দলপতির সুদৃশ্য ঘরটিতে নরম আরামদায়ক চেয়ারে টুকি এবং ঝ হেলান দিয়ে বসে আছে। সামনে কালো গ্রানাইটের টেবিল, তার অন্য পাশে বিদ্রোহীদের দলপতি, পাশে কয়েকজন বিশ্বাসী জেনারেল। সবার সামনে পানীয় এবং খাবার। দলপতি পানীয়ের একটা গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, আমাদের মহান অতিথিদের উদ্দেশ্যে। ফেডারেশানের সবচেয়ে বড় যুদ্ধে আমাদের জয়ী করিয়ে দেয়ায় তাদের অভূতপূর্ব কৃতিত্বের জন্যে।

সবাই বলল, অভূতপূর্ব কৃতিত্বের জন্যে।

পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জেনারেল কাওয়াগাতা বলল, আমি যদি নিজের চোখে না দেখতাম তাহলে বিশ্বাস করতাম না। এটি ছিল আমার দেখা সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী যুদ্ধ।

ছোট ছোট চুলের একজন জেনারেল মাথা নেড়ে বলল, সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। মূল কম্পিউটারে কোন তথ্য না দিয়ে আমাদের এই মহামান্য মোটা বিজ্ঞানী সেখানে একটা লাথি দিলেন। তার গোদা পায়ের লাথি খেয়ে মাল্টিপ্রসেসর খুলে পুরো সিস্টেম রিসেট হয়ে গেল। সে কারণে শত্রুদের মহাকাশযান আমাদের প্রধান ঘাঁটির খোঁজ পেল না। কেউ কী চিন্তা করতে পারে একটা বড় ধরনের যুদ্ধ হচ্ছে মূল কম্পিউটারকে অচল রেখে?

বুড়োমত একজন জেনারেল বলল, যখন ভয়েস কমান্ড ব্যবহার করার কথা তখন সেখানে কণ্ঠস্বরে কোন আদেশ না দিয়ে বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্ৰাউল মানুষ যেভাবে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠে ঠিক সেরকম শব্দ করতে শুরু করলেন। তখন পুরো ভয়েস কমান্ড সিস্টেম ধসে পড়ল। আর ঠিক তখন কন্ট্রোল মনিটরে একটা ঘুষি দিলেন, কী অপূর্ব সময়জ্ঞান! সাথে সাথে স্কাউটশীপ থেকে দুইটা মিসাইল বের হয়ে এল। নিখুত নিশানায় গিয়ে আঘাত করল ফেডারেশনের যুদ্ধ জাহাজকে।

জেনারেল কাওয়াগাতা বলল, কী-বোর্ডে কোন তথ্য না দিয়ে সেখানে ক্রমাগত থাবড়া দিতে লাগলেন। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল অর্থহীন কাজ। কিন্তু সেটা অর্থহীন নয় সেই থাবড়া খেয়ে কম্পিউটার জ্যাম হয়ে গিয়ে তিনটা নিউক্লিয়ার বোমা ছেড়ে দিল!

আমাদের এক স্কোয়াড্রন স্কাউটশীপ যখন উড়ে যাচ্ছিল তখন কন্ট্রোল রুম থেকে সাহায্য চাইল। কো-অর্ডিনেট না বলে তাদেরকে বললেন গোল্লায় যাও। তার অর্থ বৃত্তাকারে ঘুরতে থাক। বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে মূল মহাকাশযানকে আওতার মাঝে পেয়ে গেল।

আর মাইজার কন্ট্রোলের ঘটনাটা–

দলপতি হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এই দুই মহান বিজ্ঞানীর কথা বলে শেষ করা যাবে বলে মনে হয় না। তার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমাদের মস্তবড় সৌভাগ্য তারা যুদ্ধ পরিচালনায় আমাদেরকে সহযোগিতা করতে রাজী হয়েছিলেন। আমি তাদেরকে অবিশ্বাস করেছিলাম সে জন্যে ক্ষমা চাইছি।

টুকি এবং ঝা মৃদু হেসে ক্ষমা করে দেবার ভঙ্গী করল।

জেনারেল কাওয়াগাতা গম্ভীর মুখে বলল, বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্রাউলের কাছে থেকে আমাদের পুরো যুদ্ধ পরিচালনার নিয়ম-কানুন শিখে নিতে হবে।

দলপতি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

সবই দলপতির দিকে ঘুরে তাকাল কী আইডিয়া?

আমাদের য়ুতে মাত্র দুইজন অস্ত্রবিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্ৰাউল থাকার কারণেই অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। বিদ্রোহী দল হিসেবে আমাদের সবসময় যুদ্ধ করতে হয়। যদি দুজন না হয়ে দুইশ অস্ত্রবিজ্ঞানী হত? কিংবা দুই হাজার? কিংবা আরো বেশি?

বুড়োমত জেনারেল চোখ বড় বড় করে বলল, আপনি কী বলতে চাইছেন?

আমি এই বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্রাউলের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে তাদের বিদ্যাবুদ্ধি দক্ষতা আমাদের সকল সদস্যদের মাথায় বসিয়ে দিতে চাই। তারা সবাই যেন বিজ্ঞানী রিচি এবং ফ্রাউলের মত ভাবতে পারে, চিন্তা করতে পারে।

উপস্থিত জেনারেলরা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, চমক্কার বুদ্ধি! চমৎকার আইডিয়া!!

টুকি এবং ঝায়ের চোয়াল স্কুলে পড়ল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, সবাই আমাদের দুজনের মত হয়ে যাবে?

হ্যাঁ! আমরা গত যুদ্ধে মস্তিষ্ক স্ক্যানের এই যন্ত্রটি দখল করেছি। এটা ব্যবহার করে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান, বুদ্ধি আরেকজন মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। আপনাদের জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তাধারা ব্যক্তিত্ব সব আরেকজনের মাথায় নিয়ে যাব। যারা শুকনো পাতলা তারা পাবে বিজ্ঞানী রিচির মস্তিষ্ক যারা মোটা তারা পাবে বিজ্ঞানী ফ্রাউলের মস্তিষ্ক।

টুকি এবং ঝা খানিকক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলল, সবাই?

হ্যাঁ! আমি ছাড়া সবাই। প্রথমে জেনারেলেরা তারপর সিনিয়র সদস্যরা। তারপর সাধারণ সদস্যরা। দেরী করে লাভ নেই, এখন থেকেই শুরু করে দেয়া যাক।

 

দুই সপ্তাহ পরে যখন টুকি এবং ঝা তাদের মহাকাশযান বোঝাই করে এই গ্রহের প্রস্তর খণ্ড নিয়ে—যাকে সাধারণভাবে হীরা বলা হয়—মহাকাশের উদ্দেশ্যে। রওনা দিল তখন বিদায় জানানোর জন্যে মহাকাশ স্টেশনে এই গ্রহের প্রায় সবাই এসে ভীড় জমিয়েছিল। ঠিক বিদায়ের সময় এই গ্রহের সব অধিবাসীরা কেন মুচকি হেসে টুকি এবং ঝায়ের দিকে চোখ টিপে দিল বিদ্রোহী দলের দলপতি সেটা কিছুতেই বুঝতে পারল না। শুধু তাই নয়, যে দুর্ধর্ষ দলটিকে পুরো এম। সেভেন্টিওয়ান নক্ষত্রপুঞ্জের ত্রাস হিসেবে বিবেচনা করা হত তারা ঠিক কী কারণে যুদ্ধ বিগ্রহ ছেড়ে দিয়ে নিরীহ ছিচকে চোর হয়ে গেল, বিদ্রোহী দলের দলপতি সেই রহস্যটিও কোনদিন ভেদ করতে পারল না।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল