খুঁজতে যাব প্রাণগঙ্গার ঘাটে

পরীক্ষাটা ছিল চাকরির। দেওয়ার সময়েই বুঝতে পেরেছিল ডাক আসবে না। এমন অনেক প্রশ্ন ছিল যা সে কখনও শোনেনি, উত্তর কি লিখবে। আধ ঘণ্টার পর মনে হয়েছিল উঠে পড়লেই হয়। কিন্তু ওঠেনি, সাঁতার না জানা মানুষ যদি পুকুরের ডুব দেয় তাহলে যে অবস্থা হবে সেই অবস্থায় বাকি সময়টা কাটিয়েছিল। প্রশান্ত জানে, এটাই তার জীবনের শেষ চাকরির পরীক্ষা। আর কয়েক মাস বাদেই বয়সটা সীমারেখা পেরিয়ে যাবে।

সেই সাত সকালে সে হাওড়ার কদমতলা থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে খড়গপুরে এসেছিল এই পরীক্ষাটা দিতে। বাড়ির সবাই খুব উৎসাহ দিয়েছিল। এর আগে যতবার সে দরখাস্ত করেছে। কোনও বারই ডাক আসেনি। বাংলার অনার্সে পঞ্চাশনম্বর পাওয়া ক্যান্ডিডেটকে যে ডাকা হয় না তা সে বুঝে গিয়েছিল। এবার ডাক পাওয়ায় সে যেমন অবাক হয়েছিল তেমনই আশা বেড়েছিল বাড়ির লোকদের। চাকরিটা হয়ে গেলে ছেলেটা চব্বিশ ঘণ্টা গুম মেরে বসে থাকবে না। পাড়ার দূরের কথা, বাড়ির লোকের সঙ্গেই ভালো করে কথা বলে না। মেয়েবন্ধু দূরের কথা, ওর কোনও ছেলে বন্ধু নেই। প্রশান্তর মায়ের ধারণা, ছেলে হয় সন্ন্যাসী নয় পাগল হয়ে যাবে। যে দেড় ঘণ্টা খাতা সামনে নিয়ে বসেছিল প্রশান্ত তা একদম না লিখে শেষ করেনি। দ্বিতীয় পাতায় সে তিনটে লাইন লিখেছিল,

তাকে আমি খুঁজতে গেলাম পূর্বপাড়ার হাটে
তাকে আমি খুঁজে এলাম কৃষ্ণচূড়ার মাঠে
তাকে আমি খুঁজতে যাব প্রাণগঙ্গার ঘাটে।

কাকে যে খোঁজাখুঁজি করছে, এরকম লাইন কেন তার মাথায় এল, আর এল যখন তখন পরীক্ষার খাতায় লিখতে গেল কেন এসব প্রশ্নের কোনও জবাব সে নিজেই জানে না।

বাড়ি ফেরার জন্যে খড়গপুর স্টেশনের দুপুরের নির্জন প্ল্যাটফর্মে এসে মনে হল পরীক্ষার খাতায় ওসব লেখা ঠিক হয়নি। এখন মনে হচ্ছে কথাগুলো তার নিজের। নিজের কথা পাঁচ জনকে

জানাবার কী দরকার? যিনি খাতা দেখবেন তিনি কি মানে বুঝবেন? অবশ্য সে নিজেই মানে জানে না। নিজের এরকম কিছু কথা থাকে যার মানে ঠিকঠাক জানা যায় না।

প্রশান্ত একটা বেঞ্চিতে বসল যার প্রান্তে দাড়িওয়ালা শীর্ণ চেহারার এক প্রৌঢ় বসে আছে। লোকটির আর্থিক অবস্থা যে খারাপ তো দেখলেই বোঝা যায়। দুই আঙুলে দাড়ি চুলকে লোকটি বলল, আপনি যে উদভ্রান্ত তা দেখেই বুঝতে পারছি।

প্রশান্ত হাসল।

লোকটি পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে দু-হাতের আড়ালে দেশলাই কাঠি জ্বেলে ধরাল। তারপর অনেকটা ধোঁয়া বের করে বলল, লোকে বলে অমুক ভালোবেসে পাগল হয়ে গিয়েছে। আরে ভালোবেসে কেন পাগল হবে? পাগলের কাছে কি ভালোবাসা থাকতে পারে? পাগলরা উদাসী হয়। ভালোবাসা থাকল কি গেল তাতে আর কী?

কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছিল প্রশান্তর। হাসল।

তা মশাই-এর সমস্যাটা কি?

কী বলব! প্রশান্ত তাকাল।

তা অবশ্য। অনেক সমস্যা থাকলে কোনটা বলবেন! আমার নাম শিবশম্ভু। ঠাকুমা রেখেছিলেন। থাকি কালিঘাটের কাঠিবাবার ডেরায়। জীবমুক্ত মহাপুরুষ। এক পলক দেখলেই বলে দেবেন কোন সমস্যা আপনার আসল।

আপনি ওখানে কি করেন?

বাবার ওখানে পড়ে থাকি। যা বলেন শুনি। মন ভরে যায়। আরে মশাই, মন ভরে গেলে আর কী চাই? এই শরীরটা? দুবেলা দুটো পেটে পড়লেই শরীর ঠান্ডা। যাবেন নাকি? একবার দর্শন করে ফিরে যান। কোথায় যাচ্ছেন?

কলকাতা। হাওড়া না বলে কলকাতা বলল প্রশান্ত।

অ। তা পথেই পড়বে। ট্রেন আসছে উঠুন।

কিন্তু আমার টিকিট তো হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত কেটেছি।

রেখে দিন। ওটা পরে কাজে লাগবে। কোলাঘাট পর্যন্ত দরকার হবে না।

দুপুরের লোকাল। ভিড় কম। বসার জায়গা পাওয়া গেল।

শিবশম্ভু জিজ্ঞাসা করল, বলুন তো, কোলাঘাট কেন বিখ্যাত?

প্রশান্তর মনে পড়ল ইলিশ মাছের কথা। কিন্তু এই সামান্য উত্তরের জন্যে নিশ্চয়ই শিবশম্ভু তাকে প্রশ্নটা করেনি। সে ভাবছে দেখে শিবশম্ভু হাসল, আরে ইলিশ মাছ। কোলাঘাটে থেকেও খেতে পাই না। অত দাম দিয়ে কিনব কী করে। তা ছাড়া কাঠিবাবার ডেরায় আমিষ বারণ। পেটে কিছু দিয়েছেন না হরিমটর?

খেতে ভালো লাগছে না।

কোলাঘাটে নেমে স্বচ্ছন্দে শিবশম্ভু প্রশান্তকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। গেটে দাঁড়ানো টিটি-কে বলল, আমার ভাই! লোকটি একটিও কথা বলল না।

পকেটে টাকা থাকলে এখানে খেয়ে নিতে পারেন। স্টেশনের বাইরের ঝুপড়ি দোকান দেখাল শিবশম্ভু। মাথা নাড়ল প্রশান্ত, খিদে নেই। শিবশঙ্কু একটু হতাশ হল, মুশকিল কি জানেন, খালি পেটে কাঠিবাবার সামনে যেতে নেই।

কেন?

পেটে কিছু না থাকলে হজম করবেন কী দিয়ে?

অগত্যা ঝুপড়িতে ঢুকল ওরা। হাতে গড়া গরম রুটি আর ঘ্যাঁট। প্রশান্ত একটা খেলো তো শিবশঙ্কু ছটা। তারপর চা। দশটাকা লাগল। শিবশম্ভু বলল, কিছুই না। যে-কোনও দেবস্থানে যান, দেখবেন এর চেয়ে অনেক বেশি খরচ হবে।

হাঁটা শুরু হল। জনবসতি পেরিয়ে, মাঠ আর মাঠ। হাত তুলল শিবশদ্ভু, ওই যে আকাশের গায়ে কালো বিন্দু, ওটা বিশাল বটগাছ। ওর নিচে কাঠিবাবার ডেরা। একটু আয়েশ করে হাঁটুন, কষ্ট হবে না।

মাঠ শেষ হল। বটগাছ এখন বেশ বড়। তার নিচে খড়ের ছাউনি দেওয়া দুটো ঘর নিকোনো উঠোন। সেখানে বসে আছে জনা আটেক নারী-পুরুষ। শিবশঙ্কু বলল, বসে পড়ুন। কাঠিবাবার এখন বিশ্রামের সময়।

বটগাছের কিছুটা দূরে নদী। নদীতে জল সামান্য। না বসে সেদিকে এগিয়ে গেল প্রশান্ত। জলের কাছে যেতেই শুনতে পেল, ওমা এ আবার কে!

পাশ ফিরে সে যে নারীকে দেখতে পেল তার চুল খোলা। রুক্ষ চুল নেমে এসেছে হাঁটু পর্যন্ত। পরনে গেরুয়া শাড়ি। হাতে সদ্য ধোওয়া বাসনপত্র। নারীর বয়স পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। যথেষ্ট স্বাস্থ্যবতী। ঠোঁট মুচড়ে, চোখ ঘুরিয়ে নারী বলল, প্যাট-প্যাট করে দেখা হচ্ছে। ভালো চাও তো পালাও, নইলে মরণফাঁদে পড়বে। তারপর উঠে চলে গেল কাঠিবাবার ডেরার দিকে। মরণফাঁদ! সেটা কী জিনিস? মাথা নাড়ল প্রশান্ত। তারপর উবু হয়ে বসে নদীর জলে মুখ ধুলো। বাঃ, বেশ ঠান্ডা, শরীর জুড়িয়ে গেল।

শিবশম্ভু বলল, বাবা, বিশ্রামভঙ্গ করেছেন, তোমার কথা জানিয়ে দিয়েছি, অনেকদূরে যাবে, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন।

এই সময় সেই নারী ঘরের বারান্দায় একটা চাটাই পেতে দিল। এখন তার চুল বিশাল খোঁপা হয়ে গেছে। সাধিকা-সাধিকা লাগছে। শিবশদ্ভু নিচু স্বরে বলল, কাঠিবাবার সেবিকা।

এর পরে কাঠিবাবা বেরিয়ে এলেন। চাটাই-এর ওপর বসলেন ধীরে-ধীরে। অতি শীর্ণ শরীর। বুকের সব হাড় বোধহয় গোনা যায়। পাকা দাড়ি গলার নিচে এসে থেমেছে। মাথায় চুল নেই। চকচকে টাক। বয়স আশির আশেপাশে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। শিবশঙ্কু উঠে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল কাঠিবাবাকে। তিনি হাত ওপরে তুলে নামিয়ে নিলেন। প্রণাম শেষ করে কিছু বলল শিবশম্ভু। কাঠিবাবা মাথা নাড়লেন।

শিবশঙ্কু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাদের মধ্যে কে-কে খুব দূরের জায়গা থেকে এসেছেন? হাত তুলুন।

এক দম্পতি বসেছিল সামনে। লোকটি হাত তুলল।

আসুন আপনারা।

ওরা এসে দূর থেকে প্রণাম করল। কাঠিবাবা বললেন, আমি ভগবান নই যে যা চাইবে তাই পাইয়ে দেব, ডাক্তার নই যে রোগ সারিয়ে যাব। তোমাদের মনে অশান্তি আছে নইলে এখানে আসবে না। তাই তো–!

পুরুষটি বলল, হ্যাঁ বাবা, দশবছর বিয়ে করেছি, এখনও সন্তান হল না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। আমার এই স্ত্রী বলেছিল আবার বিয়ে করতে। কিন্তু কলকাতার ডাক্তার বলেছে না হওয়ার জন্যে আমিই দায়ী। আমি কখনও বাবা হতে পারব না। তবে আমার স্ত্রী মা হতে পারে। ডাক্তাররা নলজাত শিশুর কথা বলেছে। ওর শরীরেই বড় হবে। ওর শরীর থেকেই ভূমিষ্ঠ হবে। কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। এই নিয়ে খুব অশান্তি। কী করব বলে দিন।

কাঠিবাবা রমণীটির দিকে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, মহাভারতের গল্প জানো?

জানি। টিভি-তেও দেখেছি। স্ত্রী বলল।

এই মহাভারত, গীতা কিছুই হত না যদি ব্যাসদেব না থাকতেন। রাজার সন্তান নেই। সন্তান উৎপাদন করার ক্ষমতাও নেই। কিন্তু তখন বিকল্প ব্যবস্থা ছিল নিয়োগ প্রথা। তিনি মহামতি ব্যাসদেবের কাছে রানিদের পাঠালেন। তার ফলেই যুধিষ্ঠির এবং দুর্যোধনের পিতারা জন্ম। নিয়েছিল। আজ নিয়োগপ্রথা নেই। কিন্তু নলপ্রথা আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে তোমার সতীত্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে আপত্তি করার তো কিছু নেই। এসো তোমরা। কাঠিবাবা চোখ বন্ধ করলেন।

পুরুষটি একটি পুঁটলি সামনে রেখে প্রণাম করল। স্ত্রীও। তারপর তারা উঠে চলে যেতে শিবশঙ্কু ডাকল, প্রশান্ত এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করল। শিবশদ্ভু বলল, বসুন।

কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে কাঠিবাবা প্রশ্ন করলেন, সমস্যাটা কি? মন এত উতলা কেন? তুমি তো কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না। পৃথিবী ঘুরলেও না।

হ্যাঁ। আমার কিছু ভালো লাগে না। দিন-দিন নিজের ওপর আস্থা চলে যাচ্ছে। চাকরি পাইনি। বাড়িতে থাকতেও ইচ্ছে করে না।

তোমাকে যদি আজই অনেক টাকার চাকরি দেওয়া হয় তাহলে? মন শান্ত হবে?

আমি জানি না। বিশ্বাস করুন, আজকাল আমার কিছুই ভালো লাগে না। মনে হয় কোথাও চলে যাই। প্রশান্ত সত্যি কথা বলল।

কাঠিবাবা মাথা নাড়লেন, হুঁ। আমার চোখের দিকে তাকাও।

তাকাল প্রশান্ত। কিন্তু কাঠিবাবার শুকনো মুখ ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। কাঠিবাবা বললেন, তোমাকে আমি এমন একটা জিনিস দিতে পারি যাতে বাইরে যেতে হবে না। তুমি যেখানে আছ সেখানেই চিন্তামুক্ত হয়ে থাকতে পারবে। তুমি সামনের শনিবার এসো। বাড়িতে বোলো যে রাতে বাড়িই ফিরবে না। এসো।

হাওড়ায় ফিরে এসেছিল প্রশান্ত। এরকম অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। চাকরির পরীক্ষায় ওই কাণ্ড হওয়ায় মনে যে হতাশা এসেছিল সেটা যে কখন চলে গিয়েছে সে টের পায়নি। ব্যাপারটা শুনে বাড়ির সবাই যে গম্ভীর হয়ে গেল তাতেও সে বিচলিত হল না। তার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কাঠিবাবা তাকে কী দেবেন?

কাঠিবাবা বলেছেন শনিবারে যেতে। কখন যেতে হবে বলেননি। শিবশস্তুকে জিজ্ঞাসা করে এলে হত। শনিবার দুপুরে সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলে গেল, ফিরতে দেরি হয়ে গেলে রাত্রে থেকে যাবে, কাল ফিরবে। এই কথায় বাড়ির কারও কোনও প্রতিক্রিয়া যে হল না এটাও লক্ষ করল না সে।

কোলাঘাট স্টেশনে নেমে সে অবাক হয়ে গেল। পুলিশে-পুলিশে প্ল্যাটফর্ম তটস্থ। বেশি যাত্রীও নেই। একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল আজ ভোরের বেলায় সন্ত্রাসবাদী অথবা। উগ্রপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের গুলি বিনিময় হয়েছে। দুজন পুলিশ আর একজন উগ্রপন্থী মারা। গিয়েছে। উগ্রপন্থীরা কোলাঘাট বন্ধের ডাক দিয়েছে। পুলিশ রেললাইন অফিসার তাকে কাছে ডাকল, কোথায় থাকা হয়?

হাওড়ায়। পাহারা দিচ্ছে বলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়নি। সে প্ল্যাটফর্মের বাইরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই দুজন পুলিশ।

দ্বিতীয়জন কপালে ভাঁজ ফেলল, এখানে কোথায় যাবে?

কাঠিবাবার কাছে।

কী বাবা? দ্বিতীয়জন চোখ ছোট করল।

প্রথমজন বলল, একজন সাধু। নদীর ধারে থাকে।

কী জন্যে যাবে ওর কাছে? দ্বিতীয় জনের প্রশ্ন।

দেখা করতে।

আজ ভোরে যারা পুলিশ মেরেছে তাদের চেনো?

না।

আইডেন্টিটি কার্ড আছে?

না।

কী নাম?

প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।

কি করো।

কিছু না।

দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে বলল, শুনলে তো। এরাই ওই দলের মেম্বার। একে ছাড়া ঠিক হবে না। রগড়ালে খবর বের হতে পারে।

প্রথমজন জিজ্ঞাসা করল, কাঠিবাবার সঙ্গে কেন দেখা করবে?

উনি আসতে বলেছিলেন। আমাকে কিছু দেবেন যাতে মন শান্ত হবে।

দ্বিতীয়জন জিজ্ঞাসা করল, এই কাঠিবাবা ওদের এজেন্ট নয় তো?

প্রথমজন এবার হাসল, দূর। উনি সত্যিকারের একজন সাধক। প্রশান্ত, তোমার মনকে শান্ত করতে হচ্ছে কেন?

আমি জানি না। আমার কিছু ভালো লাগে না।

গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে রাগ হয়? সমাজব্যবস্থা বদলাতে ইচ্ছে করে?

না। আমি ওসব নিয়ে ভাবি না।

প্রথমজন বলল, যেতে দাও। ন্যাতানো মাল।

অতএব হাঁটতে শুরু করল প্রশান্ত। ঝুপড়ির দোকানগুলো বন্ধ। আচ্ছা, ন্যাতানো মাল বলল কেন? ওরা যাদের খুঁজতে তারা কি খুব শক্ত লোক, তাজা? মন খারাপ হয়ে গেল খুব।

কাঠিবাবার ডেরার সামনে আজ কোনও ভক্ত বসে নাই। সম্ভবত ধর্মঘটের জন্যেই আসতে পারেনি কেউ। চারপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না প্রশান্ত। শিবশস্তুকেও না। কুটিরের ভেতর নিশ্চয়ই কাঠিবাবা আছেন। কিন্তু কী বলে তাঁকে ডাকা যায়। শেষপর্যন্ত না বলে অপেক্ষা করবে বলে ঠিক করল সে। কুটিরের সামনে গাছের ছায়ায় বসল আরাম করে।

অবশ্য এখন এখানে আসা ঠিক হয়নি। ভরদুপুরে নিশ্চয়ই কাঠিবাবা বিশ্রাম করছেন। হঠাৎ কানে এল, ওমা! একে দেখছি হরতালও আটকাতে পারেনি?

প্রশান্ত নারীকে দেখল। পেছনের নদী থেকে স্নান সেরে আসছে। পরনের সিক্তবসনে শরীরকে আড়াল করেছে। কিন্তু কাপড় ভিজে গেলে যে আকর্ষণীয় হয় তা এই প্রথম জানতে পারল প্রশান্ত।

না, মানে, ট্রেন চলছিল, এদিকের অবস্থা হাওড়াতে টের পাইনি।

পুলিশ ধরেনি?

ধরেছিল। ছেড়ে দিয়েছে।

পুলিশ যখন ছোঁয়নি তখন বাঘেও কিছু করতে পারবে না। তা পেটে কিছু দিয়ে এসেছ না–।

না-না। আমি খেয়ে এসেছি।

বাঁচালে। নারী ভেতরে চলে গেল।

কাঠিবাবা বেরিয়ে এলেন দু-ঘণ্টা বাদে। তখন রোদ রয়েছে গাছের শরীরে। প্রশান্ত আজ সামনে গিয়ে নমস্কার করে বসে পড়ল।

সংসারে কে আছেন?

বাবা, মা, ভাই?

বিয়ে করনি?

না। আমি রোজগার করি না।

মনের ভাবটা খুলে বলল। কী চাও?

আমার সবসময় অশান্তি লাগে। বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। আবার বাইরে গিয়ে কী করব তা বুঝতে পারি না। বাড়িতে থাকলে চাকরি করতে হবে, সংসার করতে হবে। চাকরি পাইনি। চাকরির পরীক্ষায় খাতায় উলটো-পালটা লিখে এলাম।

কী লিখলে?

মাথা নাড়ল প্রশান্ত, ছেলেমানুষের মতো কথা। আপনি হাসবেন।

না হয় হাসির কথাই শোনাও।

প্রশান্ত মনে করে-করে বলল,

তাকে আমি খুঁজতে গেলাম পূর্বপাড়ার মাঠে
তাকে আমি খুঁজতে এলাম কৃষ্ণচূড়ার হাটে
তাকে আমি খুঁজতে যাব প্রাণগঙ্গার ঘাটে।

কাঠিবাবা বললেন, অপূর্ব! আসল কথাই তো বলে ফেলেছ। তোমার মন খোঁজাখুঁজি করছে। কাকে খুঁজছে? ইষ্টকে। কিন্তু তাকে পেতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঘরে বসেই তো পেতে পারো। তোমার মন ঘরে বসে যদি শান্ত হয়ে যায় তাহলে বাইরে যাওয়ার তো কারণ নেই।

কিছুক্ষণ ভাবলেন কাঠিবাবা। তারপর মুখ তুলে বললেন, আমি তোমাকে দেব। কিন্তু তার আগে বলো মাতৃগর্ভ থেকে বের হওয়ার পর তোমার শরীরের অভ্যন্তরে কোনও আন্দোলন হয়েছে কিনা?

প্রশান্ত বুঝতে না পেরে চুপচাপ তাকিয়ে থাকল।

কাঠিবাবা মাথা নাড়লেন, তুমি কি কোনও নারী শরীরে উপগত হয়েছ?

না-না। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল প্রশান্ত।

খুব ভালো। যাও, পেছনে নদী আছে। সেখানে পোশাক খুলে তিনবার ডুব দিয়ে এসো। দিগম্বর হয়ে ডুব দেবে। ওদিকে কোনও মানুষ থাকে না, লজ্জার কোনও কারণ নেই।

প্রশান্ত উঠল। নদীর ধারে গিয়ে সে কাউকে দেখতে না পেয়ে কাঠিবাবার নির্দেশ মান্য করল। তারপর ভেজা শরীরেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ফিরে এল কুটিরের সামনে। কাঠিবাবা তাকে তাঁর সামনে সোজা হয়ে বসতে বললেন।

প্রশান্ত বসল,

গায়ের জামা খুলে ফ্যালো।কাঠিবাবা আদেশ করলেন।

খুলল সে। শরীরের জলে ভিজেছে কিছুটা।

কোমরের দড়ি একেবারেই আলগা করে দাও। পাজামার গিট খুলে দিল প্রশান্ত।

বসে থাকার জন্যে সেটি নিচে নেমে যেতে পারল না। আমি তোমাকে ইষ্টলাভের পথ চিনিয়ে দেব। সেই পথে হাঁটতে হবে তোমাকেই। তোমার মন যদি একাগ্র হয় তাহলেই তুমি পূর্ণতা পাবে। যখন সেটা পাবে তখন তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। তারপর তোমার পাওয়ার অহঙ্কার যদি জটাধারী সন্ন্যাসী করে শিষ্য জুটিয়ে আশ্রম তৈরি করে তার মধ্যে শিবলিঙ্গ রেখে ভোগের মধ্যে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারো। কাঠিবাবা চোখ বন্ধ। করলেন। তারপর প্রাণের ক্রিয়া দেখালেন। কীভাবে জপ করতে হবে দেখিয়ে বীজমন্ত্র দিলেন। জিভের সঙ্গে জপের মাত্রানুযায়ী একটি ক্রিয়া দেখালেন আর বললেন, ওইখানেই নিরবচ্ছিন্ন। জপ চলবে সারাক্ষণ। বাইরে কাজকর্ম চলবে আবার জপ চলবে। এই নিরবচ্ছিন্ন জপের ফলই হবে জপসিদ্ধির অবস্থা, তারপর ধ্যানের ধারা আসবে। পবিত্র স্থানে প্রাণের ক্রিয়ার সঙ্গে এই জপ চলতে থাকলে যে অবস্থা হবে তখনই বুঝবে সৃষ্টির রহস্য, তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক।

প্রশান্ত শরীরে মনে অন্যরকম অনুভূতি আবিষ্কার করল। কাঠিবাবা বললেন, তোমার ক্ষেত্র অনেকটাই তৈরি। তুমি ঘন-ঘন আসবে আমার কাছে। না হলে সামলাতে পারবে না। তোমার শক্তিলাভ হবেই। যদি মোহমুক্ত হতে পারো তাহলেই ইষ্টলাভের সম্ভাবনা! তবে গৃহত্যাগ কোরো না। করার দরকার নেই। তুমি ফিরে যাওয়ার আগে অন্তত একঘণ্টা এই জায়গায় বসে আমার দেখানো ক্রিয়া অনুসরণ করো। যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে সংশোধন করে দিতে পারব।

কাঠিবাবা কুটিরের ভেতর চলে গেলেন।

প্রশান্ত কাঠিবাবার নির্দেশ মনে করে-করে প্রাণায়ামের ক্রিয়াকর্ম করার চেষ্টা করল। বিচিত্র অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই সে অনুভব করছিল না। মন স্থির রাখাই মুশকিল হচ্ছিল।

ফেরার ইচ্ছে নেই বুঝি!

গলা কানে যেতে তাকাল প্রশান্ত। সেই নারী দরজায় দাঁড়িয়ে। বাইরের পৃথিবীতে ছায়া নেমে গেছে। শরীর বেশবাস এখন কিছুটা পরিপাটি; ঠোঁট পানের রসে লাল।

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই খেয়াল হল। দ্রুত পাজামা ধরে ফেলে নারীর দিকে পেছন ফিরে গিট বাঁধল সে।

নারী হাসল, ওই গিটই হল আসল, গিঁট খুললেই সর্বনাশ।

পাঞ্জাবিটা পরে নিতেই নারী বলল, উঠল বাই তো কটক যাই। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। একটু বসে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

অগত্যা বসল প্রশান্ত। মিনিটখানেকের মধ্যে নারী এক বাটি মুড়ি আর একটা কাঁচা লংকা নিয়ে এল, এগুলোর গতি হোক।

খিদে ছিল না। মন এখন অন্য কিছুর আশায় উন্মুখ। তবু হাত বাড়াতে হল। খাওয়া দেখতে দেখতে নারী জিজ্ঞাসা করল, পিছুটান নেই, না?

মুখ তুলল প্রশান্ত, বাড়িতেই সবাই আছেন।

বউ আছে?বউ।

মাথা নেড়ে না বলল প্রশান্ত।

শব্দ করে হাসল নারী, তাহলে আর পিছুটান কোথায়? তারপরই গলা নামাল, তা এসব করার ইচ্ছে হল কেন? সারা জীবন শুকিয়ে মরবে বলে? বলেই কুটির থেকে নেমে চলে গেল গাছপালার আড়ালে।

হতভম্ব হয়ে গেল প্রশান্ত। কী বলল নারী?কাঠিবাবার সঙ্গে থেকে এসব কী কথা? কিন্তু এই নারী কে? তান্ত্রিকদের সঙ্গে ভৈরবী থাকে বলে শুনেছি। কিন্তু কাঠিবাবা কি তান্ত্রিক? দেখে মনে হয় না। আর এই নারীর বিপুল শরীর আর গেরুয়া শাড়ি ছাড়া আর কিছুই সাধিকার ভাবমূর্তি তৈরি করে না।

মুড়ি শেষ করে তেষ্টা পেল। কিন্তু জল দেওয়ার কেউ নেই। ওপাশে নদী আছে অবশ্য। কিন্তু সে জল পান করা ঠিক কি? প্রশান্ত স্থির করল, স্টেশনে পৌঁছে জলপান করবে। সন্ধের অন্ধকার মাটি থেকে উঠে আসছে যদিও আকাশে এখনও আলোর রেশ।

হাঁটতে শুরু করল সে। মিনিট কয়েক যেতেই দেখল নারী ফিরছে, ঠোঁট টিপে হাসল নারী, চললে?

হুঁ।

কথাটা মনে রেখো।

ইষ্টলাভের চেষ্টা করা কি অন্যায়? জিজ্ঞাসা না করে পারল না প্রশান্ত।

ইষ্ট?ইষ্ট মানে কি?ভগবান? তোমাদের ওই বাবা ভগবানকে পেয়েছে? জপ করে-করে প্রাণায়াম করে শরীরের ভেতর ঢেউ তুলে ভাবছে ভগবানের কাছে পৌঁছে গেছে। তার ফলে লোক এসে দুমুঠো মুড়ি, চারটে কলা দিয়ে যাচ্ছে। যা দেবে তাই খাও, তোমার ইচ্ছে মতো খাওয়ার পাবে না। একটাই তো জীবন। মরতে হবে। মরার পর ভগবান কোলে বসিয়ে দুধু খাওয়াবে এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। তাহলে? নিজের জন্যে জপতপ করে শুকিয়ে না মরে পাঁচ জনকে নিয়ে বাঁচো। কেউ না খেতে পেয়ে মরছে, জপ করে তাকে খাওয়ার দিতে পারবে? হাসল নারী, শক্ত লাগছে। বিয়ে করোনি, মেয়েমানুষ ছোঁওনি। তোমার মতো হাঁদা আছে বলেই তো গোলমাল।

আপনি কে?

আমি? আমার নাম নয়নতারা। তোমাদের কাঠিবাবার মেয়ে। হ্যাঁ গো। দু-দুবার বিয়ে করেছিলাম। সেঁকেনি। আবার কবে আসছ?

দেখি।

আসতে তোমাকে হবেই। কাঠিবাবা ঠিক টেনে আনবে। তা আনুক। আমাকে একটু ছুঁয়ে দাও তো। এই কনুই-এর ওপরটা ছোঁও।

কেন?

আঃ। যা বলছি তাই করো।

কাঁপা আঙুলে নয়নতারার কনুই স্পর্শ করেই হাত নামাল প্রশান্ত।

হাসল নয়নতারা, যাও। দুগ্নাদুন্না। বলে আর দাঁড়াল না।

নরম তুলতুলে স্পর্শ আঙুলের ডগায়। কেন তাকে স্পর্শ করতে বলল নয়নতারা? আলাদা রকমের অনুভূতি নিয়ে হাঁটছিল সে। পাতলা অন্ধকার চারপাশে স্থির হয়ে আছে। কাঠিবাবা যা দিয়েছেন আর নয়নতারা যা বলল তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল।

স্টেশনের কাছে আসতেই তার খেয়াল হল চারদিক স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। একটি মানুষের শরীরও চোখে পড়ছে না। হঠাৎ চিৎকার কানে এল, ওই যে, আর একটা!

সে কিছু বোঝার আগে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যারা, তারা যে পুলিশ তা বোঝার আগেই সে মাটিতে শুতে বাধ্য হল। এলোপাথাড়ি ভারি বুটের লাথি পড়ছে শরীরে। পাঁজর, কোমরের হাড় যেন ভেঙে যাচ্ছে একটার-পর-একটা।

থাম। মুখটা দেখি। ধমক ভেসে এল। তারপর টর্চের আলো পড়ল প্রশান্তর মুখে। যন্ত্রণার তার মুখ বিকৃত।

দূর। এ নয়। অফিসারের গলায় হতাশা।

স্যার এরকমই বয়স।

বয়স তো এক হতেই পারে। যাক গে, ভ্যানে তুলে রাখ।

সঙ্গে-সঙ্গে তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে ভ্যানের মধ্যে ফেলে দেওয়া হল, ঘড়াং করে বন্ধ হল ভ্যানের দরজা। ভেতরটা নিশ্চিদ্র অন্ধকার।

কিছুক্ষণ পরে খুব নিচু গলায় প্রশ্ন কানে এল, কে?

প্রশান্ত উঠে বসার চেষ্টা করল। টনটন করছে পাঁজর কিন্তু ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছে না। সে অনুভব করল পাশেই কেউ শুয়ে আছে। জবাব না দিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করল শুয়ে থাকা মানুষটাকে, আপনি কে?

লোকটা জবাব দিল না। ওপাশ থেকে সেই কণ্ঠ ভেসে এল, ও কোনওদিন কথা বলবে না। ও এখন লাশ হয়ে গিয়েছে।

আপনি কে?

আমি? আমি রতন। তুমি কি অসিত?

না। আমি প্রশান্ত।

তুমি এখানে এলে কেন? তোমার নাম তো আজকের এনকাউন্টারে ছিল না।

প্রশান্ত ঢোঁক গিলল। সে বুঝতে পারল এতক্ষণে। এদের কথাই কাগজে পড়েছে সে। আজ সকালে এদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল পুলিশের। তারপর বোধহয় বিকেলেও হয়েছে। কাগজে পড়েছে, জেনেছে এরা ভারতবর্ষের আমূল পরিবর্তন চায়। এরা সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। এরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করতে চায়। এই রতন ছেলেটি তাকেও কি সেই স্বাধীনতাযোদ্ধা বলে ভাবছে?

শোনো প্রশান্ত, একটু পরেই ওরা একটা মাঠের মধ্যে ভ্যানটাকে নিয়ে যাবে। নিয়ে গিয়ে আমাদের ছেড়ে দিয়ে পালাতে বলবে। আমরা পালবার চেষ্টা করলেই পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলবে। এরজন্যে ওদের কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। বুঝলে?

তাহলে?

আমাদের এখনই পালাতে হবে। অনেক কাজ বাকি আছে।

কী করে পালাব। দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ। প্রশান্ত বলল।

অপেক্ষা করো। ওরা তো দরজা খুলবেই। মাঠেও গুলি করে মারবে, এখানেও মারতে পারে। এখানে তবু বাঁচার একটা সুযোগ পেলেও পেতে পারি।

ঘটাং করে ভ্যানের দরজা খুলে গেল।

যারা জিন্দা আছিস তারা নেমে আয়। হুকুম হল।

ধীরে-ধীরে নিচে নামল প্রশান্ত।

ওপাশ থেকে দুপুরের একজন অফিসার এগিয়ে এলেন, আরে তুমি দুপুরে হাওড়া থেকে এসেছিলে না?

কোথায় গিয়েছিলে যেন?

কাঠিবাবার আশ্রমে।

ভ্যানে চড়লে কেন?

আমাকে মেরে তুলে দেওয়া হয়েছে।

হুঁ। এখানে ঘুরঘুর করছিলে কেন?

স্টেশনে এসেছিলাম, ট্রেন ধরে বাড়িতে যাব বলে।

অ। কাঠিবাবা কী বলল?

আমাকে মন্ত্র দিয়েছেন। জপ করতে বলেছেন।

অফিসার আর একজনের দিকে তাকালেন, দ্যাটস গুড। জপটপ নিয়ে থাকলে মাথায় দেশউদ্ধারের চিন্তা ঢুকবে না।

স্যার, এ গুল মারছে কিনা কে জানে। আচ্ছা ভাই, কীভাবে জপ করতে শিখিয়েছে কাঠিবাবা তা করে দেখাও তো।

প্রশান্ত নার্ভাস হল। কাঠিবাবা যাশিখিয়েছেন তা কাউকে দেখাবার জন্যে নয় এটা সে বুঝেছে। কিন্তু এরা তাকে ছাড়বে না। রেগে গেলেই লাশ বানিয়ে ফেলবে। অতএব বাবু হয়ে মাটিতে বসল সে। সোজা হতে গিয়ে পাঁজরে খচ করে-করে লাগল। মুখ বিকৃত করল। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

না। কিছু না। তারপর জপ করার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝল সে কিছুই মনে করতে পারছে না।

থাক, থাক। রিলিজিয়ন নিয়ে রসিকতা করার কোনও মানে হয় না। ওঠো। অফিসার আদেশ করলেন, লোকাল ধরে সোজা হাওড়ায় চলে যাও।

স্যার, ওকে ছেড়ে দেবেন?

যাক। নির্দোষ। ওই যে বলেছেনা একশোটা দোষী যদি ছাড়া পায় তো পাক, কিন্তু একজন নির্দোষ যেন সাজা না পায়। অফিসার হাসলেন।

কিন্তু স্যার ও ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবে।

নাম ঠিকানা ভেরি ফাঁই করে ছাড়ো। মুখ খুললেই তুলে আনব। তবে কাঠিবাবার কাছে নিশ্চয়ই ও আসবে। সেক্ষেত্রে মুখ গেল স্টেশনের একটি ঘরে। নাম ঠিকানা লেখাল। পরিচিত লোকের। ফোন নাম্বার দিতে হল। সেখানে ফোন করে সত্যতা যাচাই করা হল। লোকটা বলল, যা, পালা।

প্রশান্ত বলল, রতনকে ছাড়বেন না?

রতন? কে রতন?বন্ধ রাখবে।

একটা অফিসার ওকে নিয়ে

ভ্যানের ভেতর আছে।

এরমধ্যে দোস্তি হয়ে গেছে নাকি? হ্যাঁ, ওকে ছাড়ব। মাঠের ভেতর নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেব। রতন বাড়িতে চলে যাবে। অফিসারের কথা শেষ হওয়া মাত্র বাইরে চিৎকার শুরু হল। সঙ্গে গুলির আওয়াজ। প্রশান্তকে ছেড়ে অফিসার ছুটল ওদিকে। ওপাশ থেকে চিৎকার শোনা গেল, ভাগ গিয়া, ভাগ গিয়া।

শুনে খুব আনন্দ হল। রতন পালাতে পেরেছে। একটা প্রাণ বেঁচে গেল বলে তার আনন্দ হচ্ছিল। হঠাৎ ভয় হল। রতন পালিয়ে গেছে বলে ওরা যদি তাকে আবার ধরে? সে প্ল্যাটফর্মের অন্ধকার খুঁজল।

ট্রেন এসে দাঁড়াল চোরের মতো। টুপ করে উঠে বসল প্রশান্ত। যত তাড়াতাড়ি ট্রেনটা হাওড়ায় পৌঁছয় তত ভালো।

স্টেশনে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেল। আশপাশের লোকজন তার দিকে তাকাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত একজন জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে ভাই?

কী হবে?

আপনারা সারা গায়ে কাদা মাটি, মুখ ফুলে গেছে।

প্রশান্ত উত্তর না দিয়ে হাঁটতে লাগল।

লোকটা তার পাশের লোককে চাপা গলায় বলল, কোলাঘাট থেকে উঠেছে। নিজের চোখে দেখেছি। নিশ্চয়ই উগ্রপন্থী।

বাড়িতে ঢোকার মুখে বাবার সঙ্গে দেখা। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

এইসব করছ? ভারতবর্ষের মুক্তি আনবে? বারংবার পুলিশ এসে তোমার গতিবিধি জানতে চাইছে? পরীক্ষা দেওয়ার নাম করে পুলিশ মারতে যাওয়া হচ্ছে? শোনো, তোমাকে এ-বাড়িতে থাকতে দিতে পারি না।

আপনি ভুল করছেন বাবা।

ঠিক আছে। পুলিশ এসে বলুক আমি ভুল বলছি, তাহলে স্বীকার করে নেব। তোমার মুখ, পোশাক বলে দিচ্ছে তুমি কোথায় ছিলে!

মধ্যরাতেও ঘুম আসছিল না। সর্বাঙ্গে মারাত্মক ব্যথা। সে এখন কী করবে?কাঠিবাবা যা শিখিয়েছিল সব মাথা থেকে সরে গেছে। রতন বলেছিল, অনেক কাজ বাকি আছে। কী সেই কাজ? কার জন্যে কাজ?

রতনকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? রতনকে খোঁজা দরকার। কাঠিবাবা নিশ্চয়ই জানেন কিন্তু নয়নতারা কি জানে না? চোখ বন্ধ করল প্রশান্ত।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার