সকালে ব্যোমকেশকে রাত্রির ঘটনা বলিলাম। সে চুপ করিয়া শুনিল‌, কোনও মন্তব্য করিল না।

একজন কনস্টেবল একটা চিঠি দিয়া গেল। ডি.এস.পি‌, পাণ্ডের চিঠি‌, আগের দিন সন্ধ্যা ছ’টার তারিখ। চিঠিতে মাত্র কয়েক ছত্র লেখা ছিল–

প্রিয় ব্যোমকেশবাবু্‌,

ডেপুটি সাহেবের আলমারি খুলিয়া দেখা গেল কিছু চুরি যায় নাই। আপনি বলিয়াছিলেন পরীকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে‌, কিন্তু পরী এখনও নিরুদ্দেশ। চোরেরও কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। আপনি জানিতে চাহিয়াছিলেন। তাই লিখিলাম। ইতি—

পুরন্দর পাণ্ডে

ব্যোমকেশ চিঠিখানা পকেটে রাখিয়া বলিল‌, ‘পাণ্ডে লোকটি সত্যিকার সজ্জন।’

এই সময় যিনি সবেগে আসিয়া উপস্থিত হইলেন তিনি ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার। মহীধর বাবুর পাটির পর রাস্তায় নকুলেশবাবুর সহিত দু’একবার দেখা হইয়াছিল। তিনি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বলিলেন‌, ‘এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম‌, ভাবলাম খবরটা দিয়ে যাই। শোনেননি। নিশ্চয়ই? ফাল্গুনী পাল-সেই যে ছবি আঁকত—সে মহীধরবাবুর বাগানে কুয়োয় ডুবে মরেছে।’

কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া রহিলাম। তারপর ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কখন এ ব্যাপার হল?’

নকুলেশ বলিলেন‌, ‘বোধ হয় কাল রাত্তিরে‌, ঠিক জানি না। মাতাল দাঁতাল লোক‌, অন্ধকারে তাল সামলাতে পারেনি‌, পড়েছে কুয়োয়। আজ সকালে আমি মহীধরবাবুর খবর নিতে গিয়েছিলাম‌, দেখি মালীরা কুয়ো থেকে লাস তুলছে।’

আমরা নীরবে পরস্পর পরস্পরের মুখের পানে চাহিলাম। কাল রাত্রে মহীধরবাবুর বাগানে বহু বিচিত্র ব্যাপার ঘটিয়াছে।

‘আচ্ছা‌, আজ তাহলে উঠি; আমাকে আবার ক্যামেরা নিয়ে ফিরে যেতে হবে–।’ বলিয়া নকুলেশবাবু উঠিবার উপক্ৰম করিলেন।

‘বসুন বসুন‌, চা খেয়ে যান।’

নকুলেশ চায়ের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারিলেন না‌, বসিলেন। অচিরাৎ চা আসিয়া পড়িল। দুচার কথার পর ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘সেই গ্রুপ-ফটোর নেগেটিভখানা খুঁজেছিলেন কি?’

‘কোন নেগেটিভ? ও-হ্যাঁ‌, অনেক খুঁজেছি মশাই‌, পাওয়া গেল না। —আমার লোকসানের বরাত; থাকলে আরও পাঁচখানা বিক্রি হত।’

‘আচ্ছা‌, সেই ফটোতে কে কে ছিল বলুন দেখি?’

‘কে কে ছিল? পিকনিকে গিয়েছিলাম ধরুন–আমি‌, মহীধরবাবু্‌, তাঁর মেয়ে রজনী‌, ডাক্তার ঘটক‌, সস্ত্রীক প্রোফেসর সোম‌, সপরিবারে ডেপুটি ঊষানাথবাবু আর ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমরেশ রাহা। সকলেই ফটোতে ছিলেন। ফটোখানা ভারি উৎরে গিয়েছিল–গ্রুপ-ফটো অত ভাল খুব একটা হয় না। আচ্ছা‌, চলি তাহলে। আর একদিন আসিব।’

নকুলেশবাবু প্ৰস্থান করিলেন। দু’জনে কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলাম। ফাল্গুনীর কথা ভাবিয়া মনটা ভারী হইয়া উঠিল। সে নেশাখোর লক্ষ্মীছাড়া ছিল‌, কিন্তু ভগবান তাহাকে প্রতিভা দিয়াছিলেন। এমনভাবে অপঘাত মৃত্যুই যদি তাহার নিয়তি‌, তবে তাহাকে প্রতিভা দিবার কি প্রয়োজন ছিল?

ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; বলিল‌, ‘এ সম্ভাবনা আমার মনেই আসেনি। চল‌, বেরুনো যাক।’

‘কোথায় যাবে?’

‘ব্যাঙ্কে যাব। কিছু টাকা বের করতে হবে।’

এখানে আসিয়া স্থানীয় ব্যাঙ্কে কিছু টাকা জমা রাখা হইয়াছিল‌, সংসার-খরচের প্রয়োজন অনুসারে বাহির করা হইত।

আমরা সদর বারান্দায় বাহির হইয়াছি‌, দেখিলাম অধ্যাপক সোম ড্রেসিং-গাউন পরিহিত অবস্থায় নামিয়া আসিতেছেন। তাঁহার মুখে উদ্বিগ্ন গান্তীর্য। ব্যোমকেশ সম্ভাষণ করিল‌, ‘কি খবর?’

সোম বলিলেন‌, ‘খবর ভাল নয়। স্ত্রীর অসুখ খুব বেড়েছে। বোধহয় নিউমোনিয়া। জ্বর বেড়েছে; মাঝে মাঝে ভুল বকছেন মনে হল।’

আশ্চর্য নয়। কাল রাত্রে সর্দির উপর ঠাণ্ডা লাগিয়াছে। কিন্তু সোম বোধ হয় তাহা জানেন না। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ডাক্তার ঘটককে খবর দিয়েছেন?’

ডাক্তার ঘটকের নামে সোমের মুখ অন্ধকার হইল। তিনি বলিলেন‌, ‘ঘটককে ডাকব না। আমি অন্য ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছি।’

ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ চক্ষে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘কোন? ডাক্তার ঘটকের ওপর কি আপনার বিশ্বাস নেই? আমি যখন প্রথম এসেছিলাম তখন কিন্তু আপনি ঘটককেই সুপারিশ করেছিলেন।’

সোম ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ করিয়া নীরব রহিলেন। ব্যোমকেশ তখন বলিল‌, ‘সে যাক! এই মাত্র খবর পেলাম ফাল্গুনী পাল কাল রাত্রে মহীধরবাবুর কুয়োয় ডুবে মারা গেছে।’

সোম বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিলেন না‌, বলিলেন‌, ‘তাই নাকি। হয়তো আত্মহত্যা করেছে। আর্টিস্টরা একটু অব্যবস্থিতচিত্ত হয়—’

ব্যোমকেশ বন্দুকের গুলির মত প্রশ্ন করিল‌, ‘প্রোফেসর সোম‌, কাল রাত্রি এগারোটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?’

সোম চমকিয়া উঠিলেন‌, তাঁহার মুখ পাংশু হইয়া গেল। তিনি স্বলিতস্বরে বলিলেন‌, ‘আমি–আমি! কে বললে আমি কোথাও গিয়েছিলাম? আমি তো—’

হাত তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মিছে কথা বলে লাভ নেই। প্রোফেসর সোম‌, আপনার স্ত্রীর যে আজ বাড়াবাড়ি হয়েছে তার জন্যে আপনি দায়ী। তিনি কাল আপনার পেছনে পেছনে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। এই রোগে যদি তাঁর মৃত্যু হয়—’

ভয়-বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া সোম বলিলেন‌, ‘আমার স্ত্রী–ব্যোমকেশবাবু্‌, বিশ্বাস করুন‌, আমি জানি না—’

ব্যোমকেশ তর্জনী তুলিয়া ভয়ঙ্কর গভীর স্বরে বলিল‌, ‘কিন্তু আমরা জানি। আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী‌, তাই সতর্ক করে দিচ্ছি। আপনি সাবধানে থাকবেন। এস অজিত।’

সোম স্তম্ভের মত দাঁড়াইয়া রহিলেন‌, আমরা বাহির হইয়া পড়িলাম। রাস্তায় কিছু দূর গিয়া ‘ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সোমকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছি।’ তারপর ঘড়ি দেখিয়া বলিল‌, ‘ব্যাঙ্ক খুলতে এখনও দেরি আছে। চল‌, ঘটকের ডিসপেন্সারিতে একবার ঢুঁ মেরে যাই।’

বাজারের দিকে ডাক্তারের ঔষধালয়। আমরা ডাক্তারের ঘরে প্রবেশ করিতে যাইব‌, শুনিলাম সে একজনকে বলিতেছে‌, ‘দেখুন‌, আপনার ছেলের টাইফয়েড হয়েছে; লম্বা কেস‌, সারাতে সময় লাগবে! আমি এখন লম্বা কেস হাতে নিতে পারব না। আপনি বরং শ্ৰীধরবাবুর কাছে যান—তিনি প্ৰবীণ ডাক্তার–’

আমরা প্রবেশ করিলাম‌, অন্য লোকটি চলিয়া গেল। ডাক্তার সানন্দে আমাদের অভ্যর্থনা করিল। বলিল‌, ‘আসুন আসুন। রোগী যখন সশরীরে ডাক্তারের বাড়িতে আসে তখন বুঝতে হবে রোগ সেরেছে। মহীধরবাবু সেদিন আমাকে ঘোড়ার ডাক্তার বলেছিলেন। এখন আপনিই বলুন‌, আমি মানুষের ডাক্তার কিংবা আপনি ঘোড়া!’—বলিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিল। ডাক্তারের মন আজ ভারি প্রফুল্ল; চোখে আনন্দের জ্যোতি।

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘আপনি মানুষের ডাক্তার এই কথা স্বীকার করে নেওয়াই আমার পক্ষে সম্মানজনক। মহীধরবাবু কেমন আছেন?’

ডাক্তার বলিল‌, ‘অনেকটা ভাল। প্ৰায় সেরে উঠেছেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ফাল্গুনী পাল মারা গেছে শুনেছেন কি?’

ডাক্তার চকিত হইয়া বলিল‌, ‘সেই চিত্রকর। কি হয়েছিল তার?’

কিছু হয়নি। কাল রাত্রে জলে ডুবে মারা গেছে।–ব্যোমকেশ যতটুকু জানিত সংক্ষেপে বলিল।

ডাক্তার কিছুক্ষণ বিমনা হইয়া রহিল‌, তারপর বলিল‌, ‘আমার যাওয়া উচিত। মহীধরবাবুর দুর্বল শরীর–। যাই‌, একবার চট্‌ করে ঘুরে আসি।’ ডাক্তার উঠিয়া দাঁড়াইল।

ব্যোমকেশ সহসা জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনি কলকাতা যাচ্ছেন কবে?’

ডাক্তারের মুখের ভাব সহসা পরিবর্তিত হইল; সে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে ব্যোমকেশের চোখের মধ্যে চাহিয়া বলিল‌, ‘আমি কলকাতা যাচ্ছি কে বললে আপনাকে?’

ব্যোমকেশ কেবল মৃদু হাসিল। ডাক্তার তখন বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, শীগগিরই একবার যাবার ইচ্ছে আছে। আচ্ছা‌, চললাম। যদি সময় পাই ওবেলা আপনাদের বাড়িতে যাব।’

ডাক্তার ক্ষুদ্র মোটরে চড়িয়া চলিয়া গেল। আমরা ব্যাঙ্কের দিকে চলিলাম। পথে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘ডাক্তার কলকাতা যাচ্ছে জানলে কি করে? তুমি কি আজকাল অন্তর্যামী হয়েছ নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না। কিন্তু একজন ডাক্তার যখন বলে লম্বা কেস হাতে নেব না‌, অন্য ডাক্তারের কাছে যাও‌, তখন আন্দাজ করা যেতে পারে যে সে বাইরে যাবে।’

‘কিন্তু কলকাতায়ই যাবে তার নিশ্চয়তা কি?’

‘ওটা ডাক্তারের প্রফুল্লতা থেকে অনুমান করলাম।’

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়