ঢাকায় তিন গোয়েন্দা – ভলিউম–১৩ – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ ৪ জুলাই, ১৯৯১
০১.
বেশ রহস্যজনক তো! শোনা গেল আরিফ সাহেবের কণ্ঠ।
বাগানে বসে মামার কথাটা কানে গেল কিশোর পাশার। বাংলাদেশী শীতের আমেজ উপভোগ করছে সে। টকটকে লাল গোলাপের ওপর উড়ছে একটা মৌমাছি। তাকিয়ে ছিল সেদিকে, খাড়া হয়ে গেল কান। ঘরের ভেতর থেকে কথা আসছে।– আমার তা মনে হয় না, বললো আরেকটা কণ্ঠ। সব ওর শয়তানী।
হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে কিশোরের। বাংলাদেশে এসেই একটা রহস্য পেয়ে যাচ্ছে না। তো?
একবার দুবার হলে না হয় ধরে নিতাম অ্যাকসিডেন্ট, বলে যাচ্ছে কণ্ঠটা। কিন্তু চার-চারবার একই ঘটনা। বলছে মাল দেয়ার জন্যে কাস্টোমারের বাড়ি ঢুকেছে, বেরিয়ে এসে দেখে উইশীল্ড ভাঙা।
হ্যাঁ, তাই দেখেছি, বললো আরেকটা তরুণ কণ্ঠ। মিথ্যে কথা বলিনি।
মিথ্যে বলছিস, সেটা তো বলছি না আমি, বললো লোকটা। আমি বলতে চাইছি, দোষটা তোর। কারও সাথে ঝগড়া করেছিস, এখন সে শোধ তুলছে…
বিশ্বাস করো, আব্বা, ওরকম কিছুই করিনি আমি!
ঠিক আছে, শান্তকণ্ঠে বললো লোকটা, করিসনি যে প্রমাণ কর। নইলে আমার যা বলার, বলে দিয়েছি। গাড়ি চালানো তোর বন্ধ। সত্যি সত্যি কি হয়েছে, জেনে এসে বলবি, যদি দেখি তোর দোষ নেই, তাহলেই চাবি পাবি।
মাল দিতে অসুবিধে হবে না? সকাল সাতটার মধ্যেই তো মাখন না পেলে রেগে যায় লোকে, ডিম আর দুরে কথা নাহয় বাদই দিলাম…রাতে একবার, সকালে একবার; কবার যাবে তুমি মাল ডেলিভারি দিতে?
সেটা তোর ভাবনা নয়। ঠিক সময়েই মাল পাবে কাস্টোমার। তোর এখন কাজ পিকআপে মাল বোঝাই করা আর কাস্টোমারের ঘরে রেখে আসা, ব্যস। দুই বেলা গাড়ি আমিই চালাতে পারবো।
এনায়েত, আবার শোনা গেল আরিফ সাহেবের কণ্ঠ, আমার এখনও মনে হচ্ছে, রহস্য একটা আছে এর মধ্যে।
তা তো আছেই, স্যার, হেসে বললো ছেলেটার বাবা। আর সেটা কি আমি খুব ভালোই জানি। কারও সঙ্গে নিশ্চয় গোলমাল বাধিয়েছে কচি, সে এখন শোধ তুলছে।…আজ উঠি, স্যার।
বসো, টাকা নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ, দুধ-ডিম-মাখন, তিনটেই ডবল করে দিয়ে যেও কদিন। আমার ভাগ্নে এসেছে তার বন্ধুদের নিয়ে, আমেরিকা থেকে। দেখি, বিলটা দেখি, কতো হলো?
খানিক পরে সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষকে। গায়ের রঙ কালো। ভোতা নাক। খাটো করে ছাঁটা চুল। দেখেই কিশোরের মনে হলো, এই লোকটাও একসময় পুলিশে চাকরি করেছে। বাগানের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরানো একটা টয়োটা পিকআপের দিকে এগিয়ে গেল। গাড়িটার গায়ে সাদা রঙে বড় বড় করে লেখা রয়েছে
এনায়েত উল্লাহ ডেয়ারি ফার্ম।
আমরা সুলভ মূল্যে ডিম, মাখন, দুধ
সরবরাহ করিয়া থাকি।
এনায়েত উল্লাহর পেছনে বেরোলো সতেরো-আঠারো বছরের একটা ছেলে। বাবার মতো কালো না হলেও ফর্সা নয়। গায়ে-গতরে প্রায় মুসার সমান, ভালো স্বাস্থ্য।
গাড়িতে গিয়ে উঠলো লোকটা। ড্রাইভিং সীট থেকে মুখ বের করে বললো, কি হলো, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওঠ।
গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে রইলো ছেলে। রাগ করে বললো, না, আমি বাসেই যেতে পারবো।
তোর খুশি। তবে যতো যা-ই করিস, চাবি আমি দিচ্ছি না তোকে। আর। একটিবারও ছেলেকে উঠতে সাধলো না এনায়েত উল্লাহ। স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
কিশোরের ওপর চোখ পড়ল ছেলেটার। হাত নেড়ে তাকে ডাকলো কিশোর। এগিয়ে এলো কচি। কি?
আপনার নাম কচি, না?
অবাক হলো ছেলেটা। কি করে জানলে?
ঘরে আপনার কথা বলছিলেন, সব শুনেছি। হাত বাড়িয়ে দিলো কিশোর, আমি কিশোর পশি।
ও, তুমিই চৌধুরী আংকেলের ভাগ্নে। খুব আগ্রহ নিয়ে হাত মেলালো কচি। আর কে কে এসেছে তোমার সঙ্গে?
রবিন আর মুসা। আমার বন্ধু।
এদিক ওদিক তাকালো কচি। নাম তিনটে তাকে অবাক করেছে বোঝা গেল। কোথায় ওরা?
মামার স্টাডিতে পড়ছে রবিন। মুসা হাতুড়ি-বাটাল নিয়ে খুটুর-খাটুর করছে। ঘুঘুপাখি ধরার ফাঁদ বানাচ্ছে। মামী বলেছেন, মধুপুরের গড়ে নিয়ে যাবেন। ফাঁদ পেতে সেখানে ঘুঘু ধরবে সে। হাহ্ হাহ!…তা দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
আমাকে আপনি আপনি করছো কেন? কতো আর বড় হবো তোমার চেয়ে? তুমি করেই বলো। কচি ভাই-টাইয়েরও দরকার নেই। শুধু কচি। একটা চেয়ারে বসলো সে। কবে এসেছো?
এই তো, পরশু রাতে।
ও। তা থাকবে তো কিছুদিন?
থাকবো। এসেছি যখন দেখেই যাবো বাংলাদেশটা। একটা আঙুল মটকালো। কিশোর। আচ্ছা, তোমার আব্বা রাগারাগি করলেন শুনলাম। কি হয়েছে? …বেশি কৌতূহল দেখাচ্ছি না তো?
না না! বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কচি। আর বলো না ভাই। বয়েসে হয় না, বাড়িয়ে দেখিয়ে কত কষ্টে লাইসেন্সটা বাগালাম, অথচ চালাতেই পারলাম না। দুদিন চালাতে না চালাতেই বন্ধ। সহ্য হয়?
হু, বুঝতে পারছি তোমার দুঃখ, সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা দোলালো। কিশোর। কিন্তু ব্যাপারটা কি, বলতে আপত্তি আছে?
চুপ করে রইলো কচি।
বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছি মনে হচ্ছে তো? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি, তাহলেই বুঝতে পারবে। পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিলো কিশোর।
পড়ে প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেল কচি। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হলো মুখ। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে কিশোরের একটা হাত খপ করে চেপে ধরে বললো, তোমরা! সত্যি তোমরা এসেছ বাংলাদেশে! উফ, কি যে ভালো লাগছে! নাম শুনেই সন্দেহ হয়েছিলো! ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে আমার, এক্কেবারে সময়মতো পেয়ে গেছি তোমাদের! ইস, বিশ্বাসই করতে পারছি না।
ওই যে, রবিন আর মুসা আসছে, দরজার দিকে হাত তুললো কিশোর।
ওদের কাছে আরেক দফা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো কচি। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে যাচ্ছিল ওদের সঙ্গে। হেসে জানিয়ে দিলো কিশোর, ওরা দুজনে বাংলা বোঝে। বলতেও পারে মোটামুটি।
আলাপ পরিচয়ের পালা শেষ হলো।
অদ্ভুত কাণ্ড, বুঝলে,কচি বললো। গভীর রহস্য!
বলেই ফেললো না, হেসে বললো কিশোর। কখন থেকেই তো জানতে চাইছি।
কতোখানি শুনেছো?
ঘরে বসে তোমরা বাপ-বেটায় যতোখানি ঝগড়া করেছে।
আমাদের গাড়ির কাঁচ, বুঝলে, পিকআপটার উইশীল্ড, কচি জানালো, কি করে জানি ভেঙে যায়। একবার না দুবার না, চার চারবরি ভাঙলো। কাস্টোমারের বাড়িতে মাল দিতে ঢুকি, বেরিয়ে এসে দেখি ভেঙে রয়েছে।
কি করে ভাঙে কিছুই আন্দাজ করতে পারো না?
নাহ, এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লো কচি। শেষবার অবশ্য কাঁচ ভাঙার শব্দ কানে এসেছিলো। ছুটে বেরোলাম। কিন্তু গাড়ির কাছে কাউকে দেখতে পেলাম না। এক এক করে তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকালো সে। খুব অবাক। লেগেছে আমার। মনে হলো যেন আপনাআপনি ভেঙে গেল কাঁচটা।
হয় এরকম, আনমনে বললো কিশোর। একে বলে কাঁচের ফ্যাটিগ। আপনাআপনি চুরমার হয়ে যায় কাঁচ। তবে সেটা একআধবার হতে পারে। একই গাড়ির বেলায় চারবার? উঁহু, সেটা সত্ব না।
আমিও তাই বলি, চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা শব্দ করে ছাড়লে কচি। আপনাআপনি ভাঙেনি ওই কাঁচ।
মনে হয় রহস্য একটা পেয়েই গেলাম, বিড়বিড় করলো গোয়েন্দাপ্রধান।
রবিন আর মুসা চুপ করে শুনছে। কিছু বলছে না।
গোড়া থেকে সব খুলে বলো তো, কিশোর বললো। কখন, কোথায় ঘটেছে এই ঘটনা?
নাক চুলকালো কচি। তারপর শুরু করলো, গুলশানের সাত নম্বর রোডের একটা বাড়ির সামনে। রাতের বেলা। পথের পাশে সব সময় যেখানে গাড়ি রাখে। আব্বা, সেখানেই রেখেছিলাম। ডিম আর দুধ সাধারণত রাতে দিয়ে আসি আমরা, মাখন সকাল বেলা। অনেককে দুধও সকালেই দিই। যা-ই হোক, গত দুমাসে রাতের বেলা, সাত নম্বর রোডে কাঁচ ভেঙেছে মোট চারবার।
অন্য একটা প্রশ্ন করি। তুমি আর তোমার আব্বাই কি মাল সাপ্লাই দাও? কোন কর্মচারী-টর্মচারী নেই?
কারখানায় আছে। আমাদের ফার্মটা খুব ছোট। বেশি লোক রাখতে পারি না। ভীষণ খাটতে হয় আব্বাকে। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি আর আমার ছোট ভাই যতোটা পারি সাহায্য করি।
হু, বলে চুপ করে কি ভাবতে লাগল কিশোর।
মুসার দিকে তাকালো কচি। আচ্ছা, তোমার না একটা কুকুর আছে, সিমবা? শুনলাম, ওকেও নিয়ে আসবে। কই?
আনিনি। হঠাৎ শরীর খারাপ হয়ে গেল। হাসপাতালে।
ওটাকে এখানে এনেও কোন লাভ হতো না, কিশোর বললো। বুনো কুকুরের রক্ত শরীরে, কিছুতেই হিংস্রতা ভুলতে পারে না। কখন কার ওপর লাফিয়ে পড়ে টুটি ছিঁড়ে দেবে শহরের রাস্তায় ওটাকে নিয়ে বেরোনোই মুশকিল। ওর জায়গা আফ্রিকা, কিংবা অন্য কোন জঙ্গল-টল…
তারমানে জঙ্গল ছাড়া ওকে সঙ্গে রাখে না? হেসে জিজ্ঞেস করলো কচি।
না রাখাই উচিত। মুসাদের বাসার কাছেই বের করেছিলো একদিন। দিলো এক ছোকরাকে কামড়ে। অনেক কষ্টে পুলিশের ঝামেলা এড়ানো গেছে। এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার আগের কথা তুললো কিশোর, শেষ বার কবে ভাঙলো তোমাদের গাড়ির কাঁচ?
গত বুদ্বার রাতে। আর কপালটা কি দেখো, চার দিন ভাঙলো, চার দিনই আমি বেরিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে। ফলে আব্বাকেও কিছু বোঝাতে পারছি না।
চিন্তিত ভঙ্গিতে কচির দিকে তাকালো কিশোর। ওভাবে আর কোন গাড়ির উইণ্ডশীল্ড ভেঙেছে, জানো?
কি জানি!
কিছু ভাবছে কিশোর, বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো রবিন, কেন?
যদি খালি কচিদেরটাই ভাঙে, জবাব দিলো কিশোর, তাহলে বুঝবো ফ্রেমে দোষ আছে, কিংবা শত্রুতা করে কেউ ভাঙছে। কিন্তু আরও গাড়ির যদি ভেঙে থাকে, তাহলে নিশ্চয় অন্য কারণ।
তা ঠিক, ঘাড় দোলালো মুসা।
এই দাঁড়াও, দাঁড়াও! হাত তুললো কচি। মনে পড়েছে! গুলশানে আমার এক বন্ধু আছে। আমাদেরটা ভাঙার কিছুদিন আগে ওদের গাড়ির কাঁচ ভাঙার কথা কি যেন বলেছিলো। তখন খেয়াল করিনি। এখন মনে পড়ছে। কি করে ভেঙেছিলো, বুঝতে পারছিলো না সে-ও।
হু, মাথা দোলালো কিশোর, তাহলে তো মনে হচ্ছে…
থেমে গেল সে। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তার মামী। মহিলার বয়েস বোঝা যায় না। অনেক কম মনে হয়। খুব সুন্দরী। এক ছেলে আর এক মেয়ে, দুজনেই থাকে আমেরিকায়।
হাত নেড়ে হেসে বললেন তিনি, এই, আর কতো গল্প করবি? সেই কোন। সকালে নাস্তা করেছিস। খিদে পায়নি?
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুসা। একান ওকান হয়ে গেল হাসি। পায়নি মানে, কি যে বলো তুমি, আন্টি। পেটের মধ্যে কখন থেকেই তো ছুঁচো নাচছে, শুধু ভাঙা কাঁচই এতোক্ষণ আটকে রেখেছিলো। নানারকম বাংলাদেশী খাবার খাইয়ে দুদিনেই মুসাকে একেবারে ভক্ত বানিয়ে ছেড়েছেন মামী। ইতিমধ্যেই বহুবার বলে ফেলেছে তাঁকে মুসা, দুনিয়ায় শুধু দুজন মানুষ ঠিকমতো রাঁধতে জানে। একজন তুমি, আরেকজন আমাদের মেরিচাচী।
আবার হাসলেন মহিলা। আয়, খেতে আয়। কচি, তুমি যাওনি তোমার আব্বার সঙ্গে?
না, রাগ করে বললো কচি। ওই গাড়িতে আর উঠবো না। বাসে যাবো বলে রয়ে গিয়েছিলাম, ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল
ভালো হয়েছে। এসো, তুমিও এসো খেতে।
এই পরিবারের সঙ্গে মোটামুটি ভালোই খাতির জমিয়ে ফেলেছে কচি। মহিলার ছেলেমেয়ে এখানে কেউ নেই। এতো বড় বাড়িতে একা একা থাকেন শুধু স্বামীকে নিয়ে। ছেলেমেয়ের বয়েসী কাউকে পেলেই দ্রুত আপন করে নেন।
বিনা প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ালো কচি। জানে খাবো না বলে লাভ হবে না, তাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না নাদিরা খালাম্মা।
মামী যেমন দিলখোলা, হাসিখুশি, মামা তেমনি গম্ভীর। চাকরি করতেন পুলিশে, বড় অফিসার ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। সময় কাটানোর জন্যে সারাক্ষণই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকেন। প্রচুর বই পড়েন, বিশেষ করে গোয়েন্দা গল্প। কিশোরকে তার খুব পছন্দ। সুযোগ পেলেই বলে দেন, দেখ ইয়াং ম্যান, চাকরিই যদি করো, তাহলে পুলিশের। এর বাড়া চাকরি নেই। আর যেহেতু তুমি গোয়েন্দা, রহস্য পছন্দ করো, পুলিশ না হয়ে আর কি হবে? কোথায় গিয়ে আর গোয়েন্দাগিরি করার এমন সুযোগ পাবে?
কথাটা তিনি ঠিকই বলেন, মেনে না নিয়ে পারে না কিশোর। গোয়ন্দাগিরি করতে হলে পুলিশ হওয়াই উচিত। আমেরিকায় অবশ্য শখের গোয়েন্দা সে হতে। পারে, তবে পুলিশের চাকরিতে থেকে এই কাজ করার সুযোগ সুবিধে অনেক বেশি।
খাবার টেবিলে খেতে বসলো সবাই। মাথার কাছে বসেছেন চৌধুরী সাহেব। পুরু পুলিশী গোফ। চোখের দৃষ্টি এতো তীক্ষ্ণ, সরাসরি তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে মুসা, মনে হয় ধারালো ছুরির ফলা তার মনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে ফালাফালা করে চিরে দেখছে কিছু লুকানো রয়েছে কিনা।
কচিকে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে দেখে মুচকি হেসেছেন পুলিশের ভূতপূর্ব ডি আই। জি। মামী প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়াতক অপেক্ষা করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কি হে গোয়েন্দারা, রহস্য পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে?
মনে হয়, জবাব দিলো কিশোর।
কাঁচ ভাঙার রহস্য তো? আমার কাছেও কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে।
লাগছে, নী? পর পর চারবার একই গাড়ির কাঁচ ভাঙলো। কাউকে গাড়ির কাছে দেখা গেল না। কি করে ভাঙলো, কিছু বোঝা গেল না। অদ্ভুত ব্যাপার!
আলাপটা পরেও করতে পারবি, মুসার প্লেটে চিঙড়ির বিশাল দুটো কাটলেট তুলে দিয়ে বললেন মামী, আগে খেয়ে নে।
হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে এলো খাওয়া।
ইয়া বড় পুডিঙের অর্ধেকটাই মুসার পাতে দিয়ে দিলেন মামী। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল আনতে গেলেন।
হ্যাঁ, কাঁচ ভাঙার কথা হচ্ছিলো, কথাটা আবার তুললেন মামা। একই গাড়ির কাঁচ…
আলট্রাসনিক ওয়েভস! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। শব্দ কাঁচ ভাঙতে পারে।
ঠিক! পুডিঙের চামচ মাঝপথেই থেমে গেল মুসার। জেট প্লেনের শব্দে জানালার কাঁচ ভেঙে যেতে দেখেছি আমি!
এদেশে ওরকম প্লেন আসে না, বললেন চৌধুরী সাহেব। গাড়ি রেখেছিলে যেখানে, তার কাছাকাছি এমন কোনো কারখানা আছে, যেটার যন্ত্রপাতি থেকে। আলট্রাসোনিক ওয়েভ বেরোতে পারে?
না, মাথা নাড়লো কচি।
ভূমিকম্প নয় তো? মুসার প্রশ্ন।
এটা ক্যালিফোর্নিয়া নয়, মনে করিয়ে দিলো কিশোর। এখানে এতো জোরে ভূমিকম্প হয় না যে গাড়ির কাঁচ ভাঙবে।
বাতাস? রবিন বললো। ঝড়টর তো হয় এদেশেও। ঘূর্ণিঝড়?
নাহ, ওসব না।
কোনো ধরনের রশ্মি? মুসা বললো। বুঝেছি বুঝেছি, ডেথ রে!
স্টার ওয়ারস ছবিতে যেমন দেখায়? কচি বললো। হীট রে কিংবা ফোর্স রে?
অসুবিধে কি? রবিন বললো। বাংলাদেশে কি স্পেস শিপ নামতে পারে না?
নিশ্চয়ই! চামচ রেখে দিয়ে টেবিলে চাপড় মারলো মুসা। ভিনগ্রহ থেকে আসা!
অতি বুদ্ধিমান কোনো প্রাণীর কাজ বলে ভাবছো? কচি বললো।
কিংবা…কিংবা… ভয়ে ভয়ে উজ্জ্বল রোদে আলোকিত জানালার দিকে তাকালো মুসা, ভূত-টুত!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে জার্মান ভূত, পোলাটারগাইস্ট। বিরক্ত হয়ে বললো কিশোর। হাত নেড়ে বললো, কি সব ফালতু বকবকানি শুরু করেছো! থামো! মামার দিকে তাকিয়ে দেখলো, তাঁর সদাগম্ভীর মুখেও এখন যেন চিরস্থায়ী হাসি ফুটেছে, খুব উপভোগ করছেন তিনি। ভূত, স্পেস শিপভিসিআর সবার মাথা খারাপ করে দিয়েছে!
তাহলে তোমার কি ধারণা? কিশোরের কথার ধরন পছন্দ হলো না কচির রবিন আর মুসার মতো কিশোরের কড়া কথার সাথে অভ্যস্ত নয় সে।
হ্যাঁ, স্পেস শিপ না হলে কি? রবিনের প্রশ্ন।
আমি বলে দিয়েছি, ভূত, ব্যস, হাত নাড়লো মুসা।
তোমার মাথা, কিশোর বললো। অবাস্তব সব কথাবার্তা। যুক্তিতে এসো। সহজ কোনো ব্যাখ্যা আছে এই কাঁচ ভাঙার। যেটা এখনও জানি না আমরা। জানতে হলে এখন দুটো কাজ করতে হবে।
কী? আগ্রহের সঙ্গে মুখ তুললো কচি।
আড়চোখে কিশোর দেখলো, মামার তীক্ষ্ণ চোখ দুটোও এখন তার ওপর নিবদ্ধ, সে চোখে কৌতূহল।
মামা, তোমার গাড়িটা ধার দেবে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। রাতের বেলা?
কেন?
ওটা দিয়ে ফাঁদ পাতবো। পথের মোড়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবো…।
কেউ কাঁচ ভাঙে কিনা দেখার জন্যে? কিশোরের কথাটা শেষ করে দিলেন মামা। বুদ্ধিটা মন্দ না। দেবো। যদিও রিস্কি হয়ে যায় ব্যাপারটা। আর দ্বিতীয় কাজ কি?
ভূত-থেকে-ভূতে।
টেবিলে পানির বোতল রেখে কি কাজে রান্নাঘরে গিয়েছিলেন মামী। বেরিয়ে আসতেই কানে গেল কথাটা। মামা তিন গোয়েন্দা পড়েন, তিনি পড়েন না। একথার মানেও জানেন না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী?
ভূত-থেকে-ভূতে, বললেন মামা। বুঝিয়ে দিলেন, এটা আমাদের তিন গোয়েন্দার একটা অসাধারণ আবিষ্কার। কোন জিনিস খুঁজতে হলে এর জুড়ি নেই। আমি চাকরি করার সময় এই পদ্ধতিটা যদি জানতাম, কতো যে সুবিধে হতো কি বলবো!
কিছুই বুছতে পারছি না তোমার কথা!
বেশ, বুঝিয়ে দিচ্ছি, বললেন চৌধুরী সাহেব। শুনলে হাঁ হয়ে যাবে। ধরো, তোমার গাড়িটা খুঁজে পাচ্ছে না। যতো পরিচিত বাড়ি আছে তোমার, ফোন করে ওসব বাড়ির ছেলেমেয়েদের জানিয়ে দাও খবরটা। বলবে, গাড়ির খোঁজ দিতে পারলে ভালো পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। আরও বলবে, ওদের বন্ধুদের যেন খবরটা জানায় ওরা। সবাইকে জানানোর দরকার নেই। ওদের পাঁচজন পাঁচজন করে। বন্ধুকে জানালেই চলবে। কি ঘটবে, বুঝতে পারছো?
কি আর এমন.. বলতে বলতে সত্যিই হাঁ হয়ে গেলেন মামী। বুঝে ফেলেছেন। সর্বনাশ! কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহরের সমস্ত ছেলেমেয়ে জেনে যাবে, যাদের টেলিফোন আছে!
ঠিক! তুড়ি বাজালেন চোধুরী সাহেব। ওরা ছুটবে তখন গাড়ি খুঁজতে। ওদের আরও অনেক বন্ধু আছে, যাদের টেলিফোন নেই। মুখে মুখে তাদের কানেও খটা চলে যাবে। ঢাকা শহরে থাকলে তখন গাড়িটা আর লুকিয়ে রাখা যাবে বেশিক্ষণ?
না, যাবে না! ছেলেদের দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি হাসলেন। নাহ্, আছে তোদের। সত্যি
কিন্তু ভূত-থেকে-ভূতে ব্যবহার করে এখন কি লাভ? কচি জিজ্ঞেস করলো। কি খুঁজবে ওরা?
আর কোনো গাড়ির কাঁচ ওভাবে ভেঙেছে কিনা, জবাব দিলো কিশোর।
হু। তা জবাবটা দেবে কার ঠিকানায়? তোমরা এখানে এসেছে জানলে ঢাকা শহরের ছেলেমেয়ে আর থাকবে না। সব এসে ভেঙে পড়বে এই উত্তরায়। তোমাদের দেখার জন্যে পাগল হয়ে যাবে সবাই।
এতোই পপুলার আমরা? গর্ব হচ্ছে মুসার।
টেলিফোন করেই দেখো না, হাসলো কচি।
হোক না পাগল, কিশোর বললো, অসুবিধে কি? ওদের সঙ্গে দেখা করতেই তো এসেছি আমরা। তবে একটা কাজ করা যায়। এখানে এসে ভিড় করার দরকার নেই। শিডিউল করে নিয়ে একেক দিন একেক পাড়ায় আমরাই দেখা করতে যাবো, জানিয়ে দিলেই হবে। কচির দিকে তাকালো সে, তোমাদের ফোন আছে?
আছে।
সারাক্ষণ ওটা ধরার কেউ আছে? মানে, বললে প্রতে পারবে?
পারবে, আমার ভাই, রচি। ইস্কুল এখন ছুটি। সারাদিন বাড়িতেই থাকে।
তাহলে ওর ওপরই দায়িত্বটা চাপানো যাক, কি বলো? এখানে তো সারাদিন। আমরা থাকবো না। নানা জায়গায় যাবো। অনেক ফোন আসবে, বুঝতে পারছি। ধরবে কে?
অসুবিধে হবে না, আশ্বাস দিলো কচি। রচিকে বলে দেবো। খুশি হয়েই কাজটা করবে ও।
.
০২.
রাত্রে মামা বললেন, তিনিও যাবেন সঙ্গে। গাড়ি বের করলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ। কিশোর বললো, নটার মধ্যে জায়গামতো পৌঁছে যাওয়া চাই। মামা আশ্বাস। দিলেন, তাতে অসুবিধে হবে না।
বিকেলেই কচির সঙ্গে গিয়ে জায়গাটা দেখে এসেছে তিন গোয়েন্দা।
গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে এলে কিশোর তার পরিকল্পনার কথা বললো। সাত নম্বর রাস্তার মোড়ে গাড়ি থেকে নেমে যাবে ওরা তিনজন। কচিকে নিয়ে মামা চলে যাবেন সেই জায়গাটায়, যেখানে রোজ পিকআপ পার্ক করে কচি। গাড়ি থেকে বেরিয়ে মামাকে জোরে জোরে বলবে সে, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, কাজেই দুটাখানেক দেরি হবে। মামা বলবেন, তিনিও গাড়ি রেখে কাছের চা-দোকানে চা খেতে যাচ্ছেন। তারপর কচি চলে যাবে বাড়ির দিকে, মামা চলে যাবেন। রেস্টুরেন্টের দিকে। যে বাড়িতে মাল সরবরাহ করে কচিরা সেখানে ঢুকে ঘণ্টাখানেক বসে থাকার দরকার হলেও অসুবিধে হবে না তার। বাড়ির গিন্নির সঙ্গে ভালো খাতির। কিন্তু সে দিকে গেলেও আসলে বাড়িতে ঢুকবে না সে, অন্ধকারে কোথাও ঘাপটি মেরে থেকে চোখ রাখবে গাড়িটার ওপর। ততোক্ষণে পা টিপে টিপে রাস্তার অন্যপাশে চলে আসবে তিন গোয়েন্দা। লুকিয়ে থেকে ওরাও চোখ। রাখবে গাড়ির ওপর।
সাত নম্বর রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গাড়ি থামালেন মামা। নেমে পড়লো তিন গোয়েন্দা। আবার এগিয়ে গেল গাড়ি, মোড় নিয়ে ঢুকে পড়লো গলিতে।
হেঁটে চললো তিন গোয়েন্দা। বিকেলেই দেখে গেছে লুকানোর অনেক জায়গা আছে এখানে। পথের একপাশে বাড়িঘর খুব পাতলা, ঝোঁপঝাড় আছে বেশ, খাদও আছে। একটা ঝোঁপের আড়ালে এসে বসে পড়লো ওরা। গাড়িটার দিকে চোখ।– দেখলো, একটা বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কচি। মামা চলে যাচ্ছেন মোড়ের। দিকে, চায়ের দোকানে গিয়ে বসে থাকবেন।
ছায়ায় মিলিয়ে গেল কচি।
ওই পথ ধরে প্রথম একজন মহিলাকে আসতে দেখলো ওরা।
আসছে, ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।
বিদেশী মহিলা। মনে হয় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলো। বেশ লম্বা। পরনে জিনস, গায়ে গলাবন্ধ সোয়েটার। হাতে একটা চকচকে কালো লাঠি, হাতলটা রূপোয় বাধানো। সঙ্গে সঙ্গে আসছে বিশাল একটা কুকুর। জানোয়ারটা খুব অস্থির। এটা শুঁকছে, ওটা শুঁকছে, এদিকে চলে যাচ্ছে, ওদিকে চলে যাচ্ছে। কাছাকাছি রাখার জন্যে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যাচ্ছে মহিলা।
গাড়িটার কাছে এসে টায়ার হুঁকতে লাগলো কুকুরটা। মহিলাও দাঁড়িয়ে গেল।
সামনের টায়ার ওকে হঠাৎ লাফ দিয়ে জানালার কাছে দুই পা তুলে দিলো। কুকুরটা। ওকে নামতে বললো মহিলা। নামলো না দেখে হাতের লাঠিটা তুলে শাই করে বাড়ি মারলো, তবে গায়ে লাগানোর জন্যে নয়, ভয় দেখানোর জন্যে। সেই সঙ্গে দিলো কড়া ধমক।
পা নামিয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো কুকুরটা। মহিলা লাঠি হাতে চললো পেছনে।
মহা হারামী কুত্তা! মুসা মন্তব্য করলো।
আচ্ছা, রবিন বললো, কুকুরটাকে মারতে গিয়েই জানালার কাঁচে বাড়ি লাগিয়ে দেয়নি তো মহিলা?
মাথা নাড়লো কিশোর। না।
মহিলা চলে যাওয়ার পর পরই এলো দুটো ছেলে। একজনের হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট, আরেকজনের হাতে বল। বলটা বার বার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিচ্ছে। এগোচ্ছে ওভাবেই। গাড়ির কাছে পৌঁছে হাত ঘুরিয়ে ক্রিকেট বল যে ভাবে ছেড়ে তেমনি ভাবে জানালার কাঁচ সই করে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করলো ছেলেটী। কিন্তু মারলো না।
ছেলে দুটো পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর মুসা বললো, কিশোর, ওরা শয়তানী করে ভাঙেনি তো? বল ছুঁড়ে, কিংবা ব্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে?
না, আবার মাথা নাড়লো কিশোর, তা-ও মনে হয় না।
ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর আবার নীরব হয়ে গেল গলি। সময় যাচ্ছে। বাড়িঘরের অনেক জানালার আলোই নিভে যাচ্ছে একে একে। এক ঘণ্টা পেরোলো। এই সময়টায় একেবারে নির্জন রইলো গলিটা। তারপর এলো। লোকটা। লম্বা। মোড়ের দিক থেকে শাঁ শাঁ করে ছুটে এলো একটা টেন-স্পীড সাইকেলে চড়ে।
সতর্ক হয়ে উঠলো গোয়েন্দারা। সাইকেলের আলোটা বেশ উজ্জ্বল, টর্চের আলোর মতো এসে পড়েছে সামনের পথে। আঁটোসাঁটো পোশাক পরেছে। লোকটা, সাইকেল চালানোর সময় স্পোর্টসম্যানেরা যে রকম পরে। বিচিত্র আরও কিছু জিনিস রয়েছে তার শরীরে। পিঠে বাঁধা ব্যাকপ্যাক, মাথায় টুপি-ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা যে রকম পরে, চোখে বিচিত্র গগলস-গোল গোল কাঁচ, কানে। হেডফোন-ওয়াকম্যান কিংবা রেডিওটা দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয় পিঠের ব্যাগের ভেতরে ভরে রেখেছে।
খাইছে! হেসে ফেললো মুসা। ব্যাটাকে দেখে তো মনে হয় ভিনগ্রহ থেকেই নেমেছে। হাহ্ হাহ্! স্টার ট্রেক ছবির দৃশ্য। টুপির বদলে মাথায় হেলমেট থাকলেই হয়ে যেতো।
গাড়িটার কাছে এসে গতি ধীর করলো লোকটা। দম বন্ধ করে ফেললো। ছেলেরা। মুখ এদিকে, যেন ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মনে হলো, এখুনি কিছু ঘটবে। কিন্তু ঘটলো না। ওদেরকে নিরাশ করে আবার গতি বাড়িয়ে দিলো। লোকটা। ঢুকে পড়লো গিয়ে সামনের আরেকটা উপ-গলিতে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মুসা বললো, আমি তো মনে করেছিলাম…
এই ব্যাটাই কাঁচ ভাঙবে, বাক্যটা শেষ করে দিলো রবিন। অন্তত কিছু একটা করবে বলে মনে হচ্ছিলো আমার।
অন্ধকারে বসে ভ্রূকুটি করলো কিশোর, সেটা দেখতে পেলো না কেউ। আসলে সবাইকেই সন্দেহ করছি তো আমরা, ফলে নিরাশ হতে হচ্ছে। ধৈর্য ধরতে হবে।
বসে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে খিল ধরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঝাড়া। দিয়ে আবার স্বাভাবিক করে নিলো ওরা। অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলো কিশোর। এক ঘন্টা থাকার কথা, যে কোনো মুহূর্তে এখন বেরিয়ে আসতে পারে কচি।
হঠাৎ একটা নড়াচড়া চোখে পড়লো কিশোরের। দূরের একটা কোণ থেকে ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে আসছে একজন মানুষ।
আরও কাছে এলে দেখা গেল মানুষটা ছোটখাটো, হাতে কি যেন রয়েছে।
হাতে কি? ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।
এগিয়েই আসছে লোকটা, গাড়ির দিকে। মাঝে মাঝে পেছনে আর এদিক ওদিক ফিরে তাকাচ্ছে। যেন ভয় পাচ্ছে কোনো কারণে। হাতে একটা ছড়ি।
লাঠি! বেশ জোরেই বলে ফেললো রবিন, উত্তেজনায় আস্তে বলার কথা ভুলে গেছে।
ছড়ি দোলাতে দোলাতে গাড়ির দিকে আসছে লোকটা। ওটার একটা মাত্র বাড়ি লাগলেই চুরমার হয়ে যাবে জানালার কাঁচ।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ছেলেরা।
এগিয়ে আসছে লোকটা..আসছে পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে…এবার একটামাত্র বাড়ি…কিন্তু না, পাশ কাটাচ্ছে সে, দ্রুত এগিয়ে চলেছে যেন তাড়া খেয়ে। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল মোড়ের অন্ধকারে।
হতাশায় গুঙিয়ে উঠলো মুসা।
হতাশ অন্য দুজনও হয়েছে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের নির্জন, নীরব পথের দিকে। আর কেউ আসছে না। কোনো গাড়িও না। এগারোটা বাজলো, তার পরেও কিছু ঘটলো না।
এগারোটায় কচির বাড়ি ফেরার কথা, মনে করিয়ে দিলো মুসা।
সে-ও নিশ্চয় আমাদেরই মতো অপেক্ষা করছে, রবিন বললো, কাঁচ ভাঙার। বেরোচ্ছে না সেজন্যেই।
কিন্তু আর দেরি করে লাভ নেই, উঠে দাঁড়ালো কিশোর। আজ আর ভাঙবে বলে মনে হয় না। চলো।
ঝোঁপের আড়াল থেকে পথে বেরিয়ে এলো ওরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বাড়ির ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো কচি। সবাই জড়ো হলো গাড়ির কাছে।
বিষণ্ণ কণ্ঠে কিশোর বললো, হয়তো আমার ধারণা ভুল।
ভুল? কি ভুল? জানতে চাইলে রবিন।
ভেবেছিলাম, কচির বন্ধুর গাড়িরও যখন একটা কাঁচ ভেঙেছে, তারমানে শুধু। কচিদেরটাই নয়, অন্য গাড়ির ওপরও চোখ আছে লোকটার, কাঁচ যে ভাঙে। কিন্তু। এখন মনে হচ্ছে, কোনো কারণে শুধু পিকআপটার ওপরই নজর। দেখা যাক আরও খোঁজ নিয়ে।
তাহলে আবার কাল এসে পিকআপের ফাঁদ পাতলেই পারি, মুসা পরামর্শ দিলো।
ভূত-থেকে-ভূতে কোনো কাজ দিচ্ছে না, রবিন বলে। অন্য গাড়ি কাঁচই যদি না ভাঙা হয়, কি খবর আসবে?
হু, গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালো কিশোর, এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দেখা যাক, কি হয়!
.
০৩.
পরদিন সকালে বাগানে বসে রোদ পোহাচ্ছে তিন গোয়েন্দা, এই সময় ছুটতে ছুটতে এলো কচি। ভীষণ উত্তেজিত। এসেই ধপ করে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, একশো বেয়াল্লিশটা।
কি একশো বেয়াল্লিশটা? মুসা অবাক।
গাড়ি!
গাড়ি?
একশো বেয়াল্লিশটা গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে! রাত একটা পর্যন্ত টেলিফোন এসেছে। ভোর থেকে শুরু হয়েছে আবার!
একশো বেয়াল্লিশটা! বিড়বিড় করলো কিশোর।
হ্যাঁ, কচি বললো। প্রথমটা ভেঙেছে দুই মাস আগে। আমাদেরটা ভাঙারও আগে।
তাহলে কিশোরের ধারণাই ঠিক, রবিন বললো। শুধু তোমাদের গাড়ির পেছনেই লাগেনি লোকটা।
সব কি ঢাকা শহরেই ভেঙেছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কচি।
কোন কোন এলাকার গাড়ি জিজ্ঞেস করেছিলে?
করেছি। ঠিকানাও লিখে নিয়েছি, বলে পকেট থেকে নোটবুক বের করলো। কচি।
সেটা নিয়ে পাতা উল্টে দেখতে লাগলো কিশোর। অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে বললো, চলো ঘরে যাই। দেখি, মামার কাছে ঢাকা শহরের কোনও ম্যাপ আছে। কিনা।
না থাকলেও অসুবিধে নেই। জোগাড় করে নেয়া যাবে।
স্টাডিতে পাওয়া গেল চৌধুরী সাহেবকে। একটা গোয়েন্দা গল্পের পেপারব্যাক পড়ছেন। মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই যে গোয়েন্দারা, কি খবর?
বললো কিশোর।
ম্যাপ পাওয়া গেল। বেশ বড় একটা। সেটা নিয়ে শোবার ঘরে চলে এলো। কিশোর, বন্ধুদেরকে সঙ্গে নিয়ে।
আরিফ সাহেব জানতে চেয়েছেন ম্যাপ দিয়ে কি করবে কিশোর। বলেনি সে শুধু বলেছে, আগে কাজটা শেষ হোক, তারপর সব জানাবে। তিনিও আর জানার জন্যে চাপাচাপি করেননি। মুচকি হেসে শুধু বলেছেন, একেবারে এরকুল পোয়ারো।
তাঁর সঙ্গে একমত রবিন। আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা গল্পের নায়ক এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে স্বভাবের অনেক মিল আছে কিশোর পাশার।
ঘরে এসে ম্যাপটা টেবিলে বিছাতে বিছাতে কিশোর বললো, কচি, ধারে কাছে ভালো স্টেশনারি দোকান আছে?
কেন?
কয়েক বাক্স পিন দরকার। ওই যে, যেগুলোর পেছনে রঙিন প্ল্যাস্টিকের বোতাম লাগানো থাকে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, যে কটা রঙে পাওয়া যায়, সব। লাগবে।
এখানে এই উত্তরায় তেমন দোকান…আচ্ছা, ঠিক আছে, না পেলে টঙ্গি থেকে নিয়ে আসবো। এখুনি লাগবে?
হ্যাঁ, এখুনি।
নিয়ে আসছি আমি।
আমরা আসবো?
দরকার নেই। দরজার দিকে এগোলো কচি।
টাকা নিয়ে যাও।
আছে আমার কাছে, বলে বেরিয়ে গেল কচি। ফিরতে অনেক দেরি করে ফেললো। জানালো, এখানে পাইনি। টঙ্গি যেতে হয়েছে। পিনের বাক্সটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো সে।
সবাইকে নিয়ে কাজে বসলো কিশোর। কচি যখন দোকানে গেছে, বসে থাকেনি সে। চৌধুরী সাহেবের নানা বিচিত্র জিনিসের গুদাম থেকে বড় একটুকরো চারকোণী প্লাইউড জোগাড় করে এনেছে। সেটার ওপর ম্যাপটা ছড়িয়ে টেপ দিয়ে আটকে নিয়েছে।
চার রঙের পিন এনেছে কচি। সবগুলো খুলে বসলো কিশোর। কচিকে বললো, তুমি নোটবুক দেখে এক এক করে ঠিকানা বলো।
বলতে লাগলো কচি। বাক্স থেকে পিন তুলে নিয়ে ঠিকানা মোতাবেক ম্যাপের গায়ে গাঁথতে লাগলো কিশোর। তাকে সাহায্য করলো রবিন আর মুসা।
সময় যে কোনদিকে দিয়ে কেটে গেল, খেয়ালই রইলো না ওদের। দুপুরের খাবার জন্যে যখন ডাকতে এলেন মামী, তখন টনক নড়লো মুসার। প্রচণ্ড খিদে টের পেলো। এই খিদে ভুলে এতোক্ষণ থাকলো কি করে ভেবে নিজেই অবাক হলো।
উত্তেজিত হয়ে আছে চারজনেই। খাবার টেবিলে খুব একটা কথা বললো না। ওরা। তাড়াতাড়ি খেয়ে এসে আবার পিন গাঁথতে বসলো। আরও ঘণ্টাখানেকের খাটুনির পর শেষ হলো কাজ। হউফ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো কিশোর। বললো, দেখো তো, এবার কিছু বোঝা যায় কিনা?
ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকালো মুসা, পারছি। ঢাকা শহরের কোন কোন এলাকায় ভাঙছে, স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে এখন।
হ্যাঁ। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করেছো? কচি যখন ঠিকানাগুলো বলে যাচ্ছিলো, তারিখও বলতে বলেছিলাম। কোন তারিখে কোন দিন ভেঙেছে। কাঁচগুলো। শুধু সোম আর বুধবারে। অন্য কোনো বারে একটা কাঁচও ভাঙেনি।
ঠিক ঠিক! বলে উঠলো রবিন। আর কোনো বারের কথা লেখেনি কচি!
আরও একটা ব্যাপার, ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বললো কিশোর, যে রাস্তায়ই ভাঙে, মাঝের দু-তিনটে করে গলি বাদ দিয়ে নেয়।
কেন দেয়? জানতে চাইলো মুসা।
সেটা এখনও বলতে পারবো না। তবে জেনে যাবো।
গাড়ি নিয়ে আবার কি ফাঁদ পাততে যাচ্ছি আমরা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
নিশ্চয়ই। তবে আজ বিকেলে বেড়াতে যাচ্ছি, কিশোর বললো। তুরাগ নদীর ধার ধরে হেঁটে চলে যাবো গ্রামের ভেতর। যতদূর যেতে পারি। দূর থেকে দেখে মনে হয়, গ্রামগুলো সুন্দর। ভেতরে ঢুকে দেখতে চাই সত্যি কেমন।
নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে ওরা। তিন গোয়েন্দা আর কচি। শীতকাল। শুকনো মৌসুম। অনেক নিচে নেমে গেছে পানি। খুব ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। একেবেঁকে যাওয়া পানির স্রোত। রেললাইন পেরিয়ে হেঁটে চললো ওরা।
একপাশে ছড়ানো ফসলের খেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে সেই কবে, এখন খেত জুড়ে শুধু সাদা মাটির ঢেলা।
নদীর পাড়ে সাদা বালি, পানির ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। জায়গায় জায়গায় অসংখ্য শালিক বসে আছে। ঝগড়া বাধিয়েছে কোনো কোনোটা, কিচির মিচিয়ে কান ঝালাপালা। একখানে দেখা গেল পানির কিনারে এক পা তুলে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে সাদা বক। ওদের এগোতে দেখে ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেল তার। চোখের পলকে ডানার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আরেকটা পা। সতর্ক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো ওদেরকে। বোধ হয় লক্ষ করছে হাতে এয়ারগান আছে কিনা। ইদানীং এই বয়েসী ছেলেরা বড় বেশি বিরক্ত করে। এই তো, দিন কয়েক আগেই মেরে নিয়ে গেছে তার সঙ্গিনীকে।
ওদের হাতে কিছু নেই দেখে আশ্বস্ত হলো পাখিটা, তবে সতর্কতা কমলো না। ব্যাপারটা লক্ষ করলো মুসা। বকটা ওরকম করছে কেন জিজ্ঞেস করলো। এয়ারগানের কথা জানালো কচি।
আরও খানিক দূর গিয়ে একটা বড় মাছরাঙা দেখা গেল। পানিতে পড়ে থাকা মরা পচা ডালের ওপর বসে আছে। ওদেরকে দেখে ওটাও সতর্ক হয়ে গেল। ওরা আরও খানিকটা এগোতেই চিড়ড়িক ডাক ছেড়ে উড়ে চলে গেল।
এটারও কি এয়ারগানের ভয়?
চড়ুই থেকে শুরু করে কিছুই তো বাদ দেয় না ছেলেগুলো।
এগিয়ে চলেছে ওরা। পায়ে চলা পথের কিনারে এখন খানিক পর পরই খেজুর গাছ। পথের পাশে খেত আছে এখানেও। তবে ফসলের খেতের মতো শূন্য নয়। শীতকালীন শাকসজিতে সবুজ হয়ে আছে। কোথাও সরষে খেতের হলদে ফুলের শোভা। তার ওপর এসে পড়েছে বিকেলের পড়ন্ত সোনালি রোদ।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেই ফেললো মুসা, কিশোর, তোমাদের দেশটা সত্যিই সুন্দর! এতোদিন তো শুধু শুনেছি, আজ দেখলাম…
জবাব দিলো না কিশোর। শুধু মাথা ঝাঁকালো। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে তার। মায়াময় দুই চোখ। গুনগুন কবে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…
পেছনে সূর্য ডুবছে। খেজুর গাছে শালিক আর শ্যামার ভিড়। বেশির ভাগই ডাকছে নানান সুরে। কোন কোনটা এসে বসেছে রসের কলসের কানায়। রস বেয়ে পড়ার কাঠিতে ঠোঁট ডুবিয়ে রস খাচ্ছে। দূরে কোথায় যেন আপনমনে শিস দিয়ে চলেছে একটা দোয়েল। এক জায়গায় এসে দেখলো, খেজুর গাছে কলসি পাতছে ওদেরই বয়েসী একটা ছেলে।
কলসিতে যে মিষ্টি রস পড়ে, ইতিমধ্যে তা জেনে গেছে মুসা। কচিকে জিজ্ঞেস করলো, কখন খাওয়া যাবে?
সকালে, জানালো কচি।
সকালে কেন?
সারারাত ধরে কুয়াশা পড়বে। কুয়াশা আর রস গিয়ে জমা হবে কলসিতে। সকালে ওগুলো নামিয়ে বেচতে নিয়ে যাবে কৃষক।
ও। সকালে আসাই ভালো ছিলো তাহলে।
কেন, রস খাওয়ার জন্যে? হাসলো কচি। বেশ, আসবো একদিন সকালে।
গাছের ওপর থেকে ওদের কথাবার্তা সবই শুনেছে কৃষকের ছেলেটা। মুসার ভাঙা বাংলা বুঝতেও অসুবিধে হয়নি। স্থানীয় ইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে সে।
কলস পাতা শেষ করে নিচে নামলো ছেলেটা। তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। মুসা আর রবিনের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাতে লাগলো সে। বুঝতে পারছে, বিদেশী। কচির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনেরা কি এখানে নতুন আইলেন?
আমি পুরানোই। এরা নতুন।
ইনিও? কিশোরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।
হ্যাঁ।
কই থাকেন ভাই আপনেরা? এবারের প্রশ্নটা কিশোরকে।
আমেরিকায়। আমার নাম কিশোর পাশ, হাত বাড়িয়ে দিলো সে। ওরা আমার বন্ধু। ওর নাম মুসা আমান। আর ও রবিন মিলফোর্ড।
চকচক করে উঠলো ছেলেটার দুচোখ। দৃষ্টিতে বিস্ময় মেশানো অবিশ্বাস। রাখেন, রাখেন, আপনেদের নাম শুনছি! রকি বীচে থাকেন না আপনেরা?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালে কিশোর। চোখে কৌতূহল।
বুঝেছি, আপনেরাই! কতো পড়ছি আপনেগো কিচ্ছা! খুব ভাল লাগে আমার। আপনেরা তিন গোয়েন্দা, ঠিক কইলাম না? বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই কিশোরের হাত দুই হাতে চেপে ধরলো সে। আমার নাম আবদুল করিম। হগগলে ডাকে করিম কইয়া। খালি বাবায় আর হেডস্যারে যখন বেশি রাইগ্না যায়, তখন কয় করিম্মা। নিষ্পাপ হাসি হাসলো সে। এক এক করে মুসা আর রবিনের হাতও ন্টঝাঁকিয়ে দিলো।
ছেলেটার সরলতায় মুগ্ধ হয়ে গেল মুসী আর রবিন। আমেরিকায় এই বয়েসী কোন ছেলের এতোখানি আন্তরিকতা কল্পনাও করা যায় না।
মুসা জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাদের কথা জানো?
হ জানি, আবার হাসলো ছেলেটা। আপনে খালি খাইছে খাইছে করেন না? আর হগল সময় খালি খাওনের লাইগ্যা পাগল হইয়া থাকেন। ভূতের নাম শুনলেই কাছার কাপড় ফালাইয়া দৌড়। ঠিক না?
হ্যাঁ, ছেলেটার সব কথার অর্থ বুঝতে পারছে না মুসা, তবে মানে মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারছে।
গাছের মাথায় থাইক্কাই শুনলাম, রস খাওনের কতা কইতাছেন। অখন তো। অইবো না, বাই, সকালের আগে রস পাওন যাইবো না।
খুব সহজেই ওদেরকে আপন করে নিলো ছেলেটা। বকবক করে চললো। কাছেই ওদের বাড়ি। হাত তুলে দেখিয়ে দিলো।
সূর্য এখন আর চোখে পড়ে না। ডুবে গেছে। কিন্তু তার রেশ ছড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিম আকাশে সাদা মেঘের ছোট-বড় পাহাড়গুলো এখন রক্তলাল।
ওদেরকে তার বাড়িতে রাতের খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে বসলো করিম। আজ না, আরেক দিন, বলে অনেক কষ্টে এড়ানো গেল।
দ্রুত কমে আসছে গোধূলির কালচে সবুজ আলো। ছায়াঢাকা মেঠোপথ ধরে আবার শহরের দিকে ফিরে চললো ওরা। এক অপূর্ব আনন্দে মন ভরে গেছে। সবারই, বিশেষ করে তিন গোয়েন্দার।
মনে মনে আরেকবার স্বীকার করতে বাধ্য হলো রবিন আর মুসা, বাংলাদেশটা সত্যিই সুন্দর সুন্দর এর মানুষগুলো!
.
০৪.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ঘর থেকে বেরোতেই মামীর সঙ্গে দেখা। মুসার। তাকে ডাকতেই আসছিলেন তিনি। বললেন, উঠেছে। বারান্দায় গিয়ে দেখো কে এসেছে।
কে?
গিয়েই দেখো না, মিটিমিটি হেসে চলে গেলেন তিনি।
ভীষণ কৌতূহল হলো মুসার। চলে এলো বারান্দায়। তাকে দেখেই হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা।
আরে, করিম।
হ। রস লইয়া আইছি। আইজ রাইতে কুয়াশা খুব ভালো পড়ছিলো। ভালো। রস অইছে। সামনে রাখা দুই কলস রস দেখালো করিম। যান, একটা গেলাস লইয়া আয়েন। ঢাইল্লা দেই, খান।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইল মুসা। এই কষ্টটা কেন করতে গেলে?-বলে যে সৌজন্যটুকু দেখাবে সেকথাও ভুলে গেল। ভাবতেই পারেনি এভাবে রস নিয়ে হাজির হয়ে যাবে আবদুল করিম।
এই নে, গেলাস, পেছন থেকে মামীর কথায় সংবিৎ ফিরলো যেন তার।
গেলাসটা নিয়ে হাসলো মুসা। বাড়িয়ে দিলো করিমের দিকে। দাও।
কলসের মুখে পরিষ্কার গামছা বাধা। সাদা ফেনা জমে রয়েছে। রস ঢেলে দিলো করিম।
হাতে নিয়ে পানীয়টুকু ভালো করে দেখলো মুসী। এই জিনিস আগে কখনও দেখেনি সে। গন্ধ শুকলো। তারপর চুমুক দিলো গেলাসে। দিয়েই বলে উঠলো, হখাইছে! এতো মিষ্টি! বলেই ঢকঢক করে সবটুকু গিলে ফেলে আবার গেলাসটা বাড়িয়ে দিলো।
গিলে চলেছে মুসা। আর ক্রমেই বাড়ছে করিমের হাসি। দারুণ মজা পাচ্ছে। গ্রামে ওরা বন্ধুরা মিলে বাজি ধরে রস খায়। সবাই প্রচুর খেতে পারে। কিন্তু এখন তার মনে হলো, মুসার ধারে কাছে যেতে পারবে না কেউ।
চলেন, একদিন আমাগো বাড়িত গিয়া বাজি ধইরা খাইবেন? প্রস্তাব দিয়ে ফেলল করিম।
না বুঝেই মাথা কাত করলো মুসা, আচ্ছা। আবার বাড়িয়ে দিলো গেলাস।
একের পর এক গেলাস খালি করে অবশেষে ওটা করিমের হাতে দিতে দিতে। মস্ত ঢেকুর তুলল সে, নাও, আর পারবো না।
একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো মুসা। ঢোল হয়ে যাওয়া পেটে হাত বোলাচ্ছে। কিশোর আর রবিনও এসেছে। ওদেরকে বললো, দারুণ টেস্ট, বুঝলে। খেয়ে দেখো। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসলো সে। এতো মজা, লোভ সামলাতে পারিনি। এর সঙ্গে কোথায় লাগে পেপসি-কোক-ফান্টা…
রস খাওয়া শেষ হলো। কিছুতেই পয়সা নিতে চাইলো না আবদুল করিম। কিন্তু তিনজনের কাছ থেকে তিনটে ভনির তাকে নিতেই হলো। আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা। রবিন দিলো ইলেকট্রনিক ঘড়ি বসানো একট বলপেন। কিশোর দিলো একটা পকেট নাইফ। মুসা দিল সুন্দর একটা গেঞ্জি আর একবাক্স চকলেট।
খুব খুশি হলো করিম। ওদেরকে আবারও খাওয়ার দাওয়াত দিলো। একেবারে নাছোড়বান্দা। কথা আদায় না করে যাবেই না।
শেষে কিশোর বলল, ঠিক আছে, যাবো, তবে আজ না। আজ তো বুধবার, যেতে পারবো না। আরেক দিন।
বুধবারে কি অসুবিধা বুঝতে পারলো না করিম। জিজ্ঞেসও করলো না। জানতে চাইলো, আরেক দিন কবে?
কালও হতে পারে। এসো একবার যেতে পারলে চলে যাবো।
আচ্ছা, বলে উঠে পড়লো করিম।
.
দিনের বেলাটা নানা জায়গায় ঘুরে কাটালো তিন গোয়েন্দা। সোনার গাঁ দেখে এলো। বিকেল বেলা ফিরে খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। রাতের খাওয়ার পর বেরোলো আবার, গাড়ি নিয়ে, মামার সঙ্গে।
সোমবার আর বুধবারেই ঘটে কাঁচ ভাঙার ঘটনাগুলো।
আগের বারের মতোই সেদিনও সাত নম্বর রোডের মোড়ে তিন গোয়েন্দাকে নামিয়ে দিলেন চৌধুরী সাহেব। নির্দিষ্ট জায়গায় এনে গাড়ি পার্ক করলেন। কচি নেমে চলে গেল একটা বাড়ির ছায়ার দিকে। তিনি চললেন মোড়ের চায়ের। দোকানে।
আগের দিনের মতোই ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে বসলো তিন গোয়েন্দা।
প্রথমে এলো সেই লম্বা বিদেশী মহিলা। হাতে লাঠি, সঙ্গে কুকুর। সেদিনের। মতোই সব কিছু শুঁকতে শুঁকতে এলো কুকুরটা, লাফ দিয়ে গাড়ির কাঁচে পা তুলে দিলো, ধমক দিয়ে তাকে নামিয়ে নিলো মহিলা।
ফিক করে হেসে ফেললো মুসা।
কুকুরটাকে নিয়ে চলে গেল মহিলা। আবার নীরব হয়ে গেল রাস্তা।
এরপর গোটা দুই গাড়ি হুস হুস করে বেরিয়ে গেল। পার্ক করে রাখা গাড়িটার কাছে এসেও একটু গতি কমালো না।
দ্বিতীয় গাড়িটা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর এলো সেই বিচিত্র পোশাক পরা তরুণ। টেন-স্পীড সাইকেলে করে। সেদিন তো পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গতি কমিয়েছিলো, আজ তা-ও কমালো না। শাই শাই করে সোজা ছুটে গিয়ে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ল একটা উপ-গলিতে।
ঝোঁপের আড়ালে অপেক্ষা করে আছে ছেলেরা।
দশটার দিকে মোড়ের কাছে আরেকটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। আরও কাছে এলে দেখা গেল একটা ফোক্স ওয়াগেন। অদ্ভুত রঙ করেছে–ওপরের অংশটা বেগুনী, নিচের অংশ হলুদ। তোবড়ানো ফেনড়ার। সামনের বাম্পারের একপাশ খুলে গেছে, আরেক পাশ ছুটলেই খসে পড়ে যাবে। ইঞ্জিনের ভারি শব্দ আর ঝুলে পড়া বাম্পারের ঝনঝন আওয়াজ তুলে এগিয়ে এলো ওটা। পার্ক করা গাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো কি একটা জিনিস। গিয়ে পড়ল গাড়িটার নিচে।
কি ছুঁড়লো! চেঁচিয়ে বললো মুসা।
চল, দেখি! কিশোর বললো।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো তিনজনে। ছুটে রাস্তা পেরিয়ে এসে উঁকি দিলো গাড়ির নিচে। টর্চের আলোয় জিনিসটা দেখে মুখ বাকলিলা কিশোর।
জিনিসটা বের করে আনলো মুসা। ভীষণ নিরাশ হয়েছে।
সিগারেটের প্যাকেট! বিড়বিড় করলো রবিন। ভেতরে কিছু নেই তো?
খুলে দেখলো মুসা। কিচ্ছু নেই! নিমের তেতো ঝরলো তার কণ্ঠ থেকে, ধুর…
কথা শেষ হলো না তার। হঠাৎ বেজে উঠলো সাইরেন। মোড়ের কাছে দেখা দিলো পুলিশের গাড়ি। হাতের ওপরে লাল-নীল আলো জ্বলছে-নিভছে। পথের আরেক মাথায় একটা উপ-গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একই রকম আরেকটা গাড়ি।
তিন গোয়েন্দাকে ঘিরে ফেললো পুলিশ।
.
পুলিশের গাড়িতে বসানো সার্চ লাইটের আলো এসে পড়লো ওদের গায়ে এগিয়ে এলেন একজন গম্ভীরমুখো সার্জেন্ট। বুকে প্ল্যাস্টিকের ফলক ঝুলছে, তাতে নাম লেখাঃ আবদুল আজিজ। এক এক করে তাকালেন কিশোর, মুসা আর রবিনের মুখের দিকে। শেষ দুজনকে দেখে অবাক হয়েছেন, বোঝা গেল। জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের পরিচয়?
কি জিজ্ঞেস করছেন! বলে উঠল রাগত একটা কণ্ঠ, ধরে লাগান না ধোলাই! পথেঘাটে চুরি, ছিনতাই, বোমাবাজি অতিষ্ঠ করে ফেললো!
মোটা একটা বেতের লাঠিতে ভর দিয়ে পুলিশের ভিড় সরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধ। পরনে অবিন্যস্ত পোশাক। পেছন পেছন এলো এক তরুণ আর সতেরো আঠারো বছরের আরেক তরুণী।
চোর কোথাকার! তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে গর্জে উঠলেন বৃদ্ধ, আমার ঈগল কোথায়?
একটা পেট্রল কার থেকে নেমে এলেন পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর। বুকে। ঝোলানো ফলকে নাম লেখা, হাফিজ আলি। তিন গোয়েন্দাকে দেখে সার্জেন্টের মতোই অবাক হলেন তিনিও। কুঁচকে গেল ভুরু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থেকে একই প্রশ্ন করলেন, তোমাদের পরিচয়?
পরিচয়-ফরিচয় পড়ে! ধমকে উঠলেন বৃদ্ধ। আমার ঈগলটা কোথায় আগে জিজ্ঞেস করুন! ধরে পেটান না…
আহ, থামুন তো আপনি, হাত তুলে বললেন পুলিশ অফিসার। আবার তাকালেন ছেলেদের দিকে, এখানে কি করছো তোমরা?
উ…উই… ইংরেজিতে বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। বাংলায় তোতলাতে শুরু করলো, আ-আমরা-চো-চো-চো…,
চোর নই, বাক্যটা শেষ করে দিলো কিশোর। বৃদ্ধকে দেখিয়ে বললো, ইনি ভুল করছেন।
কি বলতে যাচ্ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর, চেঁচিয়ে বললো একজন কনস্টেবল, স্যার, আরেক ব্যাটাকে ধরেছি! লুকিয়ে ছিলো! কচিকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে সে।
চিৎকার করে উঠলেন বৃদ্ধ, আরি, ওটাকে চিনি তো! তিন-তিনবার দেখেছি একটা পিকআপের কাছে, আর তিনবারই কাঁচ ভেঙেছিলো, গাড়িটার!
ওটা আমাদেরই গাড়ি, কচি বললো। মাল ডেলিভারি দিতে এসেছিলাম। কে জানি ভেঙে রেখে গেছে।
এটা কার? সামনের গাড়িটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সাব-ইন্সপেক্টর।
ওসব কথা বাদ দিন না! খেপে গেলেন বৃদ্ধ। আমার ঈগল কোথায় জিজ্ঞেস করুন!
আপনি স্যার থামুন না! বিরক্ত হয়ে বললেন পুলিশ অফিসার। আমরাই তো করছি যা করার। আপনি চুপ থাকুন, প্লীজ।
গজগজ করতে লাগলেন বৃদ্ধ।
কিশোর বললো, দেখুন, আমরা গাড়ির কাঁচ ভাঙতে আসিনি। চুরি করতেও নয়।
বার বার চোর চোর শুনতে শুনতে অসহ্য হয়ে গেছে মুসা। চমকের প্রথম ধাক্কাটাও কাটিয়ে উঠেছে। রেগে গেল। ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে বললো, ঈগল ভেরি বিগ পাখি। পকেটে ভরে রেখেছি নাকি?
ঠিক, বাংলায় বললো রবিন। পরের কথাটা বললো ইংরেজিতে, পাখি চুরি করতে যাবো কোন দুঃখে?
সেটা আমি কি জানি? চুপ থাকতে পারছেন না বৃদ্ধ। মুখ ভেঙচালেন, এহ্, ভেরি বিগ পাখি! ন্যাকামো হচ্ছে! জানো না কি পাখি…।
আরেকজন কনস্টেবল চেঁচিয়ে উঠলো, স্যরি, এই গাড়িটা চিনি! নাম্বার প্লেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চৌধুরী সাহেবের! আরিফুর রহমান চৌধুরী! ডি আই জি ছিলেন…
হ্যাঁ, আমারই, পেছন থেকে শোনা গেল ভারি কণ্ঠ।
ঝট করে ফিরে তাকালেন সাব-ইন্সপেক্টর। স্যার, আপনি?
অ্যাটেনশন হয়ে গেলেন তিনি আর তার দলের লোকেরা। স্যালুট করলেন।
সালামের জবাব দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন ভূতপূর্ব ডি আই জি, হ্যাঁ। কাঁচ ভাঙে কে ধরতে এসেছি। কিশোরকে দেখিয়ে বললেন, ও আমার ভাগ্নে, কিশোর পাশা। আমেরিকায় থাকে। বেড়াতে এসেছে।…আর এরা ওর বন্ধু। ও মুসা আমান।…ও রবিন মিলফোর্ড। গোয়েন্দাগিরির খুব শখ। নামটাম ভালোই করেছে ওখানে।
আমি ওদের কথা জানি, স্যার, হাসিমুখে বললো একজন কনস্টেবল। পড়েছি। তিন গোয়েন্দা।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন চৌধুরী সাহেব।
ফোন করে ডেকে আনলাম চোর ভেবে, বিড়বিড় করলেন বৃদ্ধ। এখন শুনি গোয়েন্দা। অস্থির ভঙ্গিতে রাস্তায় বেত ঠুকতে ঠুকতে বললেন, আমার ঈগলটা কি পাবো না?
.
০৫.
এরা যে লুকিয়ে আছে, আপনারা খবর পেলেন কোথায়? চৌধুরী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
কথা হচ্ছে বৃদ্ধ আকবর আলি খানের ড্রইংরুমে বসে, তিন গোয়েন্দাকে চোর ভেবে বসেছেন যিনি। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে কিশোর। আসবাবপত্র খুব দামী, কিন্তু পুরানো ধাচের। জমিদারী আমলের জিনিসের মতো ভারি আর নকশা করা। বসার ঘরে দেয়ালে টানানো আকবর আলি খানের তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের একটা ছবি। পরনে কালো স্যুট। ঠিক একই রকম পোশাক পরেন এখনও। কিছুতেই যেন সময়টা পার হয়ে আসতে পারেননি, কিংবা হয়তো চাই না।
দুমাস ধরেই ধরার চেষ্টা করছি, স্যার, সার্জেন্ট জানালেন। অনেকেই খবর। দিচ্ছে, রহস্যময় ভাবে গাড়ির উইণ্ডশীল্ড ভেঙে রেখে যাচ্ছে কেউ। গত হপ্তায় খান। সাহেবও থানায় ডাইরি করে এসেছেন, বৃদ্ধকে দেখালেন তিনি। তাঁর গাড়ির কাঁচ ভেঙে ভেতর থেকে ঈগলটা রে করে নিয়ে গেছে। বাড়ির সামনে তখন ছিলো গাড়িটা। ভুলে ঈগলটা রয়ে গিয়েছিলো গাড়িতে। খানিক পরে মনে পড়তেই ছুটে গিয়ে দেখেন গাড়ির কাঁচ ভাঙা, ঈগল উধাও। তারপর থেকেই রাস্তার ওপর চোখ রাখেন। পরশুদিন রাতেও নাকি তিনজন ছেলেকে বাড়ির সামনের রাস্তায়, ঝোঁপের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকতে দেখেছেন। আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে রেখেছেন। আজও যখন এদেরকে দেখলেন, তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন আবদুল আজিজ, ফোন করলেন থানায়। আমি তখন চৌরাস্তার মোড়ে ডিউটিতে ছিলাম। অয়্যারলেসে আমাকে জানিয়েছেন সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ আলি।
জানালার কাঁচ ভাঙার পর, রবিন বললো, উড়ে পালিয়েছে হয়তো ঈগলটা।
মুসা বললো, ঈগল ডেঞ্জারাস পাখি। ছেড়ে রাখা হয় না। পালালো কিভাবে?
কড়া চোখে ওদের দিকে তাকালেন আকবর আলি খান। ইচ্ছে করে ন্যাকা সাজছে, না কী? পাখি হবে কেন? আমার জিনিসটা একটা..।
বুঝেছি! বলে উঠলো কিশোর। জ্বলজ্বল করছে চোখ। পাখি নয়, মুদ্রা! একটা দুর্লভ মুদ্রা!
মুদ্রা? অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকালো কচি।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আমেরিকান। সোনার টাকা, দশ ডলারের। আঠারোশো সালের শুরুতে বাজারে ছাড়া হয়েছিলো। এক পিঠে ঈগলের ছাপ মারা, ঈগল বললেই লোকে চিনতো তখন। আরও একটা প্রায় একই রকম মুদ্রা ছিলো তখন, হাফ ঈগল, ছাড়া হয়েছিলো আঠারোশো বাইশ সালে। দুনিয়ার। সবচেয়ে দুর্লভ মুদ্রাগুলোর একটা এখন।
শুনলেন! গর্জে উঠলেন আকবর সাহেব। সব জানে। তার মানে ঈগলটা দেখেছে!
দেখলেই যে জানবে শুধু, না দেখলে জানবে না, এটা কোনো কথা হলো না,। গম্ভীর হয়ে বললেন আরিফ সাহেব। না দেখেও জানা যায়, বই পড়ে। আর আমার। ভাগ্নে প্রচুর বই পড়ে।
আরিফ সাহেবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মেয়েটা বললো, ঠিকই তো। তুমি কিন্তু দুর্ব্যবহার করছ, আব্বা।
কিছু বললেন না আকবর সাহেব। তবে দৃষ্টি কিছুটা নরম হলো।
তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে আবার বললো মেয়েটা, তোমরা কিছু মনে করো না, ভাই। আব্বার মনমেজাজ ভালো নেই। ঈগলটা হারিয়ে ভীষণ অস্থির। উঠে এসে কিশোরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, কোনো জড়তা নেই। আমি ডলি। সোফায় বসা তরুণকে দেখিয়ে বললো, ও আমার চাচতো ভাই, সানি।
সানিও এসে এক এক করে হাত মেলালো তিন গোয়েন্দার সঙ্গে।
এই সময় চা-নাস্তা নিয়ে ঢুকলো বাড়ির কাজের লোক। মেহমানদেরকে সেগুলো পরিবেশন করতে লাগলো ভাই-বোন মিলে।
কি ঈগল আপনাদেরটা? চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সানিকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
ডাবল ঈগল।
তার মানে বিশ ডলারের। আঠারোশো ঊনপঞ্চাশ সালে তৈরি। হাফ ঈগলের চেয়েও দুর্লভ। যতদূর জানি, আমেরিকায় এখন একটাই আছে, গভর্নমেন্টের কাছে। দশ লাখ ডলারে কিনতে চেয়েছিলো এক কোটিপতি, তা-ও রাজি হয়নি সরকার।
জানি, সানি বললো। আঠারোশো তিপ্পান্ন সালে নাকি আরও তিনটে তৈরি হয়েছে, যার দুটোর খোঁজ আছে এখন। একেকটার দাম পাঁচ লাখ ডলার।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করলো মুসা। বিশ ডলারের একটা সোনার টুকরোর এতো দাম!।
অ্যানটিক ভ্যালু, কিশোর বললো।
হ্যাঁ, সানি বললো। চাচারটা তৈরি হয়েছে উনিশশো সাত সালে। দাম আড়াই লাখ ডলারে মতো।
গাড়িতে ছিলো কেন ওটা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
ধানমণ্ডিতে পুরানো মুদ্রার একটা একজিবিশন হয়েছিলো, ডলি জানালো, সেখানে দিয়েছিলো আব্বা। ওখান থেকে নিয়ে আসার পর ভুলে গাড়িতেই রয়ে গিয়েছিলো।
দোষটা তোর!
এবার মেয়ের ওপর রেগে গেলেন আকবর আলি। কতোবার মানা করেছি, গাড়ি চালানোর সময় এতো জোরে ক্যাসেট বাজাবি না! ভুলে গেলেন পুলিশের সামনে একথা বলা ঠিক হচ্ছে না, কারণ তাঁর মেয়ের ড্রাইভিং লাইসেন্সই নেই, ওই বয়সে পাওয়া যায় না। গোপনে চালায়। গান না ছাই! ধুড়ুম ধুড়ুম ঢাকের শব্দ আর চেঁচামেচি, আফ্রিকার জংলীরাও এই কাণ্ড করে না। কি যে শোনে আজকালকার। ছেলেমেয়েগুলো! মাথা ধরে গিয়েছিলো আমার! ওই চেঁচামেচিতেই সব ভুলে গিয়েছিলাম, বাক্স ফেলে এসেছি গাড়িতে। নইলে কি আর ঈগলটা খোয়াতাম!
দুর্লভ জিনিস তো, তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে সহানুভূতির সুরে বললো। কিশোর, টাকা দিয়েও সব সময় পাওয়া যায় না। এসব জিনিস হারিয়ে গেলে কষ্টটা সে জন্যেই বেশি পায় সংগ্রহকারী।
কিশোর, মুসা বললো, গাড়ির ভেতরের জিনিস চুরি করার জন্যেই কি তাহলে কাঁচ ভাঙে?
মাথা নাড়লো কিশোর। আমার তা মনে হয় না।
আমারও না, মাথা নাড়লো কচি। কারণ আমাদের গাড়ি থেকে একবারও কিছু চুরি যায়নি। চুরি যাওয়ার মতো অবশ্য কিছু ছিলোও না ভেতরে।
তাহলে কাঁচ ভাঙার আর কি কারণ থাকতে পারে? সানির প্রশ্ন।
তাই তো, আর কি কারণ? প্রশ্নটা উলিরও। আমার তো বিশ্বাস চুরিই এর। একমাত্র কারণ। সঙ্ঘবদ্ধ কোনো দলের কাজ।
না আমারও মনে হয় না চুরি এর কারণ, সার্জেন্ট আজিজ বললেন। তোমাদেরটা বাদে আর কোনো গাড়ি থেকেই কোনো কিছু চুরি যায়নি। রিপোর্ট করেনি কেউ। এমন কতোগুলো গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে যেগুলোর দরজা লক করা ছিলো না। যদি আর কোনো উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে বলতে হবে এটা স্রেফ শয়তানী।
কি জানি, কথাটা মানতে পারলো না কচি। শয়তানী করলে তো কোনো দুষ্টু ছেলের কাজ হতো। তাহলে কি ধরে ফেলতে পারতেন না এতোদিনে?
ঠিকই বলেছো, একমত হলো কিশোর। ম্যাপে যা দেখলাম, তাতে মনে হয় বেশ হিসেব করে একেকখানে গিয়ে একেকবার কাঁচ ভাঙে। এটা দুষ্টু ছেলের কাজ হতে পারে না। তাছাড়া সব দিন নয়, ভাঙে দুটো বিশেষ দিনে, সোম আর বুধবার।
তাই নাকি? অবাক মনে হলো সাব-ইন্সপেক্টরকে। এটা তো খেয়াল করিনি!