মমি – তিন গোয়েন্দা – সেবা প্রকাশনী / প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬
০১.
পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে ব্যস্ততা।
চাচীকে সাহায্য করছে কিশোর পাশা, আর তার দুই বন্ধু মুসা আমান ও রবিন মিলফোর্ড।
তিন চাকার ছোট্ট গাড়ি নিয়ে ইয়ার্ডের ভেতরে এসে ঢুকল পোস্টম্যান। একগাদা পুরানো লোহা-লক্কড়ের কাছে দাঁড়ানো মারিয়া পাশার দিকে চেয়ে আস্তে করে মাথা ঝোকাল একবার, তারপর এগিয়ে গেল কাঁচে ঘেরা ছোট্ট অফিস ঘরের দিকে। বারান্দার দেয়ালে ঝোলানো চিঠির বাক্সে একগাদা চিঠি ফেলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল আবার।
হায়, আল্লাহ! বলে উঠলেন মেরিচাচী, ভুলেই গিয়েছিলাম! কিশোর, বাপ, এক দৌড়ে পোস্ট অফিসে যা তো! একটা জরুরি চিঠি রেখে গেছে তোর চাচা, পোস্ট করে দিয়ে আয়।
অ্যাপ্রনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দোমড়ানো একটা খাম বের করলেন মেরিচাচী। হাত দিয়ে ডলে সমান করে বাড়িয়ে দিলেন কিশোরের দিকে।
রেজিস্ট্রি করে পাঠাস, বললেন মেরিচাচী। আরেক পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন কিশোরকে। সকালের ডাক ধরাতে পারিস কিনা দেখিস।
পারব, কিশোরের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস। মুসা আর রবিনকে খাঁটিয়ে নাও এই সুযোগে। দুই বন্ধুর দিকে চেয়ে মুচকি হাসল গোয়েন্দাপ্রধান। তাড়াতাড়ি সাইকেল বের করে চড়ে বসল।
গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল কিশোর। সেদিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। মেরিচাচী। মুসা আর রবিনকে বললেন, চল, চিঠিপত্রগুলো দেখে ফেলি। আজকাল কিশোরের নামেও অনেক চিঠি থাকে।
খুশি মনেই মেরিচাচীকে অনুসরণ করল দুই গোয়েন্দা।
বাক্স খুলে চিঠিগুলো নিয়ে অফিসে এসে বসলেন মেরিচাচী। একটা চিঠি খুলে দেখলেন। হুমম, একটা বাড়ির মাল নিলাম হবে।—এটা, বিল—একটা স্টীম বয়লার বিক্রি করেছিলাম, তার বিল।—আরেকটা বিল।—ও, এটা এসেছে আমার বোনের কাছ থেকে।—এটা?—একটা বিজ্ঞাপন টেলিভিশনের— একটার পর একটা চিঠি খুলে দেখছেন, আর মন্তব্য করছেন চাচী। রাশেদ চাচার নামে ব্যক্তিগত চিঠিও আছে গোটা দুয়েক। ওগুলো খুললেন না। আরও দুটো চিঠির নাম ঠিকানা দেখে সামান্য ভুরু কোচকালেন। মৃদু একটা হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। ঠোঁটে। খুললেন না এ দুটোও, আড়চোখে তাকালেন একবার মুসা আর রবিনের মুখের দিকে। বড়ই হতাশ হয়েছেন যেন, এমনি ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। নাহ, কিশোরের জন্যে কিছুই নেই। দুই গোয়েন্দার দিকে সরাসরি তাকালেন। তবে, তিন গোয়েন্দার নামে আছে দুটো, এই যে। নেবে নাকি? না কিশোরের হাতে দেব?
মেরিচাচীর কথা শেষ হওয়ার আগেই ছোঁ মেরে চিঠি দুটো তুলে নিল মুসা। রবিনের দিকে চেয়ে বলল, হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছি! ছুটে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে।
মুসার পেছনেই বেরোল রবিন। ফিরে চাইলে দেখতে পেত, সস্নেহ হাসি ফুটছে মেরিচাচীর ঠোঁটে।
পেছনে ফিরে তাকাল একবার মুসা, আমাদের অফিশিয়াল কিছু হতে পারে, গোপনীয়। তাই ওখানে খুললাম না। হেডকোয়ার্টারে ঢুকে খুলব।
মাথা কাত করল রবিন।
দুই সুড়ঙ্গের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। লোহার পাতটা সরিয়েই ঢুকে পড়ল পাইপের ভেতরে।
মোবাইল হোমের ভেতরে অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল মুসা। ফিরে তাকাল। রবিনও ঢুকছে।
দুটো চিঠিরই কোণের দিকের ঠিকানা পড়ল মুসা। রবিন! চেঁচিয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায়। একটা এসেছে মিস্টার ক্রিস্টোফারের কাছ থেকে। এটাই আগে খুলি।
রবিনও উত্তেজিত। না, এটা পরে। কাজের কিছু থাকলে ওটাতেই আছে। আচ্ছা, কিশোরের ফেরার অপেক্ষা করবে?
এত সৌজন্য না দেখালেও চলবে, ঝাঝাল কষ্ঠ মুসার। একটু আগে কি বলল? আমাকে আর তোমাকে খাঁটিয়ে নিতে। ওসব অপেক্ষা-টপেক্ষার দরকার নেই। খোল। রেকর্ড রাখার আর পড়াশোনার দায়িত্ব তোমার ওপর। তার মানে। চিঠি খোলারও।
মুসার কথায় যুক্তি আছে, আর কিছু বলল না রবিন। একটা চিঠি নিয়ে সাবধানে ছুরি ঢুকিয়ে দিল এক প্রান্তে। কাটল। আচ্ছা, মুসা, চিঠিটা পড়ার আগে চেষ্টা করে দেখি, দেখেই কিছু বোঝা যায় কিনা। কি বল? শার্লক হোমস চিঠি দেখেই অনেক কিছু বলে দিতে পারতেন ওটা সম্পর্কে। কিশোরও তাই বলে, শুধু দেখেই নাকি অনেক কিছু বলে দেয়া যায়। এস, চেষ্টা করে দেখি।
শুধু দেখেই কি আর বলা যাবে? সন্দেহ ফুটেছে মুসার চোখে।
জবাব দিল না রবিন। গভীর মনোযোগে উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করছে খামটা। হালকা নীল রঙ। নাকের কাছে তুলে শুকল। লাইলাক ফুলের গন্ধ। ভেতরের কাগজটা বের করল। গন্ধ আর রঙ খামটার মতই। চিঠির কাগজের এক কোণে। ছোট্ট একটা ছবি ছাপা, দুটো বেড়ালের বাচ্চা খেলছে।
হুম! গম্ভীর হল রবিন। কপালে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে আস্তে টোকা দিল বার দুই, যেন মগজটাকে খোলাসা করে নিতে চাইছে। হ্যাঁ, আমার কাছেই এসেছে এটা (সিনেমায় দেখা শার্লক হোমসের কথা আর ভঙ্গি নকলের চেষ্টা করছে)। পাঠিয়েছেন এক মহিলা। বয়েস, এই, পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেঁটেখাট, মোটা। চুলে রঙ মাখানো। কথা বলেন প্রচুর। বেড়াল বলতে পাগল। মনটা খুব ভাল। মাঝে মাঝে সামান্য খেয়ালী হয়ে পড়েন। এমনিতে তিনি হাসিখুশি, তবে এই চিঠি লেখার সময় খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার দুই চোখ। খাইছে! শুধু ওই খাম আর চিঠির কাগজ দেখেই এত কিছু জেনে গেলে!
নিশ্চয়, রবিন নির্লিপ্ত। আর হ্যাঁ, মহিলা খুব ধনী। সমাজসেবা করেন।
রবিনের হাত থেকে খাম আর চিঠিটা নিল মুসা। উল্টেপাল্টে দেখল। ভুরু কুঁচকে গেছে। অবশেষে আগের জায়গায় ফিরে গেল আবার ভুরু। বেড়ালের বাচ্চার ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মহিলা বেড়াল ভালবাসেন। স্ট্যাম্পের পাতা থেকে তাড়াহুড়ো করে খুলেছেন স্ট্যাম্প, একটা কোণ ছিঁড়ে গেছে, তারমানে খামখেয়ালী। লেখার স্টাইল দেখে বোঝা যাচ্ছে, হাসিখুশি। নিচের লাইনগুলো আঁকাবাকা, লেখাও কেমন খারাপ, অর্থাৎ কোন একটা ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। ঠিক জায়গায় নজর দিতে পারলে ডিডাকশন খুব সহজ।
হ্যাঁ, স্বীকার করল মুসা। শার্লক হোমস কিংবা কিশোর পাশার শাগরেদ হতে পারলে, এ-বিদ্যা শেখা আরও সহজ। কিন্তু, তুমিও কম না। মহিলার বয়স, আকৃতি, ধনী, চুলে রঙ করেন, বেশি কথা বলেন, এগুলো জানলে কি দেখে?
হাসল রবিন। খামের কোণে মহিলার ঠিকানা রয়েছে। সান্তা মনিকার। জায়গাটা ধনীদের এলাকা, জানই। আর ওখানকার ধনী বয়স্কা মহিলাদের সময় কাটানর জন্যে সমাজসেবা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার নেই।
বেশ, বুঝলাম। কিন্তু চুলের রঙ? বয়স? বেশি কথা বলে? আকৃতি? এসব কি করে বুঝলে?
বুঝেছি, সহজ গলায় জবাব দিল রবিন। লাইলাক ফুলের রঙ আর গন্ধ পছন্দ মহিলার, সবুজ কালিতে লেখেন। বয়স্কা মহিলাদেরই এসব রঙ আর গন্ধ। বেশি পছন্দ। আমার খালাও পছন্দ করেন। তার বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি, মোটাসোটা, বেঁটে, বেশি কথা বলেন, চুলে রঙ লাগান-তবে চিঠি লেখিকার ব্যাপারে এসব সত্যি না-ও হতে পারে। স্রেফ অনুমান করেছি। শিওর বলতে পারব না। চিঠির নিচে সইটা আরেকবার দেখল রবিন। তবে একেবারে ভুল, তাও বলব না। আমার খালা আর এই মিসেস ভেড়া চ্যানেলের অনেক কিছুতেই মিল দেখতে পাচ্ছি।
হাসল মুসা। আমাকে বোকাই বানিয়ে ফেলেছিলে। তবে, ডিডাকশন ভালই করেছ। শেষগুলো সত্যি হলে একশোতে একশোই দেয়া যায়। আচ্ছা, এবার দেখা যাক, কি লিখেছেন মহিলা।
চিঠিটা মুসাকে শুনিয়ে জোরে জোরে পড়ল রবিন। মিসেস চ্যানেলের একটা আবিসিনিয়ান বেড়াল ছিল, নাম স্ফিঙ্কস। মহিলার খুব আদরের প্রাণী। হপ্তাখানেক আগে নিখোঁজ। পুলিশকে খবর দিয়েও লাভ হয়নি, তারা বেড়ালের ব্যাপারে উদাসীন। খবরের কাগজে ইদানীং তিন গোয়েন্দার খুব নাম দেখে চিঠি পাঠিয়েছেন। যদি তারা তার বেড়ালটা খুঁজে বের করে দেয়, কৃতজ্ঞ হবেন।
বেড়াল নিখোঁজ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল মুসা, আমাদের জন্যে কেসটা ভালই। সহজ, বিপদ নেই, কোনরকম ভয়ের কারণ নেই। মহিলাকে রিং করে বলি, কেসটা নিলাম…
দাঁড়াও, মাথা তুলল রবিন। মিস্টার ক্রিস্টোফার কি লিখেছেন, পড়ি আগে।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, ফোনের দিকে এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়েছে মুসা।
দ্বিতীয় খামটা খুলে ফেলল রবিন। খুব দামি বণ্ড পেপারে লেখা একটা চিঠি। ওপরে একপাশে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের নাম-ঠিকানা ছাপা।
মুসাকে শুনিয়ে পড়তে শুরু করল রবিন। প্রথম বাক্যটা পড়েই থমকে গেল। তারপর খুব দ্রুত চোখ বোলাল পরের লাইনগুলোর ওপর। মুখ তুলে দেখল, অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে গোয়েন্দা-সহকারী।
সর্বনাশ! জোরে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে যেন রবিন। চিঠিটা বাড়িয়ে দিল বন্ধুর দিকে। নাও, নিজেই পড়। আমি বললে বিশ্বাস করবে না।
নীরবে চিঠিটা নিল মুসা। রবিনের মতই দ্রুত পড়ে শেষ করল। মুখ তুলে। তাকাল রবিনের দিকে। বিস্ময়ে কোটর থেকে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার চোখ। ইয়াল্লা! ফিসফিস করে বলল। তিন হাজার বছরের পুরানো মমি কথা বলে।
.
০২.
রকি বীচ থেকে মাইল বারো দূরে, হলিউডের বাইরে একটা গিরিসঙ্কট। পাহাড়ের মমি ঢালে এখানে কয়েকটা বড়সড় বাংলোমত বাড়ি, প্রচুর পয়সা খরচ করে তৈরি হয়েছে। বাড়িগুলোকে ঘিরে আছে গাছপালা, ঝোঁপঝাড়। পুরানো স্প্যানিশ রীতির। একটা বড় বাড়ি আছে, একটা অংশকে ব্যক্তিগত, জাদুঘর বানিয়ে নিয়েছেন বাড়ির মালিক প্রফেসর বেনজামিন, একজন বিখ্যাত ইজিপটোলজিস্ট-মিশর-তত্ত্ববিদ। প্রাচীন মিশর ও পিরামিড সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান।
বাড়িটার জানালাগুলো আবার ফরাসী রীতির, বড় বড় জানালা প্রায় মেঝে ছুঁই ছুঁই করছে। একটা বিশেষ ঘরের জানালা বন্ধ। সেই জানালার পাশে সারি দিয়ে। সাজানো কয়েকটা মূর্তি, প্রাচীন মিশরীয় কবর খুঁড়ে বের করে আনা। একটা মূর্তি ভারি কাঠের তৈরি। শরীর মানুষের, মুখটা শেয়ালের। প্রাচীন দেবতা, আনুবিস। শার্সি ভেদ করে ঢুকছে পড়ন্ত বিকেলের রোদ, মেঝেতে ছায়া পড়েছে আনুবিসের। শেয়ালের মত মুখের ছায়া অনেকটা বেশি লম্বা হয়ে পড়েছে মেঝেতে, দেখলেই গা ছমছম করে।
মিশরের পিরামিড আর প্রাচীন কবর থেকে তুলে আনা আরও সব জিনিসে প্রায় ঠাসা ঘরটা। দেয়ালে ঝুলছে ধাতব মুখোশ, সে মুখোশের বিকৃত ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। মাটির তৈরি চাকতি আর ছোট ছোট ফলক, সোনার গয়না, সবুজ পাথর থেকে খোদাই করা পবিত্র গুবরে পোকার প্রতিকৃতি সাজানো রয়েছে কাঁচের বাক্সে। একটা জানালার কাছে রাখা আছে একটা মমির-কফিন, কাঠের তৈরি ডালা আটকানো। অতি সাধারণ কফিন। গায়ে সোনার পাত নেই, নেই রঙে আঁকা কোনরকম নকশা বা ছবি। বিলাসিতা বা আড়ম্বরের কোন ছাপই নেই ওটাতে।
কফিনটা এক রহস্য, এমনকি প্রফেসর বেনজামিনের কাছেও। ওটা তার গর্বের বস্তু।
প্রফেসর বেনজামিন, ছোটখাট একজন মানুষ, শরীরের তুলনায় ভুড়িটা সামান্য বড়, চেহারা আরও সম্ভ্রান্ত করে তুলেছে কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখে গোল্ড-রিম চশমা।
তরুণ বয়সটা এবং তারপরেরও অনেকগুলো বছর মিশরেই কাটিয়েছেন। প্রফেসর। প্রত্নতাত্মিক অনেক অভিযানে অংশ নিয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন অনেক পুরানো কবর, ঢুকেছেন পিরামিডের তলায়। দেখেছেন হাজার হাজার বছর আগের ফারাও, তাদের রানী আর চাকর-বাকরের মমি-বিচিত্র অলঙ্কার আর জিনিসে জড়ানো। মূর্তি আর অন্যান্য জিনিসপত্র ওখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন। কয়েক বছর আগে ফিরে এসেছেন দেশে। প্রাচীন মিশরে তাঁর আবিষ্কার আর অভিযানের ওপর একটা বই লিখেছেন।
ওই কফিন আর ভেতরের মমিটা তার কাছে এসে পৌঁছেছে মাত্র এক হপ্তা হল। এটা তিনি আবিষ্কার করেছিলেন প্রায় পঁচিশ বছর আগে। সে সময় এবং তার পরের অনেকগুলো বছর খুব ব্যস্ত ছিলেন, নজর দিতে পারেননি মমিটার দিকে। ওটা গচ্ছিত রেখেছিলেন কায়রোর এক জাদুঘরে। দেশে ফিরে চিঠি লিখেছেন। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ মমিটা পাঠিয়ে দিয়েছে প্রফেসরের ঠিকানায়, ওটার ওপর প্রচুর। গবেষণা চালানর ইচ্ছে আছে তাঁর।
মি. ক্রিস্টোফার তিন গোয়েন্দাকে চিঠি পাঠানর দুদিন আগে।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর বেনজামিন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। মাঝে মাঝে হাতের পেন্সিল দিয়ে আস্তে টোকা দিচ্ছেন কফিনের ডালায়। এত সাধারণ একটা কাঠের কফিনে কেন রাখা হয়েছে এই মমি! বুঝতে পারছেন না প্রফেসর। কেমন অস্বস্তি বোধ করছেন।
প্রফেসরের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে তার খানসামা হুপার। লম্বা, রোগাটে একজন। মানুষ। অনেক বছর ধরে কাজ করছে তার এখানে।
স্যার, আবার খুলতে চান এটা? বলল হুপার। গতকাল ওই কাণ্ড ঘটার। পরেও?
আবার ঘটুক, তাই আমি চাই, জোর দিয়ে বললেন প্রফেসর। জানালাগুলো খুলে দাও। কতবার না বলেছি, বন্ধ ঘরে দম আটকে আসে আমার!
এই দিচ্ছি, স্যার, তাড়াতাড়ি কাছের জানালাটা খুলে দিল হুপার। অন্যগুলোও, খুলতে এগোল।
কয়েক বছর আগে একটা কবরে আটকা পড়ে যান প্রফেসর বেনজামিন। দুদিন ওই বন্ধ ঘরে আটকে থাকার পর বের করে আনা হয় তাকে। সেই থেকেই বন্ধ যে-কোন রকম ঘরের ব্যাপারে একটা আতঙ্ক জন্মেছে তার।
সবকটা জানালা খুলে দিয়ে এল হুপার। ডিবার ডালার মত আলগা চারকোনা কফিনের ডালা। তুলে ওটা কফিনের পাশেই দাঁড় করিয়ে রাখল সে। দুজনেই সামান্য ঝুঁকে তাকাল কফিনের ভেতরে।
বাহু, তোমার সাহস আছে বলতে হবে, হুপার, প্রশংসা করলেন প্রফেসর। অনেকেই মমির দিকে তাকাতে সাহস করে না। অথচ একে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিটুমিন আর অন্যান্য আরকে ভিজিয়ে, লিনেন জড়িয়ে রাখা হত হাজার হাজার বছর আগের মিশরীয় রাজ-রাজাদের দেহ। হয়ত ওদের বিশ্বাস ছিল, দেহটা ঠিক থাকলে মৃত্যুর পরের জগতে ঢোকা খুব সহজ হবে। আরেক দুনিয়ায় গিয়ে যাতে কোনরকম অসুবিধা না হয়, সেজন্যে সঙ্গে দেয়া হত সব রকমের দরকারি জিনিসপত্র। চাকর-বাকরদেরও মেরে মমি বানিয়ে রেখে দেয়া হত রাজার পাশের কোন কক্ষে। আরেক জগতে চাকরেরও অভাব হবে না রাজার, এই বিশ্বাসে। কী অদ্ভুত ধর্ম, আর বিশ্বাস! আবার মমিটার দিকে তাকালেন তিনি। ভেতরের দিকে কফিনের গায়ে খোদাই করা আছে, রা-অরকন-এর নাম। মমি জড়িয়ে থাকা লিনেনের একটা অংশ খোলা। ফলে রা-অরকনের চেহারা দেখা যাচ্ছে। গাঢ় রঙের। কাঠ কুঁদে তৈরি যেন মুখ। ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, কথা বলতে চায় বুঝি! চোখ বোজা।
রা-অরকনকে আজ খুব শান্ত মনে হচ্ছে, স্যার, বলল হুপার। আজ হয়ত কথা বলবে না।
না বললেই ভাল। তিন হাজার বছরের পুরানো মমি কথা বলে এটা খুবই অস্বাভাবিক!
হ্যাঁ, স্যার!
অথচ, গতকাল ফিসফিস করে কি যেন বলেছিল! আপনমনেই বললেন। প্রফেসর। গতকাল এঘরে একা ছিলাম, হুপার, তখন কথা বলে উঠছিল মমিটা। অদ্ভুত ভাষা, বুঝিনি! তবে কথার ধরনে মনে হয়েছে আমাকে কিছু একটা করতে বলছে ও!
মমিটার ওপর আবার ঝুঁকলেন প্রফেসর। রা-অরকন, আজও কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান? বলুন। আমি শুনছি।
চুপ করে রইল মমি। এক মিনিট কাটল। দুই। ঘরে এসে ঢুকেছে একটা মাছি, ওটার ভনভন ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই।
আমার কল্পনাও হতে পারে, আপনমনেই কথা বলছেন প্রফেসর। না, কাল কোন কথা বলেনি মমি। ওটা নিছকই আমার কল্পনা। হুপার, ওয়ার্কশপ থেকে ছোট করাতটা নিয়ে এস। কফিন থেকে ছোট এক টুকরো কাঠ কেটে নেব, আজই পাঠাব। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে। কার্বন টেস্ট করিয়ে মমিটার আসল বয়স জানা দরকার।
ঠিক আছে, স্যার, যাচ্ছি। বেরিয়ে গেল হুপার।
কফিনের ওপর ঝুঁকলেন প্রফেসর। টোকা দিয়ে দিয়ে দেখলেন। কোথা থেকে। কাটলে ভাল হবে? একটা জায়গায় ফাপা মনে হল টোকার শব্দ। চিলতে কাঠ ভরে ফোকরের মুখ বন্ধ করা হয়েছে যেন।
কাজে মগ্ন প্রফেসর। হঠাৎ কানে এল চাপা বিড়বিড় শব্দ, কফিনের ভেতর থেকেই আসছে! ঝট করে সোজা হয়ে গেলেন তিনি। চোখে অবিশ্বাস। আবার ঝুঁকে মমির ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে গেলেন।
হ্যাঁ, মমিই! ফিসফিস করে কি যেন বলছে! সামান্য ফাঁক করা ঠোঁটের ভেতর। থেকেই যেন বেরিয়ে আসছে শব্দগুলো। মিশরীয় ভাষা, কোন সন্দেহ নেই। তবে ঠিক কোন ভাষা, বোঝা গেল না। তিন হাজার বছর আগের কোন ভাষা হবে, অনুমান করলেন তিনি। একটা শব্দও বুঝতে পারছেন না প্রফেসর। কেমন খসখসে কণ্ঠস্বর, কথার ফাঁকে ফাঁকে চাপা হিসহিসানি। এতই নিচু কণ্ঠস্বর, কোনমতে শুনতে পাচ্ছেন তিনি। মাঝে মাঝে বেড়ে গিয়ে পরক্ষণেই আবার ঝপ করে খাদে। নেমে যাচ্ছে আওয়াজ। মমিটা তাকে কিছু বোঝনর জোর চেষ্টা চালাচ্ছে যেন।
উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন প্রফেসর। ভাষাটা বোধহয় আরবী, তবে অনেক প্রাচীন। দুয়েকটা শব্দ কেমন পরিচিত লাগছে না!
বলে যান, রা-অরকন! অনুরোধ জানালেন প্রফেসর। বোঝার চেষ্টা করছি। আমি।
স্যার?
বোমা ফাটাল যেন ডাকটা! চমকে উঠে পাঁই করে ঘুরলেন প্রফেসর। এতই মগ্ন। ছিলেন, হুপার এসে ঢুকেছে, টেরই পাননি। নীরব হয়ে গেছে রা-অরকন।
করাতটা মালিকের দিকে বাড়িয়ে দিল হুপার।
হুপার! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। আবার কথা বলেছে মমি! তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই শুরু করেছে! যেই ঘরে ঢুকেছ, থেমে গেছে!
হঠাৎ বড় বেশি গম্ভীর হয়ে গেল হুপার। ভ্রুকুটি করল। তার মানে, আপনি একা না হলে ওটা কথা বলে না! কি বলল, বুঝতে পেরেছেন, স্যার?
না! প্রায় গুঙিয়ে উঠলেন প্রফেসর। ইসস, কেন যে ভাষাবিদ হলাম না! প্রাচীন আরবীই বলছে বোধহয়। হিব্রাইট কিংবা শ্যালডিনও হতে পারে!
ভারি ভারি সব শব্দ! উচ্চারণ করতেই কষ্ট হয় হুপারের, মানে বোঝা তো দূরের কথা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। চোখে পড়ছে গিরিপথের ওপারে প্রায় একশো গজ দূরে ঢালের গায়ে আরেকটা বাড়ি। নতুন তৈরি হয়েছে, আধুনিক ধাচ।
এত ভাবনার কি আছে, স্যার? হাত তুলে বাড়িটা দেখাল হুপার। প্রফেসর উইলসন তো কাছেই থাকেন। তাকে ডেকে নিয়ে আসুন। রা-অরকনের কথা তিনি বুঝতে পারবেন। অবশ্য যদি তাঁর সামনে কথা বলে মমিটা।
ঠিক, ঠিক বলেছ! চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। আরও আগেই ডাকা উচিত ছিল জিমকে। জান না বোধহয়, রা-অরকনকে খোঁজার সময় ওর বাবা ছিল আমার সঙ্গে। আহা, বেচারা! মমিটা খুঁজে পাওয়ার এক হপ্তা পরেই নৃশংসভাবে খুন করা হল তাঁকে! কে, কেন করল, কিছু জানা যায়নি!…যাকগে, তুমি এখনি ফোন কর। জিমকে। বল, আমি ডাকছি। এখুনি যেন চলে আসে।
যাচ্ছি, স্যার।
হুপার বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার কথা বলে উঠল মমি। শুরু হয়ে গেল তার গা ছমছম-করা ফিসফিসানি।
মমির ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে গিয়ে কথা বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন আরেকবার প্রফেসর। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সোজা হলেন। তাকালেন গিরিপথের। ওপারের বাড়িটার দিকে। গিরিখাতগুলো এখানে অদ্ভুত। পথের অনেক নিচে নেমে গেছে ওপাশে পাহাড়ের ঢাল। ভাষাবিদ জিম উইলসনের বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে পথের সমতলের বেশ অনেকখানি নিচে।
দেখতে পাচ্ছেন প্রফেসর, বাড়ির একপাশের দরজা দিয়ে বেরোলেন ভাষাবিদ। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন গ্যারেজে। গাড়ি বেরোল। ছোট্ট একটা বিজ পেরিয়ে নামল পেঁচানো সরু গিরিপথে। চোখ যেদিকেই থাক, প্রফেসরের কান রয়েছে মমির দিকে। ফিসফিস থামিয়ে দিয়েছে ওটা, বোধহয় কথা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েই হাল। ছেড়ে দিয়েছে।
হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন প্রফেসর। যদি কথা না বলে মমিটা? প্রফেসর উইলসন এসেও কিছু করতে পারবেন না। কথা না শুনলে মানে বলবেন কি করে?
কথা থামাবেন না, রা-অরকন! প্লীজ! অনুরোধ করলেন প্রফেসর বেনজামিন। প্লীজ, আবার বলুন! আমি শুনছি। বোঝার চেষ্টা করছি।
নীরব হল মমি। বাইরে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হল। খানিক পরেই খুলে গেল। দরজা। ঘরে এসে ঢুকলেন জিম উইলসন।
এই যে, জিম, এসে পড়েছ, বলে উঠলেন প্রফেসর।
হ্যাঁ, কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন উইলসন।
এদিকে এস। অদ্ভুত একটা ভাষা শুনতে পাবে!
পাশে এসে দাঁড়ালেন উইলসন। চেঁচিয়ে বললেন প্রফেসর, রা-অরকন, প্লীজ! কথা বলুন, যা বলছিলেন এতক্ষণ, আবার বলুন!
নীরব রইল মমি, এ-ঘরে আসার আগের তিনশো শতাব্দী যেমন ছিল।
কাকে কি বলছেন বুঝতে পারছি না! উইলসনের কণ্ঠে বিস্ময়। হালকা পাতলা শরীর, মাঝারি উচ্চতা, হাসি-খুশি সুন্দর চেহারা। বয়স, এই পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ। ভারি চমৎকার কণ্ঠস্বর। ওই শুকনো লাশকে কথা বলতে বলছেন নাকি!
হ্যাঁ, কণ্ঠস্বর খাদে নামালেন প্রফেসর। ফিসফিস করে কথা বলে। অদ্ভুত ভাষায়। শুধু আমার সঙ্গে। অন্য কাউকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই—। ভাষাবিদের চাহনি দেখে থেমে গেলেন তিনি। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, না? রা-অরকন আমার সঙ্গে কথা বলে, বিশ্বাস করতে পারছ না?
গাল চুলকালেন উইলসন। বিশ্বাস করা কঠিন। তবে নিজের কানে শুনলে…
চেষ্টা করে দেখি, মমির ওপর কুঁকলেন প্রফেসর। রা-অরকন, কথা বলুন। বোঝার চেষ্টা করব আমরা।
দুজনেই অপেক্ষা করে রইলেন। রা-অরকনের মমি নীরব।
কোন লাভ নেই, শব্দ করে শ্বাস ফেললেন প্রফেসর। তবে, কথা বলেছিল। ও। বিশ্বাস কর। আবার হয়ত আমি একা হলেই বলবে। তোমাকে শোনাতে পারলে ভাল হত। কি বলছে বুঝতে পারতে।
ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে প্রফেসরের কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না উইলসন। হ্যাঁ, তা হয়ত পারতাম।–আপনার হাতে ওটা কি? করাত—মমিটা কেটে ফেলবেন নাকি?
না, না, মাথা নাড়লেন প্রফেসর। কফিনের কোণ থেকে সামান্য কাঠ নিয়ে কার্বন টেস্টের জন্যে পাঠাব। রা-অরকনকে কবে কবর দেয়া হয়েছিল জানা যাবে।
মূল্যবান জিনিসটা কেটে নষ্ট করবেন! ভুরু কোঁচকালেন উইলসন। তার কি দরকার আছে?
এই মমি আর কফিন সত্যিই মূল্যবান কিনা, এখনও জানি না। জানতে হলে কার্বন টেস্ট করতে হবে। তবে, অদ্ভুত রহস্যটার সমাধান করব আগে। কি বলে, জানব। তার আগে পাঠাচ্ছি না। সত্যি, জিম, খুব অবাক হয়েছি! মমি কথা বলে! তা-ও আবার একা আমার সঙ্গে।
হুমম। বৃদ্ধ প্রফেসরের জন্যে করুণা হচ্ছে উইলসনের। এক কাজ করবেন? কয়েকদিনের জন্যে কফিনসহ মমিটা আমার ওখানে পাঠিয়ে দিন। আমি একা থাকলে হয়ত আমার সঙ্গেও কথা বলতে পারে ওটা। বললে, বুঝতে পারবই। সমাধান হয়ে যাবে হয়ত রহস্যটার।
উইলসনের দিকে তাকালেন প্রফেসর। গম্ভীর হয়ে গেছেন। থ্যাংক ইউ, জিম, কণ্ঠস্বর ভারি। বুঝতে পারছি, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার। ভাবছ, সব আমার অলীক কল্পনা। হয়ত তোমার ধারণাই ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা সম্পর্কে শিওর না হয়ে মমি হাতছাড়া করছি না আমি।
সামান্য একটু মাথা ঝাঁকালেন উইলসন। ঠিক আছে, রা-অরকন আবার কথা। বললেই ডেকে পাঠাবেন আমাকে। চলে আসব। এখন যাই। ইউনিভার্সিটিতে সম্মেলন আছে।
প্রফেসরকে গুড বাই জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর উইলসন।
মমির দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে রইলেন প্রফেসর বেনজামিন। নীরব রইল রা অরকন।
ডিনার দেব, স্যার? দরজার কাছ থেকে হুপারের কথা শোনা গেল।
হ্যাঁ, মুখ ফিরিয়ে তাকালেন প্রফেসর। শোন, এসব কথা কাউকে কিছু বলবে না।
না, বলব না, স্যার।
উইলসনের ভাবভঙ্গি থেকেই বুঝে গেছি, কথাটা শুনলে আমার বৈজ্ঞানিক বন্ধুরা কি ভাববে। মোটেই বিশ্বাস করবে না ওরা। মুখ টিপে হাসাহাসি করবে। বলবে, বুড়ো বয়সে পাগল হয়ে গেছি। খবরের কাগজে প্রকাশ করে দিলেই গেছি। সারা জীবনে যত সুনাম কামিয়েছি, সব যাবে।
হ্যাঁ, স্যার, মাথা ঝোঁকাল হুপার। হয়ত তাই ঘটবে।
কিন্তু, কারও না কারও কাছে কথাটা বলতেই হবে আমাকে, চিন্তিত ভঙ্গিতে কানের নিচে চুলকালেন প্রফেসর। এমন কেউ, যে বিজ্ঞানী নয়। যে জানে, অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটে এই দুনিয়ায়, যার কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু কাকে বলব? কাকে—
স্যার, মি, ক্রিস্টোফারকে ফোন করে দেখুন না। তিনিও তো আপনার বন্ধু। আর রহস্য নিয়েই তার—
ঠিক, ঠিক বলেছ! চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। আজই যোগাযোগ করব ওর সঙ্গে। সারা আমেরিকায় যদি কেউ বিশ্বাস করে আমার কথা, একমাত্র ডেভিসই করবে।
.
০৩.
মমি কথা বলে কি করে? আবার একই প্রশ্ন করল মুসা।
জবাবে শুধু মাথা নাড়ল রবিন।
দুজনেই বার বার পড়েছে চিঠিটা। বিশ্বাসই করতে পারছে না। ডেভিস ক্রিস্টোফারের কাছ থেকে না এলে এতক্ষণে ছুঁড়ে ফেলে দিত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে। কিন্তু ফালতু কথা বলেন না চিত্রপরিচালক। তিনি যখন বিশ্বাস করেছেন, নিশ্চয় ব্যাপারটা প্রফেসর বেনজামিনের কল্পনাপ্রসূত নয়। প্রফেসরকে সাহায্য করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন মি, ক্রিস্টোফার।
মমি তো একটা মরা লাশ, আবার বলল মুসা। কি করে কথা বলে কোঁকড়া কালো চুলে আঙুল চালাল সে। এককালে মানুষ ছিল অবশ্য, তবে এখন…
জ্যান্ত নয়, মুসার কথাটা বলে দিল রবিন। ভূত-টুত ভাবছ না তো? অপছন্দ হচ্ছে ব্যাপারটা?
নিশ্চয়! হাত বাড়িয়ে ডেস্কে রাখা চিঠিটা আবার তুলে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল মুসা। প্রফেসর হার্বার্ট বেনজামিন প্রখ্যাত ইজিপট-অল—ইজিপট-অল—
ইজিপটোলজিস্ট, বলে দিল রবিন।
ইজিপট-অল-ইজিপট-অল–আরে ধুত্তেরি! জাহান্নামে যাক! আঁজিয়ে উঠল মুসা। তারপর নিজেকেই যেন বলল, হলিউডের কাছে হান্টার ক্যানিয়নে থাকেন প্রফেসর। ব্যক্তিগত জাদুঘর আছে। একটা মমি আছে সেখানে, যেটা কথা বলে, এবং ভাষাটা বুঝতে পারেননি প্রফেসর। খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। ঠিকই করছেন, তাঁকে দোষ দেয়া যায় না। মমিটা দেখিনি, অথচ শুনেই অস্বস্তি লাগছে আমার। এ পর্যন্ত কয়েকটা রহস্যেরই তো সমাধান করলাম! বিশেষ করে ওই ছায়া শরীর আর হাউণ্ডের ব্যাপারটা এখনও মন থেকে যায়নি। রবিন, তার চেয়ে চল সান্তা মনিকায় বেড়াল রহস্যের সমাধান করি গিয়ে। টেবিল থেকে মিসেস ভেরা চ্যানেলের চিঠিটা তুলে নিল সে।
কিশোর কোন কেসটা নিতে আগ্রহী হবে, জান, গোমড়ামুখে বলল রবিন।
জানি, মুখ বাঁকাল মুসা। ক্রিস্টোফারের চিঠিটা পড়ামাত্র তাঁকে টেলিফোন করবে সে। তারপরই ছুটবে প্রফেসর বেনজামিনের ওখানে। এক কাজ করি। এস, ভোট নিই। হারিয়ে দেব কিশোরকে। বেড়াল খোঁজার কাজটাই আগে করতে বাধ্য হবে সে।
ভোটাভুটিতে রাজিই হবে না সে, ঠোঁট ওল্টাল রবিন। চেষ্টা করে তো দেখেছি আগেও। টেরোর ক্যাসলের কথা মনে নেই? যাব না বলেছিলাম, তুমি আমি দুজনেই। শুনেছিল আমাদের কথা?
চুপ করে রইল মুসা। গম্ভীর।
কিন্তু ও আসছে না কেন এখনও! সুড়ঙ্গমুখের দিকে তাকাল রবিন। গেল তো অনেকক্ষণ।
দাঁড়াও, দেখি, বলল মুসা। হয়ত এসেছে, কোন কাজে আটকে দিয়েছে মেরিচাচী। ছোট মোবাইল হোমের এক কোণে চলে এল সে। মাঝারি আকারের মোটা একটা পাইপ, ছাত ফুটো করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ওটাকে জায়গামত আটকানর ব্যবস্থা হয়েছে লোহার শিক দিয়ে। নিচের দিকে দুপাশে আরও দুটো লোহার পাইপ-হ্যাণ্ডেল ধরে মূল পাইপটাকে ওঠানো-নামানো কিংবা এদিক-ওদিক ঘোরানর জন্যে। আসলে ওটা একটা পেরিস্কোপ, প্রথম মহাযুদ্ধের একটা সাবমেরিনে ব্যবহার করা হয়েছিল। পুরানো বাতিল অন্যান্য লোহার জিনিসের সঙ্গে ওটাও কিনে এনেছেন রাশেদ চাচা। জিনিসটাকে মেরামত করে হেডকোয়ার্টারের ছাতে লাগিয়ে নিয়েছে তিন গোয়েন্দা। দিব্যি কাজ চলে এখন। কিশোর এক অদ্ভুত নাম দিয়েছে পেরিস্কোপটার, সর্ব দর্শন।
হ্যাঁণ্ডেল ধরে পেরিস্কোপটা ঠেলে ওপরে তুলে দিল মুসা। আয়নায় চোখ রাখল। যন্ত্রটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে নজর বোলাল ইয়ার্ডে। নির্দিষ্ট একটা অবস্থানে এনে স্থির করল। একজন খদ্দের দেখতে পাচ্ছি। পাইপ বিক্রি করেছেন মেরিচাচী জঞ্জাল সরাচ্ছে বোরিস… আর, ওই যে, কিশোর, সামান্য ঘোরাল পেরিস্কোপ। ফিরে এসেছে। ঠেলে ঠেলে আনছে সাইকেলটা। খারাপ হয়ে গেছে বোধহঃ কিছু..হ্যাঁ, হ্যাঁ, সামনের টায়ার বসে গেছে। পাঙ্কচার।
পেরেক-টেরেক ঢুকেছে হয়ত, মন্তব্য করল রবিন। দেরি এজন্যেই। কি মনে হচ্ছে চেহারা দেখে? রেগেছে খুব?
নাহ, আশ্চর্য! সঙ্গের রেডিও শুনছে আর হাসছে, বলল মুসা। সত্যিই আশ্চর্য! সাইকেলের টায়ার পাঙ্কচার, ঠেলে ঠেলে আনা! কার না মেজাজ খারাপ হয়? কিশোরের তো আরও বেশি হওয়ার কথা। যেরকম খুঁতখুঁতে। তা না, হাসছে!
ওর মতিগতি বোঝা মুশকিল! বলল রবিন। কখন হাসবে, কখন রাগবে, আর কখন কি করে বসবে, সে-ই জানে! রেডিওতে মজার কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। বোধহয়।
কি জানি! পেরিস্কোপ আরেকটু বায়ে ঘোরাল মুসা। মেরিচাচীর সামনে এসে। দাঁড়িয়েছে। কি যেন দিচ্ছে চাচীকে। কিছু বলছে। এদিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন। চাচী। আমাদের কথাই বলছেন বোধহয়।…সাইকেলটা স্ট্যাণ্ডে তুলে রাখল। কিশোর। অফিসে ঢুকছে।…দেরি করছে কেন? কি করছে?…ওই যে, বেরোচ্ছে।…আসছে, এদিকেই আসছে…
ওকে নিয়ে আজ একটু মজা করব, হাসল রবিন। মিস্টার ক্রিস্টোফারের চিঠিটা পকেটে রেখে দিয়েছি। মিসেস চ্যানেলেরটা দেখাব আগে, কেসটা নিতে বলব। রাজি হলে তারপর দেখাব আসল চিঠিটা।
বেড়ালটা পাওয়ার আগে দেখিও না, খবরদার! হাসল মুসা। আরেকটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। আমি যা যা বলব, সায় দেবে। কিংবা চুপ করে থাকবে। অন্তত প্রতিবাদ করবে না।
অপেক্ষা করছে দুই গোয়েন্দা। পেরিস্কোপের কাছ থেকে সরে এসেছে মুসা। বাইরে টিনের পাত সরানর মৃদু শব্দ হল। খানিক পরেই খুলে গেল ট্রেলারের ভেতরে দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনা। চট করে এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল মুসা। সুড়ঙ্গমুখে কিশোরের হাত দেখা গেল, তারপর মাথা। উঠে এল সে ট্রেলারে।
উফফ! যা গরম! ফুহহ করে মুখের ভেতর থেকে বাতাস বের করল কিশোর।
হ্যাঁ, সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মুসা। এই গরমে সাইকেলের চাকা পাঙ্কচার? ঠেলে আনা খুব কষ্টকর।
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। কি করে জানলে, সাইকেলের টায়ার পাঙ্কচার?
ডিডাকশন, জবাব দিল মুসা। তুমিই তো ডিডাকশনের ওপর জোর দিতে বল। আমি আর রবিন এতক্ষণ ধরে তাই প্র্যাকটিস করছিলাম। না, রবিন?
মাথা নাড়ল নথি। হ্যাঁ। অনেক পথ হেঁটে আসতে হয়েছে তোমাকে, কিশোর?–
চোখের পাতা কাছাকাছি চলে এসেছে কিশোরের। সতর্ক দৃষ্টিতে একবার তাকাল মুসার দিকে, তারপর রবিনের মুখের দিকে। হ্যাঁ, তা হয়েছে। এখন বল, কি ডিডাকশন করলে? কি দেখে বুঝেছ, আমার সাইকেলের চাকা পাঙ্কচার হয়েছে?
কি দেখে মানে? মুসার কণ্ঠে দ্বিধা। ঘাবড়ে গেছে মনে হচ্ছে।
বল না, বলে দাও, তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করল রবিন। শুরুতেই না সর্বনাশ করে দেয় মুসা!
ইয়ে মানে, ঢোক গিলল মুসা। হ্যাঁ, দেখি তোমার হাত? কিশোরকে বলল।
তালু চিত করে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিল কিশোর। ময়লা ধুলোবালি লেগে আছে। নিশ্চয় টায়ার ঘাটাঘাটি করেছে। পেরেকটা খুলে ফেলে দিয়েছে। বল, কি করে বুঝলে?
তোমার হাতে, হাঁটুতে ময়লা, সামলে নিয়েছে মুসা। কিছু একটা পরীক্ষা করার জন্যে হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসে পড়েছিলে। ডিডাকশন: হাঁটু গেড়ে বসে পাঙ্কচার হওয়া টায়ার পরীক্ষা করেছ। তোমার জুতোতে প্রচুর ধুলো। ডিডাকশনঃ অনেক পথ হেঁটে এসেছ। তাই না, মাই ডিয়ার কিশোর পাশা?
কিশোরের চেহারা দেখে মনে হল, খুব অবাক হয়েছে। চমৎকার। ভাল। ডিডাকশন করতে শিখেছ। এই বুদ্ধি সাধারণ একটা বেড়াল খোঁজার পেছনে ব্যয় করার কোন মানে হয় না।
কি-ই! চমকে উঠেছে মুসা।
একটা আবিসিনিয়ান বেড়াল হারিয়েছে, ওটাকে খোঁজার কোন মানেই হয় না। তিন গোয়েন্দার জন্যে খুবই সহজ কাজ। ভারিক্কি চালে বলল কিশোর, এটা মোটেই সহ্য হয় না মুসার। আড়চোখে একবার সহকারীর মুখের ভাব লক্ষ্য করে বলল গোয়েন্দাপ্রধান, তোমার মত বুদ্ধিমান গোয়েন্দার উপযুক্ত কাজ, মমির রহস্য ভেদ করা। তিন হাজার বছরের পুরানো মমি, যেটা ফিসফিস করে কথা বলে।
কার কাছে জানলে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
তোমরা যখন ডিডাকশনে ব্যস্ত, সহজ কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি তখন মাইণ্ড রিডিং করেছি। রবিন, তোমার পকেটে রয়েছে একটা চিঠি, ওতে প্রফেসর বেনজামিনের ঠিকানা আছে। পনেরো মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব। ট্যাক্সি নেব। হাজার হোক, মিস্টার ক্রিস্টোফারের অনুরোধ আমরা ফেলতে পারব না কিছুতেই।
হাঁ হয়ে গেছে অন্য দুই গোয়েন্দা। বোকার মত চেয়ে আছে কিশোরের মুখের দিকে।
.
০৪.
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ভেতর দিয়ে ছুটছে ট্যাক্সি। পেছনের সিটে গা এলিয়ে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। পাহাড়ী পথ ধরে ছুটছে গাড়ি। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগছে।
ইসস্! সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল রবিন। ঝাঁকুনিতেই মেরে ফেলবে। রোলস রয়েসটা হলে কি মজাই না হত! আবার একটা বাজি যদি লাগাত কোম্পানি!
ভেব না, আশ্বাস দিল কিশোর। শিগগিরই আবার ওটাতে চড়ব আমরা।
কি করে! মুসা অবাক। তিরিশ দিন তো সেই কবেই পেরিয়ে গেছে!
দুইয়ে দুইয়ে চার হলেও, তিরিশ দিনে অনেক সময় তিরিশ হয় না, রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি বলে রাখছি, ওই গাড়িটা আবার ব্যবহার করব আমরা। মাসখানেকের জন্যে ভাড়া নিয়েছেন এক ব্যাংকার। মেয়াদ শেষ হলেই কোম্পানির অফিসে ফিরে আসবে গাড়িটা। তখন ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে বললেই…
দিয়ে দেবে! ফস করে বলে উঠল মুসা। এতই সহজ!
একই কথা বলেছিলে মিস্টার ক্রিস্টোফারের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে যাওয়ার আগে। যাকগে, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমরা বোধহয় এসে গেছি।
আঁকাবাঁকা গিরিপথে পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। খানিক দূরেই বাড়িটা। পুরানো ধাঁচের পোর্টিকো, বিশাল সব থাম। একটা থামে বসানো পেতলের প্লেটে খোদাই করা রয়েছে প্রফেসর হার্বার্ট বেনজামিনের নাম। গাছপালা ঝোঁপঝাড় ঘিরে রেখেছে লাল টালির ছাত দেয়া স্প্যানিশ ধাচের বাড়িটাকে। একপাশে গোল হয়ে নেমে গেছে পাহাড়, সরু উপত্যকা সৃষ্টি করে ওপাশে আবার উঠে গেছে আরেকটা পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। ওই পাহাড়টার ঢালে বিভিন্ন সমতলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঠেছে কয়েকটা বাড়ি। নতুন। বাংলো টাইপ।
চল নামি, বন্ধুদেরকে বলল কিশোর। দরজা খুলে নেমে পড়ল ট্যাক্সি থেকে।
রবিন আর মুসাও নামল। ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলল কিশোর।–
কিশোর, আমার ভয় করছে! বলে উঠল মুসা। প্রফেসর বেনজামিন পাগল টাগল নয় তো? বুড়ো ওই বিজ্ঞানীগুলো সাধারণত পাগলাটে হয়! বদমেজাজীও!
নাহ, জোর দিয়ে বলল কিশোর। আসার আগে তো টেলিফোন করলাম। গলা শুনে খুব ভদ্র বলেই মনে হল। চল, আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ভদ্রলোক।
পাগলা না হলেই ভাল! বিড়বিড় করল মুসা। এগোল গোয়েন্দাপ্রধানের পিছু পিছু। আর হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। মমির কথা শুনলে আমিও পাগল হয়ে যাব…
.
প্রফেসর বেনজামিন উত্তেজিত। চত্বরে ইজি চেয়ারে বসে আছেন পিঠ সোজা করে। সামনে টেবিলে কফির কাপ। পাশে দাঁড়িয়ে আছে খানসামা।
হুপার, বললেন প্রফেসর। সত্যি শুনেছ তো?
মনে তো হল, স্যার, জবাব দিল খানসামা। দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘরটায়। অন্ধকার। হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ-কথা বলার আওয়াজই হবে, শুনলাম!
তারপর?
আমার মনে হয়, ইঁদুর-টিদুর, স্যার, প্রফেসরের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল হুপার। শূন্য কাপটা তুলে নিল টেবিল থেকে। ন্যাপকিন এগিয়ে দিল।
ঠোঁট মুছলেন প্রফেসর। কিছু একটা হয়েছে আমার, হুপার! হঠাৎ গতরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দুরুদুরু করছিল বুকের ভেতর। কেন, কে জানে! হয়ত—হয়ত রহস্যটা আমার স্নায়ু দুর্বল করে দিয়েছে।
আমারও খুব অস্বস্তি লাগছে, স্যার, বলল হুপার। আপনার কি মনে হয়… থেমে গেল কথা শেষ না করেই।
মনে হয় কি মনে হয়? বল?
ইয়ে—মানে—বলছিলাম কি, ব্র-অরকনকে আবার মিশরে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? কায়রোর সেই জাদুঘরে? বেচে যেতেন
না! দৃঢ় কণ্ঠে বললেন প্রফেসর। মাঝপথেই হাল ছেড়ে দেয়া আমার স্বভাব নয়। তাছাড়া সাহায্য আসছে।
গোয়েন্দার কথা বলছেন তো, স্যার? ওদেরকে বলা উচিত হবে না। পুলিশের কানে কথাটা যাওয়া কি ঠিক?
পুলিশের কানে যাবে না। আমার বন্ধু, ডেভিস কথা দিয়েছে। দাম আছে তার কথার— কলিং বেলের সুরেলা শব্দে থেমে গেলেন প্রফেসর, ওই যে, এসে গেছে ওরা। হুপার, জলদি যাও। নিয়ে এস ওদেরকে এখানে।
যাচ্ছি, স্যার, তাড়াহুড়ো করে চলে গেল খানসামা। একটু পরেই তিন গোয়েন্দাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।
ভুরু কুঁচকে বসে আছেন প্রফেসর। সেটা লক্ষ্য করল কিশোর। বুঝলে তিনটে কিশোরকে আশা করেননি তিনি। ভারিক্কি চালে পকেট থেকে কার্ড বের করে বাড়িয়ে কার্ডটা দিল সে।
যন্ত্রচালিতের মত হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলেন প্রফেসর। চোখ নামালেন কার্ডের দিকে। ছাপা রয়েছে:
???
তিন গোয়েন্দা।
প্রধান: কিশোর পাশা
সহকারী: মুসা আমান।
নথিরক্ষক ও গবেষক: রবিন মিলফোর্ড
আর সবাই যা করে, সেই একই প্রশ্ন করলেন প্রফেসর বেনজামিনওঃ প্রশ্নবোধকগুলো কেন?
জানাল কিশোর ওগুলো রহস্যের প্রতীকচিহ্ন।
হমম্! কার্ডটা হাতে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ওল্টাচ্ছেন-পাল্টাচ্ছেন প্রফেসর। ডেভিস পাঠিয়েছে তোমাদেরকে। ওর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস, কাজেই তোমাদের ওপর ভরসা রাখছি আপাতত। পুলিশকে ডেকে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু, অসুবিধা আছে। ওরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। জোরজার করি যদি বেশি, একজন ডিটেকটিভ পাঠাবে। লোকের নজরে পড়বেই ব্যাপারটা।খোঁজখবর শুরু করবে ওরা। আসল খবরটা ঠিক বের করে নেবে। পাগল খেতাব দিয়ে বসবে আমাকে।
উঠলেন প্রফেসর। এস, রা-অরকনকে দেখাব, বলেই হাঁটতে শুরু করলেন বা প্রান্তের দিকে।
প্রফেসরকে অনুসরণ করল কিশোর। রবিন আর মুসাও পা বাড়াতে যাচ্ছিল, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে ঠেকাল হুপার। হাতটা কাঁপছে। চেহারা ফ্যাকাসে, উত্তেজিত ভাবভঙ্গি।
অনেকখানি এগিয়ে গেছেন প্রফেসর আর কিশোর। সেদিক থেকে চোখ ফেরাল হুপার। ফিসফিস করে বলল, ছেলেরা, মমিটা নিয়ে কাজ শুরু করার আগে কিছু কথা জানা দরকার তোমাদের।
কি কথা? ভ্রুকুটি করল মুসা।
একটা অভিশাপ রয়েছে, কণ্ঠস্বর আরও খাদে নামাল হুপার। রা-অরকনের কবরে কিছু মাটির ফলক পাওয়া গেছে। তাতে অভিশাপ বাণী লেখা: যে এই কবরের গোপনীয়তা নষ্ট করবে তার ওপর নামবে রা-অরকনের অভিশাপ। অনেক বছর আগে পাওয়া গেছে মমিটা। উদ্ধার অভিযানে যারা ছিল তাদের অনেকেরই অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। কারও কারও মৃত্য ছিল ভয়ঙ্কর আকস্মিক। প্রফেসর বেনজামিনও জানেন ব্যাপারটা। কিন্তু বিশ্বাস করেন না, বলেন মমিটা না পেলেও ঘটত ওই মৃত্যু। বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা নেই এর। কুসংস্কার। এতদিন এড়িয়েই ছিলেন, কিন্তু মমিটা ঘরে আনার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল গণ্ডগোল। ফিসফিস করে নাকি কথা বলে ওটা! তারমানে মাথার গোলমাল শুরু হয়ে গেছে প্রফেসরের। কোনদিন আত্মহত্যা করে বসবেন, কে জানে! তোমরা ব্যাপারটা অনুসন্ধান করে দেখতে চাইছ, দেখ, বাধা দেব না। তবে খুব সাবধান!
চোখ বড় বড় হয়ে গেছে দুই গোয়েন্দার। হুপারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বাড়ির প্রান্তে পৌঁছে গেছে কিশোর, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাকল, কি হল তোমাদের? এস।
দ্রুত এগিয়ে গেল রবিন আর মুসা। গোয়েন্দাপ্রধানের সঙ্গে সঙ্গে এগোল।
বিশাল জানালা দিয়ে জাদুঘরে ঢুকে পড়ল ওরা। কফিনটার সামনে গিয়ে। দাঁড়ালেন প্রফেসর। ঢাকনা তুলে দাঁড় করিয়ে রাখলেন পাশে। বললেন, এই যে, রা-অরকনের মমি। ও কি বলার চেষ্টা করেছে, আশা করি জানতে পারবে তোমরা। বলতে পারবে আমাকে।
গভীর প্রশান্তিতে যেন কফিনের ভেতর ঘুমিয়ে রয়েছে মেহগনি রঙের মমিটা। চোখের পাতা বোজা, কিন্তু দেখে মনে হয় যে-কোন মুহূর্তে মেলবে।
মমিটার ওপর তীক্ষ্ণ নজর বোলাল কিশোর। চোখেমুখে কৌতূহল।
রবিন আর মুসাও দেখছে, তবে কৌতূহলী বা আগ্রহী মনে হচ্ছে না তাদের। বরং শঙ্কা ফুটেছে চেহারায়। চাওয়া-চাওয়ি করল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
ইয়াল্লা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। একেবারে জ্যান্ত! ড্রাকুলা জাতীয় কোন ভূত! কিশোর, এবার সত্যি সত্যি ভূতের পাল্লায় পড়ব!
.
০৫.
গভীর মনোযোগে মমিটাকে পর্যবেক্ষণ করছে কিশোর। পাশে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে বার বার কপালের ঘাম মুছলেন প্রফেসর।
হুপার, খানসামাকে দেখেই বলে উঠলেন প্রফেসর, সবগুলো জানালা খোল! বলেছি না, আমি বন্ধ ঘর একেবারে সইতে পারি না।
এই যে, স্যার, দিচ্ছি, তাড়াহুড়ো করে একটা জানালার দিকে এগিয়ে গেল। লম্বা লোকটা। খুলে দিল জানালা। এক ঝলক বাতাস এসে ঢুকল ঘরে। দেয়ালে, ঝোলানো মুখোশগুলোকে নাড়িয়ে দিল। অদ্ভুত একটা খসখস আর টুংটাং আওয়াজ উঠল চারপাশ থেকে।
শব্দ শুনে মুখ তুলল কিশোর। প্রফেসর, ওই শব্দ শোনেননি তো? বাতাসে মুখোশ কিংবা আর কিছু নড়ানর শব্দ?
না না, মাথা নাড়লেন প্রফেসর। মানুষের কণ্ঠস্বর চিনতে পারি না ভাবছ? মমিটাই কথা বলেছিল!
তাহলে, বলল কিশোর, ধরে নিচ্ছি, আপনি সত্যিই মমিকে কথা বলতে শুনেছেন, এবং সম্ভবত প্রাচীন আরবীতে, তাই না?
এখানে কি আর কিছু করার আছে, স্যার, আমার? মাঝখান থেকে বলে উঠল হুপার। অনেক কাজ পড়ে আছে। যাব?
সবকটা চোখ ঘুরে গেছে খানসামার দিকে। হঠাৎই তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠতে দেখল সবাই। শঙ্কিত। প্রফেসরকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল হুপার। তাঁকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। পরমুহূর্তেই দুম করে পড়ল কাঠের ভারি মূর্তিটা। শেয়ালমাথা দেবতা আনুবিস। মুহূর্ত আগে প্রফেসর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠিক সেখানে। পাশে কাত হয়ে গেল মূর্তি, মুখ প্রফেসরের দিকে। তাঁকে শাসাচ্ছে যেন। নীরবে।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর।
হুপারও উঠল। সে আরও বেশি কাঁপছে। আমি…আমি ওটাকে নড়ে উঠতে দেখেছিলাম, স্যার! গলা কাঁপছে। ভর্তা হয়ে যেতেন এতক্ষণে। ঢোক গিলল খানসামা। রা-অরকনের অভিশাপ, আর কিছু না! মমিটার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয়েছে।
আরে দূর! হাত দিয়ে ঝেড়ে হাতের ধুলো পরিষ্কার করছেন প্রফেসর। যত্তোসব কুসংস্কার! আর ওই খবরের কাগজওয়ালারা হয়েছে একেকটা গপ্পোবাজ। কিছু একটা পেলেই হল। রঙ চড়িয়ে সাতখান করে বাড়িয়ে লিখে খালি কাগজ বিক্রির ফন্দি। এমন ঘটনা আরও ঘটেছে তুতানখামেনের মমি আবিষ্কার করার পর। অনেকেই মরল, অথচ কি সুন্দর বেঁচে গেলেন হাওয়ার্ড কার্টার। নাটের গুরু তিনি, অভিশাপে মরলে তারই সবার আগে মরার কথা ছিল। তার তো স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে। ওসব আবোল-তাবোল কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। মূর্তিটা পড়েছে অন্য কোন কারণে, অভিশাপের জন্য নয়। হয়ত ঠিকমত দাঁড় করানো হয়নি। বাতাসে পড়ে গেছে।
স্যার, ভুলে যাচ্ছেন, খসখসে শোনল হুপারের কণ্ঠ। তিন হাজার বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল মূর্তিটা, পড়েনি। আজ হঠাৎ করে পড়তে গেল কেন? আপনি ভর্তা হয়ে মরতেন, লর্ড কার্নারভনের—-
লর্ড কার্নারভন অসুখে মরেছিলেন, তপ্তকণ্ঠে বললেন প্রফেসর। মূর্তি পড়ে ভর্তা হননি। যাও, ভাগ এখন।
যাচ্ছি, স্যার, ঘুরে দাঁড়াল হুপার।
ঝুকে মূর্তিটা দেখছিল কিশোর, মাথা তুলল। থামাল খানসামাকে। হুপার, আপনি বললেন মূর্তিটাকে নড়ে উঠতে দেখেছেন। কিভাবে কোনদিকে নড়েছিল?
নাক বরাবর সামনের দিকে পড়তে লাগল, মাস্টার পাশা, টলে উঠেছিল। প্রথমে, জবাব দিল হুপার। আজ দাঁড়ানর ভঙ্গিতেই কেমন গোলমাল ছিল, খেয়াল করেছি! সামান্য নাড়া লাগলেই পড়ে যাবে, এমন ভঙ্গি। যেন আগেভাগেই প্ল্যান। করে রেখেছিল, আজ প্রফেসর সাহেবের ওপর পড়বে!
হুপার! তীক্ষ্ণ শোনাল প্রফেসরের কণ্ঠ।
সত্যিই বলছি, স্যার। টলে উঠল আনুবিস, সামনে ঝুঁকে পড়ে গেল। সময়মত নড়তে পেরেছিলাম, তাই রক্ষে!
হ্যাঁ, খুব ভাল করেছ। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তিক্ত কণ্ঠে বললেন, প্রফেসর। সব বাজে কথা! অভিশাপ-
একটা ধাতব মুখোশ খসে পড়ে তীক্ষ্ণ ঝনঝন শব্দ তুলল। প্রায় লাফিয়ে উঠল ঘরের সবাই। চমকে ফিরে তাকাল ওরা।
দেখলেন!–দেখলেন তো, স্যার! আতঙ্কে ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন হুপারের চোখ।
বাতাস! গলায় আর তেমন জোর নেই প্রফেসরের। বাতাসই ফেলেছে। আনুবিসকে, মুখোশটাও ফেলল।
হাঁটু গেড়ে কাঠের মূর্তিটার পাশে বসে পড়েছে কিশোর। হাত বোলাচ্ছে তলার চারকোনা জায়গাটায়-যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছিল মূর্তি। যথেষ্ট ভারি মূর্তি, স্যার, মুখ না তুলেই বলল কিশোর। তলাটাও খুব মসৃণ। সহজে নড়ার কথা নয়। এই মূর্তি বাতাসে ফেলতে হলে ঝড়ো বাতাস দরকার।
ইয়ং ম্যান, বিরক্তই শোনাল প্রফেসরের কণ্ঠ, আমি একজন বিজ্ঞানী। ভূতপ্রেত কিংবা অভিশাপে বিশ্বাস করি না। আমাকে সহায়তা করতেই যদি চাও, কথাটা মনে রেখে এগিয়ে।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। আমিও ওসব বিশ্বাস করি না, স্যার। কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুটো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল, পাঁচজোড়া চোখের সামনে। এবং কারণটা বোঝা যাচ্ছে না কেন পড়ল ওগুলো।
দৈবক্রমে পড়ে গেছে, বললেন প্রফেসর। এটা নিয়ে এত মাথা ঘামানর কিছু নেই। ইয়ং ম্যান, তুমি বিশ্বাস করছ মমিটা আমার সঙ্গে কথা বলেছে! কি করে বলব, কোন ব্যাখ্যা দিতে পারবে?
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করেছে কিশোর। হঠাৎ বলল, পারব, স্যার।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা? আবোল-তাবোল কিছু নয়?
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, দুই সহকারীর দিকে ফিরল কিশোর। মুসা, রবিন, গাড়িতে যে ব্যাগটা রয়েছে, ওটা আনতে হবে। কিছু যন্ত্রপাতি আছে ওতে। ওগুলো দরকার।
নিয়ে আসছি, বলল মুসা। বেরিয়ে যেতে পারছে বলে খুশিই সে। রবিন, এস।
পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব আপনাদেরকে, আসুন, হুপারও বেরিয়ে যাওয়ার ছুঁতো পেল।
বেরিয়ে এল তিনজনে, জাদুঘরে কিশোর আর প্রফেসরকে রেখে।
লম্বা একটা হলঘরের ভেতর দিয়ে চলেছে হুপার। অনুসরণ করছে দুই গোয়েন্দা। অন্য পাশের দরজা খুলল খানসামা। তিনজনে বেরিয়ে এল বাইরে।
গাড়ির বনেট মুছছে ড্রাইভার।
ছেলেরা, ফিসফিস করে বলল হুপার, প্রফেসর বেনজামিন বড় বেশি একরোখা। অভিশাপ রয়েছে, ওটাকে গ্রাহ্যই করতে চাইছেন না। কিন্তু তোমরা তো দেখলে, কি ঘটল! পরের বার হয়ত খুন হবেন তিনি! বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমাদের কেউও হয়ে যেতে পারি! প্লীজ, ওঁকে বোঝাও, রা-অরকনকে মিশরে ফেরত পাঠিয়ে দিতে। হলরুমে ঢুকে গেল আবার খানসামা।
রবিন আর মুসা, দুজনেই খুব চিন্তিত।
অভিশাপ-টাপ বিশ্বাস করে না কিশোর, বলল মুসা। আমি করি, তাও বলব না। তবে একটা কথা শিওর হয়ে বলতে পারি; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে কেটে পড়া উচিত আমাদের।
-কোন জবাব দিতে পারল না রবিন। ওসব অভিশাপ-টাপে তারও বিশ্বাস নেই। কিন্তু দুর্ঘটনাগুলো তো ঘটছে, এর কি ব্যাখ্যা?
পেছনে শব্দ শুনে ফিরে তাকাল ড্রাইভার। হয়েছে আপনাদের? না আরও দেরি আছে?
মাত্র শুরু করেছি, এখনও অনেক দেরি, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। যে কারবারে জড়িয়েছি!—ব্যাগটা নিতে এলাম।
ঘুরে গাড়ির পেছন দিকে চলে এল ড্রাইভার। ট্রাঙ্ক খুলে বের করে আনল। চামড়ার চ্যাপ্টা ব্যাগটা। বাড়িয়ে দিল মুসার দিকে, এই যে, নিন।
আছে কি এর ভেতরে? ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল মুসা। যা ভারি! রবিন, কিশোর একটা চমক দেবে মনে হচ্ছে!
দেখ কি আবার করে বসে! চিন্তিত দেখাচ্ছে রবিনকে। টায়ার পাঙ্কচারের ডিডাকশন করে তো খুব একহাত নিয়েছ, পাল্টা আঘাত হেনে না একেবারে কাত করে দেয়।
ব্যাগটা নিয়ে আবার জাদুঘরে গিয়ে ঢুকল দুই গোয়েন্দা। আনুবিসকে তুলে আবার জায়গামত দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কিশোর আর প্রফেসর। মূর্তিটাকে আরও ইঞ্চিখানেক পেছনে ঠেলে দিল কিশোর। মাথা নাড়ল। না, আপনাআপনি পড়তেই পারে না। জানালা দিয়ে বাতাস যা আসছে এতে তো পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। পড়াতে হলে প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস লাগবে।
ঘন ভুরু জোড়া কাছাকাছি চলে এল প্রফেসরের। আধিভৌতিক কোন শক্তি কাজ করছে এর পেছনে, বলতে চাইছ।
জানি না! মূর্তিটা কি করে পড়ল, আপাতত বলতে পারছি না, শান্ত কণ্ঠ কিশোরের। রবিন আর মুসার ওপর চোখ পড়তেই বলল, কিন্তু মমি কি করে কথা বলে, দেখাচ্ছি।
মুসার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে খুলল কিশোর। ভেতর থেকে বের করল বড় আকারের তিনটে ট্রানজিসটর রেডিও। একটা রেডিও তুলে দিল মুসার হাতে। ব্যাগ। থেকে একটা চামড়ার বেল্ট বের করে পরিয়ে দিল মুসার কোমরে। তামার অসংখ্য সরু সরু তার কায়দা করে লম্বালম্বি আটকানো রয়েছে বেল্টে। রেডিও থেকে বের করে রাখা দুটো তারের মাথা প্লাগ দিয়ে আটকে দিল বেল্টের তারের সঙ্গে। জানালা দিয়ে চত্বরে নাম, তারপর বাগানে চলে যাও, সহকারীকে নির্দেশ দিল গোয়েন্দাপ্রধান। কানের কাছে রেডিওটা তুলে ধরে রাখবে, যেন কিছু শোনার চেষ্টা করছ। পাশে, এই যে এই বোতামটা টিপে রাখবে। ঠোঁট যতটা সম্ভব না নেড়ে কথা। বলবে। শোনার দরকার হলে বোতামটা টিপে অন করে দেবে, ব্যস তাহলেই হবে।
কি এটা? জানতে চাইল মুসা।
ওয়াকি-টকি। বেল্টটা অ্যান্টেনা। সিটিজেন ব্যাণ্ডে খবর পাঠানো এবং ধরার রেঞ্জ আধ মাইল। আমাদের নিজেদের মাঝে যোগাযোগ রাখার একটা ব্যবস্থা। গত হপ্তায় আর্মির ফেলে দেয়া বাতিল কিছু জিনিস কিনে এনেছিল চাচা। তার ভেতর ছিল এরকম পাঁচটা জিনিস। তিনটে সারিয়ে নিয়েছি আমি।
আমি বাগানে যাচ্ছি, বলল মুসা। কি কথা বলব?
যা খুশি। জানালা গলে চত্বরে নাম, তারপর বাগান।
ঠিক হ্যায়, পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। ঝট করে চোখ তুলে তাকাল। গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে। রক্ত জমেছে মুখে। তাহলে এই তোমার মাইণ্ড রিডিং?
ওসব নিয়ে পরে আলাপ করব, হাসছে কিশোর। এখন প্রফেসরকে ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। কথা শুরু কর, বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে বড় একটা জানালার কাছে দাঁড়াল। মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল নিচে। দেয়ালের ধার ধরে চলে যাও। ওই যে, গেটপোস্টের ওপরে বড় পাথরের বলটা বসানো রয়েছে, ওদিকে।
যাচ্ছি! জানালা পেরিয়ে চত্বরে নামল মুসা। কানের কাছে তুলে রেখেছে রেডিও।
প্রফেসর, বলল কিশোর, মমিটা চুলে কোন অসুবিধা হবে?
না, মাথা নাড়লেন প্রফেসর। তবে বেশি নাড়াচড়া কোরো না।
মমির ওপর ঝুঁকল কিশোর। পরমুহূর্তেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। হাতে একটা। ওয়াকি-টকি, অন্যটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। হাতেরটা মুখের কাছে এনে বলল, হ্যাঁ, এবার কথা শুরু কর, মুসা। প্রফেসর, শুনবেন। রবিন, তুমিও শোন।
সবাই কান খাড়া রাখল। নীরবতা। তারপর একটা মৃদু বিড়বিড় শোনা গেল।
মমির ওপর ঝুঁকে দাঁড়ান, প্রফেসরকে বলল কিশোর। কানের কাছে ধরা রয়েছে তার ওয়াকি-টকি।
ভ্রুকুটি করলেন প্রফেসর। ঝুঁকলেন মমির ওপর। রবিনও ঝুঁকল। ফিসফিসে কথা শোনা যাচ্ছে কফিনের ভেতর থেকে। দুজনের কারোই বুঝতে অসুবিধে হল না, ওটা মুসার কণ্ঠস্বর।
গেট পেরিয়ে এসেছি, বলল মুসা! ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছি বড় ঝোঁপটার কাছে।
যেতে থাক, বলল কিশোর। ঘরের অন্য দুজনের দিকে ফিরল। দেখলেন তো, প্রফেসর, মমিকে কথা বলানো কত সহজ?
মমির ওপর ঝুঁকল কিশোর। আলগা লিনেনের নিচ থেকে বের করে আনল তৃতীয় ওয়াকি-টকিটা। ওটা থেকেই আসছে মুসার কণ্ঠস্বর। যেন মমিই কথা বলছে।
বৈজ্ঞানিক সমাধান, স্যার, প্রফেসরকে বলল কিশোর। মমির লিনেনে ছোট একটা রেডিও রিসিভার লুকিয়ে রাখা যায় সহজেই। বাইরে থেকে কেউ… থেমে গেল সে।
আরে! তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে মুসার কণ্ঠ। ঝোঁপের ভেতর কে জানি লুকিয়ে আছে!…একটা ছেলে! ও জানে না, আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি। ধরব ওকে।
দাঁড়াও! বলে উঠল কিশোর। আমরা আসছি। একা যেয়ো না।
তোমরা বেরোলেই হয়ত দেখে ফেলবে, শোনা গেল মুসার কণ্ঠ। আমিই যাচ্ছি। ওর পথ আটকে জানাব তোমাদের। সঙ্গে সঙ্গে ছুটবে।
ঠিক আছে, বলল কিশোর। ওকে ধরেই চেঁচিয়ে উঠবে। ছুটে আসব আমরা। প্রফেসরের দিকে ফিরল সে। ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে বসে আছে একজন। ওকে ধরতে পারলে হয়ত রহস্যটার সমাধান হয়ে যাবে।
নীরবতা।
এতক্ষণ কি করছে ও! অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল রবিন। কিছুই বলছে না মুসা! দেখাও যাচ্ছে না এখান থেকে!
আবার নীরবতা। অপেক্ষা করছে ওরা।
.
পা টিপে টিপে এগোচ্ছে মুসা। কানের কাছেই ধরা রয়েছে রেডিও। ঝোঁপের মধ্যে পেছন ফিরে বসে বাড়ির সামনের দিকে নজর রাখছে লোকটা। ঝোঁপের একেবারে কাছে চলে এল মুসা। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তারপর প্রায় ডাইভ দিয়ে ঢুকে গেল ঝোঁপের ভেতরে। ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছেলেটাকে নিয়ে পড়ল মাটিতে। উপুড় হয়ে হাত পা ছড়িয়ে পড়েছে ছেলেটা। তার ওপর মুসা। চেঁচিয়ে উঠল, জলদি এস! ওকে ধরেছি!
কথা বলে উঠল ছেলেটা। বিদেশী ভাষা। এক বর্ণ বুঝল না মুসা। ধস্তাধস্তি করছে ছেলেটী। তাকে জোর করে চেপে ধরে রেখেছে। হঠাৎ ছেলেটার হাতের আঘাতে মুসার হাত থেকে ছুটে পড়ে গেল রেডিও। ওটা তোলার চেষ্টা না করে দুহাতে ছেলেটাকে জাপটে ধরল মুসা। ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু করল দুজনে।
প্রায় মুসারই সমবয়েসী হবে ছেলেটা। লম্বা-চওড়ায় কিছুটা কম, তবে গায়ের জোর কম না। কায়দা-কৌশলও জানে মোটামুটি বান মাছের মত পিছলে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে মুসার আলিঙ্গন থেকে। একবার ছুটে বেরিয়ে গেল। কিন্তু খাড়া হওয়ার আগেই আবার তাকে ধরে ফেলল মুসা। ঢাল বেয়ে গড়িয়ে গিয়ে একটা পাথরের দেয়ালে ঠেকে গেল দুজনে। আবার কথা বলে উঠল ছেলেটা। কিছুই বুঝল না মুসা। বোঝার চেষ্টাও করল না। তার একমাত্র চিন্তা, ছেলেটাকে আটকে রাখতে হবে রবিন আর কিশোর না পৌঁছানো পর্যন্ত।
.
ওয়াকি-টকিতে মুসার চিৎকার শুনেই দরজার দিকে দৌড় দিল রবিন। তার পেছনে কিশোর ও প্রফেসর বেনজামিন।
সদর দরজায় বেরিয়েই দেখতে পেল, তাদের আগে ছুটছে আরেকজন লোক। নীল ওভারঅল পরা। ছুটতে ছুটতেই বেলচাটা ফেলে দিয়েছে হাত থেকে।
কে লোকটা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
প্রফেসর বললেন, মালী।
ঢাল বেয়ে নামতে নামতে দেখল ওরা, ছেলে দুটোর কাছে পৌঁছে গেছে মালী। মুসাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য ছেলেটার গলা চেপে ধরল। টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল, গলা ছাড়ল না।
উঠে দাঁড়াল মুসা। হাত-পায়ের ধুলো ঝাড়তে লাগল। মালীর দিকে চেয়ে বলল, শক্ত করে ধরুন। ওটা একটা বনবেড়াল!
দুর্বোধ্য ভাষায় আবার কিছু বলে উঠল ছেলেটা। গলায় মালীর হাত, গোঁ গোঁ করে এক ধরনের চাপা শব্দ বেরোল কথার সঙ্গে।
বিদেশী ভাষায় চেঁচিয়ে কিছু বলল মালী, ছেলেটার কথার জবাব দিচ্ছে। বোধহয়। মাঝপথেই আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েই ছুটল ছেলেটা। ঢাল বেয়ে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল আরেকটা ঝোপে। আর ধরা যাবে না ওকে। বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়েই রয়েছে মুসা।
ঠিক এই সময় পৌঁছে গেল রবিন, কিশোর আর প্রফেসর।
কি হল? মালীর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। তোমার হাত থেকে ছুটল কি করে ছেলেটা?
প্রফেসরের দিকে ফিরল মালী, হাতে কামড়ে দিয়েছে, স্যার! ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিল সে। কব্জির নিচে চামড়ায় দাঁতের দাগ, রক্ত বেরিয়ে এসেছে।
এত বড় দেহটা রেখেছ কেন!…একটা বাচ্চা ছেলেকে—
ও কামড়ে দেবে, বুঝতে পারিনি, স্যার।
হু! যাও, জলদি ওষুধ লাগাও। দাঁতে বিষাক্ত কিছু থাকতে পারে। ইনফেকশন হলে বুঝবে ঠেলা। জলদি যাও।
ঘুরে দাঁড়াল মালী। মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে।
লোকটা রিগো কোম্পানিতে কাজ করে, কিশোরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বললেন প্রফেসর। বাগানের কাজের চুক্তি নেয় কোম্পানিটা। খুব ভাল ভাল মালী আছে ওদের। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার অনেকেই নিয়মিত ডাকে।
এখনও হাঁফাচ্ছে মুসা। হায়-হায়রে! খামোকাই কষ্ট করলাম! ব্যাটা ছেড়ে দেবে জানলে আমিই ধরে রাখতাম!
কিন্তু ছেলেটা কে? জিজ্ঞেস করল রবিন। কি করছিল এখানে?
ঝোপে বসে প্রফেসরের বাড়ির দিকে চোখ রাখছিল, বলল মুসা। নড়েচড়ে উঠেছিল, তাই দেখে ফেলেছিলাম।
অনেক কিছু জানাতে পারত সে আমাদেরকে! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
ছেলেরা, বললেন প্রফেসর। ব্যাপার-স্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে..
তিন জোড়া চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।
..তবে, মুসার চিল্কারের পর পরই কয়েকটা শব্দ কানে এসেছে। বোধহয় ছেলেটাই বলেছে।
কিছুই বুঝিনি, বলল মুসা। বিদেশী ভাষা।
আধুনিক, আরবী, বললেন প্রফেসর। কি বলেছে জান? বলেছে: হে মহান রা-অরকন, দয়া করে সাহায্য করুন আমাকে!
কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলল কিশোর, থেমে গেল মুসার চিঙ্কারে, হুশিয়ার! হাত তুলে নির্দেশ করছে একটা দিক।
নিমেষে সবকটা চোখ ঘুরে গেল সেদিকে।
বড় গেটটার দুপাশে দুটো মোটা থাম, মাথায় বসানো দুটো এ্যানেটের বিশাল বল। কি করে জানি খসে পড়ে গেছে একটা। বিপজ্জনক গতিতে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে ওদের দিকে। গতি বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে।