সৌদামিনী নামটা আমার বাবার দেওয়া। আমি প্রায়ই ভাবি, আমাকে এক বছরের বেশি ত তিনি চোখে দেখে যেতে পাননি, তবে এমন করে আমার ভিতরে বাহিরে মিলিয়ে নাম রেখে গিয়েছিলেন কি করে? বীজমন্ত্রের মত এই একটি কথায় আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ-জীবনের ইতিহাসটাই যেন বাবা ব্যক্ত করে গেছেন।
রূপ? তা আছে মানি; কিন্তু না গো না, এ আমার দেমাক নয়, দেমাক নয়। বুক চিরে দেখান যায় না, নইলে এই মুহূর্তেই দেখিয়ে দিতুম, রূপ নিয়ে গৌরব করবার আমার আর বাকি কিছু নেই, একেবারে—কিছু নেই। আঠারো, উনিশ? হ্যাঁ, তাই বটে। বয়স আমার উনিশই। বাইরের দেহটা আমার তার বেশি প্রাচীন হতে পায়নি। কিন্তু এই বুকের ভিতরটায়? এখানে যে বুড়ী তার উনআশি বছরের শুকনো হাড়-গোড় নিয়ে বাস করে আছে, তাকে দেখতে পাচ্ছ না? পেলে এতক্ষণ ভয়ে আঁৎকে উঠতে।
একলা ঘরের মধ্যে মনে হলেও ত আজও আমার লজ্জায় মরতে ইচ্ছা করে; তবে এ কলঙ্কের কালি কাগজের উপর ঢেলে দেবার আমার কি আবশ্যক ছিল! সমস্ত লজ্জার মাথা খেয়ে সেইটাই ত আজ আমাকে বলতে হবে। নইলে আমার মুক্তি হবে কিসে?
সব মেয়ের মত আমিও ত আমার স্বামীকে বিয়ের মন্তরের ভিতর দিয়েই পেয়েছিলুম। তবু কেন তাতে আমার মন উঠল না। তাই যে দামটা আমাকে দিতে হল, আমার অতি-বড় শত্রুর জন্যেও তা একদিনের জন্যে কামনা করিনে। কিন্তু দাম আমাকে দিতে হল। যিনি সমস্ত পাপ-পুণ্য, লাভ-ক্ষতি, ন্যায়-অন্যায়ের মালিক, তিনি আমাকে একবিন্দু রেহাই দিলেন না। কড়ায় ক্রান্তিতে আদায় করে সর্বস্বান্ত করে যখন আমাকে পথে বার করে দিলেন, লজ্জাশরমের আর যখন কোথাও কিছু অবশিষ্ট রাখলেন না, তখনই শুধু দেখিয়ে দিলেন, ওরে সর্বনাশী, এ তুই করেছিস কি? স্বামী যে তোর আত্মা। তাঁকে ছেড়ে তুই যাবি কোথায়? একদিন না একদিন তোর ঐ শূন্য বুকের মধ্যে তাঁকে যে তোর পেতেই হবে। এ জন্মে হোক, আগামী জন্মে হোক, কোটি জন্ম পরে হোক, তাঁকে যে তোর চাই-ই। তুই যে তাঁরই।
জানি, যা হারিয়েছি, তার অনন্ত গুণ আজ ফিরে পেয়েছি। কিন্তু তবু যে এ কথা কিছুতেই ভুলতে পারিনে, এটা আমার নারী-দেহ। আজ আমার আনন্দ রাখবারও জায়গা নেই, কিন্তু ব্যথা রাখবারও যে ঠাঁই দেখি না প্রভু। এ দেহের প্রত্যেক অণু-পরমাণু যে অহোরাত্র কাঁদচে—ওরে অস্পৃশ্যা, ওরে পতিতা, আমাদের আর বেঁধে পোড়াস নে, আমাদের ছুটি দে, আমরা একবার মরে বাঁচি!
কিন্তু থাক সে কথা।
বাবা মারা গেলেন, এক বছরের মেয়ে নিয়ে মা বাপের বাড়ি চলে এলেন। মামার ছেলেপিলে ছিল না, তাই গরীবের ঘর হলেও আমার আদর-যত্নের কোন ত্রুটি হল না; বড় বয়স পর্যন্ত তাঁর কাছে বসে ইংরাজী-বাংলা কত বই না আমি পড়েছিলুম।
কিন্তু মামা ছিলেন ঘোর নাস্তিক। ঠাকুর-দেবতা কিছুই মানতেন না। বাড়িতে একটা পূজা-অর্চনা কি বারব্রতও কোনদিন হতে দেখিনি, এ-সব তিনি দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না।
নাস্তিক বৈ কি? মামা মুখে বলতেন বটে তিনি Agnostic, কিন্তু সেও ত একটা মস্ত ফাঁকি! কথাটা যিনি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি ত শুধু লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্যই নিজেদের আগাগোড়া ফাঁকির পিছনে আর একটা আকাশ-পাতাল-জোড়া ফাঁকি জুড়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তখন কি ছাই এ-সব বুঝেছিলুম! আসল কথা হচ্চে, সূয্যির চেয়ে বালির তাতেই গায়ে বেশী ফোস্কা পড়ে। আমার মামারও হয়েছিল ঠিক সেই দশা।
শুধু আমার মা বোধ করি যেন লুকিয়ে বসে কি-সব করতেন। সে কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ জানতে পেত না। তা মা যা খুশি করুন, আমি কিন্তু মামার বিদ্যে ষোল আনার জায়গায় আঠার আনা শিখে নিয়েছিলুম।
আমার বেশ মনে পড়ে, দোরগোড়ায় সাধু-সন্ন্যাসীরা এসে দাঁড়ালে সঙ দেখবার জন্যে ছুটে গিয়ে মামাকে ডেকে আনতুম। তিনি তাদের সঙ্গে এমনি ঠাট্টা শুরু করে দিতেন যে, বেচারারা পালাবার পথ পেত না। আমি হেসে হাততালি দিয়ে গড়িয়ে লুটিয়ে পড়তুম। এমনি করেই আমাদের দিন কাটছিল।
শুধু মা এক-একদিন ভারী গোল বাধাতেন। মুখ ভারী করে এসে বলতেন, দাদা, সদুর ত দিন দিন বয়স হচ্চে, এখন থেকে একটু খোঁজখুঁজি না করলে সময়ে বিয়ে দেবে কি করে।
মামা আশ্চর্য হয়ে বলতেন, বলিস কি গিরি, তোর মেয়ে ত এখনো বারো পেরোয় নি, এর মধ্যেই তোর—সাহেবদের মেয়েরা ত এ বয়সে—
মা কাঁদ-কাঁদ গলায় জবাব দিতেন, সাহেবদের কথা কেন তুলচ দাদা, আমরা ত সত্যিই আর সাহেব নই! ঠাকুর-দেবতা না মানো, তাঁরা কিছু আর ঝগড়া করতে আসচেন না, কিন্তু পাড়াগাঁয়ের সমাজ ত আছে? তাকে উড়িয়ে দেবে কি করে?
মামা হেসে বলতেন, ভাবিস নে বোন, সে-সব আমি জানি। এই যেমন তোকে হেসে উড়িয়ে দিচ্চি, ঠিক এমনি করে আমাদের নচ্ছার সমাজটাকেও হেসে উড়িয়ে দেব।
মা মুখ ভার করে বিড়বিড় করে বকতে বকতে উঠে যেতেন। মামা গ্রাহ্য করতেন না বটে,কিন্তু আমার ভারী ভয় হত। কেমন করে যেন বুঝতে পারতুম, মামা যাই বলুন, মার কাছ থেকে আমাকে তিনি রক্ষা করতে পারবেন না।
কেন যে বিয়ের কথায় ভয় হতে শুরু হয়েছিল, তা বলচি। আমাদের পশ্চিম-পাড়ার বুক চিরে যে নালাটা গ্রামের সমস্ত বর্ষার জল নদীতে ঢেলে দিত, তার দু’পাড়ে যে দু’ঘরের বাস ছিল, তার এক ঘর আমরা, অন্য ঘর গ্রামের জমিদার বিপিন মজুমদার। এই মজুমদার-বংশ যেমন ধনী তেমনি দুর্দান্ত। গাঁয়ের ভেতরে-বাইরে এদের প্রতাপের সীমা ছিল না। নরেন ছিল এই বংশের একমাত্র বংশধর।
আজ এতবড় মিথ্যেটা মুখে আনতে আমার যে কি হচ্চে, সে আমার অন্তর্যামী ছাড়া আর কে জানবে বল, কিন্তু তখন ভেবেছিলুম, এ বুঝি সত্যি একটা জিনিস—সত্যিই বুঝি নরেনকে ভালবাসি।
কবে যে এই মোহটা প্রথম জন্মেছিল, সে আমি বলতে পারি না। কলকাতায় সে বি.এ. পড়ত, কিন্তু ছুটির সময় বাড়ি এলে মামার সঙ্গে ফিলজফি-আলোচনা করতে প্রায়ই আসত। তখনকার দিনে Agnosticism-ই ছিল বোধ করি লেখাপড়া-জানাদের ফ্যাশন। এই নিয়েই বেশিভাগ তর্ক হত। কতদিন মামা তাঁর গৌরব দেখাবার জন্য নরেনবাবুর তর্কের জবাব দিতে আমাকে ডেকে পাঠাতেন। কতদিন সন্ধ্যা ছাড়িয়ে রাত্রি হয়ে যেত, দু’জনের তর্কের কোন মীমাংসা হতো না। কিন্তু আমিই প্রায় জিততুম, তার কারণও আজ আর আমার অবিদিত নেই।
মাঝে মাঝে সে হঠাৎ তর্কের মাঝখানে ভঙ্গ দিয়ে মামার মুখপানে চেয়ে গভীর বিস্ময়ে বলে উঠত, আচ্ছা ব্রজবাবু, এই বয়সে এত বড় লজিকের জ্ঞান, তর্ক করবার এমন একটা আশ্চর্য ক্ষমতা কি আপনি একটা ফিনোমিনন বলে মনে করেন না?
আমি গর্বে, সৌভাগ্যে ঘাড় হেঁট করতুম। ওরে হতভাগী! সেদিন ঘাড়টা তোর চিরকালের মত একেবারে ভেঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েনি কেন?
মামা উচ্চ-অঙ্গের একটু হাস্য করে বলতেন, কি জান নরেন, এ শুধু শেখাবার ক্যাপাসিটি।
কিন্তু তর্কাতর্কি আমার তত ভাল লাগত না, যত ভাল লাগত তার মুখের মন্টিক্রিস্টোর গল্প। কিন্তু গল্পও আর শেষ হতে চায় না, আমার অধৈর্যেরও আর সীমা পাওয়া যায় না। সকালে ঘুম ভেঙ্গে পর্যন্ত সারাদিন একশ’বার মনে করতুম, কখন বেলা পড়বে, কখন নরেনবাবু আসবে।
এমনি তর্ক করে আর গল্প শুনে আমার বিয়ের বয়স বারো ছাড়িয়ে তেরোর শেষে গড়িয়ে গেল, কিন্তু বিয়ে আমার হল না।
তখন বর্ষার নবযৌবনের দিনে মজুমদারদের বাগানের একটা মস্ত বকুলগাছের তলা ঝরা ফুলে ফুলে একেবারে বোঝাই হয়ে যেত। আমাদের বাগানের ধারের সেই নালাটা পার হয়ে আমি রোজ গিয়ে কুড়িয়ে আনতুম। সেদিন বিকালেও, মাথার উপর গাঢ় মেঘ উপেক্ষা করেই দ্রুতপদে যাচ্চি, মা দেখতে পেয়ে বললেন, ওলো, ছুটে ত যাচ্ছিস, জল যে এল বলে।
আমি বললুম, জল এখন আসবে না মা, ছুটে গিয়ে দুটো কুড়িয়ে আনি।
মা বললেন, পনেরো মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি নামবে সদু, কথা শোন্—যাসনে। এই অবেলায় ভিজে গেলে ঐ চুলের বোঝা আর শুকোবে না তা বলে দিচ্চি।
আমি বললুম, তোমার দুটি পায়ে পড়ি মা, যাই। বৃষ্টি এসে পড়লে মালীদের এই চালাটার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াব। বলতে বলতে ছুটে পালিয়ে গেলুম। মায়ের আমি একটি মেয়ে, দুঃখ দিতে আমাকে কিছুতেই পারতেন না। ছেলেবেলা থেকেই ফুল যে কত ভালবাসি, সে ত তিনি নিজেও জানতেন, তাই চুপ করে রইলেন। কতদিন ভাবি, সেদিন যদি হতভাগীর চুলের মুঠি ধরে টেনে আনতে মা, এমন করে হয়ত তোমার মুখ পোড়াতুম না।
বকুল ফুলে কোঁচড় প্রায় ভর্তি হয়ে এসেছে, এমন সময় মা যা বললেন, তাই হ’ল। ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। ছুটে গিয়ে মালীদের চালার মধ্যে ঢুকে পড়লুম। কেউ নেই, খুঁটি ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘের পানে চেয়ে ভাবচি, ঝমঝম করে ছুটে এসে কে ঢুকে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখি—ওমা! এ যে নরেনবাবু! কলকাতা থেকে তিনি যে বাড়ি এসেছেন, কৈ, সে ত আমি শুনিনি।
আমাকে দেখে চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ, সদু যে! এখানে?
অনেকদিন তাঁকে দেখিনি, অনেকদিন তাঁর গলা শুনিনি, আমার বুকের মধ্যে যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। কান পর্যন্ত লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠল, মুখের পানে চেয়ে ত জবাব দিতে পারলুম না, মাটির দিকে চেয়ে বললুম, আমি ত রোজই ফুল কুড়ুতে আসি। কবে এলেন?
নরেন মালীদের একটা ভাঙ্গা খাটিয়া টেনে নিয়ে বসে বললে, আজ সকালে। কিন্তু তুমি কার হুকুমে ফুল চুরি কর শুনি?
গম্ভীর গলায় আশ্চর্য হয়ে হঠাৎ মুখ তুলে দেখি, চোখ দুটো তার চাপা হাসিতে নাচচে।
লজ্জা! লজ্জা! এই পোড়ার মুখেও কোথা থেকে হাসি এসে পড়ল, বললুম, তাই বৈ কি! কষ্ট করে কুড়িয়ে নিলে বুঝি চুরি করা হয়?
নরেন ফস্ করে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, আর আমি যদি ঐ কুড়ান ফুলগুলো তোমার কোঁচড়ের ভেতর থেকে আর একবার কুড়িয়ে নিই, তাকে কি বলে?
জানিনে, কেন আমার ভয় হল, সত্যিই যেন এইবার সে এসে আমার আঁচল চেপে ধরবে। হাতের মুঠা আমার আলগা হয়ে গিয়ে চোখের পলকে সমস্ত ফুল ঝপ করে মাটিতে পড়ে গেল।
ও কি করলে?
আমি কোনমতে আপনাকে সামলে নিয়ে বললুম, আপনাদেরই ত ফুল, বেশ ত, নিন না কুড়িয়ে।
এ্যাঁ! এত অভিমান! বলে সে উঠে এসে আমার আঁচলটা টেনে নিয়ে ফুল কুড়িয়ে কুড়িয়ে রাখতে লাগল। কেন জানিনে, হঠাৎ আমার দু’চোখ জলে ভরে গেল, আমি জোর করে মুখ ফিরিয়ে আর-একদিকে চেয়ে রইলুম।
সমস্ত ফুলগুলি কুড়িয়ে আমার আঁচলে একটা গেরো দিয়ে, নরেন তার জায়গায় ফিরে গেল। খানিকক্ষণ আমার পানে চুপ করে চেয়ে থেকে বললে, যে ঠাট্টা বুঝতে পারে না, এত অল্পে রাগ করে, তার ফিলজফি পড়া কেন? আমি কালই গিয়ে ব্রজবাবুকে বলে দেব, তিনি আর যেন পণ্ডশ্রম না করেন।
আমি আগেই চোখ মুছে ফেলেছিলুম, বললুম, কে রাগ করেছে?
যে ফুল ফেলে দিলে?
ফুল ত আপনি পড়ে গেল।
মুখখানাও বুঝি আপনি ফিরে আছে?
আমি ত মেঘ দেখচি।
মেঘ বুঝি এদিকে ফিরে দেখা যায় না?
কৈ যায়? বলে আমি ভুলে হঠাৎ মুখ ফেরাতেই দু’জনার চোখাচোখি হয়ে গেল। নরেন ফিক করে হেসে বললে, একখানা আরশি থাকলে যায় কি না, দেখিয়ে দিতুম। নিজের মুখে-চোখেই একসঙ্গে মেঘ-বিদ্যুৎ দেখতে পেতে; কষ্ট করে আকাশ খুঁজতে হত না।
আমি তখন চোখ ফিরিয়ে নিলুম। রূপের প্রশংসা আমি ঢের শুনেছি, কিন্তু নরেনের চাপা হাসি, চাপা ইঙ্গিত, সেদিন আমার বুকের মধ্যে ঢুকে আমার হৃৎপিণ্ডটাকে যেন সজোরে দুলিয়ে দিলে। এই ত সেই পাঁচ বছর আগের কথা, কিন্তু আজ মনে হয়, সে সৌদামিনী বুঝি বা আর কেউ ছিল।
নরেন বললে, মেঘ না কাটলে ব্রজবাবুকে বলে দেব, লেখাপড়া শেখান মিছে। তিনি আর যেন কষ্ট না করেন।
আমি বললুম, বেশ ত, ভালই ত। আমি ও-সব পড়তেও চাইনে, বরং গল্পের বই পড়তেই আমার ঢের ভাল লাগে।
নরেন হাততালি দিয়ে বলে উঠল, দাঁড়াও বলে দিচ্ছি, আজকাল নভেল পড়া হচ্চে বুঝি?
আমি বললুম, গল্পের বই তবে আপনি নিজে পড়েন কেন?
নরেন বললে, সে শুধু তোমাকে গল্প বলবার জন্যে। নইলে পড়তুম না। বৃষ্টির দিকে চেয়ে বললে, আচ্ছা, এ জল যদি আজ না থামে? কি করবে?
বললুম, ভিজে ভিজে চলে যাব।
আচ্ছা, এ যদি আমাদের পাহাড়ী বৃষ্টি হত, তা হলে?
গল্প জিনিসটা চিরদিন কি ভালই বাসি! একটুখানি গন্ধ পাবামাত্র আমার চোখের দৃষ্টি একমুহূর্তে আকাশ থেকে নরেনের মুখের উপর নেমে এলো। জিজ্ঞেস করে ফেললুম, সে দেশের বৃষ্টির মধ্যে বুঝি বেরোনো যায় না?
নরেন বললে, একেবারে না। গায়ে তীরের মত বেঁধে।
আচ্ছা, তুমি সে বৃষ্টি দেখেচ? পোড়া-মুখ দিয়ে তুমি বার হয়ে গেল। ভাবি, জিভটা সঙ্গে সঙ্গে যদি মুখ থেকে খসে পড়ে যেত!
সে বললে, এর পর যদি একজন আপনি বলে ডাকে, সে আর একজনের মরা-মুখ দেখবে।
কেন দিব্যি দিলেন? আমি ত কিছুতেই তুমি বলব না।
বেশ, তা হলে মরা-মুখ দেখো।
দিব্যি কিছুই না। আমি মানিনে।
কেমন মান না, একবার আপনি বলে প্রমাণ করে দাও।
মনে মনে রাগ করে বললুম, পোড়ামুখী! মিছে তেজ তোর রইল কোথায়? মুখ দিয়ে ত কিছুতেই বার করতে পারলি নে। কিন্তু দুর্গতির যদি ঐখানেই সেদিন শেষ হয়ে যেত!
ক্রমে আকাশের জল থামল বটে, কিন্তু পৃথিবীর জলে সমস্ত দুনিয়াটা যেন ঘুলিয়ে একাকার করে দিলে। সন্ধ্যা হয়-হয়। ফুল ক’টি আঁচলে বাঁধা, কাদা-ভরা বাগানের পথে বেরিয়ে পড়লুম।
নরেন বললে, চল, তোমাকে পৌঁছে দি।
আমি বললুম, না।
মন যেন বলে দিলে, সেটা ভাল না। কিন্তু অদৃষ্টকে ডিঙ্গিয়ে যাব কি করে? বাগানের ধারে এসে ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলুম। সমস্ত নালাটা জলে পরিপূর্ণ। পার হই কি করে?
নরেন সঙ্গে আসেনি, কিন্তু সেইখানে দাঁড়িয়ে দেখছিল। আমাকে চুপ করে দাঁড়াতে দেখে, অবস্থাটা বুঝে নিতে তার দেরি হল না। কাছে এসে বললে, এখন উপায়?
আমি কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললুম, নালায় ডুবে মরি, সেও আমার ভাল, কিন্তু একলা অতদূর সদর রাস্তা ঘুরে আমি কিছুতেই যাব না। মা দেখলে—
কথাটা আমি শেষ করতেই পারলুম না।
নরেন হেসে বললে, তার আর কি, চল তোমাকে সেই পিটুলি গাছটার উপর দিয়ে পার করে দিই।
তাই ত বটে! আহ্লাদে মনে মনে নেচে উঠলুম। এতক্ষণ আমার মনে পড়েনি যে খানিকটা দূরে একটা পিটুলি গাছ বহুকাল থেকে ঝড়ে উপড়ে নালার ওপর ব্রিজের মত পড়ে আছে। ছেলেবেলায় আমি নিজেই তার উপর দিয়ে এপার-ওপার হয়েচি।
খুশী হয়ে বললুম, তাই চল—
নরেন তার চেয়েও খুশী হয়ে বললে, কেমন মিষ্টি শোনালে বল ত!
বললুম, যাও—
সে বললে, নির্বিঘ্নে পার না করে দিয়ে কি আর যেতে পারি!
বললুম, তুমি কি আমার পারের কাণ্ডারী নাকি?
আমি আজও ভেবে পাইনি, এ কথা কি করেই বা মনে এল এবং কেমন করেই বা মুখ দিয়ে বার করলুম। কিন্তু সে যখন আমার মুখপানে চেয়ে একটু হেসে বললে, দেখি, তাই যদি হতে পারি—আমি ঘেন্নায় যেন মরে গেলুম!