০৬.

হেনরি লিসটারকে ডেকে আনলেন মিস এমিনার। বললেন, দুপুর হয়ে আসছে। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে ওদের। আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবে। চিকেন স্যাণ্ডউইচই দাও। আমাকে বাদ দিয়ে। আজকাল আর হজম করতে পারি না। বয়েস হয়ে গেছে। আর কি খাওয়ার মজা আছে!

স্যাণ্ডউইচ নিয়ে আসছি, বলে চলে গেল লিটার।

তোমাদের বয়েসে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন মিস এমিনার, লোহা খেয়ে হজম করে ফেলেছি। টন কে টন পেনি ক্যাণ্ডি গিলেছি। লিকোরাইস হুইপ, টুটসি রোলস, কিছু বাদ দিতাম না। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে দুঃখটা ঝেড়ে ফেললেন যেন তিনি। ভালো কথা, ক্যাম্পার কি বললো?

হঠাৎ এই প্রসঙ্গ পরিবর্তনে কিশোরও সোজা হয়ে বসলো।

নিনাকে সাহায্য করতে এসেছো তোমরা, তাই না? আবার বললেন মিস এমিনার। তোমাদেরকে যে ফোন করেছে, একথা সকালেই বলেছে আমাকে। আমারও অনুরোধ, ওর জন্যে কিছু করো। মেয়েটা খুব ভালো। এখানে ভালো লোকের বড় অভাব। বেশির ভাগই তো অসভ্য!

পেছন ফিরে তাকালেন মিস এমিনার। ভেজা কাপড় নিয়ে এসে টেবিল মুছতে লাগলো রাগবি ডিগার। উজ্জ্বল রোদে আরো বেশি রোগা লাগছে তাকে। গালে লাল লাল দাগ, সেগুলোর মধ্যে থেকে নারকেল গাছের জটলার মতো চুল গজিয়েছে খাড়া হয়ে। কনুয়ের কাছে আঠা আঠা কি যেন লেগে রয়েছে। অ্যাপ্রনের নিচে টি শার্টটা ময়লা।

স্বাস্থ্য বিভাগ ওর খবর জানে কিনা ভাবি মাঝে মাঝে! নাক কুঁচকালেন মিস এমিনার। সে-ও ওদের একজন!

কাদের একজন? জানতে চাইলো রবিন।

অসভ্যদের! রবিনের দিকে ঝুঁকে খাটো গলায় বললেন মিস এমিনার। স্পীডওয়ের ওধারে ভাঙাচোরা বাড়ি আছে কয়েকটা, একটাতে থাকে ও। চোর ডাকাত, ফকির-টকিরের আজ্ঞা ওখানে। ওদেরকে দিয়ে সবই সম্ভব। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে থাকে…

থেমে গেলেন মিস এমিনার। শক্ত হয়ে গেছে ঠোঁট। ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন, অসভ্যের একশেষ একেকটা! বাপ-মা যে কোথায় ওদের, খোদাই জানে! কোথায় জন্ম, কোথায় বড় হয়, কে জানে! তারপর আর কোনো জায়গা না পেয়ে এসে ঢোকে এই ভেনিসে!

কাফে থেকে বেরিয়ে এলো হেনরি লিসটার। হাতে ট্রে। তাতে স্যাণ্ডউইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর কোকা কোলা। টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল। তার পেছনে গেল রাগবি ডিগার।

ডিগারকে, নিচু গলায় বললেন মিস এমিনার, দেখতে পারতো না কিটু।

কিশোর বললো, অনেকেই তো কিটুকে দেখতে পারে না, তার দুষ্টুমির জন্যে।

না না, আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না, তাড়াতাড়ি বললেন মিস এমিনার। চত্বরে যে কটা দোকান মালিক আছে, কিটুর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তাদের কারোই হাত নেই। প্যারেড শুরু হওয়ার সময় আমার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিস্টার মিউরোকে দেখেছি। রক মিউজিক পছন্দ করে যে মহিলা, মিস জারগন, তাকে দেখেছি। প্যারেড দেখতে চত্বরের দিকে এগোচ্ছিল ওরা। ব্রড ক্যাম্পারকেও দেখেছি। তার অ্যাপার্টমেন্ট আর গ্যালারির মাঝখানে পায়চারি করেছে কয়েকবার। তারপর কিটু আর ডবকে দৌড়ে ঢুকতে দেখলাম।

ও! হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠলো গোয়েন্দাপ্রধান। ওশন ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে। যাওয়ার পর তাহলে দেখেছেন! গুড! কি কি দেখেছেন?

বেশি কিছু না। ঠিক ওই সময় আমার চুলার টাইমারটা অফ হয়ে গেল। চুলায় কেক ছিলো। তাড়াতাড়ি নামাতে গেলাম। আবার জানালার কাছে ফিরে এসে কিটু বা ডব কাউকেই দেখলাম না। অন্তত চত্বরে ছিলো না তখন, এটা ঠিক। তবে রাগবি ডিগার ছিলো।

আবার বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে ডিগার। মিস এমিনারের শেষ কথাটা কানে গেল। তাঁর দিকে তাকিয়ে কুঁচকে গেল ভুরু। কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়ালো। আমি কি করেছি? তার এক হাতে ব্যাণ্ডেজ, কব্জির ঠিক ওপরে।

সামান্যতম চমকালেন না মিস এমিনার, নরম হলেন না। জবাব দিলেন, গতকাল প্যারেডের সময় দেখলাম মিস্টার মিউরোর দোকান থেকে বেরোচ্ছো। আমার কাছে সেটা অদ্ভুত লেগেছে। খেলনা কিংবা ঘুড়ির ব্যাপারে কোনোদিন। কোনো আগ্রহ দেখিনি তোমার। অবাক লেগেছে সে কারণেই। এরা কিটুকে খুঁজতে সাহায্য করছে, তিন গোয়েন্দাকে দেখিয়ে বললেন তিনি। ভাবলাম…

কি ভাবলেন! কি ভাবলেন? চেঁচিয়ে উঠলো ডিগার। আমি কিছু করিনি! আপনার কি মনে হয়, খেলনার লোভ দেখিয়ে ওকে ধরে নিয়ে গেছি? পাগল হয়ে গেছেন আপনি!

বারান্দায় বেরিয়ে এলো লিসটার। শুনে ফেলেছে কথা। কাল তুমি ঘুড়ির দোকানে ঢুকেছিলে?

ঢুকেছিলাম। একটা চীনা ঘুড়ির দাম, দেখতে। জানালার কাছে যেটা রেখেছিলো।

শুধু এ জন্যেই?

তাহলে আর কি জন্যে? আবার রেগে উঠলো ডিগার।

কড়া চোখে তার হাতের ব্যাণ্ডেজের দিকে তাকিয়ে মিস এমিনার বললেন, হাতে কি হলো? কুকুরে কামড়ে দিয়েছে, তাই না? আজ সকালে শেলির সঙ্গে বলছিলে, আমি শুনেছি। তোমার নিজের কুকুরে কামড়েছে?

আপনি….আপনি… রাগে কথা আটকে গেল ডিগারের।

আমি কি? নাক গলাচ্ছি? বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছি? হা, দেখাচ্ছি। দেখাবো, সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে মিস এমিনারকে।

দেখুন, বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। ভালো হবে না…

এই, চুপ করো! ধমকে উঠলো লিসটার। আর একটা কথাও বলবে না!

আহ্, কি আরম্ভ করলে তোমরা! শেলিও ধমক লাগালো। লোকে শুনলে কি বলবে! একটানে গা থেকে অ্যাপ্রনটা খুলে টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গটমট করে চত্বরে নেমে পড়লো সে। চলে যাবে।

 অ্যাপ্রনটা তুলে নিয়ে লিসটার বললো, মিস এমিনার, মাঝে মাঝে আপনি একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেন। আমিও করি। খেলনার দোকানে না হয় কাল ঢুকেইছে রাগবি, তাতে কি হয়েছে? অন্যায় তো কিছু করেনি।

দুজনেই বাড়াবাড়ি করি, তাই না? মুখ কালো করে বললেন মিস এমিনার। কোর্টের আশেপাশে যারা থাকে, সবারই জিনিসপত্র চুরি যাচ্ছে, তোমারও ক্যাশবাক্স থেকে টাকা চুরি হচ্ছে। এর পরও ডিগারকে ভালো বলবে?

ইয়ে…আমার আমতা আমতা করতে লাগলো লিসটার। মাথা ঝাঁকালো। তারপর কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে গিয়ে আবার ঢুকলো কাফের ভেতরে।

বিজেতার হাসি হাসলেন মিস এমিনার। স্বভাব কি আর সহজে বদলায় মানুষের। ডিগারই বা কি করে বদলাবে। যাকগে, কুকুরের কামড়ের কথায় আসা যাক। রাস্তার কয়েকটা নেড়ি কুত্তা গিয়ে বাস করে ওর সঙ্গে।

নেড়ি কুত্তা! মহিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো মুসা। তাহলে কামড়ে দিতেও পারে।

তা পারে। তবে সে সত্যি কথা বলছে কিনা কে জানে?

 চুপ করে মিস এমিনারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা।

ধরা যাক, নেড়ি কুত্তায় কামড়ায়নি, বলতে লাগলেন তিনি। হয়তো অন্য কোনো কুকুর, যেটার খুদে মনিবের ক্ষতি করতে যাচ্ছিলো ডিগার। ব্যস, মনিবকে বাঁচাতে কুকুরটা দিয়েছে ওকে কামড়ে। একটা কথা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে ডিগারের খুব ভাব। কি করে যেন চোখের পলকে খাতির করে ফেলে। কুকুর-বেড়াল সব কিছু। আগে কখনও তাকে কোনো কিছুতে কামড়েছে বলে শুনিনি।

এটাই আমাদের দেখাবেন বলেছিলেন? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। ডিগারের ব্যাণ্ডেজ?

মাথা ঝাঁকালেন মিস এমিনার।

হু, কিশোর বললো। বড় বেশি কাকতালীয়!

 কফির কাপে চুমুক দিলেন মহিলা। কাপটা নামিয়ে রেখে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তা ক্যাম্পারের সঙ্গে কেমন কাটলো?

আরও কিছু বলার আছে তার, বুঝতে পেরে চুপ করে রইলো কিশোর।

নিশ্চয় নিজের সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা দিতে চেয়েছে, মিস এমিনার। বললেন। তা-ই করে সব সময়। কাল টেলিভিশনের লোকের সামনে কি রকম বেহায়ার মতো গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, দেখোনি?

দেখেছি। হয়তো সত্যিই সাহায্য করতে চাইছে। এই ঘটনাটা ছেলেবেলার আরেকটা দুর্ঘটনার কথা নাকি মনে পড়িয়ে দিয়েছে তার। আপনি জানেন, ছেলেবেলায় তার এক বন্ধু হারিয়েছিলো? তারপর গর্তের পানিতে ভাসতে দেখা যায় ছেলেটার লাশ?

ওর বন্ধু? ন্যাপকিনে ঠোঁট মুছলেন মিস এমিনার। আমি তো শুনেছি ওর ছোট ভাই। এখন আবার বন্ধু হয়ে গেল কিভাবে? কি জানি, ভুলও শুনে থাকতে পারি। আর কিছু জানার আছে তোমাদের?

মাথা নাড়লো ছেলেরা। নেই। লাঞ্চ খাওয়ানোর জন্যে ধন্যবাদ জানালো। বারান্দা থেকে নেমে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলেন তিনি।

মৃদু শিস দিয়ে উঠলো মুসা। বাপরে বাপ, মহিলা বটে!

চত্বরে ঢুকলো একজন লোক। মলিন চেহারা। পরনের পোশাকটা বেটপ রকমের ঢলঢলে, বেমানান। একটা ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে আসছে। পেছনে আসছে একজোড়া মাংরল কুকুর। কাফের বারান্দার কাছে পৌঁছে কুকুর দুটোকে বসতে বললো লোকটা। বাধ্য ছেলের মতো সিঁড়ির গোড়ায় বসে পড়লো জানোয়ার দুটো। ঠেলাটা ওখানে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো লোকটা।

কয়েক মিনিট পরে কাফে থেকে বেরোলো সে। হাতে একটা বড় ঠোঙা। তার পেছনে বেরোলো হেনরি লিসটার। ঠেলা নিয়ে লোকটা সরে যাওয়ার পর বললো, জঞ্জালের মধ্যে নিশ্চয় কিছু কুড়িয়ে পেয়েছে বরগু। আট ডলারের পেস্ট্রি কিনে নিয়ে গেল। কল্পনাই করা যায় না!

মিস এমিনারের ঘরের দিকে তাকালো সে। গলা নামিয়ে বললো, ওই মহিলার ব্যাপারে সাবধান। যদি পছন্দ করে তোমাদের, ভালো। না করলে সর্বনাশ করে দেবে। সাংঘাতিক মহিলা!

লিসটার কাফেতে গিয়ে ঢুকলো।

মুসা বললো বিড়বিড় করে, সেটা আমরাও বুঝেছি। ডিগারকে যেভাবে। আক্রমণ করলো! জবাবই দিতে পারলো না বেচারা!

হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। আনমনে চিমটি কাটলো নিচের ঠোঁটে। কুকুরের দেখছি ছড়াছড়ি এখানে। বরগুর সঙ্গে কুকুর। ডিগারের সঙ্গে কুকুর। জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে তার এতো ভাব, তা-ও কামড় খেলো কুকুরের? কিটুর ছিলো। কুকুর। সেটা নিয়ে বেরোলো, তারপর গায়েব। কুকুরটাকে পাওয়া গেল। ডাস্টবিনে…।

বাধা দিয়ে বললো মুসা, ডিগারের ওপর চোখ রাখা দরকার, কি বলো?

অন্তত ওর ব্যাপারে আরেকটু খোঁজখবর নেয়া তো অবশ্যই দরকার, মুসার কথার পিঠে বললো রবিন। স্পীডওয়ের ওধারে ভাঙা বাড়িতে থাকে।…এসো, যাই।

.

০৭.

বাড়িটা খুঁজে বের করতে একটুও অসুবিধে হলো না। সামনের সিঁড়ির ওপর বসে। ঝিমোচ্ছে তখন ডিগার। মারমেড ইনের পেছনে এসে দাঁড়ানো ছেলেদের দেখতে পেলো না সে। চট করে একটা গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়লো ওরা।

 চুপ করে দেখছে তিন গোয়েন্দা। বেশ কিছুক্ষণ কিছুই ঘটলো না। নীরব হয়ে আছে ভাঙা বাড়িটা। তারপর স্পীডওয়ে ধরে এগিয়ে এলো একজন মানুষ। সঙ্গে একটা কুকুর। ওটার গলায় বাঁধা দড়ির এক মাথা ধরে রেখেছে। ডিগারের ঘরের পেছনে বেড়ার কাছ থেকে একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে ঘাউ ঘাউ করে উঠলো কয়েকটা

লাফ দিয়ে উঠলো ডিগার। চিৎকার করে বললো, এই চুপ চুপ! থাম! .

এক মুহূর্ত থমকালো আগন্তুক। তারপর কুকুরটাকে নিয়ে উঠে গেল ডিগারের বারান্দায়।

কী? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ডিগার।

কুকুর নিয়ে এসেছে যে লোকটা সে মাঝবয়েসী। ভদ্র। মাথা জুড়ে টাক। চোখে। ভারি পাওয়ারের চশমা। ডিগারের কর্কশ কণ্ঠ শুনে পিছিয়ে গেল এক পা। অস্বস্তি। জড়ানো কণ্ঠে বললো, শুনলাম, কুত্তা পছন্দ করো তুমি। তাই নিয়ে এসেছি। বীচফ্রন্ট মার্কেটের সামনে রাবিশ বিনে ঢোকার চেষ্টা করছিলো। ধরে নিয়ে এসেছি। নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে এটার।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কুকুরটাকে দেখলো ডিগার। দো-আঁশলা।

 কয় আঁশলা জানি না। তবে তুমি…

আমাকে দেখে কি মনে হয়? খেঁকিয়ে উঠলো ডিগার। কুত্তার দালাল? নাকি এতিম জানোয়ারের জন্যে এতিমখানা খুলেছি?

অবাক হয়ে গেল লোকটা। কিন্তু… ওরা যে বললো, কু-কুকুর পছন্দ করো। তুমি…

তাহলে ওদের কাছেই যাও! গজগজ করতে লাগলো ডিগার। কুত্তা আর কুত্তা!, এমন জানলে কে পালতো! যাও, যে চুলো থেকে এনেছো, সেখানেই নিয়ে ফেলে দাও! যাও!

ধমক খেয়ে পিছিয়ে এলো লোকটা। কুকুরটাকে নিয়ে আবার নামলো পথে। টেনে নিয়ে চললো।

হঠাৎ পুরানো বাড়ির বারান্দা থেকে ডাক শোনা গেল, এই রাগবি, কি হয়েছে?

কিছু না।

একটা মেয়ে বেরিয়ে এসেছে। বয়েস বিশ-বাইশ হবে। কালো চুল। পরনে স্কেটারদের পোশাক। স্কেটিং করতে যাচ্ছে বোধহয়। কিছু না মানে কি? শুনলাম তো চেঁচামেচি করছো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কি যেন। নাহ, তোমাকে। নিয়ে আর পারা যায় না। কতো আর মিথ্যে বলবে?

এই চুপ, চুপ, আস্তে! দ্রুত চারপাশে চোখ বোলালো ডিগার।

ছেলেটার খোঁজ নিতে পুলিশ এসেছিলো। তোমার কুত্তাগুলোর কথা জিজ্ঞেস করলো। মিথ্যে বললাম। এখন দুর্ব্যবহার করে লোকটাকে তাড়ালে। সে কি ভাববে? রেখে দিলে কি এমন হতো?

কি হতো না হতো সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে মাতব্বরি করতে বলেছে।

দেখো, ধমক দিয়ে কথা বলবে না আমার সঙ্গে! মেয়েটাও রেগে গেল। আর আমি থাকছি না এখানে। মিথ্যে কথা বলার দায়ে শেষে আমাকেও নিয়ে গিয়ে গারদে ভরবে পুলিশ।

দুপদাপ করে গিয়ে ঘরে ঢুকলো মেয়েটা। জানালা দিয়ে শব্দ আসছে। তিন গোয়েন্দার কানে এলো, কাঠের সিঁড়িতে পা ফেলার মচমচ আওয়াজ। দুড়ুম-দাডুম আওয়াজ হলো এরপর। নিশ্চয় ড্রয়ার টানাটানি করছে। খানিক পরেই আবার বেরিয়ে এলো মেয়েটা। আঁটো পোশাকের ওপর ঢেলা, লম্বা হাতাওয়ালা গাউনের মতো পোশাক চাপিয়েছে।

এই, নরিনা… বলতে গিয়ে বাধা পেলো ডিগার।

আমি আর এসবের মধ্যে নেই, হাতে একটা বেতের ঝুড়ি নরিনার। সেটাতে জিনিসপত্র উপচে পড়ছে। তার মানে যথাসর্বস্ব যা ছিলো, সব নিয়ে চলে যাচ্ছে সে। সিঁড়ি বেয়ে গিয়ে রাস্তায় নামলো।

মেয়েটাকে চলে যেতে দেখলো ডিগার। পার্কিং লটের দিকে ফিরতে চোখ। পড়লো ছেলেদের ওপর। এই, এই কি চাও তোমরা?

আর লুকিয়ে থেকে লাভ নেই। বেরিয়ে এলো কিশোর। স্পীডওয়ে পেরিয়ে এগোলো বাড়িটার দিকে। তাকে অনুসরণ করলো রবিন আর মুসা। ভাবছি, আমা দেরকে সাহায্য করতে পারবেন, কিশোর বললো। আপনি হয়তো জানেন..

ছুঁচোগিরি করতে এসেছো! জলদি ভাগো! নইলে কুত্তা লেলিয়ে দেবো। যত্তোসব! রাগে গরগর করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ডিগার। কিশোরের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল মেয়েটা যেদিকে গেছে সেদিকে।

পিছু নেবো নাকি? নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করলো কিশোর।

নেয়া উচিত, মুসা বললো। মেয়েটার কথা শুনলে তো? পুলিশের ভয়েই পালাচ্ছে। তারমানে কিছু একটা অন্যায় করেছে।

শোনো, শোনো, ওদেরকে থামালো রবিন। বাড়িটায় আরও কেউ আছে।

কান পাতলো তিনজনেই। একটা লোকের গলা শোনা গেল। কথা বললো, থামলো, তারপর আবার বলতে লাগলো।

নিশ্চয় টেলিফোন, রবিন বললে আবার। এক কাজ করো। তোমরা। ডিগারের পিছু নাও। আমি থাকি। দেখি, কে বেরোয়?

 কথাটা পছন্দ হলো কিশোরের। মুসাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা হলো। প্যাসিফিক অ্যাভেনিউর দিকে। দক্ষিণে অনেকখানি এগিয়ে গেছে ততোক্ষণে ডিগার। নতুন কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আর একটা বোট ম্যারিনা আছে ওদিকে। দূর থেকে তাকে অনুসরণ করলো কিশোর আর মুসা।

মারমেড কোর্ট থেকে আধমাইল দূরে ছোট একটা মার্কেটে ঢুকলো ডিগার।

দুর, লাভ হলো না, মুসা বললো। খাবার-টাবার কিনবে বোধহয়।

হয়তো। দেখা যাক।

মার্কেটের পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। কাঁচের পাল্লার ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছে ডিগারকে। গোশতের বাক্স থেকে কিছু নিয়ে সোজা স্ট্যাণ্ডের কাছে। চলে গেল সে।

চট করে একটা গাড়ির আড়ালে বসে পড়লো দুজনে। বেরিয়ে এলো ডিগার। আবার দক্ষিণে এগোলো, ম্যারিনার দিকে। কিছু দূর এগিয়ে মোড় নিয়ে একটা গলিতে ঢুকলো। এগোলো একটা রেস্টুরেন্টের দিকে।

রেস্টুরেন্টটার নাম মুনশাইন। বেশ উঁচু দরেরই মনে হচ্ছে। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল মার্সিডিজ, ক্যাডিলাক আর জাগুয়ার গাড়ি। ওগুলোর। মাঝখান দিয়ে এগোলে ডিগার। মাঝে মাঝে থেমে লাথি মারে গাড়ির টায়ারে।

ব্যাটা টায়ার চোর! মন্তব্য করলো মুসা। ভালো চাকা খুঁজছে।

আমার মনে হয় না। দেখো।

একটা হুডখোলা কনভারটিবলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ডিগার। সীটের ওপর একটা সেইন্ট বার্নার্ড কুকুর বসে আছে। গলার শেকলটা স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে বাধা। কুকুরটার চোখে চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ ডিগার। তারপর কথা বলতে আরম্ভ করলো।

উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগলো কুকুরটা।

হাতের ব্যাগ থেকে গোশত বের করে ওটার দিকে বাড়িয়ে ধরলো ডিগার। গোশত শুঁকল সেইন্ট বার্নার্ড। চাটলো। তারপর খেতে শুরু করলো।

কুত্তা চোর! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।

চুপ করে রইলো কিশোর। দেখছে।

দেখতে দেখতে কুকুরটার সঙ্গে খাতির করে ফেললো ডিগার। গাড়ির দরজা খুলে শেকল খুলতে শুরু করলো।

আর চুপ করে থাকতে পারলো না মুসা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঢুকে পড়লো রেস্টুরেন্টের ভেতর। প্রথমে আবছা অন্ধকার একটা হলওয়ে। তারপরে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত ডাইনিং রুম। দরজার ভেতরে। দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো সে, এই যে শুনছেন? বার্নার্ড কুকুরটা কার? চুরি করে। নিয়ে যাচ্ছে তত!

ঘরের একধারে চেয়ারে বসা একজন লালমুখো মানুষ লাফ দিয়ে উঠে এলো। মুসার পাশ কাটিয়ে দমকা হাওয়ার মতো বেরিয়ে চলে গেল।

রাস্তায় নেমে পড়েছে তখন ডিগার। ব্যাগের গোশতের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে খুশিমনে তার পাশে পাশে চলেছে কুকুরটা।

 পিছু নেয়ার চেষ্টাও করলো না কুকুরের মালিক। দুই আঙুল মুখে পুরে সিটি বাজালো।

থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালো বিশাল কুকুরটা।

আবার সিটি বাজালো লোকটা।

হঠাৎই ডিগারের ব্যাপারে সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে ফেললো যেন সেইন্ট বার্নার্ড। দৌড় দিলো মনিবের দিকে।

হাত থেকে শেকলটা খুলে ফেলার চেষ্টা করলো ডিগার। পারলো না। শক্ত করে পেঁচিয়ে নিয়েছিলো শেকলের এক মাথা, টান লেগে আরও শক্ত হয়ে এঁটে গেল। হ্যাঁচকা টানে পেছনে বাঁকা হয়ে গেল তার শরীর। চিৎকার করে সামলানোর চেষ্টা করলো কুকুরটাকে। পারলো না। রাস্তায় চিত হয়ে পড়ে গেল সে। তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চললো সেইন্ট বার্নার্ড।

এই থাম! চেঁচিয়ে চলেছে ডিগার, এই থাম…

অবশেষে কব্জির প্যাঁচ খুলে গেল। গড়িয়ে গিয়ে একটা ল্যাম্প পোস্টে বাড়ি লেগে থেমে গেল ডিগারের দেহটা।

বড় বড় কয়েক লাফে পার্কিং লট পেরিয়ে গিয়ে মনিবের ওপর প্রায় আঁপিয়ে পড়লো কুকুরটা। তার হাত চাটতে শুরু করলো।

 কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো ডিগার। সারা গায়ে ধুলো আর মাটি। কাপড় ছিঁড়েছে। কয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে চামড়া। শাই করে রাস্তার মোড় ঘুরে তার পাশে এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলো একটা পেট্রোল কার। লাফ দিয়ে নেমে এলো একজন পুলিশ অফিসার। এই, কি হয়েছে তোমার? ব্যথা পেয়েছো?

দৌড় দিলো ডিগার। পার্কিং লট থেকে চলে গেল পানির ধারে। একটা মুহূর্ত দ্বিধা করলো না। ঝাঁপ দিয়ে পড়লো পানিতে। অফিসারকে বোকা বানিয়ে সাঁতরে চললো খোলা সাগরের দিকে।

কুকুরের মনিবের পাশ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে এলো মুসা। কিশোরের দিকে এগোলো। একটা মার্সিডিজের গায়ে হেলান দিয়ে হো হো করে হাসছে গোয়েন্দা প্রধান। হাসতে হাসতে পানি বেরিয়ে গেছে চোখ দিয়ে। তার হাসিটা সংক্রমিত হলো মুসার মধ্যে। বললো, দারুণ একটা খেল দেখালো! একেবারে পানিতে ফেলে ছেড়েছে। কদ্দিন পর গোসল করলো কে জানে!

হাসি কমে এলো অবশেষে কিশোরের। জোরে জোরে দম নিয়ে বললো, এসো, যাই। রবিন কি করছে দেখিগে। বলেই আবার হা হা করে হেসে উঠলো।

.

০৮.

 পার্কিং লটে একটা গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে রবিন। খোলা জানালা দিয়ে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, কিন্তু কথা বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু এগিয়ে যাবে? বাড়ির সামনের সিঁড়িতে গিয়ে বসবে? নাকি পেছনের বেড়ার ভেতরে চলে যাবে?

ঠিক এই সময় একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো কুকুরগুলো। নাহ্, ভেতরে ঢোকা অসম্ভব। কিছু একটা দেখে চিৎকার করছে ওগুলো।

সামান্য সরতেই ট্রাকটা, চোখে পড়লো রবিনের। বাড়ির পাশের ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা, বেড়ার বাইরে, একটা খোলা জায়গার ঠিক নিচে।

ট্রাকের পেছনে বস্তা আর বিছানার পুরানো গদি ফেলে রাখা হয়েছে কয়েকটা। নিশ্চয় কাঁচের জিনিসপত্র বহন করে ট্রাকটা। গদি আর বস্তার ওপর সাজিয়ে রাখা হয় যাতে না ভাঙে। নোঙরা, ময়লা গদিগুলো। কিন্তু দ্বিধা করার সময় নেই। একছুটে চলে এলো ট্রাকের পেছনে। উঠে পড়লো। লুকিয়ে পড়লো একটা গদির তলায়।

হ্যাঁ, বাড়ির ভেতরের লোকটার কথা এখন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে রবিন। লোকটা উন্মাদ। কি যে করে বসবে ঠিক নেই। সর্বনাশ হয়ে যাবে তখন। সে। জন্যেই আরেকটা জায়গা খুঁজছি। এরই মধ্যে দুবার ঘুরে গেছে পুলিশ। জেনে যাবেই।

একটু বিরতি দিয়ে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো লোকটা, বড় ব্যাপার নয় মানে! অনেক বড় ব্যাপার! রাবিশ বিনে ফেলে রাখা কুত্তাটার কথা শোনোনি?

শক্ত হয়ে গেল রবিন। ডবের কথা বলছে।

আরে ঠিকই আছি আমি, ঠিকই আছি, বলে যাচ্ছে লোকটা। পাগল হইনি। যা-ই বলো, আমি থাকছি না। এখন যাচ্ছি, কিছু টাকা জোগাড় করতে পারি কিনা, দেখি। দরকার আছে।

আবার নীরবতা। তারপর লোকটা বললো, ঠিক আছে। যা হয় হবে। স্লেভ মার্কেট তো আছেই।

অবাক হলো রবিন। স্লেভ মার্কেট?

রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো। শুয়েই আছে রবিন। দরজা লাগানোর আওয়াজ হলো। তারপর বারান্দায় পদশব্দ।

শঙ্কিত হলো রবিন। লোকটা পেছনে আসবে না তো? না, এলো না। ট্রাকের দরজা খুলে উঠে বসলো একজন। গর্জে উঠলো ইঞ্জিন। ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করলো ট্রাক। ড্রাইভওয়ে থেকে রাস্তায় এসে উঠলো, বোঝা গেল।

অস্থির ভাবনা চলেছে রবিনের মাথায়। একবার ভাবলো লাফিয়ে পড়ে। পরে ভাবলো, দেখাই যাক না কোথায় যায়? লোকটা কে? ডিগারের রুমমেট? বিপদের আশঙ্কা করছে লোকটা, টেলিফোনে তার আলাপ থেকেই বোঝা গেছে। কার কাছ থেকে বিপদ? ডিগার? কিটুর ব্যাপারে কি কিছু জানে? তার আচরণ নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক।

নিশ্চয় এখন রহস্যময় স্লেভ মার্কেটে চলেছে লোকটা। হয়তো ওখানে কিটুর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সূত্র পাওয়া যাবে।

ট্রাক চলেছে। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে মুখ বের করে দেখছে রবিন। শহরের রাস্তা, দোকান-পাট চোখে পড়ছে। সব অপরিচিত।

অবশেষে থামলো ট্রাক। ইজ্ঞিন বন্ধ হলো। ড্রাইভার বেরিয়ে যাওয়ার সময় মচমচ শব্দ উঠলো ট্রাকের সামনের অংশে।

লোকটা কি পেছনে আসবে? লাফিয়ে উঠে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়ার জন্যে তৈরি হলো রবিন।

কিন্তু এবারেও পেছনে এলো না লোকটা। তার পদশব্দ সরে যেতে লাগলো। যানবাহনের আওয়াজ কানে আসছে। বেশ ভিড়। আস্তে মাথা তুলে ট্রাকের পাশ দিয়ে উঁকি দিলো রবিন। চওড়া একটা জায়গার মধ্যে দিয়ে অনবরত আসছে যাচ্ছে। নানারকম গাড়ি। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি দোকানপাট। পথের পাশে এক জায়গায় জটলা করছে কিছু লোক। প্রায় সবাই বিশাল দেহী, পরনে কাজের পোশাক। কারো কারো পায়ে ভারি বুট, কারো মাথায় শক্ত হ্যাট। কালো চামড়ার লোক আছে, বাদামী চামড়ার আছে, বিভিন্ন দেশের মানুষ ওরা।

পথের মোড়ে একটা গাড়ি এসে থামলো। দ্রুত কয়েকজন লোক গিয়ে। ড্রাইভারকে ঘিরে দাঁড়ালো, কথা শুরু করে দিলো একসঙ্গে। এই সুযোগে টুক করে নেমে পড়লো রবিন। সরে গেল ট্রাকের কাছ থেকে।

শখানেক গজ দূরে একটা নিচু দেয়াল দেখে তার ওপর উঠে বসলো। কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগলো লোকগুলোকে।

একটু পর পরই এসে মোড়ের কাছে গাড়ি থামছে। জটলার মধ্যে থেকে কিছু লোক যাচ্ছে বসা লোকের সঙ্গে কথা বলতে। কোনো কিছু নিয়ে মনে হয় দর কষাকষি করছে। কথায় বলে উঠে বসছে গাড়িতে, না বলে সরে আসছে।

একজন লোক এসে রবিনের পাশে বসলো। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আপনমনেই মাথা নাড়লো। তারপর তাকালো রবিনের দিকে, এই ছেলে, কি চাই তোমার এখানে? কাজ?

বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলো রবিন। আমি এই হাঁটতে হাঁটতে…ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটু জিরিয়ে নিচ্ছি। আপনি কি কাজ খুঁজতে এসেছেন?

মাথা ঝাঁকালো লোকটা। আমরা সবাই সে জন্যেই এসেছি। এটা স্লেভ মার্কেট। নাম শোনোনি?

 না। সাংঘাতিক কাণ্ড! দাস ব্যবসা কি এখনও হয় নাকি?

 হাসলো লোকটা। আরে না না, ওরকম কিছু না। শ্রমিকরা আসে এখানে। কাজের জন্যে। দাঁড়িয়ে থাকে। যাদের কাজ করানো দরকার, তারাও আসে, দামদর করে লোক নিয়ে যায়। হয়তো দেয়াল ধোয়ানোর দরকার পড়লো তোমার, বাগানের ঘাস সাফ করানো দরকার পড়লো, চলে আসবে স্লেভ মার্কেট। লোক পেয়ে যাবে।

 ডেনিম শার্ট আর রঙচটা জিনস পরা মোটা একজন লোক জটলা থেকে বেরিয়ে হেঁটে গেল ট্রাকটার কাছে। সামনের দরজা খুলে এক প্যাকেট সিগারেট বের করলো। ভেতর থেকে। তারপর আবার গিয়ে দাঁড়ালো জটলায়। রবিন আন্দাজ করলো, এই লোকটাই ডিগারের রুমমেট।

মোড়ের কাছে এসে থামলো একটা নীল বুইক। বেরিয়ে এলো একজন লোক। বেশ ভালো স্বাস্থ্য, ধূসর পুরু গোঁফ। পরনে হালকা রঙের স্ন্যাকস, গায়ে গাঢ় রঙের শার্ট। মাথায় নাবিকের টুপি। চোখে কালো চশমা।

দেখলে? রবিনকে বললো তার পাশে বসা লোকটা। এখানে প্রায়ই আসে ও। এমন শ্রমিক ভাড়া করে নিয়ে যায়, যার ট্রাক আছে।

ডিগারের রুমমেটের কাছে এগিয়ে গেল টুপিওয়ালা। কথা বলতে লাগলো– দুজনে। অবশেষে মাথা ঝাঁকালো রুমমেট। নিজের ট্রাকে গিয়ে উঠলো। নীল গাড়ির পেছনে পেছনে চালিয়ে চলে গেল।

নিয়ে গেল, বললো রবিনের সঙ্গী।

আনমনে মাথা ঝাঁকালো রবিন। খুব হতাশ হয়েছে। ভেবেছিলো এখানে এসে কোনো জরুরী সূত্র পেয়ে যাবে। ওসব কিছুই পায়নি, শুধু জানলো স্লেভ মার্কেটে শ্রম বেচাকেনা হয়। আর বসে থেকে লাভ নেই। দেয়াল থেকে নেমে রাস্তা ধরে এগোলো। সৈকত থেকে কয়েক মাইল দূরে এই জায়গা, মোড়ের একটা সাইন বোর্ড দেখে বুঝলো। জায়গাটার নাম ল্যাব্রিয়া।

.

০৯.

 কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

মারমেড কোর্টে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে সে আর কিশোর।

সব খুলে বললো রবিন।

হু, কিশোর বললো, স্লেভ মার্কেটের কথা আমিও শুনেছি। আমাদের কেসের সাথে বোধহয় সম্পর্ক নেই এর। একটা ব্যাপার বোঝা গেল, ডিগারের ঘরে আরও লোক থাকে। কিটুর হারানোর পেছনে ওদের কোনো হাত না থাকলেও হয়তো। ডিগারের আছে।

আচ্ছা, মুসা বললো, ওই পুরানো বাড়িটাতে আটকে রাখেনি তো কিটুকে?

মাথা নাড়লো রবিন। মনে হয় না। পুলিশকে ভীষণ ভয় পায় ডিগারের রুমমেটরা। কিটুকে ওখানে নিয়ে গেলে বহু আগেই পালাতো ওরা। নাহ্, কিটু নেই ওখানে। তবে আমার মনে হচ্ছে কুকুরগুলো সাধারণ কুকুর নয়।

হতেও পারে, কিশোর বললো। সেইন্ট বানার্ডটা চুরি করতে গিয়ে কি রকম হেনস্তা হয়েছে ডিগার, রবিনকে বললো সে। আবার হাসতে আরম্ভ করেছে।

হাসলো মুসাও। বললো, লোকটার অবস্থা যদি তখন দেখতে!

হাসি মুছতে পারছে না কিশোরও। বললো, যথেষ্ট হয়েছে, চলো বাড়ি যাই। হেডকোয়ার্টারে কাজ আছে।

বুকশপের সামনে থেকে পার্ক করা সাইকেলের তালা খুলছে ওরা, এই সময় সৈকতের দিক থেকে এলো ব্রড ক্যাম্পার। তিন গোয়েন্দাকে দেখেই ভারিক্কি করে তুললো চেহারা। জিজ্ঞেস করলো, খবর আছে?

না, এখনও কিছু পাইনি, জবাব দিলো কিশোর।

দরজায় এসে দাঁড়ালো নিনা হারকার।

সহানুভূতি দেখিয়ে তাকে বললো ক্যাম্পার, এতো ভয় পেও না। ছেলেটা দুষ্টুমি বেশি করে তো, হয়তো তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যেই এখন কোথাও গিয়ে লুকিয়েছে। নির্জন দ্বীপে বন্দি লং জন সিলভার। বইটা পড়েছে নিশ্চয়?

না, পড়িনি, মাথা নাড়লো নিনা।

তাই? তাহলে হয়তো পু সেজেছে, চলে গেছে উত্তর মেরুতে। কিংবা বাক রোজার সেজে উড়ে গেছে অন্য কোনো গ্রহে। যা উল্টোপাল্টা কল্পনা না তোমার ছেলের। অবশ্য যদি কোথাও চিত হয়ে… চুপ হয়ে গেল ক্যাম্পার।

বুঝে ফেলেছে ছেলেরা। ও বলতে চেয়েছে কোথাও চিত হয়ে যদি পানিতে না ভাসে।

রক্ত সরে গেল নিনার মুখ থেকে। তাকিয়ে রয়েছে ক্যাম্পারের দিকে।

ওহহো, তাড়াতাড়ি বললো ক্যাম্পার, দেখো, কি বলতে কি বলে ফেললাম। কখন যে মুখ ফসকে যায়। আসলে..আসলে..ছোটবেলায় দেখেছি তো ভুলতে পারি না। আমার ছোট ভাইটা খেলতে খেলকে গিয়ে…এরপর থেকে বাচ্চা ছেলে হারালেই আমার ওই এক ভয়। কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে, কিছু মনে করো না।

চুপ করে রইলো নিনা। দুচোখ থেকে গাল বেয়ে নেমে আসছে পানি।

আর কিছু বললো না ক্যাম্পার। গ্যালারির দিকে রওনা হলো।

.

সেদিন বিকেলে হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা।

রবিন আর মুসা ঢুকে দেখলো, ট্রেলারের বুক শেলফ বই ঘটছে কিশোর ওদেরকে দেখে মুখ ফেরালো।

রেফারেন্স বই খুঁজছি পুরানো সিনেমার ওপর।

কিশোরের সিনেমা-প্রীতির কথা জানা আছে অন্যদের। চুপ করে রইলো।

গত বসন্তে হলিউডের সানডাউন থিয়েটারে পুরানো কিছু ব্যারি ব্রীম ছবি দেখিয়েছিলো, কিশোর বললো। ব্রীমের কথা মনে আছে? হেনরী হকিনস সিরিজে গোয়েন্দার অভিনয় করেছিলো।

মুখ বাঁকালো মুসা। কি যে বলো। তখন তো জন্মই হয়নি আমাদের, দেখবো কি করে?

জন্মের আগের ছবি জন্মের পরে দেখতে অসুবিধে হয় না। যাকগে, ব্রীমের কিছু ছবিকে এখন ক্লাসিক হিসেবে ধরা হয়। চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় ওই ছবি। একটা ছবির কাহিনী ছিলো একটা ছেলেকে নিয়ে, যে দশ লাখ ডলারের মালিক। হয়েছিলো উত্তরাধিকার সূত্রে। তার পর পরই একটা ডোবায় তার লাশ ভাসতে দেখা যায়। এরপর একের পর এক খুন হতে থাকে মানুষ। উত্তরাধিকার সূত্রে ওই টাকা যার হাতেই যায় সে-ই খুন হয়ে যায়।

ডোবায় ভাসছিলো? ভুরু কোঁচকালো মুসা।

ব্রড ক্যাম্পারের ভাইয়ের মতো! বললো রবিন।

কিংবা তার বন্ধুর মতো, কিশোর বললো। কোনটা সত্যি সে-ই জানে। বই ঘাটছি সে জন্যেই। ব্রীমের ছবির কোনো স্টিল মেলে কিনা দেখছি।

শেলফ থেকে পুরানো একটা বই নামিয়ে আনলো কিশোর। ডেস্কের ওপর রেখে পাতা ওল্টাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর থেমে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, এই তো, পেয়েছি!

ছবিটার নাম স্ক্রীম ইন দা ডার্ক। একটা রহস্য কাহিনী নিয়ে করা। বইয়ের। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ডোবায় ভাসছে একটা বাচ্চা ছেলের লাশ। পাড়ে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে সেটা দেখছে একজন আর্দালী।

দেখার জন্যে কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে এলো মুসা আর রবিন।

আরেকটা ছবিতে দেখা গেল, ডোবার পাড়ে এসে ভিড় করেছে অনেক লোক। পানির একেবারে ধারে বসে লাশটাকে ধরার জন্যে হাত বাড়িয়েছে আৰ্দালী। ধরতে তাকে বাধা দিচ্ছে ডিটেকটিভ হেনরী হকিনস, অর্থাৎ ব্যারি ব্রীম। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুলিশ। একজনের বয়েস খুবই কম-কিশোরই বলা চলে। মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়েছে সে। বেশ সুন্দর চেহারা।

খাইছে! এ তো ব্রড ক্যাম্পার!

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আমার মনে হচ্ছিলো, এই ছবিতেই ক্যাম্পারকে দেখেছি। তাই বই বের করলাম, শিওর হওয়ার জন্যে।

লোকটা মিথ্যুক! বিরক্তিতে কুঁচকে গেল ররিনের নাক। না ছিলো ছোট ভাই। তার, না ছিলো বন্ধু। গল্পটা বলেছে ও, কারণ-কারণ… বলতে না পেরে থেমে গেল সে।

রহস্যটা এখানেই, আনমনে বললো কিশোর। এরকম গল্প কেন বলতে গেল। ক্যাম্পার? তার নিজের জীবনে সত্যি সত্যি ঘটেনি তো ও রকম কিছু?

 আল্লাহই জানে, হাত ওল্টালো মুসা। কিন্তু বেশি কাকতালীয় হয়ে যাবে না?

তা হবে। যদি মিথ্যেই বলে, তাহলে পুরানো একটা ছবির গল্প চুরি করে বলতে যাবে কেন?

রহস্যই! মাথা দোলালো রবিন। একটা কারণ হতে পারে। ছবির ওই দৃশ্যটা বোধহয় তার খুব মনে ধরেছিলো। কিটুর ওপর সেটা চালিয়ে দিয়ে এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছে। ওরকম স্বভাবের লোক আছে।

কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিশোর, এই সময় টেলিফোন বাজলো। রিসিভার তুলে নিলো কিশোর, বলুন?

কিশোর পাশা?

মিস এমিনার! প্রায় চিৎকার করে বললো কিশোর। অবাক হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফোনের লাইনের সঙ্গে লাগানো স্পীকারের সুইচ অন করে দিলো। যাতে রবিন আর মুসাও শুনতে পারে।

নিনার কাছে তোমাদের ফোন নম্বর পেয়েছি। ইন্টারেসটিং নিউজ আছে। পুলিশকে বলতে পারতাম, কিন্তু ওরা গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয় না। তাই তোমাদেরকেই ধরলাম।

কি হয়েছে?

ওশন ফ্রন্টে হাঁটতে গিয়েছিলাম। ব্রড ক্যাম্পারকে দেখলাম গ্যালারি থেকে বেরিয়ে আসছে, হাতে একটা কাগজের লম্বা প্যাকেট।

বলুন বলুন!

তার আচরণ ভালো লাগেনি আমার। উসখুস করছিলো, আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। দেখেও না দেখার ভান করলাম। মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলাম সাগরের দিকে।

তারপর?

ভেনিস পিয়ারের দিকে চলে গেল সে। পিছু নিলাম।

তারপর?

কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। এমন ভান করলো, যেন সূর্যাস্ত দেখছে। তারপর আরেকটু এগিয়ে পিয়ারের আড়ালে চলে গেল। আবার যখন বেরিয়ে এলো, দেখি হাতের প্যাকেটটা নেই।

কি ধরনের প্যাকেট? কতো ভারি হবে? কি রকম…

কিটুর লাশ ছিলো ভাবছো তো? না, তা নয়। বেশি বড় না, ভেতরে অন্য কিছু ছিলো।

কি ছিলো?

সেটা জানতে হবে তোমাদের।

নিনাকে কিছু বলেছেন?

মাথা খারাপ! বয়েস হয়েছে বটে, কিন্তু চিন্তা-ভাবনা এখনও ভালোই করতে পারি।

আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারেন, কি ছিলো ভেতরে?

নাহ!… ঠিক আছে, রাখলাম।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস এমিনার।

লাইন কেটে গেল।

যাক, খুশি হয়ে বললো মুসা, স্কুবা ডাইভিঙের একটা সুযোগ বোধহয় মিললো। বস্তাটা নিশ্চয় পানিতে ফেলেছে ব্যাটা।

.

১০.

পরদিন সকালে সৈকতে পৌঁছলো তিন গোয়েন্দা। রোলস রয়েসে করে ওদেরকে নিয়ে এসেছে হ্যানসন। ধূসর, কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। লোকজন বেশি নেই ওশন ফ্রন্টে।

পরে ভিড় হবে, হ্যানসনকে বললো কিশোর। এখন অল্প আছে। সুবিধেই হয়েছে আমাদের।

পিয়ারের পার্কিং লটে গাড়ি ঢোকালো হ্যানসন। পেছনের সীটে হেলান দিয়ে আছে মুসা। গাড়ি থামতেই ডুবুরির পোশাক পরতে আরম্ভ করলো। বেরোলো গাড়ি থেকে। তার পিঠে এয়ার ট্যাংক বাঁধতে সাহায্য করলো রবিন আর কিশোর। পরে মুখে মাউথপীস লাগিয়ে পানিতে নেমে গেল মুসা।

ও কয়েক ফুট যেতে না যেতেই কনুই দিয়ে কিশোরের গায়ে গুতো দিলো রবিন। হাত তুলে দেখালো।

ওশন ফ্রন্টে এসে হাজির হয়েছে ডিগারের রুমমেট। সৈকতের পিজা স্ট্যাণ্ডের। কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। পিজা আর সফট ড্রিংক দিয়ে নাস্তা করছে।

আশ্চর্য! অবাক হয়ে বললো হ্যানসন। এই সময়ে পিজা!

আরেক দিক থেকে ঠেলা ঠেলতে ঠেলতে এসে উদয় হলো বরগু। পেছনে আসছে নিতান্ত বাধ্য ছেলের মতো কুকুর দুটো। পিজা স্ট্যাণ্ডের কাছে এসে? কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো সেলসম্যানকে ইশারা করলো সে।

পিজা শেষ করে কাউন্টারের কাছ থেকে সরে এলো রুমমেট। স্পীডওয়ের দিকে চললো।

এই, মূসার ওপর চোখ রাখার দরকার নেই, রবিন বললো। আমি যাচ্ছি ওর পিছে। দেখি কোথায় যায়?

সাগরের দিকে তাকালো আবার কিশোর। ডুব দিচ্ছে মুসা। মুহূর্তে তলিয়ে গেল মাথাটা।

ঠিক আছে, রবিনকে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, যাও। হুশিয়ার থাকবে। ওরা কতোটা খারাপ লোক জানি না এখনও। সাবধান!

থাকবো। এগিয়ে গেল রবিন। পিজা স্ট্যাণ্ডের পাশ কাটাচ্ছে সে, এই সময় বেরিয়ে এলো বরগু। হাতে একটা কাগজের ঠোঙা। ঠেলা গাড়িতে ঠোঙাটা রেখে। গাড়ি ঠেলে নিয়ে এগোলো আবার যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে।

রবিনের সাহায্য লাগবে? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো হ্যানসন। যাবো নাকি ওর পেছনে?

হাসলো কিশোর। গোয়েন্দাগিরি করে হ্যানসনও আনন্দ পায়, সেজন্যেই যেতে চাইছে। বললো, লাগবে না।

হতাশ মনে হলো শোফারকে। মারমেড কোর্টের ওধারে হারিয়ে গেল রবিন। মুসার দিকে নজর ফেরালে কিশোর আর হ্যানসন। পানির ওপরে দেখা যাচ্ছে একসারি বুদবুদ, মুসা কোন দিকে চলছে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

.

ধীরে ধীরে সাঁতরে চলছে মুসা, তলদেশের সামান্য ওপর দিয়ে। পানি তেমন পরিষ্কার না। ঘোলা। ক্যাম্পারের ছুঁড়ে দেয়া প্যাকেটটা এই পানিতে খুঁজে বের করতে পারবে কিনা সন্দেহ হলো তার। তাছাড়া পরিত্যক্ত জিনিসের অভাব নেই। এখানে। বোতল, ক্যানেস্তারা, আরও হাজারো রকম জিনিসে বোঝাই হয়ে আছে সাগরের তলদেশ। একটা চটের পোটলা দেখে সেটা ধরে টান দিলো সে। বেরিয়ে। পড়লো বাতিল একটা ডুবুরির পোশাক। সেটা ছেড়ে আবার আগে বাড়লো সে।

পিয়ার বায়ে রেখে এগোচ্ছে মুসা।

হঠাৎ একটা নড়াচড়া টের পেয়ে মাথা ঘোরালো। ডানে নড়ছে কিছু। তলদেশ ধরে যেন ঠেলে এগিয়ে এলো কিছুদূর ওটা, তারপর ওপরে উঠলো। —

হাঙর।

বিশাল হাঙরের হাঁ করা মুখে তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি দেখতে পেলো মুসা। অলস ভঙ্গিতে সঁতরাচ্ছে, কোনো তাড়া নেই। থেমে গেছে মুসা। নিঃশ্বাস বন্ধ করে। ফেলেছে। একেবারে স্থির হয়ে ভাসছে। হাঙর সম্পর্কে নানারকম তথ্য ভিড় করে। আসছে মনে।–

কোনো কোনো হাঙর মানুষ দেখলেই আক্রমণ করে। তবে বেশির ভাগই করে। এটা কি করবে? অনেক সময় জোর শব্দ কিংবা চিৎকার শুনলে ঘাবড়ে গিয়ে। সরে যায় হাঙর।

জোর শব্দ? এমন শব্দ বলতে একমাত্র মুসার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি। দশ ফুট পানির তলায় কি করে জোরালো আওয়াজ করবে? চিৎকার করতে পারবে না। পানির ওপরে যেমন হাত নেড়ে দাপাদাপি করে শব্দ করা যায়, নিচে সেটাও পারা যায় না।

একটা পাথরের দিকে আস্তে হাত বাড়ালো মুসা। তুলে নিলো। আরেকটা লাগবে। দুটো ঠোকাঠুকি করলে শব্দ হবে, কিন্তু তাতে কি পালাবে হাঙর?

 আওয়াজ না করলে কিছু বোঝা যাবে না। কে জানে, ওই আওয়াজে না পালিয়ে রং রেগে গিয়ে এসে আক্রমণ করে বসবে!

কিন্তু চেষ্টা তো করে দেখতে হবে। আবার হাত বাড়ালো মুসা। হাতে। লাগলো গোল, শক্ত একটা জিনিস।

দুঃস্বপ্ন দেখছে যেন মুসা।

হঠাৎ আতঙ্কের ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে।

এগিয়ে আসছে হাঙরটা!

Super User