হেছো ওয়া দো শিমাছ্কা—নাড়ি কী করবেন?
নার্সের কথাটা ঠিক ধরতে পারে না জহির। মনোযোগের অভাব ছিল, সেটা অবশ্য একটা কারণ হতে পারে। তা মনোযোগ থাকেই বা কী করে! সামনে প্রসবের ব্যথায় ছটফট করছে তার স্ত্রী। এক একবার ব্যথা উঠছে আর মেয়েটা তার আঙুলের লম্বা নখগুলো ডুবিয়ে দিচ্ছে জহিরের শরীরের এখানে-সেখানে। ভোর চারটায় শুরু হয়েছিল। ওরা এসেছে পাঁচটায়। আর এখন ন’টা বাজতে যাচ্ছে। গত চার-পাঁচ ঘণ্টায় অগ্রগতি সামান্যই। ওর কাতর মুখের দিকে না তাকিয়েও জহির বুঝতে পারে, কী কঠিন সময় পার করছে বর্ণা! একবার কোথায় যেন শুনেছিল, পৃথিবীতে মৃত্যুযন্ত্রণার সঙ্গে তুলনীয় কোনো ব্যথা যদি থেকে থাকে তো সেটা প্রসবের ব্যথা। একজন মানুষ তার চোখের সামনে মৃত্যুযন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, অথচ শুধু হাত ধরে বসে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। নিজের অসহায় অবস্থাটা বেশ ভালোভাবেই টের পায় জহির। সন্তানসম্ভবা বাঙালি মেয়ের মন এ সময় কত কিছু প্রত্যাশা করে! জহির তার সেরা চেষ্টাটা দিয়েও সেসবের কতটুকুই বা পূরণ করতে পারছে—এ নিয়ে সূক্ষ্ম একটা অপরাধবোধ জহিরের মনকে মেঘাচ্ছন্ন করে ফেলে। বর্ণাকে দেশে পাঠিয়ে দিলেই হয়তো ভালো হতো—দীর্ঘশ্বাসটা আটকাতে গিয়ে জহির আরও খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
একটা যন্ত্রের মাধ্যমে ব্যথার ফ্রিকোয়েন্সি এবং শক্তি মনিটর করা হচ্ছে। প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকা লম্বা কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে জহির বোঝার চেষ্টা করছিল ব্যথার গতিপ্রকৃতি। ৯/১০ মিনিট পরপর একবার আসছে। নার্স মেয়েটা বলছিল, এই রেট আরও বাড়তে হবে। অন্তত প্রতি দু-তিন মিনিটে একবার না হলে লেবার রুমে ট্রান্সফার করা হবে না। অতএব ব্যথা কমলে চলছে না, আপাতত বাড়া চাই। মানুষের জন্মের এই কঠিন প্রক্রিয়াটা নিয়ে হঠাৎই খানিকটা দার্শনিক হয়ে উঠতে চায় জহিরের মন। ওর মুখের অমনোযোগ লক্ষ করে চটপটে মেয়েটা কথাটা আরও একবার বলে—নাড়ির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
এবার কথাটা ধরা যায়, কিন্তু তাতে লাভ হয় না। ‘হেছো’ শব্দটার মানেই জানে না জহির। মেয়েটাকে সরাসরি ওর অজ্ঞতার কথা জানায় সে। মেয়েটা একটু লজ্জা পায়। জহিরকে অপেক্ষা করতে বলে সে দ্রুত পায়ে বের হয়ে যায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রুমে ঢোকে হেড নার্স। ছোটখাটো গড়নের হেড নার্স জহিরকে তার সঙ্গে আসতে বলে দ্রুত লিফটের দিকে হাঁটতে শুরু করে। জহির বর্ণাকে বলে নার্সের পেছন পেছন ছোটে। হেড নার্সের হাতে একগাদা কাগজপত্র। হাঁটতে হাঁটতে একটা একটা করে সে জহিরের হাতে দেয় আর বোঝায়—এই কাগজগুলো এখনই রোগী ভর্তির ঘরে জমা দেওয়া দরকার। কিছু লেখালেখির ব্যাপার আছে। আমি তোমার সাথেই আছি।
কাজ শেষ হতে আধা ঘণ্টাও লাগে না। ফেরার পথে নার্স ‘হেছো’র ব্যাপারটা জহিরের কাছে ব্যাখ্যা করে। গত বছর এ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে একটা নতুন সেবা চালু হয়েছে। প্রসবের পর নবজাতক ও মায়ের ভেতর সংযোগ স্থাপনকারী নাড়ির একটা অংশ এখন থেকে মা-বাবাকে দিয়ে দেওয়া হবে। এই নাড়ি জীবনভর সন্তানকে মায়ের সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সংযুক্তির ব্যাপারটা মনে করিয়ে দেবে। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যের এই সেবা পাওয়ার একমাত্র পূর্বশর্ত হলো, আগ্রহী মা-বাবাকে তাদের আগ্রহের ব্যাপারটা দরখাস্তের মাধ্যমে আগেভাগেই কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। জহির চমৎকৃত হয়। একবার ভাবে, বর্ণার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলবে। কিন্তু ওর অবস্থার কথা ভেবে চিন্তাটা বাতিল করে দেয়। নার্সকে শুধু নাড়িখণ্ডের ব্যাপারে তার আগ্রহের কথাটা জানিয়ে রাখে।
ওয়ার্ডে ফিরে এসে জহির দেখে, বর্ণা নেই। তার জিনিসপত্রও নেই। নার্স জানাল, বর্ণাকে লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জহির বেরিয়ে যাওয়ার পর ব্যথা বেড়ে গিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেলিভারি হয়ে যাবে। উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় জহির প্রায় দৌড়ে লেবার রুমে ঢোকে এবং ঢুকেই চমকে যায়—বর্ণা কনসিভ করবার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি চেকআপে যিনি ওকে দেখেছেন, সেই ডা. মিস নোরিকো গাউন, গ্লাভ্স পরে লেবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। ডেলিভারির সময় ডা. নোরিকোকে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে জহির, বর্ণা দুজনেই বড় ধরনের উৎকণ্ঠার ভেতরে ছিল। লেবার রুমে পুরুষ ডাক্তারের উপস্থিতির ব্যাপারে বর্ণার প্রবল আপত্তি। মুখে ওকে বারবার আশ্বস্ত করলেও জহির জানত, ব্যাপারটা তার হাতের বাইরে। লেবার রুমে মিস নোরিকোর উপস্থিতি জহিরের জন্য বিরাট স্বস্তি বয়ে আনে। সে ডা. নোরিকোর দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা ঝুঁকিয়ে জাপানি কায়দায় অভিবাদন জানায়। শুকিয়ে আসা মুখে কথা তার ফোটে না। তার কৃতজ্ঞতাটুকু লেবার রুমের ভারী হয়ে উঠতে থাকা বাতাসে স্থির হয়ে ঝুলে থাকে।
একটু পরেই নার্সের ‘ওমেদেতো গোজায়মাছ’ (অভিনন্দন) আর সেই সঙ্গে নবজাতকের কান্নার শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে জহির; তার ঊনত্রিশ বছরের জীবনের শ্রেষ্ঠতম দৃশ্যটা দেখতে পায়। বর্ণা দুহাতে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে আছে তাদের সদ্যোজাত সন্তান। গোলাপি ও নীল মেশানো গায়ের রং। কেমন অনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়ছে আর মাঝে মাঝে তারস্বরে চিৎকার করে উঠে নতুন এই জায়গাটার ব্যাপারে তার আপত্তি জানাচ্ছে। একটু আগের নাড়িসংক্রান্ত আলোচনার কারণেই কি না কে জানে, জহিরের সমস্ত আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয় নবজাতকের নাভিতে। সাদা রঙের নাড়িটা বেশ খানিকটা লম্বা হয়ে ঝুলছে। ওটাই কি তাকে দেওয়া হবে? জহির তার নাভির কাছে এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। নিজেকে সবকিছু থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন মনে হয় তার। পরক্ষণে নিজেকে আবিষ্কার করে চালচিত্রটুকুর একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। নবজাতকের চিৎকার আর মাতৃত্বের গৌরবে হঠাৎ বদলে যাওয়া বর্ণার মুখের ভেতরে নিজের উপস্থিতি টের পায় সে। নিজেকে সাংঘাতিক সৌভাগ্যবান বলে মনে হয় তার। তার চোখ ভিজে ওঠে।
বুয়েট থেকে বেরিয়ে তার অনেক বন্ধুর মতো জহিরও আমেরিকায় পাড়ি জমাতে চেয়েছিল। লুজিয়ানা টেক থেকে তার আই-টুয়েন্টিও এসেছিল। কিন্তু সে ভিসা পায়নি। সম্ভবত তার ব্যাংকের কাগজপত্রে অসংগতি ধরা পড়েছিল। গোঁজামিল তো কিছু ছিলও। তবে জহির মনে করে, সে মূলত নাইন-ইলেভনের শিকার। নাইন-ইলেভনের পরপর স্টুডেন্ট ভিসায় যে ধসটা নেমেছিল, সেটাই শেষ করে দিয়েছিল তার সম্ভাবনা। আমেরিকার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর জাপানে বসবাসরত তার এক খালাতো ভাইয়ের উৎসাহে সে এখানকার ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করে। শুরুর দিকটা কষ্টে গেছে। স্কলারশিপ ছিল না। পার্টটাইম করে কোনোরকমে চালিয়েছে। মাস্টার্সের দ্বিতীয় বছরে ছোটখাটো একটা স্কলারশিপ পেয়ে কষ্টটা কিছু কমেছিল। মাস্টার্স শেষে পিএইচডিতে এনরোল করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এখানে চাকরির বাজারে নাকি পিএইচডি এক ধরনের অতিযোগ্যতা। তার পরও খুব ভালো চাকরি না হলে পড়াশুনো চালিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছিল। সেটা আর হয়নি। ফুজিৎসুর এই চাকরিটার জন্য তার প্রফেসর নিজে সুপারিশ করেছিলেন। না ঢুকলে খারাপ দেখাত। অফিসে ওর দুজন ইন্ডিয়ান কলিগ আছে। তাদের একজন আবার কলকাতার। ওদের সঙ্গে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেট, হিন্দি ছবি আর ইলিশ মাছ নিয়ে আড্ডা ভালোই জমে।
এখানকার নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ওর ভালো লাগে। বছর দেড়েক আগে বর্ণা আসার পর ভালো লাগা বহুগুণ বেড়ে গেছে। গত দেড়টা বছর অসম্ভব দ্রুত কেটেছে। যেকোনো বিবেচনায় এ সময়টাকে তার জীবনের সেরা সময় বলে ফেলতে পারে সে। ভবিষ্যতের কথাও ওরা ভাবে। স্থায়ী ইমিগ্রেশনের সুযোগ নিয়ে সুবিধাজনক কোনো এক সময়ে কানাডায় গিয়ে ওঠাটা একরকম ঠিক করা আছে। অবশ্য জাপানে সেটল করাটাও একটা অপশন হয়ে উঠেছে ইদানীং। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে না নিলেও চলছে। আপাতত দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর সবগুলো অপশনই খোলা থাক। প্রবল গতিময় এই সময়টাকে উপভোগ করতে করতে আরও একটু ভাবতে চায় ওরা।

পাঁচ দিন পর শনিবার সকালে বর্ণাকে আনতে হাসপাতালে যাওয়ার সময় বাক্সটা পকেটে ভরে নেয় জহির। এই কদিন সে জিনিসটাকে রোদে শুকিয়েছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করেছে, কীভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে রং বদলাতে বদলাতে সাদা জিনিসটা একেবারে কুচকুচে কালো হয়ে গেল। এখন বলে না দিলে কারও পক্ষে এর আসল পরিচয় উদ্ধার করা অসম্ভব।
হাসপাতালে পৌঁছেই একগাদা কাজে জড়িয়ে পড়ে জহির। বাচ্চার নাভিমূল পরিষ্কার করার নিয়ম, বাচ্চা ও মায়ের পরবর্তী চেক-আপের সময়, বার্থ সার্টিফিকেট এবং এরকম আরও বেশ কিছু ব্যাপার তাকে বুঝে নিতে হয়। ঝামেলায় পকেটের বাক্সের কথা তার মনেই পড়ে না।
তোমার জন্য সাংঘাতিক এক্সাইটিং একটা জিনিস আছে, জীবনে দেখোনি, এমনকি শোনোওনি। ঘণ্টা খানেক পর বাড়ি পৌঁছে জহির বর্ণাকে বলে।
আগে বলোই না, এক্সাইটিং বস্তুটা কী?—বর্ণাকে সত্যি সত্যি আগ্রহী মনে হয়।
খুলে দেখো—জহির বর্ণার হাতে বাক্সটা দেয়।
বর্ণা কিছুক্ষণ বাক্সটা নেড়েচেড়ে দেখে। বাক্সটা যে তার পছন্দ হয়েছে—তার মুখে সেটা পড়ে নেওয়া যায়। খাঁটি চন্দন কাঠের জিনিস। ওপরে চমৎকার কারুকাজ। পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে বাক্সটা খুলে ভেতরের কালো কুচকুচে জিনিসটা দেখে ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা হয় ওর।
কী এটা!
নাড়ি।
নাড়ি মানে?
নাড়ি মানে নাড়ি। নাড়ি দিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে।
কী আবোলতাবোল বকছ!
আবোলতাবোল বকতে যাব কেন! নাড়ি কেটে এক পিস আমাদেরকে দিয়েছে। সঙ্গে দিয়েছে চন্দন কাঠের ওই সুন্দর বাক্সটা। বলেছে নাড়ি শুকিয়ে এই বাক্সে রেখে দিতে। কীভাবে শুকাতে হবে তাও বলে দিয়েছিল। জানতে চাও!
কী ঘেন্নার কথা! নাড়ি শুকিয়ে বাক্সে ভরে রাখতে হবে কেন! বর্ণা বিস্ময়ে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।
নাড়ি তোলা থাকলে বাচ্চা কখনো মায়ের কথা ভুলতে পারবে না। নাড়ির টান আর কি! জহির হালকা গলায় হেড নার্সের কাছে শোনা ব্যাখ্যাটা বর্ণার কাছে অনুবাদ করে।
বর্ণার মুখটা হঠাৎ বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে আস্তে ও বলে, মাকে মনে রাখতে নাড়ি তুলে রাখতে হবে!
খুব নরম স্বরে বলা কথা—অভিযোগ হয়তো আছে, কিন্তু তা প্রবল নয়, যতটা প্রবল মাতৃত্বের আহত অহংবোধ। জহির ঝাঁজটা স্পষ্ট টের পায়। মাত্র তো পাঁচ দিন। ক্ষতগুলো এখনো কাঁচা!

সন্ধ্যায় ইশিকাওয়া সানের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় জহির। খবরটা দিতেই শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন বৃদ্ধা। পারলে এখনই দেখতে রওনা হয়ে যান। বারবার বলতে থাকেন—কোদোমো ওয়া কাউয়াই নে! শিশুরা সুন্দর, তাই না!
কথাটা জহির ও বর্ণা ইশিকাওয়া সানের মুখে আগেও শুনেছে। কিন্তু আজ কথাটায় গভীর আনন্দের সঙ্গে গভীরতর এক বিষণ্নতা খুঁজে পায় জহির। ইশিকাওয়া সান জহিরদের প্রতিবেশী এবং এ দেশের আর দশটা মানুষের মতোই লাজুক ও মুখচোরা। ওর সঙ্গে জহিরের পরিচয় কোনো দিনই সম্ভব হতো না, যদি না জহির ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের সেই দিনগুলোতে তার জাপানি ভাষাচর্চার জন্য পাড়ার পার্কের বেঞ্চে প্রায়ই নিঃসঙ্গ বসে থাকা এই মহিলাকে বেছে নিত। গত চার বছরে ইশিকাওয়া সানকে একটু একটু করে আবিষ্কার করেছে জহির—যতটা কথায়, তার চেয়ে অনেক বেশি মুখোমুখি বসে থাকা নীরবতায়। স্বামী মারা গেছেন বারো বছর আগে। ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার এক বছর পর আত্মহত্যা করেছিলেন। ‘গণ-আত্মহত্যা’র একটা দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের ব্যাপারটা জানা গিয়েছিল অনেক পরে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে ওঁর। বড় ছেলে অটোমবিল ইঞ্জিনিয়ার—টয়োটার তিয়ানজিন প্লান্টে কাজ করে। ছোট ছেলে গ্রাউন্ড সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের সদস্য। ইরাকে আছে। মেয়েটা স্বামীর সঙ্গে থাকে ফুকুওকায়। প্রতিবছর আগস্টে ‘ওবনে’র (‘আত্মার প্রত্যাবর্তন’) ছুটিতে ছেলেমেয়েদের দু-একজন বাড়িতে আসে। বছরের বাকিটা সময় মহিলা মূলত একা। ছেলেমেয়েরা চায় ওঁকে ওল্ড হোমে উঠিয়ে দিতে। কিন্তু মহিলা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
কিছুক্ষণ বসে, আজ তাহলে উঠি, কাল বিকেলে এসে তোমাকে নিয়ে যাব—বলে বিদায় নিয়ে বাইরে আসে জহির।
আজ খুব ঠান্ডা পড়েছে। প্রশান্ত তীরের এই শহরটাতে শীত আসে বাতাসের পিঠে চেপে। কনকনে ঠান্ডা বাতাসে অস্থিমজ্জা হিম হয়ে আসে জহিরের। ভারী জ্যাকেটটাকে সে গায়ের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে। রাত বেশি হয়নি। এখনো গাড়ি চলছে—এ দেশে যেভাবে চলে—সরীসৃপের মতো নিঃশব্দে। শুধু বাতাসের শব্দ তার চারপাশ আন্দোলিত করে তুলেছে। কিন্তু সেই পরাক্রান্ত বাতাসের শব্দ তার কানে ঢোকে না। তার কানে ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজতে থাকে ‘কোদোমো ওয়া কাউয়াই নে’! শিশুর সৌন্দর্য নিয়ে বলা সাধারণ কথাটাকে হঠাৎ খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় তার কাছে। তার সমস্ত জগৎটা যেন ভীষণ একটা নাড়া খায়। প্রবাসের অনাত্মীয় পরিবেশে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম, হাসপাতাল থেকে নাড়ি উপহার দেওয়া এবং এ ব্যাপারে বর্ণার প্রতিক্রিয়া, আর একটু আগে ইশিকাওয়া সানের মুখে হাহাকারের মতো শোনানো সন্তানবাৎসল্য—ঘটনাগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে। পুরো ব্যাপারটাকে সাজানো বলে মনে হয় তার, যেন বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে খুব কৌশলে কেউ এটা সাজিয়েছে। কেউ যেন কিছু একটা বলতে চায় তাকে। জহির উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।

দুবছর পর একদিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল জহির। ওদের অফিস বনানীতে। বন্ধু সজল আর ফজলুর সঙ্গে একটা সফটওয়্যারের ব্যবসা দাঁড় করাতে বছর খানেক ধরে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে চলেছে ওরা। যদিও বলবার মতো কোনো অবস্থায় এখনো যেতে পারেনি ওদের প্রতিষ্ঠান, তবে সামনে কিছু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ফুজিৎসুর সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে একটা সফটওয়্যার রিসার্চ ল্যাব গড়ে তোলার ব্যাপারে আলোচনা বেশ খানিকটা এগিয়েছে। ‘মেডিকেল ইনফরমেটিক্স’-এর ব্যাপারে জহিরের আগ্রহ ছিল। ফুজিৎসুতে কাজ করার সময় ওদের মেডিকেল সফটওয়্যার রিসার্চ ল্যাবে ওকে কয়েকবার ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়েছিল। মেডিকেল ইনফরমেটিক্সের মূল জিনিসগুলো ও সেখান থেকে শিখেছে। অবাক হয়ে দেখেছে কীভাবে সফটওয়্যার ব্যবহার করে জেনেটিক ইনফরমেশন পর্যন্ত প্রসেস করা সম্ভব। বাংলাদেশ মেডিকেল সফটওয়্যারের একটা ভালো বাজার হতে পারে—গত কয়েক মাসের চেষ্টায় জহির তার এই ধারণাটাকে ফুজিৎসুর উঁচু পর্যায়ের দু-একজনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। জহির জানে, ওর ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ও। পালানোর কোনো পথই খোলা রাখেনি।
এখন নভেম্বর মাস। এক কোটি মানুষ আর লাখো যানবাহনের গরম নিঃশ্বাসকে পরাজিত করে ঢাকার বাতাস অবশেষে কিছুটা শীতল। সকালের দিকটাতে বেশ একটু শীত শীত লাগে। বর্ণা দু-একদিন আগে গরম কাপড় বের করেছে। সেখান থেকে একটা জ্যাকেট নিয়ে গায়ে চাপাতে চাপাতে অভ্যাসবশে পকেটে হাত দিয়েই চমকে ওঠে জহির। বাক্সটা এখানে! কী আশ্চর্য! অথচ এক বছর ধরে মনে মনে কত জায়গাতেই না খুঁজেছে ওটাকে!
‘তোমাকে একটা জিনিস দেখাব মা!’ এক দৌড়ে মায়ের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জহির বলে। তার গলায় চাপা উত্তেজনা।
এশরাকের নামাজ পড়ছিলেন মা। আর জায়নামাজের ওপর বসে দাদির নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিল অভ্র। ছেলেটা দাদির ভীষণ ন্যাওটা। সারাটা দিন তার কাটে দাদির সঙ্গে। ওর পেছনে ছুটতে ছুটতে মার হাঁটুর ব্যথাটা নাকি এখন ভালোর দিকে—বর্ণার কাছে কথাটা শুনে সেদিন বেশ মজা পেয়েছিল জহির।
নামাজ শেষ করে উঠতে উঠতে ছেলেকে দেখে মা বললেন, আয়! কী যেন দেখাবি বলছিলি?
হ্যাঁ মা। এই যে এইটা—বলে বাক্সটা মায়ের হাতে দেয় জহির। সঙ্গে নাড়ির গল্পটা বলে।
সব শুনে হাসতে হাসতে মা বলেন, নাড়ি তুলে রাখতে নেই রে পাগল! মাটি চাপা দিতে হয়।
জহির কিছু বলে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২১, ২০১০

Super User