আঙরাভাসা

তারপরে এক সময় দিনটাও ফুরিয়ে গেল। আমাদের বাড়ির সামনে পাতাবাহারের গাছগুলোর ওপর নেতিয়া পড়া হলদে রোদটা টুক করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আরও দূরে, আঙরাভাসা নদীর শরীর ছুঁয়ে যে বিরাট খুঁটিমারির জঙ্গলটা দিনরাত গুম হয়ে বসে থাকে তার মাথা ছুঁয়ে লাল বলের মতো সূর্যটা, যাকে আমি আজ সকাল থেকে বুকের ভেতরে জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, কেমন করে ব্যাডমিন্টনের ককের মতো চোখের আড়ালে ঝুলে পড়ল, একরাশ অন্ধকার ছড়িয়ে দিল আমাদের বাড়ির চারপাশে। আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।

এই রাত, শীতের এই ছোট্ট রাতটা ফুরিয়ে গেলেই আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। দাদুর চিঠি এসেছে শহর থেকে। আমার স্কুল খুলছে। পরীক্ষা এসে গেল বলে। আমার প্রাইভেট মাস্টারমশাই শ্রীশবাবু রোজ-রোজ এসে ফিরে যাচ্ছেন। ওখানে সেই ভোর চারটের সময় ঘুম চোখে উঠে কম্ভর্টার জড়িয়ে দাদুর সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যেতে হবে, ফিরে এসেই চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে পড়া, তারপর স্কুল, স্কুল থেকে ফিরলেই শ্রীশবাবু নস্যির ডিবে নিয়ে আসবেন, আবার পড়া, আমি মরে যাব।

আজ আমি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। উঠে বাড়ির পেছনে শিউলিগাছ ঝাঁকিয়ে সাজি ভরে ফুল কুড়িয়েছি। টাটকা শিউলি ফুলের গন্ধ সকালের বাতাসে আমার দারুন লাগে। এসব তো আর কাল পাব না। গালচের মতো সবুজ চা-পাতার বনে সারাটা সকাল ঘুরেছি। কী ভীষণ ভালো লাগে! আর মাকে লুকিয়ে আঙরাভাসা নদীতে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করেছি। ছোট নুড়িবিছানো। হাঁটুজলের নদী। নদীর কোথায় কী পাথর আছে না আছে তা আমি জানি। সেই হলদে রঙের বড় পাথরটার নিচে লাল-লাল চিংড়িগুলো গুঁড়ি মেরে পড়ে থাকে, হাত বাড়ালেই হল। হায়, কাল থেকে আমি আর চিংড়ি ধরতে পারব না। পুজোর ছুটিটা কেমন দ্রুত, মুখের ভেতর নরম চকলেটের মতো দ্রুত গলে মিলিয়ে গেল। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে, ভীষণ।

আমাদের এই বাংলোটা বেশ বড়, অনেকগুলো ঘর। এই বাংলোর আনাচে-কানাচে কী আছে। আমি সব জানি। কিন্তু জেনে আর কি হবে। কাল থেকে তো আর আমি থাকছি না। আমার বই এর ব্যাগটা ড্রেসিং টেবিলের পাশের তাকে রয়েছে যেদিন ছুটিতে প্রথম আমি এখানে আসি সেদিন থেকেই। ও ব্যাগ খোলা হয়নি একদিনও। বাবা খুব রাগারাগি করতেন কিন্তু মা কিছু বলতেন না, আমারও ইচ্ছে করত না।

রাত আরও গভীর হলে, সাঁওতাল লাইনে মাদলের শব্দ উঠলে হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় বাংলোর কাঠের দেওয়ালে আমার ছায়া কাঁপতে দেখে আমার মনে হল আমার বাবা খুব খারাপ লোক, আমার মা-র মনে একটু দয়া নেই, কেউ আমাকে ভালোবাসে না। আমাকে আবার ইংরেজি পড়তে হবে। শ্রীশবাবু রাত্তিরে অঙ্ক করাতে-করাতে কান মলবেন পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে আর পাশের ঘর থেকে বাংলা খবর শুনতে শুনতে মাঝে-মাঝে দাদু চেঁচিয়ে বলবেন, প্রশ্রয় দেবেন না। মাস্টারমশাই, মারুন, ভালো করে মারুন, শাসন না করলে আসন পাবে না বড় হলে। আমি এবার ক্লাস ফাইভে উঠব।

মা আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন, আমি বুঝতে পারি। সেই মাকে আমি আজ সকাল থেকে বোঝাতে পারিনি, রাজি করাতে পারিনি। অতএব কাল আমাকে চলে যেতেই হবে। আমার চোখের সামনে মা আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলেন। কাল সকালে বাবা আমাকে বাসে তুলে দেবেন ঠিক ছিল। সেই বাস আমাকে এই চা-বাগান, ফরেস্ট, ধূপগুঁড়ি, ময়নাগুঁড়ি পেরিয়ে তিস্তা নদীর বার্নিশঘাটে পৌঁছে দিত। কিন্তু আজ খবর পাওয়া গেছে তিস্তা নদী নাকি ফুলে-ফেঁপে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। আজ দুপুরে বাবা বলছিলেন মাকে। একটু হলেই নাকি একটা নৌকা ডুবে যেত। তারপর নৌকা চলাচল বন্ধ। এখন ওদিকে যাওয়ার তো কোনও কথাই উঠতে পারে না। শুনে আমার যা আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু না, বাবা অন্য ব্যবস্থা করেছেন। কাল সকালে বাজারের ব্ৰজেন ডাক্তার শিলিগুঁড়ি যাচ্ছেন। এখান থেকে সাত মাইল দূরে বানারহাট স্টেশন। ওখান। থেকে ট্রেনে চেপে শিলিগুঁড়ি। ব্রজেন ডাক্তার আমাকে জলপাইগুড়ির ট্রেনে চাপিয়ে দিয়ে যাবে। আর দাদু আমাকে জলপাইগুড়িতে সেই ট্রেন থেকে নামিয়ে নেবেন। অর্থাৎ আমাকে যেতেই হবে।

রাত্তিরে মায়ের কাছে, মায়ের বুক লেপটে শুয়ে আমার হঠাৎ মনে পড়ল, একবার আমার পায়ে নতুন জুতোয় ফোস্কা পড়েছিল বলে পরদিন আমি আর জুতো পরতে পারিনি। আর তখন বাবা বলেছিলেন খবরদার, ছোটলোকের মতো খালিপায়ে বাইরে বেরুবে না। আচ্ছা, এখন যদি আমার পা কেটে যায়, যদি আমি জুতো পরতে না পারি, তাহলে তো আমার যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। পা কাটলে জুতো পরবই বা কী করে। ভীষণ ভালো লাগল উপায়টা বের করে। আমি নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে আমার পেন্সিল কাটার ব্লেডটা খুঁজে বের করলাম। তারপর বিছানায় ফিরে এসে মায়ের দিকে পেছন ফিরে বসলাম। পেন্সিলে ব্লেড ছোঁয়ানো মা পছন্দ করে না। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগলো বেশ কচকচ করে কাটে। এখন অনেক রাত। মা ঘুমুচ্ছে। সাঁওতাল লাইনে মাদলের শব্দ আর অস্পষ্ট গানের সুর ছাড়া আর কিছুই আমি শুনতে পেলাম না। আমি ব্লেডটা পায়ের ওপর বোলাতে-বোলাতে জোরে চেপে ধরলাম। একটু চিনচিন করে উঠল। আমি আঙ্গুলে চটচটে রক্ত অনুভব করলাম। কেটে গেলে ব্যথা লাগবে–এ বোধ একবারও মাথায়। আসেনি। বরং এখন আমার বেশ ভালো লাগল। আমার পা কেটে গেছে, আমি জুতো পরতে পারব না, তাই আমার যাওয়াও হবে না। একটা নিশ্চিন্ত খুশি নিয়ে সাঁওতালদের মাদলবাজনা শুনতে-শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে, খুব ভোর সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার মনের মধ্যে ছটফটানি শুরু হল, আমাকে যেতে হবে। আমার পাশে শোয়া ঘুমন্ত মায়ের মুখ দেখতে-দেখতে আমার মনে পড়ে গেল আমার পা। কেটে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমার খুব রোমাঞ্চ হচ্ছিল। আমি উত্তেজিত হয়ে মাকে দু-হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকতে লাগলাম। মা অবাক হয়ে চোখ মেলতেই আমি হুমড়ি খেয়ে বললাম, দ্যাখো–দ্যাখো মা, আমার পা কি ভীষণ কেটে গেছে দ্যাখো, কী ব্যথা, আমি। জুতো পরব কি করে!

মা ধড়মড় করে উঠে বসে আমার ডান পা-টা তুলে ধরলেন, ধরে জিগ্যাসা করলেন, কই, কোথায়?

আমি উপুড় হয়ে দেখাতে লাগলাম। সরু চুলের মতো একটা দাগ। অল্প লালচে আভা তার চারপাশে। মা বললেন, কাটল কি করে? আমি তখন বিছানার চাদরের আশেপাশে খুঁজছিলাম অনেক রক্তের দাগ, গাদাগাদা রক্ত। কিন্তু আশ্চর্য, কোথাও একটু চিহ্ন অবধি নেই। আঙুলে পা টিপলেন মা, আমার একটুও ব্যথা লাগল না। আর অবাক কাণ্ড, সরু চুলের মতো কাটা দাগটা যেখানে, যে দাগটাকে বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা ব্লেডটা দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করে দিলেও আমার আক্রোশ যেত না, সেই দাগটা পায়ের যেখানে সেখান অবধি আমার জুতো পৌঁছায় না। বোধহয় আমার মুখের অবস্থা দেখেই মা হেসে উঠলেন শব্দ করে আর আমি, আমার চোখ ফেটে জল এল।

মা আমাকে ভালো করে খাইয়ে দিলেন। আমার ছোট্ট সুটকেসটা যেটা আমি সহজেই বইতে পারি সেটাকে ভালো করে গুছিয়ে দিলেন। প্রথমে কথা ছিল দাদুর জন্যে বাড়ির পুরোনো গাছের ভালো রসের এক বস্তা কাঁঠাল সঙ্গে দেওয়া হবে। কিন্তু বাবা কী ভেবে সেটাকে বাতিল করলেন। ব্রজেন ডাক্তার এসে গেছেন। বাইরের ঘরে বাবার সঙ্গে তাঁর গলা পাচ্ছি। আমার কিছুই বলার নেই। এরা কেউ চায় না যে আমি এখানে থাকি। জুতো জামা পরে ভিতরের উঠোনে নেমে। এলাম। ছোট মজ:সলপুরী লিচুর ঝাড়, বুড়ো কাঁঠাল গাছ, গোয়াল থেকে কালীগাই হাম্বা-হাম্বা ডাকছে–আমি যাব বলে মা ওর দিকে নজর দেওয়ার সময় পাননি, আর বাড়ির পেছনে আমার খেলার নদী আঙরাভাসা–কী ভীষণ মায়ায় আমি চেখে-চেখে দেখলাম। তারপর আমি যেমনটি ঠিক করে রেখেছিলাম, পেয়ারাগাছের তলায় যেখানটায় ছেলেবেলা থেকে আমি এক্কা-দোক্কা খেলতাম সেই জায়গা থেকে একমুঠো মাটি তুলে নিয়ে আমার ছোট্ট রুমালে ভালো করে বেঁধে পকেটে রাখলাম। শহরে গিয়ে দাদুর বাড়িতে একটা ভালো জায়গায় মাটিটা রেখে দেব। আর রোজ সকালে একবার করে যখন মাটিটাকে দেখব তখন এই চা-বাগান, এই আঙাভাসা, এই চেনামাটির গন্ধটাকে আমি অনুভব করতে পারব। ওরা আমাকে কেউ চলে যেতে বলেনি তো!

বারান্দা থেকে মা আমায় ডাকছিলেন। কাছে যেতেই বললেন, চল, তোর দেরি হচ্ছে যে। বলে আদর করে আমার পকেটে দুটো টাকা দিয়ে দিলেন, রোজ একটা করে লজেন্স খাবি, কেমন! আমি কেঁদে ফেললাম। তারপর ফুলহাতা কমলা রঙের নতুন সোয়েটারটা পরে ছোট্ট স্যুটকেসটা নিয়ে আমি যখন বাইরে এসে দাঁড়ালাম তখন চারদিকে বেশমিষ্টি রোদ উঠেছে, বাড়ির সামনে ঝাঁকড়া বাতাবি লেবুর গাছটায় রাশি-রাশি বাতাবি হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। দেওদার গাছ থেকে চাঁপা গাছ অবধি টানা এরিয়ালের তারে, বসে একটা রোমশ পাখি বিদঘুঁটে স্বরে ডেকে উঠল, ক্যাঁ ক্কো। ব্ৰজেন ডাক্তার আমার হাত ধরলেন, চলো।

ব্ৰজেন ডাক্তার আমার হাত ধরে হাঁটছিলেন। ব্রজেন ডাক্তারের পাশে বাবা। বেশ মোটাসোটা মানুষ উনি, মাথায় বাবার কাঁধের সমান। নাকটা টিয়াপাখির মতো বাঁকানো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাকে দেখছিলাম। বাড়ির বারান্দায় মাদাঁড়িয়ে। আশেপাশের বাড়িতে আমার চা বাগানের বন্ধুরা থোকন, বাচ্চু, শুভকাউকেই আমার চোখে পড়ল না। মাঠ পেরিয়ে আমরা পাকা সড়কটায় উঠে এলাম। রাস্তার দুপাশে দেওদার, পাইন গাছ সাজানো। গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে আমাদের বাড়িটাকে মাঝে-মাঝে দেখতে পাচ্ছি। ক্রমশ আমার মায়ের চোখ-মুখ ম্লান হয়ে এল আমার চোখে। তারপর হঠাৎই আমাদের বাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম। সঙ্গে-সঙ্গে বাবা প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে উঠলেন। ব্রজেন ডাক্তার একটা হাত আমার মাথায় বুলিয়ে মিহি গলায় বললেন, অ্যাঁ, কাঁদছ কেন, অ-খোকা, কাঁদছ কেন?

আমাদের কোয়ার্টারগুলোর সামনে দিয়ে যে চওড়া কালো পিচের রাস্তাটা আসাম অবধি চলে গিয়েছে সেইটে ধরে আমরা হাঁটছিলাম। বেনু চক্কোত্তির কাঠের গোলা, হারাধনকাকুর মিষ্টির দোকান পেরোলেই বাসস্টপ। এর আগে আমি একবার বাবার সঙ্গে বানারহাট গিয়েছিলাম। আমি কোনওদিন রেলগাড়িতে চড়িনি। বানারহাটের স্টেশনে আমি রেলগাড়ি দেখেছিলাম। ছবির মতো। সেই প্রথম। ব্রজেন ডাক্তার আমাকে নিয়ে বাসে উঠলেন। আমরা যেরকম বাসে চেপে জলপাইগুড়ি শহরে যাই তার চেয়ে অনেক ছোট বাস। বাবা নিচে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে হেসে কথা বলছেন। আমি ভীষণ লোভীর মতো, আচার খাওয়ার মতো সবকিছু চেখে-চেখে দেখছিলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল মাংরা আসছে। পা টেনে-টেনে ঘাড় গুঁজে হাঁটছে। আমি জানি, ও সেই কুলি লাইন থেকে রাস্তার পাশ ঘেঁষে এই রকম পা টেনে-টেনে হেঁটে এসে হারাধনকাকুর মিষ্টির দোকানে বসবে। আমি ওকে সেই ছেলেবেলা থেকে চিনি। ওর সামনে গিয়ে আমি চেঁচিয়ে বলি, এই মাংরা, আমি কে বল তো? ও মুখ কুঁচকে ঘাড় গুঁজে একটু ভাববে, তারপর লাল-লাল দাঁত বের করে হাসবে, বা-ব-লু-উ-উ। কী ভীষণ ভালো লাগে তখন। বছরে তো দুবার মোটে এখানে আসি, তাতেই যে কী করে ও আমার গলা মনে রাখে। জন্ম থেকেই ও দেখতে পায় না। দুটো চোখই সাদা। মণিগুলো ডিমের মতো। আমার খুব ইচ্ছে করছিল মাংরার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, আমি কে বলো তো? হারাধনকাকু ওকে ভাঁড়ে করে চা দিল, রোজই দেয়। আর তখুনি বাসটা ছেড়ে দিল। সাঁওতালি আর ওঁরাও কুলিতে ভরতি সেই ছোট্ট বাসটা বিকট শব্দ করে। ছুটতে শুরু করল বিনাগুঁড়ি বানারহাটের পথ ধরে। আমার চোখের সামনে থেকে আস্তে-আস্তে সব চেনা-চেনা ছবিগুলো সরে সরে গেল।

সবুজ গালচের মতো দু-পাশে চা-বাগান, তেলিপাড়া এরোড্রোম বিনাগুঁড়ির মোড়–এসব আমি চিনি। এই তো সেদিন, ফ্যাক্টরির ট্রাকে করে বাগানের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আশেপাশের চা বাগানগুলোতে দুর্গা ঠাকুর দেখে বেড়িয়েছি এই পথ ধরে। ব্রজেন ডাক্তার ফোঁসফোঁস করে। নস্যি নিয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী–মন খারাপ লাগছে? আমি কোনও কথা বললাম না।

বানারহাট স্টেশনে সামনে আমরা বাস থেকে নামলাম। ড্রাইভার লোক প্রত্যেকের কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছিল। আমাদের কাছে নিল না। বরং বলল, সালাম ডাকদারবাবু। ব্রজেন ডাক্তার কোনও কথা বললেন না। আমরা প্ল্যাটফর্মের ওপর উঠে এলাম। চারধার খাঁ-খাঁ করছে। কুচকুচে কালো দুটো লোহার লাইন নুড়ি বিছানা পথ দিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। বাবা বলেছিলেন। আসামের দিকে। আর উলটো দিকটা? ওইদিকে আমরা যাব। শিলিগুঁড়ির দিকে। আমাদের গাড়ি কখন আসবে? আমি কখনও রেলগাড়িতে চড়িনি। ব্রজেন ডাক্তার একটা বেঞ্চিতে আমাকে বসিয়ে বললেন, বসো, আমি টিকিট নিয়ে আসি।

ব্ৰজেন ডাক্তার চলে গেলে আমার খুব একা লাগতে লাগল। একটু-একটু করে আমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমি বাড়ির সবাইয়ের থেকে আলাদা।

প্ল্যাটফর্মে লোকজন বেশি নেই। হঠাৎ আমি সেই নেপালি লোকটাকে দেখতে পেলাম। বাবার সঙ্গে যখন এখানে এসেছিলাম তখন বাবার এক বন্ধুর দোকানে আমরা গিয়েছিলাম। এই লোকটা, হ্যাঁ এই লোকটাই ওখানে কাজ করে। আমাকে ও একটা লজেন্স দিয়েছিল। কী নাম যেন, মনে পড়ছে, খড়গ বাহাদুর। খড়-গ। হাসি পায়। কিন্তু লোকটা আমায় চিনতেই পারল না। আমার একমাত্র চেনা লোক, ব্রজেন ডাক্তার ছাড়া, ও আমাকে চিনতেই পারল না। আমার পাশ দিয়ে সোজা হনহন করে চলে গেল। কী কাণ্ড।

একটু পরেই দেখতে পেলাম প্ল্যাটফর্মে সসারগোল পড়ে গেল। তারপরে আমাদের দিকটায় কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে প্রচণ্ড হুইসল দিতে-দিতে একটা ইঞ্জিন উঁকি দিল। আমাদের গাড়ি এসে গেছে, এটা আমি বুঝতে পারলাম। ক্রমশ দুলকি চালে পুরো রেলগাড়িটা আমার সামনে এসে। দাঁড়াল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ব্রজেন ডাক্তারকে খুঁজছিলাম। সবাই গাড়িতে উঠে পড়ছে। আমরা উঠছিনা কেন? সমস্ত ব্যাপারটা, মানে এই রেলগাড়ি, গাড়ির চলার ভঙ্গি আমার কাছে খুব। লোভজনক বোধ হচ্ছিল। গাড়িটা দুবার হুইসল দিল টং-টং করে কোথায় যেন ঘণ্টা পড়ল। এই সময় আমিব্রজেন ডাক্তারকে দেখতে পেলাম। একটা সাদা প্যান্ট আর কালো কোট, মাথায় কেমন যেন টুপি আর বগলে সবুজ পতাকা নিয়ে লোকটার সঙ্গে হেসে গল্প করতে-করতে আসছিলেন। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। যদি এখন রেলগাড়ি ছেড়ে দেয়! ব্রজেন ডাক্তার বলছিলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, চিন্তার কোনও কারণ নাই, আমি আজই আপনার পোলাটারে দেইখ্যা আসুম। বাবুপাড়া যাইতে আর কমিনিট। উর্দিপরা লোকটা লাল দাঁত বের করে হাসল। ব্ৰজেন ডাক্তার আমার হাত ধরে সামনের গাড়িটায় উঠতেই লোকটা পকেট থেকে হুইসল বের করে রেফারির মতো বাজালো আর প্রাণপণে হাতের সবুজ পতাকাটা নাড়তে লাগল। ব্রজেন ডাক্তার আর আমি জানলার কাছে বসতেই ট্রেনটা দুলে উঠল। আমাদের গাড়ি চলছে।

আমাদের কামরায় লোকজন কম। আমি জানলা দিয়ে দেখছিলাম বানারহাট চা-বাগান ঘরবাড়ি গাছপালা টেলিগ্রামের পোস্টগুলো কী দ্রুত উলটোদিকে ছুটে যাচ্ছে। আমার বেশ মজা লাগছিল। কেমন দোল খাচ্ছে গাড়িটা। আচ্ছা, চাকা দুটো যদি লোহার লাইন থেকে পড়ে যায়। হঠাৎ চারধার খুব গুমগুম করে উঠল। আমি দেখলাম আমরা একটা নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছি। রূপোলি বালি আর নুড়ি পাথরে ভরতি নদীর বুকের এক পাশেশীর্ণ জলের স্রোত। আমি মুখ বাড়িয়ে নিচে কোনও পুল দেখতে পেলাম না। ব্রজেন ডাক্তার বললেন, আঃঝুঁকো না। জানো ইটা কি নদী? ডায়না। বর্ষাকালে কূল পাইবা না। ফেরোসাস। ডায়না! নামটা আমি শুনেছি। ট্রেনটার গতি কমে এল হঠাৎ। মুখ বাড়িয়ে দেখলাম কুলিরা কোদাল কাঁধে চা-বাগানে ঢুকছে। দূরে বাগানের ভিতর ফ্যাক্টরির চুল্লি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে গলগল করে। স্টেশনের নাম পড়লাম চা-ল-সা। ব্রজেন ডাক্তার উঠে কয়েক পা হেঁটে পাশের একটা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। কোথায় গেল। ট্রেনটা থেমে আছে। আমার ভারি ইচ্ছে করছিল নেমে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে একটু হাঁটি। স্টেশন পেরিয়েই বোধহয় বাবুদের কোয়ার্টার–চা-বাগানের শরীর ঘেঁষে খেলার মাঠ। আমার মতো অনেক ছেলে দেখতে পেলাম। আঃ, ওদের কী মজা! একটা লোক, বুড়ো মতন, প্ল্যাটফর্ম ধরে গাড়িগুলো দেখতে দেখতে আসছিল। লোকটার পরনে কালো কোট হাতে বই। লোকটা আমাদের গাড়িতে উঠে এল। তারপর সামনে-বসা কুলিটাকে বলল, এই টিকিট দে। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, লোকটা ঘষঘষ করে পান চিবুচ্ছে। কুলিটা চুপ করে বসেছিল। লোকটা আবার খেঁকিয়ে উঠল, দে-দেনবাবপুর, গাড়িতে ওঠা হয়েছে! এবার কুলিটা ট্যাঁক থেকে পয়সা বের করে লোকটার হাতে দিতেই লোকটা চট করে গাড়িটা দেখে নিল। তারপর। আমার সামনে এসে দাঁড়াল, কী খোকা, টিকিট আছে? আমি হাঁ করে শুনছিলাম। টিকিট, আমার কাছে তো টিকিট নেই। তোমার সঙ্গে আর কেউ আছে নাকি? লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করল। আমার হঠাৎ খেয়াল হল আমার পকেটে দুটো টাকা আছে, মা দিয়েছিল, ওটি দিয়ে দিই।

এমন সময় দরজা খুলে ব্রজেন ডাক্তার প্যান্টের বোতাম আঁটতে-আঁটতে বেরুলেন। লোকটাকে আমার সামনে দেখেই ব্রজেন ডাক্তার গম্ভীর গলায় বললেন, আপনাকে গার্ড কিছু বলেনি? আমি গয়েরকাটার ব্রজেন ডাক্তার?

লোকটা সঙ্গে-সঙ্গে কাঁচুমাচু হয়ে গিয়ে বলল, ওহো, আমি ঠিক ঠিক আছে ঠিক আছে। বলেই নেমে পড়ল গাড়ি থেকে।

ব্রজেন ডাক্তার বসতে-বসতে বললেন, জ্বালাতন। ট্রেনটা চলতে শুরু করল আবার।

তারপর অনেক পাহাড়, নদী, মালবাজার, বাগারাকোট সেবক ব্রিজ দেখতে-দেখতে আমি কেমন। মোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা ভীষণ ভালো লাগছিল। ক্রমশ দিন সরে-সরে ছোট হয়ে যাচ্ছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, ব্রজেন ডাক্তার মালবাজারে আমাকে দুটো বিস্কুট খেতে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে উনি ঢুলছিলেন। এক সময় সন্ধে-সন্ধে মুখে আমরা শিলিগুঁড়ি পৌঁছে গেলাম। ব্ৰজেন ডাক্তার তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, নামো-নামো, আইস্যা গেছে, উফ কি জার্নি। আমরা প্ল্যাটফর্মে নামলাম। নামতেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এত আলো ঝলমল, এত ভিড়, এত রেলগাড়ি আমি কখনও দেখিনি।

ব্ৰজেনকাকুর পেছন-পেছন হাঁটছিলাম। আমার সুটকেসটা অল্প একটু ভারী, কিন্তু আমার বয়ে নিয়ে যেতে তেমন কষ্ট হচ্ছিল না। মাথার ওপর কেমন দিনের মতো আলো, চারধারে ইঞ্জিনের শব্দ, ফেরিওয়ালার চিৎকার, আমার ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। আমার পাশ দিয়ে কয়েকজন লোক বাক্সবিছানা নিয়ে হনহন করে ছুটে গেল, ঘোমটা মাথায় একটি বউ হঠাৎ হোঁচট খেল, কারা যেন মাইকে চিৎকার করছিল, আসামের ট্রেন এখনই ছাড়বে। আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছিল, কী কাণ্ড!

ব্রজেনকাকুর পেছন-পেছন আমি সিঁড়ি ভেঙে-ভেঙে একটা পুলের ওপর উঠে এলাম। এখান। থেকে নিচে প্ল্যাটফর্মের ছাদ, রেললাইন, একটা ইঞ্জিন কী জোর আলো জ্বালিয়ে ছুটে গেল স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ভালো করে যে সব দেখব তার উপায় নেই, ব্রজেনকাকু একটুও দাঁড়াচ্ছিলেন না। আমরা আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। এটা অন্য একটা প্ল্যাটফর্ম। বিরাট গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অনেক লোকজন ভিড় করে উঠছে। দুটো ছোট, আমার মতো ছোট, গায়ের রং কী সাদা, সাহেবের ছেলেকে দেখলাম জানলা দিয়ে মুখ বের করে হাসছে। আমরা ওদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। আবার মাইকে কে যেন বলল, দিল্লির ট্রেন এইমাত্র ছাড়ছে। আর তারপরেই ট্রেনটা কেমন দুলে উঠল। উঠে গুটি-গুটি করে এগিয়ে যেতে লাগল খুব জোরে বাঁশি বাজাতে-বাজাতে। দিল্লি। এই ট্রেনটা তাহলে দিল্লি যাচ্ছে। আকবর বাদশার রাজধানী। আমি নতুন ইতিহাস বইতে পড়েছি যে। কি মজা লোকগুলোর। আমার খুব অবাক লাগছিল। মাঝে-মাঝে আকাশ থেকে কে যেন বলছে এই ট্রেনটা দিল্লি যাবে, এই ট্রেনটা আসাম যাবে, ব্যস সঙ্গে-সঙ্গে ট্রেনগুলো চলে যাচ্ছে, কি কাণ্ড।

ব্রজেনকাকু আমাকে একটা বেঞ্চিতে বসালেন। নিজের ব্যাগটা আমার পাশে রেখে ডিবে খুলে শব্দ করে নস্যি নিলেন নাকে। আমার সামনে ফাঁকা রেললাইন। রেললাইনের ওপাশটায় কেমন অন্ধকার। ব্রজেনকাকু ঘন-ঘন ঘড়ি দেখছিলেন। তারপর একজন কালো কোটপরা লোককে। ডেকে কী যেন জিগ্যেস করলেন। তারপর আমার পাশে এসে বসে বললেন, তোমার ট্রেনের তো অনেক দেরি, বুঝলা ব্রজেনকাকু মাঝে-মাঝে বুঝলা, খাইলা এই রকম ভাষায় কথা বলেন। আমরা, মানে আমি মা-বাবা দাদু কেউ ওই ভাষায় কথা বলি না।

খোকনের বয়স কত? ব্ৰজেনকাকু জিজ্ঞাসা করলেন।

আমার বয়স? নয় বছর। আমি বললাম।

বাঃ, তুমি তো বেশ বড়ই হইয়া গেছ। আমারে আবার গার্ডের পোলাটাকে দেখতে যাওন লাগব! খুব অসুখ, বোঝলা, এত কাজ, আর পারি না, বোঝলা! ব্রজেনকাকু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

খুব অসুখ?

হ্যাঁ। তা তোমারে এখানে রাইখ্যা যাই কেমনে। এখানেই গাড়ি আসব তোমার। জলপাইগুড়ির গাড়ি শুধু এইখানেই আসে। তা তুমি তো একা-একা গাড়িতে উঠতে পারবা না। যাই কেমনে।

জলপাইগুড়ির ট্রেন এখানে আসবে?

হ্যাঁ।

তাহলে আমি উঠতে পারব। এখানেই তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার সামনেই খালি কামরা দেখবা। বাঃতাহলে তো ভালোই হইল। তুমি ভয় পাইবা না তো?

আমি ঘাড় নাড়লাম। ভয় কিসের। এখান থেকে টুক করে উঠে পড়ব। সেই রেলের গার্ডটার ছেলের ভীষণ অসুখ। ব্রজেনকাকু দেখতে যাবে। আচ্ছা, এখানে কি আর কোনও ডাক্তার নেই? কি জানি। ব্রজেনকাকুকে আড়ালে অনেকে ঘোড়ার ডাক্তার বলে। আমাদের সব চা-বাগানের সাহেবের ঘোড়ার অসুখ একবার নাকি উনি সারিয়ে দিয়েছিলেন।

ব্ৰজেনকাকু আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। তারপর আবার ঘড়ি দেখে আমার মাথায় একটু হাত বোলালেন। মাথায় হাত বোলালে আমার খুব রাগ হয়, কিন্তু আমি কিছু বললাম না। ব্রজেনকাকু নিজের ব্যাগটা টেনে বললেন, তুমি তাহলে যাইতে পারবা তো!

আমি ঘাড় নাড়লাম। ব্রজেনকাকু উঠে দাঁড়ালেন এবার। তারপর আমার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে হেসে বললেন, তোমার বাবারে কিছু কওনের দরকার নাই, বুঝলা!

আমি কিছু বুঝতে না পেরেই ঘাড় নাড়লাম। ব্রজেনকাকু হেলতে দুলতে ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে লাগলেন।

এবার আমার কেমন যেন লাগতে শুরু করল। আমার হঠাৎ গা ছমছম করে উঠল। আমার মনে হল আমার শেষ চেনা লোকটাও আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এখানে এত লোক, অথচ আমি কাউকেও চিনি না। অনেক দূরে প্ল্যাটফর্মের ধার ঘেঁষে অনেক লোকের মাঝে একটুখানির জন্যে ব্রজেনকাকুর পেছনটা আমি দেখতে পেলাম। তারপর ব্রজেনকাকু হারিয়ে গেল।

চুপ করে বেঞ্চিতে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। আমার কেমন ভয়-ভয় করছিল। আমার আশেপাশে অনেক লোক, চারিদিকে চিৎকার, রেলগাড়ির শব্দ, তবু আমার কেমন লাগছিল। আমার ট্রেন কখন আসবে? আকাশ থেকে মাইকে বলবে তো? আমি কান খাড়া করে থাকলাম।

আমার একটু-একটু খিদে পাচ্ছিল। সেই কখন খেয়েছি। ব্রজেনকাকু অবশ্য দুটো বিস্কুট দিয়েছিল। মা বলে, আমার পেটে নাকি খিদে ঘুমিয়ে থাকে। আমি চারধারে দেখতে লাগলাম। আমার চোখে পড়ল, আমার ঠিক একটু পেছনে দু-তিনটে লোক দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। দোকানের মতো কাঁচের বাক্সে কেক বিস্কুট সাজিয়ে দোকানদার বিক্রি করছে। একটা সুন্দর কাগজে মোড়া কেক আমি এখান থেকেই দেখতে পেলাম। আমার খুব ইচ্ছে করছিল কেকটাকে খেতে। আমার। কাছে দুটো টাকা আছে। আমি স্যুটকেসটা নিয়ে উঠে পড়লাম বেঞ্চি থেকে। মা বলেছেন কখনও স্যুটকেশটা হাতছাড়া করবি না। আমি সেই ছোট্ট দোকানটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দোকানটা ঠিক প্ল্যাটফর্মের মধ্যিখানে। আমার মাথার ওপরে কাঁচের বাক্স। তাতে অনেক কেক বিস্কুট মিষ্টি সাজানো। আমি সেই কেকটাকে এখন গুলিয়ে ফেললাম। আসলে সবগুলোই আমার ভালো লাগছিল। আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভেবে পাচ্ছিলাম না কোনটাকে খাওয়া যায়।

পকেট থেকে টাকাটা বের করে আমি শেষপর্যন্ত বললাম, আমাকে একটা কেক দাও। চার পাঁচজন লোক শো-কেসের এপাশে-ওপাশে দাঁড়িয়েছিল, দোকানদার তাদের নিয়েই ব্যস্ত, আমার কথা শুনতেই পেল না। শো-কেসটা এত উঁচু যে, সেটা ছাড়িয়ে আমি শুধু দোকানদারের মাথার একটা অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি আরও দুবার চাইলাম, তবু দোকানদার আমাকে দেখল না। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। এই প্রথম হাতে টাকা নিয়ে অচেনা জায়গায় আমি কিছু কিনছি, আমার মনে খুব একটা সাহসও ছিল না।

এই সময় আমি তাকে দেখতে পেলাম। বাঁ-হাতের চেটোয় ডিশ রেখে ডান হাতে কাপের হ্যান্ডেলটা ধরে সুড়ুৎ-সুড়ুৎ করে চুমুক দিচ্ছিলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। খুব লম্বা, আমার যেকোনও চেনা লোকের চেয়ে অনেক লম্বা, লিকলিকে রোগা চেহারা, মেয়েদের। মতো ঘাড় অবধি চুল, গায়ের রং আমার চেয়েও ফরসা। পরনে পাজামা আর পাঞ্জাবি। উনি। আমাকে দেখে হাসছিলেন বলেই আমার আরও রাগ হয়ে গেল। আমি এবার চেঁচিয়ে দোকানদারের কাছে কেক চাইতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই উনি বললেন, কি হে, শুনতে পাচ্ছ না নাকি! কতক্ষণ থেকে ছেলেটা একটা কেক চাইছে, দাও। বলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, একটা না দুটো?

একটা। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম।

একটা দাও। আহা, খিদের জ্বালায় মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে গো। দাও-দাও। দোকানদার একটা প্লেটে কেক দিতেই উনি ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, নাও, খেয়ে নাও।

আমি কেকটা তুলে নিলাম। ফুলের মতো কেকটা। কি মিষ্টি গন্ধ। আমি কেকে একটা কামড় বসিয়েই দেখলাম উনি পকেট থেকে পয়সা বের করে দোকানদারকে দাম দিয়ে দিলেন। উনি কি আমার দামটা দিয়ে দিলেন? তা কেন হবে?

ওঁর চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমি ওঁকে দেখছিলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন, কোথায় যাবে?

জলপাইগুড়ি।

তাই নাকি! আমিও যাব।

আপনি যাবেন?

হ্যাঁ, তোমার বাবা কোথায়? উনি আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে কথা বলছিলেন। যা লম্বা উনি।

বাবা?

যিনি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এলেন!

যাঃ উনি আমার বাবা হবেন কেন? উনি তো ব্রজেনকাকু, বাজারের ব্রজেন ডাক্তার।

বাজারের?

বাঃ, আমাদের চা-বাগানের পাশে যে বাজার আছে।

অ। তা উনি চলে গেলেন তোমাকে একা ফেলে?

উনি তো ডাক্তার, তাই একজনকে দেখতে গিয়েছেন, খুব অসুখ।

আমরা কথা বলতে-বলতে আবার বেঞ্চিতে এসে বসলাম। বসবার সময় দেখলাম ওর কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ। আর ব্যাগের ভেতর থেকে তিনটে বাঁশি উঁকি মারছে। আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। উনি কি তাহলে বাঁশি বাজান। আমি আজ অবধি কাউকে বাঁশি বাজাতে দেখিনি! আমাদের বাড়িতে একটা ছবি আছে। শ্রীকৃষ্ণ গরুর পিঠে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। উনিও কি শ্রীকৃষ্ণের মতো বাঁশি বাজাতে পারেন? বাঃকী মজা।

আপনি বাঁশি বাজাতে পারেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

উনি হঠাৎ চমকে উঠলেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ, কেন?

বাঁশিতে কী বাজান? জনগনমন, হও ধরমেতে ধীর?

দ্যুৎ, ওসব কেন। রাগরাগিনী বাজাই, বেহাগ মালকোষ এই সব।

আমি অবাক চোখে ওঁকে দেখতে লাগলাম। আমার কাছে সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।

তুমি এর আগে এখানে এসেছ? উনি জিজ্ঞাসা করলেন।

না। আমি ঘাড় নাড়লাম।

সেকি। তুমি এই স্টেশনটা আগে দ্যাখোনি। কত কি দেখার আছে এখানে। কত ট্রেন এখান দিয়ে যায় অনেক দূর-দূর। এটা তো জংশন স্টেশন। কত লোকজন এখানে দেখেছ তো!

আমার খুব ইচ্ছে করছিল স্টেশনটা ঘুরে-ঘুরে দেখি। আমাদের আঙরাভাসা নদীর গায়ে মাঝে-মাঝে সাঁওতালদের মেলা বসে। আমি একা ঘুরে-ঘুরে তার সবটা দেখে উঠতে পারিনি। মেলাটা যেখানে বসে সে জায়গায় আঙরাভাসা নদী কেমন যেন পেট ফুলে ফেঁপে খুব বড়, বিরাট হয়ে গেছে। অনেক জল তার সেখানে। আমি কোনওদিন সেই জলে নামিনি, আমার ভয় করে। আমাদের বাড়ির পেছনে ছোট্ট আঙাভাসা নদী, যা আমার খুব চেনা। কিন্তু ওখানে গেলে আমি আর তাকে চিনতে পারি না। সেই সাঁওতালদের মেলার চেয়েও যেন এই স্টেশনটা আরও জমজমাট। আরও বড়। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।

আপনি আমাকে নিয়ে বেড়াবেন? আমি উৎসুক হলাম।

বেড়াবে? তা তোমার ট্রেনের অবশ্য দেরি আছে। বেশ চলো। উনি উঠে দাঁড়ালেন। আমি এক হাতে স্যুটকেশ নিয়ে ওঁর হাত ধরে হাঁটতে লাগলাম প্ল্যাটফর্ম ধরে। কী শক্ত ওঁর হাত।

চারধারে লোকজন গিজগিজ করছে। মাইকে বলল, সবাইকে টিকিট কিনে ট্রেনে উঠতে। একটা বিরাট ট্রেনের পাশ দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম। উনি বললেন, এই ট্রেনটি যাবে কোথায় জানো? কলকাতা।

কলকাতা। কলিকাতা। আমি বইতে পড়েছি। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী।

তুমি কখনও কলকাতায় গিয়েছ?

না। আমার খুব খারাপ লাগছিল। আমি যে কোথাও যাইনি।

ওঃ খুব ভালো জায়গা। ট্রাম, বাস, সিনেমা, থিয়েটার, তুমি তো আর দ্যাখোনি, তোমাকে আর কী বলব–

গড়ের মাঠ, কালীঘাট এসব আছেনা? আমি বইয়ে যেসব ছবি দেখেছি তা মনে করতে-করতে বললাম। ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে আমার খুব হিংসে হচ্ছিল। কী মজা ওই লোকগুলোর যারা কলকাতায় যাচ্ছে।

এমন সময় ছোট, খেলার গাড়ির মতো ছোট্ট একটা ট্রেন হুস হুস করে স্টেশনে ঢুকল। আমার খুব মজা লাগছিল দেখতে। বড় ট্রেনগুলোর পাশে এটা নেহাতই খেলনা। উনি বললেন, এটা হচ্ছে দার্জিলিং-এর ট্রেন। তুমি দার্জিলিং গিয়েছ?

না। আমি বললাম।

ওঃ দারুণ জায়গা। পাহাড়, কুয়াশা, কত হোটেল, যাবে?

এখন? আমি থতমত খেয়ে বললাম।

উনি হো-হো করে হাসলেন খানিক, তারপর বললেন, আহা এখন কেন! বড় হয়ে যাবে, কি বলো?

আমরা গল্প করতে-করতে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে এলাম। দোতলার বারান্দায় ভীষণ ভিড়। অনেক মেয়েপুরুষ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শুয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে। তাদের মালপত্রে হাঁটা যায় না ভালো করে। কেমন শীর্ণ চেহারা সব। চলো ঘরে বসি গিয়ে। উনি আমার হাত ধরে একটা ঘরের সামনে এলেন। দরজায় কীসব সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। বড়-বড় কয়েকটা ডেকচেয়ার, ছোট চেয়ার, দেওয়াল আয়না রয়েছে ঘরটায়। মেঝেতে দুটো বুড়ি বিছানা করে শুয়ে।

এঃ, এখানেও শালারা সেঁধিয়েছে। এইসব রিফিউজিদের জন্যে মাইরি কোথাও যাওয়া যাবে। না। উনি একটা ডেকচেয়ারে বসতে-বসতে বললেন। উনি মাইরি, শালা বললেন? শালা তো ছোটলোকেরা বলে। মাইরি বলতে মা মানা করেছেন, বললে মা নাকি মরে যাবে। ইস। আমার খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমি কিছু বললাম না।

উনি আমাকে ওঁর কোলের ওপর টেনে নিয়ে বসালেন। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। উনি আমার হাত নিয়ে খেলা করছিলেন। একটা হাত নিয়ে উনি হাঁটুর ওপর ঘষছিলেন। ক্রমশ আমার খুব রাগ হচ্ছিল। অন্য সময় হলে আমি চিৎকার করতাম। কিন্তু এখন আমার যেন কোনও শক্তি ছিল না। আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।

বেশ খানিকটা বাদে উনি হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ইস অনেক দেরি হয়ে গেছে। ট্রেনটা এখন পেলে হয়। খুব ভালো ছেলে, লক্ষ্মী ছেলে। এখন চলো, তাড়াতাড়ি চলো। আমি কোনও কথা বলছিলাম না। আমার খুব খারাপ লাগছিল। এই লোকটা ভালো নয়–একদম নয়। আমাকে কেউ এত খারাপ করে আদর করেনি কখনও। আমি ওঁর সঙ্গে ছুটছিলাম। উনি। আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। আমরা আবার নিচে এসে একটা ট্রেনে উঠে পড়লাম। উনি জানলার ধারে একটা বেঞ্চিতে বসলেন। আমি সুটকেসটা বেঞ্চিতে রেখে ওঁর পাশে বসলাম। উনি হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে। বোকা ছেলে। মুখ একদম শুকিয়ে গেছে, অ্যাঁ? বলে জানলা দিয়ে ঝুঁকে কি যেন দেখতে লাগলেন।

আমি কি এখান থেকে পালিয়ে যাব! আমি যে কিছুই চিনি না। কাউকে না।

একটু পরেই ট্রেনটা দুলে উঠল। খুব জোরে-জোরে হুইসিল পড়ল, দুবার। আমার কামরায় লোকজন কম। দুজন লোক চাপা গলায় বর্ডার, পাকিস্তান বলছে শুনতে পেলাম। জানলা দিয়ে মুখ সরিয়ে হাসতে হাসতে উনি আমার ঘাড়ে হাত রাখলেন।

এই ট্রেনটা জলপাইগুড়ি যাবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

হ্যাঁ। বেলাকোবা, আমবাড়ি, জলপাইগুড়ি হয়ে পাকিস্তান বর্ডার। উনি বললেন। ট্রেনটা যখন প্রায় চলতে শুরু করেছে ঠিক তখন দেখলাম দরজা দিয়ে একজন মোটা মতন বউ উঠে এল। উঠে এদিকে-ওদিকে দেখতে লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে ওকে সোজা হয়ে বসতে দেখলাম। তারপর চাপা গলায় ডাকলেন, এই যে এদিকে।

বউটা আমাদের দেখল এক পলক। বেশ মোটা চেহারা। ট্রেনের এই অল্প আলোতেও আমি বুঝতে পারছিলাম ও খুব পাউডার মেখেছে। থিয়েটারে, আমি স্কুলের থিয়েটারে এরকম পাউডার মাখতে দেখেছি অনেককে। আমার মায়ের চাইতেও ও বড়। কেমন যেন।

আমাদের দিকে এগিয়ে এল ও, কখন থেকে তোমাকে খুঁজছি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটি কে?

উনি হাসছিলেন। তারপর হঠাৎ আমি দেখলাম উনি একটা চোখ কুঁচকে কি যেন ইশারা করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে বউটার মুখ থমথমে হয়ে গেল।

উনি হাসতে-হাসতে উঠে বউটাকে নিয়ে দরজায় দাঁড়ালেন। উনি চোখ কুঁচকে কী বললেন। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি ওদের লক্ষ করছিলাম। ওরা ফিসফিস করে কী সব বলছে। ট্রেন এখন খুব জোরে চলছে। বাইরে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমি জানলা দিয়ে অনেক। দূরে একটু-একটু আলো, অস্পষ্ট গাছপালা আর একরাশ জোনাকি ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না।

বউটা খুব হাসছিল। উনি নিশ্চয় খুব হাসির কথা বলছেন। ক্রমশ আমার খুব হিংসে করতে লাগল। আমি এখানে একা বসে আছি আর উনি ওই বউটার সঙ্গে হাসির কথা বলছেন কেন?

একটু বাদে ট্রেনটার গতি আস্তে-আস্তে কমে গেল। আমি মুখ বাড়িয়ে দেখলাম একটা ভীষণ নির্জন স্টেশনে ট্রেনটা চলে এল। প্ল্যাটফর্মের খুব কম আলোয় আমি দু-একজন লোককে চলাফেরা করতে দেখলাম। এখানে কোনও দোকান নেই। আমাদের কামরা থেকে কয়েকজন। লোক নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। স্টেশনের নাম পড়লাম বে-লা-কো-বা। আমার চোখে পড়ল বেশ কয়েকজন পুলিশ বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানে-ওখানে।

আমি কামরায় চোখ ফেরালাম। অবাক কাণ্ড, উনি নেই। বউটা একা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। ঝুঁকে পড়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তারপর হঠাৎ ছুটে ভেতরে চলে এল। এসে আমায় দেখেই আমার পাশে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরল দু-হাতে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বউটার মোটা শরীরে আমার নাক-মুখ গুঁজে যাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি ছটফট করে উঠতেই বউটা খিঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, চোপ। তেড়িবেড়ি করলেই গলা টিপে ফেলে রেখে যাব।

কী ভীষণ গলা বউটার। আমার শরীর হিম হয়ে গেল যেন। হঠাৎ খটখট করে কয়েকজন পুলিশকে উঠে আসতে দেখলাম। কামরায় আলো থাকা সত্বেও ওরা টর্চ জ্বেলে-জ্বেলে প্রত্যেকের মুখ দেখছে। আমাদের মুখের ওপর আলো পড়তেই একজন এগিয়ে এল, এই যে শ্রীমতী স্যাঙাত কোথায়?

বউটা জবাব দিল না।

কী, কিছু জানোনা যে। বাক্যি ছাড়ো। লোকটা কড়কড়ে গলায় বলল।

বউটা কিছু বলল না এবারও।

ওষুধ দিতেনা। বউটা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল এবার।

জানো না? এটি হবে নাকি, অ্যাঁ!

আমি কিছু জানি কে?

ছেলে।

ছেলে? বাঃ ভদ্রলোকের মতো ছেলে তো। বলে লোকটা হাসল হো-হো করে। ওর সঙ্গীরা কিছু বলতেই উনি সরে গেলেন দরজার দিকে। তারপর হুড়মুড় করে পুলিশগুলো নেমে গেল আমাদের কামরা থেকে।

পুলিশগুলো নেমে যেতেই বউটা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা একবার দেখে নিল ও। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, খুব ভালো ছেলে তুমি। কী নাম?

নাম বললাম। আমাকে এবার আলতো করে ধরে রেখেছে বউটা। ওর গা থেকে পাউডারের গন্ধ পাচ্ছি আমি।

কোথায় যাবে?

জলপাইগুড়ি।

শিলিগুঁড়ি থাকো?

না। চা-বাগানে।

পড়ো।

হ্যাঁ।

মা আছেন?

হ্যাঁ।

মাকে ছেড়ে থাকতে পারো? আমার চুলে হাত বোলাল বউটা। আর হঠাৎ আমার কান্না পেয়ে গেল। আমি চোখ বুজে দেখলাম মা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ব্রজেন ডাক্তারের সঙ্গে চলে আসার সময় মায়ের চোখ ছলছল করছিল। আমাকে কাঁদতে দেখে বউটা আমাকে জড়িয়ে ধরল, বোকা ছেলে, কাঁদছ কেন? এখানে মা নেই তো কি হয়েছে, আমি আছি।

আমি কোনও কথা বললাম না। আমি ওর বুকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলাম। পুলিশদের কাছে ও বলেছে আমি ওর ছেলে। মিথ্যে কথা। আমার মা পাউডার মাখে না। তবু আমার এখন খারাপ লাগছিল না।

তোমার ছেলে নেই?

না, না গো! বউটা হাসল। তুমিই তো আমার ছেলে। ওই যে বললাম।

আমরা অনেকক্ষণ কোনও কথা বললাম না। বউটা গুনগুন করে গান গাইছিল। আমি ওর গায়ে লেপটে পড়ে ট্রেনের আওয়াজ শুনছিলাম। চাকায়-চাকায় অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। বোকা-ছেলে, বোকা ছেলে, আমার মনে হল শব্দটা যেন বলছে।

তুমি আমাকে বকলে কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

আমি বকেছি? আর বকব না। বউটা বলল।

উনি কোথায় গেলেন?

কে? ও! জানি না তো। ওর সঙ্গে আর কথা বলবে না, বুঝলে! ও খুব খারাপ লোক। বউটা হাসল। তারপর আমার বুকপকেটে হাত দিল, এমা, তোমার পকেটে টাকা কেন গো। এইটুকুন ছেলের কাছে টাকা রাখতে নেই।

মা দিয়েছিল যে। আমি বললাম। সত্যিই তো দাদু একদিন বলেছিলেন বাচ্চাদের কাছে টাকা রাখতে নেই।

আমি রেখে দিই আমার কাছে? বউটা বলল।

দাও। আমি বললাম। আমার খুব ভালো লাগছিল।

একটু বাদেই ট্রেনটা আবার ধীরে-ধীরে চলতে লাগল। বউটা মুখ বাড়িয়ে কি দেখল। তারপর বলল, এবার ওঠ, তোমার জলপাইগুড়ি এসে গেছে।

জলপাইগুড়ি! আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম। দাদু নিশ্চয় দাঁড়িয়ে আছে। বাব্বা, এতক্ষণে আসা গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি নামবে না?

বউটা বলল, না। আমি অ-নে-ক দূর যাব।

আমার হাত ধরে বউটা দরজায় এল, তোমার স্যুটকেসে কি আছে?

স্যুটকেসে? আমার জামা আর বই। আমি বললাম।

ট্রেনটা তখন দাঁড়িয়ে গেছে। নিচে লোকজন চলছে।

বউটা ঝুঁকে পড়ে আমাকে আদর করল। তারপর আমার প্যান্টের পকেটে হাত দিল, পকেটটা এত ফুলে আছে কেন গো!

পকেটটা? আমার মনে পড়ল পকেটে আমার রুমাল আছে। বউটা ততক্ষণে রুমালটা বের করে নিয়েছে।

কী আছে এতে? কী বেঁধেছ? বউটা গিঁট খুলতে চেষ্টা করছিল।

আমি ছটফট করছিলাম, না খুলবে না, ওটা আমার।

খুলব না? বউটা আমাকে ভেঙাল। কী আছে বলো?

আছে, আমি বলব না। দাও, আমাকে দাও, তুমি নেবে না। আমি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর ওপর। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি কেড়ে নিলাম রুমালটা।

কিন্তু বউটা আমাকে অবলীলাক্রমে দু-হাতে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দিল। টান মেরে স্যুটকেসটা নিচে আমার পাশে ফেলে দিয়ে হাসতে লাগল, ইস, খুব জোর গায়ে,?

বউটা রুমালের গিঁট খুলতে পারছিল না। আমি প্রাণপণে চিৎকার করছিলাম। আমি বউটাকে মেরে ফেলতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু আমি কিছুতেই করতে পারলাম না। ট্রেনটা আবার দুলে উঠে আস্তে-আস্তে চলতে শুরু করল।

আমি প্ল্যাটফর্ম ধার ছুটছিলাম। বউটা তখনও রুমালের গিঁট খুলতে পারেনি। আস্তে-আস্তে ট্রেনটা আমার চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল।

আমি মাটিতে বসে পা ছড়িয়ে কাঁদলাম। আমাকে ঘিরে একটা ছোটখাট ভিড় জমে যাচ্ছিল। আমার বুকের মধ্যে একটা ভীষণ কষ্ট ছটফট করছিল। আমার চা-বাগান, খেলার মাঠ, খুঁটিমারীর জঙ্গল আর খেলার নদী আঙরাভাসা কখন যেন টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে। ভাসানের পর। একদিন আমি জলে ডোবা দুর্গাঠাকুর দেখেছিলাম, ঠিক সেইরকম।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার