তৃতীয় দৃশ্য

[রাজা সিংহাসেন বসে আছেন। চোখ আধ-বোজা। সিংহাসনের পাশে একজন ওস্তাদ দরবারী কানাড়া গাইছেন। দরবারে রাজার মেজাজ আনার জন্যে। ওস্তাদের গলা অদ্ভুত সুন্দর, তিনি গাইছেনও চমৎকার। সরগমের মাঝখানে রাজা হাততালি দিয়ে গান থামিয়ে দেবেন।]

[ওস্তাদ তাকাবেন রাজার দিকে]

রাজা :এটা কি বসন্তকাল?

ওস্তাদ : জ্বিনা।

রাজা : এটা কোন্ কাল?

ওস্তাদ : শীত শুরু হচ্ছে হুজুর।

রাজা : তাই নাকি? কাল রাতে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা বসন্তকাল।

ওস্তাদ : কারো কারো এ রকম ভুল হয় জনাব। শীতকালকে বসন্তকাল ভাবে। এই ভুল অবশ্যি দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

রাজা : আমার স্পষ্ট মনে হলো এটা বসন্তকাল। ফুলের গন্ধ পেলাম। মিষ্টি বাতাস বইছিলো। আমি তখন কি ঠিক করলাম জান? ঠিক করলাম একটা বসন্ত উৎসব করব। একটা বসন্ত উৎসব করলে কেমন হয়? আনন্দ-গান উল্লাস।

ওস্তাদ : ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করাই ভাল। এটাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। বসন্ত উৎসব হয়ে বসন্তকালে।

 রাজা : ইদানিং তুমি বেশি-বেশি কথা বলছ।

ওস্তাদ : [ চুপ করে থাকবেন]

রাজা : এবং তোমার গলাও খারাপ হয়ে গেছে।

ওস্তাদ : বয়েস হয়ে গেছে।

রাজাঃ দেখি একটা বসন্তের গান শুনি।

 ওস্তাদ : শীতের সময় আমি বসন্তের গান গাইতে পারি না।

রাজা : কেন?

 ওস্তাদ : নিয়ম নেই।

 রাজা : নিয়ম! কার নিয়মঃ

ওস্তাদ : শীতের সময় বসন্তের গান কেউ গাইবে না।

[রাজা হাততালি দিতেই মন্ত্রীর প্রবেশ]

রাজা : আমি একটি বসন্ত উৎসব করতে চাই। [মন্ত্রী তাকিয়ে থাকবে।] বসন্ত উৎসব!

 ওস্তাদ : হুজুরের অনুমতি পেলে আমি উঠি।

রাজা : নাচ হবে। গান হবে, আনন্দ-উল্লাস হবে।

ওস্তাদ : প্রজারা কেউ রাজি হবে না। এখন ওদের দুঃসময়। শীত হচ্ছে দুঃখ ও কষ্টের সময়।

মন্ত্রীঃ দুঃখ-কষ্ট থেকে ওদের মন ফেরাবার জন্যেই উৎসব দরকার। উৎসব হবে।

রাজা : বসন্ত উৎসব!

মন্ত্রী : বসন্ত উৎসবই হবে।

রাজাঃ নাচ হবে। গান হবে। আনন্দ-উল্লাস হবে। ফুল দিয়ে আমি রাজ্য ঢেকে দেব।

ওস্তাদ : শীতের সময় ফুল পাওয়া যাবে না।

মন্ত্রী : রাজবাড়ির কারিগর কাগজের ফুল তৈরি করবে। তার সৌরভ হবে আসল ফুলের চেয়ে বেশি, তার বর্ণ হবে…

[ পিঠ বাঁকা করে মজনু চোরা লাঠিতে ভর দিয়ে ঢুকবে।]

 রাজা : [চম্‌কে উঠে] এ কে?

মজনু : হুজুর, আমারে চিনলেন না? কাইল রাইতে আপনেরে পিঠে কইরা আনলাম। আমার নাম মজনু।

 রাজা : মজনু, তুমি ভাল আছো?

মজনু : হুজুরের দয়া। পিঠের মইধ্যে এট্টুখানি দরদ। সোজা হইতে পারি না। কিন্তু আছি ভাল।

রাজা : রাতটা খুব আনন্দের ছিল মজনু। বাতাস ছিল মধুর। পাখি ডাকছিলো। মজনু, পাখি ডাকছিলো না?

মজনু : কাউয়া ডাকতেছিল। আর কোন পাখির ডাক শুনি নাই।

রাজা :কিন্তু সেই কাকের ডাকও মধুর ছিল। ছিল না?

মজনু : জ্বে ছিল। কি সুন্দর কা-কা কইরা ডাকলো। বড় মধুর।

রাজা : আমি তোমার উপর খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। মন্ত্রী একে একশ’ বিঘা নিষ্কর জমির ব্যবস্থা করে দিন।

 মজনু : হুজুর একরের কথা বলেছিলেন। হুজুরের বোধহয় স্মরণ নাই।

রাজা : একশ’ একর নিষ্কর জমি। শোন মজনু, তোমার উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট।

 মজুন : হুজুরের দয়া। হুজুর দয়ার সাগর।

রাজা : এখন তুমি আমার পদচুম্বনেরও সুযোগ পাবে।

মজনু : হুজুর দয়ার মহাসাগর।

রাজা : বৎসরে দু’বার তোমাকে এই সম্মান দেয়া হবে।

মজনু : হুজুর হচ্ছেন দয়ার মহা-মহা-সাগর।

[ রাজা তার পা বাড়িয়ে দেবেন। মজনু পায়ে চুমু খাবে। তার চোখে-মুখে স্বৰ্গীয় ভাব।]

মন্ত্রী : জাহাপনা, বাইরে অনেকেই আপনার পদচুম্বনের জন্যে অপেক্ষা করছে।

রাজাঃ আজ আমার মন উৎফুল্ল। আজ আমি সবাইকে সুখী করতে চাই। ওদের নিয়ে এসো। [মন্ত্রী হাততালি দিতেই ২য় প্রজা এসে ঢুকবে। তারও হাতে লাঠি এবং পিঠ বাঁকা।] এ

মন্ত্রী : একবার মৃগয়াতে আপনি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন সে আপনাকে পিঠে করে নিয়ে এসেছিল। এর নাম বশির।

 রাজা : বশির, ভাল আছ?

[বশিরের মুখভর্তি হাসি। রাজা পা বাড়িয়ে দেবেন। বশির মহানন্দে তাঁর পায়ে চুমু খাবে এবং মজনুর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। মন্ত্রী দ্বিতীয়বার হাততালি দিবেন। ৩য় প্রজা এসে ঢুকবে। তারও পিঠ বাঁকা।]

মন্ত্রী : এ হচ্ছে নিয়ামত। সেও একবার আপনাকে পিঠে করে এনেছিল।

রাজা : ভাল আছ নিয়ামত?

নিয়ামতের মুখে হাসি। রাজা পা বাড়িয়ে দেবেন। নিয়ামত পায়ে চুমু খাবে এবং বাকী দু’জনের পাশে দাঁড়াবে।

মন্ত্রীঃ জাহাপনা, অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে।

 রাজা : থাকুক। মুখের লালায় আমার পা ভিজে গেছে। আমার গা ঘিন ঘিন করছে। [রাজা হাততালি দিতেই একটা বড় গামলা এনে একজন পানি দিয়ে রাজার পা ধুইয়ে দেবে।]

 রাজা : তোমরা কেউ বসন্তের গান জানো? গাও, বসন্তের গান গাও।

[পিঠ-বাকারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।]

তিনজনেঃ হুজুর! আমরা গান জানি না।

রাজা : গাইতে বলছি গাও [রাগতস্বরে]

তিনজনেঃ গান কি করে গাইতে হয় জানি না, হুজুর।

[রাজা কড়া চোখে তাকাবেন]

মন্ত্রী : রাজা সাহেব রেগে যাচ্ছেন। তাকে রাগিও না।

 [তিনজনে ভয়ে জড়সড় হয়ে কাছাকাছি চলে আসবে।]

ওস্তাদ : ঠিক আছে, তোমরা আমার সঙ্গে গাও।

[ওস্তাদ গাইবেন। ওরা তাঁর সঙ্গে ঠোঁট মেলাতে চেষ্টা করবে। আজি এ বসন্তে এই গানটি দেয়া যেতে পারে।]

 রাজা : মধু, মধু। মধুময় সংগীত। আমার মন প্রফুল্ল হয়েছে। মন্ত্রী, কেমন লাগল আপনার?

মন্ত্রী : [কাশতে থাকবেন।]

রাজাঃ ওস্তাদ, আপনার কেমন লাগল?

ওস্তাদঃ রাজা-মহারাজাদের কখন কি ভাল লাগে বোঝা মুশকিল।

রাজা : আপনি বলতে চাচ্ছেন ওদের কণ্ঠ মধুময় নয়?

ওস্তাদঃ আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। ওদের গান আপনার ভাল লাগলেই হল।

রাজাঃ আমার ভাল লেগেছে।

বৃদ্ধ : আমরা রাজা সাবের জইন্যে সকাল-বিকাল সইন্ধ্যা তিন বেলা গান গাইতে চাই।

বাকি সবাই : গাইতে চাই। তিন বেলা গান গাইতে চাই।

রাজা : গাইবে, দিনরাত তোমরা মন খুলে গাইবে। তোমাদের জন্যে আমি গান রচনা করব। সেই গান তোমরা ছড়িয়ে দেবে দেশে দেশান্তরে।

তিনজনেঃ দেশে দেশান্তর।

রাজা : পৃথিবীর মানুষেরা জানবে এই মহান নৃপতি শুধু প্রজাবৎসল নৃপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কবি এবং একজন মহান সুরকার।

তিনজনেঃ একজন মহান সুরকার।

রাজাঃ [বিরক্ত হয়ে] এরা বারবার আমার কথার পিঠে কথা বলছে কেন? ওদের ঘাড় ধরে বের করে দিন। [তিনজনেই তাড়াহুড়ো করে পালাতে গিয়ে একজন চিৎ হয়ে পড়ে যাবে।]

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ