হরিবাবু আজ বেশ উদ্বেলিত বোধ করছেন। সমঝদারের অভাবে এতদিন তাঁর কাব্যসাধনা একরকম বিফলেই যাচ্ছিল। এতদিন পর তিনি একজন ভাল সমঝদার পেয়েছেন। লোকটা হয়তো তেমন সাধু চরিত্রের নয়। একটু পেটুকও আছে। চোর গুণ্ডা বদমাশ হওয়াও বিচিত্র নয়। তবু বলতেই হবে যে, পঞ্চানন্দ লোকটা কবিতা বোঝে।

উৎসাহের চোটে হরিবাবু আজ রাত দেড়টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে কবিতার পর কবিতা লিখে চললেন। গিন্নি অনেকবার শোয়ার জন্য বললেন, বকাবকিও করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। হরিবাবুর হৃদয় আজ ময়ূরের মতো এমন নাচতে লেগেছে, ঠ্যাং না ভাঙা অবধি সেই নাচ থামবে না। বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

দেড়টার সময় হরিবাবুর খিদে পেল। রাত দশটা নাগাদ সামান্য একটু কোনওক্রমে গিলে আবার কবিতা লিখতে বসে গিয়েছিলেন। তখন পেট কুঁই কুঁই করছে।

হরিবাবু কিছুক্ষণ ঘুমন্ত বাড়ির এধার-ওধার ঘুরে খাবার খুঁজলেন। কিন্তু কোথায় খাবারদাবার থাকে, তা তার জানা নেই। ফলে কিছুই না পেয়ে পেট ভরে জল খেলেন। তারপর ভাবলেন, ছাদে গিয়ে খোলা হাওয়ায় একটু ঘুরে বেড়াবেন।

র‍্যাপারটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে হরিবাবু ছাদে উঠলেন।

আহা, চারিদিককার কী শোভা! আকাশে চাঁদটা খুব ঝুলে পড়েছে। এত ঝুলে পড়েছে যে, বেশ বড়সড় দেখাচ্ছে উঁদটাকে। আর চাঁদের রঙটাও বেশ ভাল। লাগল হরিবাবুর। রোজকার মতো হলদে চাঁদ নয়। এদের রংটা বেশ ফিকে নীল।

হরিবাবুর ইচ্ছে হল এখনই গিয়ে নীল চাঁদ নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলেন। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল, চাঁদটা একটু নড়ল যেন! হ্যাঁ, চাঁদটা বাস্তবিকই আজ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কথা নেই,বার্তা নেই, হঠাৎ আকাশ থেকে সড়াত করে বিঘতখানেক নেমে এল।

হরিবাবু ঊর্ধ্বমুখ হয়ে চাঁদের এই কাণ্ড দেখে ভাবলেন, নড়ন্ত চাঁদ আর দুরন্ত ফঁদে মিল কেমন জমবে?

উঁহু, চাঁদটা যে শুধু নীল আর নড়ন্ত তাই নয়। চাঁদটার সাইজটাও ভারি অন্যরকম। কেউ যেন দু’দিক দিয়ে খানিকটা করে চেঁছে চাঁদটাকে হুবহু একখানা হাঁসের ডিম বানিয়ে দিয়েছে। এরকম ডিমের মতো চাঁদ আগে কখনও দেখেননি। হরিবাবু। তিনি বিড়বিড় করতে লাগলেন :

এ কোন্ অদ্ভুত চন্দ্র বিম্বিত আকাশে?
চাঁদ, না ঘুঘুর ডিম ভাসে?
গগনের অশ্রু? নাকি স্বর্গের বাগানে রাজহাঁসে
ডিম ভুলে ফিরেছে আবাসে?

কবিতাটি এক্ষুনি লিখে ফেলতে হবে। নইলে সংসারের নানা ঝামেলায় মাথা থেকে মুছে যাবে জিনিসটা। হরিবাবু তাই পড়ি কি মরি করে ছাদ থেকে নেমে এলেন এবং খাতায় লিখে ফেললেন কবিতাটি।

তারপর হঠাৎ হরিবাবুর একটা খটকা লাগল। চাঁদ কস্মিনকালেও নীল হয় না। চাঁদের আকার ডিমের মতো হওয়ারও সত্যিকারের কোনও কারণ নেই। আর চাঁদ আকাশে কখনওই এরকম বেমক্কা নড়াচড়া করে না।

তা হলে ব্যাপারটা কী হল? অ্যাঁ! হরিবাবু কলম রেখে আবার ছাদে উঠে এলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, আকাশে চাঁদটা নেই, এমনকী আভাসটুকু পর্যন্ত নেই। ঘুটঘুঁটে আকাশে কুয়াশার জন্য তারাটারাও দেখা যাচ্ছে না।

হরিবাবু ভারী অবাক হয়ে চারদিকে সঁদটাকে খুঁজতে লাগলেন। ছোটখাটো জিনিস নয় যে হারিয়ে যাবে। এত তাড়াতাড়ি চাঁদটার অস্ত যাওয়ারও কথা নয়।

হরিবাবু খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে আপনমনেই। বলে উঠলেন, “এটার মানে কী? অ্যাঁ! এর মানে কী?”

জলের ট্যাঙ্কের পাশে অন্ধকার ঘুপচি থেকে একটা ক্ষীণ গলা বলে উঠল,

“আজ্ঞে, মানেটা বেশ গুরুচরণ।”

হরিবাবু আঁতকে উঠে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। অন্ধকারে কিছুই দেখার জো নেই। তবে জলের ট্যাঙ্কের দিক থেকে একটা কিস্তৃত ছায়ামূর্তি ধীরে-ধীরে এগিয়ে এল।

হরিবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “কে? কে ওখানে?”

“আজ্ঞে চাচাবেন না, আমি পঞ্চানন্দ।”

হরিবাবু একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস ছেড়ে একটু হেসে বললেন, “ওঃ পঞ্চানন্দ? তা ইয়ে, বুঝলে, একখানা এইমাত্র লিখে ফেললুম। শুনবে নাকি?”

পঞ্চানন্দ বেশ ঝুল্লুস করে কম্বলখানা গায়ে জড়িয়ে আছে। বেশ অমায়িক ভাবেই বলল, “আপনার কি শীতও করে না আজ্ঞে? গায়ে একখানা পাতলা চাঁদর দিয়ে কী করে এই বাঘা শীত সহ্য করছেন?”

হরিবাবু উদাস হেসে বললেন, “করবে না কেন, করে। তবে কিনা কবিতারও তো একটা উত্তাপ আছে। মাথাটা বেশ গরম হয়ে উঠেছিল একটু আগে”।

“সে না হয় বুঝলুম, কিন্তু চোখের সামনে এত বড় একটা ভূতুড়ে কাণ্ড দেখেও আপনার শুধু কবিতা মাথায় আসে কেন বলুন তো!”

হরিবাবু অবাক হয়ে বললেন, “ভূতুড়ে কাণ্ড! কী রকম ভূতুড়ে কাণ্ড বলল তো!”

“এই যে চোখের সামনে আকাশ থেকে যে বস্তুটাকে নেমে আসতে দেখলেন, সেটা ভূতুড়ে ছাড়া আর কী হতে পারে বলুন দিকি।”

হরিবাবু খুব হাসলেন। তারপর বললেন, “চাঁদটা দেখে ভয় পেয়েছ বুঝি? আমিও একটু অবাক হয়েছিলাম।”

পঞ্চানন্দ অবাক হয়ে বলল, “চাঁদ? আপনার কি তিথিটাও খেয়াল নেই? দিয়ে কালিয়া আর রুচি নতুন গুড়েই মানে? অলাম।”

“আজ কি আকাশে চাঁদ থাকার কথা?”

হরিবাবু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “সে অবিশ্যি ঠিক।”

পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “মোটেই ঠিক নয়। এসব ব্যাপার খুবই গোলমেলে। এ-নিয়ে একটু ভাবা দরকার।”

হরিবাবু মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, একটু ভাবলেও হয়।”

পঞ্চানন্দ একখানা হাই তুলে বলল, “আমার মুশকিল কী জানেন? পেট খালি থাকলে মাথাটা মোটেই খেলতে চায় না।”

হরিবাবু এতক্ষণ খিদের কথা ভুলে ছিলেন। হঠাৎ পঞ্চানন্দের কথায় তার পেটটাও খাঁ-খাঁ করে উঠল। মাথা চুলকে বললেন, “খিদে জিনিসটা বোধহয় ছোঁয়াচে। আমারও বোধহয় একটু পাচ্ছে।”

“বোধহয়” শুনে পঞ্চানন্দ চোখ কপালে তুলে বলল, “ধন্য মশাই আপনি! খিদের ব্যাপারেও আবার বোধহয়?”

হরিবাবু লাজুক হেসে বললেন, “অনেকক্ষণ ধরেই বোধহয় খিদেটা পেয়ে আছে। কিন্তু খাবার-টাবার কিছুই ঘরে নেই দেখলাম।”

পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “নেই মানে? আজ্ঞে, খাওয়ার ঘরের ঠাণ্ডা আলমারিতে এক ডেকচি নতুন গুড়ের পায়েস, এক বাটি রসগোল্লা, ছানার গজা, মাছের কালিয়া আর কয়েকখানা পরোটা রয়েছে। অবশ্য গিন্নি-মা ফ্রিজে চাবি দিয়ে রাখেন। কিন্তু তাতে কী?”

হরিবাবুর মাথায় ফ্রিজের কথাটা খেলেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, “তুমি বাস্তবিকই প্রতিভাবান।”

দু’জনে নিঃশব্দে নেমে এলেন। পঞ্চানন্দ ঠিক এক মিনিটে ফ্রিজের দরজা খুলে খাবার-দাবার বের করে ফেলল। খেতে-খেতে দু’জনের কথা হতে লাগল।

হরিবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ, চাঁদ নিয়ে কী যেন বলছিলে!”

পঞ্চানন্দ এক কামড়ে আধখানা মাছ উড়িয়ে দিয়ে বলল, “চাঁদ নয়, চাঁদ হলে ওরকম বেয়াদবি করত না।”

“তা হলে জিনিসটা কী?”

“মনে হয় এ হল গগন-চাকি।”

হরিবাবু খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “গগন চাকি? সে তো কামারপাড়ার দিকে থাকে, তার পাটের ব্যবসা! সে এর মধ্যে আসে কী করে?”

পঞ্চানন্দ পরোটা ঝোলে ডুবিয়ে খেতে-খেতে বলল, “আজ্ঞে সে গগন চাকি নয়। গগন মানে আকাশ আর চাকি হল গোলাকার বস্তু। উড়ন্ত-চাকিও বলতে পারেন।”

“উড়ন্ত-চাকি? সে তো এক দুরন্ত ফাঁকি। শুনেছি উড়ন্ত-চাকি বলে আসলে কিছু নেই। নিষ্কর্মা লোক ওসব গুজব রটায়!”

পঞ্চানন্দ দুটি রসগোল্লা দু’গালে ফেলে নিমীলিত নয়নে, অনেকক্ষণ চিবোল। তারপর বলল, “লোকে কত কী বলে। ওসব কথায় কান দেবেন না। যখন হিমালয়ে ছিলুম তখন খাড়াবাবার কাছে পরামর্শ নিতে বারদুনিয়া থেকে কত কিম্ভূত চেহারার জীব আসত। তারা আসত ওইসব উড়ন্ত-চাকিতে করেই। কোনওটা চ্যাপটা, কোনওটা বলের মতো গোল, কোনওটা আবার পটলের মতো লম্বাপানা। একবার আপনাদের পিছনের বাগানেও একটা নেমেছিল। তখন শিবুবাবু বেঁচে। কয়েকটা লোমওয়ালা হুমদো গোরিলা একখানা মস্ত পিপের মতো বস্তু থেকে বেরিয়ে গটগট করে গিয়ে শিবুবাবুর ল্যাবরেটরির দরজায় ধাক্কা দিল। আমি বারান্দায় শুয়ে চোখ মিটমিট করে সব দেখছিলাম।”

হরিবাবু এক চামচ পায়েস মুখে দিয়ে সেটা গিলতে ভুলে গিয়ে চেয়ে রইলেন।

পঞ্চানন্দ সস্নেহে বলল, “গিলে ফেলুন হরিবাবু, নইলে বিষম খাবেন যে!”

হরিবাবু পায়েসটা গিলে বললেন, “তারপর?”

“ভিতরে কী সব কথাবার্তা হল বুঝলাম না। তবে একটু বাদে দেখি, শিবুবাবু সেই গোরিলাগুলোর সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন, “ওরে পঞ্চা, এই এদের সঙ্গে একটু আকাশের অন্যদিকে যেতে হচ্ছে। এদের গ্রহে একটা যন্ত্র একটু খারাপ হয়েছে। মেরামত করে দিয়ে আসতে হবে। কদিন বাদে ফিরব। তা বাস্তবিকই সেই পিপেটায় গিয়ে উঠলেন শিবুবাবু। আর তারপর সেটা একটা গোঁ-ও-ও শব্দ করে একটা গুডুরেল মতো ছিটকে আকাশে উঠে গেল।”

হরিবাবু দম বন্ধ করে শুনছিলেন। বললেন, “তারপর?”

“আজ্ঞে, তাই বলছিলাম, গগন-চাকি কিছু মিছে কথা নয়। আমার তো মনে হচ্ছে আজ যেটা দেখা গেল সেটাও ওই গগন-চাকিই।”

হরিবাবু আনমনে বিড়বিড় করতে লাগলেন :

আকাশের ডিম, নাকি গগনের চাকি মর্ত্যধামে?
কিছু তার কল্পনা, কিছু তার ফাঁকি, মধ্যযামে।

বলতে বলতে হরিবাবু গায়ের চাঁদরে ঝোল আর রসগোল্লার রস লাগা হাত মুছতে মুছতে নিজের ঘরে গিয়ে কবিতাটা লিখতে বসে গেলেন।

পঞ্চানন্দ ধীরেসুস্থে খাওয়া সেরে উঠল। মুখ ধুয়ে ধীরে ধীরে নীচে নেমে জরিবাবুর ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল সে। তারপর আলো জ্বেলে নিজেই একটা পান সেজে খেল। তারপর বালিশের তলা থেকে চাবির গোছাটা বের করে টর্চটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল সে।

আকাশ থেকে ডিমের মতো বস্তুটা যখন নেমে এসেছিল অনেকটা, তখনই হঠাৎ সেটার গায়ের নীল আলো নিবে গিয়েছিল। বস্তুটা যে ধারেকাছে কোথাও নেমেছে তাতে পঞ্চানন্দের সন্দেহ নেই। কিন্তু ঠিক কোথায় নেমেছে সেটাই সে ঠাহর করতে পারেনি।

ফটক খুলে রাস্তায় পা দিয়ে পঞ্চানন্দ চারপাশটা সতর্ক চোখে একটু দেখে নিল। কেউ কোথাও নেই।

তারপর বেশ পা চালিয়ে হাঁটতে লাগল সে।

পঞ্চানন্দ যে একাই বস্তুটাকে নামতে দেখেছে তা নয়। আর-একজন ঘড়েল লোকও দেখেছে। এই লোকটা খুব সাধারণ লোক নয়। চকসাহেবের বাড়িতে গা-ঢাকা দিয়ে আছে বটে, কিন্তু তার সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিতে দুনিয়ার সব কিছুই ধরা পড়ে যায়।

পঞ্চানন্দ তাই খুব চিন্তিতভাবে এগোতে লাগল।

২২.

কোথায় বস্তুটা নেমেছে সে সম্পর্কে পঞ্চানন্দর একটা আন্দাজ ছিল মাত্র। তবে নামবার মুহূর্তে আলো নিবিয়ে দেওয়ায় সঠিক নিশানা সে ধরতে পারেনি। তবে চক-সাহেবের বাড়ির দিকটাই হবে। পঞ্চানন্দ খুব দৌড়-পায়ে হেঁটে যখন চক সাহেবের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছল তখন তার সবটুকু মনোযোগ সামনের দিকে। ফলে পিছন দিক থেকে যে বিপদটা আসছিল, সেটা সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না তার। রাস্তা থেকে চক-সাহেবের বাড়ির দিকে যাওয়ার একটা পরিত্যক্ত ভাঙা রাস্তা আছে। দু’ধারে মস্ত মস্ত বাবলাগাছ, কাঁটা-ঝোঁপ, ঘাস-জঙ্গল। সেই রাস্তার মোড়ে একজন অতিকায় ঢ্যাঙা তোক একটা ঝোঁপের আবডালে দাঁড়িয়ে হাতে একটা ক্যামেরার মতো বস্তুতে কী যেন দেখছিল, পঞ্চানন্দ যতই নিঃসাড়ে আসুক লোকটা ঠিকই টের পেল তার আগমন। টপ করে অন্ধকারে আরও একটু সরে দাঁড়াল সে। পঞ্চানন্দ যখনই ভাঙা রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল, তখনই বেড়ালের মতো তার পিছু নিল ঢ্যাঙা লোকটা।

চক-সাহেবের বাড়ির পিছনে প্রকাণ্ড মাঠ। খানাখন্দে ভরা, পুরনো মজা পুকুর, ঝোঁপঝাড়, জলাজমির এই মাঠে নোকজন বড় একটা আসে না। চাষবাসও নেই। মাঝেমধ্যে গোরু চরাতে রাখাল-ছেলেরা আসে মাত্র। সন্ধের পর এখানে আলেয়া দেখা যায়।

পঞ্চানন্দ চক-সাহেবের বাড়ি পিছনে ফেলে দ্রুত পায়ে মাঠটার দিকে হাঁটছিল। হঠাৎ কেন যেন তার মনে হল, সে একা নয়। মনে হতেই সে পিছু ফিরে চাইল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। সন্তর্পণে টর্চটা একবার জ্বালল সে। পরমুহূর্তেই নিবিয়ে দিল।

ঢ্যাঙা লোকটা তার চেয়ে কম সেয়ানা নয়। একটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে সে যন্ত্রের ভিতর দিয়ে লক্ষ রাখছিল পঞ্চানন্দকে। পঞ্চানন্দ টর্চ জ্বালাবার আগেই একটা গাছের আড়ালে সরে গেল সে।

পঞ্চানন্দ একটু দ্বিধাগ্রস্ত হল। সে জানে যে-সব অজানা মানুষ বা অমানুহে সঙ্গে তাকে পাল্লা দিতে হচ্ছে, তারা খুবই তুখোড় এবং শক্তিমান। চক-সাহেবে? বাড়িতে যে-লোকটি স্যাঙাত নিয়ে থানা গেড়েছে সে বড় যে-সে লোক নয়। পঞ্চানন্দকে ইচ্ছে করলে বায়ুভূত করে দিতে পারে যে কোনও সময়ে।

সুতরাং পঞ্চানন্দ একটু সাবধান হল। খোলা জায়গা এড়িয়ে ঝোঁপঝাড় খুঁজে আড়াল হয়ে একটু একটু করে এগোতে লাগল।

সামনে অন্ধকার বিশাল মাঠ। কিছুই দেখা যায় না। কুয়াশায় সব কিছু এক ঘেরাটোপে ঢাকা। খুব আবছা এক ধরনের আভাস মাত্র পাওয়া যাচ্ছে।

দপ করে আলেয়ার একটা নীল শিখা জ্বলে উঠে বাতাসে খানিক দোল খেয়ে নিবে গেল। ফের একটু দূরে আর একটা জ্বলে উঠল।

আলেয়া দেখে পঞ্চানন্দ আন্দাজ করল যে, ওদিকটায় জলা। সাধারণত জলা জমিতেই আলেয়া দেখা যায়।

পঞ্চানন্দ আর এগোল না। একটা বড়সড় ঝোঁপ দেখতে পেয়ে আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে খুব তীক্ষ্ণ নজরে জলাটা দেখতে লাগল। গগন-চাকি যদি এখানে নেমে থাকে তবে জলার আশেপাশেই নেমেছে।

কিন্তু অনেকক্ষণ চেয়ে থেকেও কিছুই ঠাহর করতে পারল না সে। তবে সে ধৈর্যশীল মানুষ। চুপচাপ বসে চোখকে যতদূর তীক্ষ্ণ করা যায় করে চেয়ে রইল।

খুব ক্ষীণ একটা আলো দেখা গেল কি? বা ধারে ওই যেখানে খুব উঁতেগাছ জন্মায়। হ্যাঁ, ওই দিকটায় একটা যেন নীলচে মতো আলো ফুটে উঠছে!

একটু ঝুঁকে সামনের ঝোঁপটা হাত দিয়ে সরিয়ে পঞ্চানন্দ দেখার চেষ্টা করল।

একেবারে নিঃশব্দে লম্বা ঢ্যাঙা একটা ছায়া এগিয়ে এল পিছন দিক থেকে। পঞ্চানন্দ টেরও পেল না। ঢ্যাঙা লোকটার হাতে টর্চের মতো একটা বস্তু। কিন্তু সেটা টর্চ নয়। লোকটা যন্ত্রটা তুলে একটা সুইচ টিপল।

কিছু টের পাওয়ার আগেই পঞ্চানন্দ লটকে পড়ল মাটিতে। অবশ্য ঝোঁপ ঝাড়ের জন্য পুরোটা মাটিতে পড়ল না সে। লটকে রইল মাঝপথে।

ঢ্যাঙা লোকটা যেন একটু দুঃখিতভাবেই চেয়ে রইল পঞ্চানন্দের নিথর দেহটার দিকে। তারপর দুরবীনের মতো যন্ত্রটা তুলে একটা বোম টিপল।

যন্ত্রের ভিতরে একটি কণ্ঠস্বর প্রশ্ন করল, “সব ঠিক আছে?”

ঢ্যাঙা লোকটা মৃদুস্বরে বলল, “একজন লোক এদিকে এসেছিল। মনে হয় মজা দেখতে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।”

“লোকটার শরীর ভাল করে সার্চ করে দ্যাখো। টিকটিকিও হতে পারে।”

“দেখছি।”

ঢ্যাঙা লোকটা খুব দ্রুত এবং দক্ষ হাতে পঞ্চানন্দর পকেট ট্র্যাক হাতড়ে দেখে নিল। তেমন সন্দেহজনক কিছু পেল না। যন্ত্রের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “কিছু নেই।”

“জলার দিকে লক্ষ্য রেখেছ?”

“হ্যাঁ। এখনও মুভমেন্ট কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে এটা একটা অ্যাডভান্স সার্চ পার্টি। প্রাথমিক খোঁজখবর নিতে নেমেছে।”

“লক্ষ্য রাখো। বেশি কাছে যেও না। আমার ধারণা যন্ত্রটার মধ্যে কোনও জীব নেই। শুধু যন্ত্রপাতি আর যন্ত্রমানব আছে। জীব থাকলে আমার স্ক্যানারে ধরা পড়ত।”

“আমি লক্ষ্য রাখছি।”

“আকাশে যন্ত্রটাকে আরও কেউ-কেউ দেখে থাকতে পারে। যদি দেখে থাকে তবে তারাও হয়তো এদিকে আসবে। নজর রাখো। কাউকেই জলার দিকে তুঁতেবনে যেতে দিও না।”

“আচ্ছা।”

ঢ্যাঙা লোকটা সুইচ টিপে হাতের যন্ত্রটাকে অন্য কাজে নিয়োগ করল। চার দিকের নিকটবর্তী আবহমণ্ডলে কোনও মানুষ ঢুকলেই যন্ত্র তাকে খবর দেবে।

ঢ্যাঙা লোকটা বিরক্ত হয়ে দেখল, যন্ত্রটা সঙ্কেত দিচ্ছে। অর্থাৎ অন্য কোনও মানুষ কাছাকাছি এসেছে। ঢ্যাঙা লোকটা একটু আড়ালে সরে গেল এবং চোখে দূরবীনের মতো আর একটা যন্ত্র লাগিয়ে অন্ধকারেও চারদিকটা দেখতে লাগল।

নিশুত রাত্রে তিনটে ছায়ামূর্তি জলের দিকে এগিয়ে আসছিল। তিনজনেরই হোঁতকা চেহারা। একটু দুলে দুলে তারা হাঁটে। তবে চেহারা দশাসই হলেও তারা হাঁটে বেশ চটপটে পায়ে। তেমন কোনও শব্দও হয় না।

জলার দক্ষিণ দিকে মাইল-তিনেক দূরে একটা মস্ত ঢিবি আছে। ঢিবির চারদিকে বহুদূর অবধি জনবসতি নেই। অত্যন্ত কাঁকুরে জমি, ঘাস অবধি হয় না। তারই মাঝখানে ওই ঢিবি। লোকে বলে ঢিবির মধ্যে পুরনো রাজপ্রাসাদ আছে। সেটা নেহাতই কিংবদন্তি।

তবে ওই ঢিবির গায়ে বেশ বড়সড় কয়েকটা গর্ত হয়েছে ইদানীং। রাখাল ছেলেদের মধ্যে কেউ-কেউ সেইসব গর্ত লক্ষ্য করেছে বটে, কিন্তু তারা কেউ সে কথা আর পাঁচজনকে বলার সুযোগ পায়নি। কারণ যারাই ঢিবিটার কাছে পিঠে গেছে, তাদেরই সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা পর কোনও গাঁয়ের ধারে পাওয়া গেছে। জ্ঞান ফিরে আসার পরও তারা স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তি ফিরে পায়নি। আবোলতাবোল বকে আর বিড়বিড় করে। সুতরাং ঢিবির গায়ে গর্তের কথা কেউ জানতে পারেনি।

সেই ঢিবি থেকেই একটি গর্তের মুখ দিয়ে তিনটে ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসেছে। খুব নিশ্চিন্তে জলার দিকে হাঁটছে তারা। নিচু এক ধরনের গোঙানির স্বরে তারা মাঝে-মাঝে সংক্ষিপ্ত দু-একটা কথাও বলছে। কিন্তু সে ভাষা বোঝার ক্ষমতা কোনও মানুষের নেই।

২৩.

জলার কাছ-বরাবর এসে তিনজন একটু দাঁড়াল। একজন একটা ছোট্ট পিরিচের মতো জিনিস বের করে সেটার দিকে চাইল। অন্য দু’জন একটু মাথা নাড়ল। পিরিচের মধ্যে তারা কী দেখল কে জানে, তবে তিনজনেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল।

ঢ্যাঙা লোকটা তার দূরবীনের ভিতর দিয়ে অন্ধকারে তিনজনকে স্পষ্ট দেখতে পেল। তাদের হাতের পিরিচটাও লক্ষ্য করল সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে টর্চের মতো যন্ত্রটাকে তুলে পর পর কয়েকবার সুইচ টিপল।

তিনজন অতিকায় জীব হঠাৎ থমকে দাঁড়াল জলার ওপাশে। তিনজনই একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু পঞ্চানন্দের মতো তারা লটকে পড়ল না।

হঠাৎ একটা ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল তিনজন একসঙ্গে। তারপর চিতাবাঘের মতো চকিত পায়ে তারা এক লহমায় জলটা পার হয়ে দৌড়ে এল এদিকে। ঢ্যাঙা লোকটা ভাল করে নড়বারও সময় পেল না। তিনটে অতিকায় জীব তার ওপর লাফিয়ে পড়ল তিনটে পাহাড়ের মতো।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঢ্যাঙা লোকটাকে তারা শেষ করে ফেলত। কিন্তু লোকটা অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো হাতের টর্চটা তুলে ঘন ঘন সুইচ টিপতে লাগল।

তাতে ব্যাপারটা একটু বিলম্বিত হল মাত্র। তিনটে দৈত্যের মতো জীব ততটা বিক্রমের সঙ্গে না হলেও, অমোঘভাবে এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে। অবশেষে একজন হঠাৎ ঢ্যাঙা লোকটাকে ধরে মাথার ওপর তুলে একটা ডল পুতুলের মতো আছাড় দিল মাটিতে।

ঢ্যাঙা লোকটা চিতপাত হয়ে পড়ে রইল। তিনটে অতিকায় জীব দ্রুত পায়ে জলার ওদিকে ছুঁতেবনের দিকে এগিয়ে গেল।

তেইশ জলার ধারে ঢিবির কথা গজ-পালোয়ান ভালই জানত, ঢিবিটার কোনও বৈশিষ্ট্য সে কখনও লক্ষ্য করেনি। বাইরে থেকে দেখলে সেটাকে একটা ছোটখাটো টিলা বলেই মনে হয়। এর মধ্যে একখানা আস্ত রাজবাড়ি চাপা পড়ে আছে বলে

যে কিংবদন্তী শুনেছে সে, তা গজ বিশ্বাস করে না।

কিন্তু আজ এই নিশুত রাতে এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে তাকে কথাটা বিশ্বাস করতে হচ্ছে।

সেদিন চকসাহেবের বাড়ি থেকে পালিয়ে ন্যাড়াদের বাড়িতে শিবুবাবুর ল্যাবরেটরিতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই এমন সব ঘটনা ঘটতে লাগল যার মাথা-মুণ্ডু সে কিছু বুঝতে পারছে না।

ল্যাবরেটরির দরজা বন্ধ করে জানালার পর্দাগুলো ভাল করে টেনেটুনে সে একটু ঘরটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিল। নিজের কাছে লুকিয়ে তো লাভ নেই, শিবুবাবুর। ল্যাবরেটরিতে একটা জিনিস সে অনেকদিন ধরেই খুঁজছে। এতদিন গোপনে চোরের মতো মাঝরাতে ঢুকে খুঁজেছে, আর সেদিন আলো জ্বেলে বেশ নিশ্চিন্ত মনেই খুঁজছিল। কিন্তু যে জিনিসটা সে খুঁজছিল, সেটা সম্পর্কে তার ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। যতদূর জানে, জিনিসটা একটা টেনিস বলের মতো ধাতব বস্তু। খুবই আশ্চর্য বস্তু সন্দেহ নেই, কিন্তু তার ভিতরকার কথা তার জানা নেই। সে শুধু জানে দুনিয়ায় ওরকম বস্তু দ্বিতীয়টি নেই। পাগলা শিবুবাবু সেই বস্তুটা নিজেই বানিয়েছেন না কারও কাছ থেকে পেয়েছেন তাও রহস্যময়। তবে ওই টেনিস বলের জন্য দুনিয়ার বহু জানবুঝওয়ালা লোক পাগলের মতো হন্যে হয়ে ঘুরছে।

বস্তুটা যে ল্যাবরেটরিতেই আছে তা নাও হতে পারে। কিন্তু কোথাও তো আছেই। ল্যাবরেটরিটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য জায়গা। আর শিবুবাবুর ল্যাবরেটরিতে এত আলমারি, ড্রয়ার, তাক, গুপ্ত খোপ,মেঝের নীচে পাতালঘর আর পাটাতনে গুপ্ত কক্ষ আছে যে সে এক গোলকধাঁধা। খুঁজতে খুঁজতে মাথা গুলিয়ে যায়, হাঁফ ধরে, ধৈর্যচুতি ঘটতে থাকে।

সেদিন গজ’রও সেরকমই হচ্ছিল। বস্তুটার একটা হদিস করতে পারলেই গজ এ শহরের পাট চুকিয়ে কেটে পড়তে পারে। হাতেও মেলা টাকা এসে যাবে।

আশ্চর্যের বিষয় এই, শিবুবাবুর কাছে যে ওরকম মূল্যবান একটা দরকারি জিনিস আছে, তা তাঁর ছেলেপুলেরা কেউ জানে না। শিবুবাবুর ছেলেগুলো যাকে বলে দাগঙ্গারাম। একজন কেবল মাথামুণ্ডু পদ্য লিখে কাগজ নষ্ট করে। একজন গাধাটে গলায় তানা-না-না করে সকলের মাথা ধরিয়ে দেয়। ছোটটা কেবল শরীর বাগাতে গিয়ে মাথাটা গবেট করে ফেলছে। এর ফলে আর পাঁচজনের সুবিধেই হয়েছে।

গজ যখন একটার পর একটা ড্রয়ার খুলে হাতড়ে দেখছিল তখন একসময়ে দরজায় খুব মৃদু একটা টোকার শব্দ হল। একটু আঁতকে উঠলেও গজ খুব ঘাবড়াল না। সম্ভবত ন্যাড়া তার খোঁজখবর নিতে এসেছে।

দরজার কাছে গিয়ে গজ সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে, ন্যাড়া নাকি?”

ন্যাড়া যে নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেল পরমুহূর্তেই। গজ দেখল দরজার দুটো পাল্লার ফাঁক দিয়ে লিকলিকে শিকের মতো একটা জিনিস ঢুকছে। আর শিকটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো নিপুণভাবে ওপরে বেঁকে ছিটকিনি খুলে ফেলল, বাটমটাও নামিয়ে দিল। ঘটনাটা ঘটল চোখের পলক ভাল করে ফেলার আগেই।

গজ নিরুপায় হয়ে দরজাটা চেপে ধরে রেখেছিল কিছুক্ষণ। তার গায়ে আসুরিক শক্তি। গায়ের জোরে সে অনেক অঘটন ঘটিয়েছে।

কিন্তু এ-যাত্রায় গায়ের জোর কাজে লাগল না। ওপাশ থেকে যেন একটা হাতি তাকে সমেত দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলল।

গজ মেঝেয় ছিটকে পড়েছিল। চোখ চেয়ে যা দেখল, তা অবিশ্বাস্য। হাতিই বটে, তাও একটা নয়, তিনটে। এরকম অতিকায় চেহারার মানুষ সে কখনও দেখেনি। গোরিলার মতোই তাদের চেহারা, তবে রোমশ নয়। পরনে অদ্ভুত জোব্বার মতো পোশাকও আছে। তবে মানুষ তারা হতেই পারে না।

তিনজনেই তাকে কুতকুতে চোখে একটু দেখে নিল। তারপর দুর্বোধ কয়েকটা শব্দ করল মুখে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তার দিকে।

গজ বুঝল, তার বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তা বলে সে শেষ চেষ্টা করতে ছাড়ল না। একটা লাফ দিয়ে উঠে সে সামনের গোরিলাটাকে একখানা পেল্লায়। জোরালো ঘুষি ঝাড়ল। সোজা নাকে। তারপর আরও একটা। আরও একটা।

গোরিলার মতো চেহারার লোকটা কিন্তু ঘুষি খেয়ে একটু টলে গিয়েছিল। নাকটা চেপে ধরে একটা কাতর শব্দও করেছিল।

অন্য দু’জন নীরবে দৃশ্যটা দেখে খুব নির্বিঘ্নে এবং নিশ্চিন্ত মুখেই দু’ধার থেকে বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে এল গজ’র দিকে।

গজ ক্রমাগত ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছিল ঝড়ের গতিতে। একবার সে ধোবিপাটে আছাড় দেওয়ার জন্য ডান ধারের দানোটাকে জাপটে ধরে তুলেও ফেলেছিল খানিকটা। কিন্তু অত ভারী শরীর শেষ অবধি তুলতে পারেনি।

দানোগুলো কিন্তু তার সঙ্গে লড়েনি। কিছুক্ষণ তাকে নিরস্ত করবারই চেষ্টা করেছিল। তারপর যেন একটু বিরক্ত হয়েই একটা দানো একটা চড় কষাল তাকে।

গজ সেই যে মাথা ঝিঝিম্ করে পড়ে গেল তারপর আর জ্ঞান রইল না কিছুক্ষণ।

একসময়ে টের পেল দানোগুলো তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে।

যখন ভাল করে জ্ঞান ফিরল তখন গজ দেখল, সে একটা অদ্ভুত জায়গায় শুয়ে আছে। ঘর বললে ভুল বলা হবে, অনেকটা যেন সুড়ঙ্গের মতো। আবার হঁটের গাঁথনিও আছে খানিকটা। বিছানা নয়, তবে একটা নরম গদির মতো কিছুর ওপর সে শুয়ে। মুখের ওপর একটা আলো জ্বলছে। বেশ স্নিগ্ধ আলো। কিন্তু আলোটা ইলেকট্রিক বা তেলের আলো নয়। গজ পরে পরীক্ষা করে দেখেছে একটা বেশ নারকোলের সাইজের পাথর থেকে ওই আলো আপনা-আপনি বেরিয়ে আসছে।

জ্ঞান ফেরার কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা দানো এসে তাকে ভাল করে আপাদমস্তক দেখল। দুর্বোধ ভাষায় কী একটা বলল। তারপর কোথা থেকে নানা যন্ত্রপাতি এনে তার শরীরে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে কী যেন পরীক্ষা করতে লাগল।

জায়গাটা কোথায় তা গজ বুঝতে পারছিল না। তবে মাটির নীচে কোথাও হবে। ইটের গাঁথনির ফাঁকে ফাঁকে মাটি দেখা যাচ্ছে। সোঁদা গন্ধও পাওয়া যাচ্ছিল।

ঘণ্টাখানেক বাদে একটা দানো তাকে কিছু খাবার এনে দিল। এরকম খাবার গজ জন্মেও খায়নি বা দ্যাখেনি। সবুজ-মতো চটকানো একটা ডেলা, সঙ্গে রক্তের মতো একটা পানীয়। যে ধাতুপাত্রে খাবার দেওয়া হল তা সোনার মতো উজ্জ্বল।

খিদে পেয়েছিল বলে গজ বিস্বাদ মুখ করে সেই খাবার মুখে দিয়ে কিন্তু মুগ্ধ হয়ে গেল। এত সুন্দর সেই খাবারের স্বাদ যে সমস্ত শরীরটাই যেন চনমনে খুশিয়াল হয়ে ওঠে। পানীয়টিও ভারি সুস্বাদু, বুক ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

খেয়ে গায়ে একটু জোর পেল গজ। উঠে বসল। একটু হাঁটাহাঁটি করল। দেখল, তাকে সুড়ঙ্গে আটকে রাখার জন্য কোনও আগল বা দরজা নেই। ইচ্ছে করলেই সে বেরোতে পারে।

কিন্তু বেরোতে গিয়েই ভুলটা ভাঙল। সুড়ঙ্গের চওড়া দিকটায় ঠিক কুড়ি পা গিয়েই একটা ধাক্কা খেল গজ। সমস্ত শরীরে একটা তীব্র বিদ্যুত্তরঙ্গ খেলে গেল। ছিটকে সরে এসে গজ অনেকক্ষণ ধরে ধাক্কাটা সামলাল। বুঝল, এরা এমন ব্যবস্থা করেছে যাতে বাতাসে সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক বিক্রিয়া ছড়িয়ে থাকে পর্দার মতো।

দানো-তিনটে পর্যায়ক্রমে এসে মাঝে-মাঝে নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে তাকে পরীক্ষা করে আর দুর্বোধ ভাষায় কী যেন বলে। তাদের ভাষা না বুঝলেও গজ এটা টের পায় যে, তাকে নিয়ে দানো তিনটে একটা রিসার্চ চালাচ্ছে। হয়তো পৃথিবীর প্রাণী সম্পর্কেই সেই রিসার্চ। দানো তিনটে যে পৃথিবীর প্রাণী নয় এ বিষয়ে গজ’র আর কোনও সন্দেহ নেই।

সুড়ঙ্গের মধ্যে যেটুকু পরিসর তাকে দেওয়া হয়েছে, তাতে বিচরণ করে গজ বুঝতে পেরেছে, এটা বাস্তবিকই মাটির নীচেকার কোনও ধ্বংসস্তূপ। মাঝে-মাকে বাইরে থেকে মৃদু একটা জলীয় বাষ্প বয়ে যায় ভিতরে। অর্থাৎ কাছাকাছি জলাভূমি আছে।

গজ আন্দাজ করল, জলার পাশে হয়তো সেই রাজবাড়ির ঢিবিটার গর্ভেই তাকে আটকে রাখা হয়েছে।

গজ লক্ষ্য করল, তিনটে দানোর হাতেই মাঝে-মাঝে পিরিচের মতো একটা জিনিস থাকে। খুবই উন্নতমানের পিরিচ সন্দেহ নেই। ওইটে হাতে নিয়েই ওরা বৈদ্যুতিক বেড়াজালটা দিব্যি ভেদ করে আসতে পারে।

গজ হিসেব করে দেখল, টানা দু’দিন দু’রাত্রি সে দানোদের হাতে বন্দী। দিনরাত্রির তফাত অবশ্য এখান থেকে বোঝা যায় না। শুধু এই উজ্জল পাথরের আলো ছাড়া দিনরাত আর কোনও আলো নেই। মাঝে-মাঝে গজ’র মনে হয় সে দুঃস্বপ্নই দেখছে। আর কিছু নয়।

আজ হঠাৎ গজ’র ঘুমটা মাঝরাতে ভেঙে গেল। সে উঠে বসল। তারপর কেন ঘুম ভাঙল তা অনুসন্ধান করতে চারদিকে একটু ঘুরে বেড়াল সে। আর হঠাৎই টের পেল, সুড়ঙ্গের এক ধারে বিদ্যুতের বাধাটা আজ নেই।

গজ খুব সন্তর্পণে এগোতে লাগল।

২৪.

গজ সুড়ঙ্গ পেরিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখল, যা ভেবেছিল তাই। সামনে কুয়াশা আর অন্ধকারেও জলটা আবছা দেখা যাচ্ছে। এ সেই রাজবাড়ির ঢিবিই বটে! সুড়ঙ্গের মুখে দাঁড়িয়ে গজ একটুক্ষণ পরিষ্কার বাতাসে শ্বাস নিল। এখন ইচ্ছে করলেই সে পালাতে পারে।

কিন্তু পালানোর আগে গুহাটা একটু দেখে নেওয়া দরকার। এরা কারা, কী চায় বা কী অপকর্ম করছে তা না জেনে পালিয়ে গেলে চিরকাল আপসোস থাকবে।

ধরা পড়লে কী হবে, তা গজ’র মাথায় এল না। সাহসী লোকেরা আগাম বিপদের কথা ভাবে না, হাতে যে কাজটা রয়েছে সেটার কথাই ভাবে।

গজ ফের সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে দেখল বাঁ ধারে আর ডান ধারে দুটো পথ গেছে। বাঁ ধারে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, ওদিকে বিশেষ কিছু নেই। ডান ধারের পথটা একটুখানি গিয়েই বাঁক খেয়েছে।

সে-পথে হাঁটতে গজ’র কোনও অসুবিধে হল না, কারণ মাথার ওপর একটু দূরে দূরে সেই আলোপাথর ঝোলানো। এরকম আশ্চর্য পাথর পৃথিবীর লোক চোখেও দ্যাখেনি। বজ-আঁটুনিতে আটকানো রয়েছে। খোলার উপায় নেই।

সুড়ঙ্গটা ক্রমে চওড়া হচ্ছিল আর নীচে নেমে যাচ্ছিল। যখন শেষ হল, তখন গজ দেখল বেশ প্রশস্ত একখানা ঘর, একসময়ে যে ঘরখানা রাজবাড়ির ঘর ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। শ্বেতপাথরের মেঝে, কারুকার্য করা পাথরের দেয়াল। ঘরে অবশ্য রাজকীয় কোনও জিনিসপত্র নেই। আছে নানাকরম বিদঘুঁটে যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতি কস্মিনকালেও দ্যাখেনি গজ। সে হাঁ করে দেখতে লাগল।

হঠাৎ পায়ে কুট করে কী একটা কামড়াল গজকে।

একটু চমকে উঠে গজ চেয়ে দেখল, সবুজ রঙের একটা কঁকড়াবিছে।

কাঁকড়াবিছের হুল সাংঘাতিক, চব্বিশ ঘণ্টা ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করতে হয়। তেমন-তেমন কাঁকড়াবিছের হুলে মানুষ মরেও যায়। তাই গজ ভীষণ আতঙ্কিত চোখে বিছেটার দিকে চেয়ে রইল।

হুল দিয়েই বিছেটা গুড়গুড় করে হেঁটে গিয়ে একটা ইঁদুরধরা বাক্সের মতো ছোট বাক্সের দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। দরজাটা ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।

গজ বসে পড়ে তার বাঁ পায়ের গোড়ালির কাছটা দেখল। কোনও ক্ষত নেই, ব্যথা বা জ্বালাও সে টের পাচ্ছে না। কিন্তু ভারি সুন্দর একটা গন্ধ মাদকের মতো তার নাকে এসে লাগল আর শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগল, ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগল চোখ।

অন্য কেউ হলে ঢলে পড়ত, কিন্তু গজ’র শরীরে এবং মনে অসম্ভব শক্তি। সে প্রাণপণে মাথা ঠিক রেখে উঠে দাঁড়াল। তারপর দুটো ভারী পা ফেলে ফেলে বাইরের দিকে দৌড়তে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল, অজ্ঞান হয়ে এখানে পড়ে থাকলে সে আবার দানোদের হাতে ধরা পড়ে যাবে।

এরকম আশ্চর্য মাতাল-করা সুগন্ধ আর এমন মনোরম ঘুমের অনুভূতি কখনও হয়নি গজ’র। সে চোখে নানা রঙের রামধনু দেখছিল। তার খুব হাসতে ইচ্ছে করছিল, গান গাইতে ইচ্ছে করছিল, নাচতে ইচ্ছে করছিল।

কাঁকড়াবিছের বিষে এমনটা হওয়ার কথা নয়। রহস্য হল, এই বিছেটা সবুজ। পৃথিবীতে গজ যতদূর জানে, সবুজ রঙের কাঁকড়াবিছে হয় না। এই অদ্ভুত বিছেটার বিষও যে অভিনব হবে তাতে আর বিচিত্র কী?

গজ প্রাণপণে দৌড়তে লাগল। কিন্তু সে যাকে দৌড় বলে মনে করছিল তা আসলে হাঁটি-হাঁটি পা-পা। কিন্তু তবু গজ তার ঘুমে ভারাক্রান্ত শরীরটাকে একটা ভারী বস্তার মতো টেনে-টেনে এগোতে লাগল। থামল না।

কিন্তু সুড়ঙ্গের মুখটা অনেক দূর এবং চড়াই ভাঙতে হচ্ছে বলে গজ বেশিদূর এগোতে পারল না। শরীর ক্রমে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। আর বেশিক্ষণ গজ এই ঘুম রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই চালাতে পারবে না।

ভাগ্যবলেই গজ বাঁ দিকে একটা গর্ত দেখতে পেল। খুব আবছা দেখা যাচ্ছিল।

গজ প্রাণপণে গর্তটার দিকে এগোতে লাগল। খুবই সংকীর্ণ গর্তটা। একটু। উঁচুতেও বটে। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে গজ অতি কষ্টে গর্তটার কান ধরে উঠে পড়ল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে একটু এগোতেই একটা ভীষণ ঢালু বেয়ে সে গড়িয়ে পড়ে গেল।

পতনটা আটকানোর কোনও উপায় বা শক্তি গজ’র ছিল না। ভারী শরীরটা গড়াতে-গড়াতে কতদূর যে নেমে গেল গজ তার হিসেব করতে পারল না। তারপর হঠাৎ শূন্যে নিক্ষিপ্ত হল সে।

ঝপাং, একটা শব্দ হল। গজ’র আর কিছু মনে রইল না। তবে এক গাঢ় ঘুমে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ার আগে টের পেল, সে জলের মধ্যে পড়েছে, কিন্তু ডোবেনি।

.

পঞ্চানন্দ যখন চোখ মেলল, তখনও রাতের অন্ধকার আছে।

চোখ মেলে পঞ্চানন্দ প্রথমটায় কিছুক্ষণ বুঝতেই পারল না, সে কোথায় এবং কেন এভাবে পড়ে আছে। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে পড়ায় তার পাত-পা ছড়ে গিয়ে বেশ জ্বালা করছে। মাথাটা ভীষণ ফাঁকা।

পঞ্চানন্দ উঠে বসে মাথাটা আচ্ছাসে আঁকাল। নিজের গায়ে নিজে চিমটি দিল। বেশ করে আড়মোড়া ভেঙে একখানা মস্ত হাই তুলল। তারপরই জিনিসটা টের পেল সে। খিদে। হ্যাঁ, পেটটা তার মাথার চেয়েও বেশি ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকছে।

খিদে টের পাওয়ার পরই ঝপ করে সব ঘটনা মনে পড়ে গেল তার। জলায় একটা গগনচাকি নেমেছে। সে তাই এখানে হাজির হয়েছিল। ঝোঁপের আড়ালে বসে নজর রাখতে……

ঘুমিয়ে পড়েছিল?

মা, পঞ্চানন্দ তত অসাবধানী লোক নয়। অমন একটা ঘটনা সামনে ঘটতে চলেছে, আর সে ঘুমিয়ে পড়বে–এ হতেই পারে না।

তা হলে!

পঞ্চানন্দ উঠে পড়ল। তারপর আতিপাতি করে চারদিকটা ঘুরে দেখতে লাগল টর্চ দিয়ে। টর্চটা তার হাতের মুঠোতেই থেকে গিয়েছিল।

খুব বেশি খুঁজতে হল না। মাত্র হাত-দশেক দূরে একটা বুনো কুলগাছের আড়ালে একটা লম্বা টর্চের মতো বস্তু পড়ে আছে।

যন্ত্রটা হাতে তুলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল পঞ্চানন্দ। মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারল না। কোনও যন্ত্রই হবে, তবে কী কাজে লাগে, তা কে জানে। গায়ে অনেকগুলো বোম আছে। পঞ্চানন্দ সাবধানী লোক, সে কোনও বোতামে চাপটাপ দিল না, কী থেকে কী হয়ে যায়, কে বলবে। তবে যন্ত্রটা সে কাছে রাখল।

জলার দিকটা আগের মতোই আঁধারে ঢেকে আছে।

পঞ্চানন্দ চারদিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে জলার দিকে এগোতে লাগল।

যেখানে চাকিটা নেমেছিল বলে তার ধারণা সেখানে পুঁতেবন। জংলা জায়গা। অনেকটা জলও পেরোতে হবে। তবে জলার জলও কখনই হাঁটুর ওপরে ওঠে না।

পঞ্চানন্দ কাপড়টা একটু তুলে পরে নিল। তারপর ঠাণ্ডা জলে কাদায় নেমে পড়ল দুর্গা বলে। মাঝে-মাঝে একটু থেমে দিকটা ঠিক করে নিতে হচ্ছিল। টর্চটা সে ভয়ে জ্বালল না।

জল ভেঙে ঢিবিটার ধার দিয়ে ডাঙাজমির দিকে উঠবার সময় হঠাৎ একটা মস্ত পাথর বা অন্য কিছুতে পা বেধে দড়াম করে পড়ল পঞ্চানন্দ। এই শীতে

জামা-কাপড় জলে কাদায় একাকার।

তবে পঞ্চানন্দর এসব অভ্যাস আছে। শীতে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে সে টর্চটা হাতড়ে বের করল। বেশ ভাল টর্চ, ভিজেও নেবেনি।

কিন্তু টর্চটা জ্বেলে যা দেখল পঞ্চানন্দ তাতে হাঁ হয়ে গেল। একটা বিশাল চেহারার লোক পড়ে আছে জলায়।

পঞ্চানন্দ টর্চটা নিবিয়ে নিচু হয়ে পরীক্ষা করে দেখল। না, মরেনি, নাড়ি চলছে, শ্বাস বইছে।

পঞ্চানন্দ চারদিকটা আবার ভাল করে দেখে নিয়ে হাতের আড়াল করে টর্চটা লোকটার মুখে ফেলল।

মুখটা খুব চেনা-চেনা ঠেকছে। অথচ কিছুক্ষণ চিনতে পারল না পঞ্চানন্দ।

দ্বিতীয়বার টর্চ জ্বালাতেই সন্দেহ কেটে গেল।

লোকটা গজ-পালোয়ান।

নামে আর কাজে পালোয়ান হলেও গজ’র কখনও এমন হাতির মতো চেহারা ছিল না। বরাবরই সে পাতলা ছিপছিপে। ছিপছিপে শরীরটা ছিল ইস্পাতের মতো শক্ত আর পোক্ত।

কিন্তু এই গজ-পালোয়ান গামার চেয়েও বিশাল। দুটো হাত মুগুরের মতো, ছাতি বোধহয় আশি ইঞ্চির কাছাকাছি। ঘাড়ে-গর্দানে এক দানবের আকৃতি।

পঞ্চানন্দ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল। গজ’র এরকম পরিবর্তন হল কী করে। মাত্র দুদিন আগেই গজকে শিবুবাবুর ল্যাবরেটরিতে দেখেছে সে। মাত্র দু’দিনে কারও এরকম বিশাল চেহারা হয়!

২৫.

আকাশ থেকে একটা অদ্ভুত বস্তু নেমে আসার দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল ঘড়ি। আসলে সে এ-বাড়িতে পঞ্চানন্দ নামে উটকো যে-লোকটা এসে জুটেছে তার। ওপর নজর রাখবার জন্যই রাতে জেগে অপেক্ষা করছিল। ঘড়ির দৃঢ় বিশ্বাস। তার ভালমানুষ এবং কবি-বাবাকে জপিয়ে হাত করে এ-লোকটা একটা বড় রকমের দাঁও মারার মতলবে আছে। লোকটা যে বিশেষ সুবিধের নয়, তা এক নজরেই বোঝা যায়। কিন্তু ঘড়ির বাবা হরিবাবু বড়ই সরল সোজা এবং আপনভোলা মানুষ। কে খারাপ আর কে ভাল তা বিচার করার মতো চোখই। তার নেই। তাই সে-ভার ঘড়ি নিজে থেকেই নিল। চোর-জোচ্চোররা রাতের বেলাতেই সজাগ হয় এবং তাদের কাজকর্ম শুরু করে। ঘড়িও তাই গভীর রাতেই লোকটাকে হাতেনাতে ধরে ফেলার মতলবে ছিল।

যা ভেবেছিল হয়েও যাচ্ছিল তাই। নিশুত রাতে পঞ্চানন্দ বেরোল জরিবাবুর ঘর থেকে। নিঃশব্দ, চোরের মতোই হাবভাব। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ঘড়ি খুব তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করছিল। কিন্তু লোকটাকে যে গিয়ে জাপটে ধরবে তার উপায় নেই। কারণ হরিবাবু রাত জেগে কবিতার পর কবিতা লিখে চলেছেন। শোরগোল হলেই উঠে এসে বকাবকি করবেন। ঘড়ি তাই লোকটাকে শুধু নজরে রাখছিল।

তবে লোকটা বিশেষ গণ্ডগোল পাকাল না। শুধু চারিদিকটায় ঘুরে-ঘুরে কী একটু দেখে নিয়ে বেড়ালের মতো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেল। ছাদে গিয়েই লোকটাকে ধরার সুবিধে হবে ভেবে যেই না ঘড়ি সিঁড়ির কাছে গেছে, অমনি হরিবাবু তার ঘর থেকে ‘উঃ আঃ শব্দ করতে করতে বেরিয়ে এসে ছাপানে চললেন। ঘড়িকে কাজেই ক্ষ্যামা দিতে হল।

নিজের ঘরে এসে জানালা খুলে যখন ঘড়ি ছাদের পরিস্থিতিটা উৎকর্ণ হয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল, তখনই সে আকাশের অদ্ভুত বস্তুটা দেখতে পায়। অনেকটা পটলের আকৃতি, নীলাভ উজ্জ্বল একটা জিনিস ধীরে-ধীরে নেমে আসছে।

তখন ঘড়ি তার ঘুমকাতুরে ভাই আংটিকে ডেকে বলল, “এই ওঠ, দ্যাখ কী কাণ্ড হচ্ছে।”

আংটি উঠে জিনিসটা দেখল এবং রুদ্ধশ্বাসে বলল, “উফো, আনআয়ডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট।”

অপলক চোখে দুই ভাই জিনিসটা লক্ষ্য করতে লাগল। কিন্তু হঠাৎই আলো নিবে গিয়ে বস্তুটা অন্ধকার হয়ে গেল। আর দেখা গেল না।

ডাকাবুকো বলে দুই ভাইয়েরই খ্যাতি আছে। তারা সহজে ভয় খায় না। দুনিয়ায় তাদের যত ভয় বাবাকে। অথচ হরিবাবুর মতো নিরীহ আনমনা ভালমানুষ লোক হয় না। ছেলেদের গায়ে তিনি কখনও হাত তোলেননি। বকাঝকাও করেন না বড় একটা। তবু দুই ডানপিটে ভাই ওই একজনকে যমের মতো ডরায়। আর কাউকে বা কিছুতেই তারা ভয় পায় না। উড়ন্ত-চাকিকেই বা পাবে কেন?

দুই ভাই চটপট শীতের পোশাক পরে নিল। মাথায় বাঁদুরে টুপি আর হাতে দস্তানা পরতেও ভুলল না। অস্ত্র বলতে ঘড়ির একটা স্কাউট ছুরি আর আংটির চমৎকার একটা গুলতি। আর সম্বল গায়ের জোর এবং মগজের বুদ্ধি।

এ শহরের সবরকম শর্টকাট তাদের জানা। কাজেই গজ-পালোয়ানের আস্তানায় পৌঁছুতে দেরি হল না।

চক-সাহেবের বাড়ির পর বিশাল জলা। তার ওপাশে পুঁতেবন। আর আছে বিখ্যাত সেই রাজবাড়ির ঢিবি। জায়গাটা বেশ গোলমেলে। অজস্র ঝোঁপঝাড় আর জলকাদায় দুর্গম। তবে ঘড়ি আর আংটি এ জায়গা নিজেদের হাতের তেলোর মতোই চেনে।

ঘড়ি চারদিকে চেয়ে বলল, “আমার যতদূর মনে হয় উফোঁটা জলার ওপাশে ছুঁতেবনের দিকে কোথাও নেমেছে।”

আংটি গম্ভীর মুখে বলল, “হু, কিন্তু জলা পার হবি কী করে?”

আসলে আংটি একটু শীতকাতুরে।

ঘড়ি গম্ভীর মুখে বলল, “জলা পার হতে হলে জলে নামতে হবে।”

“ও বাবা, আমি বরং এদিকটায় পাহারা দিই, তুই এগিয়ে দেখে আয়।”

ঘড়ি কিন্তু এই প্রস্তাবে আপত্তি করল না। পকেট থেকে ছোট্ট একটা টর্চ বের করে চারদিকটা দেখে নিয়ে বলল, “চক সাহেবের বাড়িতে একটু আগে একটা আলো দেখেছি। যতদূর জানি, গজ-পালোয়ান এখন ও-বাড়িতে নেই। কিন্তু আলো যখন দেখা গেছে, তখন কেউ না কেউ আছে ঠিকই। তুই চারদিকে নজর রাখিস। বিশেষ করে চক-সাহেবের বাড়ির দিকটায়। আমি জলার ওদিকটা দেখে আসছি।”

আংটি ঘাড় নাড়ল প্রকাণ্ড একটা হাই তুলতে তুলতে। তারপর বলল, “আমি বরং চক-সাহেবের বাড়িতেই গিয়ে ঢুকে পড়ি। গজদার বিছানাটা পড়ে আছে, একটু গড়িয়ে নিইগে। তুই ফিরে এসে আমাকে ডেকে নিস।”

.

ঘড়ি তার প্যান্টের পা গুটিয়ে জুতোসুদু জলে নেমে পড়ল।

অন্ধকার জলের মধ্যে ঘড়ি মিলিয়ে যাওয়ার পর আংটি আর-একটা বিকট হাই তুলল। ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে। কৌতূহল তার যতই হোক শীত আর রাতজাগা সে একদম সইতে পারে না।

চক-সাহেবের বাড়ি বেশি দূর নয়। আংটি চারদিকটা লক্ষ্য করতে করতে গিয়ে বাড়িটায় ঢুকে পড়ল। ঘড়ি বলল আলো জ্বলতে দেখেছে, কিন্তু আংটি কোথাও কোনও আলোর চিহ্ন পেল না। তবু সাবধানের মার নেই। সে চার দিকটা ঘুরে ঘুরে দেখে নিল। না, কোথাও কেউ নেই। গজ-পালোয়ানের ঘরে ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে দেখল, চৌকির ওপর বিছানা পাতাই রয়েছে। সামান্য কিছু জিনিসপত্র যেমন-কে তেমন পড়ে আছে।

আংটি আর একটা হাই তুলে বিছানার চাঁদরটা তুলে ভাল করে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। গায়ে গরমজামা থাকায় তেমন শীত করল না। ঘুমও এসে গেল টপ করে।

গাঢ় ঘুমের সময় মানুষের শাস যেমন ঘন-ঘন পড়ে, সেরকমই শ্বাস পড়তে লাগল আংটির। মৃদু-মৃদু নাকও ডাকছিল তার।

মিনিট পনেরো কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ খুব ধীরে ধীরে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। নিঃশব্দে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল দরজায়।

জলা পার হতে ঘডির বিশেষ সময় লাগল না। জল থেকে ডাঙায় উঠে সে টর্চ জ্বেলে পায়ে জোঁক লেগেছে কি না দেখে নিল। তারপর রাজবাড়ির ঢিবির নীচে উঁচু জমিতে উঠে জুতো খুলে মোজাটা নিংড়ে নিয়ে ফের পরল।

তুঁতেবন এখনও বেশ খানিকটা দূরে। ঘড়ি উঠল। উঠতে গিয়েই হঠাৎ তার। নজরে পড়ল ঢিবিটার গায়ে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে বেশ বড় একটা গর্ত। এরকম গর্ত থাকার কথা নয়। আর আশ্চর্যের কথা, গর্তের ভিতর থেকে একটা আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

ঘড়ি ভারি অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ তার মনে হল, মহাকাশযানটা ওই ঢিবির মধ্যে গিয়ে সেঁধোয়নি তো!

ঘড়ি ধীরে ধীরে ঢিবির ঢাল বেয়ে গর্তটার মুখ-বরাবর চলে এল। ভয় যে করছিল না তা নয়। কিন্তু কৌতূহলটাই অনেক বেশি জোরালো।

ঢিবির মুখে এসে সাবধানে উঁকি দিয়ে ভিতরে যা দেখল, তাতে বেশ অবাক হয়ে গেল সে। দিব্যি আলোকিত সুড়ঙ্গ। ভিতরটা বেশ পরিষ্কার।

যেন চুম্বকের টানে সম্মোহিতের মতো ঘড়ি ভিতরে ঢুকল। চারদিকে চেয়ে সে বুঝল, ঢিবিটা সম্পর্কে যে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, তা মোটেই মিথ্যে নয়। বাস্তবিকই এখানে কোনওদিন একটা প্রাসাদ ছিল।

কিন্তু তার চেয়েও যেটা বিস্ময়কর, তা হল, সুড়ঙ্গটাকে কে বা কারা খুব যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করেছে। ভিতরে খুঁড়ে খুঁড়ে ছোট বড় নানা রকম কুঠুরি বানিয়েছে। সব কুঠুরিরই দরজা বন্ধ। সুড়ঙ্গের ছাদে লাগানো আলোগুলো দেখে ঘড়ি হাঁ হয়ে গেল। ইলেকট্রিক লাইট নয়, স্রেফ এক-একটা উজ্জ্বল পাথর।

খানিক দূর হেঁটে গিয়ে সে দেখতে পেল, সুড়ঙ্গটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। ঘড়ি এগোতে লাগল। প্রতি মুহূর্তেই ভয় হচ্ছে, কেউ এসে পথে আটকাবে বা আক্রমণ করবে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না।

.

ঘড়ি এসে থামল। প্রকাণ্ড দরবার-ঘরে। চারদিকে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি। কিন্তু কোনও মানুষজন নেই।

ঘড়ি যখন চারদিকে চেয়ে দেখছিল তখন হঠাৎ পায়ের কাছে একটা হঁদুরকলের মতো ছোট্ট বাক্স নজরে পড়ল তার। এমনিতে পড়ত না, কিন্তু বাক্সের ডালাটা আপনা থেকেই খুলে যাচ্ছিল বলে তার চোখ আটকে গেল।

বাক্সের ভিতর থেকে একটা সবুজ কাঁকড়াবিছে বেরিয়ে এল।

ঘড়ি কাঁকড়াবিছে ভালই চেনে। অনেকবার ধরে সুতোয় বেঁধে খেলা করেছে। এক-আধবার হুলও খেয়েছে। কাজেই সে বিশেষ ভয় পেল না। ফট করে এক পা পিছিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখল।

কাঁকড়াবিছে সবুজ রঙের হয় কি না তার জানা নেই। তবে সে কখনও। দ্যাখেনি।

বিছেটা তাকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে, এটা বুঝতে বিশেষ বেগ পেতে হল না ঘড়ির। বাক্সের ডালা আপনা থেকেই খুলে যাওয়া এবং আশ্চর্য সবুজ রঙের বিছের আবির্ভাবের পিছনে যে রহস্য আছে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়, এখন ঘড়ির নেই। আপাতত প্রয়োজন আত্মরক্ষা।

ঘড়ি বিছেটার সামনে জুতোসুষ্ঠু পা এগিয়ে দিয়ে নিচু হয়ে হুলের গুঁড়টা দু’ আঙুলে চেপে ধরে বিছেটাকে তুলে নিল। এই অবস্থায় বিছে খুবই অসহায়।

হুলটা সাবধানে ধরে রেখে বিছেটাকে কাছ থেকে যখন দেখল ঘড়ি, তখন সে স্পষ্টই বুঝতে পারল, এটা আসল কাঁকড়াবিছে মোটেই নয়। বিছেটার শরীর ধাতু দিয়ে তৈরি। ভিতরে স্প্রিং আছে, তার জোরে বিছের পা নড়ে। মুখের কাছে একটা লম্বা দাঁড়া রয়েছে যা অনেকটা সূক্ষ্ম টেলিস্কোপিক অ্যান্টোনার মতো।

হুলটা ভাল করে লক্ষ্য করল ঘড়ি। যা দেখল, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। হুলের বদলে যেটা বারবার বেরিয়ে আসছে, তা স্টেনলেস স্টিলের তৈরি একটা ফাঁপা উঁচ। অনেকটা ইনজেকশন দেওয়ার ছুঁচের মতোই।

ঘড়ি তার রুমালটা বের করে ছুঁচের মুখে ধরতেই সেটা বিঁধে গেল রুমালে আর কয়েক ফোঁটা ভারি সুগন্ধি তরল বস্তু বেরিয়ে এল ছুঁচ থেকে।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়