সবাই চোখ বুজলেও কুন্দকুসুম চোখ বোজেননি। বরং তার চোখের পলক পড়ছিল না তাঁবুর চারদিকে যে “হায় হায়” ধ্বনি ভেসে গেল, তিনি তাতেও যোগ দিলেন না।

বিশাল রাজগোখরো যখন ছোবল দিল, তখন তার দিকে মাস্টার লখিন্দর পেছন ফিরে আছে। আর যে চাবুকের মতো গতিতে ছোবলটা এল, তা থেকে নিজেকে বাঁচানো খুব শক্ত কাজ।

কিন্তু তবু দেখা গেল, সাপটা যেখানে ছোবলটা চালাল সেখানে লখিন্দর নেই। লখিন্দর লাট্রর মতো একটা পাক খেয়ে কী করে যে সরে গেল এরেনার অন্য ধারে, সেটাই চোখ চেয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন কুন্দকুসুম।

ছোবল ফসকে যাওয়ায় সাপটাও বুজি হতভম্ব। আবার বিশাল ফণা তুলে কুটিল চোখে সাপটা দেখে লখিন্দরকে। কিন্তু ওস্তাদ লখিন্দর তখনো সাপটার দিকে পিছন ফিরে দর্শকদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। যেন সে জানেই

যে তার পিছনে কালান্তক যমের মতো গোখরো।

আবার এরেনার ওপর বিদ্যুৎ খেলিয়ে সাপটা এগিয়ে গেল এবং শপাং করে ছোবল বসাল! এবার বাঁ পায়ের ডিমে।

সেই দৃশ্য দেখে দর্শকরা পাগলের মতো চেঁচাতে থাকে, “মরে গেল মরে গেল!”

লখিন্দর এবার সরেওনি ভাল করে। শুধু বাঁ পাটা একটু ছড়িয়ে দিয়েছিল

এক চুলের জন্য ছোবলটা পায়ে না-লেগে মাটি ছুঁয়ে উঠে গেল আবার।

“বন্ধ করো! এ সর্বনেশে খেলা বন্ধ করো!” বলে মহিলারা চেঁচাতে লাগলেন। চেঁচানোই স্বাভাবিক। লখিন্দর যে সাপটার দিকে তাকাচ্ছেই না।

সাপটা যখন তৃতীয় বার ছোবল তুলেছে, তখন লখিন্দর উবু হয়ে তার ডান পায়ের জুতোর ঢিলে-হয়ে যাওয়া ফিতে বাঁধছে মুখ নিচু করে। সুতরাং তার মাথাটা এবার একেবারে সাপের দোল-দোলন্ত ফণার সামনে।

“আর রক্ষে নেই গবাদা!” বলে রামু হাঁটু খিমচে ধরে।

এবার কুলকুসুমেরও চোখ বন্ধ করে ফেলতে ইচ্ছে হল। চোখের সামনে একটা নির্ঘাত মৃত্যু কার দেখতে ভাল লাগে!

সাপটা ফোঁস করে একটা ক্রুদ্ধ আওয়াজ ছেড়ে সটান লখিন্দরের মাথা লক্ষ করে হাতুড়ির মতো নেমে এল।

কিন্তু আশ্চর্য এই, বসা অবস্থাতেই লখিন্দর একটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে সরে গেল পিছনে। একবারও সাপটার দিকে না তাকিয়ে বসে বসে সে জুতোর ফিতেটা শক্ত করে বেঁধে নিল ভারী নিশ্চিন্তভাবে।

পুলিশের একজন ইনফরমার বৈরাগীর ছদ্মবেশে কুকুসুমের পিছনের বেঞ্চে বসে ছিল। কুন্দকুসুম একবার তার দিকে ফিরে ভ্রূ কুঁচকে মাথাটা একটু ওপরে তুললেন। অর্থাৎ লোকটা কে?

ইনফরমার চারদিকে চেয়ে দেখে নিল, কেউ তাকে লক্ষ করছে কিনা। কিন্তু এরেনায় যে খেলা চলছে, তার দিকে রুদ্ধশ্বাস চেয়ে মানুষ কেউ কারো দিকে তাকাতে ভুলেই গেছে। ইনফরমার মুখটা এগিয়ে এনে মৃদু স্বরে বলল, “জানি না। তবে এ ধরনের খেলা একসময় দেখাত গোবিন্দ ওস্তাদ। কিন্তু কাশিমের চরের সেই মার্ডার কেসে গতকাল তার ফাঁসি হয়ে গেছে।

“হয়ে গেছে?”

“হয়ে গেছে। গোবিন্দর ভাই জেলখানার গিয়ে মড়া নিয়ে শ্মশানে দাহ পর্যন্ত করেছে বলে খবর পেয়েছি।”

“মুখোশের আড়ালে লোকটা তাহলে কে একটু খবর নিও।”

“যে আজ্ঞে।”

ওদিকে এরেনায় মুখোশাবৃত লখিন্দর বারবার অবহেলায়, আনমনে ছোবল এড়িয়ে এড়িয়ে সাপটাকে হয়রান করে তুলল। অবশেষে সেই রাজগোখরো যখন ক্লান্তিতে ছোবল মারা মুলতুবি রেখে একধারে বিড়ে পাকিয়ে বিশ্রাম নিতে বসল তখন শেষ হল খেলা। জীবন ও মৃত্যুর এই বিপজ্জনক খেলা দেখে দর্শকরা এত জোর হাততালি দিল যা অন্য কোন খেলায় দেয়নি।

লখিন্দর একবার হাত তুলে সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল এরেনা থেকে।

রাত গভীর। সার্কাসের চত্বরে যে যার তাঁবুতে ঘুমোচ্ছ। জেগে আছে শুধু কয়েকজন চৌকিদার। আর জেগে আছে বুড়ো সামন্তর তাবুতে সামন্ত আর গোবিন্দ ওস্তাদ।

সামন্ত মৃদু স্বরে বলে, “এবার ঘটনাটা খুল বল।”

গোবিন্দ একটু হাসল। বলল, “কাল আমার ফাঁসি হয়ে গেছে। এমন কী, দাহকাজ পর্যন্ত সারা।”

সামন্ত তামাকের নলটা মুখ থেকে সরিয়ে বলে, “আর একটু খোলশা করে বল। তোকে ফাঁসি দেয়নি তো দিল কাকে?”

গোবিন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তা আমি জানি না। ফাঁসি হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিল আমাকে। আমিও তার জন্য তৈরি ছিলাম। কিন্তু মাসখানেক আগে একদিন সকালে আমাকে যখন জেলখানার চত্বরে পায়চারি করাচ্ছিল, তখন দেখি কয়েকজন রাজমিস্ত্রি ভারা বেঁধে জেলখানার উঁচু ঘেরা দেয়ালে মেরামতির কাজ করছে।”

“তুই তখন কী করলি?”

“আজ্ঞে মাথায় তখন মতলবটা খেলে গেল। ভাবলাম, এই সুযোগ পরে আর পাব না। আমাকে দুজন বিশাল চেহারার সেপাই পাহারা দিচ্ছিল। আমি তাদের ঠাট্টা করে বললাম ঐ যে রাজমিস্ত্রি ভারা বেঁধেছে ওটায় উঠে যদি কোনো কয়েদি পালায় তবে কী করবে? ওরা বলল, অত সহজ নয়। তুই পারবি? আমি হেসে বললাম, চেষ্টা করতে পারি। ওরাও হাসল, বলল, কর না দেখি।”

“বলল?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিও ইয়ার্কির ভাব দেখিয়ে হেঁটে গিয়ে ভারার পয়লা বাঁশটায় উঠে পড়লাম। তারা দেখি তখনো মোচে তা দিচ্ছে আর ফিড়িক ফিড়িক করে হাসছে। আমি আর এক ধাপ উঠলাম। কেউ কিছু বলল না। রাজমিস্ত্রিরাও একমনে কাজ করে যাচ্ছে, আমার দিকে তাকাচ্ছে না। এক ধাপ দু ধাপ করে আমি একদম দেওয়ালের মাথায় পৌঁছে দেখি, তখনো সেপাই দুটো হাসছে আর মোচে তা দিচ্ছে।”

“বলিস কী?”

“যা হয়েছিল তাই বলছি। দেয়ালের মাথায় উঠে আমার মনে হল, কেননা কারণে জেলখানার কর্তৃপক্ষ আমাকে পালানোর সুয়োগ ইচ্ছে করেই দিচ্ছে। নইলে ততক্ষণে পাগলা ঘন্টি বেজে ওঠার কথা। বাজল না দেখে আমি দেয়ালের ওপর থেকে ঠাকুরের নাম করে বাইরের দিকে ঝাঁপ মারলাম। ট্রাপিজের খেলা দেখাতে গিয়ে অনেক উঁচু থেকে লাফ মারার অভ্যাস থাকায় হাড়গোড় ভাঙেনি। পড়েই কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে সামলে নিলাম। তারপর দৌড়।”

“তাহলে ফাঁসিটা হল কার?”

“তা আর খোঁজ নিইনি। পালিয়ে সোজা গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ব্যাগে জামাকাপড় আর কিছু টাকা নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম তক্ষুনি। বাড়ির লোককে বলে এলাম, যেন কাউকে কিছু না বলে। নিজের বাড়ি ছাড়া দুনিয়ায় আমার আর একটা মাত্র আশ্রয় আছে, তা হল এই সার্কাস। সার্কাসের জন্য জেলখানাতেও প্রাণটা কাদত। তাই ঘুরতে-ঘুরতে এসে হাজির হয়ে পড়েছি।”

“বেশ করেছিস। ভাল করেছিস। তবে কিনা…” সামন্তকে একটু চিন্তিত দেখায়।

“আমি এসে কি আপনাকে বিপদে ফেলাম সামন্তমশাই?”

সামন্ত গম্ভীর হয়ে বলে, “তুই আমার ছেলের মতো। ছেলে যদি বিপদে পড়ে আসে, তাহলে কি নিজের বিপদের চিন্তা থাকে রে গাধা! আমি ভাবছি তুই আজ খেলা দেখিয়ে ভুল করলি কি না। কুন্দ দারোগা আজ খেলা দেখতে এসেছিল। লোকটা খুবই বুদ্ধিমান। যে যদি গন্ধ পায় তবে তোর পক্ষে এ-জায়গা আর নিরাপদ নয়।”

“খেলা না দেখিয়ে যে হাঁফিয়ে পড়েছিলাম সামন্তমশাই। জেলখানায় তো ধরেই নিয়েছিলাম এই জীবনে আর সার্কাসের খেলা দেখানো হবে না। ঠাকুরের কাছে রোজ বলতাম, পরের জন্মে যেন আবার সার্কাসের খোলোয়াড় হতে পারি।”

সামন্ত মাথা নেড়ে, “এই সার্কাসকে তুই যে বুক দিয়ে ভালবাসিস তা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে? আমারও ইচ্ছে ছিল, মরার সময় এই সার্কাসের সব ভার তোকেই দিয়ে যাব। কিন্তু কাশিমের চরের সেই খুনটাই সব গোলমাল করে দিল।”

এবার গোবিন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, “হরিহর পাড়ুই লোক খুব ভাল ছিল। কিন্তু তাকে যে আমি খুন করিনি, তা কি আপনি বিশ্বাস করেন?”

“করি। আমি জানি, তুই রাগী বটে, কিন্তু কখনো পিঁপড়েটাকেও মারতে চাস না। খুন তোরা দ্বারা হওয়ার নয়!”

* * * * * *

রাত নিশুত হলেও যে সবাই লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়ে তা নয়।

উদ্ধববাবুর চণ্ডীমণ্ডপের পাশে একটা ছোট্ট খুপরিতে খাঁটিয়ায় বিছানো খড়ের বিছানায় কুটকুটে এক কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামসে ঘুমোচ্ছিল গবা পাগলা। কিন্তু ঘুম তার খুব সজাগ। হঠাৎ চটকা ভেঙে সে উঠে বসল।

দুর্দান্ত হাড় কাঁপানো শীত পড়েছে আজকে। বাইরেটা কুয়াশা আর অন্ধকারে মাখা। খুপরিটার দরজা একটা কাঠের খিল দিয়ে আটকানো ছিল। সেটা খুলে

দরজা অনেকখানি ফাঁক হয়ে আছে, এটা অন্ধকারেও দেখতে পেল গবা। দেখে মৃদু একটু হাসল। তারপর বেশ হেঁকে বলে উঠল, “কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি খেকশিয়ালি পালায় ছুটি। পালা পালা পালা রে বাপ, নইলে হয়ে যাবি যে সাফ। পাগলা গবা ধরবে এসে টুটি!”

হয়তো আরো বলত গবা, কিন্তু তার আগেই দরজা নিঃশব্দে আর-একটু ফাঁক হল। একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল চৌকাঠে।

“গবা,” একটা ভারী গলার গম্ভীর আওয়াজ হল।

“ও।” গবা জবাব দেয়।

“তুই আসলে কে আমি জানি।”

গবা চোখ পিটপিট করতে থাকে।

লোকটা আবার বলে, “যদি বেঁচে থাকতে চাও তবে আমি যা বলছি ঠিক তাই করবে। পাগলামির ভান কোরো না। আমি জানি, তুমি কস্মিনকালেও পাগল নও।”

গবা নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি কে?”

.

০৭.

উদ্ধববাবু ওঠেন একেবারে কাক-ভোরে। তখনও আকাশে চাঁদ তারা থাকে। উঠে মুখ-হাত ধুয়ে ঠাকুর-পূজো সেরে বেড়াতে বেরোন। আর বেরিয়েই বেশ গলা ছেড়ে গান ধরেন।

আসল কথা হল, ছেলেবেলা থেকেই উদ্ধববাবুর খুব গাইয়ে হওয়ার শখ। শখটা খুব তীব্র, কিন্তু তাঁর গলায় সুর নেই। সুরটা এমন জিনিস যে, জন্ম থেকে যার আছে তার আছে, যার নেই, সে গলা সেধে মুখে রক্ত তুলে ফেললেও হবে না।

উদ্ধববাবুর গলা নেই। তবু সেই ছেলেবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে গলা সেধেছেন, গানের মাস্টারমশাই রেখেছেন, বড় বড় ওস্তাদের জলসায় গেছেন। তার ধারণা ছিল সাধনায় সব হয়। কিন্তু গানের সাধনা করতে গিয়ে লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি হচ্ছে দেখে বাবা খুব রাগারাগি করতেন। তারপর গান গাইতে বসলে পাড়া প্রতিবেশীরা কাসর-ঘন্টা বাজাত, শখে ফুঁ দিত। একবার নতুন এক বউদি তাকে বলেছিলেন, “উদ্ধব ঠাকুরপো, চার আনা পয়সা দেব, আজ আর গান গেও না।”

এইসব দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর উদ্ধববাবু আর প্রকাশ্যে গান গায় না। তবে তাঁর এখনো ধারণা, চেষ্টা করলে এবং লোকে বাগড়া না দিলে তার গলা একদিন খুলে যেত ঠিকই।

যেত কেন, গেছেই। প্রকাশ্যে গান না গাইলেও রোজ সকালে বেড়াতে বেরিয়ে শহরের নির্জন প্রান্তে এসে উদ্ধববাবু নিয়মিত গলা সাধেন। দীর্ঘদিনের এই গোপন সাধনার ফলে তিনি ইদানীং লক্ষ করছেন, তার গলায় সাতটা

সুর চমৎকার করছে। হাঁ করলেই যেন গলা থেকে লোকজন ডেকে সাতটা পাখি বেরিয়ে চারদিকে উড়ে বেড়ায়।

উদ্ধববাবুর খুব ইচ্ছে, এবার একদিন লোকজন ডেকে সকলের সামনে গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দেন। কিন্তু মুশকিল হল, ওস্তাদ রাঘব ঘোষকে নিয়ে। উদ্ধববাবু রাঘবকে দুচোখে দেখতে পারেন না। সারা তল্লাটের লোক রাঘবকে বড় ওস্তাদ বলে কেন যে অত খাতির করে, তাও তার বোধের অগম্য।

সে যাই হোক, একদিন তিনি পুবের মাঠে এক শিশির ভোরে খুব আবেগ দিয়ে ভৈরবী ধরেছিলেন। চোখ বুজে গাইছেন। হঠাৎ একটা ফেঁপানির শব্দে গান থামিয়ে চোখ মেলে দেখেন, সামনেই রাঘব। ধুতির খুঁটে চোখ মুছে রাঘব বললেন, “এমন অনৈসর্গিক গান কখনো শুনিনি উকিলবাবু। তবে বলি এ গান সকলকে শোনানোর নয়। বিশেষ করে আপনার মক্কেলরা যদি শোনে, তবে তাদের ধারণা হবে, ইনি যখন এত ভাল গায়ক, তখন নিশ্চয়ই ভাল উকিল নন। কারণ প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে একজন মানুষ সাধারণত একটা বিষয়েই পারফেকশন লাভ করতে পারে।”

সেই থেকে উদ্ধববাবুর রাগ। ইচ্ছে করেই তিনি রোজ সকালে একবার রাঘব ঘোষের বাড়ির কাছাকাছি এসে খানিকক্ষণ গান করেন। অভদ্র লোকটা বুঝুক গান কাকে বলে। আজও উদ্ধববাবু পুবের মাঠে এসে রাঘবের বাড়ির দিকে মুখ করে চমৎকার তান লাগালেন ভৈরবীতে। গাইতে গাইতে তার নিজের পিঠ নিজেরই চাপড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল, শাশ।

আশ্চর্য, এই চোখ বুজে গাইতে গাইতেই হঠাৎ টের পেলেন, কে যেন সত্যিই তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে উঠল, শাববাশ।

উদ্ধববাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেন গবা পাগলা!

গবাও বেকুবের মতো চেয়ে-চেয়ে খানিকক্ষণ তাকে দেখে বলে উঠল, উদ্ধবকর্তার যে আবার গান-বাজনাও আসে, তা তো জানতাম না।”

উদ্ধববাবু একটু রাগের গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কী করছিস?”

গবা মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে কিছু করছিলাম না। কাল রাতে একটি লোক আমাকে এখানে খুন করে রেখে গেল। সেই থেকে মরে পড়ে ছিলাম। হঠাৎ এই সকালবেলায় আপনার গানে প্রাণ ফিরে এল। ওঃ, কী গান। মড়া পর্যন্ত উঠে বসে।”

“কী যা-তা বলছিস। কে তোকে মেরে রেখে গেল?”

“আজ্ঞে, তাকে তো চিনি না। কালো পোশাক পরা, মুখ ঢাকা। রাতে গিয়ে আমার ঘরে হাজির। বলল, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, অনেক টাকা দেব। রাজি না হলে প্রাণ যাবে।”

“বলিস কী?”

“আজ্ঞে, যা ঘটেছিল, বলছি, লোকটা বেশি ধানাই-পানাই না করে বলল, উদ্ধববাবু যে কাকাতুয়াটা কিনেছেন সেটা আসলে আমর, কিন্তু প্রমাণ করার উপায় নেই। আমি পাখিটাকে কিনতে চাই, কিন্তু উদ্ধববাবু বেচতে তেমন গা করছেন না। আইন দেখাচ্ছেন। আমার বড় আদরের কাকাতুয়া। তা তুমি যদি পাখিটা উদ্ধার করে দিতে পারো, তবে দুশো টাকা পাবে। নইলে…”

নইলে মেরে ফেলবে?”

“ওই নইলে কথাটায় আমার খটকা লাগল। পাখিটা ফেরত চায় কেন? অত গরজ কিসের? তা আমি সেই কথাটা জিজ্ঞেস করতেই লোকটা অ্যাই বড় একটা ভোজালি বের করে আর এক হাতে আমার টুটি ধরে টানতে টানতে মাঠের মধ্যে নিয়ে এল।”

“অ্যাটেমপট অব মার্ডার।” উদ্ধববাবুর ওকালতি-মাথা কাজ করছে। বিড় বিড় করে বললেন, “আ্যাটেমপট অব থেপট, থ্রেটেনিং অ্যাণ্ড অ্যাসাল্ট। তা লোকটা হঠাৎ ভোজালি বের করলই বা কেন? তুই কে কী বলেছিলি?”

“আজ্ঞে আমি তাকে বলেছিলাম, যুধিষ্ঠিরবাবু, আপনার পাখিটার জন্য এত গরজ কিসের?”

“যুধিষ্ঠিরবাবু! সে আবার কে?”

“আপনি চেনেন তাঁকে! বাচ্চাদের বাড়িতে পড়ান যে নতুন মাস্টারমশাই, তিনি।”

“বলিস কী! লোকটা কি সত্যিই যুধিষ্ঠির?”

“আজ্ঞে না। সত্যিকারের যুধিষ্ঠির ছিলেন ধর্মপুত্ত্বর। ইনি তিনি নন।”

“আরে দূর গাধা! আমি বলছি আমাদের যুধিষ্ঠির কিনা।”

“তাই বা বলি কী করে? তবে যুধিষ্ঠিরবাবু খুব পান আর জর্দা খান। আমিও রাত্রিবেলায় যমদূতটার মুখ থেকে সেই জর্দার গন্ধ পেয়েছেলাম। তাই”

“তারপর?”

“তারপর মাঠের মধ্যে এলে লোকটা ছোরা রেখে দু’হাতে আমার গলা টিপে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলল।”

“ফেলল? তবে বেঁচে রইলি কী করে?”

“কে বলল বেঁচে ছিলাম? সেই কখন থেকে মরে পড়ে আছি। সকালবেলা আপনার গান শুনে মরা দেহও জেগে উঠল। তাই ভাবলাম এমন যার গান, তাকে একটা শাবাশ জানিয়ে আসি। তা এসে দেখি আপনি স্বয়ং।”

উদ্ধববাবু গানের কথায় একটু গম্ভীর হলেন। বললেন, “গানের কথাটা অত বলার দরকার নেই।”

গবা অবাক হয়ে বলে, “বলেন কী? এমন উপকারী গান আমি জন্মে শুনিনি! আপনার গান শুনতে তেমন ভাল নয় বটে। মাথা ঘোরে, গা বমি বমি করে, ভিতরটা কেমন চমকে-চমকে ওঠে। কিন্তু মরা শরীরে প্রাণ ফিরে

আসে। পারবে রাঘব ঘোষ এমন গান গাইতে? রাঘবের তা-না-না কেবল লোক ভোলানোর জন্য। এখনো সা লাগাতে পারল না ঠিকমতো।”

একথায় উদ্ধব খুশি হলেন। বললেন “হুঁ।”

গবা বলল, “এ গান অবহেলার বস্তু নয় কবরখানার কাছে বসে গাইলে কবর খুঁড়ে অনেক মড়া জ্যান্ত হয়ে উঠে আসবে। শ্মশানের কাছে বসে গাইলে অনেক মড়া চিতা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়াদৌড়ি শুরু করবে।”

“আঃ! বাজে বকিস না তো! আমি ভাবছি কাকাতুয়াটার কথা। ওটাকে নিয়ে চারদিকে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। খোঁজ নিয়ে বের কর যে কাকাতুয়াটা আসলে কার! পাখীটা মাঝে মাঝে টাকার কথা বলে। মনে হয় কোনো গুপ্ত টাকার খোঁজ জানে, কিন্তু স্পষ্ট করে বলে না।”

“আমারও তাই মনে হয়। দেখব’খন খোঁজ নিয়ে।”

শেষরাতে যখন গোটা সার্কাসের চত্বরটা ঘুমে অচেতন, তখন হঠাৎ নিঃশব্দে একটা ছায়ামূর্তি বাঘের খাঁচার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার চেহারা বিশাল দশাসই। কিন্তু হাঁটাচলা বেড়ালের মতো ক্ষিপ্র এবং নিঃশব্দ।

ছায়ামূর্তি সবচেয়ে কাছের ছোট্ট একটা তাবুর দরজার পর্দা তুলে ঢুকে যায়। তার হাতে খোলা রিভলভার এবং টর্চ। টর্চটা জ্বেলে সে ঘুমন্ত লোক দুটোকে দেখে। এরা নয়।

আবার ক্ষিপ্র ও নিঃশব্দ গতিতে বেরিয়ে আসে ছায়ামূর্তি, আর একটা তাবুতে ঢোকে। এখানে চারজন লোক ঘুমিয়ে আছে। টর্চ জ্বেলে ছায়ামূর্তি তাদের ভাল করে দেখে নেয়। না, এরাও নয়।

ছায়ামূর্তি একের পর এক তাঁবুতে হানা দেয়। কিন্তু যে লোকটাকে দেখবে বলে আশা করছে তাকে কোথাও দেখতে পায় না।

শেষ তাবুটা একটু দূরে। খুব ছোট্ট। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। এমন কী ফটকটায় তালা লাগানো।

ছায়ামূর্তি একটু দাঁড়ায়। তারপর চারদিকে চেয়ে দেখে নিয়ে টপ করে। কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে যায়।

রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে লোকটা খুব সতর্কতার সঙ্গে চারদিক দেখে নেয়। তারপর খুব সাবধানে পর্দাটা ফাঁক করে টর্চ জ্বালে। অস্ফুটস্বরে বলে, “আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য!”

আশ্চর্য হওয়ারই কথা। তবুটার মধ্যে কিছুই নেই। এমনকী, অন্যান্য তাঁবুর মতো একটা খাঁটিয়াও না, মানুষ তো দূরের কথা।

ছায়ামূর্তি টর্চটা জ্বেলে চারদিকে ঘুরে ঘুরে খুব ভাল করে দেখে না, এই তাবুটা এখানে কেউ ব্যবহার করেনি। কিন্তু এই ফাঁকা তাবুটার জন্য এত সতর্কতা কেন তা ছায়ামূর্তি চমকে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়াল। বাইরে একটা ঢিল পড়ার শব্দ হল না? বেশ বড় একটা ঢিল।

ছায়ামূর্তি খুব সতর্কতার সঙ্গে দরজার কাছে আসে এবং বাইরে উঁকি মারে। চারদিকে আজ বেশ কুয়াশা আছে। ভীষণ ঠাণ্ডা। শেষরাতের একটু জ্যোৎস্নায় চারদিক খুব আবছা দেখা যায়।

ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসার জন্য বাইরে পা দিতেই ঘটনাটা ঘটল।

পিছন থেকে হঠাৎ কে যেন বজ্রকঠোর হাতে পেঁচিয়ে ধরল তার গলা। তারপর হাঁটু দিয়ে কোমর ঠেসে ধরল। ছায়ামূর্তি নিজে প্রচণ্ড শক্তিশালী লোক। গায়ের জোরে তার জুড়ি নেই। সুতরাং সে এক ঝটকায় হাতের বাঁধনটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। যে তাকে ধরেছে সে শুধু তার চেয়ে বেশী শক্তিশালীই নয় অনেক বেশী ক্ষিপ্রও। এক হাতে ছায়ামূর্তির গলাটা ধরে রেখেই অন্য হাতে রিভলভার-ধরা হাতর ওপর একটা কারাটে চড় বসাল।

রিভলভারটা ছিটকে গেল হাত থেকে। ছায়ামূর্তি যন্ত্রণায় ও বলে আবার লোকটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল।

কিন্তু জোঁকের চেয়েও ছিনে লোকটার হাত আরো বজ্ৰবাঁধনে চেপে ধরল তাকে। ছায়ামূর্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

.

০৮.

সামন্ত মশাইয়ের তাঁবুতে কুন্দকুসুম চোখ মেলে চাইলেন। তার জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞানবয়সে এর আগে আর কখনো কোনো অবস্থাতেই তিনি জ্ঞান হারাননি। অজ্ঞান হওয়ার অভিজ্ঞতা তার জীবনে এই প্রথম। কারো সঙ্গে গায়ের জোরে হেরে ‘ওয়াও এই প্রথম।

প্রবল শীতের মধ্যে একটা লোক তার মুখে অনবরত জলের ঝাঁপটা দিচ্ছিল। কুন্দকুসুম জলদগম্ভীর স্বরে তাকে বললেন “আর না।”

তারপর উঠে বসলেন। লোকটা বিনীতভাবে একটা গামছা এগিয়ে দিল। তিনি মুখ মুছতে-মুছতে দেখলেন, সামনেই একটা ফোল্ডিং চেয়ারে সামমেশাই উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। চোখে চোখ পড়তেই বলে, “এখন একটু ভাল বোধ করছেন তো?”

কুন্দকুসুম নিজের গলায় হাত বোলালেন। ব্যথা। কোমরেও যেন কুমির কামড়ে ধরে আছে। কব্জিটাও বেশ কাবু। ঝিনঝিন করছে। কিন্তু সেই বলবান লোকটার রাক্ষুসে আলিঙ্গনে তার এতক্ষণে মরে লাশ হয়ে যাওয়ারই কথা। বেঁচে যে আছেন সেই ঢের। জলদগম্ভীর গলাতে বললেন, “বেশ ভাল বোধ করছি। এ-যাত্রায় মরছি না। মরলে আপনার পো হারকিউলিসটির ফাঁসি হত।”

সামন্তমশাই শশব্যতে বলে, “আগে একটু গরম দুধ খান। গায়ে বল হোক, তারপর সব কথা।”

তার ইশারায় মূহুর্তের মধ্যে একটা আধসেরি গ্লাস ভর্তি ঈষদুষ্ণ দুধ এসে গেল।

কুন্দকুসুম দুধটায় চুমুক দিয়ে বলেন, “বাঃ বেশ দুধ। তা এ নিশ্চয়ই গরুমোষের দুধ নয়।”

“কেন বলুন তো!”

“আপনার হারকিউলিসটির গায়ে যা জোর, তাতে মনে হয় সে হাতির। দুধ খায়। কিংবা বাঘের। আপনার সার্কাসে বাঘ আর হাতির তো অভাব নেই।”

সামন্ত বিনীতভাবে হাসে। তবে তার চাউনিতে উদ্বেগটা স্পষ্টই বোঝা যায়।

কুকুসুমের এই দুধটুকুর দরকার ছিল। চোঁ করে গ্লাস নামিয়ে রেখে বললেন, “বিনা নোটিসে কাল রাতে আপনাদের তাবুতে হানা দেওয়া আমার উচিত হয়নি এটা মানছি। আমার সার্চ ওয়ারেন্টও ছিল না।”

সামন্তমশাই গলা খাঁকারি দিয়ে বলে “আজ্ঞে একাট নোটিস দিয়ে এলে এই বিপদে পড়তেন না। অন্ধকারে আপনাকে চিনতে না পেরে চোর-ছ্যাচড় ভেবে আমাদের ওয়েটলিটার ছেলেটা ওই কাণ্ড করে ফেলেছে।“

কুন্দকুসুম একটা শ্বাস ফেলে বললেন ওর দোষ নেই। আমার আচরণটা চোরের মতোই হয়েছিল। আপনার পাহারাদাররা আমাকে ধরতে পারেনি, কিন্তু এই ছোঁকরা–কী নাম ছোঁকরার?”

“আজ্ঞে ভবতোষ। খুব ভাল ছেলে। ধার্মিক। মাঝরাতে উঠে নামধ্যান করে। কাল রাতেও তাই করছিল।”

“হ্যাঁ ভবতোষ। তা এই ভবতোষ তো দিব্যি কারাটেও জানে। যা একখানা ঝেড়েছিল আমার কব্জিতে। ভাল কথা, পিস্তলটা আছে তো?”

সামন্ত মাথা নেড়ে বলে, “আছে। চিন্তা করবেন না।”

কুন্দকুসুম বলেন, “আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমার এই আচরণের অর্থ কী! বলতে বাধা নেই, সেদিন সেই সাপের খেলা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। কোনো মানুষের অত অ্যাজিলিটি থাকতে পারে তা জানতাম না। কিন্তু মনে হয়েছিল মাস্টার লখীন্দরের আসল নাম মাস্টার লখীন্দর নয়। মুখোশের আড়ালে লোকটি কে সেটা জানাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।”

সামন্তের চোখে উদ্বেগটা বাড়ল। বলল, “আজ্ঞে সে আর বেশি কথা কী? হকুম করলেই তাকে সামনে হাজির করতাম। খামোখা এত কষ্ট করতে গেলেন।

কুকুসুমের আচরণটা যে অদ্ভুত ঠেকছে লোকের চোখে, তা তিনি জানেন। কিন্তু তার জন্য লজ্জা পেলেন না। লজ্জা পাবার অভ্যাস তার নেই।

তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, “পুলিশের কাজ একটু অন্যরকম হয়। সবসময় সোজা পথে-চললে আমাদের চলে না। ঠিক আছে, লখীন্দরকে একবার ডাকুন।”

আবার সামন্তর ইঙ্গিতে একজন বেরিয়ে যায়। মিনিটখানেকের মধ্যেই বেশ ছমছমে চেহারার এক ছোঁকরা তাবুতে ঢুকে কুন্দকুসুমকে নমস্কার করে দাঁড়ায়।

কুন্দকুসুম চোখ দিয়ে লোকটাকে মেপে নিচ্ছিলেন। আরেকদিকে লোকটা অবিকল লখীন্দরের মাপসই বটে সন্দেহ নেই। কিন্তু কুকুসুমের চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা আসল লখীন্দরের একটু বেশি মাত্রায় ছোট ছিল। তিনি একটু বিস্ময়ের গলায় বললেন, “এই কি সেই?”

“আজ্ঞে। দলছুট হয়ে গিয়েছিল। ওর ঠাকুরমার খুব অসুখ। তাঁকে দেখতে দেশের বাড়িতে যাওয়ায় এখানে প্রথমে খেলা দেখাতে পারেনি। অদ্য ফিরেছে।”

“হুঁ।” বলে কুন্দকুসুম ছেলেটার দিকে চেয়ে বলেন, “তোমার নাম কি?”

“লখীন্দর। লখীন্দর কর্মকার।“

“আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পারো।”

কুন্দকুসুম যে সন্তুষ্ট হননি, তা টের পেল সামন্ত। মুখে উদ্বেগটা বাড়ল। বলল, “লুচি ভাজা হচ্ছে। একটু বসে যান দারোগাবাবু।”

“নাঃ, কাজ আছে।” বলে কুন্দকুসুম উঠলেন।

বাড়িতে ফিরে সেদিন কুলকুসুম তার দুই ছেলে আন্দামান আর নিকোবরকে খুব পেটালেন, পড়ার টেবিলে বসে কাটাকুটি খেলছিল বলে। আসলে সেটা কারণ নয়। খুব রেগে গেলে কুকুসুমের রাগ পড়ে একবার কাউকে ধরে বেধড়ক পেটালে।

বাসায় এসে তিনি আড়কাঠিকে ডেকে পাঠালেন। সুড়ুঙ্গে চেহারার ধুর্ত লোকটা এসে দাঁড়ালে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর খবর ঠিক তো?”

“আজ্ঞে একদম পাকা।”

“সামন্ত কিন্তু অন্য এক ছোঁকরাকে দেখাল।” সামন্ত খুনিটাকে আড়াল করছে।”

“আচ্ছা যা। চোখ কান খোলা রাখিস।”

যুধিষ্ঠির রায় সকালবেলায় যথারীতি পড়াতে এসেছেন। নিপাট ভালমানুষ। সাদা ধুতি আর সাদা শার্ট পরেন। অল্পবয়সী। চোখেমুখে লেখাপড়া এবং বুদ্ধির ছাপ আছে। তবে দোষের মধ্যে জর্দা দেওয়া পান খান।

উদ্ধববাবু তক্কেতক্কে ছিলেন। কাছারি-ঘরে মক্কেলদের ভিড় ছিল খুবই। তবু এক ফাঁকে এসে ছেলেদের পড়ার ঘরে হানা দিলেন। উদ্ধববাবু কোনরকম নেশা পছন্দ করেন না। তিনি নিজে সুপুরিটা পর্যন্ত খান না। বাচ্চাদের পড়ার ঘর জর্দার গন্ধে ম-ম করছে। তিনি একটু নাক কোচকালেন। গন্ধটা খারাপ নয়। বরং বেশ ভাল দামি আতরের গন্ধই। কিন্তু বাচ্চাদের শিক্ষকরা যদি নেশা-টেশা করেন, তাহলে শিশু-মস্তিষ্কে তার প্রভাব পড়তে পারে।

উদ্ধববাবু গলা খাকারি দিলেন। যুদ্ধিষ্ঠির খুব নিবিষ্ট মনে রামুকে অঙ্ক করাচ্ছিলেন। শব্দ শুনে শশব্যক্তে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “কিছু বলবেন?”

উদ্ধববাবু ছেলেবেলা থেকেই শিক্ষকদের সম্মান করতে শিখেছেন। তার মতে দেশের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ হলেন শিক্ষকেরা। রাষ্ট্রের উচিত প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির চেয়ে শিক্ষকদের বেশি সম্মান দেওয়া। নইলে শিক্ষকের ওপর ছাত্রদের শ্রদ্ধা আসে না। আর শ্রদ্ধা ছাড়া জ্ঞান আসবে কী করে?

উদ্ধববাবু খুব বিনীতভাবে হাতজোড় করে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আজ্ঞে কথা সামান্যই। আপনার ব্যক্ত হওয়ার কিছু নেই। বসুন।”

যুধিষ্ঠির বসলেন। কিন্তু উদ্ধববাবু কথাটা কীভাবে শুরু করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি উকিল মানুষ। পাজি-বদমাশ খুনে দেখে-দেখে চোখ পেকে গেছে। সেই অভিজ্ঞ চোখে যুধিষ্ঠিরের মধ্যে কোনো খুনির লক্ষণ দেখলেন না।

উদ্ধববাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “ইয়ে, আপনার পান খাওয়ার অভ্যাস আছে দেখছি।”

“আজ্ঞে। পান খেলে আমার কনসেনট্রেশনটা ভাল হয়।”

“তা ভালই। ইয়ে, বলছিলাম কী, আপনি কি রাত্রিবেলায় পান-জর্দা খান?”

যুধিষ্ঠির একটু অবাক হয়ে বলেন, “আজ্ঞে না! সারাদিনে এই সকালবেলাই একটা। ব্যস।”

উদ্ধব মাথা চুলকে বললেন, “গবাটা যে কী সব আবোল-তাবোল বকে তার ঠিক নেই।”

“গবা কে?”

“ওই একটা পাগল আছে। এ-বাড়িতেই থাকে।”

যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে বলেন, “গবা পাগলা?”ওঃ হোঃ, তার কথা সব শুনেছি। লোকে বলে লোকটা নাকি ছদ্মবেশী বৈজ্ঞানিক। তার সঙ্গে একবার দেখা করার খুব ইচ্ছে আছে।”

উদ্ধববাবু দুম করে জিজ্ঞেস করলেন “আমাদের বাড়িতে একটা কাকাতুয়া আছে তা কি আপনি জানেন?”

যুধিষ্ঠির আরো একটু অবাক হয়ে বললেন, “জানি বই কী। রামুর মুখে শুনছিলাম আপনাদের কাকাতুয়াটা নাকি গুপ্তধনের কথা বলে।”

উদ্ধববাবু একটু রাগত চোখে রামুর দিকে তাকিয়ে নিলেন। তারপর যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন, “কাল রাতে আপনার ভাল ঘুম হয়েছিল তো?”

উদ্ধববাবুর ছেলেমেয়েরাও পড়া ভুলে বাবার দিকে চেয়েছিল। এবার তারা নিজেদের মধ্যে তাকাতাকি করতে লাগল। যুধিষ্ঠিরও খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। পান, কাকাতুয়া, ঘুম এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে তারা সবাই অবাক।

উদ্ধববাবু বুঝতে পারছেন, আদালতে দাঁড়িয়ে যত ভাল সওয়ালই করুন কেন আজ ছেলেমেয়েদের সামনে তাদের মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে সওয়াল জবাব করতে গিয়ে তিনি নিতান্ত আহাম্মক বা পাগল বলে প্রমাণ হচ্ছেন।

যুধিষ্ঠির অবাক হলেও কথায় তা প্রকাশ করলেন না। বিনীত ভাবেই বললেন, “আজ্ঞে আমার বরাবরই ভাল ঘুম হয়। কাল রাতেও মড়ার মতো ঘুমিয়েছি।”

“বেশ বেশ।” বলে উদ্ধববাবু তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন। গবাটাকে হাতের কাছে পেলে মাথায় কষে একটা গাট্টা লাগাতেন।

কিন্তু গবা হাতের কাছে ছিল না।

.

০৯.

সকালবেলায় সার্কাসের খেলোয়াড়রা ট্রেনারের নির্দেশে কসরত করছিল। আসল যে-সব খেলা তারা দেখায়, তার চেয়েও এই কসরত বেশি কঠিন।

কক্সরতের সময় ট্রাপিজের জন্য নীচে জাল টাঙানো হয়েছে। জালের ওপর অনেক উঁচুতে, শূন্যে ট্রাপিজ-শিল্পীরা দোল খাচ্ছে। জালের নীচে চলছে সাইকেল, বীম ব্যালানস ইত্যাদি। এক ধারে শক্ত করে দুটো খুটিতে বাঁধা তারের ওপর চলছে শীর্ষাসন, এক-চাকার সাইকেলে একজনকে কাঁধে নিয়ে আর-একজন এপার-ওপার হচ্ছে আগু-পিছু করে। জোকাররা নানারকম ডিগবাজীর ভেলকি লাগাচ্ছে এরেনার অন্য ধারে। দামি সীটের একটা চেয়ারে বিমর্ষ মুখে বসে দেখছে সামন্ত। পুলিশ পিছনে লেগেছে, এখানকার ডেরাডাণ্ডা শিগগিরই তুলতে হবে। কিন্তু তুললেই যে রেহাই মিলবে এমন নয়। কাশিমের চরে হরিহর পাড়ুই খুন হওয়ার পর কিছুদিন পুলিসের জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। গোবিন্দকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ঝামেলা মিটেছিল বটে, কিন্তু গোবিন্দের শোকে সামন্তর আহার-নিদ্রা ঘুচে গিয়েছিল। গোবিন্দ ফিরেছে, সেই সঙ্গে ঝামেলাও। মেরে ফেললেও অবশ্য সার্কাসের কেউই পুলিসের কাছে স্বীকার করবে না যে, গোবিন্দ এখানে লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাতে আর কতটুকু কী লাভ হবে? ভেবে-ভেবে সামন্তর মাথা গরম, মন উচাটন।

একটা উটকো লোক হঠাৎ তাঁবুতে ঢুকে পড়ায় একটা শোরগোল পড়ে গেল। সামন্ত চোখ তুলে দেখে, একটা পাগল। গায়ে আল-পাকার কোট, গালে দাড়ি, ময়লা পাতলুন। লম্বা-লম্বা চুলে জট পড়েছে। বেঁটে জোকার বক্রেশ্বর রে-রে করে তেড়ে গেল তার দিকে। লোকটা বক্রেশ্বরকে লক্ষই করল না। চারদিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “ছোঃ, এইসব খেলা দেখিয়ে তোক ঠকাও নাকি তোমরা?”

বক্রেশ্বর যখন খেলা দেখায় তখন তার হাতে একটা চুষিকাঠি থাকে। সেইটেই সে লাঠির মতো ব্যবহার করে। এখনো সেইটে বাগিয়ে ধরে বলল, “দেব নাকি কয়েক ঘা?”

লোকটা বক্রেশ্বরকে ভাল করে দেখার জন্য কোটের পকেট থেকে একটা দূরবীন বের করে চোখে লাগায়। ভাল করে দেখে নিয়ে বলে, “তোমার চেয়ে ঢের বেঁটে লোক দেখেছি। অত কায়দা দেখিও না।”

বক্রেশ্বর বুক ফুলিয়ে বলে, “আমি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেঁটে মানুষ। নইলে আমাকে ঠাহর করতে তোমার দুরবীন লাগল কেন হে?”

লোকটা হেসে বলে,”অ্যায়সা বেঁটে মানুষও আছে, যাকে দেখতে মাইক্রোস্কোপ লাগে। যাও, যাও মেলা বোকো না।”

বক্রেশ্বর চুষিকাঠিটা তুলে মারতে গেল। কিন্তু হঠাৎ কী ভেবে থমকে গিয়ে খানিকক্ষণ লোকটার দিকে চেয়ে থেকে বলে, “আরে! চেনা-চেনা লাগছে যে।”

“আমাকে সবাই চেনে। আমি হচ্ছি গবা পাগলা।”

সাজা-পাগল? না হওয়া পাগল?”

“আসলে পাগল হে, আসল পাগল?”

“বেশি বোকো না, তোমার চেয়ে ঢের বেশি পাগল লোক আমি দেখেছি।”

“দেখেছ? সত্যি?”

“সেই-সব পাগলকে দেখলেও বোঝা যায়, এই হচ্ছে খাঁটি পাগল। তাকে বলতে হয় না, আমি অমুক পাগলা।”

গবা মুখ বিকৃত করে বলল, “এমন পাগলামি দেখাতে পারি যা দেখলে তোমরা পিণ্ডি চটকে যাবে। কিন্তু এখন কাজে আসা, পাগলামির সময় নেই। সামন্তমশাইকে দুটো কাজের কথা জিজ্ঞেস করে যাব। তিনি কোথায়?”

বক্রেশ্বর চোখ পিটপিট করে লোকটাকে দেখে হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল, “বলি ও ভাই পাগলা গবা! আর কতকাল পাগলা রবা? গোল ছেড়ে কও আসলকথা। পা নেই তার পায়ে ব্যথা।”

লোকটা মুখ বেঁকিয়ে বলে, “ভূতের সর্দি সারে, রাবণ যদি রামকে মারে, ঈশ্বর যদি বক্র তবে, গবা পাগল কেন হবে?”

বক্রেশ্বর আর গবার এই তকরারে কেউ মনোযোগ দিচ্ছিল না। যে যার কাজে ব্যস্ত। বক্রেশ্বর চোখ পিটপিট করে আবার ফিক কর হেসে বলল, “চাঁদ বদনখানা দাড়িগোঁফে বড়ই ঢাকা, তবু চেনা-চেনা ঠেকছে হে। গলার স্বরটা লুকোতে পারোনি। তা চেনা যখন দিতে চাও না, আমারই বা কী এমন দায় ঠেকেছে চিনবার। ওই হোথা সামন্তমশাই বসে আছেন। চলে যাও সিধে।”

হাত তুলে বক্রেশ্বর সামন্তকে দেখিয়ে দেয়।

গবা গিয়ে সামন্তর পাশের চেয়ারে বেশ জুত করে বসে বলে, “এবার ঠাণ্ডাটাও পড়েছে মশাই।”

সামন্ত লোকটাকে বিরিক্তির চোখে দেখে বলে, “কী চাই?”

গবা একটু অপমান বোধ করে বলে, “ভাল লোকেদের একটা দোষ কী জানেন? তারা পাগল-ছাগলকে পাত্তা দিতে চায় না। তারা ভাবে, পাগলগুলো সত্যিই পাগল। তা পাগলগুলো কি আর পাগল নয়? তারা তো পাগলই। কিন্তু ভালো লোকগুলো এমন পাগল না মশাই, কি বলব আপনাকে….হিঃ হিঃ….পাগলগুলো যদি ভাল লোক হত তাহলে দেখতে পেত, আসলে ভাল লোকগুলোই এমন পাগল যে পাগলকেই কেবল পাগল ভাবে।”

সামন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, “বুঝলাম, কিন্তু কথাটা কী?”

“কথা কী একটা? কথা অনেক।”

“সংক্ষেপে বলে ফেল।”

“বলছিলাম কী, এসব কি খেলা নাকি? বিষ্ণুপুরের ওরিয়েন্ট সার্কাস কী দেখাচ্ছে জানেন?”

“কী দেখাচ্ছে?”

“ট্রাপিজ-ফাপিজ নেই স্রেফ শূন্যে কিছু লোক উড়ে বেড়াচ্ছে। আপনি তারের খেলা দেখাচ্ছেন, তারা দেখাচ্ছে বেতারের খেলা। এ-খুঁটো থেকে ও-খুঁটো কেবল একটা বাতাসের দড়ি টাঙানো, তারই ওপর দিয়ে তোক সাইকেল চালাচ্ছে, হেঁটমুণ্ড হয়ে কসরত করছে। তাছাড়া আপনি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, আপনাদের বামনবীর মাত্র আড়াই ফুট লম্বা, আর ওরা কী দিয়েছে জানেন? ওরা বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আমাদের বামনবীর মাত্র তিন ফুট বেঁটে।”

“তাই নাকি?”

“আলবত তাই। লম্বাই যদি হবে, তবে আর বেঁটে বললেন কী কবে? বলতে হলে এরকমই বলতে হয়, আমাদের বামনবীর তিন ফুট বেঁটে বা চার ফুট বেঁটে বা পাঁচ ফুট বেঁটে বা ছয় ফুট বেঁটে বা–”

“থাক থাক। আর বলতে হবে না।”

“বুঝেছেন তো?”

“বুঝেছি।”

“কী বুঝলেন?”

“বুঝলাম তুমি খাঁটি পাগল।”

গবা মাথা নেড়ে বলে, ভাল মানুষদের তো ঐ একটাই দোষ। তারা পাগলকে ভাবে পাগল। পাগলরা যে সত্যিই পাগল তা কি পাগলরা জানে না? আর তারা যে পাগল সেইটে বোঝানোর জন্য কোনো পাগল কি পাগল ছাড়া অন্য কোনো পাগলের কাছে যায়? বলুন!”

সামন্ত জ্বালাতন হয়ে বলে, “তাও বুঝলাম। কিন্তু বাপু হে, আজ আমার মনটা ভাল নেই।”

“মন ভাল করার ওষুধ আমি জানি।”

“বটে! কী ওষুধ?”

“একদম পাগল হয়ে যান। ভাল মানুষরা যদি পাগল না হয়, তাহলে পাগলরা যে পাগল তা বুঝবে কী করে? আর একবার যদি পাগল হয়ে পাগলামির মজা টের পায়, তবে কি আর মন খারাপ থাকে?”

“ওঃ!” বলে সামন্ত নিজের মাথা চেপে ধরল।

গবা বলল, “এই কথাটাই বলতে আসা মশাই। তবে যাওয়ার আগে, দুচারটে আজে-বাজে কথাও বলে যাই। কথাটা হল, গোবিন্দ মাস্টার খড়ের গাদায় পৌঁছেছে। রাত্রে স্পাই আসবে। রামু নামে একটা ছেলে আসতে পারে খেয়াল রাখবেন।”

বলে গবা উঠে পড়ল। সামন্ত মুখ তুলে হাঁ করে চেয়ে থাকে।

গবা এরেনাটা পার হওয়ার সময় তাচ্ছিল্যের মুখভঙ্গি করে খেলোয়াড়দের কসরত দেখে বক্রেশ্বরের দিকে চেয়ে বলে, “আড়াই ফুট লম্বা! হুঁ লম্বাই যদি হলে তবে বেঁটে বলে অত বড়াই কেন?”

বক্রেশ্বর চোখ পিটপিট করে বলে, “তুমিও যেমন পাগল আমিও তেমনি লম্বা।”

গবা আর কথা বাড়ায় না। বেরিয়ে সোজা হাঁটতে থাকে। রবিবার বলে আজ একটু বেলায় বাজার করে হরিহরবাবু আর গদাধরবাবু ফিরছিলেন। গবার সঙ্গে রাস্তায় দেখা।

গদাধরবাবু গদগদ হয়ে বললেন, “এই যে বৈজ্ঞানিক গবা তোমার সারানো ঘড়িটা অদ্ভুত চলছে হে। একেবারে ঘন্টায় মিনিটে সেকেণ্ডে।”

হরিহরবাবু সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “তবে উল্টোদিকে। গদাধরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “দেখুন হরিহরবাবু-”

হরিহরবাবুও সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “কী বলবেন তা জানি গদাধরবাবু। তবে বলে লাভ নেই, গবা বিজ্ঞানের ব-ও জানে না। ও গবা, বলো তো, কাইনেটিক এনারজি কাকে বলে!”

গবা একটা প্রকাণ্ড হাই তুলে বলে, আপনিই তো বলে দিলেন। “তার মানে?”

“কাইনেটিক এনারজিকেই কাইনেটিক এনার্জী বলে। খুব সোজা কথা।” হরিবাবু একগাল হেসে বলেন, “দেখলেন তো গদাধরবাবু, গবা কাইনেটিক এনারজি কাকে বলে জানে না।”

গদাধরবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কে বলল জানে না? এই এই তোত বলল শুনলেন না? কাইনেটিক এনারজিকেই কাইনেটিক এনারজি বলে?”

দুজনের মধ্যে আবার একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠল।

কিন্তু গবার সময় নেই। সে দ্রুত পায়ে চলেছে শহরের আর এক প্রান্তে। একটা খড়ের গাদায়।

.

১০.

পাখিদের মুশকিল হল তারা পুরনো কথা বেশিদিন মনে রাখতে পারে না। মস্তিষ্কের ততখানি ক্ষমতা তাদের নেই, স্মৃতিশক্তিও নেই। কিছুদিনের মধ্যেই তারা পুরনো বুলি ভুলে নতুন বুলি শিখতে শুরু করে। আজ সকালে রামুর ঘুম ভেঙেছে পাখিটার ডাকে। কাকভোরে পাখিটা হঠাৎ বিকট স্বরে ডাকতে শুরু করে, রামু ওঠো, রামু ওঠো, রামু ওঠো। মুখ ধুয়ে নাও। পড়তে বোসা।

রামু তো অবাক। সে ধরে নিয়েছিল, পাখিটা নতুন বুলি কিছুতেই শিখবে। তাই নিশ্চিন্ত ছিল। একটা পাখি তার ওপর খবর্দারি করবে এটা কি সহ্য হয়? কিন্তু আজ সকালে এই অদ্ভুত কণ্ড দেখে সে হতবাক। পাখিটা যে শুধু ডাকছে তা নয়, বেশ রাগের গলায় ধমকাচ্ছে। যেমনটা তার বাবা উদ্ধববাবু করে থাকেন, হুবহু সেই স্বর। ডাকছেও পাশে বাবার ঘর থেকেই। পাখির দড়টা আজকাল উদ্ধববাবুর ঘরেই ঝোলানো থাকে।

শীতের ভোরে এখনো চারিদিক বেশ অন্ধকার। তার ওপর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। এই শীতে লেপের ওম থেকে বেরোবার সময় মনে হয়ে কেউ বুঝি

গা থেকে চামড়াটা টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে।

রামু হয়তো পাখির ডাককে উপেক্ষা করে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতো। কিন্তু পাখিটার বিকট চেঁচামেচিতে উদ্ধববাবুরও ঘুম ভেঙেছে। তিনিও উঠে গম্ভীর গলায় হাঁক দিলেন, “এই রেমো! ওঠ!”

রামু মনে মনে রাগ চেপে রেখে ওঠে এবং শীতে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে খুঁটের ছাই দিয়ে দাঁত মেজে পাথুরে ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুয়ে নেয়। তারপর ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রণাম করার নিয়ম।

একটা খদ্দরের চাঁদর মুড়ি দিয়ে সে যখন পড়ার ঘরে এল তখন উদ্ধববাবু প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে গেছেন। রামু বাবার ঘরে ঢুকে কটমট করে পাখিটার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই ভেবেছিসটা কী শুনি?”

পাখিটা দাঁড়ের একদিকে সরে গিয়ে জড়সড়ো হয়ে বসে বলে “বিশু! আমাকে মোয়রা না বিশু! আমি বুড়ো মানুষ। মরার সময় সব মোহর তোমাকে দিয়ে যাব।”

রামু রাগে দাঁত কিড়মির করে বলে, “আমার মোহরের দরকার নেই।” তুই চেঁচানি বন্ধ করবি কি না বল।”

পাখিটা হঠাৎ ডানা ঝাঁপটে, পায়ের শিকলের শব্দ করে ঠিক উদ্ধববাবুর মতো একটু কাসে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে “পড়তে বসো। পড়তে বোসস। সময় নষ্ট কোরো না।”

পাখিটা পুরনো বুলি সব ভুলে যায়নি এখনো। নতুন বুলিও শিখেছে। তবে আর কয়েকদিনের মধ্যেই পাখিটা নতুন বুলিই বলতে থাকবে ক্রমাগত। রামুর তখন ভারী বিপদ হবে। সুতরাং পাখিটাকে না ভাগানো পর্যন্ত রামুর শান্তি নেই।

কাকাতুয়া যে সব নিরীহ প্রাণী নয় তা রামু বুঝল শিকলটা খুলতে গিয়ে যেই না দাড়ে হাত দিয়েছে, অমনি পাখিটা খচ করে ঠুকরে দিল হাতে। ডান হাতের বুড়ো-আঙুলের পিছন দিকটা কেটে গেল একটু।

কাটাকুটিকে অবশ্য রামু ভয় পায় না। প্রতিদিনই তার হাত কাটছে, মাথা ফাটছে, পা মচকাচ্ছে। ওসব গা-সওয়া। সে বাইরে গিয়ে একটু দুর্বোঘাস তুলে হাতে ডলে নিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়।

যারা লেখাপড়ায় ভাল হয় না তারা হয়তো বা খেলাধুলো, গান-বাজনা, ছবি-আঁকা বা অন্য কোনদিকে ভাল হয়। রামুর ভাইবোনরা লেখাপড়ায় সবাই। ভাল। বোনরা ভাল গায়, বড়দা দারুণ তবলা বাজায়, ছোড়দা দুর্দান্ত স্পোর্টসমান। রামু কোনোটাতেই ভাল নয়। ক্লাসে টেনেটুনে পাস করে যায়. বার্ষিক স্পোর্টসে বড়জোর হাইজাম্প বা দৌড়ে একটা বা দুটো থার্ড প্রাইজ পায়। গান জানে, ছবি আঁকতে পারে না। কিন্তু শরীরের সেই অদ্ভুত কাতুকুতুটার জ্বালায় সে সাংঘাতিক, সাংঘাতিক সব দুষ্টুমি করে বেড়ায়। দুষ্টু ছেলেরা সাধারণত মায়ের আদর একটু বেশিই পায়। কিন্তু রামুর কপালটা সেদিক দিয়েও খারাপ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তার আদরই বাড়িতে সবচেয়ে কম। আসল কথা হচ্ছে তার দিকে কারো তেমন নজর নেই। রামু বলে একটা ছেলে এ বাড়ীতে থাকে মাত্র। যেমন নয়নকাজল থাকে, যেমন মাঝে-মাঝে গবা পাগলা থাকে। রামুর সন্দেহ হয়, সে নিরুদ্দেশ হলে এ বাড়ির লোকে ঘটনাটা লক্ষ্য করবে কি না।

বাইরের সিঁড়িতে বসে রামু আজ সকালে এইসব ভাবছিল। তার জীবনে শান্তি নেই।

রোদ উঠল। দাদাদিদিরা পড়ার ঘরে পড়তে বসল। আর যুধিষ্ঠির মাস্টারমশাইও দেখা দিলেন।

যুধিষ্ঠিরবাবুকে রামুর বড় ভাল লাগে। ভারী অমায়িক মানুষ। কথায় কথায় মারধর নেই, ধমক-ধামক নেই। মিষ্টি হেসে নরম সুরে বোঝান, না পারলে রাগ করেন না। আজও রামুকে জিজ্ঞেস করলেন, “মুখোনা ভার দেখছি যে। বকুনি খেয়েছ নাকি?”

“আজ কিছু ভাল লাগছে না মাস্টারমশাই।”

“সকালবেলায় কিছু ভাল না লাগলে সারা দিনটাই খারাপ যায়। সকালটাই তো মানুষের সবচেয়ে সুন্দর সময়।”

যুধিষ্ঠিরবাবুর পরনে ধপধপে ধুতি। গরম কাপড়ের নস্যি রঙের পাঞ্জাবির ওপর শাল। তার চেহারাখানাও বেশ লম্বা চওড়া। বয়স বেশি নয়। চোখের দৃষ্টি সব পরিষ্কার আর তীক্ষ্ম। অগাধ জ্ঞান। রামু শুনেছে যুধিষ্ঠিরবাবু খুব বড়লোকের ছেলে। বাবার সঙ্গে রাগারাগি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। নইলে তার যা অবস্থা তাতে রোজগার না করলেও চলে।

রামু গম্ভীর হয়ে বলে, “আজ যদি না পড়ি তাহলে কি আপনি রাগ করবেন?”

“না না। বোজ কি পড়তে ভাল লাগে?”

“কিন্তু বাবা তো বকবে?”

“না, তাও বকবেন না। চলো, তোমার দাদা আর দিদিদের পড়া দিয়ে তোমার সঙ্গে বসে আমি কাটাকুটি খেলব।”

“সত্যি খেলবেন?”

“কেন খেলব না? চলল।”

বাস্তবিকই যুধিষ্ঠির মাস্টারমশাই আর সকলকে শক্ত-শক্ত টাস্ক করতে দিয়ে একটা রাফ খাতা খুলে রামুর সঙ্গে কাটাকুটি খেলতে লাগলেন। কিন্তু কাটাকুটিও উনি এত ভাল খেলেন যে, রামু বারবার হেরে যেতে লাগল।

যুধিষ্ঠিরবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, “তোমার হাত কাটল কী করে?”

“আমাদের পাখিটা কামড়ে দিয়েছে।”

“সেই কাকাতুয়াটা?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি কী করেছিলে?”

“ছেড়ে দিচ্ছিলাম।”

“পাখিটাকে?”

“হ্যাঁ। আমাকে বড় জ্বালাতন করে।” যুধিষ্ঠিরবাবু একটু চমকে উঠে বলেন, ছেড়ে দিয়েছ?”

“না, শিকলটা খুলতে পারিনি।”

এরপর আর কোন কথা হল না বটে কিন্তু যুধিষ্ঠিরবাবু বারবার কাটাকুটি খেলায় হেরে যেতে লাগলেন। মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কাটাকুটি খেলার ঘটনা এবং পাখিটাকে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টার কথা রামুর দাদা আর দিদিরা বাড়িতে বলে দিল। উদ্ধববাবু কাঁচারিতে যাওয়ার আগে রামুকে নিজের ঘরে ডাকিয়ে আনলেন।

গম্ভীর হয়ে বলছেন, “পাখিটা তোর সঙ্গে কোনো শত্রুতা করেছে?” রামু ভয়ে কাঠ। গলা দিয়ে স্বর বেরোল না।

উদ্ধববাবু তার বেতের ছড়িটা দিয়ে শপাৎ করে এক ঘা মেরে বললেন, “দুনিয়ার সবাইকে শত্রু মনে করতে কে তোমাকে শেখাল?

রামু যন্ত্রণায় ছটফট করে বাঁ হাতের কবজি চেপে ধরল। বেতটা লেগেছিল সেইখানেই।

“বলো!” আবার শপাং। এবার লাগল কোমরে। রামু বেঁকে গিয়ে বলল “পাখিটা আমাকে ধমকাচ্ছিল।”

“বটে! পাখির ধমকে তোমার এমন অপমান হয়েছে যে, শিকলি কেটে তাকে উড়িয়ে দিতে হবে?”

আবার শপাং। এবার পিঠের চামড়াই বুঝি কেটে গেল রামুর। সে একটা চিৎকার করতে গিয়েও দাঁত চেপে রইল। বাবার সামনে কান্না বারণ। তবে সে চাপা কান্নায় থরথর করে কাঁপছিল। রাগেও।

উদ্ধববাবু গম্ভীর হয়ে বলেন, “পাখিটা আমার প্রতিনিধি হয়ে তোমাকে শাসন করবে। কথাটা মনে রেখো। যদি কখনো ফের এরকম কিছু করো তবে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব। আর শুনলাম পড়ার মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কাটাকুটি খেলছিলে আজ! সত্যি?”

“মাস্টারমশাই নিজেই তো খেললেন।”

“সেক্ষেত্রে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু মাস্টারমশাইরা কোন ধরনের ছাত্রের সঙ্গে কাটাকুটি খেলেন তা জানো? যাদের কিছু হবে না বলে ওঁরা নিশ্চিন্ত হয়ে যান। তোমারও কিছু হবে না। এখন যাও।”

চোখ মুছতে মুছতে রামু বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

উদ্ধববাবুর কড়া হুকুম আছে কোনো ছেলেকে তিনি যেদিন শাসন করবেন যেদিন সেই ছেলের খাওয়াও বারণ। তাতে নাকি ফল ভাল হয়। সুতরাং রামুকে আজ খালি পেটে ইস্কুল যেতে হল।

ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে বসে গান্টু কাঁচা কুল খাচ্ছিল নুন দিয়ে। স্যার এখনো আসেননি।

রামু গিয়ে পাশে বসতেই গান্টু চাপা গলায় বলে, “খুব ভোলাই খেয়েছিস

রামু আবার চোখের জল মোছে।

‘দূর, আমি তো কত মার খেয়েছি। কাকা এখনো মারে। তবে এখন আর লাগে না।”

রামু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “শোন গান্টু, আমি ঠিক করেছি সার্কাসের দলে নাম লেখাব।”

“সার্কাস!”

“আমার লেখাপড়া হবে না। কিছু হবে না।”

“সার্কাসে গেলে নেবে কেন? ঝাড় দেওয়ার কাজ করবি?”

“না। খেলা দেখাব।”

“পারবি?”

“শিখব।”

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়