০৯.
সারাটা রাত ওই সেন্ট্রিরুমেই কাটিয়ে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা।
ছাতে কেউ খুঁজতে আসেনি তাদেরকে। বেশ ভালই বুদ্ধি করেছিল মরিডো। ব্যালকনি থেকে ঝোলানো দড়ি, একটা ডানজনের দরজায়। পড়ে থাকা কিশোরের রুমাল (পরে জেনেছে তিন গোয়েন্দা) অন্যদিকে চোখ সরিয়ে রেখেছে পাহারাদারদের। হাতে খোঁজার কথা ভাবেইনি কেউ।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গিয়েছিল মরিডো আর মেরিনী। তারপর লম্বা হয়ে কাঠের বেঞ্চেই শুয়ে পড়েছে তিন কিশোর। সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম আর উত্তেজনার মাঝে কেটেছে, শক্ত কাঠের ওপর শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রূপালী মাকড়সা
পরদিন সূর্য ওঠার পর ভাঙল ঘুম।
চোখ মেলল মুসা। বড় করে হাই তুলল, আড়মোড়া ভাঙল। পাশে চেয়ে দেখল, আগেই উঠে পড়েছে কিশোর। হালকা ব্যায়াম করছে। মাংসপেশীর জড়তা দূর করার জন্যে।
উঠে বসল মুসা। জুতো গলাল পায়ে। দাঁড়াল। এখনও ঘুমিয়ে আছে রবিন।
সকালটা বেশ সুন্দর, দেয়ালের ফোকর দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে বলল মুসা। দিনটা ভালই যাবে, তবে আমাদের জন্যে না। পেটের ভেতর ছুঁচো নাচানাচি করছে। অথচ কোন খাবার নেই, নাস্তাই নেই, লাঞ্চ আর ডিনার তো স্বপ্ন! কিশোর, খাওয়া-টাওয়া পাব কিছু?
দুত্তোর তোমার খাওয়া! ঝাঁঝালো কণ্ঠ কিশোরের। কি করে বেরোব এই মৃত্যুপুরী থেকে তাই জানি না, খাওয়া! মরিডো কি করছে না করছে, রাতেও আসতে পারবে কিনা, তাই বা কে জানে!
সত্যিই বেরোতে পারব না আমরা এখান থেকে! চুপসে গেছে মুসা। তাহলে আর জীবনেও কিছু খাওয়া হবে না! হতাশ ভঙ্গিতে এদিক ওদিক মাথা নাড়ল সে। আচ্ছা, কিশোর, তোমার কি মনে হয়? জেগে উঠলে মনে করতে পারবে রবিন? রূপালী মাকড়সা কোথায় রেখেছে, বলতে পারবে?
কিশোর কোন জবাব দেবার আগেই চোখ মেলল রবিন। মিটমিট করে বন্ধ করল, তারপর আবার খুলল। আমরা কোথায়? বলতে বলতেই হাত নিয়ে গেল মাথার পেছনে, আহত জায়গায়। ইহ্! ব্যথা…! হ্যাঁ, এই বার মনে পড়েছে…
কি, কি মনে পড়েছে? লাফ দিয়ে দেয়ালের কাছ থেকে সরে এল মুসা। রূপালী মাকড়সা কোথায়, মনে পড়েছে?
মাথা নাড়ল রবিন। এখানে কি করে এলাম, সেটা মনে পড়েছে।
অ-অ! আবার হতাশ হয়ে পড়ল মুসা। আবার চলে গেল ফোকরের কাছে।
ভেব না, রবিন, আশ্বাস দিল কিশোর। সময় যাক। তোমার মাথার যন্ত্রণা যাক। তারপর হয়ত মনে পড়ে যাবে সব কথা…
এই, চুপ! চাপা গলায় হুঁশিয়ার করল মুসা। একটা লোক! এদিকেই আসছে!
দ্রুতপায়ে ফোকরের কাছে এসে দাঁড়াল অন্য দুজন।
ঢোলাঢালা ধূসর রঙের পোশাক পরনে। সামনের দিকে লম্বা। অ্যাপ্রন। হাতে ঝাড়, বালতি আর ন্যাকড়া। কয়েক পা এগিয়েই হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রাখল লোকটা। ভুরু কুঁচকে তাকাল একবার সেন্ট্রিরুমের দিকে। পেছনে সিঁড়ির দিকে তাকাল। তারপর এগিয়ে এল। পায়ে পায়ে।
টোকা পড়ল দরজায়। আস্তে করে।
মুসা, দরজাটা খুলে দাওঁ, ফিসফিস করে বলল কিশোর। গার্ড নয়। ও জানে, আমরা আছি এর ভেতর।
ছিটকিনি খুলে দিয়েই এক লাফে পাশে সরে গেল মুসা। তৈরি। যদি তেমনি বোঝে, লাফিয়ে পড়বে লোকটার ঘাড়ে। তিনজনে মিলে কাবু করে ফেলতে পারবে।
আস্তে ঠেলা দিয়ে দরজা খুলল লোকটা। চট করে ঢুকেই ঠেলে বন্ধ করে দিল আবার পাল্লা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল একটা ফোকরের কাছে। সিঁড়ির দিকে চেয়ে বলল, কেউ পিছু লেগেছে কিনা, দেখছি! হুঁশিয়ার থাকা ভাল।
দুটো মিনিট চুপচাপ ফোকরের কাছে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। দৃষ্টি সিঁড়ি আর ছাতের দিকে।
না, ফেউ লাগেনি পেছনে, অবশেষে বলল লোকটা। আমি ঝাড়দার। এক ফাঁকে উঠে চলে এসেছি। দেখেনি কেউ। মরিডোর মেসেজ আছে। জানতে চেয়েছে: রবিনের মনে পড়েছে কিনা।
না, জবাব দিল কিশোর। মরিডোকে বলবে, মনে পড়েনি।
বলব। অধৈর্য হতে মানা করেছে মরিডো। আঁধার নামলেই আসবে সে। এই যে নিন, খাবার। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটা অয়েল-পেপারের প্যাকেট বের করে দিল লোকটা। আরেক পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের বোতল বের করল। আর এই যে, পানি।
খাবারের প্যাকেট আর বোতল হাতে নিল মুসা।
আমি যাই, বলল লোকটা। নিচের অবস্থা খুব খারাপ। ধৈর্য হারাবেন না, সাহেবরা। প্রিন্স পল রক্ষা করবেন আপনাদের। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে চলে গেল ঝাড়দার।
দরজার ছিটকিনি তুলে দিল কিশোর।
ইতিমধ্যে খাবারের প্যাকেট অর্ধেক খুলে ফেলেছে মুসা। স্যাণ্ডউইচ, আর কিছু ফল। হাসি একান ওকান হয়ে গেল তার। আর দেরি করে লাভ কি? এস শুরু করে দিই। একটা স্যাণ্ডউইচ নিয়ে প্যাকেটটা বেঞ্চে নামিয়ে রাখল। কামড় বসাল খাবারে।
রেখে রেখে খেতে হবে, একটা স্যাণ্ডউইচ তুলে রবিনের দিকে বাড়িয়ে ধরল কিশোর। এই খাবার আর পানি দিয়েই চালাতে হবে সারাটা দিন। প্রাসাদে মরিডোর লোক না থাকলেই মরেছিলাম!
হ্যাঁ, স্যাণ্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বলল রবিন। আচ্ছা, গতরাতে প্রিন্স দিমিত্রি আর মিনস্ট্রেল পার্টি নিয়ে কি যেন আলাপ করছিলে মরিডোর সঙ্গে। মাথার ব্যথায় ভালমত কান দিতে পারিনি।
কিছু কিছু কথা তো দিনেই শুনেছ, বলল কিশোর। দিমিত্রির বাবার রাজত্বকালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মরিডোর বাবা। ডিউক রোজার রিজেন্ট হয়েই তাঁকে চেয়ার ছাড়তে বাধ্য করল। তখন থেকেই রোজারের ওপর সন্দেহ মিনস্ট্রেলদের। ওরা বুঝে ফেলল, দিমিত্রিকে সহজে প্রিন্স হতে দেবে না ডিউক। কাজে নেমে পড়ল ওরা। গোপনে। একটা দল গঠন করল। প্রিন্স পলের নাম করে শপথ নিল, নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে হলেও, রোজারের পরিকল্পনা সফল হতে দেবে না। গার্ড, অফিসার এমনকি চাকর-বাকর, ঝাড়দারদের মাঝেও লোক আছে তাদের। গতরাতে, আমাদেরকে গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছিল রোজার। সেটা জেনে ফেলেছিল একজন গার্ড, মিনস্ট্রেল পার্টির লোক। সঙ্গে সঙ্গে মরিডোকে জানিয়েছে সে ব্যাপারটা। এক বিন্দু দেরি করেনি মরিডো আর মেরিনা। ছুটে চলে এসেছে। নইলে তো গিয়েছিলাম ধরা পড়ে… স্যাণ্ডউইচে কামড় বসাল কিশোর। চিবিয়ে গিলে নিয়ে বলল, ছোট বেলায় প্যালেসে প্রায়ই আসত মেরিনা আর মরিডো। কোথাও ঢোকা বারণ ছিল না ওদের। ফলে এই প্রাসাদের গলি ঘুপচি প্রায় সবই ওদের চেনা। গোপন কোন পথ দিয়ে গিয়ে কোন্ সুড়ঙ্গে, ঢোকা যায়, সেখান থেকে নেমে যাওয়া যায় বিশাল নর্দমায়, জানে ওরা। গার্ডদেরও। অনেকেই চেনে না ওই পথ। ওদের চোখ এড়িয়ে তাই সহজেই প্রাসাদে ঢুকে পড়তে পারে দুই ভাইবোন, বেরিয়ে যেতে পারে।
খুব ভাল, বলে উঠল মুসা। তবে আমরা আটকে আছি ছাতে, এটা আবার খুব খারাপ কথা। তোমার কি মনে হয়? গার্ডদের চোখ এড়িয়ে আজ রাতে আসতে পারবে ওরা? বের করে নিয়ে যেতে পারবে আমাদের?
মনে তো হয়, বলল কিশোর। তার আগেই যদি অবশ্য ধরা না পড়ে যাই। এখান থেকে বেরিয়েই সোজা আমেরিকান এমব্যাসিতে চলে যেতে হবে আমাদের। ক্যাসেটটা তুলে দিতে হবে ওদের হাতে। রোজারের বিরুদ্ধে এটা একটা সাংঘাতিক প্রমাণ।
জেমস বৎ হলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম এখন, হাতের অবশিষ্ট স্যাণ্ডউইচটুকু মুখে পুরে দিল মুসা। দুই চিবান দিয়েই গিলে ফেলল কোঁৎ করে। জেমস বণ্ডের একটা সুবিধে আছে। যে বিপদেই পড়ুক না কেন, ঠিক বেরিয়ে যায়। তারজন্যে বিপদে পড়া আর না পড়া সমান কথা। কিন্তু আমাদের? নিজেরা কিছুই করতে পারছি না। অন্যের ওপর নির্ভর করে হাঁ হয়ে বসে থাকতে হবে সারাটা দিন!
আমাদের সাধ্যমত আমরা করেছি, করব, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। এখান থেকে বেরিয়ে যাব, প্রিন্স দিমিত্রিকে সাহায্যও করব। সহজে হাল ছাড়ছি না। তবে, মরিডো আর মেরিনা আসার আগে হাঁ করেই বসে থাকতে হবে আমাদের, এতে কোন সন্দেহ। নেই।…সেকেণ্ড, নাস্তা-লাঞ্চ সব একবারেই সেরে ফেলবে নাকি?
বাড়ানো হাতটা ঝট করে সরিয়ে নিল মুসা। করুণ চোখে তাকাল অবশিষ্ট কয়েকটা স্যাণ্ডউইচের দিকে। মনে করিয়ে দিয়েছ, ধন্যবাদ! ঠিক আছে লাঞ্চের সময়ই না হয় আবার খাব। আসলে, জানই তো, গোটা বিশেক স্যাণ্ডউইচ খাওয়ার পরেও একটা হাঁস খেয়ে ফেলতে পারি…
এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে ডবল খেয়ে পুষিয়ে নিয়ো, বলল কিশোর। ভবিষ্যতে বেশি খাওয়ার জন্যেই এখন কম খেয়ে প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে তোমাকে অনেক বড় একটা দিন পুড়ে আছে সামনে।
সত্যিই, অনেক দীর্ঘ একটা দিন। সারাটা দিন শুয়ে বসেই কাটাতে হল ওদের। কখনও উঠে গিয়ে ফোকরে চোখ রাখে, ছাতে কেউ উঠে আসছে কিনা দেখে।
অবশেষে সেইন্ট ডোমিনিকসের সোনালি গম্বুজের চূড়ার কাছে নেমে গেল সূর্যটা। দুএক মুহূর্ত ঝুলে রইল যেন অনিশ্চিতভাবে, তারপর টুপ করে ডুবে গেল পাহাড়ের ওপাশে। ভেনজো নদীর তীরে ঘন গাছগাছালির ভেতর থেকে ভেসে এল ঘরেফেরা পাখির কলরব। সেটাও থেমে গেল একসময়।
রাত নামল। ঘন হল অন্ধকার। সমস্ত প্রাসাদটা নীরব নিঝুম।
রাত বাড়ল বাড়তেই থাকল। দেখা নেই মরিডোর। অস্থির হয়ে উঠছে তিন গোয়েন্দা। তবে কি সে আসবে না? কোনরকম বিপদে পড়ে গেল?
দরজা খুলল মুসা। অন্ধকার ছাত! আকাশে মেঘ জমছে। দূরে মিটমিট করছে শহরের আলো। বাতিগুলোরও ঘুম পেয়েছে যেন।
হঠাৎ ধড়াস করে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। পাঁই করে ঘুরল মুসা। কখন নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা, টেরই পায়নি।
সেন্ট্রিরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে টর্চ জ্বাল মরিডো। ফিসফিস করে বলল, এবার বেরোতে হয়। চলুন। আমেরিকান এমব্যাসিতে যেতে হবে। পরিকল্পনা বদল করেছে ডিউক রোজার। খবর পেলাম, প্রিন্স দিমিত্রির অভিষেক অনুষ্ঠান স্থগিত ঘোষণা করবে সে আগামী কালই। নিজেকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে রিজেন্ট ঘোষণা করবে।
ঠেকানো যাবে না? জানতে চাইল কিশোর।
সম্ভব না। জনসাধারণকে যদি আসল কথাটা জানানো যেত, ছুটে আসত ওরা। ধ্বংস করে দিত রোজারকে। কিন্তু জানানো যাচ্ছে না। টেলিভিশন আর রেডিও স্টেশন দখল করে বসে আছে ডিউকের লোক। মিলিটারি দিয়ে ঘিরে রেখেছে। ওদেরকে হটানর ক্ষমতা আমাদের নেই, রবিনের দিকে ফিরল। রূপালী মাকড়সা কোথায় রেখেছেন, মনে পড়েছে? আঙিনায় পাওয়া যায়নি ওটা।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
মাকড়সাটা যদি পাওয়া যায়, বলে উঠল কিশোর, কি লাভ হবে? রোজারকে ঠেকানো যাবে এখন?
হয়ত, কথা বলল মেরিনা। মিনস্ট্রেলরা গোপনে একটা সভা ডাকতে পারবে। পাড়ার মাতব্বর গোছের কিছু কিছু লোককে ডেকে আনা হবে। মাকড়সাটা দেখিয়ে বলতে পারবে প্রিন্স দিমিত্রি সাহায্য চান। আমাদের হাতের রূপালী মাকড়সা দেখলে অবিশ্বাস করবে না তারা। খবরটা ছড়িয়ে পড়বে। এতে হয়ত স্রোতের মোড় ঘুরেও যেতে পারে। শুধু ডেনজো শহরের লোক খেপে উঠলেই রোজারের বারোটা বাজবে।
তাহলে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। মাকড়সাটা খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের। এবং সেটা এই প্রাসাদ ছাড়ার আগেই। ব্যালকনি, কার্নিস সব খুঁজব। শেষে ঢুকব সেই ঘরে। রূপালী মাকড়সানা নিয়ে যাব না।
বুঝতে পারছেন, কি ভয়ানক ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন? হুশিয়ার করল মরিডো।
পারছি, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। তবে, বিপদে না-ও পড়তে পারি। ওই ঘরে আবার ফিরে যাব আমরা, ভাববে না কেউ।…অন্তত, সে-সম্ভাবনা কম…
.
১০.
সেন্ট্রিরুম ছাড়ার আগে প্রতিটি সম্ভাবনার ব্যাপারে আলোচনা করল ওরা। এখানে ঢুকেছিল, এটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে, সে ব্যাপারেও খুব সতর্ক হল। পড়ে থাকা খাবারের প্রতিটি কণা তুলে নিল, ফেলে দিল ফোকর দিয়ে ডেনজো নদীতে। প্যাকেটের কাগজটা দলে মুচড়ে বল বানিয়ে ফেলে দিল। মোট কথা, কোনরকম চিহ্নই রাখল না।
রাত আরও বাড়ার অপেক্ষায় রইল ওরা, পাহারাদারদেরকে ঝিমিয়ে পড়ার সময় দিল।
অনেক অপেক্ষা করেছি, একসময় বলে উঠল মরিডো। দুটো বাড়তি টর্চ এনেছি, এই যে, পকেট থেকে ছোট দুটো টর্চ বের করে মুসা আর কিশোরের হাতে তুলে দিল। নিতান্ত দরকার না হলে জ্বালবেন না। গতরাতের মতই আমি আগে থাকব, মেরি সবার পেছনে। ঠিক আছে?
নীরবে মাথা কাত করে সমর্থন জানাল তিন গোয়েন্দা।
এক সারিতে সেন্ট্রিরুম থেকে বেরিয়ে এল ওরা। একটাও তারা নেই আকাশে, ঢেকে গেছে কালো মেঘে। ওরা বেরোতে না বেরোতেই একটা দুটো করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল, বড় বড়।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা। পাঁচতলার করিডরে নেমে থামল। কালি গুলে দিয়েছে যেন কেউ। আধ হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল পুরো একটা মিনিট। না, কোন শব্দ কানে আসছে না। মরে গেছে যেন বিশাল প্রাসাদটা।
ঝুঁকি নিতেই হল। টর্চ জ্বালল মরিডো, অন্ধকারে এগোতে পারবে না নইলে। একবার জেলেই নিভিয়ে দিল আবার। পথ দেখে নিয়ে পা বাঁড়াল।
অন্ধকারে এগিয়ে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে মরিডো।
পেরিয়ে এল অসংখ্য করিডর, সিঁড়ি। ছেড়ে দিলে বলতেই পারবে না তিন গোয়েন্দা, কোন্ পথে এসেছে। পথ চিনে ফিরে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। মস্ত এক গোলক ধাঁধা যেন!
তবে মরিডো চেনে পথ। একটা ঘরে এসে ঢুকল সবাইকে নিয়ে ছিটকিনি তুলে দিল দরজায়।
একটু জিরিয়ে নিই এখানে, বলল মরিডো। এ-পর্যন্ত তো ভালই এলাম। তবে সবচেয়ে সহজ পথটা পেরিয়েছি। এইবার আসতে পারে বিপদ। আমার মনে হয়, আপনাদেরকে প্যালেসে আর খুঁজছে না ওরা এখন। তাহলে সতর্কতায় ঢিল পড়তে বাধ্য। সুযোগটা নেব আমরা। প্রথমে যাব সেই ঘরে, রূপালী মাকড়সা পাই আর না পাই। তারপর চলে যাব ডানজনে। সেখান থেকে নেমে পড়ব পাতালের ড্রেনে। মাটির তলা দিয়ে চলে যাব আমেরিকান এমব্যাসির কাছে। আপনাদেরকে। নিরাপদে পৌঁছে দিয়েই অন্য কাজে হাত দেন। পোস্টার টানাব, হরতাল করব মিনস্ট্রেলদের নিয়ে। ডিউক রোজারের শয়তানী ফাস করে দেব। জনগণকে চেতিয়ে দেবার চেষ্টা চালাব। তারপর যা থাকে কপালে, হবে। চুপ করল সে। তারপর বলল, চলুন, যাই। জানালা দিয়ে বেরিয়ে গতরাতের মত ব্যালকনিতে নামি। কার্নিস ধরে চলে যাব। সেই ঘরটায়।
দুটো দড়ি নিয়ে এসেছে ওরা। একটা মরিডোর হাতে পেঁচানো। আরেকটা মেরিনার কোমরে।
হাতের দড়িটা খুলে নিয়ে জানালার মাঝখানের দণ্ডের সঙ্গে শক্ত। করে বাঁধল মরিডো। তারপর দড়ি বেয়ে নেমে চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই চাপা শিসের শব্দ এল ব্যালকনি থেকে। তারমানে পৌঁছে গেছে সে। ওদেরকে যাবার জন্যে ইঙ্গিত করেছে।
মুসা নেমে চলে গেল। তাকে অনুসরণ করল কিশোর।
জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল মেরিনা আর রবিন। ব্যালকনিতে আবছা আলো নড়াচড়া করছে। টর্চের মুখে হাত চাপা দিয়ে রূপালী মাকড়সা খুঁজছে তিনজনে।
খানিক পরেই নিভে গেল আলো। আবার শোনা গেল চাপা শিস।
রবিনকে দুড়ি ধরে ঝুলে পড়তে বলল মেরিনা।
ব্যালকনিতে নেমে এসেছে পাঁচজনে। দড়িটা ঝুলে আছে। থাকবে এভাবেই। রূপালী মাকড়সা খোঁজা শেষ করে আবার এপথেই ফিরে যেতে হবে। করিডর আর গোপন কিছু সিঁড়ি বেয়ে নামবে মাটির তলার ডানজনে।
মাকড়সাটা এখানে পড়েনি, অন্ধকারে ফিসফিস করে জানাল মরিডে। কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে, উত্তেজিত। কে জানে, নদীতেই পড়ে গেল কিনা! তবে ঘরটা অরি কার্নিস না দেখে শিওর হওয়া যাবে না।
ব্যালকনির রেলিঙ টপকে কার্নিসে নামল ওরা। দেয়ালের দিকে মুখ করে এক সারিতে এগিয়ে চলল শামুক-গতিতে। তেমনি নিঃশব্দে।
কার্নিসটা যেখানে নব্বই ডিগ্রি কোণ করে মোড় নিয়েছে, সেখানে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল রবিন। নিচে অন্ধকারের দিকে তাকাল! এখানে পড়ে যায়নি তো রূপালী মাকড়সা! তাহলে গেল। আর পাওয়া যাবে না ওটা। এর বেশি ভাবতে চাইল না রবিন। পাশে সরে সরে আবার এল সঙ্গীদের সঙ্গে।
কয়েক পা করে এগিয়েই টর্চ জ্বেলে দেখে নিচ্ছে মরিডো। শেষ। পর্যন্ত পৌঁছুল এসে সেই ঘরটার ব্যালকনিতে। কিন্তু পাওয়া গেল না। রূপালী মাকড়সা। শেষ ভরসা এখন, ওই ঘর। ওখানেও যদি না পাওয়া যায়, রবিনের মতই আর ভাবতে চাইল না সে-ও।
সবাই এসে উঠল ব্যালকনিতে। সাবধানে। পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিল মরিডো। অন্ধকার। কেউ আছে বলে মনে হল না। টর্চের আলো ফেলে নিশ্চিত হল, কেউ নেই।
একে একে ঘরে এসে ঢুকল ওরা সবাই।
এইবার খুঁজতে হবে, বলল কিশোর। কোথাও বাদ দিলে চলবে না। আনাচে-কানাচে, জিনিসপত্রের তলায়, সব জায়গায় দেখতে হবে।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ কর্কশ একটা শব্দে চমকে উঠল সবাই। কি করে জানি ঘরে এসে ঢুকেছে একটা ঝিঁঝি পোকা।
ঘরে ঝিঁঝি ঢোকা সৌভাগ্যের লক্ষণ, ফিসফিস করে বলল মুসা। এটা আফ্রিকান প্রবাদ। প্রচুর সৌভাগ্য এখন দরকার আমাদের।
হয়েছে, বলল কিশোর। কথা না বলে এস এখন কাজ করি।
খুঁজতে শুরু করল ওরা। হাঁটু মুড়ে বসে, দরকার পড়লে উপুড় হয়ে শুয়ে, প্রতিটি বর্গ ইঞ্চি জায়গা খুঁজে দেখতে লাগল। কার্পেটের তলা, গদির নিচে দেখল আগে। তারপর দেখল খাট, আলমারি আর অন্যান্য আসবাবপত্রের তলায়। শেষে দেখল আলমারির প্রতিটি ড্রয়ার, মাকড়সাটা লুকিয়ে রাখা যেতে পারে, এমন প্রতিটি জায়গায়।
খাটের তলায় ঢুকে পড়ল রবিন। হাতে লাগল শক্ত মসৃণ কিছু। পেয়েছি! বলে চেঁচিয়ে উঠেই চুপ হয়ে গেল। প্রতিটি টর্চের আলো এসে পড়ল তার হাতের ওপর। ধাতব জিনিস। তবে রূপালী মাকড়সা নয়। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি। ক্যামেরার ফিল্মের কৌটার ঢাকনা।
দুত্তোর! ক্রল করে এগিয়ে গেল রবিন। উপুড় হয়ে বসে আলো ধরে রেখেছে মুসা।
ক্রিক! ক্রিক! তীক্ষ্ণ শব্দ উঠল।
আলো সরে গেল মুসার টর্চের। সবাই দেখল, ঘরের কোণের দিকে দ্রুত সরে যাচ্ছে কালো একটা পোকা। ঝিঁঝি। আলোয় অস্বস্তি বোধ। করছে। ছুটে অন্ধকারে পালাতে চাইছে।
কপাল খারাপ পোকাটার। তাড়াহুড়ো করে লাফিয়ে সরতে গিয়ে পড়ল প্রিন্স পলের মাকড়সার জালে। ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করতে লাগল।
দুলে উঠল জাল। সুতো বেয়ে খবর পৌঁছে গেল মাকড়সার কাছে। তক্তার প্রান্ত আর মেঝের মাঝখানে সেই ফাঁকটাতেই বসে আছে। মাকড়সা, গায়ে গা ঠেকিয়ে। দুটো। লাল বড় বড় চোখ চকচক করছে আলোয়।
দ্রুত জাল বেয়ে উঠে এল একটা মাকড়সা। তাই করে ওরা। সঙ্গীসাথী যতই থাকুক, শিকার ধরা পড়লে এক জালে একটা মাকড়সাই উঠে আসে। মুখ থেকে আঠালো সুতো বের করে পেঁচিয়ে ফেলে শিকারকে। তারপর ধীরেসুস্থে বসে আরাম করে চুষে খায় রস।
খুব বেশিক্ষণ ছটফট করতে পারল না বেচারা ঝিঁঝি। দ্রুত জড়িয়ে যেতে লাগল আঠালো সুতোয়। নড়ার ক্ষমতাই আর রইল না। সাদাটে কালো একটা গোল পুটুলি হয়ে ঝুলে রইল জালে।
ছুটে গিয়ে ঝিঁঝিকে মুক্তি দেবার প্রচণ্ড ইচ্ছেটা জোর করে রোধ। করল রবিন। পোকাটাকে সরিয়ে আনতে হলে জাল ছিঁড়তে হবে মাকড়সার। হয়ত বা মাকড়সাটাকে আহত করতে হতে পারে। কিন্তু সেটা অসম্ভব। ভ্যারানিয়ার সৌভাগ্যবাহী প্রাণীর গায়ে আঙুল ছোঁয়ালেই মৃত্যুদণ্ড হয়ে যাবে তার।
কই, তোমার আফ্রিকান প্রবাদের কি হল? মুসার দিকে ফিরে বলল রবিন। আমাদের সৌভাগ্য আনতে গিয়ে ওই বেচারাকেই মরতে হল। ভাবছি, আমরাও না আবার রোজারের জালে জড়িয়ে মরি, ওই ঝিঁঝিটার মতই!
চুপ করে রইল মুসা।
খাটের তলায় পাওয়া গেল না, রূপালী মাকড়সা। বেরিয়ে এল রবিন। আলমারির সমস্ত ড্রয়ার খুলে মেঝেতে ফেলেছে মরিডো আর কিশোর। ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দেখছে।
মনে হয়, ফিসফিস করে বলল কিশোর, নদীতেই পড়ে গেছে। মাকড়সাটা! গার্ডেরা পায়নি, আপনি শিওর তো? মরিডোকে জিজ্ঞেস করল সে।
শিওর, বলল মরিডো। ভয়ানক খেপে আছে ডিউক রোজার। মাকড়সাটা পেয়ে গেলে অন্যরকম থাকত তার মেজাজ। পেছনে এসে দাঁড়ানো রবিনের দিকে ফিরল সে। আলো ফেলল তার গায়ে।
এদিক ওদিক মাথা নাড়ল রবিন ধীরে ধীরে। সেই আগের মতই অন্ধকারে ঢেকে আছে তার স্মৃতির কয়েকটা মিনিট। কিছুতেই ঢাকনা। সরাতে পারছে না ওখান থেকে।– ঠিক আছে, আবার একবার খুঁজে দেখি সারা ঘর, বলল মরিডো। কিশোরের দিকে ফিরল। আসুন, আমরা সুটকেসগুলো দেখি। মেরি, তুমি দেখ বালিশের খোলের ভেতরে। গদিটাও তুলে দেখ আরেকবার।
জানে ওরা, বৃথা সময় নষ্ট, তবু আরেকবার খুঁজে দেখল।
পাওয়া গেল না রূপালী মাকড়সা।
ঘরের মাঝখানে এসে জড়ো হল সবাই।
নেই এ ঘরে, কাঁপছে মরিডোর গলা। রোজারের লোকেরা পায়নি, আমরা পেলাম না, তারমানে গেল রূপালী মাকড়সা। নদীতেই পড়েছে ওটা! পাওয়ার আশা নেই আর।
তাহলে, কি করব এখন আমরা? বলল কিশোর। স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছে মরিডোর হাতে। এছাড়া গতি নেই এপ্রাসাদে। ওর। সাহায্য ছাড়া এখানে কিছুই করতে পারবে না তিন গোয়েন্দা।
বেরিয়ে যাব, বলল মরিডো। নিরাপদ জায়গায়,.. তার মুখের কথা মুখেই রইল। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। দপ করে জ্বলে উঠল। তীব্র উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো। চোখ ধাধিয়ে গেল ওদের।
খবরদার! যেখানে আছ, দাঁড়িয়ে থাক! এল কর্কশ আদেশ। অ্যারেস্ট করা হল তোমাদের!
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগল পাঁচজনে। হঠাৎই নড়ে উঠল মরিডো। লাফ দিল সামনে। একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, মেরিনা, ওঁদেরকে নিয়ে পালাও! ব্যাটাদের ঠেকাচ্ছি আমি!
আসুন! চেঁচিয়ে উঠল মেরিনা। জানালার দিকে ছুটেছে। আসুন আমার সঙ্গে!
পাঁই করে ঘুরেই জানালার দিকে দৌড় দিতে গেল রবিন আর কিশোর। শক্ত একটা থাবা পড়ল কিশোরের ঘাড়ে। তার শার্টের কলার চেপে ধরেছে। কিছুতেই ছাড়াতে পারল না সে।
দুপা এগোল রবিন। পরক্ষণেই পিঠের ওপর এসে পড়ল ভারি দেহ। জড়াজড়ি করতে করতে গায়ের ওপর এসে পড়েছে মরিডো আর এক প্রহরী।
ধাক্কা লেগে দড়াম করে হাত পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ল রবিন। জোরে ঠুকে গেল কপাল আর মাথার একটা পাশ। মেঝেতে পুরু কার্পেট না থাকলে খুলিই ফেটে যেত হয়ত। গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই নিয়ে দুবার আঘাত পেল মাথায়।
জ্ঞান হারাল রবিন।
.
১১.
চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে রবিন। কানে আসছে কিশোর আর মরিডোর কথা।
ওই ঝিঁঝিটার মতই জালে আটকা পড়লাম, বলল কিশোর। বাইরে করিডরে লোক থাকবে, কল্পনাও করিনি। উত্তেজনার বশে হয়ত জোরেই কথা বলে ফেলেছিলাম। কানে গিয়েছিল ব্যাটাদের। কিংবা কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে আলোও দেখে থাকতে পারে।
আমিও কল্পনা করিনি, বিষণ্ণ কণ্ঠ মরিডোর। তাহলে ওই করিডরে আগেই একবার উঁকি দিয়ে যেতাম। যাক, মুসাকে নিয়ে মেরি অন্তত পালাতে পেরেছে।
কিন্তু ওরা দুজনে কি করতে পারবে?
জানি না। হয়ত কিছুই না। বাবা আর মিনস্ট্রেল পার্টির লোকদের জানাতে পারবে বড়জোর, আমরা ধরা পড়েছি। বাবা উদ্ধার করতে পারবে না আমাদের, তবে সময়মত লুকিয়ে পড়তে পারবে। ডিউক রোজারের হাতে পড়ে কষ্ট ভোগ করতে হবে না।
কিন্তু আমরা তিনজন পড়লাম বিপাকে! দিমিত্রিও। তিক্ত কিশোরের গলা। প্রিন্সকে সাহায্য করতে এসেছি। তা-তো করতে পারিইনি, উল্টে রোজারের পথ সাফ করে দিলাম। আমাদের কাম সারা।
কা-ম সারা!
বাংলা শব্দ। মানে, আমরা শেষ।…মনে হয়, রবিনের জ্ঞান ফিরেছে। ইসস, বেচারা নথি। দুই বার লাগল বাড়ি, দুবারই মাথায়।
চোখ মেলল রবিন। কাঠের চৌকিতে শুধু পাতলা চাদরের ওপর শুয়ে আছে চিত হয়ে। ঘরে স্লান আলো। মোমবাতিটার দিকে চেয়ে চোখ মিটমিট করল সে। পাথরের দেয়াল ঘেঁষে পাতা রয়েছে চৌকি। মাথার ওপরে পাথরের ছাত। লোহার ভারি দরজার ওপর দিকে ছোট গোল একটা ফুটো, বাইরে থেকে ঘরের ভেতরটা দেখার জন্যে।
সঙ্গীকে চোখ মেলতে দেখে কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর আর মরিডো।
উঠে বসল রবিন। এর পরে আর কখনও ভ্যারানিয়ায় এলে মাথায় হেলমেট পরে আসব, শুকনো হাসি হাসল সে।
ভালই আছেন, মনে হচ্ছে! বলল মরিডো। একটা দুশ্চিন্তা গেল।
রবিন, মনে করতে পারছ কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ভালমত ভেবে দেখ।
নিশ্চয়। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল গার্ডের। এক ব্যাটাকে আমার ওপর ছুঁড়ে ফেললেন মরিডো। ব্যস, উপুড় হয়ে পড়ে খেলাম মাথার বাড়ি। তারপর আর কিছু মনে নেই।
আমি জানতে চাইছি রূপালী মাকড়সার কথা। মনে পড়ছে কিছু?
না। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন।
হুমম! অনেক সময় দ্বিতীয়বার মাথায় চোট লাগলে চলে যায় অ্যামনেশিয়া। ফিরে আসে স্মৃতি।
আসেনি, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল রবিন। কয়েকটা মিনিট এখনও ফাঁকা!
এটা বরং ভালই হল, বলে উঠল মরিডো। যতই চাপাচাপি করুক ডিউক রোজার, রূপালী মাকড়সার খোঁজ জানতে পারবে না।
ঠিক এই সময় চাবির গোছর শব্দ হল বাইরে। খুলে গেল ভারি দরজা। দুজন লোক। রয়্যাল গার্ডের ইউনিফর্ম পরা। বুটের গট গট শব্দ তুলে ভেতরে এসে ঢুকল ওরা। হাতে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক লণ্ঠন। উজ্জ্বল আলো। দুজনেরই ডান হাতে ঝকঝকে খোলা তলোয়ার।
এস, ভারি মোটা একটা কণ্ঠস্বর। ডিউক রোজার অপেক্ষা করছেন। ওঠ। আমাদের মাঝখানে থাকবে। চালাকির চেষ্টা করলে বুঝবে মজা! তলোয়ার তুলে শাসাল সে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল তিন বন্দি। আগে রইল এক প্রহরী, পেছনে অন্যজন। নিয়ে চলল বন্দিদের।
সরু অন্ধকার একটা করিডরে বেরিয়ে এল ওরা। বাতাসে ভাপসা গন্ধ। পায়ের তলায় পাথরের মেঝে কেমন ভেজা ভেজা, ঘেমে উঠেছে। যেন। সামনে পেছনে দুদিকেই অন্ধকার।
ঢালু হয়ে উঠে গেছে করিডর। একটা জায়গায় এসে থেমেছে সিঁড়ির গোড়ায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ির পরেই আবার শুরু হয়েছে করিডর। দুপাশে সারি সারি লোহার দরজা। নিশ্চয় কয়েদখানা। এই করিডরের পরে আবার কয়েক ধাপ সিঁড়ি। ওপরে আরেকটা করিডরের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রহরী।
প্রহরীদের মাঝখান দিয়ে করিডরে উঠে এল ওরা। এখোল। সামনে, একপাশের একটা দরজা খোলা। উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে করিডরে। দরজার সামনে বন্দিদেরকে নিয়ে আসা হল। একবার ভেতরে চেয়েই শিউরে উঠল কিশোর আর রবিন। এই ধরনের ঘর এর আগেও দেখেছে ওরা, ভয়াল ছায়াছবিতে। শত শত বছর আগেকার, মধ্যযুগীয় পীড়ন ঘর। তবে এটা ছায়াছবি নয়, বাস্তব।
পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হল ওদের। লম্বা একটা ঘর। বিচিত্র, কুৎসিত সব জিনিসপত্র। নির্যাতনের যন্ত্র। একপাশে কুৎসিত একটা ব্ল্যাক থেকে ঝুলছে এক হতভাগ্য। লোহার শেকলে বাঁধা কব্জি। পায়ের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেধে ঝুলিয়ে দিয়েছে ভারি পাথর। লম্বা হয়ে গেছে লোকটা। মাঝখান থেকে দুটুকরো হয়ে ছিঁড়ে যাবে আরেকটু টান পড়লেই। পরনে একটা সুতোও নেই। হাড়ের ওপর কটুচকে জড়িয়ে আছে শুকনো চামড়া।
আরেকদিকে বিশাল একটা গোল পাথর, গম ভাঙার যাতার মত দেখতে, তবে অনেক বড়। ওটার গায়ে টান টান করে আটকে দেয়া হয়েছে আরেকটা মানুষকে। এক এক করে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙা হয়েছে হাত-পায়ের হাড়।
আরও সব বিচিত্র যন্ত্রপাতি। বেশির ভাগেরই নাম জানা নেই কিশোর কিংবা রবিনের। পাথর, লোহা কিংবা কাঠের তৈরি। ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ছয় ফুট লম্বা এক লোহার মেয়েমানুষ। ওই জিনিস আগেও দেখেছে কিশোর, সিনেমায়। আয়রন মেইডেন বা লৌহমানবী নাম। আসলে মেয়েমানুষের আকৃতির একটা লম্বা বাক্স ওটা। একপাশে কজা। টান দিয়ে বাক্সের ডালা খোলার মতই খোলা যায়। ভেতরের দেয়ালে চোখ কাটা বসানো। বন্দিকে ধরে তার ভেতরে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে ডালা বন্ধ করা হয়। শরীরে ঢুকে যেতে থাকে অসংখ্য কাটা। কাটাগুলোর মাধ্যায় আবার এক ধরনের ওষুধ মাখিয়ে রাখা হয়। রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে যন্ত্রণা শতগুণে বাড়িয়ে তোলে বন্দির।
টর্চার রুম! ফিসফিস করে বলল মরিডো। কাঁপছে গলা। এটা তৈরি হয়েছে সেই ব্ল্যাক প্রিন্স জনের আমলে। ভয়াবহ এক পিশাচ ছিল লোকটা। মধ্যযুগের সবচেয়ে অত্যাচারী সাত আটজন শাসকের একজন। ওর পরে এই ঘর আর কেউ ব্যবহার করেনি বলেই জানতাম। কিন্তু এখন তো দেখছি অন্যরকম! ডিউক রোজার গোপনে ঠিকই ব্যবহার করছে এটা!
পেটের ভেতরে অদ্ভুত একটা শিরশিরে অনুভূতি হল কিশোরের। একসঙ্গে ঢুকে পড়েছে যেন কয়েক ডজন প্রজাপতি, ডানা নাড়ছে! আড়চোখে দেখল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রবিনের চেহারা। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
চুপ! ধমকে উঠল এক প্রহরী। ডিউক রোজার আসছেন।
ম্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে দরজার দুপাশে দুজন প্রহরী। বুটের খটাশ শব্দ তুলে স্যালুট করল।
গটমট করে হেঁটে এসে ঘরে ঢুকল ডিউক রোজার। পেছনে এল। ডিউক লুথার মরিজ।
বন্দিদের সামনে এসে দাঁড়াল রোজার। কুৎসিত হাসি ফুটল ঠোঁটে। ইঁদুরের বাচ্চারা, ফাঁদে পড়লে শেষে! এইবার খেচানো হবে চোখা শিক দিয়ে। যত খুশি, গলা ফাটিয়ে চেঁচিও। কোন আপত্তি নেই। তারপর গড়গড় করে জবাব দিয়ে যাবে আমার প্রশ্নের। নইলে…
ধুলো ঝেড়ে একটা চেয়ার নিয়ে এসে পেতে দিল এক প্রহরী। বসে পড়ল তাতে রোজার। আরেকটা লম্বা বেঞ্চ এনে পেতে দেয়া হল। তাতে রোজারের মুখোমুখি বসিয়ে দেয়া হল তিন বন্দিকে।
চেয়ারের হাতলে আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে টোকা দিল রোজার। তারপর, মরিডো, তুমিও আছ এর মধ্যে বেশ! টের পাবে তোমার বাবা, পুরো পরিবার। তোমার কথা বাদই দিলাম।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে মরিডো। কোন জবাব দিল না।
তারপর? আমেরিকান বিচ্ছুরা? রোজারের গলায় কেমন খুশির আমেজ। ধরা তো পড়লে। একটা অবশ্য গেল পালিয়ে। তাতে কিছু যায় আসে না। এবার কিছু প্রশ্নের জবাব দেবে আমার? না না, তোমরা কেন এসেছ, জানতে চাই না। সেটা ক্যামেরাগুলোই জানিয়ে দিয়েছে। ভ্যারানিয়ার বিরুদ্ধে গুপ্তচরগিরি করতে এসেছ। মস্ত অপরাধ। তার চেয়ে বড় অপরাধ করেছ রূপালী মাকড়সা চুরি করে। সামনে ঝুকল। হঠাৎ চেহারা থেকে চলে গেল খুশি খুশি ভাবটা। কোথায় ওটা?
আমরা চুরি করিনি, কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করল কিশোর। কোন্ হারামজাদা চুরি করে আমাদের ঘরে রেখে এসেছিল। আলমারির ড্রয়ারে।
ক্ষণিকের জন্যে ধক করে জ্বলে উঠল রোজারের চোখের তারা। তারপরই স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার। বেশ, বেশ! তাহলে স্বীকার করছ, মাকড়সাটা ছিল তোমাদের ঘরে। এটাও এক ধরনের অপরাধ। যাকগে। খুব নরম মনের মানুষ আমি। দুটো কিশোরকে মারধর করতে খুব মায়া হবে। মাকড়সাটা কোথায় আছে, বলে দাও। ছেড়ে দেব তোমাদেরকে।
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। দ্বিধা করছে গোয়েন্দাপ্রধান। শেষে বলে ফেলল, আমরা জানি না। কোথায় আছে, বলতে পারব না।
জেমস বণ্ডের ছবি খুব বেশি দেখেছ, না? ভ্রুকুটি করল রোজার। মারের চোটে হেগেমুতে ফেলবে ব্যাটা, তবু মুখ খুলবে না। রবিনের। দিকে তাকাল। তোমার কি ধারণা, বাচ্চা ইবলিস? রূপালী মাকড়সা কোথায়?
জানি না, মাথা নাড়ল রবিন।
জান না! গর্জে উঠল রোজার। দেখেছ, অথচ কোথায় আছে। জান না! কোথাও লুকিয়ে রেখেছ তোমরা। ফাঁকি দিতে চাইছ এখন। জানি না বললেই হল! কোথায় রেখেছ? কাউকে দিয়েছ?…জবাব দাও!
জানি না, বলল কিশোর। সারারাত চেঁচিয়ে যেতে পারবেন, জানি না-র বেশি কিছু বলতে পারব না আমরা।
বাহ্, চমৎকার! একেবারে জেমস বণ্ডের বাচ্চা! চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। ধীরে ধীরে আঙুলের টোকা দিতে লাগল চেয়ারের হাতলে। হঠাৎ বলল, তবে ঘাড় থেকে ভূত ছাড়িয়ে নিতে পারব। গোয়ার্তুমি রোগ সেরে যাবে একেবারে। তোমরা তো বাচ্চা খোকা। কত বড় বড় শক্তিশালী মানুষ এসে ঢুকেছে এখানে, পাথরের মত কঠিন। শেষে পানি হয়ে গেছে গলে। কোটা দিয়ে শুরু করব? আয়রন মেইডেন?
ঢোক গিলল কিশোর। চুপ করে রইল।
বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! বলে উঠল মরিডো। ভ্যারানিয়ার ইতিহাস জানা আছে আপনার, ডিউক। সিংহাসন নিয়ে এর আগেও কাড়াকাড়ি খাবলাখাবলি হয়েছে। কেউই টিকতে পারেনি। তাছাড়া, ব্ল্যাক প্রিন্সের কথাও আপনার অজানা নয়। দেশের লোক খেপে গিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়েছিল তাকে। ভুলে যাবেন না কথাটা।
বড় বড় কথা, না? দাঁত বের করে হাসল রোজার। ঠিক আছে, তোমার কথাই মেনে নিলাম। আয়রন মেইডেন ব্যবহার করব না। আগেই বলেছি, মনটা খুব নরম আমার। লোকের কষ্ট সইতে পারি না। তবে, কথা আমি আদায় করবই।
প্রহরীর দিকে চেয়ে আঙুলের ইশারা করল রোজার। জিপসি বুড়ো আলবার্তোকে নিয়ে এস।
জাদুকর আলবার্তো! উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মরিডো। ও…ওকে…
চুপ! ধমকে উঠল রোজার।
দরজায় পদশব্দ হতেই মুখ ফিরিয়ে তাকাল কিশোর। রবিন আর মরিডোও তাকাল। বৃদ্ধ একজন লোক এসে ঢুকেছে ঘরে। দুদিক থেকে ধরে তাকে নিয়ে আসছে দুই প্রহরী। এককালে খুব লম্বা ছিল, বয়েসের ভারে কুজো হয়ে গেছে এখন। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে এগিয়ে আসছে। উজ্জ্বল রঙের আলখেল্লা গায়ে, কানে সোনার আঙটা। এক ছটাক মাংস আছে কিনা মুখে, সন্দেহ। চামড়া কুঁচকে বসে গেছে হাড়ের গায়ে। বড় বড় দুটো নীল চোখ, ধক ধক করে জ্বলছে যেন। সব মিলিয়ে ঘুমের ঘোরে আঁতকে ওঠার মত চেহারা।
লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসে ডিউক রোজারের সামনে দাঁড়াল বুড়ো।
এই যে, এসে গেছে জিপসি বুড়ো, রোজারের কথার ধরনে মনে হল, আলবার্তোর মালিক মনে করে সে নিজেকে। কণ্ঠস্বরে নির্লজ্জ দাম্ভিকতা। তোমার জাদুক্ষমতা কিছু দেখাও তো, আলবার্তো। এই ছেলেগুলো কথা গোপন করতে চাইছে। বের করে আন পেট থেকে।
বুড়ো জিপসির কুৎসিত মুখে কঠিন হাসি ফুটল। আদেশ মানতে অভ্যস্ত নয় জিপসি, আলবার্তো। দুপাশের দুই প্রহরীকে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। গুডনাইট, ডিউক।
স্পর্ধা বটে বুড়োর! মুখ কালো হয়ে গেল রোজারের। কোনমতে দমন করে নিল রাগ। পকেট থেকে কয়েক টুকরো স্বর্ণ বের করল।
ভুল বুঝ না, জাদুকর, মোলায়েম গলায় বলল রোজার। এই যে নাও, তোমার সম্মানী। সোনার টুকরো।
ধীরে ধীরে ঘুরল আলবার্তো। শীর্ণ, ঈগলের নখের মত বাকানো আঙুলে একটা একটা করে টুকরো তুলে নিয়ে ঢোলা আলখেল্লার পকেটে ভরল।
হ্যাঁ, আলবার্তোর সঙ্গে যারা ভদ্র ব্যবহার করে, বলল জাদুকর। তাদের সাহায্য করে সে। তো, ডিউক, কি জানা দরকার?
এই ইবলিসের বাচ্চাগুলো ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা লুকিয়ে রেখেছে, বলল রোজার। কিছুতেই বলতে চাইছে না। সহজেই জেনে নিতে পারি ওগুলো ব্যবহার করলে, নির্যাতনের যন্ত্রপাতিগুলো দেখাল। কিন্তু মনটা আমার খুবই নরম। ওসব করতে চাই না। তোমার প্রচণ্ড ক্ষমতা প্রয়োগ করলে কোন যন্ত্রণা হবে না, ব্যথা পাবে না, অথচ মনের কথা সুড়সুড় করে বলে দেবে ওরা। সেগুলো শুনতে চাই আমি।
ঠিক আছে, ফোকলা হাসি হাসল আলবার্তো। ঘুরে দাঁড়াল তিন বন্দির দিকে। ঝোলা আলখেল্লার পকেট থেকে বের করল একটা পেতলের কাপ আর চামড়ার একটা ছোট থলে। থলে থেকে কয়েক চিমটি কালো পাউডার তুলে নিয়ে ফেলল কাপে। আরেক পকেট থেকে বের করল দামি একটা সিগারেট লাইটার। আগুন ধরাল পাউডারে। নীল ঘন ধোয়া বেরিয়ে এল কাপের ভেতর থেকে।
নাও, শ্বাস নাও বাছারা! গলাটা বকের মত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে জাদুকর। বিড়বিড় করছে অদ্ভুত কণ্ঠে। এক এক করে কিশোর, রবিন আর মরিডোর নাকের কাছে ধরল কাপ! জোরে শ্বাস নাও! জাদুকর আলবার্তোর আদেশ! শ্বাস নাও! বুক ভরে টেনে নাও সত্যি ভাষণের-ধোয়া!
এদিক ওদিক মুখ ঘুরিয়ে ধোয়া থেকে নাক বাঁচানর চেষ্টা করল ওরা। পারল না। নাকের ভেতর দিয়ে যেন মগজে ঢুকে গেল নীল ধোয়া। জ্বালা ধরিয়ে দিল মস্তিষ্কে, ফুসফুসে। তারপর হঠাৎ করেই আশ্চর্য এক পুলক অনুভব করল। আর জোরাজুরি করতে হল না, নিজেদের ইচ্ছেতেই টেনে নিল ধোয়া। ঢিল পড়ল স্নায়ুতে, ঘুম ঘুম লাগছে।
এবার…তাকাও আমার দিকে! ধীরে ধীরে মোলায়েম গলায় বলল আলবার্তো। আমার চোখের দিকে…
পুরোপুরি ভাবতে পারছে না ওরা, তবু চোখ সরিয়ে রাখার চেষ্টা করল বুড়োর চোখ থেকে। পারল না। প্রচণ্ড এক আকর্ষণ, এড়ানর উপায় নেই। নীল চোখের তারার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল গভীর নীল সাগরে ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে…চারপাশ থেকে চেপে ধরেছে। যেন পানি…কেমন এক ধরনের উষ্ণ আবেশ….
এইবার বল! আদেশ দিল আলবার্তো। রূপালী মাকড়সা কোথায় ওটা?
জানি না, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল মরিডো। তার দিকেই চেয়ে আছে এখন বুড়ো। নীল চোখের তারা থেকে আর সরিয়ে নিচ্ছে না চোখ। জানি না…জানি না…
অহ্! বিড়বিড় করল বুড়ো। শ্বাস নাও! আরও জোরে…আরও টেনে…!
একবার করে আবার তিন বন্দির নাকের সামনে কাপ ধরল আলবার্তো, ওদেরকে ধোয়া টেনে নিতে বাধ্য করল। রবিনের মনে হল, আর পানিতে নয়, আকাশে উঠে পড়েছে। সঁতরে চলেছে মেঘের ভেতর দিয়ে।
বাঁকানো আঙুল দিয়ে মরিডোর কপাল টিপে ধরল বুড়ো আলতো করে। ধরে রাখল কয়েক মুহূর্ত, তারপর ছেড়ে দিল। তর্জনীর মাথা ছোঁয়াল কপালের মাঝখানে। মুখ নিয়ে এল মুখের সামনে। স্থির চোখে তাকাল মরিডোর চোখের তারার দিকে।
এবার, ফিসফিস করল বুড়ো। এবার বল!…ভাব! ভাব, কোথায় রেখেছ রূপালী মাকড়সা। কোথায়!…অহ!
দীর্ঘ আরেক মুহূর্ত মরিডোর কপালে আঙুল ছুঁইয়ে রাখল আলবার্তো। তারপর সরিয়ে আনল। কিশোরের ওপরও একই প্রক্রিয়া চালাল। শেষে অহ! বলে সরিয়ে আনল আঙুল কপালের ওপর থেকে।
রবিনের দিকে হাত বাড়াল বুড়ো। ওর কপালে আঙুল ছুঁইয়েই। ঝটকা দিয়ে সরিয়ে আনল, যেন জ্বলন্ত কয়লা ছুঁয়েছে। কুঁচকে গেল ভুরু। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রবিনের চোখের দিকে। স্থির চেয়ে রইল দীর্ঘ এক মুহূর্ত।
আলবার্তোর চোখের দিকে চেয়ে বার বার কেবল রূপালী মাকড়সার কথাই মনে আসতে থাকল রবিনের। দুনিয়ার আর সব ভাবনা চিন্তা সরে গেছে বহুদূরে। সে যেন উঠে বসেছে নীল মেঘের চূড়ায়। পায়ের নিচ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। অদ্ভুত এক শূন্যতা মাথার ভেতরে। মনে করতে চাইছে, কোথায় আছে রূপালী মাকড়সা। হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ আচ্ছন্ন করে ফেলল মনকে…
অবাক হল যেন আলবার্তো। আরেকবার তার প্রক্রিয়া চালাল রবিনের ওপর। বিড়বিড় করল নরম গলায়, ভাব! ভাব! অবশেষে শব্দ করে শ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল।
চোখ মিটমিট করতে লাগল রবিন। মনে হল, প্রচণ্ড এক ঘূর্ণিপাক। থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে তাকে।
আপনমনেই ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বুড়ো। তাকাল রোজারের দিকে।
প্রথম ছেলেটা জানে না, বলল আলবার্তো। ও দেখেনি রূপালী মাকড়সা। মাথাবড় ছেলেটা দেখেছে, তবে হাতে নেয়নি। জানে না কোথায় আছে। আর, ওই বেঁটে ছেলেটা হাতে নিয়েছিল। এবং তারপর…
তারপর? সামনে ঝুঁকে এসেছে রোজার। উত্তেজিত। তারপর কি?
ভাবছিল সে ঠিক মতই। হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল মনকে। মেঘের ভেতরে হারিয়ে গেল.রূপালী মাকড়সা। এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হইনি আর কখনও! ও জানত, কোথায় আছে। রূপালী মাকড়সা, তারপর হঠাৎ করেই মুছে গেল, মন থেকে। কিছুতেই মনে করতে পারছে না আর। ও না পারলে, আমারও কিছু করার নেই।
হারামির বাচ্চা! গাল দিয়ে উঠল রোজার। চিন্তিত ভঙ্গিতে টোকা দিতে লাগল চেয়ারের হাতলে। বুড়ো জিপসি… বলতে গিয়েও থেমে গেল সে। তাড়াহুড়ো করে স্বর পাল্টাল। জাদুকর আলবার্তো, তুমি যথেষ্ট করেছ। রূপালী মাকড়সা কোথায় রেখেছে, মনে নেই বিটার। এটা তোমার দোষ নয়। কিন্তু, অনুমানে কিছু বলতে পার না? প্রচণ্ড ক্ষমতা তোমার, জানি। অনুমান করা সম্ভব শুধু তোমার পক্ষেই। কোথায় থাকতে পারে রূপালী মাকড়সা? আগ্রহী চোখে আলবার্তোর দিকে। তাকাল সে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। ওটার আসলেই কি কোন দরকার আছে? ওটা ছাড়া আমার ইচ্ছে কি পূরণ হতে পারে না? নেহায়েত একটা দুধের বাচ্চাকে সিংহাসনে না বসালেই কি নয়? আমি বসতে পারি না?
রহস্যময় হাসি ফুটল বৃদ্ধ জাদুকরের ঠোঁটে। ডিউক, রূপালী মাকড়সার সঙ্গে সাধারণ মাকড়সার তফাৎ নেই। তোমার ইচ্ছের কথা বলছ? বিজয়ের ঘণ্টা শুনেছি আমি।…বয়েস তো অনেক হল। পরিশ্রম আর করতে পারি না। ঘুমানো দরকার। এবার তাহলে আসি। গুড নাইট!
রহস্যময় হাসিটা লেগেই রইল আলবার্তোর ঠোঁটে। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগোল দরজার দিকে।
প্রহরীদের দিকে চেয়ে হাত নাড়ল রোজার। জাদুকরকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এস। তারপর ফিরল সঙ্গী ডিউক লুথারের দিকে। শুনলে তো? জাদুকর কি বলে গেল! রূপালী মাকড়সা শুধুই একটা সাধারণ রূপার টুকরো। ওটার কোন ক্ষমতা নেই। এবং ইচ্ছে করলে ওটা ছাড়াই চলতে পারি আমরা। তাছাড়া, ও বলল, বিজয়ের ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছে। আর কোন দ্বিধা নেই আমার। জাদুকর আলবার্তোর ভবিষ্যদ্বাণী কখনও মিথ্যে হয় না। আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। আগামীকাল সকালেই কাজে লেগে পড়। অ্যারেস্ট কর দিমিত্রিকে। অনির্দিষ্টকালের জন্যে নিজেকে রিজেন্ট ঘোষণা করব আমি। আমেরিকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বাতিল করে দেব, আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে অন্যায়ভাবে নাক গোনর জন্যে। ঘোষণা করব, দুটো আমেরিকান স্পাই এবং চোর ধরা পড়েছে আমাদের হাতে। তৃতীয়টার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করব। ভোর হওয়ার আগেই ধরে নিয়ে এস মরিডোর পরিবারের, সব লোককে। মিনস্ট্রেলদের যাকে যেখানে পাবে, ধরে নিয়ে এসে ঢোকাও কয়েদখানায়। ওদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আন। একসঙ্গে অনেক কথা বলে দম নিল ডিউক। আগামীকাল সকালেই পুরো ভ্যারানিয়া চলে আসবে আমার হাতের মুঠোয়। তারপর সিদ্ধান্ত নেব, চোর দুটোকে নিয়ে কি করা যায়। কানমলা দিয়ে ছেড়ে দেব, বের করে দেব দেশ থেকে, নাকি বিচার হবে প্রকাশ্যে? প্রহরীদের দিকে তাকাল। এগুলোকে নিয়ে ভর কয়েদখানায়।
রবিনের দিকে ঝুঁকল রোজার। ইঁদুরের বাচ্চা, ভাব…ভেবে বের কর, কোথায় রেখেছ রূপালী মাকড়সা। জনতা আমার মত নরম মনের মানুষ নয়। ওদের হাতে তুলে দিলে জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নেবে।…মাকড়সাটা অবশ্য দরকার নেই আমার, আলবার্তো বলেছে। তবু, ওটা গলায় পরে সিংহাসনে বসতে বেশ ভালই লাগবে। প্রিন্সের মতই মনে হবে নিজেকে।
কাছে এসে দাঁড়িয়েছে প্রহরীরা।
ওদের দিকে চেয়ে বলল রোজার, নিয়ে যাও।
.
১২.
পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল ওদেরকে দুজন প্রহরী। আবার সেই ডানজনে, পাতালের কয়েদখানায়।
আগে একজন প্রহরী, পেছনে রবিন, কিশোর, তাদের পেছনে মরিডো। চলতে চলতে মরিডোর গা ঘেঁষে এল পেছনের প্রহরী। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, নর্দমায় বন্ধু ইঁদুর আছে। বলেই সরে গেল।
মাথা ঝোকাল মরিডো।
ডানজনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলল প্রহরী। ঠেলে বন্দিদেরকে ঢুকিয়ে দিল পাথরের ছোট্ট ঘরে। দেয়ালের কাছে জ্বলছে মোমবাতি, আলতো বাতাস লেগে কেঁপে উঠল শিখা। ছায়ার নৃত্য শুরু হল দেয়ালে।
পেছনে শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল আবার লোহার দরজা। তালা আটকানর আওয়াজ হল। বাইরে দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে গেল দুই প্রহরী। কড়া পাহারার আদেশ আছে তাদের ওপর।
দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইল ওরা। নিস্তব্ধ পরিবেশ। কানে আসছে অতি মৃদু চাপা একটা কুলকুল ধ্বনি। পানি বইছে কোথাও। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মরিডোর দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা।
প্রাসাদের নিচেই আছে ড্রেন, জানাল মরিভে। ডেনজো নদীতে গিয়ে পড়ছে পানি। বাইরে নিশ্চয় তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। থামল সে। ডেনজোর ওই ড্রেনগুলো শত শত বছরের পুরানো। পাথরের তৈরি পাতাল-খাল বলা চলে ওগুলোকে। তলাটা চ্যাপ্টা, ছাত ধনুকের মত বাঁকানো। মাটির তলায় মাইলের পর মাইল জুড়ে রয়েছে ওই ড্রেন। শুকনোর সময় হেঁটেই যাওয়া যায় ওর ভেতর দিয়ে। বর্ষায় পানিতে যদি একেবারে ভরে না যায়, নৌকা বাওয়া যায় অনায়াসে।
চুপ করে মরিডোর কথা শুনছে দুই গোয়েন্দা। চোখে মুখে আগ্রহের ছাপ।
ওদের দিকে চেয়ে হাসল মরিডো। আজকাল খুব কম লোকেই ঢোকে এর ভেতর। পথ হারিয়ে মরার ভয় আছে। তাছাড়া রয়েছে ইঁদুর। বেড়ালের সমান বড় একেকটা। কায়ামত পেলে ধরে জ্যান্ত মানুষ খেয়ে ফেলতেও দ্বিধা করে না। তবে আমি আর মেরি ভয় করি না ওসবকে। ভালমতই চিনি ভেতরটা। অনেকবার ঢুকেছি। ওর ভেতরে গিয়ে কোনমতে ঢুকতে পারলে ঠিক চলে যেতে পারব আমেরিকান এমব্যাসির তলায়। ম্যানহোল দিয়ে উঠে যেতে পারব বাইরে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, মাথা ঝোঁকাল আস্তে করে। বুঝলাম। কিন্তু আমরা বন্দি রয়েছি ডানজনে, দরজায় তালা। বাইরে প্রহরী। নর্দমায় পৌঁছব কি করে?
মিনিটখানেকের জন্যেও যদি সময় পাই, বলল মরিডো। পৌঁছে যেতে পারব। বাইরে যে করিডরুটা আছে, তার শেষ মাথায় রয়েছে ম্যানহোল। ওটা দিয়ে সহজেই ঢুকে পড়া যাবে ড্রেনে।
কিন্তু সেজন্যে বেরোতে হবে আগে, আবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর।
ওখানে আমাদেরকে সাহায্য করার জন্যে লোক রয়েছে। এক প্রহরী মেসেজ দিয়েছে আমাকে।
তা দিয়েছে, কথা বলল রবিন। কিন্তু ওই যে, কিশোর বলল। ডানজন থেকে বেরোব কি করে আমরা?
হুউ! ধীরে ধীরে মাথা ঝোকাল মরিডো। চুপ করে গেল।
আচ্ছা, বলল রবিন। ওই বুড়ো জাদুকরটা আসলে কে? আমাদের মনের কথা জানল কি করে? থট রীডার গোছের কিছু?
হয়ত, মাথা ঝোঁকাল মরিডো। জানি না ঠিক। ভ্যারানিয়ায় এখনও কিছু জিপসি রয়েছে। তাদের সর্দার ওই বুড়ো। একশোর বেশি বয়েস। আশ্চর্য কিছু ক্ষমতার অধিকারী। কি সে ক্ষমতা, জানে না কেউই। বুঝতে পারে না। আমার তো মনে হয়, বুড়ো ঠিক জানতে পেরেছে, কোথায় আছে রূপালী মাকড়সা। কিন্তু বলেনি রোজারকে। তবে, একটা ব্যাপারে খারাপ হয়ে গেছে মনটা। ও বলেছে, বিজয়ের ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছে। কখনও ভুল হয়নি ওর কথা! ফালতু কথা বলে না। তারমানে, সিংহাসন রোজারের দখলেই যাবে! ধরা পড়বে সমস্ত মিনস্ট্রেলরা, মৃত্যুদণ্ড হবে। আমার বাপকে ধরে আনবে, বন্ধুদের ধরে আনবে। ধরে আনবে মেরিকে…চুপ করে গেল সে।
মরিডোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে রবিন। হাল ছেড়ে দেব না আমরা! দৃঢ় গলায় বলল সে। এক বুড়োর কথায় নিরাশ হয়ে ভেঙে পড়ার কোন মানে হয় না। কোনদিন ভুল করেনি বলেই যে সব সময় সত্যি হবে, এটা মানতে রাজি নই আমি। কিশোর, তোমার মাথায় কোন বুদ্ধি এসেছে?
অ্যাঁ! অন্য জগতে বিচরণ করছিল যেন এতক্ষণ গোয়েন্দাপ্রধান। হ্যাঁ, একটা বুদ্ধি এসেছে। এখান থেকে হয়ত বেরিয়ে যেতে পারব। প্রহরীদের দিয়ে আগে দরজা খোলাতে হবে। তারপর কাবু করে ফেলতে হবে ওদের।
দুটো অস্ত্রধারী লোককে কাবু করব? বলে উঠল মরিডো। কি জোয়ান একেকজন, দেখেছ? হাত দিয়ে চেপে ধরলে নড়তেই পারব। না। নাহ্, পারা যাবে বলে মনে হয় না! এেিদক ওদিক মাখা দোলাল সে।
পারতেই হবে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। একটা কথা মনে পড়ছে। রহস্য কাহিনীতে পড়েছিলাম। ওটা নিছকই গল্প। তবে বুদ্ধিটা কাজে লাগাতে পারলে, মনে হয় কাবু করে ফেলতে পারব।
কি? আগ্রহে সামনে ঝুঁকল রবিন।
আমাদের মতই বন্দি করে রাখা হয়েছিল একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে, বলল কিশোর। বিছানার চাদর ছিঁড়ে দড়ি পাকিয়েছিল ওরা। ফাস তৈরি করে ফেলে রেখেছিল দরজার কাছে। তারপর মেয়েটা মেঝেয় পড়ে চেঁচাতে শুরু করেছিল পেট ব্যথা পেট ব্যথা বলে।
ভুরু কুঁচকে গেছে মরিডোর। আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে। ঠিক, ঠিক বলেছেন! কাজ হবে এতে! গলার স্বর খাদে নামাল। কিন্তু ফাস বানাব কি দিয়ে?
কেন, বিছানার চাদর, বলল কিশোর। ওরা যা করেছিল। আমাদের এটা পুরানো। তাতে কিছু যায় আসে না। ছিঁড়ে ভালমত পাকিয়ে নিলে যথেষ্ট শক্ত হবে। হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়বে না। ওরা ছিল দুজন, তা-ও আবার একজন মেয়ে। আমরা তিনজনেই ছেলে, গায়ে জোরও আছে। আমাদের তো আরও সহজে পারা উচিত।
ঠিক, বিড়বিড় করল মরিডো। সহজেই পারা উচিত। তাছাড়া, প্রহরীদের একজন আমাদের লোক। কাজেই দরজা খোলানো তেমন কঠিন হবে না।
কাজে লেগে পড়ল ওরা। পুরানো হলেও চাদরটা বেশ শক্ত। জোরে টান দিয়ে ছিঁড়তে গেলে শব্দ হবে। তাই আস্তে আস্তে ছিঁড়তে লাগল। তাড়াহুড়ো করল না মোটেই।
চার ইঞ্চি চওড়া একটা ফালি ছেঁড়া হয়ে গেল। আরেকটা ছিঁড়তে শুরু করল ওরা।
খুব ধীরে এগোচ্ছে কাজ। দাঁত ব্যবহার করতে হচ্ছে কখনও কখনও। একের পর এক ফালি ছিঁড়তে লাগল তিনজনে। বড় চাদর। শেষই হতে চায় না যেন আর। শব্দ হয়ে যাবার ভয়ে টান দিয়ে আধ ইঞ্চির বেশি ছিঁড়তে পারছে না একবারে।
আটটা ফালি ছেঁড়া হয়ে গেলে, থামল ওরা। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে। বিশ্রাম নেবে। উত্তেজিত হয়ে আছে। শুয়ে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসল আবার। না, কাজ শেষ না করে স্বস্তি পাবে না। কোন কারণে যদি দেখে ফেলে প্রহরীরা, চাদর ছিঁড়ছে ওরা, তাহলেই গেল সুযোগ। আর বেরোতে পারবে না। কাজেই, যত তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারবে কাজ, ততই মঙ্গল। _ আবার ছিঁড়তে শুরু করল ওরা। আঙুল ব্যথা হয়ে গেছে। নাইলনের চাদর, কাজটা মোটেই সহজ নয়।
ছেঁড়ার কাজ শেষ হল। একটার সঙ্গে আরেকটা পাকিয়ে কয়েকটা দড়ি বানিয়ে ফেলতে হবে এখন।
এটা সহজ কাজ। বেশিক্ষণ লাগল না। তৈরি হয়ে গেল নাইলনের দড়ি। শক্ত। ফাঁস তৈরি করে ফেলল কিশোর। মরিডোর পায়ে লাগিয়ে টেনে দেখল।
উত্তেজনা চাপা দিতে পারল না মরিডো। ব্রোজাস! ফিসফিস করে বলল সে। কাজ হবেই। চারটে দিয়েই তো হবে। আর কি দরকার?
হ্যাঁ, হবে, মাথা ঝোঁকাল কিশোর।
আরও কয়েকটা বানিয়ে নিই, প্রস্তাব দিল রবিন। সঙ্গে নিয়ে যাব। কাজে লাগতে পারে দড়ি।
একটার সঙ্গে আরেকটা ফালি বেঁধে জোড়া দিয়ে নিল ওরা। বেশ লম্বা শক্ত আরেকটা দড়ি তৈরি হয়ে গেল। কোমরে পেঁচিয়ে নিল ওটা মরিডো।
এইবার আসল কাজ, ফিসফিস করে বলল কিশোর। নথি, চৌকিতে শুয়ে পড় চিত হয়ে। কোঁকাতে শুরু কর। মাঝে মাঝেই গুঙিয়ে উঠবে। এমন ভাব দেখাবে, যেন মাথার যন্ত্রণায় অস্থির। প্রথমে আস্তে, তারপর সুর চড়াতে থাকবে। মরিডো, দরজার কাছে দুটো ফাস বিছিয়ে দিন। ব্যাটারা ঢুকলেই যেন পা পড়ে।
তৈরি হয়ে গেল ফাঁদ। এইবার টোপ ফেলার পালা। গোঙাতে শুরু করল রবিন। সেই সঙ্গে কোঁকানি। বাড়তে থাকল। চড়তে লাগল সুর। চমৎকার অভিনয়। মনে হচ্ছে, সত্যি, মাথার যন্ত্রণায় ভারি কষ্ট পাচ্ছে বেচারা।
মিনিটখানেক পরেই দরজার ফোকরের ঢাকনা সরে গেল। মুখ দেখা গেল একটা। চোখ ঘরের ভেতরে। চুপ! ধমকে উঠল প্রহরী। এত গোলমাল কিসের? ভ্যারানিয়ান ভাষা। বুঝল না দুই গোয়েন্দা।
হাতে মোমবাতি নিয়ে রবিনের মুখের ওপর ঝুঁকে আছে কিশোর। চৌকির কাছেই দাঁড়িয়ে আছে মরিডো। প্রহরীর কথায় ফিরে চাইল। ব্যথা পেয়েছে, ভ্যারানিয়ান ভাষায় জবাব দিল সে। গতরাতে দড়ি থেকে হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল। বাড়ি লেগেছে মাথায়। সাংঘাতিক, জ্বর উঠেছে এখন। ডাক্তার দরকার।
সব তোমাদের শয়তানী, ইবলিসের দল!
আমি বলছি, ও অসুস্থ! চেঁচিয়ে উঠল মরিডো। পায়ে পায়ে এগোল দরজার দিকে। এসে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখ। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।…তাহলে…তাহলে বলব রূপালী মাকড়সা কোথায় আছে। তোদের ওপর খুশি হবে ডিউক রোজার।
দ্বিধা গেল না প্রহরীর।
ভাল করেই জান, আবার বলল মরিডো, আমেরিকান ছেলে দুটোর কোন ক্ষতি হোক, এটা চায় না ডিউক। আমি বলছি ছেলেটা অসুস্থ। ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। রূপালী মাকড়সা পেয়ে যাবে। আহ, তাড়াতাড়ি কর! ওর অবস্থা খুব খারাপ!
সত্যি বলছে কিনা দেখা দরকার, ফোকরে উঁকি দিয়েছে এসে দ্বিতীয় প্রহরী। মরিডোর কানে কানে মেসেজ দিয়েছিল সে-ই। ডিউকের কুনজরে পড়তে চাই না। আমি দরজায় থাকছি, তুমি ভেতরে। গিয়ে দেখে এস। দুতিনটে বাচ্চা ছেলেকে ভয় করার কিছু নেই।
ঠিক আছে, বলল অন্য প্রহরী। যাচ্ছি। কথা সত্যি না হলে কপালে খারাপি আছে ওদের, বলে দিলাম!
তালায় চাবি ঢোকানর শব্দ হল। শব্দ তুলে, খুলে গেল দরজা। ভেতরে পা রাখল প্রহরী।
পা দিয়েই ফাঁদে আটকাল। দড়ির ফাঁসের মাঝখানে পা পড়ল প্রহরীর। হ্যাঁচকা টান দিয়ে ফাঁসটা আটকে দিল মরিডো। টান সইতে না পেরে দড়াম করে চিত হয়ে পড়ে গেল লোকটা। হাতের লণ্ঠন উড়ে গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
লাফ দিয়ে এগিয়ে এসেছে কিশোর। আরেকটা ফাঁস আটকে দিল প্রহরীর গলায়। জোর টান দিলেই দম বন্ধ হয়ে যাবে। দ্রুত তৃতীয়। আরেকটা ফাস তার দুহাতে আটকে দিল মরিডো।
এতই দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাগুলো, প্রথমে বিমূঢ় হয়ে গেল প্রহরী। চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ জলদি জলদি এস! বিচ্ছুগুলো আটকে ফেলেছে। আমাকে!
ছুটে এল দ্বিতীয় প্রহরী। দরজার পাশেই অপেক্ষা করছে মরিডো। চোখের পলকে পায়ে আর গলায় একটা করে ফাঁস আটকে গেল দ্বিতীয় লোকটারও। হাতে আটকাল আরেকটা।
দ্বিতীয় প্রহরীর কানে কানে ফিসফিস করে বলল মরিডো। ছাড়া পাবার ভান করতে থাক! চুপ করে থেক না।
হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগল লোকটা।
শক্ত করে দুই প্রহরীকেই বেঁধে ফেলা হল। নড়ার উপায় রইল না আর ওদের।
মেঝেতে পড়ে থাকা লোক দুটোর দিকে চেয়ে হাসল মরিডো। মাকড়সার জালে আটকা পড়া পোকার অবস্থা হয়েছে যেন প্রহরীদের। শুভ লক্ষণ! আশা আর উদ্যম আবার ফিরে এল তার।
জলদি করুন! দই গোয়েন্দাকে বলল মরিডো। করিডরের অন্য মাথায় প্রহরী থাকতে পারে। চেঁচামেচি শুনলে ছুটে আসবে ওরা। লণ্ঠন তুলে নিন।
করিডরে বেরিয়ে এল মরিডো। পেছনে কিশোর আর রবিন। সামনে গাঢ় অন্ধকার। সেদিকেই ছুটল ওরা। ছোটার তালে তালে নাচছে বৈদ্যুতিক লণ্ঠনের আলো।
করিডরের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। সিঁড়ি নেমে গেছে। এক মুহূর্ত। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল মরিডো। একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকাচ্ছে। তাকে অনুসরণ করল দুই গোয়েন্দা।
সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছেই একটা ম্যানহোল। লোহার ভারি ঢাকনা। কোনকালে শেষ খোলা হয়েছিল, কে জানে! মরচে পড়ে বাদামি হয়ে গেছে, তার ওপর পুরু হয়ে জমেছে ধুলো।
ঢাকনার রিঙ ধরে টান দিল মরিডো। নড়াতে পারল না। আবার টান দিল গায়ের জোরে। কোন কাজ হল না। অটল রইল ঢাকনা।
আটকে গেছে! ফাঁসাসে আওয়াজ বেরোল মরিডোর গলা থেকে। মরচে! নড়াতে পারছি না!
জলদি! বলে উঠল কিশোর। জলদি দড়ি ঢোকান রিঙের ভেতর। সবাই ধরে টান দেব!
ঠিক! দ্রুত কোমরে পেঁচানো দড়ি খুলে নিতে লাগল মরিডো।
সবটা খোলার দরকার হল না। একটা প্রান্ত রিঙের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। শক্ত করে ধরল তিনজনে। টান লাগাল।
নড়ল না ঢাকনা।
ওরাও নাছোড়বান্দা। টান বাড়াল আরও, আরও…! পেছনে পায়ের শব্দ। দ্রুত এগিয়ে আসছে। আর সময় নেই। হ্যাঁচকা টান লাগাল ওরা। অটল থাকতে পারল না আর ঢাকনা। নড়ে উঠল!
ঠনন আওয়াজ তুলে পাথরের মেঝেতে উল্টে পড়ল ভারি ঢাকনা। গর্তের ভেতরে কালো অন্ধকার। পানি বয়ে যাবার শব্দ আসছে।
আমি আগে যাই, টেনে রিঙের ভেতর থেকে দড়িটা খুলে আনতে আনতে বলল মরিডো। দড়ি ধরে থাকবেন। তাহলে হারানর ভয়। থাকবে না।…নাহ, এসে গেছে ব্যাটারা! ঢাকনা বন্ধ করে যাবার আর সময় নেই…
গর্তের ভেতরে পা রাখল মরিডো। দড়ির একটা প্রান্ত ধরে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।
দড়ির মাঝামাঝি ধরেছে রবিন। লণ্ঠনের সরু হ্যাঁণ্ডেল ধরে রেখেছে। দাঁতে কামড়ে। গর্তের দিকে চেয়ে কেঁপে উঠল একবার। ওই অন্ধকার মোটেই ভাল লাগছে না তার। নিচ থেকে আসা পানির আওয়াজও কানে সুধা বর্ষণ করছে না। কিন্তু তবু যেতেই হবে। মুহূর্ত দ্বিধা করেই। ভেতরে পা রাখল সে।
হাঁটু অবধি পা ঢুকিয়ে দিল রবিন। কিছুই ঠেকল না। তবে কি সিঁড়ি নেই! না না আছে। লোহার মই। খাড়া। নেমে পড়ল সে। এক ধাপ…দুই ধাপ…পা পিছাল হঠাৎ করেই। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারল না ম্যানহোলের কিনারা।
রবিনের মনে হল, পতন আর কোন দিন শেষ হবে না। কিন্তু হল। প্রাচীন পাথুরে নর্দমার তলায় এসে নামল নিরাপদেই। গর্তের মুখ থেকে উচ্চতা বড় জোর সাত-আট ফুট হবে। কোনরকম আঘাত পায়নি, কারণ হাঁটু পানিতে পড়েছে। তাছাড়া, পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ধরে ফেলেছে মরিডো।
চুপ, কানে কানে বলল মরিডো। ওই যে, কিশোর। সরুন। নামার জায়গা দিন।
কিশোরও পা পিছলাল। তবে রবিনের মত নিরাপদে নামতে পারল না। সড়াৎ করে পিছলে গেল। ধপ করে পড়ে গেল পাথরের মেঝেতে চিত হয়ে। মইয়ের গোড়ায় মাথা বাড়ি লাগার আগেই ধরে ফেলল তাকে মরিডো। টেনে তুলল।
বাপরে বাপ! ঠাণ্ডা!…উফফ, মেরুদণ্ডটা ভেঙেই গেছে! হাঁসফাস করে উঠল গোয়েন্দাপ্রধান।
বৃষ্টির পানি, তাড়াতাড়ি বলল মরিডো। ময়লা নেই। চলুন, কেটে পড়ি। দড়ি ছাড়বেন না কিছুতেই। পথ হারাবেন তাহলে। নদীর দিকে বয়ে যাচ্ছে পানি। ড্রেনের মুখে লোহার মোটা মোটা শিক…
মাথার ওপরে চিৎকার শুনে চুপ হয়ে গেল মরিডো। লণ্ঠন ঝুলছে, আলো।
সরে এল তিনজনে। হাঁটতে শুরু করল।
কয়েক গজ এগিয়েই নিচু হয়ে এল সুড়ঙ্গের ছাত। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। মাথা সামান্য নুইয়ে রাখতে হচ্ছে। হাঁটুর নিচে পানির তীব্র স্রোত। পিচ্ছিল মেঝে। অসতর্ক হলেই আছাড় খেতে হবে।
ম্যানহোলের মুখে অনেক লোকের চেঁচামেচি। একটা মোড় ঘুরতেই আলো আর দেখা গেল না।
ধীরে ধীরে দূরে, অনেক দূরে মিলিয়ে গেল যেন চেঁচামেচি। আসলে খুব বেশি এগোয়নি ওরা। ম্যানহোল দিয়ে সুড়ঙ্গের ভেতরে বাইরের শব্দ আসতে পারছে না ঠিকমত।
সুড়ঙ্গের একটা মিলনস্থলে এসে পৌঁছুল ওরা। আরেকটা সুড়ঙ্গের সঙ্গে আড়াআড়ি মিলিত হয়েছে প্রথমটা। যেমন উঁচু তেমনি চওড়া। ওটাতে ঢুকে পড়ল ওরা।
দাঁড়ানো যাচ্ছে এখন সোজা হয়ে। ছাতে মাথা ঠেকছে না। পানি বেশি বড় সুড়ঙ্গটায়, স্রোতও বেশি। শাখা-সুড়ঙ্গগুলো থেকে এসে, এটাতে পড়ছে পানি। কলকল ছলছল আওয়াজ তুলছে পাথরের দেয়ালে বাড়ি দিয়ে। শক্ত করে দড়ি ধরে রেখেছে ওরা। বৈদ্যুতিক লণ্ঠনের আলোতেও কাটতে চাইছে না সামনে পেছনের ঘন কালো অন্ধকার। স্রোতের বিপরীতে এগোতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
চলতে চলতে দুপাশে অসংখ্য ছোটবড় ফাটল দেখতে পেল ওরা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ঝাড়া দিয়ে মাথা থেকে পানিতে ফেলে দিল কিছু একটা। তীক্ষ্ণ কাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠল ফাটলের ভেতর থেকে।
ইদুর, হেসে বলল মরিডো। পানি বইছে, তাই রক্ষে। নইলে এতক্ষণে হয়ত আক্রমণই করে বসত।
খাবি খেতে খেতে এগিয়ে এল একটা বাদামি রোমশ জীব। টকটকে লাল চোখ। কাছে এসে কিশোরের পা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করল। ঝাড়া দিয়ে ইঁদুরটাকে আবার পানিতে ফেলে দিল সে। স্রোতের ধাক্কায় ভেসে চলে গেল ওটা।
পেছনে মানুষের গলার আওয়াজ শোনা গেল!
ব্যাটারা আসছে! ফিসফিস করে বলল মরিডো। আসছে শুধু ডিউকের ভয়ে। সুড়ঙ্গগুলো চেনে না ওরা। তবু আসতে হচ্ছে।
গতি বাড়াল ওরা। ধীরে ধীরে পানি বাড়ছে, স্রোতও বাড়ছে। আরও খানিকটা এগিয়ে ঝর্না দেখতে পেল। না না, ঝর্না না। খোলা। ম্যানহোল দিয়ে একনাগাড়ে ঝরে পড়ছে, হয়ত রাস্তার পানি।
এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। ভিজতেই হল। চুপচুপে হয়ে গেল। মাথা-গলা-শরীর। ম্যানহোলটা পেছনে ফেলে এল ওরা।
হঠাই বেরিয়ে এল একটা বড়সড় ড্রামের মত গোল কক্ষে। চারপাশের দেয়ালে ছোট বড় গর্ত। সুড়ঙ্গমুখ।চারদিক থেকে এসে প্রধানটার সঙ্গে মিশেছে শাখা-সুড়ঙ্গগুলো। পানি থই থই করছে এখানে। লোহার ঢালু মই উঠে গেছে ওপরের দিকে।
ইচ্ছে করলে এদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি, বলল মরিডোে। কিন্তু উচিত হবে না। প্রাসাদের কাছাকাছিই রয়ে গেছি এখনও। আসুন, মইটাতে উঠে বসে জিরিয়ে নিই। প্রহরীরা আসতে অনেক দেরি আছে, যদি এতটা আসার সাহস করে ওরা। পানি ঝরছে যে, ওই ম্যানহোেলটার ওপাশ থেকেই ফেরত যেতে পারে হয়ত।
দুই ফুট চওড়া একেকটা ধাপ। তিনটা ধাপে উঠে বসল তিনজনে।
হেলান দিতে গিয়েই ককিয়ে উঠল কিশোর। ছোঁয়াতে পারছে না পিঠের নিচের অংশ। উত্তেজনায় ব্যথা টের পায়নি এতক্ষণ।
কি হল, মুখ তুলে তাকাল রবিন আর মরিডো।
কিছু না। পিঠে চোট পেয়েছি। সামান্য।
শেষ পর্যন্ত তাহলে পালাতে পারলাম! জোরে একটা শ্বাস ফেলে বলল রবিন। এতটা যখন চলে এসেছি, আর ধরতে পারবে না।
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মরিডো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, বাতি নিভিয়ে ফেলুন! জলদি!
সঙ্গে সঙ্গে বাতির সুইচ অফ করে দিল দুই গোয়েন্দা।
ড্রামের মৃত গোল দেয়ালের গায়ে বড় বড় দুটো গর্ত, প্রধান সুড়ঙ্গের দুটো মুখ। বাকিগুলো সব ছোট ছোট। ওগুলো দিয়ে ঢোকা যাবে না। বড় দুটো গর্তের একটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা খানিক আগে। ওটা দিয়েই আসছে প্রহরীরা। দ্বিতীয় মুখ, যেটা দিয়ে এগিয়ে যাবে ভেবেছিল, ওটাতে আলো দেখা যাচ্ছে। ওদিক থেকেও আসছে লোক!
তারমানে, ফাঁদে পড়ে গেছে তিনজনে।