সোমেন চন্দ

এমন আশ্চর্য ব্যাপার আর দেখি নাই, লোকটা সরবে রোদন করিতে লাগিল-ভেউ ভেউ ভেউ! কান্নার কয়েকটি নামই জানি, জীবনের এতগুলি বছর ধরাপৃষ্ঠে অবস্থান করিয়া কান্না সম্বন্ধে অনেক অভিজ্ঞতাই লাভ করিয়াছি, কিন্তু এটি কোন্‌ জাতীয়, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। অথচ পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে অচেতন হইয়া এখন কোনো ভাবনাই যে ভাবা উচিত নয়, এই তথ্যটি অতি সহজেই ভুলিয়া যাওয়ায় সহজেই বাধাপ্রাপ্ত হইলাম। চিন্তার সূত্র ধরিয়া বেশি দূর অগ্রসর হই নাই, হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড দীর্ঘনিশ্বাসযুক্ত ফোঁপানির শব্দে সভয়ে মুখ তুলিয়া দেখি, কান্নার পর্ব সশব্দে সমাপ্ত করিয়া লোকটা এবার ফুঁপাইতেছে এবং জামার আস্তিনে চোখ মুছিতেছে।

তাড়াতাড়ি বলিলাম, দেখুন এমন করে কাঁদবেন না, ও দেখে আমারও যে ভারী কান্না পায়। ছোটোবেলায় ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই মা হারিয়ে কত কেঁদেছি, বড়ো হয়ে পরীক্ষায় পাস করে কেঁদেছি, আর বিয়ে করে যা কেঁদেছি, তার তো তুলনাই হয় না, আর সে দিন সাহেবের সঙ্গে বচসা করে যা কেঁদেছি সে কথা মনে করে এখনও যে আমার ভয়ানক কান্না পাচ্ছে। দেখুন আমি বড়ো···’ আর বলিতে পারিলাম না, কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল।

লোকটার বিপুল কান্না দেখিয়া প্রথমে ভয় পাইয়াছিলাম আমি, তারপর আমারও সুবিপুল ইতিহাস শুনাইয়া মনে করিয়াছিলাম, বুঝি এবার সেও চোখমুখ হইতে সবেগে হাত সরাইয়া আস্তিন গুটাইয়া উলটা আমার মুখের দিকে শঙ্কায় চাহিয়া থাকিবে! কিন্তু এ কী হইল! কান্নার ইতিহাস শুনাইয়া আর একজনের কান্নার বেগকে আরও কয়েক ডিগ্রি বাড়াইয়া দিলাম যে! মরিয়া হইয়া বলিলাম, ‘আহা, অত কাঁদছেন কেন? এমন ভেঙে পড়লে কি চলে? বিরাট মহীরুহ যিনি, জীবন যুদ্ধে তাঁকে অত সহজে ভেঙে পড়লে কি চলে? কত কত ঝড়ের বাধাবিপত্তি তাঁকে সয়ে যেতে হয়, অটল থাকতে হয়, আপনি তো এক বিরাট মহীরুহ!’

অতঃপর অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া, অনেক ছোটোখাটো ইতিহাস শুনাইয়া, অনেক চেষ্টা করিয়া যা জানিতে পারিলাম তা এইঃ তাহার বড়ো ছেলেটি নিশ্চয় আমি দেখিয়াছি, সেই ছেলের সঙ্গে আজ ভোরবেলায় সামান্য এক কথা নিয়া বচসা, তারপরেই ঝগড়া এবং এমন কথা কি কেউ শুনিয়াছে-ঝগড়ার কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল-জ্নদাতা পিতার শতদোষ থাকিলেও, পুত্র তাহাকে মারিতে উদ্যত হয়? এবং এখন কী করিতে হইবে, সেটা আমার মতো লোকেরই বিবেচ্য, যেহেতু আমি তাহার প্রতিবেশী-ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী, এই দারুণ বিপদে সাহায্য করিবার দায়িত্ব আমারই সবচেয়ে বেশি। অবশেষে আমিও তাহার অনুরোধ অনুযায়ী তাহাদের পিতা-পুত্রের কলহের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া একটি ভীষণ দায়িত্ববোধের প্রেরণাতেই সকল তথ্য নিভুêল হিসাবে সংগ্রহ করিবার জন্য অতি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম ছেলেটির নাম কী?

বাজখাঁই গলায় উত্তর আসিল, জহরলাল! বলার ভঙ্গিতে আশ্চর্য হইয়া সভয়ে পিতৃভক্ত জহরলালের পরম ভাগ্যবান পিতার দিকে চোখ বড়ো করিয়া তাকাইলাম। এতক্ষণ কেবল তাহার কান্না নিয়াই বিশেষ ব্যস্ত ছিলাম, লোকটা সকল অবয়বে বিশেষ নজর দেওয়ার বিশেষ সুযোগ পাই নাই, এখন দিলাম। প্রথমেই দৃষ্টিতে পড়ে তাহার মাথাটি, সেখানে একেবারেই গড়ের মাঠ, মুখের দাড়ি-গোঁফ কামানো, দুটি দীর্ঘাকৃতি কানে ছোটো-বড়ো কাঁচা-পাকা লোম, গায়ে শার্টও নহে পাঞ্জাবিও নহে এমন একটি জামা, হাঁটুর উপর কাপড়, পায়ে কাপড়ের জুতা এবং গায়ের রঙ-এ কৃষ্ণ।

পিতা-পুত্রের কলহের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া তথ্যসমূহ সম্পূর্ণ করিবার মানসেই আবার সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিলাম, ‘দেখুন আমার ধৃষ্টতা মাপ করবেন, আপনার নামটি আমার এখনও জানা হয়নি! নামটি কী জানতে পারি?’

তেমনি গলায় উত্তর আসিল, ‘পৃথ্বীরাজ সিংহরায়!’ চমকিয়া উঠিলাম। পৃথ্বীরাজ পিতা জহরলাল পুত্র! তথ্য সম্পূর্ণ করিতে হইলে আরও কত যে সংযুক্তা-কমলা-ইন্দিরা-জয়চন্দ্রের মতো, এমনকী শিবাজি প্রতাপসিংহেরও মতো আরও কত যে বীর-বীরাঙ্গনা নরনারীর সন্ধান মিলিবে, সে কথা মনে করিয়া সাহস সঞ্চয় করা আর হইল না! সুরমার আশায় পেছনে দরজার পর্দার দিকে একবার তাকাইলাম।

আজ মাত্র কয়েকদিনই হয় এই বাসাটিতে সমস্ত মালপত্র (শুধু মালপত্রের কথাই বলিলাম এইজন্য যে, সুরমাকে আমি ওই দলেই ফেলি, অবশ্য সুরমা শুনিলে ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিবে) নিয়া উঠিয়া আসিয়াছি। এখনও এ পাড়ায় একেবারেই নূতন, কোনোদিন যে পুরানো হইব সে ভরসাও রাখি না! কারণ, অফিসে কাজের যে চাপ, যাইবার সময় সময়ের স্বল্পতায় রাস্তার মানুষকে মানুষ বলিয়াই গ্রাহ্য করি না; সন্ধ্যার ছায়ায় ফিরিবার সময় তাহাদের শুধু চলায়মান ছায়ামূর্তির মতোই দেখি, ছুঁইতে গেলে যেন হাতে হইতে ফসকাইয়া যাইবে। তারপর বাড়ি গিয়া যৎকিঞ্চিৎ খাবারের লোভে দৈনিক অসুস্থতাকে কাটাইয়া উঠি, আর দিবা-রাত্রির বাকি সময়টুকু তো সুরমাই অধিকার করিয়া থাকে। কখন যে এ পাড়ার সকলের সঙ্গে সামাজিক হইবার জন্য উঠিয়া-পড়িয়া লাগিব, সে কথা ভাবিয়াই কুল পাই না। কিন্তু ইতিমধ্যে পৃথ্বীরাজ সিংহ মহাশয়ের মতো অতি নিকটবর্তী এক ভদ্র প্রতিবেশীজনের সাক্ষাৎ পাইয়া কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলাম, শুধু আশ্বস্ত হইলাম কেন, তৃপ্তিলাভ করিলাম, ইহাও বলিতে পারি!

পর্দার পেছনে সুরমাকে আশা করা বৃথা। এঘর-ওঘর তাহাকে খুঁজিতে খুঁজিতে হঠাৎ এমন মনে হইল যে, সে যেন কোনো বন্যবালিকা, আর আমি তাহার কৃষকসাথি, অরণ্যে অরণ্যে, কত পাহাড়ের গা বাহিয়া, কত গাছ-লতাপাতা ঝোপঝাড়ের ছায়ায়-ছায়ায় ঘুরিয়া তাহার প্রতিধ্বনিযুক্ত কলহাসির পেছনে অনুসরণ করিতেছি। ঘর-দেয়াল দরজা-জানালা সমস্ত অগ্রাহ্য করিয়া বীরদর্পে অগ্রসর হইলাম (গান জানিলে গাহিতাম) গলার স্বর যথাসম্ভব মধুর করিয়া কেবল ‘সুরমা’ ‘সুরমা’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলাম। কিন্তু কোথায় সুরমা? চমক ভাঙিল, পাহাড়-অরণ্যকে ভুলিলাম। ঘরের বাইরে গিয়া ভিতরের বাঁধানো আঙিনা পার হইয়া দেখি, তুলসীবৃক্ষের অবস্থানের জন্য সমস্ত বাড়ির মধ্যে যে কিঞ্চিৎ জমিটুকুর ব্যবস্থা রহিয়াছে, সেখানে উপুড় হইয়া সে একটি লাউবৃক্ষ রোপণ করিবার চেষ্টায় আছে।

বলিলাম, অতএব এখন যথা আড়ম্বরে বৃক্ষরোপণ-উৎসব করাই বিধেয়। যাও তোমার কেবল ঠাট্টা আর ঠাট্টা, কেবল অভিনয়। বলিলাম, ঠাট্টা আর অভিনয় এ দুটিতে তফাত আছে, দুটি এক বস্তু নয়। -হ্যাঁ, এক, আমি বলছি এক! ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলবার কী দরকার ছিল?

হা হা করিয়া হাসিয়া বলিলাম, তাহলে অভিনয়ের কথাই বলি শোনো। মানুষের অভিনয়কে চিরকাল কী ঘৃণাই-না করে এসেছি দেখবে। ষোলো বছরে পড়েছি পর অর্থাৎ তোমরা যে বয়সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ কর, সেই যৌবনে পদার্পণ করেছি পর-কী হল জান-আমিও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। এর আগে অবধি নিজেকে ভেবে এসেচি, বুঝলে সুরমা নিজেকে ভেবে এসেচি পুরুষ, আর তখন এমন অবস্থা হল যে কেবলই মনে হতে লাগল, আমি ভয়ে ভয়ে সুরমার দিকে তাকাইলাম, মুখে তাহার ঔৎসুক্য বা বি্নয়ের চিহ্নমাত্র না-দেখিয়া বিনা দ্বিধায় বলিয়া ফেলিলাম, আমি মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নই! ওরা আমায় মেয়ের পার্ট দেবেই, যতই বলি ‘না’ তত আরও চেপে ধরবে, কিছুতেই ছাড়বে না! এমনই ক্ষেপে গিয়েছিল। আমার হল বিপত্তি। কাজেই আমি আর কী করি, আমারও কোনোবারই থিয়েটার দেখা হল না! তখন বাবাকে বড়ো মনে পড়েছে, বাবা রোজ মুগুর ভাঁজতেন, আফশোশ হল, আহা কেন সেই মুগুরদুটো ভাঁজিনি, তাহলে কি আর এমন দুর্দশা। অবিশ্যি এই কথা মনে হওয়ার পরেও ডন-কুস্তি করবার চেষ্টা করেছি একবার; কিন্তু আমার কোমল ঘাড়ে ওস্তাদজির কয়েকটি কঠিন চাঁটি পড়তেই আবার আত্ম-চৈতন্য হল, লালমাটির বুকে মাথা ঠুকে চলে এলাম। তাহলেই দ্যাখো, অভিনয়কে চিরকাল কত ঘৃণাই-না করেছি। মেয়ের পার্টে পুরুষ, ছিঃ! আচ্ছা তোমরাও তো সেগুলি কত দ্যাখো তোমরা কেন প্রতিবাদ কর না?

আরও অনেক কথাই বলিবার ছিল, আজ নিজেকে আমি লাখ-খানেক লোকের সামনে ‘সুভাষ বোস’ই মনে করিতেছিলাম। কিন্তু বক্তৃতা দেওয়া আর হইল না। রুদ্ধ কান্না যেমন হঠাৎ একটা ভীষণ শব্দে ফাটিয়া পড়ে, তেমনি একটা শব্দ আমার কানে আসিয়া সবেগে প্রবেশ করিল। কতকটা আন্দাজ করিয়া বলিলাম, এটিই সংযুক্তা নয়!

সুরমা বি্নয়-বিস্কারিত চোখে আমার দিকে চাহিল। এবং আমি আর দ্বিরুক্তি না-করিয়া সকল কথা বলিয়া তাহার বি্নয় দমন করিলাম। বলিল, তোমার কেবল ঠাট্টা আর ঠাট্টা।

প্রতিবাদ না-করিয়া নীরবে হাসিলাম এবং পাশের বাড়ির দিকে কর্ণপাত করিয়া যা শুনিলাম তা একবারে লিখিলে এই দাঁড়ায়, ছেলে কি তাহার (পৃথ্বীরাজ পত্নীর) একলার, না তাঁহারও (পৃথ্বীরাজেরও)? দোষের মধ্যে রাগটা একটু বেশি, তাই বলিয়া কি এমন ঘরের বাহির করিয়া দিতে হইবে? জুতার দোকানে কী-ই বা চাকরি করে, আর কটা টাকাই বা মাইনে, সে কটা টাকা তো তাহারই কাজে লাগে, তাতে আবার ভাগ বসানো কেন? টাকার এমন কী দরকার? ছেলেটা এখন কোথায় পাগলের মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে কে জানে!

অতঃপর ইহার উত্তরে পৃথ্বীরাজের কাতর, বিব্রত, অথচ বাজখাঁই স্বর (হাসির চেষ্টা বিকৃত); আহা অমন করছ কেন, একটু পরীক্ষা করে দেখছিলাম বই তো নয়, বুড়ো বয়সে এ ছেলে দিয়ে কতটুকু উপকার আমি পাব।

এমন সময় পৃথ্বীরাজ-পত্নীর একটানা কান্না ছাড়া কাতর, বিব্রত, অথচ হাসির চেষ্টায় বিকৃত বাজখাঁই গলাটি হঠাৎ মিলাইয়া গেল বুঝিলাম, হঠাৎ কী কারণে পৃথ্বীরাজ অদৃশ্য হইলেন?

ঘুম হইতে আমি একটু দেরিতেই উঠি, ছেলেবেলায় বাংলা বই-এ সকালে ওঠার সেই একটি নীতিবাক্যই শুধু আজও পরিহার করিয়া আসিতেছি, আর সবগুলি প্রায়ই পালন করিয়াছি এবং ফল পাইয়াছি। ঘুম হইতে উঠিতেই পাশের বাসার গোলমালে কান ঝালাপালা হইয়া গেল, ভাবিলাম এবার বুঝি পতি-পত্নীতেই বচসা হইতেছে! কিন্তু চোখে জড়ানো ঘুমের ভাব কাটিয়া যতই মেজাজ ভালো হইতে লাগিল, ততই টের পাইতে লাগিলাম যে, বাড়ি সুদ্ধ লোক আজ আনন্দ-কলরবে মাতিয়া উঠিয়াছে (মারামারির আশঙ্কা এবার নাই)। বুঝিলাম জহরলাল প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। কিন্তু কোন্‌ সময় কে ফিরিলেন, সে কথাই ভাবিয়া আশ্চর্য হইলাম।

সকল সন্দেহের অবসান হইল তখন, যখন চা খাইয়া একটা সিগারেট জ্বালাইয়া বসিয়াছি-বাহিরে ঘোড়াটি রাখিয়া পৃথ্বীরাজ বীরদর্পে আসিয়া হাজির হইলেন, ভয়ে শিহরিয়া উঠিলাম এই ভাবিয়া যে, এবার বুঝি তাঁহার কোষমুক্ত ঝকঝকে ধারালো অসির ঘায়ে শত্রুপক্ষের নিহত হইবার পালা। কিন্তু ভয় কাটিল! দেখিলাম, কোষমুক্ত অসিতে নিহত না-করিয়া পৃথ্বীরাজ সবগুলি পত্রিকাই চোখের সামনে টানিয়া বসিয়াছেন! কিছুক্ষণ পরে সবগুলি কাগজই আবার টেবিলের উপর রাখিয়া ভাওয়াল সন্ন্যাসী আর সুজাতা সরকার সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ দিতে আরম্ভ করিলেন। ভিতরে আরও চা-এর অর্ডার দিয়া আমি কেবল পৃথ্বীরাজের অশ্ব-খুরের শব্দ শুনিতে লাগিলাম। কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না, খেয়াল হইল তখন, যখন তিনি তাঁহার আর সব বিবৃতি শেষ করিয়া ভারতবর্ষে জুতার ব্যবসায়ের কথা তুলিয়াছেন। বলিলেন, ভারতবর্ষে আজ ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে জুতার চর্চা করেন বটে, ব্যবসায় করেন না; তাই-তো ছেলেটাকে শেষে জুতার দোকানেই লাগাইয়া দিয়াছেন, ইত্যাদি। পিতা-পুত্রে সম্মানজনক আপস হইয়া গিয়াছে বুঝিলাম। আরও কত কী বলিয়া পৃথ্বীরাজ গাত্রোত্থান করিলেন। চোখের দৃষ্টিকে তন্দ্রালস করিয়া দেখিলাম, সশব্দ পদক্ষেপে সভামণ্ডল অতিক্রম করিয়া পৃথ্বীরাজ প্রাঙ্গণে গিয়া পড়িলেন, কোষমুক্ত তরবারি কোষযুক্ত করিয়া অশ্বে আরোহণ করিলেন, তারপর অশ্ব যেরকম ছুটিল তার তুলনা নাই, বহুদূর পর্যন্ত ধুলা উড়াইয়া পাহাড়ের বুকে অদৃশ্য হইল।

তারপর দিন-পনেরো কাটিয়াছে। মধ্যে একবার আসিয়া পৃথ্বীরাজ কাঁদিয়া গিয়াছেন, কারণ সেই একই-পিতা-পুত্র। আমি সান্ত্বনা দিয়েছি। কিন্তু সেদিন একটা ব্যাপার যা ঘটিয়াছে তাতে বি্নিত না-হইয়া পারি নাই। আমার বসিবার ঘরের সামনেই- দুই বাসার ভেদমূলক ব্যবস্থা অর্থাৎ একটি দেওয়ালখণ্ড। সেদিন পুত্রের কলহে পিতাকে সান্ত্বনা দিতে বসিয়া হঠাৎ শুনিতে পাইলাম, ওই দেওয়ালখণ্ডের আড়ালে দাঁড়াইয়া কে যেন অতি ক্ষীণস্বরে ডাকিতেছে, আর পৃথ্বীরাজ অমনি ধড়মড় করিয়া উঠিয়া চলিয়া গেলেন। দেওয়ালের আড়ালে মৃদু ভর্ৎসনার আওয়াজ শুনিতে পাইলাম, আর পৃথ্বীরাজের বিব্রত স্বর-মেয়েটির গলা পৃথ্বীরাজ-পত্নীর যে নয়, এটা ঠিক। সেদিনের ব্যাপারটি রহস্যাবৃতই থাকিয়া গেল, সুরমাকেও আর জিজ্ঞাসা করিতে মনে নাই।
তারপর আবার মাসখানেক কাটিয়াছে। কয়েকদিন ধরিয়া তাহাদের কোনো সাড়াশব্দই পাইতেছি না, একেবারেও টুঁ শব্দটিও নাই। সর্বদা এমন কোলাহল-মুখরতার ভিতর এমন নিঃশব্দতা সত্যি বি্নয়কর। সুরমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াও কোনো সদুত্তর পাইলাম না। অন্যান্য বেশিরভাগ মেয়ের মতোই পরের বাড়ির হাঁড়ির খবর রাখিতে বরাবরই আগ্রহটা তাহার একটু কম দেখিয়াছি। তবে একটু আলাপ-পরিচয়, সেটা কি দোষের? সে কথা বলিতেই সুরমা খেপিয়া উঠিল, আলাপ-পরিচয় করেছি না-করেছি তুমি জান?
বলিলাম, তাহলে যা জিজ্ঞাসা করছি তার উত্তর দেও না কেন?-সব সময়েই ও বাড়ি গিয়ে বসে থাকতে হবে তার কোনো মানে আছে? কেবল ঠাট্টা আর ঠাট্টা!

আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, কোথায় আর কখনই বা ঠাট্টা করিয়াছি বা করিলাম!

তখন রাত্রি প্রায় এগারোটা হইবে। একটা সিগারেট ধরাইয়া সুরমারই অপেক্ষায় বসিয়াছিলাম। চারিদিকে পাথরের নিঃশব্দতা। এমন সময় হঠাৎ, জাপানি বা জার্মানি বোমার সাক্ষাৎ এখনও মেলে নাই-যেন তার চেয়েও ভীষণ এক শব্দে চমকিত হইয়া, হাতের সিগারেট ফেলিয়া ধরাশায়ী না-হোক, বিছানাশায়ী তো হইলাম। কুকুরের মতোই কান খাড়া করিয়া বুঝিলাম, একটা নির্দিষ্ট স্থানে, অর্থাৎ আমার পাশের বাসায় অবিশ্রান্ত ছোটো বড়ো মাঝারি নানা আকারের ইটপাটকেল ছোঁড়া-ছুঁড়ি হইতেছে। ব্যাপার দেখিয়া একটি গল্প মনে পড়িয়া গেল। তখন আমি ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়ি, গুরুজন অভিভাবকদের নির্ভাবনায় রাখিয়া পড়ার ফাঁকি দিয়া অতিরিক্ত বই নিয়া বাড়ির ছাদে গিয়া আশ্রয় নিতাম। আমার কী দোষ, ছোটবেলায় দাদা-দিদিদের ওই রকমভাবে পড়িতে দেখিয়া তাহাদের প্রতি যে বি্নয় ও শ্রদ্ধার উদ্রেক হইত, বড়ো হইয়া সেই মহাজন-পন্থাই যে অবশেষে গ্রহণ করিব, তাতে আর বৈচিত্র্য কী? সে যা হোক, ছাদে আশ্রয় গ্রহণ করিবার পর যা ঘটিয়াছে, তাই বলি। বেশ তো দিনগুলি নির্ভাবনায় কাটিতেছে, দক্ষিণের বাতাস দুরন্ত হইলে পেট ভরিয়া লই, প্রাক্‌-সান্ধ্য আকাশের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকি, একদিন হঠাৎ ভয়ানক অনর্থ ঘটিয়া গেল। সেদিন তখনও ভোরের রৌদ্র তত তীব্র হইয়া ওঠে নাই, ধাপাধপ সমানে কয়েকটি ইটখণ্ড ছাদের উপর আসিয়া পড়িল, একটি হইতে নিজে কোনোরকমে বাঁচিয়া গেলাম। কিছুক্ষণ পরে ইটের বর্ষণ একটু থামিলে রেলিং-এর নীচ হইতে মুখটা ভয়ে ভয়ে কিছু উঠাইয়া দেখি, বরাবর দক্ষিণদিকে দোতলা বাসার এক ছাদে একটি মেয়ে দাঁড়াইয়া খিল খিল করিয়া হাসিতেছে! কী আস্পর্ধা! সাধারণ মেয়ে হইয়া মানুষের উপর এমন অমানুষিক অত্যাচার! ভূত ভবিষ্যৎ না-ভাবিয়া সটান দাঁড়াইয়া গেলাম। কিন্তু হাসিতে হাসিতেই মেয়েটিকে আবার হাত উঠাইতে দেখিয়া চৈতন্য হইল, আবার ডুব দিলাম রেলিং-এর নীচে! পরে জানিয়াছিলাম, মেয়েটি পাগল। কিন্তু তাহার পাগলামিকে সহ্য করিতে না-পারিয়া বাসা আমাদেরই ছাড়িতে হইয়াছিল। আজ সেই কথাই মনে পড়িল। ক্রমাগত সেই দারুণ শব্দ শুনিতে শুনিতে পুরানো আতঙ্ক আবার ফিরিয়া পাইলাম। কিন্তু পরে বর্ষণ থামিলে শুনিতে পাইলাম, বীর সন্তান ছেলের দল বীরদর্পে বলিতেছেঃ ‘অসুখ কাকে বলে তা আমরা জানি, কেবল ভোজবাজি! সারাদিন কেবল লোকের আনাগোনা, সেসব লোকদের আমরা চিনি! আর এখানে কেন, বাজারে গিয়ে নাম লিখিয়ে নিলেই তো হয়। ন্যাকামি! আবার কেঁদে কেঁদে কেমন বলা হয়, নিজের ছেলে নাকি ওকে মারতে চায়-শুধু মারতে চায় কেন, মারেও তো, বেশ করে! আর একজন কে বলিল-পুলিশকে খবর দিতে হবে।

শুইয়া শুইয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিলাম, মনের সমুদ্রে অনেক হাবুডুবু খাইলাম। কিন্তু কোথাও কূল নাই, এখন পৃথিবীটা এমনি অন্ধকার হইলেও চোখের সামনে আরও অন্ধকার হইয়া আসিল। আশ্চর্য, পৃথ্বীরাজ সিংহরায় মহাশয়ের বাসায় কিন্তু টুঁ শব্দটিও নাই। স্বাস্থ্যকে জয় করিয়াছেন তো তাঁহারাই, অনিদ্রায় বিড়ম্বিত হইবেন কেন!

পরদিন অফিস হইতে ফিরিতে সুরমা বলিল, আজ দুপুর বেলায় সে গিয়াছিল পাশের বাসায়-আশ্চর্য যাইয়া দেখে বাড়ির সবাই-যে যার মতো এখানে সেখানে পড়িয়া আছে, সবাই যেন মৃত, সিংহপত্নীকে একবার ডাকিলে বালিশ হইতে মুখ তুলিলেন না তিনি, বড়ো ছেলেটি মনে হয় বাসায় নাই, আর ছোটো ছেলেমেয়েগুলি মেঝেয় পড়িয়া ভয়ানক কাঁদিতেছে, কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতেছেঃ ‘খেতে দাও মা খেতে দাও?’ অবস্থা এই দেখিয়া সুরমা প্রথমে ছোটো ছেলেমেয়েগুলিকে আনিয়া পেট ভরিয়া খাওয়াইল, তারপর অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া বড়োদেরও আবার রাঁধিয়া খাওয়াইয়াছে এবং দুইটা টাকা ধার দিয়াছে। বলিতে বলিতে শেষের দিকে তাহার গলা ধরিয়া আসিল, চোখ ছলছল করিয়া উঠিলঃ উঃ ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েগুলির সে কী কান্না, খিদে পেয়েছে মা, খেতে দাও!
কী কথা মনে হওয়ায় বলিলাম, আর মেয়েটি, সে কে সুরমা?
-সে তো তাদেরই মেয়ে, এও বুঝি জান না?
-ওকে খাইয়েছ তো?
-বারে, ওর তো অসুখ, বিছানায় পড়ে আছে।
কাল রাত্রির কথা মনে পড়িল। বীর সন্তানরা তাহা হইলে ইহারই উদ্দেশে সেই কথাগুলি বর্ষণ করিয়াছিল!

মেয়েটিকে ছাড়িয়া সুরমা আবার শিশুদেরই কথা বলিতেছিলঃ উঃ, সে কী কান্না, খেতে দাও মা খেতে দাও।

বলিলাম, অত কেঁদো না, আরও কাঁদতে হবে যে! কিন্তু ফল হইল উলটা। সুরমা এবার ঝর ঝর করিয়াই কাঁদিয়া দিয়া বলিল, তোমার কেবল ঠাট্টা আর ঠাট্টা, সবতাতেই কেবল ঠাট্টা। মানুষ না খেয়ে আছে, একথা শুনলেও তোমার হাসি পায়? বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সে অনেক কথাই বলিল। ঠিক বলিতেছি, আমার এতটুকু হাসি পায় নাই, বরং কোনো সময় চোখদুটি ছলছল করিয়া উঠিয়াছিল! কিন্তু সুরমাকে সে কথা জানাই নাই।

পরদিন আবার পৃথ্বীরাজ আসিলেন, তেমনি সরবে রোদন করিতে লাগিলেন, ভেউ ভেউ ভেউ! কারণ, সেই একই পিতা-পুত্র!

বাহিরে সেই দেওয়ালের দিকে বারবার তাকাইলাম, কিন্তু ক্ষীণস্বরে কোনো আহ্বানই আজ আসিয়া পৌঁছিল না। তাহা হইলে একমাত্র সান্ত্বনার স্থল তাঁহার সেই মেয়ের স্মেহদৃঢ় আহ্বান, ঠিক বলিতে পারি, পৃথ্বীরাজ নিশ্চয় উপেক্ষা করিতে পারিতেন না।
জহরলাল-পিতা পৃথ্বীরাজ সিংহরায় সরবে কাঁদিতে লাগিলেন,-ভেউ, ভেউ।

ভূমিকাঃ বিশ্বজিৎ ঘোষ
বাংলা ছোটগল্পে একটি বিশিষ্ট নাম সোমেন চন্দ (১৯২০-১৯৪২)। মাত্র ২২ বছর তিনি জীবিত ছিলেন। লেখালেখির সময় পাঁচ বছর। এই স্বল্প সময়ের সাধনায় বাংলা সাহিত্যে তাঁর যে সংযোজন, তা ্নরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর রচনার পরিমাণ কররেখায় গণ্য-২৬টি গল্প, একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস, তিনটি কবিতা, দুটি একাঙ্কিকা, আটটি চিঠি। বিভিন্ন পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে তাঁর আরও কিছু রচনা। কিন্তু পত্রিকাগুলো দুষ্প্রাপ্য। ফলে এসব রচনা আজও উদ্ধার করা যায়নি।

মার্কসবাদী জীবনদৃষ্টিই সোমেন চন্দকে সমকালীন সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বিশিষ্ট করে তুলেছে। জীবনকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন ইতিবাচক প্রেক্ষিতে। সমকালীন সাহিত্যিকেরা দুই বিশ্বযুদ্ধের আবর্তে পড়ে জীবনের শুভ্রতা আর স্বস্তির পরিবর্তে অঙ্কন করেছেন কেবল গ্লানি, হতাশা ও যৌনতার শব্দছবি। জীবনে তাঁরা খুঁজে পাননি আশার কোনো আলো। বিপন্ন এই যুগপরিবেশে দাঁড়িয়েও সদ্য কৈশোর-অতিক্রান্ত এক যুবক জীবনকে দেখেছেন অনিমেষ আলোর দৃষ্টি দিয়ে-শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি সাঁতার কেটেছেন জীবনের মহাসমুদ্রে, জীবনকে জয় করার জন্য। বস্তুত জীবনকে জানাই ছিল সোমেন চন্দের প্রধান ব্রত। তিনি জানতে চেয়েছেন গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনকে, যে জীবন মানুষের অগ্রযাত্রার মহাসড়ক নির্মাণে এগিয়ে আসে স্বতঃস্কূর্তভাবে।

মার্কসবাদী শ্রেণীচেতনার আলোকে সোমেন চন্দ নির্মাণ করেছেন তাঁর ছোটগল্পের প্রিয় মানুষদের। বাংলা সাহিত্যে সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ সোমেন চন্দের ছোটগল্পেই প্রথম সচেতনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘সংকেত’, ‘একটি রাত’, ‘দাঙ্গা’, ‘বনস্পতি’, ‘ইঁদুর’ প্রভৃতি গল্পের কথা ্নরণ করা যায়। নি্নবর্গের সংগ্রামশীল জীবন সোমেন চন্দের ছোটগল্পের প্রধান শিল্প-উপকরণ; ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী সংগ্রামে নি্নবর্গের দীপ্র অভ্যুত্থানই সোমেনের ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়।

সোমেন চন্দের ‘উৎসব’ গল্পটি প্রথম মুদ্রিত হয় সিলেট থেকে প্রকাশিত ১৩৪৮ সালের ্নৃতির শরৎ সংখ্যায়। স্মৃতির সম্পাদক ছিলেন জীতেশমাধব দত্ত ও হিরণ্ময় দাশগুপ্ত। স্মৃতির ১৩৪৮ সালের শারদীয় সংখ্যায় লেখকমণ্ডলীতে সোমেন চন্দ ছাড়াও ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, সুরেন্দ্র মৈত্র, অজয় ভট্টাচার্য, গোপাল ভৌমিক, জগদীশ ভট্টাচার্য, বরদা দত্তরায়, সত্যভূষণ চৌধুরী, নরেন্দ্রচন্দ্র দেব, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, বিনোদবিহারী চক্রবর্তী, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, জীতেশমাধব দত্ত ও রবীন্দ্র চৌধুরী। লেখকসূচি থেকেই স্মৃতির উচ্চমান সম্পর্কে অনুমান করা যায়। কলকাতার জাতীয় শিক্ষা পরিষদ পাঠাগারের যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সংগ্রহশালায় স্মৃতি সাময়িকীটি পাওয়া যায়। সেখান থেকে ‘উৎসব’ গল্পের পাঠ এখানে মুদ্রিত হলো।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।

Super User