১৬.

 বেল বাজাল কিশোর।

দরজা খুলে দিল মিকো ইলিয়ট। এস। মাত্র ফিরেছে তোমার বন্ধু রবিন। কিছু একটা শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। তোমার অপেক্ষাই করছে।

একটা সোফায় বসে আছে রবিন। কোলের ওপর খোলা নোট বুক।

পুরানো ধাঁচের একটা চেয়ারে বসা মিস্টার অলিভার। কিশোরকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, লারিসা কেমন আছে?

ভাল, জানাল কিশোর।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। জ্যাকবস? তাকে দেখতে গিয়েছিলে?

গিয়েছিলাম। তেমন আহত মনে হল না। তবে বিশ্রাম দরকার। ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছে। ডাক্তাররা পর্যবেক্ষণে রাখতে চাইছেন।

অ।

আপনার কোন অসুবিধে হয়নি তো?

না, মাথা নাড়লেন অলিভার। বসে না থেকে মিকোকে নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিলাম। টাকা তুলে নিয়ে এসেছি, ল্যাম্প রাখা টেবিলটা দেখালেন। মুদি দোকান থেকে জিনিসপত্র আনার একটা বাদামী ব্যাগ পড়ে আছে। টাকা কত তুলে এনেছি, কত জমা দিয়েছি। জীবনে এত অস্বস্তি বোধ করিনি আর কখনও!

বুদ্ধিটা ভালই বের করেছ, বলে উঠল মিকো। বাজারের ব্যাগে করে টাকা নিয়ে আসা। দশ হাজার ডলার! কেউ কল্পনাই করতে পারবে না।

ব্যাগের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে হাসল কিশোর। হ্যাঁ, ভাল বুদ্ধি।

আবার বাজল বেল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল মিকো।

মুসা ঢুকল। ধপাস করে বসে পড়ল রবিনের পাশে। কোন লাভ হল না! হতাশ কণ্ঠ। মিথ্যে কথা বলেনি টমি। কাজেই গেছে। আর ব্রায়ান এনড্রুও মিছে কথা বলেনি। সে-ও মোটেলে উঠেছে।

লাভ হল না বলছ কেন? জেনে আসাতে সুবিধেই হয়েছে, মুসাকে আর কিছু– বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে ঝুঁকল রবিন। সবাই এসে গেছ। এবার আমার কথা শুরু করি।

কি জেনে এসেছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

একই সময়ে একই সঙ্গে দুজায়গায় থাকতে পারে কিছু কিছু মানুষ, কণ্ঠে রহস্য ঢালল রবিন। ধীরে ধীরে বলে গেল সব, যা যা জেনে এসেছে প্রফেসর লিসা রোজারের কাছ থেকে।

তার মানে, রবিন থামলে বলল কিশোর। টমি দেয়াল ভেদ করে যেখানে খুশি ঢুকতে পারে, এটা বৈজ্ঞানিক সত্য।

লিসা খালা তো তাই বলল।

যাক! আজ নিশ্চিন্ত! জোরে শ্বাস ফেলল মুসা। ম্যানেজারকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকতে পারবে না ব্যাটা। কাজেই ছায়া হয়ে এ-ঘরে আসতে পারবে না।

উঠে গিয়ে ব্যাগটাসহ টাকাগুলো ছোট একটা আলমারিতে ভরে তালা দিয়ে দিলেন অলিভার। সতকর্তা। আশা করি, ছায়া মাথাটা এই আলমারিতে সেঁধিয়ে দিতে পারবে না হারামজাদা!–

 যদি পারেও, ব্যাগটা ছাড়া আর কিছু দেখতে পারবে না, কথার পিঠে বলল রবিন। ছায়া চোখ দিয়ে লোকে দেখতে পারে, কিন্তু ছায়া আঙুল দিয়ে কিছু নাড়তে পারে না। কাজেই ভয় নেই।

এজন্যেই, মিসেস ডেনভারের কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে নেবার পর আর কোন জিনিস নাড়াচাড়া হয়নি, বললেন অলিভার। ঘাটাঘাটি করত শুধু ওই বুড়িটাই। টমি ব্যাটা শুধু বাইরে যা আছে দেখতে পারে, দেখে চলে যায়।

হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল কিশোর। এখন বোঝা যাচ্ছে, মান্দালাটার কথা জানল কি করে টমি। ছায়াশ্বাপদের কথাও সে জানে। আপনি মিস্টার ইলিয়টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন, সে শুনেছিল। তবে, যেহেতু ছায়া শরীর কিছু ধরতে পারে। না, চোর টমি নয়। চুরিটা যখন হয়, তার ঘরে ঢুকছিল টমি। বারদুই নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল সে। বিশ্বাস করা কঠিন। তবে ডক্টর ক্লোজারের কথা অবিশ্বাসও করা যায় না। তিনি বিজ্ঞানী। আলতু-ফালতু কথা বলেন না। তাছাড়া, ওই ছায়ার। ব্যাপারটার সঙ্গে তাঁর থিওরি পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না আর।

জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মুসা। দৃষ্টি রাস্তার দিকে। হঠাৎ বলল সে, জ্যাকবসের ভাগ্নে চলে যাচ্ছে।

তারমানে, এ বাড়িতে এখন আমরা ছাড়া আর কেউ নেই, যে আলমারিতে টাকা রেখেছেন অলিভার, সেটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। ব্যাগ ভর্তি টাকা! রহস্যময় শোনাল তার কণ্ঠ। যেহেতু ব্যাগের ভেতরে রয়েছে, টাকাগুলো অদৃশ্য! হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল দুই চোখ। কোন জিনিস আরেকটা জিনিসের ভেতরে থাকলেই অদৃশ্য!

কিশোর, কি বলছ, কিছু বুঝতে পারছি না! বলল রবিন।

একটা গল্প শোনাব?

কিশোর! গুঙিয়ে উঠল মুসা। ফিরে তাকিয়েছে। আর ভুগিও না! বলে ফেল!

খুনের গল্প, কারও দিকেই তাকাল না কিশোর। অনেকদিন আগে একটা বইয়ে পড়েছিলাম। অদৃশ্য একটা অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছিল লোকটাকে।

তাই? আগ্রহী হয়ে উঠেছেন অলিভার।

ঘরে বসে ডিনার খাচ্ছিল একটা লোক আর তার স্ত্রী, বলল কিশোর। তাদের সঙ্গে সেরাতে খেতে বসেছিল লোকটার এক বন্ধু। দরজা-জানালা সব বন্ধ ঘরের। কি একটা ব্যাপার নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হল লোকটা আর তার বন্ধুর মাঝে। হাতাহাতি শুরু হল এক পর্যায়ে। হাতের নাড়া লেগে টেবিলে বসানো একমাত্র মেমিটা উল্টে পড়ে নিভে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল ঘর। অন্ধকারে স্বামীর আর্তনাদ শুনতে পেল স্ত্রী। টের পেল, তার জামার ঝুলে টান পড়েছে। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল। মহিলা। চিৎকার শুনে ছুটোছুটি করে এল চাকর-বাকরেরা। আবার আলো জ্বালানো হল। দেখা গেল, মেঝেতে মরে পড়ে আছে লোকটা। রক্তাক্ত। বুকের বাঁ পাশে একটা ক্ষত। ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপছে বন্ধুটি। মহিলার জামার নিচের দিকে রক্তের দাগ। পুলিশ এল। কিন্তু বন্ধুকে ধরে নিয়ে গিয়েও আবার ছেড়ে দিতে হল। কারণ, যে অস্ত্র দিয়ে মারা হয়েছে লোকটাকে, সেটা পাওয়া গেল না।

আশ্চর্য! বলে উঠল মিকো। কি দিয়ে খুন করা হয়েছিল?

হাসল কিলোর। ব্যাপারটা মেনে নিতে পারল না লোকটার স্ত্রী। তাঁদড় এক গোয়েন্দার কাছে গিয়ে ধর্না দিল। পাওয়া গেল অস্ত্রটা। আবার বন্ধুকে অ্যারেস্ট করল পুলিশ। ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুনের দায়ে ঝুলিয়ে দিল ফাঁসিতে। খুন করা হয়েছিল ছুরি দিয়ে।

ছুরি! চেঁচিয়ে উঠল মিকো। কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল?

বড় একটা কাঁচের ফানেলে পানি ভরে তাতে মানিপ্ল্যান্ট লাগিয়েছিল খুন হওয়া লোকটার স্ত্রী। খুন করেই মহিলার জামায় ছুরির রক্ত মুছে ফেলল বন্ধুটা। ছুরিটা নিয়ে ঢুকিয়ে রাখল ফানেলে।

ওটা তো প্রথমেই পুলিশের চোখে পড়ে যাবার কথা! হাঁ হয়ে গেছে মুসা।

না, কথা না। কারণ ছুরিটা তৈরি হয়েছিল শক্ত ক্রিস্টাল দিয়ে। পানিভর্তি কাঁচের ফানেলে ঢুকিয়ে রাখতেই অদৃশ্য হয়ে গেল। পানি আর কাঁচের সঙ্গে মিশে গেল স্বচ্ছ জিনিসটা। অলিভারের দিকে তাকাল সে হঠাৎ। মিস্টার অলিভার, কেন বিষ খাওয়ানো হল মিস ল্যাটনিনাকে? কারণ, রোজ রাতে নিয়মিত সাঁতার কটিতে। নামত সে সুইমিং পুলে।

ঈশ্বর! চেঁচিয়ে উঠল মিকো।

এবং মিসেস ডেনভার, বলে গেল কিশোর, যতই ছোঁক ছোঁক করুক, আগে তো কেউ কোন ক্ষতি করেনি তার। তার গাড়িতে বোমা মারা হল কবে? পুলের পানি পরিষ্কার করবে, বলার পর। মিস্টার অলিভার, আমরা ক্রিস্টালে তৈরি একটা মূর্তি খুঁজছি। যেটা ওই ছুরির মত জিনিস দিয়েই তৈরি। যেটা পানিতে অদৃশ্য হয়ে যায়।

পুল! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। পুলের পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়েছে মূর্তিটা!

 কোমরে হাত রেখে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল কিশোর। আগামীকাল দশ হাজার ডলার দিয়ে মূর্তিটা কিনতে হবে, মিস্টার অলিভার। কেন? আজই যদি পুল থেকে তুলে নিয়ে আসি ওটা? এখনই উপযুক্ত সময়। বাইরের কেউ নেই এখন বাড়িতে।

ঠিক! ঠিক বলেছ! উত্তেজনায় কাঁপছেন অলিভার।

হাসল কিশোর। রবিন, পেছনের গেটে গিয়ে দাঁড়াও তুমি। কেউ আসে কিনা দেখবে। মুসা, সামনের গেটে তুমি থাকবে। রাস্তার দিকে নজর রাখবে।

তুমি? জানতে চাইল মুসা।

সাঁতার কাটতে যাব, শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করেছে কিশোর।

রবিন আর মুসা গিয়ে দাঁড়াল দুই গেটে। কিশোরকে অনুসরণ করে পুলের কিনারে এসে দাঁড়ালেন অলিভার আর মিকো।

খালি গা। ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠল কিশোর। একটু দ্বিধা করে নেমে পড়ল সে পানিতে। গলা পানিতে এসে ডুব দিল।

অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রইলেন অলিভার আর মিকো। এত দেরি করছে। কেন কিশোর! আসলে তিরিশ সেকেণ্ডও যায়নি, এটা খেয়াল করছে না তারা।

ভুসস করে ভেসে উঠল কিশোর। ডান হাতটা তুলল পানির ওপর। হাতে কিছু। একটা ধা।

পেয়েছে। পেয়েছে! প্রায় নাচতে শুরু করলেন অলিভার।

চুপ! আস্তে! থামিয়ে দিল তাঁকে মিকো।

পুলের কিনারে চলে এল কিশোর। জিনিসটা বাড়িয়ে দিল অলিভারের দিকে।

কাঁপা কাঁপা হাতে নিলেন অলিভার। অপূর্ব একটা শিল্পকর্ম। নিখুঁত সৃষ্টি। পেশীগুলো পরিষ্কার, প্রায় চৌকোনা ভোতা মাথাটাকে জ্যান্তই মনে হচ্ছে। বড় বড় চোখ দুটো সোনালি, দুই কশে সোনালি ফেনা। সামনের পায়ের নিচ থেকে কানের ডগার উচ্চতা ছয় ইঞ্চি। সামনের দুই পায়ের ফাঁকে ক্রিস্টালে তৈরি মানুষের খুলির একটা খুদে প্রতিকৃতি আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কুকুরটার কোমরে মোটা লম্বা সুতো বাধা। স্বচ্ছ, প্লাস্টিকের সুতো।

এত সহজ! বলল কিশোর। পানিতে নামারও দরকার হয়নি চোরের। সুতোয় ধরে আস্তে করে পানিতে ছেড়ে দিয়েছে মূর্তিটা, ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে গভীর পানিতে চলে গেছে ওটা। হাত থেকে সুতো ছেড়ে দিয়েছে চোর। স্বচ্ছ সুতো, পানির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে। কুকুরটার চোখ আর কশের ফেনা সোনালি, তলার সোনালি মোজাইকের সঙ্গে মিলে গেছে।

বুদ্ধি আছে চোর-ব্যাটার! স্বীকার করল মিকো।

দিন ওটা। অলিভারের দিকে হাত বাড়াল কিশোর।

দেব!

 হ্যাঁ। আবার পুলের তলায় রেখে দেব।

কেন!

কারণ, আজ রাতে এটা নিতে আসবে চোর। টেলিভিশন মনিটর অন করে দেব। ঘরে বসেই দেখতে পাব চোরকে।

বুঝেছি, মূর্তিটা ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করছেন অলিভার।

 দিয়ে দাও, ফ্র্যাঙ্ক, বলল মিকো।

কিন্তু-কিন্তু মূর্তিটার ক্ষতি হতে পারে!–ভেঙেটেঙে ফেলতে পারে—

ভাঙবে না। ও ব্যাপারে হুশিয়ার থাকবে চোর। ভাঙা মূর্তি বিকোবে না।

ইচ্ছের বিরুদ্ধে মূর্তিটা আবার কিশোরের হাতে তুলে দিলেন অলিভার।

ডুব দিয়ে আবার আগের জায়গায় জিনিসটা রেখে এল কিশোর। ঠাণ্ডায়। কাঁপতে কাঁপতে পানি থেকে উঠে এল। একটা তোয়ালে আর কিছু ন্যাকড়া দরকার। পুলের ধারে এত পানি দেখলে সন্দেহ করে বসবে চোর। পানিতে নেমেছি, অনুমান করে ফেলবে। তাছাড়া চত্বরে ভেজা ছাপ থাকাও উচিত না।

প্রায় ছুটে চলে গেল মিকো। মিনিটখানেক পরেই অলিভারের ঘর থেকে একটা তোয়ালে আর কিছু ছেঁড়া কাপড় নিয়ে এল। তোয়ালেটা কিশোরের হাতে তুলে দিয়ে নিজে পুলের কিনারে ঝরে পড়া পানি পরিষ্কার করতে লেগে গেল।

দ্রুতহাতে গা মুছতে লাগল কিশোর।

সামনের গেট থেকে ছুটে এল মুসা। এনড্রু আসছে!

রবিনকে ডাকো! মিকোর দিকে চেয়ে বলল কিশোর, আপনারা দুজন ওপরে চলে যান! তাড়াতাড়ি ভেজা পায়ের তলা মুছে ফেলতে লাগল সে।

সবার শেষে অলিভারের বসার ঘরে ঢুকল কিশোর। অন্য চারজন আগেই ঢুকে পড়েছে। দরজা বন্ধ করে দিল মিকো। টেলিভিশনের সুইচ অন করল কিশোর।

গেটে দেখা দিল বেড়াল-মানব। চতুর দিয়ে হেঁটে চলল নিজের ফ্ল্যাটের দিকে।

পুলের দিকে তাকালও না! বিড়বিড় করল কিশোর। ভেজা প্যান্ট খুলে ফেলে তোয়ালে জড়িয়ে নিয়েছে কোমরে।

কেন? রবিন শুকনো একটা শার্ট এনে দিল বন্ধুকে। তাকাল না কেন?

মনে হয় গেট থেকেই খেয়াল করেছে, পুলের পানিতে ঢেউ। বোঝাই যায়, কেউ নেমেছিল। কিনারের পানিও পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়নি।

ও চোর নয় তাহলে! বলল মুসা।

হয় চোর নয়, কিংবা সন্দেহ করে ফেলেছে, পুলে নেমেছিল কেউ। মূর্তিটা পাওয়া গেছে। আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে তার ওপর। তা যদি হয়ে থাকে, অসম্ভব ধূর্ত সে!—দেখা যাক, কি হয়!

একটা দুটো করে বেড়াল ঢুকতে শুরু করল চত্বরে। এনড্রুর ঘরের বারান্দায় জমায়েত হল কয়েক ডজন। অর্ধচন্দ্রকারে বসে পড়ল। একগাদা প্লেট হাতে বেরিয়ে এল এনড্রু। একটা করে প্লেট রাখল প্রতিটা বেড়ালের সামনে। আবার ঘরে ঢুকল। বড় একটা পাত্রে করে খাবার নিয়ে বেরোল। প্লেট ভরে খাবার দিল। বেড়ালগুলোকে।

জানোয়ারগুলো খাচ্ছে, আর সামনে বসে দেখছে এনড্রু। কথা বলছে ওগুলোর সঙ্গে। আশ্চর্য শৃঙ্খলা! একে অন্যের সঙ্গে মারামারি করল না বেড়ালগুলো, কামড়াকামড়ি খামচাখামচি কিছুই করল না। শান্তভাবে যার যার প্লেটের খাবার শেষ করে চলে গেল একে একে।

প্লেটগুলো নিয়ে আবার ঘরে ঢুকে গেল এনড্রু। খানিক পরেই দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে চলে গেল সে-ও।

টেলিভিশনের পর্দায় একনাগাড়ে চোখ রাখল তিন গোয়েন্দা। এগারোটার সময় যথারীতি আলো নিবে গেল। বেড়াল-মানবের পর আর কেউ ঢোকেনি চত্বরে। বসার ঘরে বসেই ডিনার খেয়ে নিয়েছে ওরা তিনজনে।

জ্যাকেট তুলে নিল মুসা সোফার ওপর থেকে। গায়ে চড়াল। ব্যালকনিতে যাচ্ছি। লুকিয়ে থেকে চোখ রাখব।

আমিও আসছি, উঠে দাঁড়াল কিলোর। টেলিভিশনের সুইচ অফ করে দিল।

আমিও, রবিনও উঠল। আজ রাতে কিছু একটা ঘটবেই। মিস করতে চাই না। বঞ্চিত করতে চাই না চোখকে।

.

১৭.

 মাঝরাতে গেট খোলার শব্দ হল। চত্বরে ঢুকল টমি গিলবার্ট। ঘরে চলে গেল। কয়েক মিনিট আলো দেখা গেল তার জানালায়, তারপর নিবে গেল।

ব্যালকনিতে অপেক্ষা করে আছে তিন গোয়েন্দা।

একটা দরজা খুলল, বন্ধ হল, শোনা গেল মৃদু আওয়াজ।

পুলের ওপাশে একটা ছায়া দেখা গেল। কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা।

ধীরে ধীরে পুলের ধারে এসে দাঁড়াল ছায়াটা। আস্তে করে নেমে পড়ল পানিতে। ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়েছে পানিতে এক জায়গায়, দেখা গেল ছোট ছোট ঢেউ, সাতরে এগোচ্ছে ছায়াটা।

পুলের ঠিক মাঝখানে দেখা গেল একটা মাথা, আবছা! পরক্ষণেই ডুবে গেল। পানির নিচে দেখা গেল আলোর রশ্মি। পানি-নিরোধক টর্চ। নড়াচড়া করছে রশ্মিটা।

হঠাৎ নিবে গেল আলো। পানির ওপরে প্রায় নিঃশব্দে ভেসে উঠল আবার মাথাটা।

যেখান দিয়ে নেমেছিল, সেখান দিয়েই আবার উঠে পড়ল ছায়াটা। ফিরে চলল। মৃদু শব্দ হল দরজা খোলা এবং বন্ধ হবার।

আস্তে করে দরজায় টোকা দিল মুসা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল দরজাটা। টমি! ফিসফিস করে বলল সে।

দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। পেছনে মিস্টার অলিভার আর মিকো ইলিয়ট।

অন্ধকারই রয়েছে টমির জানালা।

ছায়া শরীরে বেরিয়েছিল হয়ত! ফিসফিস করল মুসা।

মোটেই না! সবার আগে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। বেল বাজাল। এক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে আবার বাজাল। গিলবার্ট! ডাকল চেঁচিয়ে। গিলবার্ট, দরজা খুলুন! নইলে পুলিশ ডাকব। ওরা দরজা ভেঙে ঢুকবে।

দরজা খুলে গেল। ঘুমোনর পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে টমি। খালি পা, আবছা দেখা যাচ্ছে। কি হয়েছে? মাঝরাতে ডাকাডাকি কেন? ঘুমিয়েছিলাম…।

ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে দিয়েছে কিশোর। আলো জ্বলে উঠল। ঘাড়ের ওপর। লেপটে আছে টমির ভেজা চুল।

ঘুমোননি, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। পুলে নেমেছিলেন।

না-আ! আমি— থেমে গেল টমি। চুল বেয়ে টপ করে পানি পড়েছে এক ফোঁটা। আমি শাওয়ারে গোসল করছিলাম।

আগে বললেন ঘুমিয়েছিলেন, এখন শওয়ার। দুটোই মিথ্যে কথা, শুধরে দিল কিশোর। আসলে পুলে নেমেছিলেন। পুলের ধার থেকে আপনার দরজা পর্যন্ত এসেছে ভেজা পায়ের ছাপ।

দরজার বাইরে তাকাল টমি। সত্যিই, দরজায় ভেজা ছাপ। কাঁধ ঝাঁকাল সে। বেশ, নেমেছিলাম পুলে। তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল? সারাদিন। পরিশ্রম করেছি, সাঁতার কেটে শান্ত করে নিয়েছি শরীরটাকে।

হাউণ্ডটা কোথায়? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন অলিভার। বজ্জাত! চোর!

কি যা-তা বলছেন! কিছুই বুঝতে না পারার ভান। কিন্তু সামাল দিতে পারল না টমি। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে চোখ, ঝট করে ঘুরে গেছে রান্নাঘরের দিকে।

কোন একটা তাকে রেখেছেন নিশ্চয়, রান্নাঘরের দরজার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। খুব বেশি তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। লুকোনর সময় পাননি।

মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার! বিড়বিড় করল টমি।

মিস্টার অলিভার, বলল কিশোর। পুলিশই ডাকুন। সঙ্গে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আসতে বলবেন।

জোর করে কারও বাড়ি সার্চ করার নিয়ম নেই! বলল টমি। তাছাড়া মাঝরাতে ওয়ারেন্ট জোগাড় করতে পারবে না পুলিশ!

সেটা তাদের ব্যাপার, শান্ত কিশোর। না পারলে সকালতক অপেক্ষা করব। ইতিমধ্যে চত্বর থেকে নড়ছি না। আপনার ফ্ল্যাট ঘিরে রাখব আমরা। আমাদের চোখ এড়িয়ে বেরোতে পারবেন না, মূর্তিটা কোথাও ফেলেও দিয়ে আসতে পারবেন না।

তোমরা তোমরা তা করতে পার না! চেঁচাতে শুরু করেছে টমি। আমাকে, আমাকে অপমান করা হচ্ছে।

অপমান করলাম কোথায়? হাত নাড়ল কিশোর। চতুরে বসে থাকব আমরা, আপনার দরজার দিকে চেয়ে থাকব, এতে কোন দোষ ধরতে পারবে না উকিল। কেন অযথা ঝামেলা বাড়াচ্ছেন? মূর্তিটা দিয়ে দিন, আমরা সব ভুলে যাব। পুলিশ ডাকার দরকারই হবে না।

ঝাড়া কয়েক সেকেণ্ড কিশোরের দিকে চেয়ে রইল টমি। পিছিয়ে গেল দরজার কাছ থেকে। চুলোর ভেতরে রেখেছি। মুখ কালো হয়ে গেছে তার। খামোকা। এসব করতে গেলেন, মিস্টার অলিভার। মুর্তিটা আপনাকেই দিয়ে দিতাম।

ব্যঙ্গ করে হাসলেন অলিভার। তাই নাকি? নিশ্চয় দশ হাজার দেবার পর?

 দশ হাজার! সত্যিই বিস্মিত হয়েছে টমি। কিসের দশ হাজার?

জানেন না? জিজ্ঞেস করল কিশোর। সত্যিই জানেন না টাকাটার কথা?

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল টমি। ভেবেছিলাম, মূর্তিটা মিস্টার অলিভারকে দিলে কিছু পুরস্কার পাব। কিন্তু দশ হাজার ডলার, জানতাম না!

টমির পাশ কাটিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন অলিভার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন আবার। হাতে হাউণ্ডের মূর্তি। কোমরে বাঁধা সুতো মূর্তির শরীরে পেঁচানো।

মিস্টার অলিভার, বলে উঠল কিশোর। টমি চোর নয়। ঘুমের ভেতরে তার ছায়া শরীর শুধু ঘুরে বেড়ায়, দেখে, শোনে। তার বেশি কিছু করতে পারে না।

চমকে উঠল টমি। ফেকাসে হয়ে গেল চেহারা। উঠল-নামল কণ্ঠা, ঢোক গিলেছে।

কি দেখেছিলেন, গিলবার্ট? প্রশ্ন করল কিশোর। ঘুমের ঘোরে মূর্তিটার ব্যাপারে কি দেখেছিলেন? কি শুনেছিলেন?

কাঁপছে টমি। ইচ্ছে করে দেখিনি, শুনিওনি! ছায়া শরীর ঘুরে বেড়ায়, এতে আমার কোন দোষ নেই! ওটা এক ধরনের স্বপ্ন!

কি দেখেছেন স্বপ্নে? আবার প্রশ্ন করল কিশোর।

একটা কুকুর, কাঁচের। দেখলাম, অনেক রাতে, অন্ধকারে পুলের ধারে এসে বসল একটা মানুষ। পানিতে নামিয়ে রাখছে কাঁচের কুকুরটা। মুখ ঢেকে রেখেছিল মানুষটা, চিনতে পারিনি।

আমার মনে হয়, সঙ্গীদের দিকে ফিরল কিশোর, টমি গিলবার্ট সত্যি কথাই বলছেন।

.

১৮.

রক্ত ফিরে আসছে টমির মুখে। দেখ, কিশোর, মূর্তিটা আমি পুল থেকে তুলে এনেছি ঠিকই। কিন্তু সত্যি বলছি, ওটা সকালেই দিয়ে দিতাম মিস্টার অলিভারকে। আমি ওটা চুরি করিনি।

বুঝতে পারছি, বলল কিশোর, আপনি করেননি। চুরিটা যখন হয়, আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন। তবে, মূর্তিটা তুলে সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার অলিভারের কাছে যাওয়া উচিত ছিল। লুকিয়ে রাখলেন কেন? কাজটা অন্যায় করেছেন।

 দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল মিকো। যাও, জলদি কাপড় বদলে এস, টমি। অলিভারের ঘরে থাকবে। তোমাকে চোখে চোখে রাখতে পারব।

জ্বলন্ত চোখে মিকোর দিকে তাকাল টমি। আপনি আমাকে আদেশ করার। কে? চেঁচিয়ে উঠল। বাড়িটা কি আপনার?

একই কথা তোমার বেলায়ও খাটে, বলে উঠলেন অলিভার। ছায়া শরীরেই হোক আর তরল শরীরেই হোক, তুমি আমার ঘরে ঢোকো কার হুকুমে? মিকো যা বলছে কর, নইলে জেলের ভাত খাওয়াব, চুরি করে অন্যের ঘরে ঢোকার অপরাধে। চোরাই মাল লুকিয়ে রাখার অপরাধে।

ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল টমি। গটমট করে হেঁটে গিয়ে ঢুকল শোবার ঘরে। টান দিয়ে খুলল আলমারির পাল্লা। কয়েক মুহূর্ত পরে বন্ধ করে দিল ধাক্কা দিয়ে। মিনিট কয়েক পরেই ফিরে এল সে। গায়ে কালো সোয়েটার, পরনে হালকা রঙের প্যান্ট।

রাতটা আমার বসার ঘরে কাটবে, এবং ঘুমোতে পারবে না! কড়া আদেশ জারি করলেন অলিভার।

গোমড়ামুখে মাথা ঝোঁকাল টমি।

মূর্তিটা এক হাত থেকে আরেক হাতে নিলেন অলিভার। কিশোর, তুমি বলেছিলে, আজ রাতে চোরটাকে ধরবে!

ধরতে তো চাই। তবে চেঁচামেচি করে ভাগিয়ে দিলাম কিনা, কে জানে! এখনও সময় আছে অবশ্য। আবার ফিরে আসতে পারে সে।

নীরবে মূর্তিটা কিশোরের হাতে তুলে দিলেন অলিভার। মিকো আর টমিকে নিয়ে রওনা হলেন তাঁর ঘরে।

আবার আস্তে করে পুলের পানিতে মূর্তিটা ছেড়ে দিল কিশোর। দুই সঙ্গীকে নিয়ে বসল ব্যালকনিতে। ঠাণ্ডা, অন্ধকার দীর্ঘ মুহূর্তগুলো পেরিয়ে গেল ধীরে ধীরে। পুব আকাশে ধলপহর দেখা দিল। ধীর পায়ে এগিয়ে এল শীতের কুয়াশামাখা ধূসর ভোর। চোর আর এল না সে রাতে।

আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল, লাল চোখ ডলছে কিশোর। চোরটার আসার কোন দরকারই নেই। আগে টাকাটা নিয়ে নেবে মিস্টার অলিভারের কাছ থেকে, তারপর জানিয়ে দেবে কোথায় রেখেছে হাউণ্ডের মূর্তি। খুব সহজ। কেন খামোকা নিজে ওটা তুলে নিতে আসার ঝুঁকি নেবে?

পেছনে খুলে গেল দরজা। দাঁড়িয়ে আছেন অলিভার। নাশতা? ফিটফাট পোশাক পরনে, বেশ তাজা দেখাচ্ছে তাকে।

সবাই খেতে বসল, টমি গিলবার্ট ছাড়া। কাজের ঘরে একটা চেয়ারে বসে আছে গোমড়ামুখে। কিছু খেতে কিংবা কারও সঙ্গে কথা বলতে চায় না সে।

নাশতা শেষ করেই কাজে লেগে গেল কিশোর। পুরানো একগাদা খবরের কাগজ আর কাচি নিয়ে বসল। কেটে কেটে একের পর এক আয়তক্ষেত্র বানাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্র দুই ইঞ্চি চওড়া, পাঁচ ইঞ্চি লম্বা।

কি করছ? আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলল রবিন।

শিগগিরই চোরটা জানাবে, কখন টাকা দিতে হবে তাকে। ওর জন্যে টাকার তোড়া তৈরি করে রাখছি, হাসল কিশোর। কুকুরটা কোথায়, জানেন এখন মিস্টার অলিভার। কাজেই সত্যি সত্যি টাকা দেবার কোন দরকারই নেই আর।

তাহলে ওই কাগজের তোড়া দেবারই দরকার কি? জানতে চাইল মুসা।

চোরটা কে জানার জন্যে, বলল কিশোর। তোড়াগুলোতে ম্যাজিক অয়েন্টমেন্ট মাখিয়ে দেব। ব্যাগটা ফেলে দিয়ে এলেই হল। তোড়ায় হাত দেবে

কালো দাগ পড়ে যাবে হাতে। তারপর চেপে ধরব ওকে।

এমনভাবে বলছ, যেন লোকটা আমাদের পরিচিত, বললেন অলিভার।

অবশ্যই পরিচিত, কিশোরের গলায় খুশির আমেজ। ও জানে, লারিসা ল্যাটনিনা চকলেটের পাগল। জানে, মিসেস ডেনভার ভোর চারটেয় বাজার করতে যায়। নিশ্চয় চোর এ-বাড়ির ভাড়াটে।

ব্রায়ান এনড্রু! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এ ছাড়া আর কেউ না!

হাসিল শুধু কিশোর, কিছু বলল না।

তুমি জান, সে কে? জিজ্ঞেস করলেন অলিভার।

জানি, কিন্তু প্রমাণ করতে পারব না, বলল কিশোর। টাকাটা নিতে এলে প্যাকেটটা ধরলে, তখন আর অসুবিধে হবে না।

নীরবে কাজ করে চলল কিলোর।

ডাকপিয়ন এল বেলা দশটায়। ততক্ষণে দশটা তোড়া বানিয়ে ফেলেছে। কিশোর। সাজিয়ে রেখেছে বসার ঘরের টেবিলে।

ডাকবাক্সে একটা মাত্র চিঠি ফেলে গেল পিয়ন।

খামটা নিয়ে এল কিশোর। ওপরে টাইপ করে লেখা অলিভারের ঠিকানা। তার দিকে তাকাল গোয়েন্দাপ্রধান। মাথা কাত করলেন অলিভার।

খামটা ছিঁড়ে ফেলল কিশোর। ভেতর থেকে বেরোল একটা ভাজ করা কাগজ। তাতে টাইপ করে ইংরেজিতে লেখা বাদামী কাগজে মুড়ে টাকাগুলো পার্কের কোণের ডাস্টবিনে ফেলে রেখে আসতে হবে আজ বিকেল ঠিক পাঁচটায়।

খামটা উল্টেপাল্টে দেখল কিশোর। উইলশায়ার ডাকঘরের ছাপ। গতকালের তারিখ। গুড, হাসল গোয়েন্দাপ্রধান। অয়েন্টমেন্ট মাখাতে শুরু করল কাগজের তোড়ায়। সবকটা তোড়াতে ভালমত মাখাল। তারপর বাদামী একটা বড় কাগজ পেচিয়ে সুন্দর করে প্যাকেট করল। বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই, ভেতরে টাকা আছে, না শুধু খবরের কাগজ কাটা।

ব্যস, হয়ে গেল, অলিভারের দিকে তাকাল কিশোর। বিকেল পাঁচটায় গিয়ে ডাস্টবিনে প্যাকেটটা রেখে আসবেন। দস্তানা পরে নেবেন। প্যাকেটের ওপরেও মলম মাখিয়েছি। আগে পুলিশে একটা ফোন করে নেবেন। হয়ত প্যাকেটটা তুলে নেবার সময়ই চোরকে ধরতে পারবে ওরা।

যদি অন্য কেউ তুলে নেয় প্যাকেটটা? বললেন অলিভার। সুন্দর প্যাকেট। কোন ছেলেছোকরার চোখে পড়লে তুলে নিতেও পারে।

তা পারে। তবে সেটা হতে দেবে না চোর। নিশ্চয় আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। আপনি ফেলে দিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এসে তুলে নেবে।

আমরা কি যাব? জানতে চাইল মুসা।

হ্যাঁ। পাঁচটায় আমরাও গিয়ে লুকিয়ে থাকব, চোখ রাখব ডাস্টবিনটার ওপর। মিস্টার অলিভার, আপনি আমাদেরকে দেখার চেষ্টা করবেন না। কোনদিকেই তাকাবেন না। সোজা গিয়ে প্যাকেটটা ফেলে রেখে চলে আসবেন।

.

১৯.

বিকেল চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।

রেকটরির পাশের ছোট্ট ফুলের ঝোপে লুকিয়ে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। রাস্তার ধারের ছোট পাকটা নির্জন। শুধু একজন ঝাড়দার রয়েছে। একটা ঝুড়ি আর ঝাড় হাতে নিয়ে পার্কের ময়লা পরিষ্কার করছে। চকলেটের মোড়ক, বিস্কুটের বাক্স, ছেঁড়া কাগজের টুকরো-টাকরা ইত্যাদি তুলে নিয়ে রাখছে ঝুড়িতে। ভরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেবে ডাস্টবিনে।

উইলশায়ারের দিক থেকে আসবে চোর, ফিসফিস করে বলল কিশোর।

একটা খবরের কাগজের ভ্যান এসে থামল পার্কের গেটের সামনে। পেছন। থেকে লাফিয়ে নামল, একজন হকার, বগলে একগাদা কাগজ। পথের পাশের ফুটপাতে কাগজগুলো সাজিয়ে রাখতে শুরু করল। চলে গেল ভ্যানটা। খদ্দেরের অপেক্ষা করছে হকার। পরিচিত দৃশ্য।

ছেলেদের মাথার ওপরে নিঃশব্দে খুলে গেল একটা জানালা। মনে হয়, শোনা গেল একটা পরিচিত কণ্ঠ, তোমরা আমার ঘরে এসে বসলেই বেশি আরাম পাবে। বাইরে ঠাণ্ডা।

মুখ তুলে তাকাল মুসা। খোলা জানালায় মুখ বাড়িয়ে আছে ফাদার স্মিথ। দাঁতের ফাঁকে পাইপ। ওই ঝোঁপের ভেতরে কেন? ঘরে এস। সামনের দরজা খুলে দিচ্ছি। ঘুরে চল এস।

অনুভব করল কিশোর, ঝাঝা করছে কান।

এত ছোট ঝোপে লুকোনো যায় না, আবার বললেন ফাদার। দেখে ফেলবেই। চলে এস। আবার পুলিশের কাজে নাক গলাচ্ছ, দেখলে খেপে যাবে ওরা।

আর কি করবে? উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। রেকটরির পাশ ঘুরে এসে দাঁড়াল। সদর দরজার সামনে। খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা।

তোমাদেরকে আসতে দেখেছি, বললেন ফাদার। ওই যে দুজন লোক, একজন ঝাড়দার, আরেকজন হকার, কারও জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা। ব্যাপারটা কি? গির্জায় চোর ঢোকার সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে?

ওরা দুজন কারও অপেক্ষা করছে, কি করে জানলেন? পাল্টা প্রশ্ন করল। কিশোর। আমরা তো বুঝতে পারিনি!

একজনকে চিনি আমি, হাসলেন ফাদার। ছদ্মবেশ নিয়েও ফাঁকি দিতে পারেনি আমাকে। সার্জেন্ট হোন। হাসপাতালে পলকে জেরা করতে গিয়েছিল। ওখানেই ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার। অন্য লোকটাকে চিনি না। তবে হকার সে নয়, বাজি রেখে বলতে পারি।

ধর্মপ্রচারে না এসে ডিটেকটিভ হওয়া উচিত ছিল আপনার, ফাদার! বলে উঠল রবিন। পল কেমন আছে?

ভালই। চোর ওকে মেরেছে, এতে দুঃখ পাওয়ার চেয়ে খুশিই হয়েছে সে বেশি। খবরের কাগজে নাম উঠেছে তার। বোকা গাধা!দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ সরালেন ফাদার। বোকা মেয়ে মানুষটাও নেই আজ, বিকেলটা ছুটি। কোথায় জানি গেছে। এখানে, এই পার্লারে দাঁড়িয়ে পাইপ টানতে পারছি সেজন্যেই। নইলে এতক্ষণে চেঁচিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিত।

হেসে ফেলল কিশোর। হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা বাজে প্রায়!

ঘোষণা করল সে।

মিস্টার অলিভারকে আসতে দেখা গেল, তাতে বাদামী কাগজের প্যাকেট। পার্কে যাওয়ার রাস্তাটার মাথায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কোণের দিকে একটা ডাস্টবিন, উপচে পড়ছে, এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে ওটার সামনে দাঁড়ালেন অলিভার। এদিক-ওদিক তাকালেন, তারপর কয়েকটা বাক্সের ওপর আস্তে করে রেখে দিলেন প্যাকেটটা। আর কোনদিকে না তাকিয়ে হন হন করে হেঁটে ফিরে আসতে লাগলেন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উইলশায়ারের রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো লোকটা হাঁটতে শুরু করল। ভবঘুরে। ছেঁড়া ময়লা কোট, নিচে শার্ট নেই। প্যান্টের এক পায়ের নিচের দিকে ঝুল প্রায় আধ হাত নেই, ছিঁড়ে পড়ে গেছে কোন্ কালে।

আহা! আস্তে মাথা নাড়লেন ফাদার। বেচারা!

পার্কের গেটের দিকে এগোচ্ছে ভবঘুরে। তার কাছ থেকে কয়েক গজ দূরে রয়েছে ঝাড়দার। নুয়ে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা কি যেন তুলছে। কাগজ গুনছে হকার।

ডাস্টবিনের কাছে এসে দাঁড়াল ভবঘুরে। ডাস্টবিন ঘাঁটতে শুরু করল। পরিত্যক্ত খাবার খুঁজছে যেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। হাতে বাদামী প্যাকেট। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা তার কোটের ভেতরে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হকার। ছুটল ভবঘুরের দিকে।

হাত থেকে ঝাড়-ঝুড়ি ফেলে দিয়ে ছুটল সার্জেন্ট হেগান।

দুটো লোককে প্রায় একই সঙ্গে ছুটে আসতে দেখল ভবঘুরে। ঘুরেই সে ছুটল উল্টো দিকে। জানালার চৌকাঠে উঠে গেল মুসা। লাফিয়ে পড়ল বাইরে, মাটিতে।

তীব্র হর্ন বাজাল একটা ছুটন্ত কার, কোনমতে পাশ কাটিয়ে ভবঘুরেকে ধাক্কা দেয়া এড়াল। কেয়ারই করল না লোকটা। ছুটছে প্রাণপণে।

প্রায় লাফিয়ে এসে রাস্তায় উঠল মুসা, ছুটল। চেঁচিয়ে উঠল একজন পুলিশ, রিভলভারের মুখ আকাশের দিকে করে বাতাসে গুলি ছুঁড়ল। রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গেছে ভবঘুরে, ডানে ঘুরে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আর থাকতে পারছি না, ফাদার! বলেই জানালার চৌকাঠে উঠে বসল কিশোর। লাফিয়ে নামল মাটিতে। ছুটল। তাকে অনুসরণ করছে রবিন।

এই যে, ছেলেরা! চেঁচিয়ে উঠল একজন পুলিশ, যে হকারের ছদ্মবেশ নিয়েছে, পথ থেকে সর! গোলাগুলি চলতে পারে!

শাঁ করে মোড় নিল একটা স্কোয়াড কার, টায়ারের কর্কশ শব্দ উঠল। কাছে চলে এল নিমেষে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে আছে একজন পুলিশ। চেঁচিয়ে তাকে বলল সার্জেন্ট হেগান, সামনের মোড়ের দিকে গেছে!

দাঁড়ান! পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডাকল কিশোর।

ফিরে তাকাল সার্জেন্ট। গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিশোরের গলা শুনে দাঁড়িয়ে গেছে মুসাও।

কি হল? জিজ্ঞেস করল হেগান।

তাড়াহুড়োর কিছু নেই, কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। হাঁপাচ্ছে। কোথায় গেছে লোকটা, জানি আমি। লুকোতে চেষ্টা করবে না সে। চমৎকার অ্যালিবাই রয়েছে।

ও, তুমিই সেই ছেলে, যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ মিস্টার অলিভার, বলল সার্জেন্ট। তো, খোকা, কোথায় পাওয়া যাবে তাকে?

এখান থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে। হ্যামলিন ক্লিনিকে।

স্কোয়াড কারের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সবই শুনল পুলিশ অফিসার। ডাকল, এস, গাড়িতে ওঠ।

পেছনের সিটে উঠে বসল তিন গোয়েন্দা। দেখতে দেখতে ক্লিনিকের গেটে পৌঁছে গেল গাড়ি। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দুপাশের দরজা। লাফিয়ে নেমে এল আরোহীরা।

রিসেপশন রুমে ঢুকে পড়ল ওরা হুড়মুড় করে। চোখ তুলে তাকাল। রিসেপশনিস্ট। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেই চুপ হয়ে গেল। তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল বারান্দায়।

দুপদাপ সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতলায় উঠে এল ওরা! থমকে দাঁড়াল ডিউটি-নার্স। কাকে চাই? রিসেপশনে আমাকে কিছু বলল না তো!

দরকার নেই, বলল কিশোর। ছুটে গেল বারান্দা দিয়ে। তার পেছনে আর সবাই। হাঁ করে চেয়ে রইল নার্স।

দরজা বন্ধ জ্যাকবসের কেবিনের। ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিশোর।

বিছানায় শুয়ে আছে জ্যাকবস। গলার কাছে টেনে দিয়েছে কম্বলটা। বিছানার উল্টোদিকের দেয়াল ঘেঁষে রাখা টেলিভিশনটা অন করা।

চোখ ফিরিয়ে তাকাল জ্যাকস। কি ব্যাপার?

প্যাকেটা কোথায়, মিস্টার জ্যাকবস? জিজ্ঞেস করল কিশোর। আলমারিতে নাকি কম্বলের তলায় নিয়ে শুয়ে আছেন?

উঠে বসল জ্যাকবস। মুখ লাল হয়ে গেছে, শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে যেন। গা থেকে খসে পড়ে গেল কম্বল। চেক চেক একটা জ্যাকেট গায়ে, নিচে শার্ট নেই।

টান দিয়ে আলমারির পাল্লা খুলে ফেলল কিশোর। ওপরের তাকেই পাওয়া। গেল প্যাকেটটা। খালা হয়নি এখনও।

গুঙিয়ে উঠল জ্যাকবস।

প্যাকেটটা ধরেছেন, বলল কিশোর। আপনার হাতে মলম লেগে গেছে। শিগগিরই ভরে যাবে কালো কালো দাগে।

চোখের সামনে হাত নিয়ে এল জ্যাকবস।

 সামনে বাড়ল সার্জেন্ট হেগান। উকিলকে ডাকবেন নাকি?

আর উকিল ডেকে কি করব! দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যাকবস।

কিশোরের দিকে ফিরল সার্জেন্ট। অলিভার বললেন, তোমরা খুব চালাক! ঠিকই বলেছেন। সুন্দর অ্যালিবাই! প্রাইভেট হসপিটাল! কে ভাবতে পেরেছিল…

নিজের ফ্ল্যাটে নিজেই আগুন লাগিয়েছেন জ্যাকবস, বলল কিশোর। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্যে। তিনি জানেন, এ-সময়ে এ-হাসপাতালে রোগীর ভিড় থাকে না। শহরের বেশির ভাগ লোকই বাইরে চলে গেছে বড় দিনের ছুটিতে। ফলে ডিউটি-নার্স আর ডাক্তারের সংখ্যাও কমিয়ে দেয়া হয়। ওদের চোখ এড়িয়ে কয়েক মিনিটের জন্যে বেরিয়ে যাওয়া কিছু না। তাছাড়া হাসপাতালটা বাসার কাছে। হাসপাতালের পেছনে ঝাড়দার ঢোকার পথ দিয়ে সহজেই ঢোকা কিংবা বেরোনও যায়। আসলে কিন্তু খুব বেশি আহত হননি জ্যাকস। যা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি করেছেন ভান। গাঁটের পয়সা খরচ করে কেউ যদি প্রাইভেট হাসপাতালে আসতে চায়, ডাক্তারদের কি? তাই তাঁর এখানে আসার ব্যাপারে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডাক্তাররাও আপত্তি করেননি। তাই না, মিস্টার জ্যাকবস?

.

২০.

শহরের বাইরে গিয়েছিলেন চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার। জানুয়ারির মাঝামাঝি ফিরে এলেন।

অফিসে, বিশাল ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন চিত্রপরিচালক। এ পাশে বসেছে তিন গোয়েন্দা। গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা রিপোর্ট পড়ছেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। দীর্ঘক্ষণ পরে মুখ তুললেন। চমৎকার! রবিন লিখেছেও খুঁটিয়ে। নিজের ছায়াদেহ নিয়ে ঘুরতে বেরোনো! সাংঘাতিক ব্যাপার! বড় বড় ভূতও ওস্তাদ মানবে টমি গিলবার্টকে!

ওর এই বিশেষ ক্ষমতার কথা সে একবারও স্বীকার করেনি, বলল রবিন। বলে, স্বপ্ন দেখে। কিন্তু প্রফেসর লিসা রোজারের কাছে সব শুনে এসেছি। কিভাবে স্বপ্ন দেখে টমি, জানি আমরা।

হ্যাঁ, কিশোরের দিকে ফিরলেন চিত্রপরিচালক। কিশোর, কি করে জানলে, জ্যাকবসই চোর?

কিছু যোগ কিছু বিয়োগ করে, কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল কিশোর। প্রথমেই সন্দেহ করলাম, চোর মিস্টার অলিভারের ভাড়াটেদের কেউ হবে। সে জানে গির্জার চাবি রেকটরির কোথায় রাখা হয়। মিস ল্যাটনিনা আর মিসেস। ডেনভারের স্বভাবচরিত্র জানাও তাদের কাছাকাছি যারা থাকে, তাদের পক্ষেই সহজ। জানে, ওই দুজনকে সরাতে পারলে পুলটা নিরাপদ। টমিকে সন্দেহ করলাম। পরে বুঝল, সে চোর নয়। চুরিটা যখন হয়, সে ঘুমিয়েছিল তার ঘরে। একই সময় দুজায়গায় থাকার ক্ষমতা অবশ্য তার আছে। তবে বড় জোর দেখতে এবং শুনতে পারে ছায়া শরীরে যখন থাকে। কোন জিনিস নাড়াচাড়া করতে পারে না। তার মানে ছায়া শরীর নিয়ে কারও ঘরে ঢুকে কোন জিনিস চুরি করতে পারে না। সে। বাদ দিলাম তাকে সন্দেহ থেকে। বব বারোজকেও সহজেই বাদ দেয়া গেল। সে ছিলই না চুরির রাতে প্যাসিও প্লেসে। পুরুষ ভাড়াটেদের মাঝে বাকি রইল। ব্রায়ান এনড্রু, আর জ্যাকবস। চুরির সময় ও-বাড়িতে দুজনের কাউকেই দেখা যায়নি। দুজনেই শুনেছে, মিসেস ডেনভারের পুলের পানি পরিষ্কার করার কথা। পরে মনে পড়েছে আমার, কথাটা শুনে একটু যেন চমকে উঠেছিল জ্যাকস। এনড্রুর কোন ভাবান্তরই হয়নি। তাছাড়া সে রাতে গাড়ি নিয়ে কোথাও বেরিয়েছিল। জ্যাকবস।

নিশ্চয় বোমার সরঞ্জাম কিনতে? বলে উঠলেন চিত্রপরিচালক। এসব জিনিস বাড়িতে রাখে না লোকে হরহামেশা।

অতি সাধারণ কয়েকটা কেমিক্যাল কিনে নিয়ে এল জ্যাকবস, আবার বলল কিশোর। সাধারণ একটা বোমা বানিয়ে বসিয়ে রাখল মিসেস ডেনভারের গাড়ির ইঞ্জিনে। মোটেই মারাত্মক ছিল না বোমাটা। প্রচণ্ড শব্দ আর ধোয়া বেরোনর জন্যে তৈরি, ক্ষতি সামান্যই করে। ভয় দেখিয়ে মহিলাকে তাড়াতে চেয়েছে আসলে। জ্যাকবস। যাতে অন্তত দুটো দিন পুলটা পরিষ্কার করাতে না পারে ম্যানেজার। রহস্যটা সমাধান প্রায় করে এনেছিলাম, কিন্তু ঘরে আগুন লাগিয়ে একটা গোলকধাঁধায় ফেলে দিল আমাকে জ্যাকবস। আগুন লাগাটা দুর্ঘটনা নয়, তখনই বুঝেছি। খটকা লাগল। সিগারেটের ব্যাপারে খুবই সতর্ক জ্যাকবস, সঙ্গে অ্যাশট্রে নিয়ে ঘোরে, ছাই থেকে আগুন লেগে যাবার ভয়ে। ধরে নিলাম, এনড্রু চোর। আগুন। লাগিয়ে জ্যাকবসকেও সরাতে চয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগল মনে, কেন সরাতে যাবে? পুলের সঙ্গে জ্যাকবসের কোন সম্পর্ক নেই। কোন যুক্তিই খুঁজে পেলাম না। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেল, যখন চিঠি নিয়ে এল পিয়ন। খামে উইলশায়ার পোস্ট অফিসের ছাপ। তাছাড়া সময় ঠিক করেছে বিকেল পাঁচটা, বেড়ালকে খাবার খাওয়ার সময় তখন এনড্রুর। কিছুতেই এই সময়ে টাকা আনতে যাবে না সে। শিওর হয়ে গেলাম, জ্যাকবসই চোর।

হাসলেন চিত্রপরিচালক। ঠিক। পাঁচটায় কিছুতেই অনুপস্থিত থাকবে না এনড্রু। মোটেল থেকে এসেও বেড়ালদেরকে খাওয়ায়। একবার গরহাজিরা দিলেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলবে বেড়ালের পাল। বেড়াল-মানবের অনুপস্থিতি জানিয়ে দেবে। কিছুতেই এই ঝুঁকি নিত না এনড্রু হলে। ঠিকই ভেবেছ তুমি। ভুরু কোচকালেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। কিন্তু চুরি করতে গেল কেন জ্যাকবস? টাকার এতই টান পড়েছিল?

টান পড়েছিল, পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে জ্যাকবস। তার ব্যবসা খুব। মন্দা যাচ্ছিল। অনেক ধার হয়ে গিয়েছিল ব্যাংকে। এমনিতেই টাকা পরিশোধ করতে না পারার দায়ে জেলে যেতে হত তাকে। কাজেই নিয়েছে ঝুঁকি।

সেই পুরানো প্রবাদ! দীর্ঘশ্বাস ফেললেন চিত্রপরিচালক। অভাবে স্বভাব নষ্ট! নইলে জ্যাকবসের মত লোক একাজ করতে যেত না! ভীষণ চাপে পড়েই কাজটা করে ফেলেছে বেচারা!

আয় যখন ভাল ছিল, ভাগ্নের পড়ার খরচের জন্যে, তার নামে ব্যাংকে অনেক টাকা জমা করেছে জ্যাকবস মাসে মাসে, বলল কিশোর। দশ হাজার ডলারের বেশি হবে। ব্যাংকের ঋণ শোধ করে দিয়েছে বব তার টাকা থেকে। কিন্তু ব্যাপারটা এখন আর শুধু তার হাতে নেই। আরও কয়েকটা কেস ঝুলছে জ্যাকবসের মাথায়। পল মিনকে পিটিয়ে বেহুশ করেছে, মিস ল্যাটনিনাকে বিষ খাইয়েছে, মিসেস ডেনভারের গাড়িতে বোমা ফাটিয়েছে। জানালা ভেঙে অন্যের ঘরে ঢুকে জিনিস চুরি করেছে, সেটা আবার ফেরত দেয়ার কথা বলে দশ হাজার ডলার দাবি করেছে। মালিকের কাছে। এগুলো মস্ত অপরাধ।

হু! মাথা ঝোঁকালেন চিত্রপরিচালক। আচ্ছা, কবে, কে মিস্টার। অলিভারের কাছে নিয়ে আসবে, জ্যাকবস জানল কিভাবে?

টমি বলেছে, বলল কিশোর। সেদিন সকালেই মিস্টার অলিভারের ঘরে ঢুকেছিল সে। ফোনে তাকে কথা বলতে শুনেছে মিকো ইলিয়টের সঙ্গে। মিসেস ডেনভার জ্যাকবসকে বলেছিল, কুকুর আনার কথা। সে ব্যাপারেই টমির সঙ্গে কথা বলছিল জ্যাকবস। এক পর্যায়ে টমি বলে বসেছে, ওটা জ্যান্ত কুকুর নয়, ক্রিস্টালের মূর্তি। অনেক দাম। কথায় কথায় তার কাছ থেকে খবর বের করে নিয়েছে স্টকব্রোকার। তারপর মিউজিয়মে চলে গেছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছে, মূর্তিটা কে বানিয়েছে, কেমন মূল্যবান। সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জেনে এসেছে শো গ্যালারি থেকে। মনে মনে প্ল্যান তৈরি করে ফেলেছে। মিকো ইলিয়টকে অনুসরণ করে এসেছে গ্যালারি থেকেই। জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে মিকো ঘরে থাকতেই…

বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল একেবারে! মন্তব্য করলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।

হ্যাঁ। তবে ওর কপাল খারাপ, রাস্তার মোড়েই পুলিশ ছিল। তাড়া খেয়ে নিজের ঘরে এসে ঢুকতে পারত, কিন্তু তাহলে ধরা পড়ে যেত। গির্জাটাই নিরাপদ জায়গা মনে করেছে। ঠিকই মনে করেছিল। পুলিশকে তো ফাঁকি দিয়ে ফেলেছিল।

কিন্তু সে জানত না, সে-সময়ে মিস্টার অলিভারের বাড়িতে হাজির তিন গোয়েন্দা, বুক ফোলাল মুসা। মুখে হাসি।

আসলেই তার কপাল খারাপ, বলল কিশোর। ফাঁকি তো প্রায় দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু সে কি আর জানত, পুলে যখন মূর্তিটা ছাড়ছে, কাছেই ছায়া। শরীরে দাঁড়িয়েছিল টমি গিলবার্ট?

টমি আছে এখনও ও-বাড়িতে? জানতে চাইলেন পরিচালক।

না, বলল মুসা। বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন তাঁকে, মিস্টার অলিভার। কাছেপিঠে ওরকম একটা প্রেতসাধককে রেখে শান্তিতে থাকতে পারবেন না, বুঝে ফেলেছেন। পশ্চিম লস অ্যাঞ্জেলেসের কোথায় একটা বাড়িতে গিয়ে উঠেছে এখন সে।

ওখান থেকেও তো আসতে পারে তার ছায়া শরীর?

পনেরো দিন হয়ে গেল, জবাব দিল রবিন। এর মাঝে একবারও আসেনি, জানিয়েছেন মিস্টার অলিভার। মিসেস ডেনভারকেও বিদেয় করে দিয়েছেন। ভাড়াটেদের শান্তি নষ্ট করবে তার ম্যানেজার, এটা কিছুতেই চান না। নতুন ম্যানেজার রেখেছেন। কমবয়েসী একটা মেয়ে। কারও সাতে ও থাকে না পাঁচেও না। কাজ যা করার করে, বাকি সময় ঘরে বসে নিজের কাজ করে, বই পড়ে, কিংবা টিভি দেখে। যেচে পড়ে কারও সঙ্গে কথা বলতেও যায় না।

যাক, সব সমস্যারই সমাধান হল, বললেন পরিচালক। একটা ছাড়া। বৃদ্ধ ফাদারের ভূত…।

ওটা কারও ভূত না, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। জ্যাকবসই ফাদারের ছদ্মবেশে গিয়েছিল…

জানি, হাত তুললেন পরিচালক। আমি সেকথা বলছি না। বলছি, গুজব আছে, গির্জায় ফাদারের ভূত দেখা যায়। যা রটে, তা কিছুটা তো বটে! কেন জানি। মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা ঘাপলা আছে! কি দেখল, কাকে দেখল তামারা, ব্রাইস? সবই কি তার কল্পনা?

হ্যাঁ, সেটা একটা রহস্য, মাথা ঝোকাল কিশোর। সময় পেলে খোঁজ করে। দেখব ভালমত। হয়ত রহস্যটার সমাধান করে ফেলতে পারব।…তো আজ আসি, স্যার।

এস, বললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। পারলে শিগগিরই ফাদারের ভূতের সন্ধান করতে যেও। আর, এর মাঝে নতুন কোন রহস্যের খোঁজ পেলে জানাব। নাউ, থ্যাংক ইউ, মাই বয়েজ!

Super User