আরিচার পর বাঘাবাড়ি। শেষ ফেরি এটাই। তারপর সোজা একটানা রংপুর। বাঘাবাড়িতে এসে রেস্ট হাউস দেখে জাহেদা বলল, একটু দাঁড়ান।

তার ছোট্ট সুটকেশটা নিয়ে জাহেদা ভেতরে চলে গেল।

একটা বাবলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল বাবর। ওপাশে নিচু জমিতে একটা মরা গরু পড়ে আছে। কয়েকটা শকুন খুবলে খুবলে খাচ্ছে তাঁর পচা মাংস। বহুদূরে একটা কুকুর বসে বসে জিভ বার করে তাই দেখছে। কয়েকটা ন্যাংটা ছেলে এসে ভিড় করেছে। বাবরের চারপাশে। সে গাড়ি থেকে তাদের একটা বিস্কুটের প্যাকেট বার করে দিল। তারা তো প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না, তাদের দেয়া হয়েছে। তারপর যখন বিশ্বাস হলো, প্যাকেটটা নিয়ে দে ছুটি কলরব করতে করতে। বাবর হা হা করে হেসে উঠল। তার ফেলে দেয়া সিগারেটের টুকরো পথ চলতে পেয়ে গেল বুড়ো। নির্বিকার মুখে টানতে টানতে সে মাঠের মধ্যে নেমে গেল।

জাহেদা বেরিয়ে এলো।

মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল বাবর। জাহেদা কালো পোশাকটা পালটে নীল জামা নীল পাজামা পরে এসেছে। মাথায় একটা নীল রিবণ দিয়েছে। রং বুলিয়েছে ঠোঁটে। মুখে মিহি গোলাপি পাউডারের আভা। চোখের কোলে একটুখানি পেন্সিল পরেছে, আরো গভীর এবং সজল। লাগছে এখন।

বাবর প্রসন্ন হাসিতে উজ্জ্বল হলো। জাহেদাও হাসল তারপর ঘুরে যখন গাড়িতে বসল। তখন তার প্রশস্ত নিতম্ব দুলে উঠল। গুরুভার একটা কোষার মত।

বাবর বলল, কিছু খেয়ে নেবে?

ক্ষিদে নেই।

আরিচা থেকে আবার স্তব্ধতা পেয়ে বসেছে জাহেদাকে। ফেরিতে সারাক্ষণ উদাস হয়ে বসেছিল সে।

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বাবর বলল, তোমার ভাল লাগছে না?

হ্যাঁ।

অনেক কিছু দেখার আছে। মহাস্তান দেখব, রামসাগরে যাব, কান্তজীর মন্দির–সারা উপমহাদেশের পোড়া মাটির ফলকে তৈরি একমাত্র মন্দির, সেটা দেখবে। আর এভারেস্ট দেখবে পচাগড় থেকে! পাহাড় দেখেছি কখনো?

চাটগাঁয়ে দেখেছি।

সে তো বাচ্চা পাহাড়। তোমার মত।

বাবর রসিকতা করল এবং হাসিটা দীর্ঘস্থায়ী করে রাখল। জাহেদাও হাসল, কিন্তু কেমন যেন আনমনা সে।৩খন বাবর আর কিছু বলল না। খুব চড়া রোদ দেখে কালো চশমা পরে নিল।

কিছুক্ষণ পর ডানে দেখিয়ে বলল, এই রাস্তা দিয়ে শিলাইদহে যাওয়া যায়। ফেরার পথে তোমাকে নিয়ে যাব। রবীন্দ্ৰনাথ এক সময়ে এখানে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছ?

হ্যাঁ শুনেছি। কী মনে করেন? আমি তার গানও শুনেছি।

ভাল লাগে তোমার?

লাগে। তার একটা গল্পও পড়েছি। দি হোম কামিং।

দি হোম কামিং? বাবর মনে করতে পারল না কোন গল্পের কথা জাহেদা বলছে। সে আবার জিগ্যেস করল, কী আছে বলতো ওতে?

একটা ছোট্ট ছেলে। মানিক না ফটিক নাম।

ওহো। বাংলায় ওটার নাম ছুটি। অতি বিখ্যাত গল্প। ইংরেজিতে দি হোম কামিং নাকি? জানতাম না। রবীন্দ্রনাথ এই শিলাইদহে বসে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প, গান আর কবিতা লিখেছেন। তুমি যখন বাংলা শিখবে তখন তার বই পড়তে দেব।

পড়ব।

জাহেদার উচ্চারণে এমন একটা মিনতি ছিল যার অর্থ আমাকে একটু চুপ করে থাকতে দাও। বাবর তাই দিল। নীরবে গাড়ি চালাতে লাগল সে। উল্লাপাড়া পার হয়ে গেল। আজ বোধহয় এখানে হাটবার। দলে দলে লোক চলেছে কত রকম জিনিস নিয়ে। বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে। আড় হয়ে পড়ে আছে কোথাও কয়েকটা গরুর গাড়ি। এরই মধ্যে হঠাৎ একটা পালকি দেখা গেল। দু বেহার হুম হাম করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খয়েরি রংয়ের ওপর সাদা চুণে লতাপাতা আঁকা পালকির গায়ে। দরোজা বন্ধ। বোধহয় বৌ যাচ্ছে।

বাবর গাড়ির গতি কমিয়ে বলল, ওটা কী দেখেছ? পালকি। আজকাল দেখাই যায় না। আমিও প্রায় পঁচিশ বছর পরে দেখলাম।

মিষ্টি করে হাসল জাহেদা। কিন্তু তেমনি অন্যমনস্ক।

আবার বাঁধান রাস্তায় টায়ারের শনশন আর এঞ্জিনের একটানা আওয়াজ শোনা যেতে লাগল শুধু। বাবরের একটু মাথা ধরেছে, এইমাত্র বুঝতে পারল সে। ঠিক মাথা ধরা না, যেন কিছুক্ষণ পর ধরবে।

জাহেদা হঠাৎ জিগ্যেস করল, আচ্ছা আপনি একা থাকেন কেন?

বাবর ভাবল, আবার সেই প্রশ্ন। কতজন কতভাবে এই এক কথা জিগ্যেস করেছে। মনে হয় মায়ের থেকে বেরিয়েই এ কথা শুনতে শুরু করেছে সে। একা থাকেন কেন? বিয়ে করে বৌয়ের সঙ্গে বেশি তাল দিলে লোকে প্রশ্ন করবে, উনি অতটা ন্ত্রৈণ কেন? বৌ থেকে দূরে দূরে থাকলে তারা মুখর হয়ে উঠবে, বৌকে ভালবাসেন না কেন? বাচ্চা না হলে, বাচ্চা হচ্ছে না কেন? বাচ্চা যদি হয়, আর কত বংশবৃদ্ধি করবেন? আর যদি কিছুই না করে ঘরে খিল দিয়ে থাকা যায়, প্ৰেমে ব্যর্থ হয়েছিল নাকি ভদ্রলোক? নাকি নপুংশক। মুক্তি নেই।

বাবর মুখে বলল, একা থাকি মানে?

মানে, বিয়ে করবেন না নাকি?

বাবরের খুব পছন্দ হলো জাহেদাকে এখন। খুব সুন্দর পছন্দ গলায় বলেছে কথাটা। বোধ হয় ওরা যাকে বিশ্বাস বলে থাকে তারই ফলে কণ্ঠ এ-রকম স্বছন্দ হয়।

হাসছেন কেন?

না, হাসছি না। কী জবাব দেব ভাবছি।

বাবর ভাবল যা সত্যি তা বললে ও বুঝতে পারবে না। বিয়ে সে করবে। কেন? শরীরের জন্যে? সে প্রয়োজন বিয়ে না করেও মেটান যায়। বরং তাতে তৃপ্তি আরো অনেক। বিবাহিত বন্ধুদের কি সে শোনেনি। স্বীকারোক্তি করতে? বৌয়ের সঙ্গে শুয়ে সুখ নেই। বন্ধুরা কি তাকে বলেনি, দে না একটা মেয়েটেয়ে যোগাড় করে? বিয়ে করবে সন্তানের জন্যে? সন্তান সে চায় না। চায় না তার উত্তরাধিকার কারো উপরে গিয়ে বর্তক। আমার জীবনের প্রসারণ আমি চাই না। মৃত্যুর পরেও আমি বেঁচে থাকতে চাই না। আমার এমন কিছু সম্পদ নেই, অর্জন নেই, উপলব্ধি নেই। যা যক্ষের মত আগলে রাখার স্পাহা বোধ করি ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্যে। এ জীবন আমি চাইনি, অতএব কারো জীবনের কারণও আমি হতে চাই না। বিয়ে করব ভালবেসে? ভালবাসা বলে কিছু নেই। ওটা একটা পন্থা। পন্থা কখনো লক্ষ্য হতে পারে না, নিবৃত্তি নেই তাতে। ভালবাসা একটা অভিনয়ের নাম।

কিন্তু জাহেদা এতসব বুঝবে না। কিম্বা সে বোঝাতে পারবে না। লোকে যতই বলুক, সে সুন্দর করে কথা বলতে পারে, সে নিজে জানে অনেক কথাই সে গুছিয়ে বলতে জানে না, এবং তাদের সংখ্যাই অধিক। তাই আর দশজনের মত সে বলল এবং মিথ্যে হলেও বলল, তোমাকে সত্যি কথা বলতে কী? একজনকে ভালবাসতাম। তার ভালবাসা পাইনি, তাই একা আছি।

জাহেদা তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বাবর প্রীত হলো একটি অনবদ্য মিথ্যা কথা সুন্দর করে বলতে পেরেছে ভেবে।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

কোনোদিন বলেননি তো?

কোনোদিন তো জিগ্যেস করনি।

কে সে?

বাবর একটু হাসল। এইভাবে অবকাশ নিল দ্বিতীয় মিথ্যে রচনার। বলল, তাকে তুমি চিনবে না। সে এখানে নেই। বিলোতে আছে এখন।

বিলেতে?

হ্যাঁ, ওর স্বামী ওখানে এমব্যাসিতে আছে।

কবে বিয়ে হয়েছে?

সে পনের বছর আগে। তুমি তখন বোধ হয়। টলমল করে হাঁট। কত বয়েস হবে তখন তোমার? তিন? চার।

জাহেদা তার জবাব না দিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে আর দেখা হয় না?

হবে কী করে? সে বিলোতে, আমি ঢাকায়। হ্যাঁ, মাঝখানে একবার দেশে এসেছিল। এয়ারপোটো হঠাৎ দেখা। ব্যাগেজের জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি কী একটা কাজে ভেতরে ঢুকেছিলাম। বাবর থেমে থেমে বানিয়ে বানিয়ে বলে যেতে লাগল, যেন সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে এখন। দেখি ওর পায়ের কাছে ছোট্ট ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে।

কথা হলো না?

না।

না? প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। বলল, কেন?

ও বলল না। আমাকে দেখেও দেখল না। আমি চলে এলাম।

জাহেদা উদাস হয়ে গেল। যেন কল্পনা করতে লাগল এয়ারপোর্টের ছবিটা। বাবর আপনি মনেই হাসল। কত সহজে বিশ্বাস করে ওরা। তার চমৎকার মিথ্যেটাকে সত্যি মনে করে বুকের ভেতর ভাঙ্গন অনুভব করছে মেয়েটা।

জাহেদা অফুট স্বরে জিগ্যেস করল, আচ্ছা, ভালবাসা তবে কী?

মনে মনে বাবর বলল, খুব ভাল কথা তুলেছি। তোমাকে বলব। তাহলে তোমাকে পাওয়া সহজ হবে। পাজামা খুলতে এতটুকু গ্লানি বোধ করবে না তুমি।

কিন্তু সরাসরি তার জবাব না দিয়ে সে একটু খেলা করতে চাইল। বলল, কোনোদিন তুমি ভালবেসেছ জাহেদা?

না।

মুখে বলল, এবং একই সঙ্গে মাথা নাড়ল জাহেদা। পরে হেসে ফেলল। কোলের উপর আসা কামিজটাকে নামিয়ে দিয়ে মসৃণ করতে লাগল ভাজগুলো।

বিশ্বাস করি না।

সত্যি বলছি।

হতেই পারে না। আমাকে বলতে কী? বল?

জাহেদার মুখ থেকে হাসিটা হঠাৎ নিভে গেল। তারপর দপ করেজ্বলে উঠল বাতিটা। মাথাটা কাৎ করে দরোজার হাতল বাঁ হাতে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, কী শুনবেন? সে অনেক আগের কথা।

তবু শুনব। বল তুমি।

না।

বল। ছেলেটা তোমার কাজিন ছিল, না?

কী করে জানলেন?

আমি জানি।

ইস, অন্ধকারে একটা ঢিল লেগে গেছে, বুঝি, বুঝি।

বাবর হাসল। নীরবে অপেক্ষা করতে লাগল। সে জানে, জাহেদা না বলে পারবে না। শুধু একটু সময় নিচ্ছে।

জাহেদা বলল, একদিন, আমার এখনো মনে আছে, ছাদের ওপর আমরা সন্ধেবেলায় হাত ধরাধরি করে বসেছিলাম।

তোমাদের বাসায় থাকত?

না। বেড়াতে এসেছিল। একটা ছাই রংয়ের সুটকেশ ছিল ওর। টিনের ( একদিন ওর জামার পকেট থেকে টুক করে পড়ে গেল চাবিটা। আমি পা দিয়ে চেপে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমার সামনেই সারা ঘর তোলপাড় করল চাবির জন্যে। তারপর হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই আমি আর হাসি রাখতে পারিনি। হেসে ফেলেছি।

খুব চালাক তো?

ভীষণ চালাক ছেলে। আমাকে ও মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল। চোখে যেন আগুন। আমাকে পুড়িয়ে ফেলবে। ভয়ে আমার বুকও শুকিয়ে এসেছিল। হঠাৎ ও হেসে ফেলল। হাসলে ওকে ভারি সুন্দর দেখাত জানেন?

কল্পনা করছি। বল।

তারপর একটি কথা না বলে আস্তে আস্তে আমার পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসল। একটা হাত রাখল ঠিক যে পায়ের নিচে চাবি ছিল তার ওপর। আমার কী হলো আমি পা সরিয়ে নিতে পারলাম না। ও সরিয়ে দিয়ে চাবিটা নিয়ে মাথা নিচু করে ঘর থেকে দৌড়ে চলে গেল। আর আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম তো থাকলামই।

তারপর?

তারপর আর কিছু নেই। এখন কেন বলছি কে জানে? হঠাৎ মনে পড়ল। আপনি জিগ্যেস করলেন, তাই।

তারপর?

বললাম তো, আর কিছুই নেই। বলে জাহেদা হাসল, ঠিক যেমন ঘুমের মধ্যে বাচ্চার হাসে নিঃশব্দে। সেই হাসিটা অস্পষ্ট হতে হতে যখন মিলিয়ে গেল, তখন চকিতে বাবরের দিকে তাকাল। বাবর বলল, তারপর কী হয়েছিল আমি জানি।

ইস।

সত্যি জানি। বলব?

বলুন তো।

তারপর রাতে তুমি ঘুমিয়েছিলে। হঠাৎ জেগে উঠে দ্যাখ তোমার পায়ে চুমো খাচ্ছে সে। জাহেদার চোখ হঠাৎ উদ্বেগে ভরে উঠল।

তুমি কিছু বলতে পারলে না। তোমার শরীরের ভেতরে আরেকটা শরীর যেন তৈরি হতে লাগল। সে এবার সাহস পেয়ে তোমার গালে চুমো দিল। ছেলেমানুষ তো, তাই জানে না, ঠোঁটে চুমো দিতে হয়।

যাহ।

লাল হয়ে উঠল জাহেদা।

তারপর অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে আবার চুমো খেল সে। হঠাৎ একটা কীসের শব্দ হলো কোথাও। লাফ দিয়ে পালিয়ে গোল ঘর থেকে।

কি ঠিক বলিনি?

জবাব দিল না জাহেদা।

মিলে গেছে? বল না। আমার কাছে লজ্জা কী?

না।

কাউকে না কাউকে বলতে হয় বল।

প্ৰায় ঠিক বলেছেন। জাহেদা ফিসফিস করে বলল। কী করে বললেন?

তোমার চেয়ে আমার বয়স যে অনেক বড়। আমার মত বয়স হলে তুমিও বলতে পারতে।

বাবর নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছিল আর অনুমানটা সত্যি হয়ে যেতে দেখে। কী করে বলল সে। এ-রকম যোগাযোগ সাধারণত হয় না। হঠাৎ খুশি কাটিয়ে মনে পড়ল তার জাহেদা বলেছে, প্রায় ঠিক বলেছেন। সে জিগ্যেস করল, প্ৰায় ঠিক বলেছি, না? আসলে আর কী হয়েছিল?

জাহেদা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না, সে রাতে তার প্যান্টের বোতামগুলো খুলে ফেলেছিল। তখন বাধা দিয়েছিল সে। কিন্তু বাধা মানেনি। কী ভীষণ লজ্জা করছিল তার। মরা একটা মাছের মত পড়েছিল সে। উন্মুক্ত ঊরু হঠাৎ কাঁটা দিয়ে উঠেছিল তার। খুব ঠাণ্ডা লাগছিল। গলার কাছে দম একটা ছিপির মত আটকে ছিল তার। কিন্তু ছেলেটা কিছুই করেনি। একমুহূর্ত পর প্যান্টটা টেনে দিয়ে চুমো খেয়েছে তাকে। তারপর সত্যি কোথায় যেন একটা খড়মের আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। কিন্তু লাফ দিয়ে পালায়নি ছেলেটা। চট করে পাশে সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর উঠে গেছে আস্তে আস্তে। বাবর বলল, কী ভাবছ? মনে পড়ছে সব?

জাহেদা অস্পষ্ট করে হাসল।

বাবর জিগ্যেস করল, ছেলেটা কোথায়?

এখন ফাইনাল ইয়ারে আছে।

ঢাকায়?

হ্যাঁ, ঢাকায়।

দেখা হয় না?

না। জানেন? হঠাৎ জাহেদা খুব স্বচ্ছন্দ হবার চেষ্টা করল। ঝরঝরে গলায় বলল, জানেন ও এখন প্রেম করছে ওরই ক্লাশে পড়ে। পাশ করে বেরুলেই বিয়ে হবে। বিলেতে যাবে।

যাক, যারা বিলেতে যেতে চায়, যাক কী বল?

দুজনে একসঙ্গে হেসে উঠল।

জাহেদা বলল, আপনি সিগারেট কিন্তু বেশি খাচ্ছেন!

তাই নাকি? আর খাব না।

সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বাবর। পথের ওপর ঘুরতে ঘুরতে পড়ে দ্রুত পেছনে সরে গোল ধিকি ধিকি আগুনটা। বাবর হাসল।

কী, হাসছেন যে?

না, এমনি। হাসি কান্না এসব শরীরের একেকটা অবস্থা। মনের অবস্থা অনুযায়ী লোকে কাঁদে হাসে, আবার কখনো কখনো শরীরের অসংখ্য কোষে হঠাৎ সাড়া জাগে, পেশিগুলো নিজে নিজেই এমন বিন্যাসে হঠাৎ পড়ে যায় যে তখন হাসি হয়, কান্না পায়। বুঝেছি? কিছু ভেবে হাসছি না।

আপনার কথা আমি একটুও বুঝতে পারি না।

বলে জাহেদা সীটে মাথা এলিয়ে চোখ বুঝল। হঠাৎ চোখ খুলে একবার দেখে নিল বাবরকে। না, এখন আর সে হাসছে না। একটু পর বাবর তার দিকে চোখ ফেরাল। তার ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগল জাহেদার দুচোখে চুমো দেয় সে। জিভের ডগা দিয়ে তার সাদা দাঁতগুলো মেজে দেয়। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটু একটু চোখ পড়ছে। ঠোঁটে খাড়া কয়েকটা ভাঁজ। সোনালি রোমগুলো চিকচিক করছে আলোয়; বাবর জানে যখন চুমো খাবে তখন ঐ রোমগুলো তার শরীরে তুলবে শিহরণ।

গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিল বাবর।

এক সময়ে জাহেদা হঠাৎ চোখ মেলল।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

হ্যাঁ, অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছ।

এটা কোথায় এলাম?

এই তো বগুড়া। একটু পরেই সাতমাথা আসবে। সাতটা রাস্তা এক জায়গায় এসে মিলেছে। ছেলে ছোঁকড়ারা খুব আড্ডা দেয় এখানে।

এই যে।

সত্যি তো।

গলা বাড়িয়ে জাহেদা সাতমাথার মোড় দেখল। তারপর গাড়ি এগিয়ে গেলে পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখল।

বাবার বলল, কিছু খেয়ে নেবে?

কত খাব?

কিছুইতো খাওনি?

তবু। আর কিছু খাব না। চমচম খেয়ে পেট ভরে গেছে।

স্যাণ্ডউচ্চ তো ছুঁলেই না। আচ্ছা, একটু চা খাও। চা কিনে নিই। রংপুর এখনো অনেক দূরে। গাড়ি থামিয়ে চায়ের খোঁজ করল বাবর। চা পাওয়া গেল না। বগুড়ায় বিকেলে নাকি চা হয়। না। পাঁচটা বাজবে, তখন চায়ের কেতলি বসবে উনুনে। অনেক খোঁজাখোঁজি করে এক দোকান পাওয়া গেল। সেখান থেকে চা কিনে গাড়িতে বসে খেল ওরা। তারপর বগুড়া ছাড়ল।

ফেরার সময় এখান থেকে রসকদম নিয়ে যাব।

রসকদম কী? জাহেদা জিগ্যেস করল।

এক ধরনের মিষ্টি।

মিষ্টি বুঝি খুব ভালবাসেন আপনি?

হ্যাঁ! এবারে ছাড়তে হবে। বয়স হচ্ছে। ডায়বেটিসের ভয় আছে। এই যে বাঁয়ে মহাস্থানগড়। ফেরার পথে থেমে তোমাকে দেখাব।

জাহেদা হেসে উঠল।

হাসির কী হলো?

আপনি সেই সকাল থেকে সব কিছু ফেরার পথে দেখাবেন বলে রাখছেন। যাওয়ার পথে কিছু দেখার নেই নাকি?

বাবর একটু লজ্জিত হলো। কথাটা একবারও তার মনে হয়নি। কিন্তু হেরে যাবে না সে। মিষ্টি হেসে বলল, যাওয়াটাই বাঁ কম কীসে? এই চলা, তুমি সঙ্গে আছ, কথা বলছি; ঢাকায় থাকলে হতো? নতুন লাগছে না।

তা লাগছে। কিন্তু আমরা দেখতে যাচ্ছি কী তাও তো বললেন না?

অনেক কিছু।

কী, অনেক কিছু?

গেলেই বুঝবে।

বাবর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু কথা খুঁজে পায় না। এ-বকম সচরাচর হয় না তার। নিজের ওপর, বিশ্বের ওপর, সময়ের ওপর ক্ৰোধ হয় তার। কী ক্লান্তিকর অভিনয় তার করতে হচ্ছে। কী দীর্ঘ প্ৰস্তৃতি নিতে হচ্ছে তাকে। মাথার ভেতরে জুলন্ত বর্ণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে জাহেদার সাথে সঙ্গমরত তার ছবিটা। সে গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। জাহেদা কি এখনো বুঝতে পারছে না, সে কী চায় তার কাছে? এতই সে নাবালিকা যে তার সঙ্গে ওভাবে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে এতদূর এসেছে অথচ একবারও মনে হয়নি যা বাবরের মনে মনে আছে?

বাবরের ভেতরে তীব্র ইচ্ছে ফণা তুলে দুলতে লাগল–এখন, এই পথের ওপর আর কিছু না হোক জাহেদাকে একটু স্পর্শ করতে।

ইচ্ছে করে হঠাৎ ব্রেক করল সে। যা চেয়েছিল তাই হলো। জাহেদার মাথা ঠুকে গোল সামনের কাচে। সামলে নিয়েছে মেয়েটা, জোরে লাগেনি।

বাবর বলল, দ্যাখ, দ্যাখ, লোকটাকে পাশ কাটাতে কী হয়ে গেল। বলে সে গাড়ি একেবারে থামিয়ে জাহেদার কপাল, দুহাতে ধরল।

দেখি, কোনখানে লেগেছে। ইস।

জাহেদা হেসে মাথা নাড়ল। না, লাগেনি তেমন।

লেগেছে, শব্দ পেলাম যে।

বলে সে তার কপালে করতাল রাখল। আস্তে আস্তে ঘষে দিতে লাগল। জাহেদা চেষ্টা করল মুক্তি পেতে। কিন্তু পারল না। বাবর বলল, ছেলেমানুষি কর না। একটু বুলিয়ে দেই। নইলে মাথা ধরবে।

আমার লাগেনি, বললাম।

মিথ্যে বল না।

সত্যি। ছেড়ে দিন। রংপুর কদ্দূর?

বাবর কপাল ছেড়ে এবার দুহাতের মধ্যে জাহেদার মুখটাকে নিয়ে নাড়া দিতে দিতে বলল, আমি খুব দুঃখিত। ওভাবে ব্ৰেক করা উচিত হয়নি।

জাহেদার মুখের কোমলতা যেন হাত ভরে রইল বাবরের। সে হাত ফিরিয়ে এনে নিজের মুখে রাখল, যেন এটা খুব স্বাভাবিক। যেন সে নিজেও ক্লান্ত। আর শরীর দিয়ে টের পেল তার করতল থেকে সঞ্চারিত জাহেদার মৃদু উত্তাপ তার মুখে। হাত দুটো যেন অন্য কারো হয়ে গেছে, এমন লাগছে তার। নিজের হাতের দিকে চকিতে তাকিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিল সে। বলল, এই রাস্তাটা খুব ভাল। প্রায় সোজা। মাইলের পর মাইল। রংপুর পর্যন্ত। দুদিকে কী সুন্দর আখের খেত দেখেছ? দ্যাখ, একটু কুয়াশার মত লাগছে না? ও কুয়াশা না। রান্নার ধোঁয়া। বিকেলের দিকে গ্রামে এই রকম একেকটা ধোঁয়া থমকে থাকে মাঠের ওপর।

চোখ ভরে দেখতে লাগল জাহেদা।

বাবর যখন পাশে ঝুঁকে দুহাতে জাহেদার কপাল ধরেছিল তখন জাহেদা বিব্রত হয়ে হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে ঠোঁট ফাঁক করে দিয়েছিল। খুব উচ্চগ্রামে কম্পন্ন হলে যেমন হয়। তেমনি দেখা যায় কি যায় না। কাপছিল তার ঠোঁট। সে কি ভাবছিল বাবর তাকে চুমো দেবে হঠাৎ? দিলে হতো। হয়ত তৈরি ছিল জাহেদা তখন।

বাবর বলল, জাহেদা।

কী?

তখন তুমি ভালবাসার কথা জিগ্যেস করছিলে না?

হুঁ।

বিশ্বাস কর ভালবাসা বলে কিছু আছে?

আছে তো।

সবাই বলে তাই না?

সবাই কেন বলবে। আমি নিজেই জানি।

না, তুমি জান না।

জাহেদা প্ৰায় চমকে উঠল। নিঃশব্দে একটা চোখের তীর তুলে তাকিয়ে রইল সে অনেকক্ষণ।

বাবর বলল, যাকে ভালবাসা বলে আমরা সবাই জানি সেটা ভালবাসা নয়। ভুল জানি আমরা।

কেন?

আচ্ছা, তুমি বল, ভালবাসা একটা আবেগ, একটা অনুভূতি, না?

হ্যাঁ, তাইতো। মানুষের যত আবেগ আছে, যত অনুভূতি আছে, যত রকম প্রতিক্রিয়া আছে তার, আমি বলি, মূলত তা দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। বাবর অনেকক্ষণ পর এই কথাগুলো ইংরেজিতে বলতে লাগল। যাতে জাহেদা বুঝতে পারে। আর তা ছাড়া ইংরেজিতে অনেক নগ্ন কথা স্বচ্ছন্দে স্বাভাবিকভাবে বলা যায়। সে বলে চলল, মন দিয়ে শুনছ তো?

হ্যাঁ, শুনছি। আপনি বলুন।

দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে তার রক্ত মাংসের অনুভূতি, জান্তব অনুভূতি, তার মৌলিক অনুভূতি, আবেগ। আর একটা তার অর্জিত অনুভূতি–যা সে শিক্ষা দীক্ষা চিন্তা ভাবনা সভ্যতার ফলে অর্জন করেছে। একটা ভেতরের, আরেকটা বাইরের।

যেমন?

মনে কর আমার কারো ওপর খুব রাগ হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি সে আমার শত্রু। তখন আমার মৌলিক আবেগ হবে তাকে হত্যা করা।

শিউরে উঠল জাহেদা। বলল, না, না।

বাবর হেসে বলল, ভয় পাবার কী আছে? এটাই হচ্ছে সত্যি। প্ৰাণীজগতে এইই দেখবে। মানুষও একটা প্ৰাণী। কিন্তু–কিন্তু আমরা হত্যা করি না, সাধারণত করি না। আদিম কালে, যখন আমরা উলংগ থাকতাম, পাথর ছুঁড়ে প্রাণী হত্যা করে তার মাংস ঝলসে খেতাম, যখন ইতিহাস ছিল না, ভাষা ছিল না, তখন আমরা ক্রুদ্ধ হলে হত্যা করতাম। তখন সেটা স্বাভাবিক ছিল। এখন যে করি না তার কারণ আমরা আইন করে নিয়েছি, কতকগুলো নিয়ম বানিয়েছি। আর মনে রাখবে, নিয়ম কানুন আইন এসব দুর্বল মানুষেব সৃষ্টি। আমরা এখন হত্যা করি না, দয়া করি, সহানুভূতি দেখাই। দয়া হচ্ছে অর্জিত আবেগ। মানুষের রক্তে তা নেই, সভ্যতা যার নাম তারই একটা অবদান ঐ দয়া। আমরা ক্রোধ দমনকে একটা মহৎ গুণ বলে সবাই স্বীকার করে নিয়েছি। যার ক্ৰোধ নেই তিনি মহাপুরুষ। কিন্তু এটা প্ৰকৃতির নিয়ম নয়।

যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে অথচ বিশ্বাস করা যাচ্ছে না এমনি একটা দোল জাহেদার চোখে।

বাবর গাড়ি চালাতে চালাতে সমুখের দিকে স্থির চোখ রেখে নির্মল স্থির একটা হাসির উদ্ভাস সৃষ্টি করে বলে যেতে লাগল, দৈহিক মিলন মৌলিক অনুভূতি, প্ৰেম অর্জিত অনুভূতি, জাহেদা।

জাহেদা চোখ নামিয়ে নিল।

বাবর বলল, এখন বড় হয়েছ, এসব কথা শুনে লজ্জা পাবার কিছু নেই। প্রকৃতির নিয়মটা কী জান? এই যে গাছ, তার একটা নির্দিষ্ট আয়ু আছে, তারপর মরে যাবে। কিন্তু ধারাটা তাই বলে শেষ হয়ে যাবে না। প্রকৃতির নিয়মেই একটা গাছ থেকে আল, একটা দুটো দশটা গাছ হবে, হয়ে এসেছে, এইভাবে জগৎ চলে এসেছে। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে জন্ম দেবে। ফুলের রেণু ভোমরার পায়ে অন্য ফুলে ছড়ায়। একটা বিপ্লব ঘটে যায়। বীজ হয়। বীজ থেকে গাছ। কার্পাসের তুলোটা প্রকৃতির একটা কারসাজি–বীজটাকে উড়িয়ে অন্যখানে নিয়ে যাবার জন্যে। আমাদের লেপ তোষক তৈরির জন্যে তার সৃষ্টি হয়নি। পুরুষ মিলিত হয় স্ত্রীর সঙ্গে, প্রকৃতির বিধানেই তাকে হতে হয়, কারণ স্ত্রীকে গর্ভবতী হতে হবে, সে আরেকটা মানুষের জন্ম দেবে। মানুষ নামে প্রাণী এইভাবে বেঁচে থাকবে। প্রকৃতির মূল তাগিদ হচ্ছে এইই। মিলন, নিজের আকৃতিতে সৃজন, সঙ্গমের মাধ্যমে জীবনের বিস্তার। এটা আমাদের রক্তে মাংসে আছে। কিন্তু আমরা সভ্য হয়েছি, চিন্তা করতে পারি, তাই একটা সুন্দর নাম দিয়েছি সেই জান্তব আকর্ষণের, নামটা প্ৰেম, ভালবাসা। ভালবাসা না হয়ে এর নাম কাঁঠাল বললে, লোকে ভালবাসাকে কাঁঠালই বলত। তাই নিয়ে গান হতো, কবিতা হতো, ছবি আঁকা হতো।

বিমূঢ় একটা হাসি ফুটে উঠল জাহেদার ঠোঁটে। তার ভেতরে একটা ঝড় হচ্ছে যেন। একটা শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আর গোপনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রাজ্যের বাতাস।

বাবর মাইল পোস্টটা দেখে নিল গাড়ির গতি একটু কমিয়ে। রংপুর আর মাত্র দশ মাইল দূরে। বেলা পড়ে আসছে। আকাশের একটা কোণ লাল হয়ে উঠেছে। তার আলোয় আরো কোমল হয়ে উঠেছে জাহেদার মুখ। স্টিয়ারিং-এর ওপর নিজের হাতের শিরাগুলো অনাবশ্যকভাবে পর্যবেক্ষণ করল বাবর কিছুক্ষণ।

তারপর বলল, আর বিয়ে কেন আবিষ্কার করেছে মানুষ জান? তখন বলেছিলাম না, ইকনমিক্স বড় মজার সাবজেক্ট। আমাদের এই জীবনটা কম্পাসের কাটার মত। ইকনমিক্সের পাল্লায় পড়ে বেচারা আর অন্য দিকে মুখ ফেরাতে পারে না। নিজের সম্পত্তি মানুষ এমন একজনকে দিতে চায় যে তার নিজেরই একটা প্রসারিত অস্তিত্ব–অর্থাৎ তার সন্তান। আগে, অনেক আগে আমরা যে যার সঙ্গে মিলিত হতাম। একটা গোষ্ঠীতে যে পুরুষেরা থাকত তারা নিজেদের সব মেয়ের সঙ্গেই সহবাস করতে পারত। মা বাবা ভাই বোন বলে কিছু ছিল না। হয়ত নিজের মেয়ের সঙ্গেই, মায়ের সঙ্গেই, বোনের সঙ্গেই ভাইয়ের সঙ্গেই হচ্ছে। এতে মালিকানার গোলমাল দেখা দিল। মানুষ সভ্য হচ্ছে যে, তাই বুঝতে পারল এভাবে তো চলে না। মানুষের স্বাৰ্থ বুদ্ধি জন্ম নিচ্ছে যে, তাই সে চিন্তিত হয়ে পড়ল, আমার বলে কিছু থাকছে না যে। অতএব একটা নিয়ম কর, আইন কর। বিয়ে আমরা আবিষ্কার করলাম। এখন আর কোনো গোল রইল না, এই আমার সম্পত্তি এই আমার সন্তান–আমার সম্পত্তি পাবে আমার সন্তান-পুরো গোষ্ঠী নয়। বিয়ে আমাদের স্বার্থ রক্ষার একটা আদর্শ ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই নিজের বৌ ফেলে অন্যের বৌয়ের দিকে তাকান পাপ। এক সঙ্গে দশটা মেয়েকে একজন পছন্দ করলে তাকে পশু বলে গাল দিই, দশ জন পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হবে কোনো মেয়ে এ কল্পনা করলেও শিউরে উঠি।–জাহেদা?

হুঁ! কিছু বলছ না।

শুনছি।

বুঝতে পারছ?

কিছু কিছু।

আমার কাছ থেকে শুনে নাও, বয়স হলে তখন নিজেই বুঝতে পারবে, প্রেম বলে কিছু নেই। প্ৰেম একটা অভিনয়। আসলে আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে শুতে চাই। বিশুদ্ধ এবং কেবলমাত্ৰ শয়ন; পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আনন্দ, সম্পূর্ণ তৃপ্তি, চূড়ান্ত উল্লাস এবং নিঃশেষে বিজয় প্রকৃতি একমাত্র সঙ্গমেই দিয়েছে। কে একজন খুব বড় কবি, বলেছিলেন, একটা ভাল কবিতা লিখলে তার যে সুখ হয় তা রতিসুখের তুল্য। আমি বিশ্বাস করি তাকে। আমরা, লক্ষ করে দেখবে, আমাদের সমস্ত সুখানুভূতি ঐ মানদণ্ডে মেপে থাকি। সারারাত কীৰ্তন গেয়ে জিকির করে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের যে চরম সুখ আমরা পেতে চাই তাও ঐ রতিসুখের মানদণ্ডেই বিচাৰ্য। একজন তন্ময় তদগত ঈশ্বর প্রেমিকের মোহাবিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ, যদি বিশ্বাস না হয়। কী? কিছু বল? জাহেদা পথের দিকে তাকিয়ে রইল। বিহবল চোখে। তারপর সেদিকে চোখ রেখেই বলল, হয়ত আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু যা বলছেন, এতে কোনো নিয়ম থাকবে না যে, সব ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি যায়?

জাহেদা বাবরের দিকে তাকাল।

বাবর সময় নিল উত্তর দিতে। তারপর খুব ধীরে ধীরে বলল, যাক। সভ্যতার নামে মানুষ সৌন্দৰ্য সৃষ্টি যেমন করতে চেয়েছে, তেমনি ধ্বংসও করেছে। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে একটু একটু করে অভিনয়ের শিক্ষানবিশী করতে করতে এখন বড় একজন পাকা অভিনেতা হয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য ভুলে গেছে সে। লক্ষ্য ভুলে গেছে। অভিনয়টাই জীবনের সার মনে করেছে। ফলে তার নিজের মুখ বিকৃত থেকে বিকৃততর হচ্ছে। এই বিকৃত মুখ থাকার চেয়ে না থাকলেই ভাল। বন্ধুত্বের নামে শোষণ করছে, মানুষ শান্তির নামে যুদ্ধ, মুক্তির নামে বন্ধন, ধর্মের নামে অন্ধত্ব। আমরা যা ভাবি তা বলি না, যা বলি তা করি না। যা করি তাতে আমাদের মনের সায় নেই। আত্মার যে কণ্ঠ তা আমরা শুনি না। আর কত বলব? আমি একা লড়তে চাই। আর কেউ আমাকে বুঝুক বা না বুঝুক, আমার পক্ষে থাক না থাক, আমাকে পৃথিবীর জঘন্যতম লোক বলে তারা চিহ্নিত করুক, আমি স্বভাবের প্রতিষ্ঠা চাই। আমি বেঁচে থাকতে চাই। বেঁচে থাকার আনন্দ পেতে চাই। প্রতিমুহূর্তে আমি অনুভব করতে চাই আমি বেঁচে আছি।

না না। জাহেদা উদ্বেগভরা গলায় বলে উঠল, আপনাকে কেউ জঘন্য বলছে আমি ভাবতেও পারি না।

তুমি বলবে না?

কখনো না।

বাবর হাসল। বলল, সত্যি?

জাহেদা চোখ নামিয়ে নিল কিন্তু কিছুই বলল না। আর। আস্তে আস্তে হেলান দিয়ে বসল। যেন ভীষণ একটা শারীরিক পরিশ্রমের পর বিশ্রামে আলস্যে শিথিল হয়ে যাচ্ছে সে। বাবর তার হাতে একটা ছোট্ট করে টোকা দিয়ে বলল, দ্যাখ, আমরা রংপুরে এসে গেছি।

Super User