[মেমফিস্‌ শহরে ১৮৯৪ খ্রীঃ ২১ জানুআরী প্রদত্ত; ‘অ্যাপীল অ্যাভালাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত।]

স্বামী বিবে কানন্দ গত রাত্রে ‘ইয়ং মেন‍্‍স্ হিব্রু এসোসিয়েশন হল’-এ ‘তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্ব’ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিয়াছেন। এখানে তিনি যতগুলি ভাষণ দিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে এইটি উৎকৃষ্ট। এই সুপণ্ডিত ভদ্রমহোদয়ের প্রতি এই শহরের অধিবাসীবৃন্দের শ্রদ্ধা এই বক্তৃতাটি দ্বারা নিঃসন্দেহে অনেক বাড়িয়াছে। এ পর্যন্ত বিবে কানন্দ কোন না কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উপকারের জন্য বক্তৃতা করিয়াছেন। ঐ-সকল প্রতিষ্ঠান যে তাঁহার নিকট আর্থিক সহায়তা পাইয়াছে তাহাও ঠিক। গত রাত্রের বক্তৃতার দর্শনী কিন্তু তাঁহার নিজের কাজের জন্য। এই বক্তৃতাটির পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থা করেন বিবে কানন্দের বিশিষ্ট বন্ধু ও ভক্ত মিঃ হিউ এল ব্রিঙ্কলী। এই প্রাচ্যদেশীয় মনীষীর শেষ বক্তৃতা শুনিতে গত রাত্রিতে প্রায় দুইশত শ্রোতার সমাগম হইয়াছিল।

বক্তা তাঁহার বক্তব্য বিষয় সম্বন্ধে প্রথমে এই প্রশ্নটি তুলেনঃ ধর্মের নানা মতবাদ সত্ত্বেও ধর্মে ধর্মে কি বাস্তবিকই খুব পার্থক্য আছে? বক্তার মতেঃ না, বর্তমান যুগে বিশেষ পার্থক্য আর নাই। তিনি সকল ধর্মের ক্রমবিকাশ আদিম কাল হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত অনুসরণ করিয়া দেখান যে, আদিম মানুষ অবশ্য ঈশ্বর সম্বন্ধে নানা প্রকারের ধারণা পোষণ করিত, কিন্তু মানুষের নৈতিক ও মানসিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর-ধারণার এই-সকল বিভিন্নতা ক্রমশঃ কমিয়া আসিতে থাকে এবং অবশেষে উহা একেবারেই মিলাইয়া যায়। বর্তমানে শুধু একটি মত সর্বত্র প্রবল—ঈশ্বরের নির্বিশেষ অস্তিত্ব।

বক্তা বলেনঃ এমন কোন বর্বর জাতি নাই, যাহারা কোন না কোন দেবতায় বিশ্বাস না করে। উহাদের মধ্যে প্রেমের ভাব খুব বলবান্ নয়, বরং উহারা জীবন যাপন করে ভয়ের পটভূমিতে। তাহাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন কল্পনায় একটি ঘোর বিদ্বেষপরায়ণ ‘দেবতা’ খাড়া হয়। এই ‘দেবতা’র ভয়ে তাহারা সর্বদাই কম্পমান। তাহার নিজের যাহা ভাল লাগে, ঐ দেবতারও তাহা ভাল লাগিবে, সে ধরিয়া লয়। সে নিজে যাহা পাইয়া সুখী হয়, সে ভাবে—উহা দেবতারও ক্রোধ শান্ত করিবে। স্বজাতীয়ের বিরুদ্ধতা করিয়াও সে এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য চেষ্টা করে।

বক্তা ঐতিহাসিক তথ্য দ্বারা প্রমাণ করেনঃ অসভ্য মানুষ পিতৃপুরুষের পূজা হইতে হাতীদের পূজায় পৌঁছায় এবং পরে

বজ্র এবং ঝড়ের দেবতা প্রভৃতি নানা দেবতার উপাসনায়। এই অবস্থায় মানুষের ধর্ম ছিল বহুদেববাদ। বিবে কানন্দ বলেনঃ ‘সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য, সূর্যাস্তের চমৎকারিতা, নক্ষত্রখচিত আকাশের রহস্যময় দৃশ্য এবং বজ্র ও বিদ্যুতের অদ্ভুত অলৌকিকতা আদিম মানুষের মনে একটি গভীর আবেশ সৃষ্টি করিয়াছিল, যাহা সে ব্যাখ্যা করিতে পারে নাই। ফলে চোখের সম্মুখে উপস্থিত প্রকৃতির এইসব বিশাল ঘটনার নিয়ামক একজন উচ্চতর এবং মহাশক্তিমান্ কেহ আছেন—এই ধারণাই তাহার হৃদয়ে সঞ্চারিত হইয়াছিল।’

ইহার পর আসিল আর একটি পর্যায়—একেশ্বরবাদের কাল। বিভিন্ন দেবতারা অদৃশ্য হইয়া একটি মাত্র সত্তায় মিশিয়া গেলেন—দেবতার দেবতা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বরে। ইহার পর বক্তা আর্যজাতিকে এই পর্যায় পর্যন্ত অনুসরণ করিলেন। এই পর্যায়ে তত্ত্বজিজ্ঞাসুর কথা হইল—‘আমরা ঈশ্বরের সত্তায় বাঁচিয়া আছি, তাঁহারই মধ্যে চলিতেছি ফিরিতেছি। তিনিই গতিস্বরূপ।’ ইহার পর আর একটি কাল আসিল, দর্শনশাস্ত্রে যাহাকে সর্বেশ্বরবাদের কাল বলা হয়। আর্যজাতি বহুদেবতাবাদ, একেশ্বরবাদ এবং বিশ্বজগৎই ঈশ্বর—সর্বেশ্বরবাদের এই মতও প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন, ‘আমার অন্তরাত্মাই একমাত্র সত্য। আমার প্রকৃতি হইল সত্তাস্বরূপ, যত কিছু বিস্তৃতি, তাহা আমাতেই।’

বিবে কানন্দ অতঃপর বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গে আসেন। তিনি বলেন যে, বৌদ্ধেরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নাই, অস্বীকারও করে নাই। উপদেশ প্রার্থনা করিলে বুদ্ধ শুধু বলিতেন, ‘দুঃখ তো দেখিতে পাইতেছ; বরং উহা হ্রাস করিবার চেষ্টা কর।’ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর কাছে দুঃখ সর্বদাই বিদ্যমান।

বক্তা বলেন, মুসলমানরা হিব্রুদের ‘প্রাচীন সমাচার’ এবং খ্রীষ্টানদের ‘নূতন সমাচার’ বিশ্বাস করেন, তবে তাঁহারা খ্রীষ্টানদের পছন্দ করেন না, কেননা তাঁহাদের ধারণা যে, খ্রীষ্টানরা প্রাচীন ধর্মমতের বিরোধিতা করেন এবং মানুষ-পূজা শিক্ষা দেন। মহম্মদ তাঁহার মতানুবর্তীদের তাঁহার নিজের কোন ছবি রাখিতে নিষেধ করিয়াছিলেন।

বক্তা বলেনঃ এখন এই প্রশ্ন উঠে যে, এই-সকল বিভিন্ন ধর্মের সবগুলিই কি সত্য, না কতকগুলি খাঁটি, আর বাকীগুলি ভুয়া? সব ধর্মই একটি সিদ্ধান্তে আসিয়া পৌঁছিয়াছে—একটি চরম অনন্ত সত্তার অস্তিত্ব। ধর্মের লক্ষ্য হইল একত্ব। আমরা যে চারি পাশে ঘটনারাশির বৈচিত্র্য দেখি, উহারা একত্বেরই অনন্ত অভিব্যক্তি। ধর্মসমূহকে যদি তলাইয়া বিশ্লেষণ করা যায়, তাহা হইলে দেখিতে পাওয়া যাইবে, মানুষের অভিযান—মিথ্যা হইতে সত্যে নয়, নিম্নতর সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে।

ধরুন জনৈক ব্যক্তি একটি মাত্র মাপের জামা লইয়া অনেকগুলি লোকের কাছে বিক্রয় করিতে আসিয়াছে। কেহ কেহ বলিল, ঐ জামা তাহাদের গায়ে লাগিবে না। তখন লোকটি উত্তর করিল, তাহা হইলে তোমরা বিদায় হও,

জামা পরিয়া কাজ নাই। কোন পাদ্রীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, যে-সব (খ্রীষ্টান) সম্প্রদায় তাঁহার মতবাদ ও বিশ্বাসগুলি মানে না, তাহাদের কি ব্যবস্থা হইবে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘ওঃ, উহারা খ্রীষ্টানই নয়।’ কিন্তু ইহা অপেক্ষা ভাল উপদেশও সম্ভব। আমাদের নিজেদের প্রকৃতি, পরস্পরের প্রতি প্রেম এবং বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ—এইগুলি হইতে আমরা প্রশস্ততর শিক্ষা পাই। নদীর বুকে যে জলস্রোতের আবর্ত, ঐগুলি যেমন নদীর প্রাণের পরিচায়ক, ঐগুলি না থাকিলে নদী যেমন মরিয়া যায়, সেইরূপ ধর্মকে বেড়িয়া নানা বিশ্বাস ও মত ধর্মের অন্তর্নিহিত শক্তিরই ইঙ্গিত। এই মতবৈচিত্র্য যদি ঘুচিয়া যায়, তাহা হইলে ধর্মচিন্তারও মরণ ঘটিবে। গতি আবশ্যক। চিন্তা হইল মনের গতি, এই গতি থামিয়া যাওয়া মৃত্যুর সূচনা।

একটি বুদ্বুদকে যদি এক গ্লাস জলের তলদেশে আটকাইয়া রাখ, উহা তৎক্ষণাৎ উপরের অনন্ত বায়ুমণ্ডলে যোগ দিবার জন্য আন্দোলন শুরু করিবে। জীবাত্মা সম্বন্ধে এই একই কথা। উহা ভৌতিক দেহ থেকে মুক্তি লাভ করিতে এবং নিজের শুদ্ধ স্বভাব ফিরিয়া পাইতে অনবরত চেষ্টা করিতেছে। উহার আকাঙ্ক্ষা হইল স্বকীয় বাধাহীন অনন্ত বিস্তার পুনরায় লাভ করা। আত্মার এই প্রচেষ্টা সর্বত্রই সমান। খ্রীষ্টান বল, বৌদ্ধ বল, মুসলমান বল, অথবা সংশয়বাদী কিম্বা ধর্মযাজকই বল, প্রত্যেকের মধ্যে জীবাত্মা এই মুক্তির প্রয়াসে তৎপর। মনে কর, একটি নদী হাজার মাইল আঁকাবাঁকা পার্বত্য পথ কত কষ্টে অতিক্রম করিয়া অবশেষে সমুদ্রে পড়িয়াছে, আর একজন মানুষ ঐ সঙ্গমস্থলে দাঁড়াইয়া নদীকে আদেশ করিতেছেঃ হে নদী, তোমার উৎপত্তি স্থলে ফিরিয়া যাও এবং নূতন একটি সিধা রাস্তা ধরিয়া সাগরে এস। এই মানুষটি কি নির্বোধ নয়? য়াহুদী তুমি, তুমি হইলে জাইঅন (Zion) শৈল হইতে নিঃসৃত একটি নদী। কিন্তু আমি, আমি নামিয়া আসিতেছি উত্তুঙ্গ হিমালয় শৃঙ্গ হইতে। আমি তোমাকে বলিতে পারি না—যাও, তুমি ফিরিয়া যাও, তুমি ভুল পথ ধরিয়াছ। আমার পথে পুনরায় বহিয়া এস। এইরূপ উক্তি বোকামী ছাড়া বিষম ভুলও। নিজের বিশ্বাস আঁকড়াইয়া থাক। সত্য কখনও বিলুপ্ত হয় না। পুঁথিপত্র নষ্ট হইতে পারে, জাতিসমূহও সংঘর্ষে নিশ্চিহ্ন হইতে পারে, কিন্তু সত্য বাঁচিয়া থাকে। পরে কোন মানুষ আসিয়া উহাকে আবিষ্কার করে এবং উহা সমাজে পুনঃ প্রবর্তিত হয়। ইহা হইতে প্রমাণিত হয়, ভগবান কী চমৎকার রীতিতে তাঁহার অতীন্দ্রিয় জ্ঞান অনবরত মানুষের কাছে অভিব্যক্ত করিতেছেন!

<

Swami Vivekananda ।। স্বামী বিবেকানন্দ