বাসায় ফিরে এসে তিতুনি ছটফট করতে থাকল, ব্যাপারটা কাউকে বলা দরকার, কাকে বলবে? টোটনকে বলার প্রশ্নই আসে না, প্রথমত সে এটা বিশ্বাসই করবে না, তাকে নিয়ে টিটকারি করতে করতে বারোটা বাজিয়ে দেবে। যদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করানো যায় তাহলে সেটা হবে আরো ভয়ংকর। তাহলে খুঁজে পেতে এলিয়েন মেয়েটাকে বের করে তাকে ধরে এনে ঘরের মাঝে বন্ধ করে দুনিয়ার যত লোক আছে তাদেরকে ডেকে আনবে মজা দেখার জন্যে। দুই টাকা করে টিকিট লাগিয়ে কিছু টাকা কামাই করে ফেলবে। তিতুনির উপরে তার যত রাগ সব ঝাড়বে এই এলিয়েন মেয়েটার উপরে।

তাহলে বাকি রইল আব্বু আর আম্মু। ঠিক তিতুনির মতো দেখতে একটা এলিয়েন মেয়ে এসেছে সেটা আম্মুকে বোঝানোই যাবে না। বাসার পিছনে জঙ্গলে নিয়ে যদি সেই গর্তটা দেখানো যায় তাহলে হয়তো বিশ্বাস করবেন এখানে কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু এখান থেকে আরেকটা তিতুনি বের হয়ে এসেছে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করানো যাবে না। যদি সে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করে তাহলে আম্মু হয়তো তাকে ধরে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করিয়ে লবণ পানি খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে রাখবেন। শুধু তা-ই না, তার হয়তো বাসার পিছনে জঙ্গলে যাওয়াটাই বন্ধ হয়ে যাবে। আব্বকে যদি বলার চেষ্টা করে তাহলে আবু হয়তো পুরোটা শুনবেন, শুনে বলবেন, “ভেরি গুড তিতুনি। খুবই চমৎকার একটা গল্প তৈরি করেছ। এখন গল্পটা প্রথমে বাংলায় লিখে ফেলো। তারপর সেটাকে ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করে ফেলো।”

তাদেরকে বিশ্বাস করানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে এলিয়েন মেয়েটাকে বাসায় নিয়ে আসা-নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস করবেন কিন্তু সেটা হবে খুবই ভয়ংকর। আম্মু একটা টিকটিকি দেখলেই চিৎকার করতে থাকেন, একবার বাসায় একটা ঢ়োঁড়া সাপ ঢুকে গিয়েছিল, সেটা দেখে প্রায় ফিট হয়ে গিয়েছিলেন। তিতুনির পাশে আরেকটা তিতুনি দেখলে তার কী অবস্থা হবে কে জানে। নির্ঘাত দাঁতে দাঁত লেগে ফিট হয়ে যাবেন। কে জানে হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। আব্বুর অবস্থা আরো খারাপ-আব্বু ভাব দেখান তার সাহস বেশি মাথা ঠাণ্ডা কিন্তু আসলে সেটা সত্যি না, আব্বু আরো বেশি ভীতু। একটা-দুইটা তেলাপোকা দেখলেই আঁৎকে ওঠেন। রাতে যদি শেয়াল ডাকে আব্বু ভয় ভয় চোখে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকেন। তিতুনির পাশে আরেকটা তিতুনি দেখলে আব্বুর খবর হয়ে যাবে। এলিয়েন তিতুনির সাথে সাথে আসল তিতুনিকেই ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যাবেন। তাই কাউকেই এলিয়েন তিতুনির খবর বলা যাবে না। এলিয়েন তিতুনি তার গ্যালাক্সিতে ফিরে যাবার পরও বলা যাবে–কেউ তো বিশ্বাসই করবে না, ধরে নেবে তিতুনির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

কাজেই তিতুনি কাউকেই কিছু বলল না। কিন্তু কাউকে কিছু না বললেও সে সারাটি দিনই ছটফট করে বেড়াল। তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটা কোথায় গিয়েছে কে জানে? একা একা আবার কোনো বিপদে না পড়ে যায়। তিতুনি যে ছটফট করছিল সেটা প্রথমে লক্ষ করলেন আম্মু। বিকালের দিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর হয়েছেটা কী?”

তিতুনি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “কিছু হয় নাই, কিছু হয় নাই।”

“তাহলে এ রকম করছিস কেন?”

“কী রকম করছি?”

“ছটফট ছটফট করছিস-একবার ঘরে আসিস একবার বের হোস। একবার ছাদে যাস আবার নিচে নামিস। দুপুরে খেলি না পর্যন্ত ঠিক করে।”

তিতুনি দুর্বল গলায় বলল, “খেয়েছি তো।”

“বল ঠিক করে তোর কী হয়েছে?”

“কিছু হয় নাই আম্মু।”

টোটন কাছাকাছি ছিল, সে বলল, “তিতুনিকে চোখে চোখে রাখা দরকার। নিশ্চয়ই কিছু একটা বদ মতলব আছে।”

অন্য সময় হলে তিতুনি টোটনের এই কথার উত্তরে কিছু একটা বলত, কিন্তু এখন সে কিছুই বলল না, টোটনের দিকে তাকাল কিন্তু টোটনকে দেখল বলেই মনে হলো না।

আম্মু তখন নরম গলায় বললেন, “সকালে তোকে বকেছি বলে মন খারাপ করে আছিস?”

তিতুনি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না আম্মু, আমার বেশিক্ষণ মন খারাপ থাকে না।”

“তাহলে?”

“কিছু না আম্মু, কিছু না।” বলে তিতুনি সরে গেল।

সন্ধ্যের ঠিক আগে আগে তিতুনি বাসার পিছনে সেই গর্তটার কাছে গেল, গাছে কিছু পাখি কিচমিচ করছে কিন্তু আর কেউ নেই। গর্তটার ভেতরেও একবার উঁকি দিল, সেখানেও কেউ নেই। তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা পৃথিবী ঘুরতে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। হয়তো তার পৃথিবী দেখা শেষ হয়েছে, হয়তো তার গ্যালাক্সিতে ফিরে গেছে।

.

রাত্রে খাওয়া শেষ করে তিতুনি তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে। এই বাসায় তার আলাদা একটা ঘর আছে-ঘরটা ছোট, একটা বিছানা আর ছোট একটা পড়ার টেবিল ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই, তার পরও এটা তিতুনির খুব প্রিয় একটা জায়গা, তার কারণ ঘরটা তার নিজের, তার চেয়ে বড় কথা ঘরটার মাঝে একটা জানালা আছে, সেই জানালা দিয়ে তিতুনি বাইরে তাকাতে পারে। যখন তার মন খারাপ হয় তখন এই জানালা দিয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজকে ঠিক মন খারাপ নেই কিন্তু ভেতরে একধরনের উত্তেজনা, তাই সে অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

তিতুনি মশারি টানিয়ে শুতে যাবার সময় হঠাৎ শুনতে পেল দরজায় কেউ বেল বাজিয়েছে। এত রাতে কে আসতে পারে তিতুনি আন্দাজ করতে পারল না, তাই কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। শুনল আব্বু বলছেন, “টোটন দেখ দেখি এত রাতে কে এসেছে।”

টোটন নাক দিয়ে বিরক্তির মতো একটা শব্দ করল। তারপর গিয়ে দরজা খুলল, তিতুনি শুনল দরজা খুলেই টোটন বিচিত্র একটা শব্দ করে বলল, “আরে, তিতুনি? তুই? তুই বাইরে?”

আসল তিতুনির হাত-পা হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল-এলিয়েন তিতুনি এসেছে। তাকে না করে দেওয়ার পরও সে এসেছে। সর্বনাশ! এখন কী হবে?

তিতুনি দরজায় কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করল।

টোটনের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে এলিয়েন তিতুনি ঘরে ঢুকে গেল। টোটন তখন আরো জোরে চিৎকার করে বলল, “কী হলো কথা বলিস না কেন?”

এলিয়েন তিতুনি কথা না বলে টোটনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করল। টোটন রেগেমেগে চিৎকার করে বলল, “আম্মু দেখো, তিতুনি আমাকে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে।”

আম্মু এসে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোকে না তোর ঘরে যেতে দেখলাম! তুই আবার বাইরে গেলি কখন?”

এলিয়েন তিতুনি (যদিও সে আসল তিতুনি না কিন্তু কারো পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না)-বলল, “এই তো একটু আগে। তোমাদের সবার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম।”

আম্মু বললেন, “খেয়াল করিনি।”

এলিয়েন তিতুনি বলল, “আমি জানি। এই বাসায় আমাকে কেউ খেয়াল করে না। আমি আছি কী নেই তাতে কারো কিছু আসে-যায় না।”

নিজের ঘরের দরজায় কান পেতে আসল তিতুনি অবাক হয়ে শুনল এলিয়েন তিতুনি গলার স্বরে একধরনের অভিমানের সুর ফুটিয়ে তুলেছে এবং সেটা শুনে আম্মু পর্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছেন।

তিতুনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “পাগলি মেয়ে, কে বলেছে। তোকে আমরা কেউ খেয়াল করি না? সকালে তোকে বকাবকি বেশি করেছি সেই জন্যে এখনো আমার উপর রাগ করে আছিস?”

এলিয়েন তিতুনি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না আম্মু, আমি রাগ করি না। এই বাসায় আমি কে? আমি কার উপরে রাগ করব? মাঝে মাঝে একটু দুঃখ পাই কিন্তু কখনো রাগ করি না।”

গলার স্বরে এতই গভীর বেদনা যে আম্মুর চোখে একেবারে পানি এসে গেল, এলিয়েন তিতুনিকে একেবারে বুকে চেপে ধরে বললেন, “ছিঃ তিতুনি। মায়ের উপর রাগ করতে হয় না। ছিঃ মা!”

অন্য-তিতুনি কিছু বলল না, কখনো কখনো কথা না বলাটাই কথা বলা থেকে বেশি কাজে দেয়। এবারেও কাজে দিল, আম্মুর চোখে আগেই পানি চলে এসেছিল, এবারে একেবারে গলা ভেঙে গেল। ভাঙা গলায় বললেন, “বল মা, কেন তুই এত রাতে বাসা থেকে বের হয়েছিলি?”

অন্য-তিতুনি কথা বলল না। “আমার উপর রাগ করে বের হয়ে গিয়েছিলি?”

এলিয়েন তিতুনি এবারেও কথা বলল না, মাথাটা আরো নিচু করল। আম্মু তিতুনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আর কখনো এ রকম পাগলামি করবি না। ঠিক আছে?”

এলিয়েন তিতুনি মাথা নাড়ল। আম্মু তখন অন্য-তিতুনিকে ছেড়ে দিলেন। অন্য-তিতুনি হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল। টোটন গজগজ করতে করতে অন্য-তিতুনির দিতে তাকিয়ে বলল, “বেশি আদর দিয়ে তোর মাথা নষ্ট করা হয়েছে আর কিছু না। আমি একেবারে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুই সামনে দিয়ে যাসনি, গেলে আমি দেখতাম।”

অন্য-তিতুনি বলল, “আমি তাহলে কোন দিক দিয়ে গিয়েছি?”

“নিশ্চয়ই জানালা দিয়ে বের হয়েছিলি। তোর ঘরে জানালার শিক নিশ্চয়ই তুই খুলে রেখেছিস।”

অন্য-তিতুনি দাঁত বের করে হাসল, সেটা দেখে টোটন গরম হয়ে বলল, “খবরদার, মুখ ভ্যাংচাবি না।”

“আমি মুখ ভ্যাংচাচ্ছি না, তোমার কথা শুনে হাসছি।”

এলিয়েন তিতুনি তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যখন দরজা ধাক্কা দিল তখন হঠাৎ করে আসল তিতুনির মনে পড়ল সে দরজাটার ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেছে। দরজাটা যে ভেতর থেকে বন্ধ সেটা সাথে সাথে টোটনের চোখে পড়েছে। সে চিৎকার করে বলল, “মিথ্যুক। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, তুই বের হলি কেমন করে?”

ঘরের ভেতর থেকে ছিটকিনি খুলে আসল তিতুনি সরে যেতে চাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই টোটন লাথি দিয়ে দরজা খুলে ফেলেছে। টোটন দেখল খোলা দরজার সামনে ঘরের ভেতর একজন তিতুনি আর দরজার বাইরে আরেকজন।

টোটন গগনবিদারি একটা চিৎকার দিয়ে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ছুটে যেতে গিয়ে ঘরের সামনেই আছাড় খেয়ে পড়ল।

সেই আছাড় খাওয়ার শব্দে মনে হয় পুরো বাসা কেঁপে উঠল।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল