বিদায় বেলায় – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
০১.
ঢাকা থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চে করে মুন্সীগঞ্জ যেতে হয়। তবে সরকারী ও বেসরকারী গাড়ি পারাপারের জন্য পঞ্চবটী রোডের দক্ষিণে ধলেশ্বর নদীতে মুক্তারপুর ফেরীঘাট আছে। নারায়ণগঞ্জের পূর্বকোল ঘেঁষে শীতলক্ষা নদী প্রবাহিত। আর দক্ষিণে ধলেশ্বর নদী। এই নদীর দক্ষিণ পাড়ে মুন্সীগঞ্জ। এটা একটা উপশহর। এখানে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কোর্ট-কাঁচারী, জেলা পরিষদ ও বিভিন্ন অফিস এবং হাসপাতাল আছে।
বর্ষাকাল। খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, নদী-নালা ও মাঠ-ঘাট পানিতে থৈ থৈ করছে। গ্রামের মেঠো পথগুলোয় একহাঁটু কাদা। মুন্সীগঞ্জের এদিকের রাস্তাগুলো এখনও পাকা হয়নি। তবে গ্রামের পাশ থেকে একটা বিশ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা মুন্সীগঞ্জ থেকে টঙ্গিবাড়ী হয়ে বালিগাঁও পর্যন্ত চলে গেছে। যারা শহরে চাকরি করে বা লেখাপড়া করে অথবা কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাতায়াত করে, তারা বর্ষার সময় বাড়ি থেকে জুতো হাতে করে এসে পাকা রাস্তার ধারে ডোবার পানিতে পা ধুয়ে জুতো পায়ে দিয়ে চলাচল করে। মুন্সীগঞ্জের তিন চার মাইল দক্ষিণে এমনি একটা গ্রাম আলদিবাজার। গ্রামটা বেশ বড়। চার পাঁচটা পাড়া নিয়ে এই গ্রাম। গ্রামের উত্তর পাড়ায় আব্দুস সাত্তারের বাড়ি। ওনি একজন আলেম। কুমিল্লার এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ওনাদের বংশে বেশ কয়েকজন আলেম ও কুরআনে হাফেজ আছেন। ওনারা দেশের বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। আব্দুস সাত্তারের এক ছেলে তিন মেয়ে। মেয়ে তিনটে ছোট। ছেলেটা বড়। নাম আব্দুস শামী। ডাক নাম শামী। আব্দুস সাত্তার ছেলেকে প্রথমে মক্তবে এবং পরে কওমী মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। শামী খুব মেধাবী ছাত্র। পাঞ্জাম পর্যন্ত খুব ভালভাবে পড়াশোনা করল। পাঞ্জামের ফাইন্যাল পরীক্ষার পর গ্রামের কিছু বাজে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিল।
তার মা মাসুমা বিবি একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, তুই মাদ্রাসায় যাচ্ছিস না কেন?
শামী বলল, আমার পড়তে ভালো লাগে না।
মাসুমা বিবি খুব অবাক হয়ে বললেন, কেন?
কেন আবার? বললাম তো পড়তে ভালো লাগে না।
তোর আব্বা শুনলে তোকে আস্ত রাখবে না। কাল থেকে মাদ্রাসায় যাবি।
না, আমি আর পড়ব না।
কি করবি তা হলে? সারাদিন গ্রামের আজেবাজে ছেলেদের সাথে বোম বোম করে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালো লাগে বুঝি? ঘরে আসুক তোর আব্বা, এলে মজা বুঝবি।
কিছু না বলে শামী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মাসুমা বিবি ছেলের স্পর্ধা দেখে যেমন খুব অবাক হলেন তেমনি রেগে গেলেন। ভেবে রাখলেন, খাবার সময় এলে যা করার করবেন। তারপর এক সময় একটা বাঁশের কঞ্চি জোগাড় করে রাখলেন।
শামী সেদিন সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে রাতে ঘরে ফিরল। সে আজ সমস্ত দিন কিছু খায়নি। তার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে। রাতে ঘরে এসে মাকে বলল, খেতে দাও।
শামী বাইরে চলে যেতে এবং সারাদিন বাইরে থাকায়, মাসুমা বিবি খুব রেগে ছিলেন। কিন্তু ছেলের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, সারাদিন কিছু খায়নি। তাই রাগটা চেপে রেখে ভাত বেড়ে খেতে দিয়ে বললেন, যাদের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়ালি তারা খেতে দেয়নি? নামায পড়েছিস, না তাও ছেড়ে দিয়েছিস?
শামী হাত ধুয়ে খেতে খেতে বলল, সমজিদ থেকে এশার নামায পড়েই তো এলাম।
মাসুমা বিবি আর কিছু বললেন না।
শামী খেয়ে উঠে ঘুমাতে গেল।
মাসুমা বিবি একটু পরে কঞ্চিটা নিয়ে রুমে এসে সপাং সপাং করে শামীকে মারতে মারতে বললেন, তুই পড়বি না কেন বল? না পড়লে তোকে আজ শেষ করে ফেলব।
শামী ভাবতেই পারেনি আম্মা তাকে মারবে। কারণ প্রথম সন্তান ও এক ছেলে বলে আম্মা তাকে ভীষন ভালবাসে। তাকে মারধর করা তো দূরের কথা, কোনো দিন চোখ পর্যন্ত রাঙ্গায়নি। বরং আব্বা কখনো কখনো কোনো কারণে বকাবকি করলে, আম্মা আব্বার উপর রাগ করে বলেছে, এতটুকু ছেলেকে তুমি এরকম করছে কেন? তারপর তাকে আদর করতে করতে আব্বার সামনে থেকে নিয়ে চলে গেছে। সেই আম্মাকে আজ কঞ্চি দিয়ে মারতে দেখে তার ভীষণ অভিমান হল। আম্মার চাবুকের আঘাত খেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে চোখের পানি ফেলতে লাগল, তবু চিৎকার করে কান্নাকাটি করল না।
মাসুমা বিবি একসময় ক্লান্ত হয়ে মার থামিয়ে বললেন, এখন কি হয়েছে? তোর আব্বা এসে কি করে দেখবি। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে এসে কঞ্চিটা ভেঙ্গে দুতিন টুকরো করে উঠোনের একদিকে ছুঁড়ে দিলেন।
তিনি যখন শামীকে মারতেছিলেন তখন ছোট মেয়ে তিনটেও সেখানে ছিল। তারা আম্মাকে কখনও এত রাগতে বা কাউকে মারতে দেখেনি। ভাইয়াকে মারতে দেখে তারা কান্না জুড়ে দিয়েছিল।
মাসুমা বিবি সেসব গ্রাহ্য না করে খাবার ঘরে এলেন। কিন্তু ভাত খেতে পারলেন। হড়ী-পাতিল ও থালা বাসন গুছিয়ে রেখে এক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমাতে গেলেন। তিনি ছেলেমেয়ের গায়ে কখনো হাত তুলেন নি। আজ রাগের মাথায় ছেলেকে মেরেছেন। এখন রাগ পড়ে যেতে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে লাগলেন। তবু ছেলেকে প্ৰবোধ দিতে গেলেন না। ভাবলেন, প্রবোধ দিতে গেলে ওর সাহস আরো বেড়ে যাবে। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি ঘুমাতে পারলেন না।
পরের দিন শামীকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সকালে তাকে দেখতে না পেয়ে মাসুমা বিবি ভাবলেন, রাগ করে হয়তো বন্ধুদের কাছে গেছে। দিনে না ফিরলেও রাতে ঠিক ফিরবে। কিন্তু অনেক রাত হয়ে যেতেও যখন ফিরল না তখন বেশ চিন্তিত হলেন। তারপর দু-তিন দিন হয়ে যেতেও যখন শামী ঘরে ফিরল না তখন তিনি সবকিছু লিখে স্বামীকে চিঠি দিলেন।
একই গ্রামের পশ্চিম পাড়ার রায়হান নামে একটা ছেলের সঙ্গে শামীর খুব বন্ধুত্ব। মাদ্রাসায় পাঞ্জাম পর্যন্ত একসাথে পড়েছে। তাদের বংশ খুব ভালো। ঐ বংশেও বেশ কয়েকজন আলেম ও হাফেজ আছে। রায়হানও ভালো ছাত্র। রেজাল্ট বেরোবার পর শামী যখন মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিল তখন একদিন রায়হান তার সঙ্গে দেখা করে বলল, কিরে, তুই আর মাদ্রাসায় যাসনি কেন?
শামী বলল, আমি আর পড়ব না।
রায়হান জানতে পেরেছিল, সে গ্রামের আজে বাজে ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে। তাই বলল, তুই আমার চেয়ে ভালো ছাত্র। এসব বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে পড়াশোনা ছেড়ে দিলি, এটা কি ঠিক হল? তোর আব্বা-আম্মা কিছু বলেন না?
শামী বলল, তারা আবার কি বলবে, আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না।
কি করবি তা হলে?
তা এখনও ভাবিনি।
আমার কি মনে হয় জানিস, তুই ঐসব খারাপ ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে এরকম হয়ে গেছিস। আমি বলি কি ওদের সাথে আর মেলামেশা না করে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে যা।
ঠিক আছে, এখন তুই যা। তোর কথা ভেবে দেখব।
সেদিন রায়হান আর কিছু না বলে ফিরে এলেও শামীর কথা ভুলতে পারল না। অনেক দিনের বন্ধুত্ব, সহজে কি ভুলা যায়? তাই মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা করে গল্প গুজব করার সময় মাদ্রাসায় ভর্তি হবার তাগিদ দেয়। কয়েকদিন তাকে দেখতে না পেয়ে একদিন রায়হান শামীদের বাড়িতে এসে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, চাচি আম্মা, শামী কোথায়?
মাসুমা বিবি রায়হানকে চেনেন। অনেকবার শামীর সঙ্গে এসেছে। বললেন, সে তো কয়েকদিন থেকে বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে বলেও যায়নি।
রায়হান আবার জিজ্ঞেস করল, ও আর মাদ্রাসায় যায়নি কেন? জিজ্ঞেস করতে বলল, সে আর পড়বে না। আপনারা ওকে কিছু বলেন নি?
মাসুমা বিবি বললেন, আমি জিজ্ঞেস করতে আমাকেও তাই বলেছে। সেই জন্যে একদিন মেরেছিলাম। তারপরের দিন থেকে না বলে কোথায় চলে গেছে। তুমি একটু খোঁজ করে দেখোত বাবা। দেখা হলে তাকে পড়াশোনা করার জন্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়িতে আসতে বলল।
রায়হান বলল, আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি। ও বলে আমার পড়তে ভালো লাগে না। ঠিক আছে, খোঁজ করে দেখব। দেখা হলে আবার বোঝাব। তারপর সালাম জানিয়ে ফিরে এল।
স্ত্রীর চিঠি পেয়ে আব্দুস সাত্তার বাড়িতে এসে সবকিছু শুনে বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন, তুমি যখন মারতে সে বাড়ি ছাড়া তখন আমি মারলেও কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। আমি বাড়িতে এসেছি শুনলে ভয়ে আর এদিকে পা মাড়াবে না। আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করে দেখ, নিশ্চয় ফিরে আসবে। আমি কাল চলে যাব। যাওয়ার পর বড় ভাইয়ের ছেলে মান্নানকে একবার মোল্লাকান্দিতে ওর নানার বাড়িতে খোঁজ নিতে পাঠাবে। যদি সেখানে থাকে, তা হলে তাকে যেন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসে। আমিও মান্নানকে বলে যাব। তাকে আর মারধর করো না। কয়েকদিন পরে আমি এসে যা করার করব। মাদ্রাসা কমিটির মিটিং চলছে। একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। কালকেই আমাকে যেতে হবে।
পরের দিন সকালে আব্দুস সাত্তার চলে যাওয়ার পর মাসুমা বিবি ভাসুরপো মান্নানকে বাবার বাড়িতে পাঠালেন।
মান্নান শামীর চেয়ে অনেক বড়। কলেজে পড়ে। মোল্লাকান্দি গিয়ে শামীকে নিয়ে এল।
মাসুমা বিবি ছেলেকে কিছু বললেন না। বরং আদর করে খেতে দিয়ে বললেন, আমি তোর আম্মা না? আম্মা মেরেছি বলে রাগ করে চলে গেলি। আমার চিন্তা হয়নি বুঝি? তোর আব্বা এসেছিল। তুই পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিস শুনে খুব দুঃখ পেয়েছে। তোকে মাদ্রাসায় ভর্তি হতে বলেছে।
শামী কিছু না বলে চুপ করে খেতে লাগল।
মাসুমা বিবি তখন আর কিছু বললেন না।
দিন দশেক পর আব্দুস সাত্তার বাড়িতে এলেন। রাতে শামীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই পড়াশোনা করতে চাচ্ছিস না কেন?
শামী ভয়ে কোনো কথা বলতে পারল না, চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আব্দুস সাত্তার হুংকার ছেড়ে বললেন, কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
শামী আরো বেশি ভয় পেয়ে কাঁপতে লাগল।
আব্দুস সাত্তার তার অবস্থা দেখে রাগ সংযত করে বললেন, কালকেই তোকে আমি ভর্তি করে দেব। মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।
পরের দিন আব্দুস সাত্তার শামীকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। তারপর চার-পাঁচ দিন বাড়িতে থেকে তিনি কর্মস্থলে ফিরে গেলেন।
যে কয়দিন আব্বা ছিল সেই কয়দিন শামী মাদ্রাসায় গেল এবং পড়াশোনাও করল। ওনি চলে যাওয়ার পর সবকিছু বন্ধ করে দিল।
মাসুমা বিবি ছেলেকে প্রথমে অনেক বোঝালেন। তাতে কাজ না হতে ভীষণ রাগারাগি করলেন। কিন্তু শামীর কোনো পরিবর্তন হল না। সে আগের মতো সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বেড়াতে লাগল। আব্বা বাড়িতে এলে শামী নানার বাড়ি, খালার বাড়ি নয়তো ফুফুর বাড়ি চলে যায়। ওনি চলে যাওয়ার পর আবার বাড়িতে আসে। এভাবে প্রায় দুবছর পার হতে চলল।
একদিন শামী বন্ধুদের সাথে রাস্তায় আড্ডা দিচ্ছিল। এমন সময় তিনটে মেয়েকে স্কুলে যেতে দেখে জামালকে জিজ্ঞেস করল, সবার আগে আগে যে মেয়েটা যাচ্ছে। তাকে চিনিস?
জামালের বাড়ি এই গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায়। সে মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ওতো আমাদের পাড়ার আবসার উদ্দিন চাচার মেয়ে ফাহমিদা।
শামীদের বাড়ি উত্তর পাড়ায়। তাই সে ফাহমিদাকে দেখলেও কম দেখেছে। এখন তার নাদুস-নুদুস চেহারা ও রূপ দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। বলল, তাইতো চেনা চেনা মনে হচ্ছে। অনেক দিন দেখিনি বলে ঠিক চিনতে পারিনি। শামী ফাহমিদাকে যতদূর দেখা গেল তার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে তার কিশোর মনে কি এক রকমের যেন অনুভূতি জন্মাল। এরপর থেকে সে ফাহমিদাকে স্কুলে যাতায়াতের সময় একাকি আড়াল থেকে দেখতে লাগল। প্রতিদিন তাকে দেখা যেন তার নেশা হয়ে দাঁড়াল। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো দিন তার মুখোমুখি হতে সাহস করল না। এভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর তার মনের পরিবর্তন হল। চিন্তা করল, গ্রামে। আরো কত মেয়ে আছে, কই, তাদেরকে তো দেখতে ইচ্ছা করে না? ওকে দেখার জন্য মন এত উতলা হয় কেন? যদি কোনো দিন ফাহমিদা স্কুলে না যায়,, সেদিন মন খুব খারাপ হয়ে থাকে কেন? হঠাৎ তার মন বলে উঠল, ফাহমিদা বড় লোকের মেয়ে। তোমরা তাদের তুলনায় কিছুই না। তা ছাড়া সে লেখাপড়া করছে, আর তুমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আজে বাজে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছ। ফাহমিদাকে যদি তোমার ভালো লাগে, তাকে যদি আপন করে পেতে চাও, তা হলে তুমি ভালোভাবে লেখাপড়া করে তাকে টেক্কা দাও। ভালো ছাত্রকে সকলে ভালবাসে। ভালো ছাত্র হতে পারলে, শুধু ফাহমিদা কেন, তারমতো সব মেয়েরা তোমাকে ভালবাসবে। এই সব চিন্ত 1 করে সে সিদ্ধান্ত নিল, মাদ্রাসায় না পড়ে স্কুলে পড়বে। একদিন শামী তার মাকে বলল, এবারে আব্বা এলে তাকে বলল, আমি মাদ্রাসায় পড়ব না, স্কুলে পড়ব। আর স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় তো এখনো তিন চার মাস বাকি, তাই এই কমাস প্রাইভেট মাস্টারের কাছে অংক ও ইংরেজী শিখব।
মাসুবা বিবি ছেলের কথা শুনে খুশী হলেন। বললেন, ঠিক আছে, আজই আমি সে। কথা লিখে তোর আব্বাকে চিঠি দিচ্ছি।
স্ত্রীর চিঠি পেয়ে আব্দুস সাত্তার এক বৃহস্পতিবারে বাড়ি এলেন। এক সময়ে স্ত্রীকে বললেন, আমার খুব ইচ্ছা ছিল, ওকে একজন বড় আলেম করার। ভেবেছিলাম, ওকে আমার কাছে রেখে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেব। কিন্তু ও যখন মাদ্রাসায় না পড়ে স্কুলে পড়তে চাচ্ছে তখন আর কি করা যাবে। আজকাল ছেলেদেরকে শাসন করলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ঠিক আছে, ও স্কুলেই পড়ুক।
প্রত্যেকবারে আব্বা বাড়িতে এলে শামী যে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি পালিয়ে যায়। এবারে গেল না। সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় মাকে বলল, তুমি আব্বাকে আমার কথা বলেছিলে?
আব্দুস সাত্তার বাড়িতে ছিলেন না। শামী যখন নাস্তা খেতে খেতে মাকে ঐ কথা বলল ঠিক তখনই এলেন। শামীকে নাস্তা খেতে দেখে বললেন, নাস্তা খেয়ে আমার কাছে আসবি, কথা আছে। তারপর তিনি ঘরের ভিতরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন।
মাসুমা বিবি স্বামীকে নাস্তা খেতে দিলেন।
শামী নাস্তা খেয়ে ঘরে ঢুকে এক পাশে দাঁড়াল।
আব্দুস সাত্তার খেতে খেতে বললেন, তোর আম্মা বলছিল, তুই নাকি তিন চার মাস প্রাইভেট পড়ে স্কুলে ভর্তি হতে চাচ্ছিস?
শামী মাথা নিচু করে বলল, জি।
আব্দুস সাত্তার বললেন, পড়তে চাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু আবার যদি পাগলামি করিস, তা হলে একদম জানে শেষ করে দেব।
শামী কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
মাসুমা বিবি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই কোন মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়বি বলছিলি, তার কাছে গিয়ে বেতন ঠিক করে পড়াশোনা শুরু কর।
শামী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রামপালের দিকে রওয়ানা দিল।
আলদিবাজার থেকে প্রায় দু-আড়াই মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে রামপাল। সেখানে বালক ও বালিকাদের আলাদা হাই স্কুল আছে। শামী স্কুলে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর একদিন রামপালে গিয়ে স্কুলের ফণিভূষণ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে রেখেছিল। আজ তার কাছে বেতন ঠিক করে এল।
পরের দিন থেকে শামী ওনার কাছে পড়তে লাগল। আর ঘরেও রীতিমত পড়তে লাগল। তারপর জানুয়ারি মাসে রামপাল বয়েজ হাই স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি হল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরও সে ফণিভূষণ স্যারের কাছে ছুটির পর প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরে।
শামী আগেই জেনেছিল, ফাহমিদা রামপাল গার্লস হাই স্কুলে পড়ে। স্কুলে যাতায়াতের পথে মাঝে মধ্যে তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। তবে পাশ থেকে যাওয়ার সময় দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখে। কয়েকবার চোখে চোখও পড়েছে। তাতেই একে অপরের মনের ভাব একটু বুঝতে পারে। ফাহমিদার সঙ্গে সব সময় রাহেলা ও জোবেদা থাকে। তাই শামীর ফাহমিদার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারে না। রাহেলা ও জোবেদা এই গ্রামেরই মেয়ে। রাহেলাদের বাড়ি পূর্ব পাড়ায় আর জোবেদাদের বাড়ি ফাহমিদাদের পাড়ায়। তারাও ক্লাস এইটে পড়ে।
হাফইয়ার্লি পরীক্ষায় শামী স্ট্যাণ্ড করতে না পারলেও ফোর্থ হল। কিন্তু ফাইন্যাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে ক্লাস নাইনে উঠল।
ফাহমিদা নিচের ক্লাস থেকে প্রতি বছর ফার্স্ট হয়। এবছরও তার ব্যতিক্রম হল না। সেই জন্যে তাকে নিয়ে কেউ সমালোচনা করল না। কিন্তু শামী মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। তা ছাড়া দুবছর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল। সে ফার্স্ট হয়ে ক্লাসে উঠতে গ্রামের লোকেরা তার সমালোচনা করে বলল, ছেলেটা ভবিষ্যতে খুব উন্নতি করবে।
বর্ষার সময় একদিন স্কুল ছুটি হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। ছুটির পরও থামার কোনো লক্ষণ নেই। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলেই অপেক্ষা করতে লাগল। যখন ঝড় বৃষ্টি একটু কমল তখন তারা ভিজে ভিজে যে যার বাড়ির পথে রওয়ানা দিল। ফাহমিদাও ভিজে ভিজে যেতে লাগল।
শামী ছুটির পর প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। তার কাছে ছাতা ছিল। কিছু দূর আসার পর দূর থেকে একটা মেয়েকে ভিজে ভিজে যেতে দেখে পা চালিয়ে এগিয়ে এসে বুঝতে পারল, মেয়েটি ফাহমিদা। আরো দ্রুত পা চালিয়ে একদম কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আপনি আমার ছাতাটা নিন।
ফাহমিদা সালামের উত্তর না দিয়ে শামীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমি তো ভিজেই গেছি। আমাকে ছাতা দিলে আপনিও ভিজে যাবেন।
শামী বলল, আমাদের বাড়ি কাছেই। এইটুকু পথ ভিজলে কিছু হবে না। আপনাকে অনেকটা পথ যেতে হবে। ঠাণ্ডা লেগে অসুখ বিসুখ হতে পারে। নিন ধরুন।
ফাহমিদা বলল, তারচেয়ে দুজনেই এক ছাতাতে যাই চলুন।
শামী আর কোনো কথা না বলে দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বলল, আপনার নামটা বলবেন?
ফাহমিদা। আপনার?
শামী।
আপনি তো মাদ্রাসায় পড়তেন, স্কুলে পড়তে অসুবিধে হচ্ছে না? শুনেছি আপনি ফার্স্ট হয়ে নাইনে উঠেছেন।
ঠিকই শুনেছেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস আগে ফণিভূষণ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে কিছুটা কভার করে ছিলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। আপনিও তো মেয়েদের স্কুলে ফার্স্ট হয়ে নাইনে উঠেছেন।
আমি তো প্রত্যেক বছরই ফাস্ট হয়ে ক্লাসে উঠি।
আসলে তারা একে অপরকে চিনে। এমন কি উভয়ে উভয়ের ফ্যামিলীর সবকিছু। জানে। তবু তারা মনের আবেগে একে অপরের কাছে নতুন করে পরিচিত হল।
কিছুক্ষণ পর শামী বলল, এবার আপনি ছাতাটি নিয়ে যান, আমাদের বাড়ির কাছে। এসে গেছি। তারপর নিজেই তার হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিল।
ফাহমিদা বলল, কিন্তু ফেরৎ দেব কি করে?
শামী বলল, আপনাদের চাকরের হাতে পাঠিয়ে দেবেন।
ফাহমিদার তখন খুব শীত করছে। সে আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। এতক্ষণ শামীর পাশাপাশি হেঁটে আসতে তার খুব ভালো লাগছিল। তখন শীত লাগলেও পাশাপাশি হাঁটার আনন্দে তা অনুভব করতে পারেনি। এক হাতে বই খাতা বুকে চেপে ধরে অন্য হাতে ছাতা ধরে হাঁটতে লাগল। বাড়িতে এসে তাদের চাকরের হাতে ছাতাটা শামীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।
.
০২.
ফাহমিদার বাবা আবসার উদ্দিন বেশ পয়সাওয়ালা লোক। জমি জায়গা অনেক। বাড়ি ঘর সব পাকা। গ্রামে প্রতিপত্তিও আছে। ওনার তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে কানাডায়। মেজ ছেলে লণ্ডনে। ছোট ছেলে হলে থেকে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছে। সবার ছোট ফাহমিদা। তাদের ফ্যামিলীর সবাই শিক্ষিত ও মডার্ণ। ফাহমিদা এক মেয়ে, তার উপর সবার ছোট। তাই সে খুব আদরে মানুষ হচ্ছে।
সেদিন বাড়িতে এসে ফাহমিদা শামীর কথা ভাবতে লাগল। সেও শুনেছিল, শামী মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে গ্রামের খারাপ ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। তখন তার সাথে পরিচয় না থাকলেও সে কথা শুনে ভেবেছিল, অমন আলেম লোকের ছেলে হয়ে খারাপ হয়ে গেল। তার এরকম ভাবার কারণ ছিল। ভালো ছেলে হিসেবে গ্রামে শামীর বেশ সুনাম ছিল। তারপর যে দিন রাহেলা ও জোবেদার সাথে স্কুলে যাওয়ার সময় শামী জামালকে তার কথা জিজ্ঞেস করে, সেদিন ফাহমিদা সেকথা শুনতে পেয়ে তার উপর খুব রেগে গিয়েছিল। পরে যখন শামী আড়াল থেকে তাকে দেখত তখন ফাহমিদা মনে মনে একটু আফশোষ করত এই কথা ভেবে যে, অত ভালো ছেলে হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিল। কিছুদিন পর তার চাচাতো ভাই হেমায়েতের মুখে শামী আবার স্কুলে পড়ছে শুনে মনে চমক খেয়েছিল। আজ এতটা পথ একসঙ্গে এসে এবং তার সঙ্গে কথা বলে ফাহমিদার তরুণী মনে কেমন যেন আনন্দ অনুভব হতে লাগল।
এরপর থেকে স্কুলে যাতায়াতের সময় তারা দেখা হলে সালাম বিনিময় করে। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে, একে অন্যের পড়াশোনার খবর নেয়। নোট অদল বদল। করে। যেদিন তার বান্ধবীরা সঙ্গে থাকে সেদিন কেউ কারো সাথে কথা বলে না। তবে চোরা চোখে দুজন দুজনকে দেখে।
ব্যাপারটা কিছু দিনের মধ্যে রাহেলা ও জোবেদা বুঝতে পারল। একদিন শামী পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর রাহেলা ফাহমিদাকে বলল, কি ব্যাপার বলতো, শামী যেমন তোকে চোরা চোখে দেখে, তুইও তেমনি শামীকে চোরা চোখে দেখিস?
সাথে সাথে জোবেদা বলে উঠল, আমিও এর আগে কয়েকবার লক্ষ্য করেছি। মনে হচ্ছে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়।
এই কথায় তিন জনেই হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে ফাহমিদা বলল, তোদের কি মনে হয়?
রাহেলা বলল, কি আর মনে হবে? তবে তোদের দুজনের মধ্যে যে কিছু একটার শিকড় গজাচ্ছে, তা হলফ করে বলতে পারি।
ফাহমিদা বলল, কিসের শিকড়? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
জোবেদা বলল, অত আর ন্যাকামো করিস নি। ভাজা মাছ যেন উল্টে খেতে জানে না? রাহেলা বলতে না পারলেও আমি বলছি; তোদের মধ্যে ভালবাসার শিকড় গজাচ্ছে।
ফাহমিদা শুনে মনে মনে খুশী হলেও রাগ দেখিয়ে বলল, এবার আমি যদি বলি, তোরাই তাকে ভালবাসিস? ঐ যে কথায় বলে, চোরের মন বোঁচকার দিকে।
রাহেলা বলল, আমরাতো শামীর দিকে চোরা চোখে তাকাই নি। আর সেও আমাদের দিকে তাকায় নি। তুই স্বীকার না করলেও আমাদের অনুমান সত্য।
ফাহমিদা কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ রইল।
জোবেদা বলল, কিরে চুপ করে আছিস কেন? মনে হচ্ছে জোকের মুখে নুন পড়েছে।
ফাহমিদা রেগে উঠে বলল, যে মূলো খায়, তার ঢেকুর থেকে মূলোরই গন্ধ বেরোয়।
জোবেদা বলল, তা ঠিক কথা। তবে তুই যাই বলিস না কেন, রাহেলা যা বলল, তা সত্য সত্য সত্য।
ফাহমিদা রেগে ছিল। জোবেদাকে তিন সত্য খেতে দেখে রাগের সঙ্গেই বলল, তোদেরকে আর ওকালতি করতে হবে না। এবার বকবকানি থামা। কান ঝালাপালা হয়ে গেল। তোদের কাছে হার মানছি।
রাহেলা বলল, ধরা যখন পড়েই গেলি তখন আর আমাদের কাছে কোনো কিছু গোপন করবি না। কিরে চিঠিপত্র দেয়া নেয়া হয়েছে নাকি? আমরা কথা দিচ্ছি, তোদের সবকিছু গোপন রাখব। দরকার হলে তোদেরকে সাহায্য করব।
ফাহমিদা হেসে ফেলে বলল, তোরা কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস। ঐ যে লোকে বলে, যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়া পড়শীর ঘুম নেই। তোদের হয়েছে সেই দশা। তোদের অনুমান কতটা সত্য জানি না। তবে এখনও চিঠি দেয়া নেয়া হয় নি।
জোবেদা বলল, সত্যি বলছিস?
ফাহমিদা বলল, সত্যি সত্যি সত্যি। হল তো?
জোবেদা বলল, আজ রাতেই একটা চিঠি লিখবি। তুই নিজে দিতে না পারলে আমি দেব।
রাহেলা বলল, জোবেদা ঠিক কথা বলেছে। চিঠি লিখে কাল স্কুলে নিয়ে আসবি। আমরাও পড়ব। আমাদের আবার যদি কোনো দিন কাউকে চিঠি দিতে হয়, তাই আগে থেকে শিখে রাখব। কিরে দেখাবি তো?
ফাহমিদা মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলল, আমি যেন কত প্রেম পত্র লিখেছি।
রাহেলা বলল, লিখিস নি তো কি হয়েছে? কেউ কি মায়ের পেট থেকে সব কিছু শিখে আসে? প্রয়োজনে সবাইকে সবকিছু শিখে নিতে হয়।
ফাহমিদা বলল, সে যদি আমার চিঠির উত্তর না দেয়? অথবা আমাকে বেহায়া মেয়ে ভেবে যা তা লিখে উত্তর দেয়, তখন কি হবে? অপমান তো আমি হব; তোরা তো হবি না।
জোবেদা বলল, শিকারী বিড়ালের গোঁফ দেখলে চেনা যায়। শামীর সঙ্গে এতবার দেখা হয়, কিন্তু একবারও আমার মুখের দিকে তাকায় না। অথচ তোর দিকে তাকায়।
জোবেদাকে থামিয়ে দিয়ে রাহেলা বলল, তোর কথা কারেক্ট। গ্রামের ছেলে সবারই সাথে প্রায় দেখা হবে। আমারও সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে একবারও কথা বলে নি। সামনা সামনি হলে মাথানিচু করে চলে যায়। আমিও বলছি, তুই চিঠি দিয়ে দেখ, আমাদের কথা সত্য না মিথ্যা।
তাদের কথা শুনে ফাহমিদা মনে মনে গর্ব অনুভব করল। সেই সঙ্গে আনন্দও কম হল না। তবু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ঠিক আছে, তোরা যখন এত করে বলছিস তখন একটা চিঠি না হয় দেব। কিন্তু যদি উল্টো এ্যাকশন হয়, তা হলে তোদেরকে আস্ত রাখব না।
রাহেলা বলল, তা না হয় না রাখলি। আর যদি তার বিপরীত হয়, তা হলে মিষ্টি খাওয়াবি বল?
ফাহমিদা বলল, খাওয়াব।
ততক্ষণে ওরা বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। সালাম বিনিময় করে যে যার বাড়ির দিকে চলে গেল।
সেদিন সন্ধ্যের পর ফাহমিদা কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারল না। শুধু রাহেলা ও জোবেদার কথা মনে পড়তে লাগল। শেষে কাগজ কলম নিয়ে শামীকে চিঠি লিখতে বসল। কিন্তু কিভাবে শুরু করবে এবং কি লিখবে ঠিক করতে না পেরে কাগজের উপর কলম ধরে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগল। সে বড় ও মেজ ভাইকে মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ে নিজের জন্য এটা সেটা পাঠাতে বলে। তাদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে চিঠি লিখেনি। এখন ভালবাসার পাত্রকে কিভাবে মনের কথা লিখবে ভেবে পেল না। অনেকক্ষণ চিন্তা করে লিখতে শুরু করল।
শামী ভাই,
প্রথমে আমার সালাম নেবেন। পরে জানাই যে, কিশোর বয়সে আব্বা-আম্মার মুখে আপনার সুনাম শুনতাম। একটু বড় হওয়ার পর আপনাকে দেখতে ইচ্ছা হত। তাই সাথীদের নিয়ে আপনাদের পাড়াতে মাঝে মাঝে ঘুরতে যেতাম। কখনো দেখতে পেতাম আবার কখনো পেতাম না। তারপর যখন শুনলাম, আপনি মাদ্রাসার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আজে বাজে ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান তখন মনে একটু দুঃখ পেয়েছিলাম। পরে আবার যখন শুনলাম, স্কুলে ভর্তি হয়েছেন তখন খুশী হলাম। কেন যে ঐরকম হত তখন বুঝতে পারতাম না। গত বছর বর্ষার সময় যেদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, সেই দিন হঠাৎ আপনি এসে আমাকে ছাতা দিতে চাইলে আমি আগের থেকে অনেক বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম। তাই সবকিছু জেনেও আপনাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করি। তারপর থেকে আপনি সব সময় আমার চোখে ও মনে ভেসে বেড়াচ্ছেন। স্বপ্নেও আপনাকে সব সময় দেখি। আপনাকে বাস্তবে বার বার দেখতে ইচ্ছা করে। মাঝে মধ্যে স্কুলের পথে হঠাৎ এক আধদিন অল্প সময়ের জন্য একাকি দেখা হলে কথা বলি। কিন্তু তাতে আমার মনের আশা মিটে না। ইচ্ছে করে সারাদিনরাত আপনার পাশে বসে গল্প করি। সে আশা কবে পূরণ হবে জানি না। যেদিন বান্ধবীরা আমার সঙ্গে থাকে সেদিন আপনাকে পাশ কেটে যেতে দেখে চোরা চাহনিতে দেখি। এর কারণ কি বলতে পারেন? আমার তো মনে হচ্ছে, আমি আপনাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবেসে ফেলেছি। মেয়ে হয়েও মনের তাগিদে নির্লজ্জের মতো বলে ফেললাম। আমার বিশ্বাস, আপনিও আমাকে ভালবাসেন। সেই বিশ্বাসের উপর। আস্থা রেখে এই পত্র লিখলাম। যদি এটা আমার অন্যায় হয়, তবে ক্ষমা করে দেবেন। আর ব্যাপারটা দয়া করে কাউকে জানাবেন না। নচেৎ আমি কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না। তখন আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোনো পথ থাকবে না। কোনো দিন কাউকে চিঠি লিখিনি। কেমন করে লিখতে হয় তাও জানিনি। ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করে দেবেন। আর একবার আপনাকে সালাম জানিয়ে শেষ করছি।
ইতি
ফাহমিদা
[বিঃ দ্রঃ উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
পরের দিন তিন বান্ধবী স্কুলে যাওয়ার পথে জোবেদা ফাহমিদাকে জিজ্ঞেস করল, কিরে, চিঠি লিখেছিস?
ফাহমিদা অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ, লিখেছি।
জোবেদা বলল, কই, জলদি বের কর।
ফাহমিদা একটা বইয়ের ভিতর থেকে মুখ খোলা রঙ্গিন খাম বের করল।
জোবেদার আগে রাহেলা ছোঁ মেরে তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল, আমি পড়ছি। সে জোরে জোরে চিঠিটা পড়ে ভাজ করে খামের ভিতর পুরে ফাহমিদার হাতে ফেরৎ দেওয়ার সময় বলল, কি, আমাদের কথা ঠিক হল? অনেক দিন থেকে তা হলে ডুবে ডুবে পানি খাওয়া হচ্ছে? আমরা বাজীতে জিতবই।
ফাহমিদা বলল, বাজী তো আমাকে নিয়ে হয়নি, শামীকে নিয়ে হয়েছে। চিঠির উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত বাজীর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। আর এতে ডুবে ডুবে পানি খাওয়ার কি হল? একজনের দ্বারা তো তা সম্ভব নয়।
জোবেদা বলল, আজ চিঠিটা দে। কাল নিশ্চয় ফলাফল পাওয়া যাবে। তখন বোঝা যাবে, ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছ কিনা। কিরে, চিঠিটা তুই দিবি? না আমরা কেউ দেব?
ফাহমিদা বলার আগে রাহেলা বলে উঠল, আমরা কেউ দিতে যাব কেন? যারটা তারই দেয়া ভালো।
ফাহমিদা চুপ করে রইল।
জোবেদা বলল, তুই ঠিক কথা বলেছিস। তারপর তারা যুক্তি করে ঠিক করল, ছুটির পর শামীর জন্য সবাই মিলে রাস্তায় অপেক্ষা করবে। তাকে আসতে দেখলে রাহেলা ও জোবেদা লুকিয়ে পড়বে। ফাহমিদা চিঠি দেয়ার পর তারা তাদের কাছে আসবে।
সেদিন ছুটির পরে ফেরার পথে রাস্তার ধারে পালেদের বড় পুকুরের পাড়ে বসে তারা অপেক্ষা করতে লাগল।
শামী ছুটির পর প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। পালেদের পুকুরের কাছে এসে ফাহমিদাকে একাকি একটা পেয়ারা গাছতলায় বসে থাকতে দেখে সালাম দিয়ে আতংকিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? এখানে বসে আছেন কেন?
ফাহমিদা সালামের উত্তর দিয়ে হাসিমুখে বলল, না, শরীর খারাপ লাগছে না। আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আসুন কিছুক্ষণ আলাপ করি।
শামী তার কথা শুনে আনন্দিত হয়ে ফাহমিদার পাশে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফাহমিদাও শামীর মুখের দিতে তাকিয়ে রইল। কতক্ষণ যে তারা ঐভাবে ছিল তা জানতে পারল না। এক সময় ফাহমিদা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, এতক্ষণ ধরে কি। দেখছেন?
শামী বাস্তবে ছিল না, ফাহমিদার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, আপনাকে।
ফাহমিদা লজ্জারাঙ্গা হয়ে বলল, আগেও তো দেখেছেন?
এত কাছ থেকে এভাবে কোনো দিন দেখিনি। এবার বলুন, অপেক্ষা করছিলেন কেন?
আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি তো আপনার চেয়ে ছোট। তা ছাড়া আমরা তো একই গ্রামের ছেলেমেয়ে।
তাই যদি বলেন, তা হলে আপনিও কেন আমাকে আপনি করে বলছেন?
আপনি আমার থেকে বড়। বড়কে আপনি করে বলাই তো উচিত।
তা অবশ্য উচিত। তবে সবক্ষেত্রে নয়। এবার থেকে আমরা কেউ কাউকে আপনি করে আর বলব না, কেমন?
ফাহমিদা মাথা নিচু করে বলল, তাই হবে।
শামী বলল, কেন অপেক্ষা করছিলে বলবে না?
ফাহমিদা চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল, এই জন্যে।
শামী চিঠি নেয়ার সময় তার হাত ধরে রেখে বলল, এটাতে কি আছে জানি না। তবু বলছি, এটার জন্য বহুদিন থেকে অপেক্ষা করছিলাম। আল্লাহপাক সেই আশা আজ পূরণ করলেন। সেজন্যে তাঁর পাকদরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া। শামী ফাহমিদার হাত ধরে রাখতে সে কাঁপছে বুঝতে পেরে শামী তার হাত ছেড়ে দিল।
শামীকে আসতে দেখে রাহেলা ও জোবেদা অনতিদূরে একটা বড় আমগাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। তারা এতক্ষণ তাদের ক্রিয়াকলাপ দেখছিল ও শুনছিল। এবার তারা এগিয়ে এসে একসঙ্গে শামীকে সালাম দিল।
শামী একটু ঘাবড়ে গিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে আমতা আমতা করে বলল, তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
রাহেলা হাত বাড়িয়ে আম গাছটা দেখিয়ে বলল, ওটার আড়ালে।
জোবেদা বলল, শামী ভাই, আমরা কিন্তু আপনাদের সব কথা শুনেছি। কিছু মাইণ্ড করেন নি তো?
তাদের কথা শুনে শামীর ভয় কেটে গেল। বুঝতে পারল, ফাহমিদা যে আমাকে চিঠি দেবে তা তারা জানে। বলল, মাইণ্ড করার কি আছে। চল, এবার এক সঙ্গে যাওয়া যাক।
জোবেদা বলল, আপনি যান, আমরা একটু পরে আসছি।
ঠিক আছে তাই এস বলে শামী তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
শামী চলে যাওয়ার পর রাহেলা ফাহমিদাকে বলল, কিরে শামী ভাইকে কেমন বুঝলি? তোদের কথাবার্তা শুনে তো মনে হল দুজনেই ফেঁসে গেছিস?
ফাহমিদা লজ্জা পেয়ে বলল, হয়তো তোদের কথা ঠিক। তবে চিঠির উত্তর পেলে সিওর হওয়া যাবে। এখন চল বাড়ি যাই।
শামী বাড়িতে এসে বই খাতা রেখে ফাহমিদার চিঠিটা পড়ে উত্তর লিখতে বসল।
প্রিয়তমা,
প্রথমে আমার আন্তরিক ভালবাসা নিয়ে আমাকে ধন্য করো। পরে জানাই যে, পত্র পড়ে আমি যে কত আনন্দিত হয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। চাতক পাখিরা তৃষ্ণার্ত হয়ে এক ফোঁটা বৃষ্টির আশায় যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি আমিও অনেক দিন থেকে তোমার চিঠির আশায় অপেক্ষা করছিলাম। মরুদ্যানে পথিকরা বিশ্রাম নেয়ার সময় বৃষ্টি হলে তারা যেমন তৃপ্ত হয়, তোমার চিঠি পেয়ে আমিও সেইরূপ তৃপ্তি পেলাম। কিশোর বয়সে তোমাকে দেখে আমিও এক রকমের আনন্দ পেতাম। তারপর যত বড় হয়েছি, তোমাকে দেখে আরো বেশি আনন্দ পেয়েছি। যখন শয়তানের প্ররোচনায় পড়াশোনা ছেড়ে দিই তখন একদিন রাহেলা ও জোবেদার সঙ্গে তোমাকে স্কুলে যেতে দেখে সেই পুরোনো আনন্দ আবার মনের মধ্যে অনুভব করি। সেই দিন থেকে আমার মন আমাকে বলতে লাগল, তুমি যে ফাহমিদাকে দেখে এত আনন্দ পাও, তার কারণ চিন্তা করে দেখছ? তার কারণ হল, তুমি তাকে ভালবাস। তাকে পেতে হলে তোমাকে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, স্কুলে লেখাপড়া করব। তারপর আব্বা-আম্মাকে রাজি করিয়ে স্কুলে ভর্তি হলাম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রায় দেড় বছর পর এক বর্ষার দিনে আল্লাহপাক তোমার সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ করে দিয়ে আমাকে ধন্য করলেন। সেই থেকে তোমার কাছ থেকে এই রকম একটা চিঠি পাওয়ার আশা করছিলাম। সেই আশাও আল্লাহপাক পূরণ করলেন। সেজন্য তাঁর পাক দরবারে জানাচ্ছি লাখো শুকরিয়া। ফাহমিদা তোমাকে আমি আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালবাসি। সেই ভালবাসা আমাকে পড়াশোনা করে মানুষ হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে। মাঝে মাঝে পত্র দিয়ে এবং দেখা দিয়ে সুখী করো। তোমাকে একান্ত করে পাওয়াই আমার জীবনের একমাত্র কামনা। তবে আমাকে উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। পারবে না ফাহমিদা অপেক্ষা করতে? আমার মন বলছে পারবে। অনেক কিছু লিখতে মন চাচ্ছে; কিন্তু তোমার পত্র পেয়ে মনের মধ্যে আনন্দের স্রোত এত বেশি বইছে যে, সেগুলো তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যাচ্ছে। এই পত্রের উত্তর পাওয়ার পর সেইসব কথা লিখব। এখন আল্লাহপাকের কাছে তোমার সহি সালামতের জন্য দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
শামী
শামী ফাস্ট বেঞ্চে বসার জন্য প্রতিদিন ফাহমিদাদের আগে স্কুলে রওয়ানা দেয়। আজ পালেদের পুকুর পাড়ের কাছে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ফাহমিদা, জোবেদা ও রাহেলা সেখানে এলে শামী সালাম দিয়ে বলল, তোমরা কেমন আছ?
রাহেলা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমরা তো ভালো আছি শামী ভাই; কিন্তু ফাহমিদার কথা বলতে পারছি না। তারপর জোবেদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলরে জোবেদা, আমরা আস্তে আস্তে এগোই। ফাহমিদাই বলুক, ও কেমন আছে। তারপর তারা স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগল।
ওরা একটু এগিয়ে যেতে শামী ফাহমিদার হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, পড়ে উত্তর দেবে কিন্তু। কেমন আছ বললে না যে?
ফাহমিদা চিঠিটা বুকের কাছে ব্লাউজের ভিতর রেখে বলল, চিঠি পড়ে তুমি কি ভাববে মনে করে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারি নি।
শামী বলল, আমি কিন্তু তোমার মনের কথা জানতে পেরে খুব শান্তির সঙ্গে ঘুমিয়েছি। আমার চিঠি পড়লেই সবকিছু জানতে পারবে। এবার থেকে আমরা স্কুলে যাওয়া আসার পথে এখানে দেখা করব। চল, যেতে যেতে কথা বলি।
ফাহমিদা আর কিছু না বলে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল।
এরপর থেকে তারা আনন্দে লেখাপড়া করতে লাগল। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় পালেদের পুকুর পাড়ে এসে ফাহমিদা, রাহেলা ও জোবেদাকে স্কুলে চলে যেতে বলে সে শামীর জন্য অপেক্ষা করে। শামী আসার পর দুজনে গল্প করতে করতে স্কুলে যায়। কোনো কোনো দিন স্কুল কামাই করে বসে বসে গল্প করে আবার কোনো দিন মুন্সীগঞ্জে বেড়াতে যায়। এতকিছু করলেও তারা পড়াশোনায় অবহেলা করল না। এভাবে দিন গড়িয়ে চলল।
জোবেদা ও রাহেলা ছাড়া তাদের দুজনের অভিসারের কথা কেউ জানতে পারল। শুধু শামীর বন্ধু রায়হান সবকিছু জানে। শামী বন্ধুকে না জানিয়ে থাকতে পারে নি। ফাহমিদা যত চিঠি দেয় এবং সেও যত চিঠি ফাহমিদাকে দেয়, সেগুলো তো রায়হানকে দেখাবেই, এমন কি তার সঙ্গে কি কথা হয় তাও বলে। প্রথম যেদিন শামী তাকে ফাহমিদার চিঠি দেখায়, সেদিন রায়হান বলেছিল, বড়লোকের মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না। আমার মনে হয় তুই ভুল করেছিস। শামী কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত করে নি। বলেছিল, সবাই সমান হয় না।
নাইন থেকে টেনে ওঠার সময় দুজনেই ফার্স্ট হল। রেজাল্টের দিন শামী তিনজনকে বাজারে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি খাওয়াল।
খাওয়া শেষে জোবেদা ফাহমিদাকে বলল, কিরে শামী ভাইকে প্রথম চিঠি দেয়ার আগে আমাদের সঙ্গে কি বাজী রেখেছিলি, তা ভুলে গেছিস না কি?
ফাহমিদা বলল, ভুলব কেন? এতদিন তোরা সেকথা বলিস নি কেন?
শামী জিজ্ঞেস করল, কিসের বাজী?
ফাহমিদা হাসতে হাসতে ঘটনাটা বলল।
শামী বলল, ফাহমিদা তোমাদেরকে মিষ্টি না খাইয়ে ভালই করেছে। তখন খাওয়ালে আমি ফাঁকা পড়ে যেতাম। এখন হয়ে যাক তা হলে।
রাহেলা বলল, আপনি যা খাইয়েছেন তাতেই পেট টৈটুম্বুর হয়ে গেছে। এখন আর কিছু খেতে পারব না। অন্য দিন ফাহমিদার কল্লা মটকাব।
রাহেলার কথা শুনে তিনজনে হাসতে লাগল। ফাহমিদা হাসি থামিয়ে বলল, তুই এমন কথা বলিস, হাসি চেপে রাখা যায় না। এবার চল বাড়ি ফেরা যাক। বেশি দেরি করলে সবাই চিন্তা করবে।
সেদিন শামী বাড়ি ফেরার পথে রায়হানকে রেজাল্টের কথা জানিয়ে এল।