থেকে থেকে জারি গান শুরু করে শেয়ালেরা। শোনামাত্র খেপে উঠে। কুকুরগুলো। যেন ওগুলোকে খেপানোর জন্যেই এমন করে ওরা।
সভা ভাঙলো এক সময়।
আবার দীঘির পাড়ের গর্তের দিকে ফিরে চললো শেয়ালের দল।
খাইছে! বিড়বিড় করে শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করতে পারলো বিস্মিত মুসা।
আশ্চর্য! জোরে বললো না রবিন, যেন আমেজ কেটে যাওয়ার ভয়ে। কয়োট আর নেকড়ে এ রকম সভা করে শুনেছি। শেয়ালেরাও যে করে জানতাম না।
না করার কোনো কারণ নেই, কিশোর বললো। হাজার হলেও জাতভাই। শেয়ালের এ রকম জলসা বসানোর কথা চাচার কাছেও শুনেছি। চাঁদনী রাতে নাকি সুন্দর বনের হরিণেরাও জলসা বসায়, নাচে। বনের মধ্যে মধু জোগাড় করতে যায় যে সব মৌয়াল, তারা এসে এসব কিচ্ছা বলে।
বানিয়ে বলে? মুসার প্রশ্ন।
আগে সে রকমই মনে হয়েছে। কিন্তু এখন আর বলব না সে কথা। চোখের সামনেই যে কাণ্ডটা ঘটতে দেখলাম!
বড় করে হাই তুললো করিম। বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকালো মুসার দিকে। রাইত অনেক অইছে। লও, বাড়িত যাই।
.
১০.
আরেক সোমবার এলো অবশেষে। মাঝখানে কয়েকটা দিন। তবে মোটেও। একঘেয়ে লাগেনি তিন গোয়েন্দার। ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেছে যেন। অনেক দেখেছে ওরা, অনেক ঘুরেছে। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে দাওয়াত খেয়ে এসেছে। হই হট্টগোল আর আনন্দ করেছে। ইতিমধ্যে একদিন মামার সঙ্গে গিয়ে পাখি শিকার করে এসেছে। তবে সব কিছুর মাঝেও বারে বারে ঘুরে ফিরে মনে এসেছে। প্রশ্নগুলোকে কাঁচ ভাঙে? কি করে ভাঙে? কেন ভাঙে? ঈগলের সঙ্গে গাড়ির কাঁচ ভাঙার কি সম্পর্ক? কে চুরি করলো মুদ্রাটা?
সোমবার দুপুর বেলায়ই আরিফ সাহেবের বাড়িতে চলে এলো কচি। কিশোর বললো তাকে, আজই আরেকবার ভূত-থেকে-ভূতে চালান দিতে চাই।
আবার?
হ্যাঁ। কেন, ভুলে গেলে, আরেকবার চালান দেয়ার কথা ছিলো না? ভিনগ্রহের মানুষের খোঁজ চেয়ে?
এবার রবিন আর মুসাও অবাক। সমস্বরে বলে উঠলো, ভিনগ্রহের মানুষ!
তোমরাই তো বললে। টেন-স্পীড যে চালায় তাকে ভিনগ্রহের মানুষের মতো লাগে।
অনেক জায়গায় ফোন করলো কচি, তার বন্ধুদের। বলে দিলো কি করতে হবে। হুঁশিয়ার করে দিলো, যাতে লুকিয়ে থেকে নজর রাখে। সাইকেলওয়ালা যেন টের না পায়। জানিয়ে দিলো, কেউ খবর পেলে যেন ওদের বাড়িতে টেলিফোনে। রচিকে জানায়। বাড়িতে ফোন করে তার ছোট ভাই রচিকে বুঝিয়ে বললো, ভূতদের ফোন যদি আসে, যা যা বলে নোটবুকে লিখে রাখতে। আরিফ সাহেবের ফোন নম্বর দিয়ে বললো নয়টা পর্যন্ত ওই বাড়িতেই থাকবে। ইতিমধ্যে যদি ফোন। আসে, সঙ্গে সঙ্গে সে যেন জানায়।
সকাল সকাল রাতের খাবার খেয়ে নিলো সেদিন ওরা। তারপর বসার ঘরে এসে বসলো। ফোন আসার অপেক্ষা করছে। আটটা বাজলো। এলো না। গেল আরও পনেরো মিনিট সাড়ে আটটায় বেজে উঠলো ফোন। ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিলো কচি। তার ভাইই ফোন করেছে। উত্তেজিত হয়ে বললো, সর্বনাশ। হয়েছে! একগাদা গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে!
দাঁড়া দাঁড়া, কাগজ-কলম বের করি! কচি বললো। আস্তে আস্তে বল!
নোটবুকে লিখে রাখা তথ্য পড়লো ওপাশ থেকে রচি, ক্যাপ, চশমা, হেডফোন আর ব্যাকপ্যাক পরা একটা লোক সাইকেল চালিয়ে গেছে ধানমণ্ডির দশ নম্বর রাস্তা দিয়ে। এইমাত্র একটা গাড়ির কাঁচ ভাঙলো। সাইকেল চালককে কিছু করতে দেখা যায়নি।
মুখ বাঁকালো মুসা। তারমানে ও কিছু করেনি।
তাই তো মনে হয়, ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। কিন্তু সে ছিলো ওখানে।
আট নম্বর রাস্তায় দেখা গেছে সাইকেল আরোহীকে, রচি বললো। কালো একটা টয়োটা প্রিন্টারের কাঁচ ভাঙা হয়েছে। লোকটা গাড়ির কাছে থামেনি।
থামেনি! কচির মুখে শুনে প্রায় চিৎকার করে উঠলো মুসা।
কিন্তু ও যাওয়ার সময়ই তো ভেঙেছে কাঁচ! রবিন বললো। সে না হলে আর কে?
ছয় নম্বর রাস্তায় আর একটা টয়োটার কাঁচ ভেঙেছে। সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে, ভাইয়ের কাছে শুনে বললো কচি। শার্টের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করছিলো।
কী? আবার চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
দাঁড়াও দাঁড়াও, শুনি, হাত তুললো কচি। হ্যাঁ, রচি, বল।
জানা গেল, বারো নম্বর রাস্তায় গগলস পরা টেন-স্পীড সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে। ওই রাস্তায় কোনো গাড়ির কাঁচ ভাঙেনি। চোদ্দ নম্বর রাস্তায়ও সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে। একটা টয়োটা পাবলিকার কাঁচ ভাঙা হয়েছে। শার্টের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করেছিলো সে।
কিন্তু কি রে করছিলো? প্রশ্ন করলো রবিন। গাড়ির কাঁচ ভাঙা যায় এমন কিছু?
ভাঙতে হলে হয় ভারি কিছু দিয়ে পিটাতে হবে, নয়তো ছুঁড়ে মারতে হবে, যুক্তি দেখালো মুসা। আর সে রকম কিছু করে থাকলে চোখে পড়তে বাধ্য। পড়লো না কেন?
রচি জানালো, ষোল নম্বর রাস্তায় দেখা গেছে সাইকেল আরোহীকে। একটা টয়োটা স্টারটেলের কাঁচ ভাঙা হয়েছে। মনে হলো গাড়ির দিকে কোনো কিছু নিশানা করছিল লোকটা। কিন্তু এতো দ্রুত সরে চলে গেল, যে ছেলেটা চোখ রেখেছিলো সে ঠিকমতো দেখতেই পারেনি। রাস্তার কয়েকটা পোস্টে আলোও ছিল না।
নিশানা করেছে, না? বিড় বিড় করে বললো মুসা। পকেট হাতড়াচ্ছে। হ্যাঁ, আছে এখনও। যত্ন করেই রেখেছিলো। দু-আঙুলে ধরে বের করে আনলো। জিনিসটা। চোখের সামনে এনে ভালোমতো দেখলো। চিৎকার করে উঠলো হঠাৎ। বুঝেছি! কিশোর, এয়ার গানের গুলি! গুলি করে গাড়ির কাঁচ ভাঙে! শক্তিশালী কোনো এয়ারগান!
রচির কথা শুনছে আর নোটবুকে লিখে চলছে কচি, আঠারো নম্বর রোডে দেখা। গেছে সাইকেল চালককে। সবুজ রঙের একটা টয়োটার কাঁচ ভেঙেছে। সাইকেল। আরোহীকে কিছু করতে দেখা যায়নি।
এটাই শেষ তথ্য। ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলো কচি।
মুসার কথাটা ভেবে দেখলো কিশোর। বললো, তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছে, সেকেণ্ড। শার্টের নিচে গানটা লুকিয়ে রাখে সে। এয়ার-পিস্তল। গাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় একটানে বের করে গুলি করেই আবার লুকিয়ে ফেলে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার। শব্দ হয় না তেমন। আর যা-ও বা হয় কাঁচ ভাঙার আওয়াজ সেটাকে ঢেকে দেয়, আলাদা করে বোঝা যায় না। অন্ধকারে দেখাও যায় না কিছু। কাঁচে লেগে চ্যাপ্টা হয়ে যায় গুলিটা। যদি জানা না থাকে কি খুঁজছে, তাহলে দেখলেও ওটা চোখে পড়বে না কারো।
এইবার পুলিশকে জানানো যায়! কচি বললো। আমার বাপ জানও এবার বিশ্বাস না করে পারবে না।
না, এখনও সময় হয়নি, কিশোর বললো। আগে হাতেনাতে ধরি ব্যাটাকে, তারপর।
কেন, এখন বললে… বাধা পেয়ে থেমে গেল মুসা। আবার বেজে উঠেছে টেলিফোন।
রিসিভার কানে লাগিয়েই চেঁচিয়ে উঠলো কচি, ধরে ফেলেছে! এই, আরেকবার বল রচি, কোন রাস্তায়!…সাতাশ নম্বর? ঠিক আছে তো? তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে বললো সে, সাইকেলওয়ালাকে ধরে ফেলেছে পুলিশ! যাবে নাকি?
নিশ্চয় যাবো! বলে উঠলো রবিন।
মামা তো ঘরে নেই, কিশোর বললো উত্তেজিত কণ্ঠে। যাবো কিভাবে? এতো দূর যেতে…
গাড়ি নিয়ে যাবো, কচি বললো।
কার গাড়ি?
তোমার মামারটাই। ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে আমার মামীকে রাজি করাও।
প্রথমে রাজি হতে চাইলেন না মামী। পরে কিশোর যখন জোর দিয়ে বললো, বিশ মাইলের বেশি গাড়ির স্পীড ওঠাতে দেবে না কচিকে, তখন রাজি হলেন।
এ সময়ে রাস্তায় গাড়ির ভিড় তেমন নেই। খোলা হাইওয়ে। ইচ্ছে করলে উড়ে। যাওয়া যায়, কিন্তু কিশোরের চাপে ইচ্ছেটা দমন করতে বাধ্য হলো কচি। তবে বিশ মাইল গতিবেগে কিছুতেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারছে না সে। তিরিশ-পঁয়তিরিশে উঠে যাচ্ছে।
সাতাশ নম্বর রোডের মোড়ে এসে দেখলো পুলিশ নেই। সারা রাস্তায় কোথাও পুলিশ দেখা গেল না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো কচি, একটু আগে এখানে কাউকে কোনো কারণে ধরেছিলো কিনা। কোনো বাড়ির দারোয়ান, কোনো দোকানদার, কিংবা কোনো পথচারীকেউই বলতে পারলো না ওরকম কিছু ঘটেছে এখানে। সবাই একবাক্যে বললো, সন্ধ্যার পর থেকে পুলিশই দেখেনি এই রাস্তায়। এমনকি টহলদার পুলিশও না।
আশ্চর্য! রবিন বললো।
ব্যাপারটা কি? মুসার প্রশ্ন। ঠকানো হয়েছে আমাদেরকে! গম্ভীর হয়ে বললো কচি। চালাকি! শেষ ফোনটা রচি করেনি। করেছে অন্য কেউ। আমাদেরকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে। ইস, তখন বুঝলাম না! গলাটা অন্যরকম লাগছিলো সে জন্যেই!