বিজ্ঞপ্তিএই গ্রন্থের অধিকাংশই গানে রচিত এবং সে গান নাচের উপযোগী। এ কথা মনে রাখা কর্তব্য যে, এই-জাতীয় রচনায় স্বভাবতই সুর ভাষাকে বহুদূর অতিক্রম ক’রে থাকে, এই কারণে সুরের সঙ্গ না পেলে এর বাক্য এবং ছন্দ পঙ্গু হয়ে থাকে। কাব্য-আবৃত্তির আদর্শে এই শ্রেণীর রচনা বিচার্য নয়। যে পাখির প্রধান বাহন পাখা, মাটির উপরে চলার সময় তার অপটুতা অনেক সময় হাস্যকর বোধ হয়। ভূমিকা প্রভাতের আদিম আভাস অরুণবর্ণ আভার আবরণে। এই তত্ত্বটি চিত্রাঙ্গদা নাট্যের মর্মকথা। দৃশ্য | |
মণিপুর-অরণ্য মণিপুর-প্রাসাদ | |
পাত্র | |
চিত্রাঙ্গদা | |
মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। তৎসত্ত্বেও যখন রাজকুলে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হল তখন রাজা তাঁকে পুত্ররূপেই পালন করলেন। রাজকন্যা অভ্যাস করলেন ধনুর্বিদ্যা; শিক্ষা করলেন যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি। অর্জুন দ্বাদশবর্ষব্যাপী ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ ক’রে ভ্রমণ করতে করতে এসেছেন মণিপুরে। তখন এই নাটকের আখ্যান আরম্ভ। | |
মোহিনী মায়া এল, এল যৌবনকুঞ্জবনে। এল হৃদয়শিকারে, এল গোপন পদসঞ্চারে, এল স্বর্ণকিরণবিজড়িত অন্ধকারে। পাতিল ইন্দ্রজালের ফাঁসি, হাওয়ায় হাওয়ায় ছায়ায় ছায়ায় বাজায় বাঁশি। করে বীরের বীর্য-পরীক্ষা, হানে সাধুর সাধনদীক্ষা, সর্বনাশের বেড়াজাল বেষ্টিল চারি ধারে। এসো সুন্দর নিরলংকার, এসো সত্য নিরহংকার– স্বপ্নের দুর্গ হানো, আনো মুক্তি আনো, ছলনার বন্ধন ছেদি এসো পৌরুষ-উদ্ধারে॥ | |
১ | |
প্রথম দৃশ্যে চিত্রাঙ্গদার শিকার আয়োজন | |
গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে পর্বতশিখরে, অরণ্যে তমশ্ছায়া। মুখর নির্ঝরকলকল্লোলে ব্যাধের চরণধ্বনি শুনিতে না পায় ভীরু হরিণদম্পতি। চিত্রব্যাঘ্র পদনখচিহ্নরেখাশ্রেণী রেখে গেছে ওই পথপঙ্ক-‘পরে, দিয়ে গেছে পদে পদে গুহার সন্ধান। | |
বনপথে অর্জুন নিদ্রিত শিকারের বাধা মনে করে চিত্রাঙ্গদার সখী তাঁকে তাড়না করলে | |
অর্জুন। | অহো কী দুঃসহ স্পর্ধা, অর্জুনে যে করে অশ্রদ্ধা কোথা তার আশ্রয়! |
চিত্রাঙ্গদা। | অর্জুন! তুমি অর্জুন! বালকবেশীদের দেখে সকৌতুক অবজ্ঞায় |
অর্জুন। | হাহা হাহা হাহা হাহা, বালকের দল, মা’র কোলে যাও চলে, নাই ভয়। অহো কী অদ্ভুত কৌতুক! [প্রস্থান |
চিত্রাঙ্গদা। | অর্জুন! তুমি! অর্জুন! ফিরে এসো, ফিরে এসো, ক্ষমা দিয়ে কোরো না অসম্মান, যুদ্ধে করো আহ্বান! বীর-হাতে মৃত্যুর গৌরব করি যেন অনুভব– অর্জুন! তুমি অর্জুন! হা হতভাগিনী, এ কী অভ্যর্থনা মহতের |
সখীগণ। | বেলা যায় বহিয়া, দাও কহিয়া কোন্ বনে যাব শিকারে। কাজল মেঘে সজল বায়ে হরিণ ছুটে বেণুবনচ্ছায়ে। |
চিত্রাঙ্গদা। | থাক্ থাক্ মিছে কেন এই খেলা আর। জীবনে হল বিতৃষ্ণা, আপনার ‘পরে ধিক্কার। আত্ম-উদ্দীপনার গান ওরে ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার |
সখী। | সখী, কী দেখা দেখিলে তুমি! এক পলকের আঘাতেই খসিল কি আপন পুরানো পরিচয়। রবিকরপাতে কোরকের আবরণ টুটি মাধবী কি প্রথম চিনিল আপনারে। |
চিত্রাঙ্গদা। | বঁধু, কোন্ আলো লাগল চোখে! বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে! ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি, ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে, জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে। অস্ফুটমঞ্জরী কুঞ্জবনে, সংগীতশূন্য বিষণ্ন মনে সঙ্গীরিক্ত চিরদুঃখরাতি পোহাব কি নির্জনে শয়ন পাতি! সুন্দর হে, সুন্দর হে, বরমাল্যখানি তব আনো বহে, অবগুণ্ঠনছায়া ঘুচায়ে দিয়ে হেরো লজ্জিত স্মিতমুখ শুভ আলোকে॥ |
[প্রস্থান | |
বন্য অনুচরদের সঙ্গে অর্জুনের প্রবেশ ও নৃত্য | |
২ | |
সখীদের গান | |
যাও যদি যাও তবে তোমায় ফিরিতে হবে। ব্যর্থ চোখের জলে আমি লুটাব না ধূলিতলে, বাতি নিবায়ে যাব না যাব না মোর জীবনের উৎসবে। মোর সাধনা ভীরু নহে, শক্তি আমার হবে মুক্ত দ্বার যদি রুদ্ধ রহে। বিমুখ মুহূর্তেরে করি না ভয়– হবে জয়, হবে জয়, হবে জয়, দিনে দিনে হৃদয়ের গ্রন্থি তব খুলিব প্রেমের গৌরবে॥ | |
সখীসহ স্নানে আগমন | |
চিত্রাঙ্গদা। | শুনি ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে অতল জলের আহ্বান। মন রয় না, রয় না, রয় না ঘরে, চঞ্চল প্রাণ। ভাসায়ে দিব আপনারে, ভরা জোয়ারে, সকল ভাবনা-ডুবানো ধারায় করিব স্নান। ব্যর্থ বাসনার দাহ হবে নির্বাণ। ঢেউ দিয়েছে জলে। ঢেউ দিল আমার মর্মতলে। এ কী ব্যাকুলতা আজি আকাশে, এই বাতাসে যেন উতলা অপ্সরীর উত্তরীয় করে রোমাঞ্চ দান, দূর সিন্ধুতীরে কার মঞ্জীরে গুঞ্জরতান॥ সখীদের প্রতি দে তোরা আমায় নূতন ক’রে দে |
সখীগণ। | বাজুক প্রেমের মায়ামন্ত্রে পুলকিত প্রাণের বীণাযন্ত্রে চিরসুন্দরের অভিবন্দনা। আনন্দচঞ্চল নৃত্য অঙ্গে অঙ্গে বহে যাক হিল্লোলে হিল্লোলে, যৌবন পাক সম্মান বাঞ্ছিতসম্মিলনে॥ [সকলের প্রস্থান অর্জুনের প্রবেশ ও ধ্যানে উপবেশন তাঁকে প্রদক্ষিণ ক’রে চিত্রাঙ্গদার নৃত্য |
চিত্রাঙ্গদা। | আমি তোমারে করিব নিবেদন আমার হৃদয় প্রাণ মন! |
অর্জুন। | ক্ষমা করো আমায়, বরণযোগ্য নহি বরাঙ্গনে, ব্রহ্মচারী ব্রতধারী। [প্রস্থান |
চিত্রাঙ্গদা। | হায় হায়, নারীরে করেছি ব্যর্থ দীর্ঘকাল জীবনে আমার। ধিক্ ধনুঃশর! ধিক্ বাহুবল! মুহূর্তের অশ্রুবন্যাবেগে ভাসায়ে দিল যে মোর পৌরুষসাধনা। অকৃতার্থ যৌবনের দীর্ঘশ্বাসে বসন্তেরে করিল ব্যাকুল॥ — রোদন-ভরা এ বসন্ত |
সখীগণ। | তোমার বৈশাখে ছিল প্রখর রৌদ্রের জ্বালা, কখন্ বাদল আনে আষাঢ়ের পালা, হায় হায় হায়। |
চিত্রাঙ্গদা। | কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা সেজেছে পরিয়া নব পত্রালিকা, সারা দিন-রজনী অনিমিখা কার পথ চেয়ে জাগে। |
সখীগণ। | কঠিন পাষাণে কেমনে গোপনে ছিল, সহসা ঝরনা নামিল অশ্রুঢালা। হায় হায় হায়। |
চিত্রাঙ্গদা। | দক্ষিণসমীরে দূর গগনে একেলা বিরহী গাহে বুঝি গো। কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত আবরণবন্ধন ছিঁড়িতে চাহে। |
সখীগণ। | মৃগয়া করিতে বাহির হল যে বনে মৃগী হয়ে শেষে এল কি অবলা বালা। হায় হায় হায়। |
চিত্রাঙ্গদা। | আমি এ প্রাণের রুদ্ধ দ্বারে ব্যাকুল কর হানি বারে বারে, দেওয়া হল না যে আপনারে এই ব্যথা মনে লাগে॥ |
সখীগণ। | যে ছিল আপন শক্তির অভিমানে কার পায়ে আনে হার মানিবার ডালা। হায় হায় হায়। |
একজন সখী। | ব্রহ্মচর্য! পুরুষের স্পর্ধা এ যে! নারীর এ পরাভবে লজ্জা পাবে বিশ্বের রমণী। পঞ্চশর, তোমারি এ পরাজয়। জাগো হে অতনু, সখীরে বিজয়দূতী করো তব, নিরস্ত্র নারীর অস্ত্র দাও তারে, দাও তারে অবলার বল। মদনকে চিত্রাঙ্গদার পূজানিবেদন |
চিত্রাঙ্গদা। | আমার এই রিক্ত ডালি দিব তোমারি পায়ে। দিব কাঙালিনীর আঁচল তোমার পথে পথে বিছায়ে। যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু তারি ফুলে ফুলে হে অতনু, আমার পূজা-নিবেদনের দৈন্য দিয়ো ঘুচায়ে। তোমার রণজয়ের অভিযানে আমায় নিয়ো, ফুলবাণের টিকা আমার ভালে এঁকে দিয়ো! আমার শূন্যতা দাও যদি সুধায় ভরি দিব তোমার জয়ধ্বনি ঘোষণ করি; ফাল্গুনের আহ্বান জাগাও আমার কায়ে দক্ষিণবায়ে॥ মদনের প্রবেশ |
মদন। | মণিপুরনৃপদুহিতা তোমারে চিনি, তাপসিনী। মোর পূজায় তব ছিল না মন, তবে কেন অকারণ মোর দ্বারে এলে তরুণী, কহো কহো শুনি॥ |
চিত্রাঙ্গদা। | পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা লভি নাই মনোহরণের দীক্ষা– কুসুমধনু, অপমানে লাঞ্ছিত তরুণ তনু। অর্জুন ব্রহ্মচারী মোর মুখে হেরিল না নারী, ফিরাইল, গেল ফিরে। দয়া করো অভাগীরে– শুধু এক বরষের জন্যে পুষ্পলাবণ্যে মোর দেহ পাক্ তব স্বর্গের মূল্য মর্তে অতুল্য॥ |
মদন। | তাই আমি দিনু বর, কটাক্ষে রবে তব পঞ্চম শর, মম পঞ্চম শর– দিবে মন মোহি, নারীবিদ্রোহী সন্ন্যাসীরে পাবে অচিরে, বন্দী করিবে ভুজপাশে বিদ্রূপহাসে। মণিপুররাজকন্যা কান্তহৃদয়-বিজয়ে হবে ধন্যা॥ |
৩ | |
নূতনরূপপ্রাপ্ত চিত্রাঙ্গদা | |
চিত্রাঙ্গদা। | এ কী দেখি! এ কে এল মোর দেহে পূর্ব-ইতিহাসহারা! আমি কোন্ গত জনমের স্বপ্ন; বিশ্বের অপরিচিত আমি। আমি নহি রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা, আমি শুধু এক রাত্রে ফোটা অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল, এক প্রভাতের শুধু পরমায়ু, তার পরে ধূলিশয্যা, তার পরে ধরণীর চির-অবহেলা। সরোবরতীরে আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি। মীনকেতু, স্বপ্নমদির নেশায় মেশা এ উন্মত্ততা, [প্রস্থান এরে ক্ষমা কোরো সখা, অর্জুনের প্রবেশ |
অর্জুন। | কাহারে হেরিলাম! সে কি সত্য, সে কি মায়া, সে কি কায়া, সে কি সুবর্ণকিরণে রঞ্জিত ছায়া! চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ এসো এসো যে হও সে হও, |
চিত্রাঙ্গদা। | তুমি অতিথি, অতিথি আমার। বলো কোন্ নামে করি সৎকার। |
অর্জুন। | পাণ্ডব আমি অর্জুন গাণ্ডীবধন্বা নৃপতিকন্যা। লহো মোর খ্যাতি, লহো মোর কীর্তি, লহো পৌরুষ-গর্ব। লহো আমার সর্ব॥ |
চিত্রাঙ্গদা। | কোন্ ছলনা এ যে নিয়েছে আকার, এর কাছে মানিবে কি হার। ধিক্ ধিক্ ধিক্। বীর তুমি বিশ্বজয়ী, নারী এ যে মায়াময়ী, পিঞ্জর রচিবে কি এ মরীচিকার। ধিক্ ধিক্ ধিক্। লজ্জা, লজ্জা, হায় এ কী লজ্জা, মিথ্যা রূপ মোর, মিথ্যা সজ্জা। এ যে মিছে স্বপ্নের স্বর্গ, এ যে শুধু ক্ষণিকের অর্ঘ্য, এই কি তোমার উপহার। ধিক্ ধিক্ ধিক্! |
অর্জুন। | হে সুন্দরী, উন্মথিত যৌবন আমার সন্ন্যাসীর ব্রতবন্ধ দিল ছিন্ন করি। পৌরুষের সে অধৈর্য তাহারে গৌরব মানি আমি। আমি তো আচারভীরু নারী নহি, শাস্ত্রবাক্যে বাঁধা। এসো সখী, দুঃসাহসী প্রেম বহন করুক আমাদের অজানার পথে। |
চিত্রাঙ্গদা। | তবে তাই হোক। কিন্তু মনে রেখো, কিংশুকদলের প্রান্তে এই যে দুলিছে একটু শিশির– তুমি যারে করিছ কামনা সে এমনি শিশিরের কণা নিমিষের সোহাগিনী। — কোন্ দেবতা সে, কী পরিহাসে |
অর্জুন। | আজ মোরে সপ্তলোক স্বপ্ন মনে হয়। শুধু একা পূর্ণ তুমি, সর্ব তুমি, বিশ্ববিধাতার গর্ব তুমি, অক্ষয়-ঐশ্বর্য তুমি, এক নারী সকল দৈন্যের তুমি মহা অবসান, সব সাধনার তুমি শেষ পরিণাম। |
চিত্রাঙ্গদা। | সে আমি যে আমি নই, আমি নই– হায়, পার্থ হায়, সে যে কোন্ দেবের ছলনা। যাও যাও ফিরে যাও, ফিরে যাও, বীর। শৌর্য বীর্য মহত্ত্ব তোমার দিয়ো না মিথ্যার পায়ে– যাও যাও ফিরে যাও। [প্রস্থান |
অর্জুন। | এ কী তৃষ্ণা, এ কী দাহ! এ যে অগ্নিলতা, পাকে পাকে ঘেরিয়াছে তৃষ্ণার্ত কম্পিত প্রাণ। উত্তপ্ত হৃদয় ছুটিয়া আসিতে চাহে সর্বাঙ্গ টুটিয়া। — অশান্তি আজ হানল এ কী দহনজ্বালা। |
৪ | |
মদন ও চিত্রাঙ্গদা | |
চিত্রাঙ্গদা। | ভস্মে ঢাকে ক্লান্ত হুতাশন; এ খেলা খেলাবে, হে ভগবন, আর কতখন। শেষ যাহা হবেই হবে, তারে সহজে হতে দাও শেষ। সুন্দর যাক রেখে স্বপ্নের রেশ। জীর্ণ কোরো না, কোরো না, যা ছিল নূতন। |
মদন। | না না না, সখী, ভয় নেই, ভয় নেই– ফুল যবে সাঙ্গ করে খেলা ফল ধরে সেই। হর্ষ-অচেতন বর্ষ রেখে যাক মন্ত্রস্পর্শ নবতর ছন্দস্পন্দন॥ [ প্রস্থান অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা কেটেছে একেলা বিরহের বেলা [ প্রস্থান অর্জুনের প্রবেশ |
অর্জুন। | কেন রে ক্লান্তি আসে আবেশভার বহিয়া দেহ মন প্রাণ দিবানিশি জীর্ণ অবসাদে। ছিন্ন করো এখনি বীর্যবিলোপী এ কুহেলিকা; এই কর্মহারা কারাগারে রয়েছ কোন্ পরমাদে। গ্রামবাসীগণের প্রবেশ |
গ্রামবাসীগণ। | হো, এল এল এল রে দস্যুর দল, গর্জিয়া নামে যেন বন্যার জল। চল্ তোরা পঞ্চগ্রামী, চল্ তোরা কলিঙ্গধামী, মল্লপল্লী হতে চল, “জয় চিত্রাঙ্গদা’ বল্, বল্ বল্ ভাই রে– ভয় নাই, ভয় নাই, ভয় নাই, নাই রে। |
অর্জুন। | জনপদবাসী, শোনো শোনো, রক্ষক তোমাদের নাই কোনো? |
গ্রামবাসী। | তীর্থে গেছেন কোথা তিনি গোপনব্রতধারিণী, চিত্রাঙ্গদা তিনি রাজকুমারী। |
অর্জুন। | নারী! তিনি নারী! |
গ্রামবাসীগণ। | স্নেহবলে তিনি মাতা, বাহুবলে তিনি রাজা। তাঁর নামে ভেরী বাজা, “জয় জয় জয়’ বলো ভাই রে– ভয় নাই, ভয় নাই, নাই রে॥ — সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান। [প্রস্থান চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ |
চিত্রাঙ্গদা। | কী ভাবিছ নাথ, কী ভাবিছ! |
অর্জুন। | চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী কেমন না জানি আমি তাই ভাবি মনে মনে। শুনি স্নেহে সে নারী বীর্যে সে পুরুষ, শুনি সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী। জান যদি বলো প্রিয়ে, বলো তার কথা॥ |
চিত্রাঙ্গদা। | ছি ছি, কুৎসিত কুরূপ সে। হেন বঙ্কিম ভুরুযুগ নাহি তার, হেন উজ্জ্বল কজ্জল-আঁখিতারা। সন্ধিতে পারে লক্ষ্য কীণাঙ্কিত তার বাহু, বিঁধিতে পারে না বীরবক্ষ কুটিল কটাক্ষশরে। নাহি লজ্জা, নাই শঙ্কা, নাহি নিষ্ঠুর সুন্দর রঙ্গ, নাহি নীরব ভঙ্গির সংগীতলীলা ইঙ্গিতছন্দমুখর॥ |
অর্জুন। | আগ্রহ মোর অধীর অতি– কোথা সে রমণী বীর্যবতী। কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা– দারুণ সে, সুন্দর সে উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে, নহে সে ভোগীর লোচনলোভা, ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণ শোভা॥ |
সখীগণ। | নারীর ললিত লোভন লীলায় এখনি কেন এ ক্লান্তি। এখনি কি সখা, খেলা হল অবসান। যে মধুর রসে ছিলে বিহ্বল সে কি মধুমাখা ভ্রান্তি, সে কি স্বপ্নের দান, সে কি সত্যের অপমান। দূর দুরাশায় হৃদয় ভরিছ, কঠিন প্রেমের প্রতিমা গড়িছ, কী মনে ভাবিয়া নারীতে করিছ পৌরুষসন্ধান। এও কি মায়ার দান। সহসা মন্ত্রবলে নমনীয় এই কমনীয়তারে যদি আমাদের সখী একেবারে পরের বসন-সমান ছিন্ন করি ফেলে ধূলিতলে, সবে না সবে না সে নৈরাশ্য– ভাগ্যের সেই অট্টহাস্য জানি জানি সখা, ক্ষুব্ধ করিবে লুব্ধ পুরুষপ্রাণ, হানিবে নিঠুর বাণ॥ |
অর্জুন। | যদি মিলে দেখা তবে তারি সাথে ছুটে যাব আমি আর্তত্রাণে। ভোগের আবেশ হতে ঝাঁপ দিব যুদ্ধস্রোতে। আজি মোর চঞ্চল রক্তের মাঝে ঝননন ঝননন ঝঞ্ঝনা বাজে। চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী একাধারে মিলিত পুরুষ নারী॥ চিত্রাঙ্গদা ভাগ্যবতী সে যে, এত দিনে তার আহ্বান এল তব বীরের প্রাণে। আজ অমাবস্যার রাতি হোক অবসান। কাল শুভ শুভ্র প্রাতে দর্শন মিলিবে তার, মিথ্যায় আবৃত নারী ঘুচাবে মায়া-অবগুণ্ঠন॥ অর্জুনের প্রতি |
সখী। | রমণীর মন ভোলাবার ছলাকলা দূর ক’রে দিয়ে উঠিয়া দাঁড়াক নারী, সরল উন্নত বীর্যবন্ত অন্তরের বলে পর্বতের তেজস্বী তরুণ তরু-সম, যেন সে সম্মান পায় পুরুষের। রজনীর নর্মসহচরী, যেন হয় পুরুষের কর্মসহচরী, যেন বামহস্তসম দক্ষিণহস্তের থাকে সহকারী। তাহে যেন পুরুষের তৃপ্তি হয়, বীরোত্তম। |
৫ | |
চিত্রাঙ্গদা ও মদন | |
চিত্রাঙ্গদা। | লহো লহো ফিরে লহো তোমার এই বর, হে অনঙ্গদেব। মুক্তি দেহো মোরে, ঘুচায়ে দাও এই মিথ্যার জাল, হে অনঙ্গদেব। চুরির ধন আমার দিব ফিরায়ে তোমার পায়ে আমার অঙ্গশোভা; অধররক্ত-রাঙিমা যাক মিলায়ে অশোকবনে, হে অনঙ্গদেব। যাক যাক যাক এ ছলনা, যাক এ স্বপন, হে অনঙ্গদেব॥ |
মদন। | তাই হোক তবে তাই হোক, কেটে যাক রঙিন কুয়াশা, দেখা দিক শুভ্র আলোক। মায়া ছেড়ে দিক পথ, প্রেমের আসুক জয়রথ, রূপের অতীত রূপ দেখে যেন প্রেমিকের চোখ– দৃষ্টি হতে খসে যাক, খসে যাক মোহনির্মোক॥ [প্রস্থান বিনা সাজে সাজি দেখা দিবে তুমি কবে, |
৬ | |
চিত্রাঙ্গদার সহচর-সহচরীগণ অর্জুনের প্রতি | |
এসো এসো পুরুষোত্তম, এসে এসো বীর মম। তোমার পথ চেয়ে আছে প্রদীপ জ্বালা। আজি পরিবে বীরাঙ্গনার হাতে দৃপ্ত ললাটে, সখা, বীরের বরণমালা। ছিন্ন ক’রে দিবে সে তার শক্তির অভিমান, তোমার চরণে করিবে দান আত্মনিবেদনের ডালা, চরণে করিবে দান। আজ পরাবে বীরাঙ্গনা তোমার দৃপ্ত ললাটে সখা, বীরের বরণমালা। | |
সখী। | হে কৌন্তেয়, ভালো লেগেছিল ব’লে তব করযুগে সখী দিয়েছিল ভরি সৌন্দর্যের ডালি, নন্দনকানন হতে পুষ্প তুলে এনে বহু সাধনায়। যদি সাঙ্গ হল পূজা, তবে আজ্ঞা করো প্রভু, নির্মাল্যের সাজি থাক্ পড়ে মন্দির-বাহিরে। এইবার প্রসন্ন নয়নে চাও সেবিকার পানে। চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ |
চিত্রাঙ্গদা। | আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী। নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী। পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি, হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সংকটে সম্পদে, সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে, পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে। আজ শুধু করি নিবেদন– আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী॥ |
অর্জুন। | ধন্য ধন্য ধন্য আমি। সমবেত নৃত্য তৃষ্ণার শান্তি সুন্দরকান্তি এসো এসো বসন্ত, ধরাতলে– |
অর্জুন। | মা মিৎ কিল ত্বং বনাঃ শাখাং মধুমতীমিং। যথা সুপর্ণঃ প্রনতন্ পক্ষৌ নিহন্তি ভূম্যাম্ এবা নিহন্মি তে মনঃ। |
চিত্রাঙ্গদা। | যথেমে দ্যাবা পৃথিবী সদ্যঃ পর্যেতি সূর্যঃ এবা পর্যেমি তে মনঃ| |
উভয়ে। | অক্ষৌ নৌ মধুসংকাশে অনীকং নৌ সমঞ্জনম্। অন্তঃকৃণুষ্ব মাং হৃদি মন ইন্নৌ সহাসতি॥ |
মন্ত্রের অনুবাদ | |
ফুল্ল শাখা যেমন মধুমতী মধুরা হও তেমনি মোর প্রতি। বিহঙ্গ যথা উড়িবার মুখে পাখায় ভূমিরে হানে তেমনি আমার অন্তরবেগ লাগুক তোমার প্রাণে। আকাশধরা রবিরে ঘিরি আমাদের আঁখি হোক্ মধুসিক্ত, |
নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- নাটক
- Category: চিত্রাঙ্গদা ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- Read Time: 111 mins
- Hits: 3058