ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সুনীল সরকার বোকা বটে‌, কিন্তু বুদ্ধি আছে।’

রমণীবাবু করুণ হাসিয়া বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আমার ধারণা ছিল আমি বুদ্ধিমান‌, কিন্তু সুনীল সরকার আমাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। তার মতলব কিছু বুঝতে পারিনি। হুকুম সিংকে খুন করার অপরাধে তাকে যে ধরব সে উপায় নেই। স্পষ্টতই হুকুম সিং তার বাড়িতে ঢুকে তার স্ত্রীকে খুন করে গায়ের গয়না কেড়ে নিয়েছিল‌, সুতরাং তাকে খুন করার অধিকার সুনীলের ছিল। সে এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে; পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করেছে এবং নিজের দুস্কৃতির একমাত্র শরিককে সরিয়েছে! স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে-ই এখন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী‌, কারণ সেই নিকটতম আত্মীয়। রেবার উইল ছিল না‌, সুনীল আদালতের হুকুম নিয়ে গদীয়ান হয়ে বসেছে।’

‘হঁ’ বলিয়া ব্যোমকেশ চিন্তাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘একটা রাস্তা বার করুন‌, ব্যোমকেশবাবু। যখন ভাবি একজন অতি বড় শয়তান আইনকে কলা দেখিয়ে চিরজীবন মজা লুটবে তখন অসহ্য মনে হয়।’

ব্যোমকেশ মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘রেবা অজিতের লেখা বইগুলো ভালবাসতো?’

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ‌, ব্যোমকেশবাবু। ওদের বাড়ি আমি আগাপাস্তলা সার্চ করেছিলাম; আমার কাজে লাগে এমন তথ্য কিছু পাইনি‌, কিন্তু দেখলাম অজিতবাবুর লেখা আপনার কীর্তিকাহিনী সবগুলিই আছে‌, সবগুলিতে রেবার নাম লেখা। তা থেকে মনে হয়। রেবা আপনার গল্প পড়তে ভালবাসতো।’

ব্যোমকেশ আবার চিন্তামগ্ন হইয়া পড়িল। আমরা সিগারেট ধরাইয়া অপেক্ষা করিয়া রহিলাম। দেখা যাক ব্যোমকেশের মস্তিষ্ক-রূপ গন্ধমাদন হইতে কোন্‌ বিশল্যকরণী দাবাই বাহির হয়।

দশ মিনিট পরে ব্যোমকেশ নড়িয়া-চড়িয়া বসিল। আমরা সাগ্রহে তাহার মুখের পানে চাহিলাম।

সে বলিল‌, রমণীবাবু্‌, ‘রেবার হাতের লেখা যোগাড় করতে পারেন?’

‘হাতের লেখা!’ রমণীবাবু ভ্রূ তুলিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ধরুন‌, তার হিসেবের খাতা‌, কিংবা চিঠির ছেড়া টুকরো।…যাতে বাংলা লেখার ছাঁদটা পাওয়া যায়।’

রমণীবাবু গালে হাত দিয়া চিন্তা করিলেন‌, শেষে বলিলেন‌, ‘চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু মতলবটা কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মতলবটা এই।–রেবা আমার রহস্য-কাহিনী পড়তে ভালবাসতো। সুতরাং অটোগ্রাফের জন্যে আমাকে চিঠি লেখা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। মেয়েদের যে ও দুর্বলতা আছে তার পরিচয় আমরা হামেশাই পেয়ে থাকি। মনে করুন। ছ’মাস আগে রেবা আমাকে চিঠি লিখেছিল; আমার অটোগ্রাফ চেয়েছিল‌, তারপর আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে‌, তার স্বামী তাকে খুন করবার ফন্দি আঁটিছে‌, আমি যদি তার অপঘাত মৃত্যুর খবর পাই তাহলে যেন তদন্তু করি।’

রমণীবাবু গভীরভাবে চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘বুঝেছি। জাল চিঠি তৈরি করবেন, তারপর সেই চিঠি সুনীলকে দেখিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করবেন!’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করব। সুনীল যদি ভয় পেয়ে সত্য কথা বলে ফেলে তবেই তাকে ধরা যেতে পারে।’

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘আমি রেবার হাতের লেখার নমুনা যোগাড় করব। আর কিছু?’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘রেবার নাম-ছাপা চিঠির কাগজ ছিল কি?’

‘ছিল। তাও পাবেন। আর কিছু?’

‘আর-একটা টেপ রেকর্ডিং মেশিন। যদি সুনীল কনফেস করে‌, তার পাকাপাকি রেকর্ড থাকা ভাল।’

‘বেশ। কাল সকালেই আমি আবার আসব।’ বলিয়া রমণীবাবু বিশেষ উত্তেজিতভাবে বিদায় লইলেন।

পরদিন সকালে আমরা সবেমাত্র শয্যাত্যাগ করিয়াছি‌, রমণীবাবু আসিয়া উপস্থিত। তাঁহার হাতে একটি চামড়ার স্যাচেল। হাসিয়া বলিলেন‌, ‘যোগাড় করেছি।’

ব্যোমকেশ তাঁহাকে সিগারেট দিয়া বলিল‌, ‘কি কি যোগাড় করলেন?’

রমণীবাবু স্যাচেল খুলিয়া সন্তৰ্পণে একটি কাগজের টুকরা বাহির করিয়া আমাদের সামনে ধরিলেন, বলিলেন, ‘এই নিন রেবার হাতের লেখা।’

চিঠির কাগজের ছিন্নাংশ‌, তাহাতে বাংলায় কয়েক ছত্র লেখা আছে—‘…স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যদি কর্তব্য না থাকে‌, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য থাকবে কেন? আমরা আধুনিক যুগের মানুষ‌, সেকেলে সংস্কার আঁকড়ে থাকার মানে হয় না…’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘এই রেবার হাতের লেখা! দস্তখত নেই দেখছি। কোথায় পেলেন?’

রমণীবাবু স্যাচেল হইতে এক তা সাদা চিঠির কাগজ লইয়া বলিলেন‌, ‘আর এই নিন রেবার নাম-ছাপা সাদা চিঠির কাগজ। কাল রাত্রে এখান থেকে বেরিয়ে সটান সুনীলের বাড়িতে গিয়েছিলাম; তাকে সোজাসুজি বললাম‌, তোমার বাড়ি আর একবার খুঁজে দেখব। সে আপত্তি করল না।–কেমন‌, যা যোগাড় করেছি তাতে চলবে তো?’

ব্যোমকেশ ছেঁড়া চিঠির টুক্‌রা পর্যবেক্ষণ করিতে করিতে বলিল, ‘চলবে। রেবার হাতের লেখা নকল করা শক্ত হবে না। যারা রবীন্দ্রীয় ছাঁদের নকল করে তাদের লেখা নকল করা সহজ।–টেপ-রেকর্ডার পেয়েছেন?’

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘পেয়েছি। যখন বলবেন তখনই এনে হাজির করব।–তাহলে শুভকর্মের দিন স্থির কবে করছেন?’

ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল‌, ‘আজই হোক না‌, শুভস্য শীঘ্রম। আমি সুনীলকে একটা চিঠি দিচ্ছি‌, সেটা আপনি কারুর হাতে পাঠিয়ে দেবেন।’

একটা সাধারণ প্যাডের কাগজে ব্যোমকেশ চিঠি লিখিল—

শ্ৰীসুনীল সরকার বরাবরেষু—
আপনার স্ত্রীর সহিত পত্রযোগে আমার পরিচয় হইয়াছিল; তিনি মৎ-সংক্রান্ত কাহিনী পড়িতে ভালবাসিতেন। শুনিলাম তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। শুনিয়া দুঃখিত হইয়াছি।
আমি কয়েকদিন যাবৎ এখানে আসিয়া ডাকবাংলোতে আছি। আপনি যদি আজ সন্ধ্যা সাতটার সময় ডাকবাংলোতে আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করেন‌, আপনার স্ত্রী আমাকে যে শেষ চিঠিখনি লিখিয়াছিলেন‌, তাহা আপনাকে দেখাইতে পারি। চিঠিখনি আপনার পক্ষে গুরুত্রপূর্ণ।
নিবেদন ইতি-ব্যোমকেশ বক্সী।

চিঠি খামে ভরিয়া ব্যোমকেশ রমণীবাবুর হাতে দিল। তিনি বলিলেন‌, ‘আচ্ছা‌, এখন উঠি। চিঠিখানি এমনভাবে পাঠাব যাতে সুনীল বুঝতে না পারে যে‌, পুলিসের সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক আছে। দুপুরবেলা টেপ-রেকর্ডার নিয়ে আসছি।’

তিনি প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ রেবার চিঠি লইয়া বসিল; নানাভাবে তাহার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিতে লাগিল; আলোর সামনে তুলিয়া ধরিয়া কাগজ দেখিল‌, ছিন্ন অংশের কিনারা পর্যবেক্ষণ করিল। তারপর সিগারেট ধরাইয়া টানিতে লাগিল।

বলিলাম‌, ‘কি দেখলে?’

ব্যোমকেশ ঊর্ধ্বদিকে ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল‌, ‘চিঠিখানা আস্ত ছিল‌, সম্প্রতি ছেড়া হয়েছে। চিঠির ল্যাজা-মুড়ো কোথায় গেল। তাই ভাবছি।’

আমিও ভাবিলাম। তারপর বলিলাম‌, ‘রেবা হয়তো নিজের কোন বান্ধবীকে চিঠিখানা লিখেছিল‌, রমণীবাবু তার কাছ থেকে আদায় করেছেন। বান্ধবী হয়তো নিজের নাম গোপন রাখতে চায়—’

‘হতে পারে‌, অসম্ভব নয়। রেবার বান্ধবী হয়তো রমণীবাবুকে শর্ত করিয়ে নিয়েছে যে‌, তার নাম প্রকাশ পাবে না। তাই রমণীবাবু আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন-যাক‌, এবার জালিয়াতির হাতে-খড়ি হোক। অজিত‌, কাগজ-কলম দাও।’

অতঃপর দুঘণ্টা ধরিয়া ব্যোমকেশ রেবার হাতের লেখা মক্স করিল। শেষে আসল ও নকল আমাকে দিয়া বলিল‌, ‘দেখ দেখি কেমন হয়েছে। অবশ্য নাম-দস্তখতটা আন্দাজে করতে হল‌, একটা নমুনা পেলে ভাল হত। কিন্তু এতেই চলবে বোধ হয়।’

রেবার চিঠি ও ব্যোমকেশের খসড়া পাশাপাশি রাখিয়া দেখিলাম‌, লেখার ছাঁদে তফাত নাই; সাধারণ লোকের কাছে ব্যোমকেশের লেখা স্বচ্ছন্দে রেবার লেখা বলিয়া চালানো যায়। বলিলাম, ‘চলবে।’

ব্যোমকেশ তখন সযত্নে চিঠি লিখিতে বসিল। রেবার নাম-ছাপা কাগজে ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ ধরিয়া লিখিল। চিঠি এইরূপ—

মাননীয়েষু‌,
ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনার চিঠি আর অটোগ্রাফ পেয়ে কত আনন্দ হয়েছে বলতে পারি না। আমার মত গুণগ্ৰাহী পাঠক আপনার অনেক আছে‌, নিশ্চয় আপনাকে অটোগ্রাফের জন্য বিরক্ত করে। তবু আপনি যে আমাকে দু’ ছত্র চিঠিও লিখেছেন সেজন্যে অশেষ ধন্যবাদ। আপনার অটোগ্রাফ আমি সযত্নে আমার খাতায় গেঁথে রাখলুম।
আপনার সহৃদয়তায় সাহস পেয়ে আমি নিজের কথা কিছু লিখছি। —
আমার স্বামী বিষয়বুদ্ধিহীন এবং মন্দ চরিত্রের লোক‌, তাই আমার শ্বশুর মৃত্যুকালে তাঁর বিষয়সম্পত্তি সমস্ত আমার নামে উইল করে গিয়েছেন। সম্পত্তি প্রচুর‌, এবং আমি তাতে আমার স্বামীকে হাত দিতে দিই না। আমার সন্দেহ হয় আমার স্বামী আমাকে খুন করবার মতলব আঁটছেন; বোধ হয় গুণ্ডা লাগিয়েছেন। কি হবে জানি না। কিন্তু আপনি যদি হঠাৎ আমার অপঘাত মৃত্যুর সংবাদ পান তাহলে দয়া করে একটু খোঁজখবর নেবেন। আপনি সত্যান্বেষী‌, অসহায়া নারীর মৃত্যুতে কখনই চুপ করে থাকতে পারবেন না।
আমার প্রণাম নেবেন।
ইতি—বিনীত
রেবা সরকার

চিঠিখানি ভাঁজ করিয়া ব্যোমকেশ একটি পুরানো খামের মধ্যে ভরিয়া রাখিল।

বেলা তিনটার সময় রমণীবাবু আসিলেন‌, সঙ্গে একজন ছোকরা পুলিস। সে রেডিও মিস্ত্রী; তাহার হাতে টেপ-রেকর্ডারের বাক্স এবং মাইক ইত্যাদি যন্ত্রপাতি।

রমণীবাবু ব্যোমকেশের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া মিস্ত্রীকে বলিলেন‌, ‘বীরেন‌, তাহলে তুমি লেগে যাও।’

‘আজ্ঞে স্যার’ বলিয়া বীরেন লাগিয়া গেল।

বসিবার ঘরে টেবিলের মাথায় যে ঝোলানো বৈদ্যুতিক আলোটা ছিল তাহার তারে মাইক লাগানো হইল‌, টেপ-রেকডার যন্ত্রটা বসানো হইল ব্যোমকেশের শয়ন ঘরে। রেকড়ার চালু হইলে একটু শব্দ হয়‌, যন্ত্রটা অন্য ঘরে থাকিলে যন্ত্রের শব্দ বসিবার ঘরে শোনা যাইবে না।

সব ঠিকঠাক হইলে বীরেন পাশের ঘরে গিয়া দ্বার বন্ধ করিল। আমরা বসিবার ঘরে টেবিলের পাশে বসিয়া সহজ গলায় কথাবার্তা বলিলাম; তারপর পাশের ঘরে গেলাম। বীরেন যন্ত্রের ফিতা উল্টাদিকে ঘুরাইয়া আবার চালু করিল‌, তখন আমরা নিজেদের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। বেশ স্পষ্ট আওয়াজ‌, কোনটা কাহার গলা চিনিতে কষ্ট হয় না।

ব্যোমকেশ সস্তুষ্ট হইয়া বলিল‌, ‘চলবে।–চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন?’

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘দিয়েছি। আসবে নিশ্চয়। যার মনে পাপ আছে‌, ও চিঠি পাবার পর তাকে আসতেই হবে। আপনি তাকে ব্ল্যাকমেল করতে চান। কিনা সেটা সে জানতে চাইবে। আচ্ছা‌, আমরা এখন যাই‌, আবার সন্ধ্যের পর আসব।’

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়