ছেলেটি দেখত, মেয়েটি প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে আগে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। হাত দুটো একটু ওপরে তুলে জানালার দুটো শিক ধরে। দাঁড়িয়েই থাকে অন্ধকার হওয়ার আগে পর্যন্ত। তখন খুব চেষ্টা করলেও তার মুখের কোনো ভাবলেশ আর বোঝা যায় না। তারপর একসময় ওই দিকের দোতলাটার নিচে টুক করে সূর্য বসে যাওয়ার মতো সেও জানালার পাশ থেকে সরে যায়। আর তখনো আরও কিছুক্ষণ ছেলেটি ওই জানালার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকত, যদি আবার মেয়েটিকে দেখা যায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত একদিনও দ্বিতীয়বার আর মেয়েটিকে জানালায় দেখা যায়নি।
সন্ধ্যার আগে আগে তাই প্রতিদিন মেয়েটিকে জানালায় দেখা ছেলেটির প্রায় রুটিন হয়ে গিয়েছিল। এই ছোট মাঠে বসে থাকলে, মাঠের ঘাসে গড়াগড়ি দিলে অথবা এখানে একখানা বই হাতে পড়তে পড়তে সূর্য বসে যেতে লাগলে অথবা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে তাতে গেম খেলতে লাগলে সেই সময় চলে আসত, যখন মেয়েটি এসে জানালায় দাঁড়াত।
কদিন পর ছেলেটি অপলক তাকিয়ে থাকত মেয়েটির দিকে। ধীরে ধীরে মেয়েটিও অপলক। কিন্তু কিছুদিন যেতেই ছেলেটি বুঝল, মেয়েটির এই চেয়ে থাকা শুধুই চেয়ে চেয়ে থাকা, ওই চোখে কোনো ভাষা নেই। তবু, বিষয়টি স্থির করার জন্য সে এগিয়ে গেল, ওই ঘাস বেয়ে বেয়ে, মেয়েটির জানালার সামনেই। কেন জানি ছেলেটির মনের তলানিতে এতটুকু আশা ছিল যে মেয়েটির চোখে সে ভাষাহীনার এক ভাষা দেখতে পেয়েছে। সেই ভাষাটা তাকে বুঝতে হবে। কিন্তু, ওই মেয়েটির চোখের ভাষা বোঝার মতো কাছাকাছি গিয়ে সে বুঝেছে, সত্যি ওই চোখে কোনো ভাষা নেই। না, কোনো ভাষাই নেই। একেবারে ভাষাহীন ওই চোখ। তাই হয় নাকি? কিন্তু ছেলেটি বুঝল, সত্যি, কোনো ভাষা নেই!
তাই ছেলেটি আরও এগিয়ে গেল। চোখ যখন কোনো কথাই বলছে না, তো তাকে আবিষ্কার করতে হবে, মেয়েটি অন্ধ কি না। না, তাও তো নয়। তবু ছেলেটি নিশ্চিত হতে একটা ডিগবাজি দিল। তাতে মেয়েটির মুখের এক পাশে যেন একেবারেই অস্পষ্ট এক চিলতে হাসির আভাস দেখা গেল। ওই আভাস যদি সে ভুল না দেখে থাকে, তাই সে মেয়েটির উদ্দেশে ডান হাতটা উঁচু করল। কিন্তু মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না। হাত তো নড়লই না, যেমন ছিল তেমনই থাকল। কিন্তু ছেলেটির কী মনে হলো, সে যেন দেখল, মেয়েটির ডান হাতের তর্জনীটা নড়ল একটু। একবারই। তারপর ছেলেটি যতবার হাত তুলল, হাত নাড়ল। মেয়েটির হাতের ওই আঙুলটি আর একবারও এক চুল নড়ল না। তাহলে সে ভুল দেখেছে?
কিন্তু সব মিলে ছেলেটি ভাবল, মেয়েটির ওই চোখ তার দিকে একবার হেসে উঠেছে, তার ইশারায় হাতের আঙুল নাড়িয়েছে। এ টুকু হলো তার অবলম্বন। তাই, সে প্রায় জানালার কাছেই গেল। কিন্তু সেদিন ততক্ষণে চারদিকের আলো ফুরিয়ে আসায় মেয়েটি প্রতিদিনের মতো চলে গেল।
পরদিন ছেলেটি জানালার কাছে সেই জায়গায়ই দাঁড়িয়ে থাকল। মেয়েটিও তার নির্দিষ্ট সময় এসে দাঁড়াল। ছেলেটি প্রথমেই কিছু একটা বলতে চাইল। বলতে পারল না। কী বলবে তাই ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারল না কিছুক্ষণ। ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, অন্ধকার একটু গাঢ় হওয়ার আগেই তো মেয়েটি চলে যাবে সে জানে। এর আগে কিছু একটা আজ তাকে বলতে হবে। তাই ছেলেটি ভাবল, কিছু একটা বলবে। কী বলবে, এটা ভাবতেই আরও কিছু সময় চলে গেল।
এ সময় সত্যি সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। খুব দ্রুত। ছেলেটি যা-যা বলবে বলে ভাবল: প্রথমে ভাবল বলে, ‘তুমি কী দেখো?’ বলতে পারল না। তারপর ভাবল বলে, ‘তুমি কথা বল না কেন?’ তাও বলতে পারল না। তারপর ভাবল, ‘হাতটা অত ওপরে তুলে রাখো কেন, ব্যথা হয় না?’ তাও বলা হলো না। তারপর ভাবল বলে, ‘আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখি। তোমাকে দেখতে আমার ভালো লাগে।’ কিন্তু তাও বলতে পারল না।
এদিকে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। ছেলেটি জানে, মেয়েটি এখনই চলে যাবে। হয়তো এখনই চলে যাবে। হ্যাঁ, এখনই চলে যাবে। এই হয়তো চলে যাচ্ছে। এই যায়। এতক্ষণ ছেলেটি প্রায় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটু এগিয়ে গেল। আর তখন ছেলেটিকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি ছেলেটির অব্যক্ত প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিল। নিচু গলায়, কিন্তু একেবারেই স্পষ্ট করে।
ছেলেছি শুনল:
‘দেখি, সবকিছু কত সুন্দর!’
—!
‘কী আর বলব? সবই তো কথা বলে, গাছপালা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি, সূর্য আর তুমিও তো বলো—’
—!!
‘হাত দুটো একটু ওপরে তুলে জানালার শিক ধরে রাখলে একটানা দাঁড়িয়ে থাকা যায়। আর নড়তে হয় না।
—!!!
‘আমিও প্রতিদিন তোমাকে দেখি। তোমাকে দেখতে আমারও ভালো লাগে।’
—!!!!
মেয়েটি চলে গেল।
ছেলেটি ধাতস্থ হয়ে ভাবল, কী শুনল? যা শুনল তা কি সত্যি?
কে জানে।
মেয়েটি আর কখনো জানালায় আসেনি।
যদিও ছেলেটি প্রতিদিন একই সময় ওই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৩, ২০১০

Super User