যখন একটু ধাতস্থ হল নয়নকাজল, তখন আবার আত্মারামের খাঁচা ছাড়ার উপক্রম। লোকটা তার কণ্ঠার কাছে বল্লমের চোখা ডগাটা ধরে আছে। যা ধার, তাতে একটু চাপ দিলেই গলা এফেঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে। নয়নের বুক ঢিবঢিব করছে, মা কালীর নামটাও স্মরণে আসছে না।

লোকটা জিজ্ঞেস করল, “তোর নাম কী?”

নয়নকাজল জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, “ইয়ে মানে–”

সর্বনাশ! নয়নকাজল দেখে নিজের নামটাও তার মনে নেই মোটেই। মাথাটা এত ঘেবড়ে গেছে যে, কোনও কথা স্পষ্ট মনে পড়ছে না। বাবার নামও নয়, নিজের নামও নয়, কারো নামই নয়। তবে উপায়?

“কী রে?” বলে লোকটা বল্লমটা একটু নাড়ে। নয়নকাজল চেঁচিয়ে বলে, “আমার নাম লোক।”

“লোক?” বলে লোকটা অবাক হয়ে পড়ে থাকা নয়নকাজলের দিকে চেয়ে বলে, “লোক আবার কারো নাম হয় নাকি?”

“কে জানে বাপু। নিজের নামটা আমার মনে পড়ছে না তেমন। মেলা খোঁচাখুঁচি কোরো না, লেগে যাবে।”

“এখানে কী করিস?”

“ডাকাতি। আর কী করার আছে?”

“তুই কেমনধারা ডাকাত? আমার মতো রোগাপটকা লোকের একটা চড় সহ্য করতে পারিস না। কোন আহাম্মক তোকে দলে ভিড়িয়েছে?”

এ-কথায় নয়নের খুব অপমান বোধ হল। লোকটা তেমন রোগাপটকা মোটেই নয়। দিব্যি ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা। হাতের চড়টাও বেশ খোলতাই হয়। নয়ন বলল, “চড়-টড় খাওয়া আমার অভ্যেস নেই।”

লোকটা হাসল! বলল, “তা দড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলি? গলায় দড়ি দিতে?”

দড়ির কথায় নয়নের গোটা ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল। তাই তো। রামু যে হাঁ করে বসে আছে তার জন্য। আর তো দেরি করা যায় না।

নিজের অবস্থাটা আড়চোখে একটু দেখে নিল নয়ন। খুবই খারাপ অবস্থা। ছাদের ধুলোবালির মধ্যে চিত হয়ে পড়ে আছে সে। তার বুকের দুদিকে দুখানা পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে নোকটা! হাতের বল্লম তার গলায় ঠেকানো। নড়ার সাধ্য নেই।

নয়ন বলল, “তা গলায় দড়ি দিলেই বা কী? তোমার বল্লমের চেয়ে সেটা কতটা খারাপ হবে?”

মতলবটা কী ফেঁদেছিলি সেটা খোলসা করে বল তো বাপ। নইলে গেলি।”

নয়ন লক্ষ্য করছিল, লোকটা তাকে মানুষ বলেই তেমন গ্রাহ্য করছে। ভাবছে নয়নের পিঁপড়ের প্রাণ, তাই ততটা সাবধানও হচ্ছে না। নয়ন নিজের ডান পাটা একটু তুলল। না, লোকটা লক্ষ্য করছে না। পা তোলার ঘটনাটা ঘটছে লোকটার পিছন দিকে। সুতরাং নয়ন লোকটাকে পিছন থেকে একটা রাম লাথি কষাতে পারে। ভয় হল, সেই ধাক্কায় লোকটার বল্লম না আবার তার গলায় বিঁধে যায়। তাই লাথি মারার সঙ্গে-সঙ্গে হাতের ঝটকায় বল্লমটা সরিয়ে নিতে হবে। তারপর মা-কালী ভরসা। নয়ন লোকটাকে অন্যমনস্ক করার জন্য হঠাৎ একটু কঁকিয়ে উঠে বলল, “আমার পেটে বড় ব্যথা। বল্লমটা সরাও।”

লোকটা আবার তার নাটুকে হাসি হেসে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা আর হল না। নয়নের আচমকা লাথিটা লোকটাকে দুহাত ছিটকে দিল। হুড়মুড় করে লোকটা যেই পড়েছে অমনি নয়ন বল্লমটা বাগিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। খুনটুন সে জীবনে করেনি। তাই বল্লমটা লাঠির মতো বাগিয়ে ইচ্ছেমতো ঘা কতক দিল লোকটাকে। লোকটা নেতিয়ে পড়ে রইল চুপচাপ।

নয়নকাজল দড়ি নিয়ে ছাদের একটা মজবুত রেলিং-এ বেঁধে খানিকটা নিজের কোমরে জড়াল। এখন আর তার আলসে দিয়ে নামতে ভয় করছে। তার চেয়ে বড় ভয় ওই লোকটার যদি চট করে জ্ঞান ফিরে আসে।

দড়ি ধরে একটু ঝুঁকতেই রামুর ঘরের ঘুলঘুলিটা হাতের নাগালে পেয়ে গেল সে। দড়িটা নামিয়ে দিয়ে ডাকল, “রামু!”

“এই যে!”

“উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি। বাইরে বিপদ।”

রামু গোবিন্দর কাছে কায়দা-কসরত কিছু কম শেখেনি ক’দিনে। দড়ি ধরে টপ করে ঝুল খেয়ে উঠে এল ঘুলঘুলিতে। তারপর দড়িটা টেনে নিয়ে বাইরের দিকে ঝুলিয়ে নেমে আসতে খুব বেশি সময় লাগল না।

সে যে পালাতে পারে, এটা নিশ্চয়ই কারো মাথায় আসেনি। এলে আরো ভাল পাহারা রাখত। কিন্তু পাহারা নেই। তা বলে পালানোও সহজ নয়। চারদিকে ঘন গাছপালা। নিবিড় জঙ্গল। তারা রাস্তা চেনে না।

‘নয়নদা, কোনদিকে যাবে?”

“তাই তো ভাবছি। চলো এগোই যেদিকে হোক। এখানে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়।”

“চলো।” বলে রামু এগাতে থাকে।

কিন্তু এগোনো খুবই শক্ত। শীতকাল বলে সাপের ভয় নেই তেমন। কিন্তু লতাপাতায় পা আটকে যায়। হঠাৎ-হঠাৎ পাখি ডেকে ওঠে।

দুর্গের মতো বিশাল বাড়িটার চৌহদ্দি বড় কমও নয়। খানিকদূর এগোনোর পর সামনে আর-একটা ভাঙা দালান। সেই দালানের একটা ঘর থেকে টেমির আলো আসছে বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে।

নয়ন রামুর হাত চেপে ধরে বলল, “সর্বনাশ! শিগগির অন্য পথে চলো।” রামু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “যাব, একটু উঁকি দিয়ে যাই।”

“পাগল হয়েছ?”

হঠাৎ কাছে-পিঠে একটা ঘোড়া পা দাপিয়ে চিহিহি করে ডেকে উঠল। দুজনেই সেই শব্দে চমকে ওঠে।

“রামু, লক্ষণ ভাল নয়।”

“তুমি চুপ করো তো নয়নদা। অত ঘাবড়ে যাও কেন?”

রামু নিঃসাড়ে গিয়ে জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়। উঁকি মেরে ভিতরে তাকিয়ে তার রক্ত জল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। একটা চৌকির ওপর কম্বলের আসনে বিশাল চেহারার এক কাপালিক বসা। তার মস্ত জটাজুট, বিশাল কালো দাড়ি-গোঁফ, কপালে সিঁদুরের ধ্যাবড়া টিপ। গায়ে লাল পোক। তার সামনে বিনীত ভাবে দাঁড়িয়ে সাতনা।

নয়ন ডাকল, “রামু! পালাও!” রামু আর দাঁড়াল না, নয়ন আর সে প্রাণপণে দৌড়তে লাগল।

কতবার যে পড়ল দুজনে, কতবার ফের উঠল, তার হিসেব নেই। গাছের সঙ্গে বার-সতেক ধাক্কা খেল। পা-হাত ছড়ে গেল, কপাল ফুলে উঠল। তবু তারা দৌড়তে থাকে।

খানিকটা দূর দৌড়োবার পরই তারা বুঝতে পারে, পিছনে কারো হাঁকডাক নেই বটে, কিন্তু কেউ তাদের পিছু নিয়েছে ঠিকই। তারা যেদিকে যাচ্ছে, পায়ের একটা শব্দও সেদিকেই তাদের পিছু নিচ্ছে।

“নয়নদা, পিছনে কেউ আসছে।”

“আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

.

২৭.

রামু বলল, “বড় হাঁফিয়ে গেছি।”

নয়ন বলল, “আমিও। এসো, বসে একটু জিরিয়ে নিই।”

ফিসফিস করে নয়ন বলে, “আসছে আমাদের পায়ের শব্দ শুনে-শুনে। নইলে এই জঙ্গলে আমাদের পিছু নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। যদি বসে থাকি, তবে আমাদের পায়ের শব্দও হবে না, আর লোকটাও খুঁজে পাবে না আমাদের।”

বলতে-বলতে নয়ন বসে দম নিতে থাকে। রামুও। পিছনে পায়ের শব্দটাও আর হচ্ছে না।

রামু জিজ্ঞেস করে, “আমরা কতদূর এসেছি নয়নদা?”

“তা কী করে বলব? এ-জায়গা আমার চেনা নয়। জঙ্গলটাও ভারী জটিল। শুনেছি পুবধারে একটা দুর্ভেদ্য বাঁশবন আছে। সেই বন এত ঘন যে, শেয়ালও গলতে পারে না।”

“আমরা কি সেদিকেই যাচ্ছি?”

“তাও জানি না। আমরা খুব বেশি দূর আসতে পারিনি। ছুটবার সময় ডাকাতদের রাতপাহারার একটা হাঁক-ডাক শুনতে পেলাম যেন।”

রামু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে চলো, আর-একটু দূরে যাই।”

নয়ন তার হাতখানা ধরে বসিয়ে দিয়ে কাহিল গলায় বলল, “খামোখা হয়রাণ হয়ে লাভ কী? গোলকধাঁধায় পড়ে আবার হয়তো গিয়ে ডাকাতদের আচ্ছায় হাজির হতে হবে। তার চেয়ে বসে থাকো। ভোর হলে আলোয় আলোয় চলে যাব।”

রামু জিজ্ঞেস করে, “কাপালিকটাকে দেখলে?”

“ভাল করে দেখিনি। যা ভয় পেয়েছিলাম।”

রামু একটা শ্বাস ফেলে বলল, “বিশাল চেহারা। ভাবসাব দেখে মনে হল সাতনাও ওকে খাতির করে।”

“তা হলে ও হল সাতনার ওপরের সর্দার। এ-দলে যে কে কোন্ পোস্টে আছে, তা বলা মুশকিল।”

“তান্ত্রিক কাপালিকরা কি ডাকাত হয়?”

“হাতে পারে। তা ছাড়া আসল কাপালিক কি না তাই দ্যাখো, ভেকও থাকতে পারে।”

যেখানে তারা বসে আছে, সে-জায়গাটায় গাছপালা তেমন ঘন নয়। শীতে গাছপালার পাতা ঝরে এমনিতেও একটু হাল্কা হয়েছে জঙ্গল। অন্ধকারে গাছপালা চেনা যায়, না, তবে এখানকার গাছগুলো সবই বড়-বড়। ঝোঁপঝাড় তেমন নেই। লম্বা ঘাসের ও আছে অবশ্য। তারা তেমনি বুক-সমান ঘাসের মধ্যেই বসে আছে। হাত বাড়ালে একটা শিশুগাছের গুঁড়ি ছোঁয়া যায়।

হঠাৎ রামু বলল, “একটা শব্দ পেলে নয়নদা?”

নয়ন একটু শক্ত হয়ে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, একটু একটু পাচ্ছি। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কেউ আসছে।

রামু বলল, “আসছে নয়, এসে গেছে। ওঠো নয়নদা, ছোটো।”

প্রাণের দায়ে নয়ন উঠল। কিন্তু ছুটতে গিয়েই ঘটল বিপদটা। কোত্থেকে একটা খেটে লাঠি ছিটকে এসে তার দুই পায়ের মধ্যে একটা ডিগবাজী খেল। তাইতে নয়ন পড়ল উপুড় হয়ে। আর একটা খেটে লাঠির পাল্লায় পড়ে রামুও চিতপটাং।

শিশুগাছের পিছন থেকে লোকটা ধীরে-সুস্থে বেরিয়ে এল। হাতে বল্লম। অন্য হাতে নড়া ধরে প্রথমে রামুকে দাঁড় করাল। ছোট্ট একটা চড় তার গালে কষিয়ে গমগমে গলায় বলল, “পালাতে চাইবে আর? ওই খেটে লাঠির ক্ষমতা জানো? এককালে ঠ্যাঙাড়ে ঠগীরা ওই দিয়ে দূর থেকে লোককে ঘায়েল করত। ফের যদি পালাও তো পাবড়া দিয়ে ঠ্যাং ভেঙে দেব।”

রামুর অবশ্য পালানোর মতো অবস্থা নয়। চড়টা খেয়ে তার মাথা ঘুরছে। সে উবু হয়ে বসে পড়ল।

নয়নকাজল আর ট্যাফো করল না। শোয়া অবস্থাতেই লোকটার পায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আজ্ঞে আর পালাব না।”

নোকটা দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে নিজেও মুখোমুখি বসল। অন্ধকারে আবছা যা দেখা যায় তাতে বোঝা যাচ্ছে লোকটার বয়স বেশি নয়। হালকা পলকা চেহারা বটে, কিন্তু গায়ে পেশ জোর রাখে। পরনে মালকোচামারা। ধুতি, গায়ে একটা বালাপোশের খাটো কোট, পায়ে নাগরা।

লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় পালাচ্ছিলে তোমরা?” নয়ন মাথা চুলকে বলল, “ঠিক পালাচ্ছিলাম না।”

“তাহলে কি এত রাতে জঙ্গলে বেড়াতে বেরিয়েছিলে?”

নয়ন একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে অনেকটা তাই, দিনকাল ভাল নয়। চারদিকে চোর-ছ্যাচড়ের উৎপাত। তাই চারদিকটায় একটু নজর রাখছিলাম আর কী।”

“এই জঙ্গলে চোর-ছ্যাচড় কী করতে আসবে?” ও লোকটা একটু অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে।

নয়ন বিগলিত হয়ে বলে, “বলা তো যায় না আজ্ঞে। আমাদের আড্ডায় তো মেলাই দামি জিনিস আছে।”

লোকটা এবার একটু আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, “তোমাদের একটা আচ্ছা আছে নাকি এখানে? তা সে আচ্ছাটা কোথায়?”

নয়ন ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে ঘন ঘন মাথা চুলকোতে থাকে। রামু বলে, “কেন, আপনি কি সাতনা ডাকাতের আড্ডা চেনেন না?”

লোকটা এবার উৎসাহে একহাত এগিয়ে আসে। চাপা গলায় বলে, “আরে, আমিও যে সেই আড্ডাটাই খুঁজতে বেরিয়েছি। জায়গাটা কোথায় বলো তো?”

রামু মাথা নেড়ে বলে, “তা আমরাও জানি না। আমরা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। জঙ্গলের রাস্তা চিনি না। ফিরে যাওয়ার পথ বলতে পারব না।”

লোকটা বলে, “তোমরা পালিয়ে এসেছ কেন? তোমাদের কি ওরা ধরে রেখেছিল?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার নাম কি রামু, উদ্ধববাবুর ছেলে তুমি?”

“হ্যাঁ।” রামু ভয়ে ভয়ে বলে।

লোকটা একটু হাসে। বলে, “আচ্ছা কাণ্ড যা হোক। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা ওদের দলেরই লোক।”

“আপনি কে?”

“আমাকে চিনবে না। আমি ডাকাতদের দলে নাম লেখাতে যাচ্ছি।”

নয়ন ফস করে বলে ওঠে, “সে তো আমিও গিয়েছিলুম। কিন্তু ওরা নতুন লোককে সহজে দলে নেয় না।”

লোকটা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, “নেবে। এলেমদার লোক দেখলে ঠিকই নেবে। তোমরা যদি কেবল পথটা বাতলে দিতে পারতে তাহলে আমার অনেক হয়রানি কমে যেত।”

নয়ন একটু গুম হয়ে থেকে বলল, “আপনি কেমন লোক কে জানে। খুব ভাল লোক যে নন তা বোঝাই যাচ্ছে। লোক আমিও ভাল নই। তাই আপনাকে বলতে বাধা নেই। আমার মনে হচ্ছে এই পশ্চিম দিকে নাক বরাবর এগোলে সেই আড্ডায় পৌঁছে যেতে পারবেন। তবে সাবধান, আচমকা বল্লম এসে বুকে বিঁধতে পারে। মাথায় লাঠি পড়তে পারে কিংবা ঘাড়ে রামদা’এর কোপ। ওরা বাইরের লোক পছন্দ করে না।”

লোকটা হেসে বলল, “কিন্তু তুমি তো ওদের দলের লোক।”

“না, আমি দল ছেড়ে পালাচ্ছি।”

“তাই কি হয়?” বলে লোকটা সাদা দাঁতে হাসতে-হাসতে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “তোমরা পালালে আমার এত পরিশ্রমই বৃথা যাবে। আমি তোমাদের ধরে আবার সাতনার আস্তানায় নিয়ে যাব চলো।”

নয়ন ভয়ে আঁতকে উঠে বলল, “বলেন কী? এই তো গত পরশু সানার এক কসাই আমাকে বিষ-বিছুটি দিয়ে ছেড়েছে। আবার সেখানে যাব?”

রামুও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, “আপনি ডাকাত হতে যাচ্ছেন তো যান, আমাদের টানছেন কেন?”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “তোমাদের ধরে নিয়ে গেলে সাতনা চট করে আমার ওপর খুশি হয়ে যাবে। তাছাড়া দলের ঘাঁতঘোঁতও কিছু তোমাদের কাছে জানার আছে আমার। আর দেরি করে লাভ নেই। ওঠো, উঠে পড়ো।”

নয়ন লোকটার পায়ে ধরার চেষ্টা করল। রামুও কঁদো-কাঁদো হয়ে অনেক কথা বলল। কিন্তু লোকটার নরম হওয়ার নাম নেই। খেটে লাঠিদুটো বগলে নিয়ে বল্লম বাগিয়ে সে একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে বলল, “নাকি কান্না বন্ধ করো। তোমাদের এত সহজে ছাড়ছি না।”

অগত্যা বল্লমের মৃদু খোঁচা খেতে-খেতে দুজনে ম্লানমুখে লোকটার আগে আগে পশ্চিমদিকে হাঁটতে লাগল।

বেশি দূর হাঁটতে হল না। আধ-মাইলটাক হাঁটতেই অন্ধকারে বিশাল বাড়িটা দেখা গেল। আর দেখা গেল মশাল হাতে বিশ-ত্রিশজন লোক ছোটাছুটি হাঁকাহাঁকি করছে।

লোকটা বলল, “ওই বোধহয় সেই আড্ডা?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। যমদুয়ার।” নয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।

আচমকা পিছন থেকে লোকটা একটা অমানুষিক “রে-রে-রে-রে” হাক ছাড়ল। সে এমন শব্দ যে মাটি কেঁপে ওঠে, গাছপালা নড়তে থাকে, দুর্বল লোকের হৃদপিণ্ড থেমে যায়। কোনো কথা নয়, শুধু “রে-রে-রে-রে” শব্দ বজ্রনির্ঘোষের মতো বেজে ওঠে।

সেই শব্দে মশালগুলো স্থির হয়ে দাঁড়াল। তার পর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল।

.

২৮.

মশালের আলোয় সবার আগে সাত ফুট লম্বা সাতনাকে দেখা গেল এগিয়ে আসতে। হাতে টাঙ্গি। ভয় খেয়ে নয়নকাজল রামুর হাত চেপে ধরে বলল, “আর রক্ষে নেই। দেশে আমার বিধবা মাকে একটা খবর পাঠিয়ে দিও ছোটদাদাবাবু।”

রামু অত ঘাবড়ায়নি। সে তো জানে কাকাতুয়াটাকে দিয়ে এখনো আসল কথা বলাতে পারেনি এরা।

দলটা কাছে এগিয়ে আসতেই দুটো মুশকো চেহারার লোক এসে খপাখপ রামু আর নয়নকাজলকে ধরে পিছমোড়া করে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল।

সাতনা গমগমে গলায় লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কে রে?”

লোকটা বেশ বুক চিতিয়েই জবাব দিল, “আমার নাম কিংকর। তুমি কেডা?”

“আমি সাতনা সর্দার।”

“ওঃ, তুমিই!” বলে লোকটা একটু হাসল। তারপর বলল “তোমার দলেই নাম লেখাতে এসেছি। আমি বর্ধমানের শংকর মাঝির শাকরেদ। নাম শুনেছ?”

“শংকর মাঝি।”

সাতনার গলায় রীতিমত ভক্তিশ্রদ্ধা ফুটে উঠল। ধরা গলায় বলল, “এ দলে আসবে নাকি?”

“হচ্ছে তো তাই।” বলে লোকটা জামার বুকপকেট থেকে বের করে সাতনার হাতে দিয়ে বলল, “এই হল শংকর মাঝির পাঞ্জা। বাঁকরো, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া যেখানে খুশি যে-কোনো দলে এই পাঞ্জা দেখালেই লুফে নেবে আমাকে। তবু তোমার দলেই এলাম কেন জানো? শুনেছি তোমরা একটা বড় দাও মারার ফন্দি এঁটেছ। সত্যি নাকি?”

সাতনার মুখটা একটু ব্যাজার হল। বলল, “সত্যি। তবে হিস্যা নিয়ে বেশি ঝাঁকাঝাঁকি কোরো না। আমাদের হিস্যাদার অনেক।”

সাতনা সর্দার তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শাকরেদদের বলল, “এ দুটোকে নিয়ে যা।”

তারপর লোকটার দিকে ফিরে বলল, “এদের তুমি পেলে কোথায় ধরেই বা আনলে কেন?”

লোকটা বলল, “ওদের মুখেই শুনলুম যে, ওরা তোমার আস্তানা থেকে পালিয়েছে। তাই ভাবলুম যার দলে নাম লেখাতে যাচ্ছি তার একটু উপকার করি গে।”

সাতনা মৃদু হেসে বলে, “দল আমার নয়। আজ বড় সর্দার এখানেই আছে। চলো তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাই।”

“চলো।”

শাকরেদরাও ওদিকে রামু আর নয়নকাজলকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল। এ-বাড়ির মাটির নীচে গোটাকয় চোরকুঠুরি আছে। তারই দুটোয় দু’জনকে ভরে বাইরে থেকে ঝপাঝপ তালা মেরে দিল।

ভিতরে জমাট অন্ধকার। সোঁদা-সোঁদা গন্ধ। হাতে আর মুখে মাকড়সার জাল জড়িয়ে যাচ্ছে বার বার। রামু বারকয়েক হাঁচি দিল নাক-সুড়সুড়ির চোটে। ঘরে কিছু নেই। না বিছানা চৌকি, না অন্য কোনো আসবাব। পায়ের নীচে শুধু ঠাণ্ডা মেঝে। তারই ওপর উবু হয়ে বসল সে। হাঁটু দুটো দুহাতে জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে শীত তাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে তুলতে লাগল।

চোরকুঠুরি থেকে কখন ভোর হল তা টেরও পায়নি রামু। একটা লোক এসে দরজা খুলে যখন নড়া ধরে তাকে হেঁচড়ে বের করে আনল, তখন সে দেখল বাইরে বেশ বেলা হয়ে গেছে।

উঠোনের রোদে একটা দড়ির চারপাইতে বসে কাসার মস্ত গেলাসে খেজুর-রস খাচ্ছিল সাতনা। তার সামনে নিয়ে রামুকে খাড়া করা হল।

সাতনা একবার ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে চেয়ে গেলাসটা গলায় উপুড় করে বাড়িয়ে দিল বাঁ ধারে। গামছায় মুখ বাঁধা একটা হাড়ি নিয়ে মাটিতে বসে আছে একটা লোক। সে গেলাসটা তাড়াতাড়ি আবার ভরে এগিয়ে দেয়।

সাতনা রামুর দিকে লালচে চোখে চেয়ে বলে, “খুব খারাপ কাজ করেছিলে কাল রাতে। তোমার কি জানের পরোয়া নেই? কিংকরের হাতে পড়েছিলে বলে বেঁচে গেছ। নইলে জঙ্গল থেকে বেরোতেও পারতে না, বেঘোরে আমার দলবলের হাতে শিকার হয়ে যেতে।”

রামু কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে।

আরো কয়েক টোক খেজুর-রস খেয়ে সাতনা একটা মস্ত ঢেকুর তুলে বলল, “তোমাকে এবারের মতো মাপ করে দিলাম। বাচ্চা ছেলেদের ওপর আমার কোনো রাগ নেই। কিন্তু খবর পেয়েছি, তোমার বাবা পুলিশে খবর দিয়েছে। তোমার খোঁজে লোকজনও লাগিয়েছে। কাজটা তোমার বাবা খুব ভাল করেনি। এখন যদি তোমাকে জ্যান্ত রাখি, তবে আমাদের মেলা ঝামেলা। তাই ঠিক হয়েছে তোমার মাথাটা কেটে নিয়ে তোমার বাবার কাছে পাঠানো হবে।”

বলে সাতনা আর-এক চুমুক খেজুর রস খেল। আর রামুর শীত করতে লাগল।

সাতনা ধুতির খুঁটে মুখ মুছে বলল, “বুঝেছ?”

রামু একটু কঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “আর নয়নদার কি হবে?”

“নয়ন?” বলে সাতনা অবাক হয়ে রামুর দিকে চেয়ে বলে, “নয়নের খবরে তোমার কী দরকার হে ছোঁকরা?”

“নয়নদার কিছু হলে তার বিধবা মা খুব কাঁদবে।”

“সে তো তোমার মা’ও কঁদবে।”

“আমাকে কেউ ভালবাসে না। বাবা না, মা না।” বলতে বলতে আজ রামুর চোখে জল এসে গেল। গলাটা এল ধরে।

সাতনা গেলাসে চুমুক দিতে গিয়েও কেমন থমকে গেল একটু। বারকয় গলা খাঁকারি দিল। হঠাৎ তার মনটা বোধহয় নরম হয়ে পড়েছিল। সেটা ঝেড়ে ফেলতে একটা বিকট হাঁকাড় দিল, “নিয়ে যা। নিয়ে যা একে।”

লোকগুলো তাকে জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। পশ্চিম ধারে একটা ঢিবি, তার ওপাশে পচা ডোবায় মস্ত হোগলা-বন। ভারী নির্জন জায়গা। ঢিবি পেরিয়ে ডোবার ধারটায় রামুকে নিয়ে এল তারা। জায়গাটা ভীষণ নির্জন। একদিকে ঢিবি র অন্যধারে হোগলার বন থাকায় জায়গাটা লোকচক্ষুর আড়ালও বটে। যে দু’জন লোক রামুকে ধরে এনেছে তারা দু’জনেই ভীষণ গড়া জোয়ান। কালো চেহারা। মুখে রসকষ নেই। একজনের হাতে ঝকঝকে একটা ভোজালি। একজন রামুকে ধরে হাত দুটো মুচড়ে পিঠের দিকে ঘুরিয়ে চুল ধরে মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল সামনের দিকে।

বিড়বিড় করে বলল, “এই বয়সে মরণ না-ডাকলে কেউ বাঘের ঘরে ঢোকে!”

রামু কোনো ব্যথা টের পাচ্ছিল না। পেট জ্বলে যাচ্ছে খিদেয়। গলা তেষ্টায় কাঠ। বুকটা দুঃখে বড় ভার হয়ে আছে। মরতে সে ভয় পাচ্ছিল না। শুধু দুঃখ হচ্ছিল তাকে কেউ ভালবাসে না বলে।

যে লোকটার হাতে ভোজালি সে একটা মসৃণ পাথরের মতো জিনিসে ভোজালিটা বারকয় ঘষে নিয়ে আঙুলে ধার দেখে নিল। তারপর বলল, “নে, হয়েছে। ভাল করে ধরিস। শেষ সময়টায় বড় ঝটকা দেয় কেউ কেউ।”

.

২৯.

জলার ধারে যখন এই ঘটনা ঘটছে, তখন একটু দূরে ঈশান কোণে একটা ভাঙা মন্দিরের উঁচু চাতালে দাঁড়িয়ে দুজন লোক দৃশ্যটা দেখছিল। আসলে দৃশ্যটা খুব মন দিয়ে দেখছিল একজন। সে কিংকর। আর দ্বিতীয় লোকটি অর্থাৎ সাতনা লক্ষ্য করছিল কিংকরকে।

রামুর ঘাড়ের ওপর উদ্যত ভোজালিতে রোদ ঝিকিয়ে উঠতেই কিংকর আর সহ্য করতে পারল না। হাতের বল্লমটা চোখের পলকে তুলে শাঁ করে ছুঁড়ে দিল। এত দূর থেকে বল্লম যত জোরেই ছোঁড়া হোক, তা পৌঁছনোর

কথা নয়। তাছাড়া নিশানা ঠিক রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কিংকরের জাদু-হাত যেন বল্লমটাকে মন্ত্রঃপুত করে ছুঁড়ল। সেটা রোদে ঝিলিক হেনে হাউইয়ের মতো তেড়ে গিয়ে খুনেটার বাঁ কাঁধে বিঁধে গেল। ভোজালি ফেলে বাপ রে’ বলে চেঁচিয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে।

সাতনা এতটুকু চঞ্চল হল না। শুধু প্রকাণ্ড একখানা হাত বাড়িয়ে কিংকরের পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বলল, “সাবাশ। বহোত খুব।”

কিংকর এই বাহবায় গলল না। চিতাবাঘের মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা ডাকাত না ছুঁচো? কাপুরুষের দল! বাচ্চাদের যারা খুন করে, তারা কখনো মরদ নয়।”

সাতনা একটু হাসল। তারপর মোলায়েম গলায় বলল, “রামুকে খুন করা হত না হে। তোমাকে একটু পরীক্ষা করার জন্য ওটুকু অভিনয় করতে হল।”

কিংকর ফুঁসে উঠে বলল, “কিসের পরীক্ষা? তোমাদের মতো চুনোপুঁটির কাছে পরীক্ষা দিতে হবে আমাকে তেমন ঠাউরেছ নাকি?”

সাতনা ঠাণ্ডা গলায় বলে, “আহা চটো কেন ভায়া! তুমি ভিন দলের লোক না শত্রুপক্ষের চর তা একটু বাজিয়ে দেখতে হবে না?”

কিংকর চোখ রাঙা করে তেজের গলায় বলল, “দেখ সাতনা, যতদূর জানি তুমি এ-দলের সামান্য মোড়ল মাত্র। সর্দার অন্ত্রিকবাবা কাল তোমাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছিল না। বেশি ফেঁপরদালালি করবে তো সোজা সর্দারকে জানিয়ে দেব। আর একটা কথা, তোমার চেহারাটা বড়সড় বটে, ভোবো না বেড়ালের মতো তোমার নটা প্রাণ আছে। এ দুখানা শুধু-হাতে তোমার ওই মোষে গর্দান ভেজা-গামছার মতো নিংড়ে মুচকে দিতে পারি। কাজেই বুঝে-সমঝে চলো। আমি তোমার পালের মেড়াদের মতো নাই।”

সাতনার সঙ্গে এই ভাষায় এবং তেজের ভঙ্গিতে কেউ কথা কওয়ার সাহস পায় না। কিন্তু এই অগ্রাহ্যের ভাব সাতনা মুখ বুজে সয়ে গেল। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি একটা ছেলেকে চিনতাম। তখন তার অল্প বয়স। ইসকুলে পড়ে। প্রতি বছর ইসকুলের স্পোর্টসে ছেলেটা জ্যাভেলিন থ্রোয়ে সেরা প্রাইজ পেত। বর্শা ছুঁড়ত এমন জোরে যে দেখে তাক লেগে যেত। বেঁচে থাকলে এখন সে তোমার বয়সীই হয়েছে।”

এ-কথা শুনে কিংকর একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তবু তেজের সঙ্গে বলল, “ওসব এলেবেলে কথা শুনতে চাই না। এবার থেকে কিংকরকে একটু সমঝে চলো।”

দুজন লোক বল্লম-খাওয়া লোকটাকে ধরাধরি করে চাতালে এনে ফেলল। মুখে জল দেওয়া হচ্ছে রক্তে ভাসাভাসি কাণ্ড। চোট গুরুতর। তবে কাঁধে লেগেছে বলে প্রাণের ভয় নেই। সাতনার স্যাঙাতরা কটমট করে কিংকরের দিকে তাকাচ্ছে, একটু ইঙ্গিত পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা নামিয়ে দেবে।

কিন্তু সাতনা তাদের দিকে তাকাল না। কিংকরকে বলল, “চলো, ভিতর বাড়িতে যাই। ভয় নেই, রামুকে কেউ এখনই খুন করবে না।”

কিংকর বলল, “না-করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ওই বাচ্চা-ছেলেটার গায়ে কেউ হাত তুলেছে বলে যদি টের পাই তবে সেই হাত আমি কেটে ফেলে দেব মনে রেখো।”

“বাপ রে!” বলে সাতনা হাসল, “তুমি যে আমাকে ভয় খাইয়ে দিচ্ছ।”

এ-কথায় কিংকরও হেসে ফেলল। তারপর ভিতরবাড়িতে গিয়ে উঠোনের রোদে দুজনে দুটো দড়ির চারপাইতে বসে খেজুর রস খেতে লাগল। কিংকর জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ আমাকে পরীক্ষা করার জন্য ওই ছেলেটাকে সাতসকালে খুনেদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলে কেন?”

সাতনা প্রথমটায় কথা বলল না। একমনে খেজুর রস খেয়ে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ বাদে বলল, “দেখছিলাম ওই ছেলেটার প্রতি তোমার দরদ আছে কি না।”

কিংকর অবাক হয়ে বলল, থাকবে না কেন? ডাকাতি করি বলে তো আর অমানুষ নই।”

সাতনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, বলল, “তোমাকে যে সেই ছেলেটার কথা বলছিলাম, যে ইসকুলে জ্যাভেলিন থ্রোতে প্রতিবার ফার্স্ট হত, তার কথা আর একটু শুনবে নাকি?”

কিংকর একটু থতমত খেয়ে বলে, “তার মানে? তোমার কি মাথার গণ্ডগোল আছে নাকি বাপু? হঠাৎ পুরনো গপ্পো ফেঁদে বসতে চাইছ কেন?”

“সাধে কি আর চাইছি? গপ্পোটা তোমার জানা দরকার। এমনও তো হতে পারে যে, সেই ছেলেটাই তুমি।”

কিংকর হাতের রসসুষ্ঠু ভাঁড়টা হঠাৎ ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ ধকধক করছে, লম্বা শরীরের পেশীগুলো জামার তলায় ঠেলাঠেলি করছে! থমথমে গলায় সে বলে, “সাতনা, বুঝতে পারছি খামোখা আমাকে ঝামেলায় জড়িয়ে, সকলের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুমি আমাকে দল থেকে হঠাতে চাইছ। কারণ আমি থাকলে এই দলে তোমার জায়গা আমার নীচেই হবে। তাই বলছি, ওসব হীন চক্রান্ত না করে এসো দুজনে মরদের মতো ফয়সালা করে নিই কে কত বড় ওস্তাদ। হাতিয়ার ধরতে হয় তো ধরো, নইলে খালি হাতে চাও তো তাই হোক। চলে এসো।”

এই চ্যালেঞ্জের জবাবে কিন্তু সাতনা নড়ল না। কেমন একরকম ক্যাবলা চোখে কিছুক্ষণ কিংকরের দিকে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, “বোস কিংকর। না, তোমার সঙ্গে আমি কাজিয়া করতে চাই না। বোসো কথা আছে।”

রাগে ফুলতে ফুলতে কিংকর আবার চারপাইতে বসল।

সাতনা বলল, “তুমি খুব সাংঘাতিক লোক, মেনে নিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো, তোমারও একটা বৈ দুটো প্রাণ নেই।”

“ জানি। ওসব ভয় আমাকে দেখিও না। কিংকরের একটাই জান বটে, কিন্তু সেটা মরদের জান। তোমার জান নয়। আমাকে প্রাণের ভয় দেখিয়ো না।”

এতেও উত্তেজিত হল না সাতনা। শান্ত গলায় বলল, “তোমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। জানি। সে-চেষ্টা করছি না। শুধু জানতে চাইছি তুমি এ-দলে ঢুকলে কেন? তুমি তোমার মতো থাকো।”

সাতনা মাথা নেড়ে বলে, “তা থাকতে পারছি কই? তুমি কথায়-কথায় আমাকে শাসাচ্ছ, লড়তে চাইছ। তার মানে ছুতোনাতায় আমার সঙ্গে তোমার লাগবেই। তাই মনে হয় তুমি আমাকে ভাল চোখে দেখতে পারছ না।”

কিংকর গম্ভীর গলায় বলে, “ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করলে ভাল চোখে দেখতে বাধা কী?”

সাতনা বলে, “বাধা আছে। তোমার বাধা আছে। আমার সব কিছু মনে থাকে। মানুষের মুখ আমি সহজে ভুলি না।”

কিংকরের মুখটা আবার হিংস্র হয়ে ওঠে।

সাতনা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “কিছু বলতে হবে না। আমি মরদ কিনা সে-পরিচয় যথাসময়ে পাবে। এখন খ্যামা দাও। শুধু মনে রেখো সাতনার দশজোড়া চোখ সব জায়গায় তোমাকে নজরে রাখবে। দশজোড়া হাত তৈরি থাকবে। এক চুল বেয়াদবি দেখলে চোখের একটা ইশারা করব, সঙ্গে-সঙ্গে তোমার মুণ্ডু খসে পড়বে।”

কিংকর ঝাঁকুনি মেরে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবিকই পিছন থেকে আচমকা দশখানা বল্লমের তীক্ষ্ণ ডগা পিঠ আর কোমর স্পর্শ করল। কিংকর উঠল না। কিন্তু একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “খুব মরদ।”

সাতনা খুব বড় একটা শ্বাস টেনে বলল, “তোমার সাহস আছে বটে।”

.

৩০.

কোনো কথা না বলে দুখানা তীক্ষ্ণ চোখে অনেকক্ষণ কিংকরকে দেখল সাতনা। তারপর বলল, “তোমার বড্ড ঝুঁজ হে। ঝাজালো লোক আমি পছন্দ করি বটে, তবে বেশি ঝাজ ভাল নয়।”

কিংকর কথা বলল না। কটমট করে তাকিয়ে রইল। সাতনা একটা হাঁক দিলে এক স্যাঙাত দৌড়ে আসে। সাতনা তাকে বলে, “যা, রামুকে ধরে নিয়ে আয়।”

কিংকরের পিছনে দশখানা বল্লম উঁচিয়ে আছে। সে অবশ্য গ্রাহ্য করল। একমনে খেজুর রস খায় আর মাঝে-মাঝে সাতনার দিকে আগুনপারা। চোখ করে চায়।

একটু বাদেই নড়া ধরে রামুকে নিয়ে এল সাতনার স্যাঙাত। অল্প সময়ের মধ্যেই রামুর মুখ শুকিয়ে গেছে। চোখে আতঙ্ক। তাকে দেখে কিংকর সাতনার ওপর রাগে দাঁতে দাঁত পিষল।

সাতনা কিংকরকেই লক্ষ্য করছিল। একটু হেসে বল, “রাগ কোরো না হে। মায়াদয়া করলে আমাদের চলে না। ওহে রামু, এই লোকটাকে চেনো?”

রামু দিশাহারার মতো চারদিকে চেয়ে দেখল। তারপর কিংকরের দিকে তাকিয়ে বলল, “চিনি। এই লোকটাই কাল রাতে আমাদের ধরে এনেছে।”

সাতনা মাথা নেড়ে বলে, “সে তো জানি। সে-কথা নয়। লোকটাকে আগে থেকে চেনো কিনা ভাল করে দেখে বলো তো।”

রামু ভাল করেই দেখল। আবছা-আবছা একটা চেনা মানুষের আদল আসে বটে, কিন্তু সঠিক চিনতে পারল না। মাথা নেড়ে সে বলল, “চিনি না।”

“খুব ভাল করে দেখলে চিনতে পারতে কিন্তু। অবিশ্যি তোমার দোষ নেই। এই লোকটা হরবোলা। একসময়ে সার্কাসে হরেক রকম পাখি আর জানোয়ারের ডাক নকল করত। যে-কোনো মানুষের গলা একবার শুনে হুবহু সেই গলায় কইতে পারে। সুতরাং গলা শুনে একে চিনবে না। আর চেহারা? যে-চেহারাটা এখন দেখছ সেইটেও এর আসল চেহারা নয়, তবে অনেকটা কাছাকাছি। দরকার শুধু থিয়েটারের সঙ সাজার কয়েকটা জিনিস। তাহলেই হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…..”

সাতনা হাসতে হাসতে বেদম হয়ে পড়ল। কিংকর স্থির চোখেই সাতনার দিকে চেয়ে ছিল। কথা বলল না।

সাতনা হাসি থামিয়ে কিংকরের দিকে চেয়ে বলল, “তোমার অনেক গুণ। এত গুণ খামোখা নষ্ট করলে হে।”

কিংকর একটু হেসে বলে, “তোমারও অনেক গুণ। সেইসব গুণ তুমিও অকাজে নষ্ট করলে সাতনা। তবে বলি তোমার ক্ষতি করতে আমার আসা নয়। আমি তোমাকে দুটি কথা বলব। বেশ মন দিয়ে শোনো।”

সাতনা হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখ করে কিংকরের দিকে চাইল। তারপর বলল “শুধু গুল মেরে এই জাল কেটে বেরোতে পারবে না। কাজেই বলার আগে ভেবেচিন্তে নাও, যা বলবে তা সত্যি কিনা।”

“আমি যা বলব তা সত্যি। তবে এত লোকের সামনে বলা যাবে না। কথাটা বড়ই গোপন।”

সাতনা পাহাড় প্রমাণ শরীরটা টান করে উঠে দাঁড়াল। বলল, “ঠিক আছে। চোরকুঠুরিতে চলো। তবে তোমার হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা থাকবে।”

“ঠিক আছে। তাই-ই সই।”

“সার্কাসে তুমি হাতকড়া খোলার খেলা দেখাতে! আমার সব মনে আছে। কিন্তু এখন চালাকি করে হাতের দড়ি খুলতে যেও না আমার কাছে রিভলভার আছে। মনে রেখো।”

দুটো লোক এসে কিংকরের হাত পিছমোড়া দিয়ে শক্ত করে বাঁধল। তারপর সাতনা আর কিংকর গিয়ে ঢুকল চোরকুঠুরিতে।

কিংকরকে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে মুখোমুখি বসল সাতনা। হাতে সত্যিই ছ’ঘরা রিভলভার। বসে বলল, “যা বলার চটপট বলে ফ্যালো।”

“আমি কাকাতুয়াটাকে দিয়ে কথা বলাতে পারি।”

“পারো? বটে?” সাতনা একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।

কিংকর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “পারি। অনেক ভেবেচিন্তে কায়দাটা বের করেছি। কিন্তু পাখিটা কথা বললে তোমরা সেই গুপ্তধন বের করবে। অথচ ওই গুপ্তধন তোমাদের পাওনা নয়। আইন বলে, যত গুপ্তধন পাওয়া যাবে তার সবই গবর্মেন্টের। কিন্তু তোমরা গবর্মেন্টকে এক পয়সাও দেবে না।”

সাতনা জলদগম্ভীর স্বরে বলে, “শুধু এই কথা?”

“না। আরো আছে। গোবিন্দ ওস্তাদকে চেনো। বেচারা মিথ্যে খুনের মামলায় ফেঁসে গেছে। অথচ তা উচিত নয়। আসল খুনীর উচিত নিজের দোষ স্বীকার করে নির্দোষ লোকটাকে খালাস করে দেওয়া।”

সাতনার মুখ ফেটে পড়ছিল দুর্দান্ত রাগে। খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে বলল, “আর কিছু?”

“হ্যাঁ। আর একটা কথা। তোমার যে-মেয়েটা হারিয়ে গিয়েছিল, আমি তার সন্ধান জানি। সে যে তোমারই মেয়ে তার প্রমাণও দিতে পারি।“

আস্তে-আস্তে, খুব আস্তে-আস্তে সাতনার মুখে একটা পরিবর্তন ঘটতে লাগল। কর্কশ, নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর মুখোনা যেন কোমল হতে লাগল। চোখ দুটো ভরে উঠল জলে। একটা দমকা শ্বাসের সঙ্গে অস্ফুট গলায় সে বলল, “মিথ্যে কথা!” একটু থেমে আবার বলল, “মিথ্যে কথা! তুই আমাকে ভোলাতে এসেছিস।”

বলতে বলতে সাতনা উঠে দাঁড়াল।

“না সাতনা, তোমাকে ভোলানোর ক্ষমতা আমার নেই। এই দ্যাখো–” বলে পিছন থেকে ডান হাত বের করে কিংকর তার বালাপোশের কোটের ভিতর দিকে হাত ভরে একখানা ফোটো বের করে আনল।

সাতনা হাঁ করে চেয়ে দৃশ্যটা দেখে বলল, “হাত খুলে ফেলেছ! তোমাকে বলেছিলাম না চালাকি করার চেষ্টা করলে-”

কিংকর অমায়িক একটু হেসে বলে, “আমার হাত কিছুতেই বাঁধা থাকতে পারে না, বুঝলে! আপনা থেকে খুলে বেরিয়ে আসে। যাকগে, আবার না হয় বাঁধতে বলে দাও।”

সাতনা জানে, সে-চেষ্টা বৃথা। হাত বাড়িয়ে সে ফোটোটা নেয়। অবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ে থাকে ফোটোটার দিকে। চোরকুঠুরিতে শুধু একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি। দিয়ে আসা আলোতেও ফোটোর মেয়েটির মুখ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় সাতনা। তার মেয়ে চুরি যায় পাঁচ-ছ বছর বয়সে। এই মেয়েটির বয়স তেরো-চোদ্দ বছর। কিন্তু কী হুবহু মিল। তার মেয়েটা বেঁচে থাকলেও এই বয়সীও হওয়ার কথা। সে জিজ্ঞেস করল, “এটা কতদিন আগেকার ফোটো?”

“গত বছরে। তোমার মেয়ের বয়স এখন চোদ্দ বা পনেরো।”

“আর কোনো প্রমাণ আছে?”

“আছে। তবে তা দিয়ে আর তোমার দরকার কী? আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো। এ তোমারই মেয়ে এবং সে বহাল তবিয়তে বেঁচেও আছে।”

সাতনা ভাল করে কথা বলতে পারছিল না বারবার টোক গিলছে। চোখে জল আসছে। অত বড় সা-জোয়ান লোকটার হাত দুটো কাঁপছে থরথর করে। সে জিজ্ঞেস করল, “আমার মেয়ে কোথায়?”

“সেইটে এখন বলতে পারছি না।”

“বলো!” বলে সাতনা প্রকাণ্ড দুটো হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল কিংকরকে। একটা রামঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “শিগগির বলো। নইলে মেরে ফেলব।”

কিংকর নিজের শরীরটাকে একটু মোচড় দিয়ে সরে গেল। তারপর বিদ্যুৎগতিতে হাতটা তুলে সাতনার ঘাড়ে হাতের চেটোর ধার দিয়ে একটা কোপ মারল।

“আঁক্‌” করে একটা শব্দ হল শুধু। তারপর হাতির মতো বিশাল শরীর নিয়ে সাতনা ঢলে পড়ল মেঝের ওপর।

কিংকর ঘরের কোণে একটা জলের কুঁজো অনেকক্ষণ আগেই লক্ষ্য করেছে। এখন সেইটে তুলে এনে সাতনার চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে পাগল।

একটু বাদেই চোখ মেলে উঠে বসল সাতনা।

কিন্তু এ এক অন্য সাতনা।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়