দেবগণকর্তৃক আদিষ্ট হইয়া বৃহস্পতিপুত্র কচ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের নিকট হইতে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখিবার নিমিত্ত তৎসমীপে গমন করেন। সেখানে সহস্র বৎসর অতিবাহন করিয়া এবং নৃত্যগীতবাদ্যদ্বারা শুক্রদুহিতা দেবযানীর মনোরঞ্জনপূর্বক সিদ্ধকাম হইয়া, কচ দেবলোকে প্রত্যাগমন করেন। দেবযানীর নিকট হইতে বিদায়কালীন ব্যাপার পরে বিবৃত হইল।
কচ ও দেবযানী
কচ। দেহ আজ্ঞা, দেবযানী, দেবলোকে দাস করিবে প্রয়াণ। আজি গুরুগৃহবাস সমাপ্ত আমার। আশীর্বাদ করো মোরে যে বিদ্যা শিখিনু তাহা চিরদিন ধরে অন্তরে জাজ্বল্য থাকে উজ্জ্বল রতন, সুমেরুশিখরশিরে সূর্যের মতন, অক্ষয়কিরণ। দেবযানী। মনোরথ পুরিয়াছে, পেয়েছ দুর্লভবিদ্যা আচার্যের কাছে, সহস্রবর্ষের তব দুঃসাধ্যসাধনা সিদ্ধ আজি; আর কিছু নাহি কি কামনা ভেবে দেখো মনে মনে। কচ। আর কিছু নাহি। দেবযানী। কিছু নাই? তবু আরবার দেখো চাহি অবগাহি হৃদয়ের সীমান্ত অবধি করহ সন্ধান— অন্তরের প্রান্তে যদি কোনো বাঞ্ছা থাকে, কুশের অঙ্কুর-সম ক্ষুদ্র দৃষ্টি-অগোচর, তবু তীক্ষ্ণতম। কচ। আজি পূর্ণ কৃতার্থ জীবন। কোনো ঠাঁই মোর মাঝে কোনো দৈন্য কোনো শূন্য নাই সুলক্ষণে। দেবযানী। তুমি সুখী ত্রিজগৎ-মাঝে। যাও তবে ইন্দ্রলোকে আপনার কাজে উচ্চশিরে গৌরব বহিয়া। স্বর্গপুরে উঠিবে আনন্দধ্বনি, মনোহর সুরে বাজিবে মঙ্গলশঙ্খ, সুরাঙ্গনাগণ করিবে তোমার শিরে পুষ্প বরিষন সদ্যছিন্ন নন্দনের মন্দারমঞ্জরী। স্বর্গপথে কলকণ্ঠে অপ্সরী কিন্নরী দিবে হুলুধ্বনি। আহা, বিপ্র, বহুক্লেশে কেটেছে তোমার দিন বিজনে বিদেশে সুকঠোর অধ্যয়নে। নাহি ছিল কেহ স্মরণ করায়ে দিতে সুখময় গেহ, নিবারিতে প্রবাসবেদনা। অতিথিরে যথাসাধ্য পুজিয়াছি দরিদ্রকুটিরে যাহা ছিল দিয়ে। তাই ব’লে স্বর্গসুখ কোথা পাব, কোথা হেথা অনিন্দিত মুখ সুরললনার। বড়ো আশা করি মনে আতিথ্যের অপরাধ রবে না স্মরণে ফিরে গিয়ে সুখলোকে। কচ। সুকল্যাণ হাসে প্রসন্ন বিদায় আজি দিতে হবে দাসে। দেবযানী। হাসি? হায় সখা, এ তো স্বগর্পুরী নয়। পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয় মর্মমাঝে, বাঞ্ছা ঘুরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে, লাঞ্ছিত ভ্রমর যথা বারম্বার ফিরে মুদ্রিত পদ্মের কাছে। হেথা সুখ গেলে স্মৃতি একাকিনী বসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্যগৃহে—হেথায় সুলভ নহে হাসি। যাও বন্ধু, কী হইবে মিথ্যা কাল নাশি— উৎকণ্ঠিত দেবগণ। যেতেছ চলিয়া ? সকলি সমাপ্ত হল দু কথা বলিয়া? দশশত বর্ষ পরে এই কি বিদায় ! কচ। দেবযানী, কী আমার অপরাধ ! দেবযানী। হায়, সুন্দরী অরণ্যভূমি সহস্র বৎসর দিয়েছে বল্লভছায়া পল্লবমর্মর, শুনায়েছে বিহঙ্গকূজন—তারে আজি এতই সহজে ছেড়ে যাবে? তরুরাজি ম্লান হয়ে আছে যেন, হেরো আজিকার বনচ্ছায়া গাঢ়তর শোকে অন্ধকার, কেঁদে ওঠে বায়ু, শুষ্ক পত্র ঝ’রে পড়ে, তুমি শুধু চলে যাবে সহাস্য অধরে নিশান্তের সুখস্বপ্নসম? কচ। দেবযানী, এ বনভূমিরে আমি মাতৃভুমি মানি, হেথা মোর নবজন্মলাভ । এর ’পরে নাহি মোর অনাদর, চিরপ্রীতিভরে চিরদিন করিব স্মরণ। দেবযানী। এই সেই বটতল, যেথা তুমি প্রতি দিবসেই গোধন চরাতে এসে পড়িতে ঘুমায়ে মধ্যাহ্নের খরতাপে ; ক্লান্ত তব কায়ে অতিথিবৎসল তরু দীর্ঘ ছায়াখানি দিত বিছাইয়া, সুখসুপ্তি দিত আনি ঝর্ঝরপল্লবদলে করিয়া বীজন মৃদুস্বরে। যেয়ো সখা, তবু কিছুক্ষণ পরিচিত তরুতলে বোসো শেষবার, নিয়ে যাও সম্ভাষণ এ স্নেহছায়ার, দুই দণ্ড থেকে যাও—সে বিলম্বে তব স্বর্গের হবে না কোনো ক্ষতি। কচ। অভিনব বলে যেন মনে হয় বিদায়ের ক্ষণে এই-সব চিরপরিচিত বন্ধুগণে— পলাতক প্রিয়জনে বাঁধিবার তরে করিছে বিস্তার সবে ব্যগ্র স্নেহভরে নূতন বন্ধনজাল, অন্তিম মিনতি, অপূর্ব সৌন্দর্যরাশি। ওগো বনস্পতি, আশ্রিতজনের বন্ধু, করি নমস্কার। কত পান্থ বসিবেক ছায়ায় তোমার, কত ছাত্র কত দিন আমার মতন প্রচ্ছন্ন প্রচ্ছায়তলে নীরব নির্জন তৃণাসনে, পতঙ্গের মৃদুগুঞ্জস্বরে, করিবেক অধ্যয়ন—প্রাতঃস্নান-পরে ঋষিবালকেরা আসি সজল বল্কল শুকাবে তোমার শাখে—রাখালের দল মধ্যাহ্নে করিবে খেলা—ওগো, তারি মাঝে এ পুরানো বন্ধু যেন স্মরণে বিরাজে। দেবযানী। মনে রেখো আমাদের হোমধেনুটিরে; স্বর্গসুধা পান করে সে পুণ্যগাভীরে ভুলো না গরবে। কচ। সুধা হতে সুধাময় দুগ্ধ তার— দেখে তারে পাপক্ষয় হয়, মাতৃরূপা, শান্তিস্বরূপিণী, শুভ্রকান্তি, পয়স্বিনী । না মানিয়া ক্ষুধাতৃষ্ণাশ্রান্তি তারে করিয়াছি সেবা; গহন কাননে শ্যামশষ্প স্রোতস্বিনীতীরে তারি সনে ফিরিয়াছি দীর্ঘ দিন ; পরিতৃপ্তিভরে স্বেচ্ছামতে ভোগ করি নিম্নতট- ’পরে অপর্যাপ্ত তৃণরাশি সুস্নিগ্ধ কোমল— আলস্যমন্থরতনু লভি তরুতল রোমন্থ করেছে ধীরে শুয়ে তৃণাসনে সারাবেলা ; মাঝে মাঝে বিশাল নয়নে সকৃতজ্ঞ শান্ত দৃষ্টি মেলি, গাঢ়স্নেহ চক্ষু দিয়া লেহন করেছে মোর দেহ। মনে রবে সেই দৃষ্টি স্নিগ্ধ অচঞ্চল, পরিপুষ্ট শুভ্র তনু চিক্কণ পিচ্ছল। দেবযানী। আর মনে রেখো আমাদের কলস্বনা স্রোতস্বিনী বেণুমতী। কচ। তারে ভুলিব না। বেণুমতী, কত কুসুমিত কুঞ্জ দিয়ে মধুকণ্ঠে আনন্দিত কলগান নিয়ে আসিছে শুশ্রূষা বহি গ্রাম্যবধূসম সদা ক্ষিপ্রগতি, প্রবাসসঙ্গিনী মম নিত্যশুভব্রতা। দেবযানী । হায় বন্ধু, এ প্রবাসে আরো কোনো সহচরী ছিল তব পাশে, পরগৃহবাসদুঃখ ভুলাবার তরে যত্ন তার ছিল মনে রাত্রিদিন ধরে— হায় রে দুরাশা ! কচ । চিরজীবনের সনে তাঁর নাম গাঁথা হয়ে গেছে। দেবযানী । আছে মনে যেদিন প্রথম তুমি আসিলে হেথায় কিশোর ব্রাহ্মণ, তরুণ অরুণপ্রায় গৌরবর্ণ তনুখানি স্নিগ্ধ দীপ্তিঢালা, চন্দনে চর্চিত ভাল, কণ্ঠে পুষ্পমালা, পরিহিত পট্টবাস, অধরে নয়নে প্রসন্ন সরল হাসি, হোথা পুষ্পবনে দাঁড়ালে আসিয়া— কচ । তুমি সদ্য স্নান করি দীর্ঘ আর্দ্র কেশজালে, নবশুক্লাম্বরী জ্যোতিস্নাত মূর্তিমতী উষা, হাতে সাজি একাকী তুলিতেছিলে নব পুষ্পরাজি পূজার লাগিয়া । কহিনু করি বিনতি, ‘তোমারে সাজে না শ্রম, দেহো অনুমতি, ফুল তুলে দিব দেবী।’ দেবযানী । আমি সবিস্ময় সেই ক্ষণে শুধানু তোমার পরিচয়। বিনয়ে কহিলে, ‘অসিয়াছি তব দ্বারে তোমার পিতার কাছে শিষ্য হইবারে আমি বৃহস্পতিসুত।’ কচ । শঙ্কা ছিল মনে, পাছে দানবের গুরু স্বর্গের ব্রাহ্মণে দেন ফিরাইয়া। দেবযানী । আমি গেনু তাঁর কাছে। হাসিয়া কহিনু, ‘পিতা, ভিক্ষা এক আছে চরণে তোমার।’ স্নেহে বসাইয়া পাশে শিরে মোর দিয়ে হাত শান্ত মৃদু ভাষে কহিলেন, ‘কিছু নাহি অদেয় তোমারে।’ কহিলাম, ‘বৃহস্পতিপুত্র তব দ্বারে এসেছেন, শিষ্য করি লহো তুমি তাঁরে এ মিনতি। ’ সে আজিকে হল কত কাল, তবু মনে হয় যেন সেদিন সকাল। কচ । ঈর্ষাভরে তিনবার দৈত্যগণ মোরে করিয়াছে বধ, তুমি দেবী দয়া করে ফিরায়ে দিয়েছ মোর প্রাণ, সেই কথা হৃদয়ে জাগায়ে রবে চিরকৃতজ্ঞতা। চিত্তে যাহা দিয়েছিল সুখ; পরিধান করে থাকে কোনোদিন হেন বস্ত্রখানি যাহা দেখে মনে তব প্রশংসার বাণী জেগেছিল, ভেবেছিলে প্রসন্ন-অন্তর তৃপ্ত চোখে, আজি এরে দেখায় সুন্দর, সেই কথা মনে কোরো অবসরক্ষণে সুখস্বর্গ-ধামে । কতদিন এই বনে দিগ্দিগন্তরে, আষাঢ়ের নীল জটা, শ্যামস্নিগ্ধ বরষার নবঘনঘটা নেবেছিল, অবিরল বৃষ্টিজলধারে কর্মহীন দিনে সঘনকল্পনাভারে পীড়িত হৃদয়—এসেছিল কতদিন অকস্মাৎ বসন্তের বাধাবন্ধহীন উল্লাসহিল্লোলাকুল যৌবন-উৎসাহ, সংগীতমুখর সেই আবেগপ্রবাহ লতায় পাতায় পুষ্পে বনে বনান্তরে ব্যাপ্ত করি দিয়াছিল লহরে লহরে আনন্দপ্লাবন—ভেবে দেখো একবার কত উষা, কত জ্যোৎস্না, কত অন্ধকার পুষ্পগন্ধঘন অমানিশা, এই বনে গেছে মিশে সুখে দুঃখে তোমার জীবনে— তারি মাঝে হেন প্রাতঃ, হেন সন্ধ্যাবেলা, হেন মুগ্ধরাত্রি, হেন হৃদয়ের খেলা, হেন সুখ, হেন মুখ দেয় নাই দেখা যাহা মনে আঁকা রবে চিরচিত্ররেখা চিররাত্রি চিরদিন? শুধু উপকার! শোভা নহে, প্রীতি নহে, কিছু নহে আর? কচ । আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয় সখী। বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময় বাহিরে তা কেমনে দেখাব। দেবযানী । জানি সখে, তোমার হৃদয় মোর হৃদয়-আলোকে দেবযানী । কৃতজ্ঞতা! ভুলে যেয়ো, কোনো দুঃখ নাই। উপকার যা করেছি হয়ে যাক ছাই— নাহি চাই দান-প্রতিদান । সুখস্মৃতি নাহি কিছু মনে? যদি আনন্দের গীতি কোনোদিন বেজে থাকে অন্তরে বাহিরে, যদি কোনো সন্ধ্যাবেলা বেণুমতীতীরে অধ্যয়ন-অবসরে বসি পুষ্পবনে অপূর্ব পুলকরাশি জেগে থাকে মনে; ফুলের সৌরভসম হৃদয়-উচ্ছ্বাস ব্যাপ্ত করে দিয়ে থাকে সায়াহ্ন-আকাশ, ফুটন্ত নিকুঞ্জতল, সেই সুখকথা মনে রেখো—দূর হয়ে যাক কৃতজ্ঞতা। যদি, সখা, হেথা কেহ গেয়ে থাকে গান চিত্তে যাহা দিয়েছিল সুখ; পরিধান করে থাকে কোনোদিন হেন বস্ত্রখানি যাহা দেখে মনে তব প্রশংসার বাণী জেগেছিল, ভেবেছিলে প্রসন্ন-অন্তর তৃপ্ত চোখে, আজি এরে দেখায় সুন্দর, সেই কথা মনে কোরো অবসরক্ষণে সুখস্বর্গ-ধামে । কতদিন এই বনে দিগ্দিগন্তরে, আষাঢ়ের নীল জটা, শ্যামস্নিগ্ধ বরষার নবঘনঘটা নেবেছিল, অবিরল বৃষ্টিজলধারে কর্মহীন দিনে সঘনকল্পনাভারে পীড়িত হৃদয়—এসেছিল কতদিন অকস্মাৎ বসন্তের বাধাবন্ধহীন উল্লাসহিল্লোলাকুল যৌবন-উৎসাহ, সংগীতমুখর সেই আবেগপ্রবাহ লতায় পাতায় পুষ্পে বনে বনান্তরে ব্যাপ্ত করি দিয়াছিল লহরে লহরে আনন্দপ্লাবন—ভেবে দেখো একবার কত উষা, কত জ্যোৎস্না, কত অন্ধকার পুষ্পগন্ধঘন অমানিশা, এই বনে গেছে মিশে সুখে দুঃখে তোমার জীবনে— তারি মাঝে হেন প্রাতঃ, হেন সন্ধ্যাবেলা, হেন মুগ্ধরাত্রি, হেন হৃদয়ের খেলা, হেন সুখ, হেন মুখ দেয় নাই দেখা যাহা মনে আঁকা রবে চিরচিত্ররেখা চিররাত্রি চিরদিন? শুধু উপকার! শোভা নহে, প্রীতি নহে, কিছু নহে আর? কচ । আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয় সখী। বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময় বাহিরে তা কেমনে দেখাব। দেবযানী । জানি সখে, তোমার হৃদয় মোর হৃদয়-আলোকে চকিতে দেখেছি কতবার, শুধু যেন চক্ষের পলকপাতে; তাই আজি হেন স্পর্ধা রমণীর। থাকো তবে, থাকো তবে, যেয়ো নাকো । সুখ নাই যশের গৌরবে। হেথা বেণুমতীতীরে মোরা দুই জন অভিনব স্বর্গলোক করিব সৃজন এ নির্জন বনচ্ছায়াসাথে মিশাইয়া নিভৃত বিশ্রব্ধ মুগ্ধ দুইখানি হিয়া নিখিলবিস্মৃত। ওগো বন্ধু, আমি জানি রহস্য তোমার। কচ। নহে, নহে দেবযানী। দেবযানী । নহে? মিথ্যা প্রবঞ্চনা! দেখি নাই আমি মন তব? জান না কি প্রেম অন্তর্যামী? বিকশিত পুষ্প থাকে পল্লবে বিলীন— গন্ধ তার লুকাবে কোথায়? কতদিন যেমনি তুলেছ মুখ, চেয়েছ যেমনি, যেমনি শুনেছ তুমি মোর কণ্ঠধ্বনি, অমনি সর্বাঙ্গে তব কম্পিয়াছে হিয়া— নড়িলে হীরক যথা পড়ে ঠিকরিয়া আলোক তাহার। সে কি আমি দেখি নাই? ধরা পড়িয়াছ বন্ধু, বন্দী তুমি তাই মোর কাছে। এ বন্ধন নারিবে কাটিতে। ইন্দ্র আর তব ইন্দ্র নহে । কচ। শুচিস্মিতে, সহস্র বৎসর ধরি এ দৈত্যপুরীতে এরি লাগি করেছি সাধনা ? দেবযানী । কেন নহে? বিদ্যারই লাগিয়া শুধু লোকে দুঃখ সহে এ জগতে? করে নি কি রমণীর লাগি কোনো নর মহাতপ? পত্নীবর মাগি করেন নি সম্বরণ তপতীর আশে প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে অনাহারে কঠোর সাধনা কত? হায়, বিদ্যাই দুর্লভ শুধু, প্রেম কি হেথায় এতই সুলভ? সহস্র বৎসর ধরে সাধনা করেছ তুমি কী ধনের তরে আপনি জান না তাহা। বিদ্যা এক ধারে, আমি এক ধারে— কভু মোরে কভু তারে চেয়েছ সোৎসুকে; তব অনিশ্চিত মন দোঁহারেই করিয়াছে যত্নে আরাধন সংগোপনে। আজ মোরা দোঁহে এক দিনে আসিয়াছি ধরা দিতে। লহো, সখা, চিনে যারে চাও। বল যদি সরল সাহসে ‘বিদ্যায় নাহিকো সুখ, নাহি সুখ যশে— দেবযানী, তুমি শুধু সিদ্ধি মূর্তিমতী, তোমারেই করিনু বরণ’, নাহি ক্ষতি, নাহি কোনো লজ্জা তাহে। রমণীর মন সহস্রবর্ষেরই, সখা, সাধনার ধন। কচ। দেবসন্নিধানে শুভে করেছিনু পণ মহাসঞ্জীবনী বিদ্যা করি উপার্জন দেবলোকে ফিরে যাব। এসেছিনু, তাই; সেই পণ মনে মোর জেগেছে সদাই; পূর্ণ সেই প্রতিজ্ঞা আমার, চরিতার্থ এতকাল পরে এ জীবন— কোনো স্বার্থ করি না কামনা আজি। দেবযানী । ধিক্ মিথ্যাভাষী! শুধু বিদ্যা চেয়েছিলে? গুরুগৃহে আসি শুধু ছাত্ররূপে তুমি আছিলে নির্জনে শাস্ত্রগ্রন্থে রাখি আঁখি রত অধ্যয়নে অহরহ? উদাসীন আর সবা-’পরে? ছাড়ি অধ্যয়নশালা বনে বনান্তরে ফিরিতে পুষ্পের তরে, গাঁথি মাল্যখানি সহাস্য প্রফুল্লমুখে কেন দিতে আনি এ বিদ্যাহীনারে? এই কি কঠোর ব্রত? এই তব ব্যবহার বিদ্যার্থীর মতো? প্রভাতে রহিতে অধ্যয়নে, আমি আসি শূন্য সাজি হাতে লয়ে দাঁড়াতেম হাসি, তুমি কেন গ্রন্থ রাখি উঠিয়া আসিতে, প্রফুল্ল শিশিরসিক্ত কুসুমরাশিতে করিতে আমার পূজা? অপরাহ্নকালে জলসেক করিতাম তরু-আলবালে, আমারে হেরিয়া শ্রান্ত কেন দয়া করি দিতে জল তুলে? কেন পাঠ পরিহরি পালন করিতে মোর মৃগশিশুটিকে? স্বর্গ হতে যে সংগীত এসেছিলে শিখে কেন তাহা শুনাইতে, সন্ধ্যাবেলা যবে নদীতীরে অন্ধকার নামিত নীরবে প্রেমনত নয়নের স্নিগ্ধচ্ছায়াময় দীর্ঘ পল্লবের মতো। আমার হৃদয় বিদ্যা নিতে এসে কেন করিলে হরণ স্বর্গের চাতুরিজালে? বুঝেছি এখন, আমারে করিয়া বশ পিতার হৃদয়ে চেয়েছিলে পশিবারে—কৃতকার্য হয়ে আজ যাবে মোরে কিছু দিয়ে কৃতজ্ঞতা, লব্ধমনোরথ অর্থী রাজদ্বারে যথা দ্বারীহস্তে দিয়ে যায় মুদ্রা দুই-চারি মনের সন্তোষে। কচ । হা অভিমানিনী নারী, সত্য শুনে কী হইবে সুখ। ধর্ম জানে, প্রতারণা করি নাই; অকপট- প্রাণে আনন্দ-অন্তরে তব সাধিয়া সন্তোষ, সেবিয়া তোমারে যদি করে থাকি দোষ, তার শাস্তি দিতেছেন বিধি। ছিল মনে কব না সে কথা। বলো, কী হইবে জেনে ত্রিভুবনে কারো যাহে নাই উপকার, একমাত্র শুধু যাহা নিতান্ত আমার আপনার কথা। ভালোবাসি কি না আজ সে তর্কে কী ফল? আমার যা আছে কাজ সে আমি সাধিব। স্বর্গ আর স্বর্গ বলে যদি মনে নাহি লাগে, দূর বনতলে যদি ঘুরে মরে চিত্ত বিদ্ধ মৃগসম, চিরতৃষ্ণা লেগে থাকে দগ্ধ প্রাণে মম সর্বকার্য-মাঝে—তবু চলে যেতে হবে সুখশূন্য সেই স্বর্গধামে। দেব-সবে এই সঞ্জীবনী বিদ্যা করিয়া প্রদান নূতন দেবত্ব দিয়া তবে মোর প্রাণ সার্থক হইবে; তার পূর্বে নাহি মানি আপনার সুখ। ক্ষমো মোরে, দেবযানী, ক্ষমো অপরাধ। দেবযানী । ক্ষমা কোথা মনে মোর। করেছ এ নারীচিত্ত কুলিশকঠোর হে ব্রাহ্মণ। তুমি চলে ষাবে স্বর্গলোকে সগৌরবে, আপনার কর্তব্যপুলকে সর্ব দুঃখশোক করি দূরপরাহত ; আমার কী আছে কাজ, কী আমার ব্রত। আমার এ প্রতিহত নিষ্ফল জীবনে কী রহিল, কিসের গৌরব? এই বনে বসে রব নতশিরে নিঃসঙ্গ একাকী লক্ষ্যহীনা। যে দিকেই ফিরাইব আঁখি সহস্র স্মৃতির কাঁটা বিঁধিবে নিষ্ঠুর; লুকায়ে বক্ষের তলে লজ্জা অতি ক্রূর বারম্বার করিবে দংশন। ধিক্ ধিক্ , কোথা হতে এলে তুমি, নির্মম পথিক, বসি মোর জীবনের বনচ্ছায়াতলে দণ্ড দুই অবসর কাটাবার ছলে জীবনের সুখগুলি ফুলের মতন ছিন্ন করে নিয়ে, মালা করেছ গ্রন্থন একখানি সূত্র দিয়ে। যাবার বেলায় সে মালা নিলে না গলে, পরম হেলায় সেই সূক্ষ্ম সূত্রখানি দুই ভাগ করে ছিঁড়ে দিয়ে গেলে। লুটাইল ধূলি-’পরে এ প্রাণের সমস্ত মহিমা। তোমা-’পরে এই মোর অভিশাপ— যে বিদ্যার তরে মোরে কর অবহেলা, সে বিদ্যা তোমার সম্পূর্ণ হবে না বশ— তুমি শুধু তার ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ; শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ। কচ। আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে। ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে। কালীগ্রাম, ২৬ শ্রাবণ [১৩০০]<