ভবিষ্যৎ
এখনকার সমাজে দাম্পত্য সংঘর্ষের একটা মূল হেতু হল সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত বিলাসের উপকরণ বাহুল্য। মেয়েরাও পিতা মাতার ওপর চাপ সৃষ্টি করে: চাই বহুবিঘোষিত অলংকার, আসবাব, মহার্ঘ্য বৈদ্যুতিক নানা যন্ত্র, যার দ্বারা গৃহকর্মে সময়লাঘব হয়; তা ছাড়াও প্রদর্শন মূল্য আছে এমন বহু সব বস্তু। এসবের সঙ্গে তারা দূরদর্শনের প্রদর্শিত যে সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং অবাঞ্ছনীয় দাম্পত্যের জীবনযাত্রার চিত্র দেখা যায়, যার মধ্যে জীবন সম্বন্ধে কোনও সুস্থ বোধ প্রায়শই অনুপস্থিত, তার দ্বারা প্রভাবিত হয় কিশোর কিশোরী ও তরুণ তরুণীর চিত্ত। প্রায়ই উপকরণ বহুল সুসজ্জিত বাড়ি, বাগান, গাড়ির পরিবেশে শুরু হয় ছবি। ক্ষণে ক্ষণে উদ্দাম যৌন প্রেরণার চমক উত্তেজক বেশোবাসে প্রায় নগ্ন নারীপুরুষের অবাধ দায়িত্ব-বোধহীন নাচে, বোধ বুদ্ধিহীন চটকদার সংলাপে, যথেচ্ছ আচরণে, এবং সম্পূর্ণ জাদুকরী মায়ায় শেষ পর্যন্ত সব আপাত সমস্যার একটা সুরাহা হওয়ার দৃশ্য। এর মধ্যে থাকে প্রচুর ষড়যন্ত্র, আদিম বর্বরতা, হিংস্র আক্রমণ, প্রচুর অস্ত্রের ঝঞ্ছনা; অনিবাৰ্য ভাবে থাকে গুলি, বারুদ, ধর্ষণ ও গুণ্ডামি, বহু কুসংস্কার ও প্রচলিত ধর্মবোধের ও অলৌকিকের উপাদান। এ দৃশ্য দিনের পর দিন দেখার ফলে যে ধরনের স্থায়ী মস্তিষ্কবিকৃতি দর্শকের অবচেতনে সঞ্চারিত ও সঞ্চিত হতে থাকছে, তার একটা ফল জনমানসে অনিবাৰ্য ভাবে দেখা দেবেই।
পাশাপাশি পরিবারে যদি সুস্থ সংস্কৃতির পরিবেশ থাকে, বিদ্যালয়ে ও কর্মস্থলে যদি বিকল্প সংস্কৃতির চর্চার দ্বারা এ সব বিকৃত মানসিকতার সমালোচনায় ছেলেমেয়েরা যোগ দেয়, পৃথিবীর সুস্থ সংস্কৃতি ও সুন্দর ঐতিহ্যের ভাণ্ডার যদি তাদের সামনে উদ্ধারিত করা যায় তা হলে— হয়তো এই আগ্রাসী পণ্যলোভাতুরতা থেকে নিষ্কৃতি মেলে। তা হলে হয়তো, দাম্পত্যে প্রবেশের মুখেই দুটি নরনারী মনের মধ্যে বস্তু ও ভোগের অদম্য বাসনা নিয়ে নবজীবনে প্রবেশ করে না। ইদানীং বহু কর্মক্ষেত্রে পরিশ্রমিক যে রকম অকল্পনীয় ভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে, ব্যবসায়ীর সামনে পৃথিবীর সমস্ত বাজার খুলে যাওয়ার সমৃদ্ধি তথা ভোগ্যপণ্যলাভের যখন কোনও সীমাই আর নেই, তখন মানুষ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত জীবন সম্বন্ধে অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছে। নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যেও অন্ধগলিপথে যে বিপুল পরিমাণে টাকা পুঞ্জিভূত হয়ে কালোবাজারে পৌঁছচ্ছে তাতে সৎ দরিদ্র ব্যক্তিকে ক্রমেই মুখ ও কৃপাপাত্র বলে গণ্য করা হচ্ছে। চোখের জলে এক অতি ধনীর সুন্দরী তরুণী গৃহিণী বলেন, ‘পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে সব রকম কাম্য ভোগ্য পদার্থ এনে দিয়েছে স্বামী, দেয়নি এতটুকু ভালবাসা, মমতা।’
‘ভালবাসা নেই তো এত দামি সব জিনিস আনে কেন?’
‘ওর ঐশ্বর্যের বিজ্ঞাপন। তা ছাড়া, ওর পার্টিতে আমার অঙ্গে এ সব কাপড়-গয়না ওর পদোন্নতির উপায়। ওর সহকমীদের ঈর্ষা উৎপাদন, ওর ওপরওয়ালার উদ্যত কামনা আমার ওপরে। এর নানা পরিণতি হতে পারে; কোনওটাতেই ওর আপত্তি নেই যদি তাতে ওর সামাজিক অধিরোহণের পথটা খুলে যায়।’
‘তোমার কী প্রতিক্রিয়া?’
‘হয়ত লোভে তলিয়ে যার কোনও নরকে। নইলে এই প্রেমহীন কুবেরপুরীতে ঐশ্বৰ্য্যে, সুরায়, উন্মাদনায় ভুলতে চেষ্টা করব যে এটা নরকই।’
এটি একটি বাস্তব সংলাপ এবং এমনি আরও বহু দৃষ্টান্ত বাস্তবে আছে। এমন কথা বা এর প্রতিধ্বনি ইতস্তত মাঝে মাঝেই শোনা যায়। অতিভোগ যে দাম্পত্যকে বিপথে নিয়ে যায়, সুখের বদলে দেয় সম্ভোগ, এ আজ ঘরে ঘরেই দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই শোনা যায়, জীবন যখন একটাই, তখন যতটা ভোগ করে নেওয়া যায়। তার চেষ্টা করতে দোষ কী? দোষ প্রথমত, ওই নগ্ন অতিলুব্ধতা মানুষের কুৎসিত একটি রিপু, যা অশুভ এবং অশুচি। দ্বিতীয়ত, এই লোভের ভোগের আতিশয্যে মানুষ সেই সব কিছুকে হারাতে বসেছে যা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। প্রেম, আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধ, সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য তৎপরতা, নতুন সুন্দর এক পৃথিবী রচনার স্বপ্ন। কুবেরের সাধনা শ্ৰীকে পরাহত করছে, অতিভোগের লালসা দাম্পত্যকে কলুষিত করছে।
চোখের সামনে অতি দ্রুত মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। আজকের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী প্রতিদিনই এই অবনমিত মূল্যবোধের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। প্রচারমাধ্যম যে ঐশ্বর্যের স্বপ্ন ছবির পর্দায় তুলে ধরেছে, এরা এদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে ওই ঐশ্বর্যের মধ্যে কল্পনায় নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে। ফলে বাস্তবে যখন তা সম্ভব হচ্ছে না। তখন দম্পতির জীবনে দেখা দিচ্ছে অন্তঃকলহ, একে অপরকে দোষ দিচ্ছে ওই অবাস্তব স্তরের ঐশ্বৰ্য না পাওয়ার জন্যে। এর জন্যে প্রয়োজন সুস্থ জীবনবোধ, যুক্তিনির্ভর আলোচনা, বাস্তববোধ ও ভোগ্যপণ্যের মাদকতা থেকে আত্মরক্ষা করবার মতো আত্মসংযম। একবার যদি দাঁড়িপাল্লায় তারা মেপে দেখে যে টাকা দিয়ে যা কেনা যায় এমন বস্তুর বিনিময়ে তারা হারাতে বসেছে, টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না। সেই প্ৰেম–তা হলে ঐশ্বর্যের মৃগতৃঞ্চিকার পিছনে ছোেটা থেকে নিজেদের নিবৃত্ত করতে পারে। উপকরণবাহুল্যের মধ্যে যে কুরুচি ও নগ্ন লুব্ধতা আছে তাকে স্বরূপে চিনে তা পাওয়ার উদগ্র বাসনা থেকে মুক্তি পেতে পারে। এ প্রসঙ্গে এত কথা বলার কারণ গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে নতুন নতুন চ্যানেল যুক্ত হচ্ছে এবং সরকার গ্রামে গ্রামে দূরদর্শন পাঠাচ্ছে। বলা বাহুল্য, সরকারের দিক থেকে গণশিক্ষার উদ্দেশ্য এখানে গৌণ, মুখ্য উদ্দেশ্য হল বহুজাতিক সংস্থার অসংখ্য ভোগ্যপণ্য সম্ভারের যে অজস্র সমাবেশ তার জন্য ক্রেতা চাই। দূরদর্শনের দর্শক সেই সম্ভাব্য ক্রেতা। কোনও দম্পতি যদি এই গুঢ় অভিসন্ধি বুঝতে পেরে দুরন্ত লোভ সংবরণ করতে পারে, নিজেদের আয়ের পরিমাপে ক্রয়ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে পরস্পর আলোচনা করে তাহলে বহু অসম্ভব লোভের ও অতৃপ্তির অন্তর্জ্বালা থেকে রক্ষা পায়, তাতে শুধু টাকাই বাঁচে না, বাঁচে দাম্পত্য শান্তি।
দুটি মানুষ, যারা আগামী প্রজন্মের সূচনা করবে নিজেদের সন্তানের মধ্যে দিয়ে, যারা আগামী পৃথিবীকে, অত্যন্ত স্বল্পাংশে হলেও নির্মাণ করবার দায়িত্ব নেয় নিজেদের মিলনের সূত্রে, তারা পরস্পরের কাছে সমকক্ষরূপে প্রতিভাত হলে তবে মিলনে একটি মর্যাদা আসবে যা অন্যথা অসম্ভব। শ্রেয় এবং হেয়, প্রভু এবং ভৃত্য, আজ্ঞাকারী এবং আজ্ঞাবাহীর মধ্যে কোনও সমতা আসা সম্ভব নয়। এবং, সেই কারণেই দায়িত্ব এবং অধিকারের অসম বণ্টন নিয়ে নানা বিপত্তি দেখা দেয়। তখন চুলচেরা হিসেব হতে থাকে দায়িত্ব ও অধিকারের নুন্যতা ও আধিক্য নিয়ে— অশান্তি পরিণত হয় সংঘাতে। কখনও বা সে সংঘাতের সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন ঘটে বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদ সঙ্গে নিয়ে আসে তার বহুতর জটিল অনুষঙ্গ। বিবাহ ব্যাপারটাই যদি প্রেম নির্ভর ও পরস্পরের শ্রদ্ধা বিশ্বাস, মানসিক সৌজন্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তা আইনে নিম্পন্ন হোক, বা অনুষ্ঠানে অথবা সম্পূর্ণ নিরনুষ্ঠান গান্ধৰ্ব্বমিলনের দাম্পত্য হোক, তার নিজস্ব একটি স্থির মহিমায় যে বিরাজিত থাকে। পরিবর্তন, অথবা বিপর্যয় ঘটতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ তা না ঘটে–এবং কখনও কখনও আদৌ তা ঘটে না–ততক্ষণ এমন এক মানবিক সত্যে এর ভিত্তি স্থাপিত থাকে যে নরনারীর মিলনের অন্তর্নিহিত যথার্থ সৌন্দর্য তাকে মূল্যবান করে তোলে। ‘বিবাহ যে রকমই হোক না কেন, এটি একটি উচ্চারিত অথবা অনুচ্চারিত চুক্তি এবং এ চুক্তি আদর্শ ভাবে সফল হত যদি দুটি সম্পূর্ণ স্বনির্ভর মানুষ। শুধুমাত্র পারস্পরিক প্রেমের অনিরুদ্ধ প্রবর্তনায় মিলিত হত।’(১) যতক্ষণ পর্যন্ত এ মিলন সজীব থাকে ততক্ষণ গাৰ্হস্থ্য, আর্থিক সামাজিক বাধায় এর কোনও ক্ষতি হয় না। সমস্যা হয় প্রথমত যখন দুটি মানুষ আস্তর আবেগের প্রবর্তনায় কাছাকাছি আসে না। অথবা জীবনের এই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপটি সম্বন্ধে যখন কতকটা অসহিষ্ণুতা বা চাঞ্চল্য থেকে যায়, ফলে পরস্পরকে চিনবার, জানিবার ও বোঝবার জন্য প্রাথমিক ভাবে যে সময়টুকু দেওয়া দরকার সেটাকে সংক্ষিপ্ত করে কিন্তু পরে পশ্চাত্তাপে শোধ করে অসহিষ্ণুতার এই মূল্য। এ ধরনের পরিণাম এড়ানো যায়–সম্পূর্ণ ভাবে না হলেও অনেকটাই। স্বীকার করাই ভাল যে, প্রথম প্রেম স্বতই দুর্বার, কতকটা বা অন্ধও। ঠিক এই কারণেই একটু সময়, একটু গভীরে চেনাজানা, পরস্পর সম্বন্ধে এবং নিজের আন্তরিক আবেগকেও চেনা ও পরীক্ষা করার ধৈর্যটুকু ওই আবেগনির্ভর গান্ধৰ্ব্বমিলনকেই দীর্ঘ পরমায়ু দিতে পারে। এ-তো প্রেমিকযুগলের স্বার্থেই। প্রেম কিছু আত্মত্যাগের প্রেরণা দেয় যা শুধুমাত্র কর্তব্যবোধ বা পাতিব্রাত্য দিতে পারে না। এইখানেই প্রেমের অপরাজেয় শক্তি, যা মৃত্যুর মতোই অমোঘ। যে বিবাহ বা দাম্পত্য এই প্ৰেম থেকে সঞ্জাত, তার অগ্নিপরীক্ষা নিজের মধ্যেই ঘটে এবং সে পরীক্ষায় জয়ও আসে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে। সে প্রেমে ভয়ের স্থান নেই এবং সেই প্রেমেই গান্ধৰ্ব্বমিলন, বিবাহ বা দাম্পত্যের প্রতিষ্ঠা। প্রেমনির্ভর মিলন ও বিবাহ আনুষ্ঠানিকই হোক বা নিরনুষ্ঠানই হোক, তার ওপরে প্রতিষ্ঠিত যুগলজীবনের দাম্পত্যের যে সুষম ও দীপ্তি তা যুগে যুগে মানুষকে আকর্ষণ করেছে, করবেও। তার কারণ, মানুষ এখনও এর কোনও বিকল্প পায়নি।
——————
১. The deal . would be for entirely self sufficient human beings to form unions one with another only in accordance with the untruncated dictates of their mutual love. The Second Ser, p 490)